০৫. একটু সুস্থ হয়েই বল্টু চলে যাবে

০৫.

একটু সুস্থ হয়েই বল্টু চলে যাবে বলে কথা দিয়েছিল কিন্তু এর মাঝে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে বল্টু চলে যাবার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। রইসউদ্দিন নিজে থেকে কিছু বলতেও পারেন না, এইটুকুন একটা ছেলেকে তো আর ঘর থেকে বের করে দেওয়া যায় না। ছেলেটা আসায় শিউলির একটা কথা বলার লোক হয়েছে, দুইজনে কুটকুট করে দিনরাত কথা বলে। মেয়েটা অসম্ভব দুষ্ট হলেও ভেতরে কেমন জানি একটা মায়া আছে, মনে হয় ছেলেটাকে একটু আদরও করে। বল্টু বাসায় থাকায় রইসউদ্দিন আরেকটা লাভ হয়েছে, মতলুব মিয়াকে চোখে-চোখে রাখার একজন মানুষ হয়েছে। পঁচিশ বছর একসাথে থেকে হঠাৎ সে যে চুরি করা শুরু করবে সেটা কে জানত? সবচেয়ে বড় কথা, শিউলির চাচার খোঁজ পাওয়া গেছে, রইসউদ্দিন চিঠি লিখেছেন, আশা করছেন সপ্তাহ দুয়েকের মাঝে চিঠির উত্তর এসে যাবে। চাচা এসে যখন মেয়েটাকে নিয়ে যাবে তখন বল্টু তার নিজের জায়গায় চলে যাবে। ততদিন তার বাসায় এই দুজন নতুন বাচ্চা অতিথি থাকা এমন কিছু খারাপ ব্যাপার নয়। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তাঁর যেরকম ভয় ছিল–সত্যি কথা বলতে কী এ দুজনকে দেখে সেই ভয়টা একটু কমেই এসেছে।

আজ অফিস ছুটি। রইসউদ্দিন তার কাগজপত্র ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করার জন্যে বের করে খানিক দূর এগিয়ে এসে হঠাৎ করে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। শিউলি আর বল্টু বেরিয়ে গেছে–দুজন টো টো করে কোথায় ঘুরে বেড়ায় কে জানে! কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে রইসউদ্দিন হঠাৎ চা খাওয়ার ইচ্ছে করল। মতলুব মিয়াকে ডেকে তাই এক কাপ চা দিয়ে যেতে বললেন।

মতলুব মিয়া কাপে করে যে-জিনিসটা চা হিসেবে নিয়ে এল সেটা দেখে অবিশ্যি রইসউদ্দিনের চা খাওয়ার ইচ্ছে পুরোপুরি উবে গেল। ময়লা কাপে ঘোলা খানিকটা তরল, তার মাঝে গোটা ছয়েক নানা আকারের পিঁপড়া ভাসছে। পিঁপড়াগুলো সরিয়ে চায়ে একটু চুমুক দিয়ে তাঁর নাড়ি উলটে এল। থুঃ থুঃ করে

ফেলে বললেন, “এইটা কী এনেছ মতলুব মিয়া? চা, নাকি ইঁদুর মারার বিষ?”

মতলুব মিয়া মুখ গম্ভীর করে বলল, “ভাই, পঁচিশ বছর থেকে আপনার জন্যে জীবনপাত করেছি, এখন আর না।”

রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “কেন? কী হয়েছে?”

“বাসার কাজ আর করব না।”

রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “বাসার কাজ তুমি করে করেছ? গত পঁচিশ বছর তো তুমি শুধু শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলে। শিউলি আসার পর মনে হয় গতরটা একটু নাড়াচ্ছ।”

মতলব মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “এই অপমান আর সহ্য করব না ভাই, স্বাধীন কাজ করব।”

“কী কাজ?”

“ব্যবসা।”

রইসউদ্দিন চোখ কপালে তুলে বললেন, “ব্যবসা তুমি ব্যবসা করবে?”

“কেন ভাই? আপনি কি মনে করেন আমি ব্যবসা করতে পারি না?”

রইসউদ্দিন গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লেন, “আমি তাই মনে করি মতলুব মিয়া। তোমার মতো আলসে মানুষ ব্যবসা করতে পারে না। তুমি কিসের ব্যবসা করবে?”

মতলুব মিয়ার মুখে সবজান্তার মতো একটা হাসি ফুটে ওঠে। সে মাথা নেড়ে বলল, “তার আগে ভাই বলেন দেখি একটা ময়না পাখির দাম কত?”

“ময়না পাখি? সে তো অনেক দাম, কয়েক হাজার তো হবেই।”

”ময়না পাখি তো দেখতে সুন্দর না কিন্তু তার দাম বেশি, কারণটা কী বলেন দেখি?”

“কারণ ময়না পাখি কথা বলে।”

“এখন যদি মনে করেন অন্য কোনো পাখি কথা বলে তবে সেই পাখির দাম কত হবে?”

রইসউদ্দিন অবাক হয়ে মতলুব মিয়ার দিকে তাকালেন, “তুমি যদি কথা বলা কাক আনতে পার লাখ টাকায় বিক্রি হবে। যদি মুরগিকে দিয়ে কথা বলাতে পার সেইটাও নিশ্চয়ই বৈজ্ঞানিকরা লাখ দুইলাখ টাকায় কিনে নেবে।”

মতলুব মিয়ার চোখ লোভে চকচক করতে থাকে, “সত্যি? সত্যি? ভাই?”

রইসউদ্দিন মাথা নেড়ে বললেন, “কিন্তু তুমি কী পাখি আনবে যেটা কথা বলে?”

মতলুব মিয়া উত্তর না দিয়ে খুব গম্ভীর গলায় বলল, “সময় হলেই দেখবেন ভাই। এখন খালি আমার দরকার একটু ক্যাশ টাকা। ধার দিবেন কিন্তু ভাই।”

রইসউদ্দিন ভুরু কুঁচকে বললেন, “দেওয়ার মতো হলে নিশ্চয়ই দেব কিন্তু কথা হচ্ছে তোমার যেরকম বুদ্ধিশুদ্ধি তোমাকে কেউ-না ঠকিয়ে দেয়!”

মতলুব মিয়া একগাল হেসে বলল, “ভাই, একজন মানুষকে আরেকজন মানুষ ঠকাতে পারে যদি তার বুদ্ধি বেশি হয়। এইখানে মক্কেলের বুদ্ধি আমার থেকেও কম। হে হে হে!”

সেদিন সন্ধ্যেবেলা দেখা গেল মতলুব মিয়া একটা খাঁচা নিয়ে এসেছে, খাঁচাটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা। অনেক যত্ন করে সেটাকে তার ঘরে টেবিলের উপর রাখা হল। রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “কী আছে ভেতরে?”

মতলুব মিয়া গম্ভীরমুখে বলল, “সময় হলেই দেখবেন।”

“কখন সময় হবে?”

“রাত বারোটায়।”

“রাত বারোটায়? রাত বারোটায় কেন?”

“পাখিদের খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম খুব নিয়মমতো নিতে হয়। একটু উলটা পালটা হলেই বিপদ।”

শিউলি জিজ্ঞেস করল, “এর ভিতরে পাখি আছে?”

“হুঁ।“

“এই পাখি কথা বলে?”

মতলুব মিয়া উত্তর না দিয়ে খুব একটা তাচ্ছিল্যের ভান করে শিউলির দিকে তাকাল। বল্টুকে এখনও স্কুলে দেওয়া হয়নি কিন্তু একা একা জেগে না থেকে সেও শুয়ে পড়ে। তবে আজকে কথা বলা পাখি দেখার জন্যে রইসউদ্দিন, শিউলি এবং বল্টু তিনজনই জেগে রইল। ঠিক রাত বারোটার সময় মতলুব মিয়া এক গ্লাস পানি, একটা পিরিচে করে কিছু চাউল এবং একটা মোমবাতি নিয়ে হাজির হল। টেবিলে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে সে ঘরের লাইট নিভিয় দিল। বল্টু জিজ্ঞেস করল, “লাইট থাকলে কী হয়?”

মতলুব মিয়া ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “শ-স-স-স কোনো শব্দ না। এই পাখিকে জাগানোর সময় কড়া আলো কড়া শব্দ থাকতে পারবে না।”

রইসউদ্দিন, শিউলি এবং বল্টু তিনজনই নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল এবং মতলুব মিয়া খুব সাবধানে কালো কাপড়টি সরিয়ে নিল। তারা অবাক হয়ে দেখল খাঁচার মাঝখানে একটা মাঝারি সাইজের মুরগি বসে আছে। কথা বলা নিষেধ জেনেও শিউলি অবাক হয়ে চিৎকার করে উঠল, “আরে! এইটা দেখি মুরগি!”

মতলুব মিয়া চোখ পাকিয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “চুপ!”

শিউলি চুপ করে যাবার পর মতলুব মিয়া গ্লাস থেকে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে মুরগির গায়ে ছিটিয়ে দিতেই মুরগি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল। মতলুব মিয়া তখন হাতে কয়টা চাউল নিয়ে খাঁচার দরজা দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল, কিন্তু মুরগি সেটা খাবার কোনো উৎসাহ দেখাল না, খাঁচার এক কোণায় সরে গেল। মতলুব মিয়া বলল, “খাও জরিনা একটু চাউল খাও।”

বল্টু জিজ্ঞেস করল, “মুরগি কথা বলতে পারে?”

“হ্যাঁ।” মতলুব মিয়া মাথা নাড়ল, “মুরগি বোলো না, মনে দুঃখু পাবে। নাম জরিনা।”

“মুরগির নাম জরিনা?”

“হ্যাঁ। সব কথা বলতে পারে।” মতলুব মিয়া মুরগির দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল, “বলো জরিনা, নাম বলো।”

সবাই কানখাড়া করে রইল, মুরগি কোনো শব্দ করল না। মতলুব মিয়া গলায় মধু ঢেলে বলল, “বলো জরিনা সুন্দরী! লজ্জা কোরো না।”

মুরগি এবারের কক কক করে একটু শব্দ করল। বল্টু হাততালি দিয়ে বলল, “বলেছে! নাম বলেছে।”

শিউলি মাথা নেড়ে বলল, “নাম বলেছে কক কক। জরিনা তো বলে নাই।”

রইসউদ্দিন এতক্ষণ একটা কথাও না বলে চুপ করে পুরো ব্যাপারটা দেখছিলেন। এবারে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “মতলুব মিয়া!”

“জে?”

“আসলেই তোমার মুরগি কথা বলে?”

“জে ভাই।”

“তোমার নিজের কানে শুনেছ?”

“জে। নিজের কানে শুনেছি।”

“কী কথা বলেছে?”

“নাম জিজ্ঞেস করলে বলে জরিনা সুন্দরী। বাড়ি জিজ্ঞেস করলে বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া।”

“ব্রাহ্মণবাড়িয়া? রইসউদ্দিন চোখ কপালে তুলে বললেন, “একটা মুরগি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বলতে পারে? এত কঠিন একটা শব্দ?”

মতলুব মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, “ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুরগি তো বাড়ি নেত্রকোনা বলতে পারে না।”

“আর কী কী কথা বলে?”

“আলুর পাতা থালু থালু কবিতাটা বলতে পারে।”

“পুরো কবিতাটি বলে?”

“জে।”

রইসউদ্দিন নিঃশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লেন। মতলুব মিয়া বলল, “অনেক পাছড়াপাছড়ি করলে গানও গাইতে পারে।”

“গানও গাইতে পারে? কী গান?”

“রঙিলা ভাবি গো–তবে গানের গলা বেশি ভালো না।”

“তুমি নিজের কানে শুনেছ?”

“জে। আপনি শুনবেন ভাই?”

“শোনাও দেখি।”

মতলুব মিয়া খাঁচার সামনে উবু হয়ে বলল, “জরিনা সুন্দরী! একটা গান শোনাও দেখি আমাদের! রঙিলা ভাবির গান! শোনাও! শোনাও দেখি–”

মুরগির গান শোনানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। মতলুব মিয়া খাঁচা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “শোনাও একটা গান। ভালো হবে না কিন্তু! অনেক রাগ হবে কিন্তু! শোনাও গান।”

মুরগি খানিকটা পেয়ে পেয় মাথা উঁচু কর কক কক করে একবার শব্দ করল। মতলুব মিয়া এবারে সত্যি সত্যি রেগে গেল, খাঁচাটা জোরে জোরে কয়েকটা ঝাঁকুনি দিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “কথা বল বেটি। বল কথা, না হলে এক আছাড় দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেব, আবাগীর বেটি। মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলব কিন্তু।

রইসউদ্দিন একটা হাই তুলে বললেন, “মতলুব মিয়া, তোমাকে বোকা পেয়ে কেউ একজন ঠকিয়ে দিয়েছে। মুরগি কোনোদিন কথা বলে না। মুরগি যদি কথা বলত তা হলে তুমিও আইনস্টাইন হয়ে যেতে।”

মতলুব মিয়া কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু আমি নিজের কানে কথা বলতে শুনেছি!”

“কী শুনেছ, কীভাবে শুনেছ আমি জানি না–কিন্তু আমার কাছ থেকে তুমি শুনে রেখো, তোমার বুদ্ধি আর ঐ মুরগির বুদ্ধির মাঝে বিশেষ পার্থক্য নাই।”

রইসউদ্দিন ঘুমাতে চলে গেলেন। শিউলি আর বল্টু মতলুব মিয়ার সাথে আরও ঘণ্টাখানেক মুরগিকে কথা বলানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। মতলুব মিয়া হাল ছাড়ল না, সারারাত মুরগির পেছনে লেগে রইল। শেষরাতে রইসউদ্দিনের ঘুম যখন একটু হালকা হয়ে এল, শুনতে পেলেন মতলুব মিয়া ভাঙা গলায় কাকুতি-মিনতি করছে, তোর দোহাই লাগে জরিনা বেটি–তোর পায়ে ধরি জরিনা–একটা কথা বল। বেশি লাগবে না, মাত্র একটা শব্দ! মাত্র একটা শব্দ! বল আবাগীর বেটি! বল সোনার চান আমার পিঞ্জিরার পক্ষী! বল একবার চেষ্টা করে দেখ, আমি জানি তুই পারবি। পাঁচশো টাকা দিয়ে তোরে কিনে এনেছি–আমারে তুই পথে বসাবি না। আল্লাহর কসম লাগে–”

সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে রইসউদ্দিন দেখলেন মতলুব মিয়া মুরগির খাঁচাটিকে সামনে নিয়ে বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি এবং চোখ টকটকে লাল। মতলুব মিয়ার অবস্থা দেখে রইসউদ্দিন তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। শিউলি স্কুলে যাবার সময় দেখল মতলুব মিয়া হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। দুপুরবেলা বল্টু যখন হাঁটতে বের হল মতলুব মিয়া তখনও তার মুরগির খাঁচার সামনে বসে আছে।

.

বিকেলবেলা বাসায় ফিরে এসে রইসউদ্দিন একটা বিচিত্র জিনিস দেখতে পেলেন–ঘরের পিলারের সাথে একটা আট-দশ বছরের ছেলে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তার সামনে মতলুব মিয়া শিউলি এবং বল্টুকে নিয়ে বসে আছে। মতলুব মিয়ার চেহারা আনন্দে ঝলমল করছে, রইসউদ্দিনকে দেখে সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল, “ভাই কেস কমপ্লিট।”

“কিসের কেস কমপ্লিট? আর এই ছেলে কে? দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছ কেন?”

“পালিয়ে যেন না যায়।”

“পালিয়ে কোথায় যাবে? কী করেছে এই ছেলে?”

“এই হচ্ছে মুরগির ব্যাপারী।”

“যার কাছ থেকে তুমি কথা-বলা মুরগি কিনেছে?”

“জে।”

রইসউদ্দিন অবাক হয়ে সাত-আট বছরের মুরগি-ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। গায়ের রং নিশ্চয়ই একসময় ফরসা ছিল, এখন রোদে পুড়ে বাদামি হয়ে গেছে। চোখ দুটি চকচক করছে, দেখলেই মনে হয় এর পেটে পেটে অনেক বুদ্ধি। রইসউদ্দিন বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি মতলুব মিয়াকে মুরগি বিক্রি করেছ?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল।

”তুমি নাকি বলেছ তোমার মুরগি কথা বলে?”

ছেলেটা আবার মাথা নাড়ল। রইসউদ্দিন বললেন, “মুরগি তো কখনো কথা বলে না।”

ছেলেটা কোনো কথা না বলে ঠোঁট ওলটাল।

মতলুব মিয়া এগিয়ে এসে বলল, “তুই মুরগিকে আবার কথা বলাতে পারবি? ছেড়ে দেব তা হলে। পারবি?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। মতলুব মিয়া তখন ঘরের ভেতর থেকে মুরগির খাঁচাটা নিয়ে এল, ছেলেটার সামনে রেখে বলল, “নে। কথা বলা।”

ছেলেটা এই প্রথম কথা বলল, “আমাকে আগে ছেড়ে দাও।” মতলুব মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “আগে কথা বলা।”

রইসউদ্দিন ধমক দিয়ে বললেন, “দড়ি খুলে দাও মতলুব মিয়া। একজন মানুষকে আবার বেঁধে রাখে কেমন করে?”

মতলুব মিয়া বিরসমুখে ছেলেটার হাতের বাঁধন খুলে দিল। ছেলেটা হাতে হাত বুলাতে বুলাতে মুরগির খাঁচার কাছে এগিয়ে গেল। মাথা নিচু করে মুরগিটাকে জিজ্ঞেস করল, “এই, তোর নাম কী?

মুরগিটা মাথা উঁচু করে ছেলেটার দিকে তাকাল, কিছু বলল না। ছেলেটা খাঁচা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ কী নাম?”

সাথে সাথে সবাই স্পষ্ট শুনল মুরগিটা বলল, “জ-রি-না।”

ছেলেটা উঠে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মতলুব মিয়া হাতে কিল দিয়ে বলল, “শুনেছেন ভাই? শুনেছেন?”

রইসউদ্দিন হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। শিউলি আর বল্টু খাঁচার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নাম কী? নাম কী তোর?”

মুরগিটা বারকয়েক কক কক করে হঠাৎ আবার স্পষ্ট গলায় বলল, “জ-রি-না সুন্দরী!”

শিউলি আর বল্টু লাফিয়ে উঠল আনন্দে।

রইসউদ্দিন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, হঠাৎ করে তাঁর মনে হল তিনি ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পেরেছেন। তার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে, একটুকু ছেলে–কিন্তু কী ধুরন্ধর! ছেলেটা মতলুব মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যাই।”

রইসউদ্দিন বললেন, “দাঁড়াও ছেলে।”

ছেলেটা শঙ্কিতমুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”

“কুকন।”

“কুকন? কুকন কি কারও নাম হয়? নিশ্চয়ই তোমার নাম খোকন। তাই না?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল। রইসউদ্দিন বললেন, “তুমি নিজের নামটাও ঠিক করে উচ্চারণ করতে পার না আর এরকম ভেন্ট্রিলোকুইজম কেমন করে শিখলে?”

ছেলেটা মাথা ঘুরিয়ে রইসউদ্দিনের দিকে তাকাল। রইসউদ্দিন বললেন, “ভেন্ট্রিলোকুইজম মানে জান? মুখ না নাড়িয়ে কথা বলা যেন মনে হয় অন কেউ কথা বলছে।”

মতলুব মিয়া হঠাৎ চোখ বড় বড় করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নাক দিয়ে ফেস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কী? কী বলছেন ভাই?”

“তোমার মুরগি কখনো কথা বলে নাই মতলুব মিয়া। কথা বলে খোকন, মনে হয় বলছে মুরগি। তাই যখন খোকন আশেপাশে থাকে না তখন তোমার মুরগিও কথা বলে না।” রইসউদ্দিন খোকনের দিকে তাকালেন, বললেন, “তাই না খোকন?”

খোকনের মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে হঠাৎ উঠে একটা দৌড় দেবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগই মতলুব মিয়া তাকে জাপটে ধরে ফেলেছে। শুধু যে ধরেছে তাই নয় নাকেমুখে কিল-ঘুসি মারা শুরু করেছে। রইসউদ্দিন, শিউলি আর বল্টু একসাথে ছুটে গিয়ে খোকনকে মতলুব মিয়ার হাত থেকে ছুটিয়ে নিল। শিউলি আর বল্টু মিলে মতলুব মিয়াকে ধরে রাখতে পারল না, রাগে ফোঁসফোঁস করে সে হাত-পা নেড়ে চিৎকার করতে করতে বলল, “ব্যাটা বদমাইশ, জোচ্চুর। ঠগের বাচ্চা ঠগ। চোরের বাচ্চা চোর। হারামখোরের বাচ্চা–”

রইসউদ্দিন প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, “মতলুব মিয়া, খবরদার ঘরের মাঝে আজেবাজে কথা বলবে না। এইটুকুন একটা ছেলের গায়ে হাত তোল, তোমার লজ্জা করে না? আরেকবার করেছ কি তোমাকে আমি পুলিশে দেব।”

মতলুব মিয়া গজগজ করতে লাগল, রইসউদ্দিন তখন খোকনকে পরীক্ষা করলেন। নাকে বেকায়দা ঘুসি লেগে খানিকটা রক্ত বের হয়ে এসেছে, রুমাল দিয়ে মুখে মুখ ধুইয়ে দেওয়া হল। বল্টু মগে করে পানি এনে তার মুখ ধুয়ে দিল। শিউলি একগ্লাস লেবুর শরবত তৈরি করে নিয়ে এল। শরবত খেয়ে একটা ঢেকুর

তুলে খোকন বলল, “আমি গেলাম।”

মতলুব মিয়া প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “আমার টাকা!” বল্টু দাঁত বের করে হেসে বলল, “তোমার টাকা গেছে মতলুব চাচা।”

শিউলি খোকনের ঘাড়ে থাবা দিয়ে বলল, “কই যাবি? আজ রাতটা আমাদের সাথে থেকে যা।”

“থেকে যাব?”

“হ্যাঁ। তুই কেমন করে ভেন্টি-কুন্টি করিস আমাদের দেখা–”

রইসউদ্দিন হেসে বললেন, “শব্দটা ভেন্টি-কুন্টি না। শব্দটা ভেন্ট্রিলোকুইজম।”

শিউলি কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঐ একই কথা।”

বল্টু রইসউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচা। খোকন আজ রাতে এখানে থাকুক?”

রইসউদ্দিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে থাকুক।”

রাত্রিবেলা জরিনা সুন্দরীকে কেটেকুটে রান্না করা হল, মতলুব মিয়ার রান্না খুব যে ভালো হল তা বলা যাবে না, কিন্তু সবাই খেলা খুব তৃপ্তি করে। সবচেয়ে মজা হল খাবার পর, যখন সবার পেটের ভেতর থেকে জরিনা সুন্দরী কথা বলতে শুরু করল! হেসে সবাই কুটিকুটি হয়ে গেল খোকনের কাণ্ড দেখে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *