দুদিন হলো আজহার অফিসে যাচ্ছেন না। শোবার ঘরে ঝিম ধরে বসে আছেন। একটার পর একটা বিড়ি টানছেন। বিড়ির ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। মাঝে মাঝে গলা খাকারি দিচ্ছেন। তখন গলা থেকে পশুর মতো অ্যাওয়াজ কেরা হচ্ছে।
তাঁর কোনো বড় সমস্যা যাচ্ছে। সমস্যার প্রধান লক্ষণ, তিনি খবরের কাগজ পড়ছেন না। কাগজ পড়া তার নেশার মতো। প্রথম একবার চা খেতে খেতে কাগজ শেষ করবেন। তারপর কাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যাবেন। দ্বিতীয় দফায় বাথরুমে কাগজ পাঠ হবে। সেই কাগজ অতি যত্নে ভঁাজ করে তুলে রাখা হবে। অফিস থেকে ফেরার পর কাগজ আবার পাঠ করা হবে। এমন যার নেশা তিনি কাগজ পড়ছেন না। ঘরে বাজার নেই। তিনি বাজারে যাচ্ছেন না। গত দুদিন ডাল, ভাত আর ডিমের তরকারি দিয়ে খাবার তৈরি হচ্ছে। এই বিষয়েও তার কোনো বিকার দেখা যাচ্ছে না। খেতে ডাকলে যাচ্ছেন। সামান্য কিছু মুখে দিয়ে উঠে যাচ্ছেন। ভালো-মন্দ কিছু বলছেন না। খাবার টেবিলে বসে লবণ বেশি হয়েছে বা কম হয়েছে এই বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন না তা হয় না।
সকাল এগারোটা। আজ বাজারে না গেলেই না। ঘরে বলতে গেলে কিছুই নেই। সালমা ভয়ে ভয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন এবং ক্ষীণ গলায় বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?
আজহার বললেন, না। খামাখা শরীর খারাপ হবে কী জন্যে? শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাহাই সয়।
সালমা বললেন, দুদিন ধরে অফিসে যােচ্ছ না। ঘরে বসে আছ।
চিন্তা করছি। কাজ করতে করতে চিন্তা করা যায় না। চিন্তার জন্যে আলাদা সময় লাগে। অবসর লাগে।
কী নিয়ে চিন্তা করছ?
আজহার বিড়ি ধরাতে ধরাতে বললেন, টুনুর বিষয়ে চিন্তা করছি। গাধা হোক, ছাগল হোক, সে আমাদের বড় ছেলে। তার অপরাধ ক্ষমার চোখে দেখা ছাড়া উপায় নাই। কী বলে? ঠিক বললাম কি না বলো?
ঠিকই বলেছ।
আজহার বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তাকে আমি ক্ষমা করলাম। তবে কাজের বিনিময়ে খাদ্য। এখন সে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। আমার জমিজমা যা আছে দেখাশোনা করবে। নিজে চাষ করবে, বরগা দিবে না। তুমি কী বলো?
সালমা কিছু বললেন না! চুপ করে রইলেন। জমিজমা সব বেহাত হয়ে গেছে, এই খবর তিনি জানেন।
আজহার বললেন, বড় ভাইজানের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জমি বুঝে নিতে হবে। সব কাজ টুনুকেই করতে হবে। তাকে ডাকো।
ও তো ফিরে নাই।
ফিরে নাই মানে? গেছে কোথায় হারামজাদা?
সালমা চিন্তিত গলায় বললেন, তুমি শুয়ে থাকে। তোমার মাথায় পানি ঢালি।
আজহার বললেন, আমার মাথায় পানি ঢালাচালির কিছু নাই। আমার জ্বর নাই। পানি চালাতে হবে টুনু হারামজাদাটার মাথায়। You understand?
সালমা দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে যুথীর কাছে গেলেন। যুথী টিউশনির জন্যে বের হয়ে যাচ্ছিল। তাকে আটকালেন। মেয়ের কাছে ঘটনা বলতে গিয়ে ক্রমাগত চোখ মুছতে লাগলেন। যুথী বলল, মরাকান্না শুরু করার মতো কিছু হয় নাই। নতুন কেউ মারা যায় নাই! নানান ঘটনায় বাবা তবদা। মেরে গেছেন। এখনই ঠিক হয়ে যাবে। আমি বাবার সঙ্গে কথা বলছি। তুমি খুব ভালো করে বাবার জন্যে আর আমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসো।
আজহার মেয়েকে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, কেমন আছ মা?
যুথী বলল, ভালো।
অফিসে যাচ্ছ? কাজ মন দিয়ে করবে। বাসের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে। বসের নেকনজরে থাকার একটাই উপায়। সবসময় ইয়েস স্যার। বাস যদি বলে। তেঁতুল টক তাহলে তেঁতুল টক। আর বাস যদি বলে তেঁতুল চিনির মতো মিষ্টি তাহলে তেঁতুল চিনির মতো মিষ্টি। আর্গুমেন্ট উইথ বস। এল হসপস।
যুথী বলল, বাবা, আমি অফিসে যাচ্ছি না। ওই চাকরিটা আমার হয় নাই। যে-কোনো কারণেই হোক তুমি ব্যাপারটা ভুলে গেছ। আমি টিউশনিতে যাচ্ছি। ঠিক করে বলো তো বাবা, তুমি কেমন আছ?
ভালো আছি।
রাতে ঘুম হয়েছে?
গতকাল রাতে ইচ্ছা করে ঘুমাই নাই। চিন্তা করেছি। সাধু-সন্ন্যাসীরা এই কাজই করেন। রাত জেগে চিন্তা করেন। তবে তাদের চিন্তা উচ্চশ্রেণীর চিন্তা। আর আমার চিন্তা সাংসারিক চিন্তা। জমিজমা, মামলা-মোকদ্দমা, পুত্ৰ-কন্যার বিবাহ। যাই হোক, টুনুর উপর থেকে আমি রাগটা সাময়িকভাবে উইথড্র করেছি। সে যে আমার এক কথায় গ্রামে গিয়ে জমিজমা দেখাশোনা শুরু করেছে। এতে আমি খুশি। very happy.. তবে আমি চাই না সে তার বড়চাচার সঙ্গে কোনো ঝামেলা করুক। মুরুব্বি মানুষের সম্মান দিতে হবে।
যুথী বলল, শার্ট-প্যান্ট পরে তো বাবা।
কেন? তোমাকে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ডাক্তার কড়া ঘুমের ওষুধ দিবে। তুমি তিন-চার দিন একনাগাড়ে ঘুমিয়ে সুস্থ হয়ে যাবে। এখন তোমার শরীর ভালো না।
জামাকাপড় তো মা পরতে পারব না। শরীর জ্বলে যাচ্ছে গরমে। এর উপর শার্ট গায়ে দেওয়া মানে চৈত্র মাসের দুপুরে কম্বল গায়ে দিয়ে রোদে শুয়ে থাকা।
সালমা ট্রেতে করে চা নিয়ে ঢুকলেন। যুথীকে বললেন, কে যেন এক ভদ্রলোক এসেছে। তোর সঙ্গে জরুরি কথা বলবে।
আজহার বললেন, সব কথাই জরুরি। তুমি যদি কু করে একটা আওয়াজ দাও সেটাও জরুরি। এখন তুমি আমাকে একটা ভিজা গামছা এনে দাও। গামছা গায়ে দিয়ে বসে থাকব। গরমটা আর নিতে পারছি না। কথায় আছে–
চৈত্র মাসের গরম
নষ্টা মাগির চেয়েও বেশরম।
যুথী বলল, মা, তুমি বাবার সঙ্গে গল্প করো। তোমরা দুজনে মিলে চা খাও। আমি দেখি কে এসেছে। আজ আর টিউশনিতে যাব না। সারা দিন ঘরেই থাকব। ডাক্তার আমিরুল ইসলাম সাহেবকে নিয়ে আসব। উনি যা বলেন তা-ই করব।
বসার ঘরে যিনি বসে আছেন, তাঁকে দেখে যুথী বড় ধরনের চমক খেল। টুনুকে বসে থাকতে দেখলেও সে এতটা চমকাতো না। চিকেন ফেদার কোম্পানির বড় সাহেব আহসান।
আহসান আমতা আমতা করে বললেন, এটা আপনার বাড়ি? আপনি যে সেই যুথী সেটা বুঝতে পারি নি।
আমি সেই যুথী মানে?
আপনার জন্যে একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। চিঠিতে যুথী নাম লেখা। এই অর্থেই বলেছি আপনি সেই যুথী। চিঠিটা পড়ুন।
যুথী বলল, রেখে যান, পরে একসময় পড়ব।
আহসান বললেন, পরে না। এখনই পড়ুন।
যুথী বলল, আমার কাছে একটা চিঠি এসেছে সেই চিঠি আমি এখন পড়ব না। এক মাস পরে পড়ব সেটা তো আমি ঠিক করুব। আমার কাছে এমন অনেক চিঠি আসে যেগুলি আমি পড়ি না। খুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেই।
আহসান বললেন, চিঠিটা আপনাকে দিয়েছেন শুভ্ৰ স্যার।
যুথী বলল, প্রতিবন্ধী শুভ্রর চিঠি? এই চিঠি পড়া না-পড়া একই। আপনি চিঠি নিয়ে যান। নিজে দশবার পড়ুন। আমি কোনোরকম আগ্ৰহ বোধ করছি না।
আহসান বললেন, স্যারের মা আমাকে অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন যেন আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাই। খুবই জরুরি। শুভ্র স্যার নিখোঁজ হয়েছেন। ম্যাডামের মাথা খারাপের মতো অবস্থা।
যুথী বলল, আমারও মাথা খারাপের মতো অবস্থা। আমার নিজের ভাই নিখোঁজ। এটা বড় কথা না; কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমাকে তার কাছে ছুটে যেতে হবে এটা কেমন কথা? যিনি দেখা করতে চাইবেন, তিনি ছুটে আসবেন। আমার কথা শেষ। এখন বিদায়। বাসায় নানান ঝামেলা চলছে, আমি আর ঝামেলা বাড়াতে চাচ্ছি না।
আহসান বিনীত গলায় বললেন, প্লিজ। চলুন। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। পাঁচটা মিনিট শুধু কথা বলবেন। গাড়ি আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।
যুথী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, Get lost.
কী বললেন?
ইংরেজিতে বললাম, Get lost. সহজ বাংলায়—বহিষ্কার হও। সম্ভবত আপনি ভুলে গেছেন। আপনি আপনার অফিস থেকে আমাকে বহিষ্কার করেছিলেন। কোনো কারণ দেখান নি। সেই তুলনায় আমি আপনার সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করেছি। আপনি যদি কানে ধরে বলেন, ক্ষমা চাই—তাহলে প্রতিবন্ধীর মার সঙ্গে কথা বলার বিষয়টা বিবেচনা করব। কনে ধরতে রাজি আছেন? রাজি হওয়ার কথা না। কাজেই বহিষ্কার। বহিষ্কার।
আহসান চোখমুখ লাল করে ঘর থেকে বের হলেন। দ্রুত বের হতে গিয়ে চৌকাঠে ধাক্কা লাগিয়ে কপাল ফুলিয়ে ফেললেন।
যুথী ডাক্তার আমিরুল ইসলামকে বাসায় নিয়ে এসেছে। আজহার ডাক্তারের সঙ্গে সহজ-স্বাভাবিকভাবেই কথা বললেন। লজ্জিত গলায় বললেন, গামছা পরে আছি ডাক্তার সাহেব, কিছু মনে করবেন না। লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। কয়েকদিন আগে ইলিশ মাছের পাতুরি খেয়েছিলাম, তারপর থেকে শরীর গরম। এই গরম আর নামছেই না। ইলিশ মাছ অত্যন্ত ডেনজারাস ফিস। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, মহাবীর আলেকজান্ডার ইলিশ মাছ খেয়ে মারা গেছেন? তার মতো মহাবীরের কপালে যদি এই থাকে তাহলে আমার অবস্থা বুঝতেই পারেন। আমি হচ্ছি—
বাল্যস্য বাল
হরিদাস পাল।
আমিরুল ইসলাম বলল, আপনি কত রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না?
বড়ভাইজানকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম। বারান্দায় শুয়ে থাকতে হতো। মশার কামড়। ইয়া বড় বড় Export quality মশা। তখন থেকে ঘুমের ডিসটার্ব শুরু হলো। এখন অবশ্য ভাইজান সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। তিনি রাতে আরামে মশারির ভিতর ঘুমাচ্ছেন। আমি পড়েছি ফ্যাসাদে।
আমিরুল ইসলাম পেথিড্রিন ইনজেকশন দিয়ে রোগীকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। কড়া কিছু ঘুমের ওষুধ লিখে দিল। একজন সাইকিয়াট্রিষ্টের নাম-ঠিকানা লিখে বলল, যুথী খালা, আমি যেসব ওষুধ দিয়েছি আমার ধারণা ব্রেইনের সাময়িক ডিসঅর্ডার এতেই দূর হবে। যদি দূর না হয় তাহলে সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।
যুথী বলল, আপনার ভিজিট না নেওয়ার তিন মাস কি শেষ হয়েছে?
এখনো শেষ হয় নি।
এক কাপ চা বানিয়ে দিলে কি খাবেন? ভিজিট না দেওয়া গেলে রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনরা একধরনের অস্বস্তিতে ভোগে। আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারলে আমার অস্বস্তি সামান্য কমতি।
যুথী খালা, চা খাব।
থ্যাংক ইউ। আপনাকে একটা অনুরোধ, রসিকতার রাবারের মতো ইলাসটিসিটি নেই। রসিকতা টানতে হয় না। প্রথমবার রসিকতা করে খালা ডেকেছেন ফুরিয়ে গেছে, আর না।
Ok.
বাবার পাগলামি সারবে তো?
অবশ্যই সরবে। ব্রেইনের রেষ্ট দরকার। রেষ্ট পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
যুথী বলল, খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার, এলাকায় আপনার ভালো পশার হয়েছে।
আমিরুল বলল, আশ্চর্য ব্যাপার হবে কেন?
যুথী বলল, আপনি ভিজিট নিচ্ছেন না, তারপরেও আপনার পশার—এটাই আশ্চর্য। যেসব ডাক্তার বেশি ভিজিট নেয়। তাদের প্রতি রোগীদের আস্থা থাকে বেশি। রোগীরা মনে করে তিনি বড় ডাক্তার। অনেকটা আমের মতো।
আমের মতো মানে?
যুথী বলল, একই আমি আপনি দুটা আলাদা ঝুড়িতে রাখবেন। একটা ঝুড়ির আমের কেজি বলবেন সত্তুর টাকা। আরেকটার কেজি বলবেন একশ টাকা। ক্ৰেতারা একশ টাকার কেজিটাই কিনবে। দরদাম করে কিছু কমানোর চেষ্টা করবে।
আমের বিষয়ে এত কিছু জানলেন কীভাবে?
যুথী বলল, আমার বড়ভাই কিছুদিন ফলের ব্যবসা করার চেষ্টা করেছে। তার কাছে শুনেছি। চা কেমন হয়েছে?
আমিরুল বলল, চা ভালো হয় নি। চায়ের সঙ্গে গল্পগুলি সুন্দর বলে চা-টা খারাপ লাগছে না। নীপা খালার কাছে শুনেছি আপনি অদ্ভুত অদ্ভূত হিউমার করেন। আশেপাশে যারা থাকে, হাসতে হাসতে তাদের পেটে ব্যথা হয়ে যায়।
আপনি চাচ্ছেন যেন আমি আপনার পেটে ব্যথা করে দেওয়ার মতো কিছু বলি?
জি।
একটা পিপড়া এবং হাতি পাশাপাশি যাচ্ছিল। হঠাৎ তাদের বামদিকে পড়ল এক পুকুর। সঙ্গে সঙ্গে পিপড়া কষে হাতির পায়ে একটা লাথি দিল।
হাতি বলল, ঘটনা কী?
পিঁপড়া বলল, ঘটনা কী তুই বুঝস না? আমার স্ত্রী পুকুরে স্নান করছে, তুই আড়চোখে তাকাচ্ছিস। তোর লজ্জা নাই?
আমিরুল বলল, গল্পে হাসির ব্যাপারটা ঠিক ধরতে পারলাম না। গল্পে কোনো লজিক নেই।
যুথী বলল, গল্পে লজিক অবশ্যই আছে। আপনার রসিকতা বোঝার ক্ষমতা নেই। আপনি হচ্ছেন শুভ্রর মতো।
শুভ্রটা কে?
সে একজন শিক্ষিত মানসিক প্রতিবন্ধী। আমার ধারণ আপনিও মানসিক প্রতিবন্ধী। মানসিক প্রতিবন্ধীরা রসিকতা বুঝতে পারে না। আর যারা পাগল, তারা রসিকতা বেশি বুঝে। সবকিছুতেই তারা হা হা করে হাসে।
আমিরুল বলল, আমি আরেক কাপ চা খাব।
যুথী বলল, একটু আগে বললেন, চা-টা ভালো হয় নি।
আমিরুল বলল, চা ভালো হয় নি, কিন্তু গল্পগুলি ভালো হচ্ছে। গল্প শোনার জন্যে আরেক কাপ চা খাব। এটা আমার ভিজিট।
মেরাজউদ্দিন এবং রেহানা পাশাপাশি বসে আছেন। তাদের সামনে আহসান। মেরাজউদ্দিনের ভঙ্গি শাস্ত। তার হাতে পাইপ। পাইপের আগুন নিভে গেছে, তারপরেও তিনি পাইপ হাতে রেখেছেন। মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরছেন। রেহানা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। তিনি কোনোদিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতেও পারছেন না। তার চোখে জ্বালাপোড়া রোগ হয়েছে। চোখ সবসময় খড়খড় করছে। চোখের ডাক্তার দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, অশ্রুগ্রন্থি থেকে ঠিকমতো অশ্রু বের হচ্ছে না বলে এই সমস্যা। চিকিৎসা হিসেবে অন্যের চোখের পানি ড্রপারে করে চোখে দিতে বলা হয়েছে। কৃত্রিম চোখের পানিও পাওয়া যায়, সেটা তেমন কাজ করে না। অনেককেই চোখের পানির কথা বলা হয়েছে। কেউ এখনো জোগাড় করে দিতে পারে নি। বাংলাদেশের মানুষ সারাক্ষণই না-কি কৰ্ম্মদে। অথচ প্রয়োজনের সময় চোখের পানি নাই।
আহসানের সামনে চায়ের কাপে চা দেওয়া হয়েছে। কেক দেওয়া হয়েছে। সে চায়ের কাপে চুমুক দেয় নি। বিঙ্কিট স্পর্শ করে নি। তার মনের অবস্থা চাবিঙ্কিট খাবার মতো না। তাকে মেরাজউদিনের প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে। খুব ভেবেচিন্তে জবাব দিতে হচ্ছে।
যুথী মেয়েটা তোমার সঙ্গে কঠিন এবং রূঢ় আচরণ করেছে। এবং তার শেষ কথা ছিল Get lost.
জি স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, শুভ্ৰকে সে প্রতিবন্ধী হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তার চিঠি সে পড়ে নি?
জি স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, এবং যুথী মেয়েটি বলেছে। কেউ যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় সে আমার কাছে আসবে। আমি কেন তার কাছে যাব?
জি স্যার।
এর বাইরে কিছু আছে?
এর বাইরে কিছু নাই স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, গাড়ির ড্রাইভার বলছিল তুমি গাড়িতে ফেরার সময় বিড়বিড় করছিলে—এত বড় সাহস। আমাকে কানে ধরতে বলে। যুথী কি বলেছিল কানে ধরতে?
আহসান হকচকিয়ে গিয়ে বলল, জ্বি স্যার।
এই কথাটা আমাকে বলে নি কেন?
বলতে লজ্জা লাগিছিল স্যার।
মেরাজউদ্দিন বললেন, লজ্জা লাগারই কথা। তুমি এমন কী ভুল করেছ যে বাচ্চা একটা মেয়ে তোমাকে কানো ধরতে বলছে? করেছ কোনো অন্যায়?
জি-না।
মেয়েটির সঙ্গে কি তোমার কোনো পূৰ্বপরিচয় ছিল? আগে কি কখনো তাকে দেখেছ?
জি-না।
চিঠি দিতে গিয়ে তার সঙ্গে তোমার প্রথম পরিচয়?
জি স্যার।
মেরাজউদ্দিন রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এক কাপ চা খাব। চাটা তুমি নিজে বানাবে।
এই কথার অর্থ রেহানাকে এখন উঠে যেতে হবে। রেহানা উঠে গেলেন। মেরাজউদ্দিন হাত থেকে পাইপ নামিয়ে আহসানের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন, অনেকগুলি বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমি চালাই। তার জন্যে তোমার মতো চৌকষ অনেক অফিসার আমার আছে। তাদের কাজকর্ম পরিচালনার জন্যে আমার ছোট্ট একটা টিম আছে। এদেরকে তুমি গুপ্তচর বলতে পার। গুপ্তচরদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার। যেমন আছেন আবার অতি সামান্য পিয়ন যার কাজ চা বানানো তারাও আছে। এরা প্ৰতিমাসে একটা রিপোর্ট দেয়। রিপোটে দেখলাম যুথী মেয়েটাকে তুমি চাকরি দিয়েছিলে। সে যেদিন চাকরিতে জয়েন করতে এল, তুমি তাকে জয়েন করতে দাও নি। কারণ কী?
আহসান বলল, পুরো ব্যাপারটা স্যার আমি ঝোঁকের মাথায় করেছি।
ঝোঁকটা তৈরি হলো কেন বলো? অনেক অর্ধসত্য বলেছি, আর অর্ধসত্য বলবে না।
স্যার, আমার খুবই পরিচিত একজন মানুষ আছেন, তাঁকে আমরা বলি করিম আংকেল। অত্যন্ত আমুদে মানুষ। উনি একটা ছবি বানাচ্ছেন, ছবির নাম গুহামানব। ছবিতে বস্তির একটি অল্পশিক্ষিত মেয়ে হঠাৎ বড় একটা চাকরি পেয়ে যায়। একমাস পর তার জয়েন করার কথা। এই একমাসে সে অনেক কিছু করে। ভালো একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। ভাইবোনদেরকে স্কুলে ভর্তি করে। চাকরিতে জয়েন করার দিন দেখে, তার চাকরি হয় নি। সে ফিরে যায় আগের জায়গায়। বাস্তবে ঘটনা কী ঘটে। তিনি জানতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথামতো আমি যুথীকে দিয়ে experimentটা করি।
করিম আংকেল মনে হচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।
জ্বি স্যার।
তাঁকে আমার অফিসে আসতে বোলো। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলব।
জ্বি স্যার। মেরাজউদ্দিন হাতে পাইপ নিতে নিতে বললেন, তুমি যে অন্যায়গুলি করেছ। সেই অন্যায় আমি করলে আমি অবশ্যই মেয়েটির কথামতো কানো ধরতাম। যাই হোক, তোমার সঙ্গে কথা শেষ! তুমি এখন যেতে পারো। সাদেক বসে আছে, তাকে আমার কাছে পাঠাও।
মেরাজউদ্দিন সাহেবের কয়েকজন পার্সোনাল সেক্রেটারির ভেতর সাদেক একজন। সদেকের সব কর্মকাণ্ডই ধোঁয়াটে। সে একমাত্র কর্মচারী যার বেতন মেরাজউদ্দিন নিজে দেন।
মেরাজউদ্দিন বললেন, শুভ্রর কোনো খোঁজ বের করতে পেরেছ?
পারি নাই স্যার।
যুথীর বিষয়ে রিপোর্টটা তৈরি হয়েছে?
জ্বি স্যার।
সাদেক টেবিলের ওপর একটা খাম রাখল। মেরাজউদ্দিন খাম হাতে নিতে নিতে বললেন, শুভ্রর মা অত্যন্ত অস্থির হয়ে পড়েছে। তার মানসিক শান্তির জন্যে তাকে কিছু মিথ্যা কথা বলা দরকার। তুমি বলবে শুভ্রর খোঁজ পাওয়া গেছে।
জি স্যার।
রেহানা চা নিয়ে ঢুকলেন। সাদেক বলল, আম্মা, ছোট স্যারের খোঁজ পাওয়া গেছে।
রেহানার হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেল। গরম চা ছিটকে তাঁর পায়েও পড়ল। তিনি গরমটা বুঝতেই পারলেন না।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তাকে কোথায় পাওয়া গেছে বুঝিয়ে বলো।
সাদেক বলল, ময়মনসিংহে হালুয়াঘাটের কাছে। সোমেশ্বরী নদীতে একটা নৌকায় ছোট স্যার থাকেন।
রেহানা বললেন, ওই বদ মেয়েটাও কি শুভ্ৰর সঙ্গে নৌকায় থাকে?
জি-না। আম্মা। সে তার ফ্যামেলি নিয়ে আরেকটা নৌকায় থাকে। রান্নাবান্না ঐ নৌকাতেই হয়। তারা নৌকা কখনো এক জায়গায় রাখে না। তবে আমাদের চোখের আড়াল হবার কোনো উপায় নেই। আমাদের একটা ইঞ্জিন নৌকা সবসময় তাদের অনুসরণ করছে।
রেহানা বললেন, আমি এক্ষুনি হালুয়াঘাট রওনা হব।
মেরাজউদ্দিন বললেন, তুমি অবশ্যই রওনা হবে না। শুভ্র এসে এ বাড়িতে ঢুকবে। তার টাকাটা শেষ হলেই সে এই কাজটা করবে। তার বিষয়ে তো সব জানলে, এখন আর অস্থির হবার কিছু নেই।
মেরাজউদ্দিন খাম নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে গেলেন। খামে যুথীর বিষয়ে যা লেখা–
নাম : সায়মা হোসেন যুথী।
[যুথী নামে পরিচিত]
শিক্ষা : ম্যাথমেটিক্সে অনার্স পাশ করেছে। ফলাফল প্রথম শ্রেণী। M.Sc.- তে ভর্তির টাকা জমা দিলেও ক্লাস করে নি।
পেশা : চারটা টিউশনি করে। একটি মেয়ে, তিনটি ছেলে। (তাদের বাসার ঠিকানা আলাদা সংযুক্ত)
পরিবার : একটি মাত্র ভাই, নাম টুনু। বর্তমানে নিখোঁজ, আশঙ্কা করা হচ্ছে, র্যাবের হাতে ক্রসফায়ারে নিহত।
এই পর্যন্ত পড়েই তিনি সাদেককে আবারও ডাকলেন। বিরক্ত গলায় বললেন, রিপোর্টে আশঙ্কা করা হচ্ছে, মনে হচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে জাতীয় কোনো বাক্য থাকা আমার পছন্দ না। যা লেখা হবে নিশ্চিত হয়ে লেখা হবে। টুনু ছেলেটি র্যাবের হাতে নিহত—এই তথ্য কতটুকু সত্যি?
পুরোটাই সত্যি।
ভুলে আশঙ্কা করা হচ্ছে লিখেছি।
সে কি সন্ত্রাসীদের কেউ? জি-না। অতি ভালো ছেলে। তবে ছোট-মজিদ তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তারা দুজন একই স্কুলে পড়ত। দুজন একই সঙ্গে ইন্টারমিডিয়েট ফেল করে। র্যাব তাকে দেখিয়েছে ছোট-মজিদের সহযোগী হিসেবে।
টুনুর পরিবারের কেউ বিষয়টা জানে না?
না। টুনুর ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্নও না। সে প্রায়ই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, আবার ফিরে আসে।
তুমি তার ব্যাপারে আরও তথ্য সংগ্ৰহ কোরো।
জি স্যার।
আমার ধারণা ছেলেটি সন্ত্রাসীদের একজন। অতি ভালো কোনো ছেলে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কারও সঙ্গে ঘুরবে না। ছেলেটি কি বিবাহিত?
জি।
তার স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। তার স্ত্রীই স্বামী সম্পর্কে আসল কথাটি বলতে পারবে। একটি চীনা প্রবচন আছে, কোনো পুরুষমানুষের বিষয়ে যেসব তথ্য ঈশ্বর জানেন না, সেসব তথ্য তাদের স্ত্রীরা জানেন।
আজ নীপার পেট্রেট করা শুরু হবে। সে রাজি হয়েছে। সফিক রঙ-তুলি-ক্যানভাস নিয়ে এসেছে। ছবিটি সে করবে তেলরঙে। এতে ভুল হলে ত্রুটি শোধরাবার সুযোগ থাকবে।
সফিক বলল, বিষয়টা আমি যেভাবে দেখছি তা বলি। অলস দুপুর। ঠান্ডা মেঝেতে তুমি হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছ। তোমার কাছে এক গ্লাস পানি টলটল করছে। পানির গ্লাসের কাছে একটা গল্পের বই। এই বইটা কিছুক্ষণ আগে তুমি পড়ছিলে।
কী গল্পের বই?
ধরো শরৎচন্দ্রের দেবদাস।
নীপা বলল, কোনো মেয়ে নেংটা হয়ে শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে না।
তাহলে টনি মরিসনের একটা বই থাকুক।
নীপা বলল, না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য বইটা থাকুক।
আচ্ছা থাকুক।
শেষ করতে কতদিন লাগবে?
সাতদিন লাগবে। সাতদিন তোমার সামনে আমি নেংটো হয়ে শুয়ে থাকব?
হুঁ।
আমি একটা ভালো বুদ্ধি দেই?
দাও।
আমার ফিগারের সঙ্গে লাইলির ফিগারের মিল আছে। তুমি যখন মুখ আঁকবে তখন আমি থাকব। অন্যসময় লাইলি থাকবে।
সে কি রাজি হবে?
নীপা বলল, কেন রাজি হবে না? প্রথম সেশন লাইলিকে নিয়ে করো।
পোট্রেটের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। ক্যানভাসে ড্রয়িং করা হচ্ছে। সফিক বলল, লাইলি, তোমাকে অনেকবার দেখেছি। তুমি যে এতটা সুন্দর আগে বুঝি নি।
লাইলি স্বাভাবিক গলায় বলল, খোসা ছাড়ানোর আগে দেখেন নি, তাই বুঝেন নি।
সফিক বলল, অস্বস্তি লাগছে না তো?
না। ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুমিয়ে পড়লেই আমার জন্যে সুবিধা। লাইলি কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। খোলা জানালায় কিছু আলো এসে পড়েছে তার গায়ে এবং পানির গ্লাসে। পানির গ্লাস ঝলমল করছে। সফিক বলল, আমার এই ছবির টাইটেল হলো তৃষ্ণা। নাম ঠিক আছে না?
নীপা হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠিক আছে।
সফিক বলল, লাইলির পায়ের পজিশন সামান্য চেঞ্জ করা দরকার।
নীপা বলল, চেঞ্জ করে দাও। চেঞ্জ করলেই ঘুম ভেঙে যাবে। আমি চাই ঘুমিয়ে থাকুক। ঘুমন্ত অবস্থায় মূল ড্রয়িংটা শেষ করে ফেলি।
সফিক বলল, রবীন্দ্রনাথের ওই গানটা কি তোমার কাছে আছে? চক্ষে আমার তৃষ্ণা। তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে। আমি বৃষ্টি বিহীন বৈশাখী দিন…
নীপা বলল, খুঁজে দেখি।
যুথীর গানের ক্লাস আজকের মতো শেষ। অশোক বাবু আগ্রহ নিয়ে নাশতা খাচ্ছেন। সুজির হালুয়া, পরোটা এবং সিদ্ধ ডিম। চা দেওয়া হয়েছে। পিরিচ দিয়ে চায়ের কপি ঢাকা।
অশোক বাবু ডিম মুখে দিতে দিতে বললেন, যতটুক উন্নতি আমি আশা করেছিলাম তারচেয়ে অনেক কম হয়েছে। হতাশাজনক পরিস্থিতি। সঙ্গীতে আপনার মন নাই।
যুথী বলল, কোনোকিছুতেই আমার মন নাই। খামাখা সপ্তাহে একদিন হারমোনিয়াম নিয়ে ভ্যা ভ্যা করি; আজই আমার শেষ ক্লাস। আর শিখব না।
এটা কেমন কথা!
যুথী বলল, আপনাকে বেতন টেতন কিছুই তো দিতে পারি নি। এক কাজ করুন, হারমোনিয়ামটা নিয়ে চলে যান।
অশোক বাবুর চোখ চকচক করে উঠল। তিনি চাপা গলায় বললেন, সত্যি নিয়ে যাব?
হ্যাঁ নিয়ে যাবেন। যে বস্তুর ব্যবহার নেই সেই বস্তু ঘরে রেখে লাভ কী?
এটা অবশ্য একটা যুক্তিসঙ্গত কথা।
যুথী বলল, হারমোনিয়াম থাকলে আপনার কাছে। আবার যদি কখনো শিখতে ইচ্ছা করে আপনাকে খবর দেব।
অশোক বাবু নাশতা শেষ করে হারমোনিয়াম হাতে নিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, রিকশাভাড়া দিন চলে যাই।
যুথী রিকশাভাড়া দিয়ে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইল। কিছু ভালো লাগছে না। ঘুমের ওষুধ খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে। তার কাছে ঘুমের ওষুধ নেই। সে তার বাবার ওষুধের বাক্স থেকে ঘুমের ওষুধ নিতে পারে। তাকে নানান ধরনের ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে সময় পার করছেন। তাঁর শরীর কতটা সেরেছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অফিসে অনেক ছুটি পাওনা ছিল। দুমাসের বেতনসহ ছুটি নিয়েছেন। তাঁর তিরিক্ষি মেজাজ এখন ঠান্ডা। সবার সঙ্গে অত্যন্ত ভালো ব্যবহার করছেন। সালমার সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করছেন। তাকে নিয়ে নিয়মিত হিন্দি সিরিয়াল দেখছেন। ট্রাজিক অংশগুলিতে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলছেন।
তবে মাঝে মাঝে বড় সমস্যা হচ্ছে। যেমন, এক রাতে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে দেখতে তিনি হঠাৎ জড়সড় হয়ে গেলেন। ক্ষীণস্বরে সালমাকে বললেন, আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। আপনি কি টুনুর শাশুড়ি? কিছু মনে করবেন। না, কিছুদিন হলো শরীর ভালো যাচ্ছে না। কিছুই মনে থাকছে না। ইলিশ মাছের পাতুড়ি খেয়ে এই সমস্যা হয়েছে। আপনি সম্ভবত জানেন না, মহাবীর আলেকজান্ডার ইলিশ মাছ খেয়ে মারা গিয়েছিলেন। বিরাট আফসোসের ব্যাপার।
যুথী ঘুমিয়ে পড়েছিল। সালমা এসে গা ঝাঁকিয়ে তাকে ডেকে তুলে বললেন, তাড়াতাড়ি বসার ঘরে যা। পুলিশ এসেছে।
কেন?
জানি না কেন? তুই গিয়ে কথা বল।
যুথী বসার ঘরে গৈল। ডিবি পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর এসেছেন। বাসার বাইরে একদল পুলিশ। মোটর করে র্যাবের দুজন আছে। তারা মোটর সাইকেল থেকে নামেনি। দাঁড়িয়ে থাকা মোটর সাইকেলে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। দুজনের চোখেই ঘন কালো কাচের সানগ্লাস।
ডিবি ইন্সপেক্টর বললেন, আমরা আপনাদের বাসাটা সার্চ করব।
যুখী বলল, কেন?
কারণ অবশ্যই আছে। পরে জানবেন। আগে সার্চ শেষ হোক।
বাড়ি সার্চ শুরু হলো। মুহুর্তের মধ্যে সব লণ্ডভণ্ড। প্রতিটি বালিশ ছেড়া হলো। তোষক কাটা হলো। একটা ট্রাঙ্কের চাবি পাওয়া যাচ্ছিল না। তালা ভাঙা হলো। একজন টিভির পেছনের ডালা খুলে ফেলল। বাথরুমের ওপরের ফলস সিলিং-এ একজন উঠে গেল। ধমাধম শব্দে সেখান থেকে জিনিসপত্র ফেলতে লাগল।
আজহার ভীষণ হৈচৈ শুরু করলেন, আপনারা কী ভেবেছেন? নিরীহ পাবলিকের ওপর অত্যাচার করবে। আর পাবলিক আপনাদের ছেড়ে দেবে? আমি যদি আপনাদের চাকরি নট করার ব্যবস্থা না করেছি। তাহলে আমার নাম আজহার আলি না। আমার কানেকশন বিরাট বড়। প্রধানমন্ত্রীর এক ফুপুর সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। সেই ফুফু প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ। বিশ্বাস না করলে এখনই তার মাধ্যমে প্ৰধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করব।
ডিবি ইন্সপেক্টর বললেন, যোগাযোগ করতে চাইলে করুন। আমাদের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই।
বাড়ি সার্চের ব্যাপারে একজনই আনন্দিত হলেন, তিনি সালমা। তাঁর দুভরি ওজনের একটা গলার হার হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা পাওয়া গেল। বিয়ের সময় তাঁর বড় মামা একটা মার্কার কলম দিয়েছিলেন। কলামটাও পাওয়া গেল।
ডিবি ইন্সপেক্টর যুখীকে বললেন, আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
যুথী বলল, কোথায় যাব?
আমাদের অফিসে। আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
সমস্যাটা কী হয়েছে তা কি জানতে পারি?
অফিসে গেলেই জানবেন।
ডিবি ইন্সপেক্টরের সামনে যুথী বসে আছে। তাকে এক কাপ রং চা খেতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে একটা মাত্র জানালা। জানালায় পর্দা টানা বলে বাইরের আলো আসছে না। টেবিলের ওপর একটা টেবিল-ল্যাম্প। টেবিল-ল্যাম্পের আলো যুথীর মুখের ওপর ফেলা হয়েছে। চোখেমুখে কড়া আলোর কারণে যুথী ডিবি ইন্সপেক্টরের মুখ দেখতে পারছে না।
আপনার নাম?
সায়মা হোসেন। ডাকনাম যুথী।
বাবার নাম।
আজহার আলি।
বাবার নামের শেষে আলি, আপনার নামের শেষে হোসেন কেন?
বাবার ধারণা মহাবীর আলির নাম মেয়েদের নামের শেষে ব্যবহার করলে মেয়েরা বেয়াড়া হয়ে যায়।
ফোটনকে চেনেন?
না।
ফ্রুট ফোটন নামের কাউকে চেনেন?
না।
আপনার নাম কী?
একটু আগে নাম বলেছি।
আমাদের প্রশ্নের ধারা এরকম; প্রথম কিছুক্ষণ এমনসব প্রশ্ন করা হয় যার সত্যি উত্তর দিতে আপনি বাধ্য। কিছুক্ষণ সত্যি বলার পর সত্যি বলাটা অভ্যাসের মতো হয়ে যায়। তখন মূল প্রশ্ন করি, যাতে সত্যি উত্তর বের হয়। এখন বলুন আপনার নাম কী?
সায়মা হোসেন। ডাকনাম যুথী।
বাবার নাম কী?
আজহার আলি।
মায়ের নাম কী?
সালমা। সালমা বেগম।
ফ্রুট ফোটন আপনার কে হয়?
আমার কেউ হয় না। এই নামে আমি কাউকে চিনি না।
আপনার বড়ভাই ফলের ব্যবসা করতেন না?
কিছুদিন করেছেন। তার নাম টুনু। ফ্রুট ফোটন না।
আপনার কি কোনো ব্যাংক একাউন্ট আছে?
না। তবে ভাইয়া একবার করিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যাংকে একাউন্ট খুলে টাকা জমা করার মতো অবস্থা আমাদের না।
আপনার সেই ব্যাংক একাউন্টের কাগজপত্র কার কাছে?
আমার কাছে না। ভাইয়ার কাছে।
আপনার নাম কী?
সায়মা হোসেন।
ডাকনাম? যুথী।
বাবার নাম?
আজহার আলি।
বড়ভাইয়ের নাম?
টুনি।
আপনার ব্যাংক একাউন্টে কত টাকা আছে আপনি জানেন?
কোনো টাকা থাকার কথা না। দুই হাজার টাকা দিয়ে একাউন্ট খোলা হয়েছিল, তারপর আর টাকা জমা দেওয়া হয় নি।
আপনার ব্যাংক একাউন্টে এই মুহুর্তে আছে এক কোটি সতেরো লক্ষ তিনহাজার দুশ টাকা।
যুথী চুপ করে রইল। তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল।
ডিবি ইন্সপেক্টর বললেন, এটা ছাড়াও বনানীতে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনা আছে আপনার নামে।
আমি এইসব কিছুই জানি না। জানলে যে কষ্টের ভেতর দিয়ে সংসার চলছে তার থেকে মুক্তি চাইতাম। ব্যাংকের টাকা খরচ করতাম।
এই টাকা আপনার ভাই কীভাবে সংগ্ৰহ করেছেন তা জানেন?
জানি না, তবে অনুমান করতে পারছি। এবং ভাইয়া কেন কিছুদিন পরপর উধাও হয়ে যেত তাও বুঝতে পারছি। ভাইয়া কি আপনাদের হাতে ধরা পড়েছে?
সে ক্রসফায়ারে মারা গেছে।
যুথী বলল, আমি কি কিছুক্ষণ কাঁদতে পারি? না-কি আপনাদের এখানে কাঁদাও নিষেধ?
কাঁদতে পারেন।
যুথী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরে ফোঁপতে ফোঁপাতে বলল, আমি এতদিন জেনে এসেছি ভাইয়া এই পৃথিবীর শ্ৰেষ্ঠ কিছু মানুষের একজন।
ডিবি ইন্সপেক্টর যুথীর মুখের ওপরের লাইটটা সরিয়ে দিলেন।
আপনি কি আপনার ভাই সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু তথ্য দেবেন?
যুথী চোখ মুছতে মুছতে বলল, এখন তথ্য দিয়ে কী হবে?
ডিবি ইন্সপেক্টর বললেন, তথ্য সবসময় গুরুত্বপূর্ণ।
যুথী বলল, আমি তার সম্পর্কে যেসব তথ্য দেব তার কোনোটাই আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ না।
তারপরেও শুনি।
ভাইয়া সুন্দর পেন্সিল স্কেচ করতে পারত। তাঁর আঁকা একটা পোর্ট্রেট আমাদের বসার ঘরে বাঁধানো আছে। এই তথ্য কি আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
না।
ভাইয়া একবার একটা গল্প লিখেছিল। গল্পটার নাম মাহিনের মৃত্যু। গল্পটা একটা দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়েছিল। আমার কাছে কপি আছে।
আর কিছু?
গল্পে সে নিজের নাম দেয় নি। ছদ্মনাম দিয়েছিল। ছদ্মনাম ছিল ভৃগু সেন। এই তথ্য নিশ্চয়ই আপনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সে নিজেকে আড়ালে রাখত। আমি এক কাপ আগুনগরম চা খেতে চাই। চা কি পাওয়া যাবে?
পাওয়া যাবে।
প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথাব্যথার দুটা টেবলেট কি পেতে পারি?
অবশ্যই। মাথা ধরার টেবলেট আনিয়ে দিচ্ছি। আপনি ওষুধ এবং চা। খেয়ে বাসায় চলে যান। পুলিশের গাড়ি আপনাকে পৌঁছে দেবে।
আজহার মেয়েকে দেখে বললেন, ঘটনা কী বল। পুলিশ তোকে ধরে নিয়ে গেল কেন? বাড়ি সার্চ করল কেন?
যুথী বলল, কে যেন পুলিশকে খবর দিয়েছে আমি বিভিন্ন জায়গায় ড্রাগ সাপ্লাই করি। ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসি। এইজন্যেই ধরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছে।
আজহার বললেন, কে দিয়েছে এরকম একটা মিথ্যা খবর?
আমি কী করে জানব?
পুলিশকে জিজ্ঞেস করিস নাই?
না।
গাধি মেয়ে। তোর এটা জানা দরকার না? যা এক্ষুনি থানায় যা। জেনে আয়। তারপর দেখ আমি কী করি।
কী করবে?
মানহানির মামলা। দশ লাখ টাকার মানহানির মামলা। ঘাড়ে গামছা দিয়ে টাকা আদায় করব। মগের মুলুক পেয়েছে? This is not মগ’স মুল্লুক।
যুথী বলল, বাবা, চিৎকার কোরো না।
আজহার বললেন, এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, তারপরেও আমি চিৎকার করব না? মুখে চুষনি দিয়ে বসে থাকব? You dont know your father.
যুথী অনেক সময় নিয়ে অবেলায় গোসল করল। নতুন একটা শাড়ি পরল। এই শাড়ি টুনু তাকে দিয়ে বলেছিল, বিরাট কোনো আনন্দের ঘটনা ঘটলে এই শাড়িটা। পরবি। আজ কি যুথির জীবনের খুব আনন্দের কোনো দিন? অবশ্যই না। তারপরেও এই শাড়িটা সে কেন পরল। নিজেও জানে না। মানুষের অনেক কর্মকাণ্ডই যুক্তিছাড়া।
পুলিশ যুথীর ঘরও লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। ঘর গোছাতে হবে। ইচ্ছা করছে না। এই মুহুর্তে মন চাইছে ভাইয়ের লেখা মাহিনের মৃত্যু গল্পটা পড়তে। গল্পটা খুঁজে বের করতে ইচ্ছা করছে না।