কলাবতীর শক্তিশেল (২০০৫)

কলাবতীর শক্তিশেল (২০০৫) – মতি নন্দী / প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৫ / আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা ৯ পৃ. ১১০। মূল্য ৭৫.০০ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কৃষ্ণেন্দু চাকী / উৎসর্গ: চিকিৎসক দম্পতি শান্তি ও গুরুসদয় ভট্টাচার্যকে। স্নেহ ও প্রীতি সহকারে।

কাঁকুড়গাছি উচ্চচমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্ল্যাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে স্কুলের মেয়েদের নিয়ে নানারকম অনুষ্ঠান করার কথা ভেবেছে মলয়া। সে এই স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। ভাবনাটা প্রথম সে জানায় ভূগোলের ব্রততী বেদজ্ঞকে। শুনেই পৌনে ছ’ফুট লম্বা, পঞ্চাশ কেজি ওজনের ব্রততী বলে উঠেছিল, ”দারুণ হবে বড়দি। বাইরের লোককে দিয়ে ফাংশন করানো আর স্কুলের মেয়েদের দিয়ে করানোয় অনেক তফাত। কত প্রতিভা এই স্কুলে আছে জানেন?”

মলয়া মাথা নেড়ে জানাল, জানে না।

”আমিও জানি না। সেটা জানার জন্যই ওদের দিয়ে এবার ফাংশন করুন। নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তি…” ব্রততী থমকে আইটেম খুঁজতে লাগল।

অন্নপূর্ণা পাইন ওদের কথা শুনছিল। সে যোগ করল, ”শ্রুতিনাটক, গীতিআলেখ্য, বৃন্দগান, সমবেত আবৃত্তি। এবারে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আমাদের হাউজি.ংয়ের মাঠে শ্রুতিনাটক হয়েছিল। কী বলব ব্রততীদি, কী ভাল যে হয়েছিল, কী হাততালি আর কী হাততালি!”

”কী শ্রুতিনাটক হয়েছিল?” ব্রততী জিজ্ঞেস করল।

”কচ ও দেবযানী।”

”কারা করল?” আবার জিজ্ঞাসা ব্রততীর।

”অনামিকা আর ওর বাবা। ওদের দিয়ে এটা করান না।” অন্নপূর্ণার স্বর আদুরে শোনাল।

অনামিকা অন্নপূর্ণার মেয়ে, এই স্কুলেই ক্লাস সেভেনে পড়ে। বয়স তেরো।

ব্রততী অবাক হয়ে বলল, ”ওইটুকু মেয়ে হল দেবযানী আর তার বাবা কচ? পারল করতে?”

”কেন পারবে না! অনামিকা তো আবৃত্তির কোচিং নেয় নবকুমার ঘোষের স্কুলে, হপ্তায় একদিন। নবকুমার খুব নামকরা আবৃত্তিকার। আমেরিকায় গিয়ে বাঙালিদের মুগ্ধ করে এসেছে।”

অন্নপূর্ণা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, মলয়া থামিয়ে দিয়ে বলল, ”ব্রততীদি, এটা খুব স্পর্শকাতর ব্যাপার। অনেকের অনেকরকম মত, ইচ্ছা থাকতে পারে। আমার মনে হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইটেম নির্বাচন করা উচিত। ভবিষ্যতে তা হলে সমালোচনা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।” এই বলে মলয়া তাকিয়ে রইল ঘরের অন্যান্যদের দিকে।

আরতি ঘটক, সদ্য বিয়ে হয়েছে, প্রায় দৌড়ে ক্লাসে আসে, ঘণ্টা পড়ে গেলেও পড়িয়ে যায়, মেয়েরা ঝালমুড়ি কিনে আরতির জন্যও এক ঠোঙা কেনে। এহেন ছাত্রীপ্রিয় আরতি বলল, ”গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটা কী বড়দি?”

”সবাইয়ের মতামত দিয়ে সিদ্ধান্তে আসা।”

অন্নপূর্ণা বলল, ”সবাইটা কে?”

মলয়া বলল, ”আমরা সব টিচার, গার্জেনরা, ম্যানেজিং কমিটির মেম্বাররা মিলে ঠিক করব। এজন্য একটা মিটিং ডাকতে হবে। ব্রততীদি, আপনি কনভেনর। একটা চিঠি ড্রাফট করুন, করে আমায় দেখান।”

আরতি বলল, ”ছাত্রীদের তরফে কেউ ওই মিটিংয়ে থাকবে না?”

মলয়া লজ্জিত স্বরে বলল, ”ইসস, ভুলেই গেছলুম, অবশ্যই থাকবে। অনুষ্ঠান তো ওরাই করবে। ব্রততীদি, টেন আর টুয়েলভ থেকে একজন করে থাকবে। কে থাকবে, সেটা আপনার বিবেচনামতো ঠিক করবেন।”

অসীমা দত্ত, যার স্বামী পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক কিন্তু নিজে রাজনীতির ধারেকাছে নেই, বলল, ”বড়দি এগারোশো মেয়ের এগারোশো গার্জেন—আপনি ক’জনকে ডাকবেন? প্রত্যেকের মতামত নিলে তো এগারোশো মতামত, পারবেন সামলাতে? তার চেয়ে বলি, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটা ঝুলি থেকে বের না করে ঝুলিতেই রেখে দিন। বেছে—বেছে কয়েকজন গার্জেনকে ডাকুন। গাজন নষ্ট হয় অধিক সন্ন্যাসীতেই। ভবিষ্যতে ঝামেলা পাকাতে পারে, এমন লোকেদেরই ডাকুন। আমি লিস্টি করে ব্রততীদিকে দোব।”

মলয়া বলল, ”আমি এক্ষুনি তোমায় একটা নাম দিতে পারি—সত্যশেখর সিংহ, কলাবতীর গার্জেন। এমন ঝামেলাবাজ লোক তুমি দুটি পাবে না।”

অসীমা বলল, ”আমিও একটা নাম দোব, পল্লবী গুহ।”

”ওহহো, সেই সমাজসেবিকা!” মলয়া প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ”গার্জেনস মিটিংয়ে যিনি মেয়েদের চরিত্ররক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। অবশ্যই ওঁকে চিঠি দেবে। অসীমা, তুমি কোনও নাম দেবে?’

গম্ভীরমুখে অসীমা বলল, ”মিস্টার দত্ত, আমার কর্তা।”

সবাই অবাক হয়ে তাকাল অসীমার দিকে।

”ওনাকে দূষণে পেয়েছে।” নির্বিকার স্বরে অসীমা বলল, ”শব্দদূষণ, দৃশ্যদূষণ, বায়ুদূষণ তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সংস্কৃতিদূষণ। ব্রততীদি, কী বলব আপনাকে, দুলু একটা রাহুল দ্রাবিড়ের রঙিন পোস্টার কিনে এনে বৈঠকখানার দেওয়ালে সেঁটেছিল। ঘরটা সদ্য সাদা রঙে পেন্ট করা হয়েছে। ওর বাবা ছবিটা খুলে দিল! বলল, ‘দৃশ্যদূষণ হচ্ছে। সাদা নির্মলতার প্রতীক, এই দেওয়ালে কোনও ছবি থাকবে না।’ শাশুড়ি কানে কম শোনেন, টিভি তাই একটু জোরে চালাতে হয়। ব্যস, সেটা হয়ে গেল শব্দদূষণ, ভলিউম কমাও। দরজা—জানলা বন্ধ করে মা এখন টিভি দেখেন।”

”আর বায়দূষণ?” অন্নপূর্ণার কৌতূহল উপচে পড়ল মিটিমিটি হাসিতে।

”কলকাতার বাতাসে অক্সিজেন কমে গেছে গাছ কেটে ফেলার জন্য। আর সেজন্যই বৃষ্টি হচ্ছে না, ফুসফুস আর হার্টের অসুখ বাড়ছে। গাছ লাগাও, যেখানে ফাঁকা জায়গা পাবে গাছের চারা বসাও। বাড়ির ছাদে এখন তেত্রিশটা টব, তাতে নয়নতারা, গাঁদা, জবা থেকে গোলাপ, বেল, এমনকী পালংশাকও। ছাদে পা রাখার জায়গা নেই। রোজ তেত্রিশটা টবে জল দেওয়া সোজা কথা। এম এল এ—বাড়িতে জলটা একটু বেশিই আসে, তাই রক্ষে।”

”সংস্কৃতিদূষণটা কী ব্যাপার?” মলয়া উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে বলল।

”এখুনি কাজটা করে ফেলতে হবে, এক সেকেন্ডও দেরি করা চলবে না। দেরি করলেই অপসংস্কৃতির ক্যাটিগরিতে সেটা পড়ে যাবে। তা হলেই সেটা হবে সংস্কৃতিদূষণ।”

”উনি এসব মেনে চলেন?” মলয়ার স্বরে সন্দেহ।

”চলতে চেষ্টা করেন খুব। এই তো গত রোববার, পাড়ার মাঠে ফুটবল ফাইনালে প্রধান অতিথি হয়ে গেছলেন ট্রফি দিতে। কার্ডে লেখা ছিল পাঁচটায় খেলা শুরু। পাঁচটা পাঁচ, তখনও দুটো টিম মাঠে নামেনি আর সভাপতিও এসে পৌঁছয়নি। উনি গটমট করে বাড়ি চলে এলেন। বললুম, ‘কী হল, কাপ শিল্ড না দিয়েই চলে এলে যে? বললেন, ‘কর্মসংস্কৃতির গোড়ার কথা সময় মেনে চলা, না চললে সেটায় দূষণ ছড়ায়। সেটাই বন্ধ করা দরকার, ওরা বুঝল কিনা জানি না।’ বড়দি, এই লোককে আগে ডাকুন, নইলে প্ল্যাটিনামকে ঝামেলায় ফেলে দেবে।”

”অবশ্যই।” এই বলে মলয়া ব্রততীর দিকে তাকাল। ব্রততী ঘাড় নাড়ল।

অন্নপূর্ণা বলল, ”আমাদের প্রণতি খুব ভাল নাচত, স্কুলে ঢুকে আর বিয়ে করে নাচ ছেড়ে দিয়েছে। ওকে বলুন না, ‘চণ্ডালিকা’ কি ‘তাসের দেশ’টা মেয়েদের দিয়ে করাতে। আমাদের অনেক মেয়ে তো খুব ভাল নাচে।”

মলয়া অবাক হয়ে বলল, ”প্রণতি নাচত? কই ওকে দেখে তো মনে হয় না! আচ্ছা,জিজ্ঞেস করব। ব্রততীদি, আর কাদের মিটিংয়ে ডাকা উচিত ঠিক করে একটা লিস্ট করে ফেলুন, খুব লম্বা লিস্ট যেন না হয়। আমি একটা চিঠি ড্রাফট করছি, সেটা জেরক্স করে কুরিয়ার মারফত পাঠাতে বৃন্দাবনবাবুকে বলে দেবেন।”

”কুরিয়ার কেন, ডাকে পাঠালেই তো হয়।” অসীমা বলল।

”ওই যে বললুম, ঝামেলা পাকাবার লোক সবাই। অন্তত একজন তো আছেই, বলে বসবে চিঠি পাইনি।”

”কে বড়দি, কে?” অসীমা বলল।

”নামটা তো আমি প্রথমেই বলে দিয়েছি, সত্যশেখর সিংহ, কলাবতীর কাকা।”

”আপনি চেনেন?” আবার অসীমার প্রশ্ন।

”হাড়ে—হাড়ে, সেই ছোটবেলা থেকে।”

মলয়া মুখটা কঠিন করে বুঝিয়ে দিল, আজকের মতো আলোচনা শেষ।

সত্যশেখর মেনে নিল সে ঝামেলাবাজ

কথামতো বৃন্দাবনবাবু কুরিয়ার মারফত সত্যশেখর, বলরাম দত্ত, পল্লবী গুহ, জনপ্রিয় গণসঙ্গীত গায়ক অরুণাচল সেনগুপ্ত এবং সিমেন্ট ব্যবসায়ী শিবশঙ্কর হালদারকে চিঠি পাঠালেন। সত্যশেখর বাদে এদের সবার মেয়ে এই স্কুলে পড়ে। ব্যারিস্টার সত্যশেখর অবিবাহিত। বাবা—মা মরা কলাবতীর একাধারে সে কাকা এবং প্রিয় বন্ধু। কুরিয়ারের লোক দুপুরে চিঠি দিতে যায় সত্যশেখরকে। তখন গৃহকর্তা, সত্তরোর্ধ্ব, বিপত্নীক, প্রাক্তন জমিদার কলাবতীর ঠাকুর্দা রাজশেখর ঘুমোচ্ছেন, সত্যশেখর কোর্টে, কলাবতী স্কুলে এবং মুরারী তাস খেলতে গেছে পাশের মালোপাড়ায়। বাড়িতে ছিল অপুর মা। যার পিতৃদত্ত নাম করুণাময়ী।

সদর দরজা খুলে অপুর মা দেখল একটা লোক, যাকে সে চেনে না। তাকে বলা আছে, দুপুরবেলা কোনও অচেনা লোক এলে দরজা খুলবে না। মুশকিল হয়েছে, দরজা না খুললে সে জানবে কী করে লোকটা চেনা না অচেনা। একটা আই—হোল দরজায় আছে বটে কিন্তু সেটা এমন উচ্চচতায় যে, সে ফুটোয় লাগানো কাচে চোখ লাগাতে পারে না।

”কী চান?”

”একটা চিঠি আছে সত্যশেখর সিনহার নামে। উনি আছেন?”

”ছোটকত্তা তো এখন কোটে। আপনি সন্ধেবেলায় আসুন।” ডাকাতটাকাত নয়, এটা অপুর মা বুঝে গেছে। তাই গলা অমায়িক করে বলল।

”আপনি চিঠিটা সই করে নিন।” বলল লোকটি।

মহা ফাঁপরে পড়ে গেল অপুর মা। কিন্তু এটা তো লোকটার কাছে ফাঁস করা যাবে না যে, সই করতে তার কষ্ট হবে।

”সইটই করাতে হলে সন্ধের পর আসুন। ছোটকত্তা তখন থাকবেন।”

”আপনিই রাখুন না সই করে।” লোকটি বলল।

কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে অপুর মা হাত বাড়াল, ”দিন।”

লোকটি একটা কাগজ আর ডটপেন এগিয়ে ঘরকাটা একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, ”এই জায়গায়, আর ফোন নম্বরটাও লিখে দেবেন।”

কাগজ—কলম হাতে নিয়ে অপুর মা এধার—ওধার তাকাল। কাগজটা রেখে সই করবে, এমন একটা উঁচু জায়গা খুঁজে না পেয়ে অবশেষে হাঁটু গেড়ে বসে মেঝেয় কাগজটা রেখে সেই ছোট্ট দেড় ইঞ্চি চৌকো জায়গায় কলম ঠেকিয়ে সে বিড়বিড় করে তার নামের বানানটা ঝালিয়ে নিতে লাগল। পাঠশালায় পড়ার সময় সে কোনওক্রমে ‘করুণাময়ী” লিখতে শিখেছিল। বাবা সাতকড়ি মোদক তখন বলেছিল, ‘অনেক শিখেছিস, আমাদের বংশের তুই প্রথম মেয়ে নিজের নাম লিখতে শিখলি। এবার রান্নাটা শেখ।’ তারপর চারটি দশক কেটে গেছে, অপুর মা শুধু হাতা আর খুন্তি ধরেছে, কলম ধরেনি। বাংলা হরফের চেহারাগুলোও এখন আর মনে নেই।

প্রথমে সে ‘ক’ লিখল। যেটা দেখতে ‘ফ’—এর মতো হল এবং চৌকো জায়গার অর্ধেকটা সেই ‘ফ’ দখল করে নিল। এরপর সে ‘র’ লিখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ‘র’—কে ‘রু’ করল এবং চৌকো ঘরটা এই দুটি অক্ষরেই ভরে গেল। ফ্যালফ্যাল করে কুরিয়ারের দিকে তাকিয়ে অপুর মা বলল, ”কী হবে! আর তো জায়গা নেই।”

কুরিয়ার অভিজ্ঞ লোক, হেসে বলল, ”ওতেই হবে। ফোন নম্বর কত?”

”তা তো জানি না। ফোন এলে ধরি, কথা বলি। কাউকে ডেকে দিতে বললে ডেকে দিই।”

”ঠিক আছে। চিঠিটা যার নামে, তাকে দিয়ে দেবেন।”

অপুর মা খামটা বিকেলে রাজশেখরের হাতে দিয়ে বলল, ”কত্তাবাবা, ছোটকত্তার এই চিঠিটা পিওন দিয়ে গেল দুপুরে, আমি সই করে নিয়েছি।” ‘সই’ শব্দটার উপর অপুর মা একটু বেশি জোর দিল।

সন্ধ্যাবেলায় সত্যশেখর চিঠিটা পড়ে কলাবতীকে ডেকে বলল, ”কালু, তোদের স্কুলের প্ল্যাটিনাম জুবিলি, তিনদিন ধরে চলবে অনুষ্ঠান। প্রোগ্রাম ঠিক করার জন্য গার্জেনদের মিটিং ডেকেছে মলু, রোববার বিকেল চারটেয়।”

”জানি। ছাত্রীদের তরফ থেকে আমি আর ধুপু মিটিংয়ে থাকব।”

”তা থাকিস, কিন্তু গার্জেনরা কেন? প্রোগ্রাম তো স্কুল—কমিটিরই ঠিক করার কথা।”

”ক্লাস সেভেনের অনামিকার কাছে শুনলুম, ওর মা অন্নপূর্ণাদি বাড়িতে বলেছেন, বড়দি চেয়েছেন সবার মতামত নিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুষ্ঠানের সূচি ঠিক করতে, যাতে ভবিষ্যতে ঝামেলা না হয় আর ঝামেলাবাজ লোক হিসেবে বড়দি প্রথমেই সত্যশেখর সিংহর নাম করেছেন। কাকা, এটা কিন্তু বড়দির খুব অন্যায় হয়েছে।” অভিমানে কলাবতীর গাল ফুলে উঠল।

”কিচ্ছু অন্যায় হয়নি, ও ছোটবেলা থেকে আমাকে চেনে এবং জানে।”

কলাবতী ভেবেছিল কাকা রেগে উঠবে, তার বদলে এমন ঠান্ডা নিশ্চিন্ত স্বরে বলল কিনা, বড়দি অন্যায় বলেনি। তার গালের অভিমান চুপসে গেল।

”চেনে, জানে বলে দিদিদের কাছে তোমাকে ঝামেলাবাজ বলে পরিচয় দেওয়াবেন? না কাকা, এটা বড়দির খুব অন্যায় হয়েছে, আমার গার্জেনকে অপমান করেছেন।”

”মলু যে একথা বলেছে, তার প্রমাণ তো মায়ের মুখে শোনা অনামিকার কথা?” এবার ব্যারিস্টার সত্যশেখরের গলা বেরিয়ে এল। ”অনামিকার মা অন্নপূর্ণাদি যদি বলে, আমি এসব কথা বলিনি এবং বলবেই, হেডমিস্ট্রেসকে কে আর চটাতে চাইবে, তা হলে তুই কিচ্ছু বলতে পারবি না তোর বড়দির এগেনস্টে। আমি বিশ্বাস করি, হান্ড্রেড পারসেন্ট করি, মলু আমাকে ঝামেলাবাজ বলেছে, বলার অনেক ভ্যালিড রিজ ন আছে, সেসব তুই জানিস না, জেনে কাজও নেই। যাই হোক, মিটিংয়ে আমি যাব। ওরা কী বলে শুনব, তারপর যা বলার বলব।”

জুবিলির জন্য গণতান্ত্রিক মিটিং

মিটিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে টিচার্স রুমে। যে ক’টা চেয়ার আছে তার সঙ্গে আরও কয়েকটি রাখা হয়েছে, দুটি টেবলও। স্কুল পরিচালন সমিতির প্রেসিডেন্ট পলাশবরণ ঘোষ বসেছেন ঘরের একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা একটি টেবলে। তার পাশের চেয়ারে হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখোপাধ্যায়, তার পাশে ব্রততী বেদজ্ঞ, তার সামনে টেবলে রাখা একটা নতুন খাতা, মলাটে মোটা অক্ষরে লেখা ‘প্ল্যাটিনাম জুবিলি প্রস্তুতি সভার কার্যবিবরণী ও অভিভাবকদের প্রস্তাবাদি।’

এদের উলটোদিকের দেওয়াল ঘেঁষে সারি দিয়ে রাখা অভিভাবকদের জন্য পাঁচটি চেয়ার ও একটি টেবল। একটি চেয়ার বাদে বাকিগুলি পূর্ণ। প্রেসিডেন্টের ডান দিকের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা চেয়ারগুলিতে বসেছে কয়েকজন শিক্ষিকা। ঘরের মাঝখানটা ফাঁকা। দরজায় টুলে বসে চতুরানন মিশির, হেডমিস্ট্রেসের খাসবেয়ারা। পাশের ঘরটা ক্লাস ফাইভ এ—ওয়ান। সেখানে দশটি কাচের গ্লাস, জলের ড্রাম ও একডজন সফট ড্রিঙ্কের বোতল নিয়ে বসে আছে টিচার্স রুমের তত্ত্বাবধায়িকা গিরিবালা ঢালি। ব্রততীর কড়া নির্দেশ তাকে দেওয়া আছে, ”বোতলের মিষ্টি জল শুধু বাইরের লোকেদের দেবে। কোনও দিদিকে নয়, এমনকী বড়দিকেও নয়, দু’জন ছাত্রীকেও নয়। ওদের জন্য শুধু ড্রামের খাওয়ার জল।”

গিরিবালা জানতে চায়, ”পেসিডেনবাবুকে মিষ্টি জল দোব তো?”

ব্রততী তিন—চার সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলে, ”দেবে, উনি বাইরের লোক।”

মলয়া ঘড়ি দেখল। চারটে বাজতে তিন মিনিট। একটা চেয়ার এখনও ফাঁকা। চেয়ারটা সত্যশেখরের জন্য। বাকিরা এসে গেছে। মলয়া হাতছানি দিয়ে কলাবতীকে ডাকল। কলাবতী বুঝে গেছে বড়দি কেন ডেকেছে। চেয়ার থেকে উঠে এসে সে মলয়ার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, ”সাড়ে তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে দাড়ি কামাতে বসল দেখে এসেছি। তারপর চা খাবে।”

”তারপর সাড়ে চারটের সময় হেলতে—দুলতে আসবে। সাধে কি বলি ঝামেলাবাজ।” ফিসফিস এবং কিড়মিড় করে মলয়া বলল।

”বড়দি আপনি অপেক্ষা করবেন না, ঠিক চারটের শুরু করে দিন।” কলাবতী নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল। ব্রততী ওদের কথা শুনছিল, সে মাথা নেড়ে অনুমোদন করল।

বলরাম দত্ত, এম এল এ, তিনিও ঘড়ি দেখছিলেন। বললেন, ”ম্যাডাম আর এক মিনিট, আশা করি ঠিক সময়েই সভা আরম্ভ করে কর্মসংস্কৃতি রক্ষা করবেন।”

”অবশ্যই।” গম্ভীর এবং কঠিন স্বরে মলয়া বলল।

মলয়ার দুটো গলা। একটা থেকে স্কুলে বেরোয় লিডস ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সায়েন্সের ডক্টরেট ছাপ লাগা ‘বড়দি’ গলা এবং স্কুল থেকে বেরোলেই অন্যটা থেকে বকদিঘির মুখুজ্জেবাড়ির মেয়ে, মিষ্টি নরম ভিতু—ভিতু ‘মলু’ গলা। দুটো গলাকেই কলাবতী চেনে ছোটবেলা থেকে।

”এবার আমাদের সভা আরম্ভ হচ্ছে।” স্কুলের সবচেয়ে সিনিয়র টিচার ব্রততী বেদজ্ঞ দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ”আমি প্রস্তাব করছি আমাদের স্কুলের প্রেসিডেন্ট, মানে ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্ট হাইকোর্টের জজ শ্রী…”

মলয়া ফিসফিস করে বলল, ”হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বলুন।”

”মার্জনা করবেন, হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, আমাদের প্রেসিডেন্ট শ্রী পলাশবরণ ঘোষ মহাশয়কে আজকের সভায় পৌরোহিত্য করার জন্য প্রস্তাব করছি।”

স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে উঠে অন্নপূর্ণা পাইন বলল, ”আমি এই প্রস্তাব সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি।”

অত্যন্ত মনোযোগে ব্রততী খাতা খুলে প্রথম প্যারাটি লিখে ফেলল। তারপর বলল, ”আমি এবার সভা পরিচালনার জন্য মাননীয় সভাপতি মহাশয়কে অনুরোধ জানাচ্ছি।”

অনুষ্ঠানসূচি লেখা একটা কাগজ ব্রততী এগিয়ে দিল সভাপতির দিকে। প্লাস পাওয়ারের চশমা চোখে লাগিয়ে তিনি কাগজে চোখ বুলিয়ে বললেন, ”এবার প্রধানশিক্ষিকা আজকের সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করাবেন।”

মলয়া গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করল, ”মাননীয় সভাপতি ও আমন্ত্রিত অভিভাবকরা, আমার সহকর্মী ও ছাত্রীরা, আপনারা জানেন আমাদের স্কুল পঁচাত্তর বছর পূর্ণ করবে সামনের জুলাই মাসে। এই পল্লির কয়েকজন শিক্ষাব্রতীর চেষ্টায়, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে, পল্লিবাসীর সক্রিয় সহযোগিতায় তেরোটি মেয়ে নিয়ে স্কুলের যে চারাগাছটি রোপিত হয়েছিল, আজ তা এগারোশো ছাত্রীর মহীরুহে পরিণত…”

ঠিক এই সময়েই কোমরে প্যান্টের বেল্ট আঁটতে—আঁটতে সাদা গেঞ্জি পরা, চোখে চশমা, আলুথালু চুলে, চটি পায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল সত্যশেখর।

মলয়া ভাষণ থামিয়ে তাকিয়ে রইল, সারাঘর হতভম্ব। আচমকা দীর্ঘদেহী, মোটাসোটা একটি লোক হঠাৎ ঘরের মধ্যে এসে পড়ায় সভা নির্বাক। সত্যশেখর বুঝতে পেরেছে সে বিদঘুটে একটা অবস্থা তৈরি করে ফেলেছে তাই বোকার মতো লাজুক হেসে বলল, ”একটু দেরি হয়ে গেল।”

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলরাম দত্ত বলল, ”তিন মিনিট দেরি হয়েছে।”

”তা হলে তো প্রায় ঠিক সময়েই এসে গেছি।” সত্যশেখরকে আশ্বস্ত দেখাল, ”নিন, এবার শুরু করুন।” খালি চেয়ারটা দেখে সে সেটায় বসল।

মলয়ার মুখ থমথমে। বক্তব্য পেশ করার মুখেই এমন একটা বাধা পেয়ে তার মেজাজ বিগড়ে গেছে। ভূমিকা বাদ দিয়ে সে সরাসরি বিষয়ে চলে গেল। ”আমরা ঠিক করেছি প্ল্যাটিনাম জুবিলি উৎসব তিনদিন ধরে করব। তিনদিন দীর্ঘ সময় আর তাতে খরচও বেড়ে যাবে।”

সমাজসেবিকা পল্লবী গুহ বলল, ”কত বাড়বে সেটা কি হিসেব করেছেন?”

”করিনি। তবে মোট কত খরচ করতে পারব তার একটা অ্যামাউন্ট আমরা আনুমানিক ধরেছি—পঞ্চাশ হাজার টাকা। স্কুল থেকে দিতে পারব তিরিশ হাজার, ছাত্রীদের কাছ থেকে দশ টাকা করে নিয়ে এগারো হাজার আর ডোনেশন—বিজ্ঞাপন থেকে দশ হাজার। এই টাকায় তিনদিন ধরে ফাংশন করা আমার মনে হয় সম্ভব নয়।”

জমি ও বাড়ির প্রোমোটার, সিমেন্ট ব্যবসায়ী শিবশঙ্কর হালদার বলল, ”পঞ্চাশ হাজারে তিনদিন?” হতাশায় মাথা নাড়ল। ”মেয়েদের একদিন তো ভাল করে খাওয়াবেন, তাতেই তো অর্ধেক টাকা চলে যাবে, তারপর আর্টিস্ট এনে জলসা, সিনেমা, থিয়েটার এসব করতে গেলে,” হাত নাড়তে—নাড়তে শিবশঙ্কর বলল, ”আরও দু’লাখ।”

ছাত্রী প্রতিনিধি ধূপছায়া এবার বলল, ”আমাদের ভাল করে না খাওয়ালেও চলবে। প্যাকেটে লুচি—আলুর দম বোঁদে দিলে সোনামুখ করে আমরা খাব।”

বলরাম দু’হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ”এই তো চাই। কবজি ডুবিয়ে মাংস—ভাত, কি বিরিয়ানি, এসব কী? এটা বিয়েবাড়ি না কালীপুজো? এঁটো কলাপাতা, হাড়গোড় ফেলে ছড়িয়ে পরিবেশদূষণ করা? না, না, ওই মেয়েটি ঠিক বলেছে, প্যাকেটের খাবার।”

শিবশঙ্কর হালদার এখনও হাল ছাড়েনি। বলল, ”আমার শালার কেটারিং ব্যবসা, তাকে বললে, থার্টি পারসেন্ট লেস করে দেবে। তা ছাড়া প্যাকেটে খাবার দেবেন, কিন্তু প্যাকেটগুলো এখানে—ওখানে ফেললে তাতে কি পরিবেশদূষণ হবে না?”

”ফেলবে কেন? বাড়ি নিয়ে যাবে।” বলরাম উত্তেজিত হয়ে গলা চড়াল।

মলয়ার মনে হল ব্যাপারটা বাগবিতণ্ডার দিকে গড়াচ্ছে। তাড়াতাড়ি সে বলল, ”খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা ফান্ডের অবস্থা বুঝে পরে আমরা ঠিক করব।”

ব্রততী ঝুঁকে খাতায় লিখে নিল। শিবশঙ্কর বলল, ”থার্টি পারসেন্ট নয়, লিখুন ফর্টি ফাইভ পারসেন্ট। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে লুচির সঙ্গে প্যাকেটটাও কি খেয়ে ফেলবে? ওটা তো ফেলতেই হবে, তাতে বোধহয় দূষণ হবে না।”

শিবশঙ্করের চিমটিটা বলরাম হজম করে নিল।

মলয়া বলল, ”আর কারও যদি কোনও প্রস্তাব থাকে, বলতে পারেন।”

”আমার একটা প্রস্তাব আছে।” পল্লবী গুহ গলা পরিষ্কার করার জন্য ছোট্ট করে কেশে নিয়ে বলল, ”পড়াশুনোয় এই স্কুল কলকাতার সেরা দশটা স্কুলের একটা। মাধ্যমিক—উচ্চচ মাধ্যমিকের রেজাল্টই তা বলে দিচ্ছে। পড়াশুনোর সঙ্গে অন্যান্য সামাজিক কাজ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো দরকার। সমাজের, দেশের মঙ্গল হয় এমন একটা কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন, যা অন্যান্য স্কুলকে ইনস্পায়ার করবে।”

সারাঘর কৌতূহলে উদগ্রীব। পল্লবী সেটা উপভোগ করে বলল, ”রক্তদান শিবির।”

সত্যশেখরের প্রবেশ দেখে যতটা হোঁচট খেয়েছিল সভা, এবার চিৎপাত হয়ে পড়ল।

এই প্রথম সত্যশেখর কথা বলল, ”বলেন কী! এই সব নাবালিকাদের শরীর থেকে রক্ত টেনে নেবেন? পুলিশে ধরবে যে!” দাঁড়িয়ে উঠে সে সভাপতির উদ্দেশ্যে বলল, ”ইওর অনার, এই প্রস্তাব অনৈতিক এবং আইনবিরুদ্ধ। কোনওমতেই এটা মানা যায় না।”

পলাশবরণ ঘোষ বহু বছর পর ‘ইওর অনার’ শুনে প্রসন্ন মনে বললেন, ”প্রস্তাব খারিজ।”

পল্লবী দাঁড়িয়ে উঠে তীব্র স্বরে বলল, ”এখনও আমার বক্তব্য পুরোটা শোনা হল না, তার আগেই খারিজ! এটা পুরো অগণতান্ত্রিক।”

সভাপতি বিব্রত হয়ে বললেন, ”আপনি আপনার বক্তব্য শোনাতে পারেন।”

”নাবালিকাদের রক্ত টানার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছা আমার নেই। তাদের অভিভাবকদের রক্ত নেওয়ার জন্য শিবির হোক। বাবা—মায়েরা স্বেচ্ছায় এসে রক্ত দিয়ে যাবেন, এটাই আমার প্রস্তাব।”

পল্লবী গুহ বসে পড়ে এক গ্লাস জল চাইল। মিশিরজি তাড়াতাড়ি টুলে বসা থেকেই চাপা গলায় ফাইভ এ—ওয়ান ঘরের দিকে মুখ করে বলল, ”গিরি, জল এক গ্লাস।”

গিরিবালা প্রস্তুত ছিল। দশ সেকেন্ডের মধ্যে জলভর্তি গ্লাস একটি প্লেটের উপর রেখে ঘরে ঢুকে সত্যশেখরের সামনে দাঁড়াল। তার মনে হয়েছে, আলুথালু চুল, গেঞ্জিপরা, মোটাসোটা লোকটিরই বোধহয় তেষ্টা পেয়েছে।

”আমাকে নয়, ওনাকে।” সত্যশেখর পাশে বসা পল্লবী গুহকে দেখাল। তারপর বলল, ”আমার রক্ত জল হয়ে গেছে ওনার প্রস্তাব শুনে।”

পল্লবী গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, ”জল নয়, জমাট বেঁধে বরফ হয়ে গেছে। এবার ওটা গলাবার জন্য চা খান।” বলেই এক চুমুকে গ্লাস খালি করে দিয়ে বলল, ”মাডাম কি চায়ের ব্যবস্থা রেখেছেন?”

ব্রততী তাড়াতাড়ি বলল, ”চা নয়, সফট ড্রিঙ্কস আছে। গিরি…।”

গিরিবালা দ্রুত ফাইভ এ—ওয়ানে ফিরে গেল।

পল্লবী গুহর প্রস্তাব শুনে সভা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল, তারপর ফিসফাস, তারপর আরতি ঘটক মুখ খোলে। ”ছাত্রীদের বাবা—মায়েরা হলে অবশ্য বলার কিছু নেই। তবে টিচাররা এতে অংশ নেবে না।”

সত্যশেখর বলল, ”কেন নেবেন না? তাঁরা তো নাবালিকা নন!”

”প্ল্যাটিনাম জুবিলিতে প্রত্যেকেরই অংশ নেওয়া উচিত। টিচাররা নিচ্ছেন, আশা করব গার্জেনরাও নেবেন। তাঁদের জন্য এই মহৎ কাজটি যদি বরাদ্দ করা হয় তা হলে তাঁদের মহানুভবতায় ভাগ বসিয়ে টিচারদের রক্ত দেওয়াটা উচিত হবে না। ঠিক কিনা?” অন্নপূর্ণা এই বলে তার সহকর্মীদের দিকে তাকাল, সকলের মাথা একদিকে হেলে পড়ল।

”রক্ত অভিভাবকরাই দেবেন, অবশ্য শিবির যদি স্থাপন করা যায়।” মন্তব্যটি অসীমা দত্তর।

তার স্বামী বলরাম এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবার মুখ খুলল, ”রক্ত দান—টান তো শুনলুম, কিন্তু পরিবেশদূষণ নিয়ে কতরকম প্রচার যে এলাকায় এই জুবিলি আর ছাত্রীদের মারফত করা যায়, সেকথা কি আপনারা ভেবেছেন? জুবিলি উৎসবকে স্রেফ নাচগান, নাটক আর জলসায় পর্যবসিত না করে সমাজ উন্নয়ন, সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধির একটা আন্দোলন গড়ার হাতিয়ার করে তোলা উচিত।”

কলাবতী ধূপছায়ার কানে ফিসফিস করে বলল, ”ভদ্রলোককে মনে হচ্ছে পলিউশনে পেয়েছে। আন্দোলন মানে স্কুলের মেয়েদের নিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে পদযাত্রা, নয়তো ঝাঁটা নিয়ে একদিন রাস্তা সাফ করা।”

”দেখি না আর কী বলেন, তারপর দূষণ আর রক্তদান কীভাবে হয় দেখা যাবে।” ধূপছায়া কথা শেষ করে দেখল, গিরিবালা দু’হাতে আঙুলের ফাঁকে কাগজের খড় ঢোকানো চারটে বোতল নিয়ে সেগুলো কাদের দেবে বুঝতে না পেরে ব্রততীর দিকে তাকিয়ে। ব্রততী সন্তর্পণে ডান হাতের তর্জনী তাক করে দেখাল সত্যশেখরকে। গিরিবালা সত্যশেখরের হাতে বোতল তুলে দিল। তর্জনী দু’ইঞ্চি ডাইনে সরল, বোতল পেল বলরাম, আরও দু’ইঞ্চি ডাইনে সরল তর্জনী, গণসঙ্গীত গায়ক অরুণাচল বোতল নিল, এরপর পেল পল্লবী গুহ। ব্যবসায়ী শিবশঙ্কর হালদার আর সভাপতি পলাশবরণ বাকি রয়ে গেছে। ব্রততী ‘ভি’ দেখাল গিরিবালাকে দুটি আঙুল তুলে। গিরিবালা ব্যস্ত পায়ে ফাইভ এ—ওয়ানে ফিরে গিয়ে দুটি—বোতল এনে তর্জনীর নির্দেশমতো শিবশঙ্করকে দিতে গেল।

”না, না, আমাকে নয়। ডায়াবিটিস আছে, ডাক্তারের বারণ।”

গিরিবালা নিরুপায় চোখে ব্রততীর দিকে তাকিয়ে বুদ্ধের বরাভয় দানের মতো ব্রততীর হাতের তালু দেখে বুঝল—থাক, দিতে হবে না। তারপরই সে দেখল তালু থেকে বুড়ো আঙুলটা বাঁ দিকে বেঁকে গেল। বাঁ দিকে বসে মলয়া, তার পাশে সভাপতি। গিরিবালা একটা বোতল মলয়ার সামনে রেখে বলল, ”বড়দি, আপনার।”

কথা ছিল বোতল পাবে শুধু বহিরাগতরা। বিব্রত মলয়া তাড়াতাড়ি বোতলটা পাশে সরিয়ে দিয়ে বলল, ”আপনি নিন। আমি পরে খাব।”

গিরিবালা বাকি বোতলটা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে, সত্যশেখর ডাকল, ”এই যে, ওটা দেখি।” হাত বাড়িয়ে বলল, ”একটা খেয়ে কি তেষ্টা মেটে!”

সফট ড্রিঙ্কস বিতরণ দেখে ধূপছায়া বলল, ”কালু, আমাদের দেবে না?”

”না, আমরা ভিতরের লোক। দেখলি না, বড়দি খেলেন না।”

”তোর কাকা কিন্তু দুটো খেলেন।”

”দুটো কেন, যে ক’টা আনানো হয়েছে সব খেয়ে নেবে যদি অফার করা হয়। তবে এখানে খাবে না, বড়দির ভয়ে। বাইরে নিলুর দোকানে ঠিক আরও গোটাচারেক খাবে।”

সবার বোতল শেষ হয়েছে দেখে মলয়া বলল, ”আমরা দুটো প্রস্তাব পেয়েছি। এবার আর কেউ কিছু বলবেন?”

গলা ঝেড়ে নিয়ে সত্যশেখর বলল, ”প্ল্যাটিনামের আগে নিশ্চয়ই ডায়মন্ড জুবিলি পনেরো বছর আগে হয়েছিল।”

এই স্কুলে তিরিশ বছরের শিক্ষিকা ব্রততী বলল, ”হয়েছিল।”

মলয়া তখন অসুস্থ ছিল, অনুষ্ঠানে আসতে পারেনি। কী হয়েছিল তা সে জানে না। তাই চুপ করে রইল।

সত্যশেখর আবার বলল, ”তখন কী প্রোগ্রাম হয়েছিল, সেটা যদি বলেন।”

”দুদিন ফাংশন হয়েছিল। সব কিছু ব্যবস্থা করেছিলুম আমরা টিচাররা, উঁচু ক্লাসের ছাত্রীরা আর ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন মেম্বার মিলে। প্রথম দিন উদ্বোধন করেন জ্যোতিবাবু। রাইটার্স থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে এসেছিলেন, সাত মিনিট ছিলেন। ছাত্রীরা নেচেছিল, কয়েকজন টিচার আবৃত্তি করেছিল…”

”বই দেখে না, না—দেখে?” কৌতূহলটা সত্যশেখরের বলাই বাহুল্য।

একটু কঠিন গলায় ব্রততী বলল, ”না দেখে। আমি আবৃত্তি করেছিলুম ‘দুই বিঘা জমি’—না দেখে। আর বক্তৃতা দিয়েছিলেন চব্বিশ বছর ধরে ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান শ্রীঅতুলকৃষ্ণ ঘোষাল। তাঁর বক্তৃতার আধঘণ্টার মাথায় হাততালি শুরু হওয়ায় তিনি বসে পড়েন। তিনদিন পর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন। আমরা ঠিক করেছিলুম তিনি পঁচিশ বছর চেয়ারম্যান থেকে সিলভার জুবিলি করলে তাঁকে সংবর্ধনা দেব, আমাদের সেই আশা পূরণ হয়নি।” আশা অপূর্ণ থাকার দুঃখে ব্রততীর গলা ধরে এল।

”অতুলকৃষ্ণবাবুকে তা হলে প্ল্যাটিনাম জুবিলির রিসেপশন কমিটির চেয়ারম্যান করে বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হোক।”

সত্যশেখরের প্রস্তাব শোনামাত্র ব্রততী খাতায় লিখে নিল।

”মিস্টার সিনহার কথামতো মাননীয় অতুলকৃষ্ণ ঘোষাল মশাইকে বিশেষ সংবর্ধনা দিতে পারলে আমাদের ভালই লাগত।” মলয়া মন্থর, ভারী গলায় বলল, ”কিন্তু গভীর পরিতাপের কথা, তিনি গতবছর পঁচানব্বই বছর বয়সে মারা গেছেন।”

”খুবই দুঃখের কথা। ওনার এই অকালমৃত্যুর কথা কালো, মোটা, চৌকো বর্ডার দিয়ে আপনারা যে সুভেনির নিশ্চয়ই বের করবেন, তাতে যেন ছাপা হয়। আর একটা কথা ম্যাডাম, আমি সিনহা নই, সত্যশেখর সিংহ, সিঙ্গিও বলতে পারেন।”

মলয়া কটমটে চোখে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ”ভুল শুধরে দেওয়ার জন্য সিঙ্গিমশাইকে ধন্যবাদ।”

”হেডমিস্ট্রেস বক্তৃতা দেননি?” আবার সত্যশেখর।

মলয়া ফিসফিস করে ব্রততীকে, ”বলেছিলুম ঝামেলাবাজ।”

”বড়দি তখন সদ্য স্কুলে জয়েন করেছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জায় শয্যাশায়ী, না হলে নিশ্চয় বক্তৃতা দিতেন। তবে এবার দেবেন।” ব্রততী জানিয়ে দিল।

”ক’মিনিট দেবেন, সেটা যেন ঠিক করে রাখেন।” বলল বলরাম দত্ত। তারপর যোগ করল, ”গার্জেনদের তরফে একজনকে যেন বলতে দেওয়া হয়।”

ব্রততী লিখে নিল। কলাবতীর ফিসফিস ধুপুর কানে, ”রেডি থাক, একটা পরিবেশরক্ষার ভাষণ শুনতে হবে।”

”হাততালি দেওয়ার রিহার্সালটা তা হলে তুইই অ্যারেঞ্জ করিস।” বলেই ধূপছায়া কাঠ হয়ে গেল, ব্রততী একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে।

”আর কী—কী হয়েছিল?” পল্লবী গুহ জানতে চাইল।

”অনেক কিছুই হয়েছিল। এখন আর সব মনে নেই।” ব্রততী মনে করার চেষ্টায় ভ্রূ কুঁচকে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ”মেয়েরা নাটক করেছিল ‘অবাক জলপান’। সুকুমার রায়ের লেখা। আর ফাইভের মেয়েরা সাঁওতালি নাচ নেচেছিল, খুব হাততালি পেয়েছিল। আলপনা দেওয়ার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। ইলেভেন বি—র মেয়েরা ফার্স্ট হয়েছিল। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝখান দিয়ে ওদের আঁকা আলপনা এক হপ্তা কেউ মাড়ায়নি,” ব্রততীর গলায় প্রচ্ছন্ন গর্ব।

গণসঙ্গীত গায়ক অরুণাচল মন্তব্য করল, ”আর্টের রিয়েল সমঝদারি একেই বলে।”

”ও হো হো, আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি,” ব্রততী মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতে তার লম্বা শরীরটা নুইয়ে জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো করে ফেলল, ”শেষ অনুষ্ঠান ছিল স্কুলের কম্পাউন্ডে সিনেমা শো। ‘শোলে’ দেখানো হয়। সে যে কী ভিড় হয়েছিল কী বলব, ছাত্রী আর গার্জেনরা মিলে হাজারখানেক তো হবেই, দাঁড়াবার জায়গা পর্যন্ত ছিল না। একটা মাত্র অঘটন দু’দিনের একেবারে শেষের এই অনুষ্ঠানে ঘটেছিল।” ব্রততী জল খাওয়ার জন্য সভাপতির সামনে রাখা জলের গ্লাসটা টেনে নিল। পনেরো বছর আগের ঘটনা মনে পড়াতেই বোধহয় গলা শুকিয়ে গেছে। এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে সে রুমালে মুখ মুছল।

”বাসন্তী যখন টাঙ্গা চালিয়ে গব্বরের লোকেদের হাত থেকে পালাচ্ছে, সবাই তখন টানটান কী হয়—কী হয়, আর ঠিক সেই সময়…” বাচ্চচাদের ভূতের গল্প বলার মতো গলায় ছমছমে ভাব এনে চার সেকেন্ড থেমে ব্রততী বলল, ”লোডশেডিং!”

”কী সব্বোনাশ!” আঁতকে উঠল অরুণাচল।

”আপনারা তখন কী করলেন?” সত্যশেখর উদগ্রীব পরের ঘটনা শোনার জন্য।

”আমরা সবাই দৌড়ে এই টিচার্সরুমে এসে দরজায় খিল আর ছিটকিনি তুলে দিলুম। মিশির আর দু’তিনজন টিচার বাইরে রয়ে গেছে, তারা দুমদুম করে দরজা ধাক্কাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। অন্নপূর্ণা ঘরের মধ্যে ‘হে মধুসূদন রক্ষা করো, ব্রততীদি দরজা খুলো না, পাবলিক ঢুকে পড়বে,’ বলে চেঁচাচ্ছে।”

অন্নপূর্ণা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, ”মোটেই আমি ‘দরজা খুলো না’ বলিনি। বাইরে কলিগরা বিপন্ন, তখন কি ওরকম কথা বলা যায়?”

”আপনি কি তখন দরজা খুলে দিয়েছিলেন?” ব্যারিস্টার জেরা শুরু করল।

”কী করে খুলব? অসীমা তো তখন দু’হাতে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে। ওর গায়ে তো জোর বেশি। অসীমা উঠে দাঁড়াও তো।”

অসীমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ”পনেরো বছরে দশ কেজি ওজন বেড়েছে। এখন দেখে মনে হবে আমার গায়ের জোর ওর চেয়ে বেশি। কিন্তু তখন ইচ্ছে করলেই অন্নপূর্ণা আমায় ঠেলে সরিয়ে দিতে পারত।”

অন্নপূর্ণা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে গণসঙ্গীত বলে উঠল, ”থাক এখন ওসব কথা, এবার বলুন লোডশেডিং হওয়ার পর পাবলিক কী করল।”

ব্রততী বলল, ”কী করবে আবার, চেয়ার ভাঙতে শুরু করল, সে কী আওয়াজ!”

সত্যশেখরের জেরা অব্যাহত বলল, ”ভাঙল মানে? নিশ্চয় কাঠের চেয়ার ছিল।”

ব্রততী বলল, ”স্টিলের চেয়ারের ভাড়া বেশি, তাই কাঠের…”

”ওইখানেই তো ভুল করেছিলেন।” গণসঙ্গীত বলে উঠল, ”বিয়ে কি বউভাত হলে কাঠের চেয়ার ঠিক আছে, কিন্তু বিনিপয়সায় সিনেমা দেখতে কি গান শুনতে আসে যখন, পাবলিকের মেজাজ তখন স্টিলের হয়ে যায়। দুটো পয়সা বাঁচাবার চিন্তা যদি মাথায় না রাখতেন, তা হলে ভাঙচুরটা হতে পারত না। গত মাসে ধপধপিতে শীতলাপুজোর একটা ফাংশনে গেছলুম। ঠিক আমারই প্রোগ্রামের সময় হল লোডশেডিং।”

”চেয়ার ভাঙাভাঙি হল তো?” বলরাম এবং পল্লবী প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল।

”ভাঙবে কী করে! সব তো লোহার চেয়ার। ওরা তো জানত লোডশেডিং হবেই। তখন কী কাণ্ড ঘটবে সেটা ওরাও যেমন জানত, আমিও তেমনি জানতুম। গাইছিলুম ‘ও আমার দেশের মাটি’, যেই না অন্ধকার হয়ে মাইক বন্ধ হল, সঙ্গে—সঙ্গে গলা ছেড়ে ফুলভলিউমে শুরু করলুম ‘কারার ওই লৌহকপাট।’ আড়াই—তিনহাজার লোক পিনড্রপ সাইলেন্ট। তবলচি চণ্ডী কাহারবা বাজাচ্ছিল, এবার যুদ্ধের ড্রামের মতো বাজাতে শুরু করল, জমে গেল আসর। শুধু ভয় ছিল ওই ‘লাথি মার ভাঙ রে তালা’ লাইনটা নিয়ে। ভাঙাভাঙির কথা শুনে জনগণের মনে বিদ্রোহের সুপ্ত বাসনা যদি সত্যি—সত্যি জেগে ওঠে, তা হলে তো লাথি মেরে চেয়ার ভাঙতে শুরু করবে। তখন কী করলুম বলুন তো?”

গণসঙ্গীত গায়ক সাত সেকেন্ড চুপ। সারা ঘর কৌতূহলে হাবুডুবু। সভাপতি ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে বলে ফেললেন, ”অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন, তাই তো?”

”আরে না না। সটকান দেবে অরুণাচল, তাই কখনও হয়। পঞ্চাশ হাজার লোকের মিটিংয়ে গেয়েছি, আর এ তো…” একটা তুড়ির শব্দ হল। ”খুব সিম্পল। একটা শব্দ বদলে দিলুম, লাথির জায়গায় ঘুঁষি বসিয়ে দিলুম। ঘুঁষি মেরে তালা ভাঙতে গেলে আঙুল ভেঙে যাবে, কেউ আর ভাঙাভাঙিতে গেল না। ওদিকে জেনারেটার চালু হয়ে গেছে। ফাংশনও শুরু হয়ে গেল।”

সত্যশেখর বলল, ”দারুণ উপস্থিত বুদ্ধি তো মশাই আপনার, উকিল হলেন না কেন? হেডমিস্ট্রেসকে অনুরোধ করছি, নোট করুন, চেয়ার রাখতে হবে লোহার আর জেনারেটরের ব্যবস্থা অতি অবশ্য চাই। কাগজে দেখলুম কোলাঘাটের তিনটে ইউনিট বসে গেছে।”

”ভাল সাজেশন দিয়েছেন মিস্টার সিঙ্গি,” মলয়া বলল।

”ধন্যবাদ।” বিনীত স্বরে বলল সত্যশেখর, ”আর একটা প্রস্তাব দোব। যদি সিনেমা দেখাতে চান, তা হলে এমন ফিল্ম বাছুন যা দেখে দর্শকরা উত্তেজনা বোধ করবে না, সফট, টেন্ডার, সেন্টিমেন্টাল এমন ফিল্ম।”

”এবং বাংলা বই।” এম এল এ বলরাম দত্ত এতক্ষণ চুপ করে থেকে হাঁপিয়ে যাচ্ছিলেন, ”বলিউডের হিন্দি বই আমাদের রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্রের বাংলায় যেভাবে সংস্কৃতিদূষণ ছড়াচ্ছে, একে প্রতিহত করতে হবে। না করলে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে না।”

ব্যবসায়ী শিবশঙ্কর বলল, ”এ ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের ফিল্ম দেখাতে পারেন, যেমন ‘দেবদাস’। হিন্দি নয়, বাংলা।”

সমাজসেবিকা পল্লবী তীব্র স্বরে আপত্তি জানাল, ”তা কী করে হয়? দেবদাস তো শুধু ড্রিঙ্ক করে, অল্পবয়সি মেয়েরা দেখে কী শিখবে?”

”ইসস, এটা তো মনে ছিল না।” শিবশঙ্করের দাঁত জিভে প্রায় বসে যাচ্ছিল, ”না, না, ‘দেবদাস’ স্কুলে দেখানো যাবে না। তা হলে বরং ‘বামাক্ষ্যাপা’, কী চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুঠ করার মতো ফিল্ম দেখানো হোক। আমি ক্যাসেট জোগাড় করে দোব।”

ভারী, গভীর গলায় অরুণাচল বলল, ”কোনও কন্ট্রোভার্সি হবে না যদি সত্যজিৎ রায় দেখান, ‘পথের পাঁচালি’ বা ‘গুগাবাবা’। এতে প্রেম নেই, মদ খাওয়া নেই, ক্লিন ছবি। ধর্মটর্ম, কি বিপ্লবের আদর্শ এখনকার ছেলেপুলেদের টানে না।”

কলাবতী ধুপুকে কানে—কানে বলল, ”শাহরুখের ‘দেবদাস’ দেখেছিস?”

”দেখেছি।”

”আমাদের কেবল টিভিতে দু’বার দেখিয়েছে, ফ্যান্টাস্টিক।”

মলয়া বলল, ”কী ফিল্ম দেখানো হবে, সেটা পরে ঠিক করা যাবে। তা যাই ঠিক হোক, হিন্দি নয়, আর ভায়োলেন্স থাকা চলবে না।”

”হাসি থাকা চলবে কি?” প্রশ্ন সত্যশেখরের।

”নিশ্চয় চলবে, হাসি অতি উপকারী জিনিস। আমাদের পাড়ায় হাসির ক্লাব খোলা হয়েছে,” গণসঙ্গীতের গলায় প্রচ্ছন্ন গর্ব। ”আমিও লাফিং ক্লাবের মেম্বার। রোজ সকালে মেম্বারদের সঙ্গে পনেরো মিনিট টানা হাসি। বলব কী, শরীর—মন তাজা, ঝরঝরে হয়ে যায়।”

”কীভাবে হাসেন, সেটা একবার দেখাবেন কি?” নিরীহ স্বরে বলল সত্যশেখর।

”না আ—আ—আ।” তীক্ষ্ন, উঁচু গলায় প্রায় ধমকের সুরে মলয়া শব্দটা করে কঠিন চোখে তাকাল সত্যশেখরের দিকে। কাঁচুমাচু ব্যারিস্টার অসহায় চোখে তাকাল ভাইঝির দিকে।

নিজের গলার স্বরে লজ্জা পেয়ে গেল মলয়া। আসলে বহুক্ষণ ধরে আজেবাজে ছেলেমানুষি কথাবার্তায় বিরক্ত বোধ করছিল। সভা ডাকার গুরুত্বটা কারও কথায় প্রকাশ না পাওয়ায় সে বুঝে গেল, পাঁচজনের মত নিয়ে সব কাজ করা যায় না। কিন্তু মাথা যে এতটা গরম হয়ে যাবে, সে বুঝতে পারেনি। লজ্জা ঢাকার জন্য সে নরম স্বরে বলল, ”কলাবতী, ধূপছায়া, তোমরা কিছু বলবে?”

ধূপছায়া দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ”বড়দি, মেয়েদের নিজেদের কিছু অনুষ্ঠান থাকা উচিত। বাইরের লোক এনে কিছু করলে লোকের ধারণা হবে এই স্কুলের মেয়েরা পড়া ছাড়া আর কিছুই পারে না। আমরাও যে অনেক কিছু পারি সেটা দেখাবার সুযোগ দেওয়া হোক।”

মলয়া তার হতাশা কাটিয়ে উঠে আগ্রহী স্বরে বলল, ”নিশ্চয় তোমরা অনুষ্ঠান করবে। কী করবে, সেটা ভেবেছ?”

কলাবতী বলল, ”আমরা সায়েন্স এগজিবিশন করব, নাটক করব।”

”শ্রুতিনাটক।” শিক্ষিকাদের একজন বলে উঠল।

কলাবতী বলল, ”নিজেরা নাটক লিখে নিজেদের পরিচালনায় অভিনয় করব।”

”’অবাক জলপান’ আবার করা যায়।” সত্যশেখর বলে উঠল।

”তা কেন! সুকুমার রায়ের তো আরও নাটক আছে, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ করা যায়।”

কলাবতী থামামাত্র মলয়া বলল, ”কিন্তু এই যে বললে, নিজেরা নাটক লিখে অভিনয় করবে?”

অপ্রস্তুত কলাবতী কথাটা শুধরে নেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বলল, ”’লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ই যে করব এমন কোনও কথা নেই। ওটা তো আশি—নব্বই বছর আগের লেখা, তাকে অবলম্বন করে আর একটা আধুনিক শক্তিশেল তো লেখা যায়।”

”কে লিখবে, তুমি?” মলয়া বলল।

”শুধু আমি কেন, সবাই মিলে লিখব।”

”বেশ। তবে মজাটা যেন থাকে।” মলয়া রাজি হয়ে গেল।

ব্রততী ঘাড় নিচু করে ঘসঘস করে লিখে নিচ্ছে। মলয়া ইশারায় মিশিরকে জানিয়ে দিল সফট ড্রিঙ্কস পরিবেশন করতে। মিশির চাপা গলায় নির্দেশ পাঠাল ফাইভ—এ—ওয়ানে। বোতল হাতে গিরিবালা ঘরে ঢুকতেই মলয়া সভাপতিকে কানে—কানে কী যেন বলল।

”ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলারা,” সভাপতি বলে উঠলেন, ”আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় যোগ দিয়ে সুচিন্তিত পরামর্শদানের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। আপনাদের সুপারিশ অবশ্যই বিবেচনা করবেন প্রধান শিক্ষিকা। প্ল্যাটিনাম জুবিলিকে সফল করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আপনাদের সক্রিয় সহযোগিতায় জুবিলি সার্থক হয়ে উঠুক, এই কামনা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। আজকের সভা এখানেই সমাপ্ত হল।”

এরপর হাততালি। মলয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ব্রততীর সভার কার্যবিবরণী লিখে যাওয়া তখনও চলছে। বাইরের আমন্ত্রিতরা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন কলাবতী বলল ধূপছায়াকে, ”ধুপু, নিলুর দোকানে চল। কাকা ঠিক হাজির হবে।”

প্রাক্তন বিচারপতিকে গাড়িতে তুলে দিয়ে মলয়া ফিরছিল, কলাবতীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিচুগলায় বলল, ”কাকাকে বোলো, ভদ্রলোকদের মাঝে যেতে হলে একটা জামা অন্তত গায়ে দিতে হয়।”

”বলব,” বাধ্য ছাত্রীর মতো কলাবতী মাথা হেলাল।

”কী বলবি রে কালু?”

”কাকাকে জামা পরতে।” হেসে ফেলে মাথার চুল ঝাঁকিয়ে কলাবতী বলল, ”আমার কাকাটা একটা ব্যোম ভোলানাথ, এটিকেটের ধার ধারে না, দেখলি না অত লোকের মধ্যে নির্বিকারভাবে গিরিমাসির কাছ থেকে কেমন বোতলটা চেয়ে নিল। দোষ শুধু একটাই ভীষণ পেটুক। তাই নিয়ে কম হাসাহাসি হয় বাড়িতে।”

স্কুলের ফটক পেরিয়ে দু’জনে নিলুর দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করল। ধূপছায়া বলল, ”খুব তো বলে দিলি আধুনিক শক্তিশেল লিখব, পারবি? কখনও নাটক লিখেছিস?”

”সেই জন্যই তো লিখব, আমার মধ্যে একজন নাট্যকার লুকিয়ে আছে কি না, সেটা তো জানতে হবে।” দাঁড়িয়ে পড়ল কলাবতী। একটু উত্তেজিত স্বরে সে যোগ করল, ”লেখার চেষ্টা না করলে সে খবরটা পাব কী করে? শুরুটা সবাইকেই তো একসময় করতে হয়, আমিও করব।”

”দারুণ একটা ডায়ালগ দিলি, আমার তো হাততালি দিতে ইচ্ছে করছে। তোর হবে, নাটক লেখা হবে। ওই দ্যাখ, কাকা নিলুদার দোকানে।”

দু’জনে এগিয়ে গেল সত্যশেখরকে দেখে।

”এসে গেছিস।” সত্যশেখর যেন জানত কলাবতী আসবে, ”নিলু দুটো বোতল দাও, কেমন মিটিং হল বল তো?” তারপর নিজেই উত্তর দিল, ”আরে দূর—দূর, এই নিয়ে কখনও মিটিং করে? মলুটার বুদ্ধিশুদ্ধি কোনওদিন ছিল না। আজও নেই। কী সব লোক ডেকে এনেছে! একজন বলল রক্তদান শিবির করতে, আর একজন বলল পরিবেশ আন্দোলন গড়ার হাতিয়ার করতে, আর একজন লোহার চেয়ার রাখতে আর একজন গুগাবাবা দেখাতে। আমি দেখলুম এভাবে চললে মিটিং আর শেষ হবে না, এটাকে ভণ্ডুল করে দেওয়া দরকার। আর তা করতে হলে চটিয়ে দাও মলুকে। দিলুম চটিয়ে। ব্যস খতম মিটিং।…আর একটা করে খা, আমিও খাই। নিলু, আর তিনটে।”

সত্যশেখরের শক্তিশেল ব্যাখ্যা

রাতে খাওয়ার টেবলে সত্যশেখর রাজশেখরকে বলল, ”জানো বাবা, কালু নাটক লিখবে।”

রাজশেখর রুটি ছিঁড়ে লাউঘন্ট দিয়ে পুঁটলি বানাচ্ছিলেন। চোখ বিস্ফারিত করে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”বটে! কী নিয়ে?”

”সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’—এর আধুনিক সংস্করণ। তাই তো রে, কালু?”

কলাবতী চামচে করে শুধুই লাউঘন্ট খাচ্ছিল, রুটি প্লেটেই পড়ে আছে। কাকার কথা যেন কানেই যায়নি, এমনভাবে সে পাশে দাঁড়ানো অপুর মাকে বলল, ”পিসি, ঘন্ট খানিকটা তুলে রেখো, কাল ভাত দিয়ে খেয়ে স্কুলে যাব। দারুণ হয়েছে।”

ঘন্টর পুঁটলিটা মুখে ঢুকিয়ে রাজশেখর বললেন, ”আধুনিক সংস্করণটা আবার কী? নাটকটা হবে কোথায়, করবে কারা?”

কলাবতী চুপচাপ খেয়ে চলেছে। সত্যশেখরই শেষ দুটো কৌতূহলের জবাব দিল, ”হবে কালুদের স্কুলের কম্পাউন্ডে। উপলক্ষ স্কুলের প্ল্যাটিনাম জুবিলি, করবে স্কুলের মেয়েরা। আরও অনেক কিছু তিনদিন ধরে হবে, তারই একটা এই নাটক।”

”ভাল কথা। তা সুকুমার রায়ের লেখাটাই তো করা যায়।”

আচমকাই কলাবতী প্রশ্ন করল, ”আচ্ছা দাদু, শক্তিশেল জিনিসটা কী?”

রাজশেখরকে অপ্রতিভ দেখাল। আমতা—আমতা করে বললেন, ”রামায়ণে অবশ্য এক্সপ্লেন করে বলা নেই। শক্তি মানে তো জানিসই, পাওয়ার, জোর, স্ট্রেংথ, আর শেল মানে…অপুর মা, চট করে বাংলা অভিধানটা নিয়ে এসো তো।”

দমবন্ধ করে বিস্ফারিত চোখে অপুর মা তাকিয়ে রইল।

”আনতে গেলে গোটা লাইব্রেরিটাই গন্ধমাদনের মতো নিয়ে আসবে। হনুমানের বিশল্যকরণী খোঁজা আর অপুর মা’র অভিধান খুঁজে আনা তো একই ব্যাপার,” সত্যশেখর তারিয়ে—তারিয়ে কথাগুলোকে লাউঘন্টর সঙ্গে মিশিয়ে বলল। তারপর যোগ করল, ”অপুর মা, অভিধানের বদলে বরং আর একটু ঘন্ট এনে দাও।”

হাঁপ ছেড়ে অপুর মা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছদ্ম কোপ দেখিয়ে কলাবতী বলল, ”কাকা, পিসিকে নিয়ে ঠাট্টা করবে না একদম। জানো, সই করে কুরিয়ারের কাছ থেকে চিঠি নিয়েছে। পিসি পূর্ণ সাক্ষর, লিটারেট। আচ্ছা তুমি বলো তো, শেল কথাটার মানে কী?”

সত্যশেখর পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ”কাশিপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির নাম শুনেছিস?”

”শুনেছি।”

”তা হলে শেল কথাটার মানে জিজ্ঞেস করছিস কেন? শেল মানে কামানের গোলা।”

”রামায়ণে কামানের গোলা।”

”এতে অবাক হওয়ার কী আছে? দু’চার হাজার বছর আগে সায়েন্সে আমরা কত অ্যাডভান্সড ছিলুম জানিস? পুষ্পক রথ, সেটা কী বল তো?” সত্যশেখর চোখ সরু করে রইল। পাঁচ সেকেন্ড পর বলল, ”স্যাবার জেট! অগ্নি বাণ, বরুণ বাণ, শব্দভেদী বাণ, এ সবই তো এখন রকেট, গ্রেনেড, এ কে ফর্টি সেভেন, স্টেনগান। তখনও শেল ছিল, এখনও বোফর্স কামানে সেটা ভরা হয়।”

”কাকা, আমরা যদি এতই অ্যাডভান্সড ছিলুম, তা হলে বিশল্যকরণীর মতো ক্যান্সারের ওষুধ বের করতে পারছি না কেন? হনুমান লাফ দিয়ে ভারত থেকে লঙ্কায় গেল, আর লং জাম্পে একটা অলিম্পিক মেডেল এখনও আমরা আনতে পারিনি।”

রাজশেখর ছেলে আর নাতনির ঝগড়া শুনতে শুনতে ধীরে—ধীরে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলেন। এবার বললেন, ”সতু, তুই কি সত্যি—সত্যিই বিলেত গেছলি? এখন আমার সন্দেহ হচ্ছে তোর কথা শুনে ব্যারিস্টারিটা সত্যিই পাস করেছিস কিনা।” কথা শেষ করে তিনি টেবল থেকে উঠে পড়লেন। তখনই লাউঘন্ট নিয়ে এল অপুর মা। সত্যশেখর ফ্যালফ্যাল করে বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেখছে।

”ছোটকত্তা, কতটা দোব?”

”সবটা।”

”কাকা, দাদু খুব চটেছে। স্যাবার জেটের পূর্বপুরুষ পুষ্পক রথ, অগ্নিবাণ থেকে আইডিয়া নিয়ে রকেট, এই সব গাঁজাখুরি থিওরি শুনলে আমিও তোমাকে কিন্তু অপুর মা আর বজরংবলীদের সঙ্গে এক দলে ফেলে দোব। দাদু তো অলরেডি ফেলেই দিয়েছে। দেখলে না, কীরকম থমথমে হয়ে গেল মুখটা।”

সত্যশেখরের গৌরবর্ণ মুখ থেকে রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। বাবাকে যেমন ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, তেমনি ভয়ও করে। ”তাই তো রে কালু, বাবা আমাকে যা বলল, তার মানে তো আমি অশিক্ষিত। তার মানে…”

টেবলে রাখা সেলফোনটা বেজে উঠল। সত্যশেখর তুলে নিয়ে প্রথমেই কে ফোন করছে তার নম্বরটা দেখে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ”মলু, এত রাতে!”

কলাবতীর কান খাড়া হয়ে উঠল। সে খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে বড়দি কেন ফোন করছে।

”হ্যাঁ বলো। …খাচ্ছিলুম। অপুর মা দারুণ একটা লাউঘন্ট করেছে উইথ চিংড়ি। কালু এখন আঙুল চাটছে…য়্যা? না, না, আমার গোটাদশেক হাওয়াই শার্ট আছে, তোমাকে আর কিনে পাঠাতে হবে না…একদম নয়। গেঞ্জি পরে মিটিংয়ে যাওয়াটা সিঙ্গিবাড়ির কালচার নয়, এটা তুমি ভালই জান। রোববার সব ভদ্রলোকই দুপুরে একটু ঘুমোয় … আমি কুম্ভকর্ণের মতো টানা ছ’মাস ঘুমোই তোমাকে কে বলল? ঘুম থেকে উঠেই মিটিংয়ে দৌড়ানো যায় না। একটু বিশ্রাম নিতে হয়, চা খেতে হয়।” এরপর কলাবতী দেখল কাকার মুখ লাল হতে হতে গম্ভীর হয়ে গেল।

”আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। বাবা বলল অশিক্ষিত, কালু বলল বজরং, তুমি বলছ কুম্ভকর্ণ, একমাত্র অপুর মা এখনও কিছু বলেনি। হয়তো বলবে ঘটোৎকচ।” বোতাম টিপে সত্যশেখর সেলফোনটা নামিয়ে রাখল।

”ওর হেডমাস্টারি স্বভাবটা আর বদলাল না।” এই বলে সত্যশেখর উঠে পড়ল, কলাবতীও।

বসার ঘরে কিছুক্ষণ টিভি দেখে কলাবতী শুতে যায়। তার আগে সে একবার দাদুর সঙ্গে দেখা করে। রাজশেখর এখন লাইব্রেরিতে। কলাবতী দরজায় উঁকি দিতেই তিনি বললেন, ”কালু শুনে যা, শেল কথাটার একটা মানে পেয়েছি অভিধানে।”

কলাবতী দেখল টেবলে গোটাতিনেক পাতা খোলা মোটা—মোটা বই। সে বুঝল, দাদু খুব গুরুত্ব দিয়েছে ‘শেল’ শব্দটায়। সে একটা চেয়ার টেনে বসল।

”সংস্কৃত শল্য থেকে শেল। তীক্ষ্নাগ্র দীর্ঘ অস্ত্রবিশেষ। এর থেকে খুব একটা ধারণা করা গেল না জিনিসটা কেমন ছিল।” রাজশেখর আর একটা বই টেনে নিলেন। ”এখানে বলছে, শ্বশুর ময়দানব শক্তিশেল তৈরি করে জামাই রাবণকে সেটা দেন। এতে আটটা ঘণ্টা বাঁধা আছে। বজ্রনিনাদী, মহাবেগবাণ এবং সর্পজিহ্বার মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরণকারী শত্রুশোণিতপায়ী অস্ত্র। এর আঘাতে রাবণ লক্ষ্মণকে ভূপাতিত করেন। ওষধি পর্বতের দক্ষিণ শিখর হতে বিশল্যকরণী, সাবর্ণকরণী, সঞ্জীবকরণী আর সন্ধানী এই চার প্রকার মহৌষধি আনতে গেলেন হনুমান, কিন্তু ওষধি খুঁজে না পেয়ে পর্বতের শৃঙ্গটিই উৎপাটন করে নিয়ে আসেন। সেই সব ওষধি আঘ্রাণ করালে লক্ষ্মণ নীরোগ হয়ে পুনর্জীবিত হন।” পড়ার চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে রাজশেখর বললেন, ”এই হল শক্তিশেল আর তার পরের ঘটনা। তুই যদি আরও কিছু জানতে চাস তা হলে বইটা নিয়ে যা। রাত্তিরে ঘুমোবার আগে রোজ একটু—একটু করে পড়িস। নাটক যে বিষয় আর ঘটনা নিয়ে, সেটা আগে ভাল করে জেনে নেওয়া উচিত।” রাজশেখর বইটা ঠেলে দিলেন কলাবতীর দিকে।

”দাদু, রাত্তিরে পড়ায় প্রধান বাধা পিসি। এগারোটা বাজলেই আলো নিভিয়ে দেবে।”

”কিছু একটা বলে ম্যানেজ করবি। আর একটা বই তোকে নাটক লেখার জন্য পড়তে হবে।”

রাজশেখর আলমারি খুলে বের করলেন মাইকেল মধুসূদন গ্রন্থাবলী। ধূসর মলাট, বইয়ের পাতাগুলো হলদেটে। কিছু পাতা খসে পড়েছে। এক সপ্তাহ বয়সি সন্তানকে মা যেভাবে ধরে, কলাবতী দেখল দাদু সেইভাবে দু’হাতে বইটি ধরে তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ”আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলুম। এর একটা ছোট অংশ আমাদের ম্যাট্রিকের বাংলা সিলেবাসে ছিল। ষাট বছর আগে পড়েছি এখনও ভুলিনি, শুনবি? মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞ করে যুদ্ধে যাবে। মন্দিরে যজ্ঞে বসার আগে তার কাকা বিভীষণ লক্ষ্মণকে গোপনে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন মন্দিরে। উদ্দেশ্য মেঘনাদকে হত্যা করা। ওই দু’জনকে মন্দিরের মধ্যে দেখে মেঘনাদ বলল …আমাদের বিষ্ণুহরিবাবু ক্লাসে এইভাবে বলেছিলেন …” কলাবতী দেখল দাদু চোখ বুজলেন, ”এতক্ষণে—অরিন্দম কহিলা বিষাদে;—জানিনু কেমনে আসি লক্ষ্মণ পশিল রক্ষঃপুরে। হায় তাতঃ, উচিত কি তব এ কাজ? নিকষা সতী তোমার জননী, সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ শূলিশম্ভুনিভ কুম্ভকর্ণ, ভ্রাতুষ্পুত্র বাসববিজয়ী। নিজগৃহ পথ তাতঃ দেখাও তস্করে? চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?” রাজশেখর চোখ খুলে বললেন, ”কালু, কী গ্রেস, কী ডিগনিটি। বাঙালি জীবনে তখন এটাই দরকার ছিল।”

রাজশেখরকে যেন ভূতে পেয়েছে। তিনি ষাট বছর আগে ফিরে গেছেন তাঁর কৈশোর জীবনে। সারাঘর গমগম করে উঠেছিল তাঁর গম্ভীর স্বরে। দরজায় এসে দাঁড়াল অপুর মা।

”কালুদি, কাল ইশকুল আছে, শোবে এসো।”

”কালু, শক্তিশেলের আগের ঘটনা জানা দরকার নাটক লেখার জন্য। কেন রাবণ শেল ছুড়েছিল সেটা পাবি এই মেঘনাদবধে। এখন শুতে যা।”

অ্যাক্টর সন্ধানে কলাবতী ও ধূপছায়া

ক্লাস টেন এ—ওয়ান সেকশনের দরজায় দাঁড়িয়ে কলাবতী অপেক্ষা করছিল ধূপছায়ার জন্য। ঠিক দশটা বাজতে দশে পিঠে বইয়ের বস্তা নিয়ে তাকে আসতে দেখে কলাবতী এগিয়ে গেল।

”পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্য, কথা আছে। এখন কার ক্লাস?”

”আরতিদির। জিওগ্রাফি!”

”ওঁকে তো বড়দি ভূগোল নিয়ে কী যেন ডিমনস্ট্রেট করে দেখাতে বলেছেন?”

”দেখাবেন নাকি চাঁদে মানুষের হাঁটা আর মাটির তলা থেকে কীভাবে কয়লা তোলা হয়। বি—টু থেকে সাত—আট জন লেগে পড়েছে। ল্যাবরেটরিতে টিফিনের সময় ওরা আরতিদির সঙ্গে কাজ শুরু করে দিয়েছে। কেমিস্ট্রির আর ফিজিক্সের কী সব এক্সপেরিমেন্ট দেখানো হবে। কিন্তু আমাদের নাটকের কদ্দূর?”

”অনেক দূর, নাটক তো হবে, কিন্তু অ্যাকটিং করবে কারা? সেটা আগে ঠিক করতে হবে তো? তুই ঠিক করার কাজটা নে।” কলাবতী হাতের খাতাটা খুলে একটা কাগজ বের করে ধূপছায়ার হাতে দিয়ে বলল, ”এতে সব লিখে দিয়েছি। চরিত্রের নাম আর কেমন মেয়ে চাই। তুই পড়ে নে আর টিফিনে কথা হবে।” কলাবতী এই বলে দ্রুত নিজের ক্লাসে চলে গেল।

টিফিনে ওরা দু’জন বসল কম্পাউন্ডে নিমগাছের নীচে সিমেন্টের বেদিতে। ধূপছায়ার হাতে কলাবতীর দেওয়া কাগজটা।

”রাম পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, ছিপছিপে, কণ্ঠস্বর মিষ্টি এবং ভরাট, একে কোথায় পাব এই স্কুলে?” ধূপছায়া অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। ”ছিপছিপে তো সবাই, কিন্তু ভরাট গলা আর পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি আমাদের ক্লাসে একটাও নেই। সব আমার মতো পাঁচ—দুই আর মিহি গলা, তুই রামটাকে একটু অন্যরকম করে দে, আর নয়তো নিজে কর।”

”আমি লিখব, ডিরেকশন দোব আবার অভিনয়ও করব, অত হয় না।”

”কেন হয় না? উৎপল দত্ত কি করতেন না?”

”সে উনি পারতেন।” কয়েক সেকেন্ড ভেবে কলাবতী বলল, ”রাম শেষ পর্যন্ত না পাওয়া গেলে তখন ভেবে দেখা যাবে। লক্ষ্মণকে খুঁজে বের কর। আর বাকি সব বোধহয় ক্লাসেই পেয়ে যাবি। একটা ঢ্যাঙা আছে তোদের ক্লাসে, ওকে বল।”

”সুগ্রীবের জন্য?”

”না, বিভীষণের জন্য। আমার নাটক হবে মেঘনাদবধ কাব্য অবলম্বনে। কীভাবে বধ হল সেটা জানিস? তবে শোন, লক্ষ্মণকে নিয়ে বিভীষণ চুপিচুপি পথ দেখিয়ে নিকুম্ভিলা উপবনে যাবে। সেখানে মেঘনাদ তখন যজ্ঞের জন্য মন্দিরে সবেমাত্র বসেছে। তার আগে একটা ব্যাপার তোর জেনে রাখা দরকার, মেঘনাদের নাম ইন্দ্রজিৎ হল কেন? জানিস কেন হল?”

”ইন্দ্রকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল বলে।” ধূপছায়া বুঝিয়ে দিল রামায়ণ তার পড়া আছে।

”হারিয়ে দিয়ে ইন্দ্রজিৎ কী করল তারপর?” উত্তরের অপেক্ষা না করে কলাবতী নিজেই বলল, ”ইন্দ্রকে বেঁধে লঙ্কায় নিয়ে আসে। দেবরাজের এরকম হেনস্থা দেখে দেবতারা ব্রহ্মাকে লিডার করে একটা ডেলিগেশন নিয়ে ইন্দ্রের মুক্তিভিক্ষা করতে আসে। ইন্দ্রজিৎ বলল আমাকে অমরত্ব বর দাও, তবেই ইন্দ্রকে ছাড়ব। ব্রহ্মা তাতে রাজি নন। বললেন অন্য বর চাও। তখন ইন্দ্রজিৎ বলল, যখন আমি অগ্নির পুজো করে যুদ্ধ করতে যাব তখন আমার জন্য অগ্নি থেকে ঘোড়াসমেত রথ উঠে আসবে, সেই রথে যতক্ষণ থাকব ততক্ষণ আমি যেন অমর হই। অগ্নিপুজোর জপ আর হোম আনফিনিশড রেখে যুদ্ধে গেলে তবেই আমাকে মারা যাবে, রাজি? ব্রহ্মা আর কী করেন, ইন্দ্রকে ছাড়িয়ে আনার জন্য তথাস্তু বলে তাতেই রাজি হয়ে গেলেন।”

”কী অবাস্তব আর গাঁজাখুরি ব্যাপার,” ধূপছায়া হেসে উঠল।

”আর হ্যারি পটারে এসব থাকলেই সেটা হয় দারুণ কল্পনা।” কলাবতীর স্বরে চাপা ব্যঙ্গ।

”তারপর কী হল বল।” ধূপছায়া তর্কে আর গেল না।

”কী আর হবে। মেঘনাদের আর যজ্ঞ করা হল না। অস্ত্র হাতে তো আর পুজো করতে আসেনি, তাই নিরস্ত্র লোককে লক্ষ্মণ খুন করে দিল। ছেলের এভাবে মৃত্যু হওয়ায় রাবণ খেপে গিয়ে যুদ্ধ করতে গেল। এলোপাতাড়ি রামের চ্যালাদের পিটিয়ে ছাতু করে হনুমানকে আর সুগ্রীবকে এমন ঠ্যাঙানি দিল যে, দু’জনই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পড়িমরি পালিয়ে বাঁচল। রাবণ তারপরই শক্তিশেল মেরে লক্ষ্মণকে শুইয়ে দিল। তারপর তো বানরদের কবিরাজ সুষেণ শেকড়বাকড় আনতে হনুমানকে পাঠাল গন্ধমাদন পাহাড়ে। হনুমান গাছপালা হাতড়ে চিনতে না পেরে পাহাড়ের মাথাটাই ভেঙে নিয়ে এল। তারপর…।”

টিফিন শেষের ঘণ্টা পড়ল। কলাবতী উঠে দাঁড়াল, ”এখন এই পর্যন্ত। তুই বরং রাতে টেলিফোন করিস। আমার ফর্দমতো এখন মেয়েদের পাস কিনা দ্যাখ।”

অন্নপূর্ণাকে টিচার্স রুম থেকে বেরোতে দেখে কলাবতী দোতলার সিঁড়ির দিকে ছুট লাগাল।

”এই যে কলাবতী,” অন্নপূর্ণা পিছু ডাকল। ”তোমার নাটকের কদ্দূর? কারা—কারা অভিনয় করবে সিলেক্ট করে ফেলেছ? অনামিকা কিন্তু ভাল অভিনয় করে, ওর দেবযানী তুমি তো শোননি?”

”অন্নপূর্ণাদি, এ নাটকে পাত্রপাত্রীরা সব রাক্ষস আর বানর, শুধু রাম লক্ষ্মণই মানুষ। এই দুটো ভূমিকায় একটু বড়, মানে লম্বা মেয়ে চাই।”

”ওমা, অনামিকা তো বেঁটে নয়। ও তো চার ফুট দশ ইঞ্চি। এই তোমার কাঁধের সমান।”

”অন্নপূর্ণাদি, আমি এখন যাই। অসীমাদির ক্লাস, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। লেখাটা হোক, তখন দেখা যাবে।”

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে কলাবতী লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গেল।

কলাবতীর মাথায় এল আধুনিক শক্তিশেল

”কালু, নাটকের কোন অঙ্কে পৌঁছলি?” রাজশেখর খাওয়ার টেবলে জানতে চাইলেন।

”অঙ্ক একটাই। পরদা টেনে শুরু, পরদা টেনে শেষ। বড়দি বলে দিয়েছেন এক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে। ওটাই শেষ প্রোগ্রাম।”

সত্যশেখর বলল, ”আধুনিক শক্তিশেল বলেছিলিস, মনে আছে? আধুনিক মানে এখনকার ব্যাপার। করবে তো স্কুলের মেয়েরা। সবারই এই প্রথম অভিনয়, তোরও। ভাল করে রিহার্সাল দিয়ে তৈরি না করালে কিন্তু গুবলেট হয়ে যাবে।”

”দাদু, আমি ভাবছি রিহার্সালটা স্কুল ছুটির পর আমাদের ছাদে করব।”

সত্যশেখর বলল, ”আমাদের ছাদে কেন? স্কুল থেকে এতদূর এসে করার চেয়ে স্কুলেরই একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে তো করা যায়। তোদের টিচার্স রুমটা তো বেশ বড়। তাছাড়া রিহার্সালের একটা খরচ আছে। সেটা তো স্কুলকেই দিতে হবে।”

”ব্রততীদি বলে দিয়েছেন প্রতিদিনের জন্য দশ টাকা। তার বেশি দরকার হলে নিজেরা চাঁদা তোলো।”

ভুরু কপালে তুলে সত্যশেখর বলল ”দ—অ—অ—শ টাকা, বলিস কী রে! বনধ ডাক, অবরোধ কর। অতগুলো মেয়ে, স্কুলের ছুটির পর খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করবে, তখন চেঁচিয়ে পার্ট বলবে? কালু, বলে রাখছি খাবার ব্যবস্থা কর, নয়তো দেখবি একটা—দুটো করে রোজ মেয়ে কমে যাবে। আচ্ছা, কখন থেকে বসে আছি অপুর মা তো খেতে—টেতে দিল না। ব্যাপার কী!”

মৃদু হেসে রাজশেখর বললেন, ”দুপুরে টিভি—তে রান্না শেখাচ্ছিল। অপুর মা আর মুরারি বসে—বসে দেখেছে। ‘বাদশাহি চানা গোস্ত কা খুল্লাম খুল্লা’। দেখে অপুর মা বলল ‘হেঃ, এই রান্নার জন্য এত বাসনকোসন, কায়দাকানুন আর বকবক? মুরারিদা বাজার থেকে মাংস, টকদই, কিসমিস, গরম মশলা আর কাবলে ছোলা এনে দাও তো। ওর চেয়ে ভাল খুল্লা খুল্লা ঘুগনি আমি রেঁধে দোব।’ মুরারি বাজার থেকে ফিরল সন্ধেবেলায়। বাগমারিতে বিকেলে বাস চাপা, তারপর বাসে আগুন, রাস্তা অবরোধ, পুলিশ, লাঠি আর গুলিও। মুরারি আটকে পড়েছিল, তাই রাঁধতে দেরি হচ্ছে, একটু অপেক্ষা কর। কালু ততক্ষণে কাকাকে কিছু খেতে দে। কোর্ট থেকে ফিরে তো খানকয়েক পরোটা আর আলুর দম ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি।”

সত্যশেখর ব্যস্ত হয়ে বলল, ”না, না, এখন আমাকে কিছু খেতে দিতে হবে না, কালু তুই বোস। বরং বল তোর আধুনিক নাটকে কী কী থাকবে? রামায়ণের গল্প, রাম—রাবণের একটা যুদ্ধু দেখিয়ে দে। মালোপাড়ায় শেতলাপুজোয় যাত্রা হত। মুরারির সঙ্গে চুপিচুপি একবার দেখতে গেছলুম। বর্গী ভাস্কর পণ্ডিতের সঙ্গে জমিদার ভৈরব রায়ের সে কী তরোয়ালের লড়াই। বাঁয়াটা ড্রামের মতো বাজছে, ক্ল্যারিওনেটে মার্চের সুর আর ঝাঁঝরটা ঝম করে উঠছে মাঝে—মাঝে। এই দ্যাখ, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।” সত্যশেখর বাঁ হাত বাড়িয়ে দিল কলাবতীর দিকে। ”তুই বরং একটা তরোয়ালের লড়াই রাখ। লক্ষ্মণ ভার্সাস রাবণ কিংবা কুম্ভকর্ণের সঙ্গে সুগ্রীবের।”

”কাকা, রামায়ণে মেজর লড়াইগুলো হয়েছিল তির—ধনুকে আর শক্তিশেলটা তরোয়াল নয়। দাদু, পৌরাণিক কাহিনীতে গদা আর তিরই তো প্রধান অস্ত্র ছিল?”

”তা বলতে পারিস। তবে সতু যা বলল, রোমহর্ষক কিছু রাখলে নাটক জমে যায়। বছর ষাটেক আগে আমার ছোটবেলায় স্টার থিয়েটারে নাটক দেখেছি পৌরাণিক কাহিনি। তাতে শনির দৃষ্টিতে ভস করে গণেশের মুণ্ডু ভস্ম হয়ে যাওয়া দেখায়। স্টেজের পিছনে একটা পরদায় ফুটে উঠল বিশাল দুটো চোখ আর সঙ্গে সঙ্গে গণেশের মুণ্ডুটা ভ্যানিশ হয়ে ধোঁয়া উঠল। পার্বতী তো কান্নাকাটি শুরু করলেন। বিষ্ণু তখন স্টেজের মধ্যিখান থেকে সুদর্শন চক্রটা ছুড়লেন, সেটাই উইংস দিয়ে উড়ে গেল। তারপর একটা হাতির মাথা ভেসে এল। বিষ্ণু সেটাই শিশু গণেশের গলায় জুড়ে দিলেন।”

কলাবতী অবাক হয়ে বলল, ”দাদু, এ তো ম্যাজিক!”

রাজশেখর বললেন, ”আমার এখনও মনে আছে সমুদ্র মন্থন দেখেছিলুম। ঠিক ওইভাবে স্টেজের পিছনে পরদায় দড়ির মতো বাসুকিকে মন্দার পর্বতে পেঁচিয়ে টানাটানি করায় তার মুখ থেকে বেরোল কালকূট বিষ। তার গন্ধে ত্রিলোক মূর্ছিত হলে ব্রহ্মা অনুরোধ করলেন মহাদেবকে সেই বিষ পান করার জন্য। তারপর কী দেখলুম জানিস? স্টেজ অন্ধকার হয়ে গেল আর মহাদেব নিচু হয়ে আঁজলা ভরে সেই বিষ তুললেন, দেখলুম তাঁর দু’হাতের আঁজলার মধ্যে দপদপ করছে একটা নীল আলো। সেটা মুখে দিলেন, গলাটা নীল হয়ে গেল। বিষটা ওখানেই রইল, তার মানে নীল আলোটা গলায় আটকে রইল। মহাদেব হলেন নীলকণ্ঠ। সে যে কী অবাক কাণ্ড, থ্রিলিং! এইরকম কিছু যদি তোর আধুনিক নাটকে রাখতে পারিস, তা হলে লোকে তোকে মনে রাখবে। তবে এসব দেখাতে হলে টাকার দরকার। পাবলিক স্টেজে ষাট—পঁয়ষটি বছর আগে হাউসফুল হয়ে যেত প্রতি শো—এ। গ্রাম থেকে দল বেঁধে লোকেরা আসত থিয়েটার দেখতে, থিয়েটারের তখন টাকা ছিল।” রাজশেখরের কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

সত্যশেখর বলল, ”রিহার্সালের জন্য দশ টাকা যেখানে বরাদ্দ সেখানে আর কী আশা করো, কালু কি সমুদ্র মন্থনের মতো হনুমানের সমুদ্র লঙ্ঘন দেখাতে পারবে? কালু একবার দ্যাখ না, অপুর মা—র খুল্লা খুল্লা ঘুগনির কতদূর।”

কলাবতী চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছে, তখনই ট্রে হাতে অপুর মা, তার পিছনে মুরারি খাওয়ার ঘরে ঢুকল। ট্রে থেকে চিনামাটির বৌলটা টেবলে রেখে অপুর মা বলল, ”এই হল আমার খুল্লা খুল্লা ঘুগনি। কত্তাবাবা, আপনি আগে খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে।”

মুরারি দিস্তা করা রুটির প্লেট টেবলে রেখে বলল, ”এই খুল্লা খুল্লা ঘুগনি অপুর মা অদ্ধেক টিভি থেকে আর অদ্ধেক ওর বাবার কাছ থেকে শেখা রান্না মিশিয়ে নতুন একটা জিনিস বানিয়েছে।”

রাজশেখর বললেন, ”তুই খেয়ে দেখেছিস?”

”খানিকটা চাখতে দিয়েছিল। গন্ধটা শুঁকুন, টেস করে দেখুন।” মুরারির জিভে উৎসাহ ঝরছে। সত্যশেখর ইতিমধ্যেই চোখ বুজিয়ে ফেলেছে। কলাবতী জানে, অত্যন্ত উপাদেয় কিছু খাদ্য খাওয়ার আগে কাকা চোখ বুজে খাদ্যটিকে ঈশ্বরজ্ঞানে ধ্যান করে আধমিনিট (‘বুঝলি কালু, এতে জিভের প্রত্যেকটা কোষ জাগ্রত হয়ে চনমন করে ওঠে’), তারপর গন্ধ শুঁকে চোখ খোলে।

অপুর মা ইতিমধ্যে বাটিতে তার ‘খুল্লা খুল্লা’ তুলে রাজশেখরের সামনে রেখেছে।

”বাবা গন্ধটা কেমন খুলেছে বলো?” সত্যশেখরের নাক ফুলে উঠেছে।

রাজশেখর একচামচ মুখে দিলেন। কপালে ভাঁজ পড়ল। অপুর মা উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে। কপালের ভাঁজ সমান হল। ”এ তো দ্রৌপদীর হাতে রাঁধা ঘুগনি রে সতু, খেয়ে দ্যাখ।” রাজশেখর এই বলে রুটি ছিঁড়লেন।

দশ মিনিট পর শূন্য বৌলটার দিকে তাকিয়ে সত্যশেখর বলল, ”একটু তাড়াতাড়িই মনে হচ্ছে খেলুম।” তারপর গলা নামিয়ে বলল, ”অপুর মা কি আমায় ঘটোৎকচ মনে করছে?”

”না। বরং তোমার খাওয়া দেখে খুশিই হচ্ছে। রান্না নিমেষে উড়ে গেলে রাঁধুনিরা খুশি হয়, কাকা আমার নাটকে ঘটোৎকচকে আনব।”

”সে কী করে! রামায়ণে কিনা মহাভারতের ক্যারেকটার?” রাজশেখর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

”দাদু এটা হবে আধুনিক লক্ষ্মণের শক্তিশেল। পৌরাণিকে আর আধুনিকে মিলেমিশে একাক্কার হয়ে যাবে। চারিদিকে কত ঘটোৎকচ আর কুম্ভকর্ণ টিভিতে আর খবরের কাগজে কিলকিল করছে, তারই দু’টোকে নাটকে ছেড়ে দোব।” বলতে—বলতে সে আনমনা হয়ে আঙুল চাটতে শুরু করল।

তাই দেখে অপুর মা বলল, ‘কালুদি, আর একটু খাবে? এনে দোব?”

”আরও আছে নাকি?” সত্যশেখর অকালে ঘুম ভাঙানো কুম্ভকর্ণের মতো ধড়মড়িয়ে উঠে বলল, ”তা হলে আমাকে আর একটু।”

”আমাকেও।” রাজশেখর বললেন।

কলাবতী অন্যমনস্কের মতো উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে ঘরে এসে সাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজ নিয়ে টেবলে বসল। মাথা নামিয়ে একমনে লিখে যেতে থাকল। মনের মধ্যে ভেসে ওঠা কথাগুলো চেতনার তলে ডুবে যাওয়ার আগেই সে অক্ষরের জাল দিয়ে তাদের তুলে কাগজের উপর ধরে রাখতে চেয়ে কলমটাকে দ্রুত চালাতে লাগল। কিছুক্ষণ পর অপুর মা এসে বলল, ”তোমার ফোন, ধূপু করেছে।”

”একমিনিট, ধরে থাকতে বলো।” মুখ না তুলে কলমের গতি বাড়িয়ে সে বাক্যটি সম্পূর্ণ করে বসার ঘরে এসে ফোন ধরল।

”বল।”

”আমার ক্লাস, আর নাইন—এ সেকশনে গিয়ে বললুম কে—কে অভিনয়ে করতে চাও। সবাই হাত তুলল। আমি চাই, আমি চাই, বলে চেঁচামেচি এমন জুড়ে দিল যে, মনে হল যেন পাঠশালায় লজেঞ্জস বিলোতে এসেছি। আমার ক্লাসে বিয়াল্লিশ আর নাইন—এ—তে ছেচল্লিশ মোট অষ্টআশি কিন্তু দরকার তো বানরসেনা সমেত বারো—তেরো জন। আমার ক্লাস থেকে রাবণ পেয়েছি, সঞ্চারী পাল, বেশ লম্বা, মোটা—মোটা হাত, গলাটাও অনেকটা হাড়ির মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে কথা বললে যেমন শোনায়, তেমনি। একজন বলল ক্লাস এইট—এ—তে একটা মেয়ে আছে, রবিনা নাম, রাবণের মতো লম্বা—চওড়া তবে খুব মিনেমিনে গলা, রামের জন্য মানাবে। ওকে বলে দেখব। বিভীষণ, সুগ্রীব ক্লাস নাইনে আছে, শুধু তোর ফর্দমতো হনুমানটাকে পাইনি এখনও। কাল স্কুলে আয়, তোকে রাম—রাবণ দেখাব।”

”ধূপু, মেঘনাদের কী হবে? খুঁজে বের কর। আর শোন, নাটকে থাকবে কুম্ভকর্ণ আর ঘটোৎকচ। দু’টো খুব রোগা মেয়ে বের কর।”

”কালু, ওরা তো রাক্ষস, ভয়ংকর বিরাট চেহারা!”

”সেকালের রাক্ষসরা একালে রোগা—প্যাংলা হয়ে গেছে। যদি তেমন চেহারার না পাওয়া যায় তো, তুই আর আমিই করব। কাল একটু তাড়াতাড়ি স্কুলে আয়, আমি গেটে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকব।”

ফোন রেখে কলাবতী ঘরে এসে দেখল, অপুর মা খাটের পাশে মেঝেয় বিছানা পেতে শোওয়ার তোড়জোড় করছে।

”কালুদি, শুয়ে পড়ো কাল ইশকুল আছে।”

”না পিসি, আমার পরীক্ষা সামনে, ভৌতবিজ্ঞানের কিছু তৈরি হয়নি, আজ রাতে এই চ্যাপ্টারটা শেষ করতেই হবে। তুমি ঘুমোও।”

”আবার পরীক্ষা? এই তো সেদিন একটা পরীক্ষা দিলে, আবার? ভূতটুত নিয়ে কি রাত্তিরে না পড়লেই নয়?”

হনুমান খুঁজে পাওয়া গেল

ধূপছায়ার অপেক্ষায় স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে কলাবতী। মেয়েরা, শিক্ষিকারা স্কুলে ঢুকছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে দু’টো কথাও বলছে।

”কলাবতীদি তুমি নাকি নাটক লিখছ, জুবিলি ফাংশনের জন্য?”

”হ্যাঁ।”

”আমাকে একটা পার্ট দাও না, দেবে?”

”তুই কাঁদতে পারবি?”

”হ্যাঁ—অ্যা—অ্যা।” মাথাটা হেলিয়ে দিল মেয়েটি।

”ধূপছায়ার কাছে নাম দিয়ে আসিস। চিনিস তো ওকে?”

”হ্যাঁ—অ্যা—অ্যা।”

মেয়েটিকে দেখে কলাবতীর মনে হল, লক্ষ্মণ শক্তিশেলের আঘাতে মূর্চ্ছা যাওয়ার পর তাকে ঘিরে যে সব বানর কান্নাকাটি জুড়বে তাদের একজন হতে পারে।

”কলাবতী, দাঁড়িয়ে কেন? নাটকের খবর কী? আমরা কিন্তু অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি। কী লেখো দেখার জন্য। আমাদের মেয়ের লেখা, আমাদের মেয়েরাই অভিনেতা—অভিনেত্রী, এই স্কুলের পঁচাত্তর বছরের ইতিহাসে এই প্রথম।”

”ব্রততীদি, অভিনেতা কেউ নেই, সবাই অভিনেত্রী।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বটে।” ব্রততী ঘড়ি দেখল। ”যাই।” দু’পা গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ”আর শোনো, তোমাদের রিহার্সালের ডেলি অ্যালাউন্সটা বড়দি বলেছেন পনেরো টাকা করে দিতে। কে এক গার্জেন কমপ্লেন করে বলেছেন দশ টাকায় তো দশ মুঠো চানাচুরও হবে না। তুমি কী বলো?”

ঢোঁক গিলে কলাবতী, ব্রততী যাতে অপ্রতিভ না হয়, বলল, ”ছোট—ছোট মুঠো হলে কুড়ি মুঠো তো হবেই। আর যাদের নেব তাদের হাতের চেটো আগে দেখে নেব।”

”গুড। রিহার্সাল শুরু করার আগের দিন আমাকে জানিও, টাকা দিয়ে দোব। তবে ঝালমুড়ি কি ফুচকা খাওয়া চলবে না। গিরিকে টাকা দেবে, ও কলা এনে রেখে দেবে। কলায় ভিটামিন আছে, পুষ্টিকর জিনিস।”

ব্রততী চলে যাওয়ার পর কলাবতীরই ক্লাসের চিত্রা বসু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার সঙ্গে বিনতা আর চারুশীলাও।

চিত্রা বলল, ”লক্ষ্মণের শক্তিশেলে কিন্তু অনেক গান আছে। কে গাইবে?”

কলাবতী বলল, ”আমার সময় বাঁধা, একঘণ্টা। আমার নাটকে গান থাকবে না।”

ঠোঁট মুচড়ে চারুশীলা বলল, ”গান ছাড়া লক্ষ্মণের শক্তিশেল, তবেই হয়েছে!”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিনতা বলল, ”এ তো রামকে বাদ দিয়ে রামায়ণ। কেমন হবে কে জানে।”

ওরা তিনজন চলে গেল। কলাবতী ঠোঁট কামড়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। এই তিনজন মিলে একটা দল। পাশাপাশি বসে শুধু নিজেদের মধ্যে ফিসফাস গুজগুজ করে। একসঙ্গে স্কুলে আসে, ছুটির পর একসঙ্গে বেরোয়। কলাবতীকে ওরা দেখতে পারে না যেহেতু সে সবার প্রিয়, বিশেষ করে বড়দির। প্রাক্তন জমিদারবাড়ির নাতনি অথচ একফোঁটাও বড়লোকি চাল নেই। ওই তিনজন বলে, এটাই ওর বড়লোকি চাল। শুনে কলাবতী শুধু হেসেছে। কিন্তু এখন ওদের কথা শুনে মনে—মনে রেগে উঠল। কেন না, খোঁচাটা তার বোধ আর বুদ্ধিকে দেওয়া হয়েছে।

রাগতে—রাগতে সে দেখল ধূপছায়া আসছে, কিন্তু ধুপুর পিছনে ওটা কে?

”দেরি হয়ে গেল, কী করব ইস্ত্রিওলাকে সকালে শাড়িটা দিয়েছিলুম, সাড়ে ন’টার সময়ও দেখি শাড়িটা ফেলে রেখেছে। ইস্ত্রি করিয়ে কাপড় পরে আসতে আসতে…”

ধূপছায়া বলতে—বলতে থেমে গিয়ে কলাবতীর দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল। স্কুল ড্রেস পরা একটা মেয়ে, পিঠে বইয়ের ব্যাগ। উচ্চচতা সাড়ে চার ফুটের একটু বেশি, ওজন পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ কেজি, গলাটা আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না, যাকে বলে ঘাড়ে—গর্দানে। কিন্তু হাঁটছে দু’হাত ফাঁক করে দোলাতে—দোলাতে, গটমট করে এবং বেশ দ্রুত। দেখেই বোঝা যায় শরীরটা অত্যন্ত ফিট, তা না হলে অত ওজন নিয়ে অমন চটপটে গতিতে হাঁটা যায় না। মেয়েটির জ্বলজ্বলে চোখের থেকে ঠিকরোচ্ছে মজা পাওয়ার ফুলকি! সারা মুখে হাসিখুশির আভা মাখানো। দেখলেই ভাল লেগে যায়। কলাবতীরও লাগল।

”কী দেখছিস রে কালু?”

”আমার হনুমানকে। খোঁজ নে কোন ক্লাসে পড়ে।”

ধূপছায়া চেঁচিয়ে উঠল। ”এই—এই, এই মেয়েটা।”

মেয়েটি থমকে পড়ল। ”আমায় বলছ?”

”হ্যাঁ, তোমায়। কোন ক্লাস, নাম কী?” ধূপছায়া এগিয়ে গেল, কলাবতীও।

”সেভেন—এ—ওয়ান। রুকমিনি তলওয়ালকর। আমাকে সবাই রুকু বলে ডাকে।”

কলাবতী বলল, ”দেরি হয়ে যাচ্ছে তোমার, ক্লাসে যাও। তোমার সঙ্গে টিফিনে কথা বলব, নিমগাছতলায় এসো, কেমন।”

রুকমিনি একটু অবাকই হল। উঁচু ক্লাসের দুটো দিদি হঠাৎ তাকে গেটের কাছে এমনভাবে ধরল, যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

‘কালু, এই তোর হনুমান! এমন সুন্দর মেয়েটাকে হনুমান বানাতে চাস?” ধূপছায়ার স্বরে ক্ষোভ আর অনুযোগ।

”ওর চেহারাটা খুব ফানি, মজাদার। হনুমানও তো তাই ছিল। এক লাফে সাগর ডিঙিয়ে যাওয়া, লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া, বিশল্যকরণী আনতে গিয়ে গন্ধমাদন পাহাড়ের চুড়োটাই ভেঙে নিয়ে এল। এই সব মজা না থাকলে কি নাটক জমে?”

আতঙ্কিত চোখে ধূপছায়া বলল, ”তোর মতলব কী বল তো? হনুমানের লাফ, লঙ্কায় আগুন, গন্ধমাদন নিয়ে উড়ে আসা—এসব দেখাতে চাস?”

”পাগল! আগুন? ওরে বাব্বা, বড়দি তা হলে হার্টফেল করবেন। এসব দেখাতে পারত ষাট—সত্তর বছর আগের স্টার থিয়েটার। এসবে যা খরচ পড়বে, আমাদের স্কুল তো তা করতে পারবে না, সুতরাং ওসব চিন্তা ছেড়ে দিয়ে যা করা যেতে পারে সেটা নিয়েই ভাবা ভাল। এই রুকমিনিকে দেখে একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। ধুপু, রোববার সকালে আমাদের বাড়িতে আয়, দুপুরে ভাত খাবি।”

টিফিনের সময় রুকমিনি এল নিমগাছতলায়। অপেক্ষা করছিল কলাবতী আর ধূপছায়া।

”রুকু, আমরা নাটক করব প্ল্যাটিনাম জুবিলিতে, তুমি রামায়ণ পড়েছ?” কলাবতী ভূমিকা না করে সোজা বিষয়ে চলে এল।

”হ্যাঁ, ছোটদের রামায়ণ। টিভি—তেও দেখেছি।”

ধূপছায়া উৎসাহিত হয়ে বলল, ”বাঃ তা হলে তো কালুর কাজটা সহজ হয়ে গেল। রুকু তো তা হলে হনুমানকে দেখে ফেলেছে। আচ্ছা, হনুমানকে তোমার কেমন লাগে?”

”খুব ভাল। গায়েও ভীষণ জোর। কীরকম লাফ দিয়ে উড়ে গিয়ে লঙ্কায় পড়ল!” রুকমিনির চোখ গোল হয়ে ঝকমক করে উঠল।

কলাবতী বলল, ”আমাদের নাটকে হনুমান থাকবে, তুমি করবে হনুমান?”

”লাফিয়ে সাগর পার হবে?” রুকমিনি পালটা প্রশ্ন করল, ”আমি কিন্তু লাফাতে পারি?”

ধূপছায়া বলল, ”কতটা পার?”

”দেখবে?” এই বলে রুকমিনি নিমগাছতলা থেকে দশ—বারো হাত হেঁটে গেল। তারপর ঠোঁট কামড়ে এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো ছুটে এসে জোড়পায়ে লাফ দিয়ে মাটিতে ধপাস করে পড়ল। সেখানে যত মেয়ে ছিল অবাক হয়ে তারা রুকমিনির দিকে তাকাল। জমিটা শক্ত। রুকমিনির লেগেছে। কলাবতী ছুটে গিয়ে হাত ধরে টেনে তুলল। স্কার্টের ধুলো ঝাড়তে—ঝাড়তে রুকমিনি একগাল হেসে বলল, ”দেখলে?”

”দেখলুম।” কলাবতী বলল, ”রুকু, আমার নাটকে কিন্তু সাগর লাফিয়ে পার হবে না হনুমান, তা করতে হলে নাটকটা অনেক বড় হয়ে যাবে। আমাকে মাত্র একঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে।” রুকমিনির মুখ ক্রমশ ম্লান হয়ে যেতে দেখে কলাবতী বলল, ”না—ই বা লাফাল, অনেক মজার—মজার কথা বলতে আর কাণ্ড করতে তো হনুমান পারে। পারে না ধুপু?”

ধূপছায়া সঙ্গে—সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, ”অবশ্যই পারে। হনুমানের জন্য কালু স্পেশ্যাল অ্যাকশন আর ডায়ালগ দেবে। রুকু, তুমি একটুও দুখ্যু কোরো না। তা হলে তুমি রাজি?

রুকমিনি নিমরাজি ভঙ্গিতে মাথায় হেলিয়ে দিতেই কলাবতী বলল, ”এই তো হনুমানের মতো লক্ষ্মী মেয়ে। হনুমানকে যা করতে বলা হত, মুখটি বুজে সেই কাজটি করত।”

”আমার মুখে কিন্তু মুখোশ দিতে হবে আর একটা ল্যাজ। টিভিতে ঠিক যে রকম দেখেছি।”

”অবশ্যই। এবার তুমি ক্লাসে যাও। রিহার্সালের সময় তোমাকে জানাব। আর একটা কথা, তুমি যে হনুমান করছ এ কথা কাউকে কিন্তু বলবে না।”

রুকমিনি চলে যেতে কলাবতী বলল, ”চমৎকার মেয়ে। দেখবি ও দারুণ হনুমান করবে।”

”সে ওর লাফ দেওয়া দেখেই বুঝেছি। ওই চেহারা নিয়ে যেভাবে ছুটে এসে লাফাল। কোনও জড়তা নেই!” ধূপছায়া মুগ্ধ কণ্ঠে বলল।

”কতটা লাফাল বল তো?”

”ছ—সাত ফুট তো হবেই, ওই ওজন নিয়ে! বাপস!”

”তা হলে রোববার আসছিস। যতটা লেখা হয়েছে, তোকে পড়ে শোনাব।”

রবিবারের মধ্যেই কলাবতী নাটকের শেষটুকু বাদে সবটাই লিখে ফেলল। পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো একটা ফ্ল্যাট ফাইলে গেঁথে রেখেছে ধুপুকে পড়াবার জন্য। সত্যশেখর রবিবার আড্ডা দিতে যায় বন্ধুর বাড়িতে। বেলা বারোটা নাগাদ সে ফিরছে, হাতে একটা পলিথিন থলি। ধূপছায়া তখন ফটক দিয়ে ঢুকছে। দু’জনের দেখা হয়ে গেল।

”এই যে ধুপু, এত দেরি করে এলে যে? ভালই হল, আজ তোমাকে কাঁকড়ার ঝাল খাওয়াব। ঝাল খাও তো?” উদ্বিগ্ন চোখে সত্যশেখর তাকাল এবং আশ্বস্ত হল ‘খাই এবং ভালই খাই’ শুনে, তারপর সে বকবক করতে—করতে বাড়ির সদর দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল।

”এই পলিথিন থলিটা পকেটে নিয়ে রোববারে বেরোই। রোববারে গাড়ি চড়ি না, হাঁটি, রাস্তায় কত রকমের যে জিনিস পাওয়া যায়। এই দ্যাখো না, আজ একজন ঝুড়িতে কাঁকড়া নিয়ে বসেছিল মানিকতলা ব্রিজের উপর। কুড়ি টাকা জোড়া। কতদিন যে খাই না। নিলুম গোটাদশেক, লোকটার কাছে এই ক’টাই ছিল।” বাড়ির ভিতর ঢুকে সে মুরারিকে দেখে থলিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ”অপুর মাকে দাও আর বোলো কড়া ঝাল দিয়ে যেন বানায়। প্রথমে গজগজ করবে, তুমি বলে দিও ধুপুকে কথা দিয়েছিল কালু তোমার হাতে রাঁধা কাঁকড়া খাওয়াবে। সেই জন্য ছোটকত্তা কাঁকড়া খুঁজতে খুঁজতে সেই হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত—না টালিগঞ্জ পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। কালুদি কথা দিয়েছিল বলেই তো, তাই না ধুপু?”

হাসি চেপে ধুপু ঘাড় হেলিয়ে বলল, ”হ্যাঁ, কালু বলেছিলই তো।”

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে—উঠতে সত্যশেখর বলল, ”কালুর নাম করলেই জোঁকের মুখে নুন, অপুর মা স্পিকটি নট। ভীষণ ভালবাসে। দ্যাখো, আধঘণ্টার মধ্যে কাঁকড়া তৈরি হয়ে যাবে।”

দোতলায় চওড়া দরদালানটাই বসার ঘর। সোফা, ইজিচেয়ার আর টেবলে সাজানো। কলাবতী টিভি দেখছিল। ধুপুকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, ”আর একটু আগে এলি না কেন, কুইজের প্রোগ্রামটা শেষ হয়ে গেল,” রেফ্রিজারেটর থেকে দু’লিটারের সফট ড্রিঙ্কসের বোতল বের করে দুটো গ্লাসে ঢেলে বোতলটা সত্যশেখরের হাতে দিয়ে বলল, ”পিসি কখন রান্না শেষ করে বসে আছে তোকে পোস্ত চিংড়ি খাওয়াবে বলে। আমি শুধু বলেছি, পিসি ধুপু চিংড়ি ভালবাসে। বাস সক্কালবেলায় মুরারিদাকে পাঠাল বাজারে। তারপর যা শুরু হল, যেন এটা যজ্ঞিবাড়ি।”

শুনতে—শুনতে সত্যশেখরের চোখের পাতা পড়া বন্ধ। ধুপুর বুকের মধ্যে শুরু হল ধুকপুকুনি। শুকনো গলায় সত্যশেখর বলল, ”কালু, তুই ঠিক জানিস ধুপু চিংড়িই ভালবাসে, কাঁকড়া নয়? কিন্তু আমি যে কাঁকড়া নিয়ে এলুম। এখন কী হবে।”

”কী আর হবে, দুটোর কোনওটাই মাছ নয়। ধুপু পোস্ত চিংড়িটা খাবে, আর তুমি কাঁকড়াটা।”

একতলা থেকে উঠে এল মুরারি। বলল, ”ছোটকত্তা, অপুর মা জানতে চাইল সব’ক—টাই কি রাঁধবে?”

গম্ভীর স্বরে সত্যশেখর বলল, ”একটাও নয়। অ্যালার্জি আছে ধুপুর, দিনেরবেলায় কাঁকড়া খেলে ওর গায়ে র‌্যাশ বেরোয়, গা চুলকোয়। কালু এটা জানত না, আমিও নয়, আর ধুপুও ভুলে গেছল বলতে। ওকে বলো সবক’টা তুলে রাখতে।”

মুরারি চলে যাওয়ার পর কলাবতী বলল, ”বেশ সামলে দিলে তো!”

সত্যশেখর বলল, ”কারও ক্ষতি না করে ছোট্ট একটা—দুটো মিথ্যে কথা তো বলাই যায় পরিস্থিতি সামলাতে। অবশ্য পরিস্থিতিটা যদি নাটকীয় হয়, এই যেমন এখন হল, কালু, তোর নাটকে নিশ্চয় নাটকীয় পরিস্থিতি থাকবে।” থাকবেই ধরে নিয়ে সত্যশেখর বোতল থেকে ঢকঢক করে আধলিটার গলায় ঢেলে নিল।

কলাবতী বলল ”নাটকীয় আবার কী! রামায়ণে ইন্টারেস্টিং ইনসিডেন্ট যা—যা আছে, তেমন দু’তিনটে ঘটনাই থাকবে। একঘণ্টায় কি গোটা মহাকাব্য দেখানো যায়?”

এই সময় স্নান সেরে ফতুয়া—পাজামা পরে রাজশেখর এসে তাঁর ইজিচেয়ারে বসে বললেন, ”কালুকে অত করে বললুম নাটকটা আমাকে একবার পড়তে দে, কিছুতেই দিল না।”

সত্যশেখর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ”আমাকেও নয়, যেন অর্থমন্ত্রীর বাজেট। একেবারে পার্লামেন্টে মানে স্টেজে করে দেখাবে। রামায়ণের দু’তিনটে ইন্টারেস্টিং ইনসিডেন্ট নাকি ওর নাটকে থাকবে।”

রাজশেখর বললেন, ”তা হলেই হবে। দেখবে তো স্কুলের মেয়েরা, ওরা যাতে মজা পায় তেমন ঘটনা থাকলেই হল। এ ব্যাপারে সেরা কিন্তু হচ্ছে হনুমান। স্টেজে একটা ল্যাজওলা হনুমান ছেড়ে দে, দেখবি নাটক জমে গেছে।”

ধূপছায়া প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, ”দাদু, আমরা একজনকে পেয়ে গেছি, রুকমিনি তলওয়ালকর। একেবারে আইডিয়াল হনুমান, বেঁটেখাটো, গাট্টাগোট্টা, দারুণ ফিট। ও রাজি হনুমান হতে।”

সত্যশেখর কৌতূহলী হয়ে বলল, ”কী বললে, তলওয়ালকর? মলয়া যখন প্রেসিডেন্সিতে পড়ত তখন ওর সঙ্গে পড়ত ভারতী বোস। পরে এক জার্নালিস্টকে বিয়ে করে, নাম বিনায়ক তলওয়ালকর। আমি দু’জনকেই চিনি, মলুই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। বিনায়কও বেঁটে, গাট্টাগোট্টা, একসময় ওয়েটলিফটিং করত। এই রুকমিনি বোধহয় ভারতীরই মেয়ে, জিজ্ঞেস করিস তো।”

কলাবতী বলল, ”রুকুর একটাই দুখ্যু, তার লাফ দেখাবার কোনও সুযোগ থাকছে না নাটকে।”

”না, না, এটা ঘোরতর অন্যায় হবে, বাল্মীকিকেও অপমান করা হবে যদি হনুমান লাফিয়ে সাগর পার না হয়।” সত্যশেখর প্রায় হাতজোড় করেই ফেলেছিল, ”ভেবে দ্যাখ রামায়ণের ওটা একটা টার্নিং পয়েন্ট, রাহুল দ্রাবিড়ের আউট হওয়ার মতো। এটা বাদ দিলে বলব তোর ড্রামাটিক সেন্স নেই। আরে হনুমানই তো প্রথম কম্যান্ডো অ্যাটাক করে লঙ্কায়। আগুন লাগিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেয়।”

ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে কলাবতী বলল, ”কিন্তু কাকা, পক প্রণালী পেরোবার মতো লাফ কি রুকু দিতে পারবে? বড়জোর আট—দশ ফুট পারবে, তাতে কি চলবে?”

”বলিস কী, আট—দ—অ—শ ফুট দারুণ চলবে, পাঁচ হাত হলেও চলবে, তবে স্পোর্টসের লংজাম্প করার মতো নয়। স্টেজের এপাশ থেকে দৌড়ে এসে দারা সিংয়ের মতো ‘জয় শ্রীরামজি’ বলে দু’হাত তুলে আকাশে ওড়ার মতো একটা লাফ দিয়ে ওপাশের উইংসের বাইরে গিয়ে পড়বে।”

ধুপু আঁতকে উঠল, ”সব্বোনাশ, তা হলে তো হাড়গোড় ভেঙে যাবে।”

”আমি ওমনি—ওমনি হাইকোর্টের উকিল হইনি ধুপু। অবশ্য অনেক পণ্ডিত—ডক্টরেট মনে করে, আমার মাথার মধ্যে গুবরে পোকার বাসা ছাড়া আর কিছুই নেই।”

কলাবতী ফিসফিস করে ধুপুকে বলল, ”ডক্টরেট মানে বড়দি।”

‘কালু, স্টেজ তৈরি করবে যে ডেকরেটর তাকে বলবি উইংসের ওদিকে, মানে যেদিকে হনুমান ঝাঁপ দেবে, প্যান্ডেল তৈরির কাপড় এনতার যেন ডাঁই করে রেখে দেয়। রুকু উড়ে গিয়ে তার উপর পড়বে। সেই সময় মিউজিক মানে ঝাঁঝর ঝম করে উঠবে। ভাল কথা, তোর মিউজিক হ্যান্ড থাকবে তো?”

কলাবতী বিপন্ন চোখে তাকাল ধূপছায়ার দিকে। নাটকের এই দিক অর্থাৎ আবহসঙ্গীতের কথা তো সে ভাবেনি।

রাজশেখর এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। বললেন, ”কালু ঘাবড়াসনি। খুঁজে দ্যাখ, স্কুলে অনেক মেয়ে নানারকম বাজনা শেখে—গিটার, বেহালা, সেতার, বাঁশি হারমোনিয়াম তো আছেই, তবলা ঢোলও এখন মেয়েরা শিখছে। এসব নাটকে মিউজিকের একটা বড় ভূমিকা থাকে।”

”ধূপু, তোর কাজ বেড়ে গেল।” কলাবতী অসহায় স্বরে বলল, ”দাদু, আমি তো নাট্যকার আর নির্দেশক। বাকি যা কিছু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সব এই ধুপুর ঘাড়ে। সব ওকে সামলাতে হচ্ছে।”

ধূপছায়া গম্ভীর হয়ে বলল, ”আমাকে এখন সামলাতে হবে বড়দি আর ব্রততীদিকে। কালু, তোকে বলে দিচ্ছি এত কম টাকার বাজেটে পাড়ার বাচ্চচাদের নাটকও করা যায় না। লাইট, মেকআপ, মিউজিক এগুলো তো মিনিমাম দরকার…”

ধুপুকে থামিয়ে সত্যশেখর বলল, ”এগুলোর খরচ দেবে না, তার মানে যতটা না দিলে নয় তাই দেবে। তোমাদের বড়দিকে তো চিনি, হাড়কেপ্পন। তোদের রিহার্সালে পাঁচটাকা শেষ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।”

”হ্যাঁ। একজন গার্জেন নাকি বড়দিকে কমপ্লেন করে বলেছেন, দশ টাকায় তো দশ মুঠো চানাচুরও হবে না।”

”দশ মুঠো!” সত্যশেখর আকাশ থেকে যেন পড়ল, ”আমি তো বলেছি পাঁচ মুঠো, অবশ্য আমার হাতের মুঠো। তবে মেকআপ, ড্রেস একটা প্রধান ব্যাপার মাইথোলজিক্যাল নাটকে, আমার এক ক্লায়েন্ট আছে পীতাম্বর অপেরার মালিক পীতাম্বর ঢোল। ওকে বলে দোব তোদের সাজিয়ে দেবে, পয়সা—টয়সা নেবে না। লাইটের কি খুব দরকার হবে?”

কলাবতী বলল, ”না কাকা, তোমাকে ভাবতে হবে না, ফাংশনে যারা আলো দেবে তাদেরই বলে দোব স্টেজ অন্ধকার করে দেওয়া, আলো বাড়ানো—কমানো আর একটা জোরালো আলো মুখে ফেলার ব্যবস্থা যেন করে।”

মুরারি এসে বলল, ”ছোটকত্তা, চান করে নাও। রান্না হয়ে গেছে।”

সবাই খাওয়ার ঘরে এসে দেখল, টেবলে সাজানো খালি প্লেট, ট্রে—তে ধোঁয়া ওঠা ভাত, বৌলে মুগের ডাল, পোস্ত চিংড়ি, ছোট—ছোট প্লেটে পারশে মাছের ঝাল আর বেগুনভাজা। আর টেবলের মধ্যিখানে একটা বড় অ্যালুমিনিয়াম গামলা, তাতে জলে ডুবে রয়েছে কয়েকটা কাঁকড়া। টেবলের একধারে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে অপুর মা ও মুরারি।

রাজশেখর একটু অবাক হয়ে গামলাটা দেখিয়ে বললেন, ”এটা কী?”

গম্ভীর স্বরে অপুর মা বলল, ”ছোটকত্তার আনা ক্যাঁকড়া।”

”আমি তো তুলে রাখতে বললুম, কাল রান্না কোরো।” সত্যশেখরের স্বরে কিঞ্চিৎ বিরক্তি।

”ফ্রিজে তুলে রাখলে আর কিছু সেখানে রাখা যাবে না। সব ফেলে দিতে হবে।”

”কেন?” উদ্বিগ্ন চোখে বলল সত্যশেখর।

অপুর মা হাতায় করে একটা কাঁকড়া তুলে সত্যশেখরের নাকের কাছে ধরে বলল, ”শুঁকুন।”

কাঁকড়ার গন্ধ নাকে টেনেই সত্যশেখর মাথাটা পিছিয়ে নিয়ে প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ”ফেলে দাও, ফেলে দাও।”

”অন্তত সাতদিনের মরা। এই কিনতে টালিগঞ্জ গেছলেন। খোলা ভাঙতেই পচা গন্ধে ম—ম করে উঠল রান্নাঘর। ধুপু দিদিমণির তো সকালে ক্যাঁকড়া খাওয়া চলবে না, অ্যালাজ্যি না কী যেন গায়ে বেরোয়। মুরারিদা, বাজারে জ্যান্ত ক্যাঁকড়া পেলে নিয়ে এসো তো। লাউ দিয়ে রাঁধব। বিকেলে কালুদি দিয়ে আসবে, রাত্তিরে ধুপু দিদিমণি খাবে।”

গামলাটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে—যেতে অপুর মা বলে গেল, ‘টমটমের চাটনি আনছি।”

প্লেটে ভাত তুলে, বৌল থেকে দু’হাতা ডাল ঢেলে নিয়ে রাজশেখর সেটা ধুপুর সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ”জ্যান্ত কি মরা সেটা দেখে কিনবি তো?”

লজ্জিত, বিব্রত স্বরে সত্যশেখর বলল, ”দেখলুম শান্তশিষ্ট হয়ে রয়েছে তাই আর বিরক্ত করিনি। সামনের রোববার ব্যাটাকে গিয়ে ধরব, অ্যায়সা থাপ্পড় কষাব, বাছাধন বুঝে যাবে কাকে পচা কাঁকড়া গছিয়েছে।”

কলাবতী বলল, ”কাকা সামনের রোববার তুমি কি ভেবেছ লোকটা মানিকতলা ব্রিজের উপর বসবে?”

”তা নয়তো কোথায় বসবে?”

”টালিগঞ্জ রেল ব্রিজের নীচে। ঠকানোর জায়গায় দ্বিতীয়বার কেউ বসে না।”

খাওয়ার পর ধুপুকে নিয়ে কলাবতী শোওয়ার ঘরে এল। পাণ্ডুলিপির ফাইলটা ধুপুর হাতে দিয়ে বলল, ”আগে পড়ে নে, তারপর যা জিজ্ঞেস করার করবি। শুধু মনে রাখিস এটা আধুনিক লক্ষ্মণের শক্তিশেল, সুকুমার রায়ের নয়, কলাবতী সিংহর লেখা, ত্রেতা নয় কলিযুগে ঘটছে। অভিনয়ের সময় একঘণ্টা।”

.

রিহার্সালে প্রবল উৎসাহ মেয়েদের। ছুটির ঘণ্টা পড়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তারা টিচার্স রুমের দরজায় এসে জড়ো হয়ে দিদিদের বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। অধৈর্য হয়ে কেউ—কেউ ঘরে ঢুকে গিয়ে চেয়ার সরাতে শুরু করে। রাম লক্ষ্মণকে নিয়ে নাটক, হনুমানজিও আছেন, তাই শুনে চতুরানন মিশির টুল নিয়ে বসে গেছল ঘরের একধারে। কিন্তু সংলাপের ভাষার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে বিরক্ত হয়ে রিহার্সাল দেখা বন্ধ করে দেয়। যার যা সংলাপ কলাবতী আলাদা—আলাদা কাগজে লিখে মুখস্থ করতে দিয়েছিল এবং তারা এমন মুখস্থ করে ফেলেছে যে, অভিনয় করে বলার বদলে কবিতা আবৃত্তির মতো গড়গড়িয়ে বলে ফেলছে। এটা সামাল দিতে কলাবতীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

মহা খুশি রুকমিনি। হনুমান লঙ্কার উদ্দেশ্যে লাফ দেবে এটা থাকছে। ধুপুদির কাছ থেকে এটা শোনার পর সে বাড়িতে লাফ বা ঝাঁপ দেওয়া প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছে। শোওয়ার খাটে কয়েকটা বালিশ রেখে সে বারান্দা থেকে ছুটে এসে ঘরের দরজার চৌকাঠ থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলে চেঁচিয়ে দু’হাত তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বালিশের উপর। চৌকাঠ আর খাটের মধ্যে দূরত্বটা সাত ফুট। ঝাঁপাতে গিয়ে একদিন পা পিছলে ডান হাঁটু খাটের কাঠে লেগে জখম হয়। তাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে ধূপছায়ার মাথায় হাত। দিনে তিনবার ঠান্ডা—গরম জল দু’দিন ধরে ঢেলে রুকমিনিকে ফিট করে দেয় তার মা। ক্লাস সিক্স—এর জ্যোতির মা মুখোশ বানাতে পারেন, এই খবরটা পেয়ে ধূপছায়া চলে গেল জ্যোতিদের বাড়িতে। বানরসেনাদের জন্য মুখোশ তৈরি করে দিতে হবে গোটা পনেরো। জ্যোতির মা রাজি, যদি কাগজ আর রং তাঁকে কিনে দেওয়া হয়। এরপর ব্রততীর সঙ্গে ধূপছায়ার টাগ অফ ওয়ার কাগজ আর রং কেনার টাকা নিয়ে। ব্রততীর হিসেব অনুযায়ী মুখোশ পিছু একটাকার কাগজ এবং পঞ্চাশ পয়সার রং, মোট দেড় টাকার বেশি অনুমোদন করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অবশেষে রফা হয় একটাকা সত্তর পয়সায়।

একদিন মলয়া টিফিনের সময় তার ঘরে ডেকে পাঠাল কলাবতী ও ধূপছায়াকে। দু’জনে এসে দেখল বড়দির টেবলের উলটোদিকে বসে ব্রততী আর ধুতি—শার্ট পরা এক প্রৌঢ় আর দেওয়াল ঘেঁষে চেয়ারে বসা বছর পঁচিশের এক তরুণ, যার মুখের একমাত্র দ্রষ্টব্য বস্তুটি হল নাক। কলাবতীর মনে হল বাঁশির মতো নাক বোধ হয় একেই বলে। নাকের ডগা গোঁফ ছাড়িয়ে উপরের ঠোঁট প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। চোখ দুটি গোল—গোল এবং ছটফটে।

মলয়া বলল, ‘কালু, তোমাদের নাটকের খবর কী? শ্রীলা বলল তাদের অর্কেস্ট্রা রেডি, অর্চনারা এগজিবিশনের জন্য মেয়েদের আঁকা গোটা চল্লিশ ছবি জোগাড় করে ফেলেছে, আরতি তার মেয়েদের নিয়ে যা—যা তৈরি করে দেখাবে বলেছিল তার থ্রি—ফোর্থ রেডি, প্রণতি বলেছে নানান রাজ্যের ফোক ডান্সের একটা প্রোগ্রাম করবে। অন্নপূর্ণার ‘কচ ও দেবযানী’টা নিয়ে আমাদের আলোচনায় বসতে হবে। কচ ও নিজে হতে চায়। সেটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।”

ব্রততী বলল ”দুজন পেন্টার, দু’জন জার্নালিস্ট, তিনজন মন্ত্রীকে সল্টলেকে পেয়ে গেছি। ওঁরা কথা দিয়েছেন আসবেন। কলাবতী, তোমাদের কীরকম স্টেজ চাই সেটা এনাকে বলো।”

ব্রততী চোখ দিয়ে প্রৌঢ়কে দেখিয়ে বলল, ”আমাদের ফাংশনের জন্য ডেকরেটিংয়ের সব কাজ ইনি করবেন। বগলাবাবু, এই মেয়েটি নাটক করাচ্ছে, কীরকম কী হবে ও বলবে।”

গলা খাঁকারি দিয়ে বগলা ডেকরেটর্সের মালিক ভ্রু কুঁচকে কলাবতীকে দেখে নিয়ে বলল, ”স্টেজ—টেজ করার ব্যাপার আমার চেয়েও ভাল বোঝে আমার ম্যানেজার এই ছেলেটি, বি কম পাস।” বগলাবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে লম্বা নাক যুবকের দিকে তাকাল, ”ও নিজে থিয়েটার—ফিয়েটার করে, এসব ব্যাপার ভাল বোঝে—টোঝে। বরং আমাকে না বলে জয়দেবকেই বলুক। জয় ‘ফুটো বেলুন’ নামে একটা থিয়েটার দলের স্টেজ ম্যানেজার, ওকে বললে সব করে দেবে। হ্যাঁ রে জয়, স্কুলের ছোট—ছোট মেয়েরা নাটক করবে, স্টেজটা কেমন হবে সেটা জেনে নিয়ে তুই করে দে।”

বাধা ছেলের মতো জয়দেব উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে বলল, ”হ্যাঁ স্যার, ওদের কিছু করতে হবে না, শুধু একবার আমায় বলে দিক নাটকটার সিনপসিস আর কী কী ঘটনা দেখাবে বা দেখাতে চায়।”

কলাবতী বলল, ”সবার জানা কাহিনী, রামায়ণের দু’তিনটে ঘটনা নিয়ে নাটক।”

জয়দেব বলল, ”ব্যস, ব্যস, বুঝে গেছি, সীতাহরণ, শূর্পণখা, জটায়ু…”

তাকে থামিয়ে দিয়ে ধূপছায়া বলল, ”আরও পর থেকে শুরু হবে নাটক। এখন এই ঘরে বসে অত কথা বলা যাবে না। যদি পারেন তা হলে ছুটির পর আমরা স্কুলেই রিহার্সাল করি, আপনি আসুন, কীভাবে করতে চাই, সেজন্য কী দরকার, সেটা আপনাকে বলে দেব।”

মলয়া বলল, ”সেই ভাল। জয়দেববাবু আপনি ছুটির পর এসে দু’জনের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিন। আপনি তো নাটকের লোক, ওদের হেল্প করতেও পারবেন।”

বড়দির ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ধূপছায়া প্রথমেই বলল, ”নাকখানা দেখেছিস, শ্রীমান লম্বনাসিকা!”

কলাবতী বলল, ”নাটকপাগল। এদের মাথায় অনেক আইডিয়া ঘোরে, আমাদের কাজে লেগে যেতে পারে।”

স্কুল ছুটির পর কলাবতী রিহার্সাল দেওয়ার জন্য টিচার্স রুমের দিকে যাওয়ার সময় দেখল জয়দেব করিডরে দাঁড়িয়ে। প্রথমেই তার মনে হল এই লম্বনাসিকা সত্যিই নাটকপাগল, নইলে মেয়েদের স্কুলের সামান্য একটা নাটকের জন্য তখন থেকে অপেক্ষা করে থাকবে কেন!

কলাবতী ব্যস্ত স্বরে বলল, ”দাদা বাইরে কেন, ঘরে আসুন। রিহার্সাল দেখুন, তা হলেই বুঝতে পারবেন কীরকম নাটক, কী আমাদের দরকার।”

জয়দেবকে নিয়ে কলাবতী টিচার্স রুমে ঢুকল। তখন রাম হাপুস নয়নে সীতার জন্য বিলাপ করছে। কলাবতী বলল, ”এই জায়গাটা কৃত্তিবাস থেকে নেওয়া, বর্ষায় চারিদিক জলে ডুবে গেছে, কবে জল সরবে, কবে সীতাকে উদ্ধার করা যাবে এই চিন্তায় পাগল হয়ে লক্ষ্মণকে বলছেন—”

রাম তখন মাথা চাপড়ে বলে চলেছে :

ততদিনে সীতা হবে অস্থিচর্মসার।
কী জানি ত্যজে বা প্রাণ বিরহে আমার।।
একাকিনী অনাথিনী শত্রুমধ্যে বাস।
কেমনে বাঁচিবে সীতা এই কয় মাস।।
আমা বিনা জানকীর অন্যে নাহি মন।
এই ক্রোধে পাছে তারে বধে দশানন।।
কান্দিতে কান্দিতে সীতা মরিবে নিশ্চিত।
কী করিবে ভাই তুমি কী করিবে মিত।।

কলাবতী দেখল জয়দেব ড্যাবডেবে চোখে রামের দিকে তাকিয়ে বলল, ”দারুণ মুখস্ত করেছে তো!” তারপরই সে চমকে উঠল লক্ষ্মণের সংলাপ শুনে।

রামের পাশে দাঁড়ানো লক্ষ্মণ ধমকে উঠে বলল, ”ছিঃ দাদা, তুমি মেয়েমানুষের মতো কাঁদছ আর কৃত্তিবাস আওড়াচ্ছ? খোঁজ নাও রাবণ কেন বউদিকে কিডন্যাপ করল? সে ব্যাটা গেল কোথায়, বালিকে মেরে যাকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করে দিলে?”

রাম।।সুগ্রীবের কথা বলছিস? বলেছিল সীতা উদ্ধারে আমাকে সাহায্য করবে, নইলে কি আমি বালিকে মারি? যেই সিংহাসনে বসল অমনি সব প্রমিস ভুলে মেরে দিল। ব্যাটাকে কিষ্কিন্ধ্যায় না বসিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পাঠানো উচিত ছিল।

লক্ষ্মণ।।যাই, হারামজাদাকে মারতে—মারতে নিয়ে আসছি।

লক্ষ্মণ রাগে গরগর করতে—করতে দশ পা হেঁটে গিয়ে একটি মেয়ের ঘাড় ধরে পিঠে মৃদুভাবে চড় মারতে—মারতে ফিরে এল।

লক্ষ্মণ।।দাদা এই সেই ব্যাটা সুগ্রীব। যা বলার এখন দাদাকে বল।

হাতজোড় করে সুগ্রীব।।

হারাইয়া রাজ্য পাই রামের প্রসাদে।
তোমার প্রসাদে আমি বাড়িনু সম্পদে।।
হেরি রঘুনাথ স্বয়ং বিষ্ণু অবতার।
কার শক্তি শোধিবেক শ্রীরামের ধার।।
সীতা উদ্ধারিবে রাম আপন শক্তিতে।
যাইব কেবল আমি তাহার সহিতে।।
না করিয়া রামকার্য বসে আছি ঘরে।
বানর জাতির দোষ লাগে ক্ষমিবারে।।
পশুজাতি কপি আমি কত করি দোষ।
সেবক বৎসল রাম না করেন রোষ।।

লক্ষ্মণ।।খুব হয়েছে, ন্যাকামো করার জায়গা পাসনি? এবার একটু কাজ করে দেখা। বউদিকে রাবণ কোথায় রেখেছে সেই খোঁজটা চটপট এনে দে। দেখছিস না দাদার হাঁড়ির হাল হয়েছে চেহারার।

সুগ্রীব।।আজ্ঞে খোঁজ পেয়েছি। তিনি আছেন লঙ্কায় অশোক কাননে।

ব্যগ্রস্বরে রাম।।পেয়েছ, খোঁজ পেয়েছ? কেমন আছে সীতা?

সুগ্রীব।।বলতে পারব না। রাবণ একটা রাক্ষসকে পাঠিয়েছিল চিঠি দিয়ে। কিষ্কিন্ধ্যায় ওর লোক এসে তোলা তুলবে, আমি যেন কিচ্ছুটি না করি। লোকটি আমাকে বলল।

লক্ষ্মণ।।তোর রাজ্যে এসে রাবণের লোক তোলা আদায় করবে, তুই কিছু বলবি না?

সুগ্রীব।।বলতে পারি, তবে পরেরদিনই আমার লাশ পড়ে যাবে।

রাম।।কোনও ভয় নেই, আমরা তোমার পাশে থাকব। তুমি শুধু সীতা কেমন আছে সেই খবরটা এনে দাও।

রিহার্সাল এই পর্যন্ত হয়ে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রইল।

জয়দেবের হতভম্ব ভাবটা এতক্ষণে কেটে গেছে এবং সে বুঝে ফেলেছে এটা কী ধরনের নাটক। হাসতে—হাসতে বলল, ”ড্রেস, মেকআপ, তির ধনুক, গদা এসব নিশ্চয় লাগবে না। স্টেজের পিছনে সাদা কাপড় দিয়ে দোব। স্টেজটা মাটি থেকে চার ফুট উঁচু, দু’দিকে উইং, কাঠের সিঁড়ি দিয়ে স্টেজে ওঠানামা। আচ্ছা লম্বায় কতটা হলে সুবিধে হয়?”

কলাবতী বলল, ”অনেকটা লম্বা চাই, এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত। কেন না, হনুমান দৌড়ে এসে সমুদ্র লঙ্ঘনের জন্য ঝাঁপ দেবে।”

জয়দেব বলল, ”ওরে বাবা, ঝাঁপও থাকবে! ঝাঁপিয়ে পড়বে কোথায়?”

”উইং দিয়ে স্টেজের বাইরে গিয়ে পড়বে, সেখানে অনেকগুলো বালিশ—তাকিয়া থাকবে। আপনাদের কাছে তো এসব থাকে, এনে রেখে দেবেন। ইনজুরি হলে বিপদে পড়ে যাব।”

”বেশ ভাল বুদ্ধি করেছেন তো।”

”বুদ্ধিটা আমার নয়, কাকার।”

”লঙ্কায় গিয়ে হনুমান তো লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে ছিল। এই নাটকেও তা আছে নাকি?”

”লঙ্কাকাণ্ড মানে অগ্নিকাণ্ড? ওরে বাবা! তা হলে বড়দি তক্ষুনি নাটক বন্ধ করে দেবেন। ধুপুকে আর আমাকে পরদিনই টি সি দিয়ে বলবেন বিদেয় হও।”

জয়দেবের নাট্য—উৎসাহ ধীরে ধীরে জেগে উঠেছে কথা বলার সঙ্গে। এই অল্পবয়সি নাট্যকার—পরিচালককে উপদেশ দেওয়ার জন্য তার মাথার মধ্যে সৃজনী পোকাটি কুটকুট করে কামড় দিল।

”আচ্ছা আপনার নাটকটা শেষ হবে রামায়ণের কোন জায়গায়?”

”সুকুমার রায় যেখানে শেষ করেছিলেন। শক্তিশেলের ধাক্কায় লক্ষ্মণ পড়ে গেল, হনুমান গন্ধমাদন পাহাড়টা মাথায় করে আনল, লক্ষ্মণ বেঁচে উঠল। ওইখানেই আমার নাটকও শেষ হবে। সময় একঘণ্টা, তার মধ্যেই যা কিছু।”

”শক্তিশেল মারাটা দেখাবেন কী করে? গন্ধমাদন নিয়ে হেঁটে হেঁটে তো হনুমান আসবে না, উড়ে আসবে। সিনেমায় দারা সিং তো তাই করেছিল।”

”এটা নিয়ে এবার ভাবতে হবে। বাইরে চলুন, রিহার্সালের সেকেন্ড পার্ট এবার শুরু হবে।” কলাবতী ঘরের বাইরে করিডরে এল, সঙ্গে জয়দেব। সেকেন্ড পার্ট মানে খাওয়া। দু’ স্লাইস পাউরুটি আর যথেষ্ট ঝাল দেওয়া দমের দু’টুকরো আলু। এটা সম্ভব হয়েছে সত্যশেখর প্রতিদিন কুড়ি টাকা ভর্তুকি দেওয়ায় এবং গিরিবালা বাড়ি থেকে রেঁধে আনায়।

জয়দেব বলল, ”আমি বলি কী, লক্ষ্মণকে রাবণ গুলি করুক। বন্দুক জোগাড় করতে পারবেন? গুলির আওয়াজটা বুড়িমা, কি চকলেট বোমা দিয়ে তৈরি করে দেওয়া যাবে। কিন্তু মুখোমুখি বানর আর রাক্ষস সৈন্যদের যুদ্ধটা কীভাবে হবে?”

”খুব সোজা, ক্যারাটে।” কলাবতী সহজ গলায় বলল, ”তিনটে মেয়ে পেয়েছি, এই পাড়ায় ক্যারাটে স্কুলে শেখে। বাকিরা টিভিতে হিন্দি ফিল্ম দেখে—দেখে সেদিন নকল করে দেখাল উইথ ডায়ালগ, ফ্যান্টাস্টিক। আর যুদ্ধের সময় অবিরাম স্টেজের দু’পাশে কালীপটকা ফেটে চলবে।”

”বড়দি তো তা হলে নাটক বন্ধ করে দেবেন, কালীপটকা ফাটবে তো আগুনে!”

”একটা উপুড় করা হাঁড়ির মধ্যে যদি ফাটে তা হলে তো ওনার আপত্তি করার কিছু থাকবে না।”

জয়দেব কবজি তুলে ঘড়ি দেখল। হঠাৎ যেন মনে পড়ল এমনভাবে বলল, ”অ্যাকাডেমিতে আজ আমাদের নতুন নাটক ‘বাঘের লোমের কাঁথা’—র ফোর্থ শো। আমার অ্যাপিয়ারেন্স অবশ্য শেষের দিকে, দেরিতে গেলেও চলবে।”

কলাবতী বিচলিত স্বরে বলল, ”আপনাকে দেরি করিয়ে দিলুম, লজ্জা করছে।”

”আরে না না, এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে। আমি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব। একটা সাজেশন দিতে ইচ্ছে করছে, বুঝতে পারছি না দেওয়া ঠিক হবে কিনা।”

”কেন ঠিক হবে না?” কলাবতী ব্যগ্র হয়ে বলল, ”আমি তো নতুন, কাঁচা, পরামর্শ চাই।”

”এই যে পদ্যে ডায়ালগ, এটা একটু লম্বা হয়ে যাচ্ছে। দর্শকরা তো রামায়ণ মহাভারত নামটাই শুনেছে, পড়ে—টড়ে তো দেখেনি। ওদের কাছে বোরিং মনে হতে পারে। একটু ছেঁটে দিন, নয়তো গদ্যে বলা হোক।” জয়দেব এই বলে কলাবতীর মুখভাব লক্ষ করল। মুখে বিরূপতা বা অপ্রসন্নতার ছায়া দেখতে না পেয়ে সে বলল, ”আমি একটা ব্যাপার করতে চাই, সেটা হল হনুমান গন্ধমাদন নিয়ে স্টেজে উড়ে আসবে।”

”সে কী! কীভাবে?” বিস্মিত কলাবতীর চোখের মণি বড় হয়ে উঠল।

”একটু ভেবে নিতে হবে। হনুমানের সাইজটা দেখতে হবে আর সাহস আছে কেমন, সেটা জানতে হবে। উড়ে আসাটা কিন্তু চেষ্টা করলে করা যায়। রোপওয়ে দেখেছেন? তারের উপর দিয়ে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে ট্রলিতে মানুষ যায়। হনুমান যদি সেইভাবে যায়?” জয়দেব এমনভাবে তাকাল যেন মহাকাশে ব্ল্যাক হোল হারিকেন হাতে খুঁজতে—খুঁজতে পেয়ে গেছে।

কলাবতী তো তাজ্জব। চোখ পিটপিট করে বলল, ”বলেন কী! এমন আইডিয়া তো আমার কাকার মাথাতেও আসেনি!”

”উনি নিশ্চয় নাটক করেন না।”

”হাইকোর্টের উকিল। ছোটবেলায় খুব যাত্রা দেখেছেন।”

”হায়ার না হয়ে লোয়ার কোর্টের উকিল হলে মাথায় ঠিক আইডিয়া গজিয়ে যেত। যাই হোক, যা বললুম এটা কাউকে বলবেন না। তা হলে কিন্তু সারপ্রাইজটা মাটি হয়ে যাবে। আমি গন্ধমাদনটা করে দেখাব।” জয়দেব আবার ঘড়ি দেখল, ”অ্যাকাডেমিতে বেল বেজেছে, স্ক্রিন এইবার সরবে। আমি যাই।”

খাবারের বাক্স ও গ্যাস বেলুন : ঝামেলাবাজদের চমক

তিনদিনের প্ল্যাটিনাম জুবিলি শুরু হয়েছিল মাথায় হলুদ ক্যাপ ও স্কুল ড্রেস পরা প্রায় হাজার ছাত্রীর পদযাত্রা দিয়ে। কাঁকুড়গাছি থেকে দক্ষিণে ফুলবাগান ঘুরে পুবে কাদাপাড়া হয়ে ই এম বাইপাস ধরে উত্তরদিকে গিয়ে মানিকতলা মেন রোড ধরে পশ্চিমে এসে আবার কাঁকুড়গাছিতে। এক সারি দিয়ে এই পদযাত্রার আগায় চিত্রবিচিত্র করা কলসি মাথায় নিয়ে সকাল ছ’টায় প্রথম হাঁটতে শুরু করে হেডমিস্ট্রেস মলয়া। প্রতি দশ মিনিট অন্তর মাথা বদল হয়। প্রোগ্রামে লেখা ছিল ‘পূর্ণমঙ্গলঘট মস্তকে ধারণ করে শিক্ষিকাদের এলাকা প্রদক্ষিণ’। কিন্তু ঘট বা কলসির আকার দেখে চারজন শিক্ষিকা জানিয়ে দেয় তাদের ঘাড়ে স্পন্ডিলোসিস, পূর্ণ নয়, কলসিটা শূন্য করা হোক। কেউ টের পাবে না ওটা খালি না ভর্তি। কিন্তু এগারোজন শিক্ষিকা এর তীব্র প্রতিবাদ করে বলে, ”স্কুলের মঙ্গলামঙ্গলের ব্যাপার এর সঙ্গে জড়িয়ে, মঙ্গলঘট পূর্ণ রাখতেই হবে। ওই চারজনকে বাদ দিয়ে আমরাই ঘট বইব।” তাই হয় শেষ পর্যন্ত। দু’ঘণ্টায় প্রায় চার মাইল পথ পরিক্রমা করে এই পদযাত্রা। প্রসঙ্গ বলে রাখা ভাল, শেষ পঁয়তাল্লিশ মিনিট মঙ্গলঘট বহন করেছিল গিরিবালা ঢালি।

এই পদযাত্রার প্রধান বৈশিষ্ট্য আধমিনিটের জন্যও ট্রাফিক জ্যাম করেনি। এ জন্য ট্রাফিক বিভাগের এসি ব্রততী বেদজ্ঞর সবিশেষ প্রশংসা করেন। সারি দিয়ে যাওয়া মেয়েদের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটে ব্রততী মিছিলকে সরলরেখায় আনতে ”স্ট্রেট লাইন, স্ট্রেট লাইন, স্ট্রেট লাইনে হাঁটো” বলে কাঁধে রূল দিয়ে টোকা মেরে—মেরে ফুটপাথের দিকে সরিয়ে দেয়। পদযাত্রার আগায় যে দুটি মেয়ে স্কুলের নাম ও প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী লেখা ব্যানার টানটান করে দু’ঘণ্টা ধরে হেঁটেছে, ব্যানারটা তারা মুহূর্তের জন্য আলগা করে ঝুলিয়ে ফেলেনি।

পদযাত্রা স্কুল থেকে শুরু হয়ে শেষ মেয়েটি বেরিয়ে যাওয়ার দু’মিনিটের মধ্যে স্কুল বাড়ির পিছনে ছোট্ট ফাঁকা জমিতে খাটানো সামিয়ানার নীচে প্রোমোটার শিবশঙ্কর হালদারের কেটারার শ্যালকের তত্ত্বাবধানে দরবেশ তৈরি এবং লুচির জন্য ময়দা মাখার কাজ শুরু হয়। আর আলুর দমের জন্য আলু সিদ্ধ করতে বড় একটা গ্যাসের বার্নারে কড়াই বসে যায়।

শিবশঙ্কর তিনদিন আগে স্কুলে এসে মলয়াকে বলে যায়, ”প্ল্যাটিনাম জুবিলি তো বছর—বছর হয় না, জীবনে একবারই হয়। মেয়েরা একটু মিষ্টিমুখ করবে না? এই ক’টা তো মেয়ে, কত আর খরচ হবে? দশ হাজার, পনেরো হাজার? আপনাদের এক পয়সাও দিতে হবে না, আমার মেয়ে পুতুল তার বন্ধুদের, দিদিমণিদের খাওয়াবে। মা অভয়ার কৃপায় পুতুলের বাবার এটুকু খরচ করার ক্ষমতা আছে।”

মলয়া বলেছিল, ”কিন্তু খাবারের বাক্সগুলো…”

তাকে থামিয়ে দিয়ে শিবশঙ্কর বলে উঠেছিল, ”পরিবেশদূষণ? ভেবে রেখেছি। দুটো ড্রাম থাকবে, মেয়েরা খেয়ে ড্রামে বাক্স ফেলবে, আমার লোক সেগুলো কর্পোরেশনের জঞ্জালের ভ্যাটে ফেলে দিয়ে আসবে, ব্যস, দূষণের ঝামেলা আর থাকবে না।”

হাঁপ ছেড়েছিল মলয়া। তার ভয় ছিল দূষণ নিয়ে বলরাম দত্ত আবার আন্দোলন না পাকায়। পুতুলের বাবা যে চমকটা মলয়াকে দিয়েছিল, প্রায় সেইরকমই চমক পেল মিশিরজি।

জয়ন্তী পদযাত্রা শুরু হতেই স্কুল ফাঁকা। পাহারা দিতে রয়ে যায় চতুরানন মিশির, দারোয়ান ভোলা দাস আর ঝাড়ুদার গণেশ। হেড ক্লার্ক বৃন্দাবনবাবু ভিয়েনের কাছাকাছি টুলে বসে। বিশাল স্কুল কম্পাউন্ডের একদিকে প্যান্ডেল ও মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ। প্লাস্টিকের বেত লাগানো লোহার চেয়ার এসে গেছে, সেই সঙ্গে লম্বা—লম্বা তিনটি সোফা, হলুদ আর খয়েরি কাপড়ে প্যান্ডেল মোড়ার কাজ চলছে। মঞ্চে জয়দেব পরদার খোলা—বন্ধ পরীক্ষায় এবং হনুমানকে উড়িয়ে আনার ব্যবস্থায় নিযুক্ত। ইলেকট্রিকের তার বিছানো কালই শেষ হয়েছে। টিউব এবং বালবের ফিটিংস এবার লাগানো হবে।

মিশিরজি দাঁড়িয়েছিল লোহার ফটকে। একটা আপাদমস্তক ঢাকা মোটরভ্যান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভ্যান থেকে একটি লোক নেমে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, ”এটা কি কাঁকুড়গাছি উচ্চচ বালিকা স্কুল?”

মিশিরজি বিরক্তমুখে আঙুল তুলে ফটকের উপরের সাইনবোর্ডটা দেখিয়ে বলে, ”বাংলাতেই তো লেখা, পড়তে পারেন না?”

লোকটি মিশিরের কথায় কান না দিয়ে বলল, ”মলয়া মুখার্জি কে? এই চালানে সই করতে হবে, মাল আছে, নামিয়ে কোথায় রাখব?”

মিশির এতগুলো কথা মাথায় সাজিয়ে নিতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল, তারপর বলল, ”মলয়া মুখার্জি এখানে বড়দি। তিনি এখন জলুস নিয়ে বেরিয়েছেন, তিন—চার ঘণ্টা তো লাগবেই ফিরে আসতে। কী মাল আছে? আমি সই করে নিয়ে নিলে হবে?”

”আপনি এখানে কী করেন?”

”আমি বড়দির খাস বেয়ারা।” মিশিরের স্বর গম্ভীর ও নম্র, নিজের গুরুত্ব বোঝাতে। লোকটি ইতস্তত করে বলল, ”এখানে স্কুলের মাস্টার—টাস্টার কেউ আছে?”

মিশির আবার বিরক্ত হয়ে বলল, ”মাস্টার কোথায় পাবেন, সব দিদিমণি। হেড কেলারক বৃন্দাবনবাবু আছেন, চলবে?”

”চলবে, ডেকে আনুন, খুব জরুরি দরকার।”

মিশির ডেকে আনল বৃন্দাবনকে। ততক্ষণে ভ্যানটা ভিতরে ঢুকে স্কুলের কোলাপসিবল গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লোকটি বলল, ”মলয়া মুখার্জি অর্ডার দিয়েছিলেন, সকাল সাতটার মধ্যে মাল রেডি করে ডেলিভারি দিতে। দেখুন সাতটার আগেই নিয়ে এসেছি।” লোকটি চালানের আসল ও কপি, দু’টো ছাপা বিল বুকপকেট থেকে বের করে বিস্মিত বৃন্দাবনের হাতে দিয়ে বলল, ”সই করে দিন আর মাল কোথায় নামিয়ে রাখব সেই ঘরটা একটু দেখিয়ে দিন।”

বৃন্দাবন চালানে চোখ বুলিয়ে দেখল উপরে লেখা ইউনিক এন্টারপ্রাইজ। জেনারেল অর্ডার সাপ্লায়ার্স। হতভম্ব স্বরে বলল, ”তিনশো পচাঁত্তরটা গ্যাস বেলুন। কে আনতে বলল?”

লোকটি বলল, ”মলয়া মুখার্জি অর্ডার দিয়েছেন, তিন হাজার টাকা আগাম পেমেন্টও করে দিয়েছেন। পাঁচটা করে এক—একটা বাঞ্চে পঁচাত্তরটা বাঞ্চ। পঁচিশটার বেশি এই ভ্যানে ধরল না। বাকি পঞ্চাশটা দু’বারে এনে দিচ্ছি, খুব কাছেই বেলেঘাটায় আমাদের অফিস, যাব আর আসব। কী যে ঝামেলার কাজ, হাত ফসকালেই উড়ে যাবে, একটু তাড়াতাড়ি করুন।”

চালানে সই করে আসলটা ফিরিয়ে দিয়ে বৃন্দাবন কৌতূহলী হয়ে বলল, ”দরজাটা খুলুন তো, একবার দেখি।”

”দেখুন আর ঠিকঠাক গুনে নেবেন, এখানে পঁচিশটা বাঞ্চে একশো পঁচিশটা বেলুন আছে।”

লোকটি ভ্যানের পিছনের দুটি পাল্লা সন্তর্পণে খুলে দেখাল। লাল, হলুদ, সবুজ, সাদা ও নীল, পাঁচ রঙের বেলুন নিয়ে সুতোয় বাঁধা এক—একটি তোড়া, দিঘিতে পদ্মফুল বাতাসে যেমন হেলে দোলে, তেমনি গ্যাস বেলুনের তোড়াগুলো ভ্যানের মধ্যে ভাসছে, দুলছে।

”একটা ঘর দিন, সেখানে বেলুনগুলো ছেড়ে দোব।”

বৃন্দাবন তাকাল মিশিরের দিকে। মিশির বলল, ”ফাইভ বি—টু—তে ছেড়ে দিক।”

লোকটি, মিশির ও বৃন্দাবন দু’হাতে দুটো করে বেলুনের তোড়া ধরে ভ্যান থেকে বেলুনগুলো নিয়ে গেল ফাইভ বি—টু—তে। ছেড়ে দেওয়া মাত্র সেগুলো বুদ্ধুদের মতো উঠে ঘরের সিলিং—এ ঠেকে রইল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাকি পঞ্চাশটা তোড়া এসে গেল। ঘরের দরজায় তালা দিয়ে চাবিটা পকেটে রেখে বৃন্দাবন বলল ”পঁচাত্তরটা তোড়া মানে পঁচাত্তর বছর। দেখেছ মিশির, বেলুনগুলোর গায়ে আমাদের স্কুলের নাম আর প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী লেখা আছে। আইডিয়া আছে বটে বড়দির!”

মিশির বলল, ”এগুলো আকাশে ছাড়া হলে যাবে কোথায়?”

বৃন্দাবন বলল, ”যেদিকে হাওয়া দেবে সেদিকে যাবে। এখন পুবদিকে হাওয়া দিচ্ছে, যাবে সল্ট লেকে।”

ঘট মাথায় ফটক দিয়ে প্রথম ঢুকল গিরিবালা। তার পিছনে ব্যানার ধরে দুটি মেয়ে। ব্রততীর নির্দেশে স্কুল কম্পাউন্ডে পূর্বনির্ধারিত ছক অনুযায়ী পাঁচ সারিতে দাঁড়াল মেয়েরা। প্রতি সারির মাথায় একটি টেবল, ঝুড়িতে করে খাবারের বাক্স এনে তার উপর থাক দিয়ে রাখা হচ্ছে। ভোরে উঠে স্কুলে এসে চার মাইল হেঁটে মেয়েদের পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে।

মঙ্গলকলস মাথায় নিয়ে গিরিবালা সেটা কোথায় নামিয়ে রাখবে বুঝতে পারছে না। আরতি ঘটককে সামনে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ”আরতিদি, কলসিটা কোথায় রাখব? যেখানে—সেখানে তো রাখা ঠিক হবে না।”

আরতি এদিক—ওদিক তাকিয়ে বলল, ”তাই তো।” তারপর দৌড়ে গিয়ে অন্নপূর্ণা পাইনকে ধরল, ”কলসিটা কোথায় রাখা যায় বলো তো, অন্নপূর্ণাদি?”

অন্নপূর্ণা বলল, ”ব্রততীদি গিরিকে বলে দেয়নি কোথায় রাখতে হবে?”

আরতি বলল, ”গিরিই তো জিজ্ঞেস করল কোথায় রাখবে। আমি বলি কী, আমাদের টিচার্স রুমে এখন রাখুক।”

সেই সময় বৃন্দাবন মলয়ার হাতে বেলুনের চালানটা তুলে দিয়ে বলল, ”আগে বলেননি, সারপ্রাইজটা কিন্তু দারুণ দিলেন।”

অবাক মলয়ার ভ্রু চালানে রেখে কুঁচকে উঠল, ”এটা কী? আমি গ্যাস বেলুনের অর্ডার দিয়েছি।” ভ্রুর সঙ্গে কপালে বিস্ময়ের কুঞ্চন ফুটল।

”দিয়েছেন কী, মাল এসেও গেছে। আসুন, দেখে যান।”

মলয়াকে নিয়ে বৃন্দাবন ফাইভ বি—টু—র ঘরের তালা খুলে দরজার একটা পাল্লা সবেমাত্র টেনেছে, বেলুনের একটা তোড়া বেরিয়ে এল। বৃন্দাবন হাঁই—হাঁই করে উঠে সেটা দু’হাতে ধরতেই একটা বেলুন ফেটে গেল। তোড়াটাকে তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিয়ে বৃন্দাবন বলল, ”জানলা দিয়ে দেখুন।”

জানলায় গিয়ে মলয়া ঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখল নানান রঙের বেলুন উপরে ওঠার জন্য বেঞ্চ ও ডেস্কের উপর এক অপরের ঘাড়ে চেপে অপেক্ষা করছে।

বেলুন ফাটার আওয়াজে কৌতূহলী হয়ে অসীমা, অন্নপূর্ণা এবং পাশের টিচার্স রুম থেকে গিরিবালা এসে হাজির। জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে তারা তাকাল বৃন্দাবনের আঙুলের নির্দেশ অনুসরণ করে এবং একই সঙ্গে ‘ওমমা’ বলে উঠল।

বৃন্দাবন বলল, ”’ওমমা’ কী বলছেন, এগুলো ওড়াতে হবে, মেয়েদের ডেকে আনুন। পঁচাত্তরটা তোড়া, এক—একটায় পাঁচটা করে, তার মানে তিনশো পঁচাত্তর। এইমাত্র একটা ফেটে গেল, এখন তিনশো চুয়াত্তর। এ সব কার কল্যাণে বলুন তো?”

বৃন্দাবন ঠোঁট আকর্ষণ টেনে ধরে মলয়ার দিকে তাকাল এবং বলল, ”আমাদের স্কুলের নাম আকাশে উড়ে—উড়ে ঘুরে বেড়াবে, দূর—দূরান্তের কত লোক জানবে…”

”জানবে, যখন গ্যাস ফুরিয়ে মাটিতে নেমে আসবে।” অসীমা বলল।

”গ্যাস সবারই একদিন না—একদিন ফুরোয়, তাই বলে কি বেলুন ওড়ার আনন্দ করবে না?” অন্নপূর্ণা হালকা স্বরে কথাটা বলে মেয়েদের খবর দিতে ছুটে গেল।

ব্রততীর তত্ত্বাবধানে খাবারের বাক্স পাঁচটি টেবল থেকে দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। অন্নপূর্ণা ছুটে এসে চেঁচিয়ে উঠল, ”বেলুন বেলুন, বড়দি বেলুন এনেছেন ওড়াবার জন্য। যারা বেলুন ওড়াতে চাও, তারা ফাইভ বি—টু—তে চলে এসো।”

অন্নপূর্ণার কথা শেষ হতে না—হতেই লাইন ছেড়ে হুড়মুড় করে মেয়েরা ছুটে গেল স্কুলবাড়ির দিকে।

ব্রততী বিরক্ত স্বরে অন্নপূর্ণাকে বলল, ”আগে আমাকে বলবে তো, তা নয় সর্দারি করে নিজে বললে, দ্যাখো তো একটা কেওস তৈরি করে দিলে।”

ফাইভ বি—টু—র দরজায় হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। বৃন্দাবন দরজার একটা পাল্লা ফাঁক করে হাত গলিয়ে একটা তোড়ার গলার সুতো ধরে বেলুন টেনে বের করে সামনে যে মেয়েকে পাচ্ছে, তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি উঁচু করে তোড়াটি ধরে ছুটে গেল কম্পাউন্ডে। সেখানে ব্রততী তাকে পাকড়াও করল।

”অ্যাই, অ্যাই, এখন বেলুন ছাড়বে না। আগে লাইন করে দাঁড়াও। সবাই একসঙ্গে মিলে ছাড়বে।”

পঁচাত্তরটি মেয়ের হাতে বেলুন দেওয়ার কাজ যখন চলছে, মলয়া তখন বিধ্বস্ত অবস্থায় তার খাস কামরায় মাথায় হাত দিয়ে বসে। হাত ব্যাগের মধ্যে রাখা সেল ফোনটা বেজে উঠতে সে ক্লান্ত হাতে ব্যাগ থেকে বের করে কানে ধরে বলল, ”হ্যালো, কে বলছেন?”

”ঝামেলাবাজ বলছি। লাগছে কেমন?”

”আন্দাজ ঠিকই করেছিলুম। সিঙ্গি না হলে আমাকে এমব্যারাস করার মতো বুদ্ধি আর কার মাথা থেকে বেরোবো।”

”এমব্যারাসড হয়েছ শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে।”

”তিন হাজার টাকার চেক আজই পাঠিয়ে দোব।”

”পাঠাতে হবে না। কালুর নাটকের দলবলকে একদিন পেটপুরে খাইয়ে দিয়ো এবং বলা বাহুল্য, আমাকেও।”

হনুমানের গন্ধমাদন আনার পরিকল্পনা

জয়ন্তীর প্রথম দুটো দিন ভালয়—ভালয় কাটল। উদ্বোধন করেন জীবিত প্রবীণতম শিক্ষিকা মহামায়া মজুমদার, বয়স পঁচাশি। রেকর্ড ঘেঁটে ষাট বছর আগে স্কুলে প্রথম পড়াতে আসা মহামায়ার নামটি বের করে বৃন্দাবন। এখনও তিনি পেনশন তুলছেন।

ডেকরেটর প্রায় চারফুট লম্বা পিতলের একটা প্রদীপের ঝাড় দেয়। তাতে ছিল একশো প্রদীপ। দুটি ছাত্রী কুঁজো হয়ে যাওয়া মহামায়াকে দু’দিক থেকে ধরে দাঁড়ায়। পঁচাত্তরটি প্রদীপে তেল ও সলতে দেওয়া ছিল। মহামায়া কাঁপা—কাঁপা হাতে মোমবাতি দিয়ে দুটি প্রদীপ জ্বালান। বাকি তিয়াত্তরটা জ্বালায় স্কুলের প্রেসিডেন্ট, হেডমিস্ট্রেস ও অন্যান্য শিক্ষিকারা। এরপর বিজ্ঞান প্রদর্শনী ও চিত্র প্রদর্শনীর ফিতে কাটা হয়, বক্তৃতা দেওয়া হয়। লোকনৃত্য দেখায় স্কুলের মেয়েরা, সবশেষে হয় ম্যাজিক শো।

দ্বিতীয়দিন দুপুরে প্যান্ডেল ফাঁকা। তখন পরদা টেনে স্টেজে ফুল রিহার্সাল দিল কলাবতী তার নাটকের। হাঁটুর নীচে ঢলঢল করা লাল ফুলছাপ দেওয়া বারমুডা আর কালো ফুলহাতা গেঞ্জি পরে এবং লোহার তার বাঁকিয়ে ৎ—এর মতো করে তাতে খড় ও কাপড়ের হলুদ পাড় জড়িয়ে তৈরি করা ল্যাজ কোমরে বেঁধে রুকমিনি হনুমানের মুখোশ লাগিয়ে চুল মাথার উপর ঝুঁটি করে বেঁধে স্টেজের উপর দাপিয়ে যেভাবে হাঁটাচলা করল, তাতে জয়দেব পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে বলতে বাধ্য হয়, ”আসল হনুমানও হার মেনে যাবে এর কাছে। সব হাততালি তো এই মেয়েটাই নিয়ে নেবে। কী সাহসী!”

রুকমিনি সমুদ্র লঙ্ঘনের লাফটা তিনবার করে দেখাল। স্টেজের এক প্রান্ত থেকে ‘জয় শ্রীরাম” বলে চিৎকার করে দুড়দাড় শব্দে যখন ছুটল, ল্যাজটা তখন উপর—নীচ করছিল স্প্রিংয়ের মতো। দু’হাত তুলে খড়ি টানা একটা জায়গায় পৌঁছেই টেকঅফ করে। অপর প্রান্তের উইংয়ের বাইরে জমিতে গোটাদশেক পেল্লায় তাকিয়া সাজিয়ে রাখা, তা ছাড়াও সতর্কতা হিসেবে একটা মোটা চাদরের দুটি প্রান্ত তাকিয়াগুলোর হাততিনেক উপরে শক্ত করে ধরে থাকে কলাবতী ও জয়দেব। হনুমানের পড়ার প্রথম ধাক্কাটা নিল ওই ধরে থাকা চাদরটা, তারপর সে চাদর—সমেত পড়ল তাকিয়ার উপর। রুকমিনির তিনটি লাফই নিখুঁত হল। তবে শেষ লাফটা দিতে পায়ের চাপটা একটু জোরেই দেয়, স্টেজের কাঠটা তাইতে মচ করে উঠেছিল।

দারুণ খুশি জয়দেব, হনুমানের ল্যাজের পাটের পুচ্ছটিতে হাত বুলিয়ে বলল, ”ল্যাজটা কে তৈরি করে দিয়েছে?”

”বাবা!” গর্বিত স্বরে বলল রুকমিনি। ”মা পরশু এই প্যান্টটা কিনে দিয়েছে। বলল, এখনকার হনুমানরা এইরকম প্যান্ট পরে। জামাটা দাদার, মানিয়েছে না?”

জয়দেবের কাছে কলাবতী জানতে চায়, হনুমানের গন্ধমাদন নিয়ে উড়ে আসার ব্যাপারটা কতদূর?

জয়দেব বলল, ”তারের উপর যে রোলারটা থাকবে সেটা আজ বিকেলে পাব। উইংয়ের বাইরে থেকে দড়ি ধরে টানলে রোলার থেকে ঝোলা হনুমান দাঁড়িপাল্লার মতো একটা তক্তায় ঝুলতে ঝুলতে সড়সড় করে এদিক থেকে ওদিকে যাবে।”

”কিন্তু ওকে তো মাটিতে নামতে হবে, নাকি ঝুলেই থাকবে?” কলাবতী তার সংশয় জানিয়ে দিল।

জয়দেব দু’হাত তুলে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ”ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই, ঝুলে থাকবে কেন, আস্তে—আস্তে হনুমানকে স্টেজে নামিয়ে দেওয়া হবে ওই দড়িটা আলগা করে। অডিয়েন্স যাতে তারটা দেখতে না পায়, সেজন্য স্টেজের উপর থেকে একহাত একটা কালো কাপড় এধার থেকে ওধার ঝোলাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আজকের প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর তারটা খাটিয়ে দোব। রোলার লাগিয়ে ট্রায়ালও কমপ্লিট করব।”

দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান শেষ হল চার্লি চ্যাপলিনের ‘গোল্ড রাশ’ দেখিয়ে। দেখল প্রায় হাজার দেড়েক ছাত্রী, অভিভাবক এবং পাড়ার লোকেরা। দেখে সবাই খুশি। দারুণ মজার তো বটেই, তা ছাড়া ইংরেজি কথা বোঝারও ঝামেলা ছিল না। ছবিটা নির্বাক।

তৃতীয় দিনে বলরাম দত্তর ‘দূষণ এবং ছাত্রীদের কর্তব্য’নামে বক্তৃতা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। পাঁচমিনিট পর মণ্ডপে ফিসফাস শুরু হয়, তারপর বেশ জোরেই কথাবার্তা এবং গল্পগুজব চলতে থাকে। ছোট মেয়েরা যখন ছোটাছুটি করে খেলতে শুরু করল, ব্রততী আর থাকতে না পেরে শ্রোতাদের ধমক দিয়ে মাইক টেনে নিয়ে বলে, ”অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে মাননীয় বলরাম দত্ত মহাশয় বলছেন, যে বিষয়টা আমাদের জীবন—মরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর আপনারা কিনা তা না শুনে গোলমাল করছেন? চুপ করে বসে শুনুন। নয়তো চুপচাপ চলে যান।”

আগুনে ঘি পড়ল। এক ছাত্রীর বাবা দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, ”আমরা এখানে জয়ন্তী দেখতে এসেছি, উৎসবের আবহাওয়া চাই, উনি আবহাওয়া দূষণ ঘটাচ্ছেন। কোথায় কী বলতে হয় জানেন না।”

ব্যস, শুরু হয়ে গেল ভদ্রলোককে সমর্থন করে হইহই। সামনের সোফায় বিশিষ্টজনের সঙ্গে বসেছিল মলয়া, রাজশেখর, পলাশবরণ, রাজ্যশিক্ষা সচিব, প্রধান স্কুল পরিদর্শক সহ তিনজন কমিটি মেম্বার। হইহইটা যখন রইরই হওয়ার দিকে, তখন মলয়া সোফা থেকে উঠে দ্রুত স্টেজের পিছনে চলে যায়।

পরদার দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আরতি ঘটক। মলয়া ব্যস্ত হয়ে বলল, ”টানো, দড়ি টানো, পরদা টানো।”

আরতি দু’হাতে ঘুড়ির সুতো টানার মতো দড়ি টেনে স্টেজ পরদা দিয়ে আড়াল করে দিল। স্টেজে তখন মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে বলরাম, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। মলয়া বলল, ”ব্রততীদি, পাবলিককে বেরিয়ে যেতে বলা উচিত হয়নি।”

বলরাম গর্জন করে উঠল, ”একশোবার উচিত হয়েছে।”

উইংয়ের পাশে দাঁড়ানো অসীমা মন্তব্য করল, ”জানি ঝামেলা একটা পাকাবেই।”

মাইকে মলয়া ঘোষণা করল, ”শারীরিক অসুস্থতার কারণে বলরামবাবু তাঁর বক্তব্য শেষ করতে পারলেন না, এজন্য আমরা দুঃখিত।” মণ্ডপে বুউউউ ধ্বনি উঠল। ”আমাদের পরবর্তী অনুষ্ঠান যোগব্যায়াম ও সঙ্গীতসহ গণব্যায়াম প্রদর্শন এখনই শুরু হবে। পরিচালনায় প্রখ্যাত গণসঙ্গীত গায়ক অরুণাচল সেনগুপ্ত এবং নেতাজি যোগব্যায়াম শিবির। যোগব্যায়ামে ও সঙ্গীতে অংশগ্রহণকারী সবাই আমাদের স্কুলেরই মেয়ে। আবহ সুর রচনায় যাঁরা বাজনা বাজাবেন তাঁরাও আমাদের স্কুলের। অনুগ্রহ করে আপনারা কয়েকমিনিট ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ধন্যবাদ।”

স্টেজ থেকে বেরিয়ে মলয়া এল কাপড় ঘিরে তৈরি সাজঘরে। তাকে দেখেই মেয়েরা কিচিরমিচির বন্ধ করে তটস্থ। ব্যায়ামের দশ বারোটি, বাজনার গুটিদশেক, নাটকের অন্তত পনেরোটি মেয়ে মিলে সাজঘরে পা ফেলার জায়গা নেই। সেই সঙ্গে বেহালা, কেটলড্রাম, সেতার, ঢোল, তবলা, গিটার, হাতে বাঁশি, বিউগল, ঝাঁঝর নিয়ে অপেক্ষমানদের পাশে মেকআপের বাক্স এবং বাচ্চচাদের একটা ট্রাইসাইকেল।

”সব রেডি?” মলয়া গলা তুলে বলল। ”অরুণাচলবাবু, শেফালি, পূর্বা, স্বাগতা, ধূপছায়া, কলাবতী তৈরি? মাইকম্যান, লাইটম্যানদের দেখুন জয়দেববাবু। তা হলে পরদা সরাতে বলি?” মলয়া আরতির দিকে তাকাতেই সে দড়ি টানতে শুরু করল।

পরদা সরে যেতেই বেজে উঠল ভৈরবী রাগ সেতারে ও বাঁশিতে। সুইমিং কস্টিউমের মতো পোশাক পরা ছয়টি মেয়ে প্রায় কুচকাওয়াজ করে স্টেজে এল কেটলড্রাম ও বিউগল ধ্বনি সহকারে। নেপথ্য থেকে প্রণতির (হাতে আসনের নাম লেখা ফর্দ) গলা ভেসে এল, ”এখন শুরু হচ্ছে যোগাসন প্রদর্শন। প্রথমে হলাসন।”

মেয়েরা একের পর এক হলাসন, ভুজঙ্গাসন, শশঙ্গাসন, মৎস্যাসন ইত্যাদি বারোটি আসন দেখাল। প্রতিটির শেষে পেল হাততালি। ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর ‘ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ নেপথ্য থেকে অরুণাচল—সহ তিনজন ছাত্রী গেয়ে উঠল। ছুটে স্টেজে ঢুকল জনাদশেক মেয়ে। স্টেজের এ প্রান্ত, ও প্রান্ত ছুটোছুটি করে তারা ভল্টের এমন কসরত দেখাতে শুরু করল যে, স্টেজের কাঠ মচমচ করে উঠল। সকালে রুকমিনি যেখান থেকে লাফ দিয়েছিল, সেখানকার তক্তাটি ফেটে গিয়ে কোনওরকমে জোড়া লেগে রইল।

‘ঊর্ধ্ব গগনের’ পর শুরু হল ‘উঠো গো ভারতলক্ষ্মী’। মেয়েরা শুরু করল একের কাঁধে আর একজন উঠে পিরামিড গড়া, মন্দির গড়া। বলা ছিল, যতক্ষণ গান চলবে ততক্ষণ তারা কাঁধে চড়ে থাকবে। কিন্তু অরুণাচলের গান আর শেষ হয় না। একবার শেষ হতেই আবার প্রথম থেকে শুরু করল। কাঁধে চড়া মেয়েরা টলমল করতে শুরু করল, যাদের কাঁধে উঠেছে তাদের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। তখন দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, ”মেয়েগুলো যে পড়ে যাবে। গানটা থামান।”

সঙ্গে—সঙ্গে দশ—পনেরোটি গলা চিৎকার শুরু করল, ”থামান, গান থামান।”

গান থামিয়ে গণসঙ্গীতগায়ক ভয়ে—ভয়ে জানতে চাইল, ”চেয়ারগুলো কীসের?”

”লোহার,” প্রণতি জানাল।

মেয়েরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দর্শকদের অভিবাদন জানাবার সঙ্গে সঙ্গে আরতি দড়ি টানল।

প্রচুর হাততালির মধ্যেই প্রণতির ঘোষণা ভেসে এল, ”আমাদের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর সমাপ্তির অনুষ্ঠান একটি নাটিকা এবার অভিনীত হবে, ‘রাবণের শক্তিশেল।’ রচনা ও পরিচালনায় আমাদেরই ছাত্রী কলাবতী সিংহ। তাকে সহযোগিতা করেছে ধূপছায়া নাগ। মঞ্চাধ্যক্ষ জয়দেব পাল। আলোকসম্পাতে ঋত্বিককুমার। আবহসঙ্গীতে প্রণতি হালদার। এখন শুরু হচ্ছে জয়ন্তীর শেষ অনুষ্ঠান ‘রাবণের শক্তিশেল’।”

ঘোষণা শেষ হতেই লাউডস্পিকারে শোনা গেল ঐকতান। অসীমা দৌড়ে গিয়ে লাউডস্পিকারের শব্দ নিয়ন্ত্রককে বলে এল, ”কমান, পঁয়ষট্টি ডেসিবেলের নীচে রাখুন, নয়তো ঝামেলা বেধে যাবে।”

সোফায় মলয়া পাশে—বসা রাজশেখরকে বলল, ”জ্যাঠামশাই এতকাল লক্ষ্মণের শক্তিশেল কথাটাই তো শুনে এসেছি, রাবণের শক্তিশেল আবার কী?”

”শক্তিশেলটা কার, রাবণেরই তো? ময়দানব ওটা তৈরি করে জামাই রাবণকে যৌতুক দিয়েছিল।”

রাজশেখরের কথা শেষ হওয়া মাত্র ঝপ করে মণ্ডপের আলো নিভে গেল আর ধীরে ধীরে মঞ্চের পরদা সরে যেতে লাগল। প্রায় এক হাজার জোড়া চোখ তাকিয়ে রইল মঞ্চের দিকে উদগ্রীব হয়ে।

.

শুরু হল রাবণের শক্তিশেল

সন্ধ্যাকাল। মঞ্চ প্রায়ান্ধকার। মঞ্চের মাঝামাঝি, থলিতে মাথা রেখে আড়াআড়ি হাত—পা ছড়িয়ে শুয়ে একটি লোক। ছোলাভাজা মুখে ফেলতে—ফেলতে জিনসের প্যান্ট আর ঢলঢলে শার্ট পরা কাকের বাসার মতো চুল মাথায় পাতলা চেহারার এক যুবক প্রবেশ করল। এধার—ওধার তাকিয়ে স্বগতোক্তি করল, ”এ কোথায় এলুম রে, বাবা। চারিদিকে জঙ্গল, ভর সন্ধেবেলা ভূত—টুত বেরোবে না তো! ট্রেকারওলাকে বললুম কিষ্কিন্ধ্যা যাব, ব্যাটা এই জঙ্গলে নামিয়ে দিয়ে বলল এটাই কিষ্কিন্ধ্যা।”

বলতে বলতে যুবকটি কয়েক পা গিয়েই শুয়ে থাকা লোকটির পায়ে ঠোক্কর খেল। ভয়ে চমকে উঠে ”উরি বাবা, ভূউউত নাকি গো।” বলে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নিচু হয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝল মানুষ। প্রচণ্ড রেগে ঘুমন্ত লোকটিকে লাথি মেরে সে বলল, ”এই ব্যাটা ওঠ, সন্ধেবেলায় রাস্তার মধ্যিখানে কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোচ্ছিস, আক্কেল—সাক্কেল নেই?”

লোকটি (উঠে বসে)।।মতো কেন, আমি তো কুম্ভকর্ণই!

যুবক।।কোন কুম্ভকর্ণ, রাবণের ভাই?

কুম্ভকর্ণ।।হ্যাঁ, বিভীষণের মেজদা, মেঘনাদের মেজকাকা।

যুবক।।তোমার বাড়ি তো লঙ্কায়। এটা তো কিষ্কিন্ধ্যা, মাঝে সমুদ্দুর। এলে কী করে?

কুম্ভকর্ণ।।ইচ্ছে করে কি আর এসেছি! দাদা বলল, তোর রাক্ষুসে খাওয়ার খরচ জোগাতে আমার ট্রেজারি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, কত আর নোট ছাপিয়ে সামাল দোব, এখনও তেত্রিশটি সোনার বাড়ি তৈরি করা বাকি। এই বলে দাদা পুষ্পক রথে চাপিয়ে আমাকে এখানে এনে নামিয়ে দিয়ে বলল, তোলা আদায় করে খা।

যুবক।।আদায় হয়েছে?

কুম্ভকর্ণ।।আরে দূর, আমার তেমন লোকবল, মানে সাগরেদ নেই, পিছনে পার্টিও নেই, কেউ আমায় ভয় পায় না। তবে চেনে না তো আমি কে, একদিন টপাটপ বানরগুলোকে ধরে—ধরে যখন মুখে ফেলব, তখন বুঝবে কুম্ভকর্ণ কী জিনিস। তা বাপু, তুমি কে?

যুবক।।আমি ঘটোৎকচ। তোমার ত্রেতার পরের দ্বাপর যুগের মানুষ, তোমার চেয়ে মডার্ন। ভীম আমার বাবা, হিড়িম্বা আমার মা, আমিও তোমার মতো রাক্ষস। (হাত বাড়িয়ে দিল, কুম্ভকর্ণ হাত ধরে ঝাঁকাল।)

কুম্ভকর্ণ।।রাক্ষস সব যুগেই আছে।

ঘটোৎকচ।।দেখবে কলিযুগেও থাকবে। কুম্ভ, আমি তো শুনেছি তোমার দাদা দুই যোজন লম্বা আর এক যোজন চওড়া একটা ঘর করে দিয়েছিল তোমার ঘুমোবার জন্য। অভিধানে বলেছে যোজন মানে চার ক্রোশ, এক ক্রোশ মানে আট হাজার হাত, দু’মাইলের বেশি। দু’যোজন মানে যা দাঁড়ায়, তোমার গতরটা তো দেখছি তেমন নয়।

কুম্ভকর্ণ।।আরে দূর, এই মহাকাব্যওলাদের কাজই তিলকে তাল করে দেখানো, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে না দেখালে ওদের পেটের ভাত হজম হয় না। তা বাপু ঘটোৎ, তুমি এই অবেলায় যাচ্ছিলে কোথা?

ঘটোৎকচ।।কাগজে বিজ্ঞাপন দ্যাখোনি, অত ঘুমোলে আর দেখবেই বা কী করে, সুগ্রীব সৈন্য রিক্রুট করবে, তোমার দাদার সঙ্গে যুদ্ধু করবে রাম আর চুক্তি অনুযায়ী সুগ্রীব রামকে সৈন্য সাপ্লাই দেবে, আজ রাত থেকেই লাইনে দাঁড়াতে হবে।

কুম্ভকর্ণ।।কেন মিছিমিছি বেঘোরে প্রাণটা দেবে ভাই। তার চেয়ে অন্য কোথাও চেষ্টা করো। তুমি পশ্চিমবঙ্গে চলে যাও না কেন, সেখানে রোজগারের এত পথ আছে যে, তুমি কোন পথটা নেবে ভাবতে—ভাবতে দিশাহারা হয়ে যাবে।

ঘটোৎকচ।।দু’—একটা পথ বাতলে দাও তো ভাই। লোকে হিড়িম্বা রাক্ষুসির ছেলে, জংলি, এই সব বলে এমন ঘেন্না করে যে, সহ্য করা যায় না।

কুম্ভকর্ণ।।তুমি পুকুর বোজানোর কাজ শুরু করো। ঠিকা নাও আর পুকুর ভরাট করো। কেউ কিচ্ছু তোমায় বলবে না, প্রোমোটার সব সামলে দেবে। আর প্রোমোটার যদি খুঁজে না পাও, তা হলে ডাক্তার হয়ে যাও। ডিগ্রি নেই? কিচ্ছু ভেব না, কতকগুলো ইংরিজি অক্ষর নামের পাশে সাইনবোর্ডে লাগিয়ে বসে যাও, কেউ টুঁ শব্দটি করবে না। চুটিয়ে ডাক্তারি করে যাও গ্রামে, এমনকী শহরেও। ডাক্তার হতে ইচ্ছে না করলে মাস্টার হয়ে যাও, স্কুলে যেতেও হবে না। তুমি দু’—একটা চেয়েছিলে, আমি এক্ষুনি তিনটে বলে দিলুম। একটু ভাবতে সময় পেলে গোটা পনেরো পথ বলে দিতে পারতুম।

(নেপথ্যে বিউগল ধ্বনি। কুম্ভকর্ণ ও ঘটোৎকচের সচকিত হয়ে স্থান ত্যাগ। সপার্ষদ রাম ও লক্ষ্মণের প্রবেশ।)

পারিষদদের মালকোঁচা করে পরা ধুতি। হাফ শার্ট। পিঠে কাগজে লালকলিতে লেখা ‘সুগ্রীব’, ‘অঙ্গদ’, ‘জাম্বুবান’ ইত্যাদি নাম পিন দিয়ে সাঁটা।

রাম (উবু হয়ে বসে ললাটে করাঘাত)।।সীতা সীতা! হায় সীতা! তুমি বেঁচে আছ কি মরে গেছ জানি না। কেউ যদি একবার খবর এনে দিত সীতা ঠিকমতো খাচ্ছে—ঘুমোচ্ছে কিনা, তা হলে আমি নিশ্চিন্ত হতুম। সুগ্রীব, সীতার খবর নিতে কাউকে পাঠাও না ভাই। এই সাগরটা লাফ দিয়ে পার হওয়া মানুষের কর্ম নয়, পারে শুধু বানরেরা।

সুগ্রীব।।আপনি কিচ্ছু ভাববেন না সীতাপতি। জানকী কোথায় আছেন সে খবর যখন পেয়ে গেছি আর ভাবনার কিছু নেই। আমি লোক পাঠাচ্ছি।

লক্ষ্মণ।।লোক?

সুগ্রীব।।সরি, বানর পাঠাচ্ছি। বাবা অঙ্গদ, তোমার সাঙ্গপাঙ্গদের ডাকো তো।

(অঙ্গদ উইংয়ের কাছে গিয়ে ভিতরদিকে মুখ করে হাঁক দিল, ‘এইই কারা আছিস দৌড়ে আয় রাজামশাই ডাকছেন।’ হনুমানসহ কয়েকজন বানর ছুটে স্টেজে ঢুকল হুমড়ি খেতে—খেতে।)

সুগ্রীব।।তোমাদের লম্ফঝম্পের কেরামতি এবার দেখাতে হবে। এই যে সাগর দেখছ (অপর প্রান্তের উইংয়ের দিকে হাত তুলে দেখাল), এই সাগর লাফিয়ে পার হয়ে লঙ্কায় যেতে হবে। সেখানে অশোকবনে সীতাজননী রয়েছেন। তাঁর খবর আনতে হবে। তিনি ঠিকমতো খাচ্ছেন—দাচ্ছেন কিনা, ঘুমটুম হচ্ছে কিনা, এগুলো জেনে আসবে আর এখানকার খবর, রামচন্দ্রর খবর দিয়ে বলবে তিনি ভীষণ কান্নাকাটি করছেন। আপনার অদর্শনে চান করেন না, চুল আঁচড়ান না, কিচ্ছুটি মুখে দেন না। আর বলবে আপনাকে উদ্ধারের জন্য কিষ্কিন্ধ্যার রাজা সুগ্রীব জোর কদমে কাজ শুরু করেছেন। সাগরের উপর একটা ব্রিজ বানাবার জন্য টেন্ডার ডাকা হবে আর সৈন্য রিক্রুটের কাজ এখুনি শুরু হবে।

১ম বানর।।সাগরটা কত চওড়া রাজামশাই?

সুগ্রীব।।একশো যোজন।

২য় বানর।।ওরে বাববা। অতটা কী করে লাফাব। পঞ্চাশ যোজন হলে চেষ্টা করতে পারি।

৩য় বানর।।সত্তর—টত্তর হলে নয় লাফানো যায়।

৪র্থ বানর।।সাগরের মাঝামাঝি যদি পাহাড়—টাহাড় গোছের কিছু থাকত তা হলে তার উপর প্রথম লাফ দিয়ে পড়ে আর এক লাফে লঙ্কায় পৌঁছনো যায়।

জাম্বুবান।।হনুমান চুপ কেন? মহাবীর তুমি। (পাঁচালির সুরে)

জানিয়া সীতার বার্তা আইস হনুমান।

চিন্তিত রামেরে সব করো পরিত্রাণ।।

পৌরুষ প্রকাশ করো সাগর লঙ্ঘিয়া।

শ্রীরামেরে তুষ্ট করো সীতা উদ্ধারিয়া।।

হনুমান।।মন্ত্রীমশাই, সুড়সুড়ি দিয়ে কার্য উদ্ধার হয় না। আগে বলুন মালকড়ি কী ছাড়বেন?

জাম্বুবান।।একশোটা মর্তমান কলা।

হনুমান।।ঠিক—ঠিক দেবেন তো? মন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি তো, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।

জাম্বুবান।।হ্যাঁ রে বাবা, দোব।

(হনুমান বৈঠক দিয়ে হাত—পা ছুড়ে ওয়ার্ম আপ শুরু করল। ছোট—ছোট লাফ দিয়ে স্টেজের উপর ঘুরল। সেই সঙ্গে পাঁচালির সুরে বলতে লাগল,

সাগর যোজন শত দেখি খালিজুলি।

শতবার পার হই আমি মহাবলী।।

উড়িয়া পড়িব গিয়া স্বর্ণ লঙ্কাপুরী।

শত্রু মারি উদ্ধারিব রামের সুন্দরী।।

চূড়ান্ত লাফ দেওয়ার আগে দৌড়বার জন্য হনুমান স্টেজের একপ্রান্তে কুঁজো হয়ে প্রস্তুত হল।

রাম।।হনু, একবারটি শোনো। (হনুমান কাছে এল। রাম কাঁধের থলি থেকে মালার মতো গাঁথা পানপরাগের পাউচ বের করে তার হাতে দিল) সীতাকে দিয়ো। রোজ ভাত খেয়ে একটা না খেলে অম্বল হয় ওর।

(পাউচগুলো বারমুডার পকেটে রেখে হনুমান আবার প্রস্তুতি নিল। কুঁজো হয়ে সামনে—পিছনে কয়েকবার দুলে হনুমান চিৎকার করে ‘জয় শ্রীরামজি’ বলেই দুড়দাড় বেগে স্টেজ কাঁপিয়ে ছুটে গিয়ে খড়ির দাগ টানা জায়গায় পৌঁছেই দু’হাত তুলে ঝাঁপ দিল। উইংয়ের বাইরে জমির উপর একটা চাদর টানটান করে জালের মতো ধরে দাঁড়িয়ে ছিল জয়দেব ও কলাবতী। হালকাভাবেই হনুমান পড়ল তাকিয়াগুলোর উপর।

কলাবতী উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, ”রুকু, লাগেনি তো?”

হাততালিতে তখন ফেটে পড়ছে মণ্ডপ। মেয়েরা ওঠবোস করছে চেয়ারে। গলা ছেড়ে ‘রুকু, রুকু’ বলে চেঁচাচ্ছে। তারই মধ্যে রাজশেখর মলয়াকে বললেন, ”কালু লিখেছে কেমন বলো? অবশ্য সতু ব্রাশআপ করে কিছুটা ঝালাই করে দিয়েছে। প্রত্যেকটি মেয়ে কিন্তু দারুণ অভিনয় করছে।”

”ও যে এইরকম ভাবতে পারে ধারণায় ছিল না। ওর গোটা টিমটাকে একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াব।” মলয়া কথাটা বলে এধার—ওধার তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজল, তারপর বলল, ”উদ্বোধনের দিন যদি আসতেন, বেলুন ওড়ানো দেখলে আপনার ভাল লাগত।”

(ইতোমধ্যে মঞ্চে আবার আলো জ্বলে উঠেছে। বানররা চোখের উপর কর রেখে বহু দূরে আকাশে মিলিয়ে যাওয়া হনুমানকে দেখছিল।)

১ম বানর।।এতক্ষণে বোধহয় পৌঁছে গেছে। যা একখানা লম্ফ দিল।

পাটাতনে খড়ির দাগ যেখানে কাটা, হনুমান সেখানে পায়ে ধাক্কা দেওয়ায় পেরেক খুলে গিয়ে পাটাতনটা ঝুলে পড়ে। অন্ধকার থাকায় সেটা কারও নজরে পড়েনি।

সুগ্রীব।।জাম্বুবান, আমাদের চিফ ইঞ্জিনিয়ারটা কে যেন, তাকে ডাকো তো।

জাম্বুবান।।বিশ্বকর্মার ছেলে নল। দারুণ রাস্তাঘাট, বাঁধ বানায়। এক—একদিনে কুড়ি—পঁচিশ যোজন পাকা রাস্তা তৈরি করে ফেলে, এগারো—বারো দিন পর্যন্ত টিকে থাকে!

সুগ্রীব।।বটে বটে, এ তো দারুণ ইঞ্জিনিয়ার। এগারো—বারো দিন, বলো কী? আমি তো জানতুম সাড়ে সাতদিনের বেশি আমাদের রাস্তা টেঁকে না। নলকে ডাকো, ওকেই সেতুবন্ধনের বরাতটা দেওয়া যাক।

জাম্বুবান।।রাজামশাই, আমাদের নিয়ম বড় কাজ টেন্ডার ডেকে দেওয়ার।

সুগ্রীব।।আরে রাখো তোমার নিয়ম। দেখছ না রামচন্দ্রজির কী অবস্থা। আর সাতদিনও টেকেন কিনা বলা যায় না। জরুরি ভিত্তিতে আমাদের কাজ করতে হবে। টেন্ডার—ফেন্ডার কাজ শেষ হলে ডেকো, তখন যা পাস—টাস করার করে দেব। যাও, জলদি যাও। (জাম্বুবানের দ্রুত প্রস্থান)। রামচন্দ্রজি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। হাজার—হাজার বেকার বানর ছেলে সৈনিক হওয়ার জন্য গ্রাম থেকে ছুটে এসে সত্তর ঘণ্টা আগে লাইন দিয়েছে খবর পেলুম। সেতুটা করে ফেলছি, আর দু’টো দিন সময় দিন, কাজ শুরু করে দেব। তারপর সেতুর উপর দিয়ে হাজার—হাজার বানর সেনা গিয়ে দেখবেন কী লঙ্কাকাণ্ড তখন বাধিয়ে দেবে।

(জাম্বুবানের প্রবেশ। সঙ্গে নল, তার বগলে একটা ফাইল)

জাম্বুবান।।ধরে এনেছি রাজামশাই। সহজে কী আসতে চায়, ঠিকেদারদের সঙ্গে বৈঠক করছিল।

সুগ্রীব।।কীসের বৈঠক?

নল।।আজ্ঞে, গঙ্গোত্রীতে বন্যা। গ্রামকে গ্রাম জলে তলিয়ে যাচ্ছে। বোল্ডার ফেলতে হবে। ঠিকাদাররা যে রেট দিচ্ছে, তা মানা যায় না। তাই নিয়েই বৈঠক।

সুগ্রীব।।কী ঠিক হল?

নল।।মেনে নিলুম। লোকে কাজ হচ্ছে দেখতে চায়। দেখাবার একটা ব্যবস্থা তো হল।

সুগ্রীব।।খুব বুদ্ধিমান তো তুমি। তা এবার বুদ্ধি করে সেতুটা চটপট বেঁধে দাও।

নল।।কীরকম সেতু চাইছেন। (ফাইল খুলে সুগ্রীবকে দেখাতে লাগল) এটা হল সাসপেনশন ব্রিজ আর এটা হল ক্যান্টিলিভার…”

সুগ্রীব।।তোমার পেনশন—টেনশন, লিভার—ফিভার ছাড়ো। বেশি সময় দিতে পারব না, স্রেফ পরপর নৌকো সাজিয়ে তার উপর তক্তা পেতে দাও।

নল।।পন্টুন ব্রিজ? চারদিন সময় দিন, এমন জবরদস্ত সেতু বানিয়ে দেব অন্তত একমাস টিকবে। ততদিনে যুদ্ধটা শেষ হয়ে সীতাদেবীকে ওই সেতুর উপর দিয়েই ফিরিয়ে আনবেন রঘুনন্দনজি। (নলের প্রস্থান। প্রবেশ করল বিভীষণ)

বিভীষণ।।এখানে রামচন্দ্র কে আছেন?

রাম।।আমি। আপনি কে? কী দরকার?

বিভীষণ।।আমি লঙ্কেশপতি দশাননের ছোট ভাই বিভীষণ। আপনার শ্রীচরণে আশ্রয় নিতে এসেছি। দাদা লাথি মেরে আমাকে একটা নৌকোয় তুলে দেয়, ভাসতে—ভাসতে এসে পড়লুম। আমাকে দয়া করুন রাঘব। সীতা উদ্ধারে আমি আপনাকে লঙ্কার সব সুলুকসন্ধান দোব।

লক্ষ্মণ।।এ তো দেখছি ঘরশত্রু। দাদা, একে দরকার হবে। রেখে দাও। তা বাপু বিভীষণ, রাবণ তোমায় লাথি মারল কেন?

বিভীষণ।।দাদা তোলা আদায়ের জন্য কুম্ভকর্ণকে কিষ্কিন্ধ্যায় পাঠাতে চাইল। আমি বললুম, ‘এটা অধর্ম, অন্যায় কাজ হবে।’ দাদা চটে গিয়ে লাথি মেরে বলল, ‘তুই ধার্মিকদের সঙ্গে গিয়ে থাক, লঙ্কায় তোর স্থান হবে না।’

(এক বানর সেনা বিভীষণের কোঁচা খুলে পকেট হাতড়ে সার্চ করা শুরু করল। পকেট থেকে বেরোল একটা পুরিয়া। সেনাটি পুরিয়া খুলে শুঁকে সেটা সুগ্রীবের হাতে দিল।)

সুগ্রীব।।এটা কী বিভীষণ? মনে হচ্ছে নারকোটিকস। তুমি কি এইসব নেশার জিনিস শোঁকো? খাও?

(মাথায় ছোট—ছোট কাগজের নৌকো নিয়ে সার দিয়ে বানররা স্টেজের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। স্টেজের পিছন দিক দিয়ে ঘুরে এসে আবার স্টেজে ঢুকল।)

জাম্বুবান।।চোরা চালানদার হতে পারে। আমাদের সুকুমারমতি ছেলেদের নেশা ধরাতে হয়তো রাবণই এই ব্যাটাকে পাঠিয়েছে। একে জেলে রাখা উচিত।

রাম।।সুগ্রীব, বিভীষণ জেলে নয়, আমার সঙ্গে থাকবে। এইরকম লোকই আমার দরকার।

(নলের প্রবেশ।)

নল।।কাজ কমপ্লিক্ট। এবার সৈন্য—টৈন্য নিয়ে লঙ্কায় চলুন।

রাম (অবাক হয়ে)।।সে কী! এর মধ্যে হয়ে গেল সেতু?

নল (আরও অবাক হয়ে)।।এতে অবাক হওয়ার কী আছে? জরুরি ভিত্তিতে কাজ না? কাঠগুলো অবশ্য কাঁচা, বেশ নরম, একটু পা টিপে—টিপে যেতে হবে। খাওয়া—দাওয়াটা এবার সেরে ফেলুন, তারপর একটা দিবানিদ্রা দিয়ে ঝরঝরে হয়ে লঙ্কা জয় করতে বেরিয়ে পড়া যাবে।

(সকলের প্রস্থান। কুম্ভকর্ণ এবং ঘটোৎকচের প্রবেশ।)

কুম্ভকর্ণ।।ঘটোৎ, কী হল, ল্যাংড়াচ্ছ কেন?

ঘটোৎকচ।।আর বোলো না কুম্ভ। হাজার—হাজার মরিয়া বেকার ছেলে এমন হুড়োহুড়ি শুরু করল যে, জাম্বুবানের পুলিশ লাইন সামলাতে লাঠি চালাল, লাইন ছত্রভঙ্গ। পায়ে লাঠি, পিঠে লাঠি, এই দ্যাখো না (জামা তুলে পিঠ দেখাল)। লাইন থেকে সেই যে ছিটকে গেলুম আর ঢুকতে পারলুম না। এখন ভাবছি মায়ের কাছে জঙ্গলে চলে যাব। সেখানে হাতিটা, গণ্ডারটা তো খেতে পাব। তুমি এখন কী করবে?

কুম্ভকর্ণ।।আমিও দেশে ফিরে যাব। শুনলুম আমার ছোট ভাইটা এখানে এসে রামের সঙ্গে ভিড়েছে, নিশ্চয়ই আমার খবর এতক্ষণে রামকে দিয়েছে। ধরার জন্য পুলিশ নিশ্চয়ই আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দ্যাখো বাপু, জেল খাটা আমার পোষাবে না। শুনেছি ওখানে শান্তিতে ঘুমোনো যায় না। আমি বরং সুগ্রীবের সৈন্যদের সঙ্গে ভিড়ে সেতু দিয়ে কুচকাওয়াজ করে লঙ্কায় ফিরে যাই।

(নেপথ্যে ড্রামের ও বিউগলের আওয়াজ। মার্চ করে জনাদশেক বানরসেনা ঢুকে ‘জয় জয় শ্রীরাম’ বলতে—বলতে অপরপ্রান্তের উইংয়ের দিকে এগোল। কুম্ভকর্ণ শেষ সেনাটির পিছনে টুক করে ভিড়ে গেল।)

ঘটোৎকচ।।তা হলে আর আমিই বা এখানে থেকে কী করব। যাই। (প্রস্থান।)

স্টেজের আলো কমে গেল। বিপরীত দিক থেকে পূজারীর বেশে মেঘনাদের প্রবেশ। স্টেজের মাঝখানে পূজা দেওয়ার ভঙ্গিতে বসে জোড়হাতে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চচারণ করতে লাগল। চুপিসাড়ে বিভীষণ ঢুকে হাতছানি দিয়ে লক্ষ্মণকে ডাকল। জিনসের ট্রাউজার্স আর জ্যাকেট, মাথায় সবুজ কাউন্টি ক্যাপ পরা লক্ষ্মণ গুঁড়ি মেরে ঢুকল। উইংয়ের আড়ালে সরে গেল বিভীষণ।

মেঘনাদ (চমকে উঠে)।।কে, কে ঢুকল এই নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে? ওহ বিভাবসু, আপনি। কী সৌভাগ্য আমার। কিন্তু কী কারণে, কহ তেজস্বী আইলা রক্ষঃকুলরিপু নর লক্ষ্মণের রূপে প্রসাদিতে এ অধীনে?

লক্ষ্মণ (দু’ পা ফাঁক করে কোমরে হাত রেখে)।।নহি বিভাবসু আমি দেখ নিরখিয়া (স্টেজের আলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল) রাবণি। লক্ষ্মণ নাম, জন্ম রঘুকুলে। সংহারিতে, বীরসিংহ তোমায় সংগ্রামে আগমন হেথা মম; দেহ রণ মোরে অবিলম্বে।

মেঘনাদ।।সত্যি যদি তুমি রামানুজ, তা হলে কোন কায়দায় এখানে ঢুকলে? চারিদিকে এত পাহারা, মাছি পর্যন্ত গলার সাধ্য নেই।

লক্ষ্মণ (কোমর থেকে পাউরুটি কাটার ছুরি বের করে)।।কী করে ঢুকলুম? বিভীষণ, কোথায় গেলে বিভীষণ (প্রবেশ করল বিভীষণ) এই যে। তোমার কাকাই আমাকে রাস্তা চিনিয়ে এনেছে।

মেঘনাদ (বিষাদভরে)।।এতক্ষণে জানলুম কী করে লক্ষ্মণ ঢুকল রক্ষঃপুরে। হায় কাকা, কাজটা কি উচিত হয়েছে? তোমার মা—দাদা—ভাইপো কারা, সেটা কি ভুলে গেলে? নিজের বাড়ির রাস্তা চোরকে দেখালে, ছোটলোককে রাজবাড়িতে আনলে?

বিভীষণ।।কী করব বল, আমি রাঘবের চাকর। তার বিপক্ষে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

মেঘনাদ।।কাকা, তোমার কথা শুনে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে আনিলে একথা। স্থাপিলা বিধুরে বিধি স্থানুর ললাটে, পড়ি কি ভূতলে শশী যান গড়াগড়ি ধুলায়? কোন মহাকুলে তোমার জন্ম, সেটা কি ভুলে গেছ? এই লক্ষ্মণটা কী নীচ দ্যাখো, আমার কাছে অস্ত্র নেই, আর বলছে কিনা যুদ্ধ করো। এটা কি মহারথিপ্রথা?

লক্ষ্মণ।।ওসব বড়—বড় প্রথার কথা রাখ। আজ তোকে বাগে পেয়েছি, আর ছাড়াছাড়ি নয়। তোকে শেষ করে এখান থেকে যাব (ছুরি তুলে এগিয়ে এল)। মেঘনাদ লাফ দিয়ে উঠে লক্ষ্মণের হাতে লাথি মারতেই ছুরি পড়ে গেল। বিভীষণ কুড়িয়ে নিয়ে তুলে দিল লক্ষ্মণের হাতে। মেঘনাদ ছুটে স্টেজ থেকে বেরিয়ে যেতে—যেতে বলল, ”দাঁড়া, অস্ত্র আনি, তারপর দেখি তুই কত বড় বীর।” লক্ষ্মণ দ্রুত ছুরি মারল প্রস্থানরত মেঘনাদের পিঠে।

মেঘনাদ (আর্তস্বরে)।।বীর কুলগ্লানি, সুমিত্রানন্দন তুই! শত ধিক তোরে। রাবণনন্দন আমি, না ডরি শমনে। কিন্তু তোর অস্ত্রাঘাতে মরিনু যে আজি, পামর, এ চির দুঃখ রহিল রে মনে। বাবা, বাবা, তুমি এর বদলা নিয়ো। (টলতে—টলতে বেরিয়ে গেল, তাকে অনুসরণ করল বিভীষণ ও লক্ষ্মণ)

(স্টেজ অন্ধকার। খাকি হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট ও মোজা পরা উদভ্রান্ত রাবণ। মাথায় হেলমেট, তাতে গোল করে সাঁটা নয়টি মুখ। দ্রতু অস্থির পায়চারি। ধুতি—পাঞ্জাবি পরা দূত তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে।)

রাবণ।।কহ দূত! কে বধিল চির রণজয়ী ইন্দ্রজিতে আজি রণে? কহ শীঘ্র করি।

দূত।।ইঁদুরের মতো নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ঢুকে সৌমিত্রি কেশরী অন্যায় যুদ্ধে বধ করেছে। বীরশ্রেষ্ঠ রাবণ, এখন শোক ভুলে যে আপনার ছেলেকে মেরেছে তাকে সংহার করুন।

রাবণ (চিৎকার করে)।।এ কনকপুরে, ধনুর্বর আছে যত সাজ শীঘ্র করি চতুরঙ্গে! রণরঙ্গে ভুলিব এ জ্বালা। এ বিষম জ্বালা যদি পারি রে ভুলিতে। (দূতসহ প্রস্থান। সঙ্গে—সঙ্গে বেজে উঠল বিউগল, ড্রাম, ঢোল, ঝাঁঝর এবং কোলাহল, হুঙ্কার। সপার্ষদ সুগ্রীবসহ রাম ও লক্ষ্মণের প্রবেশ।)

রাম (সভয়ে)।।সুগ্রীব, মনে হচ্ছে প্রলয় উপস্থিত, মাটি যেন কাঁপছে, টাইফুন যেন ধেয়ে আসছে। আমার ভীষণ ভয় করছে। রাখ গো রাঘবে আজি এ ঘোর বিপদে। (সুগ্রীবকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল) স্ববন্ধুবান্ধবহীন বনবাসী আমি ভাগ্যদোষে; তোমরা হে রামের ভরসা। কুল, মান, প্রাণ মোর রাখ হে উদ্ধারি, রঘুবন্ধু, স্নেহপণে কিনিয়াছ রামে তোমরা।

সুগ্রীব।।কিচ্ছু ভয় পাবেন না। দয়া করে কাঁদবেন না। এখন কান্নাকাটি করার সময় নয়। লক্ষ্মণ যে কেন ওইভাবে মেঘনাদকে খুন করল। এখন ঠেলা বুঝুন। রাবণ এখন ক্ষ্যাপা ষাঁড়, আমাদের গুঁতিয়ে শেষ করে দেবে, ওর টার্গেট এখন লক্ষ্মণ।

জাম্বুবান।।আমি বলি কী, লক্ষ্মণ এখন লুকিয়ে পড়ুক। আমি ওকে আমার পুকুরপাড়ের কচুবনে নিয়ে যাই। রাবণ খুঁজে পাবে না, আসুন লক্ষ্মণ। (লক্ষ্মণকে নিয়ে প্রস্থান।)

অঙ্গদ।।লক্ষ্মণ কি সাঁতার জানে? পুকুরপাড়টা ঢালু আর মাটিটা পিছল, গড়িয়ে পড়লে একেবারে জলে। ওকে বারণ করে আসি, ঢালের দিকে যেন না যায় (ছুটে প্রস্থান)।

(ট্রাইসাইকেল চেপে রাবণের প্রবেশ। গলায় দড়ি দিয়ে একটা লোহার নল, পিঠে বন্দুকের মতো আড়াআড়ি ঝোলানো। নলের মাথায় ঢোকানো একটা টর্চ। রাবণের কোমরে ঝুলছে চ্যালাকাঠ। ভিতরে হাঁড়ি চাপা কালিপটকা ফাটার শব্দ।)

রাবণ।।কোথায়, কোথায় লক্ষ্মণ। আজ ব্যাটার ছাল ছাড়িয়ে রোস্ট করে খাব। (হনুমানকে দেখে) এই হনু (কোমর থেকে চ্যালাকাঠ খুলে হনুমানের পিছনে দু’ ঘা কষিয়ে) ভাগ ভাগ। (গলা ধাক্কা, হনুমান পড়ে গেল এবং হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেল।)

সুগ্রীব (হাতজোড় করে)।।আমার হাঁটুতে বাত, দৌড়তে পারব না। আস্তে হেঁটে যাচ্ছি (খোঁড়াতে—খোঁড়াতে প্রস্থান)।

রাবণ।।এই যে রামচন্দর, দেবতাদের পুষ্যিপুত্তুর, পাবলিসিটি পেয়ে—পেয়ে মহাবীর হয়েছ। না চাহি তোমারে হে বৈদেহীনাথ। এ ভবমণ্ডলে আর একদিন তুমি জীব নিরাপদে। কোথা সে অনুজ তব কপটসমরী পামর?

রাম (কম্পিত কণ্ঠে)।।লক্ষ্মণ পুকুরপাড়ে কচুবনে। যদি বলো তো ডেকে আনছি।

রাবণ।।এক মিনিট সময় দিচ্ছি, ডেকে আনো।

(রামের দৌড়ে প্রস্থান।)

(রাবণ পিঠ থেকে নলটি খুলে পরীক্ষা করে সাইকেলে ঠেস দিয়ে রাখল। পায়চারি শুরু করল। উইংয়ের কাছে লক্ষ্মণকে দেখা গেল।)

রাবণ।।এতক্ষণে রে লক্ষ্মণ। এ রণক্ষেত্রে নরাধম তোকে পেলুম। কুক্ষণে সাগর পার হলি, পশিলি রাক্ষসালয়ে চোরবেশ ধরি, চুরি করলি জগতের অমূল্য রাক্ষসরত্ন।

লক্ষ্মণ।।আমি ক্ষত্রিয়ের ছেলে, রাক্ষসকে ভয় পাই না, এটা জেনে রেখো।

রাবণ।।বটে। তোর লম্বা চওড়া কথা বলা এবার ঘুচোচ্ছি।

(স্টেজের আলো বিদ্যুৎ চমকের মতো দপদপ করতে থাকল। দেখা গেল পিঠের নলটা রকেট লঞ্চারের মতো রাবণ কাঁধে রাখল।)

রাবণ।।লক্ষ্মণ, আজি নাহি রক্ষা মোর হাতে।

(নলের মাথায় ঢোকানো টর্চের বোতাম টিপল, তীব্র আলো অন্ধকার মঞ্চ ভেদ করে লক্ষ্মণের বুকে পড়ল। এবার চকলেট বোমা ফাটার শব্দ। ঝাঁঝর, ঢোল, ড্রাম বেজে উঠল। আর্তনাদ করে লক্ষ্মণ মঞ্চের উপর পড়ে গেল। অট্টহাসি হেসে রাবণ ঝুঁকে লক্ষ্মণকে দেখে সাইকেলে উঠে উইং দিয়ে বেরিয়ে গেল। আলো জ্বলে উঠল। ছুটতে—ছুটতে মঞ্চে এল রাম, সুগ্রীব, বিভীষণ এবং অন্যান্যরা। লক্ষ্মণের বুকে আছড়ে পড়ল রাম।)

রাম।।ভাই রে লক্ষ্মণ (হাউহাউ করে কেঁদে)। আজি এ রক্ষঃপুরে অরি মাঝে আমি বিপদসলিলে মগ্ন। রাখিবে আজি কে, কহ, আমারে? কার কাছে আমাকে রেখে গেলি ভাই, এইসব ভিতু কলা—খাওয়া বানরগুলোর হাতে? (কপাল চাপড়াতে লাগল।)

সুগ্রীব (লক্ষ্মণের নাড়ি টিপে বুকে কান পেতে)।।সুমিত্রানন্দন মনে হচ্ছে এখনও পুরো পটল তোলেননি, কলজেটা ধুকধুক করছে। হনুমান, দৌড়ে ডাক্তার ডেকে আন।

হনুমান।।এত রাত্তিরে ডাক্তার আসবে ভেবেছেন? তিন কাঁদি কলা দিলেও আসবে না। তাতে রুগি মরে তো মরুক।

সুগ্রীব।।কোবরেজমশাই সুষেণ গেলেন কোথা? (দেখতে পেয়ে) এই যে কোবরেজ, দেখুন তো লক্ষ্মণকে বাঁচিয়ে তোলা যায় কি না।

সুষেণ (লক্ষ্মণের পেট টিপে, চোখের পাতা টেনে, চুল ধরে নাড়া দিয়ে, হাতের আঙুল মটকে, নাকের তলায় হাত রেখে)।।

প্রভু না হও কাতর।

বাঁচিবেন অবশ্য লক্ষ্মণ ধনুর্ধর।।

হস্ত—পদে রক্ত আছে প্রসন্নবদন।

নাসিকায় শ্বাস বহে প্রফুল্ল লোচন।।

হেনজনে নাহি মরে সবাকার জ্ঞানে।

আনিবারে ঔষধ পাঠাও হনুমানে।।

রাম।।এখন আমার মাথার ঠিক নেই, আপনিই বলে দিন কোথা থেকে কী ওষুধপত্তর আনতে হবে। অ্যাই হনুমান, কোবরেজমশাই যা আনতে বলবেন, নিয়ে এসো।

সুষেণ।।

শুন পবনন্দন।

ঔষধ আনিতে যাহ হে গন্ধমাদন।।

গিরি গন্ধমাদন সে সর্বলোকে জানি।

তাহাতে ঔষধ আছে বিশল্যকরণী।।

হনুমান।।কোবরেজি ওষুধ মানে গাছপালা, শেকড়বাকড়। ওসব চেনা আমার কম্মো নয়। অ্যালোপ্যাথি হলে সোজা টাবলেট ক্যাপসুল কেনো আর খাও, নয়তো প্যাঁট করে ইঞ্জেকশন ফোটাও।

জাম্বুবান।।কোবরেজমশাই, এ মুখ্যুটাকে বরং ফর্দ করে লিখে দিন নয়তো সব গুবলেট করে ফেলবে।

সুষেণ।।তাই লিখে দিচ্ছি। চটাপট জলদি যাবি আর আসবি। রাত্রি মধ্যে ঔষধ বাঁচাব সহজে। রজনী প্রভাতে প্রাণ যাবে সূর্যতেজে। আয় আমার সঙ্গে, ব্যবস্থা লেখার প্যাডটা বাড়িতে রয়ে গেছে।

(সুষেণ ও হনুমানের প্রস্থান।)

(স্টেজের আলো ক্ষীণ হতে—হতে অন্ধকার।) উইংয়ের বাইরে দ্রুত তৎপরতা। ব্রততী হাতঘড়ি তুলে কলাবতীকে দেখিয়ে বলল, ‘আর পাঁচ মিনিট এক ঘণ্টা হতে। নাইলনের দড়িতে দাঁড়িপাল্লার মতো ঝুলছে একটা পিঁড়ে। তার উপর তোলার চেষ্টা চলছে হনুমানকে। ধূপছায়া ও জয়দেব কোনওক্রমে পাঁজাকোলা করে রুকমিনিকে তুলে পিঁড়িতে বসাল। হাতে তুলে দিল ছোট্ট একটি ধামা। সেটা লাউডগা, কলমি আর পুঁইশাক, নিমপাতা ও কচুপাতায় ভরা। মজা পেয়ে মিটমিট করে হাসছে রুকমিনি।

কলাবতী ধমক দিয়ে বলল, ”হাসবি না একদম। ধামাটা এইভাবে মাথায় ধরে স্টেজে নামবি। নেমে বলবি ‘অন্ধকারে আপনার প্রেসক্রিপশনটা পড়তে পারিনি। হাতের লেখাটাও বিচ্ছিরি। গন্ধমাদনের মাথাটাই ভেঙে নিয়ে চলে এলুম। এবার যা খোঁজার খুঁজে নিন।’ পারবি বলতে?”

হনুমান মাথা হেলিয়ে দিল। জয়দেব দড়ি ধরল টানার জন্য। টর্চটা হাতে নিয়ে চাপাস্বরে কলাবতী বলল, ”গো হনু।”

মঞ্চ অন্ধকার। রোমাঞ্চিত হয়ে দর্শকরা টর্চের আলোয় দেখল ধামা মাথায় হনুমান। ধামা থেকে উপচে বিশল্যকরণীর নানান পাতা। ঝুলতে—ঝুলতে হনুমান অন্য প্রান্তের উইংয়ের দিকে মন্থর গতিতে এগোচ্ছে। স্টেজের উপরদিক থেকে ঝোলানো কালো কাপড় এবং অন্ধকার থাকায় হনুমান ঝুলছে যে তার থেকে, সেটি দেখা যাচ্ছে না। উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে টর্চের রশ্মিতে শুধু হনুমান। হাততালিতে ফেটে পড়ল মণ্ডপ। রুকমিনির মা অরুণা দাঁড়িয়ে উঠে দু’হাত তুলে ঝাঁকাতে লাগল। একদল মেয়ে চিৎকার করে উঠল ‘জয় হনুমানজি কি জয়।’ ‘বলো বজরংবলীজি জিন্দাবাদ।’

হনুমান পুলকে একহাতে ধামাটা ধরে অন্য হাতটা তুলে সামান্য নাড়ল দর্শকদের উদ্দেশ্যে। পিঁড়িটা একটু নড়ে উঠল। দড়ির কোথাও রোলারটা আটকে গেছে, জয়দেব টানাটানি করতেই হনুমান দুলে উঠল। অবশেষে জয়দেব মরিয়া হয়ে দড়িতে একটা হ্যাঁচকা দিল। হনুমান—বসা পিঁড়িটা কাত হতে যেতেই রুকমিনি লাফ দিয়ে পড়ল অন্ধকার স্টেজে।

মড়াৎ একটা শব্দ। টর্চের রশ্মি হনুমানকে অনুসরণ করে যাচ্ছিল। দেখা গেল, হনুমান ধামা—মাথায় একটা গর্ত দিয়ে স্টেজের তলায় চলে যাচ্ছে। কলাবতীর মুখ দিয়ে বেরোল শুধু একটি শব্দ, ”সর্বনাশ।”

জয়দেবের মুখ ফ্যাকাশে। কোনওক্রমে বলল, ”কাঠটা পচে গেছল। তার উপর এত লাফালাফি!”

কলাবতী দৌড়ে স্টেজের পিছন দিয়ে অপর প্রান্তের উইংয়ের সিঁড়ির কাছে উবু হয়ে ফিসফিস করে ডাকল, ”রুক, অ্যাই রুক।”

”এই যে আমি।” স্টেজের অন্ধকার তলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল হনুমান, ”আমার ল্যাজটা দুমড়ে নীচের দিকে নেমে গেছে। আমি এখন লোকের সামনে যাই কী করে?”

”যেতে হবে না। ধামাটা গর্ত দিয়ে স্টেজে তুলে কোবরেজ মশাইকে ডাক।”

স্টেজের আলো জ্বলে উঠেছে। দর্শকরা দেখল, স্টেজ ফুঁড়ে ধামা ভরা লতাপাতা উঠল, তার নীচে হনুমানের মুণ্ডু।

হনুমান।।ও কোবরেজমশাই, শুনুন। আপনার জিনিসগুলো খুঁজে পেতে নিন এর মধ্যি থেকে।

(স্টেজে চিত হয়ে শুয়ে লক্ষ্মণ। তাকে ঘিরে সাত—আটজন। সেখান থেকে সুষেণ ছুটে এল। ধামাটা তুলে পাতা ঘেঁটে দেখল।)

সুষেণ। (উল্লসিত কণ্ঠে)।।যা—যা চেয়েছি সব আছে এতে। আর ভয় নেই, লক্ষ্মণ বেঁচে গেল।

তখন আরতির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ব্রততী ভোকাট্টা করার মতো পরদার দড়ি টানতে টানতে বলল, ”তিন মিনিট পর্যন্ত গ্রেস দিয়েছি, আর নয়।”

প্রচণ্ড কোলাহলের এবং হাততালির মধ্যে শেষ হল নাটক। কুশীলবদের দেখার জন্য দর্শকরা দাবি জানাল। পরদা সরে যেতে দেখা গেল মঞ্চে কলাবতীর দু’ধারে মেয়েরা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু হনুমান নেই।

”হনুমান কোথায়, হনুমান কোথায়।” চিৎকার উঠল দর্শকদের থেকে।

কলাবতী ডাকল ”অ্যাই হনুমান, শিগগির আয়।”

বিরাট একটা লাফ দিয়ে উইং থেকে স্টেজে পড়ল হনুমান। ল্যাজটা নামানো। হাতে একটা মর্তমান কলা। সেটার খোসা ছাড়িয়ে খেতে শুরু করল।

কলাবতী বলল, ”এই নাটক লেখায় প্রথমেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি দুই কবির কাছে—কৃত্তিবাস ওঝা আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তারপর ওঁদের বই যিনি পড়তে দিয়েছিলেন, সেই রাজশেখর সিংহর কাছে।”

মিনিটদশেক পর রাগে কাঁপতে—কাঁপতে মলয়া বলল, ”কোথায় ডেকরেটরের সেই লোকটা? মেয়েটার হাড়গোড় যদি ভেঙে যেত?”

জয়দেব তখন উলটোডাঙা স্টেশনে ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *