০৫. কালিপসো

পঞ্চম পর্ব
কালিপসো

স্বর্গলোকের যে মিলনশয্যায় লর্ড টিথোসের অঙ্কশায়িনীরূপে শয়ন করে দিবালোকোর জন্মদান করে তাই দিয়ে অন্তরীক্ষ ও মর্ত্যলোককে প্লাবিত করেন ঊষাদেবী, সেই শযা হতে তিনি উঠে আসতেই এক মন্ত্রণাসভায় মিলিত হলেন দেবতারা। পরে দেবরাজ জিয়াস এসে যোগদান করলেন সে সভায়। জলপরী ক্যালিপসোর দ্বীপে ওডিসিয়াসের বন্দী থাকার ব্যাপারটাতে অতিশয় দুঃখিত হয়ে পড়েছিলেন দেবী এথেন। ওডিসিয়াসের এই সকরুণ দুর্ভাগ্যের কথাটা তিনি নতুন করে মনে পড়িয়ে দিলেন দেবতাদের।

এথেন বললেন, হে পরম পিতা জিয়াস ও স্বর্গের অন্যান্য অমর দেবতাবৃন্দ, দেখে শুনে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে দয়া, উদারতা, ন্যায়পরায়তা প্রভৃতি গুণগুলো লাভের জন্য আর মর্ত্যলোকের কোন রাজা চেষ্টা করবে না, কারণ এই গুণগুলো লড়াই, অত্যাচার, অন্যায় ও অবৈধ কর্মের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করেও সুখে থাকতে পারবে তারা। একবার ওডিসিয়াসের কথাটা ভেবে দেখ। কী যশস্বী গুণবান রাজা। অথচ যেসব প্রজাদের একদিন তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন আজ তারা তাঁর কথা একবার ভাবেও না। একটি নির্জন দ্বীপে কত কষ্টে তিনি দিন যাপন করছেন। তিনি এখন বন্দী আছেন জলপরী ক্যালিপস্যের কবলে এবং সে তাকে ছাড়তে চাইছে না। তাছাড়া তিনি এখন কিছুতেই ইথাকা পৌঁছতে পারবেন না, কারণ তাঁর সঙ্গে জাহাজ বা নাবিক কিছুই নেই। ইতিমধ্যে তাঁর প্রিয়তম পুত্রও পিতার সন্ধানে সুদূর পাইলস ও ল্যাসিডীমনে গেছে।

মেঘসঞ্চারকারী বজ্ৰাধিপতি দেবরাজ বললেন, বৎসে, আমি একথা তোমার মুখ থেকে কখনই আশা করি নি, কারণ এ ঘটনা কি সম্পূর্ণ তোমার পরিকল্পনা অনুসারে হয় নি? তুমি কি এটা চাও নি যে ওডিসিয়াস নিজ বাড়িতে ফিরে সেই দুর্বত্তদের সঙ্গে নিজে বোঝাঁপড়া করবে? আর টেলিমেকাসের দেখাশোনা তো তুমি নিজেই করতে পারবে। তুমি কৌশলে তাকে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করো। আর পাণিপ্রার্থীরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাক তাদের জাহাজে করে।

এবার হার্মিসের দিকে ফিরে জিয়াস বললেন, তুমি এখন দূতরূপে আমাদের শেষ সিদ্ধান্তের কথা সেই জলপরীকে জানিয়ে এস। তাকে বলবে ওডিসিয়াস যথেষ্ট দুঃখ ভোগ করেছে। এবার সে বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু তার প্রত্যাবর্তন পথে কোন দেবতা বা মানুষ তাকে সাহায্য করবে না। নিজের হাতে তৈরি একটি নৌকোয় করে অতি কষ্টে তাকে যাত্রা শুরু করতে হবে। কুড়ি দিনের দিন সে উপনীত হবে ফীয়াসিয়া জাতির দ্বারা অধ্যুষিত স্কেরি দ্বীপে। সেখানেই সেই দ্বীপের অধিবাসীরা দেবতাদের মত ভক্তি করবে তাকে। তারা তাকে জাহাজ আর তার সঙ্গে বহু সোনা তামা প্রভৃতি মূল্যবান ধাতু ও ধনরত্ন দেবে। যা সে কোনদিন লাভ করতে পারে নি। সেইসব নিয়ে সে তার জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে আবার সে মিলিত হবে আত্মীয় পরিজনদের সাথে। জিয়াসের কথা শেষ হতেই দেবদূত হার্মিস তাঁর কথামত স্বর্ণপাদুকা পরে বাতাসের মত দ্রুতগতিতে উড়ে চলল অন্তহীন সমুদ্রের উপর দিয়ে। যে যাদুকাঠির দ্বারা সে যেকোন মানুষের চোখের মায়ার আবেশ সৃষ্টি করতে পারে, সেই যাদুকাঠিটি হাতে তুলে নিল সে। মাঝে মাঝে আকাশপথ হতে অবতরণ করে কোন পর্বত শিখরে ক্ষণিকের জন্য বসল হার্মিস। কখনো বা কোন সমুদ্রগামী মৎস্যলোভী পাখির মত হঠাৎ নত হয়ে মাছ ধরার জন্য নিজের পাকা দুটো ভিজিয়ে নিল সমুদ্রের জলে। এইভাবে হার্মিস অন্তহীন উত্তাল সমুদ্রতরঙ্গের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে অবশেষে ওজিগিয়া দ্বীপে অবতরণ করল। তারপর সে জলপরীর আস্তানার দিকে এগিয়ে গেল। হার্মিস গিয়ে দেখল জলপরী তার আস্তানাতেই আছে। সে আস্তানায় এক অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল এবং দেবদারু কাঠ পোড়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল বহু দূরদূরান্ত পর্যন্ত। সেই গুহাবর্তী আস্তানার মধ্যে জলপরী ক্যালিপসো একটি সোনার চরকায় সুতো কাটতে কাটতে সুমধুর কণ্ঠে গান গাইছিল। সেই বিরাট গুহাটি ছিল শত পুস্পিত লতাপাতা আর সুগন্ধি গাছগাছড়ায় ভরা। সেখানে রাত্রিকালে আশ্রয় নিত অনেক সামুদ্রিক পাখি। সেই সব পাখিগুলো সকাল থেকে বেরিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াত সমুদ্রের উপর। সেই গুহার মুখ থেকে শুরু হয়েছে আঙ্গুর গাছের বাগান। থোকা থোকা আঙ্গুর ধরে আছে আঙ্গুর গাছে। সেখানে থেকে চারটি পৃথক ঝর্ণা চারটি নদী হয়ে নেমে গেছে এক বিশাল প্রান্তরে। সে প্রান্তরে আছে অনেক যবের ক্ষেত। এখানকার দৃশ্য এমনই মনোরম যে স্বর্গের দেবতাদের মনও টলে যায়। এ দৃশ্য দেখলে যেকোন দেবতা অভিভূত হয়ে পড়বেন এবং বিস্ময়াবিমিশ্রিত আনন্দে।

দেবদূত হার্মিস স্তব্ধ হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতে লাগল। বাইরে থেকে সেই মনোরম দৃশ্যের সব সৌন্দর্যটুকু উপভোগ করার পর গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করল সে। জলপরী হলেও ক্যালিপসো আসলে ছিল এক দেবী। তার সে মুখ তুলে হার্মিসকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারল। কারণ দেবদেবীরা পরস্পরের কাছ থেকে যত দূরেই থাক পরস্পরকে দেখলে চিনতে পারবেই। রাজা ওডিসিয়াসকে কিন্তু গুহার ভিতরে দেখতে পেল না হার্মিস, কারণ তখন তিনি সমুদ্রতীরে একাকী বসে চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে তাকিয়ে ছিলেন দূর সমুদ্রের পানে। অবুঝ অবাধ্য দুঃখের এক অদম্য যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এইখানে সারাদিন বসে থাকতেন তিনি।

হার্মিসকে দেখে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে উজ্জ্বলভাবে পালিশ করা একটি চেয়ারে তাকে বসাল ক্যালিপসো। তারপর প্রশ্ন করল হার্মিস, কি কারণে তুমি তোমার এই সোনার যাদুকাঠি নিয়ে এখানে এসেছ? যদিও অতীতে এখানে তুমি কখনো আস নি তথাপি তুমি আজ আমার সম্মানিত অতিথি। বল, কি তুমি চাও, যদি তা একান্তপক্ষে অসম্ভব না হয় তাহলে আমি তা সানন্দে করব। আপাতত তুমি আমার সঙ্গে ভিতরে গিয়ে আমার সাদর আতিথ্য গ্রহণ করো।

ক্যালিপসো ভিতরে গিয়ে টেবিলের রাখা একটি পাত্রে লাল মদের সঙ্গে একটি ওষুধি মিশিয়ে খেতে দিল হার্মিসকে। হার্মিস তা পান করে সুস্থ হয়ে ক্যালিপসোর প্রশ্নের উত্তরে বলল, তুমি একজন দেবতা হয়ে যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করছ তখন আমি অকপটে বলছি তোমাকে সব কথা। আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন দেবরাজ জিয়াস। তিনি না পাঠালে আমি এখানে আসতাম না। কারণ এই বিশাল লবণাক্ত মহাসমুদ্র পার হয়ে কে আসবে এখানে? এই অন্তহীন মহাসমুদ্রের যেন সীমা নেই, শেষ নেই। কোন দিকে কোন নগর বা জনপদ নেই। দেবতাদের প্রীত করার জন্য কোথাও কোন জনমানব নেই। কিন্তু দেবরাজ যখন কাউকে কোন কাজের ভার দেন তখন তার কথা অমান্য করার সাহস কোন দেবতারই নেই। তিনি বলেছেন তোমার কাছে একজন। মানুষ আছে। সে লোকটি ট্রয়যুদ্ধে নয় বৎসরকাল যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে এবং দশ বৎসরে ট্রয়নগরী জয় করে যারা বাড়ি ফিরে যায় তাদের সকলের থেকে ভাগ্যের থেকে বিড়ম্বিত। মনে হয় ওরা প্রত্যাবর্তনকালে রওনা হবার সময় ঠিকমত প্রীত করতে পারে নি দেবী এথেনকে। তাই তিনি এক প্রবল ঝড়ের দ্বারা সমুদ্রবক্ষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলেন। এ ব্যক্তির অনুচরেরা সকলে প্রাণ হারায় এবং সে একা ঢেউএ ভাসতে ভাসতে এই দ্বীপে এসে ওঠে। এখন জিয়াস তোমাকে আদেশ করেছেন তুমি অবিলম্বে ওকে পাঠিয়ে দেবে। তার শেষ দিন এখনো ঘনিয়ে আসে নি এবং সে সেই দূর নির্জন দ্বীপে স্বদেশ থেকে বহু দূরে কখনই শেষ পরিণতি লাভ করতে পারে না। তাছাড়া তার ভাগ্যে আছে সে আবার তার জন্মভূমিতে ফিরে গিয়ে তার আত্মীয়স্বজনদের দেখবে।

হার্মিসের কথা শুনে ভয়ে কাঁপতে লাগল ক্যালিপসো। হার্মিসের কথা শেষ হলে সে বলল, তোমরা দেবতারা বড় নিষ্ঠুর এবং ঈর্ষাপরায়ণতায় অদ্বিতীয়। কোন দেবী যদি কোন মর্তমানবকে তার জীবনের সাথী ও শয্যাসঙ্গীরূপে প্রকাশে ঘোষণা করে তার সঙ্গে বসবাস করে তাহলে তোমরা তা সহ্য করতে পার না। গোলাপকলিকাতুল্য অঙ্গুলিবিশিষ্টা ঊষাদেবী যখন ওরিয়রনকে ভালবাসেন।

তখনও তোমরা তা সহ্য করতে পার নি। ফলে দেবী আর্তেমিস তাঁর স্বর্ণসিংহাসন হতে উঠে এক তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করেন ওরিয়নকে। আর একবার সুন্দরী দেবী দিয়েমারও মর্ত্যলোকের কোন এক কর্ষিত শষ্যক্ষেত্রে আয়েসন নামে এক মর্তমানবকে ভালবেসে আলিঙ্গন করেন আর তার ফলে ক্রোধান্ধ জিয়াস অস্ত্র নিক্ষেপ করে হত্যা করেন আয়েসনকে।

এবার আমার পালা। আমি একজন মর্তমানবের সঙ্গে বাস করার ফলে দৈবরোষ আকর্ষণ করেছি। অথচ জিয়াসকর্তৃক নিক্ষিপ্ত বজ্রের আঘাতে বিচূর্ণিত জাহাজের এক কাষ্ঠখণ্ডের উপর ভাসতে ভাসতে স্রোতের টানে এই মানুষটি যখন সঙ্গীদের হারিয়ে অসহায়ভাবে আমার এই দ্বীপে এসে ওঠে তখন আমিই থাকে উদ্ধার করি। আমি তাকে দুবাহু বাড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাই, তাকে সেবা শুশ্রূষার দ্বারা সুস্থ করে তুলি এবং তাকে অক্ষত ও অনন্ত যৌবন দান করি। কিন্তু এখন সব কিছুর শেষ, কারণ দেবরাজ জিয়াসের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস কোন দেবতার নেই। জিয়াসের যদি ইচ্ছা হয় তাহলে ও সমুদ্র অতিক্রম করে চলে যাক। কিন্তু আমি তাকে কোন সাহায্য করতে পারব না। কারণ আমার জাহাজ, নৌকো বা নাবিক কিছুই নেই। তবে আমি অকপটে প্রতিশ্রুতি দান করছি তাকে আমি এমন কিছু পথনির্দেশ প্রদান করব যাতে যে নিরাপদে তার স্বদেশ ইথাকায় পৌঁছতে পারে।

হার্মিস তখন বলল, তাহলে ওকে এই মুহূর্তে পাঠিয়ে দাও এবং জিয়াসের রোষ থেকে নিজেকে বাঁচাও। তা না হলে তিনি রুষ্ট হয়ে তোমাকে একদিন অবশ্যই শাস্তি দেবেন। এই কথা বলে দৈত্যনিধনকারী দেবদূত হার্মিস চলে গেল।

ক্যালিপসো তৎক্ষণাৎ চলে গেল তার মহান অতিথির কাছে। দেবরাজ জিয়াসের বাণী তার কানে তথনো পৌঁছয় নি। ক্যালিপসো দেখল সমুদ্রতীরে একা বসে রয়েছে ওডিসিয়াস। তার চোখদুটো তখনো সিক্ত হয়ে রয়েছে অবিরল অশ্রুধারায়। তার হারানো গৃহসুখের জন্য যে অশ্রু সে পাত করে চলেছে অবিরাম সেই অশ্রুর মধ্য দিয়েই যেন নিঃশেষে ঝরে পড়ছে তার জীবনের সব মাধুর্য ও সুষমাটুকু। বহু দিন হলো জলপরি ক্যালিপসের মধ্যে কোন আকর্ষণ খুঁজে পায় না সে। প্রতিটি রাতে অবশ্য সেই গুহার অন্ধকার নির্জনে একই শয্যায় শয়ন করতে হয় তার সঙ্গে। কিন্তু সে শয্যায় দেহটি আবদ্ধ হলেও মনকে আবদ্ধ করতে পারে না তার। অবাঞ্ছিত উত্তপ্তমনা এক নারীর পাশে এক হিমশীতল ঔদাসীন্যের সীমাহীন জড়তা নিয়ে নিজের দেহমনকে আচ্ছন্ন করে প্রাণহীন পাথরে প্রতিমূর্তির মত শুয়ে থাকে তার বহু-আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিক। কিন্তু সারাদিন দিন সে বসে থাকত সমুদ্রতীরবর্তী কোন পাহাড় বা বালুকারাশির উপরে। বেদনার্ত অন্তরে অশ্রুপূর্ণ চোখ মেলে তাকিয়ে থাকত আদিগন্ত সমুদ্রের অনন্ত জলরাশির পানে।

ওডিসির কাছে গিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে ক্যালিপসো বলল, হে আমার ব্যথাহত বন্ধু, আর আমি তোমাকে এই দ্বীপে আবদ্ধ করে রেখে তোমার দুঃখকে বাড়িয়ে তোলার মধ্যে কোন যুক্তি দেখি না। তুমি যাতে এই দ্বীপ থেকে চলে যেতে পার তার জন্য সর্বান্তঃকরণে তোমাকে সাহায্য করতে আমি প্রস্তুত। কিন্তু এর জন্য তোমাকে উঠেপড়ে লাগতে হবে। প্রথমে একটি বড় গাছকে কুঠার দিয়ে ভূপাতিত করো, তারপর তার থেকে একটি নৌকো তৈরি করে তাকে সমুদ্রযাত্রার উপযোগী করে সাজিয়ে তোল। তারপর পানীয় জল রুটি মদ প্রভৃতি প্রয়োজনীয় যাবতীয় আহার্য ও পানীয় যা লাগে সব আমি তাতে সাজিয়ে দেব। তারপরে দেব অনুকূল সমুদ্ৰবাতাস যাতে তুমি নিরাপদে তোমার স্বদেশে পৌঁছতে পার। অবশ্য যারা আমার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী, সেই সব অন্তরীক্ষবাসী দেবতারা যদি তা চান।

এ কথায় এক অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলেন ওডিসিয়াস। বললেন, সে দেবী, আমার নিরাপদ স্বদেশযাত্রা না তোমার অন্য কোন অভিপ্রায়সিদ্ধির উদ্দেশ্যেই একথা বলছ তুমি? তা না হলে কখনো এই ধরনের অপটু নৌকোয় করে এতবড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের সমুদ্রযাত্রা করতে বলতে না। এমন কি দ্রুতগামী বড় বড় জাহাজ অনুকূল বাতাস পেয়েও যে সমুদ্রে পাড়ি দিতে ভয় পায় সে সমুদ্র আমি এক সামান্য নৌকোয় কি করে অতিক্রম করব বলতে পার? সুতরাং আমি বলে দিচ্ছি তোমার আন্তরিক শুছেচ্ছা না পেলে আমি কখনই নৌকার উপর নির্ভর করে যাত্রা শুরু করব না। আগে তোমাকে শপথ করতে হবে তুমি আমার ক্ষতি করার জন্য কোনরূপ ষড়যন্ত্র করবে না।

সুন্দরী ক্যালিপসো মৃদু হেসে ওডিসিয়াসের পিঠের উপর তার হাতটি রাখল। বলল, তুমি একটি শয়তান বলেই একথা বলতে পারলে তুমি। তোমার নিজের মনই যে কুটিল তা এর থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে। উপরে অনন্ত বিস্তৃত আকাশ, নিচে ধরিত্রী ও এইসব প্রস্রবণের জলধারাকে সাক্ষী রেখে আমি তাদের সামনে এই শপথ করছি যে তোমার ক্ষতির জন্য আমি আমার অন্তরে কোন গোপন পরিকল্পনা পোষণ করি না। আমি নিজে তোমার মত অবস্থায় পড়লে কি হত তাই ভেবেই তোমার জন্য কিছু করতে চাই। যতই হোক, আমারও ন্যায়-অন্যায় বোধ আছে এবং আমার গোটা অন্তরটা লোহা দিয়ে গড়া নয়। আমারও দয়া-মায়া আছে। এই কথা বলে দেবী ক্যালিপসো চলে গেল সেখান থেকে আর ওডিসিয়াসও নীরবে অনুসরণ করলেন তাকে।

ওডিসিয়াস ও ক্যালিপসো দুজনে সেই গুহার অভ্যন্তরে গিয়ে প্রবেশ করল। একটু আগে হার্মিস যে চেয়ারটিতে বসেছিল সেই চেয়ারে বসল ওডিসিয়াস। একটি মানুষ যা খেতে পারে সে পরিমাণ খাদ্য ও পানীয় তার সামনে রাখল ক্যালিপসো। তারপর সে ওডিসির সামনে বসল। তার পরিচারিকারা লাল মদ ও একরকম ওষধি তাদের পাশে সাজিয়ে রাখল। তাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ক্যালিপসো বলতে শুরু করল, হে ধীমান ও মহানহৃদয় ওডিসিয়াস, তুমি কি তাহলে একান্তই তোমার স্বদেশ ইথাকায় ফিরে যেতে চাও? ঠিক আছে, আমিও চাই তুমি সুখী হও জীবনে। তথাপি এটা জেনে রেখো, প্রত্যাবর্তনকালে কী পরিমাণ কষ্ট তোমায় পথে ভোগ করতে হবে সে বিষয়ে কিছু যদি তুমি জানতে তাহলে এখান থেকে এক পাও যাবার কথা বলতে না, বরং আমার কাছে এখানেই চিরকাল অবস্থান করে এক অমর জীবনের অধিকারী হতে। অবশ্য আমি জানি তুমি তোমার স্ত্রীকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছ এবং তোমার পতিপ্রাণা স্ত্রী সততাসহকারে তোমার কথাই ভাবছে। তবে একটা কথা আমি জোর করে বলতে পারি, চোখ মুখ ও দেহ সৌন্দর্যের দিক থেকে তার থেকে কোন অংশেই কম নই আমি। কারণ রূপসৌন্দর্যে কোন মর্তবাসী কখনই কোন দেবীর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে না।

বুদ্ধিমান ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, হে আমার প্রিয়তমা দেবী, আমার অনুরোধ, আমার অনুভূতিতে আঘাত দিও না তুমি। আমি বেশই জানি তোমার সঙ্গে তুলনা করলে আমার স্ত্রী পেনিলোপের দেহসৌন্দর্য তুচ্ছতায় ম্লান হয়ে যাবে, কারণ সে মরণশীল মানবী আর তুমি অক্ষয় যৌবনসৌন্দর্য সম্পন্না এক অমর দেবী। তথাপি আমি আমার গৃহে ফিরে যেতে চাই এবং সেই দিনটির প্রতীক্ষায় আমি ব্যাকুল হয়ে আছি। এটাই আমার একমাত্র বাসনা এবং এ বাসনায় আমি অটল। স্বর্গের দেবতারা যদি আমার জলযানটিকে সমুদ্রে আবার বিধ্বস্ত করেন তো করুন। আমার অন্তর সমস্ত রকমের দুঃখকষ্টের জন্য কঠিন করে তুলব। যুদ্ধে আমি দীর্ঘকাল ধরে অনেক তিক্ত ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। সুতরাং আবার যদি কোন নতুন বিপর্যয় আসে আমার জীবনে তাহলে তা আসতে দাও।

ক্রমে সূর্য অস্ত গেল। অন্ধকার নেমে এল ঘন হয়ে। তখন তারা দুজনেই কথা শেষ করে সেই গুহার মধ্যে গিয়ে পরস্পরের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে এক নিবিড় প্রেমঘন রাত্রি যাপন করল।

কিন্তু পূর্ব দিক লাল হয়ে উঠতেই ওডিসিয়াস উঠে পড়লেন নেই গুহাশয্যা হতে। পোশাক পরে তৈরি হয়ে উঠলেন। ক্যালিপসোও পোশাক পরে তার উপর একটি সোনার কটিবন্ধনী এঁটে মাথায় ওড়না চাপিয়ে নিল। তারপর তার মহান অতিথির যাওয়ার ব্যবস্থার কথা ভাবতে লাগল। প্রথমে সে ওডিসিয়াসকে একটি ব্রোঞ্জনির্মিত কুঠার দিল, তার দুই দিকে তীক্ষ্ণ ধার আর হালটি অলিভ কাঠের। তারপর তার হাতে মসৃণ ধাতু দিয়ে তৈরি একটি যন্ত্র দিয়ে তাঁকে নিয়ে গেল দ্বীপের আর এক প্রান্তে এক অরণ্যের মধ্যে। সে অরণে ছিল ফার, পপলার, দেবদারু প্রভৃত বহু আকাশচুম্বী সারবান বৃক্ষ। সেসব গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা জাহাজ প্রভৃতি তৈরি হয়।

ক্যালিপসে ওডিসিকে সে অরণ্য দেখিয়ে দিয়ে চলে এল নিজের গুহার মধ্যে। ওডিসি তাঁর কুঠার দিয়ে পর পর কুড়িটি গাছ কেটে তার শাখা প্রশাখাগুলো হেঁটে করাত দিয়ে চেরার উপযুক্ত করে তুললেন। তারপর ওডিসিয়াস চারদিন ধরে সেই নৌকোটিতে হাল, পাল খাটাবার মাস্তুল, পাটাতন, প্রভৃতি সব কিছু যুক্ত করে তাকে সমুদ্রের শান্ত জলে নামিয়ে পরীক্ষা করে নিলেন। পঞ্চম দিনে তিনি যাত্রা শুরু করলেন।

ক্যালিপসো সেদিন নিজের হাতে ওডিসিকে স্নান করিয়ে উত্তম পোশাক পরিয়ে দিল। তারপর তার নৌকোতে মাংস, জবের আটা, মদ, পানীয় জল প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে দিল। তার আদেশে অনুকূল বাতাস বইতে শুরু করতেই নৌকো ভাসিয়ে রওনা হলেন ওডিসিয়াস। ক্যালিপসো সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে বিদায় দিল তাঁকে।

অনুকূল বাতাসকে ঠিকমত কাজে লাগানোর জন্য নৌকোর উপর পাল খাঁটিয়ে দিলেন ওডিসিয়াস। তারপর দিনরাত অক্লান্তভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে হাল ধরে রইলেন কঠোরভাবে। সমুদ্রে অনেক জলজ জীবজন্তু দেখলেন ওডিসিয়াস। তবু ক্যালিপসের কথামত বাম হাতে শক্ত করে হাল ধরে রাখলেন তিনি। এইভাবে সতের দিন কেটে গেল। আঠারো দিনের দিন অরণ্যচ্ছাদিত সবুজ পাহাড়ে ঘেরা ফ্যাকেসিয়া দ্বীপ দেখতে পেলেন তিনি। সমগ্র দ্বীপটিকে সমুদ্রের উপর একটি চালের মত মনে হচ্ছিল।

এমন সময় ভূকম্পন দেবতা পসেডন ইথিওপিযা হতে ফিরে আসার পথে দূর অলিমি পৰ্বত হতে ওডিসিয়াকে দেখতে পেলেন। ওডিসিয়ার নির্বিঘ্নে সমুদ্রে নৌকো চালিয়ে যাচ্ছে দেখে তাঁর ক্রোধ আরো বেড়ে গেল। তিনি তখন মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে কি বলতে লাগলেন, এই ওডিসিয়াস সম্বন্ধে দেবতাদের মতের পরিবর্তন সাধন করার জন্যই আমাকে ইথিওপিয়া যেতে হয়েছিল। আর সেই ওডিসিয়াস এখন ফ্যাকেসিয়া দ্বীপে উপনীত হতে চলেছে যেখানে একবার পৌঁছতে পারলেই তার সুদীর্ঘ দুঃখের অবসান ঘটবে। তা হোক, তথাপি আমি ওকে আরো একবার বুকভরা কষ্ট দেব।

এই বলে তিনি মেঘদের ডেকে একত্রিত করে তুললেন। তাঁর দণ্ডটি হাতে ধরে সমুদ্রকে উত্তাল হয়ে উঠার আদেশ দিলেন। সমস্ত রকমের ঝড়কে জাগিয়ে তুলে ঘন মেঘান্ধকারে আকাশ পৃথিবী সব একাকার করে ঢেকে দিলেন। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ চারিদিকে হতে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে লাগল বাতাস। উত্তর থেকে এল তুষার ঝড়। এবার ওডিসিয়াসের জানুদুটো কাঁপতে লাগল। তার মনের তেজ কমে গেল। তিনি তখন আপন মনে বলতে লাগলেন, হায় হতভাগ্য, এবার তোমার কি পরিণতি হবে? ক্যালিপসো ঠিকই বলেছে, বাড়ি পৌঁছানোর আগে আমাকে আবার অনেক দুঃখ পেতে হবে। তার প্রতিটি কথাই এখন সত্যে পরিণিত হচ্ছে। সারা আকাশ এখন বিপুল মেঘে ঢাকা। চারদিক হতে ছুটে আসছে দুরন্ত ঝড়। আমার যে সব স্বদেশবাসী ট্রয়ের রণপ্রান্তরে প্রাণবলি দিয়েছে আত্রেউসপুত্রের খাতিরে, তারা আমার থেকে অনেক বেশি ভাগ্যবান।

যেদিন অ্যাকেলিসের মৃতদেহের পাশে আমাকে লক্ষ্য করে ট্রয়সেনারা বর্শা নিক্ষেপ করে সেইদিনই যদি আমার মৃত্যু ঘটত তাহলে খুব ভাল হত। তাহলে অন্তত আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হত এবং গ্রীকরা আমার যশ দেশে বিদেশে প্রচার করত। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে আমাকে এক শোচনীয় মৃত্যুবরণ করে নিতে হবে।

আপন মনে ওডিসিয়াস যখন এইসব কথা বলছিলেন তখন এক বিশাল ঢেউ এসে তার মাথার উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে তার নৌকোটাকে ঘুরিয়ে দিল। তার শক্ত হাতের মুঠি হতে দাঁড়ট ভেঙ্গে গেল। নৌকো থেকে জলে পড়ে গেলেন ওডিসিয়াস আর ঠিক সেইসময় যেন সমস্ত ঝড়ের বেগ সংহত ও সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তাঁর নৌকোর মাস্তুলটা ভেঙ্গে দিল এবং পালটা ছিঁড়ে ভাসিয়ে দিল । অনেকক্ষণ জলের তলায় রয়ে গেলেন ওডিসিয়াস। ক্যালিপসো যেসব পোশাক তাঁকে পরিয়ে দিয়েছিল সেগুলো জলে ভিজে ভারী হয়ে যাওয়ায় তিনি ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে সাঁতার কাটতে পারছিলেন না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর জলের উপরে মাথা তুলে যে লবণাক্ত জল উদরস্থ করেছিলেন তা উদগীরণ করে দিলেন। তারপর কোনরকমে নিজের নৌকোটি ধরে ফেললেন। ঢেউ এর দোলায় ইতস্তত দুলতে থাকলেও তার নৌকোর কথাটা ভুলে যান নি ওডিসিয়াস। সেই ভগ্ন নৌকোটিকে আঁকড়ে ধরেই আসন্ন মৃত্যু হতে বাঁচতে চাইলেন তিনি। কিন্তু কয়েকজন খেলোয়াড় যেমন একটি বল নিয়ে পা দিয়ে নাচাতে থাকে তেমনি ওডিসিয়াসের সেই ভগ্ন নৌকোটি নিয়ে চারদিকের প্রবল বায়ুপ্রবাহ নাচাতে লাগল।

সমগ্র মর্ত্যলোকের মধ্যে ওডিসিয়াসের এই শোচনীয় অবস্থার মাত্র একজন সাক্ষী ছিলেন। তিনি হলেন ক্যাডমাসকন্যা ইনো। ইনো একদিন আমাদের মতই মানুষ ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি দেবীরূপে সমুদ্রগর্ভে বাস করেন এবং দেবতারা তাঁকে লুকোমী নামে অভিহিত করেন। অসহায় ওডিসিয়াসের দূরবস্থা দেখে তাঁর করুণা হলো তার উপর। সমুদ্রগর্ভ থেকে সামুদ্রিক পাখিরূপে পাখা মেলে উঠে এসে তিনি ওডিসিয়াসের ভগ্ন নৌকোর উপর বসলেন।

তিনি বললেন, হায় হতভাগ্য মানব, পসেডন কেন তোমার প্রতি এমনই বিরূপ যে তিনি একের পর এক করে বিপদের কাঁটা ছড়িয়ে চলেছেন তোমার পথে? যাই হোক, তিনি তোমাকে যত দুঃখই দিন না কেন, তিনি তোমার প্রাণ সংহার করবেন না। তোমাকে দেখে জ্ঞানবান মানুষ বলেই মনে হচ্ছে, এখন আমি যা বলছি তাই করো। এখন তোমার সব পোশাক খুলে ফেল, তারপর এই নৌকোটাকে ঝড়ের মুখে ফেলে দিয়ে শুধু নিজের চেষ্টায় সাঁতার কেটে ফ্যাকেসিয়ার উপকূলে গিয়ে ওঠ। সেখানে মুক্তি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। এখন আমি তোমাকে একটি মায়াময় বস্ত্রখণ্ড দিচ্ছি। এটা তোমার কোমরে বেঁধে নাও। কূলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এটি সমুদ্রের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে যাবে, পিছন ফিরে তাকাবে না।

এই বলে ওডিসিয়াসকে সেই ওড়নাটি দিয়ে সমুদ্রের মধ্যে জলজ জীবের মত ডুবে গেলেন লুকোমী। নিজের মনেই বিহ্বল বিমূঢ় হয়ে ভাবতে লাগলেন ওডিসিয়াস। নিজের অদম্য আত্মার সঙ্গে এই পরামর্শ করতে লাগলেন। নিজের আত্মাকে প্রশ্ন করলেন তিনি, নৌকো, ত্যাগ করার এই পরামর্শ গ্রহণ করা তাঁর যুক্তিসঙ্গত হবে কি না। এটা আবার কোন দেবতার নতুন এক চক্রান্ত কি না ভেবে পেলেন না তিনি।

নিজে নিজেই মনস্থির করে ফেললেন ওডিসিয়াস। আপন মনে বললেন, না, আমি এখনই এ নৌকো ত্যাগ করব না। যে কূলে পৌঁছলে আমি মুক্তি পাব সে কূল এখনো অনেক দূরে। আমি নিজে যা ভাল বুঝি তাই আমি করব। যতক্ষণ পর্যন্ত এই নৌকোটি একেবারে ভেঙ্গে না যাবে ততক্ষণ আমি এইভাবেই তাতে চেপে থাকব। যখন কোন ঢেউ-এর চাপে এটি একেবারে ভেঙ্গে যাবে তখনই আমি সাঁতার কেটে যাব যতদূর সম্ভব। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে ভাল যুক্তি।

ওডিসিয়াস যখন আপন এই সব কথা ভাবছিলেন তখন আর একটি বিরাট ঢেউ তাঁর সামনে পাঠিয়ে দিলেন পসেডন। সেই ভয়ঙ্কর ঢেউ ওডিসিয়াসের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল এবং তার নৌকোর কাঠগুলো ভেঙ্গে ছড়িয়ে দিল। সেই নৌকোর পাটাতনের একটি কাঠের সঙ্গে তার কোমরটাকে লুকোমরী দেওয়া সেই ওড়নাটি দিয়ে বাঁধলেন ওডিসিয়াস, তারপর ক্যালিপস্যের দেওয়া সেই পোশাকগুলো খুলে ফেললেন এবং দুটি বাহু প্রসারিত করে সেই কাঠের সঙ্গে ডুবতে আর উঠতে লাগলেন।

এবার পসেডন সবকিছু দেখে মাথা নেড়ে আবার বিড় বিড় করে কি বললেন, অনেক হয়েছে, এখন ফ্যাকেসিয়া দ্বীপে যাবার জন্য শুরু করো তোমার কষ্টকর সমুদ্রযাত্রা। সেখানকার লোকদের দেবতারাও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তবে সেখানে তুমি পৌঁছলেও সেখানে কিছু পাবে তা নিয়ে আনন্দ করার মত মনোভাব তোমার থাকবে না। এই কথা বলে তাঁর রথের ঘোড়াগুলোকে নিয়ে তাড়না করে ঈগার প্রাসাদের দিকে চলে গেলেন।

এইবার ওডিসিয়াসের সাহায্যে অবতীর্ণ হবার প্রয়োজন অনুভব করলেন দেবী এথেন। তিনি একমাত্র উত্তর ছাড়া অন্য সব দিকেই বায়ুপ্রবাহগুলোকে শান্ত হয়ে নিদ্রা যাবার আদেশ দিলেন। একমাত্র উত্তর দিক হতে শক্তিশালী অনুকূল বাতাস আকর্ষণ করে সুলভ ও সহজ করে দিলেন সন্তরণকারী ওডিসিয়াসের যাত্রাপথকে। ওডিসিয়াস এই আসন্ন মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার লাভ করে ফ্যাকেসিয়া অধিবাসীদের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারে তার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। দুই রাত্রি দুই দিন কূলহারা সেই সমুদ্রের মাঝে অসহায়ভাবে ভেসে বেড়াতে লাগলেন ওডিসিয়াস। বারবার তিনি মরতে মরতে বেঁচে গেলেন। তারপর তৃতীয় দিনে সমস্ত ঝড় থেমে গেল। শান্ত হয়ে গেল সমুদ্রের বুক।

একটি বড় ঢেউঢের মাথার উপর উঠে ওডিসিয়াস দেখলেন কূল আর বেশি দূরে নেই। অরণ্যাচ্ছাদিত এক উপকূলভূমি দেখে আনন্দের সীমা রইল না ওডিসিয়াসের। বহুদিন পর শক্ত মাটিতে পা দেবার জন্য আরো জোরে সাঁতার কাটতে লাগলেন ওডিসিয়াস। তিনি কূলের কাছাকাছি হতেই সমুদ্র থেকে একটি বিরাট ঢেউ এসে আছাড় খেয়ে কূলে পড়ে তার চারদিকে জল ছড়িয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন করে দিল সমগ্র উপকূলভূমি। ওডিসিয়াস দেখলেন নৌকো ভেড়াবার কোন জায়গা নেই কূলে। শুধু খাড়াই পাহাড় গভীর জলের ধার ঘেঁষে উঠে গেছে। কূলে ওঠার কোন পথ না পেয়ে ওডিসিয়াস তখন হতাশার সঙ্গে বলতে লাগলেন, যখন আমি সব আশা ত্যাগ করে নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম, তখন জিয়াস আমার স্থলভাগের সন্ধান দেন। আমি তাই সমুদ্রের অবিরাম তরঙ্গাভিঘাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য প্রাণপণ শক্তিতে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাই বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের গভীর জলের ধার ঘেঁষে এমনভাবে খাড়াই পাহাড়গুলো উঠে গেছে যে কোন মানুষ দু পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আমি যদি ঐ পাহাড়ের গায়ে ওঠার চেষ্টা করি তাহলে সেই সময় একটা বড় ঢেউ এসে আমার দেহটাকে পাহাড়ের গায়ে জোরে আছড়ে দেবে। আমার চেষ্টায় কোন ফল হবে না। আর যদি কূলের পাশে পাশে সাঁতার কেটে চলি কোন বন্দর বা নামার উপযুক্ত কোন বেলাভূমির আশায় তাহলে হয়ত আবার কোন বড় ঢেউ এসে আমাকে সমুদ্রের কোন মৎস্যসঙ্কুল এলাকায় নিয়ে যাবে যেখানে মাছেরা আমার দেহটাকে ছিঁড়ে খাবে অথবা কোন সমুদ্রগর্ভস্থ বিরাটকায় জলজ জন্তু আক্রমণ করবে আমাকে। আমি জানি এ্যাফিত্রিতে এইসব ভীষণকায় জলজ জন্তুর জন্ম দেয়। তার উপর ভূকম্পনদেবতা পসেডন তো আমায় খুবই ঘুণা করেন।

এ কথা ভাবা শেষ না হতেই একটা বিরাট ঢেউ এসে হঠাৎ তাঁকে পাথরঘেরা উপকূলের দিকে টেনে নিয়ে গেল। এসে পাথরের ধাক্কা লেগে তার দেহের সব অস্থি মজ্জা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যেত যদি না দেবী এথেনের কৃপায় একটা পাথরকে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরার একটা বুদ্ধি তাঁর মাথায় এসে যেত। ওডিসিয়াস সেই পাথরটাকে সজোরে ধরে রইলেন। ঢেউটা পাশ দিয়ে চলে গেল, কিন্তু ফেরার পথে ঢেউটা জোর করে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে তাঁর হাতের কিছুটা মাংস ছিঁড়ে সেই পাথরে গায়ে লেগে রইল। সেই বিরাট ঢেউটা ওডিসিয়াসের মাথার উপর দিয়ে বয়ে যাবার সময় তাকে একেবারে ডুবিয়ে দিত এবং এইভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে মৃত্যুবরণ করতে হত। কিন্তু হঠাৎ দেবী এথেন তার একটা বুদ্ধি এনে দিলেন মাথায়। সেই ঢেউটার কবল থেকে কোনরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে আবার কূলের দিকে সাঁতার কাটতে লাগলেন ওডিসিয়াস। কূল বরাবর সাঁতার কাটতে কাটতে হঠাৎ একটা নদীর মোহনা দেখতে পেলেন। সেই নদী মুখটাতে ঢুকে পড়ে দেখতে পেলেন সেই নদীর তীরে কোন পাহাড় নেই এবং সেখানে ঝড়েরও কোন প্রকোপ নেই। ওডিসিয়াস তখন নদীর দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানিয়ে বললেন, হে দেবতা, শোন আমার প্রার্থনা। যদিও তোমার নাম জানি না তথাপি আমার কাতর আবেদনের কথা একবার শোন। একমাত্র তুমিই পার আমাকে এই বিক্ষুদ্ধ সমুদ্রের কবল আর পসেডনের রোষ থেকে রক্ষা করতে। স্বর্গের অমর দেবতারাও কোন অসহায় ভ্রমণকারী পথিকের সাহায্যের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন না। আমি এখন বহু দুঃখকষ্ট ভোগের পর তোমার পবিত্র বুকে আশ্রয় নিতে চাই। আমার প্রতি সদয় হও হে নদী।

তাঁর এই কাতর প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে নদীটি তার উত্তাল ঢেউগুলোকে প্রশমিত করে ওডিসিয়াসকে সাঁতার কাটার সুযোগ দিল। এবার সহজেই সেই নদীর তীরে গিয়ে উঠলেন ওডিসিয়াস। অবিরাম সমুদ্র তরঙ্গের সঙ্গে সংগ্রাম করে করে অবসন্ন দেহে তিনি শুয়ে পড়লেন সেই নদীতীরে। তাঁর সমগ্র দেহ ফুলে গিয়েছিল এবং মুখ ও নাসারন্ধ্র দিয়ে লবণাক্ত জল বার হচ্ছিল ক্রমাগত। এক ভয়ঙ্কর ক্লান্তিতে তার দেহটা এমন অসাড় হয়ে গিয়েছিল যে তার বসার কোন শক্তি ছিল না। এবার কোমর থেকে সেই দেবী ইনোর দেওয়া ওড়নাটি খুলে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে আর পিছন ফিরে তাকালেন না। নদীর ঢেউ সেই ওড়নাটি ভাসিয়ে সমুদ্রে নিয়ে গেল এবং অবিলম্বে তা ইনোর হাতে চলে গেল। নদীর পানে পিছন ফিরে তার তীরে গিয়ে বহুআকাঙ্ক্ষিত পৃথিবীর মাটিতে আবেগ্ৰে সঙ্গে চুম্বন করলেন ওডিসিয়াস।

এবার নিজের অবস্থার কথা ভাবতে লাগলেন ওডিসিয়াস। আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগলেন এরপর তার অবস্থা কি হবে। যে দুঃসাহসিক অভিযানে একা অসহায়ভাবে বার হয়েছেন তিনি, তাঁর শেষ পরিণতি কোথায়। তিনি আপন মনে বলতে লাগলেন, যদি আমি এই নদীচরে রাত্রিতে পড়ে থাকি এই অবস্থায় তাহলে তীক্ষ্ণ তুষার ও শিশির আমার অবসন্ন ও মৃতপ্রায় দেহটাকে আরো বিপন্ন করে তুলবে। আর ভোরের দিকে নদীতীরে কি রকম ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বয় তাও আমার জানা আছে। আবার যদি নদীতীরে এই চড়াটা পার হয়ে ঐ গভীর অরণ্যে গিয়ে শৈত্যনিবিড় বাতাসের হাত হতে রক্ষা পেয়ে আরামে ঘুমিয়ে পড়ি কোন গাছের তলায় তাহলে রাত্রিতে কোন হিংস্র জন্তুর পেটে চলে যেতে পারি।

যাই হোক, সেই উপত্যাকাবস্থিত নির্জন অরণ্যপ্রদেশে রাত্রি যাপনেরই স্থির করলেন ওডিসিয়াস। তীরভূমির অদূরে পরিষ্কার প্রশস্ত পথ দেখতে পেলেন। সেখানে আছে অলিভ গাছের ঝোঁপ। সেই অলিভ লতাগুলো এমন সব ঘনসংবদ্ধ গাছের শাখা প্রশাখাগুলোকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে যাতে তার মধ্যে বাতাস ঢুকতে পারে না, আলোর কোন রশ্মি বা বৃষ্টির কোন ফোঁটা তার মধ্যে দিয়ে তার তলদেশের মাটিকে স্পর্শ করতে পারে না। ওডিসিয়াস সেই ঝোঁপের ভিতরে ঢুকে দেখলেন সেখানে শুকনো ঝরাপাতা রয়েছে প্রচুর। তার উপর দু-তিন জন লোকের ভালভাবে শোয়া হয়। ওডিসিয়াস তার মধ্যে গুঁড়ি মেরে ঢুকে কিছু পাতা পেতে কিছু পাতা শোয়ার পর তাঁর গায়ের উপর চাপিয়ে নিলেন। এবার ওডিসিয়াসের চোখে ঘুম এনে দিলেন এথেন। যে ঘুম মানুষের শ্রমজনিত সকল ক্লান্তি অপনোদন করে সেই ঘুমের ঘুরে মুদ্রিত হয়ে গেল তাঁর চোখের পাতাগুলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *