মা’র নামে একশ টাকা মনি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিলাম। আমার আর্থিক টানাটানি কিছু দূর হয়েছে। কলেজে বেতন মাফ হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যাবেলা একটা ভাল টিউশনি জোগাড় হয়েছে। ক্লাস নাইনের একটি মেয়েকে সপ্তাহে চার দিন পড়াই। মেয়েটি খুবই শান্ত স্বভাবের। বড়ই লাজুক। সারাক্ষণ মুখ নিচু করে পড়ে। যদি কিছু জিজ্ঞেস করি বইয়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়। মুখ তুলে তাকায় না। পড়ানো শেষ করে যখন যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াই তখন লাজুক মুখে বলে, স্যার একটু বসেন।
মেয়েটি দ্রুত চলে যায় ভেতরে; ফিরে আসে বরফ দেয়া এক গ্রাস পানি এবং ঝাক ঝাকে একটি কাচের বাটিতে কিছু খাবার নিয়ে। বিকালে আমার কিছুই খাওয়া হয় না। ক্ষিধায় নাড়ি মোচড় দিতে থাকে। লোভীর মত খাবারটা খাই। মেয়েটা নরম গলায় বলে, স্যার আরো খানিকটা আনি? আমার লজ্জা লাগে তবু অপেক্ষা করি খাবারের জন্যে। মাসের এক তারিখে মেয়েটি অতি সংকোচে টাকা দেয়। আমার হাতে। যেন স্যারকে টাকা দেয়াটা একটা লজার ব্যাপার। এত ভাল লাগে আমার। মাঝে মাঝে ছোটখাটো দু’একটা উপহার কিনে আনতে ইচ্ছা হয়। সাহস হয় না। হয়ত মেয়েটির মা কিছু মনে করবেন। মেয়ের মা কখনো আমার সামনে আসেন না। পর্দার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে কথা বলেন, শেলী অংকে খুব কাঁচা। দেখবেন ভাল করে।
জি দেখব।
বাড়ির কাজ ঠিকমত করে না। ধমক দেবেন। আপনাকে ভাল মানুষ পেয়ে শুধু ফাঁকি দিচ্ছে বোধ হয়।
মেয়েটির বাবার সঙ্গে দেখা প্রায় হয় না বললেই হয়। তিনি সারাক্ষণ ব্যস্ত। যখন হঠাৎ এক আাধাদিন দেখা হয় তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, চিনতে পারলাম না তো। কে আপনি?
আমি সংকোচে বলি, আমি শেলীর মাস্টার।
তাই তো তাই তো। আমি গত সপ্তাহেই তো দেখলাম। একটুও মনে নাই। লজ্জার ব্যাপার।
ভদ্রলোক দারুণ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, মাস্টার সাহেবকে চা দেয়া হয়েছে? আফজাল আফজাল।
চা খেয়েছি আমি। ভূতে কী আরেকবারর খাবেন। আপনি নিজেও তো ছাত্র?
শেলী বলেছে আমাকে। একটিই টিউশনি আপনার?
আমার দারুণ লজ্জা লাগে। কান টান লাল করে বলি, বিকালেও একটা টিউশনি আছে।
আমি নিজেও খুব কষ্ট করে পড়েছি। তিন চারটা টিউশনি করতাম। একটুও ভাল লাগত না। সারাক্ষণ ভাবতাম। কখন তারা চা টা খেতে দেবে। আপনাকে চা, টা ঠিকমত দেয় তো?
হা হা করে হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক! হাসি থামতেই গম্ভীর হয়ে বললেন, এক বাড়িতে পড়াতাম একটা ছেলেকে। মহা মুর্খ। তিনবার ফেল করেছে মেট্রিক–দেখেন অবস্থা। একেক বার ফেল করত। আর ছেলের বাবা এসে আমাকে ধমক ধামাক।–কেন ফেল করল, কেন ফেল করল।
আমার মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা বোধ আছে। সব সময় নিজেকে ছোট মনে হয়। কলেজে সংকোঁচে থাকি। একেক দিন সফিকের সঙ্গে তার কাটা কাপড়ের স্তুপের কাছে যেতে হয়। টাকা পয়সা গুণে গুণে রাখতে আমার কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করে। সব সময় মনে হয় এই বুঝি ক্লাসের কোন ছেলে বলে বসবে কে রঞ্জুনা? কিন্তু এই বাড়িতে এসে সেই ভাবটা আমার থাকে না। শেলী যেদিন জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনি ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করেন?
তখন কেন জানি আমার লজ্জা লাগল না। আমি খুবই সহজ ভাবেই বললাম, হ্যাঁ। আমার বন্ধুর সঙ্গে মাঝে মাঝে যাই। তুমি জানলে কী করে?
আমি হঠাৎ দেখলাম।
তোমার খারাপ লাগছিল নাকি?
না তো! মজা লেগেছে।
মেয়েটিকে দেখলেই পারুলের কথা মনে হয়। কোথায় যেন পারঙ্গলের সঙ্গে এর মিল আছে। স্পষ্ট কোনো মিল নয় এক ধরনের সূক্ষ্ম অস্পষ্ট মিল।
অনেক দিন পারুলের কোন খোজখবর জানি না। একবার শুনেছিলাম। তারা নাকি নেত্রকোনা থেকে বরিশাল চলে গেছে। নেত্রকোনায় শ্বশুর বাড়ির সঙ্গে বনিবনা হয়নি। বরিশালের ঠিকানা জানা না থাকায় চিঠিও দিতে পারি না। অনেকদিন পারুলকে দেখি না। শুধু পারুল কেন মার সঙ্গেও দেখা নাই অনেকদিন। যেতে আসতে অনেকগুলি টাকা খরচ হয়। প্ৰাণে ধরে এতগুলি টাকা খরচ করতে পারি না।
পান্থ নিবাসে একঘেয়ে জীবন কাটাই। সফিক সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তার দেখা পাওয়া যায় না। অনেক রাতে ঘরে ফিরেই ঘুমুতে শুরু করে। সফিকের সেই মাস্টারিটা আর নাই। কাটা কাপড়ের ব্যবসা আবার শুরু করেছে। মনে হয় খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। তার স্বাস্থ্যও ভেঙে গেছে। ঘুমের মধ্যে ছটফট করে। কে জানে বড় ধরনের কোন অসুখ নিশ্চয়ই বাঁধিয়েছে। রাতের বেলা হঠাৎ জেগে উঠে বলে, শীত লাগছে রঞ্জু জানালাটা বন্ধ করা তো। ভাদ্র মাসের পঁচা গরমে তার শীত লাগে কেন কে জানে?
মাঝে মাঝে হঠাৎ সফিককে খুব খুশি খুশি লাগে। ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলে, এই বার বিয়ে করে ফেলব। দু’জন থাকলে যুদ্ধে অনেক এডভানটেজ পাওয়া যায়। অভাবের সঙ্গে কী আর একা একা ফাইট চলে?
রেবার ছবিটা বের করা হয় তখন। সফিক লাজুক স্বরে বলে, বেশ মেয়েটি, কী বলিস? ভাল মানুষের মত দেখতে।
কিন্তু রঞ্জু এই মেয়ের অনেক বুদ্ধি। দেখ চোখের দিকে তাকিয়ে।
সফিক রেবার ছবিটি যত্ন করে একটা খামে ভরে রাখে। সেই খামটি তার টিনের ট্রাঙ্কে তালাবন্ধ থাকে। সফিকেয় লজ্জা টজা একটু কম কিন্তু রেবার প্রসঙ্গ উঠলেই সে কেমন লজ্জা পায়। সে প্রসঙ্গ ওঠে। কম। আমি নিজে থেকে কখনো তুলি না। নিশানাথ বাবু অনেকবার বলেন, সিরাজ সাহেবের বোনের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু করা দরকার। ভাল মেয়ে দেবী অংশে জন্ম। এই সব মেয়ে হাতছাড়া করা ঠিক না। বলতে বলতে আড় চোখে তাকান সফিকের দিকে। সফিক নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে, বিয়ে নিশ্চয়ই হয়ে গেছে এতদিনে?
জিজ্ঞেস করব সিরাজ, সাহেবকে?
না না, থাক।
নিশানাথ বাবু গম্ভীর হয়ে বলেন, এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে আর অসুবিধা কী?
সফিক চুপ করে থাকে। নিশানাথ বাবু বলেন, বড়ই বোকামী করছ সফিক। তোমার হচ্ছে স্ত্রী–ভাগ্যে উন্নতি। কথা তো শুনবে না কিছু।
নিশানাথ জ্যোতির্ষিণবের দিনকাল বড়ই খারাপ। লোকজন হাত দেখাতে আসে কালে ভদ্রে। পান্থ নিবাসের টাকা আবার বাকি পড়ে। রশীদ মিয়া রোজ সকালে টাকার জন্যে তাগাদা দিতে আসে। সরু চোখে তাকিয়ে থেকে হিসহিস করে কথা বলে, ঘর কবে ছাড়বেন বলেন দেখি? আবার তিন মাসের বাকি।
জ্যোতির্ষাণব মুখ নিচু করে থাকেন। কোন কোন দিন রশীদ মিয়ার গালাগালি চরমে ওঠে, আর এক মাস দেখব। তারপর বিসসিল্লাহ ইস্কু টাইট দিব বুঝছেন। সোজা আঙুলে না হলে আঙুল বেঁকা করা লাগে। জ্যোতির্ষিার্ণব কিছুই বলেন না। নবী সাহেব মৃদু গলায় বলেন, এই সব কী বলেন রশীদ মিয়া? মানুষের অভাব হয় না। এই সব কথা বলা কী ঠিক?
ঠিক বেঠিক জানি না। আমার কথা পরিষ্কার। আমি কী দানসাগর খুলেছি নাকি? না এটা সাধুজীর বাপের হোটেল?
করিম সাহেবের সঙ্গে জ্যোতির্ষিণবের মোটেই মিল নেই। জ্যোতির্ষিণবের কোন একটা ঝামেলা হলে করিম সাহেবের আনন্দে দাঁত বের হয়ে যায়। সেই করিম সাহেবও একদিন রেগে গেলেন, এইটা কী কাণ্ড রোজ রোজ, ভদ্রলোকের অপমান।
রশীদ মিয়া চোখ লাল করে বলল, ভদ্রলোকটা কে? আমি তো কোন ভদ্রলোক দেখি না।
চুপ শালা। তোমাকে আজ আমি ভদ্রলোক গিলায়ে খাওয়াব।
রশীদ মিয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল। শুকনা গলায় বলল, আপনে এই সব কী বলছেন করিম সাহেব?
চুপ একদম চুপ। শালা তোমার পাছায় লাথথি মেরে পাইখানার মধ্যে তোমারে কুপে ফেলব। ভদ্রলোক চিনবা তখন। হৈচৈ শুনে নিচ থেকে কাদের মিয়া ছুটে এল। নবী সাহেব বের হয়ে আসলেন। জ্যোতির্ষিণব বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, থামেন করিম সাহেব। কী সব বলছেন।
আপনে থামেন। আমি থামার লোক না। শালাকে খুন করে ফাঁসি যাব আমি।
করিম সাহেব লোকটিকে আমি কোনো দিনই পছন্দ করি নাই। করিম সাহেব এমন লোক, যাকে কোন কারণেই পছন্দ করা যায় না। পান্থনিবাসের কেউ তার সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলে না। কিন্তু সেই রাতে সিরাজ সাহেব তাকে চা খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আজীজ সাহেব তাকে তাস খেলার জন্যে ডাকতে আসলেন। নবী সাহেবের মেয়ের বাড়ি থেকে ডিমের হালুয়া এসেছিল। নবী সাহেব সেই হালুয়ার বাটি পাঠিয়ে দিলেন করিম সাহেবের ঘরে। সবাইকে ভাগ করে দেয়ার দায়িত্ব করিম সাহেবের।