০৫. এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা
আগেরদিন বিকেলে একসাথে বসে চা খাওয়া বন্ধুটি যখন পরেরদিন না ফেরার দেশে চলে যায়, সেই শোক সামলানোর জন্য ঠিক কীরকম মানসিক প্রস্তুতি দরকার? মাঝে মাঝে মৃত্যুকে ভারি আশ্চর্য লাগে! বুকের বাম পাশে ধুকপুক। ধুকপুক করতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা থেমে গেলে ভবলীলাটাই সাঙ্গ হয়ে যায়। মুহূর্তেই চেনাজানা একটা মানুষ হয়ে যায় অন্য জগতের বাসিন্দা।
বন্ধু জাহিদের মৃত্যুসংবাদ শোনার সাথে সাথে আমি যেন বরফের মতো জমে গেলাম। মনে হলো–আমার সমস্ত চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে গেছে। পাল্টে গেছে পৃথিবীর গতিপথ, থেমে গেছে পৃথিবীর চিরাচরিত ঘূর্ণন। ভীষণ বিপন্ন হয়ে ভেঙে পড়েছে মহাবিশ্বের সকল মহাকর্ষীয় শক্তি। প্রাণ-চল ধরণির কোথাও যেন আর এতোটুকুও প্রাণের স্পন্দন নেই।
‘জাহিদ বেঁচে নেই’–ব্যাপারটা যেন কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। মৃত্যুর এমন আকস্মিক আক্রমণে আমি বিপন্ন আর বিপর্যস্ত। মৃত্যু যে এতোখানি অনিশ্চিত এবং এতোখানি আকস্মিক–তা চিন্তা করতেও আমার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে যেন।
চারপাশে নিত্যদিন কতো মানুষকেই তো মরতে দেখি। রোগে-শোকে প্রতিদিন কতো মানুষই তো মৃত্যুর মিছিলে ভিড় জমায়। কতো মৃত্যু-সংবাদ রোজ কানের পর্দায় এসে জানান দিয়ে যায় অস্থায়ী জীবনের অমোঘ বাস্তবতার। কিন্তু সেই মৃত্যুকে এতোটা কাছ থেকে দেখা হবে এতো শীঘ্রই–তা যেন কল্পনাতীত!
জাহিদের মৃত্যুটা আমাকে নাড়া দিয়ে গেলো ভীষণভাবে। আমি ব্যাধিগ্রস্ত জীর্ণ বৃদ্ধের মতো সমস্ত মনোবল সমেত ভেঙে পড়লাম যেন। এই শোক, এই বিরহ-ব্যথা সামলে উঠবার কোনো শক্তি আমি খুঁজে পেলাম না।
তবে, আমাকে সাহস দিতে কার্পণ্য করলো না আমার স্ত্রী ফাতিমা। জাহিদের মৃত্যুতে সেও হতভম্ব এবং আমার মতোই শোকে বিহ্বল; কিন্তু এ বেলায় তার ধৈর্যশক্তি আমার চাইতে প্রবল এবং প্রচণ্ড। চেহারায় তার বিষণ্ণতার ছাপ, তবু সে পরম বিশ্বাসের সাথে আমার সামনে পাঠ করলো এই আয়াত, কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাউত।
তাই তো! কি আশ্চর্য, সারাজীবন মানুষকে বলে আসা, পড়ে আসা এই অমোঘ সত্য-বাণীটা প্রয়োজনের সময়ে আমার মনে রেখাপাত করলো না কেন? আমি কেন বিস্মৃত হলাম, কেন ভুলে গেলাম এই নির্জলা সত্যটাকে?
আমার মনে পড়ে গেলো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু-দিনের সেই ঘটনাটা যখন এমনিভাবেই মৃত্যুর মতো পরম নিশ্চিত ব্যাপারে বিস্মৃত হয়েছিলেন ধরণির একজন মহাপুরুষ–উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু৷ সেদিন তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হতে পারে! শুধু বিস্মৃতই নয়, এই মৃত্যু-সংবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তার সহজাত তেজ এবং তলোয়ার। যারাই বলবে নবিজির মৃত্যু হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই তিনি জারি করে রাখলেন মৃত্যুর পরোয়ানা। প্রিয় মানুষের বিরহ এবং বিদায় যদি তার মতো মানুষকেও ভুললামনা বানাতে পারে, সেখানে আমি আবার কোন ছার?
পৃথিবীতে তিন ধরনের মানুষ আছে। একদল সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে, আরেক দল করে না। আবার, এই দুই দলের মাঝামাঝি একটা দল আছে। তারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসও করে না, আবার অবিশ্বাসও করে না। বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী এবং সংশয়বাদী যা-ই হোক না কেন–সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি চললেও জগতের একটা ব্যাপার নিয়ে কারও মধ্যে কোনো বিরোধ কিংবা দ্বিমত নেই। সেটা হলো মৃত্যু। পৃথিবীর ইতিহাসে দম্ভভরে অনেকেই নিজেকে খোদা দাবি করবার দুঃসাহস দেখিয়েছে; কিন্তু নিজেকে খোদা বলে দাবি করা লোকটাও নিজের নশ্বর অস্তিত্বকে কোনোদিন একমুহূর্তের জন্য অস্বীকার করতে পারেনি। জনসম্মুখে না হোক, নির্জন নিরালায় তার মনে মৃত্যুর একটা তাগাদা থাকত ঠিকই। মৃত্যু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধার ধারে না। সে তার দম্ভের মতো অমোঘ, সে তার শক্তির মতো অবশ্যম্ভাবী।
জাহিদ আমার বাল্যকালের বন্ধু। আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমি আমেরিকা চলে গেলেও শিকড়ের টানে দেশেই রয়ে যায় সে। জাহিদের ছিলো শিক্ষক হবার দুনিৰ্বার নেশা। দেশে এসে দেখি সে ব্যবসা করছে। সারাজীবন চিরকুমার থাকার পণ করে থাকা জাহিদকে আমি আবিষ্কার করলাম। একটি কন্যাসন্তানের বাবা হিসেবে। ছোটোবেলার কোনো কথাই সে রাখতে পারেনি। জীবনে সে যতো রকমের ওয়াদা করেছে তার সবটাই তাকে ভাঙতে হয়েছে। খুব ছোটোবেলায়, পাটোয়ারীদের পেয়ারা গাছে বসে, পা ঝুলাতে ঝুলাতে আমাকে ছেড়ে না যাওয়ার ওয়াদা করেছিলো সে। অথচ সেই ওয়াদাও রাখা হলো না তার। আজ সে আমাকে রেখেই চলে গেছে। কবির ভাষায়, ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। সত্যি কি তা-ই? জাহিদ কি আর কখনোই ফিরে আসবে আমাদের মাঝে? আর কি কখনো আমরা একসাথে শাপলা তুলতে বেরুবো? ঝড়-বাদলের দিনে একসাথে আম কুড়ানো, স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠ-তেপান্তর চষে বেড়ানো আমার সোনালি অতীতের বন্ধুটা কি আর কখনো এসে দরজায় কড়া নেড়ে বলবে, তাড়াতাড়ি আয়, নইলে কিন্তু তোকে রেখেই চললাম?’ বলবে না। মৃত্যু মানেই হলো নিশ্চিত প্রস্থান।
জাহিদকে একবার খুবই বিমর্ষ অবস্থায় পেলাম। মুখের কোণে সারাক্ষণ হাসি ধরে রাখা বন্ধুটাকে এমন অবস্থায় দেখে আমার মনটাও ভারি হয়ে উঠলো। জিগ্যেশ করলাম, কী ব্যাপার? তোকে এতোটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা?
মায়াভরা চোখে সে আমার দিকে তাকালো। চোখ তার জ্বলে টলমলো। ভারী বর্ষণের খানিক আগে আকাশ যেমন গুমোট আকার ধারণ করে–সেরকম। বুঝতে পারলাম কোনো সমস্যা হয়েছে এবং সমস্যাটা খুবই গুরুতর। রাগত গলায় আমি বললাম, ভারি আশ্চর্য! কী হয়েছে সেটা তো বলবি, নাকি? এমন বোবা হয়ে থাকলে বুঝবো কী করে?
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল জাহিদ। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোনোরকমে তাকে শান্ত করে বললাম, ‘জাহিদ, তুই না বড় সাহসী আর সংযমী? এভাবে ভেঙে পড়লে হয়? আমাকে বল না কী হয়েছে? আমি না তোর সবথেকে প্রিয় বন্ধু?’
তার চোখের জলের অবিরাম বর্ষণ তখনো বন্ধ হয়নি। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে আমার হাত দুটো ধরে বললো, আমার মেয়েটার ব্রেইন টিউমার হয়েছে রে। চোখের সামনেই সে আস্তে আস্তে জটিল অবস্থার দিকে যাচ্ছে। বাবা হয়ে আমি ঠিকমতো তার চিকিৎসাও করাতে পারছি না। বিশ্বাস কর বন্ধু, মেয়েটার কিছু হলে আমি আর তোর ভাবি, আমাদের কেউই হয়তো বাঁচবো না’, বলতে বলতেই জাহিদ আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমার শক্ত-সামর্থ্য মনের বন্ধুটাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে আমিও ভেতরে ভেতরে খান খান হয়ে যাচ্ছি।
আমাদের কোনো সন্তানাদি নেই। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উপলদ্ধি করবার সুযোগও তাই মেলেনি কোনোদিন। মেয়ের জন্য জাহিদের এমন হৃদয়-নিংড়ানো আবেগ আর দরদ দেখে অনুধাবন করলাম এই অপার্থিব ভালোবাসা পৃথিবীর কোনো শব্দ-বন্ধনী, কোনো বাক্য-বিন্যাসে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘দেখ, এভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। রোগ। যেমন আছে, তার চিকিৎসাও আছে। তুই চিন্তা করিস না জাহিদ। আল্লাহ চান তো। তোর মেয়ের কিচ্ছু হবে না। ও ঠিক ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে।
বিপদের দিনে মানুষকে আশার আলো দেখাতে হয়। যেখানে অন্ধকার ব্যতীত আলোর নিশানাও নেই, সেখানেও আলোর উপস্থিতি কল্পনা করে নিতে হয় আমাদের। মানুষ আশা করতে পারে বলেই সে এতো বিচিত্র বিপদেও সভ্যতার পর সভ্যতা ধরে টিকে আছে।
জাহিদের সাথে কথাগুলো হয়েছিলো বেশ আগে। এরপর দীর্ঘদিন আমাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কেউ কারও খোঁজ-খবরও নিতে পারিনি সেভাবে। মতিঝিলে গতকাল অকস্মাৎ মুখোমুখি দুজনে। দুজনেই দৌড়ের ওপর ছিলাম একপ্রকার। জাহিদকে দেখলাম বেশ ফুরফুরে মেজাজেই আছে। টং দোকানে চা খেতে খেতে হালকা আলাপ হলো বটে, কিন্তু সেই প্রাণবন্ত আলাপের কোথাও দুঃখ-বেদনার কোনো উপস্থিতি টের পাইনি।
এরপর? এরপর আজ তার মৃত্যুসংবাদ! আহা মৃত্যু! আহারে মানুষ! কচুপাতার ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুর মতোই ঠুনকো মানুষের জীবন। হালকা বাতাসে পাতা দুললেই গড়িয়ে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।
হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে জাহিদের। কী জানি ওই বুকের ভেতর কতো রকমের বোঝা চেপে রেখেছিল সে। গতকালকের জাহিদকে আজ অনেকগুলো ভিন্ন ভিন্ন বিশেষণে ডাকতে হবে। মৃত জাহিদ। লেইট জাহিদ। গতকালকের জাহিদ আজ কেবলই একটা নির্জীব, অনড় পদার্থ। গতকালকের মানুষটা আজ কেবলই লাশ! জীবনের পরিণতি কতটা নিষ্ঠুর হয় তা যদি আমরা অনুভব করতাম!
জাহিদের মৃত্যুর সাথে সাথে তার মেয়েটার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেলো। যাদের সাথে ব্যবসা করতো সে, তারাও নানান অজুহাতে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে পালাবার ধান্দায় ব্যস্ত। মৃত্যুর সাথে সাথে নামে-বেনামে বেরিয়ে এলো অনেক পাওনাদার। কোথায় জানি একবার পড়েছিলাম, ‘জীবিতকে নিয়ে ব্যবসা চলে, মৃতকে নিয়ে নয়। এই অসত্য, অযৌক্তিক কথাখানি যিনি বলেছিলেন সেই ভদ্রলোক বেঁচেবর্তে আছেন কি না জানা নেই। থাকলে তাকে আজ দেখানো যেতো মৃত মানুষকে নিয়েও এখানে কতো রমরমা ব্যবসা হয়!
জাহিদের মৃত্যুর মাস তিন পেরুতে না পেরুতেই বাড়িওয়ালার কড়া নোটিশ হাজির– আগামী মাসে বকেয়া এবং চলতি পাওনা পরিশোধ না করা গেলে অন্যত্র বাসা খুঁজতে হবে, তবে অতি-অবশ্যই পাওনা অনুযায়ী বাসার আসবাবপত্র বাড়িওয়ালা রেখে দেবেন। ওদিকে ব্যবসার অংশীদারেরাও কম যান না একদম। ব্যবসায় বিরাট ক্ষতি আবিষ্কার করে তারা ইতোমধ্যেই ব্যবসার চুক্তিপত্র থেকে জাহিদের নাম। কর্তন করতে কার্পণ্য করেননি।
ঢাকা শহর, যেখানে খাবার পানিটাও কিনে খেতে হয়, সেখানে বুঝি এই অবস্থায় ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা হবে? অবস্থা এমন–বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে পথে বসা ছাড়া জাহিদের বউয়ের আর কোনো গত্যন্তর নেই। আমাদের অবস্থাও তেমন। আহামরি কিছু নয়। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি। কোনোরকমে নিজেদের ভরণপোষণ সামলে বাড়তি কারও দায়িত্ব কাঁধে নেবো–সে সাধ্যি কই? তবুও যে তাদের একেবারে ত্যাগ করেছি তা নয়। সামথ্য অনুযায়ী পাশে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা তো ছিলোই।
আমার হালকা কিছু সঞ্চয় ছিলো। মনে হলো ওই টাকা দিয়ে জাহিদের অসুস্থ মেয়েটার চিকিৎসা করানো যায়। একদিন আমার হাত ধরে মেয়ের জন্য অঝোর। ধারায় যেভাবে কেঁদেছিল জাহিদ–সেই দৃশ্যের কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। জাহিদ আজ নেই, কিন্তু মেয়েটাও যদি ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যায়–নিজের কাছে নিজেই তখন ছোটো হয়ে যাবো আমি।
ভাবনাটা ফাতিমাকে জানালাম। ফাতিমা খুবই সরল মনের মানুষ। দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে তাকে আমি কখনোই কঠোর হতে দেখিনি। মানুষের বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াবার সে কি আকুল আগ্রহ তার! তার সেই আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করে রাখত। মনে হতো–আমার যদি একদিন অনেক টাকা হয়, আমি অনেক বড় একটা চ্যারিটি ফাউন্ডেশন করে যাবো যেখান থেকে দুঃখী-দুঃস্থ মানুষেরা সাহায্য পাবে। ফাউন্ডেশনটার নাম হবে–’ফাতিমা চ্যারিটি ফাউন্ডেশন। ফাতিমা যখন শুনবে আমি আমার একমাত্র সঞ্চয় ব্যয় করে একটা অসহায় পরিবারের অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসা করাতে চাচ্ছি–আমি নিশ্চিত এটা শুনে ফাতিমার চাইতে সুখী এবং খুশি আর কেউ হবে না।
কিন্তু আমার কথা শুনে একপ্রকার আমার মুখের ওপরে সে বললো, এটার কোনো দরকার নেই।
আমি বেশ অবাক হলাম! এমন একটা প্রস্তাবে ফাতিমা রাজি হবে না–এ তো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। দু-হাতে দান করতে পারলে যে মানুষটি সুখ পায়, অসহায়ের পাশে দাঁড়াতে যার ব্যাকুল থাকে মন–সে কিনা আমার মুখের ওপরে ‘না’ বলে দিলো! নরম হৃদয়, সরল আর শুভ্র মনের অধিকারিণী যে ফাতিমাকে আমি চিনি, যাকে আমি ভালোবাসি, বিশ্বাস আর ভরসা করি–এ কি সে-ই?
তার পাশে বেশিক্ষণ বসে থাকা গেলো না। দুনিয়াটা কেমন যেন বিস্বাদ ঠেকছে। জগতের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত বোধকরি এটাই। মনে মনে বিড়বিড় করে বললাম, ‘ফাতিমা, তুমিও এভাবে বদলে যেতে পারলে? স্বার্থপরতার মোহ থেকে তুমিও বাঁচতে পারলে না?
পরিস্থিতিটা কেন জানি সহ্য হচ্ছিল না। দ্রুত স্থান ত্যাগ করার জন্যে পা বাড়াতেই আমার হাত ধরে ফেলল ফাতিমা। আমাকে আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমার কিছু কথা আছে আপনার সাথে।
আমি কোনোকিছুই বললাম না তাকে। আজ তাকে আমার কিছু বলার নেই। স্বার্থপরতার যে রূপ আজ আমি তার মাঝে দেখলাম, সেই রূপের তেজস্ক্রিয়তা সহ্য করে নিতে আমার যে বেশ অনেকখানি সময় লেগে যাবে তা আমি জানি। কিন্তু ফাতিমার এই রূপ দেখবার আগে আমার মৃত্যু হলেই ঢের ভালো ছিলো।
আমার কোনো জবাব না পেয়ে সে আবার বললো, আমার কথাটা একবার শুনুন, প্লিজ।
এবারও আমাকে পাথরের মতো নিশ্চল, নিশ্চল্প দেখতে পেয়ে ফাতিমা তার কথাগুলো বলতে শুরু করলো, আজকে না-হয় ভাবিদের আমরা টাকা দিয়ে সাহায্য করলাম, কিন্তু আগামীকাল? আগামী পরশু কী হবে তাদের? কার কাছে যাবে তারা? কোথায় গিয়ে হাত পাতবে?’
ফাতিমার কথাগুলো বুঝে উঠতে পারলাম না। কেবল নির্বাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার যেন আর কিছুই বলবার নেই। ফাতিমা তার বক্তব্য থামায়নি, ‘আজকে না-হয় তাদের আমরা দয়া করবো, কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের দরকার একটা আশ্রয়। মাথা গুঁজবার জন্য একটা আবাস। এই মুহূর্তে জাহিদ ভাইয়ের মেয়েটার একটা নির্ভরতার ছায়া দরকার। পরম যত্নে তার মাথায় বুলিয়ে দেবার মতন দুটো কোমল হাত দরকার। তার মাথার ওপর দরকার একটা বটবৃক্ষ।
প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে আমি তখন বিপন্নপ্রায়। ফাতিমার কথাগুলোর কোনো মর্মোদঘাটন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না কোনোভাবেই। কিন্তু সে কিছু একটা বলতে চায় যা আমার বোঝা দরকার বলে মনে হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর আমি বললাম, আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলবে তুমি আসলে কী বলতে চাইছো?’
এবার ফাতিমা আমার হাত ধরে ফেলল। আমি খেয়াল করলাম তার চোখ দুটো রক্তজবা ফুলের মতন লাল হয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। তার এই কান্নার কারণ আমি বুঝে উঠতে পারছি না। এই ফাতিমাকে যেন আমি চিনতেই পারছি না কোনোভাবে। সে কান্না থামিয়ে বললো, ‘আপনি ভাবিকে বিয়ে করুন।
আমি আবার নির্জীব হয়ে গেলাম। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা বাক্যটা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি কি ঠিক শুনেছি? কী বললো ফাতিমা এটা? এটা সে ভাবলোই বা কীভাবে?
ফাতিমা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। টপটপ করে তার চোখের জল নিচে গড়িয়ে পড়ছে। আমি তাকে স্পর্শ করলাম। দু-হাতে তার মুখ আলতো করে ধরে বললাম, ‘তুমি ঠিক আছে তো?’
আমার প্রশ্ন শুনে আবারও তার চোখ বেয়ে নেমে এলো অশুর ফোয়ারা। আমার দু-হাত ভরে উঠলো তার অশ্রুজলে। সে থরথর করে কাঁপছে। আমি শক্তভাবে ধরলাম তাকে। আমার বাম হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললাম, ‘এটা হয় না ফাতিমা।
‘কেন হবে না? আল্লাহ না করুন, জাহিদ ভাইয়ের জায়গায় আপনি আর ভাবির জায়গায় যদি আমি হতাম? আমাকে উদ্ৰান্ত, অসহায় অবস্থায় ধুকে ধুকে জীবন কাটাতে আপনি দেখতে পারতেন?
আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। ফাতিমার যুক্তির বিপরীতে ছোঁড়ার মতো যুক্তি আমার হাতে নেই। কিন্তু ও যে আবেগের আতিশয্যে একটা অসম্ভব দাবি উত্থাপন করেছে তা ওকে বোঝাতে হবে আমার। আমি বললাম, আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমরা তাদের পাশে দাঁড়াবো ফাতিমা। কিন্তু তাই বলে…।
আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে ফাতিমা বললো, এটা তো দয়া করা হবে। আমি চাই না তারা দয়া নিয়ে বাঁচুক। আমি চাই তারা অধিকার নিয়ে বেঁচে থাক। একজন মহিলা তার স্বামীর অধিকার এবং একটি সন্তান তার বাবার অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকাটাই আমার কাছে অধিক পছন্দের।
সেবার আমি আর কোনোভাবেই ফাতিমাকে বোঝাতে পারিনি। তার যুক্তির কাছে পেরে ওঠা আমার সাধ্যের বাইরে ছিলো। তারচেয়ে বড় ব্যাপার হলো–তার আত্মত্যাগের সামনে আমাকে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছে। এমন পবিত্র ইচ্ছাকে। অসম্মান করার মতন দুঃসাহস আমার হয়নি।
সত্যি সত্যিই আমাদের বিয়েটা হয়েছিলো। যেদিন আমার দ্বিতীয় বিয়ে হচ্ছে, সেদিন বাইরে তুমুল ঝড়-বৃষ্টি। আকাশে মুহূর্মুহূ মেঘের গর্জন। ভারী বর্ষণে প্রকৃতি তখন একেবারে দিশেহারা। এমন ঝড়ো হাওয়ার রাতে, এমন বিপন্ন-বিপর্যস্ত সময়ে আমার বুকের মধ্যেও একটা ঝড়ের তাণ্ডবলীলা চলছিল। সেই রাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করেছিলো ফাতিমা। বাইরের ভারী বৃষ্টির সবটুকু জল যেন ফাতিমার চোখে এসে ভর করেছে। জাগতিক নিয়মে পুরুষ মানুষরা নাকি কঠিন প্রকৃতির হয়। তারা নাকি খুব সহজে কাঁদতে পারে না। জগতের নিয়মকে ভুল। প্রমাণিত করে সেদিন ফাতিমাকে জড়িয়ে ধরে আমিও খুব কেঁদেছিলাম।