1 of 2

০৫. কৃষ্ণনগর থেকে বহরমপুর

কৃষ্ণনগর থেকে বহরমপুর কতখানিই বা দূর! ছেলেবেলায় অলিরা অনেকবার বহরমপুর হয়ে মুর্শিদাবাদ, খোসবাগ দেখতে গেছে, একবার সেই মেম কাকিমার সঙ্গে হাজারদুয়ারী দেখতে গিয়ে ছবি তোলা হয়েছিল, ফ্ৰকপরা অলির সেই ছবি এখনো আছে অ্যালবামে। তখন অবশ্য অভিভাবক শ্রেণীর কেউ না কেউ সঙ্গে থাকতেন, এখন অলি অনায়াসেই একলা যেতে পারে, লালগোলা প্যাসেঞ্জারে চাপলে দু’ আড়াই ঘণ্টার পথ।

কিন্তু বাড়িতে আগুন লাগার পর বিমানবিহারী মেয়েদের বাইরে বেরুতে বারণ করে দিয়েছেন। তাঁর মন ভেঙে গেছে। তিনি তক্ষুনি কলকাতায় ফিরতে পারলে খুশী হতেন, কিন্তু বসতবাড়ির পেছন দিকের পোড়া অংশগুলো কিছু মেরামত না করলে একেবারে ভেঙে পড়বে। তিনি মিস্ত্রি খাটাচ্ছেন।

প্রত্যেকবার অলিবুলি ঘূর্ণীতে নানারকম মাটির পুতুল কিনতে যায়, পুতুলের শখ বুলিরই বেশী, বাড়ি থেকে একটা রিকশা নিয়ে যাওয়া আর সেই রিকশাতেই ফিরে আসা, কিন্তু। বিমানবিহারী বললেন এবারে পুতুল কিনতে যেতে হবে না। একই রকম তো পুতুল, পরে অনেক পাওয়া যাবে।

ঘূর্ণীতেই যাওয়া হচ্ছে না, তা হলে বহরমপুর যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। অলি একবার সে প্রসঙ্গ তুলতেই বিমানবিহারী উড়িয়ে দিলেন।

অথচ বহরমপুরে শুক্রবার বিকেলবেলা অলিকে একবার যেতেই হবে।

বাবা কোনো কাজেই প্রায় বাধা দেন না, সুতরাং বাবা কোনো ব্যাপারে একবার না বললে আর তর্ক করা যায় না। কৃষ্ণনগর থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটা ইস্কুল বাড়িতে বোমা মারামারি হয়েছে বুধবার দুপুরে, সেই খবর পাবার পর বাবা-মা আরও সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। কিন্তু এই সব বোমা, খুন, আগুন লাগানোর ঘটনা সাধারণ মানুষের গা-সহা হয়ে গেছে। জীবনযাত্রা তো। থেমে নেই। ট্রেনে বাসে একই রকম ভিড়। যে রাস্তায় বোমাবাজি হয়, সেখানে দোকান পাটগুলো দ্রুত ঝাঁপ ফেলে দেয়। ঘণ্টা দু’ এক বাদেই আবার খুলে যায় সবকিছু। যে-পাড়ায় খুন হয়, পরের দিন সে পাড়ার মানুষজনকে দেখলে বোঝাই যায় না যে সেখানে কিছু ঘটনা ঘটেছে।

বহরমপুরে কল্যাণীর ছোট ভাই থাকেন, তিনি ডাক্তার, সদ্য একটি নার্সিং হোম খুলেছেন বাস স্ট্যান্ডের কাছেই। অলিবুলিদের সেই শান্তিমামা ও রীতা মামীমা গাড়ি নিয়ে এলেন কৃষ্ণনগরে, এখানকার রোমান ক্যাথলিক চার্চের ফাদার শান্তিমামার পেসেন্ট, সেই ফাদার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলেই আসতে হয়েছে শান্তিমামাকে, সেই সঙ্গে তিনি দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গেও দেখা করে যাবেন।

বৃহস্পতিবার দিন এই শান্তিমামা ও রীতা মামীমা যেন দৈব প্রেরিত। অলি সাধারণত কারুর কাছে কিছু চায় না, অনুরোধ করে না, তা মামীমার কাছে সে বাচ্চা মেয়ের মতন আবদার ধরলো, আমাকে তোমাদের সঙ্গে বহরমপুরে নিয়ে চলো, বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলো।

গাড়িতেই যাওয়া, তবু বিমানবিহারী খুব পছন্দ করলেন না। অলি ফিরবে কার সঙ্গে? শান্তিমামা বললেন, বহরমপুর থেকে তাঁর চেনা কতলোক প্রত্যেকদিন কলকাতায় যায়, একজন কারুর সঙ্গে অলিকে ট্রেনে তুলে দেবেন সকালবেলা, কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে রিকশা ধরে অলি বাড়ি চলে আসবে। দিনেরবেলা ভয়ের কী আছে? ছেলে-ছোকরারা মারামারি খুনোখুনি করছে বটে, কিন্তু মেয়েদের গায়ে কোথাও হাত দিয়েছে, এমন তো শোনা যায়নি।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়া হতেই বিমানবিহারী তাঁর শ্যালককে তাড়া দিলেন, এবার তোমরা বেরিয়ে পড়ো, গাড়িতে কম সময় তো লাগবে না! সন্ধে হয়ে গেলে রাস্তায় যদি কোথাও গাড়ি খারাপ হয়ে যায়?

বিমানবিহারী আগে এরকম ভীতু ছিলেন না। বাড়িতে আগুন লাগার ঘটনার পরেই খুব দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

গাড়িতে বেশ গল্প করতে করতে আসা হচ্ছিল। পলাশীর কাছে উঠলো কালবৈশাখীর ঝড়। ফাঁকা রাস্তার দু’ পাশে মাঠ, বিকেলবেলাতেই এমন মিশমিশে কালো আকাশ অলি কখনো দেখেনি। সোঁ সোঁ শব্দ হচ্ছে ঠিক যেন সমুদ্রে জাহাজ যাওয়ার মতন। হাওয়ার দাপটে মনে হচ্ছে যেন গাড়িটা দুলে দুলে উঠছে, যে-কোনো সময়ে উল্টে যাবে। সমস্ত কাচ তুলে গাড়িটা এক জায়গায় থামিয়ে রাখা হলো। বড় গাছপালা থেকে অনেক দূরে। একটু আগেই ওরা রাস্তার ওপর একটা শিরীষ গাছের ডাল ভেঙে পড়তে দেখেছে।

শান্তিমামা বেশ মজার মানুষ। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে যাবার বদলে তিনি। স্টিয়ারিং হুইল চাপড়ে চাপড়ে গান ধরলেন, ঝড় নেমে আয়, ওরে আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে ডালে…

রীতা মামীমা চোখ গোল গোল করে বললেন, এখন কী হবে? এই ঝড় যদি সহজে না থামে?

শান্তিমামা বললেন, তাতেই বা কী এমন হবে? আমরা সারা রাত এখানে থেকে যাবো!

রীতা মামীমা বললেন, যদি গাড়িটা শুদু উড়িয়ে নিয়ে যায়?

শান্তিমামা হেসে উঠে বললেন, সেটা হবে একটা ওয়ার্ড রেকর্ড! আকাশ পথে অ্যাম্বাসেডর গাড়ি! বিড়লার অপূর্ব কৃতিত্ব! একই সঙ্গে গাড়ি ও এরোপ্লেন! তোমার মাথাও খেলে বটে, ঝড়ে কোনদিন গাড়ি উড়ে গেছে এমন শুনেছো?

ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন পড়ছে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা। গাড়ির ছাদে যেন অনেকগুলো কাক একসঙ্গে দৌড়চ্ছো। রাস্তায় আর একটাও গাড়ি নেই।

আরও একটা গান গাইতে গাইতে হঠাৎ মাঝপথে থেমে গিয়ে শান্তিমামা বললেন, অলি, তোদের বাড়িতে আগুনটা কে লাগালো বল তো? আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা পলিটিক্যাল নয়। কৃষ্ণনগরে কোনো ছেলের সঙ্গে তোর প্রেম-ট্রেমের ব্যাপারে কোনো ঝগড়া হয়নি তো?

অলির বদলে রীতা মামীমাই বললেন, যাঃ, কৃষ্ণনগরে আবার কার সঙ্গে ওর প্রেম হতে যাবে?

শান্তিমামা ভুরু কুঁচকে বললেন, আবার মানে? অলির কী একটা প্রেম অল রেডি হয়ে গেছে নাকি?

–জামাইবাবুর এক বন্ধু, সাব জজ, তাঁর ছেলে অতীনের সঙ্গে অলি তোর ভাব ছিল না? সেই ছেলেটি এখন কোথায় রে, অলি?

–অলি এবার মৃদু গলায় বললো, সে এখন অ্যামেরিকাতে!

–কী করতে গেছে রে? চাকরি করছে, না পড়াশুনো?

–কেমিস্ট্রিতে পি-এইচ ডি করছে।

শান্তিমামা বললেন, কেমিস্ট্রিতে পি-এইচ ডি করার জন্য আমেরিকায় যাবার দরকারটা কী ছিল? সে যাকগে, অলির আর একটা বন্ধু থাকলেও কৃষ্ণনগরের কোনো ছেলে ওর প্রেমে পড়তে পারে না? একবার আমার নার্সিং হোমে একটা কেস এসেছিল, বুঝলি অলি, বহরমপুরের একটা ছেলে এক উকিলের মেয়েকে ভালোবাসতো, ছেলেটা একটু মাস্তান টাইপের, উকিলবাবু তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে তো রাজিই নয়, মেয়েকে মিশতেও বারণ করে দিলেন, তারপর সেই ছেলেটা একদিন উকিলবাবুকে মিস করে তার প্রেমিকার মামার মুখে অ্যাসিড বা ছুঁড়ে মারলো! সেই মামা ভদ্রলোকের একটা চোখ তো বাঁচানোই গেল না। বুঝে দ্যাখ ব্যাপারটা অলি, তোর প্রেমে কেউ ব্যর্থ হয়ে আমার পেটে বসিয়ে দিল ছুরি! দিনকাল হয়েছে এই রকম।

নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠলো শান্তিডাক্তার।

তারপর বললো, ঝড় অনেকটা কমেছে, নাও লেস স্টার্ট এগেইন!

খুব তোড়ে বৃষ্টি পড়ছে বলে রাস্তার সামনের দিকটা প্রায় কিছুই দেখা যায় না। গাড়ি চলছে খুব আস্তে। পেছনের সীটে বসেছে অলি আর রীতা মামীমা। গাড়ির মালিক নিজে গাড়ি চালালে বাড়ির কোনো লোককে সামনের সীটে বসতে হয়, এটাই নিয়ম, কিন্তু সামনের সীটে রাখা আছে একগাদা পেঁয়াজ কলি আর গোটা তিনেক লাউ, গাড়ির পেছনেও ভরে দেওয়া হয়েছে অনেকগুলো ঝুনো নারকোল। এসব অলিদের কৃষ্ণনগরের বাড়ির বাগানের ফসল।

রীতা মামীমার ছেলেমেয়ে কিছু হয়নি, তাঁর চেহারা অল্পবয়েসী তন্বীর মতন। শান্তিমামা মোটাসোটা ভারিক্কী ধরনের মানুষ, যদিও স্বভাবটা অনেকটা ছেলেমানুষ ধরনের। অলি তাকে কক্ষনো গম্ভীর সুরে কথা বলতে শোনেনি।

রীতা মামীমা এক সময় বললেন, অলি, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। তুমি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছো, খুব ভালো লাগছে, কিন্তু তুমি হঠাৎ বহরমপুরে আসার জন্য জেদ ধরলে কেন? এখানে কি তোমার বিশেষ কোনো কাজ আছে? কারুর সঙ্গে দেখা করতে হবে?

শান্তিমামা বললেন, এই রে, তুমি ওকে একটা পার্সোনাল ব্যাপার জিজ্ঞেস করে ফেললে? মেয়েটাকে তো আমি বাচ্চা বয়েস থেকে দেখছি, মিথ্যে কথা বলতে গেলেই ওর চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। তোতলাতে শুরু করে। খুব প্রাইভেট কিছু হলে তোকে বলতে হবে না রে, অলি!

অলি বললো, ছোটমামা, তোমাকে আর মামীমাকে আমি বলবো ঠিকই করেছিলুম। কিন্তু তোমরা প্লীজ বাবাকে কিছু জানিও না। বহরমপুর জেলে একজনের সঙ্গে আমাকে একটু দেখা করতে হবে!

–বহরমপুরের জেলে…তার মানে পলিটিক্যাল প্রিজনার কে?

–আমাদের একজন বন্ধু।

–আমাদের বন্ধু মানে? আমরা কি তাকে চিনি?

–না, তোমরা ঠিক চেনো না।

রীতা মামীমা বললেন, সেই অতীনের কোনো বন্ধু। তার মানে নকশাল। অতীন তো কী একটা বড় রকম চার্জে পড়েই আমেরিকায় পালিয়ে গেছে না?

অলি চমকে রীতা মামীমার দিকে তাকালো। আজকাল আর কারুকে কিছু বলার দরকার হয়। সবাই সব কিছু জেনে যায়। শান্তিমামা রীতা মামীমারা মাঝে মাঝে কলকাতায় আসেন, হয়তো বাবলুদাকে দু একবার দেখেছেন তাদের বাড়িতে, যদিও বাবলুদার বিষয়ে ওদের সঙ্গে

অলির কোনোদিন কোনো কথাই হয়নি!

শান্তিমামা বললেন, নকশাল প্রিজনারের সঙ্গে দেখা করবি, সে তো আগে থেকে পারমিশান। করাতে হয়। এমনি এমনি তো দেখা করতে দেবে না!

অলি বললো, আমার পারমিশানের চিঠি আছে। শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটে…তোমরা যদি হঠাৎ চলে না আসতে কৃষ্ণনগরে, তা হলে বাবাকে না বলে আমাকে একাই আসতে হতো।

–অলি, তুই বুঝি পাটি করিস? তোর মতন এরকম নরম-সরম মেয়েও যে ভেতরে

–না। আমি পার্টি করি না। বিশ্বাস করো। একজন আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছে। গাড়ির ড্যাস বোর্ড থেকে একটা রামের পাঁইট বার করে গলায় ঢালবার আগে শান্তিমামা বললেন, আমি একটু খাচ্ছি, অলি, তুই কিছু মনে করবি না তো?

রীতা মামীমা তাড়না দিয়ে বললেন, এই, তুমি ড্রিংক করছো যে এক্ষুনি? নার্সিং হোমে যেতে হবে না?

–আজ পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত নটা বেজে যাবে। আজ আর নার্সিং হোমে যাওয়া যাবে। শুভংকরের ডিউটি আছে, ও ম্যানেজ করবে।

গলায় খানিকটা রাম ঢেলে শান্তিমামা বললেন, তোকে একটা ঘটনা বলি, অলি! রীতা, সেই যে, সেই ডিসেম্বরের শনিবার রাত্তিরের ব্যাপারটা!

রীতা মামীমা বললেন, ওঃ, ভাবলেও এখনও আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়!

–ওরা কিন্তু ব্যবহার খারাপ করেনি, যাই বলো! শোন, অলি, সেটা এই তো মাস তিনেক আগের ঘটনা। ডিসেম্বরের শেষ শনিবার। ডি এম-এর বাংলোয় আমি তাশ খেলতে গেসলুম। বেশ শীত পড়েছিল সে রাতে। তাশ খেলা ভাঙলো যখন, তখন রাত পৌনে বারোটা। রীতাকে বলা ছিল, ফিরতে দেরি হবে। তাশ-টাশ খেলে আমি গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছি, তারপর পাঁচ মিনিটও হয়নি, হঠাৎ আমার কাঁধে ঠেকলো একটা পাইপগানের নল। ওরা দু’জন গাড়ির পেছনের সীটের তলায় শুয়ে ছিল। ভাব তুই ওদের সাহস, ডি এমের বাংলোর সামনে গাড়ি পার্ক করা, সেখানে সেন্ট্রি-ফেন্ট্রি থাকে, তারই মধ্যে ওরা কী করে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে শুয়ে ছিল। কতক্ষণ ধরে শুয়ে ছিল তাই বা কে জানে! ওদের ঐ সাহসের জন্যই আমি মনে মনে বললুম, জিতা রহো বেটা!

রীতা মামীমা বললেন, বাজে কথা বলো না! তোমার নিশ্চয়ই তখন ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল!

শান্তিডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলুম ঠিকই। একবার ভাবলুম, এবারে রীতা বিধবা হলো। অপারেশন টেবলে আমার হাতে কত লোক খতম হয়েছে, এবারে আমিও খতম। কিন্তু মনে মনে ছেলেগুলোর সাহসেরও তারিফ করেছিলুম। এটাও ঠিক! ওদের মধ্যে একজন বেশ ভদ্রভাবেই বললো, ডাক্তারবাবু, আমাদের একজন পেশেন্টকে দেখতে যেতে হবে। কিছু মনে করবেন না, আপনার চোখটা আমরা বাঁধবো, আপনি সরে বসুন! আমরা গাড়ি চালাবো।

রীতা বললেন, না, তুমি ভুল বলছো! ওরা তোমার চোখ বাঁধলো গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে।

–ও হ্যাঁ। প্রথমে ওদের একজন আমার গাড়িটা চালাবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই সময় আমার গাড়িটার যখন তখন স্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। গাড়িও তো অনেকটা ঘোড়ার মতন, ঠিক চেনা হাতের ছোঁয়া ছাড়া চলতে চায় না। গঙ্গার ধার পর্যন্ত আমিই চালিয়ে নিয়ে গেলুম। তারপর গাড়ি থেকে নামিয়ে আমার চোখ বাঁধলো একটা কালো কাপড়ে। সেখান থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল প্রায় পনেরো মিনিট। অত রাতে, শীতের মধ্যে ওদিকে আর লোক নেই তো। একটাও। আমি তখন কী ভাবছি বল তো? এরা সাধারণত একেবারে শেষ সময়ে ডাক্তার ডাকে। অনেক সময়ই সে রুগীর আর আশা থাকে না। ডাক্তারের হাতে রুগী মারা গেলে ডাক্তারের দোষ হয়। ওদের হাতে বন্দুক পিস্তল আছে, রাগে ঝড়াস করে গুলি চালিয়ে দেবে আমার পেটে। আজ রীতার বিধবা হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। আমি তখন মনে মনে আমার টাকা পয়সা উইল করে যাচ্ছি, আর মনে মনে বলছি, রীতা, তুমি আবার বিয়ে করো। তোমার চেহারা এখনও সুন্দর আছে।

–অ্যাই বাজে কথা বলো না! এই সবগুলো তুমি বানাচ্ছো!

–সত্যিই এই সবই ভাবছিলুম। চোখ বন্ধ থাকলে তো কিছু দেখার উপায় নেই, শুধু ভেবে যেতে হয়! একটা পড়ো বাড়িতে ঢুকিয়ে তো আমার চোখ খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কে যেন একজন বললো, এত দেরি করে ফেললি, সব শেষ! রীতার কপালে দ্বিতীয় বিয়ে নেই। আমি তার কী করবো? আমি পৌঁছোবার আগেই ওদের পেশেন্ট মারা গেছে। তখন আর আমাকে দোষ দেয় কী করে? আমাকে বললো, ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিতে। লিখলুম। যে মারা গেছে, তার নাম মানিক ভটচাজ। সে ওদের একজন বড়–গোছের লীডার!

অলি ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলো, কী নাম বললেন? চেহারাটা মনে আছে আপনার?

–আমি শুধু হাতটা তুলে ছুঁয়ে দেখেছি। মুখ দেখার দরকার হয়নি। ওরা সবাই মানিকদা, মানিকদা বলে খুব কান্নাকাটি করছিল। অবশ্য একজন আমাকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। ওফ, সেই একখানা রাত্তির গেছে বটে! আগে অতটা ভয় পাইনি বোধ হয়, কিন্তু ওরা যখন গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল, বুঝলুম যে আমি এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেছি, আর কোনো ভয় নেই, তখনই আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে এক পিকিউলিয়ার ফিলিং। গাড়ি আর স্টার্ট দিতেই পারি না।

গাড়ির মধ্যে অন্ধকার। তাতে অলির চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। তার কান্নায় কোনো শব্দ নেই। অলি স্টাডি সার্কেলে বেশীদিন যায়নি, ওদের দলের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখেনি, কিন্তু মানিকদাকে সে সত্যিই শ্রদ্ধা করতো। শুধু শ্রদ্ধাই নয়, মানিকদাকে দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগতো। মানিকদা নেই? অত নরম মনের একজন মানুষ, অতীন-কৌশিকরা প্রায়ই বলতো, মানিকদা যেন ওদের মায়ের মতন!

সারা পথ অলি আর কোনো কথা বলতে পারলো না।

পরদিন যথা সময়ে সে গেল কৌশিকের সঙ্গে দেখা করতে।

একটা ছোট ঘরের মাঝখানটায় আগে ছিল শুধু লোহার গরাদ, এখন জাল দিয়েও ঘিরে দেওয়া হয়েছে। কোনো জিনিস দেবার বা নেবার উপায় নেই। জেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অলি যে চিঠি পেয়েছিল, তাতেও লেখা ছিল যে প্রিজনারের জন্য কোনো উপহার আনা চলবে না।

সেই ঘরের দরজার কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে, সে কথাবার্তা শুনবে।

এক মুখ দাড়ি হয়েছে কৌশিকের, মাথায় এত বড় বড় চুল যে নিশ্চয়ই উকুন আছে। চোখ দুটো ও টিকোলো নাক দেখে চেনা যায় কৌশিককে। কপালের রংটাও যেন কালো হয়ে গেছে।

ঘরে ঢুকে কৌশিককে দেখা মাত্রই অলির চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো। কিন্তু তাকে হাসি মুখে কথা বলতে হবে।

অলির খুব অভিমান হলো বাবলুদার ওপর। বাবলুদা যেন স্বার্থপরের মতন একা পালিয়ে গেছে। যে দেশটাকে সে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করতো, সেই দেশে সে এখন টাকা রোজগার করছে, লাল রঙের গাড়ি কিনেছে, উইকএন্ডে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যায়। আর তার প্রাণের বন্ধু কৌশিক এই বহরমপুরের জেলে

কৌশিকই প্রথমে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছো অলি?

অলি কিছু না বলে মাথাটা হেলালো শুধু।

কৌশিক আবার জিজ্ঞেস করলো, বুলুদির কাছ থেকে চিঠিপত্র পাও? বুলুদির ছেলে খুব অসুস্থ শুনেছিলুম।

বুলুদি নামে কেউ নেই। অলিকে সব আন্দাজে বুঝে নিতে হবে। হয়তো বুলুদি মানে বাবলুদা!

–হ্যাঁ, চিঠি পেয়েছি। এখন ভালো!

–তোমাদের বাগানে লাল গোলাপ ফুল ফুটেছে এবার? ইস, কতদিন যে লাল গোলাপ দেখিনি। একটা আনতে পারলে না?

লালগোলাপ মানে লালবাজার। পমপমকে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন জেরা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে শারীরিক অত্যাচার। মাঝখানে রটে গিয়েছিল যে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পমপম পাগল হয়ে গেছে। সেই খবরটা দিতেই অলির এখানে আসা। পমপমের অসম্ভব মনের জোর। পমপম ফিটের রুগী হবার ভান করে হাসপাতালে গিয়েছিল। পি জি হাসপাতালে পমপমের সঙ্গে অলি দেখা করেছিল একদিন। পমপম ভালো আছে। পমপমই অলিকে অনুরোধ করেছিল যে-কোনো ভাবে হোক একবার কৌশিকের সঙ্গে দেখা করতে।

সে বললো, না, এবার সব লালগোলাপ ফুরিয়ে গেছে। সাদা ফুটেছে কয়েকটা।

গেটের সামনে দাঁড়ানো লোকটির ঠোঁটে মৃদু হাসি। সে জানে যে এসব অর্থহীন কথার অন্তরালে অন্য কোনো অর্থ আছে। হয়তো মনে মনে টুকে নিচ্ছে কথাগুলো। পরে ডি-কোড করবার চেষ্টা করবে!

দু একটা সাধারণ কথা বলার জন্যই অলি জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে এরা কী খেতে-টেতে দেয়? পেট ভরে?

কৌশিক বললো, আমরা তো এখানে রান্না করে খাই, জানো না?

–তোমাদের কি শিগগিরই কোর্টে প্রোডিউস করবে?

–সেরকম কিছু শোনা যাচ্ছে না।

অলি আর একটা কথা চিন্তা করলো। ছোটমামা বলেছিলেন, জেলের ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর চেনা আছে। তিনি তাঁকে বলে কৌশিককে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন। তা হলে ও স্পেশাল ডায়েট পাবে। কিছুটা আরামে থাকবে। কিন্তু অলির ধারণা, সেরকম চেষ্টা করা হলেও কৌশিক একা নিজের জন্য আলাদা কোনো সুযোগ নেবে না।

তবু সে জিজ্ঞেস করলো, তোমার যে পেটে ব্যথা হতো খুব? আলসার কিনা দেখিয়েছো?

কৌশিক সেটা উড়িয়ে দিয়ে বললো, এখন ভালো আছি। ব্যথা-ট্যাথা কিছু নেই। ওসব সেরে গেছে।

তারপর অলির চোখের দিকে চোখ রেখে কৌশিক জিজ্ঞেস করলো, আমার মা কেমন আছে? মায়ের সঙ্গে তুমি কি দেখা করে এসেছো?

কৌশিকদের বাড়িতে অলি যায় নি বটে, কিন্তু তার মা সম্পর্কে বিশেষ খারাপ কোনো খবর শোনে নি। এখনকার দিনে কোনো ছেলে যদি নকশাল হিসেবে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, তাহলে তার মা নিশ্চয়ই রাত্তিরে ঘুমোতে পারেন না। সুতরাং কৌশিকের মা নিশ্চয়ই ভালো নেই, তবে বেঁচে আছেন।

অলি বললো, তোমার মায়ের শরীর সুস্থ আছে।

কৌশিক আবার জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমার মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে? তিনি কিছু বলেছেন?

অলি এবার বুঝতে পারলো, কৌশিক নিজের মায়ের কথা জানতে চাইছে না। বাবুলদা-কৌশিকরা যাঁর সম্পর্কে বলতো আমাদের মায়ের মতন,সেই মানিকদার কথা ও জানতে চাইছে। কিন্তু সেই নামটা উচ্চারণ করা যাবে না।

এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে অলি? সে কি মিথ্যে কথা বলবে? তার চোখে আবার জল আসছে। কিন্তু কৌশিকের সামনে কিছুতেই দুর্বলতা দেখালে চলবে না।

এমনও তো হতে পারে, অলি প্রশ্নটা বুঝতে পারলো না। মা মানে পার্টির হেড মনে করাও সম্ভব। চারু মজুমদার এখনও ধরা পড়েননি।

অলি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো, ভালো আছেন। তোমার মা ভালো আছেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *