পাঁচ
কুঞ্জবনে ফুল দিয়ে সাজানো লতার দোলনায় শান্ত হয়ে বসে আছে অর্জুন। তার স্বভাবে চাঞ্চল্য নেই বলেই সে গভীর করে ভাবে। গভীর করে দেখে। লক্ষ্য ভেদ করতে পারে নির্ভুল। তবু সে এক তরুণ। কখনও কখনও চিত্ত উত্তাল হলে তাকে বশে আনার জন্য অর্জুনকে সংগ্রাম করতে হয়। সে জয়ী হয় বটে, কিন্তু তার অব্যবহিত পরেই আসে বিষাদ। বিষাদকালে অর্জুন একমাত্র ভাল থাকে অস্ত্র অভ্যাস করলে। আর যবে থেকে দেখেছে কৃষ্ণকে, মনে হয়, তার মুখ কল্পনা করলে বিষাদভাব কেটে যায়। কৃষ্ণ কৃষ্ণ— উচ্চারণ করলেই ভেতরে কেমন আপ্লুতি আসে। কেন এমন হয়? কৃষ্ণ আসলে কে? কৃষ্ণ কী?
কৃষ্ণকে প্রথম দেখার দিনটি কোনওদিন ভুলতে পারবে না অর্জুন। কৃষ্ণ আর কৃষ্ণা— দু’জনকেই যে একই দিনে একই আসরে দেখা! অর্জুন, একমাত্র অর্জুন নিজে জানে, সেদিন আর সবাই যখন পাঞ্চালীকে হাঁ করে গিলছিল— অর্জুনের চোখ তখন ছিল কৃষ্ণর দিকে। কী অমোঘ আকর্ষণ কৃষ্ণর, যে বিশ্বের সবচেয়ে লোভনীয় মেয়েকে ছেড়েও তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে! অর্জুন এই মুহূর্তের কথা বহুবার ভেবেছে। এই মুহূর্ত তার অন্যতম প্রিয় চিন্তা। সে এর ব্যাখ্যা চায় না। বার বার স্বাদ নিতে চায়।
সেদিন, ভীমের আঙুলের খোঁচায় সে পাঞ্চালীর দিকে মন দিয়েছিল। ভীম ফিসফিস করে তার কানে কানে বলছিল, “মেয়েটা যেন আগুন, তাই না?” অর্জুন ভীমের চোখে ঘোর দেখেছিল। ভীম বলে যাচ্ছিল, “এমন রূপ আর কারও নেই। আমার মনে পড়ছে, ব্যাসদেব মাকে বলে গিয়েছিলেন দ্রুপদরাজার মেয়ে আমাদের পাঁচ ভাইয়ের হবে। মনে পড়ছে তোমার? অর্জুন? একটা মেয়ে কী করে পাঁচজনের হতে পারে? শুনেছি ব্যাসের বাণী মিথ্যে হয় না। আমাদের পাঁচজনের হোক না হোক, এই মেয়ে তোমার গলাতেই মালা দেবে অর্জুন। লক্ষ্যভেদের যা শর্ত, একমাত্র তুমিই তা পারবে। এ মেয়ে যদি তোমার হয়, অর্জুন, একে কখনও কষ্ট দিয়ো না।”
অর্জুন ভীমকে দেখেছিল। বুঝেছিল। আরও অনেক কিছু বুঝেছিল। বলেছিল, “ব্যাসদেবের কথা মনে ছিল না আমার। এখন যেন অল্প অল্প মনে পড়ছে এরকম কিছু। তবে ভীম, এই লক্ষ্যভেদের কাজটা তুমি যতখানি ভাবছ, ততখানি কঠিন নয়। যে কোনও ভাল তিরন্দাজ মনোনিবেশ করে একাগ্র হলে লক্ষ্য ভেদ করতে পারবে। এখানে খেলাটা দক্ষতার নয় শুধু, একাগ্রতার।”
“তোমার মতো একাগ্র আর কে?”
“লোকে বলে আমিই ত্রিভুবনের সেরা ধনুর্ধর। কিন্তু এই কাজের জন্য কর্ণও যথেষ্ট।”
“ও তো সারথির ছেলে। পাঞ্চালী ওর গলায় মালা দেবে নাকি? আর তুমি যতই বলো অর্জুন, কাজটা কর্ণ পারবেই না। মাথার উপর মাছ ঘুরছে, নীচে জলে তার প্রতিবিম্ব দেখে, উপরের মাছের চোখে তির লাগাতে হবে— এ কি যার তার কাজ?”
“না ভীম। এ কর্ণর পক্ষে শক্ত নয়। ভুলে যেয়ো না, ভীষ্ম দ্রোণাচার্য্য যাঁর শিষ্য, কর্ণও সেই পরশুরামের শিষ্য। আর মালাই বা সে পাবে না কেন? দ্রুপদের ছেলে তো বললই— যে কেউ, সে যে জাতিই হোক, যে কুলেরই হোক, বর্ণ যাই হোক তার— লক্ষ্যভেদ করতে পারলেই সে জয়ী।”
“তুমি যখন বলছ, তখন হয়তো কর্ণ পারলেও পারতে পারে। কিন্তু ওই ব্যাটা সারথির পোয়ের কথা বোধহয় দ্রুপদের মনে ছিল না, তাই না? রাখত দ্রুপদ গদা মেরে ভেঙে চুরমার করার শর্ত, দেখিয়ে দিতাম।”
“দুর্যোধনও দেখিয়ে দিত ভীম।”
ভীম দাঁত কিড়মিড়িয়ে দুর্যোধনের মুণ্ডুপাত করছিল।
না। সেদিনের কথা ভাবতে চায় না অর্জুন। বিশ্ব জানে, সেদিন অন্যায় হয়েছিল কর্ণর সঙ্গে। কর্ণ! তার চরম প্রতিযোগী কর্ণ! কী স্পর্ধা! সামান্য সারথির ছেলে হয়ে রাজার ছেলের সমকক্ষ হতে চায়! হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, কর্ণ অসম্ভব রূপবান। ক্ষত্রিয়ের মতোই সে বিরাট। সুগঠিত। আর এখন সে রাজাও বটে। অর্জুন শুনেছে, কর্ণ ভালই রাজত্ব চালাচ্ছে। কেমন করে করছে? সারাক্ষণ তো হস্তিনাপুরে দুর্যোধনের সঙ্গে পড়ে থাকে। এ এক আশ্চর্য! দ্রোণাচার্য্যকে দ্রুপদের অর্ধেক রাজত্ব পাইয়ে দিয়েছিল অর্জুন সেই কোন বালকবেলায়। তার গুরুদক্ষিণা। প্রথম যেদিন দ্রোণের কাছে এল তারা, একশো ধার্তরাষ্ট্র এবং পাঁচ পাণ্ডব, তাদের সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে দ্রোণ ঘুরে ঘুরে সবার মুখ মাথা হাত-পায়ের গড়ন দেখছিল। অর্জুনের বুকের মধ্যে শিরশির করছিল। কী এক অজানিত উত্তেজনা! কী এক আশ্চর্য পুলক! কুন্তী বলেছিল, “মনে রেখো, গুরু পিতার সমান, তাঁকে মান্য করবে। আর মনে রেখো, অস্ত্র শিক্ষা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। সেই ধর্মই তোমাদের জীবন।” ধর্ম কী? কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না অর্জুনের। তির হাতে নিলে তার আনন্দ জাগে। যাতে সে আনন্দ পায় তাতেই সে নিজেকে সমর্পণ করবে। সে ধনুর্বিদ্যা আয়ত্ত করবে। এই ছিল তার ধর্ম।
নিরীক্ষণ শেষ করে দ্রোণ সেদিন বলেছিল, “তোমরা ক্ষত্রিয়। রাজ পরিবারের ছেলে। আমি তোমাদের অস্ত্র চালানো শেখাব। শেখাব যুদ্ধবিদ্যা। ভবিষ্যতে তোমরা পৃথিবীখ্যাত বীরত্ব লাভ করবে। মনে রেখো, আমি তোমাদের কাছে গুরুদক্ষিণা চাইব। আমার একটি কাজ তোমাদের করে দিতে হবে। কী কাজ, আমি আজ বলব না। বলো। কে করবে আমার কাজ?” সবাই নির্বাক। কেউ কিছু বলছে না। কে জানে, গুরু কী কঠিন দক্ষিণা চেয়ে বসবেন! প্রতিজ্ঞা রাখতে শেষে না নাকাল হতে হয়!
অর্জুন দেখেছিল, একে একে মাথা নত করছে সবাই। দুর্যোধনসহ একশোজন। যুধিষ্ঠিরসহ তার চার ভাই। সে আশা করেছিল, যেমন সব বিষয়ে মত প্রকাশ করে যুধিষ্ঠির, তেমনি, এবারেও সে পাঁচ ভাইয়ের পক্ষ থেকে প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করবে। তার আশা ফলল না। সে তখন দু’হাত জোড় করে বলেছিল, “গুরুদেব, আপনি আমার পিতার মতো। আমি আপনার প্রিয়সাধন করব। যে-কাজ বলবেন, তাই করে দেব আমি।”
সবাই বিস্ময়ে তাকিয়েছিল অর্জুনের দিকে। দ্রোণ খুশি হয়ে অর্জুনকে কোলে তুলে আদর করেছিল।
পরে যুধিষ্ঠির রাগ করে বলেছিল, “কী কাজ না জেনেই প্রতিজ্ঞা করা নির্বুদ্ধিতা হয়েছে তোমার অর্জুন।”
ভীম বলেছিল, “কেন? নির্বুদ্ধিতা কেন? অর্জুন তো আজই প্রতিজ্ঞা রাখতে যাচ্ছে না। ও কীরকম লক্ষ্য ভেদ করে দেখোনি যুধিষ্ঠির? লক্ষ্যভেদের খেলায় ওকে কেউ হারাতে পারে না। ও বিরাট ধনুকবাজ হবে। তুমি দেখে নিয়ো।”
অর্জুন বলেছিল, “যিনি কাজ করিয়ে নেবেন, তিনিই কাজের উপযুক্ত করে আমাদের গড়ে তুলবেন। এই আমার বিশ্বাস।”
যুধিষ্ঠির বলেছিল, “দেখো অর্জুন, এ তোমার মিথ্যা অহংকার হয়ে না দাঁড়ায়।”
অর্জুন কথা রেখেছিল। দ্রোণের অভীপ্সা পূর্ণ করতে রাজা দ্রুপদকে যুদ্ধে হারিয়ে দ্রোণাচার্য্যর কাছে বেঁধে এনেছিল। ব্রাহ্মণ দ্রোণ ক্ষত্রিয়ের মতো বীর ধনুর্ধর, রাজা। কিন্তু সে নিজের রাজ্যে থাকে না। থাকে হস্তিনাপুরে। অমাত্যরা দ্রোণের রাজত্ব ভালই চালাচ্ছে। সূত কর্ণও সেই একই পথ নিয়েছে। হস্তিনাপুরে বসেই সে রাজ্যও চালায়, আবার দুর্যোধনকে মন্ত্রণা দিয়ে বন্ধুত্বের ঋণ শোধে। কী করে পারে? ক্ষত্রিয় নয় বলেই কি ক্ষত্রিয়োচিত ধর্মে দ্রোণ ও কর্ণর আনুগত্য কম? রাজধর্মর চেয়ে বড় কিছুই ক্ষত্রিয় রাজার ধর্ম হতে পারে না। যাক গে! অর্জুনের জানার এতটুকু আগ্রহ নেই। কিন্তু সেদিন কর্ণর সঙ্গে যে-অন্যায় হয়েছিল তার প্রতি অর্জুনের কোনও নৈতিক সমর্থন নেই। অর্জুনের সেদিনের জয়ের অনুভবে গ্লানি মিশে গিয়েছে।
বড় করে শ্বাস টানল সে! কী সুন্দর এ কুঞ্জবন! ফুলের কী সুগন্ধ! কী চমত্কার এই বসন্তসন্ধ্যা। তার মধ্যে এসব কী ভাবছে সে! যা রেখে এসেছে, আবর্জনার ঝুড়ির মতো তাকে মনে বইছে কেন? অর্জুন সুগন্ধী ফুলমালা হাতে জড়াতে লাগল। তার খোলা বুকে দুলছে ফুলের মালা। তার ঘন ঢেউ খেলানো চুল ঝাঁপিয়ে পড়ছে চওড়া বলিষ্ঠ কাঁধে। যেন বাদলের মেঘ এসে ঘিরে ধরেছে পাহাড় চূড়া আর গলায় পরিয়ে দিয়েছে বিদ্যুতের মালা। অর্জুন নিজেই জানে না তাকে কী অসম্ভব রূপবান লাগছে! আর সে তো রূপবান বটেই। সুন্দর যদি নিজেই নিজেকে ছাপিয়ে যায়, তা হলে যেমন হয়, আজ অর্জুন সেইরকম।
কুঞ্জের দুয়ারে এবার উলূপীকে দেখতে পেল অর্জুন। সে উঠে দাঁড়াল। দু’জনে মুখোমুখি। দু’জনেই মুগ্ধ। দূরে অনেকগুলি শিঙা বেজে উঠল। কুঞ্জকুটিরে যেন বনদেবী আর বনদেবতা পরস্পরকে দেখতে লাগল। দু’জনের রূপে দীপাধারের আলোর শিখা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উলূপীর মনে হতে থাকল, এই অর্জুন, এই বীরশ্রেষ্ঠ, এই পরম রূপবান পুরুষটি যদি তাকে আর ছুঁয়েও না দেখে, তবু, এই সুন্দর দর্শনে তার জীবন সার্থক হয়ে গিয়েছে। সে ধীরে ধীরে অর্জুনের পায়ের কাছে জানু পেতে বসল। অর্জুন বলল, “উলূপী, আজ তুমি বসন্তের চাঁদের মতোই সুন্দর। আজ তুমি স্নিগ্ধ এবং উগ্র। আজ তুমি শান্তি এবং তৃষ্ণা। পায়ের কাছে নয়। তোমার আসন আমার বুকের ওপর।”
উলূপী নিচু স্বরে, ধীরে, বলল, “অর্জুন, তোমার সব কিছু আমার।” অর্জুনের পায়ের পাতায় চুমু খেল সে। “আমার সবকিছু তোমার।” অর্জুনের হাঁটু জড়িয়ে ধরল। অর্জুনের সারা শরীরে চুমু খেতে খেতে, নিজের নরম-কঠিন স্তন ঘষটাতে ঘষটাতে সাপিনীর মতো পাক খেয়ে খেয়ে সে উপরের দিকে যেতে লাগল। জানু থেকে ঊরু, ঊরু থেকে শিশ্নদেশ, শিশ্নদেশ থেকে নাভি, নাভি থেকে পশ্চাৎ, পিঠ থেকে বুক, বুক থেকে কণ্ঠ— অর্জুন আর থাকতে পারল না! তার সমস্ত শরীরে আগুন লেগে গেল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত দাহন। ক্রোধ নয়, এ কাম। সে সবলে জড়িয়ে ধরল উলূপীকে। অর্জুনের বুকে পিষ্ট হতে হতে উলূপী কাঁদতে লাগল সুখে। অর্জুন তার চোখের নোনতা জল চুষে চুষে খেয়ে ফেলল চোখ। যেমন করে সাপ সরু গর্তে ঢুকে যায়, তেমনি করে অর্জুনের কানের রন্ধ্রে জিভ ঢুকিয়ে দিল উলূপী। অর্জুন তাকে কোলে তুলে নিল। খেয়ে ফেলল জিভ। খেয়ে ফেলল ঠোঁট। তাকে যত্ন করে শুইয়ে দিল ফুলের বিছানায়। কান্নার মতো স্বরে বলল— উলূপী, তুমি আমার প্রথম নারী। আঃ! কী কষ্ট উলূপী! কী কষ্ট! আমি কী করব বলে দাও। আমাকে বলো।
উলূপী দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছে। উত্তুঙ্গ স্তন ওঠা-নামা করছে অতি ব্যগ্রতায়। সে শ্বাসের ভিতর থেকে বলল, “তোমার কী ইচ্ছে করছে অর্জুন? বলো! বলো!”
অর্জুন কাতরভাবে বলল, “এই দুই হাত তোমার স্তন পিষ্ট করতে চাইছে।”
“করো। খুলে দাও ফুলের আবরণ। এই সব তোমার।”
“আমার ঠোঁট, আমার জিভ লেহন করতে চাইছে তোমার সব। সারা শরীর।”
“করো অর্জুন, আমাকে লেহন করো। কামড়াও। আমাকে মারো। রমণ করো আমাকে। রমণ আর মরণ যে একই। একই।”
“উলূপী এই শিশ্ন অতি কাতর। সে তোমার গভীরে যেতে চায়। কিন্তু এ কোন বাধা! উলূপী!”
ধীরে ধীরে উঠে বসল উলূপী। খুলে ফেলল ফুলের সাজ। খুলে ফেলল বসন। অর্জুনকে নগ্ন করে দিল। শিশ্ন থেকে, অতি যত্নে, অতি নৈপুণ্যে অল্পে অল্পে সরিয়ে দিতে থাকল কৌমার্যের আবরণ। অর্জুন মুখ দিয়ে শব্দ করতে লাগল, আঃ আঃ আঃ!
উলূপী অর্জুনকে বুকে টেনে নিল। ধারণ করল তাকে।
বার বার সঙ্গম করেও আশ মেটে না। ক্লান্তি আসে না। স্বেদে আর কামরসে মাখামাখি দুই শরীরে লেগে রইল রমণে পিষ্ট ফুলের পাপড়িগুলি।
ছয়
শেষ প্রহরের শেষের সময় হল। উলূপীকে নিজের শরীরের উপর তুলে জড়িয়ে শুয়েছিল অর্জুন। এইবার তাকে উঠতে হবে। অস্ত্র অভ্যাস করতে হবে। কিছু যোগ ক্রিয়া। অস্ত্র চালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যায়াম। সমস্ত পূজার আগে এই তো তার আদি পূজা।
উলূপীর গালে চুমু খেল অর্জুন। কপালে চুমু খেল। নীচের ঠোঁটে আলতো কামড় দিয়ে বলল, “চলো। উঠি।”
কোনও জড়তা নেই। বিহ্বলতা নেই। প্রথম সঙ্গমের পরেই সব কাটিয়ে উঠেছে অর্জুন।
উলূপী অর্জুনের শরীর থেকে নেমে তার হাতে মাথা রেখে শুয়ে বলল, “এখুনি চলে যাবে?”
অর্জুন পাশ ফিরে উলূপীকে বুকে টেনে বলল, “তুমি কী চাও? চলে যাই?”
“আমি যে কথা দিয়েছি তোমাকে অর্জুন। একটি রাত পেলে তোমাকে বাঁধব না বলেছি। তুমি জানো আমার মন কী চায়।”
অর্জুন উলূপীর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “পাগলি! তুমি আমার প্রথম নারী। মৈথুনরত পশুপাখি আমি অনেক দেখেছি বনে বনে। তাদের কামমোহিত দশার সম্মোহন শক্তি আমি অনুভব করতে পারিনি। তুমি আমায় দিয়েছ সেই অনুভব। কুমার থেকে পুরুষ করেছ তুমিই আমাকে। যে-সুখ তুমি দিয়েছ আমাকে, যে-আনন্দ দিয়েছ, তা যে বার বার পেতে ইচ্ছে করছে আমার। আজই তোমাকে ফেলে চলে গেলে এই অর্জুন আর বাঁচবে নাকি?”
“অর্জুন! আমার অর্জুন!”
উলূপী আনন্দে অর্জুনের বুকে মুখ ঘষতে লাগল। কদ্রু দেবীর আশীর্বাদে অনেক পেয়েছে সে। অনেক। তার আর কোনও দুঃখ নেই। সে বলল, “চলো।”
বসন পরে অর্জুনকে সে নিয়ে চলল শ্বেতনাগিনীর কাছে। আজ, এমন আনন্দের রাতে, শ্বেতনাগিনীর জলে স্নান না করলে যে আয়োজন পূর্ণ হবে না!
পশুরা শ্বেতনাগিনীর ধারে ধারে বিশ্রাম নিচ্ছিল। একটানা জলকল্লোল ভারী পবিত্র করে তুলছিল পরিপাশ। উলূপী বলল, “এ আমার প্রিয় জায়গা অর্জুন। আমি দুঃখ হলে এখানে আসি, সুখ হলেও।”
অর্জুন বলল, “তোমার সব কিছুই সুন্দর উলূপী। এই জল, এই বন সব তোমার উপযুক্ত। সবাই তোমাকে ভালবাসে। ওই পশুদের দেখো, ওরাও তোমাকে চেনে। তোমাকে ভালবাসে। তাই তো ভয় পাচ্ছে না।”
দু’জনে স্নান করতে লাগল। স্নানের সময়ও তারা পরস্পরকে ছুঁয়ে থাকল। চন্দ্রা শুকনো বসন এনে পাড়ে রেখে গেল। উলূপী বলল, “তুমি কি যজ্ঞ দিয়ে দিন শুরু করবে অর্জুন?”
অর্জুন বলল, “আগে আমার ক্ষত্রপূজা উলূপী। তুমি আমাকে সেইরকম জায়গায় নিয়ে চলো।”
“ধনুর্বাণ চাই তোমার?”
“পেলে মন্দ হয় না।”
“চলো।”
উলূপী অর্জুনকে নিয়ে চলল বনের ভিতরে একটি খোলা মাঠে। নানান রকম ধনুক-বাণ সেখানে কেউ সাজিয়ে রেখে গিয়েছে। অর্জুন খুব খুশি হল। পছন্দমতো একটি ধনুক তুলে নিল সে। শর যোজনা করল। সবিস্ময়ে দেখল, উলূপীও তুলে নিয়েছে ধনুক-বাণ। নিখুঁত লক্ষ্যে বাণ চালাল সে। মুগ্ধ স্বরে অর্জুন বলল, “উলূপী, ধন্য আমি।”
উলূপী হেসে বলল, “পার্থ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাই হল প্রেমের ধারণ পাত্র। শ্রদ্ধা না থাকলে ক’দিনের ব্যবহারে প্রেম ক্ষয়ে যায় মাটির কলসির ঘষায় যেমন ক্ষয়ে যায় পাথর। ক’দিনের অদর্শনেই ফুরিয়ে যায় প্রেম যেমন ঢাকনা খোলা পাত্র থেকে উপে যায় কর্পূর।”
অর্জুনের মন এখন সত্যিই শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ। এই অন্ধকারে লক্ষ্যভেদ সহজ নয়। কিন্তু উলূপী সহজেই তা পেরে যাচ্ছে। তার দক্ষতা সংশয়াতীত।
উলূপী বলল, “নাগমেয়েরা সবাই অল্পবিস্তর অস্ত্র চালাতে জানে। আমাদের আদি মাতা কদ্রু জানতেন। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে বৈদ্য, আয়ুর্বেদজ্ঞ এবং অস্ত্রকুশলী। আমাদের নাগপালনের তিনিই আদি জননী। অর্জুন, তুমি কি নাগপাশ বাণের নাম শুনেছ?”
“শুনেছি। আমার আয়ত্ত নেই। শুনেছি তা মন্ত্রসিদ্ধ।”
“সেই মন্ত্র আমি তোমাকে শেখাব অর্জুন। আমি তোমাকে দেব নাগপাশ বাণ।”
“আমি ধন্য উলূপী।”
সাত
অতি সুখে অতি আনন্দে দিন যাচ্ছে অর্জুনের। তার ক্রিয়াকর্মাদি সম্পর্কে উলূপী এতখানি যত্নশীল যে, অর্জুনের কিছুমাত্র অভাব বোধ হচ্ছে না। সে যেন কুন্তী মায়ের বুকের কাছেই থাকছে সারাক্ষণ। ভাইদের জন্য তার বড্ডই মন কেমন করে। কিন্তু এই পরবাসের বারো বছর তার প্রতিকার খুঁজতে যাবার কোনও মানে হয় না। প্রত্যেক ভাইকেই সে প্রবল ভালবাসে। কিন্তু প্রাণ বেশি টানে ভীম আর নকুলের জন্য। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এখন তিন ভাই আছে, তার ধর্মচর্চা ও শাসনকর্ম আছে, মা কুন্তী আছে, আর… আর পাঞ্চালীও আছে সবার চোখের মণি হয়ে। সহদেব কুন্তীর এত আদরের যে, মায়ের কাছে থাকলে তার আর কিছু চাই না। নকুলটাই একটু একলা একলা। একেবারে স্বল্পভাষী নকুলের কোনও দাবি নেই, কোনও আবদার নেই। সারাক্ষণ নীরবে সেবা করে যায়। গাছে উঠতে হবে, যাও নকুল। গোরুর অসুখ করেছে, নকুল দেখো। অস্ত্রশালা পরিচ্ছন্ন করতে হবে, বলো নকুলকে। হাজার কাজ। লড়াই করতেও সে পিছপা নয়। নকুল রীতিমতো বীর। বহু ধরনের অস্ত্র সে ব্যবহার করতে পারে। বিচিত্রভাবে যুদ্ধ করতে পারে বলেই সে চিত্রযোধী খেতাব পেয়েছে। তা ছাড়াও বীরত্বের বিচারেও নকুল অতিরথ পর্যায়ে।
একবারের কথা অর্জুনের চিরকাল মনে থাকবে। রসাল আম পেকেছে গাছে। যুধিষ্ঠির নকুলকে বলল আম পাড়তে। বারণাবতের অগ্নিচক্রান্ত থেকে বেঁচে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন। নকুল গাছে উঠল। অনেক আম পাড়ল। তারা সবাই আনন্দে আম খাচ্ছে। নকুল বলল, “তোমরা খাও। আমি নদীতে ডুব দিয়ে আসি। গাছের শ্যাওলা লেগেছে গায়ে।”
নকুল একটু পরিপাটি বটে। তবু অর্জুনের সন্দেহ হল। “আমিও দুটি ডুব দিয়ে আসি” বলে সেও গেল নদীর দিকে। সেখানে একটি পাথরের আড়ালে বসে খুব মন দিয়ে নিজের ঊরু দেখছিল নকুল। অর্জুন নিঃশব্দে তার পিছনে গিয়ে বলল, “কী হয়েছে নকুল?”
নকুল চমকে উঠল প্রথমে। তারপর ম্লান হেসে বলল, “ওই সামান্য ক্ষত।”
“কই দেখি!”
ক্ষত্রিয়ের কাছে শারীরিক ক্ষত ভয়ের নয়, কিন্তু গুরুত্বের। কারণ যোদ্ধা মাত্রই জানে, সাধারণ ক্ষতও বিষিয়ে গিয়ে অঙ্গহানি পর্যন্ত হতে পারে। সে উবু হয়ে বসল নকুলের পাশে। দেখে, একটি গভীর ক্ষত, আমগাছের ভাঙা ডালের তীক্ষ্ণ মাথা শলাকার মতো গেঁথে গিয়েছিল। রক্তপাতের গন্ধে সেই ক্ষত ঘিরে ফেলেছে বিষ পিঁপড়ের দল। নকুল ছাড়িয়ে শেষ করতে পারছে না।
কতখানি যন্ত্রণা পাচ্ছিল নকুল জানে অর্জুন। সে তাড়াতাড়ি শুশ্রূষায় হাত লাগিয়েছিল। নকুল বলেছিল, “একথা যেন আর ভাইদের বা মা কুন্তীকে বোলো না অর্জুন। আর আমাকে গাছে উঠতে দেবে না।”
ভালবাসায় বুক টাটিয়ে উঠেছিল অর্জুনের। সে কথা রেখেছিল। তাকে বুঝেছিল অর্জুন। নকুল বড় বীর কিন্তু সে অর্জুন বা ভীম হতে পারেনি। সে অতি রূপবান। কিন্তু আর সব কিছুতে অতি সাধারণ। যদিও নকুল বাঁশি বাজায় ভাল। নকুলের সব আছে। কিন্তু ভীম ও অর্জুনের বিশালতার সঙ্গে তুলনা হয় বলেই সব থাকাও সাধারণ হয়ে ওঠে। সাধারণ্যের ফাঁকটুকু সে সেবা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে চায়। তার এই গোপন আকাঙ্ক্ষার কথা অর্জুন কাউকে বলবে না! সেইদিন অর্জুন বুঝেছিল, কী দারুণ একলা নকুল!
মনে মনে একলা সংগ্রাম যার চরিত্রে, তার মতো দুখী লোক আর কেউ নেই। সবাই যে যার নিজের মতো একা। অর্জুন নিজেকে দিয়ে তা বুঝতে পারে।
ভীমের জন্য মায়া হয় অর্জুনের কারণ প্রচুর খায়, এর-তার সঙ্গে গল্পগাছা করে, শক্তির আস্ফালন করে আর পটাপট রাক্ষস মারতে পারে বলে ভীমকেও লোকে প্রায় রাক্ষস বলেই মনে করে। ওই বিশাল বপু, ওই জাদুকরের মায়াজালের মতো তার অনায়াস গদা চালনা, মনে হয়, পর্বত যেন হাত-পা গজিয়ে যুদ্ধে নেমেছে। ভীম বিষ খেয়েও বেঁচে ওঠে। ভীম রাক্ষসের ত্রাস। একা ভীম অনায়াসে বহন করেছে মা কুন্তীকে, নকুল ও সহদেবকে। ভীম চাইলে বয়ে আনতে পারে গোটা পর্বত। অল্পেই মাথা গরম করে যা মুখে আসে বলে দেয় যাকে-তাকে। কিন্তু কেউ ভেবে দেখেনি, ভীম আসলে একটি শিশু। একটু আদরের জন্য সে কেমন কাঙাল। মা কুন্তী একদিন সহদেবের মাথা কোলে নিয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে, ভীমসেন সতৃষ্ণ চোখে তা দেখছে। তার চোখের পলক পড়ছে না! অর্জুন তাকে নজর করছে দেখে সে লাজুক হেসে বলল, “সহদেব তো সবার ছোট আর ভারী আদর-কাড়া তার স্বভাব। সে মায়ের আদরের বড় কাঙাল, তাই না অর্জুন?”
অর্জুনের মনে হয়েছিল, সে যদি মা হতে পারত, ভীমকে ওমনি করে আদর করত!
আর সেই দিনটা? হিড়িম্বাকে ছেড়ে আসার দিন? কেউ জানে না, অর্জুনকে জড়িয়ে কত কেঁদেছিল ভীম। কত ভালবাসা প্রকাশ পাচ্ছিল তার হিড়িম্বা আর ঘটোত্কচের জন্য! সে বলেছিল, “কেন ওরা আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে না অর্জুন? কীসের বাধা?”
জানে না অর্জুন। সমাজের সব নিয়মের ব্যাখ্যা সেও জানে না। সেই না জানার জায়গাটুকুতে যুধিষ্ঠিরের নির্দেশকেই সে ধর্ম বলে মানে। যুধিষ্ঠির যখন হিড়িম্বাকে সঙ্গে নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি তখন ধর্মত তা মানতে হবে। যুধিষ্ঠির অধর্ম করতে পারে না— অর্জুন নিয়ত একথা নিজেকে বোঝায়।
সেই অসম্ভব কষ্টের মুহূর্ত তার জীবনেও সমাগত। পাঞ্চালীকে পাবার আগেই সে ছেড়ে এসেছে। উলূপীকে সে পেয়ে ছেড়ে যাবে। কে জানে, আর কোনও দিন দেখা হবে কিনা! সে ফিরে গিয়ে পাঞ্চালীকে পাবে। পাঞ্চালী তাদের চিরকালের।
ভীমও নিশ্চয়ই খুব সুখী এখন! ব্যাসদেবের বাণী সত্যি হয়েছে। ভীম কত প্রবলভাবে দ্রৌপদীকে কামনা করেছিল, জানে অর্জুন। আর সে? সে নিজে?
উলূপী এসেছে। অর্জুনের ভাবনায় ছেদ পড়ল। উলূপী বলল, “আজ পূর্ণিমা। চলো আমরা আকুলকেশীর মাঠে যাই।”
“আকুলকেশীর মাঠ?”
“যে-মাঠে আমরা অস্ত্র অভ্যাস করি অর্জুন, সেই মাঠের নাম আকুলকেশীর মাঠ। চারুকেশী বলে একটি মেয়ে ছিল। তার স্বামীর নাম ছিল চন্দ্রদাস। ঠিক যেমন উলূপী ভালবাসে অর্জুনকে, তেমনি চারুকেশীও চন্দ্রদাসকে ভালবাসত। একদিন গরুড়রা চারুকেশীর সামনেই চন্দ্রদাসকে নির্মমভাবে মেরে ফেলল। চারুকেশী পাগল হয়ে গেল অর্জুন। চন্দ্রদাসের মাথাটি কোলে নিয়ে সেই সে বসল, কেউ তাকে ওঠাতে পারল না। সে একবিন্দু জল পর্যন্ত খেল না। মৃত চন্দ্রদাস তো কঙ্কাল হয়ে যাবেই, চারুকেশী প্রাণ থাকতে থাকতেই হয়ে গেল কঙ্কালসার। লোকের মুখে মুখে যখন তার নাম রটেছে আকুলকেশী, তখন সে মারা গেল।”
বনের পথে চলতে চলতে অর্জুন উলূপীর কোমর জড়িয়ে ধরল। বলল, “আমি চলে গেলে তুমি খুব কষ্টে থাকবে, তাই না উলূপী?”
উলূপী হেসে বলল, “অর্জুন, আমার কষ্ট হবে। কিন্তু তোমাকে পাবার আনন্দকে তা ছাপিয়ে যাবে না। এই যে আমাদের নাগদেশ, কৌরব্য নাগের বাড়ি, এই বন, অরণ্য, উদ্যান, পাহাড়— তারপর ওই শ্বেতনাগিনী ঝরনা, আকুলকেশীর মাঠ, যা কিছু আমার অর্জুন, এই শরীর, এই মন— সমস্ত কিছুতে তুমি রয়ে যাচ্ছ। সব জায়গায় আমি তোমাকে পাব। আমি যা চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে তার চেয়ে অনেক বেশি দিচ্ছ অর্জুন। এত ধন আমার সারা জীবনেও ফুরোবে না।”
“উলূপী, তোমার মুখে আকুলকেশীর কাহিনি শুনতে শুনতে কষ্টে আমার মনের মধ্যে কেমন করে উঠল। আমি যেন তোমাকেই দেখলাম ওইরকম উন্মত্ত অবস্থায়।”
ছায়া ঢাকা বনপথে, গাছের স্নিগ্ধ নিবিড় আশ্বাসের তলে, উলূপী দাঁড়াল অর্জুনের মুখোমুখি। অর্জুন উলূপীর হাত ধরল। চোখ রাখল চোখে। দু’জনের চোখ থেকে ভোরের শিশিরের মতো ঝরে পড়তে লাগল প্রেম। উলূপী অর্জুনকে বাঁধতে চায় না। অর্জুনের জীবনও বৃহত্তর লক্ষ্যে নির্দেশিত। বিচ্ছেদ হবেই জেনেও এই যে আকুলতা, এই যে তীব্র অনুভব পরস্পরের জন্য, প্রেম মানেই যে প্রেমাস্পদকে সাপের মাথার মণির মতো কৌটোয় পুরে রাখতে হবে— এই অসম্মানের ঊর্ধ্বে থাকতে পারা— প্রেমের পক্ষে এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কিছু হতে পারে না। নরনারীর প্রেম জীবনের সব নয়, কিন্তু জীবনের অন্যতম চালিকা শক্তি— এই উপলব্ধিই প্রেমের পরম বোধ।’
উলূপীকে বুকে টেনে নিল অর্জুন। সে জানে, উলূপীর বন্ধুরা কাছাকাছি থাকতে পারে, অন্তত চন্দ্রা, থাকতে পারে কৌরব্য নাগের নজরদার, তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন অর্জুন ঘুমন্ত অবস্থাতেও কারও উপস্থিতি টের পেয়ে যায়, আর এখন তো সে জেগে আছে। বুঝতে পারছে, আশেপাশে কেউ আছে। কে সে? গরুড় জাতির কেউ? গরুড়দের নিয়ে সবসময় এই নাগরাজ্যের চাপা ত্রাস টের পায় অর্জুন। কিন্তু সে নিশ্চিন্ত, গরুড়রা তার ক্ষতি করবে না। সে গভীর মমতায় উলূপীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মাথায় চুমু খেল। উলূপী অর্জুনকে জড়িয়ে, তার বুকে মুখ রেখেই বলল, “চারুকেশী আর চন্দ্রদাসের কাহিনি নাগদেশের সব ঘরে আছে অর্জুন। কিন্তু উলূপী আর অর্জুনের কাহিনি সব ঘরের নয়। তোমাকে পাবার ভাগ্য ক’জনের হয়? অর্জুন, তুমি আমার কাছে থাকো আর নাই থাকো, যতদিন তোমার শরীরে প্রাণ আছে, ততদিন আমিও প্রাণ রাখব অর্জুন।”
অর্জুন বলল, “তাই হোক উলূপী। তবে কী, ক্ষত্রিয় পুরুষের ধর্ম যুদ্ধ করা। তার প্রাণের কোনও নিশ্চয়তা নেই।”
“শেষ পর্যন্ত প্রাণের কোনও নিশ্চয়তা নেই বলেই প্রাণের চেয়ে ধর্ম বড় অর্জুন।”
অর্জুন খুব জোরে জড়িয়ে ধরল উলূপীকে। এই মেয়ের সঙ্গে কথা বললে মন এবং চিন্তা প্রশস্ত হয়। উলূপীকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে গর্ব বোধ হল অর্জুনের।
পরস্পরকে জড়িয়ে শ্রদ্ধায় প্রেমে দু’জনের প্রাণমন যখন নিবিষ্ট, তখনই ঝোপের আড়াল থেকে একটুখানি বেরিয়ে থাকা নারাচ বাণের মুখ দেখতে পেল অর্জুন। তার চোখ অনায়াসে বুঝে ফেলল এ বাণের লক্ষ্য উলূপী। অর্জুন চেঁচিয়ে উঠল, উলূপী!
পল মাত্র! বাণ ছুটে গিয়েছে। সময় নেই। উলূপীকে জাপটে প্রায় তুলে নিজের পিঠ বাঁকিয়ে বাণ প্রতিরোধ করল অর্জুন। বেশ কাছ থেকে ছোড়া নাতিনিপুণ বাণ হলেও উলূপীর পক্ষে তা ছিল মারাত্মক। কিন্তু অর্জুনের সুদৃঢ় পেশি-মাংস ভেদ করতে না পেরে তা কিছুটা বিদ্ধ করে আপনিই মাটিতে খসে পড়ল। উলূপী চিত্কার করে উঠল, “এ কী অর্জুন! এ কী!”
উলূপীকে ছেড়ে অর্জুন ছুটে গেল সেইদিকে যেদিক থেকে বাণ এসেছিল! পলায়নপর পায়ের শব্দ অনুসরণ করে অল্প সময় পরেই অর্জুন ধরে ফেলল লোকটাকে। আশ্চর্য! এ তো কোনও গরুড় নয়। এ যে নাগজাতীয়। তবে কি নাগজাতির অন্তর্কলহ এত দূর চলে গিয়েছে?
এক থাবায় লোকটার গর্দান পাকড়াল অর্জুন! একটু জোরে চাপ দিলেই লোকটা মরে যাবে, ঠিক যেমন তারা টিপে মারে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ। কিন্তু অর্জুন সে পদ্ধতি নিল না। আকুলকেশীর মাঠ দেখা যাচ্ছে অদূরেই। সে লোকটার ঘাড় ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে চলল মাঠের দিকে, যেমন করে নিষাদরা মড়া জন্তু ঝুলিয়ে নিয়ে যায়। লোকটা কাকুতি-মিনতি করছে— আমাকে ছেড়ে দাও। আর কক্ষনও করব না।
অর্জুন তাকে ছুড়ে ফেলল মাঠে। কঠোর গলায় বলল, “কে তুমি?”
লোকটা বলল, “আমি…আমি অশ্বসেন।”
“অশ্বসেন? তুমি কি স্বয়ম্ভূ? পিতৃপরিচয় নেই তোমার?”
“থাকবে না কেন? পাণ্ডব অর্জুন যেমন কুন্তীর গর্ভে ইন্দ্রের ক্ষেত্রজ, তেমন নয়। আমি নাগবংশীয়। কৌরব্য নাগের পরেই দ্বিতীয় যিনি এ দেশের মান্য, সেই হর্যক্ষ নাগ আমার বাবা।”
অর্জুন অশ্বসেনের বুকের ওপর একটি পা তুলে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, অর্জুন ইন্দ্রের ঔরসজাত, পৃথা ও পাণ্ডুর সন্তান। ইন্দ্র, পৃথা, পাণ্ডু তার প্রণম্য। এই জন্মের জন্য তার ততখানিই গর্ববোধ যেমন গর্ব ভীষ্ম বোধ করেন গঙ্গা ও শান্তনুর সন্তান হিসেবে আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে। ভীষ্মর জন্ম যতখানি শাস্ত্রসম্মত পাণ্ডব অর্জুনের জন্মও ততখানি। কথা তা নয়। কথা হচ্ছে, এখন আমি বুঝতে পারছি, নাগলোকের ঘরে ঘরে কেন গরুড়ের হাতে মরা ছেলের গল্প। কারণ তোমার মতো ছেলেরা সেখানে জন্মায়। এখন বলো তো বাপু অশ্বসেন, তুমি উলূপীকেই মারতে চেয়েছিলে তো?”
অশ্বসেন অর্জুনের পায়ের তলায় ছটফট করতে করতে বলল, “আমাকে ক্ষমা করো অর্জুন। তোমাকে আঘাত করার এতটুকু বাসনা ছিল না আমার। আমি ওই অহংকারী শয়তানি উলূপীকে মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার কপাল ভাল তুমি তাকে বাঁচালে।”
অর্জুনের পায়ের চাপে হাঁসফাঁস করছে অশ্বসেন, যেন হাতির পায়ের তলায় মোটকা-সোটকা মেঠো ইঁদুর। হাতি ইচ্ছে করেই তাকে পিষছে না। জিইয়ে রাখছে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “কেন তুমি উলূপীকে মারতে চাও?”
“কেন? ও নিজের মুখেই বলুক কেন! ঠগ, জোচ্চোর, মিথ্যাবাদিনী।”
উলূপী এসে দাঁড়িয়েছে অর্জুনের পিছনে। চন্দ্রা উলূপীকে ধরে আছে। অর্জুন উলূপীর দিকে তাকাল। তার মুখ সাদা। কেউ যেন তার মুখে চুন লেপে দিয়েছে। সে বিহ্বল। কাঁপছে। নিদারুণ কষ্ট হল অর্জুনের। প্রাণময়ী উলূপী কোন দোষে এমন অপদস্থ হবে? রাগে তার চোখ-মুখ তপ্ত হয়ে উঠল। সে বলল, “উলূপী আমার স্ত্রী। আমার সামনে আমার স্ত্রীর অপমান করছ, তোমার স্পর্ধা তো কম নয়। তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে তোমার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারি জানো?”
রাগে ভীমের মতো কথা বলে বসল অর্জুন। সে সহ্য করতে পারছে না উলূপীর অপমান। সহ্য করতে পারছে না নারীহত্যার ঘৃণ্য চক্রান্ত, সহ্য করতে পারছে না এই কাপুরুষকে, যে আড়াল থেকে বাণ ছুড়ে মারতে চায় একটি মেয়েকে!
অশ্বসেন বলল, “আমাকে উঠে বসতে দাও অর্জুন। তোমাকে সব বলব।”
অর্জুন পা নামিয়ে নিল। অশ্বসেন হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসে বলল, “হর্যক্ষ নাগের ঘরের বউ উলূপী। তুমি কি তা জানো অর্জুন? আমি জানি ওই পাপিষ্ঠা তোমাকে জানালে তুমি কখনও ওকে বিয়ে করতে না। ওর স্বামী গরুড়ের হাতে মরেছে। তা মেয়েমানুষ। ছেলেপিলে চাইছে। ঘরে কি পুরুষমানুষ ছিল না?”
হঠাৎ অর্জুনের সব রাগ চলে গেল। বনপথে পাখি গায়ে-মাথায় মলত্যাগ করে দিলে যে গা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয়, তেমনি পড়ে রইল শুধু। পাখির কুকর্মের জন্য যেমন তলোয়ার গদা বা ধনুর্বাণ নিয়ে তার পিছনে ছোটা বাতুলতা, এই কেঁচোর মতো লোকটাকেও কিছুমাত্র শাস্তি দেওয়ার বাসনা বাতুলতাই মনে হল অর্জুনের। মাদী হাতি কামমোহিনী হলে মদ্দা হাতির গায়ে গা লাগিয়ে চলতে থাকে। তাই না দেখে ইঁদুরের যদি ঈর্ষা হয়, যদি সে ভাবে, আহা আমারও তো লিঙ্গ আছে, আমি কীসে কম যাই, হস্তিনীর গর্ভে হোক ইঁদুর বপন— তা হলে অসি হাতে তাড়া করে গুরুত্ব দেবার চেয়ে তাকে উপেক্ষা করাই শ্রেয়।
অর্জুন বলল, “যাও অশ্বসেন। তুমি মায়ের কোলে ফিরে যাও। যাবার আগে শুনে যাও, উলূপী অর্জুনের পত্নী। তার অনাগত সন্তানের মা। ধর্ম তাদের রক্ষা করবে।”
চন্দ্রা, শুভা উত্তেজিতভাবে বলল, “ওকে কেন ছেড়ে দিচ্ছ অর্জুন? ওকে কেন মেরে ফেলছ না?”
অর্জুন বলল, “এ নীচ কাপুরুষ। আমি একে মারি না।”
ধুঁকতে ধুঁকতে মাথা নিচু করে চলে গেল অশ্বসেন। উলূপী এখনও মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অর্জুন, যেন কিছুই হয়নি, এমনভাবে বলল, “আকুলকেশীর মাঠে আমাকে নিয়ে আসছিলে কেন, তা বলোনি উলূপী।”
উলূপী অর্জুনের দিকে তাকাল। ছলছল করছে দুই চোখ। বলল, “আজ পূর্ণিমা। ভেবেছিলাম আজ সন্ধ্যায় আমরা তোমার বাণের নানারকম কৌশল দেখব। তার আয়োজন করতেই এখানে আসছিলাম। তা আর হওয়ার নয়।”
“কেন হবে না উলূপী?”
“তোমার পিঠের ক্ষত থেকে রক্ত পড়ছে অর্জুন। আগে তার শুশ্রূষা হোক।”
“তার জন্য সন্ধ্যাবেলার অনুষ্ঠান পণ্ড হবে কেন?”
অস্ত্রের খেলা দেখাতে পারবে, অর্জুন আনন্দে উদ্বেল। উলূপী জানে, অর্জুন এ খেলায় যে আনন্দ পায়, তা আর কিছুতে নয়। কিন্তু আজ তা হবে না। সে রক্তের রং দেখে বুঝতে পারছে, অশ্বসেন নারাচের মুখে সাপের বিষ মাখিয়ে রেখেছিল। অথচ, নাগলোকের নীতি অনুযায়ী, সাপের বিষ জীবনদায়ী ওষুধ হিসেবেই ব্যবহার্য, জীবননাশক হিসেবে নয়। কৌরব্য নাগের কাছে এর বিচার চাইবে উলূপী। কিন্তু তার আগে অর্জুনের চিকিত্সা দরকার। বলিষ্ঠ হওয়ায় অর্জুন এখনও কাবু হয়নি। সে বলল, “অর্জুন, নারাচে বিষ মাখানো ছিল। চলো তোমায় ওষুধ দিই।”
দুপুরের দিকে এই ঘটনার পর অর্জুন আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। বিষ তার চেতনা হরণ করছিল বারংবার। কৌরব্য নাগ রুদ্র নাগ আয়ুর্বেদাচার্যকে ডেকে এনেছে। তার তত্ত্বাবধানে উলূপী নিরন্তর সেবা করছে অর্জুনের। ঘণ্টা তিনেক লড়াই করার পর সন্ধ্যার মুখে অর্জুন প্রায় সুস্থ হয়ে উঠল। শুয়ে থাকতে তার আর ভাল লাগছিল না। সে বলল, “আজ আকাশে ফাল্গুনের পূর্ণচাঁদ। বনে বনে কত সুগন্ধী ফুল ফুটেছে, কোকিল পাপিয়া বসন্তবৌরী খুব ডাকাডাকি করছে নিশ্চয়।”
উলূপী বলল, “বাগানে যাবে অর্জুন? সেই যেখানে আমাদের কুঞ্জ বাঁধা হয়েছিল?”
“চলো। সেখানে তুমি আমায় কোল দেবে তো উলূপী? তোমার কোলে মাথা রেখে আকাশ দেখব আমি। চকোরের মতো আকণ্ঠ জ্যোত্স্না পান করে বুঁদ হয়ে থাকব, যেমন কাদম্বরী পান করে বুঁদ হয়ে যায় বলরাম!”
“আমার কোল যে তোমারই জন্য অর্জুন। তুমি যখন দূরে থাকবে, তোমার স্মৃতি থাকবে কোল জুড়ে।”
বাগানে, উলূপীর কোলে শুয়ে অর্জুন দেখল বিরাট এক সোনার থালার মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে। দূরের তারাগুলো চিকচিক করছে। হিমের পরশ লাগা বসন্তের বাতাসে সৌগন্ধ কত নাম না জানা বনফুলের। পাখিরা চাঁদের আলোয় দোসর পাবার বাসনায় গান গাইছে। কোথাও কোনও মালিন্য নেই। ছন্দপতন নেই। স্রষ্টা যেন কবে থেকে ভেবে ভেবে এমন একটি রাত্রি অর্জুনের জন্যই বানিয়ে রেখেছেন। কৃষ্ণকে মনে পড়ল তার। সে যদি থাকত, এমন বাসন্তীরাতে বাঁশি না বাজিয়ে পারত না। অর্জুন গুনগুনিয়ে গান ধরল। তার ভারী গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠ অত্যন্ত মিষ্টি আর সুরেলা। উলূপী মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল। গান থামলে, অর্জুনের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সে বলল, “এত এত গুণের সঙ্গে ভগবান যখন তোমাকে সুর দিয়েছে অর্জুন, তখন এর দ্বারা নিশ্চয় তোমার কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সাধিত হবে।”
অর্জুন বলল, “তা জানি না। তবে আমার নাচতেও খুব ভাল লাগে জানো উলূপী। আমি যখন বাণ ছুড়ি, হাওয়া কেটে সেই বাণ যখন ছুটে যায়— আমি তার গান শুনি। তার গতির মধ্যে পাই নাচের ছন্দ।”
“তুমি কি নাচ জানো অর্জুন?”
“না। সময়সুযোগ পেলে শেখার ইচ্ছে আছে। কৃষ্ণ কী বলে জানো? একজন মহাবীরের পক্ষে নাচ গান বাজনা অভিনয় জানা জরুরি। সময়ে সেইসবও রণকৌশল হিসেবে কাজ করে। সবই তো বিদ্যা। বিদ্যা যত আয়ত্ত হয়, তত ভাল। সে স্বয়ং ব্যাসদেবের কাছে আয়ুর্বেদ শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। হয়তো শিখেও ফেলেছে। কৃষ্ণ এক আশ্চর্য মানুষ উলূপী। আমাদের যা আয়ত্ত করতে এক পক্ষকাল লাগে, কৃষ্ণের লাগে আধবেলা।”
“তুমি কৃষ্ণকে বড় ভালবাস অর্জুন। তুমি প্রথম ভালবাস ধর্ম তথা কর্তব্য, তারপর অস্ত্র তথা ধনুর্বাণ, তারপর মা কুন্তী এবং ভাইদের। তথা পরিবার।”
অর্জুন খানিক অস্বস্তি বোধ করছিল। এই বুঝি উলূপী কোনও অর্থে পাঞ্চালীর নাম করে বসে। তা হলেই উলূপী আর পাঞ্চালীর অবস্থানের তুলনা এসে পড়বে। এর চেয়ে অর্থহীন আর কী হতে পারে? কিন্তু উলূপী তার ধারকাছ দিয়েও গেল না। তার শালীনতাবোধ এবং আত্মমর্যাদাবোধ অসামান্য। সে বলল, “এই সবকিছুর চেয়েও তুমি কৃষ্ণকে বেশি ভালবাস।”
অর্জুন পরম স্বস্তিতে বড় করে শ্বাস নিল। উলূপী যে পাঞ্চালীর নাম করল না, তাতে উলূপীর প্রতি তার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। সে বলল, “এর উত্তর আমি কী দেব, উলূপী? বাকি সব কথাই তুমি ঠিক বলেছ। ধর্ম আমার শিরোধার্য বলেই আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কখনও অতিক্রম করব না। তবে আমার মনে কৃষ্ণ কোথায়, তা ঠিক বলতে পারব না আমি।”
“আমি বলছি, তুমি জেনে নাও অর্জুন। তুমি কৃষ্ণকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাস। আমার এ কথা বলার কারণ আছে। বিষের প্রভাবে তুমি যখন চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলে, তখন গাঢ়তম অচেতনতায় তুমি কৃষ্ণকে ডেকেছ। তোমার চেতনা যখন পুব আকাশে সূর্য ওঠার ঠিক আগের মুহূর্তের আলোয় ভরা, তুমি মা কুন্তীকে ডাকছিলে। এসব প্রলাপোক্তি ছিল না। যখন চেতনায় ফিরলে, তুমি বললে… তুমি বললে…”
উলূপী সঙ্কোচে নিজের কথাটি বলতে পারল না। অর্জুন মৃদু হেসে বলল, “উলূপী, আমার কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ো না। তোমার ছোঁয়া ঠিক মা কুন্তীর মতো লাগছে আমার— এই কথা বলেছিলাম। সচেতনভাবেই তা বলেছিলাম উলূপী। আর তা সত্যি। উলূপী, তোমার মধ্যে যে-মাতৃত্ব, তুমি জানো না কী গভীর তার ভাব! তোমার সেই মাতৃত্ব অবলম্বন করে আমিই আবার জন্মাব তোমার কোলে। তোমার কোল শূন্য হবে না আমি দূরে গেলেও। অর্জুনকেই তুমি ছেলে হিসেবে পাবে। উলূপী, কৃষ্ণ তো সত্যিই আমার প্রাণের মানুষ। তুমি যদি জানতে চাও কেন, আমি ব্যাখ্যা দিতে পারব না। এ যেন প্রশ্নাতীত তর্কাতীত অমোঘ বন্ধন। তার জন্য আমি প্রাণ দিতে পারি, যেমন পারি যুধিষ্ঠিরের জন্য।”
“কৃষ্ণ তোমার প্রাণ জয় করেছে অর্জুন। যুধিষ্ঠিরের জন্য তুমি প্রাণ দেবে তুমি কর্তব্যপরায়ণ বলে। কিন্তু কৃষ্ণকে যে-প্রাণ দিয়েছ, তা কৃষ্ণই রক্ষা করবে তার নিজের জিনিস বলে। অন্তত তার জন্য তোমায় প্রাণপাত করতে হবে না।”
“উলূপী, তুমি অসাধারণ রমণী।”
“না অর্জুন। আমি অপরাধিনী। তোমার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে পারলে তবে আমার শান্তি হয়। তোমার ওই পায়ে আমার ঠোঁট ছুঁইয়েছি অর্জুন। বিশ্বাস করো, আমি তোমার কাছে সত্য গোপন করিনি। আমি তোমাকে চেয়েছি অর্জুন। তার মানে কি এই যে, আমার অতীতের সব কথা আগে কবুল করতে হবে? যা গত, যাতে তোমার কিছুমাত্র যোগ ছিল না, তাকে আমি কেন আমাদের এই ক্ষণিক মিলনে টেনে এনে মন ভার করব? এমনটাই ভেবেছি আমি। হয়তো ভুল করেছি। সাধারণ ভিতু মেয়ের মতো সত্যিটাকে পাশে সরিয়ে রেখেছি।”
যন্ত্রণায় আত্মগ্লানিতে ভরে উঠল উলূপীর মুখ। এই চাঁদের আলোতেও সেই গ্লানিজনিত বিবর্ণতা দেখতে পেল অর্জুন। সে উলূপীর দু’টি হাত নিজের দু’গালে চেপে বলল, “উলূপী, তুমি অসাধারণ। জানো, তোমার সঙ্গে এই কয়েকটি দিনে আমি যত কথা বলেছি, যত প্রকাশ করেছি নিজেকে, তা আমার নিজের পক্ষেই বিস্ময়কর। কৃষ্ণ ছাড়া আর কারও কাছে এত কথা বলতে পারি না আমি। এ যাবৎ তাকে পেয়েছি অতি অল্প দিন। তোমাকেও অল্প পেলাম, কিন্তু বড় গভীর করে পেলাম। তোমার শক্তি আমার মনের শক্ত খোলক গলিয়ে তার দ্যুতি প্রকাশ করেছে। তুমি ধন্য। তুমি এতটুকু গ্লানি রেখো না মনে। তুমি যে বাচালের মতো— অর্জুন, আমার কিন্তু বিয়ে হয়েছিল, আমি কিন্তু ঠিক কুমারী নেই— এমনটি না বলে কেবল ইঙ্গিতে সত্য প্রকাশ করেছিলে, তাতে আমার প্রতি তোমার আস্থা আছে, আমি বুঝেছিলাম। ইতর পুরুষের মতো ওসব নিয়ে যে আমি খুঁতখুঁত করব না, এটা তুমি বুঝেছ যে, আমার তা খুব ভাল লেগেছিল।”
“অর্জুন! আমার অর্জুন!” উলূপী মুখ নামিয়ে নিয়ে এল নীচে। অর্জুনের কপালে চুমু খেল। অর্জুন তার স্তন ছুঁয়ে বলল, “তুমি বলেছিলে, ‘আমার কোনও স্বামীও নেই যে, ধর্মত তার কাছেই আমার কামনা প্রকাশ করার কথা।’ এই কথাতেই তোমার সব কথা বলা ছিল উলূপী। কী হয়েছিল তার? এ-ও কি সেই প্রতি পরিবারের কাহিনি? গরুড়ের হাতে মৃত্যু?”
“তুমি ঠিকই বুঝেছ অর্জুন। ভাল করে চেনাজানা হওয়ার আগেই সে মরে গেল।”
“কত কষ্ট পেয়েছ তুমি উলূপী। আর পেয়ো না।”
“অর্জুন, যে-সম্বন্ধ আর পাঁচজনে রচনা করে দেয়, তা আপন হতে সময় লাগে। সেই সময়টুকু আমি পাইনি। আমার কষ্ট ছিল শূন্য মনের প্রলাপ। আমার কষ্ট ছিল নিঃসঙ্গ দেহের হাহাকার। তুমি তার সব মুছে দিয়েছ। মানুষ নিজে যে-সম্বন্ধ রচনা করে তার অমৃতস্বাদ সময়, সঙ্গ, দেহ ছাপিয়ে মনোজগতের অবলম্বন হয়ে যায়। তুমি আজ সেই অবলম্বন আমার। একটা কথা আমায় বলো অর্জুন। ওই নীচ পৈশুন্যস্বভাব অশ্বসেনকে তুমি ছেড়ে দিলে। কাপুরুষ বলে মারলে না। কিন্তু ও তো আমাদের শত্রু। ও যতদিন বাঁচবে, আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে যাবে। শত্রু যতই দুর্বল বা কাপুরুষ হোক, তার শেষ রাখা কি ঠিক কাজ?”
“খুব ভাল প্রশ্ন তুলেছ উলূপী। আমি এর উত্তর দিচ্ছি।”
অর্জুন উঠে বসল। সুন্দর দু’টি পাত্রে হালকা সুস্বাদু মদ আর ভাজা ও সেঁকা মাংস এনে রাখল শুভা। পাহাড়ি ভেড়ার মাংস। খুব ভাল খেতে।
খুব তৃপ্তির সঙ্গে এক চুমুক মদ খেল অর্জুন। সেই পাত্রই এগিয়ে ধরল উলূপীর মুখের কাছে। উলূপীও খেল এক চুমুক। মাংসখণ্ড তুলে দিল অর্জুনের মুখে। অর্জুন বলতে লাগল, “কাপুরুষ ভীরুকে বধ করার মধ্যে ক্ষত্রিয়ের গৌরব নেই, তাই অশ্বসেনকে আমি মারিনি। এ ছাড়াও রাজনৈতিক কারণ একটা আছে। যে কোনও ঘটনা, তা ধর্ম হোক বা অধর্ম, কিছু লোক তা সমর্থন করেই। চোর চুরি করে ধরা পড়ল। রাজা তাকে সাজা দিলেন। একদল বলবে, রাজা ঠিক কাজই করেছেন। আরেক দল বলবে, চোরের দোষ কী? রাজার শাসন দুর্বল বলেই দারিদ্র আছে। দারিদ্র আছে বলেই চৌর্যবৃত্তি আছে। দারিদ্র না থাকলেও লোভের বশে লোকে চুরি করে। তারও সমর্থনে যুক্তি আছে। রাজ্য পরিচালনায় দুর্বলতা আছে বলেই চোর চুরি করার সাহস পায়। উলূপী, নাগদেশ এমনিতেই বহু গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে আছে। কৌরব্য নাগ সবচেয়ে মান্য জন। অশ্বসেন মারা গেলে যে-জ্ঞাতিশত্রু তাঁর হত, তা কি ভাল হত? আমি চলে যাব। কিন্তু তোমাদের এখানে থাকতে হবে। এক অশ্বসেন বধ হলে তার পক্ষে চারজন দাঁড়িয়ে তোমাদের সঙ্গে শত্রুতা করবে। মৃত্যুর কারুণ্যে অশ্বসেন সমর্থন পাবে। তার চেয়ে, সে যদি বেঁচে থাকে, তার নীচতা, কাপুরুষতা লোকের মুখে মুখে ফিরবে। কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না। অস্ত্রে বিষ মাখানোর জন্য তার উপযুক্ত বিচার করবেন রাজা। শত্রুকে প্রথমে ক্ষমা করতে হয়। যুধিষ্ঠির তাই করে। কৃষ্ণও করে। শিশুপালের একশো অন্যায় ক্ষমা করবে কৃষ্ণ।”
উলূপী বলল, “অসাধারণ তোমার বিচার অর্জুন। তোমার ছেলে হলে তাকে আমি তোমারই আদর্শে গড়ে তুলব।”
“না উলূপী। তোমার-আমার যা কিছু ভাল, তাই দিয়ো তাকে। আর ছেলে হলে প্রথমে যেয়ো তোমার আগের শ্বশুরবাড়ি। তোমার সন্তানের মধ্যে দিয়ে তাঁদের নাতির মুখ দেখার বাসনা যদি কিছুমাত্র মেটে, তবে কেন তুমি সেই সুযোগ দেবে না?”
“যদি অশ্বসেন ছেলের কোনও ক্ষতি করে?”
“অর্জুন ও উলূপীর ছেলের ক্ষতি করবে পোকামাকড়ের অধম ওই অশ্বসেন? নিজেকে দুর্বল ভেবো না উলূপী।”
“তাই হোক অর্জুন।”
উলূপীর গর্ভ সঞ্চার হওয়া পর্যন্ত নাগলোকে থেকে গেল অর্জুন। কৌরব্য নাগের সঙ্গে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা হল তার। রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে কথা হল। কৌরব্য বিচক্ষণ মানুষ। তার পুঁথির সংগ্রহ দেখে মুগ্ধ হল অর্জুন। ব্যূহ বিষয়ে একটি বই সে আগ্রহের সঙ্গে দেখছিল। কৌরব্য সেই পুঁথি উপহার দিল অর্জুনকে। আর দিল নানারকম বাণ।
কৌরব্য ও অর্জুনের আলোচনায় উলূপীও সমানভাবে অংশ নিয়েছে। ন্যূনতম ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়াও সে সারাক্ষণ অর্জুনের সঙ্গে সঙ্গে আছে। যত বেশি করে তাকে পাওয়া যায়।
বিদায়ের আগের রাতে পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে রইল তারা। এতটুকু ছেড়ে থাকল না। কাঁদল না। সঙ্গম করল না। শরীরের টানে পরস্পর মিলেছিল। সেই মিলন শরীর ছাপিয়ে মনের মধ্যে সম্পন্ন হয়ে উঠেছে। ক্ষত্রিয় পুরুষ অর্জুন এবং নাগ মেয়ে উলূপী যতই দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হোক— বিদায়কালে বিষাদ তাদের আচ্ছন্ন করবেই। সাময়িক সেই আচ্ছন্নতা। তাদের কর্তব্যবোধকে পরাস্ত করবে কোন বিষাদ?
উলূপী বলল, “অর্জুন, বড় ভালবাসি তোমাকে। সারাজীবন ভালবাসব।”
অর্জুন বলল, “উলূপী, আমিও তোমাকে বড় ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে আমার আজীবন মনে থাকবে।”
“যাবার আগে কিছু বলে যাও অর্জুন।”
“আবার আমাদের দেখা হবে।”
“কবে?”
“কোনও না কোনও দিন।”
“আর?”
“আমাদের ছেলেকে উপযুক্ত কোরো। দূরে এক মহাযুদ্ধের কোলাহল শুনতে পাই আমি উলূপী। কৌরব আর পাণ্ডবদের যুদ্ধ। আমরাও তো কৌরব। কিন্তু দেখো, মূল স্রোত থেকে কীভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে আমাদের। তার জন্য খেদ নেই। মহারাজ পাণ্ডুর বংশধর পাণ্ডব হিসেবে আমি গর্বিত। কিন্তু অধিকারের লড়াই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। সেই ধর্মযুদ্ধ হবেই একদিন। সেইসময় আমার ছেলে যেন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। লোকে যেন বলে বীর বটে ছেলেটা। কার ছেলে, দেখতে হবে তো!”
কান্নায় গলা বুজে এল অর্জুনের। উলূপীর বুকে মুখ গুঁজে দিল সে। বিরাট শিশু যেন মুখ লুকোল ধরিত্রীর বুকে।
আট
উলূপীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে কিছুই ভাল লাগছিল না অর্জুনের। সবসময় একা থাকতে ইচ্ছে করে। শুধু মনে পড়ে তার কথা। তার হাসি-কান্না, তার কামোদ্দীপ্ত শরীরের বিভঙ্গ, তার ঠোঁট স্তন যোনির লালিমা। মনে পড়ে তার বলা কত কথা। নাগপাশ অস্ত্রকৌশল শেখাবার সময় নিবিষ্ট গুরুমশায়ের ভূমিকা। সবেতেই সে সহজ ছিল। সবেতেই সপ্রাণ। কত দিকে কত তার জ্ঞান। কী চমৎকার ঘোড়া চালায়। কোথায় কত রকম ঘোড়া পাওয়া যায়, কী তাদের গুণাগুণ— সেসব সম্পর্কে অনেক খবর রাখে উলূপী। সাপ পোষে এমনই অনায়াসে যেমন লোকে পোষে শুক সারি তোতা ময়না। বিষ দিয়ে তৈরি করে বিষহরণ বড়ি। হায়! পাঞ্চালীকে বিয়ে করে যা হয়নি, উলূপীকে পেয়ে তাই হয়েছে অর্জুনের। তার জীবন হঠাৎ অন্যরকম হয়ে গেছে।
মেয়েই হোক আর পুরুষ, কৌমার্য পার হয়ে যৌন সম্বন্ধে যৌবনের সার্থকতায় পৌঁছলে মানুষ নতুন হয়ে যায়।
সারা দিনে অন্তত কয়েকবার আমূল সঙ্গমের তীব্র ইচ্ছায় পাগল পাগল লাগে তার। এখনও সে গঙ্গাদ্বারেই আছে। চাইলেই সে উলূপীর কাছে ফিরে যেতে পারে। খুব খুশি হবে উলূপী। কিন্তু অর্জুনের নীতিতে বাধে। সে তো উলূপীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় থাকতে পারবে না। ছেড়ে তাকে আসতেই হবে। তা যখন মেনেই নেওয়া হয়েছে, শুধু কামতৃষ্ণায় ছুটে যাওয়া ইতরতা মনে হয় অর্জুনের। যেন, মাঝরাতে বেশ্যার কাছে চোরের মতো ছুটে যাচ্ছে কামুক নাগর। ছি ছি। অর্জুন কিছুতেই তা পারবে না।
কিন্তু শুধু কি শরীরের টান? উলূপী যে অর্জুনের প্রাণেও টান দিয়েছে। মায়ায় বাঁধা পড়ার সেই সবচেয়ে বড় কারণ।
না। সংসার প্রতিপালনের জন্য অর্জুনের জন্ম নয়। বিধাতা যখন তাকে ঘরছাড়া করেছে, সে আর বন্ধনে পড়বে না এই ব্রহ্মচর্যের বারো বছরে। সে আরও ভ্রমণ করবে। দেখবে কত শত দেশ। সুযোগ পেলে নতুন কোনও অস্ত্র আয়ত্ত করবে, যেমন উলূপীর কাছে পেয়েছে নাগপাশ।
নতুন করে ভ্রমণের কল্পনায় যিযিষু হয়ে উঠল অর্জুন। বিষাদ কেটে গেল অনেকখানি। জন্ম থেকে শৈশবের অনেকটা বনে বনে কেটেছে বলেই কিনা অর্জুন জানে না, তার মনের মধ্যে কেমন করে ঢুকে পড়েছে চরৈবেতির ডাক। ঘুরে বেড়াতে তার ভাল লাগে। কিন্তু যুধিষ্ঠির অর্জুনের সুবিধার জন্য যে বিরাট দলবল দিয়েছে সঙ্গে, তা আর তার ভাল লাগছে না। পথে-বিপথে রাজপ্রাসাদের সুখ সঙ্গে নিয়েই যদি চলবে সে, তবে আর লোক-দেখানো ব্রহ্মচর্য কীসের। উলূপীর সঙ্গেই তো মহাসুখে থাকতে পারত অর্জুন। অতএব, পুরোহিত পাচক এবং তিনজন মাত্র অনুচর রেখে বাকি সবাইকে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরিয়ে দিল অর্জুন। তারপর মনপ্রাণ উপড়ে নিয়ে গঙ্গাদ্বার থেকে পূর্বদিকে চলল। পুবের অনেক দেশ ঘুরে সে দক্ষিণ-পশ্চিমে চলতে লাগল। নিজের অজ্ঞাতেই হয়তো কৃষ্ণর দিকে চলছিল অর্জুন। এই দিনগুলোয় সে কঠোরভাবে সংযম পালন করছে। বহুক্ষণ অস্ত্র অভ্যাস করছে, যোগাভ্যাস এবং যজ্ঞ করছে সম্পূর্ণ মনোযোগে। উলূপীকে ছেড়ে আসার শারীরিক এবং মানসিক কষ্ট অনেকখানি জয় করেছে সে। শুধু শত্ৰুজয় করলেই জিষ্ণু হওয়া যায় না, জানে অর্জুন। এ-ও জানে, ক্ষত্রিয় মহাবীরকে হতে হয় আকাশের মতো। চন্দ্র-সূর্য ধারণ করেও যার মধ্যে আছে হাজার নক্ষত্র, হাজার নক্ষত্রের সম্ভাবনা। কেবল সম্ভবে তুষ্ট থাকবে না অর্জুনও। সে সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাবে।
অর্জুন এখন মিতাহারী, মিতবাক। অশন, বসন, শয়ন সবেতেই স্বেচ্ছায়। কষ্ট করছে সে।
এই ভ্রমণপর্বে একটি নতুন তথ্য পেয়েছে অর্জুন। সে মনে করত হস্তিনাপুর এমনই বিখ্যাত, পুরু-ভরত বংশ বা কৌরব পাণ্ডব এতই সুখ্যাত যে, সারা বিশ্ব তাদের জানে। স্বর্গে পর্যন্ত তাদের নিয়ে আলোচনা হয়, সেখানে পৃথিবী আর কী এমন! ভ্রমণে এসে তার ভুল ভেঙেছে। এই ভারত পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে যারা হস্তিনাপুরের কোনও খবর রাখে না। কেউ কেউ ভীষ্মর নাম শুনেছে, অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রর নামও শুনেছে। কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজনীতি নিয়ে তাদের কোনও আগ্রহ নেই। অর্জুন বিস্মিত, বিব্রত। সে একটি মানচিত্র তৈরি করছে। সে জানে যুধিষ্ঠির অনেক বড় রাজা হবে একদিন। রাজসূয় যজ্ঞ করবে, অশ্বমেধ যজ্ঞ করবে। তার জন্য সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে অর্জুনই তো যাবে দেশে দেশে।
যাবে অবশ্য অন্য ভাইরাও। সে অনেক সময় ভেবেছে কাকে কোথায় পাঠানো যেতে পারে। দশার্ণ, মালব প্রভৃতি দেশ অনায়াসেই জয় করবে নকুল। সহদেবের কথা এখনও কিছু ভাবেনি সে। সহদেব দুর্ধর্ষ অসিযোদ্ধা, বীর রথী। নকুলের আশেপাশেই তাকে রাখবে অর্জুন। এমনকী যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে রাজ্য রক্ষার জন্য ইন্দ্রপ্রস্থেও থেকে যেতে পারে সহদেব। নকুল না থাকলে গোরুগুলির দেখাশোনার ভার নিতে হবে সহদেবকেই। সহদেব গো-বিশেষজ্ঞও বটে। আর পরাক্রমশালী রাজ্যগুলোতে যাবে ভীম আর অর্জুন। দিগ্বিজয়ের কল্পনায় অর্জুন উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সমস্ত দেশ জয় করবে সে। পাণ্ডুরাজার নামও যারা শোনেনি, তাদেরও বাধ্য করবে প্রথম পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে সার্বভৌম সম্রাট বলে ডাকতে।
সেইসময় কি রাজসূয় যজ্ঞের বার্তা নিয়ে একবার নাগরাজ্যে আসবে না অর্জুন? কৌরব্য নাগ এখন তাদের আত্মীয়। আত্মীয় সম্বন্ধে বশ্যতা স্বীকার করানোর প্রশ্ন ওঠে না, যদি না কেউ বিদ্রোহ করে। সাধারণত রাজসূয় করলে আত্মীয় রাজারা সৌজন্যবশত প্রচুর ধনরত্ন, হাতি-ঘোড়া- গোরু উপহার দেয়। কৌরব্য নাগও দেবে নিশ্চয়ই। সেইসময় উলূপীর সঙ্গে তার দেখা হবে আবার। প্রথম সন্তানের মুখ দেখবে তখন অর্জুন।
অর্জুনের মনে হল, উলূপীর সঙ্গে আবার দেখা হবে, এই উদ্দেশ্যেই যেন সে চায় যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করুক। তার হাসি পেল। ক্ষুদ্র কোনও ঘটনার যেমন বিরাট উদ্দেশ্য থাকতে পারে, বিরাট কোনও ঘটনারও থাকে নানান ছোটখাটো সার্থকতা।
চলতে চলতে ছোট ছোট পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এক রাজ্যে এসে পৌঁছল অর্জুন। সুসজ্জিত নগর যেমন আছে এ দেশে, তেমনি আছে বন ও কৃষিনির্ভর গ্রাম। খুব ছোট এ দেশ, কিন্তু সমৃদ্ধ, তা বোঝা যায়। এ দেশের নাম মণিপুর।
একটানা বেশ কিছুদিন ভ্রমণ করছে অর্জুন। গঙ্গাদ্বার ছেড়ে আসার পর আর স্থির হয়নি কোথাও। তার ওপর ওই স্বেচ্ছায় বরণ করা কষ্ট! ভিতরে ভিতরে ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল অর্জুন। ছোট্ট মণিপুর দেশটা পছন্দ হয়ে গেল তার। কিছুদিন এখানেই থাকবে বলে ঠিক করল সে।
তীর্থে তীর্থে ঘুরে, বন পাহাড় ভেঙে পথ চলতে চলতে অর্জুনের সঙ্গীরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অর্জুনের অবস্থানের সিদ্ধান্তে তারাও হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। নগরের প্রান্তে, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কুটির বানাতে ব্যস্ত হল তারা। পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভাল। জায়গাটা মনোরম। তার সঙ্গে নগরের সুযোগ-সুবিধাও হাতের কাছে। অর্জুন নগর পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়ল।
অতি সাধারণ বেশ অর্জুনের। অবিন্যস্ত চুল মাথায় চুড়ো করে কোনওক্রমে বাঁধা। একমুখ দাড়িগোঁফ। তার ওপর কৃচ্ছ্রতায় খানিক কৃশ হয়েছে সে। ঘুরে ঘুরে কালো গায়ের রং আরও পোড়া, আরও ঘন। শুধুমাত্র বিরাট বীরোচিত গড়ন ছাড়া অর্জুনের রূপ সম্পূর্ণ চাপা পড়ে আছে। এক পক্ষে ভালই হয়েছে তার। কেউ তাকে খুব নজর করছে না। সে আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
দীন-হীন বেশ আর গোঁফদাড়ির মহিমা আগেই দেখেছে অর্জুন। অপরূপ রূপবান পুরুষ তারা পাঁচ ভাই, শৌর্য-বীর্য যেন ঠিকরে পড়ে গা থেকে, অসামান্য রূপসী কুন্তী, তাঁকে দেখলে বোঝাই যায় না এত বড় বড় পাঁচ-পাঁচটা ছেলে আছে— ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধন চক্রান্ত করে তাদের পুড়িয়ে মারার জন্য যে বারণাবতে পাঠাল, সেই বারণাবত থেকে বেঁচে ফেরার সময় ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে কেউ কি তাদের চিনতে পেরেছিল এক কৃষ্ণ ছাড়া?
এমনকী একচক্রা নগরীতে থাকার সময় যখন শোনা গেল বকরাক্ষস রোজ একটা করে মানুষ মেরে খাচ্ছে তখন ভীমকেই তো পাঠাল কুন্তী ওই বক মারার জন্য। আর ভীম মেরেও এল বকাসুরকে। ওইরকম অসুর-মারা পর্বতের মতো ভীমকেও কেউ চিনতে পারেনি কেবল ব্রাহ্মণ ভিক্ষুক সেজে ছিল বলে।
কৃষ্ণর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। লোকে ঠিকই বলে। না হলে, সেই পাঞ্চালীর স্বয়ম্বর সভাতেই কৃষ্ণ প্রথম তাদের দেখেছিল। চিনল কী করে? অর্জুন অনুমান করতে পারে, কৃষ্ণর চরচক্র অত্যন্ত কুশলী এবং তৎপর। হয়তো তার কাছে খবর ছিল ব্রাহ্মণের বেশে পঞ্চপাণ্ডব পাঞ্চালে রয়েছে। পাঞ্চালে যাবার পরামর্শ ব্যাসদেবও দিয়েছিল কুন্তীকে। কৃষ্ণ ঋষিকুলের সঙ্গে রীতিমতো যোগাযোগ রেখে চলে। তবুও, প্রথম দর্শনে কৃষ্ণ তাদের কেমন করে চিনবে যদি তার অন্তর্দৃষ্টি না থাকে?
সেই দিনটির কথা আবার মনে হল অর্জুনের। কৃষ্ণ! কী সুন্দর! কী বলবান! কী আশ্চর্য মোহন! কৃষ্ণর পাশে বলরাম দেবদুর্লভ রূপ নিয়ে, দুধে আলতা গায়ের রঙে নীল বসন পরে সভা আলো করে বসে ছিল। কিন্তু কালো কৃষ্ণর রকমটাই অন্য। বলরাম রূপবান। আর কৃষ্ণ রূপের সংজ্ঞা।
আজ যদি কৃষ্ণ তাকে দেখত, ঠিক চিনতে পারত।
ঘুরতে ঘুরতে অর্জুন দেখল, খোলা মাঠে একটি জনসভা। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, এক বালক সিংহাসনে বসে আছে। লোক তাকে ঘিরে আছে। এক একজন আসছে, তার পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসছে। এখানে কী হচ্ছে? নাট্যাভিনয়, নাকি খেলা? কৌতুকে ও কৌতূহলে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়াল অর্জুন। কাছে এসে বুঝল, বালক নয়। একটি মেয়ে। পুরুষের পোশাক পরেছে। সঙ্গে ধনুর্বাণ। অনুচরীদের পরনেও ছেলের পোশাক। তবু এই মেয়ের সৌন্দর্য উছলে পড়ছে। রীতিমতো ফুটে আছে দুটি উন্মুখ স্তন। অর্জুন কামতাড়না বোধ করল। কে এই মেয়ে? পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করল অর্জুন। একটুখানি দেখে সে যা বুঝেছে, এখানে বিচার চলছে। বহু লোক। কেউ অপরাধী, কেউ বিচারপ্রার্থী, অধিকাংশই দর্শক। তামাশা দেখছে। অর্জুনের পাশের লোকটিও দর্শক। অর্জুনের প্রশ্ন শুনে সে অবাক চোখে দেখল। বলল, “ইনি কে তুমি জানো না? তুমি কি ভিনদেশি? কোন দেশে বাস তোমার?”
অর্জুন বলল, “আমি পর্যটক।”
“পর্যটকেরও তো জন্ম হয় কোথাও। জন্মভূমি বলে কিছু থাকে।”
“ইন্দ্রপ্রস্থ আমার দেশ।”
“সে আবার কোথায়?”
“হস্তিনাপুরের নাম শুনেছ? তার কাছে।”
“হস্তিনাপুর? না বাপু। শুনিনি। আর শুনতেও চাই না। ইন্দ্রপ্রস্থ কোথায়? না হস্তিনাপুরের কাছে। এবার হস্তিনাপুর কোথায়? তুমি হয়তো বলবে বাঘবন্দিপুরের কাছে। বাঘবন্দিপুরের হদিশ দিতে গিয়ে তুমি হয়তো বিভীষণপুরের কথা বলবে— কী বললাম? বিভীষণপুর? বিভীষণ… বিভীষণ… ভীষ… ভীষ… ভীষ্ম! ভীষ্ম! হ্যাঁ হ্যাঁ! মনে পড়েছে। হস্তিনাপুর মনে পড়েছে। সেই যে লোকটা, যার কথার নড়চড় হয় না, যাকে নাকি কেউ বধ করতে পারবে না, সেই ভীষ্ম যে-দেশে থাকে! সেই হস্তিনাপুর?”
লোকটি এত চেঁচিয়ে উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে যে, কেউ কেউ তাদের দেখছে। অর্জুন চাপা গলায় বলল, “সেই হস্তিনাপুর।”
লোকটি মহা কৌতূহলে বলল, “ভীষ্মকে স্বচক্ষে দেখেছ তুমি?”
অর্জুনের হাসি পেল। সে যদি বলে, ভীষ্ম তাকে কোলে করে মানুষ করেছে, সে ভীষ্মর নয়নের মণি, এই লোকটি তার কথা বিশ্বাস করবে না। তাকে নীরব দেখে লোকটি নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব খুঁজে নিল। বলল, “তুমি সাধারণ লোক, তোমার সঙ্গে ভীষ্মর দেখা হবে কী করে? চেহারাটা অবশ্য তোমার বেশ বড়-সড়। কিন্তু সেটা তো তোমার ভীষ্মদর্শনের কারণ হতে পারে না। তা ছাড়া, তুমি তো… কী যেন বললে… ইন্দ্রপুর… না ইন্দ্রপ্রস্থর লোক। তা তোমার নাম কী?”
“আমি পার্থ। তোমার নাম কী?”
“আমি প্রদীপক। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। বংশের একটি মাত্র সলতে। তাই এই নাম।”
“বাঃ!”
“ওই যে দূরে মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দেখতে পাচ্ছ, ওটা আমার। তা তোমার নাম পার্থ কেন?”
“আমার মায়ের নাম পৃথা, সেই থেকে পার্থ।”
“কী করা হয়?”
“এই যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।”
“এ বুঝি একটা কাজ?”
“এখন এই আমার কাজ। প্রদীপক, তুমি তো বললে না এই নারী কে? কেনই বা সে বিচার করছে? তোমাদের কি রাজা নেই?”
“দাঁড়াও দাঁড়াও। তোমার তো খুব কৌতূহল। অবশ্য নারীকে পুরুষের ভূমিকায় দেখলে লোকে কৌতূহলী হবেই। বিশেষ, ভিনদেশি। দাঁড়াও, একে একে তোমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি। তার আগে তুমি আমায় জিজ্ঞেস করো, কেন আমি বিকিকিনি ফেলে এই বিচারসভায় এসেছি?”
লোকটা অত্যন্ত বেশি কথা বলে। কিন্তু অর্জুনের মন্দ লাগছে না। অনেকদিন পরে বাঁধাধরা কাজের বাইরে এমন এলোমেলো অর্থহীন সময়যাপন তার বেশ লাগছে। সে বলল, “জিজ্ঞেস করলাম। এ আমার পঞ্চম প্রশ্ন। তোমার নাম বলা ছাড়া আর কোনও প্রশ্নের জবাব এখনও তুমি দাওনি। কিন্তু তোমার সব কথার উত্তর আমি দিয়েছি।”
“বলছি বাবা বলছি। আগে শোনো, আজ আমি কেন এখানে এসেছি। ওই যে সিড়িঙ্গে মতো লোকটাকে দেখছ, ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, ওর নাম শলক। ওর আজ বিচার হবে। ওর কোন আত্মীয় নাকি বৃন্দাবনে থাকে, সেই নিয়ে খুব গর্ব। বৃন্দাবনের নাম শুনেছ তো? সেই যেখান থেকে কৃষ্ণ নামের একটা ছেলে এসে মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসকে বধ করেছিল? ওই শলক বানিয়ে বানিয়ে নানান মিথ্যা গল্প করে বৃন্দাবন আর কৃষ্ণ নিয়ে। এদিকে নিজে কোনওদিন যায়নি কিন্তু।”
“তাই কি ওর বিচার হবে?” অর্জুন সকৌতুকে বলল।
লোকটি তাড়াতাড়ি বলল, “না না। তা কেন? ও যেমন মিথ্যাবাদী, তেমনি ঠগ। আমারই মতো মিষ্টি বিক্রি করে। বেশি লাভের লোভে কী করেছে জানো?”
“না।”
“দুধে পিটুলিগোলা মিশিয়ে মিষ্টি বানিয়েছে। লোকে বোকা নাকি? দিয়েছে নালিশ ঠুকে।”
“তোমার ওর বিচার দেখে কী লাভ? তুমি তো অপকর্ম করো না।”
“চোখের সামনে ফলফলিয়ে উঠছিল, আজ মজা টের পাবে। রাজপুত্রী চিত্রাঙ্গদার কঠিন বিচার।”
“রাজপুত্রী চিত্রাঙ্গদা?”
“হ্যা। রাজা চিত্ৰবাহনের একমাত্র সন্তান। ছেলে নেই বলে রাজা মেয়েকেই ছেলে সাজিয়ে রাখেন।”
“রাজবাড়িটা কোন দিকে?”
“তুমি এখন রাজপুরীতে যাবার কথা ভাবছ নাকি?”
“যাঁর দেশে এসেছি, সেই রাজাকে একবার দর্শন করব না?”
“ঠিক ঠিক। আর একটু অপেক্ষা করো। আমি তোমাকে রাজার বাড়িতে নিয়ে যাব। তুমি কিনা আমাদের অতিথি। শলকের বিচারটা দেখে যাই।”
প্রদীপকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে শলকের বিচার দেখল অর্জুন। চিত্রাঙ্গদা শলককে পঞ্চাশ ঘা বেত মারার আদেশ দিল। তার সমস্ত গোরু এবং বিপণি বাজেয়াপ্ত হল সেই সঙ্গে। শুধু একটি গোরু শলক বেছে নিতে পারে পরিবার প্রতিপালনের জন্য, কিন্তু আর কোনওদিন সে মিষ্টি বিক্রি করতে পারবে না।
কঠিন শাস্তিই পেল শলক। কিন্তু তার পরিবারের কথা ভেবে দয়া দেখানো হল। শাস্তি নির্মম হওয়াই মুখ্য নয়।
বিচারের রকম দেখে খুশি হল অর্জুন।
প্রদীপক বলল, “ভাই চলো, আমার হাতের মিষ্টি একটু খাবে চলো। তুমি আমাদের অতিথি।”
অর্জুন আপত্তি করল না। প্রদীপকের সঙ্গে যেতে যেতে সে দেখল সভা শেষ হয়েছে। একটি সুন্দর রথ এল। পুরুষ বেশে সুন্দরী চিত্রাঙ্গদা তাতে আরোহণ করল। তার চলার ভঙ্গিটি নারীসুলভ। তার রথ চালাচ্ছিল একজন পুরুষ। অনুচরীরা ছিল পিছনে আরেকটি রথে। অর্জুনের মনে হল, চিত্রাঙ্গদা পুরুষের পোশাক পরেছে এবং পুরুষের মতোই রাজ্যশাসনে অংশ নিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই ভূমিকায় সে সহজ বোধ করছে না। বরং পুরুষের পোশাক না পরেও অনেক বেশি পুরুষোচিত দক্ষতা ছিল উলূপীর। অর্জুনের মনে হয়, দায়িত্ব পেলে উলূপী কোনও যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা রাখে।
সচকিত হয়ে উঠল সে। চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে উলূপীর তুলনা করছে কেন? দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা বংশ, আলাদা সংস্কৃতির মেয়ে। তুলনা হয় সমানে সমানে। হিমালয়ের কোলে বেড়ে ওঠা নাগরমণী উলূপীর সঙ্গে যেমন যজ্ঞের আগুন থেকে যার জন্ম সেই যাজ্ঞসেনীর তুলনা হয় না, তেমনি উলূপী বা যাজ্ঞসেনীর সঙ্গে চিত্রাঙ্গদারও তুলনা করা চলে না। তবু কেন সেই তুলনা আসে? উত্তর পাবার চেষ্টা করল অর্জুন। সে বুঝল, তিন রমণীর প্রত্যেকেই অনন্যা। শুধু দুই জায়গাতে তাদের সাধারণ্য। তারা নারী এবং তারা অর্জুনের কামনার নারী।
নয়
নগরের চাকচিক্য দেখে এই মনলুরপুর বা মণিপুর রাজ্যের সমৃদ্ধি অনুমান করেছিল অর্জুন। রাজপ্রাসাদ দেখে তার প্রত্যয় দৃঢ় হল যে, মণিপুররাজ বেশ সম্পন্ন ব্যক্তি। এরা যে শুধু ধনী তাই নয়, ধনাধিক্য প্রদর্শন করতেও জানে ভালরকম। প্রাসাদের থাম, খিলান, ছাত, দরজা, জানালা— সব কিছুতে সোনার জলের কারুকাজ। আসবাবগুলো রুপোর। তাতে মণিমুক্তোর কাজ করা। চোখ যেন ঝলসে যায়।
ভোগবিলাসবিবর্জিত বনবাসীর জীবন যেমন দেখেছে অর্জুন, তেমনি হস্তিনাপুরে ধনসম্পদও প্রচুর দেখেছে। সেখানে শুধু রাজাই নয়, রাজপরিবারের সকলেই ধনাঢ্য। জীবনযাপনের মধ্যেই ঐশ্বর্যের প্রভা সেখানে এমনভাবে মিশে আছে, সবই স্বাভাবিক লাগে। এখানে যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সম্পদ এখানে যৌবনমত্ত ঊর্ধ্বগ্রীব ময়ূরের মতো অহংকারী।
রাজা চিত্ৰবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে নানা কথা ভাবছিল অর্জুন। নাগলোকের কথাও তার মনে পড়ল। সেই শান্ত স্নিগ্ধ দেশ। নগরজীবনের চাকচিক্য, কোলাহল, জনবাহুল্য তার কোথাও নেই। অরণ্যের আড়ালে, পাহাড়ের বুকে এক অপরূপ শ্যামলশোভা গ্রাম। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি বাড়িগুলোর শিল্পসুষমাই আলাদা। কাঠে, পাথরে কী অসামান্য খোদাই করা কারুকার্য! সম্পদ নাগদেশের কিছু কম নেই। কৌরব্য নাগের ঘোড়াশালে কতরকম ঘোড়া দেখেছে অর্জুন! সম্পদ কি কেবল সোনারুপোয় মাপবার জিনিস? ঐতিহ্যও এক রকম সম্পদ। নাগ-মা কদ্রু এবং কশ্যপের কাল থেকে বিবিধ বিদ্যার যে-ঐতিহ্য নাগবংশ বয়ে চলেছে, তার মূল্য অপরিসীম।
চিত্ৰবাহন আসতেই তাকে অভিবাদন জানাল অর্জুন। ঘরবাড়ির মতোই চিত্ৰবাহনের পোশাক বহু মূল্যবান এবং চাকচিক্যময়। প্রায় একজন অপ্সরের মতো সেজে বসে আছে রাজা। বিচারসভায় রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার বেশবাস যথেষ্ট ঝলমলে ছিল। কিন্তু যৌবনবতীকে যে-সাজ আকর্ষণীয় করে, সেই সাজ প্রৌঢ়কে মানায় না। সাজ নিয়ে অর্জুন খুব ভাবে না। কিন্তু দৃষ্টিনন্দন না হলে বেশবাসের পীড়ায় সে বিরক্ত বোধ করে।
চিত্ৰবাহন বলল, “বলো যুবক। কে তুমি? কী চাও? কোথায় তোমার দেশ?”
চিত্ৰবাহনকে দেখে অর্জুনের অন্তর সংকুচিত হয়ে গেল। কথা বলার ইচ্ছাই চলে গেল তার। কোনও দেখানেপনা, কোনও আতিশয্যই পছন্দ করে না অর্জুন। তার নিজের মধ্যেও, আমিই ত্রিভুবনের সেরা ধনুর্ধর— ভাবটি আছে। অর্জুনের তা-ও পছন্দ নয়। এই ভাব সে জয় করবে। এই চিত্রবাহনের প্রাসাদ ও পোশাকের চোখ ধাঁধানো জৌলুস, তার চোখেমুখে লেগে থাকা বড়লোকি তাচ্ছিল্য তার একেবারে ভাল লাগছে না। কিন্তু দেখা করতে এসে, আমার কিছু বলার নেই, আপনার মুখ দেখতে এসেছিলাম, এমনটাও বলা যায় না। তা ছাড়া চিত্রাঙ্গদাকে দেখে অর্জুনের মনে কামনা জেগেছে। তা সে কেমন করে অস্বীকার করবে? সে বলল, “আমি অর্জুন। কুন্তীর ছেলে। হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর তৃতীয় পুত্র।”
“অর্জুন!”
রাজা চিত্ৰবাহন হাঁ করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। অর্জুন এদিক-ওদিক দেখছে। তার অস্বস্তি লাগছে। চিত্ৰবাহন আবার সবিস্ময়ে বলল, “তুমি সেই অর্জুন, ত্রিভুবনে যার তুলনীয় বীর কেউ নেই?”
একজন অপরিচিত বর্ষীয়ান রাজার মুখে এমন বিস্ময়বিমুগ্ধ শংসা পেয়ে ভারী অপ্রতিভ বোধ করল অর্জুন। হ্যাঁ, সে একজন সেরা ধনুর্ধর বটে, সেই খ্যাতিটুকু তার ভাল লাগে। সে আরও জানতে চায়। আরও দক্ষ হতে চায়। কিন্তু ত্রিভুবনের সেরা বীর সে, এই খ্যাতি এখনও রটনা মাত্র। রটনাকে সত্যি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পেল কোথায় সে? ছোট-খাটো যুদ্ধ ক্ষত্রিয় যোদ্ধার জীবনের অঙ্গ। লোকে যেমন সপ্তাহান্তে ঘোড়া বা উটের মাংস খায়, কিংবা বুনো শূয়োরের মাংস খেয়ে গতানুগতিক খাবারের স্বাদ পাল্টায়— তেমনি হল ক্ষত্রিয়ের লড়াই। ওতে বীরত্বের প্রমাণ রাখা যায় না। বীরত্ব দেখানো যায় মহাযুদ্ধে। প্রবল শক্তিমানের বিরুদ্ধে এককভাবে, দ্বন্দ্বে কিংবা সৈন্যসামন্ত নিয়ে রণাঙ্গনে। দক্ষতা অবশ্য প্রতিযোগিতায় দেখানো যায়। তবে, রণকৌশল প্রদর্শন আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এক নয়। ভীমসেন তবু রাক্ষস-টাক্ষস মেরে নিজের বীরত্বের প্রমাণ রেখেছে। আর সে? কোন কৈশোরে দ্রুপদ রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে দ্রোণাচার্যের জন্য ধরে-বেঁধে এনেছিল— সেই থেকে অর্জুন হয়ে গেল মহাবীর। আবার ওই দ্রুপদের মেয়েরই স্বয়ম্বর সভায় খানিক বীরত্ব দেখাবার সুযোগ পেয়েছিল অর্জুন আর ভীম। পাঞ্চালীকে দেখে এমনই লোভী ও কামুক হয়ে উঠেছিল রাজারা যে, লক্ষ্য ভেদ করার পর ব্রাহ্মণবেশী তরুণ অর্জুনের গলায় যেই মালা পরাল পাঞ্চালী, রাজারা একেবারে ক্ষেপে উঠল। এমনকী কর্ণ আর দুর্যোধনও ছিল সেই ব্যর্থ ক্ষুব্ধ রাজার দলে। মুহূর্তের মধ্যে স্বয়ম্বর সভা হয়ে গেল যুদ্ধভূমি। যত রাজা সেদিন যুদ্ধ করেছিল, অর্জুন তাদের প্রতিপক্ষ বলেই মনে করে না। হ্যাঁ, সেদিন যদি কৃষ্ণ ও বলরামের সঙ্গে তার লড়াই হত, যদি ভীষ্মকে হারাতে পারত কোনও যুদ্ধে, যদি ইন্দ্র তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরত, সে বুঝিয়ে দিত বীরত্ব কাকে বলে!
এই যাদের কথা মনে পড়ল অর্জুনের— তারা কেউ কোনও দিন তার বিরুদ্ধে যাবে না। অস্ত্র সেও ধরবে না ওই প্রণম্য জনেদের বিরুদ্ধে। তাই নিজেকে সেরা ভাবার স্পর্ধা আর দেখাতে চায় না সে। যত দিন যাচ্ছে, মনের ও চিন্তার পরিণতি পাচ্ছে অর্জুন। সাফল্যের গর্বকে তাই ছেলেমানুষিই মনে হয় আজকাল। এখনও কত জানার বাকি, কত শেখা হয়নি এখনও। যেমন নাগপাশ অস্ত্র পেল সে, তেমনি আরও কত আছে।
চিত্ৰবাহনের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, “আমি তৃতীয় পার্থ, তৃতীয় পাণ্ডব, ভীষ্ম আমার পিতামহ। আমি অর্জুন।”
চিত্রবাহনের বিস্ময় কাটেনি। সে বলল, “তুমিই অর্জুন! তুমি তো অতি তরুণ! একেবারে কাঁচা বয়স তোমার। এই বয়সে কৃষ্ণ ছাড়া আর কেউ এমন খ্যাতি পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। তা, তুমি যদি অর্জুনই হয়ে থাকো, এই সাধারণ বেশে এসেছ কেন? তোমার ভাইরা, তোমার সঙ্গীসাথী সব কোথায়?”
অর্জুন বুঝল, রাজা চিত্ৰবাহন তাদের সম্পর্কে খুব বেশি খোঁজখবর রাখে না। উলূপী এবং কৌরব্য নাগের সব জানা ছিল। তা হলে কি অর্জুন সব বলতে বসবে? কোনও প্রয়োজন নেই। যতটুকু প্রয়োজন, তার বেশি কথা বলতে নেই সব জায়গায়। সে বলল, “ভাইরা আমার সঙ্গে নেই। ক’জন অনুচর আর পুরোহিত নিয়ে আমি ভ্রমণে বেরিয়েছি। নগরের বাইরে আমাদের কুটির বাঁধা হচ্ছে।”
“ও। তা বেশ। শুনেছি দ্রুপদ রাজার মেয়ে তোমাদের পাঁচভাইয়ের গলাতেই মালা দিয়েছে। এ কি সত্যি?”
“আপনি ঠিকই শুনেছেন।”
“ও। তা, তুমিই তো বোধহয় তাকে জয় করেছিলে?”
“রাজা দ্রুপদের দেওয়া শর্ত আমি পালন করতে পেরেছিলাম।”
“বেশ বেশ। সব কথা তো সঠিকভাবে কানে আসে না। ভাসা ভাসা যা খবর পাই। বেশি জানার দরকারই বা কী? আমার এই ছোট রাজ্যের প্রজারা নিজের সুখ-শান্তিতে মজে আছে। কোথায় কী হল না হল খোঁজই রাখে না। আমারও যুদ্ধবিগ্রহ খুব একটা পছন্দ নয় বলে পররাজ্যে লোভ করি না। তাই বলে কেউ আক্রমণ করে পার পেয়ে যাবে ভেবো না। সৈন্যসামন্ত আমার ভালই আছে। এবার বলো অর্জুন, তোমার আসার হেতু কী?”
“রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করতে চাই আমি।”
চিত্ৰবাহন বিস্ময় বা বিরক্তি, আনুকূল্য বা অসমর্থন, কিছুই প্রকাশ করল না। বলল, “ও। তা বেশ। তবে আমার যে কিছু শর্ত আছে এ বিষয়ে?”
“বলুন কী আপনার শর্ত?”
“মহাদেব আমাদের পূর্বপুরুষ রাজা প্রভঞ্জনকে বর দিয়েছিলেন, তাঁর বংশধারা কোনওদিন লোপ পাবে না। সেই থেকে বংশ পরম্পরাক্রমে প্রত্যেকে একজন অন্তত ছেলে পেয়েছে। আমার কপাল, আমি সন্তান পেলাম বটে, তবে সে মেয়ে। তাই মেয়েই আমার কাছে ছেলের সমান। রাজকার্য, সৈন্য পরিচালনা, যুদ্ধ— সব কিছুতেই আমার চিত্রাঙ্গদা পারদর্শী। আমার অবর্তমানে আমার রাজ্য সে ভালই চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। তাই চিত্রাঙ্গদা তোমার বউ হয়ে তোমার সঙ্গে যেতে পারবে না, আর তুমিও তার ছেলে না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে যেতে পারবে না। দ্বিতীয় শর্ত হল, ছেলে তোমার পরিচয় পাবে ঠিকই, কিন্তু তুমি তাকে পাবে না। সে-ই হবে ভবিষ্যতে মণিপুরের রাজা।”
অর্জুন বলল, “বেশ। শুনলাম আপনার শর্ত। আজ আমি চলে যাচ্ছি। কাল এসে আপনাকে আমার মতামত জানাব।”
একটু মনমরাভাবে নিজের আস্তানার দিকে হেঁটে চলল অর্জুন। উলূপীর কথা আবার তার মনে পড়ল। কোনও দাবি নেই, কোনও অধিকারস্পৃহা নেই, নিঃশর্ত ভালবাসাই শুধু প্রার্থনা ছিল উলূপীর। তাও শুধু একরাত্রির জন্য। উলূপীর জন্য কষ্ট হতে লাগল অর্জুনের। তার জীবনে পাঞ্চালীও এসেছে ভাগাভাগি হয়ে। শর্তের নিগড়ে বাঁধা হয়ে। কিন্তু উলূপী? অর্জুনই তার জীবনমরণ।
এমন রমণী পেয়েও কেন অন্য রমণীকে পাবার ইচ্ছা হয়? শরীর সেই ইচ্ছার সৃষ্টি করে, নাকি মন? এক নারী থেকে অন্য নারী যেন এক দেশের পর অন্য দেশ জয় করার মতো। স্বয়ং কৃষ্ণই তো বহুবিবাহিত পুরুষ।
কৃষ্ণের কথা ভাবতেই অর্জুন খানিক উৎফুল্ল হয়ে উঠল। কুটিরে পৌঁছে দেখল দিব্যি ব্যবস্থা। অনুচরেরা হাঁড়ি-কুড়ি নিয়ে রান্নায় লেগে পড়েছে। মূল রান্না হরিষেণ সূপকারই করবে। বাকিরা তাকে সাহায্য করছে। পুরোহিত পর্যন্ত চাল ধুয়ে ধুয়ে তুলে রাখছে দেখল অর্জুন।
কুটির বাঁধতে অনেক সময় গিয়েছে। বিকেল পড়ে আসছে এখন। মানুষগুলো নিশ্চয়ই দুপুরে কিছু খাবার অবকাশ পায়নি। একবারে নৈশাহার করবে। প্রদীপক তবু অর্জুনকে অনেক মিষ্টি খাইয়েছিল। লোকটা বেশি কথা বলে। কিন্তু ভাল। এদেশে কি সবাই বেশি কথা বলে? রাজা চিত্ৰবাহন কিছু কম বলল না। প্রদীপকের কাছে আবার যাবে অর্জুন। একেবারে সাধারণ মানুষ, যারা সবসময় ধর্ম-অধর্মের সূক্ষ্ম বিচার, জয়-পরাজয়, রাজ্যলাভ প্রভৃতি বড় বড় কথা ভাবে না, নিজের ছোট কাজে ছোট ভাবনার মধ্যেই তৃপ্ত থাকে, তাদের সঙ্গ মাঝে মাঝে চিত্তমুক্তি ঘটায়। মনে হয়, এ জগৎ খুব সাংঘাতিকরকম প্রতিযোগী নয়। মনে হয়, ওই ছোট্ট বাসায়, বউ-ছেলে নিয়ে, সামান্য সম্পদ নিয়ে তৃপ্ত সুখী জীবনের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। পাখির মতোই তারা জীবনের নিবিড় উষ্ণতায় পরিপ্লুত।
অর্জুন জানে, সাধারণ মানুষের সাধারণ সুখ-দুঃখের জীবনে যে-আশ্বাস, তা তাদের বেশিদিন ভাল লাগবে না। নিজেকে প্রমাণ করা, আরও আরও বেশি প্রমাণ করার তাগিদ তাদের ছুটিয়ে নেয়। তবু, স্বল্পক্ষণের জন্য হলেও, ওই আশ্বাসটুকু আরামের।
সঙ্গীদের জন্য কিছু ফল পাওয়া যায় কিনা দেখবে বলে তির-ধনুক নিয়ে বেরুল অর্জুন। কপাল ভাল থাকলে শিকার জুটে যেতে পারে। ওই ছোট ছোট পাহাড়ের ঘন গাছপালার মধ্যে পশু এবং ফল দুই-ই থাকা সম্ভব। শিকারের উপযোগী বাণ নিল সে সঙ্গে। এর মধ্যে কয়েকটি উলূপীর দেওয়া উপহার। কোনওটার মাথা গোল, কোনওটা চ্যাপ্টা পাতে কাটা লাগানো, কোনওটা আধা চাঁদের মতো পাত বসানো। অর্জুনের ক্ষুরপ্র বাণের ছোট সংস্করণ। এ দিয়ে গাছের উপর থেকে ফল বা পাখি খুব সহজে টেনে আনা যায়। একজন অনুচর সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ে উঠতে লাগল সে। ফলমূল ভালই পেতে লাগল। বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে, পশুদের দেখে, অনেক বুনো ফল তারা খেতে শিখেছে, যা আগে খেত না। অর্জুনের মনে হয়, চূড়ান্ত রাজসুখ এবং তার বিপরীতে বনবাসী বা ভিক্ষান্নজীবীর কষ্টকর দিনযাপন— এমন বৈপরীত্য তাদের ছাড়া, ত্রেতা যুগের রামচন্দ্রর হয়েছিল একমাত্র। বা আর দু-একজন। ভোগ সুখ খুব প্রয়োজন হয় না তার। আরামের বশবর্তী সে নয়। তুলতুলে নরম সুখশয্যাতেও সে গভীরভাবে ঘুমোয়, খড়-বিচালির বিছানাতেও ঘুমোয় একই রকম। যুধিষ্ঠিরও এরকম। তবে ভীম নকুল আর সহদেব মনের মতো বিছানা না পেলে পরদিন বড় বড় হাই তোলে। অভিযোগ কেউ-ই করে না। তবু ভীমের বিরক্তি গোপনও থাকে না। তাকে আরও রাগিয়ে দেবার জন্য অর্জুন বলে, “আঃ! কী দারুণ বিছানা! কী ভাল ঘুমিয়েছি, তাই না ভীম? আমি তো স্বপ্ন দেখলাম ইন্দ্রলোকের নন্দনকাননে ঘুরে বেড়াচ্ছি।” ভীম প্রায় কির্মীর রাক্ষসের মতো দাঁত কিড়মিড় করে ধেয়ে আসে।
মা আর ভাইদের জন্য কষ্ট হতে লাগল তার। কতদিন দেখেনি!
আর সে? সেই কালো দামিনীর মতো কৃষ্ণা? না। এখন তার কথা ভাবতে চায় না অর্জুন। সে শিকারের সন্ধানে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্ত যাবার আয়োজন করছে। সেই রক্তিম সূর্যের দিকে তাকিয়ে তার মনে হল, সূর্য যেন কী বলতে চায়। অর্জুন তার ভাষা বুঝতে পারল না। আগেও এমন হয়েছে কয়েকবার। ভোরের সূর্যকে যখন সে প্রণাম করেছে, কোন ইঙ্গিতের ছটা লেগেছে জগতে, অর্জুন তা বুঝতে পারেনি। আজ যদি কৃষ্ণ থাকত কাছে, সে কৃষ্ণকে এই ইঙ্গিতের কথা বলত।
যথেষ্ট ফল সংগ্রহ হয়েছে। অর্জুন তার অনুচরকে বলল, “অনুপ, এই ফল তোমরা সবাই ভাগ করে খাও গিয়ে।”
অনুপ বলল, “সন্ধ্যা হয়েছে। তুমিও ফিরে চলো অর্জুন।”
তখন, কিছু কচি কণ্ঠের কলকলকলি ভেসে এল বাতাসে। অনেকগুলো বাচ্চা একসঙ্গে কথা বললে যেমন হয়। অর্জুন এদিক-ওদিক তাকাল। এদেশের বাচ্চারা কী খেলে? তার কৌতূহল বুঝে অনুপ বলল, “এই পাহাড়ের পেছনদিকে রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদা তাঁবু ফেলেছে। শিকারের মাংস দিয়ে ভোজ হবে রাতে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে চড়ুইভাতি। প্রায়ই হয়। জানো অর্জুন, এদেশের রাজকন্যা পুরুষ সেজে থাকে।”
অর্জুন বলল, “চলো তো দেখি। আর একটু উঠলেই পেছনদিকে দেখা যাবে।”
তারা উঠতে লাগল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, “তুমি এত জানলে কী করে অনুপ?”
অনুপ বলল, “দুটো রথ যেতে দেখলাম আমরা। এই পাহাড়কে পশ্চিমে বেড় দিয়ে পিছনে চলে গেল। রথে সব পুরুষবেশী নারী দেখে আমাদের কৌতূহল হল। এক কাঠুরিয়া আসছিল কাঠের বোঝা নিয়ে। জ্বালানি কাঠ কিনব বলে তাকে আমরা ডাকলাম। কাঠ কেনাও হল, খবরও জানা গেল।”
পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে নীচের দিকে তাকিয়ে কৌতুক বোধ করল অর্জুন। রং-বেরঙের তাঁবু, লোকজন, একটি চাঁদমারি বানিয়ে মেয়েরা লক্ষ্যভেদ করছে। অনুপ বলল, “ওই যে দেখছ নীল বসনে সোনার ফুল আর সোনার মুকুট পরা নারী, উনি রাজকুমারী চিত্রাঙ্গদা।”
অর্জুন হঠাৎ বলে উঠল, “চলো অনুপ, ফেরা যাক।” অনুপের যেমন উৎসাহ দেখা যাচ্ছে, যে-নারীকে অর্জুন কামনা করে, তার সম্পর্কে কোনও বাড়াবাড়ি বা সরস ভাব তার সহ্য হবে না। এই অনতিতরুণের প্রতি সে ক্ষুব্ধ হবে। সে গম্ভীরভাবে ফিরে যেতে লাগল। প্রায় কিশোর অনুপ কিন্তু মেয়েদের রূপ নিয়ে কিছুই ভাবছিল না। সে বলল, “দেখো অর্জুন, এদেশের মেয়েরা কী সুন্দর পুরুষের মতো জীবন কাটাচ্ছে। কী সুন্দর তির ছুড়ছে, শিকার করছে। তার মানে মেয়েরা তো সবই পারে বলো। তবু কেন তাদের ঘরবন্দি করে রাখা হয়? কী হত যদি মেয়েরাও সবই করত যা আমরা করি?”
অর্জুন একটু চুপ করে রইল। এ প্রশ্ন তার মনে কখনও আসেনি। মেয়েরা ঘরে থাকবে, সন্তানের জন্ম দেবে, আর পুরুষরা সব কিছু রক্ষা করবে। পুরুষ উৎপাদক শাসক এবং রক্ষক। নারী ধারক সেবক এবং ভোগ্যা। এই নিয়ম সমাজের। অর্জুন তা মানতে শিখেছে। নাগদেশে উলূপীর জ্ঞান ও গুণপনা দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু উলূপীর আচরণ বা মানসিকতায় পৌরুষের প্রভাব সে দেখেনি। উলূপী এমনই সহজ, স্বাধীন এবং পরিপূর্ণ যে, পুরুষের মতো হয়ে জীবনের কিছুই তাকে পেতে হয়নি। চিত্রাঙ্গদা পুরুষের বেশ পরে পুরুষোচিত স্বাধীনতা ভোগ করছে। অর্থাৎ তার জীবন যেন ঠিক তার নয়। সে যেন ছদ্মবেশে আছে। এমন একজনের জীবন সে যাপন করছে, যে এই পৃথিবীতে জন্ম পর্যন্ত নেয়নি। সে হল চিত্ৰবাহনের ছেলে। চিত্রাঙ্গদা কি এতে সুখী? অনুপের কথামতো সব মেয়ে এমন জীবন পেলে কি তারা সুখী হবে? তার হঠাৎ অনুপকে ভাল লেগে গেল। সে বলল, “মেয়েরা কি পুরুষের জীবন চায়?”
অনুপ বলল, “কেউ কেউ চায়। জানো, আমার মা ধুতপাপা ছিল অসাধারণ তিরন্দাজ। মা শিখেছিল মায়ের বাবার কাছে। আমার যখন হাতে ধনুক নেবার সময় হল, বাবা গাঁয়ের আচার্যের কাছে আমাকে ভর্তি করে দিল ঠিকই, কিন্তু আমাকে আসল শিক্ষা দিয়েছিল আমার মা। আমিও দু’দিনেই বুঝে গিয়েছিলাম, আচার্যের চেয়ে মা অনেক বেশি দক্ষ। সব মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে, শুধু জাগে পশুরা, সেই নিশুতি রাতে, মা আমাকে নিয়ে বনে চলে যেত। সঙ্গে নিত আমার বোন কৃষ্ণবেণীকে। ভয় কাকে বলে মা জানত না। মায়ের শিক্ষায় কৃষ্ণবেণীও ক’দিনে দক্ষ হয়ে উঠল। মাকে বললাম, “আচার্যের চেয়েও যখন তুমি তির চালানো ভাল জানো, তখন সবাইকেই তুমি কেন শেখাও না? কেন আমাকে এই শেখানোর কথা গোপন রাখতে বলো?” মা বলেছিল, “কারণ আমি মেয়ে। মেয়েদের এসব করতে নেই।”
“কেন?”
“শাস্ত্রে মানা আছে।”
“কেন?”
“তা আমি জানি না বাবা। তবে এটুকু জানি, মেয়েরা কোনও দিন আচার্য হতে পারবে না।”
“মায়ের স্বরে এত কষ্ট ছিল অর্জুন যে, সেকথা ভাবলে আমার কান্না পায়। কেন একজন নারী আচার্য হতে পারবে না? কারা এসব শাস্ত্র লিখেছে? একবার লিখেই যদি কেউ ফেলল, তা আর শোধরানো যায় না? মা যদি আচার্য হত, কত ভাল ভাল যোদ্ধা তৈরি হত। সমাজের ভালর জন্য শাস্ত্র। সেই শাস্ত্র আবার এমন নিয়ম করে, যাতে সমাজের ক্ষতিই হয়।
কৃষ্ণবেণী বিয়ের পর একদিন তির ধরেছিল বলে তার স্বামী তাকে লাথি মেরেছিল। আমি শুনে লোকটার পা ভেঙে দিয়ে এসেছিলাম। দুটো পা-ই ভাঙতাম, কিন্তু বোন ছেড়ে দিতে বলল। সে আর ধনুকে হাত দেয় না। অথচ জানো অর্জুন, ধুতপাপা এবং কৃষ্ণবেণী দু’জনেই অন্ধকারে শুধু শব্দ শুনে নির্ভুল লক্ষ্যে বাণ ছুড়তে পারে।”
অনেকক্ষণ কথা বলে অনুপ থামল। তারা কুটিরের কাছাকাছি এসে গিয়েছে। অনুপ ফলগুলো সবাইকে দিল। নিজেও নিল বেশ কয়েকটা। অর্জুনের জন্য সাজিয়ে নিয়ে এল এক ঝুড়ি। একটিমাত্র ছোট ফল নিল অর্জুন। এই ফল উলূপীর খুব প্রিয়। অনুপকে নিয়ে কুটিরের কাছেই ঘাসের ওপর বসল অর্জুন। শান্ত সুন্দর সন্ধ্যা নামছে পৃথিবীতে। অর্জুন বলল, “অন্ধকারে শব্দভেদী বাণ তুমি ছুড়তে পারো, অনুপ?”
অনুপ বলল, “পারি। তবে দূর লক্ষ্যে নয়। ধুতপাপাও ওইটুকুই পারত।”
“আর কী কী পারো?”
“একটিমাত্র শর যোজনা করে বহু দূর লক্ষ্য ভেদ করতে পারি আমি অর্জুন। কিন্তু একের বেশি পারি না। মা-ও পারত না।”
“তোমার আচার্য?”
“আমার বাবা শ্রুতসেন এবং আচার্য বহুকর্মা দু’জনেই দুর্যোধনের সেনাদলে ছিল। সেনাছাউনিতে এক মত্ত হাতি তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় পিষে ফেলে। বাবা যে বীরের মতো যুদ্ধ করে মরতে পারল না, সেই ক্ষোভে মা দ্বৈতবনে মুনিঋষিদের সেবা করতে চলে গেল। আমারও আর বেশি কিছু শেখা হল না।”
“খুবই বিচিত্র তোমার কাহিনি অনুপ৷”
“আমার খুব ইচ্ছা, দ্রোণাচার্যের কাছে শিক্ষা নিই। কিন্তু আমি সাধারণ লোকের ছেলে। আর তিনি রাজকুমারদের গুরু।”
“তা তো ঠিকই।”
“তুমি আমাকে শেখাবে অর্জুন?”
“আমার নিজের শেখাই এখনও শেষ হয়নি।”
“তুমি পৃথিবীর সেরা ধনুর্ধর।”
“সেই বিচার অতি সূক্ষ্ম অনুপ।”
“লোকে বলে, কর্ণ ছাড়া তোমার সমকক্ষ কেউ নেই। আমার দোষ নিয়ো না অর্জুন। এত কথা আমি তোমাকে বলতেই পারতাম না যদি তুমি আমার সঙ্গে আজ যেমন ভাইয়ের মতো আন্তরিক ব্যবহার করছ, তেমন না করতে। গঙ্গাদ্বারে তুমি যখন সবাইকে ফিরিয়ে দিলে, আর আমাকে তোমার সঙ্গে থাকবার জন্য বেছে নিলে, আমি ধন্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমি তোমাকে খুবই ভালবাসি অর্জুন। তোমার জন্য প্রাণও দিতে পারি। কেন জানো? প্রায় ছ’বছর ধরে তোমার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছি, দেখেছি সঙ্গীদের প্রতি কত স্নেহ-যত্ন তোমার। সাধু এবং ঋষিদের কত সম্মান করো তুমি। তুমি মহীয়ান।”
“একজনের কথা আজ বলি তোমাকে। সেকথা শুনলে তুমি বুঝবে, শস্ত্রশিক্ষায় উন্নতি করতে হলে প্রধানত দরকার অভ্যাস। দ্বিতীয়ত, তুমি জানবে, আমি মহান নই। সাধারণ মানুষের যত ক্ষুদ্রতা— তার অনেক কিছুই আমার মধ্যে আছে। আমরা তখন বেশ ছোট। আবার এত ছোট নই যে, জ্ঞানবুদ্ধি হয়নি। একবার আচার্যের সঙ্গে আমরা সব বনে গিয়েছি। সঙ্গে আমাদের একটা পোষা কুকুরও আছে। যা দেখছে তাই দেখেই চ্যাঁচাচ্ছে। হঠাৎ তার ডাক বন্ধ হয়ে গেল। সে ছুটতে ছুটতে আমাদের কাছে এল। দেখলাম, অনেক বাণে তার মুখ আটকে গিয়েছে কিন্তু একটিও তার শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করেনি। এ কোন বাণ? কার এ কীর্তি? আমরা খোঁজ করতে লাগলাম। সে ছিল একলব্য। ব্যাধদের রাজা হিরণ্যধনুর ছেলে। এখন হয়তো সেই রাজা হয়েছে। দ্রোণাচার্যের কাছে সে শিক্ষা পেতে চেয়েছিল। ব্যাধের ছেলে বলে আচার্য তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বনের মধ্যে দ্রোণের একটি মূর্তি গড়ে সে নিজে নিজেই তার সামনে অভ্যাস করত। নিজেই অত কিছু আয়ত্ত করেছে। অসামান্য ধনুর্ধর সে। তার কীর্তি দেখে আমি হিংসেয় জ্বলে গেলাম। সাতটি বাণ মেরে যেভাবে একলব্য কুকুরের মুখ আটকে দিয়েছিল, সেই কৌশল আমার জানা ছিল না। আচার্যকে বললাম, “আপনি বলেছিলেন আমাকে সব শেখাবেন। আমিই নাকি পৃথিবীর সেরা ধনুকবাজ হয়ে উঠব। কই, এসব তো কিছুই আমি শিখিনি।” আচার্যদেব আমাকে এত ভালবাসেন যে, আমাকে খুশি করতে একলব্যর কাছে গুরুদক্ষিণা চেয়ে বসলেন। মাটির দ্রোণমূর্তির হয়ে গুরুদক্ষিণা চাইলেন রক্তমাংসের দ্রোণ আর সেও কী, না একলব্যর ডান হাতের বুড়ো আঙুল! যে-আঙুল মানুষের সবচেয়ে বেশি লাগে, সেটাই। সেদিন আমি সুখী বোধ করেছিলাম। কিন্তু আজ সে কথা ভাবলে লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে যায়। শুধু দক্ষতায় নয়, ছলে বলে কৌশলে সেরা হতে চেয়েছিলাম আমি, ছিঃ! আচার্যের ত্রুটি ধরার স্পর্ধা আমি করি না। তবু বলি, ওই দিন তাঁর উচিত ছিল একলব্যকে গ্রহণ করা, গুণীকে স্বীকৃতি দেওয়া। উচিত ছিল আমাকে এই বলে শাসন করা— শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হয়। সেদিন তাঁর মতিভ্রম হয়েছিল নিশ্চয়ই। আমিও অর্বাচীনের বাতুলতা দেখিয়েছিলাম। অনুপ, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হয়।”
দু’জনেই চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। অনুপ প্রায় ফিসফিস করে বলল, “একলব্য আর ধনুক ধরেনি?”
অর্জুন বলল, “এখনও সে অত্যন্ত দক্ষ। ভেবে দেখো, কুটিল ঈর্ষায় কত বড় ক্ষতি করেছি আমি তার।”
“তুমি তো অনুতপ্ত অর্জুন।”
“হ্যাঁ, আমি অনুতপ্ত।”
“আজও কি কাউকে ঈর্ষা করো?”
“না। অন্তত ধনুর্বিদ্যায় আমার পক্ষে ঈর্ষণীয় কেউ আছে বলে আমি মনে করি না। ভীষ্ম আর দ্রোণাচাৰ্য আমার পরমশ্রদ্ধেয়। তাঁদের মতো ধনুর্ধর আর কে আছে? কিন্তু ঈর্ষা হয় সমকক্ষায়। আমি তাঁদের যোগ্য নই।”
“সেই আঙুল যদি কাটা না পড়ত একলব্যর, সে কি দক্ষতায় তোমাকে ছাপিয়ে যেত অর্জুন?”
“এর স্পষ্ট উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শিক্ষানবিশির সময় যে-প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়, বাস্তব প্রয়োগের সময় তার অনেক তারতম্য ঘটে। যে খুব ভাল ছাত্র, যুদ্ধক্ষেত্রে সে হয়তো ভীত সেনা। তবে, যে নিজে দক্ষ, সে অপরের দক্ষতা যাচাই করতে পারে। আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল যদি বেঁধে দেওয়া হয়, আমি একলব্যর সঙ্গে লড়াই করতে রাজি আছি।”
“সেই তুমি বলছ তোমার আরও শেখার বাকি?”
“হ্যাঁ অনুপ। আমি ঠিকই বলেছি।”
অনুপ চুপ করে রইল। মনে মনে বলল, “অর্জুন, তুমি জানো না তুমি কত বড়।”
রান্না হয়ে গিয়েছিল। খাওয়া-দাওয়া সেরে যে-যার মতো বিশ্রাম নিতে গেল। রাত নিশুতি হয়ে আসছে। অর্জুন ভাবতে লাগল চিত্রাঙ্গদার কথা। তারা কি এখনও আছে পাহাড়ের ওপারে? সে ভেবেছিল, সে পাণ্ডব অর্জুন বলেই, রাজা চিত্ৰবাহন রাজকীয় আতিথ্যের আমন্ত্রণ জানিয়ে লোক পাঠাবে। সেটাই যথোচিত ভদ্রতা হত। কিন্তু চিত্ৰবাহন তা করেনি। অর্জুন ভাবল, এক পক্ষে ভালই যে, চিত্রাঙ্গদাকে সঙ্গে করে ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরতে হবে না। বিয়ে এক বিষয়। প্রণয় পর্যন্তই তাকে সীমায়িত রাখলে অনেক অমিল অপছন্দ উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু বিবাহ যখন দু’টি পারিবারিক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে তখন শিক্ষা সংস্কার রুচি ধন মান— সমস্তই বিবেচ্য হয়ে ওঠে। আজ অর্জুন বুঝতে পারছে, কেন হিড়িম্বাকে সঙ্গে নেবার কথা বলেনি যুধিষ্ঠির। হিড়িম্বার সঙ্গে তাদের যে-সাংস্কৃতিক তফাত, পারিবারিক জীবনে তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ছিল। যুধিষ্ঠির অতি বিচক্ষণতায় শুরুতেই তা দুর করেছে।
চিত্ৰবাহনের রীতি-রেওয়াজ অবশ্যই রাক্ষসজাতির মতো নয়। অর্জুন যে-সংস্কারে লালিত, তারই কাছাকাছি। তাই অর্জুনের সুক্ষ্ম অনুভূতি পীড়িত হচ্ছে বেশি। তার বৈবাহিক সম্পর্কের কোনও অসৌজন্য তার পরিবারকে অসম্মানিত করুক, অর্জুন তা চায় না। চিত্রাঙ্গদাকে এখনও কিছুমাত্র চেনে না অর্জুন। তবু তার প্রতি মন আকৃষ্ট হয়ে আছে। আবার চিত্রবাহনের কথায় অর্জুন সম্পর্কে বিস্ময় যতখানি ছিল, সম্মান ততখানি ছিল না বলে অর্জুনের সংশয় কাটছে না। তাই সে ভাবছে, একপক্ষে ভাল, ইন্দ্রপ্রস্থে যাবে না চিত্রাঙ্গদা। তার ভালমন্দের দায় অর্জুন একাই নেবে। ভাইদের ওপর চাপাবে না।
কিন্তু চিত্রবাহনের বাকি শর্তগুলো নিয়ে ভাবা দরকার। লোকটা যথেষ্ট কূট এবং স্বার্থপর। ছেলে না হওয়া পর্যন্ত অর্জুন যেতে পারবে না, এর অর্থ কী? ভাগ্যদোষে যদি চিত্রাঙ্গদা সন্তানসম্ভবা না হয়, অর্জুন নিজের কথার পাকে নিজেই জড়িয়ে চিরকাল মণিপুরেই কাটাবে নাকি? সে তো বন্দি থাকার সামিল। সে শিউরে উঠল। কী করবে ভেবে পেল না। ছেলে হলে রেখে যেতে হবে। ছেলের ওপর কোনও দাবি থাকবে না। তা না হয় হল। কিন্তু তার আগে চিত্রাঙ্গদার গর্ভসঞ্চার হওয়া জরুরি। কী করা যায় ভেবে ভেবে অর্জুনের ঘুম ছুটে গেল। কৃষ্ণ থাকলে সে শরণ নিত। আচ্ছা, এই পরিস্থিতিতে কৃষ্ণ কী করত? ব্রহ্মচর্যীয় ভ্রমণে বেরিয়ে কোথাও একটানা এক বছরের বেশি থাকাই তো ধর্মবিরুদ্ধ। সে ঠিক করল, তিন বছর সময়সীমা দেবে চিত্ৰবাহনকে। এর মধ্যে সন্তান এলে ভাল, না এলে তিন বছর পর অর্জুনের আর দায় থাকবে না। এই তিন বছর একটানা থাকবে না সে। কাছাকাছি তীর্থক্ষেত্রগুলি ঘুরে আসবে মাঝে মাঝে।