০৫.
কলেজ ক্যান্টিনে গজল্লা চলছিল জোর। গত কালই ভারতীয় ক্রিকেট দলের নাম ঘোষণা হয়েছে। দেশের মাটিতেই খেলা, এবং যথারীতি সৌরভ গাঙ্গুলি বাদ। অনেকেই খেপে লাল, চোখা চোখা বাক্যবাণ ছাড়ছে। বিরুদ্ধ মতও পোষণ করে কেউ কেউ, তারাও নীরব নেই।
অনিরুদ্ধ টেবিল ঠুকে বলল,— শুড্ডাটাকে ফুটিয়ে দিয়ে ভালই করেছে। যা ব্যাটা, এবার খেলা ছেড়ে মেয়েটাকে নিয়ে বোস। ইংরিজি বাংলা পড়া।
সচিন শুড্ডা না? পল্লব গরগর করে উঠল,— দু’-দুটো বাচ্চার বাপ!
তীর্থঙ্কর ভেংচে উঠল,— রাহুল কি কচি খোকা? দুদু খায়?
আবীর বিজ্ঞের সুরে বলল,— বয়স-টয়স কোনও ফ্যাক্টর নয়। বেঙ্গলের বিরুদ্ধে চিরকাল ষড়যন্ত্র চলছে। একা সৌরভ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, চান্স পেয়ে কচাং কেটে দিল।
রাজ্যশ্রী চশমা ঠিক করতে করতে বলল,— কিরণ মোরে আর গ্রেগ চ্যাপেল, দুটোকেই সামনে পেলে আমি কান মুলে দিতাম।
গ্রেগ চ্যাপেলের কান অবধি তোর হাত পৌঁছোবে না রে। ওই বাঁটকুলটাতেই থেমে যা।
আমার মনে হয় স্পনসরারদেরও একটা খেলা আছে। রাহুল যাদের অ্যাড করে, তাদের বোধহয় এখন জোর বেশি। সৌরভকে তারাই নির্ঘাত চেপে দিল।
ওসব বললে তো হবে না। লাস্ট দু’বছরে কী করেছেন মহারাজ? মাল্লু কামানো ছাড়া?
সৌরভের দশ হাজার রানটা কিরণ মোরের দাদু করে গেছে নাকি? বাইশটা ওয়ান ডে সেঞ্চুরি করে এখন বসে বসে মাঠের ঘাস ছিঁড়বে?
হচ্ছে, সব হচ্ছে। বস যে-দিন মাঠে ফিরবে, সুদে আসলে সব শোধ করে দেবে।
তিতানও বসে আছে দঙ্গলে। সৌরভ টিমে না থাকায় সেও ব্যথিত। তবে মন্তব্য করছিল না কোনও। সে ব্যস্ত অন্য কাজে। টেবিলের উলটো কোণে বসে আছে শ্রেয়া, তার সঙ্গে চোখে চোখে খেলা চলছিল তিতানের। শ্রেয়ার ইশারা, তিতান উঠে পড়ুক। তিতান বলছে, আর একটু বসতে। শ্রেয়ার চোখে অসহিষ্ণু ভাব, তিতানের চোখে অনুনয়…।
গুলতানির মাঝে হঠাৎই শ্রেয়া বলে উঠল,— এই সায়র, তুই টিউটোরিয়ালে যাবি না?
তিতান চমকে ঘড়ি দেখল। আশ্বস্তও হয়েছে পরক্ষণে। সবে সওয়া তিনটে, টিউটোরিয়াল ক্লাস সাড়ে চারটেয়। তবু কী ভেবে সে উঠেই পড়ল।
ওমনি দশ-বারো জোড়া চোখ একসঙ্গে ঘুরেছে।
পল্লব বলল,— কী রে, যুগলে কাটছিস?
শ্রেয়া ভ্রূভঙ্গি করল,— সায়র আমায় একটু এগিয়ে দেবে।
দীপাবলি বলল,— কেন, তুই একা একা বাস্টস্টপ অবধি যেতে পারিস না বুঝি?
আমার খুব ভয় রে। শ্রেয়ার অঙ্গে হাসির হিল্লোল বয়ে গেল,— মোড়ের পানওয়ালা ছেলেটা আমার দিকে এমন ভাবে তাকায়!
নেকু। অনিরুদ্ধ হাত তুলল,— মারব এক ঝাপড়।
খিলখিল হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শ্রেয়া। তিতানও। শ্রেয়ার সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়ের আড় কেটেছে অনেকটা। টের পেয়েছে, শ্রেয়া তার সঙ্গ সত্যিই ভালবাসে। তিতানেরও মন্দ লাগে না। করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্বচ্ছন্দ গলায় শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল,— তুই কি এখন বাড়ি?
জেনে কী করবি! তুই তো ওখানে ফেবিকল হয়ে সেঁটে ছিলি।
গ্রুপ থেকে দুমদাম ওঠা যায় নাকি?
তুই একটা কেবলুশ। আমি কেমন তোকে বার করে আনলাম! …যাক গে, হাতে সময় আছে?
ওই যে… টিউটোরিয়াল। তাও ধর, আরও ঘণ্টাখানেক তো…
তুত্, এক ঘণ্টায় কী হয়? ভাবছিলাম…। শ্রেয়া ভাবনাটা অবশ্য প্রকাশ করল না। ঘাড় হেলিয়ে তিতানের মুখটা দেখতে দেখতে বলল,— তুই কিন্তু অল্প দাড়ি রাখতে পারিস।
কেন?
তা হলে তোকে বেশ ম্যাচো লাগত। ঝক্কাস।
এরকম একটা ধারণা তিতানেরও আছে। দাড়ি রাখলে গালফোলা ভাবটা চাপা পড়ে। টুয়েলভে পড়ার সময়ে টিউটোরিয়ালের গৈরিকাও বলেছিল কথাটা। সেই মতো বেশ কিছু দিন গালে রেজার ঘষা বন্ধ করেছিল। ওফ্ কী কুটকুট করে, বাপ্স! দিদিটাও এমন আওয়াজ মারল…! আবার কি শুরু করবে?
তিতান কায়দা করে বলল,— আমাকে ম্যাচো লেগে তোর লাভ?
তুই বুঝি সব কিছুতে লাভলোকসান হিসেব করিস?
না করলে চলে? দুনিয়াটাই তো এখন হিসেবের।
তাই বুঝি? শ্রেয়া ফের ঘাড় হেলাল,— এখন কী হিসেব করে আমার সঙ্গে বেরোলি?
প্রশ্নটা সরলও বটে। জটিলও বটে। কোন জবাবটা লাগসই হবে ঠাহর করতে পারল না তিতান। কয়েক মিনিটের ভাললাগাকে কি হিসেবের খাতায় ফেলা যায়? ক্রেডিটটা নয় বোঝা গেল, ডেবিটটা কী?
শ্রেয়া উত্তরের অপেক্ষায় নেই। কলকল করছে,— এই জানিস, নম্রতা খুব জেলাস হয়ে পড়েছে।
কিউ?
কচি খোকা! বোঝো না? তুই আমার সঙ্গে ঘুরছিস, তাই।
নম্রতা? তোদের সাইকোলজির মেয়ে?
জেনে কী করবি? ওর পেছনেও লাইন লাগাবি?
আমি কি তোর সঙ্গে লাইন করছি নাকি?
তা ছাড়া কী? শ্রেয়া কটাক্ষ হানল,— এন-ডির ক্লাসের সময়ে জানলা দিয়ে ঝাড়ি মারছিলি কেন?
জাস্ট করিডর দিয়ে যাচ্ছিলাম…
টুপি মেরো না। ছেলেদের চোখ আমি খুব চিনি। তবে একটা কথা কিন্তু বলে দিচ্ছি সায়র, আর কোনও মেয়ের দিকে তাকালে ড্যাবড্যাবা চোখ দুটো আমি গেলে দেব।
যাহ্ বাবা, কলেজে এসে অন্ধ হয়ে থাকব নাকি? তিতান কবিত্ব করার চেষ্টা করল, —এত ফুল ফুটেছে চার দিকে, তাকিয়ে দেখব না?
না। একদম না। তিতানের কোমরে একটা চিমটি কাটল শ্রেয়া,— খুব ফুলে ফুলে মধু খাওয়ার শখ, অ্যাঁ?
ফুলের তো জন্মই হয়েছে মধু বিতরণের জন্য।
আমায় রাগাস না বলছি। ভাল হবে না কিন্তু। কখন যে কলেজের গেট পেরিয়ে মোড়ে চলে এসেছে, খেয়ালই নেই দু’জনের। আচমকা শ্রেয়া বলে উঠল,— ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, তাকাচ্ছে!
হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরে যাওয়ায় তিতান সেকেন্ডের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা। পরক্ষণে দৃষ্টি গেছে পানের দোকানে। বছর পঁচিশের লুঙ্গি-গেঞ্জি ছেলেটা মাথা নিচু করে একমনে পান সাজছে।
তিতান অবাক হয়ে বলল,— দেখছে কোথায়? ও তো কাজ করছে!
চোখ উঠছে নামছে। তুই বুঝতে পারবি না। গিয়ে সিগারেট কেন, তা হলে প্রমাণ হয়ে যাবে।
ফালতু সিগারেট কিনব কেন? আমি তো খাই না।
একদম না?
একদম না।
জীবনে খাসনি?
নেভার। তিতান গর্বের সুরে বলল,— আই হেট স্মোকিং।
হঠাৎই হাসিতে ভেঙে পড়ল শ্রেয়া। প্রথমে দোপাট্টা চেপে, তারপর শরীর কাঁপিয়ে, রীতিমতো শব্দ করে।
তিতান গোমড়া হল,— হাসির কী আছে?
হিহি। তুই জীবনে একটাও সিগারেট খাসনি? হিহি। আমি ভাবতেই পারি না।
তুই যেন অনেক খেয়েছিস?
কঅঅত। এখনও তো খাই। জানিস, আমাদের পাড়ায় একটা মেয়ে ছিল … ধৃতি…। উঁহুঁ, চোখ বড় বড় করে কৌতূহল দেখাস না। তুই ধৃতির নাগাল পাবি না। এখন কানপুর আই-আই-টিতে ফিজিক্স নিয়ে পড়ছে। আমরা দু’জনে ছাদে গিয়ে…। এখন তো ধৃতি প্রায় চেন স্মোকার। হস্টেলে থাকে তো, বিন্দাস লাইফ…!
তুই বাড়িতে সিগারেট খাস?
কম। লুকিয়ে-চুরিয়ে। মা বাড়ি থাকলে টের পায়। বাথরুম থেকে বেরোলে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখে। আর নাক কুঁচকোয়। বাপি জিন্দেগিতে বুঝবে না, হেভি স্মোক করে তো। বাথরুমে তো বিড়ি নিয়ে ঢোকে। বলে, ছোটবেলার অভ্যেস, বিড়ি না টানলে নাকি পটি হয় না। হিহি। হিহি।
তুই কিনিস কী করে? দোকানে গিয়ে স্ট্রেট চাস?
নয় তো কী! তবে পাড়ায় না, বেপাড়ায়। পাশের লোকজন একটু চোখ বেঁকিয়ে তাকায়… কিন্তু তাতে আমার কলা! তোরা খেলে দোষ নেই, আমরা টানলে পাপ? মা-ও কোয়েশ্চেন করলে সোজা বলে দেব, আগে তোমার বরের ফোঁকাটা ছাড়াও। বললেই চুপসে যাবে। হিহি হিহি৷
হরেক রকম বকবকানি চলছে তো চলছেই। অর্থহীন আবোল তাবোল কুজন, যা শুধু এই উনিশ-কুড়ি বছরেই সম্ভব। এই কুজন হয়তো কোথাও গিয়ে পৌঁছোবে না শেষ পর্যন্ত, তবু এইটুকুতেই বড় সুখ।
আধ ঘণ্টাটাক পরে বাসে উঠে গেল শ্রেয়া। যাওয়ার আগে একটুখানি হাতের ছোঁয়া দিয়ে গেল তিতানকে। জানলায় বসে আঙুল নাড়ছে।
তিতানের বিকেলটা ঝপ করে ফাঁকা। শ্রেয়ার স্পর্শটুকু নিয়ে হাঁটছে ধীর পায়ে। খিদে পাচ্ছিল অল্প অল্প, একটা স্টেশনারি দোকানে দাঁড়িয়ে টিফিনকেক কিনল একটা। দোকানে দাঁড়িয়েই প্যাকেটখানা ছিঁড়ল। খাচ্ছে।
সহসা ঘাড়ে হাত। চমকে তাকাল তিতান। শ্ৰীমন্ত আর অমিত। শ্ৰীমন্ত ভুরু কুঁচকে বলল,— এখানে দাঁড়িয়ে কেক সাঁটাচ্ছিস? এদিকে আমরা তোকে কলেজে খুঁজে খুঁজে হাল্লাক হয়ে গেলাম!
কেকের শেষ অংশটুকু মুখে পুরে তিতান জিজ্ঞেস করল,— কেন শ্ৰীমন্তদা?
পরশু আমাদের শিল্পায়ন নিয়ে জাঠা বেরোবে, খেয়াল আছে?
হ্যাঁ, জানি তো। পরশু আসব তো।
তার আগে প্রস্তুতি নেই? সুবোধ মল্লিক স্কোয়্যারে ছাত্রদের রাজ্য স্তরে সমাবেশ, সেখানে আমাদের কলেজ থেকে শুধু দশ-বারো জন মুখ দেখালেই চলবে?
না। স্টুডেন্টদেরও নিয়ে যেতে হবে।
সে তো একটা পার্ট। হেড-কাউন্ট বাড়ানোর জন্যে কলেজ গেট সাড়ে বারোটায় ক্লোজ করে দেব। কেউ যেন কাট না মারতে পারে।
তাতেও গুনতি খুব বাড়বে কি? সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস ডিসলভ্ হয়ে গেছে, থার্ড ইয়ার তো প্রায় আসেই না…
অতএব ফার্স্ট ইয়ারকে ছাড়া নেই। অ্যাট লিস্ট হানড্রেড হেড না হলে আমাদের কিন্তু প্রেস্টিজ পাংচার।
ফটক আটকে ছেলেমেয়েদের গোরু ছাগলের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা কেমন যেন লাগে তিতানের। তবু বলল,— ঘাবড়াচ্ছ কেন? আশি-একশো জন কোনও ব্যাপার নয়।
হলেই ভাল। অমিত ঘাড় নাড়ল,— এ ছাড়াও তো কাজ আছে। ফেস্টুন রেডি করা, প্ল্যাকার্ড লেখা, ট্যাবলো বানানো…
আমার হাতের লেখাটা কিন্তু ভাল নয় অমিতদা।
জানি, জানি। তোর অন্য কাজ। চল চল, পার্টি অফিসে চল।
এখন? তিতান কবজি উলটে ঘড়ি দেখল,— আমার যে টিউটোরিয়াল ক্লাস আছে… এক্ষুনি…
একদিন টিউটোরিয়ালে না গেলে কিচ্ছু লস হয় না। তিতানের কাঁধ ধরে টানল শ্ৰীমন্ত, টিউটোরিয়ালের চেয়ে শিল্পায়ন অনেক বেশি জরুরি। তোর আমার ফিউচারের জন্যই তো শিল্পায়ন।
এটুকু বোঝার জন্য শ্রীমন্ত-অমিতের জ্ঞান না খেলেও চলবে তিতানের। কিন্তু পড়াশুনো না করলে, রেজাল্ট একটু ওপর দিকে না থাকলে, নতুন নতুন ইন্ডাস্ট্রিতে চাকরি জুটবে কোথথেকে?
তিতান গলা ঝেড়ে বলল,— আজ আমায় ছেড়ে দাও প্লিজ। কাল হোল-ডে জান লড়িয়ে দেব। ওয়াদা। নিজের হাতে ফেস্টুন-টেস্টুনগুলো…
কাল হচ্ছে কাল। আজকের দিনটা, আজকের দিন। আজ পল্টুদা থাকবে ওখানে, আমাদের স্টুডেন্ট ফ্রন্টের ডিস্ট্রিক্ট কমিটির দু’জন ওয়েট করছে…। মিছিলের ব্যাপারে থরো গাইড লাইন দেবে। বরুণদা তোকে অতি অবশ্য নিয়ে যেতে বলেছে।
অত এক্সপ্লেন করার কী আছে? অমিত হঠাৎ অসহিষ্ণু,— যেতে হবে, মানে যেতে হবে, ব্যস। কেউ কি জানে না, একটা র্যালি অর্গানাইজ করা কত বড় দায়িত্বের কাজ!
প্রতিবাদের আর কোনও সুযোগই নেই। দুই কমরেডের বগলদাবা হয়ে চলল তিতান। কিন্তু মন থেকে যেন সায় পাচ্ছে না তেমন। এবার ট্যুর থেকে ফিরে বাবা হঠাৎ তিতানের লেখাপড়ার হালহকিকত জানতে চাইছিল। দু-চার মিনিটের বাতচিতে কী বুঝল কে জানে, টিউটোরিয়ালে ভরতি হওয়ার হুকুম জারি হল তৎক্ষণাৎ। সেই টিউটোরিয়ালে আজ সবে তৃতীয় দিন, এর মধ্যেই কামাই! প্রচুর টাকা নিচ্ছে নেভিগেটার। সপ্তাহে দু’দিন, চারটে সাবজেক্ট, মাসে দু’হাজার। একদিন ডুব মানে নিট আড়াইশো টাকা জলে। বাবা জানলে তুলকালাম করবে। তা ছাড়া সত্যিই আজ যাওয়াটা বিশেষ দরকার ছিল। বিজনেস ইকনমিক্সের ক্লাস ছিল আজ, ট্রায়াল ব্যালেন্সও শুরু করার কথা…। পরীক্ষার আর তিন মাসও নেই, কী যে হবে!
হঠাৎ পল্লবকে মনে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে তিতান জিজ্ঞেস করল,— পল্লব এল না?
পল্লব এখন ইউনিয়ন রুমে। বরুণদাকে হেলপ করছে।
যাক, ও ব্যাটাও তা হলে পালাতে পারেনি! মনে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা পেল তিতান। তবে পল্লব যা ঘুঘু, সিগারেট কেনার নাম করে বেরিয়ে হাওয়া মারবে হয়তো! এবং কাল এসে এমন একটা ঢপ ঝাড়বে…!
পার্টি অফিস মিনিট দশেকের রাস্তা। মেন রোড থেকে একটা গলি ঢুকেছে ডাইনে, খানিক গিয়ে গলি চওড়া হয়েছে অনেকটা, সেখানে। দোতলা বাড়িটার সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছ। সম্ভবত লাল ফুল ফুটবে বলেই লাগানো হয়েছিল। তবে গাছটা বড় হয়ে সামান্য বেইমানি করেছে। ফুল ফুটছে বটে, কিন্তু রং কেমন ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে, কমলা কমলা।
অফিসটায় মাত্র একদিন এসেছে তিতান। বরুণের সঙ্গে। সে-দিনের মতোই দোতলায় গেল তিতানরা। মাঝারি ঘরটায় পল্টু বসে, সঙ্গে আরও সাত-আটজন। তিতান অবাক হয়ে দেখল, শ্ৰীমন্ত অমিতকে নয়, তাকেই হাত তুলে অভ্যর্থনা জানাল পল্টু বিশ্বাস।
এসো, এসো সায়র। এত দেরি করলে কেন তোমরা?
তিতানের মরচে পড়া ভাবটা কেটে গেল। সে কলেজের জি-এস নয়, নতুন ইউনিয়নে অমিতই এবার সাধারণ সম্পাদক। অথচ তাকে গুরুত্ব না দিয়ে, প্রশ্নটা সায়রকেই…!
তিতান জবাব দেওয়ার আগে অমিত বলল,— ওকে খুঁজতে গিয়েই তো…। টিউটোরিয়ালে চলে যাচ্ছিল…
তাই নাকি? কোথায় পড়ছ?
নেভিগেটার। গাঙ্গুলিবাগানে।
ও, দেবাশিসের কারখানায়? মধ্যবয়সি পল্টু বিশ্বাসের ঠোঁট স্মিত হাসি,— ওরা নাকি ভাল নোটফোট দেয়?
আমি সদ্য অ্যাডমিশন নিয়েছি। ঠিক জানি না। তবে শুনেছি…
ভাল। খুব ভাল। তবে আমার অ্যাডভাইস যদি শোনো… শুধু টিউটোরিয়ালের ভরসায় থেকো না, নিজেও বাড়িতে পড়াশুনো কোরো। চোখ থেকে হাই-মাইনাস পাওয়ার চশমা খুলল পল্টু বিশ্বাস। পাঞ্জাবির খুঁটে কাচ মুছতে মুছতে বলল,— তোমাকে আরও কয়েকটা কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। এক্ষুনি রুটিন ডিসকাশন স্টার্ট হয়ে যাবে, তখন হয়তো আর খেয়াল থাকবে না…। শ্ৰীমন্ত অমিত সবাই আছে, তাদের সামনেই বলছি, তোমার মধ্যে কিন্তু একটা স্পার্ক আছে। আলাদা একটা চার্ম আছে। আমি খবর পেয়েছি, স্টুডেন্টদের মধ্যে তোমার একটা পজেটিভ ইমেজ আছে। ছেলেমেয়েরা তোমায় পছন্দ করে। তোমার এই কোয়ালিটিটা কাজে লাগাতে চাই বলেই তোমাকে এবার জি-এস করা হয়নি। করলে তুমি একটা কলেজেই আটকে যেতে। তোমাকে আমরা আরও বড় ফিল্ডে আনতে চাই।
তিতানের কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। ফ্যালফ্যাল মুখে বলল,— বড় ফিল্ড মানে?
তোমাকে ওভার অল স্টুডেন্ট ফ্রন্টে চলে আসতে হবে। মানে সামগ্রিক ছাত্র সংগঠনের কাজ করতে হবে তোমাকে। কী হে, পারবে না?
তিতান ঢোক গিলে বলল,— কী কাজ?
সে আছে অনেক। জানতে পারবে আস্তে আস্তে। … আরও একটা ব্যাপার তোমায় বলি। দিনকাল তো বদলেছে, এখন নিঃস্বার্থ ভাবে কাউকে কোনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলাটা বোধহয় আর শোভা পায় না। এটা বাজার-অর্থনীতির যুগ। ফরচুনেটলি অর আনফরচুনেটলি আমরাও তার বাইরে থাকতে পারছি না এখন। নীতি আদর্শ নিশ্চয়ই থাকবে, নিজের নিজের জায়গায়। এবং আমাদেরও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ঠিক কি না?
তিতান ঢক করে ঘাড় নেড়ে দিল,— হ্যাঁ, সে তো বটেই।
তাই বলছিলাম… পড়াশুনো করো, পড়াশুনোটা মাস্ট। তবে একই সঙ্গে পার্টির কাজ করাটাও মাস্ট। পড়াশুনোর পিছনে সময় দিলে পড়াশুনো যেমন ফল দেয়, পার্টির জন্য টাইম দিলে পার্টিও তোমায় রিটার্ন দেবে। বলতে পারো, এটা এক ধরনের গিভ অ্যান্ড টেক পলিসি। … পরীক্ষা টরিক্ষা নিয়ে ভেবো না, দরকার হলে সে দায়িত্ব আমরা নেব। ইউ গিভ ইয়োর বেস্ট টু দা পার্টি। অ্যান্ড পার্টি উইল সি, কীসে তোমার ভাল হয়। কী বললাম, বুঝতে পারলে?
দুর্বোধ্য কিছু বলেনি পল্টু বিশ্বাস। তিতানের মনোবাসনা আর পল্টু বিশ্বাসের আশ্বাসবাণী কি খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে না? তবু তিতানের কেন যে গলা শুকিয়ে আসে?
জিভ বুলিয়ে তিতান ভিজোল তালুটা। মৃদু স্বরে বলল,— আমি আমার আপ্রাণ করব পল্টুদা।
গুড। পার্টির ক্লাসটাস হলে খবর পাঠাব, চলে এসো। বলেই পল্টু বাকিদের দিকে ফিরেছে,— আর কী, এবার তা হলে শুরু করা যাক।
পরশুর মিছিল আর সমাবেশ নিয়ে চলছে আলোচনা। ঠিক করা হচ্ছে কলেজ থেকে রওনা দেওয়ার সময়, পথ, স্লোগান, ব্যানারের ভাষা…। শ্ৰীমন্ত, অমিত আর জেলা ছাত্রনেতারাই বলছে বেশি। তবে পল্টুদা কোনও পরামর্শ দিলে তা নির্দেশের মতো ঢুকিয়ে নেওয়া হচ্ছে কর্মসূচিতে।
এই ধরনের নীরস কচকচিতে তিতানের হাই ওঠার কথা। কিন্তু আজ সে হঠাৎ আগ্রহভরে শুনছিল। বুঝি বা একটু উদ্দীপিতই বোধ করছে যেন। খুচরো-খাচরা দু’-একটা মতামতও দিয়ে ফেলল। কী আশ্চর্য, সেগুলো গৃহীতও হল সাদরে। তবে কি সে সত্যিই পার্টির কাছে মূল্যবান?
ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরল তিতান। প্রায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে। গুনগুন গান ভাঁজতে ভাঁজতে বসেছে টিভির সামনে।
দোলা জামাকাপড় ইস্ত্রি করছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল,— আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরলি যে? টিউটোরিয়াল হল না?
মিথ্যে বলতে চোখের পাতা কাঁপল না তিতানের। পরিষ্কার স্বরে বলল,— সেখান থেকেই তো আসছি।
কেমন পড়াচ্ছে রে ওরা?
চলতা হ্যায়।
বুঝছিস তো ঠিকঠাক? না বুঝলে জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করছিস তো?
হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। কথা ঘোরাতে তিতান উঠে মা’র নাকটা টিপে দিল,— ভাল করে দুধকফি বানাও তো দেখি। সঙ্গে তোমার হাতের সেই গরম গরম আলুর চপ।
খেতে খেতে খানিকক্ষণ টিভিতে টুকটাক প্রোগ্রাম দেখল তিতান। মা’র সঙ্গে বসে। তারপর চলে গেছে নিজের গলতায়। শার্টপ্যান্ট বদলে বইপত্র নিয়ে বসেছে। ধুস, মন লাগছে না। পল্টুদা যা বলল, তাই যদি হয়…! পার্টির জন্য খাটতে হবে তিতানকে। জোশ লাগিয়ে। জীবনের অভিমুখ বদলে ফেলার দারুণ সুযোগ এসেছে, হেলায় হারানো ঠিক হবে না বোধহয়। পল্লবকে কাল বলবে পল্টুদার গল্পটা? নিশ্চয়ই জোর চমকাবে পল্লব! নাকি জেলাস হয়ে পড়বে? তবু বলতে তো হবেই। অমিতদা শ্ৰীমন্তদাদের মুখ থেকে শুনলে বরং আহত হতে পারে পল্লব। হয়তো ভাববে, সায়র তাকে চেপে যাচ্ছে…!
আর শ্রেয়াকে জানালে? হিহি হাসবে? আওয়াজ মারবে? ওফ, মেয়েটা কিচিরমিচির করতে পারেও বটে। ঠিক যেন চড়ুইপাখি। উঁহুঁ, মুনিয়া। ডানায় কত রং মেয়েটার, চোখ যেন ধাঁধিয়ে যায়। শ্রেয়া কি সত্যিই তার প্রেমে পড়েছে? নাকি খেলছে তাকে নিয়ে? আহা রে, খেলাটা যেন না থামে!
বুকের ওপর অর্থনীতির বই। তিতানের চোখ জড়িয়ে এল ঘুমে।
.
০৬.
কফি-বার অফিস থেকে বড়জোর একশো মিটার। তবু ওইটুকু পথ হনহনিয়ে পেরোতে তিয়া হাঁপিয়ে টাপিয়ে একসা। হুড়মুড়িয়ে কাচের পাল্লা ঠেলে দেখতে পেল, সূর্য বসে আছে পরিচিত কোণটায়। সামনে, কাচের টেবিলে, প্লেট-ভরতি কাবাব। পাশের চেয়ারে হেলমেট।
রট আয়রনের চেয়ার টানতে টানতে তিয়া অপ্রস্তুত মুখে বলল,— সরি, সরি। অনেকক্ষণ ওয়েট করিয়ে রেখেছি, না?
জবাব দেওয়ার উপায় নেই সূর্যর। কানে মোবাইল, স্বরে কেজো ব্যস্ততা। ফোনে কথা চালাতে চালাতেই আঙুল দেখাল প্লেটে। ইশারায় তুলতে বলছে।
কাবাবের দিকে হাত বাড়াল না তিয়া। টেবিলে এক গ্লাস জল, ঢকঢক খেল আগে। আহ্, তেষ্টা জুড়োল যেন। রুমালে মুছছে ঠোঁট। মোবাইলে এস-এম-এস এল একটা, দেখল বোতাম টিপে। তুত্, ফালতু। কী এক স্কিম দিচ্ছে মোবাইল কোম্পানি, এত টাকার রিচার্জ করালে এত টাকা বাড়তি টকটাইম…। এই নিয়ে বোধহয় বার আষ্টেক পাঠাল বার্তাটি। জ্বালা, না জ্বালা!
সূর্য এক দফা কথা শেষ করে আবার যেন কাকে ফোনে ধরছে। ফের ডায়ালগ শুরু। কাকে যেন বলছে, ও এখন বারাসতে! বাহা রে টেকনোলজি, গুল মারার কত সুবিধে! মুচকি হেসে তিয়া ব্যাগ থেকে আয়না বার করে দেখল নিজেকে। এহ্, মুখটার কী দশা! এমন এস-এম-এসের বন্যা ছোটাচ্ছিল সূর্য, টয়লেটে যাওয়ার আর সময় পায়নি। আবার ব্যাগে হাত চালিয়ে সুগন্ধী টিস্যু পেপার তুলেছে তিয়া। ঘষে ঘষে সাফ করল মুখখানা। ইস, কী নোংরাই না বেরোল। উঠে ওয়েস্ট-বিনে ফেলে এল টিস্যুটা। এবার ওষ্ঠরঞ্জনের পালা। ঠোঁটে ন্যাচারাল শাইন বোলাতে বোলাতে দেখছে চার দিক।
শনিবারের সন্ধে। কফি-বার টইটুম্বুর। অল্পবয়সিদেরই ভিড় বেশি। দু’-চার জন অফিস ফেরতা মধ্যবয়সিও আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, ছিমছাম সাজানো, সুরাহীন পানশালায় দুলছে একটা গুনগুন ধ্বনি। হট কফি, কোল্ড কফি, আর টুকটাক মুখরোচক খাদ্যের সুবাস বাতাসে। উজ্জ্বল আলোয় যেন ঝলমল করছে জায়গাটা।।
সূর্যর আলাপচারিতা শেষ। মোবাইল পকেটে পুরে হাতে হাত ঘষল। একমাথা ঝাঁকড়া চুলে আঙুল বুলিয়ে বলল,— খুব ভোগালে যা হোক।
তিয়া বলল,— বিশ্বাস করো, আমি সেই কখন থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছি… এমন কাস্টমার আসছে…
বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারল না তিয়া। এবার তার মোবাইল সুর ধরেছে। তুলে নাম্বারটা দেখেই ভুরুতে মোটা ভাঁজ। সেলস্ ম্যানেজার।
এখন সূর্যর অপেক্ষার পালা। তিয়ার ঠোঁট নড়ছে,— হ্যাঁ অতনুদা, বলুন?
কখন বেরিয়ে গেলে?
এই তো, মিনিট আট-দশ।
বলে গেলে না তো? গেছিলে এলিংটন ইন্ডিয়ায়?
হ্যাঁ। মিট করেছি মিস্টার ঠক্করকে। তবে কাজ হয়নি। আবার মঙ্গলবার যেতে হবে।
তোমার ডেলি রিপোর্টে নেই তো! বলেছি না, প্রত্যেকটি কোয়্যারি সম্পর্কে নোট রাখতে। মিস্টার লাখোটিয়ার ইনশিয়োরেন্সের খোঁজটা নিয়েছ?
এই প্রশ্ন থেকে সেই প্রশ্ন, এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গ। শেষ পর্যন্ত মোদ্দা কথা একটাই দাঁড়াল, মার্চ মাসে ছুটিফুটি ভুলে যাও, কাল অবশ্যই এসো।
তেতো মুখে মোবাইল অফ করল তিয়া। এই রোববারটাও ভোগে। আর পারা যায় না! রবিবার শো-রুম বন্ধ থাকার দিন। কিন্তু সপ্তাহভর সময় পায় না বলে অনেক ক্রেতা এখন রবিবারেই আসতে চায়। মালহোত্রা অটোমোবাইলসও মওকা বুঝে রবিবারটা খোলা রাখা শুরু করেছে। আসছেও বটে লোকজন। সপরিবারে। সদলবলে। এক একটা পার্টি যেন টাকার কুমির। ঝনাত ঝন ক্যাশ চেক ছুড়ে দিয়ে কিনে ফেলছে গাড়ি। মালিকদের কাছে এইসব সানডে-কাস্টমাররা বেজায় মূল্যবান। কিন্তু তিয়াদের যে প্রাণ যায়। ওভারটাইম মেলে বটে, নতুন নতুন উৎসাহ ভাতার খুড়োর কলও ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে নাকের সামনে। কিন্তু একটা দিন হাত পা ছড়িয়ে সুখ না করতে পারলে ভাল লাগে?
সূর্য ঘাড় গুঁজে কাবাব পুরছে মুখে। চোখ না তুলে বলল,— শেষ হয়েছে? এবার কি একটু শান্তিতে কথা বলতে পারি?
যাহ্, বাবা। তিয়া ভুরু কুঁচকোল,— আমার তো ফোনটা এল। এদিকে বাবু যে লোক ডেকে ডেকে…
আমারটা বিজনেস, বেবি। সারাক্ষণ কনট্যাক্টগুলোকে ঝালিয়ে যেতে হয়। বাট ইউ আর ইন জব। অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছ, ব্যস খতম। জাস্ট দেখে নেবে কলটা কার, তারপর টুকুস কেটে দেবে।
কী অবলীলায় কথাটা বলল সূর্য! অথচ নিজে যত দিন ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করেছে, দিব্যি উলটো গাইত। বোঝোই তো, প্রাইভেট কোম্পানি মানে টোয়েন্টি ফোর আওয়ারস জব! ব্যাবসা করছে বলে কি সূর্য বদলে গেল? নাকি মানুষ নিজের অবস্থান মতো যুক্তি সাজায়?
তিয়া হেসেই বলল,— যাহ্, তা হয় নাকি? কত রকম দরকার থাকে…। শোরুমে এখন বহুত রাশ, টারগেট নিয়ে টপ টু বটম সবার মাথা খারাপ…
কন্ট্রাডিক্টরি কথা বোলো না। এক দিকে বলছ হেভি রাশ, ও দিকে টারগেট…!
সিম্পল্ ম্যাথ্স ইয়ার। বিক্রি বাড়ছে বলে কর্তারাও টারগেটের মিটার চড়াচ্ছে। এখন তো বলছে, তুমি একা কী সেল করলে সেটা বড় কথা নয়। তোমার টিমের পারফরমেন্সটাই আসল। অতএব দীপন ফেল করলে তার গুঁতোটাও…। ভাবো কী রকম টেনশন?
ছাড়ো তো। ভারী একটা গাড়ি বিক্রির চাকরি, তার আবার টেনশন!
মাঝে মাঝেই তিয়ার চাকরি সম্পর্কে এরকম তাচ্ছিল্যের সুর ঠিকরে ওঠে সূর্যর গলায়। সূর্য তার বন্ধু, কিংবা তার চেয়েও বেশি, তবু শুনতে তিয়ার ভাল লাগে না। ওই চাকরিটাকেই অবজ্ঞা? নাকি চাকরিটা তিয়া করছে বলে?
সূর্য ফিকফিক হাসছে,— যাহ্ বাবা, ফিউজ মেরে গেলে কেন? খাও, কাবাব তো রবার হয়ে গেল!
হ্যাঁ, নিই। তিয়া এক টুকরো কাবাবে কাঠি গাঁথল। সহজ স্বরেই জিজ্ঞেস করল,— কতক্ষণ এসেছ?
শুনে আর কী হবে ডার্লিং! শুধু বলতে পারি, তখনও আকাশ থেকে আমি অস্ত যাইনি। মরিয়া হয়ে তোমার শো-রুমের সামনেও একবার ঢুঁ মেরে এলাম।
তাই? কখন? ভেতরে যাওনি কেন?
ভাবলাম, ম্যাডামের ব্যস্ততায় ব্যাঘাত ঘটবে…। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, তোমাদের সোনালি খুটখুট করে বেরিয়ে গেল…। সূর্য আর একটা কাবাব তুলেছে,— মেয়েটার চেহারা কেমন রাফ হয়ে গেছে!
হতে বাধ্য। যা ফাস্ট লাইফ লিড করে। রুমাল পালটানোর মতো বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ করছে। হোটেলবাজি, রিসর্টবাজি, যেখানে সেখানে নাইট স্পেন্ড…
বাড়িতে কিছু বলে না?
জানি না। বুঝি না। মিডল ক্লাস ফ্যামিলিরই তো মেয়ে, বাবার ছোটখাটো বিজনেস, মা-ও যেন কী একটা করে… মেয়ের চালচলন দেখে কিছুই কি তারা বোঝে না? তিয়া ঠোঁট উলটোল,— কেরিয়ারের ব্যাপারেও তো কোনও স্ক্রুপল্স দেখি না। গাড়ি বেচার জন্য শি ক্যান গো টু এনি এক্সটেন্ট। ক্লায়েন্ট কফি খেতে ডাকল, চলে গেল। একসঙ্গে ড্রিঙ্ক? নো আপত্তি। ডিসকো যেতে চাইছ? আই অ্যাম রেডি।
হুম্। খুবই কম্প্রোমাইজিং লেডি।
সে আর বলতে। রিসেন্টলি তো দিল্লি-বেসড্ এক কোম্পানির কলকাতার চাঁইকে পাকড়েছে। ওকে নাকি আমাদের ব্যালেরিনা না গছিয়ে ও ছাড়বে না। এগারো লাখের গাড়ি, সোনালির পার্সে হাজার দশেক তো ঢুকবেই।
তুমিও ওরকম দু’-একটা ট্রাই নিতে পারো। … আমি কিছু মাইন্ড করব না।
হয়তো কৌতুকের ছলে বলা, তবু কথাগুলো কোথায় যেন বিঁধল তিয়াকে। কী ভাবে তাকে সূর্য? কেরিয়ারের জন্য তিয়া কি কখনও ওই স্তরে নামতে পারে? তিয়াকে কি সে চেনে না? জানে না তিয়ার স্বভাব? তা ছাড়া সে কী ভাবে কাজ করবে, না করবে, তা নিয়ে সূর্য মাইন্ড করার কে? সূর্য সম্মতি দিলে সে স্বেচ্ছাচারী হতে পারে? নয়তো নয়?
তিয়া ব্যঙ্গের সুরে বলল,— থ্যাঙ্কস্ ফর দা পারমিশন। যার তার সঙ্গে শুয়ে পড়তে পারি তা হলে?—
যাহ্, ফাজলামি কোরো না। সূর্য যেন সামান্য বিব্রত। পরক্ষণেই স্বর স্বাভাবিক,— আজ লান্চ করেছিলে?
হুঁ। ধোসা।
ব্যাস? … নিশ্চয়ই ভুখ লেগেছে? আর একটা কিছু বলি?
নাহ্। শুধু কোল্ড কফি।
উঠে অর্ডার দিতে গিয়েও সূর্য দাঁড়িয়ে পড়েছে। কাচের ওপারে চলমান শহরটাকে দেখল দু’-এক পল। মুখ ঝুঁকিয়ে বলল,— শনিবার সন্ধেটা একেবারে নিরামিষ যাবে? কফি খেয়েই কাটাব?
আর কী বাসনা?
চলো না, আজ একটু পাবে যাই। পর পর দুটো শনিবার তো কোথাও যাওয়াই হয়নি।
সে তোমার ফল্ট। তুমি বিজি ছিলে।
কাজ এসে গেলে কী করব বলো? পেটের ধান্দা তো আগে। … চলো না, ব্লু ভেলভেটে। লাইভ গানা শুনে মাথাটা ফ্রেশ হয়ে যাবে।
আমার টাইম লিমিট কিন্তু ন’টা।
হাফ অ্যান আওয়ার বাড়াও। মেরে খাতির।
অনুনয়ের ভঙ্গি দেখে তিয়া হেসে ফেলল। আঙুল নেড়ে বলল,— পাক্কা সাড়ে ন’টা। তার বেশি নয়।
খুশি খুশি মুখে, মাথা দোলাতে দোলাতে, কাউন্টারের দিকে যাচ্ছে সূর্য। দীর্ঘ সুঠাম চেহারা, দেখতে বেশ লাগে তিয়ার। কাউন্টারে পৌঁছে ফের মোবাইল তুলেছে কানে। কথা বলতে বলতেই পার্স থেকে টাকা বের করছে, কুপন নিচ্ছে, চাকতিটা ধরিয়েও দিল ফুড কাউন্টারে। সত্যিই কি সূর্যর এত ব্যস্ততা থাকে সর্বদা? খানিকটা দিখাওয়া নেই তো? কেন যে তিয়ার হঠাৎ হঠাৎ এরকম মনে হয়?
সূর্য টেবিলে ফেরামাত্র তিয়ার মোবাইল ডাকছে আবার। নম্বরটা দেখে তিয়া অবাক সামান্য, তবে চমকাল না। ভাবলেশহীন গলায় বলল,— হ্যাঁ, বলুন!
থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। ওপারে ইন্দ্রজিতের স্বর কৃতজ্ঞতা ঝরাচ্ছে,— আজ পেমেন্ট করে এলাম। নাম ট্রান্সফারের কাগজপত্র সোমবার মোটর ভেহিকলসে জমা করে দেব।
হ্যাঁ, দেরি করবেন না। ব্লু-বুকটা নিজের নামে করিয়ে নিন। … এনিওয়ে, আপনার গাড়ি কেনার পর্ব তা হলে চুকল?
আপনারই অনুগ্রহে। আপনি মাঝে না থাকলে মিস্টার মজুমদার কিছুতেই বাহান্ন হাজারে রাজি হতেন না।
হুঁ। ওঁরা আমায় খুব স্নেহ করেন। … যাক গে, আমার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খেয়াল আছে?
এমা, ছি ছি, আপনি কেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন? উইদাউট ফেল সামনের সপ্তাহে দিয়ে আসব।
ফাইন। নাউ এনজয় দা কার।
আমি কিন্তু এনজয়মেন্টের জন্য গাড়িটা কিনিনি ম্যাডাম। বলেছিলাম না, ওটা আমার ভীষণ দরকার…
তাই না হয় হল। ভীষণ দরকারেই ব্যবহার করুন।
প্রয়োজনটা কী ধরনের জানতে ইচ্ছে করছে না?
ওহ্, ব্যাপক বকে তো! বিরক্তি গোপন করে তিয়া ভদ্রভাবে বলল,— নিশ্চয়ই ইম্পর্ট্যান্ট কিছু।
অবশ্যই। তবে আজ ব্যাপারটা ভাঙছি না। একদিন আপনাকে নিয়ে এসে দেখাব। আপনি কিন্তু আমাকে না বলতে পারবেন না ম্যাডাম।
আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবেখ’ন। এখন ছাড়ি, হ্যাঁ?
মোবাইলের বোতাম টিপে তিয়া বিচিত্র মুখভঙ্গি করল। সূর্য চুপচাপ শুনছিল, ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,— এবার কোন মক্কেল?
এক আধ-পাগল। ইন্দ্রজিৎ রায়। একটা পুরনো গাড়ির বন্দোবস্ত করে দিয়েছি, তাতেই আহ্লাদে থইথই। গাড়িটা কোন কম্মে ইউজ করবে, সেটা আমায় দেখাতে চায়। আরে তুই মারুতি ভ্যান ভেজে খাবি, না মাথায় নিয়ে ঘুরবি, জেনে আমার কি দুটো এক্সট্রা হাত গজাবে? কমিশনটা ঝেঁপে দিস না, তা হলেই হল।
কত দেবে?
বলব কেন? ট্রেড সিক্রেট। তিয়া টেবিলে আলতো তবলা বাজাল। ভুরু বেঁকিয়ে বলল,— তুমি আমায় বলো? জিজ্ঞেস করলে তো শুনতে হয়, হিসেব কষে দেখতে হবে !
অল রাইট। বোলো না।
বাবুর রাগ হল নাকি?
নাহ্।
এটাও গুস্সেওয়ালি বাত্। তিয়া সাবিত্রীর বাচনভঙ্গি নকল করে বলল,— আগ্ করুনি দাদাবাবু। দুঃখু-দুঃখু মুখ নিয়ে ব্লু ভেলভেটে গেলে কি মজা জমবে?
বাইরে এক মোহময়ী সন্ধ্যা। সারাদিন বেশ গরম ছিল আজ, দিব্যি হাওয়া ছেড়েছে এখন। ফাল্গুনী বাতাস, একটু বুঝি এলোমেলো। নাগরিক কোলাহল আছে বটে, তবে এমন সন্ধ্যায় তা আর অসহ লাগে না। পাশে সিগারেটের দোকানে এফ-এমে গান বাজছে। তারা-রম্-পম্-পম্।
সূর্যর গাবদা মোটরবাইক ফুটপাথে দণ্ডায়মান। শিরস্ত্রাণ এঁটে সিটে বসেছে সূর্য। পিছনে তিয়া, দোপাট্টা সামলে। স্টার্ট দিতেই মৃদু ঝাঁকুনি, তিয়া খামচে ধরল সূর্যর কাঁধ। গতি বাড়ছে দ্বিচক্রযানের। তিয়ার হাত নেমে এল সূর্যর কোমরে। মেদহীন কটিদেশ বেড় দিয়ে ধরেছে। বড্ড জোরে চালায় সূর্য, ধরে না থাকলে গা শিরশির করে।
সূর্য আরও স্পিড তুলেছে। চেঁচিয়ে বলল,— একবার ভিক্টোরিয়া রেড রোডটা চক্কর মেরে আসব?
তিয়াও চিৎকার করল,— কেনওওও?
এমনিই। মস্তি।
দেরি হয়ে যাবে যে!
কতক্ষণই বা আর? দশ মিনিট, পনেরো মিনিট…
এরপর আর হাল না ছেড়ে উপায় কী! ইচ্ছে যখন চেপেছে, সূর্য যাবেই। ছেলেটার মধ্যে কিছু কিছু খেপামি আছে।
ভাগ্যিস আছে খেপামোটা। নইলে তিয়ার সঙ্গে তো আলাপই হত না। প্রথম পরিচয়ের স্মৃতিটা মনে পড়তেই তিয়া হেসে ফেলল। পার্ট টু পরীক্ষার পর তারা চার বান্ধবী গেছে দিঘায়। হঠাৎ হুজুগ চাপল, শংকরপুরটাও দেখে আসা যাক। গিয়ে তো মুগ্ধ। আহা, কী চমৎকার সমুদ্রসৈকত। বিকেলভর বিস্তর হুটোপুটি, ছবিও তোলা হল পটাপট। তারপর দিঘা ফিরে হোটেলে ঢুকতে গিয়ে মাথায় হাত। মাসতুতো দাদার বহুমূল্য ক্যামেরাটি তিয়া ফেলে এসেছে শংকরপুরে। চায়ের দোকানে। কী হবে? কী করবে? সন্ধে গড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ, তক্ষুনি তক্ষুনি শংকরপুর ছোটা তো সহজ কাজ নয়। সকালে গিয়ে কি আর মিলবে?
তখনই ত্রাণকর্তা রূপে সূর্যর আবির্ভাব। হোটেলের লবিতে হাউমাউ করছিল তিয়ারা, হঠাৎই এসে বলল,— ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমার একটা দু’চাকা আছে। ক্যামেরাটা নিয়ে আসতে পারি।
আশ্চর্য, তিয়ারা তখন সূর্যকে চেনেও না, আগে দেখেওনি। অবাক হয়ে বলল,— আপনি…?
এখানেই উঠেছি। আপনাদের প্রবলেমটা ওভারহিয়ার করলাম। ..। একাই গিয়ে আনতে পারি, কিন্তু দুটো অসুবিধে আছে। প্রথমত, কোন দোকানে ফেলে এসেছেন, আমি চিনব-কী করে? সেকেন্ডলি, দোকান ট্রেস করতে পারলেও দোকানদার আমায় দেবে কেন?
ঠিকই তো…। তা হলে…?
উপায় আছে। আপনারা কেউ সঙ্গে চলুন।
তিয়ারই ক্যামেরা। গেলে তো তিয়াকেই যেতে হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অচেনা একটা ছেলের সঙ্গে… মোটরবাইকে…! তিয়ারা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। লক্ষ করে সূর্য বলল,— দেখুন, সাফ সাফ একটা কথা বলি। দিঘা বেড়াতে আমি একাই এসেছি। হোটেলে নামঠিকানা আছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো ডাহা মিথ্যে হতে পারে। আমি কেমন, বোঝারও আপনাদের কোনও সুযোগ নেই। আর আপনারা তো শংকরপুর গেছেন, দেখেছেন নিশ্চয়ই রাস্তাটা কীরকম নির্জন! বলেই কান এঁটো করা হাসি,— এতগুলো নেগেটিভ ফ্যাক্টর মাথায় রেখে যদি যেতে পারেন, তবেই চলুন।
সে যে কী কাঁপতে কাঁপতে যাওয়া! বাবানদার পনেরো হাজার টাকার ক্যামেরা বলে কথা! এমন বজ্জাত ছেলে, ফেরার পর পকেট থেকে অফিসের আইডেন্টিটি কার্ড বার করে দেখাচ্ছে।
ভিক্টোরিয়াকে পাক খেয়ে, রেসকোর্সের পাশ দিয়ে, ছুটছে সূর্যর মোটরসাইকেল। উদ্দাম বাতাসে হুহু উড়ে যাচ্ছে দিনের ক্লান্তি। তিয়া মাথা রাখল সূর্যর পিঠে। সে-দিন কি খুব বেশি সাহস দেখিয়ে ফেলেছিল তিয়া? হয়তো। তবে তাতে ক্ষতি তো হয়নি। অন্তত একটা বিশ্বাসের ভিত তো তৈরি হয়েছিল সে-দিন। পরে যা পোক্ত হয়েছে ক্রমে ক্রমে। গত দু’বছরে। উঁহুঁ, দু’বছর কোথায়, বড়জোর একুশ-বাইশ মাস। এখন তিয়া এটুকু বুঝে গেছে, আর পাঁচটা ছেলের মতো সূর্য হ্যাংলা নয়। বান্ধবীদের এক একজনের মুখে যা গল্প শোনে! আলাপ জমতে না জমতেই বিছানা! সূর্যও মাঝে মাঝে দুঃসাহসী হয়ে ওঠে হয়তো, তবে তিয়ার সম্মতি অসম্মতিকে তো মেনেও নেয়। পুজোর সময়ে ডায়মন্ডহারবারের হোটেলে যা ঘটে গেল, তাতে তো তিয়ারও সায় ছিল। আদিম রোমাঞ্চ চাখার বাসনা তারও কি জাগেনি? কিন্তু তারপর? আবার একদিন চেয়েছিল সূর্য। গড়িয়াহাটে ফাঁকা ফ্ল্যাট, সূর্যর কাছে চাবি রেখে মাসি-মেসো গেছে মেয়ের বাড়ি, মুম্বইতে। তিয়াকে নিয়ে সূর্য সটান সেখানে। তিয়া সেদিন কেন যেন বেঁকে বসেছিল। চোরাগোপ্তা অন্যের ফ্ল্যাটে, তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে নিয়ে…। হয়তো সূর্য বেশি জোরাজুরি করলে তিয়ার অনিচ্ছা উবে যেত। তবে সূর্য কিন্তু সে-দিন আর এগোয়নি। সূর্যর এই সংযমের প্রশংসা তো করতেই হয়।
সূর্যকে কি তিয়া বিয়ে করবে? জানে না তিয়া। বিয়ে নিয়ে ভাবতে গেলেই তিয়ার শরীর কেমন ঠান্ডা হয়ে আসে। কেন যে! বাবা মাকে দেখে দেখেই কি এমনটা হল? অবশ্য সূর্যও সেভাবে প্রস্তাব রাখেনি এখনও। ব্যাবসাটা সবে শুরু করেছে, আগে দাঁড়াক তো। এখনই তাড়াহুড়োর দরকারটাই বা কীসের?
ময়দানে পাক খেয়ে ব্লু ভেলভেটে থামল মোটরবাইক। সাধারণত রাত বাড়লে এখানে ভিড় জমে বেশি। তবে আজ শনিবার, সন্ধে সাড়ে সাতটাতেই মধুশালা আজ রীতিমতো সরগরম। কাউন্টারের সামনে উঁচু উঁচু টুলগুলো প্রায় ভরতি, ছড়ানো ছেটানো টেবিলও ফাঁকা নেই খুব একটা। লম্বাটে হলের এক পাশে, মাইক্রোফোন হাতে, পুরনো দিনের হিন্দি গান গাইছে এক তরুণ, সঙ্গে জনা তিনেক বাজনদার। সংগীত আর চাপা কলরোল মিলেমিশে একাকার।
সুর্য দারুণ চনমন করছে। বসেই বলল,— কী নেবে বলো?
তিয়াও দিব্যি ফুরফুরে। পালটা প্রশ্ন করল,— তুমি?
ইউজুয়াল। হুইস্কি। তোমার একটা ভদকা বলে দিই?
অল্পস্বল্প পানে তিয়ার অনীহা নেই। বলল,— না, ভদকায় আমার চরকি আসে। জিন বলো।
উইথ লাইম?
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটাই ভাল।
সূর্যর তর সইছে না। নিজেই গিয়ে পানীয় দুটো নিয়ে এল। বার-টেন্ডার সামনে আসতেই তাকে খাবারেরও অর্ডার দিল কিছু। চিকেন টিক্কা, মাশরুম হট অ্যান্ড পেপার…।
হুইস্কি ঠোঁটে ছুঁইয়ে সূর্য বলল,— কয়েক দিন ধরে তোমায় একটা কথা বলব ভাবছিলাম, জানো।
কী?
ফ্র্যাঙ্কলি জিজ্ঞেস করছি… কিছু মনে কোরো না… এখন মাসে তোমার ইনকাম কত? আই মিন, অ্যাভারেজ?
তিয়া বেশ অবাক। আগে কখনও সরাসরি এ-প্রশ্ন করেনি সূর্য। হয়তো ঠাট্টার ছলে কিছু একটা জানতে চেয়েছে, ব্যস ওই পর্যন্ত।
সামান্য দ্বিধা নিয়ে তিয়া বলল,— কী হবে জেনে?
নিশ্চয়ই কারণ আছে।
স্যালারি আর কত, সাড়ে সাত। প্লাস, মাসে একটা গাড়ি তত বেচতে হয়ই। কমিশন, ইনসেনটিভ, সব মিলিয়ে হাজার এগারো-বারো। কোনও কোনও মাসে হয়তো আর একটু জাম্প করল…
হুম্ম্। সূর্য মাথা দোলাচ্ছে,— আমি কি তোমায় একটা অফার দিতে পারি?
তুমি?
ইয়েস। হোয়াই ডোন্ট ইউ জয়েন মাই বিজনেস? চলে এসো কানেক্টিভিটিতে।
আআআমি কী করব?
আমায় হেলপ করবে। উই উইল ওয়ার্ক টুগেদার। যা আসবে, মোটামুটি আমরা শেয়ার করে নেব।
এমন একটা মতলব যে মাথায় ঘুরছে, ঘুণাক্ষরেও তো টের পেতে দেয়নি সূর্য। তিয়া খানিকটা মজাই পেল। গালে হাত রেখে ছদ্ম গাম্ভীর্য ফোটাল গলায়,— নাউ আনসার মাই কোয়েশ্চেন। তোমার মাস গেলে কত হয়?
ডিপেন্ডস্। যেমন অর্ডার আসে। এখনও তো খুব বেশি বড় কিছু নেই … ছোটখাটো কাজে পাঁচ-দশ-পনেরো … বড় হলে চল্লিশ পঞ্চাশ…
হুম্ম্। তিয়া সূর্যকে নকল করল,— তুমি তা হলে এক সম্ভাবনাময় তরুণ। প্রস্তাবটা নিয়ে তো তা হলে ভাবতে হয়।
সূর্য হেসে ফেলল,— যত খুশি ভাবো। তবে রেজাল্টটা যেন হ্যাঁ হয়। রিয়েলি একজন রিলায়েবল কেউ সঙ্গে না থাকলে…। বিশ্বরূপ তো পার্টনার হতে রাজি। টাকাও ঢালবে। কিন্তু আমি ঠিক ওরকম চাইছি না। দিস উইল বি মাই বিজনেস। আই মিন, আওয়ার বিজনেস।
বলছ?
অফ কোর্স। ওসব গাড়িটাড়ি ফোটাও। চলো সাথ সাথ, রাখো…
কথা শেষ হল না, সূর্যর চঞ্চল চোখ হঠাৎই স্থির। পাবের দরজায়। এক সেকেন্ড… বলেই টেবিল থেকে ধাঁ। দ্রুত পায়ে এক বছর পঁয়তাল্লিশের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, করমর্দন সেরে তার সঙ্গে কথা বলছে। সাফারি-সুট লোকটাকে নিয়েই ফিরেছে টেবিলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আলাপ করিয়ে দিল,— মিট মিস্টার কিশোর তানেজা। … অ্যান্ড দিস ইজ তিয়াসা মিত্র। শি ইজ অলসো উইথ মি।
তিয়া হাত বাড়িয়ে দিল। কিশোর তানেজার ঝকঝকে মুখে একগাল হাসি,— গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
আই অ্যাম অনার্ড। প্লিজ, বসুন।
মিনিট কয়েকের মধ্যে তানেজার জন্য হুইস্কি এসে গেল। সূর্য তার সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই খুব সম্ভ্রান্ত ক্লায়েন্ট, নইলে এত তেল মেরে মেরে কথা বলে! তানেজাদের অফিসে বোধহয় কোনও প্রোগ্রাম আছে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বটা পেতে চাইছে। তানেজাও শুনছে মন দিয়ে, মতামতও জানাচ্ছে, কিন্তু বারবারই চোখ ঘুরেফিরে তিয়ায়।
এসব দৃষ্টি তিয়া গায়ে মাখে না। কর্মসূত্রে অভ্যেস হয়ে গেছে। অন্যমনস্কতার ভান করে সে চার দিকটা দেখছিল। গাইয়ে ছেলেটা বিটকেল পোশাক পরেছে তো! চকমকে প্রিন্টেড শর্ট-শার্ট, সঙ্গে জ্যাকেট। লম্বা লম্বা চুল পিছনে ঝুঁটি করে বাঁধা। যন্ত্রসঙ্গীরাও জিনস-টিশার্ট। এক টাকলু কংগো বাজাচ্ছে। টাক? না মাথা কামানো? গায়ক ছেলেটির গলা মন্দ নয়। বেশ একটা প্যাথোজ আছে। মুকেশ মুকেশ। গানও বেছেছে সেরকম। নরম নরম। … কোনও টেবিলে চেনা কাউকে চোখে পড়ে কি? আগের দিন নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আজ তেমন কেউ নেই। এক টলটলায়মান আধবুড়ো অন্দরে ঢুকছিল, তাগড়াই বাউন্সার আটকেছে তাকে। আগে নির্ঘাত বাওয়াল করেছে কোনওদিন। বেশ বিনয়ের সঙ্গে, পিঠে হাত রেখে, তাকে দরজা পার করে দিল বাউন্সার। গায়ক গান ধরেছে, দুনিয়া বনানেওয়ালে কেয়া তেরে মন্মে সমাআআইই…।
ওফ্, সূর্যর বকবকানি আর থামে না। জিনটুকু গলায় ঢেলে তিয়া নড়েচড়ে বসল। বার-টেন্ডার খাবার রেখে গেছে। দ্বিতীয় দফার হুইস্কিও। সূর্য তানেজাকে এগিয়ে দিল প্লেট। তিয়াকেও। নিজের খাওয়ার উৎসাহ নেই, তৈলমর্দন করেই চলেছে। দু’-তিনবার মোবাইল বাজল, কেটে দিল টক করে।
তিয়ার এবার একটু একটু রাগ হচ্ছিল। আগেও একদিন এমন ঘটেছে। এক মক্কেল এসে বসল তো বসলই।… গোটা সন্ধেটাই মাটি। নিজেরা যদি একটু নিভৃত-রচনা না করতে পারে, তা হলে এই আসার কোনও মানে হয়? আচমকাই লোকটাকে নিয়ে কাউন্টারে চলে গেল সূর্য, টুলে বসে হুইস্কি টানছে দু’জনে। যাহ্ বাবা, তিয়া এখন বোকার মতো বসে থাকবে?
নতুন গান শুরু হল, জোশে জওয়ানি হায় রে হায়…। বেশ তালের গান। পাশের ছোট্ট ডান্সফ্লোরে নাচতে উঠে গেল কেউ কেউ।
ঘাড় হেলিয়ে নাচ দেখছিল তিয়া, সামনে হঠাৎ তানেজা,— এক্সকিউজ মি ম্যাম। ক্যান উই জয়েন দা ফ্লোর?
তিয়া ঈষৎ থতমত। সূর্যর দিকে তাকাল একবার। চোখাচোখি হল না, কাউন্টারে বসে সুর্য মাথা দোলাচ্ছে গানের তালে তালে।
অস্বস্তির সঙ্গে তিয়া বলল,— না মানে… আমি তো ঠিক…
প্লিজ…
তিয়া আর না বলতে পারল না। সূর্য কী মনে করবে…! লোকটার সঙ্গে গিয়ে দুলল একটু। গান শেষ হতেই তালি বাজছে। ফিরে এসে বসল টেবিলে।
সূর্যও এল। তানেজা আর তাদের সঙ্গে যোগ দিল না। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
কৌতুকের সুরে সূর্য বলল,— বেশ নাচছিলে কিন্তু।
তিয়া জবাব দিল না। কেন যেন তার যষ্ঠেন্দ্রিয় একটা বার্তা পাঠাচ্ছে। টেবিলে আঙুল ঘষতে ঘষতে আচম্বিতে বলে ফেলল,— ওই লোকটা যে এখানে আসবে তুমি জানতে, তাই না?
না মানে… হ্যাঁ মানে … জানোই তো এটা কনট্যাক্ট প্লেস, অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
তুমি ইনভাইট করেছিলে বুঝি?
সূর্যর মুখ যেন একটু সাদা দেখাল। ভার গলায় বলল,— এমন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করার অর্থ?
তিয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলল। ইস, কেন যে উলটোপালটা চিন্তাটা মনে এল!
.
০৭.
বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে বাস থেকে নেমেছিল দোলা। গির্জার পাশের ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল। এই রাস্তাটায় হাঁটতে দোলার বড় ভাল লাগে। যেন খানিকটা মায়া ছড়িয়ে আছে এ-পথে। বুঝি কিছু অতীতও। এক সময়ে নিত্য আসা-যাওয়া ছিল কিনা। শোয়ের পর দল বেঁধে মানমন্দিরের মুখে এসে ছিটকে যেত যে যার মতো। কেউ উত্তরে, কেউ দক্ষিণে, কেউ বা গঙ্গার ও পারে।
দোলা রাস্তার উলটো পারে তাকাল। মেলার মাঠে ভারী ঝকমকে একটা পার্ক তো! নতুন হয়েছে। আগের বারও যখন সৃষ্টির নাটক দেখতে এসেছিল, জায়গাটা ছিল ন্যাড়া ন্যাড়া। এখন আলোয় আলোয় সাজানো। সূর্য এখনও ডোবেনি পুরোপুরি, বাহারি বাতিগুলো কেমন ফ্যাটফ্যাট করছে। তবে পরিবেশটা বেশ। এই অজর অমর শহর কী দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
শুধু দোলারই কোনও বদল ঘটল না। একটা দম দেওয়া ঘড়ির মধ্যে জীবনটা আটকে রইল। বাঁয়ে প্রাচীন গির্জার দিকে খানিকটা বাতাস ভাসিয়ে দিল দোলা। গির্জা টের পেল কি? পায়ের তলায় চৈত্রের শুকনো পাতা ভাঙছে মড়মড়। তারাও কি বুঝল কিছু? দূর, সে নিজেই তো একটা শুকনো পাতা। গাছ থেকে খসে পড়েনি, এই যা। গাছই যার দীর্ঘশ্বাসের খবর রাখে না, ওই বুড়ো গির্জা বা এই মরা পাতারা তার সমব্যথী হবে কেন!
শহরের ত্বকে শেষ বিকেলের নরম আলো। এ আলোয় যত না আবেশ, বুঝি বা ততটাই বিষাদ। আলোটুকু মুখে মেখে দোলা অ্যাকাডেমির গেটে এল। চোখ চালিয়ে দেখছে নানান নাটকের পোস্টার, ব্যানার। তারপর পায়ে পায়ে সৃষ্টির কাউন্টারে। ফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
টিকিট বেচছিল সোদপুরের পরেশ। দোলাকে দেখেই তার একমুখ হাসি,— অনেক দিন বাঁচবেন দোলনদি। এইমাত্র নীলুর সঙ্গে আপনাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল।
দোলার মুখ ওমনি উদ্ভাসিত,— তাই নাকি?
হ্যাঁ। বলছিল, আপনার সঙ্গে আজ দেখা হতে পারে। সৃষ্টির ফার্স্ট শো-র তারিখটা আপনি ভুলতে পারবেনই না।
বটেই তো। নাড়ির টান বলে কথা। … নীলু কোথায়?
এই তো ছিল এতক্ষণ। বোধহয় গ্রিনরুমে গেল। … আসুন না, ঘুরে ভেতরে আসুন।
বড় গেটটা পেরিয়ে পরেশের কাছে গেল দোলা। জিজ্ঞেস করল,— আছ কেমন?
এই তো, কেটেকুটে যাচ্ছে। রক্ত পড়ছে না।
এখনও ইয়ার্কির অভ্যেস যায়নি? দোলা মিটিমিটি হাসছে,— বউয়ের কী খবর? ঋতার স্কুল চলছে?
মাইনে পাচ্ছে, ছুটি খাচ্ছে, মাঝে মাঝে যাচ্ছে। যেদিন তালা ঝুলবে, আমার কপাল পুড়বে।
আর তুমি? কোনও পার্মানেন্ট কাজ পেলে?
দিচ্ছে কে, মিলছে কই, জুটলে কিছু বর্তে যাই।
তার মানে এখনও সেই টিউশনি?
আর কী। ছাত্র পেটাই সুখ করে, গিন্নি বেজায় মুখ করে।
দোলার ঠোঁটে অনাবিল হাসি। পারেও বটে পরেশ ছন্দ মিলিয়ে বাক্য রচনা করতে। সৃষ্টিতে কখনওই খুব একটা বড়সড় রোল পায়নি, তবু দলের ওপর কী প্রচণ্ড টান। সদানন্দ ভাব পরেশের মুখ থেকে কখনই মোছে না।
কাউন্টারে এক ক্রেতা। তাকে টিকিট দিয়ে পরেশ ফের ঘুরল,— আপনি কি একা?
দোকা আর কবে আসি ভাই?
একবার এসেছিলেন কিন্তু। দাদাকে আমার মনে আছে।
সে ভুল করে…। হাতে টিকিটখানা নিয়ে বেরোতে গিয়েও দোলা দাঁড়াল,— বক্সের কী হাল?
সৃষ্টির ফার্স্ট শোয়ে যেমন থাকে। পঁচিশ থেকে তিরিশ পারসেন্ট ফুল হবে।
উঠবে। পরে নিশ্চয়ই উঠবে।
আপনার মুখে মাটন রোল পড়ুক।
হাসতে হাসতেই দোলা হাঁটা শুরু করল। ডাইনে তাকিয়ে ফের থেমেছে পা। অ্যাকাডেমিতে এলে মাঝে মাঝে আর্ট গ্যালারিতে ঢুকত আগে। ছবির ব্যাকরণ সে বোঝে না আদৌ, তবু ঘুরে ঘুরে দেখতে মন্দ লাগত না। কত রঙের খেলা! মানুষ, জীবজন্তু, আর নিসর্গের মাধ্যমে জীবনকে কত অজস্র ভাবে কাটাছেঁড়া! সবে পৌনে ছ’টা বাজে, হাতে খানিকটা সময় আছে, যাবে একবার?
যেতে গিয়েও কী ভেবে মত বদলাল দোলা। থাক, আজ বিকেলটা তো শুধুই সৃষ্টির। দিনটার জন্য দোলা কবে থেকে যে দিন গুনছে। সকলের সঙ্গে দেখা হওয়াটাই আজ আগে।
স্নায়ুর চাপে ভোগা সাজঘরে দোলা সমাদর পেল যথারীতি। চলল টুকটাক কুশল বিনিময়। অংশু নেই, সে প্রথমেই মেক-আপ নিয়ে চলে গেছে স্টেজে, দেখভাল করছে প্রস্তুতির। রানি শর্মিষ্ঠাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে দোলা গুটিগুটি পায়ে সেখানে গেল। জোর কদমে চলছে মঞ্চসজ্জা, মাপ বুঝে বুঝে বসানো হচ্ছে চেয়ার-টেবিল, নকল দরজা-জানলা। ঠকাঠক হাতুড়ির ঘা পড়ছে এখানে সেখানে। অংশু মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে, পরনে লুঙ্গি আর আধছেঁড়া পাঞ্জাবি। পাশে স্টেজ ম্যানেজার সুদেব। দু’জনেরই চোখ ওপরে, যেখান থেকে আলো ফেলবে, সেখানে।
সুদেবেরই প্রথম নজর পড়ল দোলাতে। হাত তুলে বলল,— ওয়েলকাম দোলন।
সঙ্গে সঙ্গে অংশুও তাকিয়েছে,— বাহ্, তুমি এসে গেছ?
আগাম শুভেচ্ছা জানাতে ঢুকে পড়লাম।
বেশ করেছ। বলেই অংশু ফের কাজে মনোযোগী। চতুর্থ পরদায় গলা তুলে বলল,— রবি, অ্যাই রবি, মালটা এসেছে?
হ্যাঁ অংশুদা। ব্যাকস্টেজ থেকে তুরন্ত্ জবাব,— জায়গা মতো রেখে দিয়েছি।
আবার লিস্ট ধরে মেলাও। … টেলিফোন?
আছে।
হাত-তোয়ালেটা পেয়েছ?
ওগুলো নিয়ে আর ভাববেন না।
হুঁহ্। অংশু চেটোর উলটো পিঠে কপাল মুছল। আচমকাই দোলার দিকে আঙুল তুলেছে,— এই তুমি … তুমিই ডুবিয়েছ।
দোলা তো হাঁ। অস্ফুটে বলল,— আআআমি?
তুমি যখন ছিলে, প্রপ্স নিয়ে ভাবতে হত না। নিখুঁত সাজানো থাকত সব কিছু। রবি প্রত্যেকটা শোয়ে একটা না একটা গন্ডগোল করছে। আজ প্রিমিয়ার, এমনিই টেনশনের অন্ত নেই… উনি বিড়ির বান্ডিলটাই আনতে ভুলে গেলেন।
ঘাবড়াও কেন? সুদেব ফিচেল হাসছে,— আমার প্যাকেটটা দিয়ে দিতাম, তুমি নয় সিগারেটই ধরাতে।
বটেই তো! ক্যারেক্টারটারই বারোটা! ছেলেও বিদেশি সিগারেট খাচ্ছে, বাপও লুঙ্গি পরে ফরেন ব্র্যান্ড ফুঁকছে … সিন একেবারে মাখো মাখো! ওদিকে ক্রিটিকরাও কলম শানিয়ে বসে আছে…!
সুদেবদা? একটা স্বর উড়ে এল,— গোলটেবিল ব্যাক স্টেজের কোন সাইডে রাখব? রাইট? না লেফট?
আমার মাথায়।
বলতে বলতে দৌড়েছে সুদেব। তার উদ্ভ্রান্ত ছুট দেখে হেসে ফেলল দোলা। অংশু টেরিয়ে তাকাল,— খুব মজা পাচ্ছ, না?
একটু একটু। দোলা হাসিটুকু ঠোঁটে রেখেই বলল,— কটা দিনই বা ছিলাম … এখনও তা হলে আপনারা আমাকে মিস্ করেন?
একটু একটু। অংশু শব্দ দুটো ফেরত দিয়ে বলল,— জীবন তার নিজের পথেই চলে, দোলনচাঁপা। শূন্যতা আপনাআপনি ভরাট হয়ে যায়। তবে চিহ্নটুকু তো মোছে না।
শুধু কি দল ছাড়ার কথাই বলল অংশুদা? নাকি কোনও গভীর ইঙ্গিত আছে কথাটায়? দোলা বলতে যাচ্ছিল, আমার মতো নগণ্য মানুষের চিহ্ন থাকাও তো বিস্ময়কর … সুযোগ পেল না বলার। তার আগেই হুড়মুড়িয়ে মঞ্চে আরও চার-পাঁচ জন। চকের দাগ কাটা জায়গায় টুকিটাকি আসবাব বসাচ্ছে। অংশুও ব্যস্ত আবার, আলো ফেলার ইশারা করছে লাইটম্যানকে। সেই অনুযায়ী পা মেপে মেপে দু’-একটা জিনিস সরল অল্প অল্প। লম্বা লম্বা স্টেপ ফেলে অংশু এবার ও-পারে। সুদেব আর অলককে ডেকে হাতমুখ নেড়ে সেট নিয়ে কী বোঝাচ্ছে। একটা বাচ্চা ছেলে কেটলি আর ভাঁড় নিয়ে ঘুরছিল, হাতে হাতে চা ধরিয়ে উইংসের পিছনে ছুটল। কথা আর কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলছে পুরুক পুরুক চুমুক। সৌমাল্য একটা উইং দিয়ে ঢুকল হনহন, বেরিয়ে গেল ধীর পায়ে। আবার ঢুকল, বেরোল। শেষ মুহূর্তের প্র্যাক্টিস। চতুর্থ বারের পর বুঝি মোটামুটি সন্তুষ্ট হয়েছে, নিষ্ক্রান্ত হল পাকাপাকি। এবার মঞ্চে রানি রায়। দোলার দিকে দৃকপাত না করে মঞ্চের একদম সামনেটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পরদা ঘেঁষে। চুল খোলা, পরনে নাইটি হাউসকোট। ফার্স্ট বেল পড়ল।
এই যে সামগ্রিক ছবিটা, এর রূপ-রস-গন্ধের আহ্বানেই কি প্রাণ কাঁদে দোলার? নাকি যে এর প্রাণকেন্দ্র, তার জন্যে…? এখানে এলে, দলের মাঝে, দোলা যেন দুটোকে ঠিক পৃথক করতে পারে না। শুধু টের পায়, বুকটা কেমন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। মঞ্চের আলো নয়, সে তো চেয়েছিল পিছনেই থাকতে। আর পাঁচ জনের সঙ্গে মিশে একটা কর্মকাণ্ডের শরিক হতে। সৃষ্টির কাজে পেরেক বা নাটবল্টু হয়ে থাকতে পারার আনন্দও কি কম?
প্রিল্যুড চলছে। মেঠো বাঁশির সুর ক্রমশ বদল গেল চড়া অর্কেষ্ট্রায়। দোলা অন্ধকার হলে এসে বসল। নাটকটা সত্যিই অন্য ধরনের, সৃষ্টির আর পাঁচটা প্রযোজনার মতো প্রতীকধর্মী প্লট নয়। সমসময়ের প্রতিচ্ছবি বলা যায় বরং। পুরনো মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকা এক বাবা কী ভাবে ক্রমশ বাতিলের তালিকায় চলে যাচ্ছে…!
শো ভাঙল পৌনে ন’টায়। ফিরতে দেরি হবে জেনেও দোলা গেছে ব্যাকস্টেজে। খানিক আগে ছিল গড়ার আয়োজন, এখন সেখানে বিনির্মাণের পালা। ছোটখাটো ভিড়ও জমেছে, চেনা পরিচিত দর্শকদের। প্রশংসা আর কাটাছেঁড়া চলছে।
একটা ক্ষুদ্র জটলা থেকে বেরিয়ে এল অংশু। উদগ্রীব মুখে জিজ্ঞেস করল,— কেমন লাগল? অনেস্টলি বলবে কিন্তু।
দোলা মুগ্ধতা উগরে দিল,— ভাল। ভীষণ ভাল।
একটু লেংদি লাগেনি? ইন্টারভ্যালের আগে একটা দুটো সিনে কঁচি চালালে ভাল হয় না?
আমি অতশত বুঝি না। আমার তো টানটানই লাগল।
তাই কি?
হ্যাঁ। আমি তো মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিলাম।
সেটা অবশ্য তোমার দৃষ্টি দেখেই বুঝেছি। ফার্স্ট রোয়ে বসে এমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলে। অংশু মৃদু হাসল,— ইনফ্যাক্ট, তোমার ওই তাকিয়ে থাকাটাই আজ আমায় খুব ইন্সপায়ার করেছে।
দোলা ঈষৎ লজ্জা পেল,— যাহা্ বাড়িয়ে বলছেন। আপনি এমনিতেই … ছন্নছাড়া তো আপনি একাই জমিয়ে দিয়েছেন।
জমলেই ভাল। আগের প্রোডাকশনটা তো ফেল করল। অংশু ঘাড় ঘুরিয়ে সেট ভাঙাভাঙি দেখল একবার। তারপর সামান্য গলা নামিয়ে বলল,— একটা কথা ভাবছিলাম, জানো?
কী?
তোমার অপারগতাটা আমি বুঝি দোলনচাঁপা। তবে এখন তো ছেলেমেয়েরা অনেক বড় হয়েছে, তোমার কাছ থেকে সংসারের ডিম্যান্ডও কমেছে নিশ্চয়ই… দ্যাখো না, আবার মাঝে মাঝে আসতে পারো কিনা।
সংসারের দাবিই বড় ছিল কিনা দোলা নিশ্চিত নয়। একটা মানুষের ইচ্ছে অনিচ্ছেই তো ছিল প্রধান। তার কি বদল ঘটেছে কোনও? আজ সকালেই যখন সে নাটক দেখতে যাওয়ার কথা জানাল, পলকে চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল না? বয়স তো অনেক হল, আর সন্দেহ-টন্দেহ বরদাস্ত হয়?
দোলা মলিন মুখে বলল,— দেখি। যদি পারি…
প্লিজ চেষ্টা কোরো। তুমি এলে আমার খুব ভাল লাগবে। বলেই অংশুর ঠোঁটে কেমন এক অপ্রস্তুত হাসি,— শুধু আমি কেন, আমাদের সকলেরই ভাল লাগবে। তোমারও। ঠিক বলছি কি, দোলনচাঁপা?
দোলার স্বর ফুটল না। বুকটা যেন চলকে উঠেছে সহসা। অংশুদার ওই অপ্রতিভ হাসি কি অন্য কোনও সংকেত পাঠাল? যে সংকেতের প্রতীক্ষায় একদা আকুল থাকত এক সপ্তদশী কন্যা। পরে, সৃষ্টিতে থাকার সময়েও কি এমনই কিছু শুনতে চেয়েছিল তনুমন? অথবা এ নেহাতই কল্পনা মাত্র? মানুষ যা শুনতে চায়, সে ভাবেই তো গড়ে নেয় কথাগুলোকে। সহজ সাধারণ হলেও? হয়তো বা স্নেহের বশেই উচ্চারিত হল বাক্যগুলো, আর পাঁচ জনকে যেমন বলা হয় আর কী। তবু, অংশুদার মুখ দিয়ে বেরোল বলেই, যেন অন্য মাত্রা পেয়ে গেল আমন্ত্রণটা।
আঁজলা ভরা সুখটুকু নিয়ে দোলা বাসস্টপে এল। ন’টা বেজে গেছে, তবু এখনও বেশ লোকজন রবীন্দ্র সদনের সামনে। নন্দন চত্বরে কোনও একটা মেলা চলছে, বেরিয়ে আসছে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে কেউ কেউ, অথবা একটু বেশিই ঘনিষ্ঠ। চোখ পড়লে দোলার সামান্য অস্বস্তি হয়। কিন্তু আজ যেন তেমনটা লাগছিল না। অন্তত এই মুহূর্তে। অন্য এক আবেশে ছেয়ে গেছে মন। আগের নাটকটা দেখতে আসার দিনও অংশুদা এভাবে ডাকেনি। আবার এলে হয়। অশান্তি বাড়বে? নীরব উপেক্ষা দিয়ে প্রতিহত করতে পারবে না দোলা?
ঘ্যাঁচ করে এক ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল সামনে, ফুটপাথ ঘেঁষে। জানলা থেকে ডাক,— কাকিমা? ও কাকিমা?
দোলা চমকে তাকাল। গার্গী।
বাড়ি যাবেন তো? চলে আসুন।
সামান্য ইতস্তত করছিল দোলা। গার্গী দরজা খুলে দিয়েছে। মুখ ফুটে না বলার কারণ খুঁজে না পেয়ে শেষে দোলা উঠেই পড়ল।
ঠিকঠাক গুছিয়ে বসতে না বসতে গার্গীর প্রশ্ন,— কোনও ফাংশন দেখতে এসেছিলেন বুঝি?
নাটক।
আপনার বুঝি নাটক দেখার শখ?
এবারও দোলার সংক্ষিপ্ত উত্তর,— হুঁ।
জানেন তো, আমারও এক সময়ে নাটক-সিনেমার নেশা ছিল। এখন আর হয়েই ওঠে না। সময় পাই না।
দোলা ঝলক দেখল মেয়েটাকে। বছর পঁয়ত্রিশের গার্গীর পরনে আজ চাপা লং স্কার্ট, ঢোলা-হাত থ্রি-কোয়ার্টার টপ্৷ চোখমুখ রীতিমত ধ্বস্ত। কৌতূহল দেখাতে না চেয়েও দোলা জিজ্ঞেস করে ফেলল,— তুমি কোথ্থেকে আসছ?
হিমালয়া হাউসে একটা মিটিং ছিল। আমরা যারা সাউথ ক্যালকাটা আর সেন্ট্রাল ক্যালকাটায় অল্টিয়াসের এজেন্সি নিয়েছি, তাদের সবাইকে নিয়ে। সেই কোন চারটেয় স্টার্ট করেছিল, এতক্ষণে ছাড়া পেলাম।
ও হ্যাঁ… তুমি তো যেন কী একটা করছ!
আমাদের কোম্পানি তো রিটেলে মাল দেয় না, কানেকশন বাড়িয়ে বাড়িয়ে ক্লায়েন্ট ধরতে হয়। অবশ্য তাদেরও ক্লায়েন্ট বলে না, তারাও এজেন্ট। একটা পার্টিকিউলার অ্যামাউন্টের প্রোডাক্ট তুলে তারাও সেল শুরু করতে পারে। বলতে পারেন, কোম্পানিকে নতুন নতুন এজেন্ট দেওয়াটাই আমাদের কাজ।
ও। দোলা মোটামুটি বুঝতে পারল,— তার মানে তোমরা চেন তৈরি করো।
একদম ঠিক।… আমি তো ভাবছি, আপনার কাছেও যাব একদিন।
ওমা, কেন?
আপনি আমার টারগেট লিস্টে আছেন। গার্গীর শ্রান্ত মুখে এক ফালি হাসি,— নেহাত আমাদের হাউজিংয়ে এখনও কাজ শুরু করিনি, নইলে কবেই আপনাকে অ্যাপ্রোচ করতাম। আপনি কিন্তু সাংঘাতিক পোটেনশিয়াল এজেন্ট হতে পারেন। কাকু অত বড় চাকরি করে, সেই সূত্রে নিশ্চয়ই আপনাদের অনেক চেনাজানা… এ ছাড়া তিয়াসাও সেল্স লাইনে, সেও আপনাকে কনট্যাক্টস দিতে পারে… প্লাস, আপনাদের রিলেটিভ্স, ফ্রেন্ডস… আপনার জামাইবাবুও তো হাইলি প্লেস্ড……
মহা ধুরন্ধর মেয়ে তো! কোথ্থেকে এত হাঁড়ির খবর পেল? তিয়ার সঙ্গে মৌখিক আলাপ থাকতে পারে, তবে এত গল্প করার বান্দা তো তিয়া নয়! তার ফুরসতই বা কই, এখন তো রবিবারেও অফিস চলছে! তা হলে কে? মন্দিরা? যে উৎসাহে সে গার্গী-সমাচার দোলাকে শোনায়, হয়তো সেই উৎসাহেই দোলাদের খবরও…!
দোলা হেসে বলল,— দূর, আমায় দিয়ে ওসব হবে না। আমি কথাই বলতে পারি না।
বলতে তো হবেও না। কথা বলবে অল্টিয়াসের প্রোডাক্ট। আপনি নিজে ব্যবহার করে সন্তুষ্ট হলে তবেই না অন্যের কাছে যাবেন। গুণাগুণ তখন আপনাআপনি ব্যাখ্যা হতে থাকবে। বলেই কোলের বড় ব্যাগখানা খুলেছে গার্গী। একটা টুথপেস্ট বার করে দোলার হাতে ধরিয়ে দিল,— এটা দিয়েই স্টার্ট করুন। সাত দিন ইউজ করলে বুঝতে পারবেন বাজারচলতি প্রোডাক্টগুলোর সঙ্গে কত তফাত। রাখুন না, রেখে দিন।
ফাঁপরে পড়ল দোলা। অস্বস্তি মাখা গলায় বলল,— কত দাম এটার?
এক পয়সাও না। এটা আমার গিফ্ট। এর পর যা দেব, দাম নেব। …আপনি এখন মুখে কোন ম্যাসাজ ক্রিম ব্যবহার করেন, কাকিমা?
কিছু তো করি না।
কেন করেন না? বলেই গার্গী আলগা হাত বোলাল দোলার হাতে,— আপনার স্কিন অবশ্য এমনিই খুব ভাল। সফ্ট, টেন্ডার…। আপনার বয়সে এক একজনের তো কুমিরের মতো চামড়া হয়ে যায়। …তবু বলব, এখন থেকেই আপনার কেয়ার নেওয়া উচিত। এরপর কিন্তু আস্তে আস্তে স্কিন খসখসে হতে আরম্ভ করবে।
দোলা হেসে ফেলল,— সে তখন দেখা যাবে।
উঁহু, প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়োর। আমি আপনাকে একটা অ্যান্টি রিঙ্কল ক্রিম দিয়ে আসব, আর একটা আন্ডার আই। এমনিতেই তো আপনার বয়স বোঝা যায় না, দেখে মনে হয় তিয়াসার দিদি। ক্রিমগুলো রেগুলার লাগান, দেখবেন আরও দশটা বছর আপনার বয়স থেমে থাকবে।
তুত্, কী যে বলো! …ওসব আমার পোষাবে না। বলল বটে দোলা, তবে মনে মনে একটু খুশিও হয়েছে। সে যে মাঝে মাঝে ভাবে এখনও বুড়িয়ে যায়নি, ধারণাটা তা হলে মিথ্যে নয়! তবু গলা ঝেড়ে বলল,— তুমি বরং তিয়ার জন্যে কিছু দিয়ে যেয়ো।
তিয়াসা তো আছেই। তা বলে আপনি নিজেকে সুন্দর রাখবেন না কেন? আমাদের একটা দারুণ ফেস-মাস্ক আছে। একদম আপনাদের জন্যই। দুপুরে মুখ ডিপ ক্লিন করে প্যাকটা লাগিয়ে রাখুন… ধুয়ে ফেলুন… দেখবেন ফেস কী গ্লো করছে!
মহা নাছোড়বান্দার পাল্লায় পড়ল তো! দোলা কি কোনও অছিলায় ট্যাক্সি থামিয়ে নেমে যাবে? একেই তো বাড়িতে সে সকলের উপহাসের খোরাক। ছেলে, মেয়ে, বর, যে যখন যে ভাবে পারছে, বিদ্রুপ ছুড়ে যাচ্ছে। এর পর সৌন্দর্যচর্চা শুরু করলে তো আর দেখতে হবে না। অবশ্য জীবনে কখনও দোলা পারলার-টারলারে যায়নি, এমন নয়। তবু সব সময়ে কেমন কাঁটা হয়ে থাকতে হয়েছে, এই বুঝি খরচের অঙ্ক শুনে তুহিন কিছু বলল! মুখে না বললেও হয়তো গাল পেড়েছে মনে মনে! এমনিই তো কথায় কথায় শোনায়, রোজগার তো করলে না, রক্ত জল করা পয়সার মর্ম কী বুঝবে!
সাড়াশব্দ না করে দোলা রাস্তাঘাট দেখছিল। আবার গার্গীর গলা,— বাইরেটা ঝকঝকে রাখলে ভেতরটাও খুব তরতাজা লাগে কাকিমা।
দোলা আলতোভাবে বলল,— তাই কী?
আমার তো তাই মনে হয়।
দোলা অপাঙ্গে গার্গীকে দেখল। এখন না হয় ক্লান্ত, তবে মেয়েটার চেহারায় চাকচিক্য আছে। মেয়েটার ভেতরটাও কি অতটা চনমনে? বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরেও? কথার খই ছোটায় মেয়েটা, কথা দিয়েই কি ব্যাবসা চালায়? নাকি আরও কিছু দিতে হয়? শুধু ক’টা প্রসাধনী বেচে এত ঠাটবাট বজায় রাখা সম্ভব? অন্তত হাজার ছয়েক টাকা ভাড়া গোনে ফ্ল্যাটের, ছেলে দামি স্কুলে পড়ছে, কথায় কথায় ট্যাক্সি…! মন্দিরা যা বলে, তাই হয়তো সত্যি। কে জানে, নাও হতে পারে। কারও সম্পর্কে খারাপ ধারণা করতে দোলার বড় কষ্ট হয়। তুহিনের মতো একটা মানুষের সঙ্গে প্রায় ছাব্বিশ বছর ঘর করার পরেও।
মাথা থেকে ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল দোলা। গলায় সহজ ভাব এনে বলল,— তোমার ছেলেটাকে নীচে খেলা করতে দেখি… ভারী মিষ্টি হয়েছে।
ভয়ানক দুরন্ত। গার্গী ঘড়ি দেখল,— বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ। নির্ঘাত দিদাকে জ্বালাচ্ছে।
কোন ক্লাসে পড়ছে যেন?
এই তো, থ্রি-তে উঠল। …প্রত্যেক বছর যা খরচ বাড়ছে…
দোলার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল,— বাবা ছেলের খরচ দেয় না?
ঝট করে ঘুরে তাকাল গার্গী। দু’-এক সেকেন্ড দোলাকে দেখে নিয়ে নিস্পৃহ সুরে বলল,— দেয়। দেয় না। বিয়ে করেছে তো, আমিও আর বলি না। তার নতুন সংসার…
গার্গী থেমে গেল। বেশি কৌতূহল দেখিয়ে ফেলল কি দোলা? আর টুঁ শব্দটি না করে দোলা ফের চোখ মেলেছে রাস্তায়। দেখছে বন্ধ দোকানপাট, ধেয়ে আসা গাড়ি, আলো। অন্ধকারও। মোবাইলে একটা ফোন এল গার্গীর। অতি অনুচ্চ স্বরে কথা বলছে মেয়েটা। দোলা প্রাণপণ চেষ্টা করছিল, একটি শব্দও যেন কানে না যায়। অংশুদার কথাগুলোই ভাবছে আবার। মানে খুঁজছে।
ফোনালাপ শেষ। গার্গীও চুপচাপ। একটু বা উন্মনা। বাড়ি এসে গেল।
ফ্ল্যাটে ঢুকতেই ছিঁড়ে গেল সন্ধেটা। বাতাসে সুরার ঘ্রাণ। শোওয়ার ঘরে বোতল গ্লাস সাজিয়ে বসেছে তুহিন। যেমন প্রায়শই বসে আজকাল। সে দিকে না তাকিয়েই দোলা ব্যাগ পুরল আলমারিতে, ঘড়ি খুলল, কপাল থেকে ছোট্ট টিপটা নিয়ে সাঁটল আয়নায়। লাগোয়া বাথরুমে ঢুকছিল, পিছনে হঠাৎ তুহিনের গলা,— যাক, ফিরেছ তা হলে?
শ্লেষ গায়ে না মাখাই সংগত ছিল। তবু দোলা দাঁড়িয়ে গেছে। খর দৃষ্টি হেনে বলল,— তুমি কী আশা করেছিলে? জন্মের শোধ বিদেয় হলাম?
তুহিনের যেন কানেই গেল না, চুমুক দিচ্ছে গ্লাসে। জবাব না দেওয়ার অবজ্ঞাটা হজম করে দোলা দ্রুত পোশাক বদলে এল। তিয়া তিতান দু’জনেই ফিরেছে, কম্পিউটার নিয়ে কী যেন খুনসুটি চলছে ভাইবোনের। বড় আত্মসুখী মেয়ে, রাতের খাবারগুলো পর্যন্ত ফ্রিজ থেকে বের করেনি, মা এসে করবে।
ঝটপট মুরগির মাংস আর পাঁচমেশালি তরকারিটা গরম করে ফেলল দোলা। ক্যাসারোলের রুটি মাইক্রোওয়েভ ওভেনে গরম করল। রুটি তুলতুলে আর গরম না হলে বাবুবিবিদের গোঁসা হয়। এরপর ডাকাডাকি, সাধ্যসাধনার পালা, খেয়ে উদ্ধার করল সকলে। আহারের মাঝে তিতান নাটক নিয়ে প্রশ্ন করল টুকটাক, তিয়ার মুখের সামনে থ্রিলার, টেরচা চোখে শুনল মা-ছেলের কথা। বাপেরও কান খাড়া, তবে ভাব এমন, যেন শুনেও শুনছে না। নতুন কোনও বিদ্রূপ ছুড়ল না ছেলেমেয়ের সামনে, এই যা দোলার ভাগ্য।
টেবিল, রান্নাঘর সাফসুরত করে দোলা টিভি খুলে বসল। তুহিন আগে ঘুমিয়ে পড়ুক, তারপর শুতে যাবে।
একটা গানের অনুষ্ঠান দেখছিল দোলা, তিয়া এসেছে পাশে। দেখছে টিভি। দোলা একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল,— কী রে, আজ কম্পিউটার ছেড়ে বোকা বাক্সে?
এমনি। স্বাদ বদল।
কাল ক’টায় বেরোবি?
দেখি। তিয়া আড়মোড়া ভাঙল। ছোট্ট হাই তুলে বলল,— ভাবছি এ-চাকরিটাও ছেড়ে দেব।
দোলা চোখ ঘুরিয়ে দেখল মেয়েকে। প্রশ্ন করা বৃথা, তবু জিজ্ঞেস করে ফেলল,— কেন?
পোষাচ্ছে না। এরা বড্ড এক্সপ্লয়েট করছে। ভাবছি নতুন কিছু করব।
কী?
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। একজন খুব ডাকাডাকি করছে।
সেটা কী কাজ?
ও আছে। দায়িত্ব নিয়ে নানান ধরনের কাজকর্ম তুলে দেওয়া। তুমি বুঝবে না।
বটেই তো, দোলা তো হাবাস্য হাবা! কিছুই তার মগজে ঢোকে না!
বিরস গলায় দোলা বলল,— তা কবে ছাড়ছ?
ঠিক নেই। আগে মাসটা তো যাক।
আবার একটা হাই তুলে তিয়া উঠে গেল। তার অলস গমনভঙ্গি দোলা দেখল একটু। ফের চাকরি বদলের বাসনা জেগেছে মেয়ের, মাকে সেই কথাই শোনাতে এসেছিল নাকি? জানানোর কি প্রয়োজন ছিল কোনও? নাহ্, মেয়ের মতিগতি বোঝা ভার।
দোলা আরও খানিক্ষণ বসে রইল টিভির সামনে। তিতানের ঘরে আলো নেবার পর পায়ে পায়ে নিজেদের কক্ষে। বিস্মিত চোখে দেখল, তুহিন এখনও ঘুমোয়নি, খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। নিঃশব্দে কানের দুল জোড়া খুলে ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে রাখল দোলা। চুলের গোড়া শক্ত করে বাঁধছে।
তুহিন উঠল। বাথরুম ঘুরে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
দোলা জিজ্ঞেস করল,— কিছু বলবে?
তুহিন হাত রেখেছে দোলার কাঁধে। অল্প ঝুঁকে বলল,— তোমাকে কিন্তু আজ বেশ দেখাচ্ছিল।
দোলার কাঁধ পলকে শক্ত, ভুরুতে ভাঁজ।
হাত সরিয়ে নিল তুহিন। মুখটা আস্তে আস্তে একটা হাসিতে ভরে গেছে। স্বাভাবিকও নয়, জোর করে টানাও নয়, এ এক অন্য হাসি।।
ফ্যাসফেসে গলায় তুহিন বলল,— সরি, ভুল হয়ে গেছে। আজ তো তোমার অংশুদার দিন।
.
০৮.
হন্তদন্ত পায়ে কলেজ থেকে বেরোচ্ছিল তিতান। আচমকা পল্লবের মুখোমুখি। তীর্থঙ্কর, রাজ্যশ্রীদের জটলায় ছিল, তিতানকে দেখে এগিয়ে এসেছে। প্রায় পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে বলল,— দাঁড়া দাঁড়া, খ্যাপা পাগলের মতো ছুটছিস কোথায়?
তিতান মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,— কাজ আছে। দেরি হয়ে যাবে।
আজ তুই ক্লাস-টেস্টে বসলি না যে বড়?
ছিল নাকি আজ? তিতানের চোখ পিটপিট,— ও হ্যাঁ, এন-পির আজ নেওয়ার কথা ছিল বটে।
ওরকম ডোন্ট কেয়ার ভাবে বলছিস কেন? বসলে তো তোরই লাভ, প্রিপারেশনটা ঝালিয়ে নিতিস। পল্লবের গলায় গার্জেনি সুর,— তোর অ্যাটিচিউডটা আমি বুঝছি না সায়র। ক্লাসটাস করা তো প্রায় ছেড়েই দিয়েছিস। এরপর তো নন-কলেজিয়েট, ডিস-কলেজিয়েট হয়ে যাবি।
ইউনিভার্সিটির পরীক্ষায় বসায় ব্যাগড়া দেবে? কে? প্রিন্সিপাল?
কেন, পারে না?
তিতান হাসল মনে মনে। অত সোজা? দেখুক না প্রিন্সিপাল চেষ্টা করে, খাবে ওপর থেকে কড়কানি…। ওপর বলতে অবশ্য ঠিক কী বোঝায়, সে সম্পর্কে তিতানের এখনও সম্যক ধারণা নেই। তবে সেটা যে সাংঘাতিক শক্তিশালী কিছু, প্রায় ভগবানেরই সমগোত্রীয়, এটুকু তিতান আন্দাজ করে নিয়েছে। সুতরাং তুচ্ছ এক প্রিন্সিপাল, যে কিনা পার্টির দাক্ষিণ্যে একটা বড়সড় ঘর আর একখানা পুরু গদি-আঁটা চেয়ারে বসার সুযোগ পেয়েছে, এবং প্রতি মুহূর্তে পার্টির ভয়ে থরহরি কম্পমান, তাকে নিয়ে ভাবিত হওয়া তিতানের সাজে না।
মুখে অবশ্য অতটা অশ্রদ্ধা প্রকাশ করল না তিতান। এটাও পল্টুদার শিক্ষা। বিনয় দেখিয়েই নাকি নিজের ওজনটা বোঝাতে হয়।
পল্লবের কাঁধে হাত রেখে তিতান বলল,— ও নিয়ে ভাবিস না। ম্যানেজ হয়ে যাবে।
সরি, সরি। তুই তো এখন অনেক বড় জায়গায় নাড়া বেঁধেছিস। পল্টুদা তোকে চোখে হারায়…!
শ্লেষটা পছন্দ হল না তিতানের। আবার একটু একটু উপভোগও করল যেন। সায়র মিত্র যে এখন নেহাত হেঁজিপেঁজি নয়, তার ওপর পার্টির বিশেষ নেকনজর আছে, এটা পল্লব জানে। শুধু পল্লব কেন, ইউনিয়নের সব কর্তাই…।
পল্লবকে পালটা ঠোক্কর দেওয়ার জন্য তিতান স্বরে গাম্ভীর্য আনল,— তুই কাকে টিজ করছিস? আমাকে? না পল্টুদাকে?
কাউকেই নয় রে। পল্লবের স্বর সহসা নরম। তিতানের হাতটা ধরে বলল,— রাগ করিস না সায়র, তোকে কয়েকটা কথা বলি। পল্টুদা যত বড় নেতাই হন, যত শক্তিশালীই হন, তিনি আমার বন্ধু নন। কিন্তু তুই আমার বন্ধু। এটা মানিস তো?
মানি।
বন্ধু হিসেবেই তা হলে জিজ্ঞেস করি, তুই কি ঠিক করছিস?
কী? কোনটা?
দ্যাখ সায়র, পার্টির কাজ আমিও করি। আই মিন, ইউনিয়ন থেকে তো আমি দূরে নেই। টুকটাক খাটি, মিটিং-মিছিলে যাই, অমিতদা বরুণদা ক্লাসে কিংবা গেটে লেকচার দিলে পাশেই থাকি…। তা বলে সব কিছু ছেড়ে পার্টি পার্টি করে মাথা খারাপ তো আমি করছি না। কারণ, এদের ছুঁয়ে থাকা ভাল। ফিউচারে কাজে লাগতে পারে। কিন্তু..সারাক্ষণ এই পার্টি, ইউনিয়ন… দিস ইজ নট মাই কাপ অব টি।
হতেই পারে। এটা তোর আউটলুক। …তো?
তোর আউটলুকও এমন কিছু আলাদা নয়। তোকে তো একটু একটু চিনেছি…। বুকে হাত দিয়ে বল তো, তুই আমি কেউ নীতি-আদর্শের টানে এসেছি? ইনফ্যাক্ট, এদের কোনও নীতি-ফিতি আছে কিনা, তাও কি আমরা জানি ঠিকঠাক?
আমি জানি। আমি তো পড়াশুনো করছি। পার্টির ক্লাস অ্যাটেন্ড করব।
তাতেই সব বুঝে যাবি? …ওরে গাড়োল, পার্টি একটা খাঁচা। ঢুকে পড়লেই ব্যস, আটকে গেলি। লিডার ক’টা হয়? সবাই ক্যাডার থাকে, এবং ক্যাডারই থাকে। ওপরে উঠতে গেলে এক্সট্রা এলেম লাগে। হয় পড়াশুনো, নয় জবান চালানোর কায়দা, নয় তো প্যাঁচোয়া বুদ্ধি। কোনওটাই তোর নেই। চেষ্টা করলে একমাত্র লেখাপড়াটার কিছু উন্নতি করতে পারবি, বাকিগুলো তোর হবে না রে। …বরুণদাকেই দ্যাখ না। পরীক্ষায় গাড্ডু, সর্বক্ষণ গাঁকগাঁক চেঁচায়, মাথাটাও নিরেট। তুই লিখে রেখে দে, দশ বছর পরেও বরুণদা ক্যাডার হয়েই পড়ে থাকবে, আর কোনও একটা লিডারের পায়ে পায়ে চামচা হয়ে ঘুরবে। তখন স্রেফ ওকে কোনও উঞ্ছবৃত্তি বা খাবলে-খুবলে খাওয়ার লাইন ধরিয়ে দেবে, নয়তো ওকে দিয়ে বোমা বাঁধাবে।
গাড়োল শব্দটা কানে আসার পর থেকে তিতান চিড়বিড়িয়ে জ্বলছিল। বিনয়ী থাকার উপদেশ ভুলে রুক্ষ স্বরে বলে উঠল,— তুই দেখি খুব বেশি বুঝে গেছিস?
না রে সায়র। বুঝি না বলেই তো সাবধান থাকতে চাই। তোকে বন্ধু ভাবি, তাই তোকেও সতর্ক করতে চাইছি।
লম্বা লম্বা জ্ঞান মারিস না। আমারটা আমাকেই ভাবতে দে। তিতান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,— যত্ত সব পেটি বুর্জোয়া মেন্টালিটি।
ওয়ার্ডটা তা হলে শিখে গেছিস? পল্লবের ঠোঁটে ছেঁড়া হাসি,— ওই শব্দটা কিন্তু আমি বাড়িতে জন্ম থেকেই শুনছি। পার্টি এক সময়ে আমার বাবাও করত রে। বাহাত্তরের ইলেকশনে পোলিং এজেন্ট ছিল। ভোটের পর দিনই ডান্ডা খেয়ে বাড়িছাড়া হতে হয়েছিল বাবাকে। তিন মাস পাড়ায় ঢুকতে পারেনি। সেই লোক এখন পার্টির নাম শুনলে থুতু ছেটায়। ভোটটা এখনও ওই বাক্সেই দেয়, কিন্তু গালাগাল দেয় সারাক্ষণ। বলে, শালা ঠিকাদার প্রোমোটারগুলো পার্টিটাকে কিনে নিল! …পল্টুদার ভাইয়েরও কনস্ট্রাকশন বিজনেস আছে না?
তুই কী মিন করছিস? পল্টুদা ডিজঅনেস্ট? চোর?
যাহ্, আমি কি তাই বললাম? পল্লব যেন খানিকটা গুটিয়ে গেল। ফের হাত রেখেছে তিতানের কাঁধে,— এটা জাস্ট বিটুইন ইউ অ্যান্ড মি। তুই আবার গিয়ে সবাইকে গল্প করিস না। জাস্ট তোর ভাল চাই বলেই…
থ্যাঙ্ক ইউ। পল্লবের হাত আস্তে করে নামিয়ে দিল তিতান। বিকারহীন মুখে বলল,— তোর ডায়ালগগুলো আমার মাথায় থাকবে। …এবার যাই?
কোথায় যাবি এখন?
সেটা তোর না জানলেও চলবে।
শ্রেয়াকে আজ কলেজে দেখলাম না…। পল্লব বুঝি লঘু করতে চাইছে বাতাবরণ। ইয়ার্কির সুরে বলল,— আজকাল তোরা বাইরেও অ্যাপো করছিস নাকি?
করতেই পারি।
খেলি চুমুটুমু?
তিতান জবাব দিল না। চোয়াল শক্ত সামান্য।
পল্লব চোখ টিপল,— মনে আছে তো…ফার্স্ট কিসটা… আমার নামে…?
এক কুচি অবজ্ঞা ছুড়ে দিয়ে পল্লবকে পেরিয়ে এল তিতান। বাসস্টপে এসে ঘুরে তাকাল। পল্লব পানের দোকানে, সিগারেট কিনছে। একটা সাদা কাঠি ঠোঁটে চেপে দড়ির আগুন তুলে ধরাল। ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে তিতানকেই দেখছে আড়ে আড়ে।
তিতান দৃষ্টি সরিয়ে নিল। খুব বাড় বেড়েছে পল্লবটার। আগেও একদিন বাণী ঝাড়ছিল, তিতান পাত্তা দেয়নি। আজ পল্টুদার নামে আজেবাজে বলল…! পল্টুদার ছেলে বেঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে তো, তাই অনেকেরই চোখ টাটায়। আশ্চর্য, পল্টুদা পার্টির হোলটাইমার বলে তার ছেলের ইঞ্জিনিয়ার বনার রাইট নেই? আর ভাই যদি দাদার ছেলের পড়ার খরচ জোগায়, সেটা কী এমন দোষের? দুনিয়ার সব ভাই তো তিতানের কাকামণির মতো সেলফিস নয়! তা ছাড়া সব্বাই জানে, পল্টুদার ভাই সিভিলে ডিপ্লোমা। সে বাড়িঘর রাস্তাঘাট বানাবে না তো কি হরিসংকীর্তনের দল খুলবে? বোঝাই যাচ্ছে, পল্লবের মতো মালরাই এইসব অপপ্রচারের শরিক। দেবে নাকি একটা বাঁশ? বরুণদার সম্পর্কে যা কপচাল, জানতে পারলে বরুণদা পুরো সেঁকে দেবে পল্লবকে। …কী হারামি ছেলে, মুখে বলছে বন্ধু, ওদিকে গ্যাস খাইয়ে তাকে পার্টি থেকে বার করে আনতে চায়! আসলে দেখছে তো, তিতান কেমন চড়চড়িয়ে উঠছে… কথায় কথায় এখন জেলা নয়, ছাত্রফ্রন্টের রাজ্য কমিটি থেকে ডাক পড়ে তিতানের…ব্যাটা তাই জ্বলছে, লুচির মতো ফুলছে! ফোল শালা, তিতান এক্ষুনি এক্ষুনি খার খাবে না। পল্লব যতই প্রতিক্রিয়াশীল হোক, বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখবে তিতান। যতক্ষণ সম্ভব। তবে নজর রাখতে হবে ছেলেটার ওপর। এতই যদি পার্টিকে অশ্রদ্ধা, ইউনিয়নে আসা কেন? ফুস করে বাপের একটা গপ্পো ছেড়ে দিলি! নির্ঘাত বাপটাও পল্লবের মতোই ধান্দাবাজ ছিল। ক্যালি নেই, কলকে পায়নি, এখন গাল পেড়েই তার সুখ। হাহ্!
বাসে উঠে শ্রেয়ার কথা মনে পড়ল তিতানের। কাল রাত্রে ফোনে বলেছিল, আজ আসছে না। কারণ জিজ্ঞেস করতেই খিলখিল হাসি, মোবাইলে যেন জলতরঙ্গ বাজছে। কোথথেকে যে এত হাসি আসে মেয়েদের কে জানে! পল্লবের কী আস্পর্ধা, বলে প্রথম চুমুটা ওর নাম করে খেতে! তুই যখন রুমির ইয়েতে হাত বোলাবি, তখন কি সেটা তিতানের নামে…? হুঁহ্, যত্ত সব! শ্রেয়াটাকে অবশ্য এখনও সেভাবে বাগে পাওয়া যায়নি। তবে চুমুর অভিজ্ঞতায় শ্রেয়াই তার জীবনে প্রথম হবে না। গৈরিকা তাকে একটা চুমু খেয়েছিল। এক বারই। টিউটোরিয়াল থেকে বেরোনোর পথে, ঘুপচি বাড়ির গলিটায় দাঁড়িয়ে। এত তাড়াতাড়ি ঘটেছিল, স্বাদটা বুঝতেই পারেনি তিতান। ধুস, ওভাবে হয় নাকি? বাইরে বন্ধুরা ওয়েট করছে, এক দল নামছে সিঁড়ি বেয়ে, তার মাঝে ওরকম আচমকা…! কী মনে করে খেয়েছিল কে জানে, শৌভিকের সঙ্গে সেঁটে যাওয়ার পর তিতানকে তো আর আমল দিল না! শ্রেয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এমনটা ঘটবে না!
উঁহু, তিতান আর সেই তিতান নেই। টিকিট কেটে চেঞ্জ পার্সে রাখতে রাখতে একবার বাইরেটা দেখল তিতান। এখন তাকে পাত্তা না দেওয়া অত সহজ নয়। তা সে শ্রেয়া কেয়া খেয়া, যেই হোক না কেন। তিতান এখন বিশেষ কেউ। এই যে সে এখন ছাত্রফ্রন্টের রাজ্য কমিটির অফিসে চলেছে, স্বয়ং সহ-সভাপতির ডাক পেয়ে, খুব সাধারণ ছাত্র হলে কি এটা সম্ভব ছিল?
বছর চার-পাঁচ আগে জোন অর আর্কের গল্প পড়েছিল তিতান। জোন নিজেকে মনে করত ‘চোজেন ওয়ান’, ঈশ্বরই নাকি কিছু কাজ করার জন্যে তাকে নির্বাচিত করেছে। বিপদ, আপদ, শত্রুর শক্তি, পরিণামের আশঙ্কা, কিছুই মাথায় না রেখে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। তিতানও যেন নিজেকে সে রকমই কিছু একটা ভাবে ইদানীং। পার্টি ঈশ্বর না হোক, ঈশ্বরের সমতুল্য তো বটে। সর্বশক্তিমান, জল-স্থল-আকাশ সর্বত্র বিরাজমান এক অপ্রাকৃত শক্তির প্রায় সমকক্ষ। সেখানে যদি তিতানকে বিশেষ চোখে নাই দেখা হয়, কেন বারবার সমীরণদা জিজ্ঞেস করবে, তুমি কথাগুলো সব বুঝতে পারছ তো সায়র? …লক্ষ্য আমাদের স্থির আছে, বিপ্লব একদিন আসবেই। তবে সেখানে পৌঁছোতে এখন নানান পন্থা অবলম্বন করতে হতে পারে। কখনও কখনও মনে হবে, পথগুলো যেন আমাদের নীতি আদর্শের সঙ্গে মিলছে না। তবে তাতে ঘাবড়িও না। এগুলো স্রেফ রণকৌশল। যাদের জন্য লড়াই, প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণও হয়তো প্রয়োজন হল। অথবা আপস করতে হল বুর্জোয়া বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে। পার্টির একনিষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে তখন দুর্বল হয়ে পোড়ো না যেন। আরও কয়েক জন থাকে পাশে, তবু তিতান ভাবে শুধু বুঝি তার উদ্দেশেই বলা হল কথাগুলো। যেন তিতানকেই খানিকটা ক্ষমতা দিয়ে দিল ক্ষমতাবানরা। অতএব আশপাশের প্রত্যেকের কাছেই তিতানের একটা বাড়তি মূল্য প্রাপ্য হয়েছে, নয় কি?
ছাত্রফ্রন্টের রাজ্য অফিস তালতলায়। তিতান পৌঁছে দেখল, শঙ্খদা গল্প করছে বসে। তাকে পেয়েই যুতে দিল কাজে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্রফ্রন্টের চাঁদা এসেছে, অঞ্চল ধরে ধরে হিসেব লিখতে হবে খাতায়। সঙ্গে স্কুলের নাম, কলেজের নাম…। এই সব নীরস কাজও এখন নেশাগ্রস্তের মতো করে তিতান। এ তো শিক্ষানবিশি, উত্তরণের প্রথম ধাপ। আজ কাজের মাঝে হঠাৎ পার্টির এক বড় নেতা হাজির। বহুকাল আগে তিনি ছিলেন ছাত্রফ্রন্টের পয়লা নম্বর নেতা, এখন দলীয় সংগঠনের এক স্তম্ভ। চাইলেই নাকি মন্ত্রী হতে পারেন যখন তখন, হন না। রাজ্যের প্রতিটি কোণে দলকে ছড়িয়ে দেওয়াই নাকি তাঁর ব্রত। বেঁটেখাটো বক্সার টাইপের চেহারার নেতা অফিসে পা দেওয়ামাত্র তাঁকে ঘিরে ভিড় আর উচ্ছ্বাস। সহ-সভাপতি শঙ্খশুভ্র চৌধুরী তো বটেই, সম্পাদক আর সভাপতিও হাত কচলাচ্ছে। তিতান উঠে সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না, তিনিই এলেন তিতানদের টেবিলে। তিতানেরই পিঠ চাপড়ে বললেন, বাহ্, বাহ্, ভারী নিষ্ঠাবান কমরেড পেয়েছ তো তোমরা!
তিতান গদগদ। আরও বেশি ডুবেছে কাজে। কানে আসে টুকরো টাকরা অমৃতভাষণ, কিংবা দরাজ হাসি, অথবা চোরা ফিসফাস, সঙ্গে টেবিলে মুড়ি-শিঙাড়া, মুহুর্মুহু চা…! আগে যে-ক’দিন এসেছে এখানে, অফিসটা ফাঁকা ফাঁকাই ছিল, কিন্তু আজ যেন স্বপ্নের পরিবেশ। আড্ডা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না তিতানের। অবশেষে যখন বেরোল, বেশ রাত হয়েছে।
তিতান বাড়ি ফিরল প্রায় দিব্যোম্মাদ দশায়। বাবা রাউরকেল্লায়, কোনও জবাবদিহির দায় নেই, মেজাজ তাই আরও ফুরফুরে।
কিন্তু কী কপাল, মা আজ বাবার ভূমিকায়!
দোলা গোমড়া গলায় জিজ্ঞেস করল,— তোর ব্যাপারখানা কী, অ্যাঁ? ফের আজ সাড়ে দশটা?
তিতান কাঁধ ঝাঁকাল,— ফোনে তো বলে দিলাম, দেরি হবে!
ব্যস, জানিয়ে দিলেই বুঝি চুকে গেল? পরীক্ষার দেড় মাসও বাকি নেই, পড়াশুনো শিকেয়, সারাক্ষণ কী সব হাবিজাবি কাগজ ঘাঁটছ…!
হাবিজাবি বলবে না। ওগুলো পার্টির লিটারেচার। পড়তে হয়।
নিকুচি করেছে তোমার পার্টির লিটারেচার। ওসব এবার বন্ধ করো। টিউটোরিয়ালেও তো বোধহয় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছ! বাবা এতগুলো টাকা খরচ করে ভরতি করে দিল…
টাকার খোঁটা দেবে না। তিতানের মেজাজ খিঁচড়ে গেল। নাকমুখ নেড়ে বলল, —আমি কি বলেছিলাম ভরতি করতে?
কেন করেছিল তার তুমি কী বুঝবে? তোমার যেটুকুনি কাজ, সেটুকুনিই করো দয়া করে। পড়াশুনো করে আমাদের উদ্ধার করো।
আমাকে নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না। আমার ফিউচার আমি গড়ে নেব।
হুঁহ্, ফিউচার গড়বে! পাস্ট যেন দেখিনি, প্রেজেন্ট যেন দেখছি না…!
স্বপ্ন থেকে বাস্তবে আছড়ে পড়ে তিতান যেন হাঁসফাঁস করছে। তার সঙ্গে এভাবে উপহাসের সুরে কথা বলে মা? সায়র মিত্রর সঙ্গে?
ক্রুদ্ধ মুখে তিতান বলল,— আটভাট কমেন্ট করবে না মা। আমি কিন্তু লাইক করছি না।
তর্কাতর্কির মাঝে তিয়া কখন বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। হঠাৎই তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠেছে,— তুই কী লাইক করিস, ডিসলাইক করিস, তাতে আমাদের ঘেঁচু। সামনে পরীক্ষা, পড়বি, ব্যস আর কোনও কথা নয়।
তিতান দপ করে জ্বলে উঠল। দিদির আজকাল বহুত ফাঁট বেড়েছে। চাকরি করার পর থেকেই খুব এয়ার নিয়ে চলত, গাড়ি বিক্রি ছেড়ে কী এক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট শুরু করে মাটিতে যেন পা পড়ছে না এখন! এক ফাটিয়ালের সঙ্গে মোটরসাইকেলে দু’দিন দেখেছে তিতান, নেহাতই কৌতূহলে জিজ্ঞেস করেছিল, ওই লাল হেলমেটটা কে রে… সঙ্গে সঙ্গে থাপ্পড়ের মতো জবাব, নিজের চরকায় তেল দে!
দিদির উত্তরটাই আজ দিদিকে ফেরত দিল তিতান,— আমি কী করব, না করব, সেটা আমার ব্যাপার। তুই নিজের চরকায় তেল দে। একদম নাক গলাবি না। বলেই মা’র দিকে আঙুল,— তুমিও না।
দোলা হতবাক। তিয়া চেঁচিয়ে উঠল,— তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর বুকনি শুনছ মা? দুমদুম পিঠে দু’ঘা কষিয়ে দিতে পারছ না?
তিতানের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। যে পিঠে স্বয়ং তিনি হাত বুলিয়ে গেছেন, সেই পিঠে কিল মারতে বলে দিদি? প্রায় বুনো জন্তুর মতো তিয়ার দিকে তেড়ে যাচ্ছিল তিতান, দোলা খপ করে তার হাত চেপে ধরেছে। স্বভাববিরুদ্ধ ভঙ্গিতে গর্জে উঠল,— তুই নিজেকে কী ভাবিস, অ্যাঁ? একদম বখে গেছিস তুই। একদম।
দু’-চার সেকেন্ড রাগে অন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তিতান। তারপরই বিস্ফোরিত হয়েছে। মেঝেতে পা ঠুকে বলল,— বেশ করছি বখে যাচ্ছি, হাজার বার যাব। আমার যেভাবে খুশি, সেভাবে চলব। তোমরা যা পারো, করে নিয়ো।
চোপ৷ তোর মুখ আমি ভেঙে দেব।
দাও। দেখি তোমার কত বড় হিম্মত!
শরীর শক্ত করে তিতান দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। যেন পরখ করছে মা’র ক্ষমতার দৌড়। দুপদাপিয়ে ঘরে ঢুকে যাওয়ার আগে একখানা হুংকার ছেড়ে গেল, প্রায় বাবারই গলায় —সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, সায়র মিত্রকে ঘাঁটাতে এসো না, ভাল হবে না।
বিছানায় দড়াম শুয়ে পড়েছে তিতান। প্যান্টশার্ট না বদলেই। মাথায় কে যেন হাতুড়ি ঠুকছে। দুনিয়াসুদ্ধু লোক যার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলে, তাকে কিনা বাড়িতে এই ভাষা গিলতে হয়? তিতানের ভবিষ্যৎ তিতানের চেয়ে বেশি কে বোঝে? মা? বাবা? দিদি? ফুঃ।
কতক্ষণ শুয়ে আছে, তিতান জানে না। মা একবার খাওয়ার জন্য ডেকে গেল, শুনেও শুনল না। দিদির আর মা’র ঘরের আলো নেবার পর উঠে গিয়ে দেখল তার খাবারটা ঢাকা রয়েছে টেবিলে। খিদে বড় আপদ, ঠান্ডা রুটি তরকারি চিবোল কচকচ। সঙ্গে ঢকঢক এক বোতল ঠান্ডা জল। আশ্চর্য, খিদে কমতে মাথাও জুড়োল খানিকটা। একটু একটু অনুতাপও জাগছে যেন। সে কি মা’র সঙ্গে খুব কুৎসিত ব্যবহার করল? কেন তাকে চটিয়ে দিল এরা? মা আর দিদি কেন বোঝে না, তিতান এখন তিতান নয়, সে সায়র মিত্র!
রাতে ভাল ঘুম হল না তিতানের। পর দিন সকালেও বিছানায় পড়ে রইল চুপচাপ। উঠে একবার ব্রেকফাস্ট সেরে আবার গড়াচ্ছে। কলেজও গেল না শেষ পর্যন্ত। পরের দিনও না। মা শুকনো মুখে ঘুরছে, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলছে না। কত অজস্র বার যে ভাবল তিতান, একবার সরি বললেই তো হয়। তিতান একটু জড়িয়ে ধরলেই গলে যাবে মা। কিন্তু পারল কই? সায়র মিত্র ঘাড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে মধ্যিখানে! সমানে যে তর্জনী নাচাচ্ছে, মা-ই বা অত জেদ ধরে থাকবে কেন? দুটো নরম কথা বললে, ছেলের গায়েমাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলে কী ক্ষতি হয়! মা যদি ছেলের ওজন না বোঝে, ছেলের কীসের দায় মা’র মানভঞ্জনের!
অচলাবস্থা কাটল তৃতীয় দিন। তবে অন্যভাবে। বাড়িতে মোবাইল পুরো বন্ধ রেখেছিল তিতান, গেমস খেলতেও খোলেনি দু’দিন। তৃতীয় সকালে সুইচ অন করতে না করতেই শ্রেয়া। ওত পেতে ছিল সম্ভবত, কখন তিতানের মোবাইল প্রাণ পায়!
কী রে, তুই কোথায়? পাচ্ছি না কেন তোকে?
তিতান কষটে গলায় বলল,— বাড়িতেই আছি।
শরীর খারাপ?
ওই রকমই। ..কেন?
আজ তো লাস্ট ডে, ক্লাস সাসপেন্ড হয়ে যাচ্ছে… আসবি না?
ভাবছি।
প্লিজ আয়। এরপর তো কতদিন দেখা হবে না।।
তিতান দুলে গেল। দু’-দুটো দিন স্বেচ্ছাবন্দি থেকে শরীর মন হেজে গেছে। বাড়ির এই গুমোট আর পোষাচ্ছে না। কমরেডরাও নিশ্চয়ই তার খোঁজ করছে। তার ওপর হের্ তুহিন মিত্র বোধহয় ফিরছেন আজ, এমন দরকচা মেরে পড়ে থাকলে তিনি আবার কী হল্লা জোড়েন!
কেঠো মুখে খাওয়া সেরে রওনা দিল তিতান। কলেজে ঢোকামাত্র ঝাঁক ঝাঁক প্রশ্ন, রাশি রাশি কৌতূহল…। ঠোঁটে একটা ইলাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে তিতান সামাল দিল কোনওক্রমে।
শ্রেয়া তাকে ধরল দেড়টা নাগাদ। থার্ড পিরিয়ডের পর। সবে তখন পরিবেশবিদ্যার ক্লাস সেরে তিতান ক্যান্টিনে যাচ্ছে।
ঝপ করে হাতটা ধরল শ্রেয়া। চোখ কুঁচকে বলল,— নাহ্, জ্বর তো নেই!
ভেতরটা এখন তেতো, তবু তিতান হাসল,— আমি কি বলেছি জ্বর হয়েছে?
তা হলে? কী হয়েছিল তোর?
এমনিই… গা ম্যাজম্যাজ করছিল। তা ছাড়া ভাবলাম তোদের কাছে একটু ভাও বাড়াই…
অজুহাতটা ঠিক যেন বিশ্বাস করল না শ্রেয়া, ভুরু কুঁচকেই আছে। এ-দিক ও-দিক দেখল একটু। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল,— তোর এখন ক্লাস আছে?
সেই সওয়া তিনটেয়। কম্পালসারি ইংলিশ।
ফুঃ, ওটা আবার একটা ক্লাস নাকি? পনেরো নাম্বার তো হল কালেকশনেই জুটে যায়। চোখে একটা মদির ভাব আনল শ্রেয়া,— চল না, কাটি।
কোথায় যাবি? পলকের জন্য মা’র সে দিনের শাসন মনে পড়ে গেল তিতানের। গম্ভীর মুখে বলল,— আজ আমার টিউটোরিয়াল আছে।
ক’টায়?
সাড়ে পাঁচটায়।
তার আগেই চলে আসবি। তিতানের হাতে অল্প চাপ দিল শ্রেয়া,— চল রাস্তা-ঘাটে কী ঘুরব, আমাদের বাড়ি যাই চল।
তিতান ঈষৎ কেঁপে গেল,— তোর মা তো… এখন অফিসে…?
তো? আড্ডা তো মারব আমরা দু’জন, মা থেকে কী করবে? শ্রেয়া বিচিত্র মুদ্রা ফোটাল চোখে,— তোর কি ভয় করছে?
তা একটু একটু করছে বই কী! শূন্য বাড়ি, শুধু তিতান আর শ্রেয়া…! কিন্তু কমরেড সায়র মিত্র মুখ ফুটে ভয়ের কথা উচ্চারণ করতে পারে কি? মুখে একটা উদাসীন ভাব ফুটিয়ে তিতান বলল,— তা কেন? যেতেই পারি।
শ্রেয়াদের বাড়ি সেলিমপুরে। ছোট্ট দোতলা বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকে শ্রেয়ারা। বাবা, মা, মেয়ে, তিন জনের কাছেই চাবি মজুত, কারও ঢোকা-বেরোনোর অসুবিধে নেই।
বাড়িতে এসেও শ্রেয়ার কোনও আড়ষ্টতা নেই। লঘুপায়ে নিজের ঘরে ব্যাগ রেখে এল। জিজ্ঞাসা করল,— খাবি কিছু? আমি কিন্তু কফি বানাতে পারি।
না থাক।
কোল্ড ড্রিঙ্কস? শ্রেয়া মুচকি হাসল,— হার্ড ড্রিঙ্কসও আছে। তবে দেওয়া যাবে না। বোতল সিলড।
ধুস্, আমি ওসব খাই না। তুই ঠান্ডাই আন।
শীতল পানীয়ের বড় একখানা বোতল বার করে আনল শ্রেয়া। দুটো গ্লাসও। সফেন তরল ঢালতে ঢালতে বলল,— তুই কোনওদিন হার্ড ড্রিঙ্কসে চুমুক মারিসনি?
মুহূর্তের জন্য ঝলসে উঠল বাবার মুখখানা। মদ খেয়ে চোখ লাল, মাকে দাবড়াচ্ছে। শুধু বাবাকে দেখে দেখেই যে সুরার প্রতি তিতানের অনীহা, এ কথা কি শ্রেয়াকে বলা যায়?
চোখে একটা বিতৃষ্ণা ফুটিয়ে তিতান বলল,— নেভার। আই হেট হার্ড ড্রিঙ্কস।
শ্রেয়ার হাত থেমে গেছে। তিতানের গালটা নেড়ে দিয়ে বলল,— ওরে আমার সুইটি সুইটি দিঘির জল রে…! তোকে আমায় কত কিছু যে শেখাতে হবে। এরপর হয়তো বলবি, কখনও কোনও মেয়েকে চুমুও খাসনি!
তিতান ঢোক গিলে বলল,— খাইনি, বিশ্বাস কর। …তুই?
কঅঅত। রোজ তো মিনিমাম দুটো করে খাই। বলেই তিতানের হতভম্ব মুখটার দিকে দু’সেকেন্ড তাকিয়ে রইল শ্রেয়া। তারপর সেই শরীর কাঁপানো হাসি। কোনওক্রমে দম নিয়ে বলল,— ওমনি জেলাস হয়ে পড়লি তো। একটা বাপি, একটা মা। খুশ?
তিতান স্বস্তির শ্বাস ফেলল। তবে কেন যে স্বস্তি, ঠিক বুঝতে পারল না। দুটো-চারটে চুমু যদি কাউকে খেয়েও থাকে, শ্রেয়ার ঠোঁট দুটো তো ক্ষয়ে যায়নি! তবু ওই জানাটাতেই যেন এক ধরনের সুবাতাস বয়ে গেল।
তিতান কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাস হাতে তুলেছে। চোখ ঘুরিয়ে চারদিকটা দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল,— সত্যি তোর বাপি বিড়ি খায়?
হ্যাঁ। কেন?
বাড়িটা দেখে বোঝাই যায় না। যা টিপটপ সাজানো।
সে তো মা’র কেরামতি। ঘরে কোথাও এক কণা ধুলো থাকলেও ঠিক হক-আইতে ধরা পড়বে।
আমার মা-টা এত গোছানো নয়। কেমন হ্যালহ্যাল ঝ্যালঝ্যাল। বরং দিদি অনেক বেশি নিট অ্যান্ড ক্লিন। নিজের ঘরটা এমন সুন্দর সাজিয়ে রাখে…
অ্যাই ছেলে, শুধু ফ্যামিলির গল্প করব নাকি? আমাদের কোনও গল্প নেই?
শ্রেয়ার চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করছে। ঠান্ডা পানীয়ে চুমুক দিয়েও তিতানের গলা শুকনো হঠাৎ। সে যে কমরেড সায়র মিত্র, তা যেন আর খেয়াল নেই। অস্ফুটে বলল— কী গল্প করব?
নরম সোফায় বসা শ্রেয়া ঝপ করে অনেকটা এগিয়ে এল। দু’হাতে তিতানের গলা বেড় দিয়ে বলল,— তুইই বল।
তিতানের বুক ধড়াস ধড়াস,— ক্ক্ক্কী বলব?
দরকার কী কথার? শ্রেয়ার ঠোঁট এগিয়ে এল। চেপে ধরেছে তিতানের ঠোঁটে। তুলতুলে এক জোড়া বুকের চাপ অনুভব করছিল তিতান। আপনাআপনি তিতানের হাত দুটো আঁকড়ে ধরল শ্রেয়াকে। খুলে গেছে ঠোঁট জোড়া…। কী পান করছে তিতান? অমৃত? তিতানের হাত আর স্থির থাকছে না, ঘুরছে আকুল আর্তি নিয়ে। পেলব স্তনে এসে থামল হাত…
আচমকাই মুখটা সরিয়ে নিল, শ্রেয়া। হিহি হেসে উঠেছে,— এই, যাহ্… আমার কাতুকুতু লাগছে।
চমকে শ্রেয়াকে ছেড়ে দিল তিতান। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কমরেড সায়র মিত্র, বি-কম, ফার্স্ট ইয়ার, এখন স্রেফ শ্রীমান ভ্যাবলাকান্ত।
শ্রেয়া দুলছে মৃদু মৃদু। সাপিনির মতো কি? নাকি বেতসলতা? ওই সামান্য দুলুনিতেই কেন ঘোর লাগে চোখে?
ফিসফিস করে শ্রেয়া বলল,— দেখবি?
তিতান ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল,— কী?
যা দেখতে চাইছিস। নেকু! হি হি হি হি।
এ খেলার কোনও শেষ নেই। আবার যেন আছেও। চরম কিছু ঘটার আগেই জ্বোরো রোগীর মতো কাঁপতে থাকা তিতানকে হটিয়ে দিল শ্রেয়া। অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢেকে ফেলল চটপট। তিতানের হাঁটু কাঁপছিল। সর্বাঙ্গ দিয়ে তাপ বেরোচ্ছে যেন। শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। তীব্র এক মাদক ছড়িয়ে গেছে রক্তে, উদ্ধত পৌরুষ কঠিন থেকে কঠিনতর। শ্রেয়ার দু’কাঁধ চেপে ধরল তিতান। হিসহিসিয়ে বলল,— কী হল, থামিয়ে দিলি কেন?
শ্রেয়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল,— না না, আজ নয়। আর একদিন।
কেন নয়? ক্ষণপূর্বের সংকুচিত তিতান বদলে গেছে সায়র মিত্রে। না শোনার অভ্যেস যে দ্রুত ঝেড়ে ফেলছে। গরগরে গলায় কমরেড সায়র মিত্র বলল,— আজই চাই।
শ্রেয়া ভেসে গেল কিনা সে তথ্য নিষ্প্রয়োজন। হয়তো বা তেমন অনিচ্ছাও ছিল না শ্রেয়ার। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধে নেই, কমরেড সায়র মিত্র হওয়ার পথে একটা বড় ধাপ এগিয়ে গেল তিতান।
.
০৯.
স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচ-সাতের রাস্তা। সরু খালের ওপর ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে খোলা মাঠে ছড়ানো-ছেটানো কিছু বাড়িঘর। কোথাও গুচ্ছ গুচ্ছ, কোথাও বা খানিক তফাতে তফাতে। তার মাঝে একখানা বড়সড় ঘেরা জায়গা। গেটে সাদাকালো সাইনবোর্ড—হ্যাপি হোম।।
গরম পড়েছে বটে এ বছর। শেষ বৈশাখের প্রখর তাপে পুড়ছে পৃথিবী। কালবৈশাখীও হয়নি বড় একটা, সূর্যের তেজ বেড়েই চলেছে দিনদিন। কবে যে এই দাবদাহ কমবে!
গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে তিয়া ছাতা বন্ধ করল। পাশেই প্লাস্টারহীন বড়সড় ঘর একখানা। হ্যাপি হোমের অফিসরুম। সামনে চন্দন রং মারুতি ভ্যান দাঁড়িয়ে। গাড়িতে হেলান দিয়ে বছর সতেরো-আঠেরোর একটি ছেলের সঙ্গে নিঃশব্দে বাক্যালাপ চালাচ্ছে ইন্দ্রজিৎ। সাংকেতিক ভাষায়।
তিয়াকে দেখে ইন্দ্রজিৎ হেসে এগিয়ে এল,— আপনি সত্যি আবার এলেন তা হলে?
দোপাট্টায় মুখ মুছতে মুছতে তিয়া বলল,— বা রে, কাল তো ফোনে বললাম, যদি আজ ফ্রি থাকি তো চলে আসব।
তবু… ঠিক বিশ্বাস হয়নি। আপনি শহুরে মহিলা, গরিবের ঘোড়ারোগ দেখতে গ্রামেগঞ্জে ছুটে আসবেন…
নরেন্দ্রপুর আবার গ্রাম কোথায়! জাস্ট সাবার্ব। যাদবপুর থেকে তো ট্রেনে দশ মিনিট। তিয়া মিষ্টি করে হাসল,— আপনি দেখি আজ চাষির বেশে…! হাঁটু অবদি জিন্স গুটিয়েছেন, খালি পা… কোদাল চালাচ্ছিলেন নাকি?
হা হা হা। ওই সবার সঙ্গে একটু হাতে হাতে মেলানো। ইন্দ্রজিতের মুখে নির্মল হাসি,— আমি পাশে থাকলে ছেলেরা একটু এক্সট্রা ইমপেটাস পায়। …আসুন, ভেতরে আসুন। ঘেমে নেয়ে গেছেন দেখছি!
বাহুল্যবর্জিত অফিসঘর। খান তিনেক চেয়ার, সাদামাটা টেবিল, একখানা স্টিল আলমারি আর রং-জ্বলা স্ট্যান্ড ফ্যান। একটা জনতা স্টোভ, টুকিটাকি কয়েকটা বাসন আর ওপাশের দেওয়াল ঘেঁষে ইন্দ্রজিতের ক্যাম্পখাট। ঘরে একটি জিনিসই শুধু বেমানান। কম্পিউটার। হ্যাপি হোমের হিসেবরক্ষক।
তিয়া চেয়ার টেনে বসেছে। ইন্দ্রজিৎও। বিনয়ের সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ বলল,— বলুন, আপনার কী সেবা করতে পারি?
ধ্যাত, সেবা নিতে এসেছি নাকি? তিয়া জোরে হেসে উঠল,— আগের দিন তাড়াহুড়োয় বেশিক্ষণ বসতে পারিনি। অথচ জায়গাটা এত ভাল লাগছিল। তাই ভাবলাম আজ একটু সময় নিয়ে…
আমার পরম সৌভাগ্য। …চা খাবেন তো?
কে বানাবে? নিশ্চয়ই আপনাকেই…
উপায় কী। ছেলেদের কাউকে বললে এক্ষুনি হাসিমুখে করে দেবে, কিন্তু আমি বলি না। নিজের কাজ নিজেরই তো করা উচিত। দলবলের সঙ্গে আমার দু’বেলার রান্নাটা হয়ে যায়, এই তো যথেষ্ট। বলেই উঠেছে ইন্দ্রজিৎ। স্টোভের দিকে যেতে যেতে বলল,— এই সাড়ে তিনটে-চারটের সময়ে আমারও জিভটা খুব চা চা করে! দেখুন না খেয়ে, মুখে তোলা যায় কিনা।
তিয়া চা খায় না বিশেষ। তবে এখন আপত্তি করল না। গরমে তেষ্টা পাচ্ছে খুব, যত্রতত্র জল খাওয়ার চেয়ে চা অনেক বেশি নিরাপদ। থুতনিতে হাত রেখে ইন্দ্রজিতের কার্যকলাপ দেখছিল তিয়া। উবু হয়ে পলতে তুলল স্টোভের, সসপ্যানে জল ঢালল, আগুনে বসিয়ে দিল পাত্রটা। আলমারি খুলে কাপডিশ নিয়ে গেল একজোড়া। কাপড়ে মুছছে।
তিয়ার ভারী অবাক লাগছিল। বিস্ময়টা জেগেছিল আগের দিনই, সেটা যেন বাড়ছে। মালহোত্রা অটোমোবাইলসে তার প্রাপ্য কমিশনটা দিয়ে আসার দিনই এই হ্যাপি হোম দেখানোর জন্য বেজায় পীড়াপীড়ি করছিল ইন্দ্রজিৎ। তার পরেও অন্তত বার পাঁচেক ফোন করেছে। শেষমেশ উপরোধেই ঢেঁকি গিলেছিল তিয়া। দিন দশেক আগে, তিয়ারই পছন্দ মতো সময়ে, গড়িয়াহাট মোড় থেকে তাকে তুলে ইন্দ্রজিৎ সোজা এখানে।
এসে কিন্তু তাক লেগে গেছে তিয়ার। বারো জন অনাথ বোবা-কালা ছেলে নিয়ে কী চমৎকার এক হোম বানিয়েছে ইন্দ্রজিৎ। আড়াই বিঘা জমির এক দিকে ছেলেদের থাকার বন্দোবস্ত, পাশে ছোট একটি কর্মশালা, বাকি প্রায় গোটা জমিতে সবজি চাষ হচ্ছে হরেক রকম। ছেলেরাই করছে। কর্মশালায় তাদের হাতের কাজও শেখাচ্ছে ইন্দ্রজিৎ। মোমবাতি তৈরি, গ্রিটিংস কার্ড বানানো, টুকটাক কাঠের কাজ…। লেখাপড়াতেও অবহেলা করেনি, ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব স্কুল থেকে নিজেই নাকি ট্রেনিং নিয়ে যথাসাধ্য পড়াশুনোও চালাচ্ছে ছেলেদের। এমন একটা জায়গা দেখে তিয়া আশ্চর্য না হয়ে পারে!
না, শুধু আশ্চর্য নয়, তার চেয়েও বুঝি বেশি কিছু। এক ধরনের মুগ্ধতা। ভাল লাগা। তার নিজের কাজ তো সারাক্ষণ এক যান্ত্রিক দুনিয়ায়, যেখানে সমানে ইঁদুরদৌড় আর চোয়ালে চোয়াল কষে লড়াই। টাকা আর প্রতিষ্ঠা, এ ছাড়া তো কিচ্ছু নেই সেখানে। গাড়ির শো-রুমে ছিল টারগেট, ডিসকাউন্ট, কমিশন, ইনসেনটিভ, প্রিমিয়াম, আর ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলিয়ে কিছু মানুষের অর্থের দম্ভ হজম করা…। এক একজন তো অবলীলায় কুপ্রস্তাব দিত, গাড়ি তো হবেই ম্যাডাম, চলুন আজ একটু ডিসকো ঘুরে আসি, অথবা কান্ট উই গো ফর আ শর্ট ড্রাইভ ম্যাম! কত কায়দা করে এড়াতে হত লোকগুলোকে। আরও খারাপ লাগে ভাবতে, যারা ওই ধরনের প্রস্তাব দেয়, তাদের বউটউরা যখন শো-রুমে এসে দাঁড়ায়, তখন তাদের চোখেও তিয়ারা সস্তা দামের মেয়েছেলে! এখনও কি পরিস্থিতিটা আমূল বদলেছে? এখন তো প্রায় স্বাধীন পেশা, সূর্যর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে তিয়া, তবু মাত্র ক’দিনেই কেমন যেন হাঁপ ধরে গেল। অনবরত ক্লায়েন্টের মন জুগিয়ে চলো, যাদের দিয়ে প্রোগ্রাম তুলতে হবে তাদের শতেক বায়নাক্কা সামলাও, কোথাও পান থেকে চুন খসলে চোখা চোখা গাল শোনো, পেমেন্টের জন্য হত্যে দিয়ে বেড়াও…! তুলনায় হ্যাপি হোম যেন এক ঝলক টাটকা বাতাস। কয়েকটা প্রতিবন্ধী ছেলে প্রাণের সুখে কাজ করছে, তাদের জীবনে দাঁড় করানোর জন্য একা লড়ে যাচ্ছে এক আদর্শবাদী মানুষ… নাহ্, এখানে না এলে তিয়া বোধহয় ভুলই করত। তার কেজো পৃথিবীর বাইরেও যে এক অন্য পৃথিবী আছে, তা তো তিয়ার জানাই হত না।
ইন্দ্রজিৎ চা এনেছে। টেবিলে কাপডিশ রেখে বলল,— নিন, আপনার অগ্নিপরীক্ষা।
আমার? না আপনার? তিয়া মিটিমিটি হাসছে,— যদি ভাল না লাগে, লাইফে আপনার হাতের চা খাব না।
অত আনাড়ি নই ম্যাডাম। তবে দুধটা নেই…
খেলে আমি লাল চা-ই খাই। ঠোঁটে কাপ ছোঁয়াল তিয়া। ছোট্ট চুমুক দিয়ে দু’-আঙুলে মুদ্রা ফুটিয়েছে,— নাহ্, পাশ করে গেলেন। অবশ্য আপনারই কাজ বাড়ল। ফের যদি আসি, আপনাকে স্টোভ জ্বালাতে হবে…
যদি কেন? আর আসবেন না?
ওরে বাবা, সময় কোথায়। নেহাত আজ সানডে, আমার পার্টনার আমায় দয়া করে ছাড়ান দিলেন…। বাক্য শেষ হওয়ার আগেই মোবাইলে গান। তিয়া মুখে ছদ্ম আতঙ্ক ফোটাল,— ও মাই গড, এ বোধহয় তারই কল!
নম্বরটা দেখে তিয়া অবশ্য নিশ্চিন্ত একটু। সূর্য নয়, লোপামুদ্রা।
কী রে, কী করছিস আজ?
একটু বেরিয়েছি রে।
রোববারও তোর কাজ? চাকরিটা ছেড়ে তা হলে কী লাভ হল?
না না, কাজ নয়। একটা ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব হোমে এসেছি রে। কী সুন্দর জায়গাটা, আহা!
অনেক দূর?
কাছেই। নরেন্দ্রপুরে।
ও। …চলে আয় না সিটি প্লাজায়। মৌমিতা, পুবালী আর লিপিও আসছে। মৌমিতা চাকরি পাওয়ার ট্রিট দিচ্ছে আজ। মুভি, ডিনার, সব আজ ওর।
বলিস কী রে? কিপটেটা রাজি হল? কলেজে তো পার্সই খুলত না।
অনেক কাণ্ড করে জপিয়েছি। প্রথমে মাল্টিপ্লেক্সে ‘চিনি কম’ দেখব। বুড়ো নাকি ফাটাফাটি অ্যাক্টিং করেছে। ফিল্মটা দেখে, চাইনিজ টাইনিজ খেয়ে…। আয় না, বহুকাল জমিয়ে আড্ডা হয় না।
তিয়া একটুক্ষণ ভাবল। এসেই এক্ষুনি এক্ষুনি উঠে যাওয়াটা কেমন দেখায় না? আজ এখানে খানিকক্ষণ কাটাবে বলেই তো…। বন্ধুরাও টানছে, কিন্তু..। ওদিকে সূর্যকেও তো টাইম দেওয়া… সাড়ে সাতটায়…। সূর্যকে অবশ্য সিটি প্লাজায় আসতে বলা যায়, লোপামুদ্রা মৌমিতারা তো সূর্যর অচেনা নয়…। তুত্, তাদের চার বান্ধবীর মাঝে সূর্য ‘হংসো মধ্যে বকো যথা বনে যাবে না? পুরনো কোনও প্রসঙ্গে তারা হিহি হাহা করবে, মিছিমিছি বোর হবে সূর্য, পরে কাঁইকাঁই…
গলা ঝেড়ে তিয়া বলল,— না রে, ব্যাড লাক। আজ আমার হবে না।
পারবি না? দারুণ মস্তি হত কিন্তু। মৌমিতা বোধহয় ওর দাঁড়কাকটাকে নিয়ে আসবে। ওকে আজ লেগপুল করে কাঁদিয়ে ছাড়ব।
মৌমিতার তমাল কলেজে পড়ায়। ফিজিক্স। চুলগুলো খাড়া খাড়া বলে বেচারার ওই নামই চালু এখন। খেপিয়ে মজা আছে তমালকে। নার্ভাস হয়ে তোতলাতে থাকে।
কী রে, চুপ কেন? চেষ্টা করে দ্যাখ না।
আমাকে আজ বাদ দে রে। মৌমিতাকে বলিস, আমারটা ডিউ রইল।
ও আর হাত উপুড় করেছে! তুই-ই মিস করলি।
কেয়া করে ভাই? নসিব।
মোবাইল অফ করে তিয়া দেখল ইন্দ্রজিৎ দরজায়, হাতে চায়ের কাপ। সহবত জ্ঞান আছে তো লোকটার, সামনে দাঁড়িয়ে কথা গিলছে না!
তিয়া চা শেষ করে উঠে এল,— চলুন, আপনার গার্ডেনটা দেখে আসি।
হা হা হা, খেতটাকে আপনি বাগানে প্রোমোশন দিলেন? হাসতে হাসতেই টেবিলে কাপ রেখে ফিরল ইন্দ্রজিৎ,— অবশ্য বাগান বললেও অত্যুক্তি হয় না। ঝিঙেফুল, লঙ্কাফুলেরও তো বাহার আছে। আর কুমড়োফুলের মতো নরম রং…
কুমড়োফুলের টেস্টও ভাল। ভাজা তো ফ্যান্টাসটিক।
অনেক ফুটেছে। দেব নাকি কয়েকটা?
এমা, ছি ছি। তিয়া তাড়াতাড়ি কথা ঘোরাল,— গাড়িটা সার্ভিস দিচ্ছে কেমন?
এক্সেলেন্ট। ভ্যানরিকশায় সবজি তুলে সেই সোনারপুর নিয়ে যাওয়া ভারী ঝকমারি কাজ ছিল। খরচাও বেশি পড়ত। ছেলেরা এখন ঝপাঝপ কুমড়ো লাউ ঝিঙে পটল শসা গাড়িতে ভরে দিচ্ছে, আমি ড্রাইভ করে পৌঁছে দিয়ে আসছি। তবে সব থেকে সুবিধে হয়েছে কলকাতা যাওয়ার। ছেলেদের তৈরি মালগুলোর মধ্যে অনেক ডেলিকেট জিনিস থাকে তো, ট্রেনে বেশ প্রবলেম হত। এখন তো গড়িয়াহাটের দোকানে পৌঁছে দেওয়া জলবৎ তরলং।… তার থেকেও বড় সুবিধে কী হয়েছে জানেন… আপনাকে তো আগের দিন বলিইনি…। ইন্দ্রজিৎ গাল ছড়িয়ে হাসল,— আমার ছেলেদের নিয়ে এবার এদিক ওদিক বেড়াতে যাওয়া যাচ্ছে।
তিয়া এক পা, এক পা করে হাঁটছিল, থেমে গেল। চোখ ঘুরিয়ে বলল,— কী কাণ্ড, বারো জনকে একসঙ্গে গাড়িতে তুলছেন কী করে?
হা হা হা। হয় নাকি তা? আমার রথের স্প্রিং বসে যাবে না? তিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে তেজিয়ান আকাশটাকে ঝলক দেখল ইন্দ্রজিৎ। দৃষ্টি নামিয়ে বলল,— আমি ওদের দুটো ব্যাচ করে দিয়েছি। সিক্স প্লাস সিক্স। এ সপ্তাহে এরা, তো পরের উইকে ওরা। পিছনে দুটো টুল বসিয়ে দিই, দিব্যি আরামসে চলে যায়। গত হপ্তায় তো ক্যানিং ঘুরিয়ে আনলাম।
ইন্দ্রজিৎকে যত দেখছে, চমৎকৃত হচ্ছে তিয়া। পটল খেতের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেই ফেলল,— আপনি কিন্তু সত্যিই খুব মহৎ কাজ করছেন।
দুত, ওভাবে ভাবছেন কেন? ছেলেগুলো খাটছে, চাষবাস করছে, হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট বানাচ্ছে… আমি শুধু দেখছি ওরা যেন পরিশ্রমের বিনিময়ে কিছু পয়সাটয়সা পায়। অনাথ ছেলেগুলোকে একটু স্বনির্ভর করে দেওয়া আর কী।
তা আপনার চলে কী করে?
ওই যে আগের দিন বললাম, আমি হচ্ছি ওদের মধ্যে তেরো। আনলাকি থার্টিন।
আনলাকি বলছেন কেন?
কয়েক সেকেন্ড থেমে রইল ইন্দ্রজিৎ। মাচায় তোলা কুমড়োলতায় হাত বোলাল একটু। তারপর গলা নামিয়ে বলল,— এই হ্যাপি হোম করার কারণটা তা হলে আপনাকে বলি। আমার ছোট ভাই… একমাত্র ভাই… হি ওয়াজ ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব। বড় প্রিয় ছিল আমার। দেশবন্ধু পার্কে হঠাৎ জলে ডুবে মারা যায়। ওটাই আমায় খুব হন্ট করে। ইনফ্যাক্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়েই আমি ঠিক করেছিলাম, ডেফ অ্যান্ড ডাম্বদের জন্য একটা হোম খুলব।
আপনি তো যাদবপুরে পড়তেন, না?
হ্যাঁ। মেকানিকাল। ইন্দ্রজিৎ ঘাড় চুলকোচ্ছে।
পাশ করে নিশ্চয়ই চাকরিতেও ঢুকেছিলেন?
করেছি দু’-তিনটে কোম্পানিতে। মন বসত না। শুধু বুকে বাজত, মিশনটা ফুলফিল হচ্ছে না… মিশনটা ফুলফিল হচ্ছে না…! তখনই হঠাৎ এদিকে এসে একদিন জমিটা পছন্দ হয়ে গেল, ঝপ করে কিনেও ফেললাম…। তারপর ঘুরে ঘুরে এইসব ছেলেদের জোগাড় করা…
ব্যস, হোম বানিয়ে চাকরিটাও ছেড়ে দিলেন। তাই তো?
দু’নৌকোয় পা রেখে কী করে চলব, বলুন?
আপনার বাবা মা নিশ্চয়ই আপনাকে খুব এনকারেজ করেছিলেন?
তখন তারা আর নেই।
সে কী?
হুম, একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট…। বছর দশেক আগে। আমি তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছি।
ও। তিয়ার গলায় কিছুক্ষণ স্বর ফুটল না। তারপর আড়চোখে ইন্দ্রজিৎকে দেখে নিয়ে বলল,— এই মিশনের জন্যই বুঝি বিয়েটিয়েও হয়ে ওঠেনি।
নাহ্, সে ভুলটা করেছিলাম। তবে ওই যে, কপাল মন্দ, টিকল না।
পরের প্রশ্নটা অশোভন জেনেও তিয়া জিজ্ঞেস করে ফেলল,— কেন?
তার মনে হত আমার মাথার ঠিক নেই! যত সব আজেবাজে চিন্তা মগজে ঘুরছে! ইন্দ্রজিৎ বড় একটা শ্বাস ফেলল,— আসলে শি হ্যাড আদার প্রবলেম। একটা পুরনো অ্যাফেয়ার ছিল… যাক গে যাক, বাদ দিন। এক দিক দিয়ে তো আমি ভালই আছি, বলুন? মুক্ত বিহঙ্গ।
তিয়া মনে মনে বলল, ডানায় চোট খাওয়া। মুখে বলল,— ডিভোর্স হয়ে গেছে?
বছর চারেক আগে। এই হোম তৈরির পর পরই। ইন্দ্রজিৎ হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠেছে, একটু যেন জোর করে,— এসব জেনে আর কী লাভ? চলুন চলুন, আমাদের ঝিঙেগাছ দেখবেন চলুন। সন্ধে হলে যা সুন্দর ফুল ফোটে না…
তিয়ার বুকটা ঈষৎ চিনচিন করে উঠল। আহা রে কত দুঃখ চেপে কাজে ডুবে আছে লোকটা। শ্রদ্ধা হয়, মায়াও জাগে।
তিয়া আর কথা বলছিল না। ইন্দ্রজিৎ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে সবজি খেত। বলছে, জলের অভাবে এবার ফলন কতটা মার খেল, ডিপ টিউবওয়েল বসানোর তার সাধ্য নেই, একটা কুয়ো খোঁড়ার চিন্তা ঘুরছে মাথায়, পাম্প বসিয়ে কুয়োর জলেই যদি সেচের কাজটা হয়ে যায়…। ছেলেদের ডেরাতেও নিয়ে গেল তিয়াকে। অনাড়ম্বর ছিমছাম আয়োজন। টালির শেড, সিমেন্টের মেঝে, সার সার শয্যা…। অনেকটা ডরমিটরি যেন। ষোলো সতেরো থেকে বছর কুড়ির ছেলেগুলো বেশ আছে নিজেদের মতো। বইপত্র উলটোচ্ছে, কিংবা খবরের কাগজ, গল্পআড্ডাও চালাচ্ছে সাংকেতিক ভাষায়। তিয়াকে তারা ইশারায় নাম বলে গেল একে একে। ইন্দ্রজিৎই ব্যাখ্যা করল সংকেতের। কেউ কমল, কেউ নয়ন, কেউ বা গণেশ…
বিকেল পড়ে আসছিল। পায়ে পায়ে ফের অফিসঘরে এল তিয়ারা। ইন্দ্রজিৎ বলল,— খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লেন তো?
গরমে ঘুরে সত্যিই শ্রান্তি আসছিল তিয়ার। বলল,— একটু একটু।
তা হলে বসে জিরিয়ে নিন। ফ্যানের মুখ তিয়ার দিকে ঘুরিয়ে দিল ইন্দ্রজিৎ,— জল খাবেন?
থাক।
ইন্দ্রজিৎ চেয়ার টেনে বসল সামনে। বলল,— একটা ব্যাপার ভাবছি, বুঝলেন। ছেলেগুলোর ইন্ডোর রিক্রিয়েশনের জন্য এবার একটা টিভি আনব।
ভাল আইডিয়া। শুনতে না পাক, দেখাটাও তো আনন্দের। তিয়া চেয়ারে হেলান দিল,— আচ্ছা, একটা কথা বলি… এই যে আপনি হোমটা চালাচ্ছেন, তার তো অনেক খরচখরচা আছে?
তা তো আছেই।
পাচ্ছেন কোথ্থেকে? নিশ্চয়ই সবজি আর হ্যান্ডিক্র্যাফট বেচে সব দিক মিট-আপ করা যায় না?
ইন্দ্রজিতের মুখে এবার মিটিমিটি হাসি,— খানিকটা হয়। বাকিটার জন্য হাত পাতি।
ও। তার মানে আপনার ডোনার আছে?
ফিক্সড আছে দু’-চারজন। আই মিন, দু’-চারটে কোম্পানি। আফটার অল, হ্যাপি হোম একটা এন জি ও তো, তার কাজকর্ম দেখিয়ে অ্যাপিল জানাই। কেউ দেয়, কেউ দেয় না, তবে কুড়িয়ে বাড়িয়ে চলে যায়। খুব শর্টফল হলে মেম্বাররাও দেয় কিছু কিছু।
তিয়া সামান্য চিন্তা করল। আগের দিনই বাড়ি গিয়ে স্থির করেছিল কমিশনের দু’হাজার টাকাটা সে ফেরত দেবে ইন্দ্রজিৎকে। সত্যি বলতে কী, আজ আসার সেটাও একটা কারণ বটে। এমন একটা প্রতিষ্ঠানে গাড়ি বেচার কমিশন তিয়া অন্তত নিতে পারবে না। কিন্তু মাত্র দু’হাজারই দেবে? আর একটু বেশি কি দেওয়া উচিত নয়? ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স অবশ্য ঝপ করে নেমে গেছে, বাবাকে পঁচিশ হাজার দিয়ে দিল কিনা। বাবা অবশ্য ঘোরতর আপত্তি জুড়েছিল। শেষে তিয়া যখন বোঝাল, লাগলে আবার নেবে সে, তখন খানিক ঠান্ডা হল যেন। যাক গে, সূর্যর কাছ থেকে পেমেন্ট পেলে না হয় হ্যাপি হোমে আরও কিছু…
ইন্দ্রজিৎ দেখছিল তিয়াকে। জিজ্ঞেস করল,— কী ভাবছেন?
তিয়া ব্যাগ খুলে সাদা খামখানা বাড়িয়ে দিল,— এটা রাখুন।
কী আছে এতে?
কমিশনটা।
ওমা, কেন? ওটা তো আপনার প্রাপ্য।
আমি তো শাইলক নই।… রাখুন তো।
তিয়ার দিকে স্থির তাকিয়ে আছে ইন্দ্রজিৎ। দৃষ্টিটা রীতিমতো অস্বস্তিকর। ঠোঁটে একটা অসহজ হাসি টেনে তিয়া বলল,— আসলে কী হয়েছে জানেন তো, আপনাদের কাজকর্ম দেখে আমি খুব মুভড্। আমি কি এই এন জি ও-র মেম্বার হতে পারি না?
অবশ্যই পারেন। ইন্দ্রজিৎ চোখ সরায়নি তিয়ার চোখ থেকে। হাসিমাখা মুখে বলল,— আমি কিন্তু আপনাকে তার চেয়েও একটু বেশি কাছে পাব বলে ভেবেছিলাম।
তিয়ার ভুরু কুঁচকে গেল। এ আবার কী ধরনের কথা? মোটেই সে ইন্দ্রজিতের টানে আসেনি এখানে, এসেছে হ্যাপি হোমে!
তিয়ার চলকে ওঠা বিরাগটা বুঝি পড়ে ফেলেছে ইন্দ্রজিৎ। তাড়াতাড়ি বলে উঠল,— মেম্বাররা তো শুধু তাদের নাম আর যৎসামান্য সাহায্য দিয়েই খালাস। আমি চাইছিলাম আপনার সক্রিয় সহযোগিতা।
কীরকম? তিয়ার ভুরুর ভাঁজ মোছেনি পুরোপুরি।
যদি অভয় দ্যান, তো মনোবাসনাটা জানাই।… আপনাকে প্রথম দিন দেখেই খুব ভাল লেগেছিল। কী সুন্দর কথা বলেন, চমৎকার কনভিন্সিং পাওয়ার আছে আপনার… সে-দিন থেকেই কেন যেন মন বলছে, আপনাকে যদি এই প্রতিষ্ঠানের কাজে টেনে আনতে পারি…। বুঝছেন তো, এই ক’টা ছেলেতে থেমে থাকা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি চাই হ্যাপি হোম অনেক বড় হোক, আরও অনেক বেশি ছেলে হোমের ছায়ায় থেকে আত্মনির্ভর হয়ে উঠুক।… কিন্তু তার জন্য তো টাকা চাই ম্যাডাম। প্রচুর টাকা।
তিয়া স্বচ্ছন্দ ফের। ঠোঁট টিপে বলল,— তা আমি কী করব? আমার তো লাখ লাখ টাকা নেই!
আপনার পোটেনশিয়াল আছে। আমি লোককে সেভাবে ইমপ্রেস করতে পারি না, যেটা আপনি পারেন। যদি হোমের জন্য অল্প সময় দ্যান… দু’-চারটে বড় কোম্পানিতে ডোনেশনের জন্য অ্যাপ্রোচ করেন… প্রয়োজনে আমিও সঙ্গে থাকব…।
ওরে বাবা, এখন যা কাজের চাপ! তিয়া হাসার চেষ্টা করল,— আগের দিন তো শুনলেন, একটা জয়েন্ট ভেঞ্চারে নেমেছি…
আহা, কাজের ফাঁকে ফাঁকেই নয় করবেন। আমার… আই মিন আমাদের পাশে যদি একটু দাঁড়ান, অসহায় ছেলেগুলোর ভারী উপকার হয়।
এরপর কি মুখের ওপর না বলা যায়? তবু তিয়া সরাসরি সম্মতি জানাতে পারল না। কথা দেওয়া মানেই তো আটকে পড়া, নয় কি? অস্পষ্টভাবে বলল,— ঠিক আছে, ভেবে দেখব।
আমি কিন্তু ছিনেজোঁকের মতো লেগে থাকব। নুন ছিটিয়েও তাড়াতে পারবেন না।
নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা হাসছে ইন্দ্রজিৎ। তিয়াও উঠে পড়ল হাসিমুখে। বলল,— আজ তা হলে চলি?
চলি বলতে নেই। বলুন, আসি। আমি কিন্তু আপনার অপেক্ষায় থাকব।
বারংবার আপত্তি সত্ত্বেও তিয়াকে স্টেশন অবধি এগিয়ে দিল ইন্দ্রজিৎ। কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাতে জানাতে। দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না তিয়ার ট্রেন আসে।
ছুটির দিন। কামরা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। জানলায় বসে হ্যাপি হোমের কথাই ভাবছিল তিয়া। দুম করে তাই আবার আসা, প্রতিষ্ঠানটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে… বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না তো? অচেনা লোকটা তাকেই কেন পাকড়াও করল? সত্যিই কি তাকে যোগ্য মনে হয়েছে? কাজের সূত্রে বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা তিয়ার আছে বটে, এখন তো আরও বাড়ছে। কিন্তু তাদের কাছে হ্যাপি হোমের হয়ে বলা কি সম্ভব? নিজেদের ধান্দা ছেড়ে? যাক গে যাক, তিয়া তো প্রতিশ্রুতি দেয়নি কোনও। পারলে করবে, না পারলে করবে না, বেশি ভাবাভাবির কী দরকার!
বালিগঞ্জে নামল তিয়া। ব্যক্তিগত কেনাকাটা ছিল কিছু, সারল গড়িয়াহাটে ঘুরে ঘুরে। ব্রা, প্যান্টি, একটা স্লিপ, গোটা দুয়েক নাইটি, চুলের ক্রাঞ্চি, ক্লিপ, পছন্দসই নেলপালিশ, লিপস্টিক। ভাল একখানা সানস্ক্রিন লোশন কিনতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, গার্গীদি গুচ্ছের ক্রিম লোশন গছিয়ে গেছে বাড়িতে। মাকে নাকি এজেন্ট বানানোর চেষ্টা করছে! মা বনবে এজেন্ট, হাহ্! বেছে বেছে গোটা তিনেক সিডি-ও কিনল তিয়া। বাজার মাত করা সাম্প্রতিক সংগীতের অ্যালবাম। দোকানটায় দাঁড়িয়ে গানও শুনল খানিকক্ষণ। সময় কাটাতে হবে তো!
সূর্য এল নিখুঁত সময়ে। তার মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে এবার সোজা এক শপিংমলের ফুডকোর্ট। মেলানো মেশানো রংদার আইসক্রিম খাচ্ছে দু’জনে।
সূর্য জিজ্ঞেস করল,— কেমন হল তোমার নরেন্দ্রপুর ট্রিপ?
দারুণ। গড়গড় করে গোটা বিকেলটা উগরে দিল তিয়া। তারিফের সুরে বলল,— লোকটার কিন্তু এলেম আছে। একা হাতে একটা হোম তৈরি করা কি মুখের কথা!
সূর্য হালকা চালে বলল,— একা কেন হবে? এন জি ও-র একটা বডি থাকে। ডেফিনিটলি তারাও কিছু ডিউটি পারফর্ম করে।
আমার তো তা মনে হল না। আগের দিনও আর কারওকে দেখিনি, আজও নয়। একা একাই তো করছে সব।
উম্। সূর্য বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল,— এই ধরনের লোকরা দুটো টাইপ হয়, বুঝলে। হয় ছিটগ্রস্ত, নয়তো দু’নম্বরি।
ছিট তো আছেই। নইলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, ভাল চাকরি পেয়েও, সব ছেড়েছুড়ে নিজের আইডিয়াল নিয়ে মেতে থাকে!
স্রেফ আদর্শ? নিজেরও কি টু পাইস থাকে না?
কোথথেকে থাকবে?
আছে, আছে, অনেক রকম কায়দা আছে। তুমি বুঝবে না। ফরেন গ্রান্ট আসে কিনা জিজ্ঞেস করেছ?
না তো।
পরের দিন পতা কোরো। ইকুয়েশনটা বোঝা যাবে। সূর্যর চোখ সরু,— মালটার বয়স যেন কত বলেছিলে?
দেখে যতটা ইয়াং লাগে, ততটা বোধহয় নয়। তিরিশ-একত্রিশের বেশিই হবে। মিনিমাম পঁয়ত্রিশ। ডিভোর্সই তো হয়েছে বছর চারেক।
হুম্। খুব সাবধান।
কেন?
মনে হয় তোমার দিকে ঢলেছে। এই বয়সের বউ পালানো লোক… খুব ডেঞ্জারাস।
ভাবনাটা যে তিয়ার মনেও উঁকি দেয়নি, তা নয়। তবে ইন্দ্রজিৎকে বিপজ্জনক লোক ভাবতে সে রাজি নয়। আবার এই নিয়ে এমন এক মনোরম সন্ধ্যায় তর্কাতর্কিতেও তার স্পৃহা নেই। মুখভঙ্গি করে বলল,— লোকটার কথা থাক। কাল আমাদের কাজের ডিস্ট্রিবিউশন কীভাবে হচ্ছে।
ফার্স্ট আওয়ারে আমি প্রেসে যাচ্ছি। বুকলেটের লে-আউট ঠিকঠাক করল কিনা দেখে আসা দরকার। সেখান থেকে যাব ইভিটা ম্যাগাজিনের অফিসে। অ্যাডভান্সের সেকেন্ড ইনস্টলমেন্ট কালেক্ট করতে হবে। তারপর অফিসে আসছি। ততক্ষণে তুমিও তোমার কাজ সারতে থাকো। লিস্ট দেখে দেখে সেলিব্রিটিদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলো করে ফ্যালো। যদি দ্যাখে কেউ রিকোয়ার্ড ডেটে অ্যাভেলেবল হচ্ছে না, পরের লিস্ট ধরবে। তেমন বুঝলে ইভিটা-র এডিটরকে ফোন করে আরও কয়েকটা নাম চেয়ে নেবে। মনে রেখো, ওদের সেমিনারটা সাকসেসফুলি উতরে দিতে পারলে কেল্লা ফতে। পুজোর সময়ের কাজটার জন্য প্রেস করতে পারব। ডি-ডের কেটারিংয়ের ব্যাপারটা আমি…
আর মিস্টার তানেজাদের অর্ডারটার কী হল?
ওটা কিন্তু তোমায় যেতে হবে। কাঠ কাঠ থেকো না, বি মাখন, মাখন…। তোমার সুইটি সুইটি স্মাইলটাকে ইউটিলাইজ করো ডার্লিং। লাস্ট ইয়ারে ওদের সেমিনারটার অর্ডার পেয়েছিল রেনেসাঁ। এবার ব্যাটারা যেন ও-মুখো ঘেঁষতে না পারে।
রেনেসাঁ কত কোট করেছিল, তা কিন্তু এখনও জানতে পারোনি।
সেটা জানাও তোমারই কাজ ম্যাডাম। তানেজাকে টিপলেই বেরিয়ে আসবে।
দেখি চেষ্টা করে। ওই কাজে কিন্তু আমাদের ভাল ইনভেস্টমেন্টও আছে। ডিগনিটরিজদের আনা, হোটেল বুকিং…
আস্তে আস্তে পেশাদারি আলোচনায় ঢুকে পড়ছিল তিয়া। বলছে, শুনছে, বলছে…। কথোপকথনের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে উঠছিল নরেন্দ্রপুরের ঘেরা জায়গাটা। ইন্দ্রজিৎ, বোবা-কালা ছেলেগুলো, সবুজ খেত…। হারিয়েও যাচ্ছিল।