০৫. খবরের কাগজ বা চলতি রাজনৈতিক ডিক্সনারী

খবরের কাগজ বা চলতি রাজনৈতিক ডিক্সনারীর ভাষায় বিগ পাওয়ারের ব্যাপারই আলাদা। ওখানে যে কি হয়, আর কি হয় না, তা স্বয়ং অলমাইটি গডও জানেন না। অনেকটা মধ্যযুগীয় হারেমের মতো আর কি! কিছু বোঝা যায়, কিছু দেখা যায়, কিছু শোনা যায়, কিছু অনুমান করা যায়। তবুও সব কিছু জানা অসম্ভব। ওদের ওখানে কে সত্যিকার ডিপ্লোম্যাট বা প্রেস অফিসার বা গোয়েন্দা বিভাগের লোক, তা স্বয়ং অ্যাম্বাসেডরের অন্তর্যামীও জানেন না।

বিগ পাওয়ারের অ্যাম্বাসেডরদের অবস্থা অনেকটা বড় বড় কোম্পানির পাবলিক রিলেশান্স ম্যানেজারের মতো। কোম্পানির পরিচালনা বা অর্থকরী ব্যাপারে বা গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ক্ষেত্রে পাবলিক রিলেশান্স ম্যানেজারের কোনো ভূমিকা নেই কিন্তু প্রচার বেশি। অ্যাম্বাসেডর বক্তৃতা দেবেন, ছবি ছাপা হবে, এম্বাসীর সবাই তাকে মান্যগণ্য করবে, কিন্তু রাজনৈতিক চাবিকাঠি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্যের কাছে থাকে।

ভাগ্যবান ডিপ্লোম্যাটেরও অভিভাবক থাকবেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু বিগ পাওয়ারের ডিপ্লোম্যাটদের প্রায় ছায়ার মতো অনুসরণ করে ওদেরই সহকর্মী-গোয়েন্দা। আবার এই গোয়েন্দাদের নজর রাখার জন্যও আছে ব্যাপক ব্যবস্থা-কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স!

বিগ পাওয়ারের চালেরীগুলো যেন এক-একটি সতীনের সংসার! কেউ কাউকে বিশ্বাস করে কেউ কাউকে ছাড়তেও পারে না। তাই তো সবার মনেই সন্দেহ আর অশান্তি।

ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসে ওসব বালাই নেই। বিগ পাওয়ারের লুকোচুরি খেলার প্রয়োজন আছে। লুকিয়ে লুকিয়ে এদের দেশে কত কি হচ্ছে। বিপরীত পক্ষের সেসব গোপন খবর জানার জন্য ওরা হরির লুঠের বাতাসার মতো শত-শত সহস্র-সহস্র কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করতে দ্বিধা করে না আমাদের দেশের মানুষকে খেতে-পরতে দেওয়ারই পয়সা নেই; সুতরাং লুকিয়ে লুকিয়ে অপরের সর্বনাশ করার জন্য অর্থ ব্যয় করা অসম্ভব। আমাদের চান্সেরীগুলো সতীনের সংসার নর। কিছু কিছু অহঙ্কারি বা দায়িত্বজ্ঞানহীন লোক থাকলেও অবিশ্বাসের অন্ধকার নেই কোথাও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইন্ডিয়ান ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের সবাই এক বৃহত্তর পরিবারের মতো বসবাস করেন। ভাগাভাগি করে নেন নিজেদের সুখ-দুঃখ।

ফরেন সার্ভিসে ঢুকে প্রথম ফরেন পোস্টিং পাবার পরই দয়ালের বিয়ে হলো। বিয়ের পর মৃণালিনীকে নিয়ে যখন বন-এ ফিরল, তখন কি কাণ্ডটাই না হলো।…

…কর্মচঞ্চল ফ্রাঙ্কফার্ট এয়ারপোর্টের চির কর্মব্যস্ত কর্মচারীরাও থমকে দাঁড়ালেন : শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে মেয়ের দল সারি বেঁধে লাইন করে দাঁড়ালেন। কারু হাতে শাঁখ, কারুর হাতে বরণডালা। মাস্টার অফ সেরিমনিজ শ্রীবাস্তব কোনো ত্রুটি করেনি। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছিল টার্মিনাল বিল্ডিং-এর বাইরে, ল্যান্ডিং গ্রাউন্ডের কাছে এই অনন্য অভ্যর্থনা জানাবার। টেলিভিশন কোম্পানিতে খবর দিয়েছিল, ট্রাডিশনাল ইন্ডিয়ান ওয়েলকাম সেরিমনি টেক করে টেলিকাস্ট করার জন্য।

এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনটা এসে থামতেই মাস্টার অফ সেরিমনিজ ইঙ্গিত করল। জন-পঞ্চাশেক ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট সঙ্গে সঙ্গে হাতে তালি দিতে দিতে গাইতে শুরু করল রাজস্থানী ফোক সঙ! এসো রাজপুত্র, এসো রাজকন্যা, নতুন জীবনের পরিপূর্ণ সুরাপাত্র পান কর। প্লেনের দরজা খুলতেই শুরু হলো শঙ্খধ্বনি। দয়াল আর মৃণালিনী মুগ্ধ হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল দরজার মুখে। নিচে নেমে আসতেই মেয়েরা বরণ করল নববধুকে! ধুতি-পাঞ্জাবি শেরওয়ানী-চাপকান পরে পুরুষের দল মালা পরালেন দয়ালকে, মৃণালিনীর হাতে তুলে দিলেন ফুলের তোড়া।

অ্যাম্বাসেডর আসেননি ইচ্ছা করেই। তাই স্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন, যাও, যাও, তুমি যাও। আমার সামনে হয়তো ওরা ঠিক সহজ হয়ে হৈ-হুঁল্লোড় করতে পারবে না।

মাস্টার অফ সেরিমনিজ সব অনুষ্ঠান শেষে এগিয়ে নিয়ে গেলেন অ্যাম্বাসেডর-পত্নীকে। সন্তানতুল্য দয়ালকে আশীর্বাদ করলেন, নব-বধূর সিঁথিতে পরিয়ে দিলেন সিঁদুর।

সন্ধ্যায় জার্মান টেলিভিশনে এয়ারপোর্টের এই অনুষ্ঠান টেলিকাস্ট করা হলো। রাতারাতি দয়াল ও মৃণালিনী বিখ্যাত হয়ে গেল! বন-এ দয়াল মৃণালিনীকে নিয়ে কতদিন ধরে চলল আনন্দোৎসব।

সেদিন বন ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসীর যাঁরা দয়াল মৃণালিনীকে নিয়ে এই আনন্দোৎসব করেছিলেন, তারা ছড়িয়ে পড়েছেন সারা দুনিয়ায়। কেউ অস্ট্রেলিয়া, কেউ ভিয়েত্সাম, কেউ ওয়াশিংটন, কেউ মস্কো। কত কি হয়ে গেছে এর মধ্যে। কত উত্থান কত পতন। তবুও কেউ ভুলতে পারেননি দয়াল আর মৃণালিনীর কথা। যে মৃণালিনীকে নিয়ে ওঁরা এত আনন্দ করেছিলেন, সে মা হতে পারল না জেনে সবাই দুঃখিত, মর্মাহত। পর পর তিন তিনটি সন্তান নষ্ট হলো মৃণালিনীর। একটা ফুটফুটে সুন্দর শিশু দেখলে কাঙালিনীর মতো ছুটে যায় মৃণালিনী। চান্সেরীর বন্ধু-বান্ধবদের বাচ্চাদের নিয়েই আজ সে দিন কাটায়।

তরুণ দুঃখ পায় মৃণালিনীকে দেখে, সান্ত্বনা পায় দুঃখের এতগুলো অংশীদার দেখে।

মৃণালিনী তরুণকে বলত, জানেন ভাই, প্রথম প্রথম নিজেকে সামলাতে পারতাম না। একলা থাকলেই চুপচাপ বসে বসে চোখের জল ফেলতাম। পার্টিতে রিসেপশনে ককটেল-এ গিয়েছি কিন্তু মুহূর্তের জন্য মনে শান্তি পাইনি। কিন্তু আজ?

বন্ধুপত্নীকে আর বলতে হয় না। বাকিটুকু তরুণ জানে। জানে নায়েক, বঙ্গস্বামী, চ্যাটার্জী, শ্রীবাস্তবের ছেলেমেয়েরাই ওর সারা জীবন জুড়ে রয়েছে। অস্ট্রিয়ায় থাকবার সময় মিসেস শ্রীবাস্তব অসুস্থ হলে দুটি বাচ্চাই তো মৃণালিনীর কাছে থেকেছে। ছোট বাচ্চাটা তো নিজের বাপ-মার কাছে যেতেই চায় না। দয়াল যেখানেই বদলি হোক না কেন, মৃণালিনীর একটা সংসার সেখানে আছে।

আচ্ছা দাদা, তোমার বাচ্চা হলে আমার কাছে রাখবে তো? মৃণালিনী সত্যি সত্যি জানতে চায় তরুণের কাছে।

তরুণ মুচকি হাসে।

হাসছ কেন দাদা?

হাসব না? একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। একটু পরে, একটু যেন তলিয়ে যায়। বলে, ওসব কথা আজ ভাবি না, ভাবতে পারি না, ভাবতে চাই না।

সত্যিই কি সেসব ভাবে না তরুণ? লুকিয়ে লুকিয়ে চুরি করে নিঃসঙ্গ তরুণ নিশ্চয়ই সে স্বপ্ন দেখে। কত কি ইচ্ছে করে, কত কি মনে পড়ে তার।

জান মা, কলেজের একজন লেকচারার আমার হাত দেখে কি বললেন?

কি বললেন?

বললেন আমার নাকি অনেক দেরিতে বিয়ে। তরুণ মুচকি হাসে।

বাপ-বেটায় বেরিয়ে যাবে আর আমি একলা একলা এই ভূতের বাড়ি পাহারা দেব তাই? মা বেশ রাগ করেই বলেন।

রাগ করবেন না? উনি যে বরাবর স্বপ্ন দেখছেন বি-এ পাস করার পরই ছেলের বিয়ে দেবেন, ইন্দ্রাণীর মতো একটা বউ আনবেন ঘরে। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে কতদিন ইন্দ্রাণীকে বলেছেন, দশটা নয়, পাঁচটা নয়, একটা মাত্র ছেলে আমার। খুব ইচ্ছা করে ছেলে-বউয়ের সঙ্গে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই। ঢাকায় যেন আর টেকে না।

কেন মাসিমা, আমরা তো আছি, হাসি হাসি মুখে ইন্দ্রাণী বলে।

তোকে কি আর আমার কাছে চিরকাল ধরে রাখতে পারব মা? কত বড় ঘরে তোর বিয়ে হবে, কোথায় চলে যাবি তার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে? কথাগুলো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা ছোট্ট নিঃশ্বাসও পড়ে।

পরে ইন্দ্রাণী তরুণকে বলেছিল, জান মাসিমা কি বলছিলেন?

কি?

বলছিলেন আমার কত বড় ঘরে বিয়ে হবে, আমি নাকি কোথায় চলে যাব।

বইটা উল্টে রেখে তাচ্ছিল্য ভরে তরুণ জবাব দেয়, ডাকাতদের মতো কোকড়া চুল-ওয়ালা মেয়েকে রমনার কোচোয়ানরা ছাড়া আর কেউ বিয়ে করলে তো?

চোখ দুটো ঘুরিয়ে ইন্দ্রাণী জবাব দেয়, তুমি বুঝি এবার পরীক্ষার পর কোচোয়ানগিরি শুরু করবে?

তরুণ হাসতে হাসতে নিজের হার স্বীকার করে।

এই বুদ্ধি নিয়ে তোমার কোন চুলোয় জায়গা হবে, তাই ভাবি। আমি না থাকলে যে তোমার কি দুর্গতিই হবে?

শৈশব থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে এখন যৌবনের প্রতিটি দিন পাশে পাশে পেয়েছে ইন্দ্রাণীকে, সাহায্য নিয়েছে প্রতি পদক্ষেপে।

সেদিনের ঢাকা হারিয়ে গেছে তরুণের জীবন থেকে, কিন্তু দূরে সরে যায়নি ইন্দ্রাণীর স্মৃতি। ডিপ্লোম্যাট তরুণ সেনগুপ্ত কত মেয়ের সান্নিধ্য পেয়েছে, কিন্তু ইন্দ্রাণীর স্মৃতি চাপা দিতে পারেনি কেউ। বিধাতাপুরুষের নির্দেশে সে যেন আজও তারই পথ চেয়ে বসে আছে। বন্ধু-বান্ধব। সহকর্মীদের হাসিখুশিভরা সংসার দেখে তাদের ছেলেমেয়েকে আদর করে, ভালোবাসে। কত আনন্দ পায়। দিনের শেষে যখন নিজের শূন্য ফ্ল্যাটে ফিরে আসে, তখন পিকাডেলি সার্কাস-টাইমস স্কোয়ার-গিঞ্জার সব নিওন লাইটগুলো একসঙ্গে জ্বলে উঠলেও তরুণের অন্ধকার মনে একটুও আলোর ইসারা দিতে পারে না। ইন্দ্ৰ-পত্নী ইন্দ্রাণীর মতো হয়তো তার ইন্দ্রাণী সুন্দরী ছিল না। সত্য, কিন্তু সে ছিল অপরূপা, অনন্যা। কিশোরী ইন্দ্রাণী যখন ম্যাট্রিক পাস করে ইডেন কলেজে ভর্তি হলো, শাড়ি পরতে শুরু করল, তখন যেন রাতারাতি ওর দেহে বন্যা এলো। চোখের নিমেষে যেমন পদ্মর ভাবান্তর হয়, ইন্দ্রাণীর সর্বাঙ্গে তেমন ভাবান্তর দেখা দিল। মেঘ দেখলেই যেমন মেঘনার জল নাচতে থাকে তেমনি তার অতদিনের অত পরিচিতা মেয়েটাকে দেখেও তরুণের মনে দোলা দিতে শুরু করল।

শীতের সন্ধ্যায় ভিক্টোরিয়া এমব্যাঙ্কমেন্ট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তরুণ একটু দাঁড়ায়। ফেন্সিং-এ ভর দিয়ে টেমস-এর দিকে তাকায়। চারিদিকে কুয়াশা যেন তরুণকেও গ্রাস করে।-এই কবছর ইন্দ্রাণী নিশ্চয়ই আরো পূর্ণ, পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, ওর ওই স্বচ্ছ কালো চোখের বিদ্যুৎ আরো উজ্জ্বল আরো স্পষ্ট হয়েছে। ওর ওই ঘন কালো কেঁকড়া কোঁকড়া চুলগুলো কোনোদিনই শাসন মানত না। যে একগোছা চুল সব সময় কপালের ওপর উড়ে বেড়াত, সেগুলো তো এতদিনে আরো সুন্দর, আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

ঘন কুয়াশা পাতলা হলো। ও-পারের রয়্যাল ফেস্টিভ্যাল হলের আলো যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তরুণের মনের স্বপ্নময় কুয়াশাও কেটে যায়, ফিরে আসে রূঢ় বাস্তবে, নির্মম ইন্দ্রাণী-বিহীন নিঃসঙ্গ জীবনে।

মনটা কদিন ধরেই ভালো না। ডেপুটি হাই-কমিশনারের সঙ্গে কাজ করতে একটুও ইচ্ছা করে না। বুড়ো-হাবড়া হাই-কমিশনার দেশসেবার বিনিময়ে কেনসিংটনের ওই বিরাট প্রাসাদ ও রোলস রয়েস ভোগ করছেন। কিছু কাগজপত্র সই করতে হয় বটে, তবে বিন্দুমাত্র দায়িত্ব-কর্তব্যের বালাই নেই। ডেপুটি হাই-কমিশনারই সর্বময় কর্তা।

ডেপুটি হাই-কমিশনার মিঃ ব্যাস নিঃসন্দেহে একজন উঁচুদরের কূটনীতিবিদ। বেনিয়া ইংরেজ পর্যন্ত দর কষাকষিতে মাঝে মাঝে হার মানতে বাধ্য হয়। এর আগে উনি যখন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন তখন ভারতীয় ইমিগ্রান্টদের নিয়ে এক মহা হৈ-চৈ পড়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার কিছু সংবাদপত্র। ও রাজনীতিবিদ এমন হাহাকার করে উঠলেন যেন কয়েকজন ব্ল্যাক ইন্ডিয়ানকে অস্ট্রেলিয়ায় পাকাঁপাকি ভাবে থাকার অনুমতি দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে। মিঃ ব্যাস তখন কানে কানে ফিসফিস করে ওঁদের বলেছিলেন, কিছু মধ্যযুগীয় অধিবাসী ছাড়া অস্ট্রেলিয়ান বলে কোনো। জাত নেই। তোমরা সবাই একদিন ইমিগ্রান্ট হয়েই এ দেশে এসেছিলে। সুতরাং ইন্ডিয়ানদের এত ঘেন্না করছ কেন?

এই ছোট্ট একটা চিমটি কাটাতেই অস্ট্রেলিয়ার ওই সংবাদপত্র ও রাজনীতিবিদরা হুঁশ ফিরে পেয়েছিলেন এবং কাজ হয়েছিল।

কূটনীতিবিদ ব্যাস সাহেবের নিন্দা তার চরম শত্রুরাও করবে না। তবে সন্ধ্যার পর বা কাজ কর্মের অবসরে সুন্দরী-সান্নিধ্য পেলে ভুলে যান বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়। হাজার হোক সাবেকী মানুষ! শিকার করেন শুধু ভারতীয়।…

এডিনবরা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য ভারতবর্ষ থেকে একদল শিল্পী এলেন লন্ডনে। কলকাতার মিস বলাকা রায় ও বোম্বের সুজাতাও এলেন। ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ ওঁদের থাকার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মিঃ ব্যাস গম্ভীরভাবে জানিয়ে দিলেন, ডোন্ট বার অ্যাবাউট আওয়ার আর্টিস্টস। আমাদের আর্টিস্টদের থাকার ব্যবস্থা আমরাই করব।

ব্যাস সাহেব আর্টিস্টদের জানিয়ে দিলেন, ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করলেই বড় বড় হোটেলে থাকতে হবে ও তার ফলে আপনাদের সীমিত ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে বিপদে পড়বেন। তাই আমরাই ব্যবস্থা করছি।

কলকাতা থেকে মিস রায় লিখলেন, মেনি মেনি থ্যাঙ্কস। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না। ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষ ইনভিটেশন পাঠিয়েছেন বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মাত্র ২৭ পাউন্ড ফরেন এক্সচেঞ্জ মঞ্জুর করেছে। দশ দিনের জন্য সাতাশ পাউন্ড! ভাবলেও মাথা ঘুরে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম এসকর্ট হিসেবে ছোট ভাইকে সঙ্গে নেব, কিন্তু এই ফরেন এক্সচেঞ্জ…।

শেষে লিখলেন, আপনার ভরসাতেই আসছি। দয়া করে দেখবেন। এয়ারপোর্টে যদি কাউকে পাঠান তবে বিশেষ কৃতজ্ঞ হবো।

ব্যাস সাহেব মনে মনে হাসলেন। উত্তর দিলেন পরদিনই, কিছু ঘাবড়াবেন না মিস রায়। আপনাদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য। সব ব্যবস্থা ঠিক থাকবে। যদি কাইন্ডলি একুশে বি-ও-এ-সি ফ্লাইট থ্রি-সিক্স-ওয়ানে আসেন, তবে বড় ভালো হয়।

ডেপুটি হাই-কমিশনার সাহেব এমনভাবে প্রোগ্রাম ঠিক করলেন যে, দুজন আর্টিস্ট একসঙ্গে এলেন না। তাছাড়া এক একজনকে এক-একটা হোটেলে ব্যবস্থা করলেন। কার্লটন টাওয়ারে সুজাতা, স্ট্রান্ড প্যালেসে মিস রায়। বোম্বের উঠতি নায়ক প্রেমকুমার? কেনসিনটন প্যালেসে।

সবাইকে এক কৈফিয়ত, লন্ডনে এখন পুরোপুরি টুরিস্ট সীজন ট্রান্স-অ্যাটলান্টিক চাটার্ড ফ্লাইটে রোজ কয়েক হাজার আমেরিকান আর কানাডিয়ান আসছে। কিভাবে যে আমরা হোটেলে রিজার্ভেশন পেয়েছি, তা ভাবলেও অবাক লাগে।

সুজাতা দেবী বছর তিনেক আগে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল দেখে দেশে ফেরার পথে মাত্র দুদিনের জন্য লন্ডনে এসেছিলেন শুধু বোম্বের বাজারে নিজের দাম বাড়াবার জন্য। সুতরাং ধরতে গেলে তিনজনেই একেবারে আনকোরা। নিউকামারদের হাত করা খুব সহজ। টালিগঞ্জের ফিল্ম পাড়ায় বা পার্কস্ট্রিটের ওই দু-চারটে রেস্তোরাঁয় চালিয়াতি করা সহজ, কিন্তু লন্ডনের মতো মহা মহানগরে এসে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে রীতিমতো কেরামতি দরকার। অজস্র অর্থ থাকলে তবু সম্ভব, কিন্তু সাতাশ পাউন্ড ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে?

হিথরো এয়ারপোর্টে মিঃ ব্যাস ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, মিস রয়। দিজ ইজ ব্যাস।

গুড আফটারনুন! গুড আফটারনুন! আপনি নিজে কষ্ট করে এয়ারপোর্টে এসেছেন?

কেবিন-ব্যাগ হ্যাঁন্ডব্যাগ ঠিক করে ধরতে ধরতে বললেন, ছি ছি, আমাদের জন্য আপনাকে কি দুর্ভোগই না সহ্য করতে হলো।

ব্যাস সাহেব মনে মনে ভাবলেন, আসব না সুন্দরী! তোমার মতো সুন্দরী অথচ ইগনোরেন্ট গেস্টদের শিকার করবার জন্য রোজ এয়ারপোর্টে আসতে রাজি আছি।

নিজের অজ্ঞাতেই ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা ফুটে উঠল। হাজার হোক আপনি একজন সেলিব্রেটেড আর্টিস্ট। আপনাদের সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য।

নিজের গাড়িতে নিজে ড্রাইভ করে মিস রায়কে নিয়ে গেলেন স্ট্রান্ড প্যালেস। গাড়ি থেকে নামার আগে মিস রায়ের কোটের দুটো বোম আটকে দিয়ে উপদেশ দিলেন, বোতামগুলো ভালো-করে আটকে নিন। হঠাৎ কখন ঠাণ্ডা লেগে যাবে, তা টেরও পাবেন না।

ফিল্ম স্টার হলেও বাঙালি মেয়ে তো! ব্যাস সাহেব অত আপন জ্ঞানে কোটের বোম লাগাবার সময় বলাকা রায় একটু অস্বস্তি বোধ করেছিল। কিন্তু একে লন্ডন, তারপর এমন। পরম হিতাকাক্ষী; তাই আপত্তি করা তো দূরের কথা, হাসিমুখেই ধন্যবাদ জানিয়েছিল। তাছাড়া সিনেমা-অ্যাকট্রেস হয়েও কলকাতা শহরে ঠিক সামাজিক স্বীকৃতি বা মর্যাদা পান না মিস রায়। একটু হাসি, একটু কথা, একটু মেলামেশা অনেকেই পছন্দ করেন, কিন্তু স্বীকৃতি-মর্যাদা দিতে ওঁদের বড় কুণ্ঠা। লন্ডনে ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের এমন সহজ সরল মেলামেশা ও সাহায্যে মিস রায় বরং কৃতজ্ঞ হলেন।

একটু জল, একটু সার ছড়ালে ফসল হবেই। জমিটা উর্বর হলে সে ফসল আরো ভালো

এই সামান্য সৌজন্যের সার ছড়িয়েই ব্যাস সাহেব শান্তি পেলেন না। ওয়েস্ট মিনিস্টার, সেন্ট জেমস পার্ক, বাকিংহাম প্যালেস, রিজেন্ট পার্ক, হাইড পার্ক, মার্বেল আর্চ, জুলজিক্যাল গার্ডেন, কেনসিংটন গার্ডেন দেখালেন, বেড়ালেন! তারপর মিস রায় এডিনবরা থেকে ফিরে এলে উদার ডেপুটি হাই-কমিশনার সাহেব তাকে নাইট ক্লাব দেখালেন, উইক-এন্ডে ব্রাইটনের সমুদ্র পাড়েও নিয়ে গেলেন।

মৌমাছি শুধু মধুর জন্যই ফুলের কাছে যায়, ফুলের সৌন্দর্য বা সান্নিধ্য উপভোগের জন্য নয়। ব্যাস সাহেবও ঠিক তাই। নিজের কাজ-কর্ম কাউন্সিলার ও তরুণের উপর চাপিয়ে দিয়ে মিছিমিছি বলাকা রায়ের পিছনে ঘুরে বেড়াননি, একথা হাই-কমিশনের সবাই জানত।

মিসেস ব্যাস তখন ইন্ডিয়ায় থাকায় ব্যাস সাহেবের লীলাখেলা আরো জমেছিল। বলাকাকে বিদায় দেবার পর সুজাতাকে তো নিজের আস্তানাতেই নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর অনারে ডিনার-ককটেল হলো। ডেইলি মীরর-এর ফটোগ্রাফারকে এনে ফিচার ছাপাবার ব্যবস্থাও হলো।

বিদেশ-বিভুইতে বলাকা রায় বা সুজাতার মতো কত কে আসেন। ভারতবর্ষের পরিচিত সমাজ-সংসার থেকে দূরে এসে এঁরা যেন কেমন মুক্ত হন বহুদিনের বহু রীতিনীতি সংস্কার থেকে। কেমন যেন শিথিল হয় সব বন্ধন। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ দেখার আনন্দে মেতে ওঠে বলাকা রায়, সুজাতা ও আরো অনেকে। আর সেই বন্ধনহীন আনন্দের ফাটলের সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে ঢুকে পড়েন ব্যাস সাহেব।

যে তরুণ সারা জীবন ধরে ভালোবেসেছে, স্বপ্ন দেখেছে শুধু ইন্দ্রাণীকে, সে সহ্য করতে পারে না ব্যভিচারী ব্যাসকে। অথচ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত অল্ডউইচের বিরাট হাই-কমিশনে শুধু ওই একটি মানুষকে নিয়েই তার সংসার! কুটনৈতিক দুনিয়ার বিরাট চাকচিক্য-রোশনাইয়ের মধ্যেও তরুণ যেন আলোর নিশানা খুঁজে পায় না। কতদিনের কত স্বপ্নের লন্ডনও যেন ভালো লাগে না তার। এত বড় শহরের এত পরিচিতের মধ্যেও নিঃসঙ্গতার দাহ যেন তাকে আরো পীড়া দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *