আজকের সকালটা এত সুন্দর কেন?
ঘুম ভাঙতেই আসমানীর চোখ পড়ল আকাশেজানালার ফাঁক গলে ছোট্ট একটা আকাশ। কিন্তু এ আকাশ ছোট্ট না। বিশাল আকাশ। যে কোনো বিশাল কিছুর সামনে দাঁড়ালে মন কেমন করতে থাকে। শুধু আকাশের সামনে মন কেমন করে না, কারণ আকাশ দেখতে-দেখতে অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে আজ আসমানীর মন কেমন করছে। কান্না-কান্না পাচ্ছে।
তার মামাতো বোন এসে বলল, আপু ঘুমুচ্ছ?
আসমানী চোখ বন্ধ করে রাখল। যেন সত্যি-সত্যি ঘুমুচ্ছে। সে কাউকে জানতে দিতে চায় না যে সে সারারাত ঘুমুয় নি। সারারাত জেগে কাটিয়েছে। বিদেশে থাকা ঐ ছেলেটির সঙ্গে তার যেদিন বিয়ে হল সেদিন রাতেও এই অবস্থা। সারারাত সে জেগে, এক ফোঁটা ঘুম নেই। অবশ্য ঐ রাতে সে একা না বাড়ির সবাই জেগে ছিল। সবাই নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা করছিল। এর মধ্যে তার এক দূর সম্পর্কের ফুপাতো ভাই সাদা কাপড় পরে ভূত সেজে তাদের ভয় দেখাল। কত না কাণ্ড হল সেই রাতে। আহা ঐ বেচারা ফুপাতো ভাইটা বেঁচে নেই। পরের বছরই তিন দিনের জ্বরে মারা গেল। ও বেঁচে থাকলে আজও এসে কত হৈচৈ করত। ভালোভালো মানুষগুলো, যাদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ, যারা সব সময় পৃথিবীর সবাইকে আনন্দ দিতে চায় তাদেরকে এত সকাল-সকাল পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় কেন? ভাবতে-ভাবতে আসমানীর চোখ ভিজে উঠতে শুরু করল।
আপু, সবাই রাগ করছে। দুলাভাই কিন্তু চলে আসবে।
ভারি লজ্জা লাগছে আসমানীর। এখনো বিয়ে হয় নি, অথচ দুলাভাই ডাকছে। আজ ঐ লোকটার এ বাড়িতে নাস্তা করার কথা। নাস্তার পর দুজন মিলে কিছু কেনাকাটা করবে। যেমন ওর জন্য পায়জামা, পাঞ্জাবি এবং স্যুটের কাপড় কেনা হবে। আসমানী কিনবে তার বিয়ের শাড়ি। আজকাল নাকি নতুন নিয়ম হয়েছে এইসব কেনাকাটাগুলো হবু স্বামী-স্ত্রী একত্রে করে। এই কেনাকাটা করতে করতে সামান্য পরিচয় হয়। দুপুরে দুজন একত্রে বসে খায়। দেশটা কী সুন্দর করেই না বদলাচ্ছে। দুজনে মিলে এই প্রথম কিছু কেনা—এরচে সুন্দর আর কী হতে পারে?
আসমানীর মামী বললেন, তোর মুখ দিয়ে তো কোনো কথা বের হয় না। কম। দামি শাড়ি গুছিয়ে দিতে চাইলে রাজি হবি না, ব্লাউজ পিস দর্জির কাছে দিয়ে আসবি। স্যান্ডেলের মাপ দিবি। তুই আগে জিজ্ঞেস করে নিবি, তোমার বাজেট কত?
আসমানীর মামা বললেন, ওরে বাজেট কি আর লাখ টাকা হবে না-কি? খামাখা এসব জিজ্ঞাস করে লাভ নেই।
মামী বললেন, খালি হাতে তো আর বিয়ে করছে না। এইসব মানম্যানে ধরনের ছেলেরা বিয়ের টাকা ইউনিভার্সিটি লাইফ থেকে জমানো শুরু করে। বাইরে থেকে মনে হয় ফকির।
আসমানীর মামা ওদের দুজনের জন্যে একটা গাড়ি জোগাড় করে দিয়েছেন। পুরানো একটা ভোক্সওয়াগন। সারাদিন থাকবে। ড্রাইভারকে বলা আছে। গাড়িটার একটাই সমস্যা মাঝে-মাঝে স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়।
আসমানীকে অনেক রকম উপদেশও দেয়া হল, যেমন, ছেলে হয়ত বলবে, আমাকে ক্যাশ টাকা দিয়ে দাও আমি কিনে নেব তুই রাজি হবি না-যা কিবি দরাম করে কিনবি। তোর কাছে কত টাকা আছে শুরুতেই জানতে চাইবে-বলবি না কিন্তু।
আজ জহিরকে দেখে আসমানীর বুকটা ধ্বক করে উঠল। বেচারার মুখ এত শুকনো কেন? কি হয়েছে? আসমানী আজ তৃতীয়বারের মতো তাকে দেখছে। আজো তার গায়ে ঐ হালকা নীল শার্টটা। ঐ নীল শার্ট ছাড়া কি বেচারার আর কোনো শার্ট নেই? আচ্ছা আমি ওকে আজ পছন্দ করে কয়েকটা শার্ট কিনে দেব।
গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই জহির ইতস্তত করে বলল, আসমানী একটা সমস্যা হয়েছে।
আসমানী চোখ তুলে তাকাল, কিছু বলল না। কি সমস্যা হয়েছে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। নিজ থেকেই বলবে।
আমার এক মামাতো বোন আছে-ওর নাম অরু। ও গতকাল আমার কাছ থেকে সাত হাজার টাকা নিয়ে গেছে। ওর কি না-কি সমস্যা।
আসমানী ক্ষীণ গলায় বলল, কি সমস্যা?
গুছিয়ে বলে নাই। স্বামীর সাথে বনিবনা হচ্ছে না। হয়ত আলাদা থাকতে চায়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করি নি। কাঁদতে-কাঁদতে টাকাটা চাইল, দিয়ে দিলাম।
আজ তাহলে কী করবেন? চলে যাবেন?
পছন্দ করে রাখি পরে এক সময়….
আসমানী বলল, আমার জিনিসগুলি থাক। আপনারগুলি কিনে ফেলি।
জহির অবাক হয়ে বলল, আমার কি জিনিস?
পায়জামা, পাঞ্জাবি, স্যুটের কাপড়…।
আরে কী যে বল, আমি স্যুটের কাপড় কিনব নাকি? আমি হচ্ছি কেরানি মানুষ।
কেরানি মানুষরা বুঝি স্যুট পরে না?
পরে। না পরলেও হয়, না পরাটাই ভালো।
আসমানীর কাছে জহিরকে খুব লাজুক বলে মনে হচ্ছে না। আশ্চর্যের ব্যাপার, বোকা বলেও মনে হচ্ছে না। অথচ বাসার সবাই বলছিল…ছেলেটা বোকা টাইপের। আসমানীর ফুপুতে খুব খারাপ ভঙ্গিতেই বলেছিলেন, ছেলেটা ভেলা। রূপ দেখে আর ইশ নাই। সারাক্ষণ হাঁ করে আছে। এই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলে কপালে দুঃখ আছে। এমন দুঃখ যে দুঃখের আর সীমা-পরিসীমা থাকবে না।
ঘন্টাখানিক দুজন নিউমার্কেটে এলোমেলো ঘুরল। সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা একজন ছেলে, যে ছেলে দুদিন পর তার স্বামী হবে তাকে নিয়ে ঘুরতে কেমন লাগে আসমানী বুঝতে চেষ্টা করছে, পারছে না। তবে একটা জিনিস সে বুঝতে পারছে মানুষটার সঙ্গে তার কথা বলতে ভালো লাগছে, কথা বলতে ইচ্ছাও করছে।
আসমানী বলল, নীল রঙ বুঝি আপনার খুব পছন্দ?
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, কই না তো!
এই নীল শার্টটা পরে রোজ আসেন।
জহির কিছু বলল না। আসমানী বলল, আসুন আপনার জন্য কয়েকটা শার্ট কিনি। চকলেট রঙের শার্ট আমার খুব পছন্দ। আপনার কি চকলেট রঙের কোনো শার্ট আছে?
না।
আসুন না একটা কিনি।
আশ্চর্যের ব্যাপার, সব রকম শার্ট ঢাকা শহরে আছে শুধু চকলেট রঙের শার্টই নেই।
আসমানী ক্লান্তিহীন হাঁটল—এ দোকানে ঢুকল, ও দোকানে ঢুকল। কোথাও পাওয়া গেল না।
দুপুরে তারা গেল এক চীনে-রেস্তরাঁয়। অন্ধকার-অন্ধকার ঘর। ভালো করে মুখও দেখা যায় না। জহির অবশ্যি এর আগেও বেশ কয়েকবার এই রেস্তরাঁতেই এসেছে। এসেছে অরুর সঙ্গে।
মাঝে-মাঝে অরুর খুব বাজারের নেশা হত। স্কলারশিপের টাকা জমিয়ে কিছু টাকা হলেই সে বাজারে যাবে। সঙ্গে যাবে জহির।
অরু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলবে, জহির ভাই, আমার জিনিসপত্রগুলি ক্যারি করবার জন্যে আমার একজন গাধা দরকার। সঙ্গে চলুন তো? গাধা বলায় আপনি আবার কোনো রকম মানসিক কষ্টবোধ করবেন না। আমার কাছে গাধা কোনো গালাগালি নয়। গাধা হচ্ছে—শান্ত, নিরীহ, ভদ্র এবং কষ্টসহিষ্ণু একটি প্রাণী। নিজের জন্যে যে তেমন কিছু কখনো চায় না। সব সময় চায় অন্যকে সুখী করতে। আপনি যেমন আমাকে সুখী করতে চান, তাই না? আপনি চান না আমি সুখী হই?
হ্যাঁ চাই।
এই জন্যেই গাধা বললাম। বুঝলেন জনাব, রাগ করবেন না।
একগাদা বাজার-টাজার করার পর অরু খেতে যেত চাইনিজ রেস্তরাঁয়। অন্ধকার ঘরে মুখোমুখি খেতে বসা। এইসব খাবার জহিরের মোটেই মুখে রোচে না। স্যুপে কেমন কাঁচা মাংসের গন্ধ। এই জিনিস সবাই এত আগ্রহ করে খায় কী করে?
অরু খায়, জহির চুপচাপ বসে থাকে।
আজ দুজনের কেউ-ই খাচ্ছেনা। দুজনই চুপচাপ বসে আছে। স্যুপমুখে দিয়ে আসমানী বলল, খেতে কেমন যেন ভাতের মাড়ের মতো লাগছে।
কথাটা শুনে জহিরের খুব ভালো লাগল। মেয়েটা বেশ মজার তো।
আসমানী বলল, গুলশান বাজারে যাবেন? গুলশান বাজারে হয়ত চকলেট কালারের শার্ট পাওয়া যাবে। বিদেশিদের মার্কেট তো। ওখানে সব কিছু পাওয়া যায়। আচ্ছা, আপনি কি কখনো গুলশান মার্কেটে গিয়েছেন?
না।
আমিও যাই নি। আমি শুধু শুনেছি।
বলতে বলতে অকারণ মনের আনন্দে আসমানী একটু হেসে ফেলল।
কি সুন্দর হাসি। হাসির সময় অনেক মেয়ের চোখ ছোট হয়ে যায় কিন্তু এই মেয়েটার সবই অদ্ভুত। এর চোখ বড় হয়ে যায়।
আসমানী?
কি?
এই খাবারগুলো খেতে তোমার একটুও ভালো লাগছে না, তাই না?
হ্যাঁ।
আমারও না। চল উঠে পড়ি। আসমানী বলল, টেবিল পরিষ্কার করে নিয়ে যাক তারপর আমরা খানিকক্ষণ কফি খেতেখেতে গল্প করব। কথাগুলি আসমানী খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল। যেন সে প্রায়ই এখানে আসে, প্রায়ই খাবার-টাবার শেষ করার পর কফি খায়। গল্প করে।
আসমানী।
জ্বি।
তুমি কি প্রায়ই এখানে আস?
না তো!
আমি কয়েকবার এখানে এসেছি। অরুর সঙ্গে। ওর আবার এইসব খাবার খুব আলো লাগে।
জহির লক্ষ করল, আসমানীকে এখন কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। জহির বলল, আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি মানে এম্নি জিজ্ঞেস করা, তোমার ইচ্ছা না হলে জবাব দিও না।
আসমানী প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বলল, আপনি কী বলতে চান আমি জানি যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়েছে কিনা—এই তো?
জহির খুবই অবাক হল। মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ।
আসমানী বলল, না কোনোদিন দেখা হয় নি।
জহির বলল, তবে উনার ছবি তোমার কাছে আছে। তাই না?
আসমানী অস্পষ্ট স্বরে বলল, হা একটা ছবি আছে।
জহির বলল, ঐ ছবিতে উনার গায়ে নিশ্চয়ই চকলেট রঙের একটা শার্ট ছিল।
আসমানী শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। জহিরের কথার জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই। কথাটা পুরোপুরি সত্যি। আসমানী ভেবে পেল না বোকা ধরনের এই মানুষটা এটা কী করে বুঝে ফেলল।
জহির বলল, চল যাওয়া যাক। অনেকক্ষণ বসে আছি। এঁরা হয়ত ভাবছেন।
আসমানী নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল, কিছু বলল না। সত্যি-সত্যি অনেকক্ষণ কেটে গেছে। বিকেল হয়ে গেছে। আকাশ মেঘলা। আজকের সকালটা খুব সুন্দর ছিল—এখন কেন জানি ভয়ঙ্কর খারাপ লাগছে। আসমানীর চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মন খারাপ, ভয়ঙ্কর মন খারাপ।
আসমানী বলল, আপনাকে সঙ্গে আসতে হবে না। আপনি থাকুন। আমি একা-একাই যাব। জহির বলব, তুমি কি কোনো কারণে আমার ওপর রাগ করেছ?
আসমানী জবাব দিল না। কিন্তু জহির দেখল আসমানীর চোখ ছলছ্ল করছে।