০৫. আনিস সাবেত

আনিস সাবেত

আমার মন বলছে আজকের যুদ্ধে হুমায়ূন ভাই মারা যাবেন। নৌকার ছাদে বসে তিনি যখন আপন মনে গুনগুন করছিলেন, তখনি আমার এ কথাটা মনে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর তিনি নেমে এসে বললেন, অনেকগুলি উপকাঁপাত হল। একটা তো প্রকাণ্ড। তখনি আমি নিশ্চিত হয়েছি। আমার মনের মধ্যে যে-কথাটি ওঠে, তাই সত্যি হয়। এ আমি অনেক বার দেখেছি।

সেবার স্বরূপহাটির রেলওয়ে কালভার্ট ওড়াতে গিয়েছি।–আমি, রহমান আর ওয়াহেদ। রহমানের আবার খুব চায়ের নেশা। খুঁজে-খুঁজে চায়ের দোকানও একটা বের করেছে। বিস্বাদ তেতো চা–তাতে চুমুক দিয়ে রহমান চেচিয়ে উঠল, ফার্স্ট ক্লাস চা। আর তখনি কেন জানি আমার মনে হল, রহমানের কিছু-একটা হবে। হলও তাই। হুমায়ুন ভাইয়ের বেলাও কি তাই হবে?

হুমায়ূন ভাইয়ের ঢাকার বাসার ঠিকানা আছে আমার কাছে) ১০/৭ বাবর রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-৭। দোতলায় থাকেন তাঁর খাবা-মা। যদি সত্যি কিছু হয়, তাহলে এই ঠিকানায় খবর দিতে আমি নিজেই যাব। তাঁর মা নিশ্চয়ই জানতে চাইবেন তাঁর ছেলে কী ভাবে থাকত, কী করত। সব বলব আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তাঁরা হয়তো ছেলে কোথায় মারা গেছে, দেখতে চাইবেন। আমি নিজেই তাঁদের নিয়ে আসব। আমরা আজ যে-পথে এসেছি, সেই পথেই আনিব। বলব, রাতটা ছিল অন্ধকার। নক্ষত্রের আলোয় আলোয় এসেছি। পথে মোক্তার সাহেবের বাড়িতে ভাত খেয়েছি। হুমায়ূন ভাইয়ের মা হয়তো মোক্তার সাহেবকে দেখতে চাহবেন। মোক্তার সাহেবকে হয়তো তিনি বলবেন, আপনি আমার ছেলেকে শেষ বারের মতো ভাত খাইয়েছেন। আল্লাহ। আপনার মঙ্গল করুক।

ক্যান কান্দেন?

আমাকে যে-ছেলেটি বাতাস করছিল, সে অবাক হয়ে আমার কাঁদবার কারণ জানতে চাইছে। ইচ্ছে করে কি আর কাঁদছি? হঠাৎ চোখে জল এল।

মাথার মধ্যে পানি দিবেন। একটু?

না।

মাথাটা টিপা দিমু?

না-না।

সে দেখি আমার সেবা না-করে ছাড়বে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি তো দিব্যি আরাম করে শুয়ে আছি। আর ওরা নিশ্চয়ই কাদা ভেঙে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। রামদিয়া থেকে আরো দু মাইল উত্তরে মেথিকান্দা। সেখানে তারা হাঁটা-পথে যাবে, না কায় ?

টুনু মিয়ার দলে মোট কত জন ছেলে আছে ? হুমায়ুন ভাই এক বার বলেছিলেন, কিন্তু এখন দেখি ভুলে বসে আছি। ওদের সাথে দু ইঞ্চি মর্টারও আছে। মেথিকান্দা আজ নিশ্চয়ই দখল হবে। সুজনতালির রেলওয়ে পুলও উড়িয়ে দেওয়া হবে। সমস্ত অঞ্চলটা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ উড়িয়ে দেব। ফাইন। কে জানে, এত গোলমালে কেউ কি আর জাতীয় পতাকার কথাটা মনে রাখবে? স্থানীয় লোকজনের কাছে নিশ্চয়ই স্বাধীন বাংলার ফ্ল্যাগ পাওয়া যাবে। আগে তো ঘরে ঘরে ছিল। মিলিটারি আসবার পর সবাই হয় পুড়িয়ে ফেলেছে, নয়তো এমন জায়গায় লুকিয়েছে যে ইদুরে খেয়ে গিয়েছে। এমন দিনে একটা ঝকঝকে নতুন ফ্ল্যাগ চাই।

এত দিন শুধু ছোটখাটো হামলা করেছি। বিভিন্ন থানায় ছোটখাটো খণ্ডযুদ্ধের পর রাতারাতি সরে এসেছি নিরাপদ স্থানে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যতিব্যস্ত করে রাখা। মুহুর্তের জনোও যেন শান্তির ঘুম না দিতে পারে। কিন্তু আজকের ব্যাপার অন্য। আজ আমরা খুটি গেড়ে বসব। আহা, আবার চোখে জল আসে। কেন?

পর্দার আড়াল থেকে সুশ্ৰী একটি মেয়ে উঁকি দিয়ে আমায় দেখে গেল। বেশ মেয়েটি। ইচ্ছে হচ্ছিল ডেকে কথা বলি। কিন্তু ইচ্ছাটা গিলে ফেলতে হল। এ বাড়িতে কিছু সময় থাকতে হবে আমাকে। এ সময় এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে এ বাড়ির লোকজন বিরক্ত হয়।

স্নামালিকুম।

অলায়কুম সালাম।

আমি গনি মিয়ার চাচাত ভাই। উত্তরের বাড়িতে থাকি। মিয়া সাহেবের শরীলডা এখন কেমুন?

ভালো।

শুধু গনি মিয়ার চাচাত ভাই-ই নয়, আরো অনেকেই জড়ো হয়েছে। সম্ভবত আরো লোকজন আসছে। আমার বিরক্ত লাগছে, আবার ভালোও লাগছে। বিরক্ত লাগছে কথা বলতে হচ্ছে বলে, ভালো লাগছে লোকজনদের কৌতূহলী চোখ দেখে। তোমরা তাহলে শেষ পর্যন্ত কৌতূহলী হয়েছ? দেখতে এসেছ মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের? বেশ বেশি।

ইস, কী দিনই না গিয়েছে। শুরুতে। গ্রামবাসী দল বেঁধে মুক্তিবাহিনী তাড়া করেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। অবশ্যি তাদেরই—বা দোষ দিই কী করে? মিলিটারি রয়েছে ওৎ পেতে। যেই শুনেছে অমুক গ্রামে মুক্তিবাহিনী ঘোরাফেরা করছে, হুকুম হল–দাও ঐ গ্রাম জ্বালিয়ে। যেই শুনেছে অমুক লোকের বাড়ি মুক্তিবাহিনী এক রাত্রি ছিল, অমনি হুকুম হল, অমুক লোককে গুলী করে মারি গ্রামের মধ্যিখানে, যাতে সবার শিক্ষা হয়। আহ, শুরুতে বড়ো কষ্টের দিন গিয়েছে।

কয়টা বাজে এখন? আমার কাছে ঘড়ি নেই। সময়টা জানা থাকলে হত। বুঝতে পারতাম। কখন গুলীর আওয়াজ পাব। অবশ্যি প্রথম শুনব বীজ উড়িয়ে দেবার বিকট আওয়াজ। ব্রীজটা ওড়াতে পারবে তো ঠিকমতো? শুনেছি রেঞ্জাররা পাহারা দেয়। সারা রাত। খুব অস্থির লাগছে। ওদের সঙ্গে গেলেই হত। না-হয় একটু দূরে বসে থাকতাম। রেসের ঘোড়ার মতো হল দেখি। রেসের ঘোড়া বুড়ো হয়ে গেলে শুনেছি। অর্ধ-উম্মাদ হয়ে যায়। রোস শুরু হলে পাগলের মতো পা নাচায়।

আপনার জন্যে দুধ আনব এক গ্লাস?

সেই সুশ্ৰী মেয়েটি ঘরের ভেতর ঢুকেছে দেখে অবাক লাগছে। গ্ৰামঘরের বাড়িতে এ-রকম তো হয় না। বেশ কঠিন পর্দার ব্যাপার থাকে। আমার খানিকটা অস্বস্তি লাগছে। গনি মিয়ার ভাই, যিনি আমার বিছানার পাশে বসেছিলেন, তিনিও আমার অস্বস্তি লক্ষ্য করলেন।

মেয়েটি আবার বলল, আনব আপনার জন্যে এক গ্লাস দুধ?

না-না, দুধ লাগবে না।

খান, ভালো লাগবে। আনি?

আন।

গনি মিয়ার চাচাত ভাই বললেন, বড়ো ভালো মেয়ে। শহরে পড়ে।

কী পড়ে?

বি… এ… পড়ে। হোস্টেলে থাকে।

শুনে আমি অপ্রস্তুত। তুমি তুমি করে বলছি, কী কাণ্ড! কামিজ পরে আছে বলেই বোধহয় এত বাচ্চা দেখা যায়। তাছাড়া তার হাবভাবও ছেলেমানুষী।

মেয়েটি মোক্তার সাহেবের বড়ো ভাইয়ের মেয়ে। বড়ো ভাই ও ভাবী দু জনেই মেয়েটিকে ছোট রেখে মারা গেছেন। মেয়েটি মোক্তার সাহেবের কাছেই বড়ো হয়েছে। পড়াশোনার খুব ঝোঁক, ঢাকায় হোস্টেলে থেকে পড়ে। গণ্ডগোলের আভাস পেয়ে আগেভাগেই চলে এসেছিল।

মেয়েটি দুধের গ্লাস আমার সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখল না, হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, তোমার নাম?

হামিদ। হামিদা বানু।

আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না! অথচ মেয়েটি দাঁড়িয়েই আছে। হয়তো কিছু কথা শুনতে চায়। যুদ্ধের গল্প শুনতে মেয়েদের খুব আগ্রহ। হামিদা একসময় বলল, আমার নামটা খুব বাজে! একেবারে চাষা-চাষা নাম।

আমি বললাম, নাম দিয়ে কী হয়?

হয় না। আবার, আমার বন্ধুদের কী সুন্দর সুন্দর নাম! এক জনের নাম কিন্নরী, এক জনের নাম স্বাতী।

মোক্তার সাহেব বললেন, আপনার জন্যে ডাক্তার আনতে লোক গেছে। ভালো ডাক্তার–এল. এম. এফ.। হামিদা আম্মাজি, ভেতরে যান।

বাহ্‌! কী সুন্দর আম্মাজি ডাকছে। মেয়েটি বোধহয় সবার খুব আদরের। মোক্তার সাহেবের কথায় সে ঘাড় ঘুরিয়ে হাসল। আমাকে দেখতে-আসা লোকগুলি চলে যাচ্ছে একে একে। এত তাড়াতাড়ি কৌতূহল মিটে গেল? মোক্তার সাহেব অবশ্যি লোকজনদের ঝামেলা না করবার জন্যে বলছেন। তবুও তাদের আগ্রহ এত কম হবে কোন?

অন্দরমহলের ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছে। পর্দার ওপাশে জটলা-পাকান মেয়েদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। হামিদা বলল, ওরা আপনাকে দেখতে চায়। মুক্তিবাহিনী কোনো দিন তো দেখে নাই।

তুমি দেখেছি নাকি?

এই তো আপনাকে দেখলাম।

বাহ, বেশ মেয়ে তো! বেশ গুছিয়ে কথা বলে। ইউনিভার্সিটিতে আমাদের সঙ্গে পড়ত।–শেলী রহমান। সেও এরকম গুছিয়ে কথা বলত–একেক বার আমাদের হাসিয়ে মারত। শেলী রহমানের বাবা তো পুলিশ অফিসার ছিলেন, মিলিটারির হাতে মারা যান নি তো।

কয় ভাইবোন আপনারা?

আমি একা। ভাইবোন নেই কোনো।

ভাইবোন না থাকা খুব বাজে।

এ কী! গুলীর আওয়াজ শুনলাম না? তাহলে কি শুরু হল নাকি? তিনটে বেজে গেছে। এর মধ্যে। আমি ছটফট করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম, কয়টা বাজে হামিদা, একটু জেনে আসবে? মোক্তার সাহেব বললেন, দুটো পাঁচশ। কী আশ্চর্য, এখনো তো যুদ্ধ শুরুর সময় হয় নি।

হামিদা বলল, কী হয়েছে?

গুলীর আওয়াজ শুনলাম।

কই না, না তো!

আমি তো শুনলাম নিজ কানে।

মোক্তার সাহেব বললেন, না, গুলীর আওয়াজ নয়। গুলীর আওয়াজ হলে বুঝতাম। কত বার যুদ্ধ হল এখানে।

মেথিকান্দার আশেপাশে যারা থাকে, গুলীর শব্দ তারা অনেক বারই শুনেছে। অনেক বার ব্যৰ্থ আক্রমণ হয়েছে এখানে। কিন্তু কেউ মুক্তিবাহিনী দেখে নি, এটা কেমন কথা। হয়তো সবাই বিল পার হয়ে ছোট খাল ধরে এগিয়েছে। আমাদের মতো গ্রামের ভিতর দিয়ে রওনা হয় নি। যাই হোক, এ নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে। না। বমি-বমি লাগছে। মাথাটা এমন ফাঁকা লাগছে কেন। বীজটা ঠিকমতো ওড়াতে পারবে তো? এমন যদি হত, সবাই ঠিকঠাক ফিরে এসেছে, কারো গায়ে আচড়টি লাগে নি। তা কি আর হবে? কি একটা গান আছে না। সুবীর সেনের–মন নিতে হলে মনের মূল্য চাই। ও কি, মাথা ঘুরছে নকি?

আপনার কী হয়েছে, এ রকম করছেন কেন?

কিছু হয় নি। এই তো, এই তো গুলীর শব্দ পাচ্ছি। হামিদা, যুদ্ধ শুরু হল।

বাতাসে জানালা নড়ার শব্দ শুনছেন–

মর্টারের শেল ফাটার আওয়াজ পাচ্ছি না?

আপনি চুপ করে শুয়ে থাকুন। মাথায় পানি দিই?

মেয়েটির মাথা নিচু হয়ে এসেছে। কিন্নরী না নাম? উঁহু, হামিদা। তাহলে কিন্নরী নাম কার? বেশ সুশ্ৰী মেয়েটি। গলাটি কী লম্বা! ফর্সা, হাঁসের মতো। ঐ তো, আবার শেল ফাটার আওয়াজ। আহি পুরোদমে ফাইট চলছে।

আপনি নড়াচড়া করবেন না। চুপ করে শুয়ে থাকুন।

অনেক অপরিচিত মহিলা ঘরের ভেতরে ভিড় করছেন। মোক্তার সাহেবকে দেখছি না তো। মোক্তার সাহেব কোথায়? এই দাড়িওয়ালা লোকটি কে?

 

রামদিয়ার ঘাটে তারা যখন পৌঁছল, তখন আকাশ আবার মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে, বিজলি চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। দমকা বাতাসে শো শো শব্দ উঠছে বাশবনে। হুমায়ূন পিছিয়ে পড়েছিল। হোঁচটি খেয়ে তার পা মচকে গিয়েছে। সে হাঁটছে খুঁড়িয়ে-খুড়িয়ে। জাফর গলা উঁচিয়ে ডাকল, হুমায়ূন ব্রাদার, হুমায়ূন ব্রাদার।

তার ডাকার ভঙ্গিটা ফুর্তিবাজের ভঙ্গি। সব সময় এ-রকম থাকে না। মাঝেমধ্যে আসে। হুমায়ূন হাসল মনে মনে। সেও খুব তরল গলায় সাড়া দিল, কী ব্যাপার জাফর?

বৃষ্টি আতা হায়। বহুত মজাকা বাত।

বলতে-বলতেই টুপটুপ করে বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল। জাফর হেসে উঠল হো-হো করে। যেন এ সময় বৃষ্টি আসাটা খুব একটা আনন্দের ব্যাপার।

হাসান আলি মাথার বাক্স নামিয়ে তার উপর বসে ছিল–যদিও বেশ বেগে হাওয়া বইছে, তবু সে লাল গামছা দুলিয়ে নিজেকে হাওয়া করছিল। বৃষ্টি আসতে দেখে সেও কী মনে করে যেন হাসল।

মজিদ একটা সিগারেট ধরিয়েছে। ফুস-ফুস করে ধোঁয়া ছাড়ছে। সে বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এখানে দাঁড়িয়ে তার ক্লান্তি আরো বেড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বলল, কী ব্যাপার হাসান আলি, টুনু মিয়ার দল কোথায়?

হাসান আলি সে কথার জবাব দিল না, গামছা দুলিয়ে হাওয়া করতেই লাগল। মজিদ গলা উঁচিয়ে বলল, কথা বলছি না যে, কী ব্যাপোর?

নৌকা আসতাছে। বিশ্রাম করেন মজিদ ভাই।

হুমায়ূন ও জাফর এসে বসল হাসান আলির পাশে। বৃষ্টি নামতে-নামতে আবার থেমে গেছে। বসে থাকতে মন্দ লাগছে না। তাদের। রামদিয়ার ঘাটে টুনুমিয়ার দলকে না দেখতে পেয়ে তারা সে-রকম অবাক হল না। জাফর হঠাৎ সুর করে বলল, ওগো ভাবীজান, মর্দ লোকের কাম।

তারা সবাই মিনিট দশেক বসে রইল। চারিদিকে ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে সিগারেটের ফুলকি আগুন জ্বলছে-নিভিছে। ঝিঝি পোকার একটানা বিরক্তিকর আওয়াজ ছাড়া অন্য আওয়াজ নেই। হাসান আলি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, নৌকা দেখা যায়। উঠেন, সবেই উঠেন।

দেশী ডিঙ্গি নৌক ঠেলে উজানে নিয়ে আসছে।

হাসান আলি উঁচু গলায় সাড়া দিল, হই হই হই-হা।

নৌকা থেকে এক জন চেঁচিয়ে উঠল, হাসান ভাই নাকি গো? ও হাসান ভাই।

কী।

ঠিকমতো পৌঁছছেন দেহি।

হাসান আলি আচমকা প্রগলভ হয়ে উঠল। নৌকা পাড়ে ভিড়তেই নৌকার দড়ি ধরে শিশুর মতো চেঁচিয়ে উঠল, টুনু মিয়া, ও টুলু মিয়া?

নৌকার ভেতর থেকে একসঙ্গে উঁচু স্বরগ্রামে হেসে উঠল সবাই। টুনু মিয়া লাফিয়ে নামল নৌকা থেকে, বেঁটেখাট মানুষ। পেটা শরীর, মাথার চুল ছোট-ছোট করে কাটা। সে হাসিমুখে এগিয়ে গেল হুমায়ূনের দিকে।

আমারে চিনছেন কমাণ্ডার সাব? আমি টুনু। বাজিতপুরের টুনু মিয়া। বাজিতপুর থানায় আপনার সাথে ফাইট দিছি।

হুমায়ূন বলল, তোমরা দেরি করে ফেলেছ, আড়াইটা বাজে।

আগে কন আমারে চিনছেন কিনা।

চিনেছি, চিনেছি। চিনব না কেন?

বাজিতপুর ফাইটে আমার বাম উড়াতে গুলী লাগল। আপনে আমারে পিঠে লইয়া দৌড় দিলেন। মনে নাই আপনার?

খুব মনে আছে।

বাঁচনের আশা আছিল না। আপনে বাঁচাইছেন। ঠিক কইরা কন, আমারে চিনছেন? সেই সময় আমার লম্বা চুল আছিল।

হুমায়ূন অবশ্যি সত্যি চিনতে পারে নি, তবু আজকের এই মধ্যরাতে স্বাস্থ্যবান হাসি-খুশি এই তরুণটিকে অচেনা মনে হল না। দলের অন্যান্য সবাই নেমে এসেছে। হাসান আলি তাদেরকে কী যেন বলছে, আর তারা ক্ষণে ক্ষণে হেসে উঠছে। কে বলবে এই সব ছেলেদের জীবন-মৃত্যুর সীমারেখা কিছুক্ষণের মধ্যেই সম্পূৰ্ণ মুছে যাবে।

জাফর বলল, আর লোকজন কোথায়?

আছে, জায়গা মতোই আছে।

তাহলে আর দেরি কেন? নৌকা ছাড়া যাক। হুমায়ূন ভাই কী বলেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, উঠে পড় সবাই।

নৌকায় উঠে বসতেই বড়ো বড়ো ফোটায় বৃষ্টি নামল। নৌকা যদিও ভাটির দিকে যাচ্ছে, তবু বাতাসের ঝাপটায় এগোচ্ছে ধীর গতিতে, মাঝে মাঝে তীরে গজিয়ে-ওঠা বেতঝোপে আটকে যাচ্ছে। যত বারই নৌকা আটকে যাচ্ছে, তত বারই মাঝি দুটি গাল পাড়ছে, ও হালার পুত, ও হারামীর বাচ্চা। গ্রামের ভেতর দিয়ে নৌকা যাবার সময় মেঘ ধরে গেল। তীরে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে অনেক কৌতূহলী লোক বসে আছে। দু-এক জন সাহস করে নিচু গলায় বলছে, জয় বাংলা।

 

মুক্তিবাহিনী চলাচল হচ্ছে এ খবর কী করে পেল কে জানে!, হুমায়ূন একটু বিরক্ত হল। মুখে কিছুই বলল না। অবশ্য ভয় পাবার তেমন কিছু নেইও। মিলিটারিরা কিছুতেই এই রাত্রিতে থানার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে বাইরে বেরুবে না। মজিদ বলল, হুমায়ূন ভাই, পজিশন নেব কোথায়? সব খানাখন্দ তো পানিতে ভর্তি। সাপখোপও আছে কিনা কে জানে।

নৌকার অনেকেই এই কথায় হেসে উঠল! মজিদ রেগে গিয়ে বলল, হাস কেন? ও মিয়ারা, হাস কেন? মজিদ রেগে যাওয়াতেই হাসিটা হঠাৎ করেই থেমে গেল। নৌকা নীরব হল মুহূর্তেই। তখনি শোনা গেল, বাইরে ঝুপরূপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝি দু জন ভিজে চুপসে গেছে। জাফর বলল, মাঝিরা তো দেখি গোসল সেরে ফেলেছে।

হ গো ভাই, তিন দফা গোসল হইল।

জাফর সুর করে বলল, বাইচ বাইতে মর্দ লোকের কাম।

মজিদ ক্রমাগতই বিরক্ত হচ্ছিল। ভয় করছিল তার। ভয় কাটোনর জন্যেই জিজ্ঞেস করল, মর্টার কোথায় ফিট করেছ তোমরা? থানা কত দূর?

গোঁসাই পাড়ায়। বেশি দূর না। পরথমে সেইখানে যাইবেন?

না-না, যাওয়ার দরকার কী? তাদের কাজ তারা করবে। হুমায়ূন ভাই কী বলেন?

হুমায়ূন কিছু বলল না, চুপ করে রইল। তার মচকে-যাওয়া পা ব্যথা করছিল। সে মুখ কুচকে বসে রইল। তীর থেকে কে এক জন চেঁচিয়ে ডাকল, কার নাও? কার নাও?

নৌকার মাঝি রসিকতা করল, হেঁড়ে গলায় বলল, তোমার নাও।

নাও ভিড়াও মাঝি, খবর আছে, নাও ভিড়াও।

নৌকা ভিড়ল না, চলতেই থাকল এবং কিছুক্ষণ পরেই তীব্র টর্চের আলো এসে পড়ল নৌকায়।

নৌকা ভিড়াও মাঝি, সামনে রাজাকার আছে।

কোনখানে?

শেখ জানির খালের পারে বইসা আছে।

থাকুক বইসা, তুমি কেডা গো?

আমি শেখজানি হাইস্কুলের হেড-মাস্টার আজিজুদ্দিন। মুক্তিবাহিনীর নাও নাকি?

মনে অয় হেই রকমই।

নৌকা ভিড়ল না, কারণ নৌকা শেখজনির খালে যাচ্ছে না। আজিজদ্দিন মাস্টার হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এই মাঝরাত্রে সে ছয় ব্যাটারির টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন কে জানে?

এখান থেকেই গ্রামের চেহারাটা বদলাতে শুরু করেছে। দুটি আস্ত বাড়ি, তার পরপরই চারটি পুড়ে-যাওয়া বাড়ি। আবার একটা গোটা বাড়ি নজরে আসছে, আবার ধ্বংসস্তুপ। মিলিটারিরা প্ৰায় নিয়মিত আসছে। এদিকে। লোকজন পালিয়ে গেছে। ফসল বোনা হয় নি। চারিদিক জনশূন্য। নৌকা যতই এগিয়ে যায়, ধ্বংসলীলার ভয়াবহতা ততই বেড়ে ওঠে। আর এগোন ঠিক নয়। রাজাকারদের ছোটখাট দল প্রায়ই নদীর তীর ঘেঁষে ঘুরে বেড়ায়! নজর রাখে রাতদুপুরে কোনো রহস্যজনক নৌকা চলাচল করছে কিনা। তাদের মুখোমুখি পড়ে গেলে তেমন ভয়ের কিছু নেই। তবে আগেভাগেই গোলাগুলীর শব্দে চারিদিক সচকিত করে লাভ কী?

রুস্তম ভাই, এই রুস্তম ভাই।

কেন্ডা গো?

আমি চান্দু, পাঞ্জাবী মিলিটারি, হিহিহি। নৌকা থামান।

নৌকার গতি থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। একটি ছোটখাট রোগা মানুষ লাফিয়ে উঠল। নৌকায়। জাফর বলল, কী ব্যাপার, কী চাও তুমি? কে তুমি?

আমি কেউ না, চান্দু!

কী কর তুমি?

আমি খবরদারী করি। আপনেরার সাথে যামু। যা করবার কন করুম।

রুস্তম বলল, চান্দুরে লন সাথে, খুব কামের ছেলে। গ্রেনেড নিয়া একেবারে থানার ভিতরে ফালাইব দেখবেন।

চান্দু গম্ভীর হয়ে বলল, নামেন গো ভালোমানুষের পুলারা। জিনিসপত্র যা আছে, আমার মাথায় দেন। পিনপিনে বৃষ্টি মাথায় করে দলটি নেমে পড়ল। সবে মাটিতে পা দিয়েছে, অমনি দূরাগত বিকট আওয়াজ কানে এল। কী হল, কী হল। দল দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ। মজিদ উৎকণ্ঠিত স্বর বের করল, হুমায়ূন ভাই, কী ব্যাপার? উত্তর দিল চান্দু, কিছু না। পুল ফাটাইয়া দিছে। সাবাস, ব্যাটা বাপের পুত।

তা হলে ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আহ কি আনন্দ! ভয় কমে যাচ্ছে সবার। সবাই দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ। বিকট শব্দটা হম হম করে প্রতিধ্বনি তুলল। থানার হলুদ রঙের দালানটি দেখা যাচ্ছে। রঙ দেখা যাচ্ছে না। কাঠামোটা স্পষ্ট নজরে আসছে। থানার আশেপাশে দু, শ গজের মতো জায়গা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। ঘরবাড়ি নেই, গাছপালা নেই।–খাঁ-খাঁ করছে। অনেক দূর থেকে যাতে শক্রর আগমন টের পাওয়া যায়, সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা।

তিনটি দলে ভাগ হয়ে অপেক্ষা করছে ছেলেরা। এদেরও অনেক পেছনে আধইঞ্চি মর্টার নিয়ে অপেক্ষা করছে একটি ছোট্ট দল, যে-দলে পেনসনভোগী এক জন বৃদ্ধ সুবাদার আছেন। পুরনো লোক। তার উপর বিশ্বাস করা চলে। উত্তর দিকের ঢালু অঞ্চলটায় রুস্তম একাই আট হয়ে বসেছে। মাটি হয়েছে। পিছল। এল. এম. জি.র পা পিছলে আসে। কিন্তু সে সব এখন না ভাবলেও চলে।

চান্দু বসে আছে জাফরের পাশে। তার ইচ্ছে–বুকে হেঁটে থানার সামনে যে— দুটি বাঙ্কার, সেখানে গ্রেনেড ছুঁড়ে আসে। এ কাজ নাকি সে আগেও করেছে। জাফর কান দিচ্ছে না। তার কথায়।

বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশ আবার পরিষ্কার হয়েছে। তারা দেখা যাচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হুঁ-হু করে। ঘণ্টা দু য়েকের ভেতর অন্ধকার কেটে গিয়ে আকাশ ফর্স হবে। শুরু হবে আরেকটি সূর্যের দিন।

কৰ্দমাক্ত ভেজা জমি। চারপাশের গাঢ় অন্ধকার, ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা–এর মধ্যেই নিঃশব্দে অপেক্ষা করছে সবাই। কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। রুস্তম ফিসফিস করে বলে, পায়ের উপর দিয়ে কী গেল, সাপ নাকি? ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগল। তার কণ্ঠস্বর অন্য রকম শোনায়। কেউ কোনো জবাব দেয় না। সবাই অপেক্ষা করে সেই মুহূর্তটির জন্যে, যখন মনে হবে পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাইফেলের উপর ঝুঁকে থাকা একেকটি শরীর আবেগে ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকবে থরথর করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *