পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আশিক ও মাসুক
মুক্তবেণীতে সরস্বতী ও গঙ্গাসঙ্গমের নিকটে একটি তিন্তিড়ি বৃক্ষতলে বসিয়া একটি যুবক একমনে গঙ্গ-প্রবাহে অসংখ্য নৌবাহিনীর সম্মিলন দেখিতেছিল। সরস্বতী তখন প্রায় বিগতযৌবনা, কিন্তু তথাপি বর্ত্তমান সময়ের ন্যায় কঙ্কালাবশিষ্টা হয় নাই। তখনও চারি পাঁচ হাজার মনের নৌকা স্বচ্ছন্দে হিজলি হইতে সপ্তগ্রামে আসিত এবং বৎসরের বারমাস নদীতে নৌকা চলিত। সরস্বতীর মোহানায় ক্ষুদ্র বৃহৎ অনেকগুলি নৌকা ভাঁটার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল, তাহার মধ্যে দুই একখানি বজ্রাও ছিল। একখানি বজরার কামরার সম্মুখে দুইটি মুসলমান রমণী বসিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে একজন যুবতী ও রূপসী, অপর প্রৌঢ়া ও কুরূপা। তাহাদিগের পোষাক পরিচ্ছদ দেখিলে বোধ হয় যে তাহারা সম্ভ্রান্তবংশীয়া, অথচ তাহারা নর্ত্তকী; কারণ কোন মুসলমান কূলবধূ দিবসে জনসমাজে বাহির হয় না। রূপসী কুরূপাকে কহিল, “ফতেমা, ঐ তিন্তিড়ি বৃক্ষতলে যে কাফের যুবক বসিয়া আছে, যদি তাহাকে পাই তবে বিবাহ করি।” প্রৌঢ়া বিরক্ত হইয়া কহিল, “তোমার বয়স হইয়াছে তথাপি গাম্ভীর্য্য আসিল না। কি দুঃখে কাফেরকে বিবাহ করিতে যাইবে? কোন মুসলমানের ঘরে কি উপযুক্ত পাত্র নাই?” “হয়ত আছে। আমার মনে ধরিলে ত?” “এত যায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইলে, এত লোক দেখিলে, কাহাকেও কি, বাছা, তোমার মনে ধরিল না?” “ধরিয়াছে ত।” “কাহাকে?” “ঐ কাফের যুবককে।” “সে কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। মনের মত পাত্র কি সুবাবাঙ্গালার মুসলমান সমাজে মিলিল না?” “না।” “ধন্য মন বটে!” “সে জিনিষটা এখন বেশ ভাল আছে, ফতেমা, তুই সেতারটা লইয়া আয়।”
“এই এত লোকের মাঝে, বজরার সম্মুখে বসিয়া, সেতার বাজাইবে? লোকে কি বলিবে?” “আমি কি সুলতানা আরজমন্দ বাণু বেগম যে সারা হিন্দুস্থানের লোক আমাকে দূষিবে? আমি তওয়াইফের বেটী, আমার মা জহাঙ্গীর নগর হইতে লাহোর পর্য্যন্ত সারা হিন্দুস্থানটা নাচিয়া গাহিয়া বেড়াইয়াছে—”
“ছি মা, অমন কথা মুখে আনিতে নাই; তোমার মা স্বর্গে গিয়াছেন। তিনি তওয়াইফ ছিলেন বটে, কিন্তু কস্বী ছিলেন না।” “দূর, আমি কি তাই বল্ছি? মা ত পেশোয়াজ পরিয়া মজ্লিসে নামিত? তবে আমি যদি বজরার সম্মুখে সেতার বাজাই তাহাতে দোষ কি?” “তোমার সঙ্গে কথায় অাঁটিয়া উঠিতে পারিব না, বাছা, তোমার যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই কর।”
এই বলিয়া ফতিমা সেতার আনিবার জন্য উঠিয়া গেল। বজরার ছাদে একজন বৃদ্ধ মুসলমান বসিয়াছিল; যুবতী তাহাকে ইসারা করিল, সে নামিয়া আসিয়া সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। যুবতী কহিল, “হবিব, ঐ তিন্তিড়ি-বৃক্ষ-তলে যে কাফের যুবা বসিয়া আছে, গোপনে উহার পরিচয় জানিয়া আইস। খবরদার আমাদের পরিচয় দিও না।” বৃদ্ধ সেলাম করিয়া বজরা হইতে নামিয়া গেল। এই সময়ে ফতিমা সেতার লইয়া ফিরিয়া আসিল, যুবতী সেতার লইয়া সুর বাঁধিতে বসিল। সুর বাঁধা শেষ হইলে, যুবতী নয়নকোণে চাহিয়া দেখিল যে, হবিব্ তিন্তিড়ি-বৃক্ষতলে যুবকের পার্শ্বে গিয়া বসিয়াছে। যুবতীর তাম্বূলরঞ্জিত কুসুমপেলব অধরে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা দিয়া আবার মিলাইয়া গেল। যুবতী সেতার উঠাইয়া লইয়া বাজাইতে আরম্ভ করিল। তখনও দিবসের প্রথম প্রহর অতীত হয় নাই। যুবতী ভুলক্রমে পূরবী আলাপ করিতে আরম্ভ করিল, ভুল বুঝিতে পারিয়া তাহা ছাড়িয়া দিল। গজদন্তনির্ম্মিত ক্ষুদ্র সেতারে সিন্ধুর একটা মিঠা গৎ বাজিতেছিল। সেকালে সপ্তগ্রামে সমজদারের অভাব ছিল না, দেখিতে দেখিতে নদীতীরে লোক জমিয়া গেল, যুবতী সেতারের অন্তরাল হইতে চাহিয়া দেখিল, কাফের যুবা একদৃষ্টে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। গোলাপের ন্যায় সুন্দর অধরে আবার হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিল, যুবতী সেতার রাখিয়া কামরায় প্রবেশ করিল। তীরে ও নদীর জলে নৌকায় নৌকায় লোকে স্তব্ধ হইয়া সেতারের আলাপ শুনিতেছিল; সেতার থামিলে সকলে একসঙ্গে কথা কহিতে আরম্ভ করিল। কেহ বলিল, এ বাদশাহের বেটী, ফিরিঙ্গীরা ধরিয়া আনিয়াছিল, এখন প্রাণের দায়ে ছাড়িয়া দিয়াছে। অার একজন বলিল যে, এ ইরাণের তওয়াইফ, সুবাদারের মজলিসে মজুরা করিতে যাইতেছে। এক বৃদ্ধ ফকির শ্মশ্রুতে অঙ্গুলী চালনা করিতে করিতে কহিল যে, রমণী নিশ্চয়ই পরীজাদী, আশমান ছাড়িয়া শীকারের চেষ্টায় দুনিয়ায় আসিয়াছে। এই অবসরে যুবার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া হবিব কহিল,“বাবু সাহেব বোধ হয় সহরে নূতন আসিয়াছেন?” যুবা মুখ ফিরাইয়া দেখিল যে এক বৃদ্ধ মুসলমান তাঁহার পলাণ্ডুগন্ধযুক্ত মুখ ও মেহেদীসংযুক্ত শ্মশ্রু তাহার মুখের নিকটে লইয়া আসিয়া প্রচুর পরিমাণে নিষ্ঠীবন বর্ষণ করিতেছে। যুবা বিরক্ত হইল; কিন্তু বুড়া এমনই মোলায়েম কায়দার সহিত কথা কয়টি বলিয়াছিল যে, বিরক্তি প্রকাশ করিতে যুবক লজ্জা বোধ করিল। সে কহিল, “হাঁ।” তখন বৃদ্ধ এক দীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিল, “বাবু সাহেব সম্ভ্রান্তবংশজাত, মুখ দেখিলেই তাহা বুঝিতে পারা যায়। বাবু সাহেব বোধ হয় ভ্রমণ করিতে আসিয়াছেন? সপ্তগ্রাম বড় আজব সহর, এমন সহর গৌড় ছাড়া সুবাবাঙ্গালায় আর নাই।” যুবা কি বলিবে তাহা ভাবিয়া পাইল না। এই বৃদ্ধ কে? সে সহসা দয়াপরবশ হইয়া তাহার সহিত আলাপ করিতে আসিল কেন? যুবা যখন এই চিন্তা করিতেছিল, তখন বুড়া পুনরায় জিজ্ঞাসা করিল, “বাবু সাহেব জাফর খাঁ গাজীর দর্গাহ্ দেখিয়াছেন কি? এমন খুবসুরত ইমারৎ হিন্দুস্থানে অল্পই আছে।” যুবা ধীরে ধীরে কহিল, “না।”
“তবে চলুন, আপনাকে দেখাইয়া আনি।” যুবা তাহার আকস্মিক দয়ার কারণ বুঝিতে না পারিয়া কহিল, “চলুন।” উভয়ে তিন্তিড়ি বৃক্ষের পশ্চাতে অবস্থিত পাষাণনির্ম্মিত সমাধিমন্দিরে প্রবেশ করিল।
বজরার গবাক্ষ হইতে যুবতী তাহা দেখিল। সে তাহার সঙ্গিনীকে কহিল, “ফতেমা, নাজির আহমদ কি নৌকায় আছে?” ফতেমা কহিল, “খাঁ সাহেব বোধ হয় বাজারে গিয়াছেন, ঠিক বলিতে পারি না, দেখিয়া আসি।” ফতেমা বজরার বাহিরে আসিয়া দেখিল যে, বজরার পশ্চাতে একখানি পান্সীর উপরে দাঁড়াইয়া একজন প্রৌঢ় ফর্শীতে তামাকু সেবন করিতেছে। প্রৌঢ়া তাহাকে কহিল, “খাঁ সাহেব, বিবি আপনাকে তলব করিয়াছেন।” প্রৌঢ় তাহা শুনিয়া ফর্শী নামাইয়া রাখিল এবং কহিল, “ফতেমা বিবি, সাহেবা বুঝি চটিয়াছেন, কল্য রাত্রিতে সেতারের মেজরাপ্ খরিদ করিতে হুকুম করিয়াছিলেন, আমি সন্ধ্যাবেলায় আফিম্ টানিয়া তাহা বিলকূল ভুলিয়া গিয়াছি। বিবির হাতে সেতার দেখিয়া ডিঙ্গার ভিতরে লুকাইয়া ছিলাম। খোদা তালার কসম বিবিজান, আজ সকালে সাহেবার মেজাজটা কেমন বল দেখি?” ফতেমা হাসিয়া কহিল, “খাঁ সাহেব, তোমার নসিবে আজ দুঃখ নাই। মেজাজ বড়ই খোস্, বিবির প্রাণে এখন আশিক্ জাগিয়াছে। তুমি শীঘ্র আইস।” খাঁ সাহেব দাড়ী গোঁফ্ চোমরাইয়া লইয়া বজরায় উঠিয়া কছিল, “ফতেমা বিবি, তুমি তবে এত্তালা দিয়া আইস।” প্রৌঢ়া কহিল,—“এত্তালা দিতে হইবে না, তুমি যাও।” বজরার প্রথম কক্ষের দ্বারে কিংখাবের পর্দ্দা উঠাইয়া খাঁ সাহেব কামরায় প্রবেশ করিল। যুবতী তখন বজরার বাতায়নের পার্শ্বে বসিয়া একখানি পত্র লিখিতেছিল; তাহা দেখিয়া খাঁ সাহেব সেলাম করিয়া দু’য়ারে দাঁড়াইয়া রহিল। পত্র লেখা শেষ হইল, যুবতী তাহা কুন্দদন্তে টিপিয়া ধরিয়া লেফাফায় বন্ধ করিল এবং দ্বিরদরদখচিত অপূর্ব্ব কৌটা হইতে গালা ও মোহর বাহির করিল; তাহা দেখিয়া খাঁ সাহেব কক্ষান্তর হইতে প্রজ্বলিত বর্ত্তিকা লইয়া আসিল। পত্র মোহর করিয়া যুবতী তাহা খাঁ সাহেবের হস্তে দিল এবং কহিল, “গোকুলবিহারীর কুঠী হইতে এক হাজার আসর্ফী লইয়া আইস। আর দেখ অদ্যই একটা বাটি ভাড়া করিয়া আইস, আমি আকবরনগর যাইব না, সপ্তগ্রামেই থাকিব।” খাঁ সাহেব সেলাম করিয়া দ্রুতপদে পলায়ন করিল।
হবিব যুবককে সঙ্গে লইয়া জাফরখাঁর কবর, মসজিদ্, মদরসা প্রভৃতি দেখাইয়া তিন্তিড়ি বৃক্ষতলে ফিরাইয়া আনিল। যুবক তাহাকে কিছু অর্থ দিতে চাহিল; কিন্তু বৃদ্ধ তাহা কোন মতেই গ্রহণ করিল না। সে কহিল, “হুজুর ঠিকানা দিয়া যাউন, আমি কল্য প্রাতে দুয়ারে হাজির থাকিব এবং ফরমায়েস মত হুজুরকে সহর দেখাইতে যাইব।” যুবা তাহাকে নিরস্ত করিতে বহু চেষ্টা করিল, কিন্তু বৃদ্ধ তাহা শুনিল না। তখন যুবা বাধ্য হইয়া কহিল, “আমি মীনাবাজারে গোকুলবিহারী সেনের গৃহে থাকি, আমার নাম ময়ূখ।” বুড়া তাহা শুনিয়া যুবকের মুখে প্রচুর পরিমাণে নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করিতে করিতে কহিল, “তোফা বাবু সাহেব, বড় সুন্দর নাম, খোদাতালা আপনাকে যেমন খুবসুরত দিয়াছেন, নামটিও তেমনই সুন্দর। আমি কল্য প্রাতে হুজুরের দৌলতখানায় হাজির থাকিব।” বৃদ্ধ প্রস্থান করিল।
ময়ূখ যতক্ষণ হবিবের সহিত কথা কহিতেছিলেন, ততক্ষণ আর একখানি নৌকা হইতে জনৈক দীর্ঘাকার ব্রাহ্মণ তাঁহাকে লক্ষ্য করিতেছিল। হবিব চলিয়া গেলে ময়ূখ নদীর দিকে ফিরিলেন, তখন ব্রাহ্মণ তাঁহার মুখ দেখিতে পাইলেন। তিনি দুই তিন বার ডাকিলেন, কিন্তু ময়ূখ তাহা শুনিতে পাইলেন না। ব্রাহ্মণের নৌকা দূরে ছিল, তাহা ভিড়াইতে ভিড়াইতে ময়ূখ প্রস্থান করিলেন। ব্রাহ্মণ কুলে উঠিয়া আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না।