০৫. কে যেন এসে খবর দিয়ে গেল

কে যেন এসে খবর দিয়ে গেল মহীতোষ খুব অসুস্থ, বিকেলের দিকে রোজই জ্বর আসছে। জলপাইগুড়ি থেকে স্বৰ্গছেঁড়ায় সরিৎশেখর পোস্টঅফিস মারফত চিঠিপত্র খুব-একটা পাঠাতেন না। চার ঘণ্টার পথ কোনো-কোনো সময় চারদিন নিয়ে নিত ডাকবিভাগ। খেয়েদেয়ে দুপুরনাগাদ কিং সাহেবের ঘাটে গিয়ে দাঁড়ালেই হল, প্রচুর লোক স্বৰ্গছেঁড়া, বীরপাড়া, বানারহাটে যাচ্ছে। তাদেরই কারও হাতে চিঠি দিয়ে দিতেন তিনি, মহীতেগাষ সন্ধেনাগাদ পেয়ে যেতেন। যারা স্বৰ্গছেঁড়ার লোক নন অথচ মহীতোষকে চেনেন তারা যাবার সময় স্বৰ্গছেঁড়ায় চৌমাথার ট্রেলপাম্পে চিঠি রেখে যেতেন। চিঠি দেবার না থাকলেও সরিৎশেখর দুপুরে কিং সাহেবের ঘাটে যেতেন। ওখানে গেলে পুরো ড়ুয়ার্সের হালফিল খবর পাওয়া যায়। কোর্টকাছারি করতে অজস্র মানুষ আসছেন ওদিকে মালবাজার নাগরাকাটা আর এদিকে ফালাকাটা-হাসিমারা থেকে। অনেকেই সরিৎশেখরকে চেনেন, দেখা হলে নমস্কার করে খবরাখবর নেন। তা ছাড়া চিম্বার মাস্টন্টরা তো আছেনই, ওঁদের জলপাইগুড়িতে না এসে উপায় নেই। তা আজ বিকেলে ফেরার সময় এই খবরটা পেলেন। মহীতোষ যে অসুস্থ একথা আগে কেউ বলেনি, কেউ চিঠি লেখেনি। বিকেলে দিকে জ্বর আসছে এটা ভালো কথা নয়। তিস্তার পাশ-ঘেঁষে যে-কাঁচা পথটা দিয়ে রোজ হাঁটচলা করতেন সেটার ওপর মাটি পড়ছে। পি. ডব্লু. ডি. অফিসের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে হল।

অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন সরিৎশেখর। আজকাল লাঠি আর পা কেমন মিলেমিশে পথ মেপে নেয়। লাস্ট বাস বার্নিশ থেকে ছাড়ে বিকেল ছটায়। এখনও ঘণ্টাদেড়েক সময় আছে, অনিকে নিয়ে রওনা হলে রাত নটার মধ্যে স্বৰ্গছেঁড়ায় পৌঁছে যাওয়া যায়। তেমন বোধ করলে মহীতোষকে এখানে নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতে হবে। হঠাৎ তার মনে হল আজ অবধি তাকে শুধুই দায়িত্ব পালন করে যেতে হচ্ছে। চাকরিতে যখন ছিলেন তখন তো বটেই, আজ নিঃসঙ্গ অর্থহীন অবসর-জীবনেও এইসব। সাংসারিক চিন্তা তাকে ভাবতে বাদ্য করে। সব ছেড়েছুড়ে একা একা বেঁচে থাকার সুখ পাওয়া আর হল না। অথচ হেম আজকাল প্রায়ই বলে থাকে যে তিনি নাকি অত্যন্ত নির্দয়, পাষাণ। তার কথাবার্তা অত্যন্ত ঠোঁটকাটা এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া না-ভেবে বলা হেম এসব কথা আগে বলতে সাহস পেত না, ইদানীং বরে থাকে। সরিৎশেখরের মাঝে-মাঝে মনে হয়, মেয়ের মাথাটায় কিছু গোলমাল হয়েছে। কারণ রাতারাতি তার সম্পর্কে যে-ভয়টা সকলে ছিল সেটা হেম খেয়াল কী করে! মাঝেমাঝে এমন উপদেশ দেয় যে বন্ধুর মতো মনে হয়, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে গোরমাল করলে মায়ের মতো ধমকে ওঠে, আবার বাবার সংসারে পড়ে থেকে জীবনটা নষ্ট হল বলে যখন আক্ষেপ করে তখন চট করে বড়বউ-এর কথা মনে পড়ে যায়। এক অত খেলা মেয়ের সঙ্গে, হেমলতাও মৌজ হয়ে। খেলে যায়। অনির সঙ্গে কথাবার্তা কম হয়। পড়াশুনা খারাপ করছে না, করলে রেজাল্ট ভালো হত না। তার কড়া নির্দেশ আছে যেখানেই থাক সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরতে হবে। সকালে অঙ্কের মাস্টার পড়িয়ে যায় অনিকে, মহীতোষ তার টাকা দিচ্ছে। কিন্তু বাজারদর যেভাবে বাড়ছে সংসারের খরচ সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে তার। ফলে হেমলতার জমা-টাকায় হাত দিতে হয়। মনে মনে ভীষণ কুণ্ঠার মধ্যে আছেন।

প্রতিজ্ঞা করেছিলেন স্বৰ্গছেঁড়ায় ফিরে যাবেন না আর। জীবনের সব প্রতিজ্ঞাই কি রাখতে পারা। যায়? দ্রুত পা চালালেন সরিৎশেখর। হাসপাতাল-পাড়া থেকে দুটো সাইকেল-রিকশা রেস দিয়ে আসছিল কোর্টের দিকে। মোড় ঘোরার সময় এ ওকে ডিঙিয়ে যেতে-যেতে পরস্পরকে ছুঁয়ে ফেলতেই ঘটে গেল ব্যাপারটা। সরিৎশেখর দেখলেন রিকশাটা দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছু বোঝার আগেই হাঁটুর ওপর প্রচণ্ড একটা আঘাত তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিল না। প্রায় মুখ-থুবড়ে পড়ে গেলেন সরিৎশেখর। হইহই করে লোকজন ছুটে এল চারধার থেকে। রিকশা রাস্তার একপাশে কাত হয়ে উলটে আছে। রিকশাওয়ালা ছোকরা মাটিতে শুয়ে। ওরা যখন সরিৎশেখরকে তুলে ধরল তখন তার। চোখে অন্ধকার, চশমা নেই, লাঠিটা ছিটকে গেছে হাত থেকে। মাজাভাঙা লাউডগার মতো হিলহিল। করছে শরীর, ছেড়ে দিলেই ধুপ করে পড়ে যাবেন, বা পা-টা যেন তার শরীরে নেই। আর তার পরেই বেদনাটা অনুভব করলেন তিনি, যেন একটা ধারালো করাত দিয়ে কেউ তার পা কেটে দিচ্ছে। ছেলেরা অনেকেই সরিৎশেখরকে চিনত, দাঁড়িয়ে-থাকা অন্য রিকশাটায় ওরা ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ধাক্কা লাগার পর সেটার কিছু হয়নি, এমনকি রিকশাওয়ালারাও চুপচাপ ভদ্রলোকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল।

অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনি বাড়ি ফিরে আসত। সূর্য ড়ুবে গেলে যে-ছায়াটা চারধার জুড়ে থাকে সেটা মন-কেমন করার। কারণ একটু বাদেই দৌড়তে হবে, পিসিমা ঠাকুরঘর থেকে সন্ধে দিয়ে বেরিয়ে আসার আগেই কলতলায় পৌঁছে যেতে হবে। এই একটি ব্যাপারে সরিৎশেখর দারুণ কড়া। রাত হয়ে গেলে কী হবে অনি অনুমান করতে পারে।

আজ অবশ্য সেরকম কোনো সমস্যা তার নেই। ছুটির পর বাড়ি এসে বেরুতে যাবে এমন সময় শচীন আর তপন এসে হাজি হল। শচীন ওদের ক্লাসের গোলগাল-মার্কা ভালো ছেলে, ওর বাবার দুটো চা-বাগানে শোয়ার আছে। শচীন তপনকে নিয়ে এসেছে অনিকে নেমন্তন্ন করতে। স্কুলে বললে হবে বলে বাড়ি বয়ে এসেছে, তার দিদির বিয়ে।

ভেতরের বারান্দায় চেয়ার পাতা ছিল, সেখানে ওদের বসিয়ে অনি পিসিমাকে ডেকে আনল। দাদু বাড়িতে নেই, নিশ্চয়ই কিং সাহেবের ঘাটে গিয়েছেন। অনির বন্ধুরা খুব কমই বাড়িতে আসে, পিসিমা তড়িঘড়ি দেখতে এলেন। আজকাল পিসিমা বাড়িতে শেমিজ পরেন না, কেমন যেন হয়ে গেছেন। কিছুতেই খেয়াল থাকে না।

হেমলতা দেখে অনির বন্ধুরা উঠে দাঁড়াল। ফুটফুটে দুটো ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেমলতা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, বসো বসো, দাঁড়াতে হবে না, তোমরা তো সব অনির বন্ধু? তা আমাদের বাড়িতে আস না কেন? কী নাম তোমাদের।

অনির খুব মজা লাগছিল, পিসিমা যখন কথা বলেন তখন যেন থামতে চান না। ওর বন্ধুরা বেশ হকচকিয়ে গেছে, কোন উত্তরটা দেবে বুঝতে পারছে না। অনি বলল, পিসিমা, এ হচ্ছে তপন, খুব ভালো গান গায়, আর ও-

অনিকে থামিয়ে হেমলতা বললেন, তপন কী?

তপন এবার চটপট বলল, মিত্র। বলে এগিয়ে এসে হেমলতাকে প্রণাম করল।

হেমলতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেঁচে থাকো বাবা। মিত্তির হল কুলীন কায়েত।

অনি বলল, আর এ হচ্ছে আমাদের ক্লাসের গুড বয়। ওর দিদির বিয়েতে নেমন্তন্ন করতে এসেছে।

হেমলতা বললেন, কী নাম তোমার বাবা?

আমার নাম শচীন রায়।

শচীন এগিয়ে গেল প্রণাম করতে। কিন্তু বেচারা নিচ হতে-না-হতেই হেমলতা ধড়মড় করে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেনত না না, থাক থাক, প্রণাম করতে হবে না। শচীন তো বটেই, অনিও খুব অবাক হয়ে গেল পিসিমার এরকম ব্যবহারে। একটু সামলে নিয়ে বললেন, বামুনের ছেলে তুমি।

কথা শেষ করার আগেই অবাক-গলায় শচীন বলল, না না, আমরা বৈদ্য।

হেমলতা তা-ই শুনে দোনোমনা হয়ে বললেন, একই হল। বন্দিরা তো একধরনের বামুন তোমরা সব বসে গল্প করো। হেমলতা আর দাঁড়ালেন না। উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে-যেতে আর-একবার ওদের দেখে গেলেন।

শচীন বলল, তোর পিসিমা খুব সেকেলে, না রে?

অনি বলল, কই, না তো!

তপন বলল, যাঃ, আমি প্রণাম করলাম কিছু হল না! ও প্রণাম করতেই বামুন-টামুন বের করে ফেললেন!

শচীন বলল, মিত্ররা তো কায়েত সবাই জানে। আগেকার লোকেরা বামুনদের শুধু সম্মান দিত। তোর পিসিমার কথা বাড়িতে গিয়ে বলতে হবে।

তপন গম্ভীর গলায় বলল, স্বাধীনতা এলেও আমরা যে কত পরাধীন তা তোর পিসিমাকে দেখলে বোঝা যায় অনি।

এসব কথা শুনতে অনির একদম ভালো লাগছিল না। পিসিমা এমন কাণ্ড করবেন ও ভাবতে পারেনি। বদ্যি না বামুন না-জেনেই প্রণাম নিলেন না, বন্ধুদের কাছে ওই খবরটা ওরা নিশ্চয়ই ছড়িয়ে দেবে। খুব খারাপ লাগছিল ওর। এমন সময় রান্নাঘর থেকে হেমলতা চাপা গলায় তাকে ডাকলেন। হেমলতা এইভাবে তাকে ডাকেন না, অন্য সময় তার চিৎকার শুনে সরিৎশেখর অবধি বিরক্ত হয়ে ধমক দেন, কী কাকের মতো চাচা

চটপট হেমলতা জবাব দিতেন, কী করব, জন্মাবার সময় তো কেউ মধু দেননি। তা এখনও এই ওকে ডাকছেন, ওকে মোটেই কর্কশ মনে হচ্ছে না। অনি উঠে রান্নাঘরে এল।

হেমলতা প্লেট সাজিয়ে বসে ছিলেন। তিলের নাড়, নারকেলের নাড় আর মোটা পাকা কলা। হেমলতা বললেন, যারে, ও আবার এসব খাবে-টাবে তো! নাহলে বল দুটো লুচি ভেজে দিই।

অনি বলল, কে খাবে না, কার কথা বলছ?

হেমলতা বললেন, ঐ যে, ফরসামতন—

অনি বলল, দুজনেই তো ফরসা। তপন?

হেমলতা দ্রুত ঘাড় নাড়লেন, না না, যে প্রণাম করতে আসছিল–।

ও, শচীনের কথা বলছ? তুমি কিন্তু ওকে প্রণাম না করতে দিয়ে খুব অন্যায় করেছ। আমার বন্ধুরা শুনলে খ্যাপাবে। অনি সোজাসুজি বলে ফেলল।

হেমলতা বলে উঠলেন, না বাবা, প্রণাম করতে হবে না। তা ও কি খাবে এসব?

খাবে না কেন? অনি দুটো প্লেট হাতে নিয়ে যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, একটাতে বেশি দিয়েছ কেন অত।

হেমলতা হাসলেন, বেশি কোথায়? ওটা ওকে দিবি।

অনি বলল, কেন দুজনকেই সমান দাও। তপন কী দোষ করল? একেই প্রণাম নেবার সময় অমন করলে, খাবার সময় যদি তপনকে কম দাও তো ও ছেড়ে কথা বলবে?

হেমলতা যেন অনিচ্ছায় দুটো প্লেটের খাবার সমান করতে চেষ্টা করলেন, হারে ছেলেটা খুব শান্ত, না রে?

কোন ছেলেটা? অনির হঠাৎ মনে হল পিসিমাকে অন্যরকম লাগছে। এমন ভঙ্গিতে পিসিমাকে কথা বলতে ও কোনোদিন দেখেনি।

ওই যে, বদ্যিব্রাহ্মণ-।

ওঃ, অনি প্রায় খিঁচিয়ে উঠল, তুমি বারবার.ওই যে ওই যে করছ কেন? শচীন নামটা বলতে পারছ না?

হেমলতা কিছু বললেন না। অনি খাবার নিয়ে চলে গেলে একা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তার কোনো ছবি নেই, মুখ মনে নেই, এই শরীরে কোনো চিহ্ন সে একে যেতে পারেনি, কারণ শরীরটা তখন তৈরি হয়নি। সে শুধু বেঁচে আছে হেমলতার কাছে একটা নাম হয়ে, বুকের মধ্যে একটা নামজপের মন্ত্রের মতো অবিরত ঘুরেফিরে আসে। সে-মানুষতে তিনি মনে করতে পারেন না, শুনেছেন বড় সুন্দর ছিল লোকটা, খুব ফরসা। তারপর এতদিন ধরে নামটাকে সম্বল করে কল্পনায় চেহারাটাকে তৈরি করে নিজের সঙ্গে খেলে-খেলে যাওয়া। আজ এতদিন বাদে সেই নামের একটি মানুষকে তিনি প্রথম দেখলেন। ফরসা সুন্দর চেহারার একটি কিশোর। হোক কিশোর, নামটা শুনে বুকের মধ্যে লোহার মুঠোয় কে দম টিপে ধরেছিল। এ-নামের মানুষের কাছে কী করে তিনি প্রণাম নেবেন?

হেমলতা চুপচাপ একা একা কাঁদতে লাগলেন। যৌবনের শুরুতে যে-মানুষটা তাকে কুমারী রেখে চলে গিয়েছিল স্বার্থপরের মতো, আজ এতদিন পরে তার নামটার সঙ্গে মিলিয়ে একটি ছবি পেয়ে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

সরিৎশেখরের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তপন আর শচীন চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল অনি যেন অবশ্যই যায়, ওর দাদুকে যেন অনি বলে যে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। জলপাইগুড়িতে তখন একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু ছিল। কোনো বিবাহ-অনুষ্ঠানে পত্র দিয়ে অথবা মুখে নিমন্ত্রণ করলেই চলবে না, অনুষ্ঠানের দিন ঘনিষ্ঠদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বলে আসতে হবে। এরকম অনেকবার হয়েছে, এই সামান্য ক্রটির জন্য বিবাহ-অনুষ্ঠান ফাঁকা হয়ে গেছে, বাড়িতে বলা হয়নি বলে অনেকেই আসেননি।

শচীনরা চলে গেলে অনি চুপচাপ গেটের আছে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন খেলার মাঠে গিয়ে কোনো লাভ নেই। পিসিমা আজ ওরকম করছিলেন কেন? শচীনকে নাম ধরে ডাকছিলেন না পর্যন্ত হঠাৎ ওর খেয়াল হল পিসিমার বরের নাম ছিল শচীন। দাদু একদিন সেসব গল্প বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনি ঘুরে দাঁড়াল। এখন ও বুঝতে পেরে গেছে কেন শচীনকে উনি প্রণাম করতে দেননি। ইদানীং ও পিসিমার সঙ্গে ঠাট্টাতামাশা করে, বয়স হয়ে যাবার জন্যে বোধহয় পিসিমা ওকে প্রশ্রয় দেন। এরকম একটা ব্যাপার তাকে ডেকে উঠল। অনি ফিরে দেখল, এদের পাড়ার একটি বড় ছেলে ওকে ডাকছে, এই খোকা, তোমার নাম অনি তো?

অনি ঘাড় নাড়ল।

তাড়াতাড়ি বাড়িতে খবর দাও, তোমার দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ছেলেটি গেটের কাছে এসে দাঁড়াল।

দাদুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অনি হতভম্বের মতো তাকাল। কী করতে হবে কী বলতে হবে বুঝতে পারছিল না। ছেলেটি আবার বলল, দাঁড়িয়ে থেকো না, যাও। খুব খারাপ কিছু না, পায়ে চোট লেগেছে বোধহ, ভয়ের কিছু নেই।

দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অথচ ভয়ের কিছু নেই-একথা লোকে চট করে বিশ্বাস করতে চায় না। তা ছাড়া প্রিয়জনের দুর্ঘটনা মানেই একটা মারাক ব্যাপার হয়ে যায়। অনি যখন ছুটে গিয়ে হেমলতাকে। চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন। বাবার দুর্ঘটনা ঘটেছে, যে-লোকটা একটু আগে সুস্থ শরীরে বেড়াতে গেল সে-লোকটা এখন হাসপাতালে-একথা ভাবতেই বুকটা কেমন করে ওঠে। এই দীর্ঘ জীবনটা তার বাবার সঙ্গে কেটেছে, বাবা ছাড়া তিনি কিছু ভাবতেই পারেন না। ফলে এই খবরটা ওঁর শরীর নিংড়ে একটা ভয়ের কান্না বের করে আনল। স্বামীর কথা ভাবতে গিয়ে যে-কান্নাটা বুকে ঘোরাফেরা করছিল এতক্ষণ, আশ্চর্যভাবে সেটা চেহারা পালটে ফেলল এখন। সেই কান্নাটা এখন হেমলতাকে যেন সাহায্য করল।

হাসপাতালে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ঘরদোর বন্ধ করে তালা দিতে গিয়ে হেমলতা আবিষ্কার করলেন বাড়িটা একদম খোলা পড়ে থাকবে। এত বড় বাড়িতে তালা দিয়ে এর আগে সাবই মিলে কোথাও যাওয়া হয়নি। হেমলতা দেখলেন বাগানের ভেতর দিয়ে কেউ এসে তালা ভেঙে যদি সব বের করে নিয়ে যায় তবে পাড়ার লোকে কেউ টের পাবে না। কিন্তু একটা বড় আতঙ্ক ছোট ভয়ের সম্ভাবনাকে চাপা দিতে পারে, হেমলতা ইষ্টনাম করতে করতে অর্ক নিয়ে বের হলেন।

অনি দেখল, পিসিমা থান-শোমিজের ওপর একটা সুতির চাদর জড়িয়েছেন। এর আগে কখনো সে পিসিমার সঙ্গে রাস্তায় বের হয়নি। এখানে আসার পর পিসিমা কখনো বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন কি না মনে পড়ে না। সন্ধে হয়ে এসেচে। টাউন ক্লাব মাঠের পাশ দিয়ে যেতেই ওরা রিকশা পেয়ে গেল। হেমলতা তখন থেকে শুধু নাম জপ করে যাচ্ছেন। দাদুর পায়ে চোট লেগেছে, ভয়ের কিছু নেই, শোনার পরও কিন্তু অনি সহজ হতে পারছিল না। খারাপ খবর নাকি লোকে টপ করে দেয় না, সইয়ে সইয়ে দেয়। দাদু যদি মরে গিয়ে থাকে এতক্ষণে তা হলে ও কী করবে?

হাসপাতালে প্রথম ঢুকল অনি। পিসিমা পেছন পেছন। রিকশা থেকে নেমেই অনি দেখল পিসিমা মাথায় ঘোমটা দিয়েছেন। এরকম বেশে ওঁকে দেখে অনির খুব হাসি পেলেও কিছু বলল না। তাড়াহুড়োয় পয়সাকড়ি আনা হয়নি বলে রিকশাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হল। ফিরে গিয়ে একেবারে ডবল পাবে। কলা ওষুধের গন্ধ নাকে ধক করে আসতেই অনির মনে হল, হাসপাতালে থাকতে খুব কষ্ট হয়। অনুসন্ধান লেখা কাউন্টারটায় কেউ নেই। একটা ওটকোমতো বেয়ারাগোছের লোক মেঝেতে বসে ছিল, অনিদের বোকার মতো চাইতে দেখে বলল, কী খুঁজছ বাবা?

অনি বলল কি বলবে না ভেবে বলে ফেলল, আমার দাদু কোথায় তা-ই জানতে এসেছি।

লোকটা কেমন অথর্বের মতো তাকাল, জানতে চাইলেই জানতে পারবে না। ছটার পর বাবুদের ডিউটি খতম। হাত দিয়ে পাকা চেয়ার দেখাল সে, কী কেস?

অমি ঠিক বুঝতে পারল না প্রথমটা, মানে?

বাঁচবে না কষ্ট পাবে? লোকটা উদাস গলায় জিজ্ঞাসা করল। অনিকে ঘুরে পিসিমার দিকে চাইতে দেখে লোকটা বুঝিয়ে দিল, চুকে গেলেই বেঁচে যাওয়া যায়, এখানে থাকলেই তো ভোগান্তি, কষ্ট। কিন্তু চাইলেই কি যাওয়া যায়? এই যে দ্যাখো, আমি একেবারে খোদ যাবার দরজা-এই হাসপাতালে কাজ করছি আর প্রতিদিন চলে যাবার জন্য চেষ্টা করছি, তবু সে-মালা কি আমাকে টিকিট দেবে? তা কখন ভরতি হয়েছে।

বিকেলে। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে পায়ে। অনি বলল।

ও, সেই রিকশা-কেস বাঁচার কোনো আশা নেই, সে-শালা দয়া করবে না, অনেক ভোগান্তি আছে। তা তিনি আছেন ওই সামনে হলুদ বাড়িতে। এসে অবধি ডাক্তার নার্সদের ধমকে বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। যাও, রিকশা-কেস বললেই যে-কেউ এখন বলে দিতে পারবে। লোকটা একফোঁটা নড়ল না।

তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে অনি বলল, বাঁচার আশা নেই বলল, না?

হেমলতা বললেন, তার মানে ভগবান নিয়ে যাবে না, ওর কাছে মরে যাওয়া মানে বেঁচে যাওয়া। যত বদ লোক।

হেমলতা হাঁটছিলেন টিপটিপে পায়ে। হাসপাতালের বারান্দায় রুগিরা সার দিয়ে শুয়ে রয়েছে। রাজ্যের মানুষের ছোঁয়া লেগে যাওয়ায় তার হাতটা শ্লথ হচ্ছিল। দুবার তাগাদা দিয়ে অনি এগিয়ে গিয়েছিল হলুদ বাড়ির দরজায়। এখন ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেছে। দলেদলে মানুষজন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। দরজায় একজনদারোয়ানগোছের লোক ওদের আটকাল। অনি ব্যাপারটা তাকে বললেও সে যেতে দিতে নারাজ, সময় চলে গেছে।

ততক্ষণে হেমলতা এসে পড়েছেন, মুনে খেঁকিয়ে উঠলেন, আমরা কি জেনে বসে আছি যে কখন ওর অ্যাক্সিডেন্ট হবে আর আমাদের সে-খবর পেয়ে আসতে তোমাদের সময় চলে যাবে।

দারোয়ান বলল, কখন অ্যাডমিট হয়েছে আপনার স্বামী?

হেমলতা সব ভুলে চিৎকার করে উঠলেন, মুখপোড়া বলে কী! ওরে উনি আমার বাবা, স্বামীকে অনেক দিন আগে খেয়েছি। অনির চট করে মনে পড়ে গেল, দাদু বরেন পিসিমা নাকি রাক্ষসগণ।

দারোয়ানটা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কী হয়েছিল?

এবার অনি চটপট বলর, রিকশায় লেগেছে।

সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ানের চেহারা বদলে গেল, আরে বাপ, যান যান, বাঁদিকে ঘুরে তিন নম্বর বেড।

লোকটা এরকম ভয় পেল কেন বুঝতে পারল না অনি। পিসিমা তখনও গজগজ করেছেন, এদের এখানে চাকরি দেয় কেন? মেয়ে বউ বুঝতে পারে না যত বদ লোক!

সরিৎশেখর বিছানার ওপর হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তার একটা পা মোটা ব্যান্ডেজ জড়ানো, টানটান করে রাখা। ওদের দেখে তিনিই কাছে ডাকলেন, এই যে, এদিকে এসো। দ্যাখো কীভাবে এরা সব আছেন। এটা কি হাসপাতাল না শুয়োরের খাচা! ঘরময় নোংরা ছিল, আমি বলেকয়ে। সরিয়েছি, নইলে আমরা ঢুকতে পারতে না।

হেমলতা বাবার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে?

সঙ্গে সঙ্গে গলা তুললেন সরিৎশেখর, স্বাধীন হয়ে সব উচ্ছন্নে গেছেন। আমি এখানে এসে এক ঘণ্টা পড়ে আছি, একটা ডাক্তার নেই যে এসে দেখবো নাকি তার ডিউটি ওভার, নতুন লোক, আসেনি। ভাবতে পার? ইংরেজ আমলে এসব জিনিস হলে হ্যাঙ আনটিল ডেথ হয়ে যেত। আমি কালই জওহরলাল নেহরুকে লিখব।

সরিৎশেখরের পাশের বেডে শুয়ে-থাকা একজন রুগি চিনচিনে গলায় বলে উঠলেন, আমাদের খাবার থেকে চুরি করে ওরা, কী জঘন্য খাবার!

সরিৎশেখর হেমলতাকে বললেন, শুনলে? চুরি করা আমি বের করছি। আমি এখানকার দেখনবাহার নাইটিঙ্গেলদের বলেছি খাবারের চার্ট দেখাতে, একটা-কিছু বিহিত করতে হবে। ওই যে আট নম্বরের বাচ্চাটা-চল্লিশ মিনিট চেঁচিয়েও বেডপ্যান পায়নি, আমি এলে তবে দিল। হ্যাঁ মশাই, সিভিল সার্জন কখন আসেন হাসপাতালে?

হেমলতা এবার প্রায় অসহিষ্ণু গলায় বললেন, আপনার পায়ের অবস্থা কীরকম?

যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। এতক্ষণে মুখ-বিকৃতি করলেন সরিৎশেখর, কাল সকালে বোধহয় প্লাস্টার করবে। দুপুরনাগাদ বাড়ি গিয়ে ভাত খাব।

পারবেন? হেমলতা যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

পারব না কেন? আমার একটা পা তো ঠিক আছে। হঠাৎ যেন তার কথাটা মনে পড়ে যেতেই তিনি অনিকে কাছে ডাকলেন, শোনো, তুমি কাল সকালের ফাক্ট বাসে স্বৰ্গছেঁড়ায় চলে যাবে।

অনি অবাক হয়ে বলল, কেন? আমার স্কুল যে খোলা!

সরিৎশেখর বললেন, সারাজীবনে অনেক স্কুল খোলা পাবে। আমি যেতে পারছি না, তুমি অবশ্যই যাবে। তোমার বাবার খুব অসুখ।

কিং সাহেবের ঘাটের চায়ের দোকানগুলো বোধহয় দিনরাত খোলা থাকে। এই কাক-ভোরেও তাদের সামনে লোকের অভাব নেই। ভাতের হোটেল এখনও খোলেনি। সেগুলো ছাড়িয়ে সামান্য এগোতেই অনিকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। একই সঙ্গে চার-পাঁচজন ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সাক্ষাত এসে ওকে যেন কোলে করেই নিজের গাড়িতে তুলতে চাইছে। অনি অসহারে মতো এপাশ-ওপাশ। তাকাচ্ছিল। সামনে সার দিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। মণ্টু এগুলোকে বলে মুড়ির টিন। থার্টি টু পার্টস অল আউট। পুরো গাড়িটাই নাকি ভাঙাচোরা-সবকটা অংশ কোনরকমে জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। হর্ন নেই, দরকারও হয় না। চলার সময় এক মাইল দূর থেকে সবাই এদের গর্জন শুনতে পায়। অনি কোনোদিন এই ট্যাক্সিতে চড়েনি। স্বৰ্গছেঁড়া থেকে আসবার সময় লরিতে চেপে জোড়ানৌকায় পার হয়ে এসেছিল। অনেকদিন ওরা কিং সাহেবের ঘাটে এসে দেখেছে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপিয়ে আগাপাশতলা যাত্রী বোঝাই করে ট্যাক্সিগুলো তিস্তার কাশবন চিরে চুটে যায় বার্নিশের দিকে। বছরের যে-কটা মাস চর শুকনো থাকে ট্যাক্সিগুলো প্রতাপ দেখিয়ে বেড়ায়। তাও পুরো চর নয়, বার্নিশের কাছে সিকি মাইল গভীর জলের ধারা আছে। সে-অবধি গিয়ে আবার যাত্রী নিয়ে ফিরে। আসে ট্যাক্সিগুলো। তারপর যখন বর্ষা বেশ জমে ওঠে, নদীর এপার-ওপার দেখা যায় না, ঢেউগুলো খ্যাপা গোখরোর মতো ছোবল মারতে থাকে অবিরত, তখন ট্যাক্সিগুলো কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায়। অনি দেখল সামনের একটা ট্যাক্সির দরজা খুলে গেল হঠাৎ। তারপর একজন বয়স্ক মানুষ চাপা গলায় ধমে উঠলেন, কী হচ্ছে!

সঙ্গে সঙ্গে অনি দেখল লোকগুলো বেশ থতমত হয়ে গেল। একজন চট করে বলে উঠল, কেন ঝামেলা করস, বাবু তখন থিকা বইস্যা আছেন, ইনারে পাইলেই গাড়ি খুলুম-আসেন কত্তা, আমাগো পিক্ষিরাজে বসেন, আমি ডেরাইভার সাহেবকে ডাইক্যা আনি।

লোকটা ওকে যেন পথ দেখিয়ে খানিকটা দূর এগিয়ে এসে গাড়িটা চিনিয়ে দিল। অনি দেখল অন্যান্য গাড়ির তুলনায় এটা তবু দ্ৰ চেহারার, মাথার ওপরের ত্রিপলটা আস্ত আছে। বয়স্ক ভ্রলোক তখনও বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনি দেখেই বুঝল অনি নিশ্চয়ই খুব বড়লোক, কারণ এর ফিনফিনে ধুতি, গিলে-করা পাঞ্জাবি আর ফরসা গোলগাল চেহারা থেকে একটা আভা বের হচ্ছিল।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, গাড়িতে উঠিয়ে ছাড়ার নাম নেই! তোমাদের প্যাসেঞ্জার না হওয়া অবধি বসে থাকতে হবে।

কথাটার কোনো জবাব দিল না কেউ। ভদ্রলোক এপাশ-ওপাশ তাকালেন। অনি দেখল যে-লোকটা ওকে গাড়ি চিনিয়েছে সে একটা পাটকাঠির মতো ফিনফিনে লোককে সঙ্গে নিয়ে এদিকে আসছে। অনি শুনতে পেল ভদ্রলোক তাকে ডাকছেন, এই খোকা, ওপারে যাবে তো? গাড়িতে উঠে বসো। এবার না ছাড়লে দেখছি! অনি গাড়িতে ওঠার আগেই ফিনফিনে লোকটি দরজা খুলে ওকে সামনে বসতে বলল। ডাইভারের সিটে কোনো গদি কোনো গদি নেই। গোল গোল.শ্রিং-এর ওপর মোটা বস্তা পাতা রয়েছে। খুব চওড়া ফুটবোর্ডের ওপর পা রেখে নিচু হয়ে বসতেই মনে হল ওর পাছায় অজস্র পিপড়ে কামড়াচ্ছে। ড্রাইভারের সঙ্গীটি তখন চাঁচাচ্ছে-ফাস্টো টিপ–বার্নিশ, ফাস্টো টি-বার্নিশ!।

গাড়িতে ওঠার সময় অনি লক্ষ করেছিল ভদ্রলোক একা নেই। একজন মহিলা এবং একটি ছেলেকে এক পলকে নজর করেছিল সে। এখন গাড়িতে উঠে ও দেখল ওর সামনে আয়নাটা আস্ত আছে এবং ভদ্রলোকের পাশে ভীষণ ফরসা একজন মহিলা বসে আছেন লাল কাপড় পরে। মহিলার চোখে নতুন ধরনের চশমা যা অনি কোনোদিন দেখেনি, জামাটার হাতা নেই। এরকম জামা ছোট ঠাকুমা পরত। দাদুর তোলা ছোট ঠাকুমার একটা ছবি দেখছিল সে, ঠিক এইরকম, তবে একটু ঢোলা। অনি উঠতেই তিনি চোখ কুঁচকে তাকে একবার দেখলেন, রাবিশ! এত করে বললাম গাড়ি বের করো, শুনলে না, এখন বোঝে।

ভদ্রলোক বললেন, তিস্তার চরে প্রাইভেট গাড়ি চালালে বারোটা বেজে যাবে।

ভদ্রলোক বললেন, ছেলে শুনছে।

শুনুক! এখন তো শোনার বয়স হচ্ছে।

ভদ্রমহিলার কথা শেষ হওয়ামাত্র হুড়মুড় করে চার-পাঁচজন কাবুলিওয়ালার একটা দল এসে পড়র। ওদের দেখে অন্যান্য ট্যাক্সি-ড্রাইভার কিন্তু একদম চিৎকার করল না। ওরা বোধহয় এই ট্যাক্সিতে প্যাসেঞ্জার দেখে সোজা এখানেই চলে এল। ড্রাইভারের সঙ্গী চেঁচিয়ে বলল, এক কপিয়া খান সাব এক আদমি কো।

একটা মোটা কাবুলিওয়ালা, যার ঘাড় মাথার অর্ধেক অবধি কামানো, ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, পচ আদমি-চার রুপয়া।

এই নিয়ে যখন ওদের মধ্যে কথা চলছে অনি শুনল ভদ্রমহিলা বললেন, এই গাড়িতে ওরা যাবে নাকি? ভদ্রলোক জবাব না দিলেও অনি বুঝতে পারল, তিনিও ওদের যাওয়াটা পছন্দ করছেন না। ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি ড্রাইভারকে বলো ওদের না নিতে।

ভদ্রলোক বললেন, ও শুনবে কেন? আমরা তো পুরো ট্যাক্সি রিজার্ভ করিনি।

এবার যেন মহিলা ধৈর্য রাখতে পারলেন না, তা-ই করো। আঃ! তুমি জান না ওরা কীরকম। আজ অবধি কেউ কাবুলিওয়ালার বউ দেখেনি, জান?

হঠাৎ ভদ্রলোকের গলার স্বর পালটে গেল, তাতে তোমার কী এসে গেল, তুমি তো আমার স্ত্রী।

অনি দেখল ভদ্রমহিলার মুখ সব লাল হয়ে গেছে। তার একপাশে ওর বয়সি যে-ছেলেটা চুপচাপ বসে আছে তার মুখটা অসম্ভব রকমের গোবচারা। এরকম লালটু পোলাটু-মার্কা ছেলে ওদের দলে একটাও নেই। হঠাৎ ছেলেটা বলে উঠল, কাবুলিওয়ালারা খুব ভালো, না মা? আখরোট দেবে আমাদের?

ভদ্রমহিলা খিঁচিয়ে উঠলেন, আঃ, তুমি চুপ করো। যেমন বাপ তেমনি ছেলে!

ছেলেটি হতচকিত হয়ে বলল, হ্যাঁ মা, মিনিকে দিত, আমি পড়েছি।

অনি ঠিক বুঝতে পারছিল না ছেলেটি কোন পড়ার কথা বলছে। তবে আন্দাজ করল ও কাবুলিদের নিয়ে কোনো গল্প পড়েছে।

দর ঠিকঠাক হয়ে গেলে লোকগুলো যখন গাড়িতে উঠতে যাবে তখন অনি পিঠে একটা হাতের স্পর্শ পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখল, ভদ্রমহিলা অনেকটা ঝুঁকে প্রায় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলছেন, তুমি আমাদের এখানে এসে বসো তো ভাই, সামনের সিটটা ওদের ছেড়ে দাও।

অনি কী করবে বুঝে না উঠতেই ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, চলে এসো পেছনে, কুইক।

অনি কী করবে বুঝে উঠতেই ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন, চলে এসো পেছনে, কুইক। ভদ্রলোক জানা ছাড়বেন না, তার কীসব দেখার আছে। গোলালু ছেলেটা প্রায় নাকে কেঁদে উঠল, সে ওপাশের জানালা থেকে সরবে না। অনি নেমে দাঁড়িয়েছিল। একটা ছোকরা-কাবুলি ওর মাথায় আলতো করে টোকা মারল। তারপর ওরা চারজন ড্রাইভারের পাশে গিয়ে অদ্ভুত ভাষায় উঃ আঃ করতে করতে বসে পড়ল। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক নেমে দাঁড়াতে অনি পেছনের সিটে বসতে পেল। ছোট্ট কাপড়ের ঝোলাটা কোলের ওপর রেখে মহিলার পাশে বসতেই অনির মনে হল অত এক ফুলের বাগানে সে ঢুকে পড়েছে। তরকম ফুলের গন্ধ একসঙ্গে নাকে আসছে যে দিশেহারা হয়ে যেতে হয়। মায়ের গা থেকে যেরকম গন্ধ বের হত এটা সেরকম নয়, মহিলার শরীর থেকে যে-সৌরভ বের হচ্ছে তা মানুষকে যেন অবশ করে দেয়। সামনের সিটে বসে যে কেন গন্ধটা পায়নি বুঝতে পারছিল না অনি। কাবুলিরা উঠে বসেই প্রায় একই সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দেখল। একজন কী-একটা মন্তব্য করতেই সবাই ঠাঠা করে হেসে উঠল। অনি দেখল ভদ্রমহিলা এক হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন, অন্য হাত তার পিঠের উপর রাখা।

ড্রাইভারের সঙ্গী এবং অবশিষ্ট কাবুলিটা ফুটবোর্ডে উঠল। সঙ্গীটি ওঠার আগে হ্যাণ্ডেল নিয়ে কয়েক মিনিট প্রাণপণে ঘুরিয়ে ইঞ্জিন স্টার্ট করতে সেটা সফল হয়ে এল। ইঞ্জিন গর্জে উঠতেই গাড়িটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। অনিরমনে হতে লাগল মণ্টুর কথা সত্যি, যে-কোনো সময় গাড়ির সবকটা অংশ খুলে পড়ে যেতে পারে। বিকট চিৎকার করে গাড়িটা চলতে শুরু করল এবার। ভেতরে বসে কানে তালা লাগার যোগাড়। অনি দেখল পেছনের সিটের গদি এখনও সবটা উঠে যায়নি।

দুপাশে বালি আর বারি, ইতস্তত কিছু কাশগাছ, গাড়িটা যত জোরে ছুটছে তার বহুগুণ বেশি শব্দ করছে। মাঝে-মাঝে মরা নদীর খোঁজে কিছু জল জমে রয়েছে। অবলীলায় ট্যাক্সি সেটা পেরিয়ে এল। কাবুলিগুলো খুব মজা পেয়েছে, অনি শুনল, ওরা চিৎকার করে গান ধরেছে। অনির বসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। মহিলা তাকে প্রায় চেপটে ফেলেছেন। ওঁর পেটের গমের মতো রঙের চর্বি যত নরম হোক ওজনে দমবন্ধ করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। ভদ্রমহিলা বোধহয় অনির পেছনদিক দিয়ে স্বামীকে চিমটি কেটেছিলেন, কারণ তিনি হঠাৎ উঃ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। মহিলা কেমন হাসিহাসি গলায় বললেন, কাবুলিওয়ালারাও গান গায়, শুনেছ আগে?

ভদ্রলোক বললেন, হুঁ। সেক্স এলে ওরা গান গায়।

প্রায় আঁতকে উঠলেন মহিলা, সে কী!

সঙ্গে সঙ্গে চাপা গলায় ভদ্রলোক বলে উঠলেন, তোমার অবশ্য ভয়ে দিন অনেক আগে চলে গেছে। আয়নায় মুখ দ্যাখো না তো!

অনি দেখল মহিলা হঠাৎ চুপ করে গেলেন। ওঁর হাতটা নির্ভার হয়ে ওর পিঠের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। মুখ ঘুরিয়ে অনি দেখল একটা ঠোঁট চেপে ধরে তিনি ছেলের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। কেন হঠাৎ এমন হল সে বুঝতে পারছিল না। সেক্স মানে কী? এই শব্দটাই সব গোলমালের কারণ। মানে জিজ্ঞাসা করলে যদি ভদ্রলোক চটে যান? ও মনে মনে কয়েকবার আওড়ে শব্দটা মুখস্থ করে ফেলল। বাড়িতে ফিরে গিয়ে ডিকশনারিতে এর মানেটা দেখতে হবে। আর এই সময় আর্তনাদ করে গাড়িটা থেমে গেল। অনি দেখল চারধারে এখন মাথা অবদি কাশগাছের বন। একটা ডাহুক পাখি ডাকছে কোথাও। ড্রাইভারের সাক্ষাত লাফিয়ে নামল, হালারে টাইট দেবার লাগব। বলে পাশ থেকে একটা কাশগাছের উঁটা ছিঁড়ে নিয়ে ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলে ভেতরে কোথাও খুঁজে দিতেই আবার শব্দ করে গাড়িটা ডেকে উঠল। ব্যাপারটা এতটা আকস্মিক যে কাবুলিগুলো পর্যন্ত হাঁ হয়ে গেল। ভদ্রলোক চাপা গলায় বললেন, আমার গাড়ি হলে মেকানিক ডাকতে হত।

নদীর ধারে এসে ট্যাক্সিটা দাঁড়াতেই কাবুলিগুলো আগে লাফিয়ে নামল। এপারে কোনো দোকানপাট নেই। প্রায় রোজই ঘাট জায়গা বদলাচ্ছে, তা ছাড়া পাহাড়ের বৃষ্টি হলেই শুকনো চরে আট-দশটা মেটো ধারা গজিয়ে এক হয়ে যাবে। ওপারে বানিশ! বার্নেশও বলে অনেক। লোকজন দোকানপাটে জমজমাট। এই সাতসকালে সেখানে গঞ্জের ভিড়। সমস্ত ড়ুয়ার্স এবং সুদূর কুচবিহার থেকে বাসগুলো এসে ওই বার্নিশে বসে থাকে। তিস্তা পেরিয়ে জলপাইগুড়িতে আসার উপায় নেই। তাই বার্নিশের রবরবা এত। বার্নিশের নিচে মণ্ডলঘাট, জলপাইগুড়িতে আসার সময় রা মওলঘাট দিয়ে এসেছিল।

গাড়ি তেকে নেমে অনি দেখল জোড়া-নৌকো একটাও নেই, ছোট ছোট নৌকো দুটো দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ে ভিড় নেই একদম, একটা নৌকোয় গোটা-আটেক লোক বসে আছে। তবে এই সিকি মাইল চওড়া তিস্তায় এখন প্রচণ্ড ঢেউ, জলের রঙ লালচে। হঠাৎ দেখলে কেমন ভয়-ভয় করে। ড্রাইভারের সঙ্গী এসে তার কাছে টাকা চাইল। ও দেখল ভদ্রলোক মহিলা এবং গোলালুকে নিয়ে নৌকোর দিকে এগোচ্ছেন। টাকাটা দিয়ে ও চটপট এগোল। আসবার সময় পিসিমা তিনটে একটাকার নোট তাকে দিয়েছেন, একটাকা ট্যক্সির ভাড়া, চার আনা নৌকোর ভাড়া, পাঁচসিক বাসভাড়া আর আটকায় দুটো রাজভোগ। একদম হিসেব করে দেওয়া টাকা। সকালবেলায় সাততাড়াতাড়ি না খেয়ে বেরনো-তাই রাজভোগ বরাদ্দ।

ভদ্রলোক উঠে গেছেন নৌকোয়, উঠে ছেলেকে প্রায় কোলে করে টেনে তুলেছেন। অনিকে আসতে দেখে মহিলা বললেন, তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি ভাই। একসঙ্গে এলাম তো, যাই কী করে!

অতবড় মহিলা তাকে ভাই বলছেন, অনির কেমন অস্বস্তি হল। ও কি মাসিমা না বলে দিদি বলবে? ওরা নিশ্চয়ই খুব আধুনিক। বড়লোক হলেই বোধহয় আধুনিক হয়। মণ্টু বলে বিলেতে আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা বাপ-মায়ের বন্ধু। ওঁদের চেয়ে আধুনিক কে আছে। মহিলা তো তাকে শুধু ভাই বললেন।

অনি দেখল ঢেউ-এর দোলায় নৌকোটা পাড়ের বালিতে ঘষা খেয়ে আবার হাতখানেক সরে যাচ্ছে। সে-সময় তার ফাঁক দিয়ে লালচে জলের স্রোত দেখা যাচ্ছে। ভদ্রমহিলা বোধহয় সেই দিকে চোখ পড়ার আর এগোতে পারছেন না। ওদিকে ভদ্রলোক কিন্তু উদাস-চোখে বার্নিশের দিকে চেয়ে আছেন। নৌকোটা ছোট। দুধারে সরু তক্তা পাতা, যাত্রীরা সেখানে বসে আছে। মাঝখানে কাঠের বিমগুলো এখন ফাঁকা। গোলাপু জুলজুল করে বাবার পাশে বসে মাকে দেখছিল। অনির একটু ভয়-ভয় করছিল। সে সাবধানে নৌকোতে উঠতেই সেটা সামান্য দুলে উঠল। প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি এবার ব্যালান্স থাকবে না, কিন্তু সেটা চট করে ফিরে এল। সোজা হয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না। ও ঘুরে দেখল ভদ্রমহিলা ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, বেশি দুলছে না তো? অনি ঘাড় নেড়ে হাত ধরতেই ভদ্রমহিলা শরীরের সব ওজন নৌকোর ওপর অনিকে ভর করে ছেড়ে দিলেন। অনির মনের হল ওর দমবন্ধ হয়ে যাবে, ও উলটে জলে পড়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হল না, সামনে নিয়ে ভদ্রমহিলা সেখানেই কাঠের ওপর বসে পড়ে অনিকে বললেন, বসো। অনি বসতে বসতে শুনতে পেল মহিলা বলছেন, স্বার্থপর, জেলাস। ঠিক বুঝতে না পেরে ওঁর দিকে তাকাতেই তিনি হেসে ফেললেন, না না, তোমাকে নয় ভাই। এখা, তোমাকে কেন বলব! তুমি আমার কত উপকার করলে। কোথায় যাচ্ছ?

স্বৰ্গছেঁড়ায়। অনি বলল।

দারুণ রোমান্টিক নাম, না? আমরা যাচ্ছি ময়নাগুড়ি। আজই ফিরে আসব। জলপাইগুড়িতে থাক কাঁধে হাত রেখে পা নাচালেন মহিলা।

হ্যাঁ।

এলে দেখা কোরো। আমরা থাকি বাবুপাড়ায়। বাড়ির নাম ড্রিমল্যান্ড। মনে থাকবে তো?

অনি ঘাড় নাড়ল। ও কোন স্কুলে পড়ে।

কে? ও, প্রিন্স? কার্শিয়াং-এ পড়ে। ছুটিতে এসেছে। আমার একটা মেয়ে আছে, দারুণ সুন্দরী, আমার চেয়েও। ওর সঙ্গেই আমার মেলে বেশি। প্রিন্স ওর বাবার মতন, স্বার্থপর। অহো, তোমার নাম কী? কোন স্কুলে পড়। এত কথার পর মহিলার এবার যেন প্রশ্নটা মনে পড়ল। ঠিক সে-সময়:মাঝিরা এসে নৌকোয় উঠতে সেটা খুব জোরে দুলে উঠল। মহিলা ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন। সেইরকম ফুলের বাগানে ঢুকে পড়ে অনি বলল, আমার নাম অনিমেষ, জেলা স্কুলে পড়ি।

নৌকোটা ছেড়ে দিল। নৌকোর মুখে একটা মোটা লম্বা দড়ি বেঁধে কয়েকজন সেটাকে টানতে লাগল পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে। সেই টানে নৌকো এগিয়ে যেতে লাগল ওপরের দিকে। অনি শুনতে পেল ভদ্রলোক গোলালুকে বলছেন, একে বলে গুণ টানা। গোলা বুঝল কি না বোঝা গেল না। ও কেন জেলা স্কুলে না পড়ে কার্শিয়াং-এ পড়ে সেখানে নিশ্চয়ই একা থাকতে হয়। ওর হঠাৎ সোলালুর জন্য কষ্ট হল। মা থেকেও ও মার কাছে থাকতে পারছে না। ঢেউ বাচিয়ে নৌকোটাকে অনেক দূরে নিয়ে এসে মাঝিরা লাফিয়ে উঠে বসল। সঙ্গে সঙ্গে ছপছপ করে বৈঠা পড়তে লাগল জলে। বাঁধন খুলে যেতেই স্রোতের টানে শেশো করে নৌকো নদীর ভিতর ঢুকে পড়ল।

বড় বড় ঢেউ দেখা যাচ্ছে মাঝনদীতে। এক-একটা বড় যে তার আড়ালে বার্নিশটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে পলকের জন্য। হঠাৎ নৌকোর একধারে বসে-থাকা রাজবংশীরা চিৎকার করে উঠল, তিস্তা বুড়িকি জয়! সঙ্গে সঙ্গে সেটা গর্জন করে ফিরে এল। মাঝিলা প্রাণপণে নৌকো ঠিক রাখার চেস্টা করছে। চিৎকার করে নিজেদের মদ্যে কথাবার্তা বলছে ওরা। অনি দেখল বড় ঢেউয়ের কাছাকাছি নৌকো এসে যেতেই একটা দিক কেমন উঁচু হয়ে যাচ্ছে নৌকোর।

গোলালু ওর বাবাকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। ভদ্রলোক অন্য হাতে নৌকোর তক্তা শক্ত করে ধরে আছেন। ভদ্রমহিলা এই সকালে কলকল করে ঘামছেন। তাঁর মুখের রং কাদা হয়ে গড়িয়ে পড়ছে একধারে। সমস্ত শরীর দিয়ে যেন অনিকে জয়ি ধরেছেন। ছিটকে ছিটকে জল আসছে নৌকোয়। কাবুলিগুলো পর্যন্ত নদীর চেহারা দেখে ভয়ে। পচাপ হয়ে বসে গেছে।

এবার ঢেউটা পার হবে নৌকো। অনি দেখল স্রোতটা এখানে গর্তের মতো নিচে নেমে গিয়ে হঠাৎ তুবড়ির মতো ওপরে সে উঠছে। নৌকো সেই টানে নিচে নেমে যেতেই অনুত একটা ঝাঁকুনি লাগল। সেটা সামলে জলের টানে ওপরে উঠতেই একটু বেটাল হয়ে গেলে হুড়মুড় করে একরাশ জল নৌকোয় উঠে এল। আর তখনই অনি দেখল বেটাল নৌকোর একপাশে বসে থাকা একটা লোক টুপ করে জলে পড়ে গেল চুপচাপ। যেন ভেতরে ভেতরে কেউ কাজ করে যায়, নইলে সেই মুহূর্তে মহিলার বাঁধন খুলে অনি ঘুরে বসত না। আর বসতেই ও দেখল সেই শরীরটা ছুটন্ত জলের সঙ্গে পাক খেয়ে তার নিচ দিয়ে নৌকোর তলায় ঢুকে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বকে পড়ে অনিমেষ তার পিঠের জামা চেপে ধরল মুঠোয়। জলের স্রোতে শরীরটার ওজন কমে গিয়েছে, তবু তাকে ধরে রাখা অনির পক্ষে অসম্ভব। পিঠের দিকে টান লাগায় শরীরটার নিচ দিক নৌকোর তলায় ঢুকে গেল আর লোকটা চট করে আধা উলটে গেল। অনি দেখল লোকটার সারা শরীর কাপড়ে মোড়া, বাঁচার স্বাদ পেয়ে একটা হাত ওপরে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে কতক্ষণ সে ধরে থাকতে পারে? মহিলা না থাকলে সে নিজে পড়ে যেত। মহিলা তার কোমর দুহাতে ধরে রাখায় সে ব্যালেন্স রাখতে পারছে। এতক্ষণে নৌকোটা সেই বড় ঢেউ-এর জায়গাটা পেরিয়ে এসেছে। দুজন মাঝি দৌড়ে ছুটে এল অনিকে সাহায্য করতে। তারা এসে। ঝুঁকে পড়ে লোকটাকে ধরতেই সে হাত বাড়িয়ে নৌকোর কাঠ ধরতে গেল। নাগাল পাচ্ছে না দেখে। অনি হাতটা ধরে সাহায্য করতে যেতেই দেখল সে কোনোরকমেই মুঠো করতে পারছে না। কারণ মুঠো করার জন্য আঙুলগুলোই তার নেই। এই জলে-ভেজা হাতের যেখানে সে চেপে ধরেছিল সে জায়গাটা যেন কেমন-কেমন লাগছে। আর এই সময় চিৎকারটা শুনতে পেল অনি। কানের কাছে মহিলা প্রচন্ড আর্তনাদ করে তার কোমর ছেড়ে দিলেন। দিয়ে আলথালু হয়ে দৌড়ে স্বামীর পাশে গিয়ে বসলেন।

যেহেতু এখন নৌকো দুলছে না, অনি সোজা হয়ে একা দাঁড়াতে পারল। ততক্ষণে নৌকোটা পাড়ের কাছে এসে গেছে এবং এই মাঝি দুটো লোকটাকে টেনে অনিরা যেখানে বসেছিল সেখানে তুলেছে। অনি দেখল মৃতপ্রায় একটা মানুষ নৌকোর কাঠের ওপর এলিয়ে পড়ে আছে। মুখভরতি দাড়ি দাঁত নেই, হাঁ করে বুক কাঁপিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। অনি দেখল লোকটার নাক নেই, কানের অর্ধেকটা খসা, চুলের জায়গায় ছোপ ছোপ দাগ। পুরো মুখটা ঢেকে বসেছিল সে নৌকোয়। আর এতক্ষণ পরে অনি টের পেল ওর শরীর থেকে অদ্ভুত একটা পচা গন্ধ বের হচ্ছে। কেমন একটা গা-ঘিনঘিনে ভাব সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল এবার। অনি নিজের হাতের দিকে তাকাল। তারপর ঝুঁকে তিস্তার জলে হাত ধুয়ে নিল। আর এই সময় একটা মাঝি ওকে বলে উঠল, পণ্য করলেন না। ভাই, আপনার পাপই হইল। কথাটার মানে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে বলল, এ তো মানুষ না, জন্তুর অধম। মইরা গেলেই এশান্তি পাইত, তিস্তাবুড়ির কোল থিকা ছিনাইয়া আইন্যা কী লাভ হইল!

অনি এত অবাক হয়ে গিয়েছিল যে ওর জামাকাপড়ের অনেকটা যে জলে ভিজে গেছে টের পেল, কিন্তু ও মরে যেত যে!

মাঝিরা হাসল, হক কথা। কিন্তু বাঁইচ্যা যাইত।

ঠিক তখন কাল সন্ধেবেলায় হাসপাতালের সেই লোকটার মুখ মনে পড়ল। এই পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া মানে বেঁচে যাওয়া-লোকটা বলেছিলেন। এখন এই মাঝিও প্রায় সেই কথাই বলছে নিজের মায়ের কথা ভাবল অনি, মা কি বেঁচে গেছে তাকে ফেলে রেখে মা কি শান্তিতে আছে? মানুষের কেন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না বুঝতে পারছিল না অনি। হঠাৎ ওর মনে হর হাসপাতালের সেই লোকটা অথবা খসে-যাওয়া-শরীরে লোকটা বোধহয় একই রকমের।

পাড়ে নৌকো এসে ভিড়তেই ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ভিড় জমে গেল নৌকোটার সামনে। সবাই একে একে পয়সা দিয়ে নেমে গেলে অনি মাঝিটাকে পয়সা দিতে গেল। সে ঘাড় নেড়ে বলল, না, আপনের ভাড়া লাগবে না।

পাড়ে দাঁড়িয়ে দুলন্ত নৌকোয় দাঁড়ানো মাঝিকে সে বলল, কেন?

মাঝি হাসল, আপনি যা করছেন তা কজনা করে!

কিছুতেই পয়সা নিল না সে! অনেকগুলো বিস্মিত মুখের সামনে দিয়ে অনি ওপরে উঠে এল। সারা সার বাস দাঁড়িয়ে। জায়গাগুলোর নাম মাথার ওপর লেখা-সাপাড়া-আলিপুরদুয়া-কুচবিহার-নাগুয়া-ফালাকাটা। এইসব চেনা বাসগুলোকে দেখতে পেয়ে ওর খুব খিদে পেয়ে গেল। খাবারের দোকান খুঁজতে গিয়েও দেখল ভদ্রলোক, মহিলা আর গোলালু একটা মিষ্টির দোকানে বসে আছেন। হাসিমুখে ওঁদের কাছে যেতেই অনি দেখল মহিলার মুখ কালো হয়ে গেল। একটা চেয়ার খালি ছিল, অনি সেটা ধরতেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, বসো,, বসো না, খবরদার, ছোঁয়া লেগে যাবে! হ্যাঁ হয়ে গেল অনি। মহিলা স্বামীকে বললেন, ওকে এখান তেকে যেতে বলে দাও। সংক্রামক রোগ, অলরেডি ওর ভেতরে এসে গিয়েছে কি না কে জানে!

ভদ্রমহিলার দিকে আড়চোখে দেখে নিয়ে ওর স্বামী অনিকে বললেন, তুমি বরং কার্বলিক সোপ দিয়ে হাতটা ধুয়ে নিও। হিরোর সব মানুষের কাছে সমান নয় ভাই। উইশ ইউ গুড লাক।

ভীষণ কান্না পেয়ে গেল অনির! কোনোরকমে দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে এল সে। খাবার ইচ্ছেটা এখন একদম চলে গেছে। এসব রোগ কি সংক্রামক। তার ভেতরে কি চলে আসতে পারে? এখানে কার্বলিক সোপ সে কোথায় পাবে। চারদিকে তাকিয়ে হঠাৎ নাকের কাছে সে দেখল তার ওপর আলিপুরদুয়ার লেখা, বাসটা এখনই ছাড়বে। স্বৰ্গছেঁড়ার ওপর দিয়ে একে যেতে হবে।

প্রায় অন্ধের মতন সে বাসে উঠে বসল। এখান থেকে মিষ্টির দোকানটা দেখা যাচ্ছে। জানলার পাশের সিটে বসে অনি দেখল ওদের টেবিলে বড় বড় রাজভোগ এসে গিয়েছে। আজ অবধি কেউ তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করেনি। সে কি জানত লোকটার খারাপ অসুখ আছে একটা মানুষ ড়ুবে যাচ্ছে দেখে তার বুকের মধ্যে এমন একটা ব্যাপার হল যে সে ঠিক থাকতে পারেনি। হঠাৎ ওর মনে পড়ল, মাঝিগুলো তো নির্দিধায় লোকটাকে টেনে তুলেছিল। ওরা কি কার্বলিক সোপে হাত ধোবে? ওদের মনে যদি কোনো চিন্তা না এসে থাকে সে এত ভাবছে কেন? মহিলা নিশ্চয় ভুল বুঝেছেন অথবা তিনি মোটেই আধুনিক নন। সংস্কার না থাকার নামই নাকি আধুনিক হওয়া, আমেরিকানদে মতো-মণ্টু প্রায়ই বলে। ওর মনে পড়ল মাঝি ওকে বলেছে আপনি যা করেছেন তা কজনে পারে? অদ্ভুত একটা শান্তি একটু একটু করে ফিরে আসছিল অনির।

এই সময় ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ল দুবার হর্ন বাজিয়ে। সামান্য লোক হয়েছে গাড়িতে। কন্ট্রাক্টর দরজা বন্ধ করে চাচাল, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, স্বৰ্গছেঁড়া, বীরপাড়া-আলিপুরদুয়ার। আর বাসটা এবার নড়তেই হঠাৎ অনি লক্ষ করল কী-একটা ছুটে আসছে তার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই কালোমতন জিসিসটা চটাং করে এসে লাগল জানলার ওপরে। একটা কাদার তাল ঝুলে থাকল জানলায়। একটু নিচু হলেই সেটা গলে অনির মুখে এসে লাগলত। বিস্মিত, হতভম্ব অনি সমস্ত শরীরে কাঁপুনি নিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখল একটা লোক ওকে দেখে চাচাচ্ছে, কেন বাঁচালি, মরতে চেয়েছিলাম তো তোর বাপের কী, শালা! কেন বাঁচালি? সেই আধখানা শরীরটা নৌকোর ওপর থেকে এসে ভেজা কাপড়ে হিংস্র হয়ে লাফাচ্ছে আর নাকিম্বরে অনির দিকে তাকিয়ে একই কথা বলে যাচ্ছে। ও কী করে টের পেল যে অনি চিয়েছে: নিশ্চয়ই কেউ বলে দিয়েছে। অনির বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল, চোখের সামনে জলের আড়াল। ও তাড়াতাড়ি কাচের জানলাটা বন্ধ করে দিল। ঝাঁপসা হয়ে গেলে সব মানুষকে সমান দেখায়।

বাবার অসুখের খবর পেয়ে জোর করে দাদু তাকে পাঠালেন কিন্তু ধূপগড়ি না পেরনো পর্যন্ত সেকথা খুব-একটা মনে পড়েনি অনির। ড়ুড়ুয়া নদী ছাড়িয়ে রাস্তাটা বাঁক নিতে যেই স্বৰ্গছেঁড়া চা-বাগানের গাছগুলো চোখে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে একা উত্তেজনা হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল। কদিন বাদে সে আবার এইসব গাছগাছালি, ডানদিকের মদেসিয়া কুলিদের ঘরবাড়ি দেখতে পাচ্ছে। মুখ বাড়িয়ে একটা পরিচিত মুখ দেখল না ও। যদিও স্বৰ্গছেঁড়ার বাজার এখান থেকে মাইল দুয়েক, তবু কেউ-কেউ তো এদিকে আসতেও পারে। তারপর সেই বিরাট শালের মাঝখানে কাজ-করা ফুলের মতো চা-বাগানের মধ্যখানে মাথা-তোলা ফ্যাক্টরি-বাড়িটা চোখে পড়ল তক্ষুনি ওর বুকটা কেঁপে উঠল। বাবার খুব অসুখ, ওই ফ্যাক্টরিতে বাবা নিশ্চয়ই কাজ করতে যেতে পারছেন না। চা-বাগানের শেষে বাদিকে বাবুদের কোয়ার্টার, দু-দুটো চাপাগাছ বুকে নিয়ে নিয়ে বিরাট খেলার মাঠ চুপচাপ পড়ে আছে। অনি চিৎকার করে বাস থামাল।

মাটিতে নামতেই ইউক্যালিপটাস গাছের শরীর-ছোঁয়া বাতাসটাকে নাক ভরে টেনে নিয়ে ও চারপাশে তাকাল। কোয়ার্টারগুলোর দরজা বন্ধ। রাস্তার এপাশে মাড়োয়ারিদের দোকানের সামনে একজন পশ্চিমগোছের লোক উবু হয়ে বসে তাকে দেখছে। চোখাচোখি হতে দাঁত বের করে হাসল, অনি তাকে চিনতে পারল না। ক্লাবঘর তালাবন্ধু, অনি বারান্দায় উঠে এসে দরজার কড়া নাড়ল।

ডানদিকের খিড়কিদরজা খুলে বাগান দিয়ে বাড়ির ভেতরে যাওয়া যায়, কিন্তু হঠাৎ এই সদরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর মনটা কেমন হয়ে গেল। এখন এ–বাড়িতে মা নেই। এই বারান্দা, এ-বাড়ির ঘর উঠোন যে-কোনো জায়গায় ও মাকে কল্পনা করতে পারে। মা মারা গেছেন জেনেও মাজে মাঝে নিজের সঙ্গে খেলা করে তাবত মা স্বৰ্গছেঁড়ায় আছে, গেলেই দেখা হবে। এখন এই সত্যটার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে অদ্ভুত কষ্ট হচ্ছিল ওর। মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে বাবাকে মনে পড়ে যেতে শক্ত হয়ে দাঁড়াল অনি। বাবার কী হয়েছে। দাদু কেন জোর করে ওকে স্বৰ্গছেঁড়ায় পাঠালেন। হঠাৎ অনি কুইকঁই শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল একটা কালো রঙের ঘেয়ো নেড়িকুকুর চার পা মুড়ে মাটিতে বসে ওর দিকে কেমন আদুরে চোখে তাকিয়ে শব্দ করছে। কুকুরটাকে চিনতে পারল ও, মা এঁটো ভাত দিতেন, কালু বলে ডাকতেন, আর একদম পছন্দ করতেন।

পিসিমা কুকুরটাকে। আশ্চর্য, ও কী করে অনিকে চিনতে পারল। আর-একবার কড়া নাড়তেই ভেতরে খিল খোলার শব্দ হল। দরজার কপাট খুলে যেতে অনি দেখল ছোটমা দাঁড়িয়ে আছে।

ওমা, তুমি। কী চমকে দিয়েছ, আমি ভাবলাম কে না কে। সত্যিই অবাক হয়ে গেছে ছোটমা, হাত বাড়িয়ে অনির ব্যাগটা নিয়ে কাছাকাছি হতেই আবার বলল, আরে, তুমি যে দেখছি আমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছ মাথায়!

অনি এখন চট করে কথা বলতে পারছিল না। অনেক ছোটমা জলপাইগুড়ি যায়নি। মহীতোষ একা গেছেন মাসখানেক আগে। কিন্তু একটা মানুষের চেহারা যে এই সামান্য কয়েক মাসের ব্যবধানে এত খারাপ হতে পারে ছোটমাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। কী রোগ হয়ে গেছে শরীরটা! দেখে মনে হয় ছোটমারই খুব কঠিন অসুখ হয়েছে। কিন্তু গলার ওপর অতখানি কাটা দাগ কেন? অনি সেদিকে তাকিয়ে বল, তুমি পড়ে গিয়েছিলো।

না তো! বলেই ছোটা প্রশ্নটা বুঝতে পারল, ও হ্যাঁ, খোচা লেগেছিল একবার। তা তুমি হঠাৎ করে এলে যে, স্কুল কি ছুটি।

না, ছুটি না। দাদু জোর করে পাঠালেন, বাবার নাকি খুব অসুখ, কী হয়েছে অনি ছোটমার পেছনে পেছনে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ওদের বাইরের ঘরটা সেইরকমই রয়ে গেছে। এমনকি দু-দুটো সোফার ওপরে যে কভার ছিল সেগুলো অবধি একইরকম আছে, ছিঁড়ে যায়নি। ছোটমা বলল, অসুখ মানে? বাবাকে কে খবর দিল? ছোটমা ঘুরে ওর দিকে তাকাল।

জানি না। কাল বোধহয় কেউ দাদুকে বলেছে। কিন্তু বাড়ি আসার সময় একটা রিকশার সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্টে দাদুর পা ভেঙে গেছে, আজ প্লাস্টার করে হাসপাতাল থেকে আসবে। অনি খবরটা দিল।

ও মা! কী করে হল? এখন কেমন আছেন?

ভালো।

কিন্তু ওঁর এই অবস্থায় তুমি চলে এলে কেন?

কী করব! দাদু যে জোর করে আমাকে পাঠলেন, কোনো কথা শুনতে চাইলেন না। বাবা কোন ঘরে? এখন কেমন আছেন?

খুব আস্তে ছোটমা বলবেন, এখন ভালো আছেন, ফ্যাক্টরিতে গিয়েছেন।

অবাক হয়ে গেল অনি, সে কী! তা হলে কাল যে দাদু খবর পেলেন বাবা খুব অসুস্থ! দাদু লোকের কথায় চট করে বিশ্বাস করেন। অনির মনে হল ছোটমা খুব কষ্ট করে হাসতে চেষ্টা করল।

মাঝের ঘরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল অনি। কোনো জানলা খোলা নেই, যাওয়া-আসার দরজায় ভারী পর্দা ঝোলানো। প্রায়ন্ধকার ঘরে এক কোনায় টেবিলের ওপর প্রদীপ জ্বলছে। সেই প্রদীপের আলোয় অনি দেখতে পেল মাধুরী খুব গম্ভীরমুখে তাকিয়ে আছেন। বেশ বড় ফ্রেমের চৌহদ্দিতে মাধুরীর একটা অচেনা ছবি এনলার্জড় করে ধরে রাখা হয়েছে। যেহেতু ঘরের ভেতর আলো আসার রাস্তা নেই তাই ছবির ওপর পড়া প্রদীপের আলোটা অদ্ভুতভাবে চোখ কেড়ে নেয়। অনির মনে হল মাকে যেন দেবদেবীর মতো লাগছে, এ-বাড়ির সবাই এখানে এসে পূজা করে যায়। কিন্তু এই বন্ধ ঘরে কিছুক্ষণ থাকলে দম বন্ধ হয়ে যাবে। একটা চাপা অস্বস্তি সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। মুখ ঘুরিয়ে ছোটমার দিকে তাকাতেই দেখল ছোটমা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। খুব দ্রুত অনি বলল, জানলা বন্ধ করে রেখেছ কেন,খুলে দাও।

সঙ্গে সঙ্গে ছোটমা চমকে উঠল, না না, এ-ঘরের জানলা কোলা বারণ। চলো, ভেতের যাই। ছোটমা আমার দালি না। অনি দেখল ঘরের ভেতর ঠিক ছবির সামনে একটা খাট পাতা। ঘরটা থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে ছবিটার দিকে আর-একবার তাকিয়ে ওর মনে হল মা যখন খুব গম্ভীর হয়ে যেতেন অথবা কোনো কারণে যখন মায়ের মন-খারাপ হয়ে যেত তখন এইরকম দেখাত।

ভেতরের ঘরে যেখানে অনিরা শুত সেখানে একটা ছোট ছোট খাট আর তার চারপাশের কাপড়চোপড় দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না যে এটা ছোটমার ঘর, ছোটমা একাই শোয় এখানে।

ছোটমা বলল, আগে একটু জিরিয়ে নাও, আমি তোমার জন্য খবর করি।

অনি বলল, ঝাড়িকাকু কোথায়?

ছোটমা যেন সামান্য ভ্রূকুটি করল, তুমি জান না?

অনি ঘাড় নাড়ল। ছোটমা মুখ নিচু করে বলল, তোমার বাবার সঙ্গে তর্ক করেছিল বলে উনি তাড়িয়ে দিয়েছেন। তা আমার অসুবিধে হচ্ছে না কিছু, একা মানুষ সারাদিন বসে থাকতাম, এখন কাজ করতে করতে বেশ দিনটা কেটে যায়। ছোটমা উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে অনি মনে হল ও যেন একদম অচেনা কোনো পরিবেশে চলে এসেছে।

জুতো খুলে খালিপায়ে অনি উঠোনে এসে দাঁড়াল। ঝাড়িকাকুকে বাবা ছাড়িয়ে দিয়েছেন? পিসিমা বলতেন, ঝাড়িকাকু এ-বাড়িতে এসে বাবাকে কোলে পিঠে করেছেন, কাকুকে তো মানুষ করেছেন বলা যায়। ইদানীং অনির মনে হত ও সবকিছু বুঝতে পারে, ও অনেক বড় হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখন এই কাঁঠালগাছ আর তালগাছের দিকে তাকিয়ে ও কিছুতেই বুঝতে পারল না যে বাবা কী করে ঝাড়িকাকুকে ছাড়িয়ে দেন!

বাড়ির ভেতর যে-বাগানটা ছিল সেটা অপরিষ্কার হয়ে গেছে। অনি তারের দরজা ঠেলে পেছনে এল। গোলাঘরের আশেপাশে বেশ জঙ্গল হয়ে গিয়েছে। সেদিকে এগোতেই খুব দ্রুত হাম্বা হাখা ডাক শুনতে পেল অনি। গলাটা ধরা-ধরা, কিন্তু অনি চিনতে পারল। কাছাকাছি হতে ও একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল। গোলাঘরের কাছে বিচলির স্তুপের পাশে কালীগাইকে বেধে রাখা হয়েছিল। অনিকে দেখে সে সমস্ত শক্তি দিয়ে দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। এখন ওর অনেক বয়স, শরীর হাড়জিরজিরে হয়ে গেছে, ফলে বেচারার গলায় দড়ির চাপ লাগায় চোখ বড় বড় হয়ে যাচ্ছে। অনি। দৌড়ে ওর পাশে যেতে গরুটা একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর খুব অভিমানী মেয়ের মতো মাথা নিচু করে ফেঁসফোঁস শব্দ করতে লাগল। অনি ঘাড়ে হাত রাখতেই কালী ওর লম্বা গলাটা চট করে তুলে যেন অনিকে জড়িয়ে ধরতে কোমরের কাছে ঘষতে লাগল। সেই ফোঁসফোঁস শব্দটা সমানে চলছে। অনি শব্দটার মানে বুঝতে পারছিল। বেচারার প্রচুর বয়স হয়েছে। এখন নিশ্চয়ই আর দুধ দেয় না। মা ওকে এইটুকুনি কিনে এনেছিল। তারপর ওর নাতিপুতি বিরাট বংশে গোয়ালঘর ভরতি হয়ে গেল। হঠাৎ অনির খেয়াল হল, আর-কোনো গোরুকে দেখতে পাচ্ছে না তো! কালীর আদরের চোটে যখন অস্থির তখন অনি ছোটমার গলা শুনতে পেল, তোমাকে দেখে ওর খুব আনন্দ হয়েছে, না?

অনি দেখল ছোটমা তাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। কালী ওকে সরতে দিচ্ছে না, ওর গলায় হাত বোলাতে বোলাতে অনি বলল, আর গোরুগুলো কোথায়?

ছোটমা বলল, ঝাড়ি চলে যাওয়ার পর তোমার বাবা রাগ করে সবকটাকে বিক্রি করে দিলেন।

অনি অবাক হয়ে বলল, বিক্রি করে দিলেন?

ছোটবা হাসল, দিদি খুব যত্ন করত, আমি পারি না, তাই। ঝাড়ি থাকতে ও-ই করত সব। তা যেদিন সবগুলোকে নিয়ে হাটে চলে যাবে সেদিন এই গরুটার কী কান্না। ঠিক বুঝতে পেরেছিল এবাড়ি থেকে চলে যেতে হবে। এখন তো আর দুধ দেয় না বোচারা, গায়ে জোরও নেই যে চাষ করবে, বোধহয় কেটেই ফেলত ওকে। এমনভাবে কাঁদতে কাঁদতে আমার দিকে তাকাল যে আমি পারলাম না। তোমার বাবাকে অনেক বলেকয়ে ওকে রেখে দিলাম। বেশিদিন আর বাঁচবে না।

হঠাৎ অনি আবিষ্কার করল কালীগাই-এর গলায় আদর করতে করতে কখন ওর দুই চোখ ঝাঁপসা হয়ে গেছে। ছোটমা সেই সময় ডাকল, এসো, হাতমুখ ধুয়ে জলখাবার খেয়ে নাও। সেই কোন সাতসকালে বেরিয়েছে।

ছোটমার হাতের রান্না ভালো, তরকারিটা খেতে-খেতে অনির মনে হল। একটু ঝাল-ঝাল, কিন্তু বেশ সুস্বাদ। সুচি র খুব প্রিয় জিনিস, ফুলকো হলে কথাই নেই। ঠিক এই সময় অনি নতে পেল। বাইরের ঘরের দরজায় কে যেন খুব জোরে জোরে শব্দ করছে খেতে-খেতে ও উঠতে যাবে, ছোটমা রান্নাঘর থেকে ছুটে এল, তুমি খাও, আমি দেখছি।

ভেতরের বারান্দায় জলখাবার খাবার চল এ-বাড়িতে এখনও আছে। টুলমোড়াগুলো পালটায়নি। খেতে-খেতে অনি পিসিমার পেয়ারাগাছটা তার সব ডালপালা যেন নামিয়ে দিয়েছে, বেশ ডাশা ডাঁশা পেয়ারা হয়েছে গাছটায়। এই সময় বইরের ঘরে বেশ জোরে একটা ধমক শুনতে পেল অনি, কোথায় আড্ডা মারা হচ্ছিল, অ্যাঁ? আধঘন্টা ধরে ডাকছি, দরজা খোলা নাম নেই। ছোটমা বোধহয় কিছু বলতেই চিৎকারটা জোরদার হল, কেন, আস্তে বলব কেন? বিয়ের সময় তোমার বাপ তো বলে দেয়নি তোমার কান খারাপ!

খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল, অনি উঠে দাঁড়াল। গলাট নিচে নেমে আসতে ও স্পষ্ট চিনতে পারল। আর চিনতে পেরেই হতভর হয়ে গেল। মহীতোষকে এ-গলায় কোনদিন কথা বলতে শোনেনি অনি। আজ অবধি বাবাকে কারও সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখেনি পর্যন্ত। মায়ের সঙ্গে যখন ঠাট্টা করতেন তখন বাবার গজদাঁত দেখা যেত। ও কিছুতেই মেলাতে পারছিল না। এমনকি বাবা যখন জলপাইগুড়ি যান তখনও তো এধরনের কথা বলেন না। মেয়েদের এ-বাড়িতে কেউ বকেছে এমন গলায়, মনে করতে পারছিল না অনি। তা ছাড়া, ওর যেজন্য আসা, বাবার এই গলা শুনে কিছুতেই মনে হচ্ছে না যে তার কোনো অসুখ করেছে।

ধুপ জ্বলছে না কেন, ধুপআবার চিৎকার ভেসে এল, এবার কাছে। বোধহয় বাবা এখন মাঝের ঘরে চলে এসেছেন। তবে স্বরটা কেমন কাপা-কাঁপা, সুস্থ নয়।

ছোটমার গলা শুনতে পেল ও, নিবে গেছে।

অ্যাই! গর্জনটা অভূতভাবে গোল যেন, সারাদিন খ্যাটন মারছ, একটা কাজ বললে পাওয়া যাবে না, না?

আঃ! আস্তে কথা বলো। ছোটমা যেন ধমকে উঠলেন।

ও বাবা, আবার গলায় তেজ হয়েছে দেখছি। ঝেড়ে বিষ নামিয়ে দেব?

জবাবে ছোটমা বলল, অনিমে এসেছে।

প্রথমে বোধহয় বুঝতে পারেননি বাবা, কে এসেছে। আবার কে জুটল?

ছোটমা বলল, অনিমেষ-অনি।

এবার চটপট বাবার কেমন-হয়ে-যাওয়া গলাটা কানে এল, অনি? অনি এসেছে! কোথায়? ভেতরে, খাচ্ছে। খুব নির্লিপ্ত ছোটমার গলা।

তুমি আনালে?

না, বাবা পাঠিয়েছেন তোমাকে দেখতে। অসুখের খবর পেয়েছেন কার মুখে। কাল বাবারও পা ভেঙেছে।

সে কী! কী করে?

রিকশার ধাক্কা লেগে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন। তবু ছেলেকে পাঠিয়েছেন তোমায় দেখতে, আর তুমি-। কেমন ধরা-ধরা লাগল ছোটমরা গলা।

অ্যাই, আগে বলিনি কেন যে ও এসেছে ছেলেকে দেখাতে চাও, না? প্রতিশোধ নিতে চাও, না।

তুমি আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাওনি। রোজ রোজ তুমি যা কর, আমি আর পারি না। এবার যেন কেঁদে ফেলল হোট।

সঙ্গে সঙ্গে বাবা বলে উঠলেন, অ্যাই চুপ! খবরদার এ-ঘরে দাঁড়িয়ে তুমি কাঁদবে না। ছেলেকে শোনাচ্ছ বুঝতে পারছি। খবরদার, কোনো নালিশ করবে না।

ছোটমা বলল, চমৎকার। তোমার নামে আমি ঐটুকু ছেলের কাছে নালিশ করব? গলায় দড়ি জোটে না তার চেয়ে!

বাবা বললেন, গুড। তা সে কোথায়? অনেকদিন পরে এল, না?

অনির খুব লজ্জা করছিল। বাবার গলা তার আসার খবর পেয়ে অদ্ভুতভাবে যে পালটে গেল এটা টের পেয়ে লজ্জাটা যেন আর বেড়ে গেল। মা বেঁচে থাকলে বাবা কি কখনো এরকমভাবে কথা বলতে পারত? বাবার গলা ক্রমশ এদিকে এগিয়ে আসছে। ওর ইচ্ছে করছিল দৌড়ে এখান তেকে চলে যায়, বাবার সঙ্গে এই মুহূর্তে দেখা না হলেই যেন ভালো হয়।

মহীতোষ এলেন। খুব শব্দ করে। জুতো মশমশিয়ে। বারান্দায় পা দিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। এই কয় মাসে পাউডগার মত চড়চড় করে বেড়ে গেছে শরীরটা, মাথায় মহীতোষকে ধরতে আর দেরি নাই। নিজের ছেলেকে এখন হঠাৎ লোক-লোক বলে মনে হল মহীতোষের। চোখাচোখি হতেই গলা ঝাড়লেন মহীতোষ, কখন এলে?

বাবার চেহারাটা এরকম হয়ে গেল কী করে? কেমন রোগা-রোগা, চোখের তলায় কারি, গাল ভাঙা, মাথার চুল লালচে-লালচে-মাঝে-মাঝে চিকচিক করছে। অসুখটা কী! মহীতোষ বললেন, স্কুল বন্ধ?

না। অসুখের খবর শুনে দাদু জোর করে পাঠালেন।

অসুখ? কার অসুখ? আরে না না, কে এসব বাজে কথা রটায়! আমি ভালো আছি। স্কুল যখন খোলা তখন তোমার আসা উচিত হয়নি। তোমার মা থাকলে রাগ করতেন। তোমার এখন ফার্স্ট ডিউটি অধ্যয়ন! তোমার মায়ের ঘরে গিয়েছ। মহীতোষ চোখ বড় বড় করে তাকালেন।

অনির হঠাৎ মনে হল বাবা ঠিক স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন না। কথাগুলো যেন অসংলগ্ন এবং সেটা তিনি নিজেও টের পাচ্ছেন। মায়ের ঘর মানে? যে-ঘরে মায়ের ছবি আছে সেই ঘর? ও না-বুঝে ঘাড় নাড়ল।

মহীতোষ বললেন, শুড।–ঘরে গিয়ে চুপচাপ করে বসে থাকলে দেখবে, ইউ ক্যান ফিল হার। অনি লক্ষ করল কথাটা বলার সময় বাবার চোখ কেমন জ্বলজ্বল করে উঠল। ওর মনে পড়ল ছোটমা খবর দেওয়া সত্ত্বেও বাবা দাদুর অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলেছেন না কিছু। ও ঠিক করল, না বললে সেও কিছু জানাবে না। কারণ ওর মনে হল বাবার মাথায় এখন অন্য কোনো চিন্তা রয়েছে, দাদুর কথাটা একদম ভুলে গিয়েছেন।

ছোটমাকে রান্নাঘর থেকে জলখাবার নিয়ে বের হতে দেখে বাবা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ারেন, আচ্ছা, তুমি তা হলে আজকের দিনটা থাক অনি। স্কুল কামাই করা ঠিক নয়। দাদুর ওখানে তোমাকে রেখেছি-হ্যাঁ, দাদুর নাকি পা ভেঙে গেছে, রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লেগে?

অনি ঘাড় নাড়ল, কাল বিকেলে হয়েছে, হাসপাতালে ছিলেন। আজ প্লাস্টার করে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।

এবার যেন মহীতোষের কানে-শোনা চেহারাটাকেই সামনাসামনি দেখতে পেল অনি, অ্যা! দাদুকে হাসপাতালে রেখে তুমি চলে এসেছ। আশ্চর্য অকৃতজ্ঞ ছেলে। লেখাপড়া শিখে তুমি বদর তৈরি হচ্ছ যে তোমাকে বুকে আগলে রেখেছে তার প্রতি কর্তব্য বলে কিছু নেই? ছি ছি ছি।

জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে এসব শব্দ দিয়ে তৈরি কড়া বাক্য শোনাল। অনি বাবার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সমস্ত শরীরে একটা আলোড়ন অনুভব করল। তারপর কোনোরকমে বলল, আমি আসতে চাইনি, দাদু জোর করে পাঠালেন। এখন অনির রি কান্না পাচ্ছিল না, এত শক্ত কথা শুনেও ওর ভেতরে কোনো অভিমান হচ্ছিল না। বরং ও খুব শক্ত হয়ে সিটিয়ে দাঁড়াল।

তুমি আসতে চাওনি, গুড গুড। তা এই প্রথম বাপ-মায়ের কথা মনে পড়ল? গিয়েছ তো অনেকদিন, আমরা এখানে আছি খোঁজ রেখেছ! আমি আসতে চাইনি-তা তো করবেই!মহীতোষ। কেমন ঠাট্টা অথচ রাগরাগ গলায় বললেন। এর জবাব কী দেবে অনি? মা থাকতে বাবা তাকে আনতে চাননি। এখন এলেও দোষ, না-এলেও দোষ। অনি কোনো কথা বলছে না দেখে মহীতোষ ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর দুপা এগিয়ে অনির কাঁধে হাত রাখলেন, রাগ কোরো না, একটু বুঝতে শেখো। তোমার মা তো তোমার জন্যই মারা গেলেন।

চমকে উঠল অনি, আমার জন্য?

ঘাড় নাড়ালেন মহীতোষ, হ্যাঁ। তোমার জেলে যাবার ভবিষ্যদ্বাণীটা শোনার পর থেকেই ছটফট করছিল। না হলে বৃষ্টির মধ্যে কেউ ঐ অবস্থায় ছাদে আসে। আমিও দোষী, বুঝলি অনি, আমি যদি তখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। ওর চলে যাওয়ার জন্য আমরা সবাই দায়ী।

হঠাৎ ছোটমার গলা মহীতোষের যেন বাধা দিল, অনেক হয়েছে, ছেলেটা এল আর সঙ্গে সঙ্গে ওকে নিয়ে পড়লে। ওকে ছেড়ে দাও। লুচির থালাটা টেবিলের ওপর রাখল ছোটমা।

মহীতোষ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার মা আমার সঙ্গে এভাবে কোনোদিন কথা বলেনি।

অনি কোনোদিন উত্তর দিল না। বাবার দিকে না তাকিয়ে আস্তে-আস্তে উঠোনে নেমে এল। এই মুহর্তে ও বাবাকে যেন সহ্য করতে পারছিল না।

বাইরের খোলা মাঠে একাশ ছাগল গলায় ঘন্টি বেঁধে টুংটুং শব্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনি আচ্ছন্নের মতো সেখানে এসে দাঁড়াল। এখন মনে হচ্ছে এই বাড়িতে ওর কোনো জোর নেই। নিজের বাড়ি বলে ও আর ভাবতে পারছে না। এখন যদি জলপাইগুড়িতে চলে যেতে পারত। ও ঠিক করল বিকেলের বাসে ফিরে পাবে। বাবা কী করে বদলে গেলেন! বাবার এই চেহারাটা জলপাইগুড়িতে ওরা কেউ টের পায়নি।

সামনের আসাম রোড দিয়ে হশহুশ করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। একরাশ মদেসিয়া মেয়ে পিঠে টুকরি বেঁধে চা-পাতি নিয়ে ফ্যাক্টরি দিকে ফিরে যাচ্ছে। অনি কোয়ার্টারগুলোর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। মাথার ওপর ঠা-ঠা রোদ এখন। বিশু বা বাপীরা এখন নিশ্চয়ই স্কুলে। সীতাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে অনি শুনতে পেল কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। ও দেখল বাড়ির জানালায় সীতার ঠাকুমা বসে আছেন। ওকে তাকাতে দেখে ঠাকুমা রোজ বিকেলে ওদের বাড়িতে পিসিমার কাছে বেড়াতে লাগল। অনি যখন এখানে থাকত তখন ঠাকুমা রোজ বিকেলে ওদের বাড়িতে পিসিমার কাছে বেড়াতে আসতেন। ঠাকুমার কাছে ওরা কত মজার গল্প শুনেছে।

গেট খুলে বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠল অনি সীতাদের কোয়ার্টারটা একই রকম আছে, চোখ বন্ধ করে ও ঘোরাফেরা করতে পারে। বাঁদিকের ঘরে ঠাকুমা বসে আছেন। ওকে দেখেই ফোকলা দাঁতে বলে উঠলেন, আয় দাদু, কাছে এসে বোস, কখন এলি?

ঠাকুমার চেহারা একই রকম আছে। বিছানার ওপর ছড়ানো পা দুটো দেখল অনি, বেশ ফোলাফো।চোখে বড় কম দেখি আজকাল, তাই ভাবলাম সত্যি দেখছি তো! কী লম্বা হয়ে গেছিস দাদু, আয় কাছে এসে বোস।

হাত বাড়িয়ে বিছানার একটা ধার দেখিয়ে দিতে অনি সেখানে বসল, কেমন আছ ঠাকুমা?

ওমা, গলার স্বর দ্যাখ, একদম ব্যাটাছেলে-ব্যাটাছেলে লাগছে। তা হ্যাঁ দাদু, এখান থেকে চলে গিয়ে আমাদের এমন করে ভুলে যেতে হয়? ঠাকুমা তার শির-বার-করা হাত অনির গায়ে বোলাতে লাগলেন।

মনটা কেমন হয়ে যাচ্ছিল অনির,আস্তে-আস্তে বলল, তুমি একইরকম আছ।

সে কী! দুরকম হতে যাব কেন? কিন্তু আজকাল একদম হাঁটতে পারি না রে, বাতে পেড়ে ফেলেছে, পা দুটো দ্যাখ, কলাগাছ। কবে যে ছাই যমের কচি হবে। সে-বেটি তো স্বার্থপরের মতো কলা দেখিয়ে চলে গেছে। ঠাকুমার শেষ কথাটা শুনে অনি ওঁর মুখের দিকে তাকাতেই তিনি কেঁদে ফেললেন, গৃহপ্রবেশে যাবার আগে আমায় বলে গেল তোমার ওপর সব দায়িত্ব, এবার দিদি নেই। তা আমি বসে আটখানা কাঁথা সেলাই করে রেখেছিলাম, মাধুর বড় ইচ্ছে ছিল মেয়ে হোক এবার। ড়ুকবে-ওঠা কান্নাটাকে কোনোরকমে সামলে আবার বললেন, তা সেসব কথা আমার কাছে পড়েই রইল। মহীকে এত করে জিজ্ঞাসা করলাম, বাঁচাতে পারলি না কেন? জবাব দেয় না।

মায়ের কথা ঠাকুমা এভাবে বলবেন আন্দাজ করতে পারেনি অনি। এসব কথা শুনেও ওর কান্না পাচ্ছে না কেন আজ? হঠাৎ ঠাকুমা গলা নামিয়ে যেন কোনো গোপন কথা বলছেন এই ভঙ্গিতে বললেন, তোর সত্য বড় ভালো মেয়ে রে! এত লোককে দেখলাম, মেয়ে দেখলে আমি চিনতে পারব না? বেশ মেয়ে, কিন্তু বড় দুখি। তুই ওকে কষ্ট দিস না ভাই।

হাসতে চেষ্টা করল অনি, কী যা-তা বলছ! আমি কষ্ট দিতে যাব কেন?

ঠাকুমা যেন কী বলতে গিয়ে বললেন না। তারপর প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, তোর দাদু কেমন আছে রে?

অনি দাদুর খবরটা দিতেই মাথা নাড়তে লাগলেন, বুড়ি, এই বয়সে পা ভাঙলে কি আর জোড়া লাগে। দেখেশুনে তো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হয়। তা হ্যাঁ দাদু, তেনার পা সেরে গেলে শিগগির একবার নিয়ে আসতে পারবি?

কেন?

দরকার আছে ভাই। নইলে যে সব ভেসে যাবে। আমি তো বিছানা থেকে উঠতে পারি না, আমার কথা কে শোনে। কিন্তু আমার কানে তো সবই আসে। দাদুভাই, আমাদের সবাইকে ভগবান নিজের নিজের জায়গায় থাকতে দিয়েছেন, আমরা যদি বাড়াবাড়ি করি তবে তিনি সইবেন কেন? তা তুই কিন্তু মনে করে তেনাকে বলিস।

ব্যাপারটা কেমন অস্পষ্ট অথচ কিছু-একটার ইঙ্গিত পাচ্ছে অনি। ও জানে ঠাকুমাকে, এ-বিষয়ে বেশি প্রশ্ন করে লাভ হবে না।

ঠাকুমা হঠাৎ চিৎকার শুরু করেন, ও বউমা, দ্যাখো কে এসেছে! তোমার বন্ধুর ছেলে গো।

সাধারণত চা-বাগানের এইসব কোয়ার্টারের রান্নাঘর একটু দূরে, উঠোন পেরিয়েই বেশি ভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। সেখান থেকে মহিলাকণ্ঠে সাড়া এল।

অনি বলল, সীতা কোথায়? স্কুলে

সে-মুখপুড়ি গলা ফুলিয়ে বিছানায় কাত হয়ে আছে। যা না, পাশের ঘরে গিয়ে দ্যাখ-না, দুদিনের জলে কী চেহারা হয়েছে।

অনি উঠে পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। এখানে দাঁড়িয়েই ও সীতাকে দেখতে পেল। একটা বড় খাটের ঠিক মধ্যখানে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মুখটা ঘামে ভরতি। চোখ দুটো বোজা-অঘোরে ঘুমুচ্ছে। শব্দ না করে পাশে এসে দাঁড়ালানি। বোধহয় জ্বর ছাড়ছে ওর, বালিশ অবধি ঘামে ভিজে গেছে। ঘুমালে মানুষের মুখ কেমন আদুরে-আদুরে হয়ে যায়।

ডাকতে মায়া হল অনির, ফিরে যাবে বলে মুরতেই ও সীতার মাকে দেখতে পেল। রান্না করতে করতে বোধহয় ছুটে এসেছেন, ও মা, অনি কখন এলি? দেখেছেন মা, কী লম্বা হয়ে গেছে।

ঠাকুমা বললেন, ওদের গুষ্টির ধাত লম্বা হওয়া।

এই তো আজ সকালে। অনি হাসল।

তোর নাকি এত পড়ার চাপ যে আসবার সময় পাস না? সীতার মা বললেন।

অনি বলল, কে বলল?

তোর নতুন মা। কথাটা বলেই দ্র মহিলা চট করে শাশুড়ির দিকে তাকালেন। তারপর বলে উঠলেন, দড়িয়ে কেন, বোস। আজকে নাড় বানিয়েছি, খেয়ে যা। ছেলেবেলায় ও নাড় খেতে ভালোবাসত, না মা?

ঠাকুমা হাসলেন, একবার হেমের ঠাকুরঘরের নাড় চুরি করে খেয়েছিল বলে দশবার ওঠ-বোস করেছিল।

অনি বলল, আজ থাক ঠাকুমা। আমি এইমাত্র খেয়ে আসছি।

ঠাকুমা বললেন, পাক মানে? এ-বাড়ি থেকে না খেয়ে যাবি বড় হয়ে গেছিস বুঝি! আর ওমেয়েটা যদি ঘুম থেকে উঠে শোনে যে তুই এসে না কথা বলে চলে গেছিস তা হলে আমাকে আস্ত রাখবে?

সীতার মা বললেন, তুমি ওকে ডেকে তোলো, অবেলায় ঘুমোচ্ছে। আমি তোমার নাড় নিয়ে আসছি। রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি।

অনি আবার সীতার দিকে ফিরে তাকাল। ঠোঁটটা ঈষৎ ফাঁক হয়ে থাকায় সাদা দাঁত চিকচিক করছে। মুক্তোর মতো ঘামের ফোঁটা কপালময়, গলায় ছড়ানো। রুক্ষ একরাশ চুপ কেঁপে ফুলে বালিশটাকে অন্ধকার করে রেখেছে। হঠাৎ অনির খুব অস্বস্তি হতে আরম্ভ করল। ও ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ঠাকুমা পাশের ঘরের খাটে বসে খোলা দরজা দিয়ে তাকে দেখছেন। চোখাচোখি হতে হেসে বললেন, কী, কী হল, চেঁচির ডাক। মেয়েটা একটু কালা আছে।

হঠাৎ অনির মনে পড়ল ছেলেবেলায় সীতা কানে একটু কম শুনত। ও এবার ঝুঁকে পড়ে চেঁচিয়ে ডাকল, সীতা সীতা।

আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে যে-অস্বচ্ছতা থাকে সেটা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগল সীতার। মুখের সামনে একটি অনভ্যস্ত মুখ দেখতে পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

একটু সময় উঠতে দিয়ে অনি বলল, খুব ভয় পেয়ে গেছিস, না।

খুব দ্রুত খাটের উপর বাবু হয়ে বসে গায়ের চাদরটা শরীরে জড়িয়ে নিতে নিতে সীতা হাসতে চেষ্টা করল, দুর্বলতার হাসিটা সচ্ছল হল না, শেষ পর্যন্ত আমাদের মনে পড়ল?

জবাব দিতে গিয়ে কথা আটকে গেল অনির। সীতা কেমন বড়দের মতো কথা বলছে। এখন ও বসে আছে গায়ে চাদর জড়িয়ে, কিন্তু তবু কেমন বড় বড় দেখাচ্ছে। যুতসই উত্তর খুঁজে না পেয়ে সামান্য হাসল অনি, জ্বর বাধিয়ে বসে আছিস?

এই একটু। কখন আসা হল? সীতার বোধহয় অস্বস্তি হচ্ছিল, খাট থেকে নেমে দাঁড়াল।

অনি বলল, সকালে। তুই শো, উঠলি কেন?

সারাক্ষণ তো শুয়ে আছি। তা নিজের থেকে আমাদের বাড়িতে আসা হয়েছে, না ঠাকুমা ডাকল? সীতা চোখ বড় বড় করল।

এখন এই মুহূর্তে সত্যি কথাটা বলতে অনির ইচ্ছে করছিল না। ওকে ইতস্তত করতে দেখে সীতা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠাকুমা, তুমি ওকে ডেকেছ, না?

বুড়ি প্রথমে ঠাওর না করতে পারলেও শেষে বললেন, ও আসব-আসব করছি আর আমিও ডেকে ফেললাম, কেন, কী হয়েছে।

সীতা বলল, জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়ে তো, আমাদের এখানে আসা মানায় না।

ঠাকুমা হেসে বললেন, পাগলি!

অনি ঘাড় নাড়ল, ঠিক ঠিক। এখনও বাচ্চা আছিস তুই।

চোখের কোণে তাকাল সীতা, তাই নাকি? এখনও হাফপ্যান্ট পরা হয় কিন্তু!

অনি চট করে জিভটা সামলে নিল। ও সীতাকে বলতে পারত যে, সে-ও ফ্রক পরে, কিন্তু ক্রমশ টের পাচ্ছিল সীতা যেন ওর চেয়ে অনেক বেশি বুঝে কথা বলে। সেই ছেলেবেলার সীতা যে কিনা শক্ত হাতে হাত ধরলে কেঁদে ফেলত, সে কেমন করে কথা বলছে দ্যাখো।

প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল অনি, বিশু বাপীদের খবর কী রে?

পিঠের ফুলে-থাকা ডানগোছের চুলটাকে সামনে এনে সীতা আঙুলে তার ডগা জড়াতে জড়াতে বলল, বিও তো কুচবিহারে জেঙ্কিংস স্কুলে পড়ছে। চিঠি লেখালেখি পর্যন্ত হয় না?

ঘাড় নাড় অনি, না।

চমকার! আমি ভাবলাম শুধু আমিই বঞ্চিত। আর বাপীর কথা না-বলাই ভালো। অন্যের কাছে শুনলেই হয়। সীতা গভীরমুখে বলে আবার খাটে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। বোধহয় দাঁড়াতে ওর কষ্ট হচ্ছিল।

কেন, কী হয়েছে ওর?

খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে বাপী। মেয়েদের টিটকিরি দেয়, সাইকেল নিয়ে পেছন পেছন ঘোরে। রাজারহাট স্কুলে ভরতি হয়েছিল, যায়ই না। মুখ বাঁকাল সীতা।

তোকে কিছু বলেছে। বাপীর চেহারাটা ও এই বর্ণনার সঙ্গে মেলাতে পারছিল না।

ইস, অত সাহস আছে। একদিন রাস্তায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলেছিস-এই সীতা, রাবণ এলে খবর দিল, কী অসভ্য ছেলে!

আমি খুব চ্যাঁচামেচি করে উঠতে ও পালিয়ে গেল। যাবার আগে কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বলে গেল, তুই আমাদের সেই সীঅতো রে, বড় হয়ে গেলে তোরা সব কেমন হয়ে যাস। ও চলে গেলে দম ফেলে বাচি বাবা। সীতা বুকে হাত রাখল, জানি না, আমার সামনে যিনি আছেন তিনি শহরে এসব করেন কি না! দেখে তো মনে হয় খুব শান্তশিষ্ট।

হঠাৎ অনি আবিষ্কার করল যে, সীতা ওকে এতক্ষণ ধরে তুই বা তুমি কোনেটাই বলছে না। এভাবে সম্বোধন না করে কথা বলা খুব সহজ নয়, কিন্তু সীতা বেশ অবলীলায় তা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই সময় সীতার মা এক ডিশ খাবার-হাতে ঘরে এলেন। অনি দেখল, তিল আঁর নারকেলের নাড় তে ডিশটা সাজানো, সন্দেশও আছে।

সীতার মা বললেন, নাও, খেয়ে নাও। তুমি যা ভালোবাস তা-ই দিলাম।

খাবার দেখে আঁতকে উঠল অনি, এখনও পেট ভরাট, এত খেতে পারব না।

সীতা হঠাৎ হেসে উঠল শব্দ করে, ও ঠাকুমা, শুনছ, তোমার নাড় গোপাল বলছে খেতে পারবে, শহরের জল পেটে পড়লে সব পালটে যায়।

অনি একটু ধমকের গলায় বলল, খুব পাকা-পাকা কথা বলছিস তুই।

সীতার মা বললেন, ঠিক বলেছ তুমি। ভীষণ অসভ্য মেয়ে। ভাবছি এবার ওকে এখানকার স্কুল থেকে ছাড়িয়ে জলপাইগুড়িতে তপুদের স্কুলে পাঠিয়ে দেব। হোস্টেল আছে, বেশ হবে তখন।

পাশের ঘরে খাটের ওপর বসে ঠাকুমা বললেন, মেয়ে হয়েছে যখন, তখন পরের ঘরের তো যাবেই একদিন, এখন থেকে বাড়ির বাইরে পাঠানোর কী দরকার?

সীতার মা বললেন, না, এখানে ওর পড়াশুনা হচ্ছে না।

ঠাকুমা বললেন, জন্মেছে তো হাঁড়িবুনতি ঠেলতে-বিদ্যে নিয়েও তো সেই একই গতি। মেয়েকে পড়াশুনা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে দেবো

চট করে কথাটার জবাব দিলেন না সীতার মা, যা-ই বলুন,শহরের ভালো স্কুলে পড়লে চেহারাই অন্যরকম হয়ে যায়। এই দেখুন আমাদের অনিকে, এখানকার ছেলেদের চেয়ে কত আলাদা, দেখলেই বোঝা যায়।

সীতা ফুট কাটল, নড় গোপাল-নাড় গোপাল!

সীতার মা মেয়েকে ধমক দিলেন।

অনি যতটা পারে খেল, তারপর খানিকক্ষণ গল্প করে চলে আসার জন্য উঠল। ঠাকুমা আবার দাদুকে বলার জন্য অনিকে মনে করিয়ে দিলেন। বাইরে এখন রোদ নেই বলা যায়। একটা বিরাট মেঘ ভুটানের পাহাড় তেকে ভেসে এসে এই স্বৰ্গছেঁড়ার ওপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাই চারধার কেমন ছায়া-ছায়া।

সীতা বাইরের দরজা অবধি হেঁটে এসে জিজ্ঞাসা করল, কবে যাওয়া হবে?

অনি বলল, বোধহয় কাল।

কেমন উদাস গলায় সীতা বলল, আজ বিকেলে কি বাপীর সঙ্গে আড্ডা মারা হচ্ছে?

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল অনি, কেন?

এখানে এলেই হয়। সীতা দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর গায়ে এখন চাদর নেই। জুর না থাকলেও তার ছাপটা মুখে স্পষ্ট। ওর শরীর এবং পায়ের দিকে তাকাতেই অনির মনে হল-সীতা খুব বড় হয়ে গেছে। সেই কামিনটার মতো সীতার শরীর এখন। চাহনিটা দেখে বোধহয় সীতা সোজা হয়ে দাঁড়াল, বিকেলে না এলে আর কথা বলব না। অসভ্য! বলে সীতা দ্রুতপায়ে ভেতরে চলে গেল।

হঠাৎ অনির বুকের ভিতর কী যেন কেমন করে উঠল। সীতাকে আর-একবার দেখার জন্য মুখ ফিরিয়ে ও দেখল জানলায় বসে ঠাকুমা ওর দিকে চেয়ে আছেন।

বাগানের এলাকা আসাম রোড ধরে বাজারের দিকে হাঁটতে বেশ অবাক হয়ে গেল অনি। দুপাশে এত দোকানপাট হয়ে গেছে যে, জায়গাটাতে চেনাই যায় না। আগে যেসব জায়গায় শুধু হাটবারে ত্রিপল টাঙিয়ে দোকান বসত সেখানে বেশ মজবুত কাঠোর দোকানঘর দেখতে পেল সে। দোকানদারের অধিকাংশই অচেনা, বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে প্রচুর লোক স্বৰ্গছেঁড়ায় এসে স্থায়ী আস্তানা গেড়ে বসেছে। শুয়োরকাটার মাঠটা ছাড়িয়ে আগে নদী, ওপারের ধানক্ষেত স্পষ্ট দেখা যেত, এখন সব আড়ালে পড়ে গিয়েছে।

বিলাসের মিষ্টির দোকানটা বেশ বড় হয়েছে যেন, নতুন শো-কেসের মধ্যে মিষ্টির ডালাগুলো দূর থেকে দেখা যায়। বিলাসকে কাছেপিঠে দেখল না সে। আঙরাভাসা নদীর পুলটার ওপরে এসে দাঁড়াল অনি। নিচে লকগেটের তলা দিয়ে সেইরকম জল প্রচণ্ড স্রোতে ফেনা ছড়িয়ে বয়ে যাচ্ছে ওদের কোয়ার্টারের পিছনদিক দিয়ে ফ্যাক্টরির হুইল ঘোরাতে। অনির মনে পড়ল বাপী একবার বলেছিল, এখান থেকে সাঁতরে বাড়িল পেছন অবধি যাবে, আর যাওয়া হয়নি। বাপীটা এরকম হয়ে গেল কী করে? মেয়েদের টিটকিরি দিলে কী লাভ হয়? বরং সীতার মতো মেয়েরা তো চ্যাঁচামেচি করবে। তা ছাড়া খামোক টিটকিরি দেবেই-বা কেন?

ভরত হাজামের দোকানটা নেই। সেখানে এখন বেশ বড়সড় সেলুন হয়েছে, ওপরে সাইনবোর্ডে নাম পড়ল অনি, কেশচর্চা। রাস্তা থেকেই ভেতরের বড় বড় আয়না, চেয়ার দেখা যায়। বুকে সাদাকাপড় বেঁধে তিনজন লোক চুল কাটছে খদ্দেরের। সেই ল্যাংডা কুকুর বা বরত হাজাম, কাউকে কাছেপিঠে চোখে পড়ল না। নাচ বুড়িয়া নাচ, কান্ধে পর নাচ-অনি হেসে ফেলল।

চৌমাথায় এসে অনির চমক আরও বেড়ে গেল। স্বৰ্গছেঁড়া যেন রাতারাতি শহর হয়ে গেছে। পুরো চৌমাথা ঘিরে পান-সিগারেট, রেস্টুরেন্ট আর স্টেশনারি দোকানে ছেয়ে গেছে। ওপাশের পেট্রলপাম্পের গায়ে অনেক নতুন নতুন সাইনবোর্ড ঝুলছে। সকাল-পেরিয়ে-যাওয়া এই সময়টায় আগে স্বৰ্গছেঁড়ার রাস্তায় লোকজন থাকত না বললেই চলে, এখন জলপাইগুড়ির মতো জমজমাট হয়ে আছে। এমন সময় কুচবিহার-জলপাইগুড়ি রুটের একটা বাস এসে স্ট্যাণ্ডে দাঁড়াতে অনি সেদিকে তাকাল। দুতিনজন কুলি মাল বইবার জন্য ছুটে গেল সেদিকে। তাদের একজনের দিকে নজর পড়তে অনি সোজা হয়ে দাঁড়াল, ঝাড়িকাকু। হাফপ্যান্ট আর ময়লা একটা ফতুয়ামাতন পরে বাসের মাথার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, স্বৰ্গছেঁড়ায় এখন কেউ মালপত্র নিয়ে নামল না। অনির মনে। হচ্ছিল, ও ভুল দেখছে। সেই ঝাড়িকাকু এখন কুলিগিরি করছে! ভিড়টা একটু হালকা হতে ঝাড়িকাকু ঘুরে দাঁড়াতে রাস্তার এপাশে দাঁড়ানো অনির সঙ্গে চোখাচোখি হল। অনি দেখল, পথমে যেন চিনতে পারেনি চট করে। তারপর হঠাৎ ঝাড়িকাকুর চেহারাটা একদম অন্যরকম গেল। যেন অনিকে দেখেনি এমন ভান করে দ্রুত পা চালিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে চাইল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনি আর দেরি করল না। পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করতে লাগল, ও ঝাড়িকাকু, ঝাড়িকাকু।

কয়েক পা হেঁটে বোধহয় আর এড়াতে পারল না, ঝাড়িকাকু দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল অনি, আরে, তুমি আমাকে দেখেও চলে চ্ছিলে কেন? ঝাড়িকাকুর একটা হাত ধরল সে। খুব বুড়িয়ে গেছে ঝাড়িকাকু। মুখে কাঁচাপাকা খোচা-খোচা দাড়ি। গাল থরথর করে কাঁপছে। তার পরই মুখ বিকৃত করে অতবড় মানুষটা একটা কান্না চাপবার চেষ্টা করে যেতে লাগল প্রাণপণে। কারও চোখে জল দেখলেই অনির চোখ কেমন করে উঠে, এই, তুমি কাঁদছ কেন?

এবার হাউমাউ করে উঠল ঝাড়িকাকু, তোর বাবা আমাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে রে, এই একটুখানি দেখেছি যে-মহীকে সে আমাকে দূর করে দিল।

এরকম একটা দৃশ্য প্রকাশ্য চৌমাথায় ঘটতে দেখে মুহূর্তেই বেশ ভিড় জমে গেল। দুতিনজন কুলিগোছের লোক ঝাড়িকাকুকে বারংবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল, কী হয়েছে। কোন শালা মেরেছে? ঝাড়িকাকু কারও কথার জবাব দিচ্ছিল না বটে, কিন্তু অনির খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। সবাই তার দিকে সন্দেহের চোখে ও তাকাচ্ছে এটা বুঝতে পারছিল সে। যারা অনিকে চিনতে পারছে তারা কেউ-কেউ বলতে লাগল, নিজের হাতে মানুষ করেছে-এ বাবা নাড়ির বাধনের চেয়ে বেশি। ভিড়টা যখন বেশ বড়সড় হয়ে উঠেছে, এমন সময় দু-তিনটে সাইকেল খুব জোরে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে ওদের পাশে এসে ব্রেক কষে দাঁড়াল। কী খেলা হচ্ছে, পকেটমার নাকি গলাটা খুব চেনা-চেনা মনে হল অনির, সামনে মানুষের আড়াল থাকায় দেখতে পাচ্ছিল না। আর দুজন কী-একটা বলে এগিয়ে আসতেই ভিড়টা চট করে হালকা হয়ে গেল। অনি দেখল, একটা লম্বাটে ছেলে এসে ওদের দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠল, ক্রাইং কেস!

সে আবার কী! ওপাশে সাইকেলে ভর দিয়ে কথাটা যে বলল তাকে এবার দেখতে পেল অনি। চোখাচোখি হলে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর অনি কিছু বোঝার আগেই বাপী তীরের মতো ছুটো এসে জড়িয়ে ধরল। ঝনঝন করে একটা সাইকেলকে মাটিতে পড়ে যেতে শুনল সে। সেদিকে কান না দিয়ে বাপী ততক্ষণ একনাগাড়ে কীসব বলে গিয়ে শেষ করল, গুড বয় হয়ে শেষ করল, গুড বয় হয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে ভুলে গেলি, অনি?

ভীষণ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল অনি, না, ভুলব কেন? তুইও তো আমাকে চিঠি দিস না?

বাপী বলল, ভেবেছিলাম দেব, কিন্তু এত বানান ভুল হয়ে যায় না যে লজ্জা করে। আমি-না খুব খারাপ হয়ে গেছি, সবাই বলে।

কেন? খারাপ হতে যাবি কেন? অনির কেমন কষ্ট হচ্ছিল।

দূর শালা, তা আমি জানি নাকি! এই শোন, আমি এখন বীরপাড়ায় যাচ্ছি, একটা ঝামেলা হয়েছে, সামলাতে হবে। বিকেলবেলায় দেখা হবে, হ্যাঁ? অনি ঘাড় নাড়তেই বাপী দৌড়ে সাইকেলটাকে মাটি থেকে তুলে লাফিয়ে সিটে উঠল। অনি দেখল ওর দুই সঙ্গীকে নিয়ে তিনটে সাইকেল দ্রুত বীরপাড়ার দিকে চলে গেল।

বোধহয় অন্য একটা ঘটনা সামনে ঘটে যাওয়ায় ঝাড়িকাকু সামলে নিয়েছিল এরই মধ্যে। বাপীরা চলে গেলে কয়েকজন দূর থেকে ওদের দেখতে লাগল, কিন্তু আগের মতো কাছে এসে ভিড় করল না। অনি দেখল লঙ্কাপাড়া থেকে একটা প্রাইভেট বাস এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই কুলিরা সেদিকে ছুটে গেল। ঝাড়িকাকু একবারও বাসটার দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কখন এলি? কর্তাবাবু কেমন আছে?

সকালে। দাদুর পা ভেঙে গেছে কাল, এমনিতে ভালো আছে।

সে কী! পা ভাঙল কেন? এই বুড়ো বয়সে-পড়ে গিয়েছিল?

না, রিকশায় ধাক্কা লেগেছিল।

শুনে ঝাড়িকাকু জিভ দিয়ে কেমন একটা চুক চুক শব্দ করল।

দিদি কেমন আছো ভালো।

কিন্তু তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো নেই রে! ঝাড়িকাকু ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগল স্কুলের রাস্তায়।

যদিও শরীর দেখেই বোঝা যায় তবু অনি জিজ্ঞাসা করল, কেন?

আমার যে কেউ নেই রে! ঝাড়িকাকু ওকে নিয়ে হাঁটতে লাগল স্কুলের রাস্তায়।

যদিও শরীর দেখেই বোঝা যায় তবু অনি জিজ্ঞাসা করল, কেন?

আমার যে কেউ নেই রে, একা কি ভালো থাকা যায়! অনি কথাটা শুনে ঝাড়িকাকুর হাতটা চট করে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগল। ঝাড়িকাকু বলল, তুই আমার সঙ্গে হাঁটছিস দেখলে মহী রাগ করবে।

কেন, রাগ করবে কেন? তুমি কি আমার পর?

তুই যে কবে বড় হবি!

আমি তো বড় হয়েছি, তোমার চেয়ে লম্বা!

এই বড় নয়-যে-বড় হলে মহীর মতো আমাকে চড় মারা যায়!

কেন আমাকে মেরেছিল বাবা? কী করেছিলে তুমি?

কী হবে সেকথা শুনে! হাজার হোক মহী তোর বাবা, বাবার নিন্দে কোনো ছেলের শুনতে নেই। মুখ ঘুরিয়ে নিল ঝাড়িকাকু।

তবু অনি জেদ ধরল, মা বলত সত্যি কথা বললে শুনলে কোনো পাপ হয় না।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ঝাড়িকাকু, মা! তোর মায়ের কথা মনে আছে?

অবাক হয়ে গেল অনি, কেন থাকবে না! সব মনে আছে।

আমি খবরটা শুনে বিশ্বাস করতে পারিনি। এই সেদিন কর্তাবাবু মহীকে বিয়ে দিয়ে নিয়ে এলেন তোর মাকে। তারপর তুই হলি-কী যে হয়ে যায় সব! তোর মা চলে গেলে মহীটা একদম ভেঙে পড়েছিল। তখন রোজ রাত্রে ওর ঘরে শুতাম আমি। এক শুলেই কান্নাকাটি করত। ওর খাটের পাশে মাটিতে শুয়ে আমি শুধু তোর মায়ের কথা ছাড়া সব গল্প করতাম। ঝাড়িকাকু কথা থামিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল।

এসব খবর অনির জানা নেই। ঝাড়িকাকু কোনোরকমে তখন বাবাকে রান্না করে খাওয়াচ্ছে-এই খবরটাই শুনেছিল শুধু। তাই বাকিটা শোনার জন্য বলল, তারপর?

বাঁ হাতের ডানায় চট করে মুখটা ঘষে নিয়ে ঝাড়িকাকু বলল, তারপর যখন মহীর আবার বিয়ের কথা উঠল তখন ও কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। আমারও পছন্দ ছিল না। কিন্তু অন্য বাবুরা বুঝিয়েসুঝিয়ে ওর মত করিয়ে বিয়ে দিয়ে দিল। হঠাৎ ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঝাড়িকাকু বলল, তোর মায়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে।

হেসে ফেলল অনি, বা রে! কেন হবে না।

ঝাড়িকাকু বলল, বড় ভালো মেয়ে রে। বিয়ের পর বছর তিনেক তো বেশ ভালো সবই। আমি ভাবতাম, যাক, এই ভালো হল। তোর মায়ের অভাব টের পেতে দিত না মেয়েটা। এমনকি আমার সঙ্গে থেকে গোরুর কাজও শিখে নিয়েছিল। যে গেছে তার জন্যে মানুষ কতদিন দুঃখ করতে পারে! কিন্তু এই মেয়েটা রাতারাতি যেন এই বাড়ির লোক হয়ে গেল।

আরে! তুমি আমাদের বড়বাবুর নাতি না।

অনি মুখ ঘুরিয়ে দেখল, একজন বৃদ্ধমতন লোক ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। মাথা নাড়ল অনি, হ্যাঁ।

বড়বাবু কেমন আছেন? বৃদ্ধ যেখানে দাঁড়িয়ে তার পিছনে বিরাট স-মিল। অনি এতক্ষণ চিনতে পারল। ওঁর নাম হারাণচন্দ্র পাল। খুব বড়লোক। দু-তিনটে স-মিল আছে, বাস-ফাস, জমি-টমি আছে। দাদুর কাছে শুনছে অনি, একদম ছোটবেলায় ইনি স্বৰ্গহেঁড়ায় এসে মুড়ি বিক্রি করতেন। পা ভাঙার কথাটা বলতে গিয়েও ঘাড় নাড়ল অনি। ক্লাসে সংস্কৃতের স্যার পড়া জিজ্ঞাসা করলে মন্ট এইরকমভাবে ঘাড় নাড়ে। হ্যাঁ কিংবা না দুটোই হয়।  ভালো, ভালো। তুমি তো বড় হয়ে গেছ হে। কিন্তু এত রোগা কেন? তালপাতার সেপাই! আরে দেশ গড়তে গেলে স্বাস্থ্য ভালো চাই। সেই পনেরোই আগস্ট সকালে ফ্লাগ তুলেছিলে তুমি যতই বড় হও, দেখেই চিনেছি। হেঁ হেঁ। বেশ বেশ। বৃদ্ধ হাসিহাসি মুখ করে ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছেন দেখে ওরা আবার হাঁটতে লাগল। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্টের কথাটা বৃদ্ধ বলতেই ওর বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল। স্বৰ্গছেঁড়ায় অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করে রেখেছে তার কথা। বৃদ্ধ বলতেই ওর বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছিল। স্বৰ্গছেঁড়ায় অনেকেই নিশ্চয়ই মনে করে রেখেছে তার কথা। উঃ, ফ্লাগটা কী দারুণ উড়েছিল।

ভবানীমাস্টারের মধুটা মনে পড়তেই ও দেখা করার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল। ঝাড়িকাকু চুপচাপ কিছু ভাবছিল। ও বলল চলো, স্কুলে যেতে-যেতে সব শুনব।

কেন, স্কুলে কী হবে ঝাড়িকাকু ব্যাপারটা পছন্দ করল না।

ভবানীমাস্টারকে দেখে আসি।

কাকে?

ভবানীমাস্টার। আমাদের পড়াত না? ভবানীমাস্টার, নতুন দিদিমণি!

ও। সে-স্কুলে তো উঠে গিয়েছে মরাঘাটে। আর বানীমাস্টারের খুব অসুখ, বাঁচবে না।

কী হয়েছে অনি সেই মুখ মনে করতে চেয়ে স্পষ্ট দেখে ফেলল।

শরীর নাকি অবশ হয়ে গেছে। কলোনিতে আছে, আমি দেখিনি।

একটা অদ্ভুত নিঃসঙ্গতা-বোধ অনিমেষকে ঘিরে ধরল আচমকা। এইসব মানুষ এবং এই পরিচিত জায়গাটা যদি এমনি করে তার চেহারা পালটে একদম অচেনা হয়ে যায় তা হলে কী করবে!

অনি জিজ্ঞাসা করল, কলোনিতে কোথায় অনি আছেন তুমি জান?

ঝাড়িকাকু ঘাড় নাড়ল। তারপর বলল, কেন?

আমি যাব। তুমিচলো আমার সঙ্গে, খুঁজে নেব। অনি জোর করে ঝাড়িকাকুর হাত ধরে কলোনির দিকে হাঁটতে লাগল। দুপাশে কাঁচা কাঠের গন্ধ বেরুচ্ছে। স.মিলগুলো থেকে একটানা করাত চালাবার শব্দ হচ্ছে। একটা ট্রাক্টর চজা-পাতা-বোঝাই ক্যারিয়রকে টেনে নিয়ে ফ্যাক্টরির দিকে চলে গেল।

অনি পুরনো কথার যেই ধরে জিজ্ঞাসা করল, তারপর কী হল? বাবা তোমাকে মারল কেন?

ঝাড়িকাকু বলল, এসব কথা থাক।

তুমি বারবার থাক বোলো না তো! অনি প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠল।

ঝাড়িকাকু বিব্রত হয়ে ওর দিকে তাকাল। এই ছোট্ট মানুষটা খুব দ্বিধায় পড়েছে বোঝা যাচ্ছিল। তারপর যেন বাধ্য হয়ে বলল, তোর নতুন মাকে নিয়ে তোর বাবা মাঝে-মাঝে কুচবিহার যেত ডাক্তারের কাছে। শেষে একদিন দুজনের মাঝে কী ঝগড়া। মেয়েটাকে সেইদিন প্রথম কথা বলতে দেখলাম। লোকে বলে, মহী নাকি বাচ্চা-বাচ্চা করে খেপে গিয়েছিল। থাক, তুই এসব কথা শুনিস না–

আঃ! বলো মদ খেতে লাগল। প্রথমে লুকিয়ে লুকিয়ে খেত। কোথা থেকে ও একজন লোককে ধরে এনেছিল যে নাকি সামনে বসে ভূত নামাতে পারে। রোজ রাত্রে দরজা বন্ধ করে ওরা নাকি তোর মাঝে নামাত। একদিন তোর মায়ের একটা ছবি বিরাট করে বাঁধিয়ে নিয়ে এসে খুব ধূপধুনো দিতে লাগল-দরজা বন্ধ করে দিল। নাকি ও তোর মায়ের সঙ্গে ওখানে কেমন চুপচাপ হয়ে যেতে লাগল। একদিন ঘরে ঝাট দিতে গিয়ে আমি জানালাটা খুলেছিলাম, সে সময় ও মদ খেয়ে বাড়ি ফিরল। জানলা খোলা দেখে কী হম্বিতম্বি, আমি আর পারলাম না, বললাম, এরকম করলে আমি কর্তাবাবুকে সব বলে দেব। এই শুনে ও আমাকে মারতে লাগল। বলল, চাকর চাকরের মতো থাকবি। একে মাতাল, তারপর ইদানীং ওর মাথার ঠিক নেই, আমি চুপচাপ মার খেতে লাগলাম। তাই দেখে নতুন বউ ছুটে এসে ওকে ধরতে মহী বলল, ও, খুব দরদ! এই মুহূর্তে তুই বেরিয়ে যা। আমি চলে এলাম।

আসার সময় কিছু বলল না।

তোর নতুন মা আমাকে অনেক করে বলেছিল, ক্ষমা চেয়েছিল মহীর হয়ে। কিন্তু যে-বাড়িতে সারাজীবন কাটিয়ে এলাম নিজের দিকে না তাকিয়ে, সেই বাড়ির ছেলে চ মারলে আর থাকা যায়। কর্তাবাবু যাওয়ার সময় আমার সব মাইনের টাকা মহর কাছে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা আর ফেরত নিইনি। চলে আসার সময় ও মনে দেয়নি। যদি কোনোদিন ইচ্ছে হয় তো দেবে, আমি চাই না।

কেন চাইবে না, তোমার নিজের টাকা না? শক্ত হয়ে গিয়েছিল অনি এসব কথা শুনে। ছোটমায়ের মুখের কাটা দাগটা যে কোত্থেকে এল এতক্ষণে বুঝতে অর অসুবিধে হচ্ছে না। অনি দেখল ও বাবার ওপর রাগতে পারছে না। অত নিরাসক্ত হয়ে বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করল। বাবা যেন ওর কষ্ট হতে লাগল। বাবা যখন বিয়ে করেছিল তখনও ওর কিছু মনে হয়নি, এখনও হল না। শুধু ওর মনে হল, ও-বাড়িতে দুজন খুব কষ্ট পাচ্ছে, একজন ছোটমা আর একজন যাকে ছবিতে পুরে দরজা-জানলা বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

অনি আবার প্রশ্নটা করতে ঝাড়িকাকু বলল, সবসময় কি চাওয়া যায়। টাকা চাইলেই তো ও চাকর বরে দিয়ে দিত। ও নিজে থেকেই দেবে।

দাদুকে বললে না কেন? তুমি তো জলপাইগুড়িতে যেতে পারতে!

লজ্জা করছিল। তা ছাড়া এসব শুনলে কর্তাবার কষ্ট পাবে। তাই একজনকে দিয়ে কাল খবর পাঠিয়েছিলাম যে দেখা হলে বলতে মহীর খুব অসুখ। এ-বাড়ির ছেলে হয়ে মদ খায় কী করে? বড়দা যে ত্যাজ্যপুত্র হয়েছে ভুলে গেল! আর মহীর মতো শান্ত ছেলে, আ! নিশ্চয় ভূতে পেয়েছে ওকে। এরকম হলে বাগানের কাজ থাকবে না ওর! লোকে বলছে ওর নাকি মাথার ঠিক নেই। আমি তো আর যাই না যে দেখব!

অনি ঝাড়িকাকুর দিকে তাকাল। দাদুকে গিয়ে সব কথা বলতে হবে। শুনলে নিশ্চয়ই দাদু বাবাকে ত্যজ্যপুত্র করে দেবেন। কিন্তু তা হলে ছোটমায়ের কী হবে? কী করা যায় বুঝতে পারছিল না অনি। বাবাকে কি ভূতে পেয়েছে। বন্ধ জানলা-দরজার অন্ধকার ঘরে বসে যদি মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে, তবে তো সে মায়ের ভূত! কথাটা মনে হতেই ও হেসে ফেলল। মা কখনো ভূত হতে পারে না। ওসব বুজরুকি। ও ঠিক করল ব্যাপারটা কী আজ রাত্রে দেখবে।

কলোনির মুখটাতে এসে ঝাড়িকাকু কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল ভবানীমাস্টার কোথায় থাকেন। আগে স্বৰ্গছেঁড়ার এই অঞ্চলটায় লোকবসতি ছিল না। ওপাশে হিন্দুপাড়ায় কুলিলাইনটা অবশ্য ছিল, কিন্তু সে বানারহাটের রাস্তায়। এদিকটায় খুটিমরি ফরেস্টের গা-ঘেঁষে স্বৰ্গছেঁড়া টি এস্টেটের অন্য প্রান্ত। খাসমহলের জায়গাগুলো তখন আগাছা জঙ্গলে প্রতি ছিল। সাতচল্লিশ সালের পর ওপারের মানুষেরা এপারে আসতে শুরু করলে এইসব জায়গার চেহারা পালটে গেল রাতারাতি। অনি এই প্রথম এমন একটা জায়গায় এল যাকে কালোনি বলে। কলোনি শব্দটা এর আগে ও শোনেনি। ভেতরে ঢুকে ও দেখল সরু রাস্তার দুপাশে কাঠ আর টিনের ছোট ছোট বাড়ি, এর উঠোনের গায়ে ওর শোওয়ার ঘর। সদর অন্দর কিছু নেই। বোঝাই যায় যারা এসেছেন তারা বাধ্য হয়ে এখানে আছেন।

ছোট্ট একটা কাঠের বাড়ির গায়ে আলকাতরা বোলানো, দরজা বন্ধ, ওরা জানল এখানেই ভবানীমাস্টার থাকেন। একটা ভাঙা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওরা দরজার গায়ে এসে দেখল একটা মাকুকুর তার তিন-চারটে বাচ্চাকে চোখ বুজে শুয়ে বুকের দুধ খায়াচ্ছে। বোধহয় এ-সময় কারও আসার কথা নয় বলে সে খুব বিরক্ত হয়ে দুবার ডাকল। বন্ধ দরজায় শব্দ করতেই ভেতরে কেউ খুব আস্তে কিছু বলর। কয়েকটা বাচ্চা ওদের দেখছিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে, তাদের একজন বলল, দরজার খোলাই আছে, জোরে ঠেললেই খুলে যাবে। সত্যি দরজাটা খোলাই ছিল। অনি ভেতরে ঢুকেই ভবানীমাস্টারকে দেখতে পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে অতিকষ্টে দরজার দিকে ঠিকরে-বেরনো দুটো চোখে যিনি তাকিয়ে আছে তাকে দেখে পাথর হয়ে গেল অনি। সমস্ত শরীর বিছানার সঙ্গে ল্যাপটানো, বিছানাটা অপরিষ্কার। মাথার পেছনে জানলাটা খোলা।

কে? সামনে এসো–অদ্ভুত একটা শব্দ গলা থেকে। বুঝতে কষ্ট হয়।

অনি পায়ে পায়ে ভবানীমাস্টারের সামনে এল। ঝাড়িকাকু ঢুকল না ঘরে। অনি দেখল দুটো চোখ ক্রমশ তার মুখের ওপর স্থির হল এবং সেই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না।

মাস্টারমশাইয়ের শরীর শুকিয়ে চিমসে হয়ে গেছে, কিন্তু মুখোনা প্রায় একই রকম আছে। যদিও কাঁচাপাকা দাড়িতে সমস্ত মুখ ঢাকা, তবু চিনতে কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ বেরুল গলা থেকে, অ-নি-মে-ষ!

তাড়াতাড়ি ঘাড় নাড়ল অনি, হ্যাঁ। ঘরঘড় শব্দটা উচ্চারণের অনেকটা ঢেকে দিচ্ছিল। কথা বললে হয়তো কষ্ট বেড়ে যাবে, অনি বলল, কথা বলবেন না।

ভবানীমাস্টার হাসলেন, প্যা-রা-লা-ইসিস।

এমন সময় বাইরের থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এল, কে আইছে শুনলাম, দুদিন পরেই তো মরব, এখন আইয়া কামটা কী? অ, আপনারা আইছেন, উনার কেউ হন নাকি?

সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়িকাকুর গলা শুনল অনি, না না। মাস্টারের ছাত্র এসেছে।

উত্তরে সেই মহিলাকণ্ঠ বিরক্ত হল, এখন আর পড়াতেই পারব নাকি উনি। উনি যাইলে আমার পরান জুড়ায়, আর পারি না।

ভবানীমাস্টার বললেন, তো-তো-মার মানে আছে পতাকা তুলেছিলে?

অনি বলল, হ্যাঁ। আপনার সব কথা মনে আছে আমার।

বড় হও বাবা, বড় হও! কথাটা বলতে বলতে চোখের কোল বেয়ে একটা সরু জলের ধারা। বেরিয়ে এসে কানের দিকে চলে গেল। অনি আর দাঁড়াতে পারছিল না। শায়িত মানুষকে প্রণাম করতে নেই। ও চট করে এগিয়ে গিয়ে হাতের চেটো দিয়ে ভবানীমাস্টারের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে দৌড়ে বাইরে চলে এল।

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর কাঁঠালগাছতলায় এসে দাঁড়াল অনি। বাড়ি ফেরার পর থেকে ছোটমার সঙ্গে কথাই হচ্ছে না প্রায়। এমনকি অনিকে খাবার দেবার সময় মনে হচ্ছিল রান্নাঘরে ওর খুব কাজ, সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় পাচ্ছেন না। উঠোনে ডাই-করা বাসন অথচ বাড়িতে কাজের লোক নেই-বাবার ওপর ক্রমশ চটে যাচ্ছিল। ছোটমাকে এখন সব কাজ করতে হয়। বিয়ের পর পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে ওর ঘরে-আসা ছোটমার সঙ্গে এখন কেমন রোগা জিরজিরে হয়ে যাওয়া ছোটমার কোনো মিল নেই। সত্যি বলতে কী ছোটমার জন্য ওর কষ্ট হচ্ছিল।

অনির খাওয়া হয়ে যাবার পর মহীতোষ এলেন। ভাগ্যিস একসঙ্গে খেতে বসা হয়নি। তখন বাবার পাশে চুপচাপ শব্দ না করে চিবিয়ে যাওয়া, একটা দমবন্ধকরা পরিবেশে কথা না বলে খাবার গেলা-অনির মনে হল ও খুব বেঁচে গেছে। কাঁঠালগাছতলায় দাঁড়িয়ে বাবার গলা শুনতে পেল সে, অনি কোথায়? ছোটমার জবাবটা স্পষ্ট হল না। মহীতোষ গলা চড়িয়ে বললেন, এই রোদ্দুরে টোটো করে না ঘুরে মায়ের কাছে গিয়ে বসতে তো পারে। ভক্তি নেই, বুঝলে, আজকালকার ছেলেদের মাতৃভক্তি নেই। ছোটমার গলা শোনা গেল না।

অনি ঘরে দাঁড়াল। ও ভাবল চেঁচিয়ে বাবাকে বলে যে মাকে ও যেরকম ভালোবাসে তা বাবা কল্পনা করতে পারবে না। কিন্তু বলার মুহূর্তে যেন অনির মনে হল কেউ যেন তাকে বলল, কী দরকার, কী দরকার। কিছুদিন হল অনি এইরকম একটা গলা মনেমনে শুনতে পায়। যখনই কোনো সমস্যা বড় হয়ে ওঠে, তার খুব অভিমানবা রাগ হয়, তখনই কেউ-একজন মনেমনে কদিন আগে একটা ব্যাপার হয়েছিল। ওদের স্কুলে একজন নতুন টিচার এসেছেন দক্ষিণেশ্বর থেকে খুব ভক্ত লোক। আর বেশ ভালো লেগেছিল দেখতে। একদিন হলঘরের প্রয়ারের পর উনি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিলেন ওঁ ভগবতে · শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ। ওরা ভেবেছিল এটা মাস্টারমশাই-এর নিছক খেয়াল। দিন-সাতেক পরে হঠাৎ ক্লাসে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন লাইনটা কার স্পষ্ট মনে আছে, কে লিখতে পারবে? কেউ খেয়াল করেনি, ফলে এখন ঠিকঠাক সাহস পাচ্ছিল না। অনি সঠিক জবাব দিতে তিনি ওকে কাছে ডেকে বললেন, চিরকাল লাইনটা মনে রাখবে। সুখে কিংবা দুঃখে, বিপদে-আপদে মনেমনে লাইনটা বলে নিজের কপালে মা শব্দটা লিখবে। দেখবে তোমার অমঙ্গল হবে না। কথাটা বলে ওর মুখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রামকৃষ্ণ কে ছিলেন জান তো? ঘাড় নেড়েছিল অনি।

গুড! অনি ছিলেন পরম সত্য, পরম আনন্দ। তার আলোর কাছে কোনো আলো ঘেঁষতে পারে না।

কথাগুলো তখন ভালো করে বুঝতে না পারলেও মনেমনে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে নিয়েছিল অনি। তার পর থেকে এই প্রক্রিয়াকে অনেকবার কাজে লাগিয়েছে ও। যেমন, বিকেল ফুরিয়ে সন্ধে হয়ে গেলে দেরি করে বাড়ি ফেরার জন্য বুকটা যখন চুকচুক করে ওঠে তখন চট করে ওই চারটে শব্দ আওড়ে কপালে মা লিখলে অনি লক্ষ করছে কোনো গোলমালে পড়তে হয় না। এই আজকে যখন ঝাড়িকাকুকে চৌমাথায় ছেড়ে ও বাড়ি ফিরল তখন মনে হচ্ছিল এখন বাবার মুখোমুখি হতে হবে, একসঙ্গে খেতে হবে। বাড়িতে ঢোকার আগে প্রক্রিয়াটা করতে ফাড়া কেটে গেল।

রামকৃষ্ণকে ভগবান মনে করে প্রণাম করার একটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু এটা অনিমেষের কাছে স্পষ্ট নয় মাস্টারমশাই কেন মা শব্দটা কপালে লিখতে বলেছিলেন। আশ্চর্য, শব্দটা লেখার পর সারা শরীরে মনে কেমন একটা নিশ্চিন্তি সৃষ্টি হয়।

সারা দুপুর ওর প্রায় টেটো করেই কেটে গেল। ওদের বড়ির পেছনের বাগানের সেই চেনা-চেনা গাছগুলো অদ্ভুত বড়সড় আর অগেছালো হয়ে গিয়েছে। সেই বুনো গাছগুলো যাদের বুকে জোনাকির মতো হলুদ ফুল ফুটত তেমনি ঠিকঠাক আছে। এই দুপুরে ঘুঘুগুলো একা একা হয়ে যায় কেন? এমন গলায় কী কষ্টের ডাক যে ডাকে! অনি ঘুরতে ঘুরতে নদীর কাছে এসে দেখল জলেরা এখনও তেমনি চুপচাপ বয়ে যায়।

একসময় সূর্যটা খুঁটিমারির জঙ্গলের ওপাশে মুখ ডোবালে স্বৰ্গছেঁড়া ছায়া-ছায়া হয়ে গেল। এখন একরাশ পাখির চিৎকার আর মদেসিয়া কলিকামিনদের ভাঙা-ভাঙা গান জানান দিচ্ছিল রাত আসছে। নদীর ধারে-ধারে অনি চা-বাগানের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ছোট ছোট পায়েচলা পথ দুপাশে ঠাসবুনোট কোমর-সমান চায়ের গাছে ফুল ফুটেছে, শেডট্রিগুলোতে ঝাঁকে-ঝাঁকে টিয়াপাখি বসে সবুজ করে দিয়েছে। এখন চা-বাগানের মধ্যে কেউ নেই। লাইনে ফেরার জন্য পথসংক্ষেপ করে কোনো-কোনো কামিন মাথায় বোঝা নিয়ে দূর দূর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এই নির্জন পরিবেশে বিশাল সবুজের অঙ্গীভূত ঢেউ-এ দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে-দেখতে অনির মনে হতে লাগল ও খুব একা, ভীষণ একা। ওর মা নেই, বাবা নেই, কোনো আত্মীয়-বন্ধু নেই। ঠিক এই মুহূর্তে ও দাদু বা পিসিমার কথা ভাবতে চাইছিল না। ওঁদের বিরুদ্ধে অনির কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু বয়সবাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওঁরা যেন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর কিছুই যেন তাদের স্পর্শ করে না তেমন করে। তোমাদের দুটো জননী, একজন গর্ভধারিণী অন্যজন ধরিত্রী-যিনি তোমাকে বুকে ধারণ করেছেন। নতুন স্যারের সেই কথাগুলো মনে হতেই এই নির্জন সন্ধ্যা-নামা সমটায় চা-বাগানের ভিতর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে গলা কাঁপিয়ে গাইতে লাগল, ধন-ধান্য-পুষ্প-ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।

না, বাড়িতে ইলেকট্রিক আসেনি। অনিরা প্রথম যখন জলপাইগুড়িতে গেল তখনই মহীতোষ সব বন্দোবস্ত করে কলকাতা থেকে ডায়নামো আনবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আসেনি। ফলে এখন রাত্রে এ বাড়িতে হারিকেন জ্বলে। দুটো নতুন জিনিস দেখল অনি, সন্ধে চলে গেলেও ক্লাবঘরে হ্যাজাক জ্বলল না, কেউ এল না তাস খেলতে। আর সব বাবু সাইকেলে চেপে টর্চ জ্বালতে জ্বালতে যে যার কোয়ার্টারে ফিরে গেলেও মহীতোষ ফিরলেন না। অথচ রাত হয়ে গেছে বেশ, চাবাগানে-যে রাতটায় কুলিলাইনে মাদল বাজা শুরু হয়ে যায়। অনি ঠিক বুঝতে পারছিল না ও কোন ঘরে থাকবে। যদি বাইরের ঘরে থাকতে হয় তা হলে মহীতোষ ফেরার আগেই খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লেই ভালো।সন্ধের পর বাড়ি ফিরলে ছোটমা একবার জিজ্ঞাসা করেছিল, খাবে না। সত্যি সারাদিন এত ঘুরেও একটুও খিদে পায়নি অনির। ও না বলেছিল, ছোটমা আর কথা বাড়ায়নি। সামনের মাঠে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। আসাম রোড দিয়ে মাঝে-মাঝে শহুশ করে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে। অনি ঠিক করল কাল সকালের ফাস্ট বাসে ও জলপাইগুড়ি ফিরে যাবে।

একটু বাদে ও খিড়কিদরজা খুলে উঠোন পেরিয়ে ভেতরে এল। ঘরের মধ্যে দিয়ে এলে মায়ের ছবিটা ঘরটা পার হতে হবে যেটা অনি কিছুতেই চাইছিল না। রান্নাঘরের বারান্দায় উঠে ও দেখল দরজাটা খোলা। ভিতরে কাঠের উনুনে কিছু-একটা ফুটছে আর উনুনের পাশে উবু হয়ে গালে হাত দিয়ে ছোটমা বসে আছে। জ্বলন্ত কাঠের লাল আগুনের আভা এসে পড়েছে গালে, স্থির হয়ে কোনো ভাবনায় ড়ুবে থাকা। চোখের পাতায়, চলে, কাপড়ে। চারপাশের অন্ধকারে ছোটমাকে কাঠের উনুনের আঁচ মেখে এখন একদম অন্যরকম দেখাচ্ছিল। অনি এসে দরজায় দাঁড়াতেও ছোটমার হুঁশ হল না। ভাগ্যিস এখানে চুরিচামারি বড়-একটা হয় না। .

অনি রান্নাঘরে ঢুকতে ছোটমা চমকে সোজা হয়ে বসল, তারপর অনিকে দেখে আঁচলটা ঠিক করে নিল, ওমা তুমি। সারাদিন কোথায় ছিলে?

ঘুরছিলাম।অনি খুব আস্তে উত্তরটা দিল। ও রান্নাঘরটা দেখছিল। যখন ছিল তখন এরকম ব্যবস্থা ছিল না। বোধহয় কাজ করার সুবিধে অনুযায়ী চোখাচোখি হতে বলল, খিদে পেয়েছে।

অনি ঘাড় নাড়ল, না। আচ্ছা, একটা লম্বা কাঠের সিঁড়ি ছিল, ওপরে গোলাপের ফুল আঁকা, সেটা কোথায়?

অবাক হল ছোটমা, কেন?

অনি বলল, ঐ পিড়িটায় আমি বসতাম। রাত্তিরবেলায় খুব ঘুম পেয়ে গেলে এই ঘরে পিড়িটায় বসে খেয়ে নিতাম।

কথা শুনে ছোটমা হাসল, তারপর উঠে পাশের ঘরে গিয়ে সেই পিড়িটাকে এনে মাটিতে পেতে দিল, বসো, গল্প করি।

অনি পিড়িটায় বসে বেশ আরাম পেল, আজকাল ক্লাবে তাসখেলা হয় না?

প্রশ্নটা করতেই ছোটমা ঘাড় নাড়ল, না।

কেন?

তরকারিতে হয়তো খন্তি চালাবার কোনো দরকার ছিল না, তবু ছোটমা সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তারপর বলল, জানি না।

বাবা কখন আসবে?

অনির দিকে পেছন ফিরে তরকারি নামাতে নামাতে ছোটমা বলল, ওর ফিরতে দেরি হবে, তুমি খেয়ে শুয়ে পড়ে। কালকে আবার যেতে হবে তো!

এখানে থাকতে যদিও তার একটুও ইচ্ছা করছিল না, তবুও এখন অনির কেমন রাগ হয়ে গেল, বাঃ, তুমি তো আমাকে একসময় আসার জন্য চিঠি লিখেছিলে, এখন চলে যেতে বলছ কেন?

মুখটা পলকে কালো হয়ে গেল ছোটমার। অনি দেখল, নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিচ্ছে ছোটমা। তারপর বলল, তখন তো তোমার এত পড়াশুনা ছিল না।

হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, অনি, ঝাড়িকাকুকে বাবা তাড়িয়ে দিয়েছে কেন?

ছোটমা দুচোখ তুলে ওকে দেখল, তাড়িয়ে দিয়েছে কে বলল?

আমার সঙ্গে ঝাড়িকাকুর দেখা হয়েছিল। অনির অমন জেদ ধরে যাচ্ছিল। ছোটমা কি ওকে খুব বাচ্চা ভেবেছে। এভাবে কথা লুকিয়ে যাচ্ছে কেন?

এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না, আমি বলতে পারব না।

তুমি আমাকে বন্ধু বলেছিলে না।

ছোটমা কোনো উত্তর দিল না। উঁচু করে রাখা দুটো হাঁটুর ওপর গাল রেখে চুপ করে রইল। অনি বলল, বাবা আগে এমন ছিল না, মা থাকতে বাবা একদম অন্যরকম ছিল।

খুব গাঢ় গলায় ছোটমা বলল, কী জানি! বোধহয় আমি খারাপ, তাই।

উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসল অনি, তুমি মিথ্যা কথা বলছ।

হঠাৎ ঝট করে উঠে বসল ছোটমা, বেশ, আমি মিথ্যে কথা বলছি। আমার খুশি তাই বলছি।

কেন? মিত্যে কথা বললে-। অনি কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কেউ অন্যায় করছে এবং এরকম জেদের সঙ্গে স্বীকার করছে-কখনো দেখেনি সে।

খুব কাটা-কাটা গলায় ছোটমা বলল, উনি যা করছেন করুন তবু আমাকে এখানে থাকতে হবে। আমার পেটে বিদ্যে নেই যে রোজগার করব। ভাইদের কাছে গলগৃহ হয়ে থাকার চেয়ে এখানে। অপমান সহ্য করা অনেক সুখের। নিজের জন্যে মিথ্যে বলতে হবে, আমাকে আর প্রশ্ন করবে না তুমি।

অনি চুপ করে গেল। ছোটমার কথাগুলো বুঝে উঠতে সময় লাগল। ওর হঠাৎ মনে হল এতক্ষণ ও যেভাবে কথা বলেছে সেটা ঠিক হয়নি। জলপাইগুড়িতে প্রথম পরিচয়ের দিন যাকে বন্ধু এবং নিজের চৌহদির মধ্যে বলে মনে হয়েছিল, এখন এই রাত্রে তাকে ভীষণ অচেনা বলে মনে হতে লাগল। কিন্তু ছোটমা তাকে একটা মুখ সত্যের মুখোমখি দাড় করিয়ে দিয়েছে। বাবার এইসব কাজ, কাজ না বলে অত্যাচার বলা ভালো, ছোটমাকে মুখ বুঝে সহ্য করতে হচ্ছে তার ভাইদের কাছে গিয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে। ছোটমা যদি লেখাপড়া শিখত তা হরে চাকরি করতে পারত সেটাও সম্ভব নয়। আচ্ছা, আজ যদি বাবা তাকে। সঙ্গে সঙ্গে অনি যেন চোখের সামনে সরিৎশেখরকে দেখতে পেল, পেয়ে বুকে বল এল। দাদু জবিত থাকতে তার কোনো ভয় নেই। কিন্তু দাদুকে আজকাল কেমন অসহায় লাগে মাঝে-মাঝে, পিসিমার সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে প্রায়ই চা কথা-কাটাকাটি হয়। হোক, তবু তার দাদু আছে, কিন্তু ছোটমার কেউ নেই। ও গম্ভীর গলায় বলল, তুমি চিন্তগা কোর না আমি পাশ করে চাকরি করলে তুমি আমার কাছে গিয়ে থাকবে। বাবা কিছু করতে পারবে না।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ছোটমা বলল, ছি! বাবাকে কখনো অসম্মানের চোখে দেখতে নেই, ভুল বুঝতে পারলে তিনি ঠিক হয়ে যাবেন।

অনি কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, বাবার বিরুদ্ধে কিছু বললেই ছোটমা একদম সমর্থন করে না কেন? ছোটমা উঠে মিটসেফ থেকে একটা বিরাট জামবাটি বের করে ওর সামনে এনে রাখল, তোমার জন্যে করেছি। বাড়িতে তো আর দুধ হয় না, অনেক কষ্টে এটুকু যোগাড় করতে পেরেছি। অনি দেখল জামবাটির বুক-টইটম্বুর পায়েসের ওপর কিমিসগুলো ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে আছে, একটা তেজপাতা তিনভাগ শরীর ড়ুবিয়ে কালো মুখ বের করে আছে। চোখাচোখি হতে ছোটমা বলল, ভালো না হলেও যেতে হবে অনি, দিদির মতো হয়নি আমি জানি।

অনি হাসল, ছোটমা সেই প্রথম দিনের কথাটা এখনও মনে রেখেছে।

এ-বেলা একদম নিরামিষ, তোমার খেতে অসুবিধে হবে খুব।

ছোটমার কথা শুনে হাসল অনি, এতখানি পায়েস পেলে আমার কোনো খাবারের আর দরকার নেই। একটা চা-চামচ দিয়ে ধারের দিকে একটু পায়েস নিয়ে মুখে দিয়ে বলল, ফাইন! তারপর চোখ বুজে সেটাকে ভালোভাবে গলাধঃকরণ করে বলল, পিসিমার চেয়ে একটু কম ভালো হয়েছে, তবে মায়ের চেয়ে অনেক ভালা। পিসিমা ফার্স্ট, তুমি সেকেন্ড, মা থার্ড।

অনির কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিল ছোটমা। সারাদিন এবং এই একটু আগেও যে-অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, ছেলেটা খেতে আরম্ভ করার পর থেকে সেটা টুপ করে চলে গেল। যে যা ভালাবাসা তাকে সেটা তৈরি করে খাওয়াতে যে এত ভালো লাগে এর আগে এমন করে জানা ছিল না। কী তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে ছেলেটা। আর এই সময় প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ উঠল, কেউ যেন মনের সুখে দরজায় লাথি মারছে। খেতে-খেতে চমকে উঠে অনি বলল, কিসের শব্দ?

ছোটমার খুশির মুখটা মুহূর্তেই কালো হয়ে গেল যেন, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে কোনোরকমে বলে গেল, তুমি খাও, আমি আসছি।

শব্দটা থামছে না, ঘড়ির আওয়াজের মতো বেজে যাচ্ছে। তারপর দরজা খোলার শব্দ হতে একটা হুঙ্কার এদিকে ভেসে এল। খাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে অনি সোজা হয়ে উঠ দাঁড়াল, তারপর একছুটে বাঁধানো উঠোন পেরিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ল। ছোটমার ঘরে একটা ছোট্ট ডিমবাতি জ্বলছে, এত অল্প আলো যে চলতে অসুবিধে হয়। মায়ের ছবির ঘরের দরজায় এসে থমকে দাঁড়াল। ও। বাবা কথা বলছেন, জড়িয়ে জড়িয়ে, কোনো কথার শেষটা ঠিক থাকছে না, কোথায় আড়া। মারছিলে, আমি দুঘন্টা ধরে নক করছি খেয়াল নেই, এ্যা?

ছোটমা বলল, অনিকে খেতে দিচ্ছিলাম।

অনি? হু ইজ অনিঃ মাই সন? সন বড় না ফাদার বড়, অ্যাঁ? আমার আসবার সময় কেন দরজায় বসে থাকনি, অ্যাঁ?

ছোটমা খুব আস্তে বলল, কাল ছেলেটা চলে যাবে, আজকের রাতটায় এসব না করলেই নয়?

জ্ঞান দিচ্ছ? সেদিনকার ছুঁড়ি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছে, অ্যাঁ! বিনে পয়সায় মা হয়েছে, মাগিরি দেখাছ ভালো, ভালো। মাধু গিয়ে আচ্ছা প্রতিশোধ নিয়েছে। নইলে একটা বাঁজা মেয়েছেলে কপালে জুটল! গলাটা টলতে টলতে মায়ের ঘরে চলে এল, অ্যাই, ধূপ জ্বলছে না কেন?

ছোটমা দৌড়ে মহীতোষের পাশ দিয়ে এসে বোধহয় ধূপ জ্বেলে দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তার গলা থেকে একটা আর্তনাদ উঠল, উঃ!

কৌতূহলে অনিমেষ এক পা বাড়াতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ছোটমার ডান হাতের কবজিটা বাবার মুঠোয় ধরা, বাবা সেটাকে মোচড়াচ্ছেন। সমস্ত শরীর বেকিয়ে ছাড়াবার চেষ্টা করেও পারছে

ছোটমা। বাবা সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, শান্তি দিচ্ছি, অন্যায় করলেই শাস্তি পেতে হবে, হুঁহুঁ বাবা!

বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে অনি মাধুরীর ছবিটা দেখতে পেল। অত বড় ছবিটার ওপর দুটো চাইনিজ লণ্ঠনের আলো পড়ায় মুখটা একদম জীবন্ত। সকালে ছবিটায় অদ্ভুত একটা বিমর্ষভাব দেখতে পেয়েছিল অনি, এখন সেটা নেই যেন। বরং উল্লাসময় একধরনের উপভোগ করার অভিব্যক্তি মায়ের মুখে। চোখ দুটো কি খুব চকচক করছে! না, আলো পড়ায় ওরকম হয়েছে। ছবির মাকে ওর একদম পছন্দ হচ্ছিল না! ও মহীতোষের দিকে তাকাল। এখনও উনি ছোটমাকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছেন, ছোটমা ইচ্ছে করলে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন বাবাকে, কিন্তু দিচ্ছেন না। অনি যেন শুনতে পেল কে যেন তার কানের কাছে বলে গেল, বল বল, ভয় কিসের? অনি সঙ্গে সঙ্গে মহীতোষকে বলল, ছোটমাকে মারছেন কেন?

মহীতোষ পাথরের মতো শক্ত হয় দাঁড়িয়ে পড়লেন, দুচোখ কুঁচকে লক্ষ করার চেস্টা করলেন কে বলছে। এই সময় তার শরীরের নিম্নভাগ স্থির ছিল না। অনিকে চিনতে পেরে বললেন, আমি যে মারছি তোমাকে কে বলল? তোমার এই মা বলছে? তুমি একে মা বল তো, অ্যাঁ?

অনি দেখল ছোটমা সামান্য জোর দিয়ে নিজের হাতটা বাবার মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিল। মহীতোষ বললেন, গতরে জোর হয়েছে দেখছি!

মেরে ছোটমার গালে দাগ কে করে দিয়েছে। অনি প্রশ্নটা এমন গলায় করল যে মহীতোষ প্রাণপণে সোজা হবার চেষ্টা করলেন। ছোটমা মুখে আঁচল দিয়ে বিস্ফারিত-চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। দুই পা এগিয়ে এক হাত বাড়িয়ে মহীতোষ বললেন, অনি, পুত্র, পুত্র আমার! এখানে এসো, এই বুকে মাথা রেখে শুনে যাও।

অনি কিছু বোঝার আগেই মহীতোষ কয়েক পা টলতে টলতে হেঁটে এসে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। অনির স্পর্শ শরীরে পেতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি, মাধু দ্যাখো, কে আমার বুকে এসেছে, অ্যাঁ!

এই প্রথম অনিমেষ জ্ঞানত পিতার আলিঙ্গন পেল এবং সেই আলিঙ্গনে ওর সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠল যেন। বাবার মুখ দিয়ে যে-বিশ্রী ক্লেদাক্ত গন্ধ বের হচ্ছে তা সহ্য করতে পারছিল না অনি। তীক্ষ্ম গলায় ও চিৎকার করে উঠল, আপনি মদ খেয়েছেন?

প্রশ্নটা শুনেই ছোটমা দাঁড়িয়ে ড়ুকরে কেঁদে উঠল। মহীতোয় ছেলেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে চমকে দিলেন, আঃ, ফাঁচা কোরো না তো, পিতাপুত্রের কথাবার্তার মধ্যে ফ্যাঁচফ্যাচানি! হ্যাঁ বাবা, ইয়েস আমি ড্রিঙ্ক করেছি। ইউ মে আস্ক মি, হোয়াইট লুক অ্যাট হার! এক হাতের আঙুল তীরের মতো মাধুরীর ছবিটার দিকে বাড়িয়ে মহীতোষ বলরেন, দ্যাখো ও কেমন খুশি হয়েছে। ইওর মাদার! তোমাকে ও পেটে ধরেছিল, হোলি মাদার! ওর খুশির জন্য খেয়েছি।

আপনি কি ওঁর খুশির ছোটমাকে মারেন? গলাটা এত জোরে যে মহীতোষ দুহাতের মধ্যে দাঁড়ালেন প্রায় অর চিবুক অবধি লম্বা ছেলের মুখ দেখবার চেষ্টা করে বললেন, ইউ আনফেথফুল সন, কোনোদিন নিজের মাকে ছোট করে দেখবে না। আমি প্রত্যেক রাত্রে মাধুরীর সঙ্গে কথা বলি। এখানে, এই ঘরে দাঁড়িয়ে, ড়ু ইউ নোর।

অনির আর সহ্য হচ্ছিল না। আপনি মিথ্যে বলছেন!

কী? আমি মিথ্যে বলছি? আমি মিথ্যে বলছি! হাত বাড়িয়ে খিমচে ধরলেন মহীতোষ ছেলেকে। মাতাল হলেও বাবার গায়ের জোরের সঙ্গে পেরে উঠছিল না অনি, মাকে যদি আপনি এত ভালোবাসেন, মা যদি-না, তা হলে আপনি মদ খেতেন না, ছোটমার উপর অত্যাচার করতেন না। শুনেছি ভুতে ধরলে মানুষ অন্যরকম হয়ে যায়, আপনার সেরকম হয়েছে!

সঙ্গে সঙ্গে তাকে ছেড়ে দিয়ে মহীতোষ ছোটমার দিকে ছুটে গেলেন, তুমি ওকে এসব শিখিয়েছ, আমার ছেলেকে আমার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছ

দুহাতের আড়ালে মুখ রেখে ছোট সেই চাপাকান্নার মধ্যে গলা ড়ুবিয়ে বলে উঠল, আমি বলিনি, বিশ্বাস করো, আমি কিছু বলিনি।

কিন্তু কথাটা একদম বিশ্বাস করলেন না মহীতোষ, রাগে উন্মাদ হয়ে বলে চললেন, কাল সকালে বেরিয়ে যাবে, তোমাকে আমার দরকার নেই, একটি বাজা মেয়েছেলের মুখ দেখা পাপ। তোমার জন্য সে এই কয় বছর আমার কাছে আসছিল না, তুমি আমার ছেলেকে।

প্রচণ্ডভাবে মাথা নেড়ে হঠাৎ উচ্চকণ্ঠে কেঁদে উঠল ছোটমা, আমি কাউকে কিছু বলিনি।

বোধহয় সমস্ত শরীরের ওজন দিয়ে মহীতোষ ডান হাতখানা শূন্যে তুলেছিলেন, যেটার লক্ষ্য ছিল ছোটমার গাল। ঠিক সেই পলকে অনিমেষ যেন শুনতে পেল, যাও, ছুটে যাও। কিছু বোঝার আগেই সে তীরের মতো এগিয়ে গিয়ে মহীতোষের ডান হাত চেপে ধরে ওদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে মহীতোষ ছেলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন, অনি নিজেকে বাঁচাতে সরে দাঁড়াতেই নেশাগ্রস্ত শরীরটা দুম করে মাটিতে পড়ে গেল। পড়ে যাওয়াটা এত দ্রুত ঘটে গেল এবং একটা মানুষ যে পুতুলের মতো সোজা চিত হয়ে পড়তে পারে অনি বুঝতে পারেনি ; মেঝের ওপর পড়ে-থাকা নিথর শরীরটার দিকে ওরা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল যেন বিশ্বাস করাই যায় না যে এই লোকটাই এতক্ষণ এখানে ছিল। অনির আগে ছোটমা চিষ্কার করে ছুটে গেলেন মহীতোরে কাছে। অনি দেখল ছোটমা বাবার মাথাটা কোলের ওপর নিয়ে প্রাণপণে ডাকছেন। বাবার মাথাটা একটা পাশে বারবার ঘুরে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় কোলের ওপর নিয়ে প্রাণপণে ডাকছেন। বাবার মাথাটা একটা পাশে বারবার ঘুরে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় ঠোঁট দুটো বেঁকে গেছে। হাত-পা টানটান, শরীরে কোনো আলোড়ন নেই। প্রথমে সন্দেহের চোখে তাকালি অনিমেষ, বাবার ওপর আর কোনোরকম শ্রদ্ধা ছিল না তার, এই মুহূর্তে। বাবা মদ খায়, ছোটমাকে মারে, তার মৃতা মায়ের নাম করে যা ইচ্ছে। বলে–এখন যে এভাবে পড়ে আছে তা স্বাভাবিক নয়। বাবার জোরের সঙ্গে সে পারবে না কিছুতেই, তাই ওর সামান্য ঠেলায় এভাবে পড়ে মাথা থেকে বেরিয়ে-আসা রক্তে ছোটমার শাড়ি ভিজে যাচ্ছে।

আমি! কোনোরকমে বলল সে।

কেন মাতাল মানুষটাকে ঠেলে দিলে! আমাকে মারলে তোমার কী এসে যেত, যদি আমাকে মেরে সুখ পায়, পাক-না! নিজের আঁচলটা বাবার মাথায় চেপে ধরে ছোটমা ড়ুকরে ড়ুকবে কথাগুলো বলল।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনি চারপাশে অনেকগুলো মুখ দেখল, নড়ে নড়ে ভেঙেচুরে যাচ্ছে। মুখগুলো কার? নাকি একনজরের মুখ হাজার হয়ে যাচ্ছে! শিরশিরে একটা শীতল বোধ ওর শিরদাঁড়ায়। উঠে এল। মুহূর্তে কপাল ভিজে যাচ্ছে ঘামে। ও দেখল মায়ের ছবিটা বড় বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

অদ্ভুত একটা ভয় ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে বেড়াচ্ছে। ও কি বাবাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল? না
, কখনো নয়। গলা প্রায় বুজে যাচ্ছিল অনির, ওকথা বলল, বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমি ভাবিনি, বাবা পড়ে যাবেন।

হঠাৎ যেন ছোটমার গলার স্বর বদলে গেল! খুব ধীরে ছোটমা বলল, ওকে একটু ধরবে অনি! খাটের ওপর শুইয়ে দিই।

মহীতোষকে শুইয়ে দিতে ওদের একটু কষ্ট হল, দেহটা বেশ ভারী। ছোটমার হাত মাথার ফেটেযাওয়া জায়গায় আঁচল চেপে রেখেছে। অনি বলল, আমি একছুটে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনছি।

ও যেই বেরুতে যাবে এমন সময় ছোটমার ডাক শুনল। দরজা অবধি পৌঁছে ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাল সে। ছোটমার মুখটা অস্পষ্ট। পাশে বাবার শরীরটা আবছা দেখা যাচ্ছে। ওদের পেছনে দেওয়ালে মায়ের ছবিটা ঝকঝক করায় সামনেটা কেমন হয়ে গিয়েছে। ছোটমা যেন অনেক দূর থেকে তাকে বলল, অনি, আমার একটা কথা রাখবে

গলার স্বরে এমন একটা মমতা ছিল যে অনি স্পষ্ট শুনতে পেল কে যেন তাকে বলছে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। ও বলর, হ্যাঁ।

মানে?

ও নিজেই ভার সামলাতে পারেনি, একথা সবাই জানবে!

কিন্তু বাবা–?

মাতাল মানুষের কোনো খেয়াল থাকে না। জেগে উঠলে যা বলব বিশ্বাস করবে।

অনি বুঝতে পারছিল না কেন ছোটমা একথা বলছে। সবাই যদি শোনে অনি বাবাকে ফেলে দিয়েছে, তা হলে-। ওর বুকে ভেতর থেকে অনেক অনেক অনেকদিন পরে একটা কান্নার দমক উঠে এল গলায় কেন?

ছোটমা বলর, আমার জন্য। আর জানতে চেয়ো না। কেউ যেন জানতে না পারে, মনে থাকে যেন। যাও, দেরি কোনো না। ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনন।

কখনো কখনো অন্ধার,বন্ধুর মতো কাজ করে। এখন স্বৰ্গছেঁড়ায় গভীর রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকারে জোনাকিরা ঘুরে বেড়ায়,লাইনে মাদল বাজে। সার-দেওয়া কোয়ার্টারের দরজাগুলো বন্ধ। মাঠের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে ডাক্তারবাবুর কোয়ার্টারের দিকে যেতে-যেতে এই অন্ধকারটা যদি শেষ না হত তা হলে যেন ও বে; যেত। বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে কী করবে সে?

ডাক্তারবাবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ও বুক ভরে নিশ্বাস নিল। তারপর অন্ধকারে উচ্চারণ করল, ও ভাগবতে শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ। একটা ঘোরের মধ্যেও মা শব্দ আঙুলের ডগা দিয়ে কপালে লিখতেই অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল শরীরটা মাধুরী ওকে জড়িয়ে ধরে যেমন হত।

নিশ্চিন্তে ডাক্তাবাবুর দরজার কড়া নাড়তে লাগল অনিমেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *