০৫. উদযোগপর্ব

 উদযোগপর্ব

॥ সেনোযোগপর্বাধ্যায়॥

১। রাজ্যোদ্ধারের মন্ত্রণা

অভিমন্যু-উত্তরার বিবাহের পর রাত্রিতে বিশ্রাম করে পাণ্ডবগণ প্রভাতকালে বিরাট রাজার সভায় (১) এলেন। এই সভায় বিরাট দ্রুপদ বসুদেব বলরাম কৃষ্ণ সাত্যকি প্রদ্যুম্ন শাম্ব বিরাটপুত্রগণ অভিমন্যু এবং দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্ৰ উপস্থিত ছিলেন। কিছুক্ষণ নানাপ্রকার আলাপের পর সকলে কৃষ্ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন।

কৃষ্ণ বললেন, আপনারা সকলে জানেন, শকুনি দ্যূতক্রীড়ায় শঠতার দ্বারা যুধিষ্ঠিরকে জয় করে রাজ্য হরণ করেছিলেন। পাণ্ডবগণ বহু কষ্ট ভোগ করে তাঁদের প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন, তাঁদের বার বৎসর বনবাস এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাস সমাপ্ত হয়েছে। এখন যা যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন দুজনেরই হিতকর এবং কৌরব ও পাণ্ডব উভয়ের পক্ষে ধর্মসম্মত যুক্তিসিদ্ধ ও যশস্কর, তা আপনারা ভেবে দেখুন। যুধিষ্ঠির ধর্মবিরুদ্ধ উপায়ে সুররাজ্যও চান না, বরং তিনি ধর্মসম্মত উপায়ে একটিমাত্র গ্রামের স্বামিত্বই বাঞ্ছনীয় মনে করেন। দুর্যোধনাদি প্রতারণা করে পাণ্ডবগণের বৈতৃক রাজ্য হরণ করেছেন, তথাপি যুধিষ্ঠির তাদের শুভ কামনা করেন। এঁরা সত্যপরায়ণ, নিজেদের প্রতিজ্ঞা পালন করেচেন এখন যদি ন্যায্য ব্যবহার না পান তবে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণকে বধ করবেন। যদি আপনারা মনে করেন যে পাণ্ডবগণ সংখ্যায়। অল্প সেজন্য জয়লাভে সমর্থ হবেন না, তবে আপনারা মিলিত হয়ে এমন চেষ্টা করুন যাতে এঁদের শত্রুরা বিনষ্ট হয়। কিন্তু আমরা এখনও জানি না দুর্যোধনের অভিপ্রায় কি, তা না জেনেই আমরা কর্তব্য স্থির করতে পারি না। অতএব কোনও ধার্মিক সৎস্বভাব সদ্বংশীয় সতর্ক দূতকে পাঠানো হ’ক, যাঁর কথায় দুর্যোধন প্রশমিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে অর্ধরাজ্য দিতে সম্মত হবেন।

বলরাম বললেন, কৃষ্ণের বাক্য যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন উভয়েরই হিতকর। শান্তির উদ্দেশ্যে কোনও লোককে দুর্যোধনের কাছে পাঠানোই ভাল। তিনি গিয়ে ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণ অশ্বত্থামা বিদুর কৃপ শকুনি কর্ণ ও ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণকে প্রণিপাত করে যুধিষ্ঠিরের সপক্ষে বলবেন। দুর্যোধনাদি যেন কোনও মতেই ক্রুদ্ধ না হন, কারণ তাঁরা বলবান, যুধিষ্ঠিরের রাজ্য তাদের গ্রাসে রয়েছে। যুধিষ্ঠির দূতপ্রিয় কিন্তু অজ্ঞ, সুহৃদ্গণের বারণ না শুনে দূতনিপুণ শকুনিকে আহ্বান করেছিলেন। দূতসভায় বহু লোক ছিল যাদের ইনি হারাতে পারতেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে না খেলে ইনি সুবলপুত্র শকুনির সঙ্গেই খেলতে গেলেন এবং প্রমত্ত হয়ে রাজ্য হারালেন। খেলবার সময় যুধিষ্ঠিরের পাশা প্রতিকূল হয়ে পড়ছিল, বার বার হেরে গিয়ে ইনি ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন। শকুনি নিজের শক্তিতেই এঁকে পরাস্ত করেছিলেন, তাতে তার কোনও অপরাধ হয়নি। যদি আপনারা শান্তি চান তবে মিষ্টবাক্যে দুর্যোধনকে প্রসন্ন করুন। সাম নীতিতে যা পাওয়া যায় তাই অর্থকর, যুদ্ধ অন্যায় ও অনর্থকর।

সাত্যকি বললেন, তোমার যেমন স্বভাব তেমন কথা বলছ। বীর ও কাপুরুষ দুইপ্রকার লোকই দেখা যায়, একই বংশে ক্লীব ও বলশালী পুরুষ জন্মগ্রহণ করে। হলধর, তোমাকে দোষ দিচ্ছি না, যারা তোমার বাক্য শোনেন তারাই দোষী। আশ্চর্যের বিষয়, এই সভায় কেউ ধর্মরাজের অল্পমাত্র দোষের কথাও বলতে পারে! অক্ষনিপুণ কৌরবগণ অনভিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে ডেকে এনে পরাজিত করেছিল, এমন জয়কে কোন যুক্তিতে ধর্মসঙ্গত বলা যেতে পারে ? যুধিষ্ঠির যদি নিজের ভবনে ভ্রাতাদের সঙ্গে খেলতেন এবং দুর্যোধনাদি সেই খেলায় যোগ দিয়ে জয়লাভ করতেন তবেই তা ধর্মসঙ্গত হত। যুধিষ্ঠির কপট দ্যুতে পরাজিত হয়েছিলেন, তথাপি ইনি পণ রক্ষা করেছেন। এখন বনবাস থেকে ফিরে এসে ন্যায়ানুসারে পিতৃরাজ্যের অধিকার চান, তার জন্য প্রণিপাত করবেন কেন? এঁরা যথাযথ প্রতিজ্ঞা পালন করেছেন তথাপি কৌরবরা বলে যে এঁরা অজ্ঞাতবাসকালে ধরা পড়েছিলেন। ভীষ্ম দ্রোণ ও বিদুর অনুনয় করেছেন তথাপি ধার্তরাষ্ট্রগণ রাজ্য ফিরে দিতে চায় না। আমি তাদের যুদ্ধে জয় করে মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের চরণে নিপাতিত করব, যদি তারা প্রণিপাত না করে তবে তাদের যমালয়ে পাঠাব। আততায়ী শত্রুকে হত্যা করলে অধর্ম হয় না, তাদের কাছে অনুনয় করলেই অধর্ম ও অপযশ হয়। তারা যুধিষ্ঠিরকে রাজ্য ফিরিয়ে দিক, নতুবা নিহত হয়ে রণভূমিতে শয়ন করুক।

দ্রুপদ বললেন, মহাবাহু সাত্যকি, দুর্যোধন ভাল কথায় রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন।। ধৃতরাষ্ট্র তার পুত্রের বশেই চলবেন, ভীষ্ম ও দ্রোণ দীনতার জন্য এবং কর্ণ ও শকুনি মূর্খতার জন্য দুর্যোধনের অনুবর্তী হবেন। বলদেব যা বললেন তা যুক্তিসম্মত মনে করি না, যাঁরা ন্যায়পরায়ণ তাদের কাছেই অনুনয় করা চ’লে। দুর্যোধন পাপবুদ্ধি, মৃদুবাক্যে তাকে বশ করা যাবে না, মৃদুভাষীকে তিনি শক্তিহীন মনে করবেন। অতএব সৈন্যসংগ্রহের জন্য মিত্রগণের নিকট দূত পাঠানো হ’ক। দুর্যোধনও দূত পাঠাবেন, রাজারা যে পক্ষের আমন্ত্রণ আগে পাবেন সেই পক্ষেই যাবেন, এই কারণে আমাদের ত্বরান্বিত হ’তে হবে। বিরাটরাজ, আমার পুরোহিত এই ব্রাহ্মণ শীঘ্র হস্তিনাপুরে যান, ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধন ভীষ্ম ও দ্রোণকে ইনি কি বলবেন তা আপনি শিখিয়ে দিন।

কৃষ্ণ বললেন, কৌরব আর পাণ্ডবদের সঙ্গে আমাদের সমান সম্বন্ধ। আমরা এখানে বিবাহের নিমন্ত্রণে এসেছি; বিবাহ হয়ে গেছে, এখন আমরা সানন্দে নিজ গৃহে ফিরে যাব। দ্রুপদরাজ, আপনি বয়সে ও জ্ঞানে বৃদ্ধতম, ধৃতরাষ্ট্র আপনাকে সম্মান করেন, আপনি আচার্য দ্রোণ ও কৃপের সখা। অতএব পাণ্ডবগণের যা হিতকর হয় এমন বার্তা আপনিই পুরোহিত দ্বারা পাঠিয়ে দিন। দুর্যোধন যদি ন্যায়পথে চ’লেন তা হলে কুরুপাণ্ডবের সৌভ্রাত্র নষ্ট হবে না। তিনি যদি দর্প ও মোহের বশে শান্তিকামনা না করেন তবে আপনি সকল রাজার কাছে দূত পাঠাবার পর আমাদের আহ্বান করবেন।

তারপর বিরাটের নিকট সসম্মানে বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ সবান্ধবে দ্বারকায় প্রস্থান করলেন। যুধিষ্ঠির বিরাট ও দ্রুপদ প্রভৃতি যুদ্ধের আয়োজন করতে লাগলেন এবং নানা দেশের রাজাদের নিকট দূত পাঠালেন। আমন্ত্রণ পেয়ে রাজারা সানন্দে আসতে লাগলেন। পাণ্ডবগণ বলসংগ্রহ করছেন শুনে দুর্যোধনও তার মিত্রগণকে আহ্বান করলেন।

যুধিষ্ঠিরের মত নিয়ে দ্রুপদ তাঁর পুরোহিতকে বললেন, আপনি সকুলজাত বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানী, দুর্যোধনের আচরণ সবই জানেন। আপনি যদি ধৃতরাষ্ট্রকে ধর্মসম্মত বাক্যে বোঝাতে পারেন তবে দুর্যোধনাদিরও মনের পরিবর্তন হবে। বিদূর আপনার সমর্থন করবেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতিরও ভেদবুদ্ধি হবে। অমাত্যগণ যদি ভিন্ন মত অবলম্বন করেন এবং যোদ্ধারা যদি বিমুখ হন তবে তাদের পুনর্বার স্বমতে আনা দুর্যোধনের পক্ষে দুরূহ হবে, তার সৈন্যসংগ্রহে বাধা পড়বে। সেই অবকাশে পাণ্ডবগণের যুদ্ধায়োজন অগ্রসর হবে। আমাদের এখন প্রধান প্রয়োজন এই, যে আপনি ধর্মসংগত যুক্তির দ্বারা ধৃতরাষ্ট্রকে স্বমতে আনবেন। অতএব পাণ্ডবগণের হিতের নিমিত্ত আপনি পুষ্যা নক্ষত্রের যোগে জয়সূচক শুভ মুহূর্তে সত্বর যাত্রা করুন। দ্রুপদ কর্তৃক এইরূপে উপদিষ্ট হয়ে পুরোহিত তাঁর শিষ্যদের নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।

** (১) উপপ্লব্যনগরস্থ বিরাটরাজসভায়

২। কৃষ্ণ-সকাশে দুর্যোধন ও অর্জুন-বলরাম ও দুর্যোধন

অন্যান্য দেশে দূত পাঠাবার পর অর্জুন স্বয়ং দ্বারকায় যাত্রা করলেন। পাণ্ডবগণ কি করছেন তার সমস্ত সংবাদ দুর্যোধন তার গুপ্তচরদের কাছে পেতেন। কৃষ্ণ-বলরাম প্রভৃতি স্বভবনে ফিরে গেছেন শুনে দুর্যোধন অল্প সৈন্য নিয়ে অশ্বারোহণে দ্রুতবেগে দ্বারকায় এলেন। অর্জুনও সেই দিন সেখানে উপস্থিত হলেন। কৃষ্ণ নিদ্রিত আছেন। জেনে দুর্যোধন ও অর্জুন তার শয়নকক্ষে গেলেন। প্রথমে দুর্যোধন এসে কৃষ্ণের মস্তকের নিকটে একটি উৎকৃষ্ট আসনে বসলেন, তার পর অর্জুন এসে কৃষ্ণের পাদদেশে বিনীতভাবে কৃতাঞ্জলি হয়ে রইলেন।

জাগরিত হয়ে কৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে দেখলেন, তারপর পিছন দিকে দৃষ্টিপাত করে সিংহাসনে উপবিষ্ট দুর্যোধনকে দেখলেন। তিনি স্বাগত সম্ভাষণ করে দুজনের আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে দুর্যোধন সহাস্যে বললেন, মাধব, আসন্ন যুদ্ধে তুমি আমার সহায় হও। আমার আর অর্জুনের সঙ্গে তোমার সমান সখ্য, সমান সম্বন্ধ (১)। আমি আগে তোমার কাছে এসেছি, সাধুজন প্রথমাগতকেই বরণ করেন, তুমি সজ্জনশ্রেষ্ঠ, অতএব সদাচার রক্ষা কর।

কৃষ্ণ বললেন, রাজা, তুমি প্রথমে এসেছ তাতে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি ধনঞ্জয়কেই প্রথমে দেখেছি, অতএব দুজনকেই সাহায্য করব। যারা বয়ঃকনিষ্ঠ তাদের অভীষ্টপূরণ আগে করা উচিত, সেজন্য প্রথমে অর্জুনকে বলছি।

-নারায়ণ নামে খ্যাত আমার দশ কোটি গোপ যোদ্ধা আছে, তাদের দৈহিক বল আমারই তুল্য। পার্থ, তুমি সেই দুর্ধর্ষ নারায়ণী সেনা চাও, না যুদ্ধবিমুখ নিরস্ত্র আমাকে চাও? তুমি বার বার ভেবে দেখ-যুদ্ধে সাহায্যের জন্য দশ কোটি যোদ্ধা নেবে, কিংবা কেবল সচিবরূপে আমাকে নেবে?

কৃষ্ণ যুদ্ধ করবেন না জেনেও অর্জুন তাকেই বরণ করলেন। দুর্যোধান দশ কোটি যোদ্ধা নিলেন এবং পরম আনন্দে মনে করলেন যেন কৃষ্ণকেই পেয়েছেন। তার পর বলরামের কাছে গিয়ে দুর্যোধন তার আসবার কারণ জানালেন। বলরাম বললেন, বিরাটভবনে বিবাহের মামাতো ভাই, কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা অর্জুনের পত্নী; কৃষ্ণপুত্র শাম্ব দুর্যোধনের জামাতা।

পর আমি যা বলেছিলাম তা বোধ হয় তুমি জান। তোমার জন্যই আমি বার বার কৃষ্ণকে বাধা দিয়ে বলেছিলাম যে দুই পক্ষের সঙ্গেই আমাদের সমান সম্বন্ধ। কিন্তু তিনি আমার মত গ্রহণ করেননি, আমিও তাকে ছেড়ে ক্ষণকালও থাকতে পারি না। কৃষ্ণের মতিগতি দেখে আমি স্থির করেছি যে আমি পার্থের সহায় হব না, তোমারও সহায় হব না। পুরুষশ্রেষ্ঠ, তুমি মহামান্য ভরতবংশে জন্মেছ, যাও, ক্ষত্রধর্ম অনুসারে যুদ্ধ কর। দুর্যোধন বলরামকে আলিঙ্গন করে বিদায় নিলেন। তিনি মনে করলেন যে কৃষ্ণ তার বশে এসেছেন, যুদ্ধেও তার জয় হয়েছে। তার পর তিনি কৃতবর্মা (২) র সঙ্গে দেখা করলেন এবং তার কাছে এক অক্ষৌহিণী সৈন্য লাভ করলেন।

দুর্যোধন চ’লে গেলে কৃষ্ণ অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি যুদ্ধ করব না তথাপি তুমি আমাকে বরণ করলে কেন? অর্জুন বললেন, নরোত্তম, তুমি একাকীই অমাদের সমস্ত শত্ৰু সংহার করতে পার এবং তোমার যশও লোকবিখ্যাত। আমিও শত্ৰুসংহারে সমর্থ এবং যশের প্রার্থী এই কারণেই তোমাকে বরণ করেছি। আমার চিরকালের ইচ্ছা তুমি আমার সারথি হবে, এই কার্যে তুমি সম্মত হও। বাসুদেব বললেন, পার্থ, তুমি যে আমার সঙ্গে স্পর্ধা কর তা তোমারই উপযুক্ত। আমি সারথি হয়ে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ করব। তার পর কৃষ্ণ ও দাশার্হ (৩) বীরগণের সঙ্গে অর্জুন আনন্দিতমনে যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে এলেন।

**

(১) কৃষ্ণ অর্জুনের

(২) ভোজবংশীয় প্রধান বিশেষ। ইনি কৌরবদের পক্ষে ছিলেন।

(৩) সাত্যকি প্রভৃতি।

৩। শল্য, দুর্যোধন ও যুধিষ্ঠির

আমন্ত্রণ পেয়ে মদ্ররাজ শল্য (১) তার বৃহৎ সৈন্যদল ও মহাবীর পুত্রগণকে নিয়ে পাণ্ডবগণের নিকট যাচ্ছিলেন। এই সংবাদ শুনে দুর্যোধন পথিমধ্যে তার সংবর্ধনার উদযোগ করলেন। তার আদেশে শিল্পিগণ স্থানে স্থানে বিচিত্র সভা-মণ্ডপ, কূপ, দীর্ঘিকা, পাকশালা প্রভৃতি নির্মাণ করলে। নানাপ্রকার ক্রীড়া এবং খাদ্যপানীয়েরও আয়োজন করা হল। শল্য উপস্থিত হলে দুর্যোধনের সচিবগণ তাঁকে দেবতার ন্যায় পূজা করলেন। শল্য বললেন, যুধিষ্ঠিরের কোন্ কর্মচারিগণ এই সকল সভা নির্মাণ করেছে? তাদের ডেকে আন, যুধিষ্ঠিরের সম্মতি নিয়ে আমি তাদের পারিতোষিক দিতে ইচ্ছা করি। দুর্যোধন অন্তরালে ছিলেন, এখন শল্যের কাছে এলেন। দুর্যোধনই সমস্ত আয়োজন করেছেন জেনে শল্য প্রীত হয়ে তাকে আলিঙ্গন করে বললেন, তোমার কি অভীষ্ট বল, আমি তা পূর্ণ করব।

দুর্যোধন বললেন, আপনার বাক্য সত্য হ’ক, আপনি আমার সমস্ত সেনার নেতৃত্ব করুন। শল্য বললেন, তাই হবে; আর কি চাও? দুর্যোধন বললেন, আমি কৃতার্থ। হয়েছি, আর কিছু চাই না। শল্য বললেন, দুর্যোধন, তুমি এখন নিজ দেশে ফিরে যাও, আমি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, আপনি দেখা করে শীঘ্র আমাদের কাছে আসবেন, আমরা আপনারই অধীন, যে বর দিয়েছেন তা মনে রাখবেন। দুর্যোধনকে আশ্বাস দিয়ে শল্য উপপ্লব্য নগরে যাত্রা করলেন।

পাণ্ডবগণের শিবিরে এসে শল্য যুধিষ্ঠিরাদিকে আলিঙ্গন ও কুশলপ্রশ্ন করলেন। এবং কিছুক্ষণ আলাপের পর দুর্যোধনকে যে বর দিয়েছেন তা জানালেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি দুর্যোধনের প্রতি তুষ্ট হয়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা ভালই। এখন আমার একটি উপকার করুন, যদি অকর্তব্য মনে করেন তথাপি আমাদের মঙ্গলের জন্য তা আপনাকে করতে হবে। আপনি যুদ্ধে বাসুদেবের সমান, কর্ণ আর অর্জুনের যখন দ্বৈরথ যুদ্ধ হবে তখন আপনি নিশ্চয় কর্ণের সারথি হবেন। আপনি অর্জুনকে রক্ষা করবেন, এবং যদি আমার প্রিয়কার্য করতে চান তবে কর্ণের তেজ নষ্ট করবেন। মাতুল, অকর্তব্য হলেও এই কম আপনি করবেন।

শল্য বললেন, আমি নিশ্চয়ই দুরাত্মা কর্ণের সারথি হব। সে আমাকে কৃষ্ণতুল্য মনে করে, যুদ্ধকালে আমি তাকে এমন প্রতিকূল ও অহিতকর বাক্য বলব যে তার দর্প ও তেজ নষ্ট হবে এবং অর্জুন তাকে অনায়াসে বধ করতে পারবেন। বৎস, তুমি যা বলেছ তা আমি করব, এবং তোমার প্রিয়কার্য আর যা পারব তাও করব। যুধিষ্ঠির, তুমি ও কৃষ্ণা দূতসভায় যে দুঃখ পেয়েছ, সূতপুত্র কর্ণের কাছে যে নিষ্ঠুর বাক্য শুনেছ, জটাসুর ও কীচকের কাছে দ্রৌপদী যে ক্লেশ পেয়েছেন, সে সমস্তের ফল পরিণামে সুখজনক হবে। মহাত্মা ও দেবতারাও দুঃখভোগ করেন, কারণ দৈবই প্রবল। দেবরাজ ইন্দ্রও তাঁর ভাষার সঙ্গে মহৎ দুঃখভোগ করেছিলেন।

** (১) নকুল-সহদেবের মাতুল।

৪। ত্রিশিরা, বৃত্র, ইন্দ্র, নহুষ ও অগস্ত্য

যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন, মহারাজ, ইন্দ্র ও তার ভার্যা কি প্রকারে দুঃখভোগ করেছিলেন ? শল্য এই উপাখ্যান বললেন।

ত্বষ্টা নামে এক প্রজাপতি ছিলেন, তিনি ইন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত হয়ে ত্রিশিরা নামক এক পুত্রের জন্ম দিলেন। ত্রিশিরার তিন মুখ সূর্য চন্দ্র ও অগ্নির ন্যায়; তিনি এক মুখে বেদাধ্যয়ন, আর এক মুখে সুরাপান এবং তৃতীয় মুখে যেন সর্বদিক গ্রাস করে নিরীক্ষণ করতেন। ইন্দ্ৰত্বলাভের জন্য ত্রিশিরা কঠোর তপস্যায় রত হলেন। তাঁর তপোভঙ্গের জন্য ইন্দ্র বহু অপ্সরা পাঠালেন, কিন্তু ত্রিশিরা বিচলিত হলেন না, তখন তাঁকে মারবার জন্য ইন্দ্র বজ্র নিক্ষেপ করলেন। ত্রিশিরা নিহত হলেন, কিন্তু তার মস্তক জীবিতের ন্যায় রইল। ইন্দ্র ভীত হয়ে একজন বর্ধকী (ছুতোর) কে বললেন, তুমি কুঠার দিয়ে এর মস্তক ছেদন কর। বর্ধকী বললে, এর স্কন্ধ অতি বৃহৎ, আমার কুঠারে কাটা যাবে না, এমন বিগর্হিত কর্মও আমি পারব না। কে আপনি? এই ঋষিপুত্রকে হত্যা করে আপনার ব্রহ্মহত্যার ভয় হচ্ছে না? ইন্দ্র বললেন, আমি দেবরাজ, এই মহাবল পুরুষ আমার শত্রু সেজন্য বজ্রাঘাতে একে বধ করেছি, পরে আমি কঠোর প্রায়শ্চিত্ত করব। বর্ধকী, তুমি শীঘ্র এর শিরচ্ছেদ কর, আমি তোমার প্রতি অনুগ্রহ করব; লোকে যখন যজ্ঞ করবে তখন নিহত পশুর মুণ্ড তোমাকে দেবে। বর্ধকী সম্মত হয়ে ত্রিশিরার তিন মুণ্ড কেটে ফেললে। প্রথম মুণ্ডের মুখ থেকে চাতক পক্ষীর দল, দ্বিতীয় মুখ থেকে চটক ও শ্যেন, এবং তৃতীয় মুখ থেকে তিত্তির পক্ষীর দল নির্গত হল। ইন্দ্র হৃষ্ট হয়ে স্বগৃহে চ’লে গেলেন।

পুত্রের নিধনসংবাদ পেয়ে ত্বষ্টা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং ইন্দ্রের বিনাশের নিমিত্ত অগ্নিতে আহুতি দিয়ে বৃত্রাসুরকে সৃষ্টি করলেন। ত্বষ্টার আজ্ঞায় বৃত্র স্বর্গে গিয়ে ইন্দ্রকে গ্রাস করলেন। দেবতারা উদবিগ্ন হয়ে জ্বম্ভিকা (হাই) সৃষ্টি করলেন, তার প্রভাবে বৃত্ৰ মুখব্যাদান করলেন, ইন্দ্রও দেহ সংকুচিত করে বেরিয়ে এলেন। তারপর ইন্দ্র বৃত্রের সঙ্গে বহুকাল যুদ্ধ করলেন, কিন্তু তাকে দমন করতে না পেরে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু বললেন, দেবতা ঋষি ও গন্ধর্বদের নিয়ে তুমি বৃত্রের কাছে যাও, তার সঙ্গে সন্ধি কর। এই উপায়েই তুমি জয়লাভ করবে। আমি অদৃশ্যভাবে তোমার সঙ্গে অধিষ্ঠান করব।

ঋষিরা বৃত্রের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি দুর্জয় বীর, তোমার তেজে জগৎ ব্যাপ্ত হয়ে আছে। কিন্তু তুমি ইন্দ্রকে জয় করতে পারনি, দীর্ঘকাল যুদ্ধের ফলে দেবাসুর মানুষ সকলেই পীড়িত হয়েছে। অতএব ইন্দ্রের সহিত সখ্য কর, তাতে তুমি সুখ ও অক্ষয় স্বর্গলোক লাভ করবে। বৃত্র বললেন, আপনারা যদি এই ব্যবস্থা করেন যে শুষ্ক বা আর্দ্র বস্তু দ্বারা, প্রস্তর বা কাষ্ঠ বা অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা, দিবসে বা রাত্রিতে, আমি ইন্দ্রাদি দেবতার বধ্য হব না, তবেই আমি সন্ধি করতে পারি। ঋষিরা বললেন, তাই হবে। বৃত্রের সঙ্গে সন্ধি করে ইন্দ্র চ’লে গেলেন।

একদিন ইন্দ্র সমুদ্রতীরে বৃত্রাসুরকে দেখতে পেলেন। ইন্দ্র ভাবলেন, এখন সন্ধ্যাকাল, দিনও নয় রাত্রিও নয়; এই পর্বতাকার সমুদ্রফেন শুষ্কও নয় আর্দ্রও নয়, অস্ত্রও নয়। এই স্থির করে ইন্দ্র বৃত্রের উপরে বজ্রের সহিত সমুদ্রফেন নিক্ষেপ করলেন। বিষ্ণু সেই ফেনে প্রবেশ করে বৃত্রকে বধ করলেন। পূর্বে ত্রিশিরাকে বধ করে ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার পাপ করেছিলেন, এখন আবার মিথ্যাচার করে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। মহাদেবের ভূতরা ইন্দ্রকে বার বার ব্রহ্মহত্যাকারী বলে লজ্জা দিতে লাগল। অবশেষে ইন্দ্র নিজের দুষ্কৃতির জন্য অচেতনপ্রায় হয়ে জল-মধ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে বাস করতে লাগলেন। ইন্দ্রের অন্তর্ধানে পৃথিবী বিধ্বস্ত, কানন শুষ্ক এবং নদীর স্রোত রুদ্ধ হল , জলাশয় শুখিয়ে গেল, অনাবৃষ্টি ও অরাজকতার ফলে সকল প্রাণী সংক্ষুব্ধ হল। দেবতা ও মহর্ষিরা ত্রস্ত হয়ে ভাবতে লাগলেন, কে আমাদের রাজা হবেন। কিন্তু কোনও দেবতা দেবরাজের পদ নিতে চাইলেন না।

অবশেষে দেবগণ ও মহর্ষিগণ তেজস্বী যশস্বী ধার্মিক নহুষকে বললেন, তুমিই দেবরাজ হও। নহুষ বললেন, আমি দুর্বল, ইন্দ্রের তুল্য নই। দেবতা ও ঋষিরা বললেন, তুমি আমাদের তপঃপ্রভাবে বলশালী হয়ে স্বর্গরাজ্য পালন কর। নহুষ অভিষিক্ত হয়ে ধর্মানুসারে সর্বলোকের আধিপত্য করতে লাগলেন। তিনি প্রথমে ধার্মিক ছিলেন কিন্তু পরে কামপরায়ণ ও বিলাসী হয়ে পড়লেন। একদিন তিনি শচীকে দেখে সভাসদগণকে বললেন, ইন্দ্রমহিষী আমার সেবা করেন না কেন? উনি সত্বর আমার গৃহে আসুন। শচী উদবিগ্ন হয়ে বৃহস্পতির কাছে গিয়ে বললেন, আমাকে রক্ষা করুন। বৃহস্পতি তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ভয় পেয়ো না, শীঘ্রই তুমি ইন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হবে।

শচী বৃহস্পতির শরণ নিয়েছেন জেনে নহুষ ক্রুদ্ধ হলেন। দেবগণ ও ঋষিগণ। তাকে বললেন, তুমি ক্রোধ সংবরণ কর, পরস্ত্রীসংসর্গের পাপ থেকে নিবৃত্ত হও; তুমি দেবরাজ, ধর্মানুসারে প্রজাপালন কর। নহুষ বললেন, ইন্দ্র যখন গৌতম-পত্নী অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন এবং আরও অনেক ধর্মবরুদ্ধ নৃশংস ও শঠতাময় কার্য করেছিলেন তখন আপনারা বারণ করেন নি কেন? শচী আমার সেবা করুন, তাতে তার ও আপনাদের মঙ্গল হবে। দেবতারা বৃহস্পতির কাছে গিয়ে বললেন, আপনি ইন্দ্রাণীকে নহুষের হস্তে সমর্পণ করুন, তিনি ইন্দ্র অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, বরবর্তিনী শচী তাকেই এখন পতিত্বে বরণ করুন। শচী কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। বৃহস্পতি বললেন, ইন্দ্রাণী, আমি শরণাগতকে ত্যাগ করি না, তুমি নিশ্চিন্ত থাক। দেবগণ, তোমরা চ’লে যাও।

দেবতারা বললেন, কি করলে সকলের পক্ষে ভাল হয় আপনি বলুন। বৃহস্পতি বললেন, ইন্দ্রাণী নহুষের কাছে কিছুকাল অবকাশ প্রার্থনা করুন, তাতে সকলের শুভ হবে। কালক্রমে বহু বিঘ্ন ঘটে, নহুষ বলশালী ও দর্পিত হলেও কালই তাকে কালসদনে পাঠাবে। শচী নহুষের কাছে গেলেন এবং কম্পিতদেহে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, সুরেশ্বর, আমাকে কিছুকাল অবকাশ দিন। ইন্দ্র কোথায় কি অবস্থায় আছেন আমি জানি না; অনুসন্ধান করেও যদি তাঁর সংবাদ না পাই তবে নিশ্চয় আপনার সেবা করর। নহুষ সম্মত হলেন, শচীও বৃহস্পতির কাছে ফিরে গেলেন।

তার পর দেবতারা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে বললেন, আপনার বীর্যেই বৃত্র নিহত হয়েছে এবং তার ফলে ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার পাপে পড়েছেন। এখন তার মুক্তির উপায় বলুন। বিষ্ণু বললেন, ইন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞে আমার পূজা করুন, তাতে তিনি পাপমুক্ত হয়ে দেবরাজত্ব ফিরে পাবেন, দুর্মতি নহুষও বিনষ্ট হবে। দেবগণ ও বৃহস্পতি প্রভৃতি ঋষিগণ ইন্দ্রের কাছে গিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন এবং তার ফলে ইন্দ্র ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হলেন। তার পাপ বিভক্ত হয়ে বৃক্ষ নদী পর্বত ভূমি স্ত্রী ও প্রাণিগণে সংক্রামিত হল।

দেবরাজপদে নহুষকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত দেখে ইন্দ্র পুনর্বার আত্মগোপন করে কালপ্রতীক্ষা করতে লাগলেন। শোকার্তা শচী তখন উপশ্রুতি নাম্নী রাত্রিদেবীর উপাসনা করলেন। উপশ্রুতি মূর্তিমতী হয়ে দর্শন দিলেন এবং শচীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রমধ্যে এক মহাদ্বীপে উপস্থিত হলেন। সেই দ্বীপের মধ্যে শত যোজন বিস্তীর্ণ সরোবরে উন্নত বৃন্তের উপরে একটি শ্বেতবর্ণ বৃহৎ পদ্ম ছিল। উপশ্রুতির সঙ্গে শচী সেই পদ্মের নাল ভেদ করে ভিতরে গিয়ে দেখলেন, মৃণাল-সূত্রের মধ্যে ইন্দ্র অতি সূক্ষ্মরূপে অবস্থান করছেন। শচী তাঁকে বললেন, প্রভু, তুমি যদি আমাকে রক্ষা না কর, তবে নহুষ আমাকে বশে আনবে। তুমি স্বমূর্তিতে প্রকাশিত হও এবং নিজ বলে পাপিষ্ঠ নহুষকে বধ করে দেবরাজ্য শাসন কর।

ইন্দ্র বললেন, বিক্রম প্রকাশের সময় এখনও আসেনি, নহুষ আমার চেয়ে বলবান, ঋষিরাও হব্য কব্য দিয়ে তার শক্তি বাড়িয়েছেন। তুমি নির্জনে নহুকে এই কথা বল—জগৎপতি, আপনি ঋষিবাহিত যানে আমার নিকট আসন, তা হলে আমি সানন্দে আপনার বশীভূত হব। শচী নহুষের কাছে গিয়ে বললেন, দেবরাজ, আপনি যদি আমার একটি ইচ্ছা পূর্ণ করেন তবে আপনার বশগামিনী হব। আপনি এমন বাহনে চড়ুন যা বিষ্ণু রুদ্র বা কোনও দেবতা বা রাক্ষসের নেই। আমার ইচ্ছা, মহাত্মা ঋষিগণ মিলিত হয়ে আপনার শিবিকা বহন করুন। নহুষ বললেন, বরবর্ণিনী, তুমি অপূর্ব বাহনের কথা বলেছ, আমি তোমার কথা রাখব।

ঐরাবত প্রভৃতি দিব্য হস্তী, হংসযুক্ত বিমান ও দিব্যাশ্বযোজিত রথ ত্যাগ করে নহুষ মহর্ষিগণকে তার শিবিকাবহনে নিযুক্ত করলেন। তখন বৃহস্পতি অগ্নিকে বললেন, তুমি ইন্দ্রের অন্বেষণ কর। অগ্নি সর্বত্র অন্বেষণ করে বললেন, ইন্দ্রকে কোথাও দেখলাম না, কেবল জল অবশিষ্ট আছে, কিন্তু তাতে প্রবেশ করলে আমি নির্বাপিত হব। অগ্নির স্তুতি করে বৃহস্পতি বললেন, নিঃশঙ্কে জলে প্রবেশ কর, তোমাকে আমি সনাতন ব্রাহ্ম মন্ত্রে বর্ধিত করব। অগ্নি সর্বপ্রকার জলে অন্বেষণ করে অবশেষে পদ্মের মৃণালমধ্যে ইন্দ্রকে দেখতে পেলেন এবং ফিরে এসে বৃহস্পতিকে জানালেন। তখন দেবতা ঋষি ও গন্ধবদের সঙ্গে বৃহস্পতি ইন্দ্রের কাছে। গিয়ে স্তব করে বললেন, মহেন্দ্র, তুমি দেবতা ও মনুষ্যকে রক্ষা কর, বল লাভ কর। স্তুত হয়ে ইন্দ্র ধীরে ধীরে বৃদ্ধিলাভ করলেন।

দেবতারা নহুষবধের উপায় চিন্তা করছিলেন এমন সময় ভগবান অগস্ত্য ঋষি সেখানে এলেন। তিনি বললেন, পুরন্দর, ভাগ্যক্রমে তুমি শত্রুহীন হয়েছ, নহুষ দেবরাজ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন। দেবর্ষি ও মহর্ষিগণ যখন নুহুষকে শিবিকায় বহন করছিলেন, তখন এক সময়ে তারা শ্রান্ত হয়ে নহুষকে প্রশ্ন করলেন, বিজয়িশ্রেষ্ঠ, ব্রহ্মা যে গোপ্রোক্ষণ (যক্ষে গোবধ) সম্বন্ধে মন্ত্র বলেছেন, তা তুমি প্রামাণিক মনে কর কি না? নহুষ মোহবশে উত্তর দিলেন, না, ও মন্ত্র প্রামাণিক নয়। ঋষিরা বললেন, তুমি অধর্মে নিরত তাই ধর্ম বোঝ না। প্রাচীন মহর্ষিগণ এই মন্ত্র প্রামাণিক মনে করেন, আমরাও করি। ঋষিদের সঙ্গে বিবাদ করতে করতে নহুষ তার পা দিয়ে আমার মাথা স্পর্শ করলেন। তখন আমি এই শাপ দিলাম—মূঢ় তুমি ব্ৰহ্মর্ষিগণের অনুষ্ঠিত কর্মের দোষ দিচ্ছ, চরণ দিয়ে আমার মস্তক স্পর্শ করেছ, ব্রহ্মার তুল্য ঋষিগণকে বাহন করেছ, তুমি ক্ষীণপুণ্য (১) হ’য়ে মহীতলে পতিত হও। সেখানে তুমি মহাকায় সর্প (২) রূপে দশ সহস্র বৎসর বিচরণ করবে, তার পর তোমার বংশজাত যুধিষ্ঠিরকে দেখলে আবার স্বর্গে আসতে পারবে। শচীপতি, দুরাত্মা নহুষ এইরূপে স্বর্গচ্যুত হয়েছে, এখন তুমি স্বর্গে গিয়ে ত্রিলোক পালন কর। তারপর ইন্দ্র শচীর সঙ্গে মিলিত হয়ে পরমানন্দে দেবরাজ্য পালন করতে লাগলেন। এ উপাখ্যান শেষ করে শল্য বললেন, যুধিষ্ঠির, ইন্দ্রের ন্যায় তুমিও শত্রু বধ করে রাজ্যলাভ করবে। আমি যে বেদতুল্য ইন্দ্রবিজয় নামক উপাখ্যান বললাম, তা জয়াভিলাষী রাজার শোনা উচিত। এই উপাখ্যান পাঠ করলে ইহলোকে ও পরলোকে আনন্দলাভ এবং পুত্র, দীর্ঘ আয়ু ও সর্বত্র জয় লাভ হয়।

যথাবিধি পূজিত হয়ে শল্য বিদায় নিলেন। যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, আপনি অবশ্যই কর্ণের সারথি হবেন এবং অর্জুনের প্রশংসা করে কর্ণের তেজ নষ্ট করবেন। শল্য বললেন, তুমি যা বললে তাই করব এবং আর যা পারব তাও করব।

** (১) যার পুণ্যজনিত স্বৰ্গভোগ শেষ হয়েছে।

(২) বনপর্ব ৩৭-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

৫। সেনাসংগ্রহ

নানা দেশের রাজারা বিশাল সৈন্যদল নিয়ে পাণ্ডব পক্ষে যোগ দিতে এলেন। ক্ষুদ্র নদী যেমন সাগরে এসে লীন হয়, সেইরূপ বিভিন্ন দেশের অক্ষৌহিণী সেনা যুধিষ্ঠিরের বাহিনীতে প্রবেশ করে লীন হ’তে লাগল। সাত্বতবংশীয় মহারথ সাত্যকি, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু, জরাসন্ধপুত্র মগধরাজ জয়ৎসেন, সাগরতটবাসী বহু যোদ্ধা সহ পাণ্ড্যরাজ, কেকয়রাজবংশীয় পঞ্চ সহোদর, পুত্রগণসহ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, পার্বতীয় রাজগণ সহ মৎস্যরাজ বিরাট এবং আরও বহু দেশের রাজারা সসৈন্যে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবপক্ষে সাত অক্ষৌহিণী সেনা সংগৃহীত হল।

দুর্যোধনের পক্ষেও বহু রাজা বৃহৎ সৈন্যদল নিয়ে যোগ দিলেন। কাঞ্চনবর্ণ চীন ও কিরাত সৈন্য সহ ভগদত্ত, সোমদত্তপুত্র ভুরিশ্ৰবা, মদ্ররাজ শল্য, ভোজ ও অন্ধক সৈন্য সহ হৃদিকপুত্র কৃতবর্মা, সিন্ধুসৌবীরবাসী জয়দ্রথ প্রভৃতি রাজারা, শক ও যবন সৈন্য সহ কাম্বােজরাজ সুদক্ষিণ, দাক্ষিণাত্য সৈন্য সহ মাহিষ্মতীরাজ নীল, অবন্তী দেশের দুই রাজা এবং অন্যান্য রাজারা সসৈন্যে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধনের পক্ষে এগার অক্ষৌহিণী সেনা সংগৃহীত হল। হস্তিনাপুরে তাদের স্থান হল না; পঞ্চনদ, কুরুজাঙ্গল, রোহিতকারণ্য, মরুপ্রদেশ, অহিচ্ছত্র, কালকূট, গঙ্গাতীর, বারণ, বাটধান, যমুনাতীরস্থ পার্বত দেশ, সমস্তই কৌরবসৈন্যে ব্যাপ্ত হল।

॥ সঞ্জয়যানপর্বাধ্যায়॥

৬। দ্রুপদ-পুরোহিতের দৌত্য

দ্রুপদের পুরোহিত হস্তিনাপুরে এলে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুর তাঁর সংবর্ধনা করলেন। কুশলজিজ্ঞাসার পর পুরোহিত বললেন, আপনারা সকলেই সনাতন রাজধর্ম জানেন, তথাপি আমার বক্তব্যের অঙ্গরূপে কিছু বলব। ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু একজনেরই পুত্র, পৈতৃক ধনে তাদের সমান অধিকার। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ তাদের পৈতৃক ধন পেলেন, কিন্তু পাণ্ডুপুত্রগণ পেলেন না কেন? আপনারা জানেন, দুর্যোধন তা অধিকার করে রেখেছেন। তিনি পাণ্ডবগণকে যমালয়ে পাঠাবার অনেক চেষ্টা করেছেন এবং শকুনির সাহায্যে তাদের রাজ্য হরণ করেছেন। এই ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের কর্ম অনুমোদন করে পাণ্ডবগণকে তের বৎসর নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। দূতসভায় বনবাসে এবং বিরাটনগরে পাণ্ডবগণ ভার্যা সহ বহু ক্লেশ পেয়েছেন। এইসকল নির্যাতন ভুলে গিয়ে তাঁরা কৌরবগণের সঙ্গে সন্ধি করতে ইচ্ছা করেন। এখানে যে সুহৃর্গ রয়েছেন তারা পাণ্ডবদের ও দুর্যোধনের আচরণ বিচার করে ধৃতরাষ্ট্রকে অনুরোধ করুন। পাণ্ডবরা বিবাদ করতে চান না, লোকক্ষয় না করেই নিজেদের প্রাপ্য চান। দুর্যোধন যে ভরসায় যুদ্ধ করতে চান তা মিথ্যা, কারণ পাণ্ডবরাই অধিকতর বলশালী। তাদের সাত অক্ষৌহিণী সেনা প্রস্তুত আছে, তার উপর সাত্যকি, ভীমসেন আর নকুল-সহদেব সহস্র অক্ষৌহিণীর সমান। আপনাদের পক্ষে যেমন এগার অক্ষৌহিণী আছে, অপর পক্ষে তেমন অর্জুন আছেন। অর্জুন ও বাসুদেব সমস্ত সেনারই অধিক। সেনার বহুলতা, অর্জুনের বিক্রম এবং কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তা জেনে কোন্ লোক পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে ? অতএব আপনারা কালক্ষেপ করবেন না, ধর্ম ও নিয়ম অনুসারে যা পাণ্ডবগণের প্রাপ্য তা দিন।

পুরোহিতের কথা শুনে ভীষ্ম বললেন, ভাগ্যক্রমে পাণ্ডবগণ ও কৃষ্ণ কুশলে আছেন এবং ধর্মপথে থেকে সন্ধিকামনা করছেন। আপনি যা বলেছেন সবই সত্য, তবে আপনি ব্রাহ্মণ সেজন্য আপনার বাক্য অতিরিক্ত তীক্ষ্ম। পাণ্ডবদের বহু কষ্ট দেওয়া হয়েছে এবং ধর্মানুসারে তারা পিতৃধনের অধিকারী এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। অর্জুন অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত মহারথ, স্বয়ং ইন্দ্রও যুদ্ধে তার সমকক্ষ নন।

কর্ণ ক্রুদ্ধ হয়ে বাধা দিয়ে দ্রুপদের পুরোহিতকে বললেন, ব্রাহ্মণ, যা হয়ে গেছে। তা সকলেই জানে, বার বার সে কথা বলে লাভ কি? দুর্যোধনের জন্যই শকুনি দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরকে জয় করেছিলেন এবং যুধিষ্ঠির পণরক্ষার জন্য বনে গিয়েছিলেন। প্রতিজ্ঞানুযায়ী সময়ের মধ্যে (১) তিনি মূখের ন্যায় রাজ্য চাইতে পারেন না। দুর্যোধন ধর্মানুসারে শত্রুকে সমস্ত পৃথিবী দান করতে পারেন, কিন্তু ভয় পেয়ে পাদপরিমিত ভূমিও দেবেন না। পাণ্ডবরা যদি পৈতৃক রাজ্য চান তবে অবশিষ্ট কাল বনবাসে কাটিয়ে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন, তার পর নির্ভয়ে দুর্যোধনের ক্রোড়ে আশ্রয় নিন।

ভীষ্ম বললেন, রাধেয়, অহংকার করে লাভ কি, অর্জুন একাকী ছ’জন রথীকে জয় (২) করেছিলেন তা স্মরণ কর। এই ব্রাহ্মণ যা বললেন তা যদি আমরা না করি তবে অর্জুন কর্তৃক নিহত হয়ে আমরা রণভূমিতে ধূলিভক্ষণ করব।

কর্ণকে ভর্ৎসনা করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, শান্তনুপুত্র ভীষ্ম যা বলেছেন তা সকলের পক্ষে হিতকর। ব্রাহ্মণ, আমি চিন্তা করে পাণ্ডবগণের নিকট সঞ্জয়কে পাঠাব, আপনি আজই অবিলম্বে ফিরে যান। তার পর ধৃতরাষ্ট্র দ্রুপদপুরোহিতকে সসম্মানে বিদায় দিলেন।

** (১) কর্ণ বলতে চান যে, অজ্ঞাতবাসের কাল উত্তীর্ণ হবার আগেই পাণ্ডবগণ আত্মপ্রকাশ করেছেন সেজন্য তাদের আবার বার বৎসর বনবাসে থাকতে হবে।

(২) গোহরণকালে

৭। সঞ্জয়ের দৌত্য

ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন, তুমি উপপ্লব্য নগরে গিয়ে পাণ্ডবগণের সংবাদ নেবে এবং অজাতশত্রু যুধিষ্ঠিরকে অভিনন্দন করে বলবে, ভাগ্যক্রমে তুমি বনবাস থেকে জনপদে ফিরে এসেছ। সঞ্জয়, আমি পাণ্ডবদের সূক্ষ্ম দোষও দেখতে পাই না, ক্রস্বভাব মন্দবুদ্ধি দুর্যোধন এবং ততোধিক ক্ষুদ্রমতি কর্ণ ভিন্ন এখানে এমন কেউ নেই যে পাণ্ডবদের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত। ভীম অর্জুন নকুল সহদেব এবং কৃষ্ণ ও সাত্যকি যাঁর অনুগত সেই যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধের পূর্বেই তার রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া ভাল। গুপ্তচরদের কাছে কৃষ্ণের যে পরাক্রমের কথা শুনেছি তা মনে করে আমি শান্তি পাচ্ছি না, অর্জুন ও কৃষ্ণ মিলিত হয়ে এক রথে আসবেন শুনে আমার হৃদয় কম্পিত হচ্ছে। যুধিষ্ঠির মহাতপা ও ব্রহ্মচর্যশালী, তার ক্রোধকে আমি যত ভয় করি অর্জুন কৃষ্ণ প্রভৃতিকেও তত করি না। সঞ্জয়, তুমি রথারোহণে পাঞ্চালরাজের সেনানিবেশে যাও এবং যুধিষ্ঠির যাতে প্রীত হন এমন কথা বলো। সকলের মঙ্গল জিজ্ঞাসা করে তাকে জানিও যে আমি শান্তিই চাই। বিপক্ষকে যা বলা উচিত, যা ভরতবংশের হিতকর, এবং যাতে যুদ্ধের প্ররোচনা না হয় এমন কথাই তুমি বলবে।

সূতবংশীয় গবদ্গনপুত্র সঞ্জয় উপপ্লব্য নগরে এসে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করলেন। উভয়পক্ষের কুশল জিজ্ঞাসার পর যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, দীর্ঘকাল পরে কুরুবৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কুশল শুনে এবং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ ধৃতরাষ্ট্রকেই দেখছি। তার পর যুধিষ্ঠির সকলেরই সংবাদ নিলেন, যথা—ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা কর্ণ, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ, রাজপুরস্থ জননীগণ, পুত্র ও পুত্রবধূগণ, ভগিনী ভাগিনেয় ও দৌহিত্রগণ, দাসীগণ প্রভৃতি।

সকলের কুশলসংবাদ দিয়ে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, দুর্যোধনের কাছে সাধুপ্রকৃতি বৃদ্ধগণ আছেন, আবার পাপাত্মারাও আছে। আপনারা দুর্যোধনের কোনও অপকার করেননি তথাপি তিনি আপনাদের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত হয়েছেন। স্থবির ধৃতরাষ্ট্র যুদ্ধের অনুমোদন করেন না, তিনি মনস্তাপ ভোগ করছেন, সকল পাতক অপেক্ষা মিত্রদ্রোহ গুরুতর—এ কথাও ব্রাহ্মণদের কাছে শুনেছেন। অজাতশত্রু, আপনি নিজের বুদ্ধিবলে। শান্তির উপায় স্থির করুন। আপনারা সকলেই ইন্দ্রতুল্য, কষ্টে পড়লেও আপনারা ভোগের জন্য ধর্মত্যাগ করবেন না।

যুধিষ্ঠির বললেন, এখানে সকলেই উপস্থিত আছেন, ধৃতরাষ্ট্র যা বলেছেন তাই বল। সঞ্জয় বললেন, পঞ্চপাণ্ডব বাসুদেব সাত্যকি চেকিতান (১) বিরাট পাঞ্চালরাজ ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্বােধন করে আমি বলছি। রাজা ধৃতরাষ্ট্র শান্তির প্রশংসা করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন, তার বাক্য আপনাদের রুচিকর হ’ক, শান্তি স্থাপিত হ’ক। মহাবলশালী পাণ্ডবগণ, হীন কর্ম করা আপনাদের উচিত নয়, শুক্ল বস্ত্রে অঞ্জনবিন্দুর ন্যায় সেই পাপ যেন আপনাদের স্পর্শ না করে। কৌরবগণকে যদি যুদ্ধে বিনষ্ট করেন তবে জ্ঞাতিবধের ফলে আপনাদের জীবন মৃত্যুর তুল্য হবে। কৃষ্ণ সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ও চেকিতান যাঁদের সহায় কে তাদের জয় করতে পারে? আবার দ্রোণ ভীষ্ম অশ্বত্থামা কৃপ কর্ণ শল্য প্রভৃতি যাঁদের পক্ষে আছেন সেই কৌরবগণকেই বা কে জয় করতে পারে ? জয়ে বা পরাজয়ে আমি কোনও মঙ্গলই দেখছি না। আমি বিনীত হয়ে কৃষ্ণ ও বৃদ্ধ পাঞ্চালরাজের নিকট প্রণত হচ্ছি, সকলের মঙ্গলের জন্য আমি সন্ধির প্রার্থনা করছি। ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র এই চান যে, আপনারা শান্তি স্থাপন করুন।

যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, আমি যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক এমন কথা তোমাকে বলিনি, তবে ভীত হচ্ছ কেন? যুদ্ধ অপেক্ষা অযুদ্ধ ভাল, যদি দারুণ কর্ম না করেও অভীষ্ট বিষয় পাওয়া যায় তবে কোন মূর্খ যুদ্ধ করতে চায়? বিনা যুদ্ধে অল্প পেলেও লোকে যথেষ্ট মনে করে। প্রদীপ্ত অগ্নি যেমন ঘৃত পেয়ে তৃপ্ত হয় না, মানুষও সেইরূপ কাম্য বস্তু পেয়ে তৃপ্ত হয় না। দেখ, ধৃতরাষ্ট্র ও তার পুত্রগণ বিপুল ভোগ্য বিষয় পেয়েও তৃপ্ত হন নি। ধৃতরাষ্ট্র সংকটে পড়ে পরের উপর নির্ভর করছেন, এতে তার মঙ্গল হবে না। তিনি বহু ঐশ্বর্যের অধিপতি, এখন দুর্বুদ্ধি ক্রুরস্বভাব কুমন্ত্ৰিবেষ্টিত পুত্রের জন্য বিলাপ করছেন কেন? দুর্যোধনের স্বভাব জেনেও তিনি বিশ্বস্ত বিদুরের উপদেশ অগ্রাহ্য করে অধর্মের পথে চলছেন। দুঃশাসন শকুনি আর কর্ণ—এঁরাই এখন লোভী দুর্যোধনের মন্ত্রী। আমরা বনবাসে গেলে ধৃতরাষ্ট্র ও তার পুত্ররা মনে করলেন সমগ্র রাজ্যই তাদের হস্তগত হয়েছে। এখনও তারা নিষ্কণ্টক হয়ে তা ভোগ করতে চান, এমন অবস্থায় শান্তি অসম্ভব। ভীম অর্জুন নকুল ও সহদেব জীবিত থাকতে ইন্দ্রও আমাদের ঐশ্বর্য হরণ করতে পারেন না। আমরা কত কষ্ট পেয়েছি। তা তুমি জান; তোমার অনুরোধে সমস্তই ক্ষমা করতে প্রস্তুত আছি; কৌরবদের সঙ্গে পূর্বে আমাদের যে সম্বন্ধ ছিল তাও অব্যাহত থাকবে, তোমার কথা অনুসারে শান্তিও স্থাপিত হবে; কিন্তু দুর্যোধন আমাদের রাজ্য ফিরিয়ে দিন, ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য আবার আমার হ’ক।

** (১) যাদব যোদ্ধা বিশেষ

সঞ্জয় বললেন, অজাতশত্ৰু, কৌরবগণ যদি আপনাকে রাজ্যের ভাগ না দেন তবে অন্ধক ও বৃষ্ণিদের রাজ্যে (১) আপনাদের ভিক্ষা করাও শ্রেয়, কিন্তু যুদ্ধ করে রাজ্যলাভ উচিত হবে না। মানুষের জীবন অল্পকালস্থায়ী দুঃখময় ও অস্থির; যুদ্ধ করা আপনার যশের অনুরূপ নয়, অতএব আপনি পাপজনক যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হন। জনার্দন সাত্যকি ও দ্রুপদ প্রভৃতি রাজারা চিরকালই আপনার অনুগত, এঁদের সাহায্যে পূর্বেই আপনি যুদ্ধ করে দুর্যোধনের দর্প চূর্ণ করতে পারতেন। কিন্তু বহু বৎসর বনে বাস করে বিপক্ষের শক্তি বাড়িয়ে এবং স্বপক্ষের শক্তি ক্ষয় করে। এখন যুদ্ধ করতে চাচ্ছেন কেন? আপনার পক্ষে ক্ষমাই ভাল, ভোগের ইচ্ছা ভাল নয়, ভীষ্ম দ্রোণ দুর্যোধন প্রভৃতিকে বধ করে রাজ্য পেয়ে আপনার কি সুখ হবে? যদি আপনার অমাত্যবর্গই আপনাকে যুদ্ধে উৎসাহিত করেন, তবে তাদের হাতে সর্বস্ব দিয়ে আপনি সরে যান, স্বর্গের পথ থেকে ভ্রষ্ট হবেন না।

যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, আমি ধর্ম করছি কি অধর্ম করছি তা জেনে আমার নিন্দা করো। আপকালে ধর্মের পরিবর্তন হয়, বিদ্বান লোকে বুদ্ধিবলে কর্তব্য নির্ণয় করেন। কিন্তু বিপন্ন না হলে পরধর্ম আশ্রয় করা নিন্দনীয়, যদি আমরা তা করে থাকি তবে আমাদের দোষ দিও। আমি পিতৃপিতামহের পথেই চলি। যদি সাম নীতি বর্জন করি (সন্ধিতে অসম্মত হই) তবে আমি নিন্দনীয় হব; যুদ্ধের উদযোগ করে যদি ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম পালন না করি (যুদ্ধে বিরত হই) তা হলেও আমার দোষ হবে। মহাযশা বাসুদেব উভয়পক্ষের শুভার্থী, ইনিই বলুন আমাদের কর্তব্য কি।

কৃষ্ণ বললেন, আমি দুই পক্ষেরই হিতাকাঙ্ক্ষী এবং শান্তি ভিন্ন আর কিছুর উপদেশ দিতে চাই না। যুধিষ্ঠির তার শান্তিপ্রিয়তা দেখিয়েছেন, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র আর তাঁর পুত্ররা লোভী, অতএব কলহের বৃদ্ধি হবেই। যুধিষ্ঠির ক্ষত্রধর্ম অনুসারে নিজের রাজ্য উদ্ধারের জন্য উৎসাহী হয়েছেন, এতে তার ধর্মলোপ হবে কেন? পাণ্ডবরা যদি এমন কোনও উপায় জানতেন যাতে কৌরবদের বধ না করে রাজ্যলাভ করা যায় তবে এঁরা ভীমসেনকে দমন করেও সেই উপায় অবলম্বন করতেন। পৈতৃক ক্ষত্রধর্ম অনুসারে যুদ্ধ করতে গিয়ে যদি ভাগ্যদোষে এঁদের মৃত্যু হয় তাও প্রশংসনীয় হবে। সঞ্জয়, তুমিই বল, ক্ষত্রিয় রাজাদের পক্ষে যুদ্ধ করা ধর্মর্সম্মত কিনা। দস্যুবধ করলে পুণ্য হয়, অধর্মজ্ঞ কৌরবগণ দস্যুবৃত্তিই অবলম্বন করেছেন। লোকদৃষ্টির অগোচরে বা প্রকাশ্যভাবে সবলে যে পরের ধন হরণ করে সে চোর। দুর্যোধনের সঙ্গে চোরের কি পার্থক্য আছে? পাণ্ডবগণের প্রিয়া ভার্যা দ্রৌপদীকে যখন দূতসভায় আনা হয়েছিল তখন ভীষ্মদি কিছুই বলেন নি, ধৃতরাষ্ট্রও বারণ করেন নি। দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীকে শ্বশুরদের সমক্ষে টেনে নিয়ে এল তখন বিদুর ভিন্ন কেউ তার রক্ষক ছিলেন না, সমবেত রাজারা কোনও প্রতিবাদ করতে পারলেন না। সঞ্জয়, দূতসভায় যা ঘটেছিল তা ভুলে গিয়ে তুমি এখন পাণ্ডবদের উপদেশ দিচ্ছ! পাণ্ডবদের অনিষ্ট না করে যদি আমি শান্তি স্থাপন করতে পারি তবে আমার পক্ষে তা পুণ্যকর্ম হবে। আমি নীতিশাস্ত্র অনুসারে ধর্মসম্মত অহিংস উপদেশ দেব, কিন্তু কৌরবগণ কি তা বিবেচনা করবেন ? তারা কি আমার সম্মান রক্ষা করবেন? পাণ্ডবগণ শান্তিকামী, যুদ্ধ করতেও সমর্থ, এই বুঝে তুমি ধৃতরাষ্ট্রকে আমাদের মত যথাযথ জানিও।

সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আমাকে এখন গমনের অনুমতি দিন। আমি আবেগবশে কিছু অন্যায় বলি নি তো? জনার্দন, ভীমার্জুন, নকুল-সহদেব, সাত্যকি, চেকিতান, সকলকেই অভিবাদন করে আমি বিদায় চাচ্ছি। আপনারা সুখে থাকুন, আমাকে প্রসন্ননয়নে দেখুন।

যুধিষ্ঠির বললেন, সঞ্জয়, তুমি প্রিয়ভাষী বিশ্বস্ত দূত, কটুবাক্যেও ক্রুদ্ধ হও না, কৌরব ও পাণ্ডব উভয়পক্ষই তোমাকে মধ্যস্থ মনে করেন, পূর্বে তুমি ধনঞ্জয়ের অভিন্নহৃদয় সখা ছিলে। তুমি এখন যেতে পার। হস্তিনাপুরের বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতগণকে, দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে, এবং বৃদ্ধ অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে আমার অভিবাদন জানিও। গন্ধর্বতুল্য প্রিয়দর্শন অস্ত্রবিশারদ অশ্বত্থামা, মূর্খ শঠ দুর্যোধন, তার তুল্যই মূর্খ দুষ্টস্বভাব দুঃশাসন, যুদ্ধবিমুখ ধার্মিক বৈশ্যাপুত্র যুযুৎসু, মহাধনুর্ধর ভূরিশ্রবা ও শল্য, অদ্বিতীয় অক্ষপটু মিথ্যাবুদ্ধি গান্ধাররাজ শকুনি, যিনি পাণ্ডবদের জয় করতে চান এবং দুর্যোধনাদিকে মুগ্ধ করে রেখেছেন সেই কর্ণ, অগাধবুদ্ধি। দীর্ঘদশী বিদুর যিনি আমাদের পিতামাতার তুল্য মাননীয় শুভার্থী ও উপদেষ্টা; এবং যাঁরা বৃদ্ধা, রাজভার্যা বা আমাদের পুত্রবধূ-স্থানীয়া, তাঁদের সকলকে কুশলজিজ্ঞাসা করো। তুমি অন্তঃপুরে গিয়ে কল্যাণীয়া কুমারীগণকে আলিঙ্গন করে জানিও যে আমি আশীর্বাদ করছি তারা অনুকূল পতি লাভ করুক। বেশ্যা দাসদাসী খঞ্জ ও কুঞ্জদের, এবং অন্ধ ও বধির শিল্পীদের অনাময় জিজ্ঞাসা করো। যে সকল ব্রাহ্মণ আমার নিকট বৃত্তি পেতেন তাদের জন্য দুর্যোধনকে বলো। ভীষ্মের চরণে আমার প্রণাম জানিয়ে বলো, পিতামহ যাতে আপনার সকল পৌত্র প্রীতিযুক্ত হয়ে জীবিত থাকে সেই চেষ্টা করুন। দুর্যোধনকে বলো, নরশ্রেষ্ঠ, পরদ্রব্যে লোভ ক’রো না, আমার শান্তিই চাই, তুমি রাজ্যের একটি প্রদেশ আমাদের দাও। অথবা আমাদের পাঁচ ভ্রাতাকে পাঁচটি গ্রাম দাও-কুশস্থল বৃকস্থল মাকন্দী বারণাবত এবং আর একটি, তা হলেই বিবাদের অবসান হবে। সঞ্জয়, আমি সন্ধি বা যুদ্ধ উভয়ের জন্য প্রস্তুত, মৃদু বা দারুণ দুই কার্যেই সমর্থ।

যুধিষ্ঠিরের নিকট বিদায় নিয়ে সঞ্জয় সত্বর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ফিরে এসে বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, আপনি পত্রের বশবর্তী হয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য ভোগ করতে চাচ্ছেন এতে আপনার পৃথিবীব্যাপী অখ্যাতি হয়েছে। আপনার দোযেই কুরুপাণ্ডবদের বিরোধ ঘটেছে, যদি যুধিষ্ঠিরকে তার রাজ্য ফিরিয়ে না দেন তবে অগ্নি যেমন শুষ্ক তৃণ দগ্ধ করে সেইরূপ অর্জুন কৌরবগণকে ধ্বংস করবেন। আপনি অবিশ্বস্ত লোকদের মতে চলছেন, বিশ্বস্ত লোকদের বর্জন করেছেন; আপনার এমন শক্তি নেই যে এই বিশাল রাজ্য রক্ষা করতে পারেন। আমি রথের বেগে শ্রান্ত হয়েছি, আজ্ঞা দিন এখন শয়ন করতে যাই। যুধিষ্ঠির যা বলেছেন কাল প্রভাতে আপনাকে জানাব।

** (১) যাদবগণের দেশে।

॥ প্রজাগর-ও সনৎসুজাত-পর্বাধ্যায়॥

৮। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে বিদুর-বিরোচন ও সুধন্বা

সঞ্জয় চ’লে গেলে ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে ডেকে আনিয়ে বললেন, পাণ্ডবদের কাছ থেকে ফিরে এসে সঞ্জয় আমাকে ভর্ৎসনা করেছে, কাল সে যুধিষ্ঠিরের কথা জানাবে। আমি উৎকণ্ঠায় দগ্ধ হচ্ছি, আমার নিদ্রা আসছে না, মনের শান্তি নেই, সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন বিকল হয়েছে। বিদুর, তুমি আমাকে সৎপরামর্শ দাও।

বিদুর বললেন, মহারাজ, যুধিষ্ঠির রাজোচিত লক্ষণযুক্ত এবং ত্রিলোকের অধিপতি হবার যোগ্য। তিনি আপনার আজ্ঞাবহ ছিলেন সেজন্যই নির্বাসনে গিয়েছিলেন। আপনি ধর্মজ্ঞ, কিন্তু অন্ধ, সেজন্য রাজ্যলাভের যোগ্য নন। দুর্যোধন শকুনি কর্ণ ও দুঃশাসনকে প্রভুত্ব দিয়ে আপনি কি করে শ্রেয়েলাভ করতে পারেন? আপনি পাণ্ডবগণকে তাদের পিতৃরাজ্য দান করুন, তাতে আপনি সপুত্র সুখী হবেন, আপনার অখ্যাতি দূর হবে। যত কাল মানুষের কীর্তি ঘোষিত হয় তত কালই সে স্বর্গভোগ করে। আপনি পাণ্ডুপুত্রদের সঙ্গে সরল ব্যবহার করুন, তাতে আপনি ইহলোকে কীর্তি এবং মরণান্তে স্বর্গ লাভ করবেন। একটি প্রাচীন কথা বলছি শুনুন।

কেশিনী নামে এক অতুলনীয়া রূপবতী কন্যা ছিলেন। তার স্বয়ংবরে প্রহাদের পুত্র বিরোচন উপস্থিত হলে কেশিনী তাকে প্রশ্ন করলেন, ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ না দৈত্য শ্রেষ্ঠ? বিরোচন বললেন, প্রজাপতি কশ্যপের বংশধর দৈত্যরাই শ্রেষ্ঠ, সর্বলোক আমাদেরই অধীন। কেশিনী বললেন, কাল সুধন্বা এখানে আসবেন, তখন তোমাদের দুজনকেই দেখব। পরদিন সুধন্বা এলে কেশিনী তাঁকে পাদ্য অর্ঘ্য ও আসন দিলেন। বিরোচন বললেন, সুধন্বা আমার এই হিরন্ময় আসনে বসুন। সুধন্বা বললেন, তোমার আসন আমি স্পর্শ করলাম, কিন্তু তোমার সঙ্গে বসব না; তোমার পিতা আমার আসনের নিম্নে বসেন। বিরোচন বললেন, স্বর্ণ গো অশ্ব প্রভৃতি অসুরদের যে বিত্ত আছে সে সমস্তই আমি পণ রাখছি; যিনি অভিজ্ঞ তিনিই বললেন আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ। সুধন্বা বললেন, স্বর্ণ গো প্রভৃতি তোমারই থাকুক, জীবন পণ রাখা হ’ক।

দুজনে প্রহ্লাদের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ বললেন, তোমরা পূর্বে কখনও একসঙ্গে চলতে না, এখন কি তোমাদের সখ্য হয়েছে? বিরোচন বললেন, পিতা, সখ্য হয় নি, আমরা জীবন পণ রেখে তর্কের মীমাংসার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সুধন্বার সংবর্ধনার জন্য প্রহ্লাদ পাদ্য জল, মধুপর্ক ও দুই স্কুল শ্বেত বৃষ আনতে বললেন। সুধন্বা বললেন, ওসব থাকুক, আপনি আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিন-ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, না বিরোচন শ্রেষ্ঠ? প্রহ্লাদ বললেন, সুধম্বার পিতা অঙ্গিরা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সুধার মতো বিরোচনের মাতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। বিরোচন, তুমি পরাজিত হয়েছ, তোমার প্রাণ এখন সুধন্বার অধীন। সুধন্বা, আমার প্রার্থনায় তুমি বিরোচনকে প্রাণদান কর। সুধম্বা বললেন, দৈত্যরাজ, আপনি ধর্মানুসারে সত্য কথা বলেছেন, পুত্রের প্রাণরক্ষার জন্য মিথ্যা বলেন নি, সেজন্য বিরোচনকে মুক্তি দিলাম। ইনি কুমারী কেশিনীর সমক্ষে আমার পাদপ্রক্ষালন করুন। (১)

উপাখ্যান শেষ করে বিদুর বললেন, মহারাজ, পররাজ্যের জন্য মিথ্যা বলে। আপনি পুত্র ও অমাত্য সহ বিনষ্ট হবেন না। পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করুন, পাণ্ডবরা যেমন সত্যপালন করেছেন দুর্যোধনকেও সেইরূপ সত্যরক্ষায় প্রবৃত্ত করুন, তিনি পূর্বে যে পাপ করেছেন আপনি তার অপনয়ন করুন। বিদুর আরও অনেক উপদেশ দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তুমি যা বললে সবই সত্য, পাণ্ডবদের সঙ্গে আমি ন্যায়সংগত ব্যবহার করতে চাই, কিন্তু দুর্যোধন কাছে এলেই আমার বুদ্ধির পরিবর্তন হয়। মানুষের ভাগ্যই প্রবল, পুরুষকার নিরর্থক। বিদুর, তোমার কথা অতি বিচিত্র, যদি আরও কিছু বলবার থাকে তো বল। বিদুর বললেন, আমি শূদ্রযোনিতে জন্মেছি, অধিক কিছু বলতে সাহস করি না। জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ সনৎসুজাত (সনৎকুমার) আপনার সকল সংশয় খণ্ডন করবেন।

বিদুর স্মরণ করলে সনৎসুজাত তখনই আবির্ভূত হলেন। তাঁকে যথাবিধি অর্চনা করে বিদুর বললেন, ভগবান, ধৃতরাষ্ট্র সংশয়াপন্ন হয়েছেন, আপনি এমন উপদেশ দিন যাতে এঁর সকল দুঃখ দূর হয়। বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্রের প্রার্থনায় সনৎসুজাত ধর্ম। ও মোক্ষবিষয়ক বহু উপদেশ দিলেন।

** (১) মূলে আছে-‘পাদপ্রক্ষালনং কুর্যাৎ কুমাৰ্যাঃ সন্নিধৌ মম। টীকাকার নীলকণ্ঠ ব্যাখ্যা করেছেন, আমার সন্নিধানে কুমারী কেশিনীর পাদপ্রক্ষালন করুন, অর্থাৎ তাকে বিবাহ করুন; বিবাহের পূর্বে বরকন্যা হরিদ্রা দিয়ে পরস্পরের পাদপ্রক্ষালন করে।

॥ যানসন্ধিপর্বাধ্যায়॥

৯। কৌরবসভায় বাদানুবাদ

ধৃতরাষ্ট্র সমস্ত রাত্রি বিদুর ও সনৎসুজাতের সঙ্গে আলাপে যাপন করলেন। পরদিন তিনি রাজসভায় উপস্থিত হয়ে ভীষ্ম দ্রোণ দুর্যোধন কর্ণ প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হলেন। সকলে আসন গ্রহণ করলে সঞ্জয় তার দৌত্যের বৃত্তান্ত সবিস্তারে নিবেদন করলেন।

ভীষ্ম বললেন, আমি শুনেছি দেবগণেরও পূর্বতন নর-নারায়ণ ঋষিদ্বয় অর্জুন ও কৃষ্ণ রূপে জন্মগ্রহণ করেছেন, এঁরা সুরাসুরেরও অজেয়। বৎস দুর্যোধন, ধর্ম ও অর্থ থেকে তোমার বুদ্ধি চ্যুত হয়েছে, যদি আমার বাক্য গ্রাহ্য না কর তবে বহুলোকের মৃত্যু হবে। কেবল তুমিই তিনজনের মতে চলনিকৃষ্টজাতীয় সূত্রপুত্র। কর্ণ যাঁকে পরশুরাম অভিশাপ দিয়েছিলেন, সুবলপুত্র শকুনি, এবং ক্ষুদ্রাশয় পাপবুদ্ধি দুঃশাসন।

কর্ণ বললেন, পিতামহ, আমি ক্ষত্রধর্ম পালন করি, ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হইনি, আমার কি দুষ্কর্ম দেখেছেন যে নিন্দা করছেন? আমি সকল পাণ্ডবকে যুদ্ধে বধ করব। যাদের সঙ্গে পূর্বে বিরোধ হয়েছে তাদের সঙ্গে আর সন্ধি হ’তে পারে না। ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, এই দুর্মতি সূতপুত্রের জন্যই তোমার দুরাত্মা পুত্ররা বিপদে পড়বে। বিরাটনগরে যখন এঁর ভ্রাতা অর্জুনের হস্তে নিহত হয়েছিলেন, তখন কর্ণ কি করছিলেন? কৌরবগণকে পরাভূত করে অর্জুন যখন তাদের বস্ত্র হরণ করেছিলেন তখন কর্ণ কি বিদেশে ছিলেন ? ঘোষযাত্রায় গন্ধর্বরা যখন তোমার পুত্রকে হরণ করেছিল তখন কর্ণ কোথায় ছিলেন ? এখন ইনি বৃষের ন্যায় আস্ফালন করছেন!

মহামতি দ্রোণ বললেন, মহারাজ, ভীষ্ম যা বলবেন আপনি তাই করুন, গর্বিত। লোকের কথা শুনবেন না। যুদ্ধের পূর্বেই পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করা ভাল মনে করি, কারণ অর্জুনের তুল্য ধনুর্ধর ত্রিলোকে নেই। ভীষ্ম ও দ্রোণের কথায় ধৃতরাষ্ট্র মন দিলেন না, তাদের সঙ্গে কথাও বললেন না, কেবল সঞ্জয়কে প্রশ্ন করতে লাগলেন।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, সঞ্জয়, আমাদের বহু সৈন্য সমবেত হয়েছে শুনে যুধিষ্ঠির কি বললেন? কারা তার আজ্ঞার অপেক্ষা করছেন? কারা তাকে যুদ্ধ থেকে নিরস্ত হ’তে বলছেন? সঞ্জয় বললেন, যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতারা এবং পাঞ্চাল কেকয় ও মৎস্যগণ, গোপাল ও মেষপালগণ, সকলেই যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাবহ। সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে যেন চিন্তা করতে লাগলেন এবং সহসা মূৰ্ছিত হলেন। বিদুরের মুখে সঞ্জয়ের অবস্থা শুনে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, পাণ্ডবরা এঁকে উদবিগ্ন করেছেন।

কিছুক্ষণ পরে সুস্থ হয়ে সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, যুধিষ্ঠিরের মহাবল ভ্রাতারা, মহাতেজা দ্রুপদ, তাঁর পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী যিনি পূর্বজন্মে কাশীরাজের কন্যা ছিলেন এবং ভীষ্মের বধকামনায় তপস্যা করে দ্রুপদের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে পরে পুরুষ হয়েছেন (১), কেকয়রাজের পঞ্চ পুত্র, বৃষ্ণিবংশীয় মহাবীর সাত্যকি, কাশীরাজ, দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র, কৃষ্ণতুল্য বলবান অভিমন্যু, শিশুপালপুত্র ধৃষ্টকেতু, তাঁর ভ্রাতা শরভ, জরাসন্ধপুত্র সহদেব ও জয়ৎসেন, এবং স্বয়ং বাসুদেব-এঁরাই যুধিষ্ঠিরের সহায়।

** (১) উদযোগপর্ব ২৭-পরিচ্ছেদে এই ইতিহাস আছে।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমি ভীমকে সর্বপেক্ষা ভয় করি, সে ক্ষমা করে না, শত্রুকে ভোলে না, পরিহাসকালেও হাসে না, বক্রভাবে দৃষ্টিপাত করে। উদ্ধতস্বভাব বহুভোজী অস্পষ্টভাষী পিঙ্গলনয়ন ভীম গদাঘাতে আমার পুত্রদের বধ করবে। পাণ্ডবরা জয়ী হবে জেনেও আমি পুত্রদের বারণ করতে পারছি না, কারণ মানুষের ভাগ্যই বলবান। পাণ্ডবগণ যেমন ভীষ্মের পৌত্র এবং দ্ৰোণ-কৃপের শিষ্য, আমার পুত্রগণও তেমন। ভীষ্ম দ্রোণ ও কৃপ এই তিন বৃদ্ধ আমার আশ্রয়ে আছেন, এঁরা সজ্জন, যা কিছু এঁদের দান করেছি তার প্রতিদান এঁরা নিশ্চয় করবেন। এঁরা আমার পুত্রের পক্ষে থাকবেন এবং যুদ্ধশেষ পর্যন্ত সৈন্যগণের অগ্রণী হবেন। কিন্তু দ্রোণ ও কর্ণ অর্জুনের বিপক্ষে দাঁড়ালেও জয় সম্বন্ধে আমার সংশয় রয়েছে, কারণ কর্ণ ক্ষমাশীল ও অসতর্ক এবং দ্রোণাচার্য স্থবির ও অর্জুনের গুরু। শুনেছি তিন তেজ একই রথে মিলিত হবে-কৃষ্ণ, অর্জুন ও গাণ্ডীব ধনু। আমাদের তেমন সারথি নেই, যোদ্ধা নেই, ধনুও নেই। কৌরবগণ, যুদ্ধ করা আমি ভাল মনে করি না। আপনারা ভেবে দেখুন, যদি আপনাদের মত হয় তবে আমি শান্তির চেষ্টা করব।

সঞ্জয় বললেন, মহারাজ, আপনি ধীরবুদ্ধি, অর্জুনের পরাক্রমও জানেন, তথাপি কেন পুত্রদের বশে চ’লেন জানি না। দূতসভায় পাণ্ডবদের প্রতিবার পরাজয় শুনে আপনি বালকের ন্যায় হেসেছিলেন। তাদের যে কটুবাক্য বলা হয়েছিল তা আপনি। উপেক্ষা করেছিলেন। তারা যখন বনে যান তখনও আপনি বার বার হেসেছিলেন। এখন আপনি অসহায়ের ন্যায় বৃথা বিলাপ করছেন। ভীমার্জুন যাঁর পক্ষে যুদ্ধ করবেন তিনিই নিখিল বসুধার রাজা হবেন। এখন আপনার দুরাত্মা পুত্র ও তার অনুগামীদের সর্ব উপায়ে নিবৃত্ত করুন।

দুর্যোধন বললেন, মহারাজ, ভয় পাবেন না। পাণ্ডবরা বনে গেলে কৃষ্ণ, কেকয়গণ, ধৃষ্টকেতু, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও বহু রাজা সসৈন্যে ইন্দ্রপ্রস্থের নিকটে এসে আমাদের নিন্দা করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, পাণ্ডবদের উচিত কৌরবদের উচ্ছেদ করে পুনর্বার রাজ্য অধিকার করা। গুপ্তচরের মুখে এই সংবাদ পেয়ে আমার ধারণা হয়। যে পাণ্ডবরা তাদের বনবাসের প্রতিজ্ঞা পালন করবেন না, যুদ্ধে আমাদের পরাস্ত করবেন। সেই সময়ে আমাদের মিত্র ও প্রজারা সকলেই ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের ধিক্কার দিচ্ছিল। তখন আমি ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও অশ্বত্থামাকে বললাম, পিতা আমার জন্য দুঃখ ভোগ করছেন, অতএব সন্ধি করাই ভাল। তাতে ভীষ্মদ্রোণাদি আমাকে আশ্বাস দিলেন, ভয় পেয়ো না, যুদ্ধে কেউ আমাদের জয় করতে পারবে না। মহারাজ, অমিততেজা ভীষ্মদ্রোণাদির তখন এই দৃঢ় ধারণা ছিল। এখন পাণ্ডবগণ পূর্বাপেক্ষা বলহীন হয়েছে, সমস্ত পৃথিবী আমাদের বশে এসেছে, যে রাজারা আমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছেন তারা সুখে দুঃখে আমাদেরই অংশভাগী হবেন, অতএব আপনি ভয় দুর করুন। আমাদের সৈন্যসমাবেশে যুধিষ্ঠির ভীত হয়েছেন তাই তিনি কেবল পাঁচটি গ্রাম চেয়েছেন, তার রাজধানী চান নি। বৃকোদরের বল সম্বন্ধে আপনি যা মনে। করেন তা মিথ্যা। আমি যখন বলরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতাম তখন সকলে বলত গদাযুদ্ধে আমার সমান পৃথিবীতে কেউ নেই। আমি এক আঘাতেই ভীমকে যমালয়ে পাঠাব। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ অশ্বত্থামা কর্ণ ভূরিশ্রবা শল্য ভগদত্ত ও জয়দ্রথ—এঁদের যে কেউ পাণ্ডবদের বধ করতে পারেন, এঁরা সম্মিলিত হলে ক্ষণমধ্যেই তাদের যমালয়ে পাঠাবেন। কর্ণ ইন্দ্রের কাছ থেকে অমোঘ শক্তি অস্ত্র লাভ করেছেন; সেই কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে অর্জুন কি করে বাঁচবেন? আমাদের যে দশ কোটি সংশপ্তক (১) সৈন্য আছে তারা প্রতিজ্ঞা করেছে-হয় আমরা অর্জুনকে মারব, না হয় তিনি আমাদের মারবেন। আমাদের এগার অক্ষৌহিণী সেনা, আর পাণ্ডবদের সাত, তবে। আমাদের পরাজয় হবে কেন? বৃহস্পতি বলেছেন, শত্রুর সেনা যদি এক তৃতীয়াংশ ন্যূন হয়, তবে তার সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আমাদের সেনার আধিক্য বিপক্ষসেনার এক-তৃতীয়াংশকে অতিক্রম করে। মহারাজ, বিপক্ষের বল সর্বপ্রকারেই আমাদের তুলনায় হীন।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমার পুত্র উন্মত্তের ন্যায় প্রলাপ বকছে এ কখনও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে জয় করতে পারবে না। পাণ্ডবদের বল ভীষ্ম যথার্থরূপে জানেন, সেজন্যই এঁর যুদ্ধে রুচি নেই। সঞ্জয়, যুদ্ধের জন্য পাণ্ডবগণকে কে উত্তেজিত করছে? সঞ্জয় বললেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন; তিনিই পাণ্ডবগণকে উৎসাহ দিচ্ছেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দুর্যোধন, যুদ্ধ হ’তে নিবৃত্ত হও, অর্ধরাজ্যই তোমাদের জীবিকা নির্বাহের পক্ষে যথেষ্ট, পাণ্ডবগণকে তাদের ন্যায্য ভাগ দাও। আমি যুদ্ধ ইচ্ছা করি না, ভীষ্মদ্রোণাদিও করেন না।

দুর্যোধন বললেন, আপনার অথবা ভীষ্মদ্রোণাদির ভরসায় আমি বল সংগ্রহ করি নি। আমি, কর্ণ ও দুঃশাসন, আমরা এই তিন জনেই পাণ্ডবদের বধ করব। আমি জীবন রাজ্য ও সমস্ত ধন ত্যাগ করব, কিন্তু পাণ্ডবদের সঙ্গে একত্র বাস করব না। তীক্ষ্ম সূচীর অগ্রভাগ দিয়ে যে পরিমাণ ভূমি বিদ্ধ করা যায় তাও আমি পাণ্ডবদের ছেড়ে দেব না।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমি দুর্যোধনকে ত্যাগ করলাম, সে যমালয়ে যাবে। যারা তার অনুগমন করবে তাদের জন্যই আমার শোক হচ্ছে। দেবগণ পাণ্ডবদের পিতা, তাঁরা পুত্রদের সাহায্য করবেন, ভীষ্মদ্রোণাদির প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হবেন। দেবতাদের সঙ্গে মিলিত হলে পাণ্ডবদের প্রতি কেউ দৃষ্টিপাত করতেও পারবে না।

দুর্যোধন বললেন, দেবতারা কাম দ্বেষ লোভ দ্রোহ প্রভৃতি ত্যাগ করেই দেবত্ব পেয়েছেন, তারা পুত্রদের সাহায্য করবেন না। যদি করতেন তবে পাণ্ডবরা এত কাল কষ্ট পেতেন না। দেবতারা আমার উপর বিক্রম প্রকাশ করবেন না, কারণ আমারও পরম তেজ আছে। আমি মন্ত্রবলে অগ্নি নির্বাপন করতে পারি, ভূমি বা। পর্বতশিখর বিদীর্ণ হলে পূর্ববৎ স্থাপন করতে পারি, শিলাবৃষ্টি ও প্রবল বায়ু নিবারণ করতে পারি, জল স্তম্ভিত করে তার উপর দিয়ে রথ ও পদাতি নিয়ে যেতে পারি। দেব গন্ধর্ব অসুর বা রাক্ষস কেউ আমার শত্রুকে ত্রাণ করতে পারবে না। আমি যা বলি তা সর্বদাই সত্য হয়, সেজন্য লোকে আমাকে সত্যবাক বলে।

কর্ণ বললেন, আমি পরশুরামের কাছে যে ব্রহ্মাস্ত্র পেয়েছি তাতেই পাণ্ডবগণকে সবান্ধবে সংহার করব। আমি পরশুরামকে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিলাম সেজন্য তিনি শাপ দেন—অন্তিমকালে এই ব্রহ্মাস্ত্র তোমার স্মরণে আসবে না। তার পর তিনি আমার উপর প্রসন্ন হয়েছিলেন। আমার আয়ু এখনও অবিশষ্ট আছে, ব্রহ্মাস্ত্রও আছে, অতএব পাণ্ডবদের নিশ্চয় জয় করব। মহারাজ, ভীষ্মদ্রোণাদি আপনার কাছেই থাকুন, পরশুরামের প্রসাদে আমিই সসৈন্যে গিয়ে পাণ্ডবদের বধ করব।

ভীষ্ম বললেন, কর্ণ, কৃতান্ত তোমার বুদ্ধি অভিভূত করেছেন তাই গর্ব করছ। তোমার ইন্দ্রদত্ত শক্তি অস্ত্র কেশবের সুদর্শন চক্রের আঘাতে ভস্মীভূত হবে। যে সর্পমুখ বাণকে তুমি নিত্য পূজা কর তা অর্জুনের বাণে তোমার সঙ্গেই বিনষ্ট হবে। যিনি বাণ ও নরক অসুরের হন্তা, যিনি তোমার অপেক্ষাও পরাক্রান্ত শত্রুকে সংহার করেছেন, সেই বাসুদেবই অর্জুনকে রক্ষা করবেন।

কর্ণ বললেন, মহাত্মা কৃষ্ণের প্রভাব নিশ্চয়ই এইরূপ, কিংবা আরও অধিক। কিন্তু পিতামহ ভীষ্ম আমাকে কটুবাক্য বলেছেন, সেজন্য আমি অস্ত্র ত্যাগ করলাম। ইনি যুদ্ধে বা এই সভায় আমাকে দেখতে পাবেন না। এঁর মৃত্যুর পর পৃথিবীর সকল রাজা আমার পরাক্রম দেখবেন। এই বলে কর্ণ সভা থেকে চ’লে গেলেন।

ভীষ্ম সহাস্যে বললেন, কর্ণ সত্যপ্রতিজ্ঞ, কিন্তু কি করে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবে? এই নরাধম যখন নিজেকে ব্রাহ্মণ বলে পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছিল তখনই এর ধর্ম আর তপস্যা নষ্ট হয়েছে।

ধৃতরাষ্ট্র তার পুত্রকে অনেক উপদেশ দিলেন, সঞ্জয়ও নানাপ্রকারে বোঝালেন যে পাণ্ডবদের জয় অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু দুর্যোধন নীরবে রইলেন। তখন রাজারা উঠে সভা থেকে চ’লে গেলেন। তার পর ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে ব্যাসদেব ও গান্ধারীর সমক্ষে সঞ্জয় কৃষ্ণমাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন।
 

** (১) যে মরণ পণ করে যুদ্ধ করে। দ্রোণপর্ব ৪-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

॥ ভগবদযানপর্বাধ্যায়॥

১০। কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরাদি ও দ্রৌপদীর অভিমত

সঞ্জয় হস্তিনাপুরে চ’লে গেলে যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন, তুমি ভিন্ন আর কেউ নেই যিনি আমাদের বিপদ থেকে ত্রাণ করতে পারেন। ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধনের অভিপ্রায় কি তা তুমি সঞ্জয়ের কথায় জেনেছ। লুব্ধ ধৃতরাষ্ট্র আমাদের রাজা ফিরিয়ে না দিয়েই শান্তি কামনা করছেন, তিনি স্বধর্ম দেখছেন না, স্নেহের বশে মূর্খ পুত্রের মতে চলছেন। জনার্দন, আমি আমার মাতা ও মিত্রগণকে পালন করতে পারছি না এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? দ্রুপদ বিরাট প্রভৃতি রাজগণ এবং তুমি সহায় থাকতেও আমি শুধু পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলাম, কিন্তু দুরাত্মা দুর্যোধন তাও দেবে না। ধনশালী লোক ধনহীন হলে যত দুঃখ পায়, স্বভাবত নির্ধন লোক তত দুঃখ পায় আমরা কিছুতেই পৈতৃক সম্পত্তি ত্যাগ করতে পারি না, উদ্ধারের চেষ্টায় যদি আমাদের মৃত্যু হয় তাও ভাল। যুদ্ধ পাপজনক, তাতে দুই পক্ষেরই ক্ষতি হয়; যাঁরা সজ্জন ধীর ও দয়ালু তারাই যুদ্ধে মরেন, নিকৃষ্ট লোকেই বেঁচে থাকে। বৈর দ্বারা বৈরের নিবৃত্তি হয় না, বরং বৃদ্ধি হয়, যেমন ঘৃতযোগে অগ্নির হয়। আমরা রাজ্য ত্যাগ করতে চাই না, কুলক্ষয়ও চাই না। আমরা সর্বতোভাবে সন্ধির চেষ্টা করব, তা যদি বিফল হয় তবেই যুদ্ধ করব। কুকুরু প্রথমে লাঙ্গুল চালনা, তার পর গর্জন, তারপর দন্তপ্রকাশ, তার পর যুদ্ধ করে, তাদের মধ্যে যে বলবান সেই মাংস ভক্ষণ করে। মানুষেরও এই স্বভাব, কোনও প্রভেদ নেই। মাধব, এখন কি করা উচিত? যাতে আমাদের স্বার্থ ও ধর্ম দুই রক্ষা হয় এমন উপায় তুমি বল, তোমার তুল্য সুহৃৎ আমাদের কেউ নেই।

কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনাদের দুই পক্ষের হিতার্থে আমি কৌরবসভায় যাব, যদি আপনাদের স্বার্থহানি না করে শান্তি স্থাপন করতে পারি তবে আমার মহাপুণ্য হবে। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি কৌরবদের কাছে যাবে এ আমার মত নয়। দুর্যোধন তোমার কথা রাখবে না, সে যদি তোমার প্রতি দুর্ব্যবহার করে তবে তা আমাদের অত্যন্ত দুঃখকর হবে। কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন পাপমতি তা আমি জানি, কিন্তু আমি যদি সন্ধির জন্য তার কাছে যাই তবে অন্য লাভ না হলেও লোকে আমাদের যুদ্ধপ্রিয় বলে দোষ দেবে না, কৌরবগণ আমাকে ক্রুদ্ধ করতেও সাহস করবেন না।

যুঠিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণ, তোমার যা অভিরুচি তাই কর, তুমি কৃতকার্য হয়ে নিরাপদে ফিরে এস। তুমি কথা বলতে জান, যে বাক্য ধর্মসংগত ও আমাদের হিতকর তা মৃদু বা কঠোর যাই হ’ক তুমি বলবে।

কৃষ্ণ বললেন, আপনার বুদ্ধি ধর্মাশ্রিত, কিন্তু কৌরবগণ শত্রুতা করতে চান। যুদ্ধ না করে যা পাওয়া যাবে তাই আপনি যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হওয়া বা হত হওয়াই ক্ষত্রিয়ের সনাতন ধর্ম, দুর্বলতা তার পক্ষে প্রশংসনীয় নয়। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সন্ধি করবেন এমন সম্ভাবনা নেই, ভীষ্মদ্রোণাদির ভরসায় তারা নিজেদের প্রবল মনে করেন, আপনি মৃদুভাবে অনুরোধ করলে তারা শুনবেন না। আমি কৌরবসভায় গিয়ে আপনার গুণ আর দুর্যোধনের দোয দুইই বলব, সকলের সমক্ষে দুর্যোধনের নিন্দা করব। কিন্তু আমি যুদ্ধেরই আশঙ্কা করছি, বিবিধ দুর্লক্ষণও দেখছি, অতএব আপনি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হ’ন।

ভীম বললেন, মধুসূদন, তুমি এমনভাবে কথা বলো যাতে শান্তি হয়, যুদ্ধের ভয় দেখিও না। দুর্যোধন অসহিষ্ণু ক্রোধী, কিসে ভাল হয় তা বোঝে না, তাকে মিষ্ট বাক্য বলো। আমরা বরং হীনতা স্বীকার করব, কিন্তু ভরতবংশ যেন বিনষ্ট না হয়। তুমি পিতামহ ভীষ্ম ও সভাসদ্গণকে বলো, তাদের যত্নে যেন দুর্যোধন। শান্ত হয়, উভয় পক্ষের মধ্যে সৌভ্রাত্র স্থাপিত হয়। আমি শান্তির জন্যই বলছি, ধর্মরাজও শান্তির প্রশংসা করেন; অর্জুন দয়ালু, তিনিও যুদ্ধার্থী নন।

কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, ভীমসেন, ধার্তরাষ্ট্রদের বধ করবার ইচ্ছায় তুমি অন্য সময়ে যুদ্ধের প্রশংসাই করে থাক। তুমি নিদ্রা যাও না, উবুড় হয়ে শোও, সর্বদাই অশান্ত বাক্য বল, অকারণে হাস বা কাঁদ, দুই জানুর মধ্যে মাথা রেখে দীর্ঘকাল চক্ষু মুদে থাক এবং প্রায়ই ভ্রুকুটি ও ওষ্ঠদংশন কর। ক্রোধের জন্যই এমন কর। তুমি বলেছিলে, ‘পূর্বদিকে সূর্যোদয় এবং পশ্চিম দিকে সূর্যাস্ত যেমন ধ্রুব সত্য, আমি গদাঘাতে দুর্যোধনকে বধ করব এও সেরূপ সত্য। তুমি ভ্রাতাদের কাছে গদা স্পর্শ করে এই শপথ করেছ, অথচ আজ তুমি শান্তিকামী হয়েছ। কি আশ্চর্য, যুদ্ধকাল উপস্থিত হলে যুদ্ধকামীরও চিত্ত বিমুখ হয়, তুমিও ভয় পেয়েছ! পর্বতের বচলন যেমন আশ্চর্য তোমার কথাও সেইরূপ। ভরতবংশধর, তোমার কুলগৌরব স্মরণ কর, উৎসাহী হও, অবসাদ ত্যাগ কর। অরিন্দম, এই গ্লানি তোমার অযোগ্য, ক্ষত্রিয় নিজের বীর্যে যা লাভ করে না তা ভোগও করে না।

কোপনস্বভাব ভীম উত্তম অশ্বের ন্যায় কিঞ্চিৎ ধাবিত হয়ে বললেন, কৃষ্ণ আমার উদ্দেশ্য না বুঝেই তুমি অন্যরূপ মনে করছ। তুমি দীর্ঘকাল আমার সঙ্গে বাস করেছ সেজন্য আমার স্বভাব তোমার জানা উচিত; অথবা অগাধ জলে যে ভাসে সে যেমন জলের পরিমাণ বোঝে না তেমনই তুমিও আমাকে বোঝ না। মাধব, তুমি অন্যায় বাক্যে আমাকে ভৎর্সনা করেছ, আর কেউ এমন করতে সাহস করে না। আত্মপ্রশংসা নীচ লোকের কর্ম, কিন্তু তোমার তিরস্কারে তাড়িত হয়ে আমি নিজের বলের কথা বলছি।,এই অন্তরীক্ষ ও এই জগৎ যদি সহসা ক্রুদ্ধ হয়ে দুই শিলাখণ্ডের ন্যায় ধাবিত হয় তবে আমি দুই বাহু দিয়ে তাদের রোধ করতে পারি। সমস্ত পাণ্ডবশত্রুকে আমি ভূতলে ফেলে পা দিয়ে মর্দন করব। জনার্দন, যখন ঘোর যুদ্ধ উপস্থিত হবে তখন তুমি আমাকে জানতে পারবে। আমার দেহ অবসন্ন হয় না, মন কম্পিত হয় না, সর্বলোক ক্রুদ্ধ হলেও আমি ভয় পাই না। সৌহার্দ্য ও ভরতবংশের রক্ষার জন্যই আমি শান্তির কথা বলেছি।

কৃষ্ণ বললেন, তোমার মনোভাব জানবার জন্য আমি প্রণয়বশেই বলেছি, তিরস্কার বা পাণ্ডিত্যপ্রকাশের জন্য নয়। তোমার মাহাত্ম্য বল ও কীর্তি আমি জানি। তুমি ক্লীবের ন্যায় কথা বলছিলে সেজন্য শঙ্কিত হয়ে আমি তোমার তেজ উদ্দীপিত করেছি।

অর্জুন বললেন, জনার্দন, আমার যা বলবার ছিল তা যুধিষ্ঠিরই বলেছেন। তুমি মনে করছ যে ধৃতরাষ্ট্রের লোভ এবং আমাদের বর্তমান দুরবস্থার জন্য শান্তি-স্থাপন সুসাধ্য হবে না। সম্যক যত্ন করলে কর্ম নিশ্চয়ই সফল হয়। তুমি আমাদের হিতার্থে। যা করতে যাচ্ছ তা মৃদু বা কঠোর কি ভাবে সম্পন্ন হবে তা অনিশ্চিত। তুমি যদি মনে কর যে ওদের বধ করাই উচিত হবে অবিলম্বে আমাদের সেই উপদেশই দিও, আর বিচার ক’রো না।

কৃষ্ণ বললেন, তুমি যা বললে আমি তাই করব, কিন্তু দৈব অনুকূল না হলে কেবল পুরুষকারে কর্ম সম্পন্ন হয় না। ধর্মরাজ পাঁচটি গ্রাম চেয়েছেন, কিন্তু দুর্যোধনকে তা বলা উচিত নয়, সেই পাপাত্মা তাতেও সম্মত হবে না। বাক্য ও কর্ম দ্বারা যা সাধ্য তা আমি করব, কিন্তু শান্তির আশা করি না।

নকুল বললেন, মাধব, ধর্মরাজ ভীমসেন ও অর্জুনের মত তুমি শুনেছ; সে সমস্ত অতিক্রম করে তুমি যা কালোচিত মনে কর তাই করবে। মানুষের মতের স্থিরতা নেই, বনবাসকালে আমাদের একপ্রকার মত ছিল, অজ্ঞাতবাসকালে অন্যপ্রকার। হয়েছিল, এখন আবার অন্যপ্রকার হয়েছে। তোমার প্রসাদে আমাদের কাছে সাত অক্ষৌহিণী সেনা সমাগত হয়েছে, এদের দেখলে কে ভীত হবে না? তুমি কৌরব-সভায় গিয়ে প্রথমে মৃদুবাক্য বলবে, তার পর ভয় দেখাবে। তোমার কথা শুনে ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর ও বাহ্লীকরাজ অবশ্যই বুঝবেন কিসে সকলের শ্রেয় হবে এবং তারা ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধনকেও বোঝাতে পারবেন।

সহদেব বললেন, কৃষ্ণ, ধর্মরাজ যা বলেছেন তা সনাতন ধর্ম বটে, কিন্তু যাতে যুদ্ধ হয় তুমি তাই করবে, কৌরবরা শান্তি চাইলেও তুমি যুদ্ধ ঘটাবে। দূতসভায় পাঞ্চালীর নিগ্রহের পর যদি দুর্যোধন নিহত না হয় তবে আমার ক্রোধ কি করে শান্ত হবে? ধর্মরাজ আর ভীমার্জুন যদি ধর্ম নিয়েই থাকেন তবে আমি ধর্ম ত্যাগ করে যুদ্ধ করব। মূর্খ দুর্যোধনকে তুমি বলো, আমরা হয় বনবাসের কষ্টভোগ করব নতুবা হস্তিনাপুরে রাজত্ব করব।

সাত্যকি বললেন, মহামতি সহদেব সত্য বলেছেন, দুর্যোধন হত হলেই আমার ক্রোধের শান্তি হবে। রণকর্কশ বীর সহদেবের যে মত, সকল যোদ্ধারই সেই মত। সাত্যকির কথা শুনে যোদ্ধারা চারিদিক থেকে সিংহনাদ করে উঠলেন এবং সকলেই সাধু সাধু বললেন।।

অপূর্ণনয়নে দ্রৌপদী বললেন, মধুসূদন, তুমি জান যে দুর্যোধন শঠতা করে পাণ্ডবগণকে রাজ্যচ্যুত করেছে, ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায়ও সঞ্জয়ের মুখে শুনেছ। যুধিষ্ঠির পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলেন, দুর্যোধন সে অনুরোধও গ্রাহ্য করেনি। রাজ্য না দিয়ে সে যদি সন্ধি করতে চায় তবে তুমি সম্মত হয়ো না, পাণ্ডবগণ তাদের মিত্রদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দুর্যোধনের সৈন্য বিনষ্ট করতে পারবেন। তুমি কৃপা করো না, সাম বা দান নীতিতে যে শত্রু শান্ত হয় না তার উপর দণ্ডপ্রয়োগই বিধেয়। এই কার্য পাণ্ডবদের কর্তব্য, তোমার পক্ষে যশস্কর, ক্ষত্রিয়েরও সুখকর। ধর্মজ্ঞরা জানেন, অবধ্যকে বধ করলে যে দোষ হয় বধ্যকে বধ না করলে সেই দোষ হয়। জনার্দন, যজ্ঞবেদী থেকে আমার উৎপত্তি, আমি দ্রুপদরাজের কন্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, তোমার প্রিয়সখী, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, পঞ্চ ইন্দ্রতুল্য পঞ্চ পাণ্ডবের মহিষী; আমার মহারথ পঞ্চ পুত্র তোমার কাছে অভিমন্যুরই সমান। কেশব, তোমরা জীবিত থাকতে আমি দূতসভায় পাণ্ডবদের সমক্ষেই নিগৃহীত হয়েছি, এঁদের নিশ্চেষ্ট দেখে আমি গোবিন্দ রক্ষা কর’ বলে তোমাকে স্মরণ করেছি। অবশেষে ধৃতরাষ্ট্রের বরে এঁরা দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে বনবাসে যাত্রা করেন। ধিক অর্জুনের ধনুর্ধারণ, ধিক ভীমসেনের বল, দুর্যোধন মুহূর্তকালও জীবিত আছে।

তার পর অসিতনয়না কৃষ্ণা তার সুবাসিত সুন্দর বক্রাগ্র মহাভুজঙ্গসদৃশ বেণী বাম হস্তে ধরে কৃষ্ণের কাছে গিয়ে বললেন, পুণ্ডরীকাক্ষ, তুমি যখন সন্ধির কথা বলবে তখন আমার এই বেণী স্মরণ করো-যা দুঃশাসন হাত দিয়ে টেনেছিল।ভীমার্জুন যদি সন্ধি কামনা করেন তবে আমার বৃদ্ধ পিতা ও তার মহারথ পুত্রগণ। কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, অভিমন্যুকে অগ্রবর্তী করে আমার পাঁচ বীর পুত্রও। যুদ্ধ করবে, দুঃশাসনের শ্যামবর্ণ বাহু যদি ছিন্ন ও ধূলিলুণ্ঠিত না দেখি তবে আমার হৃদয় কি করে শান্ত হবে? প্রদীপ্ত অগ্নির ন্যায় ক্রোধ নিরুদ্ধ রেখে আমি তের বৎসর কাটিয়েছি, এখন ধর্মভীরু ভীমের শান্ত বাক্য শুনে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। এই বলে দ্রৌপদী অশ্রুধারায় বক্ষ সিক্ত করে কম্পিতদেহে গদ্গদকণ্ঠে রোদন করতে লাগলেন।

১১। কৃষ্ণের হস্তিনাপুরগমন

শরৎকালের অন্তে কার্ত্তিক মাসে একদিন প্রভাতকালে শুভ মুহূর্তে কৃষ্ণ স্নানাহ্নিক করে সূর্য ও অগ্নির উপাসনা করলেন। তার পর তিনি শুভযাত্রার জন্য বৃস্পর্শ, ব্রাহ্মণদের অভিবাদন এবং অগ্নি প্রদক্ষিণ করে শিনির পৌত্র সাত্যকিকে বললেন, শঙ্খ চক্র গদা তুণীর শক্তি ও অন্যান্য সর্বপ্রকার অস্ত্র আমার রথে রাখ, কারণ শত্রুকে অবজ্ঞা কার উচিত নয়। কৃষ্ণের পরিচারকগণ তার রথ প্রস্তুত করলে। এই রথ চতুরশ্বযোজিত, অর্ধচন্দ্র চন্দ্র মৎস্য পশু পক্ষী ও পুষ্পের চিত্রে শোভিত, স্বর্ণ ও মণিরত্নে ভূষিত, এবং ব্যাঘ্রচর্মে আবৃত। রথের উপরে গরুড়ধ্বজ স্থাপিত হলে কৃষ্ণ সাত্যকিকে তুলে নিলেন। বশিষ্ঠ বামদেব শুক্র নারদ প্রভৃতি দেবর্ষি ও মহর্ষিগণ কৃষ্ণের দক্ষিণ দিকে দাঁড়ালেন। পাণ্ডবগণ এবং দ্রুপদ বিরাট প্রভৃতি কিছুদূর অনুগমন করলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, জনার্দন, যিনি আমাদের বাল্যকাল থেকে বর্ধিত করেছেন, দুর্যোধনের ভয় ও মৃত্যুসংকট থেকে রক্ষা করেছেন, আমাদের জন্য বহু দুঃখ ভোগ করেছেন, পুত্রবিরহবিধুরা আমাদের সেই মাতাকে তুমি অভিবাদন ও আলিঙ্গন করে আশ্বস্ত করো। আমরা যখন বনে যাই তখন তিনি সরোদনে আমাদের পশ্চাতে ধাবিত হয়েছিলেন, আমরা তাকে পরিত্যাগ করে প্রস্থান করেছিলাম। তুমি ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ ও অশ্বত্থামা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ রাজগণকে আমাদের হয়ে অভিবাদন করো, মহাপ্রাজ্ঞ বিদুরকে আলিঙ্গন ক’রো।

অর্জুন বললেন, গোবিন্দ, দুর্যোধন যদি তোমার কথায় অবজ্ঞা না করে অর্ধরাজ্য আমাদের দেয় তবে আমরা সুখী হব, তা যদি না করে তবে তার পক্ষের সকল ক্ষত্রিয়কে আমি বিনষ্ট করব। এই কথা শুনে ভীম আনন্দিত হয়ে কম্পিতদেহে সগর্বে গর্জন করে উঠলেন। সেই নিনাদ শুনে সৈন্যগণ কম্পিত হল হস্তী অশ্ব প্রভৃতি মলমূত্র ত্যাগ করলে।

কৃষ্ণের সারথি দারুক দ্রুতবেগে রথ চালালেন। কিছুদূর যাবার পর নারদ কেবল মৈত্রেয় কৃষ্ণদ্বৈপায়ন পরশুরাম প্রভৃতি মহর্ষিগণ কৃষ্ণের কাছে এসে বললেন, মহামতি কৃষ্ণ, আমরা তোমার বাক্য ও তার প্রত্যুত্তর শোনবার জন্য কৌরবসভায় যাচ্ছি। তুমি নির্বিঘ্নে অগ্রসর হও, সভায় আবার আমরা তোমাকে দেখব! সূর্যাস্তকালে আকাশ লোহিতবর্ণ হলে কৃষ্ণ বুকস্থলগ্রামে পৌঁছলেন। পরিচারকগণ তার রাত্রিবাসের জন্য সেখানে শিবিরস্থাপন ও খাদ্যপানীয় প্রস্তুত করলে। কৃষ্ণ স্থানীয় ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করে ভোজন করালেন।

কৃষ্ণ আসছেন এই সংবাদ দূতমুখে শুনে ধৃতরাষ্ট্র হৃষ্ট হয়ে তার উপযুক্ত সংবর্ধনার জন্য পুত্রকে আদেশ দিলেন। দুর্যোধন নানা স্থানে সুসজ্জিত পটমণ্ডপ নির্মাণ এবং খাদ্য পেয় প্রভৃতির আয়োজন করলেন। কৃষ্ণ সে সকল উপেক্ষা করে কৌরবরাজধানীর দিকে চললেন।

ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, আমি কৃষ্ণকে অশ্বসমেত ষোলটি স্বর্ণভূষিত রথ, আটটি মদাবী হস্তী, যাদের সন্তান হয় নি এমন এক শ রূপবতী দাসী, এক শ দাস এবং বহু কম্বল ও মৃগচর্ম উপহার দেব। এই উজ্জ্বল বিমল মণি যা দিনে ও রাত্রিতে দীপ্তি দেয়, এটিও দেব। দুর্যোধন ভিন্ন আমার সকল পুত্র ও পৌত্র, সালংকারা বারাঙ্গনাগণ এবং অনাবৃতমুখে কল্যাণীয়া কন্যাগণ কৃষ্ণের প্রত্যুদ্গমনের জন্য যাবে। ধ্বজপতাকায় নগর সাজানো হ’ক, পথে জল দেওয়া হ’ক।

বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনি সরল পথে চলুন, আমি বুঝতে পারছি আপনি ধর্মের জন্য বা কৃষ্ণের প্রিয়কামনায় উপহার দিচ্ছেন না, আপনার এই ভূরি-দক্ষিণা মিথ্যা ছল মাত্র। পাণ্ডবরা পাঁচটি গ্রাম চান, আপনি তাও দিতে প্রস্তুত নন, অথচ অর্থ দিয়ে কৃষ্ণকে স্বপক্ষে আনবার ইচ্ছা করছেন। ধনদান বা নিন্দা বা অন্য উপায়ে আপনি কৃষ্ণার্জুনের মধ্যে ভেদ ঘটাতে পারবেন না। পূর্ণ কুম্ভ, পাদপ্রক্ষালনের জল এবং কুশলপ্রশ্ন ভিন্ন জনার্দন কিছুই গ্রহণ করবেন না। তিনি কুরুপাণ্ডবের মঙ্গলকামনায় আসছেন, আপনি তার সেই কামনা পূর্ণ করুন।

দুর্যোধন বললেন, বিদুর সত্য বলেছেন, কৃষ্ণ পাণ্ডবদের প্রতি অনুরক্ত, তাকে আমাদের পক্ষে আনা যাবে না। তিনি নিশ্চয়ই পূজাৰ্য, কিন্তু দেশ কাল বিবেচনা করে তাকে এখন মহার্ঘ উপহার দেওয়া উচিত নয়, তিনি মনে করবেন আমরা ভয় পেয়েছি। আমরা যুদ্ধে উদ্যোগী হয়েছি, যুদ্ধ ভিন্ন শান্তি হবে না।

কুরুপিতামহ ভীষ্ম বললেন, তোমরা কৃষ্ণের সমাদর কর বা না কর তিনি ক্রুদ্ধ হবেন না, কিন্তু তাঁকে যেন অবজ্ঞা করা না হয়। তিনি যা বলবেন বিশ্বস্তচিত্তে তোমাদের তাই করা উচিত। তিনি ধর্মসংগত ন্যায্য কথাই বলবেন, তোমরাও তাকে প্রিয়বাক্য বলো।

দুর্যোধন বললেন, আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হয়ে রাজ্যভোগ করতে পারব না। যা স্থির করেছি শুনুন,আমি জনার্দনকে আবদ্ধ করে রাখব, তা হলে যাদবগণ। পাণ্ডবগণ এবং সমস্ত পৃথিবী আমার বশে আসবে।

দুর্যোধনের এই দুরভিসন্ধি শুনে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, এমন ধর্মবিরুদ্ধ কথা বলো, হৃষীকেশ দূত হয়ে আসছেন, তার উপর তিনি তোমার বৈবাহিক, আমাদের প্রিয় এবং রিপরাধ। ভীষ্ম বললেন, ধৃতরাষ্ট্র, তোমার দুর্বুদ্ধি পুত্র কেবল অনর্থ। বরণ করে, তুমিও এই পাপাত্মার অনুসরণ করলে। কৃষ্ণকে বন্ধন করলে দুর্যোধন। তার অমাত্য সহ ক্ষণমধ্যে বিনষ্ট হবে। এই বলে ভীষ্ম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সভা ত্যাগ করে চ’লে গেলেন।

প্রাতঃকালে কৃষ্ণ বৃকস্থল ত্যাগ করে হস্তিনাপুরে এলেন। দুর্যোধনের ভ্রাতারা এবং ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি অগ্রসর হয়ে তার প্রত্যুদ্গমন করলেন। রাজপথে বহু লোক কৃষ্ণের স্তুতি করতে লাগল, বরনারীগণ উপর থেকে দেখতে লাগলেন, তাদের ভারে অতিবৃহৎ অট্টালিকাও যেন স্থানচ্যুত হল। তিন কক্ষ্যা (মহল) অতিক্রম করে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্রাদি সকলেই গাত্রোত্থান করে সংবর্ধনা করলেন। পুরোহিতগণ যথাবিধি গো মধুপর্ক ও জল দিয়ে কৃষ্ণের সৎকার করলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর কৃষ্ণ বিদুরের ভবনে গেলেন এবং অপরাহ্নে পিতৃস্বসা কুন্তীর সঙ্গে দেখা করলেন।

১২। কুন্তী, দুর্যোধন ও বিদুরের গৃহে কৃষ্ণ

কৃষ্ণের কণ্ঠ আলিঙ্গন করে কুন্তী সরোদনে বললেন, বৎস, আমার পুত্রেরা বাল্যকালেই পিতৃহীন হয়েছিল, আমিই তাদের পালন করেছিলাম। পূর্বে যারা বহু ঐশ্বর্যের মধ্যে সুখে বাস করত তারা কি করে বনবাসের কষ্ট সইল ? ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির ও মহাবল ভীমার্জুন কেমন আছে? জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার বশবর্তী আমার সেবাকারী বীর সহদেব কেমন আছে? যাকে আমি নিমেষমাত্র না দেখে থাকতে পারতাম না সেই নকুল কেমন আছে? যিনি আমার সকল পুত্র অপেক্ষা প্রিয়, যিনি কুরুসভায় নিগৃহীত হয়েছিলেন, সেই কল্যাণী দ্রৌপদী কেমন আছেন? আমি দুর্যোধনের দোষ দিচ্ছি না, 
নিজের পিতারই নিন্দা করি। বাল্যকালে যখন আমি কন্দুক নিয়ে খেলতাম তখন তিনি কেন আমাকে কুন্তিভোজের (১) হাতে দিয়েছিলেন? আমি পিতা ও ভাশুর ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক বঞ্চিত হয়েছি, আমার বেঁচে লাভ কি? অর্জুনের জন্মকালে দৈববাণী হয়েছিল,এই পুত্র পৃথিবীজয়ী হবে, এর যশ স্বর্গ স্পর্শ করবে। কৃষ্ণ, যদি ধর্ম থাকেন তবে যাতে সেই দৈববাণী সফল হয় তার চেষ্টা করো। ধনঞ্জয় আর বৃকোদরকে বলো, ক্ষত্রিয় নারী যে নিমিত্ত পুত্র প্রসব করে তার কাল উপস্থিত হয়েছে। এই কাল যদি বৃথা অতিক্রম কর তবে তা অতি অশুভকর কর্ম হবে। উপযুক্ত কাল সমাগত হলে জীবনত্যাগও করতে হয়, তোমরা যদি নীচ কর্ম কর তবে চিরকালের জন্য আমি তোমাদের ত্যাগ করব। নকুল-সহদেবকে বলো, তোমরা বিক্রমার্জিত সম্পদ ভোগ কর, প্রাণের মায়া করো না। অর্জুনকে বলো, তুমি দ্রৌপদীর নির্দিষ্ট পথে চলবে।

কুন্তীকে সান্ত্বনা দিয়ে কৃষ্ণ বললেন, আপনার ন্যায় মহীয়সী কে আছেন? হংসী যেমন এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে আসে সেইরূপ আপনার পিতা শূরের (২) বংশ থেকে আপনি কুন্তিভোজের বংশে এসেছেন। আপনি বীরপত্নী, বীরজননী। শীঘ্রই পুত্রদের নীরোগ কৃতকার্য হতশত্রু রাজশ্রীসমন্বিত ও পৃথিবীর অধিপতি দেখবেন।

কুন্তীর নিকট বিদায় নিয়ে কৃষ্ণ দুর্যোধনের গৃহে গেলেন। সেখানে দুঃশাসন কর্ণ শকুনি এবং নানা দেশের রাজারা ছিলেন। সংবর্ধনার পর কৃষ্ণ আসনে উপবিষ্ট হলে দুর্যোধন তাকে ভোজনের অনুরোধ করলেন, কিন্তু কৃষ্ণ সম্মত হলেন না। দুর্যোধন বললেন, জনার্দন, তোমার জন্য যে খাদ্য পানীয় বসন ও শয্যার আয়োজন করা হয়েছে তা তুমি নিলে না কেন? তুমি কুরুপাণ্ডব দুই পক্ষেরই হিতাকাঙক্ষী ও আত্মীয়, রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয়, তথাপি আমাদের আতিথ্য প্রত্যাখ্যান করলে এর কারণ কি?

কৃক্ষ তার বিশাল বাহু তুলে মেঘগম্ভীর স্বরে বললেন, ভরতবংশধর, দূত কৃতকার্য হলেই ভোজন ও পূজা গ্রহণ করে। দুর্যোধন বললেন, এমন কথা বলা তোমার উচিত নয়, তুমি কৃতকার্য বা অকৃতকার্য যাই হও আমরা তোমাকে পূজা করবার জন্য আগ্রহান্বিত হয়ে আছি, তোমার সঙ্গে আমাদের শত্রুতা বা কলহ নেই, তবে আপত্তি করছ কেন? ঈষৎ হাস্য করে কৃষ্ণ বললেন, সম্প্রীতি থাকলে অথবা বিপদে পড়লে পরের অন্ন খাওয়া যায়। রাজা, তুমি আমাদের উপর প্রীত নও, আমি বিপদেও পড়ি নি। শত্রুর অন্ন খাওয়া অনুচিত, তাকে অন্ন দেওয়াও অনুচিত। তুমি পাণ্ডবদের বিদ্বেষ কর, কিন্তু তারা আমার প্রাণস্বরূপ। যে পাণ্ডবদের শত্রুতা করে সে আমারও করে, যে তাঁদের অনুকূল সে আমারও অনুকূল। দুরভিসন্ধির জন্য তোমার অন্ন দূষিত, তা আমার গ্রহণীয় নয়, আমি কেবল বিদুরের অন্নই খেতে পারি।

তার পর কৃষ্ণ বিদুরের গৃহে গেলেন। ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি সেখানে গিয়ে বললেন, কৃষ্ণ, তোমার বাসের জন্য সুসজ্জিত বহু গৃহ নিবেদন করছি। কৃষ্ণ বললেন, আপনাদের আগমনেই আমি সৎকৃত হয়েছি। ভীষ্মদি চ’লে গেলে বিদুর বিবিধ পবিত্র ও উপাদেয় খাদ্যপানীয় এনে বললেন, গোবিন্দ, এতেই তুষ্ট হও, তোমার যোগ্য সমাদর কে করতে পারে? ব্রাহ্মণগণকে নিবেদনের পর কৃষ্ণ তার অনুচরদের সঙ্গে বিদুরের অন্ন ভোজন করলেন।

রাত্রিকালে বিদুর বললেন, কেশব, এখানে আসা তোমার উচিত হয়নি। দুর্যোধন অধার্মিক ক্ৰোধী দুর্বিনীত ও মূর্খ। সে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতির ভরসায় এবং বহু সেনা সংগ্রহ করে নিজেকে অজেয় মনে করে। যার হিতাহিত জ্ঞান নেই তাকে কিছু বলা বধিরের নিকট গান গাওয়ার সমান। দুর্যোধন তোমার কথা গ্রাহ্য করবে না। নানা দেশের রাজারা সসৈন্যে কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে পূর্বে তোমার শত্রুতা ছিল, যাঁদের ধন তুমি হরণ করেছ, তারা সকলেই এখানে এসেছেন। কৌরবসভায় এইসকল সত্রুদের মধ্যে তুমি কি করে যাবে? মাধব, পাণ্ডবদের উপর আমার যে প্রীতি আছে তারও অধিক প্রীতি তোমার উপর আছে, সেজন্যই এই কথা বলছি।

কৃষ্ণ বললেন, আপনার কথা মহাপ্রাজ্ঞ বিচক্ষণ এবং পিতামাতার ন্যায় হিতৈষী ব্যক্তিরই উপযুক্ত। আমি দুর্যোধনের দুষ্ট স্বভাব এবং তার অনুগত রাজাদের শত্রুতা জেনেও এখানে এসেছি। মৃত্যুপাশ থেকে পৃথিবীকে যে মুক্ত করতে পারে সে মহান ধর্ম লাভ করে। মানুষ যদি ধর্মকার্যে যথাসাধ্য যত্ন করে তবে সম্পন্ন করতে না পারলেও তার পুণ্য হয়। আবার, কেউ যদি মনে মনে পাপচিন্তা করে কিন্তু কার্যত করে না তবে সে পাপের ফল পায় না, ধর্মজ্ঞগণ এইরূপ বলেন। আমি কুরুপাণ্ডবের মধ্যে শান্তিস্থাপনের যথাসাধ্য চেষ্টা করব, যাতে তারা যুদ্ধে বিনষ্ট না হন। জ্ঞাতিদের মধ্যে ভেদ হলে যিনি সর্বপ্রযত্নে মধ্যস্থতা না করেন তাকে মিত্র বলা যায় না। আমি শান্তির চেষ্টা করলে কোনও শত্রু বা মূর্খ লোক বলতে পারবে না যে কৃষ্ণ ক্রুদ্ধ কুরুপাণ্ডবগণকে বারণ করলেন না। দুর্যোধন যদি আমার ধর্মসম্মত হিতকর কথা না শোনেন তবে তিনি কালের কবলে পড়বেন।

**

(১) আদিপর্ব ১৯-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

(২) শূর,বসুদেবের পিতা।

১৩। কৌরবসভায় কৃষ্ণের অভিভাষণ

পরদিন প্রভাতকালে সুকণ্ঠ সূতমাগধগণের বন্দনায় এবং শঙ্খ ও দুন্দুভির রবে কৃষ্ণের নিদ্রাভঙ্গ হল। তাঁর প্রাতঃকৃত্য শেষ হলে দুর্যোধন ও শকুনি তাঁর কাছে এসে বললেন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্ম প্রভৃতি তোমার প্রতীক্ষা করছেন। কৃষ্ণ অগ্নি ও ব্রাহ্মণগণকে প্রদক্ষিণ করলেন এবং কৌস্তুভ মণি ধারণ করে বিদুরকে নিয়ে। রথে উঠলেন। দুর্যোধন শকুনি এবং সাত্যকি প্রভৃতি রথে গজে ও অশ্বে অনুগমন করলেন। বহু সহস্র অস্ত্রধারী সৈন্য কৃষ্ণের অগ্রে এবং বহু হস্তী ও রথ তার পশ্চাতে গেল। রাজসভার নিকট এসে কৃষ্ণের অনুচরগণ শঙ্খ ও বেণুর রবে সর্বদিক নিনাদিত করলে। বিদুর ও সাত্যকির হাত ধরে কৃষ্ণ সভাদ্বারে রথ থেকে নামলেন। তিনি সভায় প্রবেশ করলে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম দ্রোণাদি এবং সমস্ত রাজারা সসম্মানে গাত্রোত্থান করলেন।

ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে সর্বতোভদ্র নামে একটি স্বর্ণভূষিত আসন কৃষ্ণের জন্য রাখা ছিল। সকলকে যথাযোগ্য সম্ভাষণ করে কৃষ্ণ ভীষ্মকে বললেন, নারদাদি ঋষিগণ অন্তরীক্ষে রয়েছেন, তারা এই রাজসভা দেখতে এসেছেন; তাদের সংবর্ধনা করে আসন দিন, তারা না বসলে আমরা কেউ বসতে পারি না। ভীষ্মের আদেশে ভৃত্যেরা মণিকাঞ্চনভূষিত বহু আসন নিয়ে এল, ঋষিরা তাতে বসে অর্ঘ্য গ্রহণ করলেন।

অতসীপুষ্পের ন্যায় শ্যামবর্ণ পীতবসনধারী জনার্দন সুবর্ণে গ্রথিত ইন্দ্রনীলমণির ন্যায় শোভমান হলেন। তাঁর আসন স্পর্শ করে বিদুর একটি মৃগচর্মাবৃত মণিময় পীঠে বসলেন। কর্ণ ও দুর্যোধন কৃষ্ণের অদূরে একই আসনে বসলেন। সভা নীরব হল। নিদাঘান্তে মেঘধ্বনির ন্যায় গম্ভীরকণ্ঠে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করে বললেন, ভরতনন্দন, যাতে কুরুপাণ্ডবদের শান্তি হয় এবং বীরগণের বিনাশ না হয় তার জন্য আমি প্রার্থনা করতে এসেছি। আপনাদের বংশ সকল রাজবংশের শ্রেষ্ঠ, এই মহাবংশে আপনার নিমিত্ত কোনও অন্যায় কম হওয়া উচিত নয়। দুর্যোধনাদি আপনার পুত্রগণ অশিষ্ট, মর্যাদাজ্ঞানশূন্য ও লোভী, এঁরা ধর্ম ও অর্থ পরিহার করে নিজের শ্রেষ্ঠ আত্মীয়দের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন। কৌরবগণের ঘোর বিপদ উপস্থিত হয়েছে, আপনি যদি উপেক্ষা করেন তবে পৃথিবীর ধ্বংস হবে। আপনি ইচ্ছা করলেই এই বিপদ নিবারিত হ’তে পারে। মহারাজ, যদি পুত্রদের শাসন করেন এবং সন্ধির জন্য যত্নবান হন তবে দুই পক্ষেরই মঙ্গল হবে। পাণ্ডবগণ যদি আপনার রক্ষক হন তবে ইন্দ্রও. আপনাকে জয় করতে পারবেন না। যে পক্ষে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ প্রভৃতি আছেন সেই পক্ষে যদি পঞ্চপাণ্ডব ও সাত্যকি প্রভৃতি যোগ দেন তবে কোন দুর্বুদ্ধি তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইবে? কৌরব ও পাণ্ডবগণ মিলিত হলে আপনি অজেয় ও পৃথিবীর অধিপতি হবেন, প্রবল রাজারাও আপনার সঙ্গে সন্ধি করবেন। পাণ্ডবগণ অথবা আপনার পুত্রগণ যুদ্ধে নিহত হলে আপনার কি সুখ হবে বলুন। পৃথিবীর সকল রাজা যুদ্ধের জন্য সমবেত হয়েছেন, তারা ক্রুদ্ধ হয়ে সৈন্য ধ্বংস করবেন। মহারাজ, এই প্রজাবর্গকে আপনি ত্রাণ করুন, আপনি প্রকৃতিস্থ হলে এরা জীবিত থাকবে। এরা নিরপরাধ, দাতা, লজ্জাশীল, সজ্জন, সদ্বংশীয়, এবং পরস্পরের সুহৃৎ, আপনি মহাভয় থেকে এদের রক্ষা করুন। এই রাজারা, যাঁরা উত্তম বসন ও মাল্য ধারণ করে এখানে সমবেত হয়েছেন, এঁরা ক্রোধ ও শত্রুতা ত্যাগ করে পানভোজনে তৃপ্ত হয়ে নিরাপদে নিজ নিজ গৃহে ফিরে যান। পিতৃহীন পাণ্ডবগণ আপনার আশ্রয়েই বর্ধিত হয়েছিলেন, আপনি এখনও তাদের পুত্রের ন্যায় পালন করুন। পাণ্ডবগণ আপনাকে এই কথা বলেছেন,আপনার আজ্ঞায় আমার দ্বাদশ বৎসর বনবাসে এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে বহু দুঃখ ভোগ করেছি, তথাপি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিনি। আপনি আমাদের পিতা, আপনিও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করুন, আমাদের প্রাপ্য রাজ্যের ভাগ দিন। আমরা সকলে বিপথে চ’লেছি, আপনি পিতা হয়ে আমাদের সৎপথে আনুন, নিজেও সৎপথে থাকুন। পাণ্ডবরা এই সভাসদগণকে লক্ষ্য করে বলেছেন, এঁরা ধর্মজ্ঞ, যেন অন্যায় কার্য না করেন; যে সভায় অধর্ম ধর্মকে এবং অসত্য সত্যকে বিনষ্ট করে সেখানকার সভাসদগণও বিনষ্ট হন।

তার পর কৃষ্ণ বললেন, এই সভায় যেসকল মহীপাল আছেন তারা বলুন আমার বাক্য ধর্মসংগত ও অর্থকর কিনা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনি ক্ষত্রিয়গণকে মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত করুন, ক্রোধের বশীভূত হবেন না। অজাতশত্রু ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আপনার সঙ্গে যেরূপ ব্যবহার করেছেন তা আপনি জানেন। জতুগৃহদাহের পর তিনি আপনার আশ্রয়েই ফিরে এসেছিলেন। আপনি তাকে ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সকল রাজাকে বশে এনে আপনারই অধীন করেছিলেন, আপনার মর্যাদা লঙ্ঘন করেন নি। তার পর শকুনি কপট দূতে তার সর্বস্ব হরণ করেছিলেন। সে অবস্থাতেও এবং দ্রৌপদীর নিগ্রহ দেখেও যুধিষ্ঠির ধৈর্যচ্যত হন নি। মহারাজ, পাণ্ডবগণ আপনার সেবা করতে প্রস্তুত, যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত; আপনি যা হিতকর মনে করেন তাই করুন।

১৪। রাজা দম্ভোব-সুমুখ ও গরুড়

সভায় যে রাজারা ছিলেন তারা সকলেই মনে মনে কৃষ্ণবাক্যের প্রশংসা করলেন, কিন্তু কিছুই বললেন না, নীরবে রোমাঞ্চিত হয়ে রইলেন। তখন জামদগ্ন্য পরশুরাম বললেন, মহারাজ, আমি একটি সত্য দৃষ্টান্ত বলছি শুনুন। পুরাকালে দম্ভোদ্ভব নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি সর্বদা সকলকে প্রশ্ন করতেন, আমার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বা আমার সমান যোদ্ধা কেউ আছে কিনা। এক তপস্বী ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে বলেলন, গন্ধমাদন পর্বতে নর ও নারায়ণ নামে দুই পুরুষশ্রেষ্ঠ তপস্যা করছেন, তুমি কখনও তাদের সমান নও, তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। দম্ভোদ্ভব বিশাল সৈন্য নিয়ে গন্ধমাদনে গিয়ে ক্ষুৎপিপাসা ও শীতাতপে শীর্ণ দুই ঋষিকে দেখলেন এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধ প্রার্থনা করলেন। নর-নারায়ণ বললেন, এই আশ্রমে ক্রোধ লোভ অস্ত্রশস্ত্র বা কুটিলতা নেই, এখানে যুদ্ধ হ’তে পারে না, তুমি অন্যত্র যাও, পৃথিবীতে বহু ক্ষত্রিয় আছে। দম্ভোদ্ভব শুনলেন না, বার বার যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন নর ঋষি মুষ্টি ঈষীকা (কাশ তৃণ) নিয়ে বললেন, যুদ্ধকামী ক্ষত্রিয়, তোমার অস্ত্র আর সৈন্যদল নিয়ে এস। রাজা শরবর্ষণ করতে লাগলেন, কিন্তু তার আক্রমণ ব্যর্থ হল। নর ঋষি ঈষীকা দিয়ে সৈন্যগণের চক্ষু কর্ণ নাসিকা বিদ্ধ করতে লাগলেন। ঈষীকায় আচ্ছন্ন হয়ে আকাশ শ্বেতবর্ণ হয়ে গেছে দেখে রাজা নর ঋষির চরণে পড়লেন। নর বললেন, আর এমন করো না, তুমি ব্রাহ্মণের হিতকামী এবং নির্লোভ নিরহংকার জিতেন্দ্রিয় ক্ষমাশীল হয়ে প্রজাপালন কর, বলাবল না জেনে কাকেও আক্রমণ করো না। তখন রাজা দম্ভোদ্ভব প্রণাম করে চ’লে গেলেন।

উপাখ্যান শেষ করে পরশুরাম বললেন, মহারাজ, নারায়ণ ঋষি নর অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ, নর-নারায়ণই অর্জুন-কৃষ্ণ হয়ে জন্মেছেন। আপনি সবুদ্ধি অবলম্বন করে পাণ্ডবগণের সঙ্গে সন্ধি করুন, যুদ্ধে মত দেবেন না।

মহর্ষি কণ্ব বললেন, দুর্যোধন, মনে করো না যে তুমিই বলবান, বলবান অপেক্ষাও বলবান দেখা যায়। একটি পুরাতন ইতিহাস বলছি শোন।-ইন্দ্ৰসারথি মাতলির একটি অনুপমরূপবতী কন্যা ছিল, তার নাম গুণকেশী। মাতলি তার কন্যার যোগ্য বর কোথাও না পেয়ে পাতালে গেলেন। সেই সময়ে নারদও বরুণের কাছে যাচ্ছিলেন; তিনি বললেন, আমরা তোমার কন্যার জন্য বর নির্বাচন করে দেব। নারদ মাতলিকে নাগলোকে নিয়ে গিয়ে বিবিধ আশ্চর্য বস্তু দেখালেন। মাতলি বললেন, এখানে আমার কন্যার যোগ্য বর কেউ নেই, অন্যত্র চলুন। নারদ মাতলিকে দৈত্যদানবদের নিবাস। হিরণ্যপুরে নিয়ে গিয়ে বললেন, এখানকার কোনও পুরুষকে নির্বাচন করতে পার। মাতলি বললেন, দানবদের সঙ্গে আমি সম্বন্ধ করতে পারি না, তারা দেবগণের | বিপক্ষ। অন্যত্র চলুন, আমি জানি আপনি কেবল বিরোধ ঘটাতে চান। তার পর নারদ গরুড়বংশীয় পক্ষীদের ললাকে এসে বললেন, এরা নির্দয় সর্পভোজী, কিন্তু কার্যত ক্ষত্রিয় এবং বিষ্ণুর উপাসক। মাতলি সেখানেও বর নির্বাচন করলেন না। নারদ তাকে রসাতল নামক সপ্তম পৃথিবীতলে নিয়ে গেলেন, যেখানে গোমাতা সুরভি বাস করেন, যাঁর ক্ষীরধারা থেকে ক্ষীরোদ সাগরের উৎপত্তি।

তারপর তারা অনন্ত নাগ বাসুকির পুরীতে গেলেন। সেখানে একটি নাগকে বহুক্ষণ দেখে মাতলি প্রশ্ন করলেন, এই সুদর্শন নাগ কার বংশধর? একে গুণকেশীর যোগ্য মনে করি। নারদ বললেন, ইনি ঐরাবত নাগের বংশজাত আর্যকের পৌত্র, এঁর নাম সুমুখ। কিছুকাল পূর্বে এঁর পিতা চিকুরু গরুড় কর্তৃক নিহত হয়েছেন। মাতলি প্রীত বয়ে বললেন, এই সুমুখই আমার জামাতা হবেন। সুমুখের পিতামহ আর্যকের কাছে গিয়ে নারদ মাতলির ইচ্ছা জানালেন। আর্যক বললেন, দেবর্ষি, ইন্দ্রের সখা মাতলির সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ কে না চায়? কিন্তু গরুড় আমার পুত্র চিকুরুকে ভক্ষণ করেছে এবং বলেছে এক মাস পরে সুমুখকেও খাবে; এই কারণে আমার মনে সুখ নেই। মাতলি বললেন, সুমুখ আমার সঙ্গে ইন্দ্রের কাছে চলুন, ইন্দ্র গরুড়কে নিবৃত্ত করবেন।

নারদ ও মাতলি সুমুখকে নিয়ে দেবরাজের কাছে গেলেন, সেখানে ভগবান। বিষ্ণুও ছিলেন। নারদের মুখে সকল বৃত্তান্ত শুনে বিষ্ণু বললেন, বাসব, সুমুখকে অমৃত পান করিয়ে অমর কর। ইন্দ্র সুমুখকে দীর্ঘায়ু দিলেন, কিন্তু অমৃত পান করালেন না। তার পর সুমুখ ও মাতলিকন্যা গুণকেশীর বিবাহ হল।

সুমুখ দীর্ঘায়ু পেয়েছেন জেনে গরুড় ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে বললেন, তুমি আমাকে নাগভোজনের বর দিয়েছিলে, এখন বাধা দিলে কেন? ইন্দ্র বললেন, আমি বাধা দিইনি, বিষ্ণুই সুমুখকে অভয় দিয়েছেন। গরুড় বললেন, দেবরাজ, আমি ত্রিভুবনের অধীশ্বর হবার যোগ্য, তথাপি পরের ভৃত্য হয়েছি। তুমি থাকতে বিষ্ণু আমার জীবিকায় বাধা দিতে পারেন না, তুমি আর বিষ্ণুই আমার গৌরব নষ্ট করেছ। তার পর গরুড় বিষ্ণুকে বললেন, আমার পক্ষের এক অংশ দিয়েই তোমাকে আমি অক্লেশে বইতে পারি, ভেবে দেখ কে অধিক বলবান। বিষ্ণু বললেন, তুমি অতি দুর্বল হয়েও নিজেকে বলবান মনে করছ; অণ্ডজ, আমার কাছে আত্মশ্লাঘা ক’রো না। আমি নিজেই নিজেকে বহন করি, তোমাকেও ধারণ করি। তুমি যদি আমার বাম বাহুর ভার সইতে পার তবেই তোমার গর্ব সার্থক হবে। এই বলে বিষ্ণু তাঁর বাম বাহু গরুড়ের স্কন্ধে রাখলেন, হতচেতন হয়ে গরুড় পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে গরুড় প্রণাম করে বললেন, প্রভু, আমি তোমার ধ্বজবাসী পক্ষী মাত্র, আমাকে ক্ষমা কর। তোমার বল জানতাম না তাই মনে করতাম আমার বলের তুলনা নেই। তখন বিষ্ণু তার পদাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে সুমুখকে গুরুড়ের বক্ষে নিক্ষেপ করলেন। সেই অবধি সুমুখের সঙ্গে গরুড় অবিরোধে বাস করেন।

উপাখ্যান শেষ করে কথ বললেন, গরুড়ের গর্ব এইরূপে নষ্ট হয়েছিল। বৎস দুর্যোধন, যে পর্যন্ত তুমি যুদ্ধে পাণ্ডবদের সম্মুখীন না হচ্ছ সেই পর্যন্তই তুমি জীবিত আছ। তুমি বিরোধ ত্যাগ কর, বাসুদেবকে আশ্রয় করে নিজের কুল রক্ষা কর। সর্বদর্শী নারদ জানেন, এই কৃষ্ণই চক্রগদাধর বিষ্ণু। দুর্যোধন কথের দিকে চেয়ে উচ্চহাস্য করলেন এবং গজশুণ্ডতুল্য নিজের ঊরুতে চপেটাঘাত করে বললেন, মহর্ষি, ঈশ্বর আমাকে যেমন সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আমার যা হবে আমি সেই ভাবেই চলছি, কেন প্রলাপ বকছেন?
 

১৫। বিশ্বামিত্র, গালব, যযাতি ও মাধবী

নারদ বললেন, দুর্যোধন, সুহৃদগণের কথা তোমার শোনা উচিত, কোনও বিষয়ে নিবন্ধ (জিদ) ভাল নয়, তার ফল ভয়ংকর হয়। একটি প্রাচীন ইতিহাস বলছি শোন

।-পুরাকালে বিশ্বামিত্র যখন তপস্যা করছিলেন, তখন তার কাছে বশিষ্ঠের রূপ ধরে স্বয়ং ধর্মদের উপস্থিত হলেন। ক্ষুধার্ত অতিথিকে দেখে বিশ্বামিত্র ব্যস্ত হয়ে পরমান্নের চরু পাক করতে লাগলেন। ধর্ম অপেক্ষা করলেন না, অন্য তপস্বীদের অন্ন ভোজন করলেন। তারপর বিশ্বামিত্র অভুক্ত অন্ন নিয়ে এলে ধর্ম বললেন, আমি ভোজন করেছি, যে পর্যন্ত ফিরে না আসি তত কাল তুমি অপেক্ষা কর। বিশ্বামিত্র দুই হাতে মাথার উপর অন্নপাত্র ধ’রে বায়ুভোজী ও নিশ্চেষ্ট হয়ে রইলেন। এই সময়ে শিষ্য গালব তার পরিচর্যা করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে বশিষ্ঠরূপী ধর্ম ফিরে এসে বললেন, বিপ্রর্ষি, আমি তুষ্ট হয়েছি। এই বলে তিনি অন্ন ভোজন করে চ’লে গেলেন।

বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয়ত্ব ত্যাগ করে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করলেন এবং প্রীত হয়ে গালবকে বললেন, বৎস, এখন যেখানে ইচ্ছা হয় যেতে পার। গালব বললেন, আপনাকে গুরুদক্ষিণা কি দেব? তিনি বার বার এই প্রশ্ন করায় বিশ্বামিত্র কিঞ্চিৎ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আমাকে আট শত এমন অশ্ব দাও যাদের কান্তি চন্দ্রের ন্যায় শুভ্র এবং একটি কর্ণ শ্যামবর্ণ।

গালব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বিষ্ণুকে স্মরণ করতে লাগলেন। তখন তাঁর সখা গরুড় এসে বললেন, গালব, আমার সঙ্গে এস, তোমার অভীষ্ট পূর্ণ হবে। গরুড় গালবকে নিয়ে নানা দিকে নানা লোকে ভ্রমণ করলেন এবং পরিশেষে রাজা যযাতির কাছে। এসে গালবের গুরুদক্ষিণার জন্য অশ্ব প্রার্থনা করলেন। যযাতি বললেন, সখা, আমি পূর্বের ন্যায় ধনবান নই, কিন্তু এই ব্রহ্মর্ষিকে নিরাশ করতেও পারি না। গালব, আপনি আমার কন্যা মাধবীকে নিয়ে যান, রাজারা এই কন্যার শুল্কস্বরূপ নিশ্চয় আপনার অভীষ্ট আট শত অশ্ব দেবেন, আমিও দৌহিত্র লাভ করব।

যযাতির কন্যা মাধবীকে নিয়ে গালব অযোধ্যার রাজা হর্যশ্বের কাছে গেলেন। তাঁর প্রার্থনা শুনে হর্ষ বলেলন, এই কন্যা অতি শুভলক্ষণা, ইনি রাজচক্রবর্তী পুত্রের জন্ম দিতে পারবেন। কিন্তু আপনি শুল্কস্বরূপ যা চান তেমন অশ্ব দুই শত মাত্র আমার আছে। আমি এই কন্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করব, আপনি আমার অভীষ্ট পূর্ণ করুন। মাধবী গালবকে বললেন, এক ব্রহ্মবাদী মুনি আমাকে বর দিয়েছেন, তুমি প্রত্যেক বার প্রসবের পর আবার কুমারী হবে। অতএব আপনি দুই শত অশ্ব নিয়ে আমাকে দান করুন; এর পরে আরও তিন রাজার কাছে আমাকে নিয়ে যাবেন, তাতে আপনার আট শত অশ্ব পূর্ণ হবে, আমারও চার পুত্র লাভ হবে। গালব হর্ষশ্বকে বললেন, মহারাজ, আমার শুল্কের চতুর্থাংশ দিয়ে আপনি এই কন্যার গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করুন।

যথাকালে হর্ষ বসুমনা নামে একটি পুত্র লাভ করলেন। তখন গালব তার কাছে গিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনি অভীষ্ট পুত্র পেয়েছেন, এখন অবশিষ্ট শুল্কের ন্য আমাকে অন্য জার কাছে যেতে হবে। সত্যবাদী হর্ষ তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারে মাধবীকে প্রত্যর্পণ করলেন, মাধবীও পুনর্বার কুমারী হয়ে গালবের সঙ্গে চললেন। তার পর গালব একে একে কাশীরাজ দিবোদাস এবং ভোজরাজ উশীনরের কাছে গেলেন। তাঁরাও প্রত্যেকে দুই শত অশ্ব দিয়ে মাধবীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করলে তাঁদের পুত্রের নাম যথাক্রমে প্রতর্দন ও শিবি।

গরুড় গালবকে বললেন, পূর্বে মহর্ষি ঋচীক কান্যকুব্ধরাজ গাধিকে এইরূপ সহস্র অশ্ব শুল্ক দিয়ে তার কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করেছিলেন। এই সকল অশ্ব ঋচিক বরুণালয়ে পেয়েছিলেন। মহারাজ গাধি ব্রাহ্মণগণকে সমস্ত অশ্ব দান করেন, তাঁদের কাছ থেকে হর্ষ দিবোদাস ও উশীনর প্রত্যেকে দুই শত অশ্ব ক্রয় করেন, অবশিষ্ট চার শত পথে অপহৃত হয়। এই কারণে আর এরূপ অশ্ব পাওয়া যাবে না, তুমি এই ছয় শতই বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দাও।

বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে গালব বললেন, আপনি গুরুদক্ষিণাস্বরূপ এই ছয় শত অশ্ব নিন এবং অবশিষ্ট দুই শতের পরিবর্তে এই কন্যাকে নিন। তিন জন রাজর্ষি এঁর গর্ভে তিনটি ধার্মিক পুত্র উৎপাদন করেছেন, আপনি চতুর্থ পুত্র উৎপাদন করুন। বিশ্বামিত্র বললেন, গালব, তুমি প্রথমেই এই কন্যা আমাকে দাও নি কেন, তা হলে আমার চারটি বংশধর পুত্র হত। বিশ্বামিত্র মাধবীকে নিলেন, অশ্বগুলি তার আশ্রমে বিচরণ করতে লাগল। যথাকালে অষ্টক নামে মাধবীর একটি পুত্র হল। বিশ্বামিত্র এই পুত্রকে ধর্ম অর্থ ও অশ্বগুলি দান করলেন এবং মাধবীকে শিষ্য গালবের হাতে দিয়ে বনে চ’লে গেলেন।

গালব মাধবীকে বললেন, তোমার প্রথম পুত্র বসুমনা দাতা, দ্বিতীয় প্রতর্দন বীর, তৃতীয় শিবি সত্যধর্মরত এবং চতুর্থ অষ্টক যজ্ঞকারী। তুমি এই চার পুত্র প্রসব করে আমাকে, চার জন রাজাকে এবং তোমার পিতাকে উদ্ধার করেছ। তারপর গরুড়ের সম্মতি নিয়ে গালব মাধবীকে যযাতির হস্তে প্রত্যর্পণ করে বনে তপস্যা করতে গেলেন।

যযাতি তার কন্যার স্বয়ংবর করাবার ইচ্ছা করলেন। যযাতিপুত্র যদু ও পুরু ভগিনীকে রথে নিয়ে গঙ্গাযমুনাসংগমস্থ আশ্রমে গেলেন। বহু রাজা এবং নাগ যক্ষ গন্ধর্ব প্রভৃতি স্বয়ংবরে উপস্থিত হলেন, কিন্তু মাধবী সকলকে প্রত্যাখ্যান করে তপোবনকেই বরণ করলেন। তিনি মৃগীর ন্যায় বনচারিণী হয়ে বিবিধ ব্রতনিয়ম ও ব্রহ্মচর্য পালন করে ধর্মসঞ্চয় করতে লাগলেন।

দীর্ঘ আয়ু ভোগ করে যযাতি স্বর্গে গেলেন। বহু বর্ষ স্বর্গবাসের পর তিনি মোহবশে দেবতা ঋষি ও মনুষ্যকে অবজ্ঞা করতে লাগলেন। স্বর্গবাসী রাজর্ষিগণ তাকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, এ কেন স্বর্গে এল ? কে একে চেনে? সকলেই বললেন, আমরা একে চিনি না। তখন যযাতির তেজ নষ্ট হল , তিনি তার আসন থেকে চ্যুত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে পড়তে লাগলেন। দেবরাজের এক দূত এসে তাকে বললেন, রাজা, তুমি অত্যন্ত মদগর্বিত, সকলকেই অপমান কর, তুমি স্বর্গবাসের যোগ্য নও, গর্বের জন্যই তোমার পতন হল। যযাতি স্থির করলেন, আমি সাধুজনের মধ্যেই পতিত হব। সেই সময়ে প্রতর্দন বসুমনা শিবি ও অষ্টক নৈমিষারণ্যে বাজপেয় যজ্ঞ করছিলেন। যজ্ঞের ধূম অবলম্বন করে যযাতি সেই চার রাজার মধ্যে অবতরণ করলেন। তখন মাধবীও বিচরণ করতে করতে সেখানে এলেন এবং পিতা যযাতিকে প্রণাম করে বললেন, এই চার জন আমার পুত্র, আপনার দৌহিত্র। আমি যে ধর্ম সঞ্চয় করেছি তার অর্ধ আপনি নিন। প্রতর্দন প্রভৃতি রাজারা তাদের জননী ও মাতামহকে প্রণাম করলেন। গালবও অকস্মাৎ সেখানে এসে বললেন, রাজা, আমার তপস্যার অষ্টম ভাগ নিয়ে আপনি স্বর্গারোহণ করুন।

সাধুজন যেমন তাকে চিনতে পারলেন তৎক্ষণাৎ যযাতির পতন নিবারিত হল। প্রতর্দন প্রভৃতি উচ্চকণ্ঠে বললেন, আমরা সৎকর্মের ফলে যে পুণ্য লাভ করেছি তা আপনাকে দিলাম, তার প্রভাবে আপনি স্বর্গারোহণ করুন। যযাতি ভূমি স্পর্শ করলেন না, দৌহিত্রগণের উক্তির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গে উঠতে লাগলেন। দেবতারা তাকে সাদরে অভিনন্দন করলেন। ব্রহ্মা বললেন, মহারাজ, তুমি বহু যজ্ঞ দান ও প্রজাপালন করে যে পুণ্য অর্জুন করেছিলে তা তোমার অভিমানের ফলে নষ্ট হয়েছিল, তাই তুমি স্বর্গবাসীদের ধিক্কার পেয়ে পতিত হয়েছিলে। অভিমান বলগর্ব হিংসা কপটতা বা শঠতা থাকলে স্বর্গতভাগ চিরস্থায়ী হয় না। উত্তম মধ্যম বা অধম কাকেও তুমি অপমান করো না, গর্বিত লোকে শান্তি পায় না।

উপাখ্যান শেষ করে নারদ বললেন, অভিমানের ফলে যযাতি স্বর্গচ্যুত হয়েছিলেন, অতিশয় নিবন্ধের জন্য গালবও দুঃখভোগ করেছিলেন। দুর্যোধন, তুমি অভিমান ক্রোধ ও যুদ্ধের অভিপ্রায় ত্যাগ কর, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি কর।

১৬। দুর্যোধনের দুরাগ্রহ

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভগবান নারদের কথা সত্য, আমিও সেরূপ ইচ্ছা করি, কিন্তু আমার শক্তি নেই। কৃষ্ণ, তুমি যা বলেছ তা ধর্মসংগত ও ন্যায্য, কিন্তু বৎস, আমি স্বাধীন নই, দুরাত্মা পুত্ররা আমার আদেশ মানবে না, গান্ধারী বিদুর ভীষ্ম প্রভৃতির কথাও দুর্যোধন শোনে না। তুমিই ওই দুর্বুদ্ধিকে বোঝাবার চেষ্টা কর।

কৃষ্ণ মিষ্ট বাক্যে দুর্যোধনকে বললেন, পুরুষশ্রেষ্ঠ, মহাপ্রাজ্ঞ বংশে তোমার জন্ম, তুমি শাস্ত্রজ্ঞ ও সর্বগুণান্বিত, যা ন্যায়সম্মত তাই কর। জিনের প্রবৃত্তি ধর্মার্থযুক্ত দেখা যায়, কিন্তু তোমাতে তার বিপরীতই দেখছি। ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিদুর, সোমদত্ত, বাহ্নীকরাজ, বিকর্ণ (১), বিবিংশতি (১), সঞ্জয় এবং তোমার জ্ঞাতি ও মিত্রগণ সকলেই সন্ধি চান। তুমি পিতামাতার বশবর্তী হও। যে লোক শ্রেষ্ঠ সুহৃদ্গণের উপদেশ অগ্রাহ্য করে হীন মন্ত্রণাদাতাদের মতে চ’লে সে ঘোর বিপদে পড়ে। তুমি আজন্ম পাণ্ডবদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আসছ কিন্তু তারা তা সয়েছেন। পাণ্ডবরা যে রাজ্য জয় করেছিলেন তা এখন তুমি ভোগ করছ, কর্ণ দুঃশাসন শকুনি প্রভৃতির সহায়তায় তুমি ঐশ্বর্যলাভ করতে চাচ্ছ। তোমার সমস্ত সৈন্য এবং ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ প্রভৃতি সকলে মিলেও ধনঞ্জয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবেন না। খাণ্ডবপ্রস্থে যিনি দেবতা গন্ধর্ব যক্ষ প্রভৃতিকে জয় করেছিলেন, কোন্ মানুষ তার সমকক্ষ? শুনেছি বিরাটনগরে বহুজনের সঙ্গে একজনের আশ্চর্য যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধই আমার উক্তির যথেষ্ট প্রমাণ। যিনি সাক্ষাৎ মাহদেবকে যুদ্ধে সন্তুষ্ট করেছিলেন, আমি যাঁর সঙ্গে থাকব, সেই অর্জুনকে তুমি জয় করবার আশা কর! রাজা দুর্যোধন, কৌরবকুল যেন বিনষ্ট হয়, লোকে যেন তোমাকে নষ্টকীর্তি কুলঘ্ন না বলে। পাণ্ডবগণ তোমাকে যুবরাজের পদে এবং ধৃতরাষ্ট্রকে মহারাজের পদে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তুমি তাদের অর্ধ রাজ্য দিয়ে রাজলক্ষ্মী লাভ কর।

ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, বৎস, তুমি কৃষ্ণের কথা শোন, কুলঘ্ন কুপুরুষ হয়ো না, হিতৈষীদের বাক্য লঙ্ঘন করে কুপথে যেয়ো না, পিতামাতাকে শোকসাগরে। মগ্ন করো না। দ্রোণ বললেন, বৎস, কেশব ও ভীষ্ম তোমাকে ধর্মসংগত হিতবাক্যই বলেছেন, তুমি এঁদের কথা রাখ, কৃষ্ণের অপমান করো না। আত্মীয়বর্গ ও সমস্ত প্রজার মৃত্যুর কারণ হয়ো না, কৃষ্ণার্জুন যে পক্ষে আছেন সে পক্ষকে তুমি অজেয় জেনো। বিদুর বললেন, দুর্যোধন, তোমার জন্য শোক করি না, তোমার বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্যই করি। তোমার কর্মের ফলে এঁরা অনাথ ও মিত্রহীন হয়ে ছিন্নপক্ষ পক্ষীর ন্যায় বিচরণ করবেন, কুলনাশক কুপুত্রকে জন্ম দেবার ফলে ভিক্ষুক হবেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, দুর্যোধন, মহাত্মা কৃষ্ণের কথা অতিশয় মঙ্গলজনক, তাতে অলব্ধ। বিষয়ের লাভ হবে, লব্ধ বিষয়ের রণা হবে। তুমি যদি এঁর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান কর তবে নিশ্চয় পরাভূত হবে। ভীষ্ম ও দ্রোণ বললেন, দুর্যোধন, যুদ্ধারম্ভের পূর্বেই। শত্রুতার অবসান হ’ক। তুমি নতমস্তকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম কর, তিনি তার। সুলক্ষণ দক্ষিণ বাহু তোমার স্কন্ধে রাখুন, তোমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিন; ভীমসেন। তোমাকে আলিঙ্গন করুন, পাণ্ডব ভ্রাতাদের সঙ্গে তোমাকে মিলিত দেখে এই রাজারা। সকলে আনন্দাশ্রু মোচন করুন।

দুর্যোধন কৃষ্ণকে বললেন, তুমি বিবেচনা না করে কেবল পাণ্ডবদের প্রতি প্রীতির বশে আমাকে নিন্দা করছ। তুমি বিদুর পিতা পিতামহ ও আচার্য দ্রোণ-তোমরা কেবল আমাকেই দোষ দাও, পাণ্ডবদের দোষ দেখ না। বিশেষ চিন্তা করেও আমি নিজের বৃহৎ বা ক্ষুদ্র কোনও অপরাধই দেখতে পাই না। পাণ্ডবগণ দ্যূতক্রীড়া ভালবাসেন সেজন্যই আমাদের সভায় এসেছিলেন। সেখানে শকুনি তাদের রাজা জয় করেছিলেন তাতে আমার কি দোষ? বিজিত ধন পিতার আজ্ঞায় তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার পর তারা আবার পরাজিত হয়ে বনে গিয়েছিলেন, তাতেও আমাদের অপরাধ হয়নি। তবে কি জন্য তারা কৌরবদের শত্ৰুগমের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমাদের বিনষ্ট করতে চান ? উগ্র কর্মে বা কঠোর বাক্যে ভয় পেয়ে আমরা ইন্দ্রের কাছেও নত হবে না। পাণ্ডবদের কথা দূরে থাক, দেবতারাও ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণকে পরাস্ত করতে পারেন না। আমরা শত্রুর নিকট নত না হয়ে যদি যুদ্ধে। বীরশয্যা লাভ করি তবে বন্ধুগণ আমাদের জন্য শোক করবেন না। কেশব, পূর্বে আমার পিতা পাণ্ডবগণকে যে রাজ্যাংশ দেবার আদেশ দিয়েছিলেন, আমি জীবিত থাকতে পাণ্ডবরা তা পাবেন না। যখন আমি অল্পবয়স্ক ও পরাধীন ছিলাম, তখন অজ্ঞতা বা ভয়ের বশে পিতা যা দিতে চেয়েছিলেন এখন তা আমি দেব না। তীক্ষ্ম সূচীর অগ্রভাগে যে পরিমাণ ভূমি বিদ্ধ হয়, তাও আমি ছাড়ব না।

ক্রোধচঞ্চলনয়নে হাস্য করে কৃষ্ণ বললেন, তুমি আর তোমার মন্ত্রীরা যুদ্ধে বীরশয্যাই লাভ করবে। পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে তুমি শকুনির সঙ্গে দূতসভার আয়োজন করেছিলে। তুমি ভিন্ন আর কে ভ্রাতৃজায়াকে সভায় আনিয়ে নির্যাতন করতে পারে? তুমি কর্ণ আর দুঃশাসন অনার্যের ন্যায় বহু নিষ্ঠুর কথা বলেছিলে। বারণাবতে পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তীকে তুমি দগ্ধ করবার চেষ্টা করেছিলে। সর্বদাই তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে এইরূপ ব্যবহার করে আসছ, তবে তুমি অপরাধী নও কেন? তারা তাদের পৈতৃক অংশই চাচ্ছেন, তাতেও তুমি সম্মত নও। পাপাত্মা, ঐশ্বর্যভ্রষ্ট ও নিপাতিত হয়ে তোমাকে অবশেষে সবই দান করতে হবে।

দুঃশাসন দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, আপনি যদি সন্ধি না করেন, তবে ভীষ্ম দ্রোণ ও পিতা আপনাকে আমাকে ও কর্ণকে বন্ধন করে পাণ্ডবদের হাতে দেবেন। এই কথা শুনে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে মহানাগের ন্যয়া নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সভা থেকে উঠে চ’লে গেলেন; তার ভ্রাতার মন্ত্রীরা এবং অনুগত রাজারাও তার অনুসরণ করলেন।

ভীষ্ম বললেন, ধর্ম ও অর্থ বিসর্জন দিয়ে যে লোক ক্রোধের বশবর্তী হয়, শীঘ্রই সে বিপদে পড়ে এবং তার শত্রুরা হাসে। কৃষ্ণ বললেন, কুরুবংশের বৃদ্ধগণ মহা অন্যায় করেছেন, একটা মুখকে রাজার ক্ষমতা দিয়েছেন অথচ তাকে নিয়ন্ত্রিত করেননি। ভরতবংশীয়গণ, আপনাদের হিতার্থে আমি যা বলছি আশা করি তা আপনাদের অনুমোদিত হবে।

-দুরাত্মা কংস তার পিতা ভোজরাজ উগ্রসেন জীবিত থাকতেই তার রাজত্ব হরণ করেছিল। আমি তাকে বধ করে পুনর্বার উগ্রসেনকে রাজপদে বসিয়েছি। কুলরক্ষার জন্য যাদব বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়গণ কংসকে ত্যাগ করে স্বস্তিলাভ করেছেন। দেবাসুরের যুদ্ধকালে যখন সমস্ত লোক দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে ধ্বংসের মুখে যাচ্ছিল তখন ব্রহ্মার আদেশে ধর্মদেব দৈত্যদানবগণকে বন্ধন করে বরুণের নিকট সমর্পণ করেছিলেন। আপনারাও দুর্যোধন কর্ণ শকুনি আর দুঃশাসনকে বন্ধন করে পাণ্ডবদের হাতে দিন। অথবা কেবল দুর্যোধনকেই সমর্পণ করে সন্ধি স্থাপন করুন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, আপনার দুর্বলতার জন্য যেন ক্ষত্রিয়গণ বিনষ্ট হন।

ত্যজেৎ কুলার্থে পুরুষং গ্রামস্যার্থে কুলং ত্যজেৎ।

গ্রামং জনপদস্যার্থে আত্মার্তে পৃথিবীং ত্যজেৎ ||

-কুলরক্ষার প্রয়োজনে একজনকে ত্যাগ করবে, গ্রামরক্ষার জন্য কুলত্যাগ, দেশরক্ষার জন্য গ্রামত্যাগ এবং আত্মরক্ষার জন্য পৃথিবীও ত্যাগ করবে।

** (১) দুর্যোধনের ভ্রাতা।

১৭। গান্ধারীর উপদেশ-কৃষ্ণের সভাত্যাগ

কৃষ্ণের কথায় ধৃতরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে বিদুরকে বললেন, দূরদর্শিনী গান্ধারীকে এখানে ডেকে আন, আমি তার সঙ্গে দুর্যোধনকে অনুনয় করব। গান্ধারী এলে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তোমার দুরাত্মা অবাধ্য পুত্র প্রভুত্বের লোভে রাজ্য ও প্রাণ চ’লে গেছে।

গান্ধারী বললেন, অশিষ্ট অবিনীত ধর্মনাশক লোকের রাজ্য পাওয়া উচিত নয় তথাপি সে পেয়েছে। মহারাজ, তুমিই দোষী, পুত্রের দুষ্ট প্রবৃত্তি জেনেও স্নেহবশে তার মতে চ’লেছ, মূঢ় দুরাত্মা লোভী কুসঙ্গী পুত্রকে রাজ্য দিয়ে এখন তার ফল ভোগ করছ।

ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর দুর্যোধনকে আবার সভায় নিয়ে এলেন। গান্ধারী বললেন, পুত্র, তোমার পিতা ও ভীষ্মদ্রোণাদি সুহৃবর্গের কথা রাখ। রাজত্বের অর্থ মহৎ প্রভুত্ব, দুরাত্মারা এই পদ কামনা করে কিন্তু রাখতে পারে না। যে লোক কামনা বা ক্রোধের বশে আত্মীয় বা অন্যের প্রতি অন্যায় আচরণ করে, কেউ তার সহায় হয় না। পাণ্ডবগণ ঐক্যবদ্ধ মহাপ্রাজ্ঞ বীর, তাদের সঙ্গে মিলিত হলে তুমি সুখে পৃথিবী ভোগ করতে পারবে। বতস, ভীষ্ম-দ্রোণ যা বলেছেন তা সত্য, কৃষ্ণার্জুন অজেয়। তুমি কেশবের শরণাপন্ন হও, তা হলে তিনি উভয় পক্ষের মঙ্গল করবেন। যুদ্ধে কল্যাণ নেই, ধর্ম বা অর্থ নেই, সুখ নেই, সর্বদা জয়ও হয় না। তুমি তের বৎসর পাণ্ডবদের প্রচুর অপকার করেছ, তোমার কামনা আর ক্রোধের জন্য তা বর্ধিত হয়েছে, এখন তার উপশম কর। মূঢ়, তুমি মনে কর ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতি তোমার জন্য যুদ্ধে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করবেন, কিন্তু তা হবে না। কারণ, এই রাজ্যে তোমাদের আর পাণ্ডবদের সমান অধিকার, দুই পক্ষের সঙ্গেই এঁদের সমান স্নেহসম্বন্ধ, কিন্তু পাণ্ডবরা অধিকতর ধর্মশীল। ভীষ্মদি তোমার অন্নে পালিত সেজন্য জীবন বিসর্জন দিতে পারেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে শত্রুরূপে দেখতে পারবেন না। বৎস, কেবল লোভ করলে সম্পত্তিলাভ হয় না, লোভ ত্যাগ কর, শান্ত হও।

মাতার কথায় অনাদর দেখিয়ে দুর্যোধন ক্রুদ্ধ হয়ে শকুনি কর্ণ ও দুঃশাসনের কাছে গেলেন। তারা মন্ত্রণা করে স্থির করলেন, কৃষ্ণ ক্ষিপ্রকারী, তিনি ধৃতরাষ্ট্র আর ভীষ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমাদের বন্ধন করতে চান; অতএব আমরাই আগে তাঁকে সবলে নিগৃহীত করব, তাতে পাণ্ডবরা বিমূঢ় ও নিরুৎসাহ হয়ে পড়বে। ধৃতরাষ্ট্র ক্রুদ্ধ হয়ে বারণ করলেও আমরা কৃষ্ণকে বন্ধন করে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করব।

দুর্যোধনাদির এই অভিসন্ধি বুঝতে পেরে সাত্যকি সভা থেকে বেরিয়ে কৃতবর্মাকে বললেন, শীঘ্র আমাদের সৈন্য বৃহবদ্ধ কর এবং বর্ম ধারণ করে তুমি এই সভার দ্বারদেশে থাক। তার পর সাত্যকি সভায় গিয়ে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরকে দুর্যোধনাদির অভিসন্ধি জানিয়ে বললেন, বালক ও জড়বুদ্ধি যেমন বস্ত্র দ্বারা প্রজ্বলিত অগ্নি আবরণ করতে চায়, এই মূর্খগণ সেইরূপ কৃষ্ণকে বন্ধন করতে চাচ্ছে। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, মহারাজ, আপনার পুত্রেরা কালের কবলে পড়েছে, তারা বিগহিত অসাধ্য কর্ম করতে যাচ্ছে।

কৃষ্ণ বললেন, রাজা, এরা যদি আমাকে সবলে বন্দী করতে চায় তবে আপনি অনুমতি দিন, এরা আমাকে বাঁধুক কিংবা আমিই এদের বাঁধি। আমি এদের সকলকে নিগৃহীত করে পাণ্ডবদের হাতে দিতে পারি, তাতে অনায়াসে তাদের কার্যসিন্ধি হবে। কিন্তু আপনার সমক্ষে আমি এই নিন্দিত কর্ম করব না। আমি অনুমতি দিচ্ছি, দুর্যোধন যা ইচ্ছা হয় করুক।

দুর্যোধনকে আবার ডেকে আনিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, নৃশংস পাপিষ্ঠ, তুমি ক্ষুদ্রবুদ্ধি পাপাত্মাদের সাহায্যে পাপকর্ম করতে চাচ্ছ! হস্ত দ্বারা বায়ুকে ধরা যায় না, চন্দ্রকেও স্পর্শ করা যায় না, মস্তক দ্বারা পৃথিবী ধারণ করা যায় না; সেইরূপ কৃষ্ণকেও সবলে গ্রহণ করা যায় না।

কৃষ্ণ বললেন, দুর্যোধন, তুমি মোহবশে মনে করছ আমি একাকী, তাই আমাকে সবলে বন্দী করতে চাচ্ছ। এই দেখ—পাণ্ডবগণ, অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয়গণ, আদিত্য রুদ্র ও বসুগণ, মহর্ষিগণ, সকলেই এখানে আছেন। এই বলে কৃষ্ণ উচ্চহাস্য করলেন। তখন সহসা তার ললাটে ব্রহ্মা, বক্ষে রুদ্র, মুখ থেকে অগ্নি, এবং অন্যান্য অঙ্গ থেকে ইন্দ্রাদি দেবতা যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব প্রভৃতি, হলধর বলরাম ও পঞ্চপাণ্ডব আবির্ভূত হলেন। আয়ুধ উদ্যত করে অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ তাঁর সম্মুখে এলেন এবং শঙ্খ চক্র গদা শক্তি শাঙ্গনু প্রভৃতি সর্বপ্রকার প্রহরণও উপস্থিত হল। সহস্রচরণ সহস্রবাহু সহস্রনয়ন কৃষ্ণের ঘোর মূর্তি দেখে সভাস্থ সকলে ভয়ে চোখ বুজলেন, কেবল ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর সঞ্জয় ও ঋষিরা চেয়ে রইলেন, কারণ ভগবান জনার্দন তাঁদের দিব্যচক্ষু দিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্রও দিব্যদৃষ্টি পেয়ে কৃষ্ণের পরম রূপ দেখলেন। দেবতা গন্ধর্ব ঋষি প্রভৃতি প্রণাম করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, প্রভু, প্রসন্ন হও, তোমার রূপ সংবরণ কর, নতুবা জগৎ বিনষ্ট হবে। তখন কৃষ্ণ পূর্ব রূপ গ্রহ করলেন এভং ঋষিদের অনুমতি নিয়ে সাত্যকি আর বিদুরের হাত ধরে সভা থেকে বেরিয়ে এলেন। নারদাদি মহর্ষিগণও অন্তর্হিত হলেন।

দারুকের আনীত রথে উঠে কৃষ্ণ যখন প্রস্থানের উপক্রম করছিলেন তখন ধৃতরাষ্ট্র তার কাছে এসে বললেন, জনার্দন, পুত্রদের উপর আমার কতটুকু প্রভাব তা তুমি দেখলে। আমার দুরভিসন্ধি নেই, দুর্যোধনকে যা বলেছি তা তুমি শুনেছ। সকলেই জানে যে আমি সর্বপ্রযত্নে শান্তির চেষ্টা করেছি।

ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মদ্রোণাদিকে কৃষ্ণ বললেন, কৌরবসভায় যা হল তা আপনারা দেখলেন, দুর্যোধন আমাকে বন্দী কবার চেষ্টা করেছে তাও জানেন। ধৃতরাষ্ট্রও বলছেন তার কোনও প্রভুত্ব নেই। এখন আপনারা আজ্ঞা দিন আমি যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যাব। এই বলে কৃষ্ণ রথারোহণে কুন্তীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।

১৮। কৃষ্ণ ও কুন্তী-বিদুলার উপাখ্যান

কুন্তীকে প্রণাম করে কৃষ্ণ তাকে কৌরবসভার সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। কুন্তী বললেন, কেশব, তুমি যুধিষ্ঠিরকে আমার এই কথা বলো।-পুত্র, তুমি মন্দমতি, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা করে তোমার বুদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি কেবল ধর্মেরই চিন্তা করছ। ক্ষত্রিয়ের যে ধর্ম স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা নির্দিষ্ট করেছেন। তুমি তার দিকে মন দাও। তিনি তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয় সৃষ্টি করেছেন সেজন্য বাহুবলই ক্ষত্রিয়গণের উপজীব্য, সর্বদা নির্দয় কর্মে নিযুক্ত থেকে তাদের প্রজাপালন করতে হয়। রাজা যদি উপযুক্ত রূপে দণ্ডনীতি প্রয়োগ করেন তবেই চার বর্ণের লোক স্বধর্ম পালন করেন। এমন মনে করো না যে কালপ্রভাবেই রাজার দোষগুণ হয়; রাজার সদসৎ কর্ম অনুসারেই সত্য ত্রেতা দ্বাপর বা কলি যুগ উৎপন্ন হয়। তুমি পিতৃপিতামহের আচরিত রাজধর্ম পালন কর, তুমি যে ধর্ম আশ্রয় করতে চাও তা রাজর্ষিদের ধর্ম নয়। দুর্বল বা অহিংসাপরায়ণ রাজা প্রজাপালন করতে পারেন না। আমি সর্বদা এই আশীর্বাদ করছি যে তুমি যজ্ঞ দান ও তপস্যা কর, শৌর্য প্রজা বংশ বল ও তেজ লাভ কর। মহাবাহু, সাম দান ভেদ বা দণ্ডনীতির দ্বারা তোমার পৈতৃক রাজ্যাংশ উদ্ধার কর। তোমার জননী হয়েও আমাকে পরদত্ত অন্নপিণ্ডের প্রত্যাশায় থাকতে হয় এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে? কৃষ্ণ, আমি বিদুলা ও তাঁর পুত্রের কথা বলছি, তুমি যুধিষ্ঠিরকে শুনিও।

বিদুলা নামে এক যশস্বিনী তেজস্বিনী ক্ষত্রিয়নারী ছিলেন। তাঁর পুত্র সঞ্জয় সিন্ধুরাজ কর্তৃক পরাজিত হয়ে দুঃখিতমনে শুয়ে আছেন দেখে বিদুলা বললেন, তুমি আমার পুত্র নও, তুমি কোথা থেকে এসেছ? তুমি ক্রোধহীন ক্লীবতুল্য, তুমি যাবজ্জীবন নিরাশ হয়ে থাকতে চাও। নিজেকে অবজ্ঞা করো না, অল্পে তুষ্ট হয়ো না, নির্ভীক ও উৎসাহী হও। রে ক্লীব, তোমার সকল কীর্তি নষ্ট হয়েছে, রাজ্য পরহস্তগত হয়েছে, তবে বেঁচে আছ কেন? লোকে যার মহৎ চরিত্রের আলোচনা করে না সে পুরুষ নয়, স্ত্রীও নয়, সে কেবল মানুষের সংখ্যা বাড়ায়। যার দান তপস্যা শৌর্য বিদ্যা বা অর্থের খ্যাতি নেই সে তার মাতার বিষ্ঠা মাত্র। পুত্র, নির্বাপিত অগ্নির ন্যায় কেবল ধূমায়িত হয়ো না, মুহূর্তকালের জন্যও জ্বলে ওঠ, শত্রুকে আক্রমণ কর।

বিদুলার পুত্র সঞ্জয় বললেন, আমি যদি যুদ্ধে মরি তবে সমস্ত পৃথিবী পেয়েও আপনার কি লাভ হবে? অলংকার সুখভোগ বা জীবনেই বা কি হবে? বিদুলা বললেন, যিনি নিজের বাহুবল আশ্রয় করে জীবনধারণ করেন তিনিই কীর্তি ও পরলোকে সদ্গতি লাভ করেন। সিন্ধুরাজের প্রজারা সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু তারা মুঢ় ও দুর্বল, তাই রাজার বিপদের প্রতীক্ষায় নিশ্চেষ্ট হয়ে আছে। তুমি যদি নিজের পৌরুষ দেখাও তবে অন্য রাজারা সিন্ধুরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তুমি গিরিদুর্গে থেকে সুযোগের প্রতীক্ষা কর, সিন্ধুরাজ অজর অমর নন। যুদ্ধের ফলে তোমার সমৃদ্ধিলাভ হবে কিংবা ক্ষতি হবে তার বিচার না করেই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। আমি মহাকুলে জন্মগ্রহণ করে তোমাদের মহাকুলে এসেছি, আমি রাজ্যের অধিশ্বরী মঙ্গলময়ী ও পতির আদরিণী ছিলাম। সঞ্জয়, আমাকে আর তোমার পত্নীকে যদি দীনদশাগ্রস্ত দেখ তবে তোমার জীবনে প্রয়োজন কি? শত্রুদের বশে আনতে পারলে ক্ষত্রিয় যে সুখ লাভ করেন সে সুখ ইন্দ্রভবনেও নেই। যুদ্ধে প্রাণবিসর্জন অথবা শত্রুর বিনাশ-এ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের শান্তিলাভ হ’তে পারে না।

সঞ্জয় বললেন, আপনি আমার প্রতি নিষ্ঠুর, আপনার হৃদয় কৃষ্ণলৌহে নির্মিত। আমার ধন নেই, সহায়ও নেই, কি করে জয়লাভ করব? এই দারুণ অবস্থা জেনেই আমার রাজ্যোদ্ধারের ইচ্ছা নিবৃত্ত হয়েছে। আপনি পরিণতবুদ্ধি, যদি কোনও উপায় জানেন তো বলুন, আমি সর্বতোভাবে আপনার আদেশ পালন করব।

বিদুলা বললেন, তুমি পূর্বে যে বীরত্ব দেখিয়েছ তা আবার দেখাও, তা হলেই রাজ্য উদ্ধার করতে পারবে। যারা সিন্ধুরাজের উপর ক্রুদ্ধ, যাদের তিনি শক্তিহীন ও অপমানিত করেছেন, যারা তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়, তাদের সঙ্গে তুমি মিত্রতা কর। তুমি জান না, আমাদের রাজকোষে বহু ধন আছে। তোমার অনেক সুহৃৎও আছেন যাঁরা সুখদুঃখ সইতে পারেন এবং যুদ্ধ থেকে পালান না।

বিদুলার কথায় সঞ্জয়ের মোহ দূর হল তিনি বাক্যবাণে তাড়িত হয়ে জননীর উপদেশে যুদ্ধের উদযোগ করলেন এবং জয়ী হলেন। কোনও রাজা শত্রুর পীড়নে অবসন্ন হলে তাকে তার মন্ত্রী এই উৎসাহজনক তেজোবর্ধক উপাখ্যান শোনাবেন। বিজয়েচ্ছু রাজা ‘জয়’ নামক এই ইতিহাস শুনবেন। গর্ভিণী এই উপাখ্যান বার বার শুনলে বীরপ্রসবিনী হন।

কুন্তীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করে কৃষ্ণ ভীষ্মদির নিকট বিদায় নিলেন, তার পর কর্ণকে নিজের রথে তুলে নিয়ে সাত্যকির সঙ্গে যাত্রা করলেন।

১৯। কৃষ্ণ-কর্ণ-সংবাদ

যেতে যেতে কৃষ্ণ কর্ণকে বললেন, রাধেয়, তুমি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের সেবা করেছ। এবং তাদের কাছে ধর্মশাস্ত্রের সূক্ষ্ম তত্ত্বসকল শিখেছ। কুমারী কন্যার গর্ভে দুই প্রকার পুত্র হয়, কানীন (১) ও সহোঢ় (২)। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতগণ বলেন, কন্যাকে যে বিবাহ। করে সেই লোকই এই দুইপ্রকার পুত্রের পিতা। কর্ণ, তুমি কানীন পুত্র এবং ধর্মানুসারে পাণ্ডুরই পুত্র। অতএব তুমিই রাজা হও, তোমার পিতৃপক্ষীয় পাণ্ডবগণ এবং মাতৃপক্ষীয় বৃষ্ণিগণ দুই পক্ষকেই তোমার সহায় বলে জেনো। তুমি আজ আমার সঙ্গে চল, পাণ্ডবরা জানুন যে তুমি যুধিষ্ঠিরের অগ্রজ। তোমার পাঁচ ভ্রাতা, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র এবং অভিমন্যু তোমার চরণ ধারণ করবেন; সমাগত রাজারা এবং অন্ধক ও বৃষ্ণিবংশীয় সকলেই তোমার পদানত হবেন। রাজা ও রাজকন্যারা তোমার অভিষেকের জন্য হিরন্ময় রজতময় ও মৃন্ময় কুম্ভ এবং ওষধি বীজ রত্ন প্রভৃতি উপকরণ নিয়ে আসবেন দ্রৌপদীও ষষ্ঠ (৩) কালে তোমার সঙ্গে মিলিত হবেন। আমরা তোমাকে পৃথিবীর রাজপদে অভিষিক্ত করব, যুধিষ্ঠির যুবরাজ হবেন এবং শ্বেতচামরহস্তে তোমার পশ্চাতে থাকবেন। ভীমসেন তোমার মস্তকে শ্বেত ছত্র ধরবেন, অর্জুন তোমার রথ চালাবেন, অভিমন্যু সর্বদা তেমার কাছে থাকবেন। নকুল, সহদেব, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র, পাঞ্চালগণ ও মহারথ শিখণ্ডী তোমার অনুগমন করবেন। কুন্তীপুত্র, তুমি ভ্রাতৃগণে বেষ্টিত হয়ে রাজ্যশাসন কর, কুন্তী ও মিত্রগণ আনন্দিত হন, পাণ্ডব ভ্রাতাদের সঙ্গে তোমার সৌহার্দ হ’ক।

কর্ণ বললেন, কৃষ্ণ, তুমি যা বললে তা আমি জানি, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে আমি পাণ্ডুরই পুত্র। কুন্তী কন্যা অবস্থায় সূর্যের ঔরসে আমাকে গর্ভে ধারণ করেন এবং হিতচিন্তা না করে আমাকে ত্যাগ করেন। সূতবংশীয় অধিরথ আমাকে তার গৃহে আনেন, স্নেহবশে তখনই তার পত্নী রাধার স্তনদুগ্ধ ক্ষরিত হয়েছিল, তিনি আমার মলমূত্রও ঘেঁটেছিলেন। আমি কি করে তার পিণ্ডলোপ করতে পারি? অধিরথ আমাকে পুত্র মনে করেন, আমিও তাকে পিতা মনে করি।

তিনি আমার জাতকর্মাদি করিয়েছেন, তার নিযুক্ত ব্রাহ্মণরা আমাকে বসুষেণ নাম দিয়েছেন, তার আশ্রয়েই যৌবনলাভ করে আমি বিবাহ করেছি। পত্নীদের সঙ্গে আমার প্রেমের বন্ধন আছে, তাদের গর্ভে আমার পুত্র-পৌত্রও হয়েছে। গোবিন্দ, সমস্ত পৃথিবী এবং রাশি রাশি সুবৰ্ণ পেলেও আমি সেই সম্বন্ধ মিথ্যা করতে পারি না, সুখের লোভে বা ভয় পেয়েও নয়। আমি দুর্যোধনের আশ্রয়ে তের বৎসর নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করেছি; সুতগণের সঙ্গে আমি বহু যজ্ঞ করেছি, তাদের সঙ্গে আমার বিবাহাদি সম্বন্ধও আছে। আমার ভরসাতেই দুর্যোধন যুদ্ধের উদযোগ করেছেন, দ্বৈরথ যুদ্ধে অর্জুনের প্রতিযোদ্ধা রূপে আমাকেই বরণ করেছেন। মৃত্যু বা বন্ধনের ভয়ে অথবা লোভের বশে আমি তার সঙ্গে মিথ্যাচরণ করতে পারি না। তুমি যা বললে তা অবশ্য হিতের জন্যই। মধুসূদন, তুমি আমাদের এই আলোচনা গোপনে রেখো, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির যদি জানতে পারেন যে আমিই কুন্তীর প্রথম পুত্র তবে আর তিনি রাজ্য নেবেন না। যদি আমিই সেই রাজ্য পাই তবে দুর্যোধনকেই সমর্পণ করব। অতএব যুধিষ্ঠিরই রাজ্য লাভ করুন, হৃষীকেশ তাঁর নেতা এবং অর্জুন তাঁর যোদ্ধা হয়ে থাকুন। কেশব, ত্রিলোকের মধ্যে পুণ্যতম স্থান কুরুক্ষেত্রে বিশাল ক্ষত্রিয়মণ্ডল যেন অস্ত্রযুদ্ধেই নিহত হন, সমস্ত ক্ষত্রিয়ই যেন স্বর্গলাভ করেন। মৃদু হাস্য করে কৃষ্ণ বললেন, কর্ণ, আমি তোমাকে পৃথিবীর রাজ্য দিতে চাই, কিন্তু তুমি তা নেবে না। পাণ্ডবদের জয় হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তুমি ফিরে গিয়ে ভীষ্ম দ্রোণ ও কৃপকে বলো, এই মাস (৪) অতি শুভকাল, এখন পশুখাদ্য ও ইন্ধন সুলভ, শস্য পরিপুষ্ট, বৃক্ষ সকল ফলবান, মক্ষিকা অল্প, পথে কর্ম নেই, জল স্বাদু হয়েছে, শীত বা গ্রীষ্ম অধিক নয়। সাত দিন পরে অমাবস্যা, সেই দিন সংগ্রাম আরম্ভ হ’ক। যুদ্ধের জন্য সমাগত রাজাদের বলো যে তাদের। অভীষ্ট পূর্ণ হবে, দুর্যোধনের অনুগামী রাজা ও রাজপুত্রগণ অস্ত্রাঘাতে নিহত হয়ে উত্তম গতি লাভ করবেন।

কর্ণ বললেন, মহাবাহু, সব জেনেও কেন আমাকে ভোলাতে চাচ্ছ? এই পৃথিবীর ধ্বংস আসন্ন, দুর্যোধন দুঃশাসন শকুনি আর আমি তার নিমিত্তস্বরূপ। আমি দারুণ স্বপ্ন ও দুর্লক্ষণ দেখেছি, তুমি যেন রুধিরাক্ত পৃথিবীকে হাতে ধ’রে নিক্ষেপ করছ, অস্থিস্তুপের উপরে উঠে যুধিষ্ঠির যেন সুবর্ণপাত্রে ঘৃতপায়স ভোজন করছেন এবং তোমার প্রদত্ত পৃথিবী গ্রাস করছেন। কৃষ্ণ বললেন, আমার কথা যখন তোমার হৃদয়ে প্রবেশ করলে না তখন অবশ্যই পৃথিবীর বিনাশ হবে। কর্ণ বললেন, কৃষ্ণ, এই মহাযুদ্ধ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে আমরা কি আবার তোমাকে দেখতে পাব? অথবা স্বর্গেই আমাদের মিলন হবে? এখন আমি যাচ্ছি। এই বলে কর্ণ কৃষ্ণকে গাঢ় আলিঙ্গন করে রথ থেকে নামলেন এবং নিজের রথে উঠে দীনমনে প্রস্থান করলেন। কৃষ্ণ ও সাত্যকি তাদের সারথিকে বললেন, শীঘ্র চল।

**

 (১) কুমারী যাকে বিবাহের পূর্বে প্রসব করে।

(২) গর্ভবতী কুমারী বিবাহের পর যাকে প্রসব করে।

(৩) পঞ্চপাণ্ডবের জন্য নির্ধারিত পঞ্চকালের অতিরিক্ত।

(৪) অগ্রহায়ণ।

২০। কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ

কৃষ্ণ চ’লে গেলে বিদুর কুন্তীকে বললেন, আপনি জানেন, যুদ্ধ নিবারণের জন্য আমি সর্বদা চেষ্টা করেছি, কিন্তু দুর্যোধন আমার কথা শোনে নি। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের বশবর্তী হয়ে অধর্মের পথে চ’লেছেন। কৃষ্ণ অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেলেন, এখন পাণ্ডবগণ যুদ্ধের উদযোগ করবেন। কৌরবদের দুর্নীতির ফলে বীরগণ বিনষ্ট হবেন, এই চিন্তা করে আমি দিবারাত্র বিনিদ্র হয়ে আছি।

কুন্তী দুঃখার্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, যুদ্ধ হলেও দোষ, না হলেও দোষ। দুর্যোধনাদির পক্ষে ভীষ্ম দ্রোণ আর কর্ণ থাকবেন এজন্যই আমার ভয়। হয়তো দ্রোণ তার শিষ্যের সঙ্গে যুদ্ধ কামনা করেন না, পিতামহ ভীষ্ম হয়তো পাণ্ডবগণের প্রতি স্নেহশীল হবেন। অবিবেচক দুর্মতি দুর্যোধনের বশবর্তী হয়ে পাণ্ডবদের বিদ্বেষ। করে, তার জন্যই আমার ভয়। কন্যাকালে যাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি সেই কর্ণ কি আমার হিতকর বাক্য শুনবে না ?

এই চিন্তা করে কুন্তী গঙ্গাতীরে গেলেন। দয়ালু সত্যনিষ্ঠ কর্ণ সেখানে পূর্বমুখ ও ঊধ্ববাহু হয়ে জপ করছিলেন। সূর্যতাপে পীড়িত হয়ে শুষ্ক পদ্মমালার ন্যায় কুন্তী কর্ণের উত্তরীয়বস্ত্রের পশ্চাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কর্ণ মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত জপ করলেন, তার পর পিছনে ফিরে কুন্তীকে দেখতে পেলেন। তিনি সবিস্ময়ে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলিপুটে বললেন, আমি অধিরথ-রাধার পুত্ৰ কৰ্ণ, আপনাকে অভিবাদন করছি, আজ্ঞা করুন আমাকে কি করতে হবে।

কুন্তী বললেন, কর্ণ, তুমি কৌন্তেয়, রাধার গর্ভজাত নও, অধিরথ তোমার পিতা নন, সূতকুলেও তোমার জন্ম হয় নি। বৎস, রাজা কুন্তিভোজের গৃহে আমার কন্যা অবস্থায় তুমি আমার প্রথম পুত্ররূপে জন্মেছিলেন। তুমি পার্থ (১), জগৎপ্রকাশক তপনদেব তোমার জনক। তুমি কবচকুণ্ডল ধারণ করে দেবশিশুর ন্যায় শ্রীমণ্ডিত 
হয়ে 
আমার পিতার গৃহে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলে। পুত্র, তুমি নিজের ভ্রাতাদের না চিনে মোহবশে দুর্যোধনাদির সেবা করেছ, তা উচিত নয়। যে রাজলক্ষ্মী অর্জুন পূর্বে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ভোগ কর। কৌরবগণ আজ দেখুক যে কর্ণার্জুন সৌভ্রাত্ৰ-বন্ধনে মিলিত হয়েছেন। কৃষ্ণ-বলরামের ন্যায় মিলিত হলে তোমাদের অসাধ্য কি থাকতে পারে? তুমি সর্বগুণসম্পন্ন, আমার পুত্রদের সর্বজ্যেষ্ঠ; তুমি পার্থ, তোমাকে যেন কেউ সূতপুত্র না বলে।

তখন কর্ণ তার পিতা ভাস্করের এই স্নেহবাক্য শুনতে পেলেন-তোমার জননী পৃথা সত্য বলেছেন, তার কথা শোন, তোমার মঙ্গল হবে। মাতাপিতার অনুরোধেও কর্ণ বিচলিত হলেন না। তিনি কুন্তীকে বললেন, ক্ষত্রিয়জননী, আপনার বাক্যে আমার শ্রদ্ধা নেই, আপনার অনুরোধও ধর্মসংগত মনে করি না। আপনি আমাকে ত্যাগ করে ঘোর অন্যায় করেছেন, তাতে আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট হয়েছে। জন্মে ক্ষত্রিয় হলেও আপনার জন্য আমি ক্ষত্রিয়োচিত সংস্কার পাইনি, কোন শত্রু এর চেয়ে অধিক অপকার করতে পারে? আপনি যথাকালে আমাকে দয়া করেননি, আজ কেবল নিজের হিতের জন্যই আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন। কৃষ্ণের সহিত মিলিত অর্জুনকে কে না ভয় করে ? এখন যদি আমি পাণ্ডবপক্ষে যাই তবে সকলেই বলবে আমি ভয় পেয়ে এমন করেছি। কেউ জানে না যে আমি পাণ্ডবদের ভ্রাতা। এখন যুদ্ধকালে যদি আমি পাণ্ডবপক্ষে যাই তবে ক্ষত্রিয়রা আমাকে কি বলবেন? ধার্তরাষ্ট্রগণ আমার সর্ব কামনা পূর্ণ করেছেন, আমাকে সম্মানিত করেছেন, এখন আমি কি করে তা নিষ্ফল করতে পারি? যাঁরা আমাকে শ্রদ্ধা করেন, যাঁরা আমার ভরসাতেই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবেন, তাদের মনোরথ আমি কি করে ছিন্ন করব? যে সকল অস্থিরমতি পাপাত্মা রাজার অনুগ্রহে পুষ্ট ও কৃতার্থ হয়ে কার্যকালে কর্তব্য পালন করে না, সেই কৃতঘমদের ইহলোক নেই পরলোকও নেই। আমি সৎপুরুষোচিত অনৃশংসতা ও চরিত্র রক্ষা করে আপনার পুত্রদের সঙ্গে যথাশক্তি যুদ্ধ করব, আপনার বাক্য হিতকর হলেও তা পালন করতে পারি না। কিন্তু আপনার আগমন ব্যর্থ হবে না, সমর্থ হলেও আমি আপনার সকল পুত্রকে বধ করব না। কেবল অর্জুনকে নিহত করে অভীষ্ট ফল লাভ করব, অথবা তার হাতে নিহত হয়ে যশোলাভ করব। যশস্বিনী, যেই মরুক, অর্জুন অথবা আমাকে নিয়ে আপনার পাঁচ পুত্রই থাকবে।

শোকার্তা কুন্তী কম্পিতদেহে পুত্রকে আলিঙ্গন করে বললেন, কর্ণ, তুমি যা বললে তাই হবে, কুরুকুলের ক্ষয় হবে, দৈবই প্রবল। অর্জুন ভিন্ন অন্য চার ভ্রাতাকে তুমি অভয় দিয়েছ এই প্রতিজ্ঞা মনে রেখো। মা কুন্তী শুভাশীর্বাদ করলেন, কর্ণও তাকে অভিবাদন করলেন, তারপর দুজনে দুদিকে চ’লে গেলেন।

**

(১) পৃথা বা কুন্তীর পুত্র।

২১। কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তন

উপপ্লব্য নগরে ফিরে এসে কৃষ্ণ তার দৌত্যের বিবরণ যুধিষ্ঠিরকে জানিয়ে বললেন, আমি দুর্যোধনকে মিষ্টবাক্যে অনুরোধ করেছি, তার পর সভাস্থ রাজাদের ভর্ৎসনা করেছি, দুর্যোধনকে তৃণতুল্য অবজ্ঞা করে কর্ণ ও শকুনিকে ভয় দেখিয়েছি, দূতসভায় ধার্তরাষ্ট্রগণের আচরণের বহু নিন্দা করেছি। অবশেষে দুর্যোধনকে বলেছি, পাণ্ডবগণ অভিমান ত্যাগ করে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুরের আজ্ঞাধীন হয়ে থাকবেন, নিজের রাজ্যাংশ শাসনের ভারও তোমার হাতে দেবেন; ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্ম ও বিদুর তোমাকে যে হিতকর উপদেশ দিয়েছেন তা পালন কর। অন্তত পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রাম দাও, কারণ তাদের ভরণ করা ধৃতরাষ্ট্রের কর্তব্য। তার পর কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আপনাদের জন্য আমি কৌরব সভায় সাম দান ও ভেদ নীতি অনুসারে বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও ফল হয়নি। এখন চতুর্থ নীতি দণ্ড ছাড়া আর কোনও উপায় দেখি না। কৌরবপক্ষের রাজার বোধ হয় এখন বিনাশের নিমিত্ত কুরুক্ষেত্রে। যাত্রা করেছেন। দুর্যোধনাদি বিনা যুদ্ধে আপনাকে রাজ্য দেবেন না।

॥ সৈন্যনির্মাণপর্বাধ্যায়॥

২২। পাণ্ডবযুদ্ধসজ্জা

যুধিষ্ঠির তার ভ্রাতাদের বললেন, তোমরা কেশবের কথা শুনলে, এখন সেনা বিভাগ কর। সাত অক্ষৌহিণী এখানে সমবেত হয়েছে, তাদের নায়ক দ্রুপদ, বিরাট, ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, সাত্যকি, চেকিতান ও ভীমসেন। এঁরা সকলেই যুদ্ধবিশারদ বীর এবং প্রাণ দিতে প্রস্তুত। সহদেব, তোমার মতে যিনি এই সাত জনের নেতা হবার যোগ্য, যিনি সেনাবিভাগ করতে জানেন এবং যুদ্ধে ভীষ্মের প্রতাপ সইতে পারবেন, তার নাম বল।

সহদেব বললেন, মৎস্যরাজ বিরাটই এই কার্যের যোগ্য। ইনি আমাদের সুখে সুখী দুঃখে দুঃখী, বলবান ও অস্ত্রবিশারদ, এঁর সাহায্যেই আমরা রাজ্য উদ্ধার করব। নকুল বললেন, আমাদের শ্বশুর দ্রপদই সেনানায়ক হবার যোগ্য, ইনি বয়সে ও কুলমর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, ভরদ্বাজের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন এবং সর্বদা দ্রোণ ও ভীষ্মের সহিত স্পর্ধা করেন। দ্রোণের বিনাশকামনায় ইনি ভার্যার সহিত ঘোর তপস্যা করেছিলেন (১)। অর্জুন বললেন, যে দিব্য পুরুষ তপস্যার প্রভাবে এবং ঋষিগণের অনুগ্রহে উৎপন্ন হয়েছিলেন, যিনি ধনু ও কবচ ধারণ করে রথারোহণে অগ্নিকুণ্ড থেকে উঠেছিলেন, সেই ধৃষ্টদ্যুম্ন (১) ই সেনাপতিত্বের যোগ্য। ভীম বললেন, সিদ্ধগণ ও মহর্ষিগণ বলেন যে, দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডীই ভীষ্মবধের নিমিত্ত জন্মেছেন, ইনি রামের ন্যায় রূপবান, এমন কেউ নেই যে এঁকে অস্ত্রাহত করতে পারে। এঁকেই সেনাপতি করুন।

যুধিষ্ঠির বললেন, কৃষ্ণই আমাদের জয়পরাজয়ের মূল, আমাদের জীবন রাজ্য সুখদুঃখ সবই এঁর অধীন, ইনিই বলুন কে আমাদের সেনাপতি হবেন। এখন রাত্রি আসন্ন, কাল প্রভাতে আমার অধিবাস (২) ও কৌতুকমঙ্গল (৩) করে যুদ্ধযাত্রা করব।

অর্জুনের দিকে চেয়ে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, যাঁদের নাম করা হল তাঁরা সকলেই নেতৃত্ব করবার যোগ্য। আপনি এখন যথাবিধি সৈন্যযোজনা করুন, আপনার পক্ষে যে বীরগণ আছেন তাদের সম্মুখে দুর্যোধনাদি কখনও দাঁড়াতে পারবেন না। আমি ধৃষ্টদ্যুম্নকেই সেনাপতি মনোনীত করছি। কৃষ্ণের কথায় পাণ্ডবগণ আনন্দিত হলেন।

যুদ্ধসজ্জা আরম্ভ হল , সৈন্যগণ চঞ্চল হয়ে কোলাহল করতে লাগল, হস্তী ও অশ্বের রব, রথচক্রের ঘর্ঘর ও শঙ্খদুন্দুভির নিনাদে সর্ব দিক ব্যাপ্ত হল। সেই বিশাল সৈন্যসমাগম মহাতরঙ্গময় সমুদ্রের ন্যায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। বর্মে ও অস্ত্রে সজ্জিত যোদ্ধারা আনন্দিত হয়ে চলতে লাগলেন, যুধিষ্ঠির তাদের মধ্যভাগে রইলেন, দুর্বল সৈন্য ও পরিচারকগণও তাঁর সঙ্গে চলল। শকট, বিপণি, বেশ্যাদের বস্তুগৃহ, কোষ, যন্ত্ৰায়ুধ ও চিকিৎসকগণ সঙ্গে সঙ্গে গেল। দ্রৌপদী তার দাসদাসী ও অন্যান্য স্ত্রীদের নিয়ে উপপ্লব্য নগরেই রইলেন।

পাণ্ডববাহিনী কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হল। যুধিষ্ঠির শ্মশান, দেবালয়, মহর্ষিদের আশ্রম ও তীর্থস্থান পরিহার করলেন এবং যেখানে প্রচুর ঘাস ও কাঠ পাওয়া যায় এমন এক সমতল স্নিগ্ধ স্থানে সেনা সন্নিবেশ করলেন। পবিত্র হিরন্বতী নদীর নিকটে পরিখা খনন করিয়ে কৃষ্ণ সেখানে রাজাদের শিবির স্থাপন করলেন। শত শত বেতনভোগী শিল্পী এবং চিকিৎসার উপকরণ সহ বৈদ্যগণ শিবিরে রইলেন। প্রতি শিবিরে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, মধু, ঘৃত, সর্জরস (ধুনা), জল, ঘাস, তুষ ও অঙ্গার রাখা হল।

কৌরবসভায় যে কথাবার্তা হয়েছিল তার সম্বন্ধে যুধিষ্ঠির আরও জানতে চাইলে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন আপনার প্রস্তাব এবং ভীষ্ম বিদুর ও আমার কথা সমস্তই অগ্রাহ্য করেছে, কর্ণের ভরসায় সে মনে করে তার জয়লাভ হবেই। সে আমাকে বন্দী করবার আদেশ দিয়েছিল, কিন্তু তার ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। ভীষ্ম-দ্রোণও ন্যায়সংগত কথা বলেন নি, বিদুর ছাড়া সকলেই দুর্যোধনের অনুবর্তী।

যুধিষ্ঠির দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, যে অনর্থ নিবারণের জন্য আমি বনবাস স্বীকার করে বহু দুঃখ পেয়েছি, সেই মহা অনর্থই উপস্থিত হল। যাঁরা অবধ্য তাদের সঙ্গে কি করে যুদ্ধ করব? গুরুজন ও বৃদ্ধদের হত্যা করে আমাদের কিরূপ বিজয়লাভ হবে? অর্জুন বললেন, মহারাজ, কৃষ্ণ কুন্তী ও বিদুর কখনও অধর্ম করতে বলবেন না; যুদ্ধ না করে ফিরে যাওয়া আপনার অকর্তব্য। ঈষৎ হাস্য করে কৃষ্ণ বললেন, ঠিক কথা।

দ্রুপদ বিরাট সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুম্ন ধৃষ্টকেতু শিখণ্ডী ও মগধরাজ সহদেব-এই সাত জনকে যুধিষ্ঠির যথাবিধি অভিষিক্ত করে সেনাপতির পদ দিলেন। তার পর তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নকে সর্বসেনাপতি, অর্জুনকে সেনাপতিপতি, এবং কৃষ্ণকে অর্জুনের নিয়ন্তা ও অশ্বচালক নিযুক্ত করলেন।

**

(১) আদিপর্ব ২৯-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।

(২) অস্ত্রপূজা বা নীরাজন।

(৩) রক্ষাসূত্র-বা রাখি-বন্ধন।

২৩। বলরাম ও রুক্সী

কুরুপাণ্ডবের ঘোর অনিষ্টকর যুদ্ধ আসন্ন হয়েছে এই সংবাদ পেয়ে অশ্রুর উদ্ধব শাম্ব প্রদ্যুম্ন প্রভৃতির সঙ্গে হলায়ুধ বলরাম যুধিষ্ঠিরের ভবনে এলেন। তিনি কৈলাসশিখরের ন্যায় শুভ্রকান্তি, সিংহসখেলগতি (১), তার চক্ষু মদ্যপানে আরক্ত, পরিধান নীল কৌষেয় বসন। তাকে দেখে সকলে সসম্মানে উঠে দাঁড়ালেন এবং যুধিষ্ঠির তার কর গ্রহণ করলেন। অভিবাদনের পর সকলে উপবিষ্ট হলে বলরাম কৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললেন, দৈববশে এই যে দারুণ লোকক্ষয়কর যুদ্ধ আসন্ন হয়েছে তার নিবারণ করা অসাধ্য। আমি এই কামনা করি যে আপনারা সকলে নীরোগে অক্ষতদেহে এই যুদ্ধ থেকে উত্তীর্ণ হবেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির, আমি কৃষ্ণকে বহু বার বলেছি যে আমাদের কাছে পাণ্ডবরা যেমন দুর্যোধনও তেমন, অতএব তুমি দুর্যোধনকেও সাহায্য করো। কিন্তু কৃষ্ণ আমার কথা শোনেননি, অর্জুনের প্রতি স্নেহের বশে আপনার পক্ষেই সর্ব শক্তি নিয়োগ করেছেন, একারণে আপনারা অবশ্যই জয়লাভ করবেন। আমি কৃষ্ণকে ছেড়ে অন্য পক্ষে যেতে পারি না, অতএব কৃষ্ণের অভীষ্ট কার্যই করব। গদাযুদ্ধবিশারদ ভীম ও দুর্যোধন আমার শিষ্য, দুজনের উপরেই আমার সমান স্নেহ। কৌরবদের বিনাশ আমি দেখতে পারব না, সেজন্য সরস্বতী তীর্থে ভ্রমণ করতে যাচ্ছি।

বলরাম চ’লে গেলে ভোজ ও দাক্ষিণাত্য দেশের অধিপতি ভীষ্মকের পুত্র রূক্সী এক অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে উপস্থিত হলেন। ইনি কিন্নরশ্রেষ্ঠ দ্রুমের কাছে ধনুর্বেদ শিখে বিজয় নামক ঐন্দ্রধনু লাভ করেছিলেন। এই ধনু অর্জুনের গাণ্ডীব ও কৃষ্ণের শার্ঙ্গ ধনুর তুল্য। লক্ষ যখন রুক্মিণীহরণ করেন তখন তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে রুক্মী পরাজিত হন।

যুধিষ্ঠির সসম্মানে রক্মীর সংবর্ধনা করলেন। বিশ্রামের পর রক্মী বললেন, অর্জুন, যদি ভয় পেয়ে থাক তবে এই যুদ্ধে আমি তোমার সহায় হব। আমার তুল্য বিক্রম কারও নেই, শত্রুসেনার যে অংশের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে দেবে সেই অংশই আমি.বিনষ্ট করব, দ্রোণ কৃপ ভীষ্ম কর্ণকেও আমি বধ করব। অথবা এই রাজারা সকলেই যুদ্ধে বিরত থাকুন, আমিই শত্ৰুসংহার করে তোমাদের রাজ্য উদ্ধার করে দেব।

অর্জুন রুক্মীকে সহাস্যে বললেন, কুরুকুলে আমার জন্ম, আমি পাণ্ডুর পুত্র, দ্রোণের শিষ্য, বাসুদেব আমার সহায়, আমি গাণ্ডীবধারী, কি করে বলব যে ভয় পেয়েছি? আমি যখন ঘোষযাত্রায় মহাবল গন্ধবদের সঙ্গে, নিবাতকবচ ও কালকেয় দানবদের সঙ্গে, এবং বিরাটরাজ্যে বহু কৌরবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলাম তখন কে আমার সহায় ছিল? আমি রুদ্রইন্দ্র কুবের যম বরুণ অগ্নি কৃপ দ্রোণ ও মাধবের অনুগৃহীত; আমার তেজোময় দিব্য গাণ্ডীব ধনু, অক্ষয় তৃণ ও বিবিধ দিব্যাস্ত্র আছে, ভয় পেয়েছি এই যশোনাশক বাক্য কি করে বলব? মহাবাহু, আমি ভীত হইনি, আমার সহায়েরও প্রয়োজন নেই, তোমার ইচ্ছা হয় এখানে থাক, না হয় ফিরে যাও।

রুক্মী তার সাগরতুল্য বিশাল সেনা নিয়ে দুর্যোধনের কাছে গেলেন এবং অর্জুনকে যেমন বলেছিলেন সেইরূপই বললেন। বীরাভিমানী দুর্যোধনও তাকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এইরূপে রোহিণীনন্দন বলরাম এবং ভীষ্মকপুত্র রুক্মী কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ থেকে দূরে রইলেন।

** (১) ক্রীড়ারত সিংহের ন্যায় যাঁর গতি।

২৪। কৌরবযুদ্ধসজ্জা

কৃষ্ণ হস্তিনাপুর থেকে চ’লে গেলে দুর্যোধন কর্ণ প্রভৃতিকে বললেন, বাসুদেব অকৃতকার্য হয়ে ফিরে গেছেন, তিনি নিশ্চয় ক্রুদ্ধ হয়ে পাণ্ডবগণকে যুদ্ধে উত্তেজিত করবেন। তিনি যুদ্ধই চান, ভীমার্জুনও তাঁর মতে চ’লেন। দ্রুপদ আর বিরাটের সঙ্গেও আমি শত্রুতা করেছি, তারাও কৃষ্ণের অনুবর্তী হবেন। অতএব কুরুপাণ্ডবের মধ্যে তুমুল লোমহর্ষণ যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। তোমরা অতন্দ্রিত হয়ে যুদ্ধের সমস্ত আয়োজন কর। কুরুক্ষেত্রে বহু সমস্র শিবির স্থাপন করাও, সর্বদিকে যেন প্রচুর অবকাশ রাখা হয়। শিবিরমধ্যে জল কাষ্ঠ ও বিবিধ অস্ত্র এবং উপরে ধ্বজপতাকা থাকবে। খাদ্যাদি অনায়নের পথ যেন শত্রুরা রোধ করতে না পারে।

দুর্যোধনের আদেশে কুরুক্ষেত্রে সেনানিবেশ স্থাপিত হল। সমাগত রাজারা উষ্ণীষ অন্তরীয় উত্তরীয় ও ভূষণ প্রভৃতিতে সজ্জিত হলেন। রথী অশ্বারোহী গজারোহী ও পদাতি সৈন্যগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল। রাত্রি প্রভাত হলে দুর্যোধন একাদশ অক্ষৌহিণী সেনা বিভক্ত করলেন। প্রত্যেক রথে চার অশ্ব যোজিত হল এবং দুই অশ্বরক্ষক ও দুই পৃষ্ঠরক্ষক নিযুক্ত হল। প্রত্যেক হস্তীতে দুই অঙ্কুশধারী, দুই ধনুর্ধারী এবং একজন শক্তি-ও পতাকা-ধারী রইল।

দুর্যোধন কৃতাঞ্জলি হয়ে ভীষ্মকে বললেন, সেনাপতি না থাকলে বিশাল সেনাও পিপীলিকাপুঞ্জের ন্যায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শুনেছি একদা ব্রাহ্মণ বৈশ্য ও শূদ্র এই তিন বর্ণের লোক হৈহয় ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যায়, কিন্তু তারা বার বার পরাজিত হয়। তার পর ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়দের জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের পরাজয়ের কারণ কি? ধর্মজ্ঞ ক্ষত্রিয়গণ যথার্থ উত্তর দিলেন-আমরা সকলে একজন মহাবুদ্ধিমানের মতে চলি, আর আপনারা প্রত্যেকে নিজের বুদ্ধিতে পৃথক পৃথক চ’লেন। তখন ব্রাহ্মণরা একজন যুদ্ধনিপুণ ব্রাহ্মণকে সেনাপতি করলেন এবং ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হলেন।

তার পর দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আপনি শুক্রাচার্য তুল্য যুদ্ধনিপুণ, ধর্মে নিরত এবং আমার হিতৈষী, আপনিই আমাদের সেনাপতি হন। গোবৎস যেমন ঋষভের অনুগমন করে আমরা সেইরূপ আপনার অনুগমন করব। ভীষ্ম বললেন, মহাবাহু, আমার কাছে তোমরা যেমন পাণ্ডবরাও তেমন, তথাপি প্রতিজ্ঞা অনুসারে তোমার জন্যই যুদ্ধ করব। অর্জুন ভিন্ন আমার সমান যোদ্ধা কেউ নেই, তাঁর অনেক দিব্যাস্ত্রও আছে; কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করবেন না। পাণ্ডুপুত্রদের বিনষ্ট করা আমারও অকর্তব্য। যত দিন তাদের হাতে আমি না মরি তত দিন আমি প্রত্যহ পাণ্ডবপক্ষের দশ সহস্র যোদ্ধাকে বধ করব। কিন্তু কর্ণ সর্বদাই আমার সঙ্গে স্পর্ধা করেন, অতএব প্রথম সেনাপতি আমি না হয়ে তিনিই হ’তে পারেন। কর্ণ বললেন, ভীষ্ম জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করব না, এঁর মৃত্যুর পর আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব।

দুর্যোধন রাশি রাশি উপহার দিয়ে ভীষ্মকে সেনাপতির পদে যথাবিধি অভিষিক্ত করলেন, শত সহস্র ভেরী ও শঙ্খ বেজে উঠল। এই সময়ে নানাপ্রকার অশুভ লক্ষণ দেখা গেল, বজ্রধ্বনি ভূমিকম্প উল্কাপাত ও রুধিরকর্মবৃষ্টি হল। যোদ্ধারা। নিরুদ্যম হয়ে পড়লেন। তার পর ভীষ্মকে অগ্রবর্তী করে প্রচুর স্কন্ধাবার সহ দুর্যোধন প্রভৃতি কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন।

॥ উলূকদূতাগমনপর্বাধ্যায়॥

২৫। উলূকের দৌত্য

কুরুক্ষেত্রে হিরন্বতী নদীর নিকটে পাণ্ডববাহিনী সন্নিবেশিত হলে কৌরবগণও সেখানে তাদের সেনা স্থাপিত করলেন। কর্ণ দুঃশাসন ও শকুনির সঙ্গে মন্ত্রণা করে দুর্যোধন স্থির করলেন যে শকুনির পুত্র উলূক দূত হয়ে পাণ্ডবদের কাছে যাবেন। তিনি উলূককে এইরূপ উপদেশ দিলেন। –

তুমি যুধিষ্ঠিরকে বলবে, তুমি সর্ব প্রাণীকে অভয় দিয়ে থাক, তবে নৃশংসের ন্যায় জগৎ ধ্বংস করতে চাও কেন? পুরাকালে দেবগণ প্রহ্লাদের রাজ্য হরণ করলে প্রহ্লাদ এই শ্লোকটি গেয়েছিলেন-হে সুরগণ, প্রকাশ্যে ধর্মের ধ্বজা উন্নত রাখা এবং প্রচ্ছন্নভাবে পাপাচরণ করার নাম বৈড়াল ব্রত। উলূক, নারদকথিত এই উপাখ্যানটি তুমি যুধিষ্ঠিরকে শুনিও—এক দুষ্ট বিড়াল গঙ্গাতীরে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যার ভান করত। পক্ষীরা তার কাছে গিয়ে প্রশংসা করতে লাগল, তখন বিড়াল ভাবলে, আমার ব্রত সফল হয়েছে। দীর্ঘকাল পরে এক দল মূষিক স্থির করলে, এই বিড়াল আমাদের মাতুল, ইনি আমাদের সকলকে রক্ষা করবেন। মূষিকদের প্রার্থনা শুনে বিড়াল বললে, তপস্যা এবং তোমাদের রক্ষা এই দুই কর্ম এক কালে করা অসম্ভব, তথাপি তোমাদের যাতে হিত হয় তা করব। কিন্তু আমি তপস্যায় পরিশ্রান্ত হয়ে আছি, কঠিন ব্রত পালন করছি, কোথাও যাবার শক্তি আমার নেই। বৎসগণ, তোমরা আমাকে প্রত্যহ নদীতীরে বহন করে নিয়ে যেয়ো। মূষিকরা সম্মত হল এবং বালক বৃদ্ধ সকলেই বিড়ালের আশ্রয়ে এল। মূষিক ভক্ষণ করে বিড়ালের শরীর ক্রমশ স্থূল চিক্কণ ও বলিষ্ঠ হ’তে লাগল। মূষিকরা ভাবলে, মাতুল নিত্য বৃদ্ধি পাচ্ছেন কিন্তু আমাদের ক্ষয় হচ্ছে কেন? একদিন ডিণ্ডিক নামে এক মূষিক বিড়ালের আচরণ লক্ষ্য করবার জন্য তার সঙ্গে সঙ্গে গেল, বিড়াল তাকে খেয়ে ফেললে। তখন কোলিক নামে এক অতি বৃদ্ধ মূষিক বললে, এঁর শিখাধারণ ছল মাত্র, এঁর বিষ্ঠায় লোম দেখা যায়, কিন্তু ফলমূলভোজীর বিষ্ঠায় তা থাকে না। ইনি স্থূল হচ্ছেন এবং আমাদের দল ক্ষীণ হচ্ছে, সাত আট দিন থেকে ডিণ্ডিককেও দেখছি না। এই কতা শুনে মূষিকরা পালিয়ে গেল, দুষ্ট বিড়ালও তার পূর্ব স্থানে ফিরে গেল। দুরাত্মা যুধিষ্ঠির, তুমিও বৈড়াল ব্রত অবলম্বন করে জ্ঞাতিদের প্রতারিত করছ। তুমি পাঁচটি গ্রাম চেয়েছিলে, আমি তা দিইনি, কারণ আমার এই ইচ্ছা যে তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ কর। তুমি কৃষ্ণকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিলে যে তুমি শান্তি ও সমর দুইএর জন্যই প্রস্তুত আছ। আমি যুদ্ধের আয়োজন করেছি, এখন তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন কর।

উলূক, তুমি কৃষ্ণকে বলবে, কৌরবসভায় যে মায়ারূপ দেখিয়েছিলে সেই রূপ ধারণ করে আমার প্রতি ধাবিত হও ইন্দ্রজাল মায়া কুহ’ক বা বিভীষিকা দেখলে অস্ত্রধারী বীর ভয় পায় না, সিংহনাদ করে। আমরাও বহুপ্রকার মায়া দেখাতে পারি, কিন্তু তেমন উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাই না। কৃষ্ণ, তুমি অকস্মাৎ যশস্বী হয়ে উঠেছ, কিন্তু আমরা জানি পুংশ্চিহ্নধারী নপুংসক অনেক আছে। তুমি কংসের ভৃত্য ছিলে সেজন্য আমার তুল্য কোনও রাজা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করেননি।

উলূক, তুমি সেই শৃঙ্গহীন বৃষ বহুভোজী মূর্খ ভীমকে বলবে, বিরাটনগরে তুমি বল্লভ নামে পাচক হয়ে ছিলে, তা আমারই পৌরুষের ফল। দূতসভায় যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে তা যেন মিথ্যা না হয়, যদি শক্তি থাকে তবে দুঃশাসনের রক্ত পান কর। নকুল-সহদেবকে বলবে, দ্রৌপদীর কষ্ট স্মরণ করে এখন যুদ্ধে তোমাদের পৌরুষ দেখাও। বিরাট আর দ্রুপদকে বলবে, প্রভু ও ভৃত্য পরস্পরের গুণাগুণ বিচার করে না, তাই গৌরবহীন যুধিষ্ঠির আপনাদের প্রভু হয়েছে। ধৃষ্টদ্যুম্নকে বলবে, তুমি দ্রোণের সঙ্গে পাপযুদ্ধ করবে এস। শিখণ্ডীকে বলবে, তুমি নির্ভয়ে যুদ্ধ করতে এস, ভীষ্ম তোমাকে স্ত্রী মনে করেন, তোমাকে বধ করবেন না।

উলূক, তুমি অর্জুনকে বলবে, রাজ্য থেকে নির্বাসন, বনবাস, এবং দ্রৌপদীর ক্লেশ স্মরণ করে এখন পুরুষত্ব দেখাও। লৌহময় অস্ত্রমূহের সংস্কার হয়েছে, কুরুক্ষেত্রে কর্ম নেই, অশ্বসকল খাদ্য পেয়ে পুষ্ট হয়ে আছে, যোদ্ধারাও বেতন পেয়েছে, অতএব কেশবের সঙ্গে এসে কালই যুদ্ধ কর। তুমি কূপমণ্ডুক তাই দুর্ধর্ষ বিশাল কৌরবসেনার স্বরূপ বুঝতে পারছ না। বাসুদেব তোমার সহায় তা জানি, তোমার গাণ্ডীব চার হাত দীর্ঘ তাও জানি, তোমার তুল্য যোদ্ধা নেই তাও জানি; তথাপি তোমাদের রাজ্য হরণ করে তের বৎসর ভোগ করেছি। দূতসভায় তোমার গাণ্ডীব কোথায় ছিল? ভীমের বল কোথায় ছিল? তোমরা আমাদের দাস হয়েছিলে, দ্রৌপদীই তোমাদের মুক্ত করেন। তুমি নপুংসক সেজে বেণী দুলিয়ে বিরাটকন্যাকে নৃত্য শেখাতে। এখন কৃষ্ণের সঙ্গে এসে যুদ্ধ কর, আমি তোমাদের ভয় করি না। সহস্র সহস্র বাসুদেব এবং শত শত অর্জুনও আমার অব্যর্থ বাণের প্রহারে দশ দিকে পলায়ন করবে।

উলূক, পাণ্ডবশিবিরে গিয়ে দুর্যোধনের সকল কথা জানালেন। ভীমকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ দেখে কৃষ্ণ সহাস্যে বললেন, শকুনিনন্দন, শীঘ্র ফিরে যাও, দুর্যোধনকে জানিও যে তার সব কথা আমরা শুনেছি, অর্থও বুঝেছি, তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই হবে। ভীম বললেন, মূর্খ, তুমি দুর্যোধনকে বলবে, আমি দুঃশাসনের রক্তপান করে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব। আর উলূক, তোমার পিতার সমক্ষে আগে তোমাকে বধ করব তার পর সেই পাপিষ্ঠকে বধ করব।

অর্জুন সহাস্যে বললেন, ভীমসেন, যাদের সঙ্গে আপনার শত্রুতা তারা এখানে নেই, উলূককে নিষ্ঠুর কথা বলা আপনার উচিত নয়। উলূক, দুর্যোধন যে গর্বিত বাক্য বলেছেন, কাল সৈন্যদের সম্মুখে গাণ্ডীব দ্বারা আমি তার প্রত্যুত্তর দেব। যুধিষ্ঠির বললেন, বৎস শকুনিপুত্র উলূক, তুমি দুর্যোধনকে বলবে, যে লোক পরস্ব হরণ করে এবং নিজের শক্তিতে তা রাখতে না পেরে অপরের সাহায্য নেয়, সে নপুংসক। দুর্যোধন, তুমি পরের বলে নিজেকে প্রবল মনে করে গর্জন করছ কেন? অর্জুন বললেন, উলূক, দুর্যোধনকে বলবে, তুমি মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্মকে যুদ্ধে নামিয়ে মনে করছ আমরা দয়াবশে তাঁকে মারব না। যার ভরসায় তুমি গর্ব করছ সেই ভীষ্মকে আমি প্রথমে বধ করব। বৃদ্ধ বিরাট ও দ্রুপদ বললেন, আমরা সাধুজনের দাসত্ব কামনা করি। আমরা দাস হই বা যাই হই, কার কত পৌরুষ আছে কাল দেখা যাবে। শিখণ্ডী বললেন, বিধাতা ভীষ্মবধের নিমিত্তই আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি তাকে রথ থেকে নিপাতিত করব। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি দ্রোণকে সসৈন্যে সবান্ধবে বধ। করব, আমি যা করব তা আর কেউ পারবে না।

উলূক কৌরবশিবিরে ফিরে গিয়ে সব কথা জানালেন।

॥ রথতিরথসংখ্যানপর্বাধ্যায়॥

২৬। রথী-মহারথ-অতিরথ-গণনা-ভীষ্ম-কর্ণের বিবাদ

সেনাপতির পদে নিযুক্ত হয়ে ভীষ্ম দুর্যোধনকে বললেন, শক্তিধর কুমার কার্তিকেয়কে নমস্কার করে আমি সেনাপতিত্বের ভার নিলাম। তুমি দুশ্চিন্তা দূর কর, আমি শাস্ত্রানুসারে যথাবিধি যুদ্ধ এবং তোমার সৈন্যরক্ষা করব।

দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আপনি গণনায় দক্ষ, উভয় পক্ষে রথী (১) ও অতিরথ (১) কে কে আছেন আমরা শুনতে ইচ্ছা করি।

ভীষ্ম বললেন, তুমি ও তোমার ভ্রাতারা সকলেই শ্রেষ্ঠ রথী। ভোজবংশীয় কৃতবর্মা, মদ্ররাজ শল্য যিনি নিজের ভাগিনেয়দের ছেড়ে তোমার পক্ষে এসেছেন, সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা—এঁরা অতিরথ। সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ দুই রথীর সমকক্ষ। কম্বােজরাজ সুদক্ষিণ, মাহিষ্মতীর রাজা নীল, অবন্তিদেশের বিন্দ ও অনুবিন্দ, ত্রিগর্তদেশীয় সত্যরথ প্রভৃতি পঞ্চ ভ্রাতা, তোমার পুত্র লক্ষ্মণ, দুঃশাসনের পুত্র, কৌশলরাজ বৃহদ্বল, তোমার মাতুল শকুনি, রাজা পৌরব, কর্ণপুত্র বৃষসেন, মধুবংশীয় জলসন্ধ, গান্ধারবাসী অচল ও বৃষক—এঁরা রথী। কৃপাচার্য অতিরথ। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা মহারথ (১), কিন্তু একটি মহাদোষের জন্য আমি তাকে রথী বা অতিরথ মনে করতে পারি না,-ইনি নিজের জীবন অত্যন্ত প্রিয় জ্ঞান করেন, নতুবা ইনি অদ্বিতীয় বীর হ’তেন। দ্রোণাচার্য একজন শ্রেষ্ঠ অতিরথ, ইনি দেব গন্ধর্ব মনুষ্য সকলকেই বিনষ্ট করতে পারেন, কিন্তু স্নেহবশে অর্জুনকে বধ করবেন না। বাহ্নীক অতিরথ। তোমার সেনাপতি সত্যবান, মহাবল মায়াবী রাক্ষস অলম্বুষ, প্রাগজ্যোতিষরাজ ভঘদত্ত-এঁরা মহারথ। তোমার প্রিয় সখা ও মন্ত্রণাদাতা নীচপ্রকৃতি অত্যন্ত গর্বিত এই কর্ণ অতিরথ নয়, পূর্ণরথীও নয়। এ সর্বদাই পরনিন্দা করে, এর সহজাত কবচকুণ্ডল এখন নেই, পরশুরামের শাপে এর শক্তিরও ক্ষয় হয়েছে। আমার মতে কর্ণ অর্ধরথ, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করলে জীবিত অবস্থায় ফিরবে না।

দ্রোণ বললেন, ভীষ্মের কথা সত্য, কর্ণের অভিমান আছে, অথচ এঁকে যুদ্ধ থেকে পালাতেও দেখা যায়। কর্ণ দয়ালু ও অসাবধান, সেজন্য আমিও এঁকে অর্ধরথ মনে করি।

ক্রোধে চক্ষু বিস্ফারিত করে কর্ণ বললেন, পিতামহ, আপনি বিনা অপরাধে আমাকে বাক্যবাণে পীড়িত করেন, দুর্যোধনের জন্যই আমি তা সহ্য করি। আমার মতে আপনিই অর্ধরথ। লোকে আবার বলে ভীষ্ম মিথ্যা কথা বলেন না! আপনি ইচ্ছামত রথী আর অতিরথ বলে যোদ্ধাদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করছেন। ভীষ্ম সর্বদাই কৌরবগণের অহিতাচরণ করেন, কিন্তু আমাদের রাজা তা বোঝেন না। ভীষ্মের অভিসন্ধি ভাল নয়, তুমি এঁকে ত্যাগ কর। ইনি সকলের সঙ্গেই স্পর্ধা করেন, কাকেও পুরুষ বলে গণ্য করেন না, অথচ এঁকে দেখলে সব পণ্ড হয়। (২) বৃদ্ধের বচন শোনা উচিত, কিন্তু অতিবৃদ্ধের নয়, তারা বালকের সমান। ভীষ্ম জীবিত থাকতে আমি যুদ্ধ করব না, এঁর মৃত্যুর পর আমি বিপক্ষের সকল মহারথের সঙ্গেই যুদ্ধ করব।

ভীষ্ম বললেন, সূতপুত্র, যুদ্ধ আসন্ন, এ সময়ে আমাদের মধ্যে ভেদ হওয়া অনুচিত, সেই কারণেই তুমি জীবিত রইলে। স্বয়ং জামদগ্ন্য পরশুরাম আমাকে অস্ত্রাঘাতে পীড়িত করতে পারেননি, তুমি আমার কি করবে?

দুর্যোধন বললেন, পিতামহ, আমার কিসে শুভ হবে সেই চিন্তা করুন, আপনাদের দুজনকেই মহৎ কর্ম করতে হবে। এখন বলুন পাণ্ডবপক্ষে রথী মহারথ ও অতিরথ কে কে আছেন।।

ভীষ্ম বললেন, যুধিষ্ঠির নকুল সহদেব প্রত্যেকেই রথী। ভীম আট রথীর সমান। স্বংয় নারায়ণ যাঁর সহায় সেই অর্জুনের সমান বীর ও রথী উভয় সৈন্যের মধ্যে নেই, কেবল আমি আর দ্রোণাচার্য তার সম্মুখীন হ’তে পারি। দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র সকলেই মহারথ। বিরাট পুত্র উত্তর, উত্তমৌজা, যুধামন্যু এবং দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী—এঁরা উত্তম রথী। অভিমন্যু, সাত্যকি ও দ্রোণশিষ্য ধৃষ্টদ্যুম্ন—এঁরা অতিরথ। বৃদ্ধ হলেও দ্রুপদ ও বিরাটকে আমি মহারথ মনে করি। ধৃষ্টদ্যুম্নের পুত্র ক্ষত্ৰধর্মা এখনও বালক সেজন্য অর্ধরথ। শিশুপালপুত্র ধৃষ্টকেতু, জয়ন্ত অমিতৌজা, সত্যজিৎ, অজ, ভোজ ও রোমান-এঁরা মহারথ। কেকয়দেশীয় পঞ্চ ভ্রাতা, কাশীরাজ কুমার, নীল, সূর্যদত্ত, শঙ্খ, মদিরা, ব্যাঘ্ৰসেন, চন্দ্রদত্ত, সেনাবিন্দু, ক্রোধহন্তা, কাশ্য—এঁরা সকলেই রথী। দ্রুপদপুত্র সত্যজিৎ, শ্রেণিমান ও বসুদান রাজা, কুন্তিভোজদেশীয় পাণ্ডবমাতুল পুরুজিৎ, এবং ভীম-হিড়িম্বার পুত্র মায়াবী ঘটোৎকচ—এঁরা সকলেই অতিরথ।

তার পর ভীষ্ম বললেন, আমি তোমার জন্য যথাসাধ্য যুদ্ধ করব, কিন্তু শিখণ্ডী শরক্ষেপে উদ্যত হলেও তাকে বধ করব না, কারণ সে পূর্বে স্ত্রী ছিল, পরে পুরুষ হয়েছে। পাণ্ডবগণকেও আমি বধ করব না।

**

(১) রথী-রথারোহী পরাক্রান্ত খ্যাতনামা যোদ্ধা। মহারথরথযুথপতি বা বহু রথীর অধিনায়ক। অতিরথ—যিনি অমিত যোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধ করেন, অথবা যিনি মহারথগণের অধিপতি।                                              (
২) ভীষ্ম নিঃসন্তান এই কারণে

॥ অম্বোপাখ্যানপর্বাধ্যায়॥

২৭। অম্বা-শিখণ্ডীর ইতিহাস

দুর্যোধন প্রশ্ন করলেন, পিতামহ, আপনি পূর্বে বলেছিলেন যে পাঞ্চাল ও সোমকদের বধ করবেন, তবে শিখণ্ডীকে ছেড়ে দেবেন কেন? ভীষ্ম বললেন, তাকে কেন বধ করব না তার ইতিহাস বলছি শোন।–

আমার ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ বিচিত্রবীর্যকে আমি রাজপদে অভিষিক্ত করি এবং তার বিবাহের জন্য কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ংবর সভা থেকে সবলে হরণ করে আনি। (১) বিবাহকালে জ্যেষ্ঠকন্যা অম্বা লজ্জিতভাবে আমাকে জানালেন যে তার পিতা কাশীরাজের অজ্ঞাতসারে তিনি ও শাল্বরাজ পরস্পরকে বরণ করেছেন। তখন আমি কয়েকজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ও একজন ধাত্রীর সঙ্গে অম্বাকে শাল্বের কাছে পাঠিয়ে দিলাম এবং তাঁর দুই ভগিনী অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিবাহ দিলাম। অম্বাকে দেখে শাম্ব বললেন, আমি তোমাকে ভার্যা করতে পারি না, তুমি অন্যপূর্বা, ভীষ্ম তোমাকে হরণ করেছিলেন, তাঁর স্পর্শে তুমি প্রীত হয়েছিলে, অতএব তাঁর কাছেই যাও। অম্বা বহু অনুনয় করলেও শাল্ব শুনলেন না। সেখান থেকে চ’লে এসে অম্বা এই বলে বিলাপ করতে লাগলেন-ভীষ্মকে ধিক, আমার মূঢ় পিতাকে ধিক যিনি পণ্যস্ত্রীর ন্যায় আমাকে বীর্যশুল্কে দান করতে চেয়েছিলেন, শাল্বরাজকে ধিক, বিধাতাকেও ধিক। ভীষ্মই আমার বিপদের মুখ্য কারণ, তাঁর উপর আমি প্রতিশোধ নেব। অম্বা নগরের বাইরে তপস্বীদের আশ্রমে উপস্থিত হলেন এবং নিজের ইতিহাস জানিয়ে বললেন, আমি এখানে তপস্যা করতে ইচ্ছা করি। তপস্বীরা বললেন, তুমি তোমার পিতার গৃহে ফিরে যাও। অম্বা তাতে সম্মত হলেন না।

এই সময়ে অম্বার মাতামহ রাজর্ষি হোত্ৰবাহন সেই তপোবনে উপস্থিত হলেন। সমস্ত ঘটনা শুনে তিনি অম্বাকে বললেন, তুমি আমার কাছে থাক, তোমার অনুরোধে জামদগ্ন্য পরশুরাম ভীষ্মকে বধ করবেন, তিনি আমার সখা। এমন সময়ে পরশুরামের প্রিয় অনুচর অকৃতব্রণ সেখানে এলেন। সব কথা শুনে তিনি অম্বাকে বললেন, তুমি কিরূপ প্রতিকার চাও? যদি ইচ্ছা কর, তবে পরশুরামের আদেশে শাল্বরাজ তোমাকে বিবাহ করবেন; অথবা যদি ভীষ্মকে নিৰ্জিত দেখতে চাও তবে পরশুরাম তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করবেন। অম্বা বললেন, ভগবান, শাল্বের প্রতি আমার অনুরাগ জেনেই ভীষ্ম আমাকে হরণ করেছিলেন, এই বিবেচনা করে আপনিই ন্যায় অনুসারে বিধান দিন। অকৃতব্রণ বললেন, ভীষ্ম যদি তোমাকে হস্তিনাপুরে না নিয়ে যেতেন তবে পরশুরামের আজ্ঞায় শাল্ব তোমাকে মাথায় তুলে নিতেন; অতএব ভীষ্মেরই শাস্তি হওয়া উচিত।

পরদিন অগ্নিতুল্য তেজস্বী পরশুরাম শিষ্যগণে পরিবেষ্টিত হয়ে আশ্রমে উপস্থিত। হলেন। রূপবতী সুকুমারী অম্বার কথা শুনে পরশুরাম দয়ার্দ্র হয়ে বললেন, ভাবিনী, আমি ভীষ্মকে সংবাদ পাঠাব, তিনি আমার কথা রাখবেন (২); যদি অন্যথা করেন তবে তাকে আর তাঁর অমাত্যগণকে যুদ্ধে বিনষ্ট করব। আর তা যদি না চাও তবে আমি শাল্বকেই আজ্ঞা করব। অম্বা বললেন, ভৃগুনন্দন, শাল্বের প্রতি আমার অনুরাগ জেনেই ভীষ্ম আমাকে মুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু শাল্ব আমার চরিত্রদোষের আশঙ্কায় আমাকে নেন নি। আপনি বিচার করে দেখুন কি করা উচিত। আমার মনে হয় ভীষ্মই আমার বিপদের মূল, তাঁকেই আপনি বধ করুন। পরশুরাম সম্মত হলে এবং অম্বা ও ঋষিগণের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রে সরস্বতী নদীর তীরে এলেন।

তারপর ভীষ্ম বললেন, তৃতীয় দিনে পরশুরাম দূত পাঠিয়ে আমাকে আহ্বান করলেন। আমি ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতগণের সঙ্গে সত্বর তার কাছে গেলাম এবং এক ধেনু উপহার দিলাম। তিনি পূজা গ্রহণ করে বললেন, ভীষ্ম, তুমি অম্বাকে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে এসে আবার কেন তাকে পরিত্যাগ করলে? তোমার স্পর্শের জন্যই শাল্ব তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, অতএব আমার আদেশে তুমি এঁকে গ্রহণ কর। আমি পরশুরামকে বললাম, ভগবান, আমার ভ্রাতা বিচিত্রবীর্ষের সঙ্গে এঁর বিবাহ দিতে পারি না, কারণ পূর্বেই শাল্বের প্রতি এঁর অনুরাগ হয়েছিল এবং আমি মুক্তি দিলে ইনি শাল্বের কাছেই গিয়েছিলেন। ভৃগুনন্দন, আপনি আমাকে বাল্যকালে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন, আমি আপনার শিষ্য, তবে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চান কেন? পরশুরাম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তুমি আমাকে গুরু বলে মানছ অথচ আমার প্রিয়কার্য করছ না। তুমিই এঁকে গ্রহণ করে বংশরক্ষা কর। 

তাঁর আজ্ঞাপালনে আমাকে অসম্মত দেখে পরশুরাম বললেন, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করবে এস, আমার বাণে তুমি নিহত হবে, গৃধ্র কঙ্ক ও কাক তোমাকে ভক্ষণ করবে, তোমার মাতা জাহ্নবী তা দেখবেন। তার পর কুরুক্ষেত্রে পরশুরামের সঙ্গে আমার ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হল , ঋষি ও দেবতারা সেই আশ্চর্য যুদ্ধ দেখতে এলেন। আমার জননী গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে আমাকে ও পরশুরামকে নিরস্ত করতে এলেন, কিন্তু তার অনুরোধ বিফল হল। আমি পরশুরামকে বললাম, ভগবান, আপনি ভূমিতে আছেন, আমি রথে চড়ে আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি না। আপনি কবচ ধারণ করে রথারোহী হয়ে যুদ্ধ করুন। পরশুরাম সহাস্যে বললেন, মেদিনী আমার রথ, বেদ সকল আমার বাহন, বায়ু আমার সারথি, বেদমাতারা আমার কবচ। এই বলে তিনি বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। তখন আমি দেখলাম, নগরের ন্যায় বিশাল দিব্যাশ্বযুক্ত বিচিত্র রথে তিনি আরূঢ় রয়েছেন, তার অঙ্গে চন্দ্রসূর্যচিহ্নিত কবচ, অকৃতব্রণ তাঁর সারথি।

বহুদিন ধরে পরশুরামের সঙ্গে আমার যুদ্ধ হল। তিনি আমার সারথিকে বধ করলেন, আমাকেও শরাঘাতে ভূপতিত করলেন। তখন আমি দেখলাম, সূর্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী আট জন ব্রাহ্মণ আমাকে বাহুদ্বারা বেষ্টন করে আছেন, আমার জননী গঙ্গা রথে রয়েছেন। আমি তার চরণ ধরে এবং পিতগণকে নমস্কার করে আমার রথে উঠলাম। গঙ্গা অন্তর্হিত হলেন। আমি এক হৃদয়বিদারক বাণ নিক্ষেপ করলাম, পরশুরাম মূৰ্ছিত হয়ে জানুতে ভর দিয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি প্রকৃতিস্থ হয়ে আমাকে মারবার জন্য তার চতুর্হস্ত ধনুতে শরযোজন করলেন, কিন্তু মহর্ষিগণ তাঁকে নিবারণ করলেন।
রাত্রিকালে আমি স্বপ্ন দেখলাম, পূর্বদৃষ্ট আট জন ব্রাহ্মণ আমাকে বলছেন, গঙ্গানন্দন, পরশুরাম তোমাকে জয় করতে পারবেন না, তুমিই জয়ী হবে। তুমি প্রস্বাপন অস্ত্র প্রয়োগ কর, তাতে পরশুরাম নিহত হবেন না, কিন্তু নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পরাস্ত হবেন। পরদিন কিছু কাল প্রচণ্ড যুদ্ধের পর আমি প্রস্বাপন অস্ত্র নিক্ষেপের উদ্যোগ করলাম। তখন আকাশ থেকে নারদ আমাকে বললেন, তুমি এই অস্ত্র প্রয়োগ করো না, দেবগণ বারণ করছেন; পরশুরাম তপস্বী ব্রাহ্মণ এবং তোমার গুরু। এমন সময়ে পরশুরামের পিতৃগণ আবির্ভূত হয়ে তাঁকে বললেন, বৎস, ভীষ্মের সঙ্গে আর যুদ্ধ করো না, ইনি মহাযশা বসু, এঁকে তুমি জয় করতে পারবে না। তার পর নারদাদি মুনিগণ এবং আমার মাতা ভাগীরথী যুদ্ধস্থানে এলেন। মুনিগণ বললেন, ভার্গব, ব্রাহ্মণের হৃদয় নবনীতের ন্যায়, তুমি যুদ্ধে নিরস্ত হও, তোমরা পরস্পরের অবধ্য। উদিত গ্রহের ন্যায় দীপ্যমান আট জন ব্রাহ্মণ আবার আবির্ভূত হ’য়ে আমাকে বললেন, মহাবাহু, তুমি তোমার গুরুর কাছে যাও, জগতের মঙ্গল কর। আমি পরশুরামকে প্রণাম করলাম। তিনি সস্নেহে বললেন, ভীষ্ম, তোমার সমান ক্ষত্রিয় বীর পৃথিবীতে নেই, আমি তুষ্ট হয়েছি, এখন যাও।

পরশুরাম অম্বাকে ডেকে বললেন, ভাবিনী, আমি সর্ব শক্তি প্রয়োগ করেও ভীষ্মকে জয় করতে পারি নি, এখন তুমি তার শরণ নাও, তোমার অন্য উপায় নেই। অম্বা বললেন, ভগবান, আপনি যথাসাধ্য করেছেন, অস্ত্রদ্বারা ভীষ্মকে জয় করা অসম্ভব। আমি স্বয়ং তাকে যুদ্ধে নিপাতিত করব।

পরশুরাম মহেন্দ্র পর্বতে চ’লে গেলেন। অম্বা যমুনাতীরের আশ্রমে কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন। তারপর তিনি দুঃসাধ্য ব্রত গ্রহণ করে নানা তীর্থে অবগাহন করতে লাগলেন। বৃদ্ধ তপস্বীরা তাকে নিরস্ত করতে গেলে অম্বা বললেন, আমি ভীষ্মের বধের নিমিত্ত তপস্যা করছি, স্বর্গকামনায় নয়। তার জন্য আমি পতিলাভে বঞ্চিত হয়েছি, আমি যেন স্ত্রীও নই পুরুষও নই। আমার স্ত্রীত্ব ব্যর্থ হয়েছে সেজন্য পুরুষত্বলাভের জন্য দৃঢ় সংকল্প করেছি, আপনারা আমাকে বারণ করবেন না।

শূলপাণি মহাদেব অম্বাকে বর দিতে এলেন। অম্বা বললেন, আমি যেন ভীষ্মকে বধ করতে পারি। মহাদেব বললেন, তুমি অন্য দেহে পুরুষত্ব পেয়ে ভীষ্মকে বধ করবে, বর্তমান দেহের সব ঘটনাও তোমার মনে থাকবে। তুম দ্রুপদের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করবে এবং কিছু কাল পরে পুরুষ হবে। মহাদেব অন্তর্হিত হলেন, অম্বা নবজন্মকামনায় চিতারোহণে দেহত্যাগ করলেন।

সেই সময়ে দ্রুপদ রাজা অপত্যকামনায় মহাদেবের আরাধনা করছিলেন। মহাদেব বর দিলেন, তোমার একটি স্ত্রীপুরুষ সন্তান হবে। যথাকালে দ্রুপদমহিষী একটি পরমরূপবতী কন্যা প্রসব করলেন, কিন্তু তিনি প্রচার করলেন যে তার পুত্র হয়েছে। এই কন্যাকে দ্রুপদ পুত্রের ন্যায় পালন করতে লাগলেন এবং নাম দিলেন-শিখণ্ডী। গুপ্তচরের সংবাদে, নারদ ও মহাদেবের বাক্যে, এবং অম্বার তপস্যার বিষয় জ্ঞাত থাকায় আমি বুঝেছিলাম যে শিখণ্ডীই অম্বা।

কন্যার যৌবনকাল উপস্থিত হলে দ্রুপদকে তাঁর মহিষী বললেন, মহাদেবের বাক্য মিথ্যা হবে না, শিখণ্ডী পুরুষ হবেই, অতএব কোনও কন্যার সঙ্গে এর বিবাহ দাও। দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে শিখণ্ডীর বিবাহ হল। কিছু কাল পরে এই কন্যা কয়েক জন দাসীকে তার পিতার কাছে পাঠিয়ে জানালেন যে দ্রুপদকন্যা শিখণ্ডিনীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছে। হিরণ্যবর্মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দূত দ্বারা দ্রুপদকে বলে পাঠালেন, দুর্মতি, তুমি আমাকে প্রতারিত করেছ, আমি শীঘ্রই তোমাকে অমাত্যপরিজন সহ বিনষ্ট করব।

দ্রুপদ ভীত হয়ে তার মহিষীর সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। মহিষী বললেন, মহারাজ, আমার পুত্র হয়নি, সপত্নীদের ভয়ে আমি শিখণ্ডিনীকে পুরুষ বলে প্রচার করেছি, মহাদেবও বলেছিলেন যে আমাদের সন্তান প্রথমে স্ত্রী তার পর পুরুষ হবে। তুমি এখন মন্ত্রীদের পরামর্শ নিয়ে রাজধানী সুরক্ষিত কর এবং প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে দেবপূজা ও হোম কর। পিতামাতার এই কথা শুনে শিখণ্ডিনী ভাবলেন, আমার জন্য এঁরা দুঃখ পাচ্ছেন, আমার মরাই ভাল।

শিখণ্ডিনী গৃহ ত্যাগ করে গহন বনে এলেন। সেই বনে স্থূণাকর্ণ নামে এক যজ্ঞের ভবন ছিল। শিখণ্ডিনী তাতে প্রবেশ করে বহু দিন অনাহারে থেকে শরীর শুষ্ক করলেন। একদিন যক্ষ দয়ার্দ্র হয়ে দর্শন দিয়ে শিখণ্ডিনীকে বললেন, তোমার অভীষ্ট কি তা বল, আমি পূর্ণ করব। আমি কুবেরের অনুচর, অদেয় বস্তুও দিতে পারি। শিখণ্ডিনী তার ইতিহাস জানিয়ে বললেন, যক্ষ, আমাকে পুরুষ করে দিন। যক্ষ বললেন, রাজকন্যা, আমার পুরুষত্ব কিছুকালের জন্য তোমাকে দেব, তাতে তুমি তোমার পিতার রাজধানী ও বন্ধুগণকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু তুমি আবার এসে আমার পুরুষত্ব ফিরিয়ে দিও। দ্রুপদকন্যা সম্মত হয়ে যক্ষের সঙ্গে লিঙ্গবিনিময় করলেন। স্থণাকর্ণ স্ত্রীরূপ পেলেন, শিখণ্ডী পুরুষ হয়ে পিতার কাছে গেলেন।

দ্রুপদ আনন্দিত হয়ে দশার্ণরাজকে বলে পাঠালেন, বিশ্বাস করুন, আমার পুত্র পুরুষই। আপনি পরীক্ষা করুন, লোকে আপনাকে মিথ্যা কথা বলেছে। রাজা হিরণ্যবর্মা কয়েকজন চতুরা সুন্দরী যুবতীকে পাঠালেন। তারা শিখণ্ডীকে পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেল। তাদের কাছে সংবাদ পেয়ে দশার্ণরাজ আনন্দিত হয়ে বৈবাহিক দ্রুপদের ভবনে এলেন এবং কয়েকদিন থেকে কন্যাকে ভৎর্সনা করে চ’লে গেলেন।

কিছু কাল পরে কুবের স্থূণাকর্ণের ভবনে এলেন। তিনি তার অনুচরগণকে বললেন, এই ভবন উত্তমরূপে সজ্জিত দেখছি, কিন্তু মন্দবুদ্ধি স্থূণাকর্ণ আমার কাছে। আসছে না কেন? যক্ষরা বললে, মহারাজ, দ্রুপদের শিখণ্ডিনী নামে একটি কন্যা আছেন, কোনও কারণে স্থূণাকর্ণ তাকে নিজের পুরুষলক্ষণ দিয়ে তাঁর স্ত্রীলক্ষণ নিয়েছেন। তিনি এখন স্ত্রী হয়ে গৃহমধ্যে রয়েছেন, লজ্জায় আপনার কাছে আসতে পারছেন না। কুবেরের আজ্ঞায় তার অনুচরগণ স্থূণাকর্ণকে নিয়ে এল। কুবের ক্রুদ্ধ। হয়ে শাপ দিলেন, পাপবুদ্ধি, তুমি যক্ষগণের অপমান করেছ, অতএব স্ত্রী হয়েই থাক, আর দ্রুপদকন্যা পুরুষ হয়ে থাকুক। শিখণ্ডীর মৃত্যুর পর তুমি পূর্বরূপে ফিরে পাবে। এই বলে কুবের সদলে চ’লে গেলেন।

পূর্বের প্রতিজ্ঞা অনুসারে শিখণ্ডী এসে স্থূণাকর্ণাকে বললেন, আমি ফিরে এসেছি। স্থুণাকর্ণ বহু বার বললেন, আমি প্রীত হয়েছি। তার পর তিনি কুবেরের শাপের কথা জানিয়ে বললেন, রাজপুত্র, এখন তুমি যেখানে ইচ্ছা বিচরণ কর, দৈবকে অতিক্রম করা আমাদের সাধ্য নয়। শিখণ্ডী আনন্দিত হয়ে রাজভবনে ফিরে গেলেন। দ্রুপদ রাজা তাঁকে দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষার জন্য পাঠালেন। কালক্রমে ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে শিখণ্ডীও চতুষ্পদ ধনুর্বেদ শিক্ষা করলেন।

অম্বার ইতিহাস শেষ করে ভীষ্ম বললেন, দুর্যোধন, আমি গুপ্তচরদের জড় অন্ধ ও বধির সাজিয়ে দ্রুপদের কাছে পাঠাতাম, তারাই আমাকে সকল বৃত্তান্ত জানিয়েছিল। শিখণ্ডী স্ত্রী ছিল, পরে পুরুষত্ব পেয়ে রথিশ্রেষ্ঠ হয়েছে, কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বাই শিখণ্ডী। আমার এই প্রতিজ্ঞা সকলেই জানে যে স্ত্রীলোককে, স্ত্রী থেকে পুরুষ হয়েছে এমন লোককে, এবং স্ত্রীনামধারী ও স্ত্রীরূপধারী পুরুষকে আমি শরাঘাত করি না।

** (১) আদিপর্ব ১৭-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য

 (২) অর্থাৎ তোমাকে বিবাহ করবেন।

২৮। যুদ্ধযাত্রা

পরদিন প্রভাতকালে দুর্যোধন ভীষ্ম প্রভৃতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভীমার্জুন-ধৃষ্টদ্যুম্নাদি কর্তৃক রক্ষিত এই বিশাল পাণ্ডববাহিনী আপনারা কত কালে বিনষ্ট করতে পারেন?

ভীষ্ম বললেন, আমি প্রতিদিন দশ সহস্র সৈন্য এবং এক সহস্র রথীকে বধ করব, তাতে এক মাসে সমস্ত বিনষ্ট হবে। দ্রোণ বললেন, আমি স্থবির হয়েছি, শক্তি কমে গেছে, তথাপি আমিও ভীষ্মের ন্যায় এক মাসে পাণ্ডববাহিনী ধ্বংস করতে পারি। কৃপ বললেন, আমি দুই মাসে পারি। অশ্বত্থামা বললেন, আমি দশ দিনে পারি। কর্ণ বললেন, আমি পাঁচ দিনে পারি।

কর্ণের কথায় ভীষ্ম উচ্চ হাস্য করে বললেন, রাধেয়, এখন পর্যন্ত তুমি শঙ্খধনুর্বাণধারী বাসুদেবসহিত রথারোহী অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে মিলিত হওনি তাই এমন মনে করছ। তুমি যা ইচ্ছা হয় তাই বলতে পার।

যুধিষ্ঠির তার গুপ্তচরদের কাছে কৌরবগণের এই আলোচনার সংবাদ পেলেন। তিনি তার ভ্রাতাদের জানালে অর্জুন বললেন, কৌরবপক্ষের অস্ত্রবিশারদ যোদ্ধারা নিজেদের সামর্থ্য সম্বন্ধে যা বলেছেন তা সত্য। কিন্তু আপনি মনস্তাপ দূর করুন, আমি বাসুদেবের সহায়তায় একাকীই নিমেষমধ্যে ত্রিলোক সংহার করতে পারি, কারণ। কিরাতরূপী পশুপতির প্রদত্ত মহাস্ত্র আমার কাছে আছে। কিন্তু এই দিব্য অস্ত্র দ্বারা যুদ্ধে লোকহত্যা অনুচিত, অতএব আমরা সরল উপায়েই শত্রু জয় করব, পরাক্রান্ত মহারথগণ আমাদের সহায় আছেন।

প্রভাতকালে কৌরবপক্ষীয় রাজগণ স্নানের পর মাল্য ও শুভ্র বসন ধারণ করলেন, তারপর হোম ও স্বস্তিবাচন করে দুর্যোধনের আদেশে পাণ্ডবগণের অভিমুখে যাত্রা করলেন। দ্রোণাচার্য প্রথম দলের, ভীষ্ম দ্বিতীয় দলের, এবং দুর্যোধন তৃতীয় দলের অগ্রণী হয়ে চললেন। কৌরববীরগণ সকলে কুরুক্ষেত্রের পশ্চিম দিকে সমবেত হলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণও সুসজ্জিত হয়ে যাত্রা করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রথম সৈন্যদলের, ভীম সাত্যকি ও অর্জুন দ্বিতীয় দলের, এবং বিরাট দ্রুপদ প্রভৃতির সঙ্গে যুধিষ্ঠির তৃতীয় দলের অগ্রবর্তী হলেন। সহস্র সহস্ৰ অযুত অযুত সৈন্য সিংহনাদ এবং ভেরী ও শঙ্খের ধ্বনি করতে করতে পাণ্ডবদের পশ্চাতে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *