০৫. এই পৃথিবী আবহমান কাল থেকে

এই পৃথিবী আবহমান কাল থেকে ঘুরে চলেছে; এক মুহূর্তের ভগ্নাংশ সময়ের জন্যও এই বিচিত্র বিস্ময়কর পৃথিবীতে যে মানুষের বাস, তাদের অদৃষ্টের চাকাও নিত্য ঘুরে চলেছে সবকিছু তুচ্ছ করে। মানুষের শত অনুরোধ উপরোধ আকুতি মিনতিতেও অদৃষ্টের চাকা এক পলের জন্য থমকে দাঁড়ায় না।

অদৃষ্ট যেমন নির্মম, তেমনই উদাসীন ও রহস্যময়। তার মনের কথা কেউ জানতে পারে না।

সব মানুষই কত হিসেব-নিকেশ করে, কত স্বপ্ন দেখে ভবিষ্যতের কিন্তু অদৃষ্টের নিছক খামখেয়ালীপনায় তা স্রোতের জলে খড়ের কুটোর মত ভেসে যায়। তাইতো অতীত দিনের জমিদারদের উত্তরপুরুষ কলকাতার রাজপথে হকার হয় আবার দীন-দরিদ্রের সন্তান খ্যাতি-যশ-অর্থ-প্রতিপত্তির স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়ায়। শত সহস্র কোটি টাকার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী অর্থের লোভ ও পরমা সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর মোহ ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়; আবার কামিনী ও কাঞ্চনের মোহে কত অজস্র মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে সারাজীবন হাহাকার করে।

কেউ জানে না কেন একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে গর্ভধারিনীকে সারাজীবন চোখের জল ফেলতে হয় ও বহু সন্তানের জননীকে সন্তানদের মুখে দু’মুঠো অন্ন জোগাবার জন্য দরজায় দরজায় ভিক্ষা করতে হয়।

সব মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু অঘটন ঘটবেই। সুখী পরিবারেও কোন কোন সময় ছন্দপতন ঘটবেই। জীবন-পথের সব যাত্রীকেই হোঁচট খেতে হবেই।

.

মাস খানেক পরের কথা।

রাত তখন প্রায় দশটা। একটু আগেই খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে। সুব্রতবাবু শুতে যাবার উদ্যোগ-আয়োজন করছেন। ঠিক সেই সময় টেলিফোন।

হ্যালো দাদা, আমি আপনার মা জননীর বাবা বলছি।

হ্যাঁ, ভাই, বলুন কি ব্যাপার।

দাদা, হঠাৎ একটা গুরুতর সমস্যায় পড়েছি।

সুব্রতবাবু অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে বলেন, হঠাৎ কোন বিপদ ঘটলো নাকি?

না, তেমন কিছু না।

তবে?

আপনার ও দিদিদের সঙ্গে খুব জরুরী ব্যাপারে আলোচনা করতে চাই।

কি জরুরী ব্যাপার জানতে পারি কি?

দাদা, যখন দেখা হবে, তখন সব কথা বলব।

কবে দেখা করতে চান?

এখন তো রাত হয়েছে; তা নয়তো আজই আলোচনা করতে পারলে ভাল হতো।

মিঃ চৌধুরী না থেমেই বলেন, দাদা, কাল কখন আসব বলুন।

কাল আমারও অফিস আছে, আপনার দুই দিদিরও কলেজ আছে।…

হ্যাঁ, তা তো আছে।

কাল আমি না হয় একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরব আপনি সাড়ে ছ’টা সাতটায় আসুন।

দাদা, আমি আর সুনন্দা সাড়ে ছ’টাতেই পৌঁছে যাবো।

ঠিক আছে, তাই আসবেন।

.

টেলিফোনে স্বামীর দু’একটা কথা শুনেই ভারতী বুঝেছেন, কোন গুরুতর ব্যাপার। তাই উনি সঙ্গে সঙ্গে শিবানীকে ডেকে পাঠান।

সুব্রতবাবু রিসিভার নামিয়েই দেখেন, ভারতী আর শিবানী পাশে দাঁড়িয়ে। বেশ চিন্তিত হয়েই উনি ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলেন, ঠিক বুঝতে পারছি না কি এমন গুরুতর সমস্যা হলো যে কালই…

ওনার কথা শেষ হবার আগেই ভারতী বলেন, কোন কারণে ওরা এই বিয়ে ক্যানসেল করতে চাইছেন বলে কি তোমার মনে হলো?

উনি তো কোনকিছুই খুলে বললেন না।

শিবানী বলেন, বাবাই সোনার মতো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে ওদের কখনই কোন আপত্তি থাকতে পারে না। আমার মনে হয়, অন্য কোন সমস্যা নিয়ে ওরা কথা বলতে…

ভারতী বলেন, অন্য কি সমস্যা হতে পারে?

উনি না থেমেই বলেন, দুর্বা কোন ছেলেকে ভালবেসে বিয়ে করতে চায়নি, বাবাই কোন খারাপ কাজ করে, তেমন কথাও কেউ ওদের বলতে পারে না…

না, না, সেসব না।

তবে আবার কি সমস্যা? আমরা কি দু-একশ ভরি সোনা বা লাখ লাখ। টাকা নগদ চেয়েছি যে…

সুব্রতবাবু বলেন, এসব আলোচনা করে কোন লাভ নেই। দেখা যাক, কাল ওরা কি বলেন।

শুধু সে রাত না পরের দিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ওরা যে কি অস্বস্তিতে কাটান, তা ভাবা যায় না। কাজকর্মের ফাঁকে ওরা যখনই একটু সময় পেয়েছেন, তখনই কত ভাল-মন্দ কথা ওদের মনে আসে।

দুপুরের দিকে এক অফ পিরিয়ডে ভারতী শিবানীকে বলেন, হারে, আমি সুনন্দাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করব কি ব্যাপার?

না, কখনই না।

কেন বলতো?

যে কথা মিঃ চৌধুরী টেলিফোনে দাদাকে বললেন না, সেই কথা ও তোকে বলে দেবে?

তা ঠিক কিন্তু…

তাছাড়া আমাদেরও তো আত্মসম্মান আছে।

শিবানী না থেমেই বলেন, নেহাত আন্দাজ করে বা তর্কের খাতিরে বলছি, যদি ওরা কোন কারণে বাবাই সোনার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে না চায়, তাহলে…

হ্যাঁ, বুঝেছি… দ্যাখ ভারতী, ওদের মেয়ের সঙ্গে আমাদের ছেলের বিয়ে দেবার জন্য আমরা সীমা ছাড়িয়ে আগ্রহ দেখিয়েছি।…

তা ঠিক।

আমরা শুধু মেয়েটাকে ভালবাসিনি,ওর মা-বাবাকেও যথেষ্ট খাতির-যত্ন করেছি, ভালবেসেছি। এখন সুনন্দাকে ফোন করলে প্রায় হ্যাংলামির পর্যায়ে চলে যাবে।

ভারতী চুপ করে থাকেন।

শিবানী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, অধৈর্য হয়ে লাভ নেই। দেখাই যাক ওরা কি বলেন।

হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস, সুনন্দাকে টেলিফোন করা ঠিক হবে না।

ওদের ক্লাশ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ওরা ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরে যান। সাড়ে পাঁচটা বাজতে না বাজতেই সুব্রতবাবুও বাড়ি ফিরে আসেন।

.

সাড়ে ছ’টায় না, ঠিক পৌনে সাতটায় মিঃ চৌধুরী সস্ত্রীক এসে যান।

সুব্রতবাবু আর ভারতী ওদের অভ্যর্থনা করে শিবানীর বাড়ি নিয়ে যান। শিবানী প্রায় ছুটে এসে বলেন, পর পর দুটো টেলিফোন এল বলে সব ঘরে ধূপ দিতে দেরি হয়ে গেল।

সুনন্দা বলে, সব ঘরে ধূপ দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ, ভাই, হয়েছে।

সুব্রতবাবু বলেন, বৌমা আমার ভাইয়ের ছবিগুলোর সামনে প্রথমে ঘুম থেকে উঠে, তারপর স্নান করে, আবার সন্ধেতে আর রাত্তিরে শুতে যাবার আগে ধূপ। দেন।

কেউ কোন কথা বলেন না।

শিবানী একটু হেসে বলেন, আর তো কিছু দেবার সেই তাই ধূপ দিই বার বার।

ভারতী ওর হাত ধরে বলেন, আয়, আমার পাশে…

হ্যাঁ, বসছি। সারদাকে…

ওনাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সুনন্দা বলেন, শিবানী, প্লীজ এখনই সারদাকে কফি করতে বলল না। আমরা চা-টা খেয়েই রওনা হয়েছি।

সুব্রতবাবু বলেন, ঠিক আছে বৌমা, একটু পরেই কফি করতে বলো।

উনি সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন, হ্যাঁ, ভাই, বলুন, কি ব্যাপার।

মিঃ চৌধুরী শুরু করেন, দাদা, আমাদের ফরিদাবাদের ফ্যাক্টরীতে একটা নতুন ইউনিট খোলার ডিসিশন নেওয়া হয় কয়েকবছর আগেই। সব শুদ্ধ প্রায় সওয়া দুশ কোটি টাকার প্রজেক্ট।

তার মানে কোয়াইট এ বিগ প্রজেক্ট।

হ্যাঁ, দাদা, বেশ বড় প্রজেক্ট।

উনি একটু থেমেই বলেন, গ্লোবাল টেন্ডার ডাকা হয়; তারপর সুইডিস, জার্মান আর ব্রিটিশ ফার্মের অফার ইভ্যালুয়েট করার জন্য দু’জন চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে পাঠানো হয়…

হ্যাঁ, এসব তো করতেই হবে।

যাইহোক ব্রিটিশ ফার্মের অফারই শেষ পর্যন্ত অ্যাকসেপ্ট করা হয়েছে; দাম ঠিক হয়েছে একশ বত্রিশ কোটি টাকা।

নাউ হোয়াট ইজ দ্যা প্রবেলম?

দাদা, ঐ মেসিনের ব্যাপারে আমাদের চারজন ইঞ্জিনিয়ারকে দু’বছর গ্লাসগোতে থাকতে হবে এবং ব্রিটিশ ফার্ম আর আমাদের ডিরেক্টররা ঠিক করেছেন, আমাকে ঐ টিমের লীডার হতে হবে।

এতো খুব ভাল খবর।

মিঃ চৌধুরী একটু হেসে বলেন, এই পর্যন্ত সত্যি ভাল খবর কিন্তু এর পর যা বলব, তা বোধ হয় ভাল লাগবে না।

ভারতী বলেন, কেন ভাই?

দিদি, দু’বছরের ব্যাপার বলে আমাদের সস্ত্রীকই যেতে হবে। ব্রিটিশ ফার্ম আমাদের ওখানকার সব খরচ-পত্তর দেবে আর আমাদের কোম্পানী শুধু আমাদের প্লেন ভাড়া দেবে।

শিবানী বলেন, সুনন্দা আপনার সঙ্গে গেলে সমস্যা কি?

বলছি, বলছি।

মিঃ চৌধুরী মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, আমি কাল বিকেলেই লন্ডন থেকে ফ্যাক্স পেলাম কবে রওনা হতে হবে। বাংলা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সেই তারিখ মিলিয়ে দেখলাম, ২৯শে শ্রাবণ রাত্রে আমাদের রওনা হতে হবে।

ভারতী আর শিবানী দৃষ্টি বিনিময় করেন। সুব্রতবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আই সী।

দাদা, আমি অফিস থেকেই আমাদের পুরোহিতের কাছে যাই। উনি বললেন, ২৩শে ও ২৫শে বিয়ের দিন আছে।

একটু ভেবেই সুব্রতবাবু বলেন, তার মানে অগাস্ট মাসের পাঁচ-সাত বা আট ন’ তারিখ হবে।

হ্যাঁ, দাদা, ঠিক বলেছেন।

সুব্রতবাবু খুব জোরে নিঃশ্বাস নিয়েই বলেন, তাতাই সোনার ফাইন্যাল পরীক্ষা শুরু হবে বোধহয় তার কয়েক দিনের মধ্যেই। সুতরাং সে সময় বিয়ে হলে ওর পক্ষে আসা কোনমতেই সম্ভব হবে না অথচ…

সুব্রতবাবু কথাটা শেষ করেন না, শেষ করতে পারেন না।

সুনন্দা বলে, দাদা, আমরাও খুব ভাল করে বুঝি যে তাতাই না থাকলে এই বিয়ের কথা আপনারা ভাবতে পারেন না।

হ্যাঁ, বৌমা, ঠিকই বলেছ।

আমাদের দুজনের চাইতে ময়না আরো ভাল করে জানে, তাতাইয়ের অনুপস্থিতিতে ওদের বিয়ে হতে পারে না। তাইতো ও আমাকে বলছিল, তোমরা চলে যাও, আমি ছোট মা-র কাছে থাকব। ছোট মা আমার বিয়ে দিয়ে দেবেন।

সেই শুনে সুব্রতবাবু আর ভারতী-শিবানীও না হেসে পারেন না।

সুব্রতবাবু বলেন, না, বৌমা, তা হয় না। হাজার হোক মা জননী আপনাদের একমাত্র মেয়ে। আপনাদের অনুপস্থিতিতে কখনই ওর বিয়ে হতে পারে না।

মিঃ চৌধুরী ওনার দুটো হাত ধরে বলেন, দাদা, আপনি বলুন কি করা যায়। আমরা তো ভেবে কোন কুলকিনারা পাচ্ছি না।

ভাই, আমরাও খুব চিন্তায় পড়লাম। এক্ষুনি আপনাকে কিছু বলতে পারছি না। আমাদের কয়েক দিন সময় দিন। আমরা আলাপ আলোচনা করে দেখি, কি করা যায়।

কিন্তু দাদা, হাতে সময় খুব কম।

হ্যাঁ, তাও জানি কিন্তু আমরা নিজেদের মধ্যে একটু কথা না বলে তো…

হ্যাঁ, দাদা, নিশ্চয়ই আপনারা আলোচনা করুন।

আপনি চিন্তা করবেন না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনাকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব।

কফি-টফি খেয়ে মিঃ চৌধুরী ও সুনন্দা বিদায় নেবার পরই সুব্রতবাবু শিবানীর দিকে তাকিয়ে বলেন, বলো তো বৌমা, কি অদ্ভুত সমস্যায় পড়লাম। তাতাই সোনাকে বাদ দিয়ে বাবাইয়ের বিয়ের কথা তো আমি ভাবতেই পারি না।

উনি না থেমেই বলেন, বাবাইয়ের বিয়ের সবকিছুই তো ও করবে, আমরা শুধু পিছনে থাকব।

শিবানী বলেন, ওরাও খুবই সমস্যায় পড়েছেন।

ভারতী বলেন, বাবাই এইসব শুনলে তো সোজা বলে দেবে, ভাইয়া ছাড়া এই বিয়ে হতে পারে না।

সুব্রতবাবু বলেন, তা তো বলবেই।

উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, বিয়ের খবর শুনলেই তাতাই সোনা আনন্দে খুশিতে পাগল হয়ে যাবে কিন্তু ফাইন্যাল পরীক্ষার ঠিক আগে আগেই ওকে এই খবর জানালে ওর সত্যি খুব ক্ষতি হবে।

শিবানী বলেন, হ্যাঁ, দাদা, ওর মন তখন বিয়ের ব্যাপারেই নেচে উঠবে ও কিছুতেই পড়াশুনায় মন বসাতে পারবে না।

ভারতী বলেন, না, না, আমরা তাতাই সোনার এই ক্ষতি করতে পারি না।

ঠিক সেই সময় টেলিফোন।

.

রিসিভার হাতে না নিয়েই শিবানী বলেন, হ্যালো ও শিল্পী তুমি!

হ্যাঁ, ছোট মা, আমি। মা-বাবা কি এখনও তোমাদের ওখানে আছেন?

না, মা; ওরা মিনিট দশেক আগেই রওনা হয়েছেন।

মা কি বলেছে, বিয়ের ব্যাপারে আমি কি বলেছি?

শিবানী একটু হেসে বলেন, তুমি আমার কাছে থাকবে আর তাতাইয়ের পরীক্ষার পর…।

হ্যাঁ, ছোট মা, আমি এই কথাই বলেছি।

সুব্রতবাব বলেন, মা জননী, তুমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তারা নিজে থেকে তোমার বিয়ে দেবেন না, তাই কি হতে পারে?

ছেলে, তুমি বলো, কেন হতে পারে না।

দুর্বা না থেমেই বলে যায়, আমি এত বছর মা-বাবার কাছে থাকলাম কিন্তু বাকি জীবন তো তোমাদের সবাইকে নিয়ে কাটাতে হবে। আমি তাতাইকে দুঃখ দিয়ে কি শান্তিতে সংসার করতে পারবো?

ও বোধ হয় কাঁদতে কাঁদতেই বলে, না, ছেলে, তোমাদের কাউকে দুঃখ দিয়ে বিয়ে করতে পারবো না।

ভারতী বলেন, ওরে পাগলী মেয়ে, তুমি যে আমাদের কাউকে দুঃখ দিতে পারবে না, তা আমরা খুব ভাল করেই জানি। প্লীজ তুমি কান্নাকাটি বা দুঃখ করো না। যাহোক একটা রাস্তা তো বের করতেই হবে।

আমার কিছু ভাল লাগছে না। তুমি ছোট মাকে বলল, আমাকে নিয়ে যেতে।

সুব্রতবাবু বলেন, মা জননী, শুধু তোমার ছোট মা না, আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে আসব।

না, দুর্বা আর কোন কথা বলে না।

.

সুব্রতবাবু শিবানীকে বলেন, বৌমা, এই মেয়েটা আমাদের সবাইকে কি ভালবাসে, তা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি।

হ্যাঁ, দাদা, মেয়েটা সত্যি খুব ভাল।

সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত ওরা এই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। বাবাইও ছিল। ও খুব বেশি কথা বলেনি; তবু বলেছিল, দুর্বা বোধহয় ঠিক কথাই বলেছিল ওর মাকে। ও তোমাদের সঙ্গে মেলামেশা করে খুব ভাল করেই বুঝেছে, ভাইয়ার। অনুপস্থিতিতে আমার বিয়ের কথা কেউ ভাবতেও পারে না।

বাবাই মুহূর্তের জন্য থেমে বলেছিল, যাইহোক তোমরা চিন্তা-ভাবনা করে দেখো কি করবে আমি যাচ্ছি।

পরের দিন শুধু সুব্রতবাবু না, ভারতী আর শিবানীও অসুস্থতার অজুহাতে কামাই করে বাড়িতে রইলেন শুধু বিয়ের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিতে। ওরা আলোচনা করলেন সকাল-দুপুর-বিকেলসন্ধে। শেষ পর্যন্ত তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওরা রাত নটা নাগাদ সিদ্ধান্ত নিলেন, পঁচিশে শ্রাবণই বিয়ে হবে। তারপর তাতাইয়ের পরীক্ষা শেষ হবার পর ওকে শুধু সব কথা বলা হবে না, সব দোষ নিজেদের ঘাড়ে নেওয়া হবে।

সুব্রতবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, দরকার হলে আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইব। যত রাগ-দুঃখ অভিমানই হোক ও তো আমাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। আমরাও ওকে ছাড়া বাঁচব না।

.

হ্যাঁ, পঁচিশে শ্রাবণই রাত্রি ৮টা ২৩ মি ৩২ সেকেন্ড গতে শ্রীমতী ভারতী ও শ্রী সুব্রত সরকারের একমাত্র পুত্র শ্রীমান দেবব্রতর সঙ্গে শ্রীমতী সুনন্দা ও শ্রীমানবেন্দ্র চৌধুরীর একমাত্র কন্যা কল্যাণীয়া দুর্বার শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হলো।

পরের দিন সন্ধের পর দেবব্রত তার নব পরিণীতা স্ত্রী দূর্বাকে নিয়ে এলো নিজেদের বাস ভবনে। কিছু আচার-অনুষ্ঠানের পর দুর্বা কালরাত্রি যাপনের জন্য গেল শিবানীর বাড়ি।

ব্যস! সঙ্গে সঙ্গে দুর্বা শিবানীকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

ছোট মা, কি করে যে বিয়ে হলো, তুমি ভাবতে পারবে না। মালাবদলের সময়েও আমাদের দুজনের মুখে হাসি ছিল না। বাসর ঘরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তোমাদের ছেলে কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমি একটি শব্দ উচ্চারণ না করে শুধু চোখের জল ফেললাম।

ও একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলে, ছোট মা, কি করে তাতাইয়ের কাছে মুখ, দেখাবো? সে যদি আমাকে মেনে না নেয়, তাহলে আমি কি করে সংসার করবো?

মা, আজকের দিনে অমন করে চোখের জল ফেলতে সেই। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

একটু আগেই সুব্রতবাবু আর ভারতী এসে ওদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

সুব্রতবাবু বলেন, মা জননী, তাতাই সোনার সব রাগ-দুঃখ-অভিমান আমি আমার বুকের মধ্যে টেনে নেব। আমাদের এই পাগলা ছেলে কখনই তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে না।

এত দুঃখ-কষ্ট-চোখের জল সত্ত্বেও সময় নির্মম উদাসীন বাউলের একতারা বাজিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায়। বৌভাত ফুলশয্যাও হয় যথারীতি। চৌধুরী দম্পতিও লন্ডনের পথে দমদম থেকে দিল্লী রওনা হন। দু’চারদিন পর কর্মজীবন শুরু হয় সবারই। মাসী ঘুমুচ্ছে; জেগে আছে শুধু দুর্বা।

না, ওর চোখে ঘুম নেই। কখনও চিত হয়ে শুয়ে কখনও উপুড় হয়ে; কখনও কখনও শুয়ে থাকতে পারে না। ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হলেই জানলার ধারে দাঁড়ায়। আবার কখনও কখনও জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় বাইরে। বৃষ্টিতে হাত ভিজে যায়। আগে কত ভাল লাগতো বৃষ্টি দেখতে, বৃষ্টিতে ভিজতে। আর এখন? মনে হচ্ছে, প্রকৃতি যেন ওরই মতো বিষণ্ণ; তাইতো চোখের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন ধরিত্রীকে।

আগে বৃষ্টি শুরু হলেই দুর্বা কত গান গাইতো কিন্তু বিয়ের দিন ঠিক হবার পর থেকেই ওর কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেছে। একটি গানও গাইতে পারে না। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের অনুরোধ-উপরোধ পীড়াপীড়িতেও বাসরে কিছুতেই একটা গানও গাইতে পারেনি। না, এখানে এসেও কাউকে গান শোনায়ানি।

কিন্তু কি আশ্চর্য। আজ এই বর্ষণকান্ত ভাদ্রের অপরাহ্নে দুর্বা গুন গুন করে গেয়ে ওঠে–

না যদি বা এলে তুমি
এড়িয়ে যাবে তাই বলে?
অন্তরেতে নাই কি তুমি
সামনে আমার নাই বলে।…

অফিস থেকে ফিরে বাড়ির মধ্যে না ঢুকেই বাইরে দাঁড়িয়েই বাবাই চিৎকার করে, ও ছোট মা! ছোট মা!

শিবানী তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলেন, কিরে, অত চিৎকার করে ডাকছিস কেন?

ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা টিকিট ডান হাতে উঁচু করে ধরে একটু হেসে বলে, আয়াম ফ্লাইং টু ডেলহি অন সানডে।,

হঠাৎ দিল্লী যাবি কেন?

আমার ভাইয়ার ফাইন্যাল এম. এস. পরীক্ষা শুরু হচ্ছে সোমবার; আমাকে সেদিন ওর কাছে থাকতে হবে না?

ওর চিৎকার শুনে ভারতী আর দুবাও বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। ভারতী বলেন, তোকে তাতাই সোনা ফোন করেছিল বুঝি?

তবে কি তোমাকে বা ছোটমাকে করবে?

বাবাই হাসতে হাসতে বলে, তোমরা যতই তাতাই সোনা তাতাই সোনা করো, ভাইয়া তোমাদের চাইতে আমাকে অনেক বেশি ভালবাসে।

শিবানী একটু হেসে বলেন, তার জন্য আমরা কি তোকে হিংসা করবো?

উনি না থেমেই বলেন, ও তোকে কখন ফোন করেছিল?

আর বলো না। ঠিক অফিস থেকে বেরুবার কয়েক মিনিট আগেই ফোন করেছিল। ওর ফোন পাবার সঙ্গে সঙ্গে অফিস ম্যানেজারকে বলে আমাদের ট্রাভেলিং এজেন্টকে দিয়ে রিটার্ন টিকিটের ব্যবস্থা করে…

ভারতী বলেন, ওর পরীক্ষা শেষ হবে কবে?

ভাইয়াও আমাকে বলেনি, আমিও কিছু জিজ্ঞেস করিনি। ফার্স্ট পরীক্ষা শুরুর খবর দিয়েই ও ফোন ছেড়ে দিল।

ও নিশ্চয়ই খুব ব্যস্ত ছিল।

হ্যাঁ, তাই হবে।

শিবানী বলেন, এবার হাত-মুখ ধুয়ে চা-টা খা; আমি আসছি।

হ্যাঁ, চা খেতে খেতেই বাবাই মা আর ছোটমাকে বলে, আমি সোমবার থাকব না বলে রবিবার আমাকে অফিসে যেতেই হবে। তোমরা যা নির্মল্য-পূজার প্রসাদ দেবে, তা ঠিক করে রেখো। আমি অফিস থেকে এয়ারপোর্ট যাবার পথে…

ভারতী বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা সব ঠিক করে রাখব।

চা-টা খেয়েই বাবাই ক্লান্তিতে একটু শুয়ে পড়ে। পাঁচ-দশ মিনিট পর দুর্বা ঘরে ঢুকতেই ও বলে, কাল তুমি একটা কাজ করবে?

বলো কি করতে হবে।

তুমি পার্ক স্ট্রীটের গিগিল চেনো?

খুব চিনি। বন্ধুদের সঙ্গে ঐ দোকানে অনেকবার গিয়েছি।

খুব ভাল কথা।

বাবাই না থেমেই বলে, পার্কারের সব চাইতে ভাল দুটো কলম কিনতে হবে।

দুর্বা একটু হেসে বলে, তাতাইকে দেবে?

হ্যাঁ।

বাবাই একটু হেসে বলে, আমার দেওয়া নতুন কলম দিয়েই ভাইয়া হায়ার সেকেন্ডারী আর এম. বি. বি. এস ফাইন্যাল পরীক্ষা দিয়েছে।

দুর্বা আবার একটু হেসে বলে, তোমার দেওয়া কলম তো দারুণ পয়া!

তা জানি না; তবে দু’বারই আমার দেওয়া কলম দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে অভাবনীয় ভাল ফল করেছে।

তাহলে তো এবারও ও আশা করবে, তুমি ওকে নতুন কলম দেবে?

ও আশা করবে না ভাইয়া জানে, এটা ওর প্রাপ্য।

ওর কথা শুনে দুর্বার খুব ভাল লাগে।

দু’এক মিনিট চুপ করে থাকার পর বাবাই বলে, যদি পারো তুমি আরো দু’একটা দোকান দেখো।…

তুমি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি মনে মনে ঠিক করেছি আগে অক্সফোর্ড বুক শপ-এ যাবো। ওখানে…

ভেরি গুড। ওখানেই তুমি সব চাইতে ভাল কলম পাবে।

তোমার আলমারী থেকেই টাকা নেব?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

দুর্বা একটু পরেই বলে, আমি এখান থেকেই একটা ট্যাক্সি নেব। দুই মা-কে কলেজে নামিয়ে দিয়ে সোজা পার্ক স্ট্রীট যাবো।

হ্যাঁ, সেই ভাল হবে।

রাত্র শোবার পর দুর্বা বলে, যদি আমাদের বিয়ের সময় তাতাই থাকতে পারত, তাহলে ঠিক আমি তোমার সঙ্গে যেতাম।

বাবাই একটু হেসে বলে, যেতাম মানে? ভাইয়া হুকুম করতো তোমাকে যাবার জন্য।

কয়েক মিনিট কেউই কোন কথা বলে না। তারপর দুর্বা আপনমনেই একটু হেসে বলে, সত্যি, তোমরা সবাই তাতাইকে কি অসম্ভব ভালবাসো।

ও এত ভাল যে ওকে ভাল না বেসে উপায় নেই। তাছাড়া আরো একটা কারণ আছে।

কি কারণ আছে?

ও আমাদের প্রত্যেককেই এমন বিচিত্রভাবে ভালবাসে যে আমরা প্রত্যেকেই মনে করি ও সব চাইতে আমার কাছের মানুষ।

বাবাই মুহূর্তের জন্য থেমেই বলে, এর পর তুমি দেখো, ভাইয়া তোমাকে এমন ভাবে ভালবাসবে, এমন ভাবে কাছে টানবে যে তুমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারবে না।

তুমিও দেখো, আমিও ওকে এমন ভালবাসব যে ও নিজেও আমাকে ছেড়ে থাকতে চাইবে না।

ময়না, আমি খুব ভাল করেই জানি, তোমরা দু’জনের কেউই বেশি দিন ছাড়াছাড়ি করে থাকতে পারবে না।

কিন্তু বিয়ের সময় থাকতে পারেনি বলে ও রাগে-দুঃখে আমাকে দূরে সরিয়ে দেবে না তো?

ও রাগ-দুঃখ মান-অভিমান সবকিছুই করবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমাকে কিছুতেই ও দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।

আবার একটু নীরবতা।

দুর্বা বলে, তুমি কি দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকেই সোজা তাতাইয়ের কাছে যাবে?

না, না, তা যাবো না।

কেন?

আমাকে দেখলেই এত হৈ হৈ শুরু করবে যে সেদিনের পড়াশুনা বিশেষ হবে না।

না, তাহলে তোমার যেয়ে কাজ নেই। ফাইন্যালের ঠিক আগের দিনের পড়াশুনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি সোমবার সকাল ন’টায় ওর হস্টেলে যাবে। তারপর পরীক্ষা শুরু হবার আগে পর্যন্ত ওর সঙ্গে থাকব।

তারপর?

বাবাই একটু হেসে বলে, পরীক্ষা শেষ হবার পর দু’ভাই কোন ফার্স্ট ক্লাস রেস্তোরাঁয় গিয়ে লাঞ্চ খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা দেব।

তারপর?

তারপর ওকে হস্টেলে নামিয়ে দিয়ে একটু আমাদের গেস্ট হাউস ঘুরেই সোজা এয়ারপোর্ট।

.

বাবাই দিল্লী যায় রবিবার সন্ধের ফ্লাইটে, ফিরে আসে পরের দিন রাত নটা নাগাদ।

ও বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই সবাই ওকে ঘিরে ধরেন। সুব্রতবাবু ভারতী ও শিবানী। দুর্বা ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়।

সবারই প্রথম প্রশ্ন, তাতাই সোনার পরীক্ষা কেমন হলো?

বাবাই এক গাল হেসে বলে, আমার ভাইয়া কখনও পরীক্ষায় খারাপ করেছে?

ভারতী একটু বিরক্ত হয়েই বলেন, অত ভনিতা না করে বল আজকের পরীক্ষা কেমন হলো?

খুব ভাল, খুব ভাল, খুব ভাল।

ভারতী আর শিবানী সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়েই দু’চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে কি যেন প্রার্থনা করেন।

দুর্বা বলে, তুমি তাতাইয়ের হস্টেলে কখন গিয়েছিলে?

ন’টায়।

শিবানী প্রশ্ন করেন, তখন ও কি করছিল?

ভাইয়া তখন কাকু আর প্রফেসর রাও-এর ছবি প্রণাম করছিল।

তারপর?

ও ঘুরে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে এক লাফে আমার গলা জড়িয়ে ধরেই আমার কোলে চড়ে…

শুনে সবার মুখেই হাসি।

সুব্রতবাবু হাসতে হাসতে বলেন, তোকে কাছে পেলে তাতাই সোনা পাগলামী না করে থাকতে পারে না।

শিবানী বলে, ওকে নির্মাল্য আর প্রসাদ…

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দিয়েছিলাম।

বাবাই মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, ভাইয়া নির্মাল্য আর প্রসাদ মাথায় ঠেকিয়ে প্রসাদ মুখে দিল আর নির্মাল্য পকেটে রাখলো।

দুর্বা বলে, তারপর?

আমি ওকে কলম দুটো দিতেই কপালে দুইয়ে এক গাল হেসে ভাইয়া বলল, আমি জানতাম, তুমি আসবে আর আমাকে নতুন কলম দেবে। তোমার কলম দিয়ে পরীক্ষা দিয়েই এতকাল ভাল রেজাল্ট হয়েছে।

দুর্বা আবার বলে, তারপর?

তারপর ওকে পরীক্ষায় হল পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। অন্য যেসব ছেলেমেয়ে। পরীক্ষা দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে দু’চার মিনিট কথাবার্তা বলার পর আমাকে প্রণাম করে হলে ঢুকে গেল।

ভারতী সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করো, ওকে আশীর্বাদ করেছিলি?

অমি তো ভাইয়াকে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করি না। বরাবর ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খাই। আজ সকালেও তাই করেছি।

দুর্বা বলে, পরীক্ষা শেষ হবার পর তাতাইকে নিয়ে খেতে গিয়েছিলে?

গিয়েছিলে মানে?

বাবাই একটু থেমে একটু হেসে বলে, ও হল থেকে বেরিয়েই আমাকে বলল, ভাইদা, আমাকে লাঞ্চ খাওয়াবে তো? হস্টেলের রান্না খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া। পড়ে গেছে।

শিবানী জিজ্ঞেস করেন, তোরা কোথায় খেতে গেলি?

ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভের পিছন দিকে হোটেল ডিপ্লোম্যাটে।

দুর্বা একটু হেসে বলে, ওকে ভাল করে খাইয়েছিলে?

শুধু ওকে কেন? দু’ভাই যেমন জব্বর খেয়েছি, তেমনি জব্বর আড্ডা দিয়েছি।

সুব্রতবাবু বলেন, ওকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়েছিলি তো?

হ্যাঁ, হ্যাঁ।

শিবানী বলেন, তুই এয়ারপোর্ট রওনা হলি কখন?

ওকে হস্টেলে পৌঁছে দিয়ে গেস্ট হাউস ঘুরেই সোজা এয়ারপোর্ট!

সুব্রতবাবু বলেন, তাতাইসোনার পরীক্ষা শেষ হবে কবে?

ভাইয়ার থিওরি পরীক্ষা শেষ হবে সামনের সপ্তাহের বুধবার। তবে কেস স্ট্যাডি আর অপারেশনের প্রাকটিক্যাল কবে হবে, তা পরে জানাবে।

শিবানী বলেন, তার মানে মাস খানেকের আগে শেষ হবে না।

হ্যাঁ, ছোট মা, তা হয়তো লাগবে।

শুধু থিওরি পরীক্ষার পর না, দু’পর্যায়ে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার পরও তাতাই ফোন করে। সবাই জানতে চায় কবে কলকাতা আসছিস?

কিছু ঠিক নেই।

কেন? এখন তো তোদের ছুটি।

ছুটি হলে কি হয়? প্রফেসর রাও ছাড়লে তো?

উনি পারমিশন দিচ্ছেন না কেন?

উনি যেমন পড়াশুনা করাচ্ছেন, সেইরকমই প্রতিদিন আমাদের অপারেশন করতে হচ্ছে।

তার মানে তোর আসার কোন ঠিক নেই।

না।

তাতাই একটু থেমেই বলে, যেদিন প্রফেসর রাও ছাড়বেন সঙ্গে সঙ্গে পালাব। শিবানী বলেন, দেখিস, যদি একটু তাড়াতাড়ি আসতে পারিস। সবাই তোর পথ চেয়ে বসে আছে।

মা, আমি কি তা জানি না? আমি যে মুহূর্তে সুযোগ পাবো, আমি সঙ্গে সঙ্গে রওনা হবো।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সাত-দশ দিন তো দূরের কথা, পুরো তিন সপ্তাহ কেটে গেল। তবু তাতাইয়ের দেখা নেই।

.

পরের রবিবার।

খাওয়া-দাওয়ার পর ভারতী শিবানীর কাছে শুয়ে গল্প করছেন। ও বাড়িতে বাবাই আর দুর্বাও খেয়ে দেয়ে নিজেদের ঘরে শুয়ে শুয়ে কথাবার্তা বলছে। সুব্রতবাবু এক সহকর্মীর গৃহ প্রবেশের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছেন; এখনও ফেরেন নি।

হঠাৎ মনে হলো একটা ট্যাক্সি বা গাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামল। তারপরই চিৎকার, ও বড়মা। ও মা! আমি এসে গেছি।

এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ভারতী আর শিবানী ছুটে যান তাতাইয়ের গলা শুনে।

তিড়িং করে লাফ দিয়ে ওঠে বাবাইও। বলে, ভাইয়া, এসেছে।

দুর্বা বলে, তুমি ঠিক শুনেছ?

বাবাই একটু হেসে বলে, ভাইয়ার গলা চিনব না?

শিগগির চলো।

না, ময়না, এক্ষুনি ওর সামনে যেতে ভয় করছে। মা আর ছোট মা আগে ওকে একটু সামলে নিন। তারপর আমি যাবো।

বাবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কি করে যে ভাইয়াকে মুখ দেখাব, তা ভেবে পাচ্ছি না।

তুমি না যাও আমি যাচ্ছি।

ময়না, এক্ষুনি যেও না; একটু পরে যাও।

আমার মনে হয়, যত তাড়াতাড়ি ওকে ফেস করা যায় ততই ভালো।

আমি জানি কিন্তু ফাস্ট স্টীমটা বেরিয়ে যাক। তারপর আমরা যাবো।

দুর্বা আর কোন কথা বলে না কিন্তু স্থির থাকতে পারে না। একবার এই ঘর, আরেকবার ঐ ঘরের জানলায় সামনে দাঁড়িয়ে ও বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে।

এইভাবে কয়েক মিনিট কাটার পরই ও বলে, আমি আর দেরি করব না; অমি যাচ্ছি।

ও বাড়ির ড্রইংরুমে পা দিয়ে এক পা এগুতেই দুর্বা থমকে দাঁড়ায়।

ওর কানে আসে-কি বললে বড়মা? মেয়েটিকে দেখতে খুব ভালো?

হ্যাঁ, বাবা, সত্যি মেয়েটিকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

বড়মা, পৃথিবীতে আর সুন্দরী মেয়ে নেই? নাকি এই রাজকন্যাই একমাত্র সুন্দরী?

তাতাই না থেমেই বেশ গলা চড়িয়ে বলে, ভাইদা কি কানা-খোঁড়া? নাকি দেখতে খারাপ? ভাইদা কি মূর্খ নাকি বেকার? নাকি ভাইদা নেশাখোর, লম্পট, চরিত্রহীন?

তা কেন হবে?

ভাইদাকে বিয়ে করার জন্য হাজার হাজার সুন্দরী মেয়ে লাইন দেবে। ভাইদাকে বিয়ে করে যে কোন মেয়ে ধন্য হবে।

না, ভারতী বা শিবানী কোন কথা বলেন না।

আমাকে বললে না কেন? কত সুন্দরী ভাল ভাল ডাক্তার মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ আছে। আমি তাদের কাউকে পছন্দ করে ভাইদার সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু তোমরা কি করে আমাকে না জানিয়ে…

বললাম তো বাবা, পরীক্ষার আগে তোর মন বিক্ষিপ্ত হবে বলে আমরা জানাতে পারিনি।

এসব কথা আমাকে বলো না; এসব কথা শুনে আমার মন ভুলবে না।

ভারতী দু’হাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে বলেন, তাতাইসোনা, তুই মেয়েটাকে দেখ; নিশ্চয়ই তোর ভাল লাগবে। তাছাড়া ওর গান শুনলে তোর মন ভরে যাবে।

না, না, আমি ওকে দেখতেও চাই না, গানও শুনতে চাই না। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সী হার ফেস।

তুই তোর ভাইদার বউকে না দেখে থাকতে পারবি?

থাকা উচিত না কিন্তু থাকতেই হবে। তোমার পুত্রবধূর সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।

শিবানী বলেন, তাতাই সোনা, ঐ মেয়েটার তো কোন দোষ নেই। ও নিজে তো বিয়ে করতে চায়নি আমরাই চেয়েছি ওকে আপন করে নিতে।

উনি না থেমেই বলেন, তুই শুধু শুধু ওকে দুঃখ দিবি কেন?

ঠিক সেইসময় সুব্রতবাবু ড্রইংরুমে ঢুকেই দুর্বাকে দেখে বলেন, তাতাই এসেছে?

দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের সামনে হাত নিয়ে বলে, চুপ। তাতাই এসেছে। যেমন রেগেছে, তেমনই দুঃখ পেয়েছে। বড়মা-ছোটমাকে কত কি বলছে।

সুব্রতবাবু খুব চাপা গলায় বলেন, তুমি ভিতরে যাওনি কেন?

আমার উপরই তো যত রাগ।

ঠিক আছে, আমি দেখছি।

সুব্রতবাবু ওর ঘরে ঢুকতেই তাতাই ছুটে এসে ওনাকে জড়িয়ে ধরেই কঁদতে কাঁদতে বলে, জ্যেঠু, তোমরা একি করলে? আমি কি তোমাদের কেউ না? বড়মার পেটে হইনি বলে কি আমি ভাইদার ভাই না? আমি তো তোমার আর বড়মার মাঝখানে শুয়ে বড় হয়েছি। আমাকে তোমরা এভাবে দূরে সরিয়ে…

উনি ওর মাথার উপর মুখ রেখে বলেন, তুই স্বপ্নেও ভাবতে পারিস আমরা তোকে দূরে সরিয়ে দেব? তুই যে আমাদের এক টুকরো স্বপ্ন, তা কি জানিস না?

তাই তো জানি কিন্তু…

লক্ষ্মী, বাবা আমার, তুই চোখের জল ফেলিস না। আমি তপুর মৃত্যুর পর তোর মা-র চোখের জল দেখে মাসের পর মাস শান্তিতে ঘুমুতেও পারিনি, খেতেও পারিনি। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, তুই কখনই চোখের জল ফেলবি না। আমি তোর চোখের জল সহ্য করতে পারব না।

তাতাই তখনও চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলে, কিন্তু জ্যেঠু, আমি যে ভাবতে পারছি না, ভাইদার বিয়ের ব্যাপারে আমি কিছু জানতেও পারলাম না, করতেও পারলাম না।

তাতাইসোনা, তোকে না জানিয়ে, তোকে কাছে না পেয়ে আমরা যে কি করে বাবাইয়ের বিয়ে দিলাম, তা কি তুই বুঝতে পারছিস না?

সুব্রতবাবু প্রায় না থেমেই বলেন, তুই ভাবতে পারিস, আমরা মাত্র সাতজন বরযাত্রী গিয়েছিলাম? তুই ভাবতে পারিস, বৌভাতের দিন মাত্র চল্লিশ-বিয়াল্লিশ জনকে আসতে বলেছিলাম?

ঐ কথা শুনেই তাতাই যেন দপ করে জ্বলে ওঠে-কেন? ভাইদা কি ভিখিরী? নাকি তোমাদের কারুর কিছু নেই?

তুই ছিলি না বলে…

ওনাকে কথাটা বলতে না দিয়েই তাতাই বলে, ওসব কোন কথা না। ভাইদা কি আবার বিয়ে করবে? ভাইদার কি আবার বৌভাত হবে?

দুর্বা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঐ ঘরে ঢুকেই সুব্রতবাবুকে বলে, ছেলে, তুমি যাও। আমি ওর সঙ্গে কথা বলব।

সুব্রতবাবু ঘর থেকে চলে যেতেই দুর্বা তাতাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, তাতাই, আসামী হাজির। আমাকে কি শাস্তি দেবে, দাও।

তাতাই একটি শব্দ উচ্চারণ করে না। শুধু অবাক হয়ে ওকে দেখে।

দুর্বা বলে, তুমি কি জানো, তোমার ছবি দেখে, তোমার কথা শুনে, তোমার চিঠি পড়ে আমি শুধু তোমাকে দেখার জন্য হা করে বসে আছি?

না, তবুও তাতাই কোন কথা বলে না। শুধু অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

তাতাই, তুমি জানো না, তোমাকে আমি কত ভালবাসি। আজ হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তুমি স্থির জেনে রাখো, আমি তোমার সব চাইতে কাছের, সব চাইতে আপন হবে।

দুর্বা মুহূর্তের জন্য মে বলে, আমার স্থির বিশ্বাস, তুমিও আমাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসবে, আমাকে কাছে টেনে নেবে, আমাকে কখনই তুমি দূরে সরিয়ে দেবে না।

এবার ও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু হেসে ডান হাত এগিয়ে দিয়ে বলে, আমার সঙ্গে হাল্ড সেক করো।

এতক্ষণ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দুঃখ আক্ষেপ অভিমান আর রাগের পর তাতাই ঠোঁটের কোনে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে ডান হাত এগিয়ে দেয়।

হঠাৎ যেন ঐ ঘরের মধ্যে দিয়ে বসন্তের দমকা হাওয়া বয়ে যায়।

দুর্বা এক গাল খুশির হাসি হেসে দুহাত দিয়ে ওর মুখোনা ধরে দু’গালে চুমু খেয়ে বলে, মাই সুইট বিলাভেড বয়ফ্রেন্ড!

দরজার দু’পাশে দাঁড়িয়ে তারতী আর শিবানী লুকিয়ে লুকিয়ে সব শুনছিলেন, সব দেখছিলেন। এবার আর ওরা খুশি চেপে রাখতে না পেরে ঘরের মধ্যে হাজির হন।

ভারতী তাতাইকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেই বলেন, এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই আমরা সবাই হা করে বসেছিলাম। দুর্বা তোকে ঠিকই বলেছে, ও তোর সব চাইতে কাছের মানুষ হবে আর তুইও ওর সবচাইতে প্রিয়জন হবি।

তাতাই একটু হেসে বলে, আমি যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হলাম শুধু তোমাদের জন্য; এই শ্ৰীমতীর রূপ দেখে না।

দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে তাতাইয়ের দুটো হাত ধরে গেয়ে ওঠে–

আমি রূপে তোমার ভোলাব না।
ভালো বাসায় ভোলাব।
আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো,
গান দিয়ে দ্বার খোলাব।।

তাতাই সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে ওঠে-ও বড়মা, এ তো নটী বিনোদিনীর গুরু।

ওর কথা শুনে শুধু ভারতী আর শিবানী না, দুর্বাও হো হো করে হেসে ওঠে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *