০৫.
কিছু কিছু দৃশ্য ছবি হয়ে বুকে গেঁথে যায় চিরদিনের মতো। দাঁতে দাঁত চেপে ভুলতে চাইলেও আচমকা চোখের সামনে এসে অস্তিত্বের মূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়ে যায়। মায়ের মুখের ওপর সেদিন বৃষ্টির ওভাবে পা নাচানোর দৃশ্যটা জয়ার বুকে বিঁধে ছিল বহুদিন। স্টাফরুমে বসে কথা বলতে বলতে, একা স্টুডিওতে ছবি আঁকতে আঁকতে, ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে পড়াতে, কোন প্রস্তুতির অবকাশ ছাড়াই, হঠাৎই ছবিটাকে দেখতে পেত জয়া। একটা উজ্জ্বল ঘর, পোস্টার ওপড়ানোর ক্ষত-চিহ্নে ভরা দেওয়াল, পুরনো আমলের একটা সিঙ্গল-বেড খাট, সেই খাটে শুয়ে বৃষ্টি অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে পা দোলাচ্ছে। ভীষণ সচেতনভাবে উপেক্ষা করছে তাকে। উপেক্ষা? না অপমান? দৃশ্যটা বোধহয় আমৃত্যু জয়ার বুকে রয়ে যাবে।
এ ছাড়াও আরও কিছু দৃশ্য প্রতিটি মানুষের মনে জমা থাকে। মানুষ ভাবে ভুলে গেছে। অথবা সময় সম্পূর্ণ মুছে ফেলেছে দৃশ্যটা। বাস্তবে তা হওয়ার নয়। অবচেতন মনে ছবি রয়েই যায়। সামান্য সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে, অবচেতনের পর্দা সরে গিয়ে, ছবিটা জ্যান্ত হয়ে চোখের সামনে নড়াচড়া করতে থাকে। অ্যাকাডেমির সেন্ট্রাল গ্যালারিতে ছাত্র রঞ্জন হালদারের আঁকা পেন্টিংটা দেখতে গিয়ে সেরকমই একটা আন্দোলন হৃদয়ে অনুভব করল জয়া।
অন্ধকার গুহায় এক চিলতে সূর্যের আলো টেরচাভাবে এসে পড়েছে, আলোটুকু ছাড়া গুহাতে আর কিছুই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। প্রধানত হলুদ আর খয়েরি মিশিয়ে দৃশ্যটা ধরার চেষ্টা করেছে রঞ্জন। তেলরঙের কাজ, রঙে তেমন গভীরতা আসেনি, রেখাগুলোও তত পরিণত নয় কিন্তু ছবিটা দেখেই সুবীরদের ন্যায়রত্ন লেনের বাড়িটা নিখুঁতভাবে জয়ার চোখে ফুটে উঠল।
সুবীরের সঙ্গে জয়া প্রথম দিন গেছে ন্যায়রত্ন লেনের বাড়িতে। গলির পর গলি পেরিয়ে জীর্ণ বাড়িটাতে ঢোকার সময়, আজন্ম বালিগঞ্জে মানুষ হওয়া মেয়েটার প্রথমটা মনে হচ্ছিল বুঝি কোন কোটরে ঢুকছে। প্রাচীন গাছের কোটর। অথবা ওই ছবিটার মতোই কোন ধসে পড়া পাহাড়ের গুহায় ঢুকছে জয়া। সামনেই কালচে সবুজ স্যাঁতসেঁতে উঠোন, উঠোন ঘিরে কোম্পানির আমলের সাবেকি খিলান। উঠোনে পা রাখতেই জয়ার চোখ আটকে গেল সুবীরদের দোতলার বারান্দার স্যান্ড কাস্টিং করা রেলিং-এ। কোন এক অজানা ফাঁক দিয়ে এককুচি সূর্য এসে পড়েছিল রেলিং-এর গায়ে। চতুর্দিকের সাদা-কালো আলোছায়ার মাঝখানে ওই জায়গাটুকু কী তীব্র উজ্জ্বল। গগন ঠাকুরের ছবির আভাস যেন। জয়া মন্ত্রমুগ্ধ। মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, —অসাধারণ! দ্যাখো, দ্যাখো ওই রোদ্দুরটুকু ওখানে কী এক্সকুইজিট্!
সুবীর হেসে উঠেছিল,—ওই রোদ্দুরটা ওখানে তিন মিনিট থাকে। ওটা আমার জ্যাঠামশাই-এর ভাগের আলো।
সুবীর কিছু ভেবে কথাটা বলেনি; আজ জয়ার মনে হয় পৃথিবীতে সবার ভাগেই বোধহয় ওরকম পৃথক পৃথক আলোর টুকরো থাকে। বাদবাকি সবটাই স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। ওই আলোটুকুর জন্যই তো বেঁচে থাকে মানুষ। বৃষ্টিকে একদিন যদি দৃশ্যটা দেখানো যেত! কী সুন্দর একটা পালঙ্কও ছিল ও বাড়িতে। মেহগনি কাঠের। বিডে অ্যাকেনথাস্ পাতার কারুকাজ। পার্ক স্ট্রিটের পুরনো কবরখানার গথিক প্যাটার্নের সমাধিগুলোর মাথায় যেরকম হেলেনিস্টিক কাজ আছে, ঠিক সেরকম।
ছাত্রছাত্রীদের প্রদর্শনী দেখতে এলেই জয়া সব সময় চাপা রোমাঞ্চ অনুভব করে। পাশ করার পর ঠিক এভাবেই সে, নিখিল, শিপ্রা আর শ্যামাদাস মিলে প্রথম এগজিবিশন করেছিল। নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে কার্ড ছাপিয়েছে, প্রেসের লোকদের ঘুরে ঘুরে নিমন্ত্রণ করে এসেছে। সমালোচকরা আসতে পারে, সিনিয়ার আর্টিস্টদের কেউ যদি এসে পড়েন, মাস্টারমশাইরাও আসবেন হয়ত, চিন্তায় চিন্তায় জয়ার পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। বুকের মধ্যে অবিশ্রান্ত ড্রাম বেজে চলেছে।
—অ্যাই, বলো না কি হবে? সবাই যদি গালাগাল করে? যদি বলে কিছু হয়নি?
সুবীর তার সমস্ত ভয় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল,—আমার বউ-এর ছবির নিন্দে করবে! বুকের পাটা আছে কারুর?
সত্যিই খুব সাহস দিয়েছিল সুবীর। সুবীরের ওপর নির্ভর করতে ভালও লাগত তখন। সেই লোকই উদ্বোধনের দিন কি ডোবান ডুবিয়েছিল। কি অবুঝ সব ধারণা নিয়ে যে চলত সুবীর! শিল্পীর স্বামীকেও শিল্পের সমঝদার হতে হবে!! তা না হলে সানগ্লাস পরে হলের ভেতর এগজিবিশন দেখতে দেখতে দুম করে ওরকম একটা মন্তব্য করে বসে! জয়ারই ছবি দেখিয়ে!
—কি দারুণ কাজ দেখেছেন? ভ্যান গখের টাচ্ আছে না?
তিনজন মাত্র শিল্পীর নাম জানত সুবীর। ভ্যান গখ, মাতিস্ আর রেমব্রান্ট্।
সবাইকে সব জানতেই হবে তার কোন মানে নেই। জয়া কতটুকু জানে সেলস্ প্রোমোশন সম্পর্কে? এ কথাটাই কোনদিন সুবীরকে বোঝাতে পারেনি জয়া। সুবীর তাকে এক দিনের জন্যও মানুষ বলে গণ্য করল না। তার শুধু শো-কেসে রাখার জন্য একটা বউ-এর দরকার ছিল। দরকার মতো চাবি খুলে তাক থেকে নামিয়ে আদর-ফাদর করে আবার তাকে তুলে রেখে দেবে। আর সে ঘরে না থাকলে পুতুল তাক থেকে নেমে তার ঘরদোর সামলাবে। এবার হয়ত বিয়ে করে আগের আফশোস মিটেছে।
—দিদি, আমার ছবিগুলো একটু দেখবেন না?
জয়া চমকে তাকাল। সেই থেকে রঞ্জনের ছবিটার সামনেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হাসার চেষ্টা করল একটু,
—নিশ্চয়ই।
শুধু রত্নাবলী নয়, সৌমেনও রয়েছে তার সহপাঠিনীর পাশে,—দিদি, আপনাকে আমি এগজিবিশনের আগে অনেক খুঁজেছিলাম।
—কেন?
—আপনি যদি পেন্টিংগুলো আগে একটু দেখে দিতেন…
—বেশ তো হয়েছে।
—তবু দিদি আপনি দেখে দিলে…
—দূর। আমি পড়াই বলে কি ছবির এক্সপার্ট নাকি? কতটুকু জানি ছবি সম্পর্কে? আসল ব্যাপারটা হল ফিলিংস্। অনুভূতি। তুমি কিভাবে তোমার চারদিককে দেখছ, সেই দেখার রঙ কিরকম, রূপ কিরকম, সবটাই তোমার নিজের ব্যাপার। দিনে, রাতে, প্রতি মুহূর্তে আলোর সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি জিনিসের, মানুষের, জীবজন্তুর চেহারা বদলে যায়। তখন তুমি তাকে কিভাবে দেখছ, তোমার দেখার আনন্দ, তোমার দেখার যন্ত্রণা সব মিলিয়েই তো ছবির নিজস্ব চরিত্র তৈরি হবে।
জয়া তার ছাত্রছাত্রী মহলে বেশ প্রিয়। এদের মধ্যেই সব থেকে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে সে। বৃষ্টিটাও কি সুন্দর ছবি আঁকতে পারত। চমৎকার রঙ চেনার ক্ষমতা আছে। অথচ একদিনের জন্যও সেভাবে তুলি ধরল না।
ছেলেমেয়েগুলো এখনও জয়াকে ঘিরে আছে। ফিরোজ একদিন ঠাট্টা করে বলেছিল,—তুই কখনও একা হস্ না কেন বল্ তো? যখনই দেখি চ্যালাচামুণ্ডা ঘিরে রয়েছে। তোকে একটু ফাঁকা পাওয়ার চান্সই পেলাম না কখনও।
—পেলে কি করতিস?
—টুক করে মনের কথাটা বলে ফেলতাম।
—ইয়ার্কি হচ্ছে?
—নারে, ইয়ার্কি নয়। তোকে দেখে সত্যিই হিংসে হয়। কলেজে ছেলেমেয়েদের নিয়ে রয়েছিস, বাড়িতে দিব্যি নিজের রাজত্ব, ভাবনাচিন্তা নেই, মনের সুখে ছবি আঁকছিস, বৃষ্টির মতো একটা লাভলি মেয়ে পেয়েছিস…
ফিরোজের গলায় বিষন্নতার সুর চাপা ছিল না। সে এমনিতে দিলখোলা, আমুদে, বোহেমিয়ান টাইপের। প্যারিসে দু বছর থাকার ময় তার পরিচয় হয়েছিল এডার সঙ্গে। জার্মান মেয়ে। ব্রুনেট্। মডেলিং করত। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা, সেখান থেকে লিভ টুগেদার। ফিরে আসার পরও বহুদিন দুজনের যোগাযোগ ছিল। বিয়েও করবে ঠিকঠাক। এডা এ দেশে এলও একবার কিন্তু দেশটা তার একদম পছন্দ হল না। এত লোডশেডিং। এত বিশ্রী উষ্ণতা! ফিরোজকে বলেছিল তার সঙ্গেই প্যারিসে গিয়ে থাকতে। সে মডেলিং করবে, ফিরোজ ছবি আঁকবে, দিব্যি চলে যাবে দুজনের। ফিরোজ রাজি হয়নি। এডা ফিরে গেল। ফিরোজ হয়ে উঠল দশগুণ বেশি বোহেমিয়ান সারাক্ষণ হাসছে, নাচছে, গাইছে, মদ খেয়ে ধুম হয়ে পড়ছে। কিন্তু ছবির ভেতর আসল ফিরোজ ঠিক ধরা পড়ে যায়। তার সব আঁকাতেই রহস্যময় বিষাদ। কোন উজ্জ্বল রঙ সে ব্যবহার করে না।
জয়া ফিরোজকে বলেছিল,—তুই কাজটা ঠিক করিসনি। তোর তো প্যারিস সুট করে গিয়েছিল; ওর এ দেশটা ভাল নাও লাগতে পারে। ওখানে চলে গেলে তোরও ফ্যামিলি হত, বৃষ্টির থেকেও হয়ত লাভলি মেয়ে থাকত।
ফিরোজের মুখচোখ ম্লান হয়ে গিয়েছিল, —কিন্তু আঁকতে পারতাম নারে।
—কেন? ওদেশে কি ক্যানভাস পাওয়া যায় না
—ক্যানভাস আছে। কিন্তু আমার তো রুট নেই সেখানে। শিকড় ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে? বাদ দে, তুই আমার কথা অত সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? একা আছি, তোফা আছি। একা থাকার যে কি আনন্দ তোর মতো সংসারীরা বুঝবে কি করে?
জয়া ফিরোজের কথা শুনে কষ্ট পেয়েছিল। একা কে নয়? ফিরোজই কি একা? এই যে অ্যাকাডেমির সেন্ট্রাল গ্যালারিতে একঘর লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, এখনও তো একাই সে।
রঞ্জন জয়ার কাছে দৌড়ে এল,
—দিদি, দারুণ খবর আছে। এইমাত্র আমার একটা ছবি বিক্রি হয়ে গেল!
—তাই! কত’তে?
—বারোশো। টুয়েলভ হানড্রেড।
ছেলেটার চোখ আনন্দে জ্বলজ্বল। ছাত্রের খুশিতে শিশুর মতো উচ্ছল জয়াও।
-ওমা তাই নাকি? এক্ষুনি কিছু খাওয়াও।
—কি খাবেন বলুন…
—যা খাওয়াবে। চপ, কাটলেট, কফি, কোল্ডড্রিঙ্কস, নিদেনপক্ষে এক কাপ চা।
ছেলেটা লজ্জা পেয়েছে, —আপনি এখনও চা পাননি?
বলেই দৌড়েছে চা আনতে। খুব ভিড় না হলেও বেশ কিছু লোকজন এসেছে ছবি দেখতে। ওপাশের গ্যালারিতে ফোটোগ্রাফির এগজিবিশন চলছে। জয়া কোণে পাতা চেয়ারে বসে পড়ল। এই যে জীবনের প্রথম এগজিবিশনে একটা ছবি বিক্রি হওয়া, এর যে কি আনন্দ…ছবির গায়ে ছোট্ট লাল টিপ পড়া…!
জয়ার প্রথম ছবি বিক্রি হয়েছিল পাঁচশো টাকায়। এক অস্ট্রেলিয়ান সাহেব কিনেছিল! আজও জয়া পরিষ্কার ছবিটাকে দেখতে পায়। শীতের কুয়াশায় একটা একলা মোরগ ডেকে ডেকে পৃথিবীর ঘুম ভাঙাচ্ছে। ছবিটার নাম দিয়েছিল, —ডন। সেও ঠিক এভাবেই সেদিন ছুটে গিয়েছিল তার মাস্টারমশাই-এর কাছে। ছটফট করেছিল সুবীরকে খবরটা দেওয়ার জন্য।
সুবীর নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিল। এই যে মেয়েটা তার সঙ্গে রয়েছে, নরম-সরম ছোট্টখাট্টো শ্যামলা মেয়ে, যে কি না তার সামান্য আদরেও মোমের মতো গলে পড়ে, সারারাত্রি তাকে না আঁকড়ে ঘুমোতে পারে না, যার ছবি আঁকাটাকে একটা শৌখিন খেয়াল বলে সে হেসে হেসে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে, মনে করেছে আহা, একটা কিছু নিয়ে তো থাকবে, তার প্রথম ছবির দাম পাঁচশো টাকা! টাকা এত সহজেও রোজগার হয়! নির্ঘাত মন খচখচ করে উঠেছিল সুবীরের। তবে নিজেকে চাপা দিয়ে দিয়েছিল,
—কি খাবে? কোথায় খাবে?
বলেই জয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েছিল বিছানায়।
রঞ্জন সত্যি সত্যি চা এনে ফেলেছে। কোনরকমে কাগজের কাপটা ধরিয়ে দিল জয়ার হাতে,
—দিদি, রমেনবাবু এসেছেন। আমি একটু যাই?
কেন উনি তো ভেতরেই আসবেন? বলতে গিয়েও সংযত হয়েছে জয়া।
প্রথম এগজিবিশনে ক্রিটিক সত্যি এসে পড়লে কিরকম উত্তেজিত বোধ করে ছেলেমেয়েরা সেটা সব শিল্পীই জানে।
জয়া জিজ্ঞাসা করল, —কই রমেনদা?
—ওই তো বাইরে গাড়িবারান্দায় স্বপন আইচ আর নিখিল দত্তরায়ের সঙ্গে কথা বলছেন।
নিখিল আবার এল কোথেকে! ও তো এই সব এগজিবিশনে বড় একটা আসে না!
রঞ্জন দরজা পর্যন্ত পৌছনোর আগেই রমেন নিখিল গ্যালারিতে ঢুকেছে। নিখিল জয়াকে হাত নেড়ে মধ্যিখানে সাজানো ভাস্কর্যগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।
রমেন জয়ার কাছে এসেছে, —কি ম্যাডাম? কতক্ষণ?
—এই খানিক আগে। খবর কি আপনার?
—আমার আর কি খবর। নিউজপেপার অফিসের লোকেদের কোন খবরটবর থাকে না। তারা খবর খোঁজে। তারপর? তোমার সোলো কবে?
—এপ্রিলের দিকে করার ইচ্ছে আছে। আগে তো কলকাতা তিনশ’ সামলাই।
—কি কাজ করছ?
—দেখি। ঠিক করিনি এখনও।
-তুমি তো আজকাল খুব সুররিয়ালিজম-এর দিকে ঝুঁকছ। লাস্ট মান্থে দরবার গ্যালারিতে তোমার ‘অ্যাগনি’ ছবিটা দেখছিলাম। পুরনো ফর্ম থেকে অনেক সরে যাচ্ছ মনে হচ্ছে? ওটা তো প্রায়… অ্যাবস্ট্র্যাক্টের….
—ওই একরকম চেষ্টা আর কি। জয়া কথা ঘোরাতে চাইল। নিজের ছবি সম্পর্কে আলোচনা করতে সে বেশ অস্বস্তিবোধ করে,
—আমার ছেলেমেয়েদের কাজ দেখুন। দারুণ কাজ করেছে। রঞ্জন আর রত্নাবলীর কয়েকটা কাজ তো বেশ ম্যাচিওরড্।
—দেখব। দেখব। রমেন জোরে হেসে উঠল, —ওদের একটা ভাল রিভিউ চাই। তাই তো?
জয়ার মুখে চাপা অর্থপূর্ণ হাসি।
—কবে আসছেন বাড়িতে? আপনার তো পাত্তাই পাওয়া যায় না আজকাল।
—ওভাবে যেতে বললে হবে? জোরদার নেমন্তন্নটন্ন করো। বেশ জম্পেশ পাটি। বাই দা বাই, তোমার মেয়েকে সেদিন দেখলাম। ইউনিভার্সিটির সামনে চুটিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। বেশ বড় হয়ে গেছে তো! ও কি এখন কলেজে?
—হ্যাঁ, ফার্স্ট ইয়ার। জয়া মৃদু হাসল। হাসলে এখনও তার ডান গালে গভীর টোল পড়ে, —আমরা এখন বুড়ির দলে। বয়স কম হল?
কত হল? ষাট ও সত্তর…এই নিখিল, জয়া কি বলছে শোন, ও নাকি বুড়ি! এখনও ইচ্ছে করলে…
জয়া আড়চোখে ছাত্রছাত্রীদের দেখে নিল। রমেন সাহা এরকমই। মুখের কোন রাখঢাক নেই।
—আহ্ রমেনদা, কি হচ্ছে কি? আপনার নেমন্তন্ন কনফার্মড। শুধু একটা রিঙ করে আসবেন।
নিখিল একমনে একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি দেখছে। পেন্টিং-এর থেকেও মূর্তি গড়ার দিকে নিখিলের ঝোঁক বেশি। বিয়ে করার পর ছবি, স্কালচার, এগজিবিশন প্রায় মাথায় উঠেছে তার। একটা প্রায়-সরকারি অফিসে শাড়ির ডিজাইনিং-এর কাজ করতে হয় তাকে। বছরে এখন বড়জোর আট দশটা ছবি আঁকে কি আঁকে না। মূর্তি গড়ে আরও কম।
জয়া ডাকল, —তুই কি অফিস থেকে আসছিস? যাবি আমার সঙ্গে? নিখিল মূর্তি থেকে চোখ সরাল না, —কোথায়?
—সেমিনারে।
—কোথায় সেটা?
—আশুতোষ হলে। চল্, চারজন ইটালিয়ান পেস্টার এসেছে। অনেকে আসবে। প্রকাশদাদের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে।
—দুৎ। ও সব সেমিনার টেমিনার আমার পোষায় না। লেকচার দেওয়া তোর পেশা, তুই যা। সিনিয়ার টিনিয়ারদের সঙ্গে দেখা করারও আমার কোন ইচ্ছে নেই।
—তুই এখন করবিটা কি?
—ছবি দেখব। ছেলেমেয়েগুলো আশা করে কার্ড দিয়ে এল, ভাল করে দেখব না? নিখিল ঘুরে দাঁড়াল, কাজ নেই, কম্মো নেই, শুধু সেমিনার! তোকেও যেতে হবে না। চল, আমার সঙ্গে ফিরবি।
জয়া দ্বিধায় পড়ল। সেমিনারটায় গেলে ভালই হত। এ সব সেমিনারে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যায়। আর যোগাযোগ না রাখলে আজকের দুনিয়ায় কে কাকে পোঁছে? তাছাড়া মডার্ন ইউরোপিয়ান ট্রেন্ডগুলো সম্পর্কেও…।
—যাবি, কি যাবি না ভাবছিস তো? যেতে হবে না। চল, তোদের বাড়িতে যাই, অনেকদিন বাবলুর সঙ্গে আড্ডা দেওয়া হয়নি। মন খুঁতখুঁত করলেও নিখিলের সঙ্গে বেরিয়ে এল জয়া। বাড়িই ফিরবে।
অ্যাকাডেমির উল্টোদিকের মাঠে মেলা শুরু হয়েছে। মেলার রঙিন আলোয় সদ্যনামা অন্ধকার বর্ণময়। রবীন্দ্রসদনের সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। ট্যাক্সি ধরবে।
রবীন্দ্রসদনের মেইন গেটে তিনটে লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। তাদেরই একজন ঘুরে ঘুরে দেখছে জয়াকে। জয়ার প্রথমটা একটু অস্বস্তি হল। লোকটা জয়ার দিকেই এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। পরনে ধুতি-শার্ট, চোখে চশমা, লম্বাটে মুখ, তোবড়ানো ভাঙা গাল। ভীষণ চেনা চেনা যেন!
—কি খবর তোমার? কেমন আছ?
গলাটা শুনেই জয়া চিনতে পেরেছে। প্রবীর। সুবীরের দাদা। সুবীরের থেকে কতই বা বড়? বেশি হলে বছর চারেকের। এর মধ্যেই কী চেহারা ভেঙেছে! পঞ্চাশে পৌঁছনোর আগেই সন্তুরে বুড়ো যেন। নিখিলের থেকে একটু তফাতে সরে গেল জয়া।
—আপনি কেমন আছেন?
—এই কেটে যাচ্ছে।
বাবা মা? বলতে গিয়েও জয়া থমকে গেল। সুবীরের বাবা মাকে কি এখন আর বাবা মা সম্বোধন করা যায়?
প্রবীর বলল, তোমার নামটাম তো খুব দেখি আজকাল কাগজে। সব সময় আমার চোখে না পড়লেও, সুবুর বউদি তো ঠিক খুঁজে খুঁজে বার করে।
সুবীর নামটাতেই আড়ষ্টতা এসে গেল জয়ার। প্রবীর লক্ষ করল না। কথা বলেই চলেছে, —আমাদের মেয়েটা কেমন আছে? অনেক বড় হয়ে গেছে, তাই না?
—এই নভেম্বরে তো আঠেরো হয়ে গেল।
মাঝে মাঝে মেয়েটাকে বড় দেখতে ইচ্ছে করে।
জয়ার খারাপ লাগল। ঠাকুর্দা ঠাকুমা, জেঠু জেঠি সম্পর্কে আকর্ষণ দূরে থাক, ধারণা তৈরি করারও সুযোগ পেল না বৃষ্টি। এ ব্যাপারে জয়ারই বা কি করার ছিল? পরিস্থিতির কাছে মানুষ বড় অসহায়।
একটুক্ষণ চুপ থেকে প্রবীর আবার কথা শুরু করেছে, —সুবুর কাছ থেকে অবশ্য মাঝে মাঝেই বৃষ্টির খবর পাই। সুবু আজকাল প্রত্যেক মাসেই দু-একবার করে যায় বাড়িতে।
—বাড়ির সবাই ভাল আছে তো? জয়া কথার মোড় ঘোরাতে চাইল, —টুকাই বুকাই কোন্ ক্লাসে পড়ছে?
—টুকাই এবার মাধ্যমিক দেবে। বুকাই এইটে। মাঝে এক বছর ফেল করল তো। আমারই মতো মাথা হয়েছে দুটোর। প্রবীর একটু রসিকতা করার চেষ্টা করল। —তোমরা তো এখনও ওই বাড়িতেই? দেশপ্রিয় পার্ক? তোমার ভাই-এর খবর কি?
—সেই একই রকম। হুইল চেয়ার।
এত বছর পর প্রবীরের সঙ্গে কথা বলতে জয়ার ভাল লাগছিল। শরীর বুড়িয়ে গেলেও, মানুষটা এখনও সেই সাদামাটা, ভালমানুষ। সুবীরের সঙ্গে তুমুল গণ্ডগোলের সময় একমাত্র এই লোকটাই জয়াকে বলেছিল,
—আমি জানি সুবুর সঙ্গে তোমার বনা খুব কঠিন। সুবুটা এত স্বার্থপর… বাবা-মা যাই বলুক, তোমার ডিসিশন তুমিই নেবে। সুবুর সঙ্গে থাকো তুমিই। তোমার বাবা মা-ও থাকে না, আমার বাবা মা-ও না। …
একবার বাড়িতে যেতে বলবে নাকি প্রবীরকে? বৃষ্টির সঙ্গেও দেখা হয়ে যাবে? থাক। ছিঁড়ে যাওয়া সুতোতে নতুন করে গিঁট বাঁধার চেষ্টা করে লাভ নেই। জয়া অন্য কথায় গেল,
—অনেকদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে খুব ভাল লাগছে, আপনি কি এখানে থিয়েটার দেখতে…?
—না না। ওই বন্ধুরা রয়েছে, ওদের অফিস ক্লাবের ফাংশন। গানটান হবে। চলি। ওরা দাঁড়িয়ে আছে। তুমি কি বাড়ির দিকে?
—হ্যাঁ।
প্রবীর চলে যাওয়ার পর নিখিল এগিয়ে এল,
—কে রে? কথা শুনে মনে হচ্ছিল সুবীরের কেউ হয়?
—আগে দেখিসনি? সুবীরের দাদা। চেহারাটা এত বদলে গেছে, আমিই চিনতে পারিনি।
—কি বলছিল কি?
—কি আর বলবে? ফরমাল কথাবার্তা। মেয়ে কেমন আছে, সুবীর এখন মাঝে মাঝে নাকি তার বাড়িতে যায়, এই সব আর কি।
—যাক্। নবাবের মতি ফিরেছে তা হলে? নিজের বাড়ির কথা উঠলে যা মুখ বেঁকাত! বাবা মা দাদা কেউ যেন মানুষই নয়!
—এরকমই বোধহয় হয় রে। জয়ার গলায় আচমকা দার্শনিক সুর, —আকাশ ছোঁওয়ার নেশায় পেলে মানুষ মাটিকেই ভুলতে চায়। আর একটু বয়স হয়ে গেলে সেই মাটিই আবার টানতে শুরু করে। হেঁচকা টান।
একটা ফাঁকা ট্যাক্সি দেখে নিখিল দৌড়ল। ট্যাক্সিতে উঠে কিছু দূর যেতে যেতেই বার বার তাকাচ্ছে ঘড়ির দিকে। জয়া ভুরু তুলল,
—তুইও আজকাল ঘড়ি দেখছিস! তাও সন্ধে ছটায়।
—সাধে কি দেখছি। তোর মতন তো আর আমার মুক্তজীবন নয়। তোর বাড়ি যাব বলে তোকে তো সেমিনার থেকে ভাগিয়ে আনলাম, এদিকে বউ টাইম লিমিট করে দিয়েছে। আটটার মধ্যে বাড়ি না ঢুকলে ক্যানভাসে ছুরি চালিয়ে দেবে।
—বেশ করবে। তুমিও আরতিকে কম নেগলেক্ট করো না। সী হ্যাজ দা রাইট টু ডিমান্ড ইওর কম্পানি।
—হ্যাঁ, ওই সব বলে বলেই তো তোরা ওর মাথাটা বিগড়ে দিয়েছিস।
এলগিন রোডের মোড়ে ট্রাফিক সিগনালে থেমেছে ট্যাক্সি। শীতের সন্ধ্যা বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে। জয়া ভাল করে গায়ে চাদর জড়িয়ে নিল।
—ডিসেম্বর পড়তেই এই। শীত এবার জাঁকিয়ে পড়বে মনে হচ্ছে।
—হ্যাঁ। ফুলস্লিভগুলো বার করে ফেলতে হবে।
পরশু ফিরোজ এসেছিল। আর্টিস্ট কলোনির ব্যাপারে সেন্ট্রাল থেকে কি একটা গ্রান্ট ফান্টের চেষ্টা করছে। ওর কোন্ রিলেটিভ আছে দিল্লিতে, খুব ইনফ্লুএনশিয়াল বিজনেসম্যান, তার থ্রু দিয়েই…
—ওর যত সব বড় বড় ব্যাপার। বাপের পয়সা আছে। নিজেও প্রচুর ঘাঁতঘোঁত জানে…
—খালি ওর লাইফটাই কেমন হয়ে গেল। বাউণ্ডুলে…
—বাউণ্ডুলে না আরও কিছু। জাতে মাতাল তালে ঠিক। যথেষ্ট হিসেবী। দ্যাখ না, চার ছ’ মাসের মধ্যে ঠিক চারদিক ম্যানেজ করে ফেলবে। ওর যা এখন নামডাক…
—আমাকেও বলছিল ওর সঙ্গে জয়েন করার জন্য।
—খবরদার। একদম ওর মধ্যে যাস না। এখন ওর রিসেন্ট সঙ্গিনী কে হয়েছে জানিস তো?
—না তো! কে?
—কিছুই তো খবর রাখিস না। তোদের দেবযানী।
—যাহ্। জয়ার মুখে অবিশ্বাসের হাসি।
—বিশ্বাস হচ্ছে না? একটা কথা মনে রাখিস, তোদের ওই দেবযানী পারে এমন কোনও কাজ নেই।
জয়ার মুখে তবু অবিশ্বাস। নিখিল দেবযানীকে একদমই সহ্য করতে পারে না। কলেজে পড়ার সময় মধুশ্রী বলে একটা মেয়ের ওপর একটু দুর্বলতা ছিল নিখিলের। একেবারে প্লেটোনিক স্তরের। তাই নিয়ে জয়ারাও খুব খেপাত নিখিলকে। একদিন জয়ার বাড়ির আড্ডাতে উঠেছিল কথাটা। দেবযানী সেখান থেকেই শুনে কথায় কথায় গল্প করে এসেছিল আরতিকে। ব্যস্, আর যায় কোথায়! নিখিলের সঙ্গে সে সময় কি যে সাংঘাতিক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল আরতির! দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙে ভাঙে। তারপর থেকেই আরতি অত্যন্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জয়াও আরতির লিস্টের বাইরে ছিল না। জয়া অবশ্য গায়ে মাখেনি। এরকম তো হতেই পারে। মানুষ কখন কাকে ভালবাসবে, কখন কাকে সন্দেহ করবে, তার তো কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। মনটাকে অত বশে রাখাও যায় না। যদি যেতই তবে কেন এখনও সুবীরের বিভিন্ন অনুষঙ্গ মনে পড়ে যায় তার! এগারো বছর পরেও!
বাড়িতে ঢুকে জয়া সুধাকে বলল,
—তাড়াতাড়ি একটু কফি করে ফ্যাল তো। আর নিখিলদাদাকে কিছু খাবার করে দে।
সুধা চলে যাচ্ছিল, কি মনে হতে আবার ডেকেছে,
—বৃষ্টি ফিরেছে?
সুধা ইতস্তত করল, —না। মানে আজ ফিরতে দেরি হবে।
নিখিল বাবলুর ঘরে গিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। বাবলু নিখিলকে খুব পছন্দ করে। আর একজনও তার পছন্দের ছিল। সুবীর। তবে পছন্দ করে বলে যে মতে মেলে তা নয়। নিখিল বাবলু এক জায়গায় হলেই কিছুক্ষণ পর তর্ক শুরু হয়ে যায়। দুজনেই পাগলের মতো চেঁচাতে থাকে। বিশেষত রাজনীতির প্রসঙ্গ এলে। জয়া পারতপক্ষে তাদের আলোচনায় যোগ দেয় না। ইরাক কুয়েত দখল করে ভাল কাজ করেছে কিনা, রাষ্ট্রসংঘে ঠিক ঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কিনা ইত্যাদি প্রসঙ্গে জয়ার উৎসাহ নিখিল বাবলুর থেকে অনেক কম।
কফি খেয়ে জয়া যখন বাথরুম থেকে হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল, তখনও তুমুল তর্ক চলছে দুজনের। ঘরে গিয়ে মুখে ক্রিম-ট্রিম মাখল, তখনও চলেছে তর্ক। টিভিতে বাংলা খবর শেষ হয়ে এল, তখনও।
জয়া বাবলুর ঘরে এল। সঙ্গে সঙ্গে নিখিল বাবলু দুজনে মিলে সাক্ষী মানতে শুরু করেছে জয়াকে। যেন জয়ার মতামতের ওপর নির্ভর করছে আমেরিকা ইরাকে সৈন্য পাঠাবে, কি পাঠাবে না অথবা চন্দ্রশেখর সরকারের গদির অবস্থা কি হবে।
—তোকে না আরতি তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছে?
নিখিলকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠতে হল। তর্কের মাঝখান থেকে উঠে যেতে হলে কেমন পরাজিত পরাজিত লাগে নিজেকে। প্যাসেজে এসে জুতো পরছে,
—বৃষ্টি ফেরেনি এখনও?
—তাই তো দেখছি। খুউব বন্ধুবান্ধব বেড়েছে আজকাল। আবার বলছিল নেতারহাট বেড়াতে যাবে বন্ধুদের সঙ্গে। সারাক্ষণ ডানা মেলে উড়ছে।
—সে তো হবেই। নতুন কলেজে ঢুকেছে, একটু তো পাখা গজাবেই। শুধু কি পাখনা? কল্জেও বেড়েছে। নইলে ওভাবে মেয়ে মুখের ওপর পা দোলায়!
আজ প্রবীরের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা আকস্মিক হলেও পুরোপুরি আকস্মিক মনে হচ্ছিল না জয়ার। এমন তো বহু সময়ই ঘটেছে, যে লোকের সম্পর্কে ভাবছে সে অথবা তার ঘনিষ্ঠ কেউ তার পরেই হাজির হয়েছে বাড়িতে। এই তো পরশু বিকেলে কয়েকটা ছবির ফ্রেমের ব্যাপারে শ্যামাদাসের কাছে যাবে ভাবছিল, তার খানিক পরেই পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দেখা হয়ে গেল শ্যামাদাসের বউয়ের সঙ্গে। প্রায় দু’তিন বছর পর। কোন ঘটনাটা যে ঠিক আকস্মিক, সেটার বোধহয় সঠিক সংজ্ঞা হয়ও না। তবে প্রবীরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অত ই্মোশনাল হয়ে পড়াটাও কোন কাজের কথা হয়নি। এই বয়সে জোলো আবেগ…! আবেগের দিন কবেই পিছনে ফেলে এসেছে জয়া। প্রবীরের কোন্ কথাতে সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল? সুবীরের প্রসঙ্গে? না বৃষ্টির?
বৃষ্টির কথা মনে পড়তেই জয়া সুধাকে ডাকল,
—আজ কেন দেরি হবে বৃষ্টি কিছু বলে গেছে?
বাবলু হুইল চেয়ারে নিজস্ব বাথরুমে যাচ্ছিল। বাবলুর সুবিধামত প্রিয়তোষ কমোড, বেসিনের ব্যবস্থা করে নতুন বাথরুম তৈরি করে দিয়েছিলেন। জয়ার ঘরের সামনে হুইল চেয়ার থামাল বাবলু,
—শুধু আজ কেন? রোজই তো বৃষ্টি দেরি করে ফেরে। তুই নিজে সন্ধেবেলা বাড়ি থাকিস না, তাই জানিস না।
অন্য সময় হলে পাত্তা দিত না; এখন কথাটা জয়ার গায়ে লেগে গেল,— সন্ধেয় থাকি না মানে? আমি কি আড্ডা মেরে বেড়াই?
—আড্ডা মারো, কি কি করো সেটা তুমি জানো। যা ফ্যাক্ট আমি তাই বলছি। বেশ কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি সন্ধেবেলা ফিরছে না এটাও ফ্যাক্ট, তুই থাকিস না, খবর রাখিস না, সেটাও।
—তোরা তো থাকিস্। তোরা জিজ্ঞেস করতে পারিস না?
বাবলু উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। হুইল চেয়ার ঠেলে এগিয়ে গেল। সুধা তখনও জয়ার সামনে দাঁড়িয়ে। জয়া এবার তার দিকে ফিরল,
—হাঁ করে দেখছিস্ কি? সারা দিন তেতে পুড়ে, মুখের রক্ত তুলে খেটে এসে আমাকেই যদি সব খবর রাখতে হয়… তোরা বাড়িতে আছিস কি জন্য? বলতে বলতে চোখ পড়েছে টেবিলের ফুলদানির দিকে, —ওটা পরশুর ফুল না? ওটা বদলানোরও সময় পাওনি? গাছগুলোকে রোদ খাওয়ানো হচ্ছে? নাকি সেটারও সময় পাও না?
সুধা জানে এটা তার দিদির রাগের সময়। দিদির সমস্ত বাহারী গাছেদের মাপা রোদ চাই, মাপা ছায়া। না হলেই সুখী গাছ সব শুকিয়ে মরে যাবে। এ সময় দিদিকে কোন কথা বোঝানোও যাবে না। সুধা ঘাড় নিচু করে চুপচাপ হজম করল বকুনিগুলো।
জয়া সশব্দে মেয়ের ঘরের দরজা খুলল। সঙ্গে সঙ্গে উৎকট কড়া গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মেরেছে। বৃষ্টি কি আজকাল সিগারেট খাচ্ছে নাকি! পোড়া তামাকের গন্ধ! না বদ্ধ ঘরের ভ্যাপসা গন্ধ! ঘরে যথারীতি বিশ্রী ভাবে জামাকাপড়, জিনিসপত্র ছড়ানো। পোস্টারহীন ঘরটাকে কী কুৎসিত লাগছে। কোন জিনিসে মেয়েটার এতটুকু যত্নআত্তি নেই। হয়ত যা প্রয়োজন তার থেকে বেশি পেয়ে এসেছে বলেই। ছোটবেলা থেকেই ওর চাওয়াগুলোকে আরও সংযত করা উচিত ছিল।
না দিয়েই বা কি উপায় ছিল? সব সময় মনে রাখতে হত মেয়েটার বাবা যেন কোন ভাবেই জিততে না পারে। বাবা মাও যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন তারা চুটিয়ে আদর দিয়ে গেছে নাতনিকে। জয়া মেয়ের জন্য সময় দিতে পারত কতটুকু? কিন্তু নিজের আঁকা ছাড়া আর যা খাটাখাটুনি করেছে সবই তো এই সংসারের জন্যই। বৃষ্টির জন্যই। না হলে এ বাড়িতে আসার পর কি দরকার ছিল তার আঁকার স্কুলে পার্ট টাইম মাস্টারি নেওয়ার? কিংবা বড়লোকের ছেলেমেয়েদের শৌখিন আঁকা শেখার টিউশনি ধরার? উদয়াস্ত দোকান বাড়ি সাজানোর পরিশ্রম? আর্ট কলেজের চাকরিটা পেয়ে সে তো বেঁচে গেছে। তার ছবি যাতে মোটামুটি বিক্রি হয়, একটা নিশ্চিত রোজগার থাকে, আর্ট ডিলাররা যাতে মাথায় হাত বুলোতে না পারে, তার জন্য পরিশ্রম ছোটাছুটি তো করতেই হয়। যার জন্য এত পরিশ্রম, এত চিন্তাভাবনা, সেই মেয়েও কেমন দূরের হয়ে গেছে আজকাল।
জয়ার বুক নিংড়ে দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে এল। সে নিজেও তো মেয়েকে আর সেভাবে কাছে ডাকতে পারে না। কেমন যেন বাধ বাধ ঠেকে। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস নিকটতম সম্পর্কেও মরচে ধরিয়ে দেয়। আবার সেদিনের দৃশ্যটা জয়ার মনে পড়ে গেল। মেয়ে তাকে দেখেও কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে পা নাচাচ্ছে।
জয়া মেয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাবলুও তো একটু নজর রাখতে পারে। সারাদিন নিজের ঘরে শামুকের মত গুটিয়ে আছে। নিজের খোলে। কেবল কোন কারণে আঁতে ঘা লাগলেই…।
থাক, যে যেভাবে খুশি থাকতে চায়। কে কবে জয়ার কথা ভেবেছে? সুবীর চেয়েছিল তার সময়, তার শরীর, তার অখণ্ড মনোযোগ। তার চাহিদা মত সব জুগিয়ে যেতে পারলে সম্পর্কটাই ভাঙত না হয়ত। পরগাছার মত কেটে যেত জীবনটা। একা ওই মানুষটাকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ। বাবা মা ভাই বৃষ্টি সবাইকে নিয়েই তো তার জীবন। তারা কতটুকু দিয়েছে জয়াকে? চলে আসার পরও তো বাবা মা মুখের গুমোট আস্তরণ দিয়ে সব সময় বলতে চাইত, জয়া ফিরে যা। জয়া ফিরে যা। অন্তত বৃষ্টির মুখ চেয়ে। আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে অনুভব করারও চেষ্টা করেনি মেয়ে তার নিজের হাতে গড়া সংসার ফেলে এসেছে কত যন্ত্রণায়।
একটা জলপ্রপাত তুষারের তূপ হয়ে জমে গেছে বুকে। সবাই পর। সবাই পর।
জয়া দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।
সুধা ডাকল পিছন থেকে, —দিদি, খেয়ে যাবে না?
—স্টুডিওতে দিয়ে যাস্।
—বৃষ্টি এলে তোমাকে ডাকব?
জয়া পলকের জন্য দাঁড়াল। তারপর আবার উঠতে শুরু করেছে,
—না। থাক্।
.
০৬.
—আমরা একবার নেতারহাট গিয়েছিলাম তোর মনে আছে বৃষ্টি?
পরশু রাত্রে খেতে বসে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই বলে উঠেছিল জয়া। ডাইনিং টেবিলে মোমবাতির আলোয় বৃষ্টি মার মুখটা দেখতে পায়নি ভাল করে। আজকাল শীতকালেও এত লোডশেডিং হয়!
বৃষ্টির মন পলকের জন্য ভিজে গিয়েছিল। পরক্ষণেই ভুল ভেঙেছে। জয়া নিজের কথার পিঠেই কথা চাপিয়ে দিয়েছে, —শুধু আড্ডা আর বন্ধুবান্ধব নিয়ে জীবন কাটবে না বৃষ্টি। কোন্ কলেজে পড়া মেয়ে এত রাত অবধি রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে? এবার এসব কমাও
সেই শাসন। শুধুই শাসন। আবহমানকাল থেকে শুধু তো শাসনটুকুই আছে।
শাসন তো করে সব বাবা মা’ই। স্থানকালপাত্র ভেদে সেই শাসনের অর্থ পাল্টে যায়।
রাঁচি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে মার কথাগুলো মনে পড়তেই একটা অসহ্য খারাপ লাগায় মেজাজ তেতো হয়ে গেল বৃষ্টির। ওদিকে সুদেষ্ণা একটানা গজগজ করে চলেছে, —এইসব ধ্যাধেড়ে বাসে যেতে হবে! এখনই তো ছাদে লোক উঠতে আরম্ভ করেছে! টানা ছ’ ঘণ্টা মুর্গিঠাসা অবস্থায়…।
অঞ্জন বলল,— তোর জন্য এখানে আলাদা গাড়ি থাকবে ভেবেছিলি নাকি? স্কুলে থাকতে কখনও বন্ধুদের সঙ্গে এক্সকারশানে যাসনি? নাকি সেখানেও তোদের বাড়ির গাড়ি যেত?
—তোরা ওভাবে নিচ্ছিস কেন? সুদেষ্ণার গলায় মিনতি,— এই বৃষ্টি, টুরের তো একটা অ্যালট্মেন্ট আছে, যদি কিছু এক্সট্রা লাগে আমি দিয়ে দিচ্ছি, স্যারের কাছে গিয়ে বল না একটা জিপ টিপ ভাড়া করতে। এখানকার লোকগুলোর গায়ে কী বোঁটকা গন্ধ! কেমন সব চোয়াড়ে চাষাড়ে টাইপ…
—এদের সঙ্গে যেতে তোর ঘেন্না করছে নারে? বিক্রম বলে উঠল, —কিন্তু আনফরচুনেটলি এরাই দেশের এইট্টি পারসেন্ট। যেতে হয় সবার সঙ্গে চল্, নয়ত দ্যাখ ফেরার টিকিট ফিকিট পাস্ কিনা।
বৃষ্টি জানে না এরকম পরিস্থিতিতে কি করতে হয়। তবে লোকাল লোকেদের সঙ্গে যেতে তার মোটেই আপত্তি নেই। কলকাতার বাসট্রামের যাত্রীর থেকে কি আর খারাপ হবে এখানকার লোকজন! বিক্রমের খোঁচাটা তবু ভাল লাগল না তার,
—তোর ওই ফাঁকা বুলিগুলো একটু বন্ধ কর্ তো। সুদেষ্ণার অসুবিধে হচ্ছে বলে একটা প্রোপোজাল দিয়েছে। এই নিয়ে তুই আর অঞ্জন ফালতু বুকনি শুরু করলি কেন?
—বুকনির কি আছে? যা বিশ্বাস করি, তাই বলছি।
—কি বিশ্বাস করিস?
—তোরা বুঝবি না। দিন রাত তো নিজেদের নিয়েই পড়ে আছিস। কামিজের কাটিং কিরকম হবে, কোথায় রাজস্থানী দুল পাওয়া যায়, কোথায় গুজরাটি নাকছাবি, চাইনিজ ডিশ পার্ক স্ট্রিটে ভাল, না ট্যাংরায়, এর বাইরে চিন্তা করিস্ কোন সময়? এর বাইরেও একটা দেশ আছে, সেখানে কোটি কোটি মানুষ হাড়ভাঙা খেটেও এক বেলার বেশি পেটের ভাত জোগাড় করতে পারে না…
সব সময় বিক্রম আর অঞ্জনের মুখে বিপ্লবের ফুলঝুরি ছুটছে! বৃষ্টির রাগ হয়ে গেল। বিক্রমকে জিজ্ঞাসা করল,
—তোর শার্টটার কত দাম রে?
—কেন?
—এমনিই। বল্ না। জিনস্টাও মনে হচ্ছে ফরেন্?
—এটা আমার কাকা পাঠিয়েছে কানাডা থেকে।
—তোর কাকা কি কানাডাতেই সেট্লড্?
—হ্যাঁ। সো হোয়াট?
—তুই ‘স্যাটে’ বসেছিলি না? স্যাট্ দিয়ে ইন্ডিয়ার কোন্ কোন্ গ্রামে পড়তে যায় রে ছেলেমেয়েরা?
বিক্রম এতক্ষণে বৃষ্টির ব্যঙ্গ ধরতে পেরেছে। তৃষিতাও মজা পেয়ে এগিয়ে এল,— তুই বিক্রমদের ঠাট্টা করছিস্ বৃষ্টি? দেখিসনি কিছুদিন আগে অঞ্জন কিরকম দাড়ি রেখেছিল? এই অঞ্জন, ওটা কার প্যাটার্ন ছিল রে? লেনিন? না হো চি মিন?
অঞ্জন অল্প থতমত খেয়ে গেল।
বিক্রম বলল, —ওই দ্যাখ, শুভ কি বলছে।
শুভ চেঁচিয়ে সকলকে ডাকছে, —অ্যাই, তোরা এদিকে আয়। এই বাসটা আগে ছাড়বে। আমি সিটে খবরের কাগজ রেখে এসেছি।
দেবাদিত্য বৃষ্টিদের পাশে এসে দাঁড়াল, —শুভটা হেভি বোর হচ্ছে বুঝলি। তখন থেকে মাল কেনার ধান্দা করে যাচ্ছে; স্যার ওকে কিছুতেই ছাড়বেন না। খালি বলছেন, শুভ তুমি বেশ স্মার্ট আছ, তুমি সঙ্গে থাকলে আমি কনফিডেন্স পাই।
মীনাক্ষী হেসে উঠল, —ঠিক হয়েছে। উচিত জব্দ।
দেবাদিত্য, মীনাক্ষী আর তৃষিতা আগে আগে হাঁটছে। হাতে হাতে নিজস্ব লাগেজ। অরিজিৎ বৃষ্টিকে বলল,
—ভাল ধরেছিলি দুটোকে। সব সময় ধান্দা চালাচ্ছে কি করে আমেরিকায় কেটে পড়বে। কিছু বললেই উল্টো জ্ঞান দিয়ে দেয়। বলে যাব তো নলেজ গ্যাদার করতে, নলেজের আবার স্বদেশ বিদেশ কি? বাপ্ মার পকেট বেশি গরম থাকলে বক্তৃতা দিয়ে ভিজে ঘাসেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়।
অরিজিতের মত রামপড়ুয়ার মুখে এ হেন কথাবার্তা বৃষ্টি আশা করতে পারেনি। বৃষ্টি একবার ঘড়ি দেখল। আটটা কুড়ি। এখনও ভোরের শীত লেগে রয়েছে রাঁচির বাতাসে। সূর্য যথেষ্ট চড়া কিন্তু রোদ্দুরের তাত এখনও পুরোপুরি ফুটে বেরোচ্ছে না। অরিজিতের কথায় ফিরোজ আঙ্কলের সেদিনের চেঁচামিচি মনে পড়ল বৃষ্টির। মা’র দু’একজন কলেজের বন্ধু পাকাপাকি ভাবে প্যারিসে থেকে গেছে; তাদের ওপর কি রাগ ফিরোজ আঙ্কলের,
—বিদেশে গিয়ে থাকতে চাস্ থাক, প্যারিসে নাইটক্লাব আছে, সাতচল্লিশ রকমের পাঁউরুটি পাওয়া যায়, দুশো রকমের মদ, তোর ইচ্ছে না হলে তুই ফিরিস না। তা বলে যদি কোন পুঙ্গির পুত বলে শিল্পের আত্মা খুঁজতে আমি ভিখিরির দেশ ছেড়ে প্যারিসে গিয়ে পড়ে আছি তবে সে ব্যাটা মিথ্যুকেরও বেহদ্দ। ডোন্ট মাইন্ড ইয়াং লেডি, এই লোকগুলো কেন্নোরও অধম।
রেগে গেলে দু’একটা দেশের গালাগাল বেরিয়ে যায় ফিরোজ আঙ্কেলের মুখ থেকে। বৃষ্টি আরেকটু তাতানোর চেষ্টা করেছিল,
—তাই তুমি এখানে আর্টিস্ট কলোনি করতে চাইছ?
—কারেক্ট। আমার কলোনিতে সব আর্টিস্ট স্বাধীনভাবে কাজ করবে।… একটা কমিউনিটি লাইফ, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেককে ফিল করছে, চিন্তা কমিউনিকেট করছে, ভাষা কমিউনিকেট করছে। এ নিউ ফর্ম অফ আর্ট মুভমেন্ট। ক্রিয়েটিভ আর্টের জগতে ইনডিভিজুয়ালের যেমন একটা মূল্য আছে, গোষ্ঠীবদ্ধতারও একটা মূল্য আছে।
—সেই জন্যই তো প্যারিসে….
—হোয়াই প্যারিস? হোয়াই নট ইন মাই সিটি? আমার কলোনিতে থাকবে ছোট ছোট অজস্র কটেজ, সেখানে হলুদ রোদ, সঙ্গে সবুজের চালচিত্র। আমি দেখাতে চাই আমার শহরও কি পারে। যদি আমরা চাই।
ফিরোজ আঙ্কল কী ভীষণ ভালবাসে কলকাতাকে। বোধহয় বৃষ্টির থেকেও অনেক বেশি।
বাসে উঠে পিছনের সিটে চোখ চলে গেল বৃষ্টির। রণজয় আর পরভিন তন্ময় হয়ে গল্প করছে।
অনেকক্ষণ থেমে আছে বাসটা। বৃষ্টি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। আনমনা চোখ একটা দোকানের দিকে পড়তেই কারেন্ট খেলে গেছে শরীরে। দোকানটাকে সে চেনে! সাধারণ গঞ্জ মতন জায়গায় ওষুধের দোকান। ময়লা সাইনবোর্ড। বাস থেকে মনে হচ্ছে ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টির চোখ চঞ্চল। ওই তো দরজির দোকানের সাইন বোর্ডে লেখা, কুরু। বাস থেকে নেমে ওই দোকানেই তো ঢুকেছিল বাবা!
… কাগজে মোড়া বড় একটা বোতল ভরে ফেলল কাঁধের ব্যাগে। তারপর পাশের দোকান থেকে শালপাতার ঠোঙায় একরাশ জিলিপি। কমলারঙ, গরম, মুচমুচে, কিটকিটে মিষ্টি। বাসে ফিরতেই মা হিশহিশিয়ে উঠল,
—ফের তুমি কিনলে ওসব? একটা দিন না গিলে থাকতে পারো না?
বাবার মুখে অপ্রস্তুত হাসি,—রাঁচি থেকে নিতে ভুলে গেলাম। খাচ্ছি তো এইটুকুন, মেডিকেল ডোজ।
মা একবার ছোট্ট বৃষ্টিকে দেখে নিয়েই জানলার বাইরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বার করে পরে নিল। শাড়ির আঁচলে মুখ নাক চাপা। ভয়ানক ধুলো উড়ছে। সব ঝাপসা।…
সুদেষ্ণা ড্রাইভারের পিছনের লেডিজ সিটে বসে এই ডিসেম্বরেও দরদর ঘামছে। দেবাদিত্যরা শেষের টানা লম্বা সিটে কোরাসে গান ধরেছে। বিক্রম গেয়ে উঠল,
—চিটে গুড়ে পিঁপড়ে পড়লে…
বাকিরা দোহারকি দিল, —নড়তে চড়তে পারেএএ না…
সাঁওতাল মেয়েরা ওদের ভঙ্গি দেখে এ ওর গায়ে হেসে গড়াগড়ি। টি এম মুখ ঘুরিয়ে রয়েছেন। এ সময় মাস্টারমশাইরা প্রকৃতি দেখতে ভালবাসেন।
বাসে বেশির ভাগই স্থানীয় উপজাতির মানুষ। দুজন সাঁওতাল যুবক মীনাক্ষীর পাশের জানালা বেয়ে তর তর করে ছাদে উঠে গেল। মীনাক্ষী ভয়ে হাত সরিয়ে নিল। বাসে ওঠার পর থেকেই সিঁটিয়ে ছিল মেয়েটা।
বাস দাঁড়িয়েই রয়েছে। মনে হয় এখানে আজ হাটবার।
পিছন থেকে শুভর চিৎকার শুনতে পেল বৃষ্টি, —এই মেয়েরা, তোরা গাইছিস্ না কেন? তৃষিতা, তুই তো সব সময় গলা মেলাস্, তুই গা।
তৃষিতা ঘাড় ঘুরিয়ে ভেংচি কাটল। ভিড়ের ফাঁক দিয়ে কেউ দেখতে পেল বলে মনে হল না। তৃষিতার কোলের পাশে এক আদিবাসী শিশু জড়োসড়ো দাঁড়িয়ে। কন্ডাক্টর তাকে টেনে সরিয়ে দিল,
—ইধার আ যা। মেমসাব কো তন্ মত্ কর্।
মীনাক্ষী তৃষিতার ঊরুতে চিমটি কাটল,
—এই, কন্ডাক্টর তোকে মেমসাহেব বলছে।
লোকটাকে দেখে বৃষ্টির হাসি পেয়ে গেল। কি বিদ্ঘুটে চুলের ছাঁট, জুলপি চাঁছা, ব্যাকব্রাশ করা চুল ঘাড় অবধি লতানো, রাস্তার হিন্দি সিনেমার পোস্টারে যেরকম দেখা যায়। হিরোস্পেশাল। মাথায় তেলও মেখেছে অঢেল। তেলের উগ্র গন্ধ বাতাসে ম-ম করছে। এমন একটা লোকের মুখে মেমসাহেব সম্বোধন শুনেও তৃষিতা বেশ বিগলিত। তৃষিতার গায়ের রঙ যথেষ্ট চাপা, কালোই বলা যায় তাকে। মেমসাহেব বলে ডাকলে ভিখিরিকেও বেশি পয়সা দিয়ে ফেলে সে। লজ্জা লজ্জা মুখে বলল,
—ফাজলামো হচ্ছে? তোরা যাই বল লোকটার ফিজিক কিন্তু দারুণ।
বৃষ্টি মীনাক্ষি চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। বাসটাও ছাড়ল ঠিক সেই মুহূর্তে। ধীরে ধীরে ঘামের ওপর উষ্ণ বাতাসের ছোঁয়া। শীতের শুরুতেও এসব অঞ্চলে দুপুরে এত গরম থাকে কি করে কে জানে!
দূরে ছোট ছোট টিলা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বৃষ্টি বলল, —মীনাক্ষি, তুই বিহারের এদিকটায় আগে কখনও এসেছিস?
—এদিকে আসিনি, তবে মধুপুরের দিকে গেছি। ওখানে আমাদের একটা বাগানবাড়ি আছে। প্রায় শীতেই বাড়িসুদ্ধ দলবেঁধে হল্লা করতে যাওয়া হয় ওখানে। তুই এসেছিস?
—এসেছিলাম একবার। ছোটবেলায়। তেমন খুব একটা মনে নেই।
—এদিকটা ভীষণ ড্রাই। মধুপুরের দিকে আমগাছ-টাছ আছে প্রচুর।
—ড্রাই সয়েলেরও একটা রাফ বিউটি আছে। কি সুন্দর তালে তালে টিলাগুলো আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে দ্যাখ।
বেলা তিনটে নাগাদ বাস থামল এক গ্রামে। এর পর থেকে শুরু হবে পাহাড়, জঙ্গল। বাস মিনিট দশেক দাঁড়াবে বলে সবাই নেমে পড়ে হাত-পায়ের খিল ছাড়াচ্ছে। শুভ লম্বা অ্যাথলেটিক চেহারা কোমর থেকে ভাঙছে আর সোজা করছে। কাল অনেক রাত অবধি ট্রেনে যে উন্মত্ত হুড়োহুড়ি করেছে তার কোন চিহ্নই নেই কারুর শরীরে। ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েই সব আবার তরতাজা।
—ইয়ে বনারি হ্যায় তো?
অঞ্জন চিৎকার করে গল্প জুড়েছে এক থুরথুরে বুড়ির সঙ্গে। জনসংযোগ! বুড়ি কি বুঝল কে জানে, ফিক করে হাসি উপহার দিল একটুকরো।
—ইধর কোয়েল নদী কাঁহা হ্যায়? কোয়েল? কোয়েল?
বৃষ্টি অঞ্জনকে ডাকল, —এই ফিরে আয়। ওই টোনে হিন্দি বলে আর লোক হাসাস না।
অঞ্জন থামল না।
—তুমহারা গ্রামকা কাছমে হোনা চাহিয়ে। ম্যাপমে দেখা হ্যায়। ম্যাপ জানতা হ্যায়? ম্যাপ? অ্যাটলাস্?
দেবাদিত্য বলল, —তোর ওই ল্যাঙ্গুয়েজ ট্রাইবাল বেল্টে চলবে না। এখানে দরকার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। দেখব নাকি একবার ট্রাই করে?
এদের মাঝে পড়ে বুড়ি বিড়বিড় করে কি যে বলে চলেছে বোঝা যায় না।
টি এম একা হাঁটতে হাঁটতে উল্টোদিকে চলে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে ডাকছেন ছেলেমেয়েদের,
—এখান থেকে পাহাড়ে ওঠার পর একটা রাস্তা সেপারেট হয়ে চলে গেছে বেতলা ফরেস্ট, ডাল্টনগঞ্জ। ওই পথে একটা ফিফটিনথ সেনচুরির বিধ্বস্ত কেল্লা আছে। তাছাড়া রাজা মেদিনী রায়ের ভাঙাচোরা মাটির ফোর্টও পড়ে পথে। আর কিছুটা গেলে…
—ক্লাস নিচ্ছে রে, কেটে পড়।
ক্রমে সকলেই টি এম এর কাছ থেকে দূরে সরতে সরতে বাসের কাছে। বিক্রম বাসে হেলান দিয়ে দামী ক্যামেরাটা নিয়ে খুটখাট করছিল। রণজয় বাসের জানালা দিয়ে প্রশ্ন করল,
—ক্যামেরায় কিছু প্রবলেম হচ্ছে নাকি?
—টাইমারটা মনে হয় গণ্ডগোল করছে।
—ছাড় তো, টাইমার দিয়ে কি হবে? ছবি উঠলেই হল।
বিক্রম সামান্য অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎই রণজয়ের দিকে তাকিয়ে কান এঁটো করে হাসল, —আরে, খেয়ালই করিনি তুই কথা বলছিস। তোরাও যাচ্ছিস নাকি আমাদের সঙ্গে!
রণজয় পরভিন বাস থেকে নামেনি। বিক্রমের ঠাট্টা গায়ে মাখল না তারা।
বাস স্টার্ট নিচ্ছে। কন্ডাক্টর ডাকল, —চলিয়ে, চলিয়ে, পোঁহুছনেমে অ্যায়সে হি শাম হো যায়েগি।
শুভ বাসের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। ধ্যাত্তেরি বলে ছুঁড়ে ফেলে দিল সিগারেট।
কন্ডাক্টর ভুল বলেনি। বাস থেকে নেমে গভর্নমেন্ট লজের ডরমেটরিতে ঢুকতে ঢুকতে সূর্যের প্রায় চিহ্নমাত্র নেই। পাহাড়ে ওঠার পর থেকেই গরমের ছিটেফোঁটা মুছে গিয়েছিল। এখন বেশ কনকনে পাথুরে ঠাণ্ডা। অন্ধকার ভাল করে নামার আগেই চতুর্দিক হিমশীতল।
ছেলেরা মেয়েরা পৃথক পৃথক দুটো ঘরে। টি এম-এর একার জন্য একটা ডবল বেড়। মেয়েরা এসেই প্রথমে বাথরুম দখল করতে শুরু করে দিয়েছে। সারাদিনের রোদখাওয়া ধুলোমাখা মুখ এক্ষুনি মসৃণ চকচকে করে ফেলতে হবে।
বৃষ্টি শাল জড়িয়ে বাইরের আঙিনায় এসে দাঁড়াল। পশ্চিম আকাশে এখনও সামান্য লালচে আভা। বৃষ্টির সামনের পাহাড়গুলো যদিও এর মধ্যেই অন্ধকার মেখে নিয়েছে গায়ে। যেন গুটিসুটি মেরে বসে থাকা কালো বুড়ো। ট্রেনের জানলা থেকে দেখা ব্রাহ্ম মুহূর্তের আকাশটা সারাদিনে কতবার যে রঙ বদলাল! রাঁচিতে ঢোকার আগে, ভোরের আলো যখন পাহাড়ে পড়েছিল, তখন
পাহাড় যেন নীল সবুজে মেশা এক ধ্যানস্থ সন্ন্যাসী, আবার সেই পাহাড়রাই দুপুরে বাস থেকে একদল বর্ণহীন প্রবল পুরুষ, এখন সন্ধ্যায় তারাই অসহায় কালো বৃদ্ধ।
নিখিলমামা বলত, —বুঝলি বৃষ্টি, ইন্অ্যানিমেট্ অবজেক্টের কোন নিজস্ব ক্যারেক্টার থাকে না। সেটা কোথায় রয়েছে, কেন রয়েছে তার ওপর কিভাবে লাইট অ্যান্ড শেড কাজ করছে, সেটাই ঠিক করবে বস্তুর ক্যারেকটর। যেমন ধর তোদের ওই দুধঅলার সাইকেলটা। ভোরবেলা যখন দুপাশে দুধের ক্যান ঝুলছে, তখন মনে হয় না সাইকেলটা যেন বাঁক কাঁধে জল দেওয়ার ভারী? আবার ওই সাইকেলের হ্যান্ডেলের মাঝখানটায় লাল টুপি বসিয়ে দে, ওটা তখন হয়ে যাবে বুলফাইটের ষাঁড়। ম্যাটাডোরের দিকে রেগে ছুটছে।
বৃষ্টির ছোটতে কী নেশাই না ছিল আঁকার! বলতে গেলে নিখিলমামার কাছেই তার নাড়া বাঁধা।
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় বৃষ্টিদের স্কুলে এক বিরাট সিট্ অ্যান্ড ড্র কমপিটিশন হয়েছিল। আট-দশটা স্কুল মিলিয়ে হাজারখানেক ক্ষুদে শিল্পী। বৃষ্টি ফার্স্ট। প্রাইজ ডে’র দিন মা আসবে বলে কথা দিয়েও আসেনি। সেদিনই কার একটা এগজিবিশনের প্রিমিয়ারে আটকে গিয়েছিল। হয়ত কোন নামকরা আর্টিস্টের। হয়ত কোন বন্ধুর। অনেক রাত্রে প্রাইজ দেখে মা বৃষ্টিকে আদর করার চেষ্টা করেছিল,
—তোর রাগ হয়েছে বৃষ্টি? কি করব বল, এমনভাবে সবাই আটকে দিল…
বৃষ্টি একটা কথাও বলেনি। একফোঁটা জলও আসেনি তার চোখে। দাদু দিদা মা ভালমামা কেউই বুঝতে পারেনি আর কোনদিন ছবি আঁকবে না বৃষ্টি।
বৃষ্টির মনে হল এই মুহূর্তেই তার একটা সিগারেট দরকার। একটা সিগারেট। একটা সিগারেট।
ছেলেরা কোত্থেকে তিন-চারটে লাঠি জোগাড় করে ফেলেছে। এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে আর অন্ধকারে ঝোপেঝাড়ে অকারণ লাঠি চালাচ্ছে। কীটপতঙ্গ সাপখোপ কি যে ওরা মারে।
টি এম্ ম্যানেজারের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা করলেন, —লাস্ট মান্থে এখানে একটা বাঘ বেরিয়েছিল। যে জঙ্গলটা রয়েছে সেখান থেকেই। ইউজুয়ালি এদিকে বাঘ থাকার কথা নয়, তবে কোন কোন সময় অন্য রেঞ্জ থেকে চলে আসে এক-আধটা। লোকাল গ্রামের কুঁড়েঘর থেকে একটা ছাগল তুলে নিয়ে গেছে। তোমরা যখন তখন যেখানে সেখানে বেরোবে না। যদিও প্রতিটি বাঘের একটা নির্দিষ্ট জোন্ থাকে…
দেবাদিত্য থামিয়ে দিল টি এম-কে, —গাঁয়ে মানুষ ছিল না স্যার? নাকি বাঘেরাও আমাদের মতো মাটন্ খেতে ভালবাসে?
বিরলকেশ, সৌম্যদর্শন অধ্যাপক হেসে ঘরে চলে গেলেন। এসব ট্যুরে ছেলেমেয়েদের টীকাটিপ্পনি উপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সুদেষ্ণা বারান্দা থেকে বৃষ্টিকে ডাকল,
—এই বৃষ্টি, বাথরুম খালি। মুখ হাত ধুবি তো চলে আয়।
বৃষ্টির জায়গাটা ছেড়ে একটুও নড়তে ইচ্ছে করছে না। চাঁদ ওঠার পর অন্ধকার অনেক মিহি। দূরে, বহু নীচে, কয়েকটা আলোর ফুটকি। কোন গ্রামট্রাম! না শীতে স্থানীয় অধিবাসীরা কাঠকুটো জ্বেলেছে!
…ছ’ ফুট লম্বা, ফর্সা, মেদহীন শরীরে পুঁতে রঙ সোয়েটার পরে গটগট করে বাবা নেমে যাচ্ছে পাইন গাছের মাঝখান দিয়ে। নামতে নামতে নামতে নামতে একটা দীঘির পাড়ে গিয়ে হারিয়ে গেল।
—মা, বাবা কোথায় চলে গেল?
—জাহান্নামে। চল, আমরা ফিরি।
—বাবা আসবে না?
—আসবে। সময় হলেই। নেশা ছুটলে।
ক্ষুদে বৃষ্টি একটা ইটের টুকরো তুলে ইউক্যালিপটাসের গুঁড়িতে কাঁচা হাতে বানান করে করে লিখে দিল, —বাবা, জলদি এসো।…
বাবা এখনও ফরিদাবাদে। কবে যে ফিরবে!
—কিরে, একটা সিগারেট চলবে নাকি? ধর, অনেকক্ষণ তো শুকননা আছিস।
চাঁদের আবছা আলোয় শুভর মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল না বৃষ্টি।
—লজ্জা করে না বলতে? নিজেরা ফাঁক পেলেই টুকটাক চালিয়ে যাচ্ছিস? গোটা দে একটা। আমার প্যাকেট রুমে।
সিগারেট ধরিয়ে সারাদিন পর মৌজ করে টান দিল বৃষ্টি। চোখ বুজে অনেকক্ষণ ধরে ধোঁয়াটাকে গিলল।
—আহ্। মাথাটা একদম ধরে গেছিল। চা-ফা দেবে না?
—চা খেয়ে কি হবে? বিক্রম আর রণজয় ট্রাইবালদের ঠেকের দিকে গেছে। এখানে এসে যদি মহুয়া দিয়েই না শুরু করা যায়….
—তুই সত্যি কলকাতা থেকে কিছু আনিসনি? সেদিন যে খুব হিড়িক তুললি?
—ধুস্, কেউ কন্ট্রিবিউট করল না। নিজের পয়সায় আনি আর সবাই মিলে ফাঁক করে দিক।
—টি এম্ ঝামেলা করবে না তো?
পরভিন কখন গুটিগুটি এসে বৃষ্টির পাশে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির কথায় হি হি হেসে উঠল, —স্যারের কাছেই একটা ছোট বোতল আছে। ব্যাগ খোলার সময় রণজয় দেখে ফেলেছে। অ্যাই শুভ, আমি কিন্তু আজ একটু মহুয়া টেস্ট করব।
—যা যাহ্। কতটুকুনি জোগাড় হয় তার ঠিক নেই। মেয়েরা বাদ। শেষে খেয়ে একটা কিছু কেলো করো…
বৃষ্টি ছুঁসে উঠল, —এম সি পির মতো কথা বলিস না তো। মাল খাওয়ায় আবার ছেলেরা মেয়েরা কিরে?
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর শাল কম্বল পুলোভার জড়িয়ে সকলে বসেছে বারান্দায়। টি এম এতক্ষণ ম্যানেজারের সঙ্গে গল্প করছিলেন, একটু আগে শুতে গেলেন। গোটা ট্যুরিস্ট লজ নিস্তব্ধ। বোর্ডাররা যে যার বন্ধ ঘরে। বাঙালি নবদম্পতি অনেকক্ষণ বাইরে বসেছিল, তারাও একটু আগে দরজা বন্ধ করেছে।
শুভ গুম হয়ে বসে আছে। বিক্রমরা একফোঁটা মহুয়াও জোগাড় করতে পারেনি। অঞ্জন মাউথ অরগ্যান বাজিয়ে সুর ধরল,
—হ্যায় আপনা দিল, তো আওয়ারা…
না জানে কিস্পে আয়েগা…
সারাদিন পর মন উদাসকরা সুরে চোখ জড়িয়ে আসছে সকলের। দেবাদিত্যর মতো ছেলেও নিশ্চল তাকিয়ে দূরের আঁধারের দিকে। আকাশে পাতলা মেঘের স্তর থাকায় চাঁদের দীপ্তি ছড়াচ্ছে না পুরোপুরি।
…ঘুম ভেঙে গেছে অন্ধকারে। কম্বল পায়ের কাছে জড়ো। বিছানায় উঠে বসতেই দুটো চাপা কণ্ঠস্বর।
—ভেবে থাকলে অন্যায় কি? মেয়ে পড়ে থাকবে আর মা ড্যাং-ড্যাং করে লন্ডন প্যারিসে বেড়াতে যাবে!
—তুমি অফিস ট্যুরে যাও না? তখন মেয়েকে কে দেখে? আসলে তোমাকে আমার হাজব্যান্ড বলে পরিচয় দেওয়া হয়, সেটাই তোমার আঁতে লাগে। হিংসুটে কোথাকার। টাকার ধান্দা ছাড়া তো জীবনে কিছু শেখোনি।
কাচের গ্লাসে টুং-টাং শব্দ। মা খাটে ফিরেছে। বন্ধ চোখেও বৃষ্টি বুঝতে পারছে মা দেখে নিচ্ছে মেয়ে ঘুমিয়েছে কি না। আবার ফিরে গেছে।
—আমি বলছি তুমি যাবে না। যাবে না ব্যস।
—একশো বার যাব! এ সুযোগ বার বার আসে না। একবার তোমার জন্য ফ্রেঞ্চ-স্কলারশিপ মিস্ করেছি…
—আমার জন্য? না বাচ্চা হবে বলে?
—তুমিই তো ফাঁসিয়েছিলে। ইচ্ছে করে। যাতে আমি না যেতে পারি তাই। …
এত বছর পর দৃশ্যগুলো কেন উঠে আসছে বৃষ্টির চোখে? আসছেই যদি তবে কেন শুধুই ভয়ঙ্কর সেগুলো? বুক ভেঙে আচমকা একটা কান্না উঠে আসতে চাইছে। চোখের দু কূল ছাপিয়ে গেল। অঞ্জনের সুর ভেঙে দিল শেষ প্রতিরোধ। নিঃসীম ফিকে জ্যোৎস্না মিলিয়ে গেল চোখের জলের পর্দার ওপারে। বৃষ্টি হাঁটুতে মুখ গুঁজল।
ফ্রিসবিগুলো বাতাসে ভাসছে। ভাসতে ভাসতে, দুলতে দুলতে এক হাত থেকে অন্য হাতে যাচ্ছে, সেখান থেকে আরেক। শুভ হলুদ ছুঁড়ে লুফে নিল নীল। মীনাক্ষি নীল ধরে গোলাপি ছুঁড়েছে। বিক্রম সবুজ ছুঁড়ে লাল। প্লাস্টিকের চাকতি নয়, যেন একঝাঁক রঙিন পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে মায়াবী রোদ্দরে বিকেলের আকাশে। শীতল বাতাস কেটে কেটে। পাইন গাছের ওপারে, মাঠের প্রান্তে মিলিটারি ছাউনি থেকে দু-চারজন জওয়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে রঙিন পাখিদের ওড়াউড়ি।
দেবাদ্যি একটা সবুজ ফ্রিসবি ছুঁড়ে দিল বৃষ্টির দিকে,
—এই বৃষ্টি ধর।
চাকতিটা সামনে এসেও সোঁ করে মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছে লেকের পাড়ে। সুদেষ্ণার ছোঁড়া নীল ফ্রিসবি বৃষ্টির নাকের সামনে দিয়ে হাওয়ায় বেঁকে চলে গেল শুভর দিকে। বিক্রমের হলুদ চাকতি বৃষ্টির আঙুল ছুঁয়ে পালিয়ে গেল। বৃষ্টি অধৈর্য হয়ে উঠছে। আশ্চর্য! সবাই কি সহজেই ধরে ফেলছে, সে কেন পারছে না? এবার ধরতেই হবে। লাফিয়ে উঠতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়েছে নিজেরই সালোয়ারে পা জড়িয়ে। স্বচ্ছ ওড়না ছিটকে গেল!
দেবাদিত্য দাঁত বার করে হেসে উঠল,
—এবার পারবি। ওঠ। ধর।
বৃষ্টি কামিজের ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল। সব আনন্দের মুহূর্তই তার আঙুলে ছোঁয়া দিয়ে দূরে সরে যায়। কই, আর কারুর তো এরকম হচ্ছে না!
বৃষ্টির ফর্সা মুখে রক্ত জমেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে, কোন এক সুড়ঙ্গ পথ ধরে কনকনে বাতাস দৌড়ে আসছে হঠাৎ হঠাৎ।
ইউক্যালিপটাসের একটা সরু ডাল ভেঙে শুঁকছে অরিজিৎ। বৃষ্টি তার দিকে এগিয়ে গেল,
—চল, একটু হেঁটে আসি।
অরিজিৎ দলের সঙ্গে থাকতে সব সময়ই অস্বস্তিবোধ করে। বৃষ্টি লক্ষ করেছে, যে কোন একজনের সঙ্গে কথা বলার সময় সে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। স্বাভাবিক। অকারণে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মোছা অরিজিতের প্রিয় মুদ্রাদোষ। বৃষ্টির হাতে ডালটা ধরিয়ে সেই কাজটাই সারল সে। তারপর বলল,
—চল। আমারও ওই ফ্রিসবি খেলা ঠিক আসে না।
শুভ চিৎকার করে বলল,—তোরা চললি কোথায়?
বৃষ্টি গলা ওঠাল,—পরভিন রণজয়কে খুঁজতে।
—অরিজিৎ এখনও মাইনর আছে। ওকে নিয়ে যাস না। তেমন কিছু সিন দেখে ফেললে ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিবি। সেন্সরড হয়ে যাবে।
অরিজিৎ কিছুই বুঝতে পারল না,
—কেন রে? কি হয়েছে রণজয়দের?
বৃষ্টি উত্তর দিল না। মনে মনে বলল, হয়নি। হবে। তখন মজা বুঝবে।
হাঁটতে হাঁটতে অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় চলে এসেছিল অরিজিৎ আর বৃষ্টি। এখানে গাছপালা একটু বেশি ঘন, শাল ছাড়াও বেশ কয়েকটা পলাশ, মহুয়া, সেগুন গাছও রয়েছে। বাতাসের ফিসফাস ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না এই মুহূর্তে।
অরিজিৎ আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল।
—কিরে, কি হল তোর!
—ভাল লাগছে না রে। আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না।
ছোট্ট লাল নুড়ি তুলে অরিজিৎ ছুঁড়ল সামনের শালগাছের গায়ে।
—এই শালবনে যদি সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত। ওই জঙ্গলে কুঁড়েঘর তৈরি করে আদিবাসীদের মতো থাকতে পারতাম।
বৃষ্টির ভুরু কুঁচকে গেল। মেয়েদের একা পেলেই অনেক ছেলে অহেতুক রোমান্টিক হয়ে উঠতে চায়। গত বছরই লেকের ধারে তাকে একা পেয়ে পিকলুও কেমন গদগদ হয়ে পড়েছিল।
গম্ভীর মুখে অরিজিৎকে বলল,
—এনাফ্। অনেক হয়েছে। চল, এবার ফেরা যাক।
—বিশ্বাস করছিস না আমাকে? সত্যি বলছি, অন গড, আমি আর পারছি না। কলকাতায় ফিরে সেই আবার মুখ গুঁজে পড়াশুনো, বই নোটস…। অরিজিৎ থেবড়ে মাটিতে বসে পড়ল।
হল কি ছেলেটার! এ তো ঠিক প্রেম নিবেদনের সংলাপ নয়! বৃষ্টি ধীর পায়ে অরিজিতের পাশে এসে নিচু হল।
—কি হল তোর বল তো?
—কী হালেই না জুতে দিয়েছে আমাকে বাবা মা। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে। ওয়ান থেকে কেন? নার্সারি থেকেই। স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে, উল্টোদিকের বাড়ির সিঁড়িতে, ঠায় বসে থাকত মা। স্কুল থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ত, দেখি দেখি, কি টাস্ক দিয়েছে? ক্লাস ওয়ার্কে কত পেলি? হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে বাড়িতে এনেই আবার বই-এর সামনে, তোমাকে বড় হতে হবে বাবুন, মন দিয়ে পড়াশুনো করো। ক্লাস ফাইভ থেকে স্কুলের পরে টিউটোরিয়াল। বাড়ি ফিরতে সেই সন্ধে। কোন লাইফ নেই। খেলা নেই। গল্পের বই পড়বে না। মাধ্যমিকের আগে সায়েন্স গ্রুপের জন্য তিনটে টিউটর লাগিয়ে দিল। এককাঁড়ি খরচা, তবুও। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। শরীর টলছে। মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে। তোতাকাহিনীর পাখিটার মতো। কানের কাছে ভনভন চলছে, তোকে নিয়ে আমাদের খুব আশা বাবুন। যেন আরেকটা জে সি বোস বা সি ভি রমন চাই। চাই-ই। মাধ্যমিকে অঙ্কে পেলাম ফরট্টিফোর।
—মাত্র ফরট্টিফোর? কেন রে?
—নয়তো কি? অঙ্ক আমার একটুও ভাল লাগে না। মাথাতেই ঢোকে। শেষমেষ বাধ্য হয়ে এইচ. এস-এ. আর্টস পড়া। মেনে নিল। এখন চায় আমি একটা পারসিভাল হই বা আর সি মজুমদার। সামথিং অরিজিনাল। বিগ্। নইলে বাবা মা আমাকে ছাড়বে না। কি করে বোঝাই হিস্ট্রি ইজ নট অলসো মাই কাপ অফ টি। আমার লিটারেচর ভাল লাগে।
—সেটাই পড়লে পারতিস।
অরিজিৎ শব্দহীন বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। নখ দিয়ে এক মনে পাশের মাটি খুঁড়ছে। দূরে অপসৃয়মান সূর্যের ক্ষীণ রশ্মি এসে পড়েছে তার মুখে। এই ক’ মাসের চেনা অরিজিৎ একদম অন্যরকম। অবসন্ন।
—কি করে পড়ব? সাহিত্য পড়ে তো আর শেক্সপিয়ার, রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না! কী ভালই যে লাগত কবিতা পড়তে। তুই জীবনানন্দ পড়েছিস বৃষ্টি? সেই কবিতাটা? সেই যে,
পৃথিবী এখন ক্রমে হতেছে নিঝুম। সকলেরই চোখ ক্রমে বিজড়িত হয়ে যেন আসে;/ যদিও আকাশ সিন্ধু ভরে গেল অগ্নির উল্লাসে;/ যেমন যখন বিকেলবেলা কাটা হয় ক্ষেতের গোধূম/ চিলের কান্নার মতো শব্দ করে মেঠো ইঁদুরের ভিড় ফসলের ঘুম/ গাঢ় করে দিয়ে যায়। —এইবার কুয়াশায় যাত্রা সকলের।
অরিজিৎ যন্ত্রণায় নুয়ে পড়েছে। এক ক্লিন্ন, ন্যুব্জ, বৃদ্ধ যেন।
শালবনের ফাঁক দিয়ে অদূরে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। তিন-চারটে মিশকালো আদিবাসী শিশু খেলা করছে সেখানে। ঢিল ছুঁড়ছে পরস্পরের দিকে। আদিম খেলা।
অরিজিতের পিঠে আলতো হাত রাখল বৃষ্টি, —চল্। ওঠ। অন্ধকার হয়ে আসছে।
শুভ রাগে ফেটে পড়ল, —অপদার্থের দল। দু দিনে একটু মহুয়া জোগাড় করতে পারলি না? তোরা টি. এম-কে সামলাস, আমি কাল নিজেই যাব।
বিক্রম বলল, —ওদের পাড়াতেও তো গিয়েছিলাম কিন্তু কাকে যে বলতে হবে সাহস করে সেটাই…
—এতে সাহসের কি আছে? পয়সা ফেলবি, জিনিস কিনবি। এত ক্যাবলা তোরা….
মীনাক্ষি আচমকা ঝাঁঝিয়ে উঠল, —তোদেরও বলিহারি যাই। বেড়াতে এসেছিস বলে কি খেতেই হবে? না খেলে কি হয়? বাবা মা বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছে আর তোরা এখানে…
মীনাক্ষির কথায় চোখ জ্বলে উঠল বৃষ্টির, —বেশি খুকিপনা করিস না তে। বাবা মা অনেক দেখেছি। বেড়াতে এসেছি, খেতে ইচ্ছে করছে, খাব।
—তুইও খাবি!
খাবোই তো। ইচ্ছে হলে খেয়ে বেহেড হব। বাবা মা যা চাইবে, তাই করতে হবে নাকি সবসময়? তোর বাবা মা সব কাজ বুঝি তোর পারমিশান নিয়ে করে?
দেবাদিত্য মাঝখানে পড়ে থামাতে চাইল, —বৃষ্টি, কি হচ্ছেটা কি? মীনাক্ষি তো ঠিকই বলছে। খেতে ইচ্ছে করলে কলকাতা ফিরে গিয়ে যখন ইচ্ছে হয় খাবি। সাহস থাকলে বাড়ির লোকের সামনে খাবি। বেড়াতে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে…
—এখানেও খাব। দরকার হলে বাড়িতে গিয়েও খাব। তুই আমাদের কথার মাঝখানে এসে ভাঁড়ের মতো দাঁড়িয়েছিস কেন?
মীনাক্ষি বলল, —দেবাদিত্য সরে আয়। না খেয়েই ও মাতাল হয়ে গেছে।
দেবাদিত্য হাঁ করে বৃষ্টির দিকে তাকিয়েছিল। বুঝি বৃষ্টিকে পড়তে চাইছে।
তৃষিতা বলল, —এই ছেলেরা, তোরা বেরো তো ঘর থেকে। ঘুম পাচ্ছে।
পরভিন বলল, —কি হয়েছে? আরেকটু থাকুক না ওরা। সবে তো রাত দশটা! কাল বাদে পরশুই তো…
সুদেষ্ণা মুখে কোল্ডক্রিম মাখছিল। তার বিদেশী নাইলন নাইটির ওপর শাল জড়ানো। মুখ ফিরিয়ে শান্ত গলায় পরভিনকে বলল, —তোর যদি ইচ্ছে হয় সারারাত বাইরে গিয়ে আড্ডা মার। আমরা ঘুমোব।
ছেলেরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে পরভিন।
তৃষিতা চাপা গলায় বলল, —পরভিনটা ভীষণ বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। বাড়িতে সব সময় রিপ্রেশনের মধ্যে থাকতে থাকতে একটা সাংঘাতিক কিছু করবার ইচ্ছে গ্রো করে। ছেলেদের সঙ্গে জীবনে মেশেনি তো।
সুদেষ্ণা ঠোঁট ওল্টাল,—ও তো প্রথম প্রথম কলেজে এসে ফিলজফির অরিন্দমের সঙ্গেও কদিন ঘুরেছিল।
—বেশ রেবেল রেবেল ভাব এসেছে ওর মধ্যে। যেদিন ওর বাড়িতে জানবে…ওর দাদাসাহেব ওর ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখিয়ে খাবে। আসলে যারা যত কনফাইন্ড থাকে…। দেখছিস না জার্মানি পোল্যান্ডে কি অবস্থা।
বৃষ্টি টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কি মনে হতে আবার উঠে বসেছে। বালিশের পাশে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করল। রাগটা না থিতোলে ঘুম আসবে না তার।
দুপুরবেলা খেয়ে উঠে বৃষ্টি একাই বেরিয়ে পড়ল লজ থেকে। জনা পনেরো আদিবাসী শালগাছের নীচে জটলা করছিল, একটা মেয়েকে ভরদুপুরে একা দেখে ঘুরে ঘুরে দেখছে। বৃষ্টি তাদের লক্ষই করল না। লালচে মেটে পথে এলোমেলো হাঁটল কিছুক্ষণ। জায়গাটা সত্যিই সুন্দর। লোকবসতি এত কম যে মাঝে মাঝেই মনে হয় সভ্য সমাজ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। ইউক্যালিপটাসের হাল্কা গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে। বৃষ্টি চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টানল। আহ্।
হঠাই পশ্চিমের একটা বাড়িতে চোখ আটকে গেল বৃষ্টির। ওই বাড়িতেই সেবার উঠেছিল না! হলুদ রঙ বাড়ি। অ্যাসবেসটসের ছাদ! হয়ত ওটাই। হয়ত ওটা নয়।
বৃষ্টি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে। গেটে ওয়াটার ওয়ার্কস ইন্সপেকশন বাংলোর সাইনবোর্ড। উকিঝুঁকি দিতেই নেভি-ব্লু লঙ্কোট পরা বুড়ো দারোয়ান বেরিয়ে এল।
—কিস্কো চাহিয়ে? শর্মাজি আভি নেহি হ্যায়।
বুড়োর কথা বৃষ্টির কানে ঢুকল না। সামনের লম্বা করিডোরে চোখ অশান্তভাবে ঘুরছে। ডানদিকে পর পর দুটো সেকেলে দরজা। বাঁদিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। বাগান। একটা অর্জুন গাছ। কুঁয়ো। এই বাড়িটাতেই ছিল তারা।
কোন্ ঘরটায় তারা ছিল! প্রথম, না দ্বিতীয়! একবার যদি দেখা যেত!
বুড়োকে অগ্রাহ্য করে বৃষ্টি এগোল। দুটো ঘরেই তালা ঝুলছে। বন্ধ ঘরে ফ্যাঁসফাঁস করে লড়াই করছে দুটো প্রাণী। দরজাতেও নখের আঁচড়ের আওয়াজ।
বৃষ্টি তীরবেগে বেরিয়ে এল। সোজা কাল বিকেলের মাঠটার দিকে হাঁটছে। কোথাও যদি একটু বসতে পারত সে! এই চড়া রোদের মধ্যে একটু ছায়া! একদম একা!
ফ্রিসবি খেলার মাঠ এখন শুনশান। মাঠের পরেই লেক। লেকের জল রোদ্দুরে ঝিকমিক। এই মাঠটাকেই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা বলে মনে হয়েছিল ছেলেবেলায়! ওই লেকটাকে টলটলে জলের হ্রদ! হয়ত এ রকমই হয়। ছোটবেলায় যা বিশাল, বর্ণময়, রোমাঞ্চকর, বড় হলে সেটাই একেবারে ছোট্ট, ম্যাড়মেড়ে। পাইন গাছগুলোকেও আর তত উঁচু লাগছে না বৃষ্টির।
ছ’ বেডের ডরমেটরির ষষ্ঠ বিছানায় ডাঁই স্যুটকেস, কিটসব্যাগ, জামাকাপড়, সোয়েটার। টুকিটাকি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে সকলে। কাল ভোরে ফেরার পালা।
সুদেষ্ণা খাটের বাজুতে রাখা শাল ভাঁজ করে তুলল নিজের স্যুটকেসে। স্যুটকেস বন্ধ করতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। আসার সময় কি করে যে সব জামাকাপড় ঢুকেছিল ভেতরে!
—অ্যাই তৃষিতা, একটু চেপে ধর না প্লিজ।
তৃষিতা চাপতে শুরু করল। নিশ্বাস বন্ধ করে। হাঁটু দিয়ে। হঠাৎ দমকা হাসি এসে ছিটকে বার করে দিল নিশ্বাসটাকে। স্যুটকেস ছেড়ে গড়িয়ে পড়েছে হাসতে হাসতে। হাসির দমকে দেহ কাঁপছে থর থর। পাগলের মতো অবস্থা প্রায়। কাপড়জামা গুছনো থামিয়ে বাকিরা হাঁ করে দেখছে তাকে।
মীনাক্ষি তার দু কাঁধ চেপে ধরল, —উন্মাদ হয়ে গেলি নাকি? কি হয়েছে। বলবি তো?
—ওই হানিমুন কাপল্টা ..হিহি.. হিহি… হিহি… গাছের আড়ালে গিয়ে ছেলেটা চুমু খাচ্ছিল মেয়েটাকে।… হিহি… তাদের ফেরার সময় কী করুণ অবস্থা।
সুদেষ্ণা আর মীনাক্ষিও হাসিতে ফেটে পড়ল। বৃষ্টিও। দুপুরের পর এই প্রথম প্রাণ খুলে হাসছে সে।
ম্যাগনোলিয়া পয়েন্টে সূর্যাস্তের পর জিপ প্রথমে মিলিটারি অফিসারের বউ ছেলেমেয়েকে পৌছতে গিয়েছিল, ফিরে এসে নিয়ে যাবে বাকি সকলকে। নবদম্পতিও ছিল বৃষ্টিদের সঙ্গে। জিপ জঙ্গলে মিলিয়ে যাওয়ার পর সদ্য কলেজে ওঠা ছেলেমেয়েদের দঙ্গল এড়িয়ে একটু বোধহয় একান্ত হতে চেয়েছিল দুজনে।
—কি গান গাইছিল মেয়েটা শুনেছিস? তুঁহু মম প্রাণ হে…। সুর করে দেখাতে গিয়ে তৃষিতার গায়ে গড়িয়ে পড়েছে সুদেষ্ণা।
তৃষিতা দম নেওয়ার চেষ্টা করল, —আর দেবাদিত্য কী না করছিল! এমন ভয় দেখাল দুজনকে…এখানে প্রায়ই বাঘ আসে, বুননা ভাল্লুক মহুয়া খেয়ে ঘুরে বেড়ায়…বিক্রম আবার ক্যামেরা নিয়ে মাঝে মাঝেই ট্রাই করে যাচ্ছিল যদি কোন ইনটিমেট শট নেওয়া যায়।
—নিয়েছে তো? জানিস না? ওই চুমু খাওয়ার সিন্টা? ফ্ল্যাশ জ্বলতেও ওরা টের পেল না। বলতে বলতে বৃষ্টি হেসে গড়াগড়ি। হাসতে হাসতে ঘুষি ছুঁড়ছে বালিশে।
—তোরা ওভাবে হাসছিস? পরভিনের মুখ হাসিহাসি কিন্তু হাসছে না,
—বেচারা মেয়েটা ভয়ে কিরকম কেঁদে ফেলল…
—তোর খুব মায়া হয়েছে নারে? তুইও কি ওরকম…?
—না হয় জিপটা আসতে একটু দেরিই করেছিল। অবশ্য জঙ্গলটা বেশ ঘন।
গুম গুম শব্দে দরজায় ধাক্কা পড়ছে। পরভিন ছিটকিনি খুলল। অঞ্জন আর শুভ।
—হাই বেবিজ! গেট রেডি ফর দা ক্যাম্পফায়ার।
—তোরা পেয়েছিস?
—শুভ অপদার্থ নয়। শুভ কোন কাজে ফেল করে না। তবে যে টেস্ট করবে তাকেই নাচতে হবে। আগে খেয়ে নিই চল, তারপর নীচের মাঠটায় গিয়ে…
ভালই ফেয়ারওয়েল ডিনারের বন্দোবস্ত করেছেন টি, এম। ফ্রায়েড রাইস, চিকেন দোপেঁয়াজা, কাস্টার্ড।
রুমে যাওয়ার আগে টি. এম আরেকবার বলে গেলেন,
—তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো কিন্তু সকলে। কাল সকাল সাতটায় বাস।
আকাশ আজ তারায় তারায় ঝকঝক। আজকালের মধ্যেই বোধহয় পূর্ণিমা। ফিনফিনে মসলিনের মতো চাঁদের কিরণ ছড়িয়ে গেছে সকলের গায়ে, মুখে। উগ্র অথচ মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল বৃষ্টির। কি ফুল এটা! বুক ভরে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করল। জঙ্গলে গাছেদের মাথায় রুপোলি সরের মতো জ্যোৎস্নার ঢেউ। সব দুঃখ ছাপিয়ে একটা ভাল লাগা। একটা অসম্ভব ভাল লাগা। সমস্ত পার্থিব অস্তিত্ব যেন তুচ্ছ হয়ে যায় এই ভাল লাগার কাছে। এই মুহূর্তেই যদি মৃত্যু হত বৃষ্টির!
শুকনো ডালপালার আগুন ঘিরে এগারোটা নিস্পাপ আত্মার মতো সকলে বসে। গোল হয়ে। মুখে তাদের কেঁপে কেঁপে উঠছে অগ্নিশিখা। পরভিনের মাথা রণজয়ের কাঁধে।
বিক্রম ওয়াটার বটল এগিয়ে দিল পরভিনকে,
—এক চুমুক। বেশি নয়।
বেশ কিছুটা গলায় ঢেলে ফেলল পরভিন। দু হাতে রণজয়কে জড়িয়ে ধরল।
বৃষ্টি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে প্লাস্টিকের বোতল। ঢক ঢক করে অনেকটা গিলে নিল। একটা তীব্র কষা স্বাদ। মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস বন্ধ।
আবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে ঘরটা। তালা বন্ধ। ভেতরে দুটো রাগী জন্তু রোঁয়া ফুলিয়ে ঝগড়া করছে। থাবা খুলে নখ বার হয়ে এল। ক্ষতবিক্ষত করছে বৃষ্টিকে।
বোতল হাত ঘুরে শুভর কাছে। এক হেঁচকায় কেড়ে নিয়েছে বৃষ্টি। ঢেলেই চলেছে গলায়। শুভ বাধা দেবার আগেই।
—কি হচ্ছে কি? একাই সবটা মেরে দিবি নাকি? শালা কালেকশনে কেউ যাবে না… কারুর মুরোদ নেই…
অঞ্জন উঠে বোতলটা নিয়ে নিল।
দেবাদিত্য আর অঞ্জন একসঙ্গে ড্যানি হুইটেন ধরেছে—
আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু টক অ্যাবাউট ইট…
আই ডোন্ট… আই ডোন্ট… আই ডোন্ট…
রণজয় পরভিনকে হাত ধরে টেনে তুলল। সঙ্গে মীনাক্ষি তৃষিতা। বিটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাঁচজন নাচতে শুরু করেছে। মীনাক্ষি বা তৃষিত মহুয়া না খেলেও নাচে কম উৎসাহী নয়।
আগুন থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিল সুদেষ্ণা আর বৃষ্টি। গানের তালে তালে ক্ল্যাপ দিচ্ছে বাকি সবাই। অরিজিতও।
উঠতে গিয়ে বৃষ্টির পা টলে গেল। সুদেষ্ণার কাঁধে চাপ দিয়ে শেষ পর্যন্ত কোনরকমে দাঁড়াতে পেরেছে। নাচবার চেষ্টা করছে। শিথিল পা বেসামাল বার বার। তবুও আগুন ঘিরে টলমল পায়ে নেচে চলার চেষ্টা।
অঞ্জনের হাত থেকে আবার বোতলটা টেনে নিল।
—দে না শালা আরেকটু।
—তুই আউট হয়ে গেছিস মাইরি। হল্লা শুরু করেছিস। স্যারের ঘুম ভেঙে গেলে…
—হ্যাঙ ইওর স্যার। গুলি করে মেরে দেব সব্বাইকে।
আদিম মানবীর মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে বৃষ্টির চুল। কাঁধের শাল ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘাসের গায়ে। ঘোর লাগা গলায় চিৎকার করছে, —আই ডোন্ট্…আই ডোন্ট্… আই ডোন্ট…
তৃষিতা বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে বসানোর চেষ্টা করল। বৃষ্টি বদ্ধ মাতাল। তার চোখের সামনে দুটো রোঁয়া ফোলানো হিংস্র জন্তুর মুখ। জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে মারল জন্তুদুটোর মুখে। স্খলিত গলায় শাসিয়ে উঠল,
—দেখে নেব। দেখে নেব তোমাদের। কত ধানে কত চাল… শুধু নিজেদের ফুর্তি লোটা…!
এর পরই পড়ে গেছে মাথা ঘুরে। সুখ-স্মৃতিহীন মাতালের ঘুমে ডুবে গেছে কয়েক মিনিটের মধ্যেই।
.
০৭.
ডিসেম্বর শেষ হয়ে এল। অতিথি শিল্পীর ভূমিকায় শীত এখন কলকাতায় তার স্বল্পকালীন দাপট দেখাচ্ছে। কদিন ধরেই থার্মোমিটারের পারদ দশ-এগারোয়। দিল্লি-টিল্লিতে তো রীতিমত থরহরিকম্প অবস্থা। রোজই টেম্পারেচার পাঁচ ছয়। আপার ইন্ডিয়া জুড়ে শৈত্যপ্রবাহ চলছে। কাগজ খুললেই রোজ ঠাণ্ডায় দু-একজনের মারা যাওয়ার খবর। ফরিদাবাদ থেকে ফিরে সুবীর আবার ফরিদাবাদ গেছে। এতদিনে চলে আসার কথা। ফিরেছে কি?
ওয়াড্রোব খুলে বৃষ্টি মিনিটখানেক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। জন্মদিনের পর থেকে বাবার ট্যুরের পরিমাণ যেন বেড়ে গেছে। শেষবার ফিরে একবারই মাত্র বৃষ্টিকে ফোন করেছিল। আগে কত ঘন ঘন ফোন আসত।
হ্যাঙার থেকে কাশ্মিরী শালটা বার করে বৃষ্টি শুঁকল একবার। এখনও ইউক্যালিপটাসের গন্ধ লেগে আছে। এত মোটা শাল দরকার নেই, কলকাতার শীতে কাচ বসানো গুজরাটি চাদরটাই যথেষ্ট। এ বাড়ির সকলে বেশ শীতকাতুরে হলেও বৃষ্টির শীতবোধ একটু কম। ডিসেম্বর পড়তে না পড়তেই এ বাড়িতে লেপ কম্বল সব বেরিয়ে পড়ে। সারা দুপুর ধরে গা গরম করতে থাকে ছাদে। বিকেল না হতেই সেঁধিয়ে যায় যার যার বিছানায়। বৃষ্টিরই শুধু পাতলা কম্বলে রাত কেটে যায়; লেপ লাগে না। এই লেপ গায়ে দেওয়া নিয়ে কী যুদ্ধই না হত বৃষ্টির দিদার সঙ্গে। বৃষ্টি কিছুতেই লেপ নেবে না; মৃন্ময়ী দেবেনই। যেই না রাত্রে ঘুম এসেছে ওমনি লেপ উঠিয়ে দিয়েছেন নাতনির গায়ে। বৃষ্টিও সেয়ানা কম নয়, ঝট করে সরিয়ে দিয়েছে।
—ওরকম করে না সোনা, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
—আমার শীত করছে না।
—না করুক। তবু গায়ে থাক। কদিন আগে জ্বর থেকে উঠেছ মনে নেই?
—সে তো দু মাস আগে। আমার গা কুটকুট করছে।
—করুক।
—আমি কিছুতেই লেপ গায়ে দেব না। বৃষ্টি ঘাড় বেঁকিয়ে উঠে বসেছে।
—আচ্ছা জেদি মেয়ে তো! ডাকব মাকে?
—ডাকো। মা আমার কলা করবে।
বৃষ্টি ভালভাবেই জানত যতই অবাধ্য হোক দিদা সত্যি সত্যি মাকে ডাকবে না কখনই। কত অত্যাচার যে করেছে এক সময় দাদু দিদার ওপর। রাতদুপুর অবধি জাগিয়ে রাখা, খাওয়া নিয়ে বায়না, স্নান নিয়ে বায়না…। যতদিন ছিল দুজনেই চোখে হারাত বৃষ্টিকে। কেন যে পুট-পুট করে অত তাড়াতাড়ি মরে গেল দুজনে! বৃষ্টিকে বেশি ভালবাসত বলেই কি? প্রিয়তোষ মারা যাওয়ার সময় বৃষ্টি মাত্র দশ, মৃন্ময়ীর সময়ে বারো।
দুটো বৃষ্টি একরাশ জামাকাপড় টেনে নামাল ওয়াড্রোব থেকে। দরজা বন্ধ করে সিগারেট ধরাল। মাঝে মাঝেই ভাবে সিগারেট খাওয়ার সময় আর দরজা বন্ধ করবে না। তবুও কেন যে করে! কাজটা অনুচিত মনে করে বলেই কি! নাকি শুধুই প্রচলিত সংস্কার মেশা কুণ্ঠা!
দুটো সুখটান দিয়ে সিগারেটটা জানলার বাইরে ফেলে দিল বৃষ্টি। ফ্লেয়ারকাট সালোয়ার-কামিজ হাতে তুলেও ছুড়ে দিল বিছানায়। উঁহু, এটা নয়। জিনসের প্যান্টের সঙ্গে লাল পাতলা পাঞ্জাবিটা পরবে আজ। মা একদম পাঞ্জাবিটাকে সহ্য করতে পারে না। প্রথম যেদিন পরেছিল সেদিন কী উষ্মা!
—ছিঃ, এটা কি পরেছিস?
—কেন? খারাপ কিসের?
—খারাপ না? গা দেখা যাচ্ছে। তোর অস্বস্তি হয় না?
—এরকম তো আজকাল সবাই পরে। সেদিন বুলবুলদিও তো এই টাইপের একটা পরে এসেছিল।
—পরুক। তুমি পরবে না। যথেষ্ট অশালীন লাগে দেখতে। আর কোনদিন যেন না দেখি…
বৃষ্টি আজ এটাই পরবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গায়ে গলিয়ে নিল লাল পাঞ্জাবি। জিনসের প্যান্টের বোতাম আটকাল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বেঁধে নিল চুড়ো করে। ন্যাচারাল শাইন লিপস্টিক লাগাল ঠোঁটে, চোখে হাল্কা আই লাইনার। এমন ভবে, যাতে আছে, আবার নেই!
ফোন বেজে উঠল। বৃষ্টি বেরোতে গিয়েও বেরোল না। মা আজ বাড়িতে আছে। একটু আগে দুজন ছাত্র এসেছিল। ছাত্রদের অ্যানুয়াল এগজিবিশন নিয়ে আলোচনা চলছিল জোর। তারা না যেতেই বাসুদেবন। লোকটা কেন আর্ট গ্যালারির মালিক যেন? ভেনাস? চিত্রদীপ? না জুপিটার? বৃষ্টি নামটা ঠিক স্মরণ করতে পারল না।
—বৃষ্টি, তোমার ফোন।
বৃষ্টি দরজা খুলে বাইরে এল। এখন আবার কার ফোন! বাবা।
ড্রয়িংরুমে ফেরার আগে জয়া দাঁড়িয়েছে,
—উঠে এসে ফোনটা তো একটু ধরতে পারিস। দেখছি আমি একটা দরকারি কথা বলছি।
হুঁহ্। ভারী তো কাজ। হয় কৃষ্ণ সিরিজ, নয় রাধা সিরিজ। লোকটা তো এসেছে ওই জন্যই। বৃষ্টি দেওয়ালের দিকে মুখ করে রিসিভার তুলল। লাল পাঞ্জাবিটাকে দেখিয়ে। শরীরের ভাঁজগুলোকে প্রকট করে।
—কি ব্যাপার অরিজিৎ! তুই! হঠাৎ!
—খুব আরজেন্ট দরকার রে।
—বল্।
—তোর মামার কাছে ফার্স্ট রাইখের ওপর একটা ভাল বই আছে বলছিলি না?
—বলেছিলাম নাকি? সো?
—বইটা একবার দিবি আমাকে? এই ধর্ দিন দশেকের জন্য?
—মামা অদ্দিনের জন্য বোধহয় দেবে না। ম্যাক্সিমাম দিন তিন-চার।
—তাই দিস। যেদিন কলেজ খুলবে সেদিনই আনিস প্লিজ।
অরিজিৎ ফিরে গেছে তার পুরনো জগতে। নেতারহাটের দুঃখী ছেলেটা নেতারহাটেই রয়ে গেল। সেই শাল-মহুয়ার জঙ্গলে। পাইন বনে।
কী সুন্দর একটা কবিতা আবৃত্তি করেছিল অরিজিৎ। বৃষ্টি কবিতাটার মানে বুঝতে পারেনি কিন্তু শব্দগুলো এখনও লেগে আছে কানে। মানে বুঝবে কি করে? কবিতা পড়ার অভ্যাসই তার তৈরি হয়নি কোনদিন। হৃদয়ের কোমল তারগুলো বাজতেই চায় না। রঙ-তুলির মতো তারাও নির্বাসিত।
বৃষ্টি ড্রয়িংরুমের দিকে তাকাল। মা কি তার ড্রেসটা লক্ষ করেছে? না করলেও করাতে হবে। ড্রয়িংরুমের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। মা আর বাসুদেবনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেন্টার টেবিল থেকে ম্যাগাজিনগুলো তুলে ঘাঁটতে লাগল, যেন কোন এক বিশেষ পত্রিকা এখ্খুনি তার দরকার। লাল মলাটের একটা পুরনো ‘ভোগ্’ তুলে নিল হাতে। পাতা ওল্টাচ্ছে। এই বয়সের ইন্দ্রিয় সিগনাল পাঠাচ্ছে, দেখছে, দেখছে। বাসুদেবন তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে।
জয়া বিরক্ত মুখে বাসুদেবনকে বলে উঠল, —ঠিক আছে। নেক্সট উইকের শেষাশেষি খোঁজ নিয়ে যাবেন, যদি শেষ করতে পারি তো….
—প্লিজ ম্যাডাম, যে কটা কমপ্লিট হয়েছে সেগুলোই যদি…
—অদ্ভুত কথা বলছেন! হাফফিনিশড্ ছবি….
—আপনার মতো আর্টিস্টদের হাফফিনিশড্ কাজও ভ্যালুয়েবল। আপনার লাস্ট গণেশ সিরিজটা…
ম্যাগাজিনটা নিয়ে বেরিয়ে এল বৃষ্টি। বাসুদেবনের কি এক্সপ্রেশান! এক চোখে গিলছে তাকে, অন্য চোখে রাধা সিরিজের আব্দার। যাক্, বৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল। মার গলায় বেশ ঝাঁঝ ছিল।
পেন্সিল হিল্ পায়ে গলিয়ে বেরোনোর আগে বৃষ্টি বাবলুর দরজার সামনে দাঁড়াল একটু। ভালমামা নিবিষ্ট মনে ক্রসওয়ার্ড পাজল করছে। ঠিক খুঁজে খুজে শক্ত শব্দগুলোকে বার করে ফেলে। বৃষ্টি দু-একবার চেষ্টা করে দেখেছে। বেশ খটোমটো। তবে সময় কাটানোর পক্ষে আইডিয়াল।
বাবলু এখন এত তদ্গত যে বৃষ্টির দাঁড়িয়ে থাকা খেয়ালও করল না। বৃষ্টি একবার ভাবল ডেকে বিসমার্কের বইটার কথা বলে; পরমুহূর্তে ভাবল থাক, এ সব সময় ডাকলে ভালমামা ভীষণ রেগে যায়।
রাস্তায় নামতেই বৃষ্টির মনটা খুব ভাল হয়ে গেল। চমৎকার এক ঝকঝকে দিন ফুটে আছে বাইরে। শীতের রোদের রঙ এত নরম, এত সোনালি হয়! এরকম দিনে মনখারাপ করে থাকাই যায় না। যে কোন ঘ্যানঘেনে ভিখিরিকেও পয়সা দিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
পার্কের রেলিঙে হেলান দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে টুকুনরা। বাড়ির কাছে এমন একটা পার্ক থাকলে তার রেলিঙে আড্ডা মারার প্রশস্ত জায়গা। তার সঙ্গে শীতের রোদটুকু তো উপরি পাওনা।
—কিরে? খুব মাঞ্জা দিয়ে? চললি কোথায়?
পিকলুর ডাক শুনে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে পড়ল। ছোটবেলায় টুকুন রনি পিকলুদের সঙ্গে খেলা করত পার্কে। লায়লি মামণিরাও সঙ্গে থাকত। লায়লিরা কবেই বেহালায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে চলে গেছে। মামণির সঙ্গে দেখা হলে কিরে কেমন আছিস সম্পর্ক। শৈশবের বন্ধুরা আর কজন টিকে থাকে শেষ পর্যন্ত? টুকুন পিকলুদের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক অবশ্য ততটা ভাঙা নয়, মাঝে মাঝে কথাবার্তা বলে, আড্ডা মারে সময় পেলে।ব্যস্, ওই পর্যন্তই।
বৃষ্টি দেখল রনিদের সঙ্গে ওই ছেলেটাও দাঁড়িয়ে। সাদা টি-শার্ট পরা, ট্রাউজারসও সাদা। কলকাতার কপিলদেব। চার্লি চ্যাপলিনের মতো আটকে গিয়েছিল ট্রেনের দরজায়।
রাস্তা পেরিয়ে পার্কের ধারে গেল বৃষ্টি,
—খুব মেয়েদের আওয়াজ দিচ্ছিস আজকাল?
—আওয়াজ খাওয়ারই তো ড্রেস!
—আমাকেই দিচ্ছিস? নাকি যে যায় তাকেই…?
টুকুন চুপ থাকতে পারল না, —তুই প্রেমনগর দেখেছি বৃষ্টি? ইয়ে লাল রঙ কব মুঝে ছোড়েগা…
—এক ঘুসি মারব। পাঞ্জাবিটা কত দিয়ে কিনেছি জানিস?
—আমাদের ভাই জাহাজের খবরে কি দরকার। খাই দাই। খেলি টেলি। আর তোদের দেখলে একটু আওয়াজ দিই,। আর কি চাই?
বৃষ্টি লক্ষ করল কপিলদেব মিটিমিটি হাসছে। সরাসরি তাকাচ্ছে না। আড়চোখে তাকে দেখে সেই অন্যমনস্কতার ভান। সুধামাসি সেদিন বলছিল ছেলেটার বাবা নাকি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ওরা, মা আর ছেলে, নাকি আলাদা আলাদা থাকে সব সময়। মা-তো কারুর সঙ্গেই মেশে না।
ছেলেটাকে আড়াল করে চোখের ইশারায় রনিকে জিজ্ঞাসা করল, কে রে ছেলেটা?
—চিনিস না? বুবলু। সায়নদীপ ব্যানার্জি। জেম অফ আ বয়। স্টারস স্পোর্টিং-এর ওপেনার। রনি বেশ জোরেই বলে উঠেছে, —অলরেডি লিগে এবার তিনটে সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। বস্ এবার ঠিক বেঙ্গল খেলবে। গত বছর আল্ডার টোয়েন্টিটুতে যা খেলেছে না…. সায়ন, একে চিনিস? বৃষ্টি রায়।…এই তোর ভাল নামটা কি যেন? খঞ্জনী না কি একটা নাম আছে না?
—শিঞ্জিনী। বৃষ্টি ছেলেটার দিকে সরাসরি তাকাল, —তবে আমি বৃষ্টি। টিপটিপ করে নয়। মুষলধারে পড়া।
স্কুল পর্যন্ত বৃষ্টির শিঞ্জিনী নামটা খুব চলেছিল। তারপর মেয়েদের কৈশোর যেভাবে হারিয়ে যায়, সেভাবে কবে যে দুম করে হারিয়ে গেল নামটা! নিজের গলাতেই নামটা এখন কেমন অচেনা লাগে। তবু নামটা তো আছেই। কাগজে কলমে, সার্টিফিকেটে, মার্কশিটে। অনেকটা তার বাবা মা’র পরিচয়ের মতো। শিঞ্জিনী রায় ডটার অফ সুবীর রায় অ্যান্ড জয়া রায়….
বৃষ্টির মজা লাগছে ছেলেটাকে দেখতে। কি বিটকেলভাবে সেদিন দৌড়চ্ছিল সকালে। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,
—কাঁধে কিটসব্যাগ নিয়ে দৌড়ও কেন তুমি? মাঠে রাখলে চুরি যাবে সেই ভয়ে?
সায়নদীপ মুহূর্তের জন্য থতমত।
—না মানে ওটা এক টাইপের ওয়েটট্রেনিং। ওতে দু কাঁধের জোর বাড়ে। এনডিওরেন্স্ বাড়ে। রজার ব্যানিস্টার বলেন যতটা শরীরের ক্ষমতা আছে সেটাকে পুরো স্ট্রেচ করার পর আরও পরিশ্রম করলেই এনডিওরেন্স বাড়ানো সম্ভব।
বাহ্। স্মার্টলি জ্ঞান দিচ্ছে তো! যতটা ক্যাবলা ভেবেছিল ততটা তো নয়!
—তোমাদের ক্লাবে জিম্ন্যাশিয়াম নেই? বৃষ্টি ওজন তোলার ভঙ্গি করল—বারবেল তুলতে পারো না?
রনি বলে উঠল, —ফাজলামি হচ্ছে? কলকাতার কটা ক্রিকেট ক্লাবে জিম্ আছে রে?
—না, আমাদের ক্লাবে জিম নেই। তবে আমি একটা জিমে ভর্তি হয়েছি। আমাদের কোচ বলেন …
ও বাবা, এ যে কথায় কথায় কোটেশন দেয় দেখি! বৃষ্টি মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছে সায়নদীপকে, —আর কে কে তোমাকে কি বলে ভাই? পার্কে ব্যায়াম করার সময় ছাদে দাঁড়ানো মেয়েদের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাতে কে বলেছে তোমায়? গাভাস্কার? না বয়কট? ওতে কি আইসাইট্ ভাল হয়? বলের সুয়িং দেখে খেলতে সুবিধে হয়?
এতক্ষণে সায়নদীপ লজ্জা পেয়েছে। লাজুক মুখে হাসছে। হাসিটা শিশুর মত সরল।
টুকুন সায়নকে বাঁচানোর জন্য কথা ঘোরানোর চেষ্টা করল, —আমাদের কথাও কিছু জিজ্ঞেস কর্। রনি কি দারুণ ফিল্ডিং করছে সে খবর রাখিস্?
রনির বাড়ির সামনে সেদিনের জটলাটা মনে পড়ে গেল বৃষ্টির। মুখে বলল, —হ্যাঁ, ওকে সেদিন দেখলাম বটে। রামকৃষ্ণ মিশনের সামনে দিয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে ফিল্ডিং করতে করতে যাচ্ছিল।
—হ্যাহ! তুই কাকে দেখতে কাকে দেখেছিস্? রনি হাঁ হাঁ করে উঠেছে।
—ঠিকই তো। তুই তো আজকাল প্রায়ই বিকেলে হাওয়া হয়ে যাস্। টুকুন চোখ ঘোরাল, —ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ গুরু?
—তোরাও যেমন। বৃষ্টি নাচাচ্ছে; তোরাও নাচছিস্।
—তাই? বৃষ্টি ভুরু ওঠাল, —মেয়েটার নাম সীমা আবস্তি। লেকমার্কেটে থাকে। মেয়েটার বায়োডাটা বলব? আরও কিছু?
—যাও না বস্, যেখানে যাচ্ছিলে যাও। রনি গজগজ করছে, —একটু কাঠি না করলে কি সুখ হচ্ছিল না?
বৃষ্টি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সান্গ্লাস বার করল। নাহ্, রনিকে আর বিপদে ফেলে লাভ নেই। চুল ঝাঁকাল,
—চলি রে, এরপর দাড়ালে হয়ত টুকুন পিকলুও আমাকে ভাগাতে চাইবে। সব সময় মনে রাখবি আমার নাম বৃষ্টি। বৃষ্টি কভার্স এ লট্ অফ্ গ্রাউন্ড। বৃষ্টির লক্ষ চোখ থাকে।
—চোখ কি শুধু বৃষ্টিরই থাকে? আমাদের থাকে না? এই ধরো তুমি গত সোমবার নিউএম্পায়ার, বুধবার লাইটহাউস আর বৃহস্পতিবার গ্লোবে ইভনিং শো-এ সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে।
সায়নের কথার আকস্মিকতায় বৃষ্টি হতবাক। গোয়েন্দা নাকি রে বাবা?
সায়ন নির্বিকারভাবে বলে চলেছে, —সোমবার তোমার সঙ্গে ছিল দুটো ছেলে একটা মেয়ে, একটা ছেলে লম্বাচওড়া, আরেকটা ছোটখাটো উইক চেহারা, বুধবার ওই লম্বা ছেলেটা সঙ্গে ছিল, বৃহস্পতিবার ….
—ব্যস্, ব্যস্, হয়েছে। এবার থামো।
বৃষ্টি হাত উঁচু করল। মনে বেশ ধন্দ লেগেছে। প্রেমে টেমে পড়েছে নাকি! ছেলেটার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল,
—ছিঃ। ওভাবে মেয়েদের পেছনে পেছনে ঘুরতে নেই। তুমি না ভাল ছেলে?
তৃষিতাদের বাড়িতে এর আগে একবারই এসেছে বৃষ্টি। বাড়িটা বেশ পুরনো। তৃষিতার ঠাকুর্দা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একতলাটা ভাড়া নিয়েছিলেন। বোমা পড়ার ভয়ে কলকাতায় বাড়িভাড়া তখন দারুণ সস্তা। বাড়িটার সামনে বড় লোহার গেট। একপাশে পাথরের ফলকে লেখা— গ্রেস গ্রোভ্।
গেট খুলে ঢুকতেই প্রথমে ছোট্ট গাড়িবারান্দা। লাল সিঁড়ি দিয়ে উঠে আরেকটা বারান্দা পেরিয়ে পর পর ঘর। হাইরাইজের আমলে এরকম চেহারার বাড়ি কমে যাচ্ছে কলকাতায়।
গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ডাকল, —তৃষিতা।
রোগা মতন এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বোধহয় তৃষিতার বাবা।
—এসো এসো। তুমি বৃষ্টি?
বৃষ্টি আগেরবার এসে তৃষিতার বাবাকে দেখেনি।
—সবাই এসে গেছে?
—সব্বাই। এসেই খালি বৃষ্টির খোঁজ। এই শীতেও।
কিছু কিছু লোকের কণ্ঠস্বরে এত স্নেহ মাখানো থাকে! স্নেহের জাদু সহজেই বশ করে ফেলতে পারে অন্যকে। বৃষ্টি ঝপ করে একটা প্রণাম ঠুকে ফেলল। এমনিতে সহজে সে কারুর পায়ে হাত দেয় না।
—থাক থাক। সোজা এঘর দিয়ে বাঁদিকে চলে যাও।
খাটে পা মুড়ে বয়স চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে সবাই। চারিদিকে ইতস্তত ছড়ানো এক রাশ ছবি। নেতারহাটের।
বৃষ্টিও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল ছবিগুলো।
—সেই ছবিটা তো দেখছি না? সেই ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট? হানিমুন কাপ্ল্?
—ওটা বিক্রম নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। কাউকে দেবে না।
সুদেষ্ণা বলল, —বিক্রমটা বেশ পারভার্ট আছে। একা একা দেখবে আর রেলিশ করবে।
শুভ বলল,—ছাড় তো বিক্রমের কথা। সিনেমার পর আজ বসা হচ্ছে, কি হচ্ছে না? বলতে বলতে তৃষিতের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল,—ভাল ছেলে মেয়েরা না হয় ফিরে আসবে। কিরে পরভিন, আজ একটু জিন্ হবে নাকি? কিচ্ছু টের পাবে না বাড়িতে।
—হ্যাঁ হ্যাঁ। দুটো এলাচ মুখে দিয়ে নিলেই ব্যস। বৃষ্টি পরভিনকে সাহস দিতে চাইল।
তৃষিতা বৃষ্টির মুখে আঙুল রেখেছে,—এই আস্তে। বাবা পাশের ঘরেই আছে।
তৃষিতার চুপ করানোর চেষ্টা দেখে পরভিন হেসে উঠল। তার মধ্যে আরও বিদ্রোহী বিদ্রোহী ভাব এসেছে।
সুদেষ্ণা বলে উঠল,—আমি কিন্তু আজ থাকছি না।
—কেন?
—একটা পার্টি আছে সন্ধেবেলা। মা’র। যেতেই হবে সঙ্গে।
বৃষ্টি আর পরভিন চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। সুদেষ্ণার সব সময় বড় বড় ব্যাপার। স্যাটারডে ক্লাব, লেক ক্লাব, তাজবেঙ্গল।
—তোর গাড়ি দুটো নাগাদ আসবে না? আমাদের একটু এস্প্ল্যানেডে ছেড়ে দিস্।
তৃষিতার বাবা ঘরে ঢুকলেন,—তোমরা কি এবার খেতে বসবে?
দেবাদিত্যর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে।
তৃষিতা বলল, —হ্যাঁ হ্যাঁ চল্, বসে পড়ি। দেবাদিত্য তো সেই দশটার সময় এসেছে। ওর নিশ্চয়ই খিদে পেয়ে গেছে এতক্ষণে।
দেবাদিত্য লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল,—না, না, আমার খিদে পায়নি। বেরোনোর সময় কাকিমা যা এক কাপ চা খাইয়েছে ওতেই চার পাঁচ ঘন্টার জন্য নিশ্চিন্ত। সঙ্গে পাঁউরুটির চুয়িংগাম।
তৃষিতার বাবা বললেন, —তাহলে আমি খাবার দাবার রেডি করে ডাকি তোমাদের?
তৃষিতার বাবা চলে যেতেই দেবাদিত্য বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে।
—খাওয়ার আগে তৃষিতার নেমন্তন্নর অনারে আমি একটা দুরন্ত নিউজ দিতে পারি।
—কি রে?
—মীনাক্ষি লটঘট চালাচ্ছে। বহুত পুরনো।
—যাহ্। হতেই পারে না।
—হতে পারে না কিন্তু হয়েছে। বচপন্ কা মোহব্বত্। আশিক ক্ষুর চালায়।
—মানে?
—পাড়ার দাদা। বড়দা নয়, মেজদা ফেজদা টাইপ্।
—কি করে হয়! মীনাক্ষি তো এক্কেবারে অন্যরকম। সফ্ট। টেন্ডার নার্ভাস। বাবা মার খুব বাধ্য। ওর বাবা মা জানে?
—জানে তো বটেই। মেয়ে মোহব্বত করবে; বাপ মা টের পাবে না? গায়ের গন্ধে টের পাবে। এই নিয়েই তো ওদের বাড়িতে হেভি ঝামেলা চলছে। পরশু ওর বাবা খেপে গিয়ে ছেলেটাকে রাস্তায় ধরে কি সব তড়পেছে, পুলিশ ফুলিসের ভয় দেখিয়েছে, ওমনি রাত্রেই হিরোর চামচারা এসে কষে রগড়ে দিয়ে গেছে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে। ওই ইকনমিকসের মোটা পার্থ, ও তো ওদের পাশের পাড়ায় থাকে, ওদের বাড়ির সামনে গণ্ডগোল দেখে গেছিল…
বৃষ্টি বলল,—আমি বিশ্বাস করি না।
—আমিও। সুদেষ্ণা বলল,—বড় গুল মারিস তুই। তোর মত মিথ্যেবাদী…
দেবাদিত্যর মুখে আহত ভাব। সুদেষ্ণা সুযোগ পেলেই যা তা ভাষায় কথা বলে তার সঙ্গে।
দেবাদিত্য উত্তেজিতভাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তৃষিতা হাতের ইশারায় থামাল। তার মা এবার খেতে ডাকতে এসেছেন।
একটা বেশ বড়সড় ঢাকা বারান্দায় পুরনো আমলের শ্বেতপাথরের খাবার টেবিল। খেতে বসে সকলে মিলে পেছনে লেগেছে দেবাদিত্যের।
—মাসিমা, দেবাদিত্যকে রুই মাছ এক পিস্ বেশি দেবেন।
—এই তৃষিতা, আরেকটা ফ্রাই দে দেবাদিত্যকে।
—নে না, লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আরেকটু ফ্রায়েড রাইস নে।
—মেসোমশাই, দেবাদিত্য আরেক পিস্ মুরগির ঠ্যাং নেবে।
দেবাদিত্য ঠাট্টাগুলো গায়ে না মাখার চেষ্টা করল। অনেকদিন পর তার বেশ ভালমত খাওয়া জুটেছে দুপুরে।
তৃষিতার মা বললেন, —তোমরা সবাই মিলে ওর পেছনে লেগেছ কেন? কি এমন খায় বেচারা? ওইটুকু তো ঘিভাত নিয়েছে। বলতে বলতে হাসছেন, খায় হচ্ছে তোমাদের তৃষিতার বাবা।—ছটা বাটি নিয়ে, সাজিয়ে…বসে…
তৃষিতা বলে উঠল,—সত্যি, জানিস মার বৌভাতের দিন কি হয়েছিল? ওই যে সব বরের পাতে খাওয়ার নিয়ম ফিয়ম আছে না… বাবা খাওয়ার পর মা যখন বসেছে তখন পাত একেবারে আয়নার মত চকচকে।
তৃষিতার বাবা-মা’র কান বাঁচিয়ে শুভ ফিসফিস করল,
—তুই সামনের টেবিলে বসেছিলি বুঝি?
তৃষিতা বাঁ হাতে একটা চাপড় মারল শুভকে। তৃষিতার বাবা বলে উঠলেন,—ওই একদিন। একদিনই আমার জুটেছিল। তারপর থেকে কে খায়, কে খায় না সেটা তোমরা তোমাদের মাসিমার চেহারা দেখলেই বুঝতে পারবে।
তৃষিতার মা তাঁর ভারী চেহারা নিয়ে একটু লজ্জায় পড়লেন যেন,—আর তুমি যে আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে গিয়ে বিকেলবেলা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে? কিসের জন্য?
—তোমার জন্যে।
—বাজে বোকো না। বাবা কখন ফিরে আলুর চপ বেগুনি আনতে দেবে তার জন্যে। তোমরা বিশ্বাস করবে না, রোজ সাত আটটা করে বেগুনি, সাত আটটা করে আলুর চপ খেত। তারপরও মাকে বলত, মিষ্টি ফিষ্টি কিছু নেই? নোন্তা খেয়ে মুখ কেমন করছে।
—ওই তো মেয়েদের দোষ। কথার অর্থও বোঝো না। তখন তো মিষ্টি ছিলে তুমি, নোনতা ছিল তোমার বাবা। কী ঝাল! তবে বেশ সুস্বাদু। আমার হজম হয়ে গেছে। এখন অবশ্য তোমারও সেই মিষ্টত্ব আর নেই। তবু ….
তৃষিতা হাসছে—আমার বাবা মা’র রোমান্স শান্তিনিকেতনের খুব ফেমাস ঘটনা। কি বলব নাকি মা? …
একটা অসম্ভব সুন্দর সুখী পরিবারের দৃশ্য। এই দৃশ্যগুলো বৃষ্টি কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। এই সব দৃশ্য দেখার আশঙ্কাতেই ছোট থেকে কোন বন্ধুর বাড়ি সহজে যেতে চাইত না সে। আজ কেন যে এল?
তৃষিতার মা পাশে এসে দাঁড়ালেন,—এই মেয়ে, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না দেখছি?
তৃষিতার মা’র মুখে কী সুন্দর মা মা ভাব। বৃষ্টির চোখে জল এসে গেল।
তৃষিতার বাবা বললেন, —তোমরা, আজকালকার মেয়েরা, কি বলো তো? বন্ধুদের সঙ্গে দিন রাত টো টো করছ, এখানে ছুটছ, সেখানে ছুটছ কিন্তু খাওয়ার বেলায় …সব ডায়েটিং চলছে!
এভাবে কি কোনদিন বৃষ্টি বন্ধুদের ডাকতে পেরেছে বাড়িতে? পারবে কি? এভাবে মা দাঁড়িয়ে আদর করে খাওয়াবে সবাইকে! বাবা দেখাশোনা করবে!
ধীরে ধীরে অন্য বৃষ্টিটা দখল নিচ্ছে মস্তিষ্কের। শরীরের কোষে কোষে জমে থাকা তীব্র অভিমান হিংস্র রাগ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শিরায় উপশিরায়। এই সময় বৃষ্টি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অনেক কষ্টে সামলে রাখার চেষ্টা করল নিজেকে।
ঘরে ফিরে খাটের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছে সবাই।
তৃষিতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।
সুদেষ্ণা একটা বালিশ টেনে গড়িয়ে পড়ল, —মাসিমা মেসোমশাই দারুণ। কী জলি দুজনেই।
তৃষিতা দাঁত দিয়ে হেয়ার ক্লিপ্ আলগা করল, —দু জনে একসঙ্গে মুডে থাকলে যা … বিশেষ করে আমার বাবা …
বৃষ্টি হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়েছে, —আমি যাচ্ছি।
—কোথায়? বন্ধুরা সবাই এক সঙ্গে চমকে উঠল।
—সে কৈফিয়ত কি তোদের দিতে হবে? বৃষ্টির গলা অস্বাভাবিক রূঢ়! বন্ধুরা স্তম্ভিত।
—সিনেমা যাবি না?
—না।
—বাহ্। নিজে সবাইকে নাচালি; কেটে পড়বি?
—আমার ইচ্ছে। দ্রুত পায়ে বৃষ্টি একেবারে রাস্তায়। শুভ দেবাদিত্যরা পিছন পিছন কিছুটা এসেও দাঁড়িয়ে পড়ল। এ কয়েক মাসেই তারা লক্ষ করেছে বৃষ্টি মাঝে মাঝেই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করে। হঠাৎ যদি উচ্ছল, তো হঠাৎই রাগী, গম্ভীর, রুক্ষ। এই সময় ওকে না ঘাটানোই ভাল। নেতারহাটে যা কাণ্ড করেছিল!
রাস্তা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে উদভ্রান্তের মত হেঁটে চলেছে বৃষ্টি। পেনসিল হিল পরা এক সুবেশা মেয়েকে শীতের দুপুরে ওভাবে হাঁটতে দেখে অনেকেই দেখছে ঘুরে ঘুরে। বৃষ্টির কোনদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। কোনরকম অনুভূতিই নেই তার। দুবার হোঁচট খেতে খেতে বেঁচে গেল। একজন পথচারীর সঙ্গে ধাক্কা লাগল সজোরে। লোকটা কিছু বলার আগেই দেখল মেয়েটা বিশ পঁচিশ হাত দূরে চলে গেছে। ভিড়ের মাঝখানে এসে পড়তে বৃষ্টির সম্বিৎ ফিরল। হাঁটতে হাঁটতে হাজরার মোড়ে চলে এসেছে। এবার কোথায় যাবে স্থির করতে পারছে না। ট্রামস্টপে গিয়েও ফিরে এল। মাথার ভেতর একটা যন্ত্রণা তাকে কুকুর-তাড়া করে চলেছে। কি করবে সে এখন? বাড়ি ফিরে যাবে? কখখনো না। হঠাৎই যন্ত্রচালিতের মত এগিয়ে গেছে টেলিফোন বুথের দিকে। পাগলের মত ব্যাগে একটা কয়েন খুঁজছে। একটা কয়েন। হাতে নিয়েই ডায়াল ঘোরাতে আরম্ভ করেছে। মস্তিষ্কের যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে দেবে ওপারেও। রীতা ফোন ধরেছে, —হ্যালো! কে বৃষ্টি! কি খবর তোমার?
—বাবা ফিরেছে?
—হ্যাঁ, পরশু।
—বাবাকে দাও।
—তোমার বাবার শরীরটা খুব ভাল নেই। ঘুমোচ্ছে।
—ডাকো। বলো বৃষ্টি ডাকছে।
—তুমি কি পরে রিঙ্ করতে পারো না? কিংবা তোমার বাবা যদি উঠে তোমায় ফোন করে? বুকে ব্যথা হচ্ছে বলছিল …
—তুমি ডেকে দাও। আমার এখখুনি দরকার। এখখুনি।
—ধরো। দেখছি। রীতার গলায় বিরক্তি।
বৃষ্টি দাঁতে দাঁত ঘষল। নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন।
সুবীর রিসিভার তুলেছে। গলায় ঘুমঘুম ভাব,
—কিরে, কি বলছিস্?
—কি ঠিক করলে? কবে থেকে থাকছ আমার সঙ্গে?
—শোন্ শোন, তোকে আমার কয়েকটা কথা বলার আছে।
—আমি কোন কথা শুনতে চাই না।
—লক্ষ্মী মেয়ে, এরকম করে না।
—আই জাস্ট ওয়ান্ট্ টু হিয়ার ইয়েস অর নো ফ্রম ইউ। না বলছ?
—উঃ, কখন না বলোম? কি পাগলের মত …
—ও। তাহলে আমি এখন পাগল! তোমরাই সব সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ! বৃষ্টি হাতের মুঠো শক্ত করল,—পাগলামি করছি? ও কে। লেট ইট্ বি সো।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে বাড়ি অবধি চলে এসেছে,বৃষ্টি নিজেও জানে না। কলিংবেল বাজাতে গিয়ে হুঁশ ফিরল। বাড়িতেই কেন ফিরল সে!
সুধা হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলেছে। দেখেই বোঝা যায় আরামে ঘুমোচ্ছিল।
—এখন ফিরলে যে! তোমার না সন্ধেয় ফেরার কথা!
—কেন? বৃষ্টি খরখর করে উঠল, —আমি এলাম বলে তোমার ঘুমের ডিসটার্ব হল?
কাঁচা ঘুম ভাঙা বিরক্তিতে সুধা বলল, —আমার আবার ডিসটাব্। হুকুমের বাঁদি ফরমাশ মত খাবার দেব, বাসন মাজব, বাজার করব, দরজা খুলব .. আমি কথা বলার কে? তোমার মা খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে গেল বলে একটু যা গড়িয়েছিলাম …
বৃষ্টি আরও রুক্ষ হল, —সরো তো। লেকচার মেরো না।
নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় ব্যাগ আছড়ে ফেলেছে। এখনও রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বিড়বিড় করল, আমি পাগল? আমি পাগল? বৃথাই জানলার গরাদটাকে বাঁকানোর চেষ্টা করল কয়েকবার। ওয়াকম্যানে সজোরে লাথি মারল। সব ভেঙে দেবে। সব। দরজা খোলা রেখেই সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিস্ফল আক্রোশে দেখছে পুরু গরাদটাকে।
—কি ব্যাপার! তুই সিগারেট খাচ্ছিস!
বৃষ্টি চমকে তাকাল। ভালমামা হুইল চেয়ারে দরজায়।
বাবলু আবার বলল, —তুই সিগারেট ধরলি কবে থেকে!
বৃষ্টি কাঁধ ঝাঁকাল, —ধরলাম।
—তোর আস্পর্ধা তো কম নয়!
—আস্পর্ধার কি আছে? বৃষ্টির গলা শীতল, —সিগারেট খাওয়া কি ক্রাইম নাকি? অনেকেই খায়। আমিও খাই।
বৃষ্টির মধ্যে আর কোন লুকোছাপা নেই। বাবলু হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
বৃষ্টি মুখ ঘুরিয়ে নিল।
.
০৮.
মেয়েটাকে অনেকক্ষণ আগেই দেখতে পেয়েছিল সায়নদীপ। মেডিকেল কলেজের উল্টো ফুটপাথ ধরে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে। এত অন্যমনস্ক যে আচমকা কেউ সামনে এসে পড়লে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ছে, ঠিক করতে পারছে না কোন পাশে সরে জায়গা করে দেবে সামনের পথচারীকে। দু হাত বুকের কাছে জড়ো, হালকা নীল শৌখিন শাল আষ্টেপৃষ্টে জড়ানো। শালের নিচ দিয়ে কাঁধ থেকে ঝোলা ব্যাগ প্রায় কামিজের ঝুল বরাবর নেমে এসেছে, দুলছে হাঁটার তালে তালে। প্রত্যেকটি মানুষেরই হাঁটার নিজস্ব ছন্দ আছে। চরিত্রও। বৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে এইমাত্র যে মেয়েটি ভিড়ের মাঝখান দিয়ে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে চলে গেল, তাকে দেখেই বোঝা যায় সমস্ত রকম প্রতিকূল পরিস্থিতি সে কাটিয়ে চলে যেতে পারবে। কিন্তু এই মেয়েটা কেমন!
মেডিকেল কলেজের সামনে এসে মেয়েটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রাস্তার মাঝখানে বড়সড় একটা ভিড়। ভিড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে এক দেহাতী বউ হাউ-হাউ করে কাঁদছে আর দুর্বোধ্য ভাষায় হাসপাতালের দিকে আঙুল দেখিয়ে কিছু বলতে চাইছে, মাঝে মাঝে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। সন্ধের দিকে এমনিতেই এ অঞ্চলে বেজায় ভিড় থাকে। টুকটাক উপলক্ষ এসে গেলে আরও বেশি ভিড় জমে যায়। যেন দল বেঁধে সব চিড়িয়াখানায় মজা দেখছে। হাসপাতালই এ শহরের শ্রেষ্ঠ চিড়িয়াখানা।
মোড়ের ট্র্যাফিক পুলিশটা বেশ কয়েক মিনিট পর এগিয়ে এল,—কি হচ্ছে কি এখানে, অ্যাঁ? রাস্তা জ্যাম করে ঝামেলা? হল্লা করতে হয় ফুটপাথে যাও।
এক এক করে লোক সরতে শুরু করেছে। মেয়েটাও হাঁটতে শুরু করেছিল, সেই সময়েই চোখাচোখি হয়ে গেল সায়নদীপের সঙ্গে।
মাঝে মাঝেই মেয়েটাকে এখানে ওখানে চোখে পড়ে যায় সায়নদীপের। আলাপের পর দু-একবার দূর থেকে দেখে হাতও নেড়েছে। মুখে হাসির আভাস ফুটলেও কাছে যেতেই মেয়েটা বদলে গেছে। সায়নকে এগোতে দেখলেই রোদচশমার আড়ালে লুকিয়ে ফেলেছে নিজেকে। কোন দিন সায়ন বলেছে,
—হাই। কলেজ?
—হুঁ।
মেয়েটা হয়ত মুখ ঘুরিয়ে বাস আসছে কি না দেখার চেষ্টা করেছে কিংবা একমনে তাকিয়ে থেকেছে বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং-এর দিকে।
—তুমি কি আমার সঙ্গে কথা বলা পছন্দ করছ না?
বৃষ্টির মুখে স্পষ্ট অসন্তোষ।
আবার কোন দিন নিজেই যেচে ডেকেছে সায়নকে,
—জাসুসের মত আমার পেছন পেছন ঘোরো কেন বলো তো? কি মতলব তোমার?
—মতলবের কি আছে? খেলার পর ও-পাড়ায় আমরা দল বেঁধে সরবত খেতে যাই, তখনই তোমাকে দু-চার দিন চোখে পড়েছিল। তাই ভেবেছিলাম বলে তোমাকে চমকে দিই।
—ঢপ মেরো না। ডেফিনিটলি এ তোমার রোমিও কোচের টিপস্।
সায়ন এ সব কথায় ভারী অসহায় বোধ করে।
কখনও বা বৃষ্টি আরও কাছে এগিয়ে আসে,
—তোমার হেভি কৌতূহল না? আমার সম্পর্কে?
সায়ন থতমত।
—কৌতূহলী বেড়ালের কি হয়েছিল জান?
—না তো।
—নেক্সট দিন কথা বলার আগে জেনে আসবে।
সেই মেয়েটাই অবাক চোখে দেখছে সায়নকে! সায়ন যেচে কথা বলবে কি না ভাবল। আজ তার মা সঙ্গে রয়েছে। যদি মেয়েটা মার সামনে উল্টোপাল্টা কিছু বলে দেয়!
বৃষ্টি নিজেই এগিয়ে এল,—তুমি এদিকেও!
সায়ন চোখের ইশারায় দেখাল, মা।
মা সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে ছোট মামিমার সঙ্গে কথা বলছে। জিজ্ঞাসা করবে না ভেবেও সায়ন প্রশ্ন করে ফেলল,
—কলেজ থেকে?
বৃষ্টি ঘাড় নাড়ল।
—এত দেরি! ছ’টা তো প্রায় বাজে!
—খেলা করছিলাম। ডাংগুলি। বৃষ্টি ঠোঁট টিপে হাসল। বলেই সচেতন হয়েছে,—তোমরা এখানে কেন? হসপিটালে?
—আজ সকালে আমার এক মামার সেরিব্রাল হয়েছে।
সায়নের মামিমা হাসপাতালের ভেতরে চলে গেলেন। করবী ছেলের দিকে এগিয়ে আসছে। বৃষ্টিকে দেখে থমকাল সামান্য।
সায়ন বলল,—মা, একে চেনো তো? আমাদের পাড়ার বৃষ্টি। টিপ টিপ করে পড়া নয়, মুষলধারে পড়া।
করবী মৃদু হাসল,—চিনব না কেন? দেখেছি তো ওকে। তুমি কি এত দূরে কলেজে আসো?
—হুঁ। বৃষ্টি চকিতে ভদ্র-সভ্য, —আপনার ভাই এখন কেমন আছেন?
—ভাই না। মামাতো দাদা। বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে বলছে কিছু নাকি বোঝা যাবে না। তোর কিরকম মনে হল রে বুবলু?
—মনে তো হল মার্জিনালি বেটার। কিছুটা ব্লিডিং হয়ে গেছে তো। তবে বাঁ দিকটা বোধহয়…
—আমার থেকে মাত্র চার বছরের বড়। ভীষণ মারত আমাকে ছোটবেলায়। এখন কি অসহায় শিশুর মত অবস্থা!
করবীর স্বরে বিষণ্ণতা। সায়ন বৃষ্টি নিশ্চুপ। মিনিটখানেক পর বৃষ্টি বলল,—আমি চলি। আপনারা ব্যস্ত রয়েছেন।
—না, না, আমরাও ফিরব এখন। তুমিও তো বাড়ি ফিরছ, চলো আমাদের সঙ্গে।
সায়ন লক্ষ করল মার কথায় বৃষ্টি বেশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। দেখেই বোঝা যায় এক্ষুনি বাড়ি ফেরার তার একটুও ইচ্ছে নেই।
—এই বুবলু একটা ট্যাক্সি দ্যাখ্ না।
সায়ন বৃষ্টিকে আড়চোখে আরেক প্রস্থ দেখে নিল,—তোমরা দাঁড়াও। আমি এমারজেন্সির সামনে থেকে ধরে আনছি।
ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে সায়ন ঘাড় ঘুরিয়ে বৃষ্টিকে প্রশ্ন করল,
—তোমার অন্য কোথাও যাওয়ার ছিল নাকি?
—তেমন কিছু না। এক বন্ধুর বাড়ি যাব ভাবছিলাম।
—কোন্ দিকে? পথে পড়বে? তা হলে নামিয়ে দিতে পারি।
—না, সে অন্যদিকে। লেক গার্ডেন্সে।
—ও। সায়ন হাল্কা নিশ্বাস ছাড়ল।
—তোমার মামার সঙ্গে আলাপ হল সেদিন, বারান্দায় বসে ছিলেন, পিকলু কান্নানকে ডেকে কথা বলছিলেন, তখন।
নিমেষের আলোয় সায়নদীপ দেখল বৃষ্টির মুখে বাঁকা হাসি। যেন জানতে চাইছে ছেলেটা এবার কি এক পা এক পা করে এগোচ্ছে তার বাড়ির দিকে! হাল্কা গলায় জিজ্ঞাসা করে উঠল,
—তোমার প্র্যাকটিস কি বন্ধ এখন? দৌড়-টৌড় চলছে না?
সায়ন হেসে ফেলল, —কেন? তুমি বুঝি আর ভোরবেলা ওঠো না? আমি এখন এক দিন করে পার্কে দৌড়ই। শনিবার। তাও খেলা না থাকলে।
—ওই ব্যাগ নিয়েই?
—না। এমনিই। ওটা সিজনের প্রথম দিক ছিল। মিড সিজনে এখন হাল্কা কিছু ব্যায়াম, প্র্যাকটিস, দৌড়ঝাঁপ ব্যস।
করবী এতক্ষণ জানলার বাইরে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পর কথা বলল,
—তোমার মা-ই তো বিখ্যাত শিল্পী জয়া রায়, না?
—হুঁ।
—সেদিন কি একটা কাগজে তোমার মা’র ইন্টারভিউ দেখছিলাম…কী গুণী তোমার মা।
বৃষ্টি ঝট করে জানলার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল। সায়ন বুঝতে পারল এ আলোচনা ঠিক পছন্দ করছে না মেয়েটা। সোজা হয়ে বসল সায়ন। বৃষ্টির মায়ের মুখটা মনে পড়ল তার। সায়নের মার সঙ্গে কতই বা তফাত হবে বয়সের? নিশ্চয়ই চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হবেন। তবু এখনও মুখ কত মসৃণ। চকচকে। কমনীয়। সে তুলনায় তার মার মুখে অনেক বেশি ক্লান্তির ছাপ। চোখের নীচে ঘন কালি, কপালের দিকের চুল সবই প্রায় সাদা। রেয়ার ভিউ মিরারে মাকে দেখার চেষ্টা করছিল সায়ন। ঝাপসা। কি তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে গেল মা! মাত্র সাত বছরের মধ্যে! বুড়িয়ে গেল? না ফুরিয়ে গেল? ফুরিয়েই গেল।
ভয়ঙ্কর দুর্যোগের আঘাতে এভাবেই বোধহয় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায় কেউ কেউ। আবার অনেকে দুর্যোগ থেকে শিক্ষা নিয়েই নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। বালির ঝড়ের ভয়ে আতঙ্কিত মরুভূমির ইঁদুরের মত তারা গর্ত খুঁড়ে মাটির তলায় ঢুকে নিরাপত্তা খোঁজে না। উটের মত কষ্টসহিষ্ণু হতে শেখে। পরিশ্রমীও।
বাবার মৃত্যুর পর সায়ন তিলে তিলে নিজেকে নিজের মত করে গড়ে তুলছে। গোটা দিনটাকেই নিয়মের ছন্দে বেঁধে রাখে সে।
খুব ভোরে বিছানা ছাড়া সায়নদীপের বহুদিনের অভ্যাস। ছোটবেলায় সকালে উঠে চিৎকার করে পড়া মুখস্থ করত। তার বাবা বলত,
—ভোরবেলা মস্তিষ্ক তাজা থাকে বুবলু। গ্রহণক্ষমতা অনেক বেশি বৃদ্ধি। পায়।
খেলাধুলোয় নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়ার সময়ও সে কথা ভোলেনি সায়ন। ক্রীড়ানুশীলনেরও শ্রেষ্ঠ সময় এই সকাল। ভোর হলেই ট্র্যাকস্যুট পরে, কাঁধে কিটসব্যাগ ঝুলিয়ে ট্রামে উঠে পড়ে সে। ক্লাবে প্র্যাকটিস না থাকলে সামনের পার্কটা তো রয়েছেই।
সকালের শুরুতে ফাঁকা ট্রামে চেপে ময়দানের দিকে এগোতে ভারী ভাল লাগে সায়নদীপের। মনে হয় একটা সরীসৃপ বহন করে নিয়ে চলেছে তাকে। তারই শরীরের ফাঁকফোকর দিয়ে, আধফোটা সকালকে দেখতে দেখতে, সে পৌঁছে যায় তার তীর্থক্ষেত্রে। বিশেষ করে সিজনের কয়েকটা মাস, অক্টোবর থেকে মার্চ, বিশেষ ব্যত্যয় হয় না।
গত বছর থেকে সায়ন খুব আশা জাগিয়েছে তার কোচের মনে। ছেলেটার মধ্যে প্রচণ্ড জেদ আছে। হার না মানার জেদ। পরিশ্রমে ক্লান্ত না হওয়ার জেদ। ভাল পেডিগ্রির রেসের ঘোড়ার মত ট্রেনারের সব হুকুম নিঃশব্দে তামিল করে যায় ছেলেটা।
সায়ন তার কোচ ঝন্টুদার কথামত টেন্টে এসেই প্রথমে জগ করে। তারপর কিছুটা স্প্রিন্ট টানে। তারপর ধীরে ধীরে দৌড়য়। আবার স্প্রিন্ট টানে। তারপর কুকুরের মত জিভ বার করে কিছুক্ষণ হাঁপায়। আবার দৌড়য়। আবার দৌড়য়। আবার। রজার ব্যানিস্টারের কথা ভীষণভাবে মেনে চলে সে। নিজেই নিজেকে বলে,
শরীরের ক্ষমতাটাকে স্ট্রেচ করো। শরীর সব সইতে পারে যদি মনের সাহায্য পায়।
এই রকম খাটুনির পর প্যাড গ্লাভস চড়িয়ে এসে নেটের উইকেটের সামনে দাঁড়ায় সায়ন। দলজিৎ ছুটে আসে বল করতে। কখনও অন্তু, রবীন। সায়ন প্রত্যেকটি বল খুব মন দিয়ে খেলে। যেন নেট আউট হওয়ার ওপরেই তার জীবন মরণ নির্ভর করছে। এই গুণের জন্য সায়নকে নেটে বল করে আরাম পায় ক্লাবের সকলে।
দলজিৎ বলে,
—তুমি সব সময় এত সিরিয়াস থাকতে পারো কি করে বলো তো? প্রত্যেকটা বল ম্যাচের মত করে খেলো?
সায়নের উত্তর বড় অদ্ভুত লাগে তাদের, —আমার কাছে প্র্যাকটিসটাই আসল ম্যাচ। এই সময় যদি পুরো কনসেনট্রেশন আনতে পারি, তা হলে ম্যাচে প্র্যাকটিসের মতই হালকা লাগবে। মনযোগের জন্য ছটফট করতে হবে না।
নেটে বল ছাড়া সত্যিই আর সায়ন কিছু দেখে না। কানের কাছে ক্রমাগত শুধু ভেসে আসা কথাগুলোই শুনতে পায়। হাত পায়ের নড়াচড়া শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করে সেইমত।
…বাঁ পা-টা এগোও। একটু আড়াআড়ি। হ্যাঁ, এইভাবে। …কোন সময়…উহু, ব্যাটটা আরও পরে আসবে। একটু পরে। না। আরও আস্তে। লেটে খেললে জোর পাবি বেশি। টাইমিংটাই আসল।
সায়ন জানে এখন তার নিজেকে গড়ার সময়। এখন শুধু শুনতে হয়। মা’র কথা, কোচের কথা, বন্ধুদের কথা, গুরুজনদের কথা। শেষ পর্যন্ত কোন কথাদের সে অন্তরে রাখবে সেটা সে ঠিক করবে। কিন্তু মন দিয়ে শোনাটা বড় জরুরি।
প্র্যাকটিস শেষ হলে পেটের মধ্যে ক্ষিদেটা চনচন করে ওঠে। সায়ন তখন তাদের লনের সামনে এসে প্যাড খুলতে খুলতে চেঁচায়,
—শম্ভুদা…
ক্যান্টিনের মালিক শম্ভু হাঁক শুনলেই কাঁচা পাঁউরুটিতে মাখন মাখাতে আরম্ভ করে। ক্যান্টিনের ছেলেটা এসে স্ট্যু পাঁউরুটি রেখে যায় সামনে। মোহন দলজিৎ রবীন মাঝে মাঝেই চোখ টেপে তাদের ক্লাবের ক্রিকেট সেক্রেটারি গোপালদাকে। গোপালও তাদের তালে তাল মিলিয়ে ঠাট্টা করে ওঠেন,—কি চাষাড়ে হ্যাবিট রে তোর! স্টুতে কাঁচা রুটি ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাস! তুই তো নাম করে গেলে মুড়ি দিয়ে শ্যাম্পেন খাবি রে!
সায়ন হাসে। সবাই কি আর একরকম হয়! যে কোনো একটা ঘাসের মাঠের ওপর দিয়ে গেলেই তার যে মনে হয় কোনো ক্রিকেট পিচের ওপর দিয়ে হাঁটছে, এ অনুভূতি কি অন্যের হয়! ভোরবেলা মা যখন ডেকে দেয় তাকে, তখন ঘুমচোখে বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে গিয়ে মনে হয়, সে নয়, অন্য একটা লোক আয়নায় দাঁড়িয়ে আছে, তার সাদা সোয়েটারে নীল ভি বর্ডার, মাথার ক্যাপে ন্যাশনাল এমব্লেম, এই প্লেয়ারটাকে আর কেউ দেখতে পায় কি? পরিশ্রমের পর খেয়ে-দেয়ে সায়নের শরীরটা বেশ তাজা লাগে। এরপর একে একে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় ক্লাবের সবাই। কেউ কেউ উৰ্দ্ধশ্বাসে দৌড়োয়। বাড়ি গিয়ে তাদের অফিস ছুটতে হবে কিংবা কলেজ। বি. কম পাশ করার পর সায়ন আর পড়াশুনো করেনি। তার পড়াশুনোর জগৎ ভিন্ন।
খেলা না থাকলে প্র্যাকটিস থেকে ফিরে একা একাই সায়ন স্নান-খাওয়া সেরে নেয়। করবী অফিস বেরিয়ে যায় সাড়ে নটার মধ্যেই। স্বামীর মৃত্যুর পর সহানুভূতি দেখিয়ে, দয়া দেখিয়ে তাকে একটা ছোট চাকরি দিয়েছিল সরকার। কাজ থেকে ফিরতে তার সেই সন্ধে। সারা দুপুর সায়ন একা বাড়িতে বসে নিজের পড়াশুনো করে। তার বেশির ভাগ বই-ই খেলাধুলা সংক্রান্ত। প্রায় দুপুরেই ক্যাসেট চালিয়ে একই খেলা বার বার দেখে সে। গাভাস্করের কোনো বিশেষ ইনিংস, রিচার্ডস-এর কোনো চোখ ঝলসানো সেঞ্চুরি বা গ্রেগ চ্যাপেলের রাজসিক ব্যাটিং। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই খেলা। একই দৃশ্য। বারবার। স্লো-মোশনে। রিপ্লে করে। স্টিল করে। তাকে আরও নিখুঁত হতে হবে। এটাই তার এখনকার পড়াশুনো।
সারা দুপুর পড়াশুনো করে মস্তিষ্কে একটা ঝিমধরা ভাব আসে। মাথা ছাড়াতে সায়ন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়, পার্কে গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করে। এ সময়টাই তার একমাত্র অবসর। বন্ধুরা নানান তর্কে গলা ফাটায়। এখন ইরাক আমেরিকার যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে সকলেই উত্তেজিত। যুদ্ধ বা মৃত্যুর আলোচনা সায়নকে একটুও টানে না। সে নীরবে দেখে দূরের রাস্তাঘাট, মানুষজন। চৌরাস্তার মোড়ে জীর্ণ সালোয়ার কামিজ পরা এক বুড়ি পাগলি সারাদিন ধরে ট্রাফিক কনট্রোল করার চেষ্টা করে, কেউ তাকে মানে না, তবু সে নিজের মনে কাজ করে যায়, যেন কলকাতার সমস্ত অবাধ্য যানবাহনকে বশে রাখার জন্যই তার জন্ম হয়েছিল। সায়ন একদৃষ্টে পাগলিটাকে দেখে।
এসব সময়, কখনও কখনও, বৃষ্টিকেও চোখে পড়ে সায়নের। কখনও কখনই। তখন বৃষ্টির হাঁটাচলা অন্যরকম। অশান্ত। যেন চাপা উত্তেজনায় টান টান। আবার এই মেয়েকেই বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা হলের সামনে দেখেছিল ভেলপুরি খেতে খেতে হি-হি করে প্রাণ খুলে হাসতে। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে রাস্তায়। তখন মনে হয়েছিল এই মেয়ের নাম বৃষ্টি মানায় না, ওর নাম হওয়া উচিত রোদ্দুর। শীতের রোদ্দুর।
সায়ন পিছন ফিরে বৃষ্টিকে দেখল। নিরীহ মেয়ের মত জড়োসড়ো বসে আছে। পাশে তার মা-ও নীরব। দু’জনের মুখ দু জানলায়।
বৃষ্টির শান্ত ভঙ্গি রহস্যময় লাগল সায়নের। বাসস্টপে রোদচশমার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টি, সিনেমা হলের সামনে উচ্ছল হাসিতে ভেঙে পড়া বৃষ্টি, ট্যাক্সির পিছনের সিটে আড়ষ্ট বসে থাকা বৃষ্টি, কোনটা ওই মেয়ের আসল রূপ? নাকি অন্য কোন বৃষ্টি লুকিয়ে আছে এইসব ছদ্মবেশের আড়ালে?
সায়নদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামতেই বৃষ্টি আগে দরজা খুলে নেমে গেল,
—থ্যাংক ইউ মাসিমা। অন্য দিন ফেরার সময় যেরকম ভিড়ের মধ্যে উঠতে হয়।
—যা বলেছ। ফেরার পর শরীরে আর কিছুই থাকে না। এসো না আমাদের বাড়িতে। একটু চা-টা খেয়ে যাবে।
বৃষ্টি ইতস্তত করল,—না, আজ নয়, অন্য এক দিন। আপনি বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন। আপনাকে খুব টায়ার্ড লাগছে।
করবী জোর করল না। সায়ন মনে মনে ধন্যবাদ দিল বৃষ্টিকে। মা সন্ধের সময় একা থাকতেই ভালবাসে আজকাল।
সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে উঠছে করবী। সায়নও। চারতলার ফ্ল্যাটে উঠতে করবী বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সায়ন ওঠে জগিং করতে করতে।
ঘরে ঢুকেই সামনের সোফায় বসে করবী কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিল। সায়ন বলল,—দেখেছ তো, কেন বলেছিলাম চারতলার ফ্ল্যাট নেওয়াটা উচিত হয়নি? এর পর আরও বয়স বাড়বে, ধকলও বাড়বে।
করবী হাতের ইশারায় বলল, এক গ্লাস জল।
জল খাওয়ার পর ধাতস্থ হল একটু,
—সব কিছুই কি নিজের ইচ্ছেয় হয় রে? তোর দাদুর তো শুধু এই জমিটাই পড়ে ছিল। দাদা, সুনু, রেবা সবাই মিলে যা ঠিক করবে তাই তো হবে? জমির দাম বেশি দিয়েছে বলে প্রোমোটারও তো একটু ওপরের দিকেই ফ্ল্যাট দেবে। তাও বাবা একতলার থেকে ভাল। নীচে যা নোংরা! ধুলো!
সায়ন চুপ করে গেল। মা-ই শুধু ফ্ল্যাট নিয়েছে। মাসিরা, মামারা জমি বিক্রির ক্যাশ। তাদের আছে অনেক। এই ধরনের ফ্ল্যাটে তাদের পোষাবেও না।
করবী হঠাৎ প্রশ্ন করল,—মেয়েটা খুব ঠাণ্ডা, তাই না?
মার কথাটা প্রথমে ঠিক বুঝতে পারল না সায়ন,—কোন মেয়েটা?
—ওই যে এল আমাদের সঙ্গে। বৃষ্টি।
—কখনও ঠাণ্ডা, কখনও গরম, এই বয়সে যা হয় আর কি।
করবী হেসে ফেলল,—তুই এই বয়স, এই বয়স বলছিস কেন? তুই কি বুড়ো নাকি?
সায়ন মাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল,—তুমিই বা এমন বুড়ি বুড়ি হয়ে থাকো কেন? শরীরে না পোষালে ক’দিন ছুটিও তো নিতে পারো। খাও, দাও, রেস্ট নাও…
সায়ন ভালভাবেই জানে মা শয্যাশায়ী না হওয়া পর্যন্ত ছুটি নেবে না।
করবী জামাকাপড় বদলাতে নিজের ঘরে উঠে গেল। দু ঘরের মাঝারি ফ্ল্যাট। সঙ্গে কিছুটা ড্রয়িংরুমের জায়গা। ডাইনিং স্পেসটা বেশ ছোট। একটা ফ্রিজ, চারটে চেয়ার আর ছোট ডিম্বাকৃতি খাবার টেবিলেই পুরো জায়গাটা ভরে গেছে।
করবী ঘর থেকে জিজ্ঞাসা করল,—চা খাবি নাকি? করব?
সায়ন ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেখান থেকেই বলল,—তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো। আমি করছি।
সায়ন যখন চা নিয়ে ঘরে ঢুকল, করবী শুয়েই ছিল। চোখ বন্ধ করে। মুখ একহাতে আড়াআড়ি ঢেকে। কাপ রাখতে গিয়ে সায়ন দেখল মার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।
—কি হল? আবার কান্নাকাটি কেন? ওঠো। উঠে বোসো। টুলুমামা ঠিক সামলে উঠবে।
করবী উঠে বসে চোখ মুছল,—উঠলেই ভাল।
—উঠবেই। টুলুমামার ভীষণ মনের জোর। একবার যদি সেই জোর দিয়ে চায় আমি সুস্থ হয়ে উঠব, তা হলে ঠিক উঠে দাঁড়াবে।
—সে কি আর সব জায়গায় হয়? শরীরের ওপর কি আর মানুষের হাত থাকে?
—নিশ্চয়ই থাকে। কত অ্যাথলিট তো মনের জোরে ক্যানসার উড়িয়ে দিচ্ছে। আর তুমিই তো বলতে টুলুদা চাইলে পারে না এমন কোনো কাজ নেই।
—তা ঠিক। তোর বাবাকে বিয়ে করার সময় তোর দাদু কম আপত্তি করেছিল? টুলুদাই তো বলে বুঝিয়ে…তখন টুলুদা না পাশে থাকলে…
এ গল্প মায়ের কাছে বহুবার শুনেছে সায়ন। শুনতে ভালও লাগে। কিন্তু এই মুহূর্তে অন্য ভয় পাচ্ছিল সে। টুলুমামার কথা বলতে বলতে মা বাবার প্রসঙ্গে যাবেই।
সায়ন কথা ঘোরাল,—ক্লাবে দু-চারটে চাকরির খবর আসছে, বন্ধুরা অনেকেই বলছে নিয়ে নিতে, কি করি বলো তো?
—তুই কি চাস?
—আমি খেলতে চাই। তবে চাকরিও তো দরকার।
—চাকরি করলে খেলার ক্ষতি হবে?
—তা তো একটু হবেই। সেজন্যই তো নিতে চাইছি না।
—দ্যাখ তুই যা ভাল বুঝিস…
সায়ন জানে মা কোনো ব্যাপারেই তার ওপর জোর করবে না। বাবা মারা যাওয়ার পর মা আমূল বদলে গেছে। মাঝে মাঝে সায়নের বিশ্বাসই হয় না। এই কি তার ছোটবেলায় দেখা দোর্দণ্ডপ্রতাপ মা! যার ভয়ে বাবা গুটিয়ে থাকত সব সময়! মার জন্য হঠাৎই বড় কষ্ট হল সায়নের। বুকের ভেতর একটা শুঁয়োপোকা নড়াচড়া করছে। নড়ছে। নড়ছে। নড়েই চলেছে।
গভীর অরণ্যে এক সন্ন্যাসী দস্যু রত্নাকরকে বলেছিলেন, ডাকাতি তো করছ; তোমার পাপের ভাগী কে হবে? বউ? ছেলে? মেয়ে? বাবা? মা? কেউ না। রত্নাকর যাচাই করতে গিয়ে দেখেছিল সেটাই সত্যি।
মিথ্যে কথা। পাপের ভাগ সবাইকেই নিতে হয় বৈকি। মা, বাবা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে। একথা সায়নের থেকে বেশি আর কে জানে। চোখের সামনে, নিজেরই মায়ের অন্তরে যে তীব্র অনুশোচনার দহন দেখছে এই সাত বছর ধরে সেটা কি পাপের অংশীদারী নয়? পাপ কি কারুর একার?
খালি কাপ ডিশ তুলে নিয়ে সায়ন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। পিছন থেকে করবীর স্বর,
—বুবলু, তুই আমায় নিয়ে চিন্তা করিস না। তুই চাকরি করতে চাইলে চাকরি কর, খেলতে চাস খ্যাল…আমি কোনো মত চাপাব না।
করবী যেন সায়নকে নয়, নিজেকেই শোনাতে চাইছে কথাগুলো।
কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না সায়ন।
মুহূর্ত পরে করবী হঠাৎই বলে উঠেছে,—তোর বাবার মুখটা তোর মনে পড়ে বুবলু?
সঙ্গে সঙ্গে সায়নের চোখের সামনে ঘরটা দুলে উঠল। সাদা চাদরে ঢাকা… একই মৃতদেহ। চাদর সরতেই একটা বীভৎস, নুন ছাল উঠে যাওয়া ক্ষতবিক্ষত মুখ।
সায়ন চোখ বুজে ফেলল।
.
০৯.
রোমিলা থাপারের বইটা ফেরত দিয়ে পরভিনের সঙ্গে লাইব্রেরি থেকে বেরোল বৃষ্টি! সকালে কলেজে আসার সময় বইটার দিকে তার নজর পড়েছিল। বেশ কয়েক দিন হল ফেরত দেওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে।
আজকাল বৃষ্টি দরকারি কাজগুলো বড় ভুলে যাচ্ছে। নবনীতার নিউ ইয়ারস গ্রিটিংস্ সাত-আট দিন হল এসেছে, এখনও উত্তর দেওয়া হয়ে উঠল না। সামান্য একটা কার্ড কিনে পোস্ট করা, তাও মনে থাকছে না। হপ্তা দুয়েক ধরে একটা বল্গাছাড়া বুনো রাগ তাকে আলটপ্কা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এই মাথা ঠাণ্ডা, হাসিমুখে কথা বলছে লোকের সঙ্গে, আবার এই মেজাজ আগুন বাড়িতে কারণে অকারণে মুখ করছে সুধাকে, বাবলুর সঙ্গেও দু দিন ঝগড়া হয়ে গেল, বাবলু তার সঙ্গে কথা বলছে না। ক্লাসে লেকচার শুনবার সময় সব সময় নিজেকে সুস্থিত রাখতে পারে না সে। কেন অমন মুর্খের মত কাজ করে ফেলেছিল সেদিন? কি দরকার ছিল তার ওভাবে বাবাকে ফোন করার? ভাবতে গেলেই বৃষ্টির প্রতিটি রোমকূপে অপমানের হুল ফুটতে থাকে। প্রতি পলে মনে হয় রীতা নামের মহিলাটিও নিশ্চয়ই সেদিন দাঁড়িয়েছিল বাবার পাশে, সুবীর যখন তাকে পাগল ভাবছিল নিশ্চয়ই মনে মনে হেসেছে, ভেবেছে, দ্যাখো মেয়ে ভাবে বাবা এখনও তার বাচ্চাবেলার কেনা গোলাম, হুকুম করলেই সুড়সুড় করে মেয়ের পিছন পিছন বেরিয়ে পড়বে! তা কি আর হয়! সুবীর এখন রীতার স্বামীই নয়, রাজার বাবাও বটে! মা ছেলের সেই টানের সঙ্গে এই ধিঙ্গি অসভ্য মেয়েটা পেরে উঠবে কেন?
বৃষ্টি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল,
—তুই যা। আমার ক্লাস করতে ভাল লাগছে না। তাছাড়া এ ডি আর তো ক্লাস নিতে আসেই না, মিছিমিছি পাস ক্লাসে গিয়ে বসে থাকা…
—আজকে যদি আসে? একদিন ক্লাসে না দেখলে গোটা বছর অ্যাবসেন্ট করে দিতে পারে। লাস্ট ইয়ারে সেকেন্ড ইয়ারের কয়েকজনকে নাকি করেছিল।
—মামদোবাজি নাকি? নিজে সারা বছর গুলতানি মেরে বেড়াবে, ক্লাস নিতে আসবে না…
—গুলতানি কি বলছিস্ রে? পার্টির কাজ করে বেড়ান…
—পার্টি করে বলে মাথা কিনে নিয়েছে নাকি? গভর্নমেন্ট থেকে কি ওকে মুখ দেখানোর জন্য মাইনে দেয়? আমি যাব না। দেখি কি করে আমাকে সারা বছর অ্যাবসেন্ট করে!
—আমি একবার যাই। রণজয়ও গেছে। ও বলছিল…
—ও। তুই তাহলে ক্লাস করার জন্য যাচ্ছিস্ না? বৃষ্টি হঠাৎই খুব নিষ্ঠুরভাবে বলে উঠল, —আহ্লাদীপনা করতে যাচ্ছিস্?
পরভিন আহত চোখে তাকাল বৃষ্টির দিকে। বৃষ্টি আজকাল এরকমই বিশ্রীভাবে কথা বলে।
উত্তর না দিয়ে পরভিন উঠে যাচ্ছিল, বৃষ্টি তার হাত ধরে টেনেছে, লঘু গলায় বলল— শোন্ শোন্, কি এত কথা থাকে রে তোদের?
—সেটা তোকে বলব কেন? পরভিন গম্ভীর।
বৃষ্টি পরভিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল,
—চুমু ফুমু খাচ্ছিস? গায়ে হাত ফাত দিচ্ছে?
পরভিন জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল,
—তুই আজকাল খুব ভালগার হয়ে গেছিস বৃষ্টি।
বৃষ্টির মুখ সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে গেছে,
—কথাগুলোই ভালগার? আর কাজগুলো খুব রোমান্টিক, তাই না?
জ্বলন্ত চোখ হেনে পরভিন দৌড়ে ওপরে উঠে গেল। বৃষ্টি নিজের মনে কাঁধ স্রাগ করল। পরভিনের এই সতী সতী ভাব সে একদম বরদাস্ত করতে পারে না। নীচে নেমে দেখল সামনের মাঠে দেবাদিত্য, শুভ আর বিক্রম দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ওদের পাস সাবজেক্ট আলাদা। বৃষ্টি ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেবাদিত্যকে বলল,
—তুই যে আজ বড় ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারছিস!
দেবাদিত্যের মুখে স্বভাবসুলভ হাসি, —কোথায়? তুই তো এসে গেছিস। পরভিন কোথায়? একটু আগে তোর সঙ্গে ঘুরছিল দেখলাম!
—পরভিনটা খুব খেপে গেছে। নিজেরই কপাল পোড়াচ্ছে।
—কে কার কপাল পোড়ায়! ওই দ্যাখ্, ওই ওদিকের থামটার আড়ালে…
—কে রে?
—কে আবার। অরিজিৎ। আজও ব্যাটা ড্রাগ নিয়ে ব্যোম হয়ে বসে আছে।
অরিজিৎকে দেখে বৃষ্টির বুক ছমছম করে উঠল। মাসখানেক হল অরিজিৎ ড্রাগ ধরেছে। হোস্টেলে গিয়ে মোটা পার্থদের সঙ্গে ব্রাউন সুগার নেয়।
বিক্রম বলল, —ওর বাবা মার কথাটা একবার ভাব। কি আদরের ছেলে। দিব্যি পড়াশুনো করছিল, লাইব্রেরি যাচ্ছিল…ওর বাবার উচিত ওকে ধরে আগাপাশতলা চাবকানো।
—কেন, চাবকাবে কেন? বৃষ্টি তখ্খুনি ঝন্ করে উঠেছে, —কোন্ রাইটে পেটাবে? কারণ ছাড়া কোন ফল হয় না।
শাল মহুয়ার জঙ্গলের অরিজিৎকে দেখতে পাচ্ছিল বৃষ্টি। কি অপূর্ব ধ্বনিময় কবিতা!
শুভ বলল, —ঠিক বলেছিস্। ওরও তো কোন মেন্টাল প্রবলেম থাকতে পারে।
বিক্রম বিজ্ঞের মত মুখ করল, —মেন্টাল প্রবলেম না কচু। ও সব অজুহাত। আসলে ক্যাপিটালিস্ট ব্লকের দেখাদেখি থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলোতেও এসব ভাইস্ ঢুকেছে।
—থাম্ তো। শুভ ফস্ করে সিগারেট ধরাল, —লেকচার দিস না। ড্রাগ নেওয়া উচিত নয়, ঠিক আছে, মেনে নিলাম উচিত নয়। তবে উচিত তো অনেক কিছুই নয়। কটা উচিত হয় রে? মাস্টারদের ক্লাসে ফাঁকি দেওয়া উচিত নয়, ছাত্রদের পড়াশুনো না করে গুণ্ডাবাজি করা উচিত নয়, গভর্নমেন্টের লোকেদের অফিসে ঘুমোনো উচিত নয়, ঘুষ খাওয়া উচিত নয়, প্রাইভেট কোম্পানির লোকেদের দুনম্বরী করা উচিত নয়, ব্যবসায়ীদের বাটপার হওয়া উচিত নয়, ভোটের আগে লিডারদের ঝুড়ি ঝুড়ি গুল মারা উচিত নয়, এই তোদের সুদেষ্ণার কথায় কথায় নোটের গরম দেখানো উচিত নয়…
—এর মধ্যে আবার সুদেষ্ণাকে আনছিস্ কেন? বেশ তো লিস্ট তৈরি করছিলি…
শুভ বাধা পেয়ে বিরক্ত হয়েছে। কটমট করে তাকাল দেবাদিত্যর দিকে, —তোর গায়ে লেগে গেল বুঝি? নেতারহাট যাওয়ার সময় তোকে কত টাকা দিয়েছিল রে সুদেষ্ণা? তিন শ? না পুরোটাই?
—তুই জানলি কি করে? কে বলেছে?
—কে বলবে আবার। সুদেষ্ণাই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে। তুই কি ভেবেছিলি তোকে টাকা দিয়ে সুদেষ্ণা সেটা গোপন রাখবে? হারামের পয়সা বিলোচ্ছে…
দেবাদিত্যর মুখটা করুণ হয়ে গেল।
বিক্রম বলল, —হারামের পয়সা বলছিস্ কেন? ওর বাবা কত বড় ডাক্তার জানিস? ওর বাবার ফি জানিস?
—ডাক্তার মারাস্ না তো। ওরকম অনেক ডাক্তারের ইনকাম ট্যাক্স ফাইল আমার বাবার কাছে আসে। ওদের দুনম্বরী পয়সা রগড়েই তো আমার বাবার পেট চলে। নিউ আলিপুরে সুদেষ্ণার বাবা কত বড় একটা নার্সিংহোম খুলেছে জানিস্? রুগীদের গলা মুচড়ে রোজগার। আঙুল গুনে বল্ তো নার্সিংহোমগুলোতে কটা নরমাল ডেলিভারি হয়, আর কটা সিজারিয়ান?
শুভ গাঁক গাঁক করে চেচাচ্ছে। বৃষ্টির খুব মনঃপূত হল কথাগুলো,
—যা বলেছিস। যেদিকে তাকাবি সব শালা চোর, ঘুষখোর। টপ টু বটম। খালি নিজেদের সুখ শান্তি খুঁজছে। করাপ্ট্, সেলফ্ সেন্টারড্…
—আমার ছোট কাকা নকশাল মুভমেন্টের সময় গুলি খেয়ে মরে গেল। ঠিক হোক, ভুল হোক, একটা কিছুর জন্য তো মরেছিল? সেই লোকটার কথা এখন আমাদের বাড়িতে কেউ ভুলেও উচ্চারণ করে না। আমার দাদু ঠাকুমার কাছে পর্যন্ত সেই ছেলে হল বোকার হদ্দ আর বুদ্ধিমান হচ্ছে আমার ঘুষখোর বাবা।
দেবাদিত্য শুভকে বলল,—তুই কি রে? সারাক্ষণ নিজের বাবাকে গালাগাল করিস কেন? সবার সামনে? ছিঃ।
বিক্রম বলল, —তুই নিজে কি? বাপের পয়সায় টুকটাক মাল খেয়ে বেড়াচ্ছিস, ফুর্তি মারছিস…
শুভ খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল,—প্রথমত, আমি বাপের পয়সায় মাল খাই না, বাবার বোতল থেকে খাই। দ্বিতীয়ত, বাবার পয়সায় আমার একটা ন্যায্য অধিকার আছে, সেটুকু আমি নিতেই পারি।
দেবাদিত্য বলল, —তোকে দেখলে আমার ভয় করে রে শুভ। তুই যখন বড় হয়ে চাকরি বাকরি করবি, বিয়ে থা করবি, তখন যে তুই কি জিনিসে পরিণত হবি…
—কিসে পরিণত হব? এ পারফেক্ট নাটবল্টু টু দিস্ মডার্ন সোসাইটি। মোটা মাইনের চাকরি জোগাড় করব কম্পিটিটিভ্ পরীক্ষা টরীক্ষা দিয়ে, তারপর এনরমাস ঘুষ নেব, প্রমত্ত হুড়োহুড়ি করব, যাকে বলে ফুল এনজয়মেন্ট অফ লাইফ ইন এভ্রি সেন্স, তারপর পঞ্চাশের পর থেকে প্রেশার আর সুগারের ওষুধ, ষাটে অক্কা। ততদিনে আমার ছেলেও একটা পারফেক্ট আমি তৈরি হয়ে যাবে।
দেবাদিত্য হাত ওল্টালো।
বৃষ্টি চুপ করে বন্ধুদের কথা শুনছিল। নাহ্। এরা সবাই তার সাময়িক সঙ্গী হতে পারে মাত্র; বন্ধু নয়। এদের সকলের স্বভাবেই কোন না কোন রকম হ্যাংলামি রয়েছে। দেবাদিত্যর মধ্যেও। ঠাট্টার মোড়কে হ্যাংলামিকে ঢেকে রাখতে চাইলেও মাঝে মাঝে এমন প্রকট হয়ে পড়ে! অভাব থেকেই হয়ত ওর এই অভ্যাসটার জন্ম হয়েছে। নিজেরই অবচেতনায়। নাকি বৃষ্টিরই ভুল? বিক্রম, রণজয়, শুভদের মতো স্পষ্টভাবে দেবাদিত্যকে পড়তে পারে না বৃষ্টি।
সূর্য দূরে ইকনমিকস্ বিল্ডিং-এর মাথায় নেমে এসেছে। থেকে থেকেই দৌড়ে আসছে হিমেল হাওয়া। গঙ্গাসাগরের বাতাস। বৃষ্টি ভাল করে গলায় স্কার্ফ জড়িয়ে নিল। পরশু থেকে জোর কাশি হয়েছে। ঘরে ফিরে রাতে ফ্যান চালিয়েছিল। সেই জন্যই কি?
কাল রাত্রে বৃষ্টির ঘঙঘঙ কাশি শুনে মা এসে একবার দাঁড়িয়েছিল দরজায়। কোন কথাও বলেনি, কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে চলে গেল। সুধামাসি বলছিল, কয়েক দিনের জন্য নাকি শান্তিনিকেতন যেতে পারে। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এক্সকারশান্। যেখানে খুশি যাক, বৃষ্টির তাতে কি?
বৃষ্টি শুভকে বলল, —কিরে, যাবি তো?
—তুই কোথায় যাচ্ছিস? বাড়ি?
—দূর, এত তাড়াতাড়ি কি বাড়ি ফিরব? চল্, একটা সিনেমায় যাই।
শুভ দেবাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করল, —যাবি আমাদের সঙ্গে?
দেবাদিত্য এড়িয়ে গেল, —তোরা যা। আমার হোস্টেলে কাজ আছে।
শুভ আর বৃষ্টি কলেজের বাইরে বেরিয়ে এল। কদিন ধরে বেশ কনকনে শীত পড়েছে। বেলাও তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে আসে এখন।
শুভ বৃষ্টিকে আঙুল তুলে দেখাল, —ওই দ্যাখ্। বড়লোকের বেটি বই দর করছে।
বৃষ্টি দেখার আগেই সুদেষ্ণা দেখতে পেয়েছে বৃষ্টিকে, —অ্যাই বৃষ্টি দেখে যা, বইটার কি দাম চাইছে!
শুভ নিচু গলায় বলল, —যেতে হবে না। বল্ কাজ আছে।
শুভর ছেলেমানুষি দেখে বৃষ্টি হেসে ফেলল, —দাঁড়া না, দেখি কি করছে।
—তুই যা, আমি সিগারেট কিনছি।
—আমার জন্যও এক প্যাকেট নিস্।
সুদেষ্ণার হাতে ফ্রেঞ্চ কুকিং রেসিপির বই। ইদানীং সুদেষ্ণার রান্নাবান্নার বইতে খুব আগ্রহ হয়েছে। গ্রন্থমেলা থেকেও তিন-চারটে রান্নার বই কিনেছিল। বিয়ের পর জয়ন্তকে খাওয়ানোর রিহার্সাল দিচ্ছে। ন্যাকা ন্যাকা কাণ্ড যত। রান্নাবান্নার ব্যাপারে বৃষ্টি মোটেই উৎসাহী নয়। তবু বইটা দু-চার পাতা ওল্টালো,
—কত চাইছে?
—সেভেনটি। আমি তিরিশ বলেছি।
—একটা ছুরি গলায় বসায়ে দ্যান দিদি, তবু পারব না। মা সরস্বতীর দিব্যি, পঞ্চাশে কেনা। আপনাদের দিতে পারলে আমারই তো ভাল লাগে। একটু যদি কাজে লাগতে পারি…
দোকানদার ছেলেটি যথেষ্ট সপ্রতিভ। বই বিক্রির চেয়ে সুন্দরী ক্রেতার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়াতেই বেশি আনন্দ তার।
—থাক তাহলে। সুদেষ্ণা সরে এল দোকান থেকে।
শ্যাওলা-সবুজ চাদর জড়ানো ছেলেটা শেষবারের মত মরিয়া চেষ্টা করল,
—দিদি, লাস্ট দর পঞ্চান্ন, কোথাও আপনি এই বই এক পয়সা কমে পেলে আমার গলায় গামছা দিয়ে টাকা আদায় করে নেবেন।
—আমি থার্টির বেশি এক পয়সা দেব না।
বৃষ্টি তরলভাবে বলল, —নিয়ে নিলেই পারতিস্। অনেকগুলো চিংড়ির প্রিপারেশান ছিল দেখলাম। তোর পাইলট প্রন্ খেতে ভালবাসে বলছিলি না?
—নারে, জানিস না, এরা আমাকে চান্স পেলেই চিট্ করে। সেদিন মোঘল ল্যান্ড রেভেনিউ সিস্টেমের ওপর একটা বই কিনলাম, ওটা রণজয় আমার থেকে আট টাকা কমে কিনেছে।
শুভ কখন পায়ে পায়ে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে,
—কিরে, কিনলি না যে? দরে বনল না বুঝি?
—নাহ্। অনেক বেশি চাইছে।
—কত বেশি? তোর একদিনের গাড়ির তেলের খরচার থেকেও?
সুদেষ্ণা ভ্রূকুটি করল। তারপর বৃষ্টির দিকে ফিরে, কাঁধের ব্যাগ দোলাতে দোলাতে বলল, —কোথায় যাচ্ছিস? চল্ না একটু কফি হাউসে যাই। সুনীতা ওখানে একটা জাপানি ছেলেকে নিয়ে আসবে।
—কে সুনীতা? সুনীতা আগরওয়াল?
—না, সুনীতা চাওলা। ইকোর। জাপানি ছেলেটা নাকি থার্ড ওয়ার্ল্ডের এডুকেশন সিস্টেমের ওপর কাজ করছে। সোর্স মেটিরিয়াল চায়।
বৃষ্টির এই ধরনের কথাবার্তায় পিত্তি জ্বলে যায়। একটা মিজিগুচি বা টাকাশিমা ভিখিরির দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নানা রকম থিসিস্ লিখে যাবে, তা নিয়ে এত আদিখ্যেতা করার কি আছে? সুনীতা চাওলা মেয়েটা পারেও বটে। ভালমামা এসব আদিখ্যেতার কথা শুনলেই রেগে যায়। বলে, স্লেভ্ মেন্টালিটি। কিছু কিছু মানুষের জন্য পৃথিবীটাই আর বাসযোগ্য থাকবে না। বৃষ্টি মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করল,
—নারে, আমি আর শুভ একটা জায়গায় যাব।
সুদেষ্ণা রাস্তা পেরিয়ে যেতে বৃষ্টিরা বউবাজার মোড়ের দিকে এগোল।
শুভ বলল, —আজ সিনেমা থাক্। চল্, তোকে আজ রাজীবদের আড্ডায় নিয়ে যাই। দেখবি কত হৈচৈ, হুল্লোড়, মস্তি…একটা অন্য লাইফ…
ঝাঁচকচক একটা নতুন বাড়ির দোতলার ফ্ল্যাটের বেল টিপল শুভ। জিন্সের ওপর কালো পুলওভার পরা এক কুচকুচে কালো মেয়ে দরজা খুলেছে। শুভকে দেখেই তার মুখে এক গাল হাসি,
—হাই বিগ ম্যান্। তিন চার দিন ডুব কেন?
শুভ বৃষ্টিকে দেখাল, —মিট্ বৃষ্টি। আমার ক্লাসমেট্। অ্যান্ড দিস ইজ জিন্ডা। জয়ন্তী সেন।
জিন্ডা বলল, —হাই।
রাজীবদের ফ্ল্যাটে ঢুকেই প্রথমেই চোখে পড়ে ধোঁয়াশামাখা এক বিশাল হলঘর। এত বিশাল যে বৃষ্টির মনে হল তাদের গোটা বাড়িটাই বুঝি এই হলে ঢুকে যাবে। ঘর জুড়ে ইতস্তত ছড়িয়ে দামি সোফাসেট, কোণে রঙিন টি ভি-তে হিন্দী ফিল্মের ক্যাসেট চলছে। তার সামনে তিন চার জন ছেলে, গোটা দুয়েক মেয়ে। কেউ সোফায় বসে নেই, সকলেই আরাম করে বসে দেওয়ালজোড়া পুরু কার্পেটের ওপর। দুটো ছেলের হাতে গ্লাস, গ্লাসে পানীয় টলটল করছে। বৃষ্টি আর শুভকে দেখে সকলেই ঘুরে তাকাল,
—হ্যালোও!
শুভ হাত নাড়ল।
জিন্ডা বৃষ্টিকে বলল, —দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোসো।
সোফায় শুভর পাশে বসে বৃষ্টি বলল, —ঘ্যাম্ ফ্ল্যাট তো রে! কি করেন রাজীবের বাবা?
—বিজনেস্। আমার বাবার ক্লায়েন্ট। এখানে থাকে না। হাওড়ায়।
শুভ বৃষ্টির কানে তথ্য ঢেলে চলেছে,—ছেলেই এ বাড়ির কেয়ারটেকার। একটা বুড়ো চাকরও থাকে। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে ফুর্তি করতে আসে এখানে। আসার আগে রাজীবকে নোটিস পাঠায়, বেটা, আজ তুমি কাটো, আজ আমার পালা। অনেক ভি আই পি, টি আই পি আসে তখন। সরকারি। বে-সরকারি। আমলা। মিনিস্টার। আমার বাবাও আসে। খুব নাচাগানা, খানাপিনা—…বলতে বলতে এক চোখ বন্ধ করে বিচিত্র অর্থপূর্ণ মুদ্রা করল শুভ।
পাশের ঘর থেকে এক যুবককে তাদের দিকে আসতে দেখে শুভ কথা থামাল। এই শীতেও ছেলেটা শুধু একটা বুকখোলা টিশার্ট পরে আছে, জিনসের প্যান্টে অসংখ্য তালি, এক কানে দুল চকচক করছে। ঘরে অনেকের গায়েই যদিও গরম পোশাক নেই তবু এর পোশাক যেন একটু বেশি বেপরোয়া। বৃষ্টির পাশে এসে নির্দ্বিধায় বসে পড়ল।
শুভ বলল, —বৃষ্টি। শী ইজ্ বৃষ্টি রায়।
ছেলেটা চকচকে হাসি হাসল, —দারুণ নাম তো! আমি জিমি। জীয়ন মুখার্জি।
বৃষ্টি আলতো হাসল। যার ফ্ল্যাট সে কোথায়? রাজীব?
জিমি বুঝি বৃষ্টির মনের কথা বুঝতে পারল, —চলো, ভেতরে চলো। রাজীবটার খুব মাথা ধরেছে। টেকিং রেস্ট্।
পাশের বড় সুসজ্জিত ঘরে প্রকাণ্ড খাটে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে শুয়ে ছিল রাজীব। রাজীবের মুখ বেশ কমনীয়, প্রায় মেয়েলি, মুখ দেখে পনেরো-ষোল বছরের বেশি বলে মনে হয় না।
প্রথমে পরিবেশটা অস্বস্তিকর ঠেকলেও, ছেলেমেয়েগুলোর আন্তরিকতায় বৃষ্টি কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ সাবলীল হয়ে উঠল। রাজীব ছেলেটা তো এমন ভাবে কথা বলছিল যেন বৃষ্টি তার কতদিনের চেনা। ছোট্টখাট্টো মিষ্টিমুখ নিধি কার্লেকার একটা গ্লাস দিতে চাইল বৃষ্টিকে,
—চলবে?
বৃষ্টি বলল, —নো, থ্যাংকস্।
—চলে না বুঝি?
—চলে না আবার! শুভ ফুট কাটল, —নেতারহাটে গিয়ে এক ওয়াটার বটল্ ভর্তি মহুয়া একাই সাফ করেছে…
বৃষ্টি লজ্জা পেল। নেতারহাটে সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল। পরদিন কি কষ্ট! রাঁচি পৌছে টি এম তো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান আর কি। কিন্তু এই মুহূর্তে তার ড্রিঙ্ক করতে একটুও ইচ্ছে করছে না। আবার এরা তাকে গাঁইয়া, আনস্মার্ট ভাবুক সেটাও ভাবতে ভাল লাগল না। বৃষ্টি ব্যাগ থেকে সিগারেট বার করে ধরাল,
জিমি জিজ্ঞাসা করল, —প্লেন্?
বৃষ্টি প্রথমটা মানে বুঝতে পারেনি, বলে ফেলল, —না, ফিল্টার।
রাজীব জোরে হেসে উঠল, —জিমি জিজ্ঞেস করছে প্লেন সিগারেট, না ভেতরে মালমশলা কিছু আছে?
গাঁজা টাজার কথা বলছে নাকি!
—না, না, প্লেন।
জিমি একটা সরু সিগারেট বাড়িয়ে দিল, —লাইক টু হ্যাভ ওয়ান?
বার বার না বলা যায় না। বৃষ্টি কাঁধ ঝাঁকাল,
—শিওর। হোয়াই নট?
প্রথম টানটা দিতেই বুকে সজোরে ধাক্কা। এ ধাক্কা কলেজে প্রথম দিন সিগারেট খাওয়ার ধাক্কার থেকেও অনেক বেশি প্রবল। নিশ্বাস বন্ধ করে ধাক্কাটাকে হজম করল বৃষ্টি। ধোঁয়াটাও। দ্বিতীয় টান, তৃতীয় টানে…আহ্, সব মুছে যাচ্ছে মাথা থেকে। সব। মা, বাবা, দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা বিষাদ সব মিলিয়ে গেল মহাশূন্যে। বৃষ্টি আবারও টান দিল। ভাসছে। ভাসছে। মহাশূন্যে পাক খেয়ে চলেছে। পৃথিবী নেমে গেল অনেক নিচে। রাজীব, জিমি জিন্ডা, শুভ ইন্দ্রজিৎ নিধি সবাই ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। বোতলের ভূতের মত দেখাচ্ছে সকলকে।
বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে উঠল। এই কি সুখ!
পর পর কয়েক দিন কলেজ থেকে সোজা রাজীবদের ফ্ল্যাটে হাজির বৃষ্টি। দু-দিন তো শুভকে ছাড়াই। সন্ধেবেলায় একটা সাজানোগোছানো ঘরে এক ঝাঁক ছেলেমেয়ের সঙ্গে দিব্যি সময় কেটে যায়। বিকেলের পর আর কি করি কি করি ভাবটা নেই। এ ওর পিছনে লাগছে, ক্রিকেট ফুটবল টেনিস নিয়ে গলা ফাটাচ্ছে কেউ, কেউ রাজনীতি নিয়ে। কোন ব্যাপারেই কেউ বেশি গভীরে যায় না। পালকের মত হাল্কা জীবন। ভাসো। শুধু ভেসে থাকো। তাদের পাড়ার সায়নদীপ ছেলেটা রামবোকা। খেলা নিয়ে সিরিয়াস, শরীর নিয়ে সিরিয়াস, জীবন নিয়ে সিরিয়াস। সেদিন দেখে মনে হয়েছিল মাকে নিয়েও সিরিয়াস। যেভাবে মার পিঠে হাত দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে গেল! মাঝে একদিন সকালে মুখোমুখি পড়ে যেতে বৃষ্টি ভদ্রতা করে জিজ্ঞাসা করেছিল,
—তোমার মামা কেমন আছেন?
ছেলেটার চোয়াল এমন ঝুলে পড়ল যেন মারাই গেছেন ভদ্রলোক। বলল,—বাঁদিকটা পড়ে গেছে। কি করে যে মামিমার চলবে এখন!
সেদিন সারা সন্ধে ভোঁ হয়ে বসে বৃষ্টি ভেবেছে আর হেসেছে। হেসেই গেছে নিজের মনে। ছেলেটাকে ভুগতে হবে। ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি ক্রমশ ডুবে গেছে চড়া পাশ্চাত্ত্য বাজনায়। মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে অবশ।
দিনগুলো একই রকমের বর্ণহীন, সন্ধ্যাগুলো সম্মোহক। এভাবেই অনন্তকাল কেটে যেতে পারত বৃষ্টির। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। নিস্তরঙ্গ পুকুর জানতেও পারে না কোথা থেকে ছোট্ট ইঁটের কুচি এসে শান্ত জলকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
রাস্তা থেকেই অনেক কটা গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল বৃষ্টি। খুনখুনে গলার হাসিটা শুনে চিনতে পারল। শিপ্রা হালদার। শান্তিনিকেতন থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বেড়িয়ে আসার পর বাড়িতে আজ আড্ডা বসিয়েছে।
বৃষ্টি বাইরে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না।
কদিন ধরেই সামনের পার্কটা আলোয় আলোময়। শীতকালীন হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট্সের মেলা বসেছে। ওপাশের টেনিসকোর্টে যথারীতি সান্ধ্য ক্রীড়ার আসর। রনিদের বাড়ির দৈনিক চিৎকার শব্দ আর আলোতে চাপা পড়ে যাচ্ছে।
সুধা দরজা খুলে দিতে বৃষ্টি ঘরের দিকেই যাচ্ছিল, ফিরোজ পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখে ফেলেছে তাকে,
—কেরে বিড়ালের মত পা টিপে টিপে ভেতরে যায়? আয় এদিকে।
বৃষ্টি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ড্রয়িংরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল।
মা, ফিরোজ আঙ্কল, রমেন মামা, শিপ্রামাসি সোফায়। ভালমামা জানলার কাছে, হুইল চেয়ারে।
—তোকে যেন একটু শুকনো শুকনো লাগে!
অন্যদের দিকে তাকানোর আগে মার সঙ্গেই যে কেন চোখাচোখি হয়ে গেল! বৃষ্টি তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে ফিরোজের দিকে,
—ড্যাম টায়ার্ড। তোমার আর্টিস্ট কলোনির খবর কি বলো? কবে ইনগরেশন?
—হবে শীগগীরই। লাল ফিতের ফাঁসে একটু ফেঁসে আছে। তা সিনরিটা, তুমি এত রাত্রে কোথ্থেকে? কোন রাখাল বালকটালক জুটেছে নাকি?
রমেন জোরে হেসে উঠল,
—হোয়াট এ স্ট্রেনজ কোয়েশ্চন ফিরোজ? এই বয়সে রাখাল বালক আসবে তো কি আমাদের মত আধবুড়ো ভামেরা চারদিকে নেচে বেড়াবে?
ফিরোজ আঙ্কলের মুখে লালচে আভা, ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে আছে কপালে, মাঘ মাসেও। রমেনমামার হাসিটাও বেশ অস্বাভাবিক। দুজনেই মনে হয় টিপ্সি আছে।
বৃষ্টি ঠোঁট টিপে হাসল, —ইস্, রাখাল বালক কি জীবনের মোক্ষ নাকি? আমিও তোমাদের মতই আড্ডা মারছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে।
শিপ্রা আবার খুনখুনে হাসি ছিটিয়ে দিল,
—ওয়েল সেড ডার্লিং। আয়, তুই আমার পাশে আয়, তোকে কতদিন আদর করিনি।
বৃষ্টির গা গুলিয়ে উঠল। শিপ্রামাসি এমন চকাৎ চকাৎ শব্দ করে চুমু খায়! বৃষ্টির আপত্তি কি টের পেল জয়া? আচমকা বলে উঠেছে,
—আমরা কিন্তু পয়েন্টটা থেকে সরে গেলাম। যে কথা হচ্ছিল…
ফিরোজ বলল,—বোস্ বৃষ্টি, তুইও শোন। তোর মা একটা ভাইটাল প্রশ্ন তুলেছে। ট্র্যাডিশনাল ভ্যালু বলে কিছু থাকবে, কি থাকবে না।
শিপ্রা অ্যাশট্রেতে সিগারেট গুঁজল,—আমার তো মনে হয় ট্র্যাডিশনাল ভ্যালু শব্দটারই কোন মানে হয় না। মরালিটির কি কোন রিজিড ডেফিনেশান থাকতে পারে? বাচ্চা মেয়েটা রয়েছে, তাও বলি, ভিক্টোরিয়ান যুগে তো চেয়ার টেবিলের পায়াকে পর্যন্ত কাপড় পরাত ব্রিটিশরা, এখন তাদের গিয়ে দ্যাখো, হামলে পড়ে সব পিপ্ শো দেখছে। দুনিয়ার যতরকম নষ্টামি সব করছে প্যারিসে গিয়ে। ওদের দেখাদেখি আমাদেরও এই দুমুখোপনা।
ফিরোজ সোফায় হেলান দিল, —আমি বাবা অত ভ্যালুজ, মরালিটি বুঝি না। যা করতে মন চায় না, সেটাই অন্যায়, অশালীন ব্যস্। মনই হল গড। কন্সেন্সই আসল। নীতিফিতি বলে কিস্যু নেই।
বাবলু জানলা থেকে মুখ ঘোরাল, —তার মানে একটা সোসাইটির নিজস্ব সংস্কার, মূল্যবোধ সব মিথ্যে?
রমেন বিশেষ কথা বলছে না। বাবলুর প্রতিটি কথা শুধু ঘাড় নেড়ে নেড়ে সমর্থন করে যাচ্ছে।
—আহা, মূল্যবোধ কেন মিথ্যে হবে? ফিরোজ সোজা হল, —তবে মূল্যবোধ ভাঙতেই পারে। সোসাইটির যে কোন ক্রাইসিসে…
—এই, এইটাই হল আসল কথা। বাবলু রীতিমত উত্তেজিত হয়ে পড়েছে,
—তাহলে আগে খুঁজতে হবে ক্রাইসিস্টা কেন এল, কি ভাবে এল। এখন আমরা এমন একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যেখানে অর্ধেক মানুষই যা বিলিভ করে সেটা করে না। এক ধরনের হিপোক্রেসি…
—রাইট্! দ্যাখো গে যাও, যে ব্যাটা দিনে মার্কসিস্ট্, রাত্রে সেই ইনডাসট্রিয়ালিস্টের পেয়ালা থেকে মাল খাচ্ছে। চল্লিশ বছর আগেও, এ দৃশ্য কল্পনা করা যেত? তাদের অনড় ভ্যালুজ যদি বদলে যেতে পারে, মধ্যবিত্তের মূল্যবোধ ভাঙবে না কেন? চোখের সামনে মানুষ যা দেখে, তাতেই রিঅ্যাক্ট করে।
শিপ্রা আরেকটা সিগারেট ধরাল, —এই যে কথা আর কাজের কন্ট্রাডিকশন, এতে ভ্যালুজে ঘা লাগবেই। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। এর থেকে আমাদের পরের জেনারেশান কি শিখছে? আমাদের ছেলেমেয়েরা?
গুরুগম্ভীর কথার ঝাপটায় বৃষ্টির মাথা ভারী হয়ে আসছিল। ফুরফুরে মেজাজটা থিতিয়ে আসছে। তার উপস্থিতি নিয়ে এরা কেউই তেমন আর সচেতন নয়।
ফিরোজ বলল, —মাইরি তোরা বিশ্বাস করবি না, সেদিন ভোরবেলা আমাদের বাড়িতে এক মহিলা এসে উপস্থিত। বছর পঞ্চাশ বয়সেও চেহারায় দিব্যি চেকনাই…
রমেন প্রশ্ন করল, —রেণুকা কাপাডিয়া? খুব ফর্সা?
—না, না, মিসেস কাপাডিয়াকে আমি চিনি। তার ওরকম কুড়ি কুড়ি হাবভাব নেই। ···বলে কিনা, ছবি দিন, নতুন গ্যালারি খুলছি, এগজিবিশান করব। আমি তো হাঁ। চিনি না, জানি না···
—তুমি কি বললে?
—বলোম, আপনি জানলেন কি করে এ বাড়িতে একটা আঁকিয়ে থাকে? উত্তর শুনে আরও তাজ্জব। বলে, খাম্বাজ গ্যালারির মিসেস জিন্দাল নাকি ওকে বলেছে ফিরোজ আনোয়ার নামে একটা লোক ছবিটবি আঁকে, ব্যাটার বাজারদর নাকি বেশ ভাল।
জয়া বলল, —মনে হচ্ছে লক্শমি সুব্রামানিয়ম। থিয়েটার রোডে নতুন গ্যালারি খুলেছে।
—লক্ষ্মী সরস্বতী বুঝি না, মহিলা না হলে আমি নির্ঘাত দোতলা থেকে ফেলে দিতাম। আর্টকে তোরা কোন পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছিস ভাব। স্রেফ কমোডিটি। নাথিং মোর দ্যান স্নো পাউডার।
জয়া বলল, —এটা তুই ঠিক বলছিস না। সর্বত্রই এ জিনিস চলে। তুই ছবি আঁকতে পারিস; সে করছে তার বিজনেস। দোষটা কোথায়?
—দোষ তাদের বলছি না তো, দোষ আমাদের। যেভাবে ফরমাশ আসছে···আচ্ছা তুই বল না, এই যে তুই ফরমাইশি কৃষ্ণ রাধা এঁকে যাস্···এসব আঁকতে তোর নিজের ভাল লাগে?
—না লাগার কি আছে? আর্ট ইজ আর্ট। বিক্রি হলেও। না হলেও।
ফিরোজ লম্বা নিশ্বাস ফেলল,
—তুই অনেক বদলে গেছিস জয়া।
একটা কথাতেই ঘরের আবহাওয়া ভারী হয়ে গেল।
বৃষ্টির এতক্ষণে মজা লাগছিল। ফিরোজ আঙ্কল ভাল টাইট দিয়েছে মাকে। মা গুম। টুক করে দরজা থেকে সরে গেল বৃষ্টি।
সুধা রান্নাঘর থেকে ডাকল,
—তুমি কি এখন খেয়ে নেবে? না পরে সবার সঙ্গে?
বৃষ্টির খিদে পাচ্ছিল। বলল, —আমাকে এখনই দিয়ে দাও।
ঘরে ফিরে সালোয়ার কামিজ ছেড়ে নাইটি পরে নিল। আজকাল নিজের ঘরে ঢুকলেই শরীরে তার এক ধরনের কষ্ট হয়, বুকে যেন দম আটকানো অনুভূতি। এ সময় ঘরে বসে টানা দুখানা সিগারেট খেয়ে মানসিক স্থিরতা নিয়ে আসে সে। আজ মনটা তত ভার ভার নেই। সিগারেট ধরাল না। নিজের মনে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে খাবার টেবিলে এল। সুধা খাবার দিয়ে দিয়েছে।
বৃষ্টি চামচ করে ফ্রায়েড রাইস মুখে তুলছিল, সুধা এসে দাঁড়াল,
—তোমার একটা ফোন এসেছিল।
—কার ফোন?
—নাম বলেনি। মেয়েছেলের গলা। খালি জিজ্ঞাসা করল তুমি বাড়ি আছ কিনা। নেই শুনেই রেখে দিল।
ওফ্। এই মেয়েছেলে শব্দটা কিছুতেই সুধামাসির জিভ থেকে সরানো গেল না।
—কটার সময় করেছিল?
—সাড়ে সাতটা হবে। টিভিতে বাংলা খবর চলছিল তখন।
কে ফোন করতে পারে! মীনাক্ষি কদিন ধরে কলেজে আসছে না। কিন্তু মীনাক্ষিদের বাড়িতে তো ফোন নেই! হঠাৎই স্নায়ুতে বিদ্যুৎঝিলিক। আজ পঁচিশে জানুয়ারি না! বাবার জন্মদিন! সেদিন ফোনে কথা কাটাকাটি করার পর একবারও বৃষ্টি বাবাকে ফোন করেনি, শনি রবিবারে দেখাও করতে যায়নি, বাবার ফোন এলেও ধরেনি পারতপক্ষে।
বাবা কী রীতাকে দিয়ে ফোন করিয়েছিল!
বৃষ্টি ঝটপট খাওয়া শেষ করে ডায়াল ঘোরাল,
—হ্যাপি বার্থডে বাবা। সরি, লেট হয়ে গেল।
সুবীরের গলায় প্রচ্ছন্ন অভিমান, —বেটার লেট দ্যান নেভার। কেমন আছিস?
—ভাল। ফাইন্। তোমার শরীর কেমন?
—ঠিক আছে।
—বাই দা বাই, রীতাআন্টি কি আমাকে ফোন করেছিল?
—তা তো জানি না। দেখছি জিজ্ঞাসা করে···
রিসিভার ধরেই বাবা রীতাকে ডাকাডাকি করছে। ভাসা ভাসা মেয়েলি গলা শোনা গেল, কথা বোঝা যাচ্ছে না। ড্রয়িংরুমে এত জোরে জোরে হাসছে সবাই! ভালমামাও। ভালমামা এখনও এত জোরে হাসতে পারে! রবিবার অকারণে কি চিল্লান না চিল্লালো!
এক দৃষ্টে অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ দেখছিল ভালমামা, একটা অ্যাঞ্জেল অবিকল মার মত নিস্পৃহ মুখে গোমড়ামুখো রেডসোর্ড টেলের দিকে তাকিয়ে। কেঁচো রাখার ভাসমান পাত্র প্রায় খালি। জলে অনর্গল বুদবুদ। টিভি বোবা।
বৃষ্টি গায়ে পড়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিল,
—তোমার আজ রুটিন ব্রেক? অ্যাকোয়ারিয়াম তো তুমি দুপুরে দ্যাখো?
বাবলুর চোখের পাতা নড়েনি।
—টিভি চালিয়ে দেব? সাদ্দাম হোসেনের খবর নেবে না?
—একদম ফাজলামি মারবে না। বাবলু আচমকা ফেটে পড়েছিল,—টিভিটা কাল থেকে খারাপ হয়ে পড়ে আছে, সে হুঁশ কারুর আছে? একজন শান্তিনিকেতনে গিয়ে মজা করছেন, আরেকজন বাড়িতেই থাকেন না···
—ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখছ না কেন?
—ন্যাকামো হচ্ছে? জানো না আমি কালার টিভি দেখি না?
—সুধামাসিকে বললেই পারতে। মনোহর পুকুরের দোকানটায় খবর দিয়ে আসত।
—কেন? সব কথা বলতে হবে কেন? আক্কেল নেই কারুর? সবাই যে যার মত আরামে রয়েছে, কারুর তো কোন সুখের অভাব দেখি না। শুধু আমার ব্যাপারেই···
বাবা নয়, রীতা কথা বলছে ফোনে, —হ্যালো বৃষ্টি, হ্যাঁ আমিই ফোন করেছিলাম।
বৃষ্টির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
—তুমি তো প্রতিবছরই এদিন বাবার কাছে আসো, এবার কোন খোঁজখবর নেই, ভাবলাম তোমার শরীরটরীর খারাপ হল কিনা··তোমার বাবা সারাদিন ধরে তোমার জন্য ছটফট করছে। ···মুখে কিছু বলছে না···
বৃষ্টি দড়াম করে রিসিভার নামিয়ে রাখল। ঝরঝরে মেজাজ নিমেষে বিস্বাদ হয়ে গেছে। ওই মহিলার ন্যাকাপনা এবার বন্ধ করতে হবে।
বৃষ্টি ঘরে এসে সশব্দে দরজা বন্ধ করল। সিগারেট ধরাল একটা। সুধা ঠিকই বলেছে! মেয়েছেলে! মেয়েছেলেই তো!
মেয়েছেলে। মেয়েছেলে। মেয়েছেলে।