কবিতা আসছে না একেবারেই। বাংলার বদলে কবি এখন বেশি লিখছেন ইংরেজি। কখনও নিজের রচনার অনুবাদ, আর বিদেশি বন্ধু ও পৃষ্ঠপোষকদের চিঠিপত্র। গীতাঞ্জলি পুরস্কার পাবার পর তাঁর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজিতে। ভালই বিক্রি হয়, তার রয়ালটির টাকায় কিছুটা নির্বাহ হয় শান্তিনিকেতনের ক্রমবর্ধমান ব্যয়। আরও ইংরেজি গ্রন্থের চাহিদা আছে।
বিদেশযাত্রা আপাতত স্থগিত। বিশ্বযুদ্ধের এখন ঘোর অবস্থা। রাশিয়া ও রুমানিয়া এর মধ্যে সন্ধি করেছে জার্মানির সঙ্গে। পূর্ব রণাঙ্গন থেকে সৈন্য সরিয়ে এনে জার্মানরা এখন সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়েছে ফ্রান্সের দিকে। প্যারিস নগরীর পতন বুঝি আসন্ন।
কবি বেশি সময় কাটাচ্ছেন শান্তিনিকেতনে। ছাত্রদের ক্লাস নিচ্ছেন নিয়মিত। সেসব ক্লাসে দশ-বারো বছরের ছাত্ররাও যেমন থাকে, তেমনই যোগ দেন অধ্যাপকেরা, হঠাৎ হঠাৎ এসে পড়েন অ্যান্ড্রুজ, আবার সীতা, শান্তার মতো তরুণীরাও বসে পড়ে এক ধারে।
ফণিভূষণ অধিকারীকে সপরিবারে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে মহর্ষি ভবনে। তাঁর চিকিৎসার ত্রুটি নেই, যদিও উন্নতি হচ্ছে না বিশেষ। কবি প্রতিদিন তাঁকে দেখতে যান।
রাণু বনবালার মতো সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। কখনও সে সকলের উপাসনাগৃহে উঁকি মারে, কখনও ক্লাস নেবার সময় একপাশে দাঁড়ায়, আবার এক একসময় সে আম্রকুঞ্জের কোনও গাছে চড়ে বসে।
এখানে একটি পোষা হরিণ আছে, সেটি তার খেলার সঙ্গী। তাকে সে ঘাস খাওয়ায়, ছোলা খাওয়ায়। হঠাৎ হরিণটি খোয়াইয়ের দিকে ছুটতে শুরু করলে রাণুও তার সঙ্গে ছোটে। রাণুর আগেই অবশ্য হরিণটা ফিরে আসে নিজের জায়গায়।
দূর থেকে তাই দেখে কবি হাসেন। একদিন বললেন, ভাবছি এবার থেকে তোমাকে শকুন্তলা বলে ডাকব।
রাণুর তাতে ঘোর আপত্তি। অন্য কোনও নামের চেয়ে রাণু নামটাই তার বেশি পছন্দ। সে বরং শকুন্তলার গল্পটা শুনতে চায়।
কবি অন্য কাজ সরিয়ে রেখে গল্প বলতে শুরু করেন।
কিশোরী শকুন্তলার রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে যেন কবির সামনের এই মেয়েটির চেহারার সঙ্গেই মিলে যায়। রাণু কিন্তু তা বুঝতে পারে না।
সে এখনও সচেতন হয়নি নিজের সম্পর্কে। তাই তো গরম লাগলেই সে জামা খুলে ফেলে। এখানে অবশ্য তার মা তাকে প্রায় সব সময় চোখে চোখে রেখেছেন, নিজে রাণুকে শাড়ি পরিয়ে বাইরে পাঠান।
ছোটাছুটি করতে গিয়ে রাণুর শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটোয়। কখনও শাড়িতে পা জড়িয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে মাটিতে। আবার সামলে নেয়।
গল্পের মাঝখানে রাণু জিজ্ঞেস করল, শকুন্তলা কি শাড়ি পরত?
কবি স্মিতহাসে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আশ্রমের ঋষিরা পরতেন বঙ্কুলের পোশাক, সেকালে ধুতি-শাড়ির চলনই ছিল না। ছবিতে অবশ্য অন্যরকম আঁকে।
তিনি বললেন, গাছের পাতা সেলাই করে কী সুন্দর পোশাক বানানো হত তখন। শাড়ির চেয়েও অনেক ভালো।
গাছের পাতার পোশাক কেমন হবে, কল্পনা করার চেষ্টা করল রাণু।
শকুন্তলার গল্পটা অবশ্য শেষ হল না, মাঝখানে অন্য লোক আসায় ছেদ পড়ে গেল।
অন্য তোক দেখলে রাণুও আর এখানে থাকতে চায় না।
দুপুরবেলা কবি যখন লিখতে বসেন, তখন কেউ তাঁর ঘরে আসে। আশ্রমের সবাই এটা জানে। কিন্তু রাণুকে কে আটকাবে? দমকা বাতাস কিংবা আকাশের অশনিকে কেউ বাধা দিতে পারে।
বহু প্রত্যাশিত বর্ষা সবে এসে পড়েছে। আর ক’দিন পরেই পয়লা আষাঢ়ের উৎসব হবে, আজও বৃষ্টি পড়ছে ঝেপে ঝেপে। কবি ইংরিজি চিঠি লিখছেন এক বিদেশিনীকে।
হঠাৎ একটুকরো ঝড়ের মতো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল রাণু।
বৃষ্টিতে তার মাথার চুল ভেজা, তার মুখখানিও কমল-কোরকের মতো জলে ধোওয়া। একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পরেছে সে, আঁচলটা গাছ-কোমর করে বাঁধা।
চক্ষুদুটি বিস্ফারিত করে বলল, জানেন, জানেন, হরিণটাকে কাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
কবি সে সংবাদ আগেই জেনেছিলেন। লেখা থেকে সহজে মন ফেরানো যায় না। তিনি অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, হুঁ।
রাণু কাছে এসে তাঁর হাত থেকে কলম কেড়ে নিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এত বড় একটা কাণ্ড ঘটে গেল, আর আপনি এখনও লিখচেন? কী এত লেখেন সারাদিন? মোটেই এত লিখতে হবে না। কাল থেকে সবাই মিলে কত খোঁজাখুজি করছে, আমিও খুঁজতে গিয়েছিলাম—
কবি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় খুঁজতে গিয়েছিলে?
রাণু বলল, অনেক দূরে, খোয়াইয়ের ও পাশে যে জঙ্গল আছে,…তারপর লালবাঁধে।
কবি এবার লেখার সরঞ্জাম সরিয়ে রেখে বললেন, বনের হরিণ, ও যে একদিন চলেই যাবে তা জানতুম। এবারের বসন্তে, যখন শালগাছগুলো মঞ্জরীতে ভরে গেল, বাতাস ভরে গেল সুগন্ধে, তখনই ওকে উন্মনা দেখেছি। আমার হাত থেকে আর খাবার নিতে চাইত না। তখনই বুঝেছি, অরণ্য ওকে টানছে, মানুষের কাছে আর থাকতে চায় না। তুমি যে ফিরে এসেছ, জঙ্গলে হারিয়ে যাওনি, তাই-ই যথেষ্ট।
রাণু বলল, আমি কেন হারিয়ে যাব? আমার জঙ্গল ভাল লাগে না, আমার কাশী ভাল লাগে।
কবি জিজ্ঞেস করলেন, শান্তিনিকেতন ভাল লাগছে না?
রাণু বলল, হ্যাঁ, ভাল লাগছে। আপনি আছেন বলেই বেশি ভাল লাগছে। আচ্ছা, হরিণটাকে আর পাওয়াই যাবে না? আমার কষ্ট হচ্ছে।
কবি সুর করে বললেন, সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে/কে তারে বাঁধল অকারণে…
রাণু ভুরু দুটি তুলে বলল, ওটা কী, গান? এই মাত্র বানালেন?
কবি বললেন, না। কাল রাতেই মনে এসেছিল। বনের হরিণকে ঘরের পাশে বেঁধে না রেখে মনের মধ্যে রেখে দেওয়াই তো ভাল।
রাণু বলল, বাকিটা শুনি শুনি–
কবি আবার সুর ধরলেন,…সে কোন বনের হরিণ ছিল আমার মনে/কে তারে বাঁধল অকারণে।।/গতিরাগের সে ছিল গান, আলো ছায়ার সে ছিল প্রাণ/আকাশকে সে চমকে দিত…
হঠাৎ গান থামিয়ে কবি বললেন, এবারে অন্য দুটি প্রাণী পুষব ঠিক করেছি। বলো তো, কোন প্রাণীর শরীরের চেয়ে তার ল্যাজটা বেশি লম্বা?
রাণু কয়েক মুহূর্ত মাত্র চিন্তা করে বলল, জানি। হনুমান!
কবি সহাস্যে বললেন, ছি ছি, আমি হনুমান পুষব? তুমি ভাবলে, আমার সঙ্গে মিল আছে? আমার লাঙ্গুলটি প্রকাশ্য নয় বটে, কিন্তু আমিও মাঝে মাঝে এক লম্ফে সমুদ্র পাড়ি দিই!
রাণু কোপের ভঙ্গি করে বলল, মোটেই আমি সে কথা ভেবে বলিনি। আপনি জানেন না, আপনি কত সুন্দর? আপনি সকলের চেয়ে সুন্দর।
কবি বললেন, শুনে আশ্বস্ত হলেম। আমি মনে করেছিলাম, আমি ছ’ফুট লম্বা মানুষ, এত বড় গোঁফ দাড়িওয়ালা কিম্ভুত কিমাকার লোক, প্রথম দেখে তুমি হয়তো নারদমুনির মতন মনে করে ভয় পাবে, তোমার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে যাবে। তা যে হল না সেদিন, তুমি যখন এসে আমার হাত ধরলে, তখন তোমার হাত একটুও কাঁপল না, এ কী কাও বলো দেখি!
রাণু কবির গা ঘেঁষে এসে বলল, মনে মনে যেমন ভেবে রেখেছিলাম, আপনি তার চেয়েও বেশি সুন্দর। এবারে কী পুষবেন বলুন না?
কবি বললেন, ময়ূর। রথীকে এক জোড়া ময়ুর আনতে বলেছি। এক জোড়া না হলে ওদের মানায় না!
রাণু তার বেদানা রঙের ওষ্ঠ উলটে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ওঃ ময়ুর! আমাদের কাশীতে কত ময়ূর আছে, পুষতে হয় না। এবারে রেলে চড়ে আসবার সময় দু পাশের মাঠে অনেক ময়ূর দেখেছি!
কবি বললেন, তা ঠিক। কিন্তু এখানে তো ময়ুরেরা নিজে নিজে আসে না। এই বর্ষায় ময়ূরের পেখম মেলা নৃত্য দেখবার জন্য পুষতেই হবে অগত্যা। হ্যাঁ, ভাল কথা, আর সবাই আমাকে প্রণাম করে, তুমি করো না কেন?
রাণু বলল, আর সবাই আপনাকে গুরুদেব বলে। আমি তো বলি। কেমন যেন দূর দূর মনে হয়।
কবি বললেন, ও তাই! আমি মনে করেছিলুম, তোমারও বুঝি জাতের গুমোর আছে। তোমার বাবা প্রথম যখন এখানে আসেন, আমাকে প্রণাম করতে চাননি। শুনেছিলুম, তোমরা তো উঁচু জাতের বামুন, আর আমরা পিরিলির বামুন, পতিত, তাই আমার পায়ে তোমাদের হাত ছোঁয়াতে নেই।
রাণু বলল, মোটেই না। আমার বাবা, মা সবাই আপনাকে প্রণাম করে দেখেছি।
কবি বললেন, এখন করেন। তবু তুমি করো না কেন?
রাণু বলল, অত ভক্তি-শ্রদ্ধা আমার আসে না। আমি যে আপনাকে ভালবাসি!
কবি রাণুর নবনীত কোমল একটি হাত ধরে বললেন, এত স্পষ্টাস্পষ্টি ভালবাসার কথা কতকাল যে কেউ আমাকে বলেনি। রাণু, তুমি আমার মাধুরীলতার শূন্যস্থান যেন পূর্ণ করে দিতে এসেছ! তোমাকে যতবার রাণু বলে ডাকি, ততবার আমার আর এক মেয়ে রেণুর কথাও মনে পড়ে। কখনও কখনও তাকে রাণু বলেও ডাকতাম। কিন্তু, তুমি যদি আমায় ভালবাসো, তবে সব চিঠিতে গম্ভীর ভাবে প্রিয় রবিবাবু লেখো কেন? এ যেন একেবারে ফর্মাল সম্বোধন! তা হলে যে আমাকেও রাণু দেবী বলে লিখতে হয়!
রাণু বলল, আমি আপনাকে যখন প্রথম চিঠি লিখেছিলাম, তখনও আপনি আমার কাছে নিতান্ত রবিবাবুই ছিলেন। তখনও আমি আপনাকে ভালবাসতাম। কিন্তু তখনকার চাইতে এখন বেশি ভালবাসি। আমি আপনাকে তো ইংরিজি কায়দায় প্রিয় লিখিনি। প্রিয়র বাংলা মানে যা হয় তাই লিখেছি। আমি আর কাউকে প্রিয় লিখিও না। আপনি তো কবিতায় অনেক প্রিয় লেখেন, আমি লিখলেই বুঝি যত দোষ! আমি প্রিয় যে চিঠি লেখবার পাঠ তা জানিও না। আপনাকে প্রিয় লাগে বলেই লিখি। আপনি ঠাকুরকে যেমন বলেন, আমিও আপনাকে তেমনি প্রিয় বলি।
কবি সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, বোঝা গেল, বোঝা গেল। তোমার যুক্তির কাছে হার মানছি! অধ্যাপকের মেয়ে না যেন পাকা উঁকিলের মেয়ে। কিন্তু রবিবাবু কেন? অন্তত রবিদাদাও তো লিখতে পারো!
রাণু বলল, ও নামেও অনেকে আপনাকে ডাকে। আমি এমন একটা নাম চাই, যে নামে আর কেউ ডাকবে না।
কবি বললেন, সে রকম নাম খুঁজে বার করতে হবে।
রাণু জিজ্ঞেস করল, আপনার মেয়ে মাধুরীলতা কখনও আপনার কোলে বসত?
কবি বললেন, তোমার বয়েসে? নিশ্চয়ই। যখন তখন এসে ঝুপ করে আমার কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরত।
রাণু বলল, তা হলে আমিও বসি?