০৫. কতো লম্বা টুথপেস্ট

৫. কতো লম্বা টুথপেস্ট

নতুন টুথপেস্টটা হাতে নিয়ে বল্টু বলল, “অনেক দিন থেকে একটা নতুন টুথপেস্ট খুঁজছি।”

নান্টু বলল, “অ।”

বল্টু হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নান্টু, তোকে আমি কোনোভাবেই কিছু শেখাতে পারি না। আমি যদি কিছু একটা বলি, তুই সেটা শুনে অ বলবি না।”

নান্টু মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”

“ঠিক আছে বললেও হবে না। তোকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কেন আমি নতুন টুথপেস্ট খুঁজছি।”

নান্টু জিজ্ঞেস করল, “বল্টু ভাইয়া, তুমি কেন নতুন টুথপেস্ট খুঁজছ?”

“আমি অনেক দিন থেকে দেখতে চাচ্ছিলাম, একটা টুথপেস্টের ভেতর কয় ইঞ্চি টুথপেস্ট থাকে।”

নান্টু “অ” বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সেটা তুমি কীভাবে মাপবে?”

বল্টু টেবিল থেকে রুলারটা হাতে নিয়ে বলল, “এই যে রুলার দিয়ে মাপব।”

“কিন্তু টুথপেস্ট তো ভেতরে …”

“আগে টিপে বের করে নেব।”

নান্টু ভয়ে ভয়ে বলল, “চাচি রাগ করবেন না?”

বল্টু অবাক হয়ে বলল, “কেন? আম্মু রাগ করবে কেন?”

“টুথপেস্ট নষ্ট করলে সব সময় আম্মুরা রাগ করে।”

বল্টু হা হা করে হেসে বলল, “আম্মু জানতেই পারবে না। টুথপেস্টটা কয় ফুট কয় ইঞ্চি লম্বা মেপে আবার ভেতরে ভরে রাখব। আম্মু জানতেও পারবে না।”

নান্টু এবার মাথা নেড়ে বলল, “অ”।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, বল্টু টেবিলের ওপর টিপে টুথপেস্টটা বের করে রাখতে শুরু করেছে। টিউবটা টিপে পুরো টুথপেস্ট বের করে টেবিলের ওপর কয়েকবার ডানে-বাঁয়ে যেতে হলো। তারপর বল্টু তার ফুট রুলার দিয়ে সেটা মাপল। পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি লম্বা!

বল্টু একটা কাগজে সেটা লিখে তার দরজায় টানিয়ে দিয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলল, “দেখলি, কত সোজা!”

নান্টু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। খুবই সোজা। একেবারে পানির মতো সোজা।”

বল্টু বলল, “যদি পরীক্ষায় আসে একটি টুথপেস্টের ভেতরে কয় ফুট কয় ইঞ্চি টুথপেস্ট থাকে, তাহলে শুধু আমি সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব। আর কেউ তার উত্তর দিতে পারবে না।”

নান্টু বলল, “আমিও পারব। পাঁচ ফুট সাড়ে চার ইঞ্চি।”

“হ্যাঁ খালি আমি আর তুই। আর কেউ পারবে না।” বল্টু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু দেখিস, পরীক্ষায় স্যারেরা আর আপারা কখনোই এ প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেবে না। সব আজেবাজে, আলতু-ফালতু প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেবে।”

নান্টু মাথা নাড়ল, বলল “ঠিক বলেছ, বল্টু ভাইয়া।”

বল্টু মাথা নেড়ে বলল, “আয়, এখন টুথপেস্টগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলি। আম্মু দেখলে এমন চিৎকার শুরু করবে যেন কী না কী হয়ে গেছে।”

নান্টু বলল, “ঠিক আছে।”

টেবিলের ওপর লম্বা হয়ে পড়ে থাকা টুথপেস্টটুকু টিউবের ভেতরে ঢোকাতে গিয়ে বন্দু আবিষ্কার করল কাজটা খুব সহজ নয়। মিনিট দশেক চেষ্টা করে আবিষ্কার করল, কাজটা শুধু যে সহজ না, তা নয়–কাজটা খুব কঠিন। আরও মিনিট দশেক চেষ্টা করে বল্টু ও নান্টু বুঝতে পারল, কাজটা অসম্ভব। টুথপেস্ট একবার টিউব থেকে বের হয়ে গেলে সেটা আর ভেতরে ঢোকানো যায় না। চেষ্টা করতে গিয়ে দুজনের হাত-মুখ এবং জামা টুথপেস্টে মাখামাখি হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত বল্টু হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমার মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এসেছে।”

“কী বুদ্ধি?”

“টুথপেস্টটা একটা কাপের মধ্যে রেখে দেব।”

“কাপের মধ্যে?”

“হ্যাঁ।” বল্টু বড় বড় চোখ করে বলল, “তাহলে টুথপেস্ট নেওয়া আরও সোজা হবে। টিপে টিপে আর নিতে হবে না। টুথব্রাশটা দিয়ে কাপের মধ্যে একটা খাবলা দিলেই টুথব্রাশে টুথপেস্ট লেগে যাবে। ঠিক বলেছি না?”

নান্টু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক বলেছ, বল্টু ভাইয়া। একদম ঠিক বলেছ।”

রাতের বেলা ঘুমানোর আগে রিতু টুথপেস্টটা খুঁজে না পেয়ে যখন এঘর-ওঘর করছে তখন বল্টু তাকে সাহায্য করল, বলল, “আম্মু, তুমি কি টুথপেস্ট খুঁজছ?”

“হ্যাঁ,” রিতু চোখ ছোট ছোট করে সন্দেহের চোখে বলল, “তুই নিয়েছিস নাকি?”

“আমি নিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছি।”

“কোথায়?”

“ওই যে কাপের মধ্যে বের করে রেখেছি। এখন তোমাকে আর টিপে টিপে বের করতে হবে না। তুমি কাপের মধ্যে খাবলা দিয়ে টুথপেস্ট নিয়ে নিতে পারবে।” বল্টু একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমাকে টুথব্রাশটা দাও, আমি দেখিয়ে দেই।”

রিতু টুথব্রাশটা না দিয়ে খপ করে বল্টুর কানটা ধরার চেষ্টা করল, বলল, “তবে রে পাজি ছেলে! নতুন টুথপেস্টটা এভাবে শেষ করেছিস? একবার কেউ ধরে নাই পর্যন্ত …”

বলু কোনোভাবে নিজের কানটা ছুটিয়ে বলল, “আমি মোটেও শেষ করি নাই। সবটুকু আছে কাপের মধ্যে। সবটুকু আছে।”

রিতু বল্টুর কোনো কথা শুনতে রাজি হলো না। চিৎকার করে পুরো বাসায় তুলকালাম করে ফেলল। বল্টু এত অবাক হলো, সেটা আর বলার মতো নয়। এই ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে এত হইচই করার কী আছে, সে বুঝতেই পারল না। যতই বড় হচ্ছে, বড় মানুষদের বিচারবুদ্ধির ওপর ততই সে আস্থা হারিয়ে ফেলছে।

.

বল্টু যখন কোনো কিছুর দিকে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তখন রিতু ঘাবড়ে যায়। তার কারণ, এর দু-এক দিনের ভেতরই সেই জিনিসটা নিয়ে একটা মহা ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। তাই যেদিন রিতু দেখল বল্টু তার একটা শাড়ির দিকে চোখ ছোট ছোট করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তখন সে একটু নার্ভাস হয়ে গেল। বল্টুর দিকে তাকিয়ে গলার স্বর উঁচু করে জিজ্ঞেস করল, “তুই কী দেখছিস এভাবে?”

“তোমার শাড়িটা দেখছি।”

“তুই আগে আমার শাড়ি দেখিস নি? এখন এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন?”

রিতুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বল্টু বলল, “আম্মু, তোমার শাড়ি এত লম্বা কেন?”

“আমার শাড়ি মানে? সবার শাড়িই তো লম্বা হয়। শাড়ি লম্বা না হলে মানুষ শাড়ি পরবে কেমন করে!”

উত্তরটা বল্টুর খুব পছন্দ হলো না, বলল, “আম্মু, শাড়ির এত লম্বা হওয়া ঠিক হয় নাই। কত কাপড় নষ্ট করেছ।”

রিতু বলল, “তোর সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।”

বল্টু অবশ্য এত সহজে হাল ছেড়ে দিল না, বলল, “আম্মু, শাড়িটাকে মাঝখান দিয়ে কাটলেই তো দুইটা শাড়ি হয়ে যায়।”

রিতু ধমক দিয়ে বলল, “খবরদার! যদি আমার শাড়িটাতে হাত দিয়েছিস! শাড়ি যে লম্বা হয় তার কারণ আছে, বুঝেছিস?”

বল্টু মাথা নাড়ল; বলল “বুঝি নাই। তুমি এত চিকন, তোমার এত লম্বা শাড়ি লাগবে কেন?”

রিতু এবার বন্দুকে ধমক দিয়ে বিদায় করে দিল। কাজটা যে ভালো হলো না সেটা সে তখনই অনুমান করতে পেরেছিল।

খানিকক্ষণ পরই দেখা গেল, বল্টু ও নান্টু টেবিলের নিচে বসে কথা বলছে। বল্টুর হাতে একটা খাতা আর কলম, সে গম্ভীর হয়ে বলল, “বুঝলি নান্টু, এখন পর্যন্ত আমরা দেশের জন্যে কোনো কাজ করি নাই। আমরা ছোট বলে কেউ কিছু করতে দেয় না। কিন্তু আমাদের দেশের জন্যে কাজ করতে হবে।”

নান্টু মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

“দেশের জন্যে দরকার হচ্ছে ভাত আর কাপড়।”

নান্টু বলল, “শুধু শুধু ভাত তো খাওয়া যাবে না। একটা ডিমভাজা না হলে ডাল …”

বল্টু নান্টুকে কথা শেষ করতে দিল না, বলল, “হ্যাঁ সেটা তো লাগবেই। কিন্তু আমরা তো সারা দেশের সব মানুষের জন্যে ভাত, ডিম আর ডাল দিতে পারব না। তবে মনে কর কাপড়ের ব্যাপার কিছু একটা করতে পারব।”

নান্টু জিজ্ঞেস করল, “কী করতে পারব?”

“এই দেখ, আমি হিসাব করেছি।” বল্টু খাতাটা দেখাল, “দেশে মানুষ হচ্ছে চৌদ্দ কোটি। তার মধ্যে অর্ধেক মেয়ে, অর্ধেক ছেলে। তার মানে, মেয়ে হচ্ছে সাত কোটি। এই সাত কোটির মধ্যে মনে কর অর্ধেক ছোট আর অর্ধেক বড়। যারা ছোট তারা জামা পরে, টি-শার্ট পরে। কিন্তু যারা বড় তারা সবাই শাড়ি পরে। তারা মানে, এই দেশের সাড়ে তিন কোটি মেয়ে শাড়ি পরে।”

নান্টু হিসাবটা খুব ভালো বুঝল না, কিন্তু বল্টুর ওপর তার বিশ্বাস আছে। তাই সে মাথা নেড়ে মেনে নিল। তবে শাড়ি পরার ব্যাপারটা সে ঠিক বুঝল না। বল্টু অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এটা বোঝানো শুরু করল; নান্টুকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি কখনো দেখেছিস একটা শাড়ি কত লম্বা?”

নান্টু মাথা নাড়ল, বলল, “দেখেছি।”

“আমি মেপে দেখেছি, একটা শাড়ি হচ্ছে ছয় গজ লম্বা। তুই বল, এত লম্বা হওয়ার কোনো দরকার আছে?”

বল্টু কোন উত্তরটা শুনতে চাইছে নান্টু সেটা আন্দাজ করতে পারল। তাই সে জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “কোনো দরকার নাই।”

“এই দেখ, তুই ব্যাপারটা বুঝেছিস। কিন্তু আম্মুকে বোঝাতেই পারলাম না।”

বল্টুকে খুব হতাশ দেখা গেল। তখন নান্টু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “চাচি কী বলেন?”

“আমি আম্মুকে বলেছি, আম্মু, তুমি তোমার শাড়িটা মাঝখান থেকে কেটে দুই ভাগ করে ফেলল, তাহলে এটা দুইটা শাড়ি হয়ে যাবে। এত লম্বা শাড়ির তো কোনো দরকার নেই।”

“চাচি কী বললেন?”

“আম্মুর কথা বলে লাভ নাই! আমার কথা তো শুনলই না, উল্টা। আমাকে ঝাড়ি!”

বল্টু মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “বড় মানুষদের নিয়ে বিরাট সমস্যা। তারা মনে করে তারা যেটা জানে সেটাই ঠিক। অন্য একজনের কথা তারা শুনতেই চায় না। যদি মনে কর আম্মুকে রাজি করাতে পারতাম, তাহলে সবাইকে বলতে পারতাম, একটা শাড়ি ইকুয়েলস টু দুইটা শাড়ি! দেশে কাপড়ের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত!”

নান্টু ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি কি আমার আম্মুকে বলে দেখব?”

বল্টু হাত নেড়ে বলল, “কোনো লাভ নাই। তোর আম্মুও রাজি হবে না। বড় মানুষরা সবাই এক রকম।”

“তাহলে কী করবে, বল্টু ভাই?”

“আমি অনেক চিন্তা করে একটা প্ল্যান করেছি।”

নান্টুকে এবার একটু উৎসাহী দেখাল, বলল, “কী প্ল্যান?”

“আমরা যদি নিজেরা শাড়িটার মাঝখান দিয়ে কেটে ফেলি তাহলে আম্মু আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। কিন্তু যদি ব্যাপারটা আস্তে আস্তে করি, তাহলে?”

“আস্তে আস্তে?”

“হ্যাঁ। মনে কর আজকে আম্মুর শাড়ির এক পাশ থেকে ছয় ইঞ্চি কেটে রাখলাম, তাহলে আম্মু টেরই পাবে না। কয়েক দিন পর আরও ছয় ইঞ্চি এভাবে আস্তে আস্তে যদি শাড়িটা ছোট করতে থাকি তাহলে আম্মু বুঝতে পারবে না। তোর কী মনে হয়?”।

নান্টু মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু আম্মুরা কীভাবে কীভাবে জানি সবকিছু বুঝে ফেলে, তাদের কাছে কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না।”

বল্টু মাথা নাড়ল; বলল, “সেটা তুই ঠিকই বলেছিস। আমি যে সময় কিছু একটা করি, আম্মু আমার মুখ দেখলেই সেটা বুঝে ফেলে।”

“তাহলে কী করবে?”

“সেই জন্যে তো আর থেমে থাকলে হবে না! আমাদের তো চেষ্টা করতে হবে!

কাজেই বল্টু সেদিন খুব সাবধানে তার আম্মুর একটা শাড়ির ছয় ইঞ্চি কেটে আলাদা করে ফেলল। বল্টুর ধারণা সত্যি, রিতু সেটা বুঝতে পারল না। বল্টুর উৎসাহ তখন আরও বেড়ে গেল। দুই দিন পর সে আরও ছয় ইঞ্চি কেটে ফেলল। রিতু সেটাও বুঝতে পারল না। বল্টুর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল প্রায় দশ গুণ।

সপ্তাহ দুয়েক পর রিতু একদিন শাড়িটা পড়তে গিয়ে একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “ব্যাপার কী! এই শাড়িতে কুঁচিটা ঠিক করে আসছে না কেন?”

রাজু কাছাকাছি ছিল, বলল, “আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। আমি কুঁচি বিশেষজ্ঞ না।”

বল্টু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হবে আম্মু, হবে! আরেকটু টাইট করে পরো, তাহলেই হবে।”

বল্টুর কথা শুনে রিতু আর রাজু দুজনই তার দিকে ঘুরে তাকাল। দুজনই বুঝে গেল এতে বল্টুর কোনো হাত আছে। রিতু প্রথমে তার শাড়ির দিকে তাকাল, তারপর বল্টুর দিকে। তারপর চোখ বড় বড় করে বলল, “শাড়িটা ছোট কেন?”

বল্টু বলল, “না, আম্মু। ছোট না! তুমি আরেকটু টাইট করে পরলেই হবে।”

“টাইট করে পরব? শাড়ি টাইট করে পরে কেমন করে?” রিতু হুঙ্কার দিয়ে বলল, “কী করেছিস, বল?”

বল্টুর ব্যাখ্যা দিতে হলো না, শাড়িটা খুলে অন্য শাড়ির সঙ্গে মাপ দিয়ে দেখা গেল, সেটা আড়াই ফুট ছোট। দিনে ছয় ইঞ্চি করে বল্টু পাঁচ দিনে আড়াই ফুট কেটেছে। রাজু রক্ষা না করলে বল্টুর কপালে সেদিন অনেক বড় দুঃখ ছিল।

.

বিকেলবেলায় টেবিলের নিচে নান্টু আর বল্টুকে আবার দেখা গেল। বল্টুর মেজাজ ভালো না। নান্টু তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে রইল। অনেকক্ষণ পর বল্টু বলল, “তুই এখন বুঝতে পারছিস তো আমাদের দেশে কেন কোনো উন্নতি হয় না? শুধু আমাদের আব্বু আর আম্মুদের জন্যে। তারা কোনো কিছু বুঝতে চায় না!”

নান্টু বলল, “অ।”

বল্টু বলল, “তুই চিন্তা কর, আম্মু ভেবেছে আমি নাকি দুষ্টুমি করার জন্যে শাড়িটা কেটেছি! আমি কোনো দিন কোনো দুষ্টুমি করেছি?”

নান্টু মাথা নাড়ল; বলল, “না।”

“আম্মুকে তো বোঝানোই গেল না, অনেক কষ্ট করে আব্বুকে বুঝিয়েছি যে দেশের কাপড়ের অভাব মেটানোর জন্যে এটা একটা গবেষণা ছিল।”

নান্টু জিজ্ঞেস করল, “চাচা বুঝেছেন?”

“বুঝাতে কি চায়? বড় মানুষরা কিছু বুঝতে চায় না।”

“তারপর চাচি কী বলেছেন?”

বল্টু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুই বিশ্বাস করবি না আম্মু কী বলেছে! আম্মু বলেছে, আমার সবগুলো শার্ট, টি-শার্ট বুকের কাছে কেটে অর্ধেক করে দেবে। আর এখন থেকে প্যান্ট না পরে আমাকে পরতে হবে ছোট ছোট টাইট নেংটি। নেংটি পরে নাকি স্কুলে যাব। এভাবে নাকি কাপড়ের সমস্যা মিটে যাবে! আমাকে দিয়েই নাকি দেশের কাপড়ের সমস্যা মেটানোর কাজ শুরু হবে।”

নান্টু চোখ বন্ধ করে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল। বল্টু চোখ পাকিয়ে বলল, “কী হলো? তুই হাসছিস কেন?”

“তুমি বুক পর্যন্ত কাটা শার্ট আর ছোট টাইট নেংটি পরে স্কুলে গেলে তোমাকে দেখতে কেমন লাগবে, সেইটা চিন্তা করে একটু হাসি পেয়েছে।”

বল্টু বলল, “খবরদার! হাসবি না।”

নান্টু মুখ গম্ভীর করে বলল, “ঠিক আছে, হাসব না।”

.

কদিন পরের ঘটনা। রিতু একটা কেক বানাচ্ছে, তার মাখন লাগবে। হাত দুটো ব্যস্ত বলে বন্দুকে ডেকে বলল, “বল্টু, ফ্রিজ থেকে মাখনের ট্রেটা দিয়ে যা তো।”

বল্টু রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজের দরজা খুলে ভেতরে তাকিয়ে রইল। ফ্রিজের ভেতরে এত রকম জিনিস থাকে সেটা সে আগে খেয়াল করে দেখে নাই। সে অবাক হয়ে ডেকচি, বাটি, বোতল, সবজি, ডিম, দুধ, পানির বোতলের দিকে তাকিয়ে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে তার বৈজ্ঞানিক মাথা কাজ করতে শুরু করল।

রিতু কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে বলল, “কী হলো!”

বল্টু কোনো জবাব না দিয়ে ফ্রিজের ভেতর তাকিয়ে রইল। রিতু বুঝে গেল বল্টুর মস্তিষ্ক অন্য কিছুতে কাজ করতে শুরু করছে! তাই সে নিজেই এল মাখনটা নিতে। এসে দেখে, বল্টু ফ্রিজের দরজা খুলে ভেতরে একদৃষ্টে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। রিতু মাখনটা নিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

বল্টু বলল, “আম্মু দেখেছ, ফ্রিজের ভেতরে কত জিনিস!”

রিতু বলল, “ফ্রিজে জিনিস থাকবে না তো কোথায় থাকবে?”

“কিন্তু আম্মু, দেখেছ ভেতরে কত জায়গা নষ্ট হয়েছে?”

“জায়গা নষ্ট হয়েছে?”

“হ্যাঁ। এই দেখো আলুগুলি গোল গোল। আলু যদি গোল না হয়ে চারকোণা হতো তাহলে একেবারে গায়ে গায়ে লাগিয়ে কত বেশি আলু রাখা যেত, তুমি জানো?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আলু চারকোণা হয় না, আলু হয় গোল।”

বল্টু নিরুৎসাহ হলো না, বলল, “কিন্তু ডেকচিগুলি তো চারকোণা হতে পারত। আর পানির বোতল। এইগুলি তো চারকোণা বানানো যেত।”

“ঠিক আছে, তুই যখন বড় হবি তখন তুই আর তোর বউ মিলে তোর বাসার ফ্রিজে সব চারকোণা জিনিস রাখিস। চারকোণা আলু, চারকোণা পেঁপে, চারকোণা ডিম …”

বল্টু হাতে কিল দিয়ে বলল, “আম্মু, তুমি ঠিকই বলেছ। ডিমগুলো হওয়া উচিত ছিল চারকোণা।”

“থাক, হয়েছে,” রিতু বলল, “এই গোল ডিম পাড়তেই মুরগির বারোটা বেজে যায়। চারকোণা ডিম পাড়তে হলে মুরগির খবর হয়ে যাবে।”

“কেন আম্মু, মুরগির কেন খবর হবে?”

কাজেই রিতুর তখন অনেক সময় নিয়ে বল্টুকে বোঝাতে হলো, কেন মুরগির গোল ডিম পারতে হয়, কেন চারকোণা ডিম পাড়তে পারবে না।

কয়েক দিন পর দুপুরবেলা রাজু আর রিতু খেতে বসেছে, দেখা গেল ডালটাতে একটা টক টক গন্ধ। আগের রাতে মাছ রান্না করা হয়েছিল। বড় বড় চোখে সেই মাছ বাটিতে শুয়ে শুয়ে রাজু আর রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে রাজুর আর খাওয়ার সাহস হলো না। সে রিতুকে বলল, “একটা ডিম ভাজা করে খেয়ে ফেলি।”

রিতু বলল, “তুমি বসো, আমি ভেজে আনছি।”

পেঁয়াজ, মরিচ কুচি করে কেটে বাটিতে রেখে দুটো ডিম নেওয়ার জন্য ফ্রিজ খুলে ডিমে হাত দিয়েই রিতু চিৎকার করে পিছনে সরে এল। রাজু ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

রিতু ভয়ে ভয়ে ডিমগুলোর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ওই দেখো।”

রাজু বলল, “কী দেখব?”

“ডিম! হাত দিয়ে দেখো।”

রাজু ডিমটা হাত দিয়ে ধরে চমকে পিছনে সরে এল। ডিমগুলো নরম থলথলে। উপরের শক্ত খোসাটা নেই। রাজু অবাক হয়ে ডিমগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “কে এনেছে এই ডিম?”

“কেউ আনে নাই। ডিমগুলো এই রকম হয়ে গেছে।”

রাজু বলল, “নিজে থেকে ডিম এ রকম হয়ে যাবে কেমন করে?”

“কালকেও ভালো ছিল।”

রাজু একটু এগিয়ে আবার সাবধানে ডিমটা ধরে টেনে ওপরে তুলল। একেবারে তুলতুলে নরম, মনে হয় কেউ বেলুনে পানি ভরে রেখেছে! সে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, ঠিক তখন বল্টু দড়াম করে দরজা খুলে এসে ঢুকল। রাজুকে একটা ডিম ধরে রাখতে দেখে চিৎকার করে বলল, “আমার ডিম! আমার ডিম!”

রিতু চোখ কপালে তুলে বলল, “তোর ডিম মানে? তুই কবে থেকে ডিম পাড়া শুরু করেছিস?”

“আমি ডিম পাড়ি নাই, আমি এটা বানিয়েছি।”

রাজু অবাক হয়ে বলল, “তুই ডিমগুলোর এই অবস্থা করেছিস?”

“হ্যাঁ।”

“কীভাবে?”

“অনেক গবেষণা করে বের করতে হয়েছে। ডিমগুলোকে এসিডে চুবিয়ে দিলে ওপরের খোসাটা গলে ভুরভুর করে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হয়!”

রিতু আঁতকে উঠে বলল, “এসিড? তুই এসিড কোথায় পেয়েছিস?”

বল্টু মুখ শক্ত করে বলল, “আমি কতবার আব্বুকে বলেছি একটু সালফিউরিক না হলে হাউড্রোক্লোরিক এসিড কিনে দিতে। আব্লু তো দিচ্ছে না…”

“তাহলে?”

“তাই ভিনেগারে চুবিয়ে রেখেছি। খাঁটি এসিড দিলে এক মিনিটে হয়ে যেত, ভিনেগার দিয়ে সারা রাত লেগেছে?”

রাজু ধরে রাখা নরম তুলতুলে ডিমটা সাবধানে ফ্রিজে রেখে বলল, “সবই বুঝতে পারলাম। কিন্তু ডিমটা এই রকম নরম তুলতুলে করলি কী জন্যে?”

“আব্বু, তুমি জানো মুরগিদের ডিম পাড়তে কত কষ্ট হয়?”

রাজু বলল, “আমি তো আর মুরগি না, আমি জানব কেমন করে?”

“মুরগিদের ডিম যদি তুলতুলে নরম হয় তাহলে ওদের কোনো কষ্ট হবে।”

সবকিছু বুঝে ফেলার মতো ভঙ্গি করে রাজু বলল, “ও আচ্ছা।”

“আব্বু, এখন আমার এক্সপেরিমেন্টটা শেষ করতে হবে। আমার এখন একটা মুরগি দরকার।”

“মুরগি?”

“হ্যাঁ। সেই মুরগিটাকে আচ্ছামতো ভিনেগার খাওয়াতে হবে, তাহলে দেখবে তার তুলতুলে নরম ডিম হবে! ঠিক আছে?”

রাজু বলল, “ঠিক আছে।”

“মুরগি যখন দেখবে তাদের ডিম পাড়তে কোনোই কষ্ট নাই তখন তারা অনেক বেশি ডিম পাড়বে।”

“নিশ্চয়ই পাড়বে।”

“তুমি অফিস থেকে আসার সময় একটা মুরগি নিয়ে এসো। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

বিজ্ঞানী ছেলেকে মানুষ করা কঠিন, রাজু আর রিতু সেটা অনেক দিন হলো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *