আশরাফুজ্জামান সাহেব দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলেন
আশরাফুজ্জামান সাহেব দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলেন। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াকিটাকি হাতে অল্প বয়েসী এক পুলিশ অফিসার। হাসি হাসি মুখ। যেন ঈদের দাওয়াত খেতে এসেছে। পুলিশের মুখের হাসিতে আশরাফুজ্জামান সাহেব বিভ্রান্ত হলেন না। শুকনো গলায় বললেন, কাকে চাই?
আপনি কি রকিবউদিনের বাবা?
জ্বি।
স্যার কেমন আছেন?
ভালো আছি।
একটু কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
বলুন।
বাইরে দাঁড়িয়ে তো কথা হয় না। ঘরে গিয়ে বসি।
আশরাফুজ্জামান দ্রুত চিন্তা করলেন। ঘরের ভেতর পুলিশ ঢোকানো ঠিক হবে না। একবার পথ চিনে ফেললে এরা বারবার আসবে। লোকজন নানান সন্দেহ করবে। আশরাফুজ্জামান সাহেব বললেন–আমি তো এখন বেরোচ্ছি। আমার একজন আত্মীয় অসুস্থ। অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে।
উনি কোথায় আছেন?
হলিফ্যামিলি হাসপাতালে। আমার ভাই হয়। চাচাতো ভাই।
আমি কি পরে আসব?
কখন বাসায় থাকি ঠিক নাই তো। রোগীর অবস্থা ভালো না। সারাদিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। বুকে কনজেশান হয়েছে। ক্রিটিক্যাল অবস্থা।
তাহলে বরং একটা কাজ করুন–রোগী দেখে আপনি থানায় চলে আসুন। রমনা থানা। আমার নাম বললেই হবে। আমার নাম আব্দুল খালেক সাবইন্সপেক্টর।
জ্বি আচ্ছা!
আপনার ছেলের ব্যাপারে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব। চিন্তিত হবার মতো কিছু না।
আমি চিন্তিত না।
তাহলে স্যার যাই? স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আশরাফুজ্জামান সাহেব পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বের হয়ে এলেন। মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনলেন। সিগারেট তাঁর জন্যে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ হলেও তিনি সমানে খেয়ে যাচ্ছেন। সিগারেট খাবার জন্যেই তাকে দীর্ঘ সময় বাসার বাইরে থাকতে হয়। সিগারেট হাতে তিনি ইস্কান্দরের চায়ের দোকানে ঢুকলেন। তার ডায়াবেটিস আছে। চিনি দিয়ে চা খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইস্কান্দরের চায়ের দোকানে তিনি এই নিষিদ্ধ কর্মটিও করেন। দু চামচের জায়গায় তিন চামচ চিনি দিয়ে চা খান।
ইস্কান্দর বলল, চাচামিয়া কেমুন আছেন?
তিনি হাসিমুখে বললেন, ভালো আছি। দেখি চা দাও। দই আছে?
আছে।
মিষ্টি না টক?
মিষ্টি।
দাও একটু দই খাই। এক কাজ কর, দইয়ের সঙ্গে একটা কালোজাম দাও।
তিনি খুব আরাম করে দই-কালোজাম খেলেন। চা সিগারেট খেলেন। পুলিশের দুশ্চিন্তা তার মাথা থেকে চলে গেল। তাঁর এখন শেষ সময়। শেষ সময়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ কী! তিনি কোনো অন্যায় করেন নি। পুলিশ তাকে নিয়ে জেলে ঢোকাতে পারবে না। যে কটা দিন আছেন–সুখে শাস্তিতে পার করে দিতে পারলেই হলো।
রকিব কী ব্যামেলা পাকিয়েছে কে জানে? কামেলা যদি পাকিয়েই থাকে তার ভাইরা বুঝবে। তিনি কে? তিনি কেউ না।
আশরাফুজ্জামান সাহেব আরেক কাপ চা দিতে বললেন। প্রথম চা-টা সিগারেট ছাড়া খেয়েছেন। দ্বিতীয় কাপ সিগারেট দিয়ে খাওয়া। ইস্কান্দরের হোটেলে দুপুরে তেহারি রান্না হয়। আজ তেহারি খেতে ইচ্ছা করছে। গরম হাঁড়ি নামলেই খেয়ে ফেলতে হবে। দেরি করলে নিচে তেল জমে যায়। তেল খাওয়াটা ঠিক না।
ইস্কান্দর।
জ্বি।
আজ তোমার এখানে তেহরি খাব।
জ্বি আচ্ছা।
মুখের রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা করে। তোমার তেহারিটা ভালো হয়। বাবুর্চি ভালো। নাম কী বাবুর্চির?
ইস্কান্দর জবাব দিল না। সে জেনে গেছে বুড়োদের সব কথার জবাব দিতে হয় না। একটা পর্যায়ে কথা বলা বন্ধ করে দিতে হয়।
ইস্কান্দর।
জ্বি।
দেশে রাজনীতির হালচাল কী?
জানি না।
মিলিটারি ছাড়া আমাদের গতি নাই ইস্কান্দর। লেফট রাইট না করালে দেশটার কিছু হবে না। দেখি তোমার পিচ্চিটারে ডাক তো–একটা খবরের কাগজ আনিব।
বাসায় খবরের কাগজ আছে। তারপরেও আলাদা করে কাগজ পড়ার অন্য রকম মজা। বাসার কাগজ পড়ায় সেই মজা নেই। আশরাফুজ্জামান সাহেব মাঝে মাঝে নিজের টাকায় কাগজ কেনেন। পড়া হয়ে গেলে সেই কাগজ যত্ন করে জমা করে রাখেন। অনেকগুলো কাগজ জমেছে। বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। খবরের কাগজ কত দরে বিক্রি হয় কে জানে!
ইস্কান্দর।
জ্বি।
পুরনো খবরের কাগজের দর কত জান? কী দরে বিক্রি হয়?
জানি না।
দেখি আরেক কাপ চা দিতে বল। দুধ বেশি করে দিবে।
খবরের কাগজ শেষ করতে তাঁর এক ঘণ্টার মতো লাগল। টাকা পুরোপুরি উসুল করলেন। কোনো কিছুই বাদ দিলেন না। এরশাদ সাহেবের একটা কবিতা ছাপা হয়েছে। নদী-পাখি-আকাশ বিষয়ক। সেই কবিতা তিনি পড়ে ফেললেন। নদী-পাখি এবং আকাশ নামক বস্তুগুলোর প্রতি তার মমতা দেখে তিনি মুগ্ধ হলেন কি না বোঝা গেল না।
আশরাফুজ্জামান সাহেব পত্রিক ভাজ করে বগলে নিয়ে নিলেন। তেহারি রান্না হতে এখনো দেরি আছে। আজ ছুটির দিন বাসায় লোকজন নেই। বউমা তার ভাইয়ের বাসায়। খালি বাসায় চুপচাপ বসে থাকার অর্থ হয় না। বড় মেয়ের বাসা থেকে কি একবার ঘুরে আসবেন? তাঁর স্ত্রী বর্তমানে বড় মেয়ের বাসায় আছেন। স্ত্রীর সঙ্গেও দেখা হলো। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়াটা অবশ্য তত জরুরি না। বড় মেয়ের কাছে গেলে একটা লাভ অবশ্য হয়। বড় মেয়ে মাঝেমধ্যেই তাক্লে কিছু টাকা-পয়সা দেয়। বেশি না, সামান্যই। কখনো একশ’ টাকার দুটো নোট। কখনো পঞ্চাশ টাকার তিনটা নোট। তার স্বামী যখন আশপাশে থাকে না তখন চট করে নোট কটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে দিলে বলে—বাবা রেখে দিন।
চাচা স্নামালিকুম।
আশরাফুজ্জামান সাহেব চমকে তাকালেন। লম্বা একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মুখভর্তি হাসি। এমন আনন্দিত মুখের কোনো ছেলেকে তিনি ইদানীংকালে দেখেছেন বলে মনে পড়ে না।
চাচা আমাকে চিনতে পারেন নি, তাই না?
না চিনতে পারি নি।
আমি লিটন।
ও আচ্ছা লিটন। ভালো খুব ভালো।
আমি হাসানের বন্ধু। স্কুলে পড়েছি। ওর সঙ্গে।
ভালো ভালো। খুব ভালো।
হাসানের খোজে বাসায় গিয়েছিলাম–দেখি বাসায় কেউ নেই।
হাসান কোথায় গেছে জানি না। বউমা গেছে তার ভাইয়ের বাসায়।
হঠাৎ করে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। চাচা। আজ সন্ধ্যাবেলায় বিয়ে। অনুষ্ঠান টনুষ্ঠান কিছু না— কাজি ডেকে বিয়ে। হাসানকে খবরটা দিতে এসেছিলাম।
আমি বলে দেব।
চাচা আমার নাম মনে থাকবে তো? লিটন। লিটন বললেই হবে।
আমি বলব। আশরাফুজ্জামান হাঁটছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে লিটনও ঘটছে। ভালো যন্ত্রণা হলো দেখি।
আমি পরশুদিন সকালে মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছি। আদম বেপারিকে ধরে ব্যবস্থা হয়েছে। দেশে কিছু হচ্ছিল না। খুব কষ্টে ছিলাম চাচা–এখন মনে হয় আল্লা মুখ তুলে চেয়েছেন।
ভালো খুব ভালো।
হাসান আমার কাছে দুই হাজার টাকাও পায়। এক হাজার টাকা নিয়ে এসেছি। আপনার কাছে দিয়ে যাই।
আচ্ছা দাও।
ইচ্ছা ছিল সবার সব ঋণ শোধ করে যাব। সম্ভব হয় নাই। এখন বিদেশ থেকে পাঠাব।
ভালো খুব ভালো। ঋণ রাখতে নেই।
মালয়েশিয়ায় গুছিয়ে বসে ইনশাল্লাহ হাসানকেও নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব।
আশরাফুজ্জামান লিটনের টাকাটা রাখলেন। তাঁর হেঁটে হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল–এখন রিকশা নিয়ে ফেললেন। পকেটে টাকা আছে রিকশায় ঘোরাফেরা করা যায়।
চাচা।
বল বাবা।
কাল সকালে চলে যাচ্ছি তো–তাই তাড়াহুড়া কবে বিয়ে। আগেভাগে কাউকে কিছু বলতে পারি নি। হাসানকে আপনি অবশ্যই পাঠিয়ে দেবেন।
অবশ্যই পাঠাব।
আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন। চাচা।
অবশ্যই দোয়া করব।
লিটন পা ছুঁয়ে সালাম করল। আশরাফুজ্জামান সাহেব চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ বিড়বিড় করলেন।
রিকশা চলছে। তিনি হুড ধরে আনন্দিত ভঙ্গিতে বসে আছেন। লিটনের টাকাটা পেয়ে ভালো লাগছে। হাত একেবাবে খালি হয়ে গিয়েছিলো। কিছু টাকা চলে এল। টাকার কথা, লিটনের বিয়ের কথা হাসানকে বলার। তিনি কোনো কারণ দেখছেন না। তিনি বুড়ো মানুষ এইসব কথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক।
রিকশাওয়ালা বললেন, কই যাইবেন চাচা মিয়া?
চল রমনা থানায় চল।
রমনা থানার ঝামেলাটা চুকিয়ে আসা ভালো। তিনি রিকশার হুড ফেলে দিলেন। গায়ে রোদ লাওক। রোদে ভাইটামিন সি না ডি কী যেন আছে। বৃদ্ধ বয়সে শরীবে সব রকম ভাইটামিন দরকার–এ, বি, সি, ডি, ই, এফ, জি, এইচ, আই, জে, …। রমনা থানার যার সঙ্গে কথা বলবেন তার নাম হচ্ছে–আব্দুল খালেক। হাসানেব বন্ধুব নাম লিটন। বয়স হলেও স্মৃতিশক্তি এখনো ভালো আছে। মাথায় রোদ লাগছে। তিনি রিকশার হুড তুললেন না। বগলে রাখা খবরের কাগজটা মাথার ওপর ধরলেন। আব্দুল খালেকের সঙ্গে কথা বলে বড় মেয়ের বাসায় যাবেন। আজ দিনটা শুভ, বড় মেয়েও হয়ত নতুন পাঁচশ টাকার একটা নোট পকেট ঢুকিয়ে দেবে। যখন টাকা আসতে থাকে তখন আসতেই থাকে। এটা হলো টাকার ধর্ম।
আব্দুল খালেক হাসিমুখে বললেন, ও আপনি এসেছেন? আপনার রোগী কেমন?
আশরাফুজ্জামান চিন্তিত মুখে বললেন, ভালো না। মনে হয় সময় হয়ে গেছে।
বয়স কত?
বয়স অল্প–৪৫/৪৬ হবে।
চা খাবেন?
জ্বি না, বাসায় গিয়ে ভাত খাব। আমার নিজেব শরীরও ভালো না। আপনি কী জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলেন জিজ্ঞেস করুন।
আপনার ছোট ছেলের নাম রকিব?
জ্বি।
ও কী করে না করে তা কি আপনি জানেন?
পড়াশোনা করে–ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে।
পড়াশোনা ছাড়া আর কী করে জানেন?
জানি না।
আপনার সঙ্গে যোগাযোগ কেমন?
যোগাযোগ নেই। ছেলেমেয়ে কারো সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। বাপ বুড়ো হলে যা হয়।
সিগারেট খাবেন?
দেন, একটা খাই।
আব্দুল খালেক সিগারেটের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দিলেন। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে দিলেন। তারপর নিজের চেয়ার আরো কাছে টেনে এনে গলা নিচু করে বললেন–আপনার এই ছেলে ভালো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে। চকবাজারের একজন রবারের ব্যবসায়ীকে সে এবং তার কয়েক বন্ধু মিলে ধরে নিয়ে গেছে। তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেবে। এই হলো ঘটনা। তারা ওই ভদ্রলোককে প্রথম দিন রেখেছে শহীদুল্লাহ হলে— এখন অন্য কোথায় যেন ট্রান্সফার করেছে। আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
আশরাফুজ্জামান সাহেব তাকিয়ে রইলেন। কিছু বললেন না। তিনি খুব যে বিক্ষিত হয়েছেন তাকে দেখে তাও মনে হলো না।
ব্যবসায়ী ভদ্রলোককে তারা যদি মেরে টেরে ফেলে তাহলে অবস্থা খারাপ হবে। এই কথাটা আপনার ছেলেকে জানানো দরকার। যদি সে বাসায় আসে, বাসার কারো সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাকে ব্যাপারটা বলবেন।
জ্বি বলব।
আমার যা বলার বলেছি–এখন আপনি চলে যেতে পারেন।
জ্বি আচ্ছা।
আপনাকে থানায় এনে কষ্ট দিয়েছি, কিছু মনে করবেন না।
জ্বি না।
সময় খারাপ–অপরাধ করে ছেলেমেয়ে, আমরা বাবা-মাকে জেরা করি। আমাদেরও খারাপ লাগে।
আশরাফুজ্জামান সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মনটা খারাপ হয়েছে। তবে এই মন খারাপ ভাব দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে না। এই বয়সে ছেলেপুলেদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানো অর্থহীন। অল্প যে কদিন আছেন নিশ্চিন্তু মনে থাকতে চান। তিনি রাস্তায় নেমে রিকশা নিলেন। বড় মেয়ের বাসায় যাবেন। আজ দুপুরে তেহারি মনে হয় খাওয়া হবে না। বড় মেয়ের বাসায় গেলে না খেয়ে আসা যায় না। খেয়ে আসতে হয়। ইদানীং ঘরের খাওয়া তার মুখে রুচে না–তবু ভাব করতে হয় যেন অমৃত খাচ্ছেন।
তিনি বাসায় ফিরলেন রাত আটটায়। ঘরে ঢুকে একটা মজার দৃশ্য দেখলেন—তার ছোট ছেলে রকিব এসেছে। সে ঘোড়া সেজেছে। টগর এবং পলাশ দুজন তার পিঠে চেপে আছে। তারা হাঁট হাঁট করছে এবং ঘোড়া লাফিয়ে লাফিয়ে বারান্দার এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছে–মাঝে মাঝে চিঁহি করে বিকট চিৎকার দিচ্ছে।
বাবাকে দেখে রকিব হাসি মুখে বলল, বাবা কেমন আছ?
ভালো। তুই কখন এসেছিস?
এই তো কিছুক্ষণ আগে।
টগর, আনন্দিত গলায় বলল, দাদুভাই ছোট চাচা আজ আমাদের সবাইকে চাইনিজ খাওয়াবে। তাড়াতাড়ি কাপড় পর।
আশরাফুজ্জামান বললেন, সত্যি নাকি রে?
রবিক বলল, হ্যাঁ সত্যি। তোমার জন্যেই দেরি করছি। কাপড় পরে নাও।
চাইনিজ খাওয়াবি টাকা পেলি কোথায়?
খেলাধুলার জন্যে একটা স্কলারশিপ পেয়েছি।
ভালো খুব ভালো।
আশরাফুজ্জামান খুশি মনে কাপড় বদলোত গেলেন। অনেকদিন চাইনিজ খাওয়া হয় না। থাই সুপ তাঁর খুব পছন্দের জিনিস। বৃদ্ধ বয়সে সুপ জাতীয় খাবারই ভালো। সহজপাচ্য, খেতেও সুস্বাদু।
সবাই চাইনিজ খেতে গেল। শুধু যে এ বাড়ির সবাই তাই না, রকিব তার বড় বোনকেও বলে এসেছিল। সেও চলে এল। হাসানের মা রাগ করে এতদিন মেয়ের বাড়িতে ছিলেন। তিনিও এলেন। শুধু হাসান গেল না। তার শরীর ভালো না। সন্ধ্যা থেকে মাথা ঘোরাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে থাকলে মাথা ঘোরায় না। চোখ মেললেই মাথা ঘোরে। একজন ডাক্তার মনে হয় দেখানো দরকার।
বাসা খালি হয়ে যাবার পর হাসানের মন কেমন করতে লাগল। বেশি রকম একলা লাগছে। সবার সঙ্গে গেলেই হত। কিছু না খেয়ে বসে থাকলেও হতো। বাসার সবার একসঙ্গে হওয়া একটা বড় ঘটনা। অনেকদিন পর এই ঘটনা ঘটছে শুধু সে বাদ পড়ল।
হাসান বিছানা থেকে নামল। একা একা শুয়ে থাকতে অসহ্য লাগছে। রেস্টুরেন্টের ঠিকানা জানা থাকলে সেখানে চলে যেত। ঠিকানা জানা নেই। হাসান রওয়ানা হলো তিতলীদের বাসার দিকে। অসুস্থ অবস্থাতেই প্ৰিয়জনদের বেশি দেখতে ইচ্ছে করে। তিতলীকে কেন জানি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। হাসান তিতলীদের বাড়ির গেট পর্যন্ত গেল। গেটের ভেতর ঢুকাল না। এত ঘনঘন ওই বাড়িতে যাওয়া ঠিক না। তিতলীর বাবা নিশ্চয়ই রাগ করবেন। সেই রাগ তিনি হাসানের ওপর দেখাবেন না, দেখাবেন তিতলীর ওপর। তার কারণে তিতলী বকা খাবে এটা ঠিক না।
ফেরার পথে হাসান ঠিক করে ফেলল। পরের বার যখন হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে দেখা হবে তখন সে অবশ্যই একটা চাকরির কথা তাকে বলবে। তাকে বলতেই হবে। এইভাবে থাকা আর যায় না।
একটা মোটামুটি ভদ্র চাকরি হলে সে তিতলীর মাকে বলতে পারে–খালা আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
না, তার পক্ষে এটা সরাসরি বলা অসম্ভব। সে ভাবিকে দিয়ে বলবে। হিশামুদ্দিন সাহেব যেদিন তাকে চাকরি দেবেন। সেদিনই সে ভাবিকে পাঠাবে। অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই, অবশ্যই।
হাসান কেমন আছ?
জ্বি স্যার ভালো।
চোখ লাল কেন?
হাসান জবাব দিতে পারল না। তার যে চোখ লাল এই ব্যাপারটা সে জানে না। ঘর থেকে বেরোবার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়েছে। তখন চোখের দিকে তাকায় নি। আয়নায় নিজেকে খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস তার নেই।
হিশামুদিন সাহেব বললেন, রাতে ঘুম হয় নি?
জ্বি স্যার হয়েছে।
তোমার কি অনিদ্রা রোগ আছে?
জ্বি না।
তুমি তাহলে মানুষ হিসেবে খুব আধুনিক নও। অনিদ্রা হচ্ছে আধুনিক মানুষের রোগ।
হাসান চুপ করে রইল। হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে সমান তালে গল্প করার মতো অবস্থা তার না। হিশামুদিন সাহেব প্রশ্ন করলে সে জবাব দেবে। যতদূর সম্ভব কম কথায় জবাব দেবে। তবে আজ সে তার চাকরির কথাটা বলবে। যে ভাবেই হোক বলবে।
বিয়ে কর নি তো?
জ্বি না।
বিয়ের কথা ভাবছ না?
হাসান জবাব দিল না। একবার ভাবল এখনই সময়। এখনি বলা দরকার, স্যার চাকরি বাকরি নেই, বিয়ে করলে স্ত্রীকে খাওয়াব কী? এই কথায় দ্রবীভূত হয়ে হিশামুদ্দিন সাহেব তাঁর বিশাল কোম্পানিতে কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। তবে বাস্তব আশার পথ ধরে চলে না–বাস্তব চলে নিরাশার এবড়ো খেবড়ো পথে। তার কথায় হিশামুদ্দিন সাহেব দ্রবীভূত হবেন এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। এ জাতীয় মানুষকে অন্যরা দ্রবীভূত করতে পারে না। তবে চাকরির কথাটা আজ বলতেই হবে। এখন না হলেও কিছুক্ষণ পরে বলবে।
হাসান।
জ্বি স্যার।
তোমার কি পছন্দের কেউ আছে যাকে বিয়ে করতে চাও।
হাসান লজ্জিত গলায় বলল, আছে স্যার।
তার নাম কী?
তিতলী।
হাসান খুবই অবাক হচ্ছে। হিশামুদ্দিন সাহেব এ জাতীয় হালকা প্রশ্ন কেন করছেন সে বুঝতে পারছে না। তার পছন্দের কেউ আছে কি না তা দিয়ে হিশামুদ্দিন সাহেবের কিছু যায় আসে না।
তিতলী নামের অর্থ কী?
প্ৰজাপ্রতি।
প্ৰজাপতি তো সুন্দর নাম।
হিশামুদিন সাহেব দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন–এস শুরু করি।
হাসান অপেক্ষা করছে, হিশামুদিন সাহেব কিছুই বলছেন না। মানুষটা কি ঘুমিয়ে পড়ছে? ভাবভঙ্গি ঘুমিয়ে পড়ার মতোই। এস শুরু করি বলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে না। হিশামুদিন সাহেবের মতো মানুষ তো বটেই। হাসান বুঝতে পারছে না। খুক খুক করে কেশে সে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কি না। সেটা ঠিক হবে না। অনেক ওপরের লেভেলের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কাশি কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। হাত উঠানো যায়। হাত উঠালে। লাভ হবে না, হিশামুদিন সাহেব চোখ বন্ধ করে আছেন–কিছু দেখবেন না।
হাসান।
জ্বি স্যার।
কী বলবি গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছিলাম। তুমি যদি জীবনের গল্প শুরু কর তখন দেখবে গোছানো খুব কঠিন। সিস্টেমেটিকালি সব মনেও আসে না। তুচ্ছ ঘটনা আগে মনে পড়ে। অনেক বড় বড় ঘটনা মনেই পড়ে না। ধারাবাহিকতা থাকে না। ধারাবাহিকভাবে মানুষ তার সমস্ত ঘটনা পানিতে ডুবে মরার সময় দেখতে পায় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। তাও ঠিক না। আমি পানিতে ডুবে মরতে বসেছিলাম। আমি কিছুই দেখি নি। চোখের সামনে শুধু হলুদ আর লাল আলো দেখেছি। তুমি কি কখনো পানিতে ডুবেছ?
জ্বি না স্যার?
সাঁতার জান?
জ্বি না।
আমার পানিতে ডোবার ঘটনাটা বলব, না বাবার জেল থেকে ফিরে আসার গল্পটা আগে বলব বুঝতে পারছি না।
আপনার বাবার ফিরে আসার গল্পটা বলুন।
বাবার নাম কি তোমাকে বলেছি?
জ্বি না।
উনার নাম আজহারউদ্দিন খাঁ। আমরা খাঁ বংশ। খুবই উচ্চ বংশ। যাই হোক আমাদের উচ্চ বংশীয় বাবা দু মাসের জেল খেটে হাসিমুখে একদিন বাসায় ফিরলেন। তার হাতে চারটা কিদবেল। জেলখানার গাছের কদবেল। জেলার সাহেবকে বলেটলে কীভাবে জানি নিয়ে এসেছেন। মানুষকে মুগ্ধ এবং খুশি করার আর্ট বাবা খুব ভালো জানতেন। যে-কোনো মানুষের সঙ্গে বাবা যদি কিছুক্ষণ কথা বলেন তার ধারণা হবে বাবা অসাধারণ একজন মানুষ। বাবা বাসায় ফিরলেন। নিজের হাতে কন্দবেলের ভর্তা বানালেন। কন্দবেলের ভর্তা কখনো খেয়েছ হাসান?
জ্বি না স্যার।
ঠিকমতো বানাতে পারলে অতি উপাদেয় একটা জিনিস। চিনি দিয়ে টক কমাতে হয়। কাচামরিচ দিয়ে ঝাল ভাব আনতে হয়। লবণও দিতে হয়। চিনি ও লবণের অনুপাতের ওপর স্বাদ নির্ভর করে। বাবা ছিলেন। কদবেল ভর্তার বিশেষজ্ঞ। আমরা বিপুল আনন্দে কদবেলের ভর্তা খেলাম। বাবা হাসিমুখে জেলখানার শিল্প করতে লাগলেন। স্বাক্ষর সব গল্প। গল্প শুনলে যে কেউ বাকি জীবনটা জেলখানায় কাটিয়ে দিতে চাইবে।
বাবা তাঁর জেল জীবনের স্মৃতির উপসংহার টানলেন এই বলে যে, প্রতিটি মানুষের জীবনে জেলের অভিজ্ঞতা দরকার আছে। বাবার গল্প শুনে আমি ঠিক করে ফেললাম জীবনের একটি অংশ যে করেই হোক আমাকে জেলে কাটাতে হবে।
হিশামুদিন সাহেব চুপ করলেন। হাসান মনে মনে কয়েকবার আওড়াল আজহারউদ্দিন। নামটা যেন মনে থাকে। হিশামুদ্দিন সাহেবের স্বভাব হলো কোনো নাম তিনি বারবার বলেন না। এক-দুবার বলেন। আজহারউদ্দিন নামটা তিনি আরো বলবেন। বলে মনে হয় না।
হাসান।
জ্বি স্যার।
গল্প বলার সময় তোমার মনে যদি কোনো প্রশ্ন আসে–তুমি যদি কিছু জানতে চাও জিজ্ঞেস করো। চুপ করে থেকে না। প্রশ্ন করলে আমার মনে হবে তুমি আগ্রহ করে শুনছ।
স্যার আমি খুব আগ্রহ করেই শুনছি।
কেন?
হাসান জবাব দিতে পারল না। হিশামুদিন বললেন, আমি যে সব গল্প বলছি তা খুবই সাধারণ গল্প। কিন্তু তুমি আগ্রহ করে শুনছ কারণ যিনি গল্প বলছেন তিনি অসম্ভব বিত্তবান একজন মানুষ। তিনি যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। পরাজিত মানুষের গল্প আমাদের শুনতে ভালো লাগে না। বিজয়ী মানুষের গল্প আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনি। চেঙ্গিস খাঁর গল্প আমরা পড়ি কারণ তিনি জয়ী। যে সব রাজাদের তিনি পরাজিত করেছেন–যারা ধ্বংস হয়ে গেছে–তাদের গল্প আমরা পড়ি না। ঠিক বলছি হাসান?
জ্বি স্যার।
বাবার গল্পে চলে যাই। বাবা জেল থেকে ফেরার পর আমরা খুব কষ্টে পড়লাম। আসল কষ্ট–ভাতের কষ্ট। তিনি যে কদিন জেলে ছিলেন সেই কদিন ভাতের কষ্ট আমাদের ছিল না। দুবেলা ভাত খেতে পেরেছি। আমাদের বড় বোন পুষ্প ব্যবস্থা করেছেন। কী করে করেছেন আমরা জানি না-কিন্তু করেছেন। বাবা ফেরার পর দায়িত্ব তার হাতে চলে গেলে তিনি অকূল সমুদ্রে পড়লেন। জেলখাটা দাগি লোক কাজেই কোথাও চাকরি জোটাতে পারছেন না। সারাদিন চাকরির সন্ধানে ঘোরেন।
রাত আটটার-নাটার দিকে বাসায় ফেরেন। খাবার নিয়ে ফেরেন। আমরা রাতে একবেলা খাই–তবে পেট ভরে খাই। বাবা খাবার আনতেন হোটেল থেকে। তুমি জান কি না জানি না ভালো চালু হোটেলে উৎকৃষ্ট খাবার প্রচুর জমে যায়। হোটেল মালিকরা সেইসব খাবার ফেলে না। একত্রে জমা করে রাখে। গরিব-দুঃখীদেরকে দিয়ে দেয়। বাবা একটা হোটেলের সঙ্গে ব্যবস্থা করেছিলেন। রাত আটটার দিকে প্যাকেটিভর্তি খাবার নিয়ে আসতেন। সবকিছু একসঙ্গে মেশানো বলে অদ্ভুত স্বাদ। মাছ, গোশত, ভাজি, বিরিয়ানি, খিচুড়ি–সবকিছুর অদ্ভুত মিশ্রণ!
স্যার খেতে কেমন?
প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে যা খাওয়া যায়। তাই অমৃতের মতো লাগে– তবে ওই খাবারটা ভালো ছিল। আমরা সবাই খুব আগ্রহ করে খেতাম। শুধু আমার মেঝো বোন খেতেন না। আমার মেঝো বোন ছিলেন বিদ্রোহী টাইপের। তিনি বিদ্রোহ করে ফেলেন, কঠিন গলায় বললেন, মানুষের এঁটো খাবার আমি খাব না। মরে গেলেও না। বাবা তাকে নানা যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলেন–‘সবকিছু এঁটো হয়। কিন্তু খাবার কখনো এঁটো হয় না।’ মেঝো বোন বাবার যুক্তির ধার দিয়েও গেলেন না। তিনি চোখমুখ শক্ত করে বললেন, আমি ঐটা খাবার খাই না। তার জন্যে চিড়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সে শুকনো চিড়া চিবিয়ে পানি খেত।
আমার মেঝো বোন খুব রূপবতী ছিলেন। আমরা সবাই দেখতে মোটামুটি ভালো ছিলাম-মেঝো বোন ছিলেন সেই ভালোর মধ্যেও ভালো। খুব হাসিখুশি ছিলেন। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে আশপাশের মানুষদের চমকে দিতে ভালোবাসতেন। যেমন তাঁর একটা কথা ছিল–একটা পোকা আছে আমার খুব প্রিয়। আমি সেই পোকা কী যে পছন্দ করি! পোকাটার নাম চিংড়ি মাছ।
আপনার সেই বোনের নাম কী স্যার?
হিশামুদ্দিন ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—তার নাম আমি তোমাকে বলব না। ওই নামটা অজানাই থাকুক। হাসান আজ আর কথা বলব না। কেমন যেন মাধা ধরে গেছে। আগামী সপ্তাহে আবার দেখা হবে।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তোমাকে টাকা-পয়সা ঠিকমতো দিচ্ছে তো?
জ্বি সার।
আচ্ছা ঠিক আছে।
হাসান তার কথা বলতে পারল না। হিশামুদ্দিন সাহেব যেখানে তাঁর গল্প থামিয়েছেন সেখানে হুট করে চাকরি চাওয়া যায় না।
হিশামুদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কেমন জানি অস্বস্তি লাগছে। বুকে চাপ ব্যথা বোধ হচ্ছে। লক্ষণগুলো পরিচিত। আবার ঠিক পরিচিতও নয়। শরীর খারাপের একটা লক্ষণের সঙ্গে অন্যটায় তেমন মিল থাকে না।
হিশামুদ্দিন নিজের শোবার ঘরে ঢুকলেন। বিছানায় কি খানিকক্ষণ শুয়ে থাকবেন? তার প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে না। বুকের ব্যাখােটা কমে গেছে। তবে মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ছে। মনে হয় চোখ সম্পর্কিত কোনো সমস্যা। কাল অনেক রাত জেগে কাগজপত্র দেখেছেন–চোখের ওপর চাপ পড়েছে। চশমাটা বদলানো দরকার, বদলানো হচ্ছে না। তাঁর পানির পিপাসা হচ্ছে। পানি দেবার জন্যে কাউকে বলতে হয়–এই পরিশ্রমটুকু করতে ইচ্ছা করছে না। খাটের পাশে কলিংবেলের সুইচ আছে, সুইচে হাত পড়লেই কেউ একজন ছুটে আসবে। তিনি বসেছেন সোফায়–কলিংবেলটা মনে হচ্ছে অনেক দূরে।
চিত্ৰলেখার সঙ্গে কথা বললে কেমন হয়? মেরিল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশের সময়ের ব্যবধান যেন কত? এই তথ্য তার জানা, তারপরেও চিত্ৰলেখার সঙ্গে কথা বলার সময় প্রতিবার নতুন করে জানতে হয়। দিনের শুরুতেই তিনি জানেন আজ কত তারিখ। তারপরেও প্রতিটি সিগনেচারের সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করতে হয়–আজ কত তারিখ।
বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সময়ের ব্যবধান কত? আট ঘণ্টা? রাত দুটোর সময়ে মেয়েকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার কোনো অর্থ হয় না। হিশামুদ্দিন সোফা থেকে উঠে খাটের দিকে গেলেন। খাটে হেলান দিয়ে সুইচ টিপলেন। মোতালেব উদ্বিগ্নমুখে ছুটে এলো। ঘরে ঢুকল না। দরজার পরদা সরিয়ে উঁকি দিল। হিশামুদিন সাহেব ঠিক বুঝতে পারলেন না, কী জন্যে মোতালেবকে ডেকেছেন। পানি দেবার জন্যে, নাকি কটা বাজে জানার জন্যে। তাঁর শোবার ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। ঘড়ির শব্দে তাঁর অস্বস্তি বোধ হয়। সময় জানার জন্যে তাকে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়।
কটা বাজে মোতালেব?
স্যার চারটা এখনো বাজে নাই। চা দিব?
না–আজ চা খাব না। তুমি টেলিফোন হ্যান্ডসেটটা নিয়ে এস।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
মোতালেব প্রায় দৌড়ে গেল। বাংলাদেশ-আমেরিকার সময়ের পার্থক্যটা জানা হলো না। চিত্ৰলেখা হয়তো ডরমিটরিতে নেই–ক্লাসে গেছে। টেলিফোন বেজে যাবে কেউ ধরবে না।
হ্যালো।
কেমন আছিস রে মা?
বাবা এক সেকেন্ড ধরে রাখ–আমি আসছি।
হিশামুদিন টেলিফোন ধরে আছেন। তার মাথার যন্ত্রণাটা এখন খুব বেড়েছে। এই যন্ত্রণা নিয়েই তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে মেয়ের সঙ্গে কথা বলবেন। এটাও এক ধরনের খেলা!
হ্যালো বাবা।
এক সেকেন্ডের জন্যে কোথায় গিয়েছিলে?
মাইক্রো আভেন বন্ধ করতে গিয়েছিলাম।
রান্নাবান্না?
ঠিক রান্নাবান্না না–ক্ষিদে লেগেছিলে। পিজা ‘থ’ করতে দিয়েছিলাম।
থ হয়েছে?
হুঁ। হয়েছে। আমি কপ কপ করে খাচ্ছি। শব্দ শুনতে পাচ্ছ না?
পাচ্ছি।
তোমার খবর কী বাবা?
খবর ভালো।
জীবনী লেখা হচ্ছে?
হুঁ।
যতটুকু লেখা হয়েছে পাঠিয়ে দিতে পারবে–এখন আমার একটা ফ্যাক্স নাম্বার আছে। নাম্বার দেব?
না।
না কেন?
সবটা লেখা হোক তারপর।
তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন বাবা?
কেমন শোনাচ্ছে।
মনে হচ্ছে তুমি অসুস্থ।
আমি সুস্থই আছি। তোর পড়াশোনার অবস্থা কী?
অবস্থা ভালো। এখন পর্যন্ত কোনো B পাই নি। স্ট্রেইট A।
ও আচ্ছা।
তুমি একটা শুকনা ও আচ্ছা দিয়ে সেরে ফেললে? ষ্ট্রেইট A যে কী ভয়াবহ জিনিস তুমি কি জান? আমি যখন করিডোর দিয়ে হাঁটি ছেলেমেয়েরা তখন অদ্ভুত চোখে তাকায়। বাবা এক সেকেন্ড ধরবে–আমি একটা কোকের ক্যান নিয়ে আসি।
হিশামুদ্দিন টেলিফোন ধরে রাখলেন। মাথার ব্যথাটা এখন আর নেই, তবে পিঠে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথার ব্যাপারটা কি সাইকোলজিক্যাল? মনস্তাত্ত্বিক ব্যথাই শুধু মিনিটে মিনিটে স্থান বদলায়।
বাবা।
কী মা?
কোকের ক্যান নিয়ে এসেছি এখন কথা বল।
কী কথা বলব?
কী কথা বলবে সেটা তুমি জান। আমি কী করে বলব।
তুই কথা বল আমি শুনি।
আমার কথা বলার হলে তো আমিই টেলিফোন করতাম। টেলিফোন তুমি করেছ। তুমি কথা বলবে। আমি শুনব।
আগের বার বলেছিলি ব্ৰাজিলের এক ছেলের সঙ্গে ভাব হয়েছে, সেই ভাব এখনো আছে?
ভাব হয়েছে এই কথা তো বাবা বলি নি–সে আমাকে ডিনার এবং মুভি দেখার জন্য ইনভাইট করেছিল আমি গিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর আবার কী?
একবারই গিয়েছিলি? আর যাস নি?
না। হাঁদা টাইপ ছেলে। চেহারা দেখে বুঝা যায় না। কিছুক্ষণ কথা বললেই টের পাওয়া যায়। ওর সঙ্গে কথা বলে আমার কী মনে হয়েছে জান?
কী মনে হয়েছে?
মনে হয়েছে–মানুষ বানর থেকে এসেছে ঠিকই। তবে সবাই পুরোপুরি মানুষ হয় নি। অনেকেই বানর রয়ে গেছে। হি হি হি।
এখন এমন কেউ নেই যার সঙ্গে ডিনার খেতে যাচ্ছিস বা মুভি দেখছিস?
উঁহুঁ। ইচ্ছে করে না। বাবা আমার কী ধারণা জান? আমার ধারণা পুরুষরা প্ৰাণী হিসেবে মেয়েদের অনেক নিচে। বুদ্ধিবৃত্তি লোয়ার লেভেলে। রাগ করেছ বাবা?
রাগ করব কেন?
তুমিও তো পুরুষ এই জন্যে হি হি হি।
কথায় কথায় হাসার অভ্যাস কি তোর এখনো আছে?
এটা তো বাবা কোনো খারাপ অভ্যাস না যে ছেড়ে দিতে হবে।
তা না।
তুমি যে বলেছ। আমার জন্যে ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের করবে যাকে আমি বিয়ে করব, খুঁজে পেয়েছ?
এখনো পাই নি।
খুঁজছি নাকি খোঁজা বন্ধ করে দিয়েছ?
খুঁজছি।
বাবা আমার পয়েন্টগুলো মনে আছে তো? ছেলেটির কী কী গুণ থাকতে হবে মনে আছে?
আছে।
বল তো শুনি।
লম্বা হতে হবে, গায়ের রঙ শ্যামলা, IQ থাকবে ১৬০-এর ওপরে, কথায় কথায় হি হি করে হেসে ওঠার ক্ষমতা থাকতে হবে, পড়াশোনায় খুব ভালো হতে হবে।
একটা পয়েন্ট বাদ গেছে বাবা।
কোন পয়েন্ট?
ঠোঁট মোটা হলে চলবে না, ঠোঁট পাতলা হতে হবে।
তুই কি এর মধ্যে দেশে বেড়াতে আসবি?
পাগল হয়েছ? আমার মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগলের অবস্থা। পড়াশোনার যে কী প্ৰচণ্ড চাপ তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না। এখন সবাই ঘুরে টুরে বেড়াচ্ছে আর আমি চারদিকে বই সাজিয়ে বসে আছি। তুমি টেলিফোন রাখামাত্র আমি ফার্মাকোলজির বই খুলে বসব।
তাহলে টেলিফোন এখন রাখি মা?
আচ্ছা।
হিশামুদ্দিন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। মোতালেব চা নিয়ে এসেছে। তিনি চা দিতে নিষেধ করেছিলেন তার পরেও এনেছে।
হিশামুদিন চায়ের কাপ হাতে নিলেন।