সকাল হয়েছে বলে জীবনে এই বোধ হয় প্রথম খুশি হলাম। নইলে অন্য দিন তো প্রায় রোজই আমাকে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামাতে হয়। শুধু যে মাজন-টাজন নেই বলে দাঁত মাজতে হবে না তা নয়, উঠে দেখি রাত্রের ভয়-ভাবনাগুলো দিনের আলোতে দিব্যি মেঘের মতো কেটে গেছে। তবে থেকে থেকে খালি খালি মনে হতে লাগল, তবে কি শ্যামাদাসকাকা ভেলকি জানে? মালা এল কোত্থেকে? এটা যে সে মালা হতেই পারে না, সে-কথা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি।
জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি শেষটি সত্যি সত্যি সূর্য উঠেছে। বৃষ্টির জলে-ধোয়া গাছের পাতায় পাতায় আলো লেগেছে। গাছের মাঝে মাঝে ঝোলানো বিশাল আটকোনা সব মাকড়সার জাল রোদ লেগে ঝিকমিক করছে।
নীচে থেকে শুনলাম গোরুটা যেন খুশি হয়ে ডাকছে, কিছু পেয়েছে-টেয়েছে হয়তো। ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখি রাত জাগার পর ওরা তিন জনেই অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
কী নিয়ে যে ওদের এত ভাবনা ভেবেই পেলাম না। অন্য সময় তো বিরিঞ্চিদার মুখ দেখলেই ঠানদিদির পিত্তি জ্বলে যায়, যা খুশি তাই বলেন। আর শ্যামাদাসকাকাকে পেলে বিরিঞ্চিদাকে ছেড়ে ওকে আগে ধরেন। আর এখন সারাদিন এক গাড়িতে, সারারাত এক ঘরে, অথচ একটা রাগের কথা নেই! এ ভাবা যায় না।
দেখতে দেখতে রোদে ঘর ভরে গেল, ওদের মুখে রোদ পড়ল। বাইরের পাখিরাও মহা গোলমাল শুরু করে দিল। একে একে ওরা সব উঠে বসল। চোখের নীচে কালি, বড়োরা যেমন সকালবেলা চা না পেলে বিরক্ত হয়ে যায়, তেমনি মুখ করে সব কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর উঠে মুখ-টুক ধুয়ে তবে কথা বলতে লাগল।
যতই কথা বলে, মনের ফুর্তিও দেখি ততই বেড়ে যায়। ঠানদিদি বিরিঞ্চিদাকে বললেন, যাক, তাহলে বোধ হয় তোর আর কোনো ভাবনা
বিরিঞ্চিদা আমার দিকে চেয়ে বলল, স-স-স।
আবার একটু বাদেই বিরিঞ্চিদা খুশি হয়ে শ্যামাদাসকাকাকে বলল, কে জানে, বোধ হয় মরেনি, এমনও তো হতে পারে।
শ্যামাদাসকাকা ভীষণ চমকে উঠে বলল, চোপ, ইডিয়ট।
মনে হল রাতের বিপদ কেটে যাওয়াতে ওরা সব অসাবধান হয়ে পড়েছে। হাসি পেল। এমনি সময় জঙ্গলের ভিতর দিয়ে মনে হল মেলা লোজন আসছে।
জানলার কাছে গিয়ে বাইরে চেয়ে দেখে বললাম, যাক, আর আমাদের কোনো ভয় নেই! পাঁচ-সাতজন পুলিশ-টুলিশ এসে পড়েছে।
যেইনা বলা অমনি ঠানদিদি আর শ্যামাদাসকাকা হুড়মুড় করে গিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকল।
আমি আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখে, ওদের সাহস দেবার জন্য ডেকে বললাম, কোথায় যাচ্ছ? বলছি না কোনো ভয় নেই। ওই তো ওদের সঙ্গে সেজোদাদামশাই, বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই সবাই রয়েছেন।
ও মা, অমনি বিরিঞ্চিদাও পড়িমরি করে ছুটে স্নানের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিল।
আমি তো প্রায় মুচ্ছো যাই আর কী! মনে হল তবে নিশ্চয় আমারও গা ঢাকা দেওয়া উচিত। স্নানের ঘরের দরজায় কত ধাক্কাধাক্কি পেড়াপীড়ি করলাম, কোনো ফল হল না।
শেষ অবধি আর কিছু ভেবে না পেয়ে, জুতো পায়ে দিয়ে খাটের তলায় গিয়ে ঢুকলাম। আমার নতুন জুতো রে বাবা, কী দরকার ফেলে রেখে।
ততক্ষণে ওরাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। আধ মিনিট বাদে দরজায় টোকা।
আমি একেবারে চুপ।
হেঁড়ে গলায় কে ডেকে বললে, ভবিষ্যতে যদি ভালো চান তো বন্দুক- টন্দুক যা সঙ্গে আছে দরজার বাইরে ফেলে দিন। আর নিজেরা মাথার উপরে হাত তুলে, দরজার দিকে মুখ করে সারি সারি দাঁড়িয়ে যান।
আমি নিশ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে থাকলাম। তারপর আরও মোটা.গলায় কে বললে, দেখুন, যা হবার তা হয়ে গেছে, আর কেন অপরাধ বাড়াচ্ছেন? নিজেদের ভালোর জন্য বেরিয়ে আসুন।
আমি যেমন শুয়েছিলাম তেমনি রইলাম।
এবার বিরিঞ্চিদার পিসেমশাই নিজেই রেগেমেগে চেঁচিয়ে বললেন, কী বললেন সবটা বোঝা গেল না, বেশ ইয়ে-টিয়েই বললেন, তার মোটামুটি মানে দাঁড়ায়– দ্যাখ বিরিঞ্চি, কী ভেবেছিস তুই? যা ইচ্ছে তাই করবি আর পার পেয়ে যাবি? ভালো চাস তো দরজা খোল।
কে জানি আবার একটু দূর থেকে বলল, দরজাটা ভেঙে ফেলুন-না, মশাই!
পিসেমশাই বললেন, হ্যাঁ, তাই করি আর গোলা খেয়ে আমার মুণ্ডুটাই উড়ে যাক আর কী!
পেছন থেকে সেজোদাদামশাই বললেন, কেন বাবা, তোমরা সরকারের মাইনে খাও, তোমরাই দরজা ভাঙো-না কেন! তা ছাড়া তোমরা মরেটরে গেলে তো পেনসিল পাবে, তোমাদের আবার অত ভয় কীসের?
এমন কথা শুনে পুলিশরা প্রথমটা চুপ। তারপর পাঁচ-সাত জন মিলে গলা খাঁকরে, বুট ঘষে, লাঠি ঠুকে, খুব আওয়াজটাওয়াজ করে, ভয় দেখাবার চেষ্টা করতে লাগল। এমনি সময় একতলা থেকে বুড়ি এসে হাজির। আধ সিঁড়ি উঠেই, হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচিয়ে বলল, ওমা, কী সব বীরপুরুষ গো! দরজার তো ভিতরকার ছিটকিনিই লাগে না।
আর কী, হুড়মুড়িয়ে সব ভেতরে এল। এসে দেখে ভোঁ ভাঁ, কেউ কোথাও নেই! একি সত্যি ভেলকি নাকি? অতগুলো লোক গেল কোথায়?
ঠ্যাং দেখে বুঝলাম, দাঁড়িওয়ালা লোকটা, কানে-মাকড়ি ছেলে, বুড়ি সব আছে। স্নানের ঘরের রজার দিকে চোখ পড়তে সবাই মিলে মহা গোলমাল শুরু করে দিয়েছে। এবার দরজা যে সত্যি বন্ধ সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই।
আমারও হাত-পা পেটে সেঁদিয়েছে। দরজা খুললেই কী কাণ্ডটা না জানি হবে।
এ ঘরটা খালি দেখে ভারি সাহস বেড়ে গেছে ওদের, দু-চারটে ষণ্ডা লোক দু-চার বার ধাক্কা দিতেই মরচে ধরা কবজা ভেঙে দরজা গেল খুলে।
আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এবার ঠানদিদি টেরটা পাবেন! ভেবে খুব খারাপ লাগল না। কিন্তু এমন অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ কেন?
নিজের বিপদের কথা ভুলে গিয়ে, খাটের তলা থেকে মুণ্ডু বের করে দেখতে চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কী।
গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। স্নানের ঘরে কেউ নেই! এইমাত্র তিন-তিনটে ধেড়ে লোককে ঢুকতে দেখলাম আর এখন দেখি কেউ কোথাও নেই! ওদিকে ঘরে আরেকটা দরজা নেই যে পালাবে। একটা ছোট্ট জানলা আছে বটে, তাও মাটি থেকে দশ ফুট উঁচুতে, আবার মোটা মোটা গরাদ লাগানো। তা ছাড়া সেসব খুলে ফেললেও বেড়াল-টেড়াল ছাড়া অন্য কিছু গলবে না সেখান দিয়ে।
এমনি আশ্চর্য হয়ে গেছলাম যে মুণ্ডুটা টেনে খাটের তলায় নিয়ে যেতে ভুলেই গেছলাম!
আর যায় কোথায়! একটা এই মোটা পুলিশ, কথা নেই বার্তা নেই, অমনি আমার দুকান ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে এল। আমি প্রাণপণে খাটের পায়া আঁকড়ে ধরলাম, কিন্তু তাতে কোনো সুবিধে হল না!
তখন সবাই মিলে আমাকে নিয়ে সে যে কী লাগিয়ে দিল সে আর বলার নয়। আমি তো ভেবেছিলাম টানাটানির চোটে এই ছিঁড়েই গেলাম আর কী! এত করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, তা কে কার কথা শোনে! বিরিঞ্চিদার পিসেমশায় আর সেজোদাদামশায় যে কী খারাপ কথা বলতে পারেন!
বার বার বললাম, আমি কী জানি! স্পষ্ট দেখলাম তিন জনে হুড়মুড় করে গিয়ে স্নানের ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিল, এখন নেই বললে তো আর হবে না। নিশ্চয়ই আছে ওইখানেই কোথাও, ভালো করে খুঁজলেই বেরিয়ে পড়বে। আর না-ই যদি থাকে, সেও কি আমার দোষ? যাবে আবার কোথায়, খুঁজে দেখোনা, নিশ্চয় পাবে।
সেজোদাদামশাইয়ের সে কী রাগ! বাবার বিষয় পর্যন্ত কী সব বলতে লাগলেন। শেষ অবধি একটা পুলিশের কাছে আমাকে জিম্মা করে দিয়ে সবাই মিলে বিষম খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিল।
প্রথমটা তো সেখান থেকে ওরা নড়তেই চায় না, বারে বারে আমাকে জিজ্ঞেস করে তোক তিনটেকে কী করেছি।
শেষে বললাম, খায়ো
রাগের সময় আমার কীরকম হিন্দি বেরিয়ে যায় বললাম, যদি গিলেই ফেলে থাকি, তবু স্নানের ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে কেমন করে বন্ধ করলাম বলতে পার?
তাই শুনে ওরা খানিকটা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিয়ে শেষটা খানাতল্লাশি আরম্ভ করে দিল। সেজোদাদামশাই আর পিসেমশাইও ওদের সঙ্গে চললেন; সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন না। আমার তো তাতে কলাও হল না।