আজকাল বাবাকে দেখলে কমলার কষ্ট হয়। ওপরের ওই বারান্দায় বসে অসহায়ভাবে ছটফট করেন ছোট ছেলের জন্যে।
আরামকেদারায় সোজাভাবে বসে দ্বৈপায়ন বললেন, “জানো বউমা, যে-কোনো একটা চাকরি হলেই আমি সন্তুষ্ট। খোকনের একটা স্থিতি প্রয়োজন।”
কমলা গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বললো, “নিশ্চয় স্থিতি হবে বাবা।”
“কোনো লক্ষণ তো দেখছি না, মা, গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন দ্বৈপায়ন।
চোখের চশমাটা খুলে সামনের টেবিলে রেখে দ্বৈপায়ন বললেন, “যার দাদারা ভালো চাকরি করে, তার পক্ষে একেবারে সাধারণ হওয়া বড় যন্ত্রণার। খোকন সেটা বোঝে কি না জানি না, কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয়।”
কমলা অনেকবার ভেবেছে, দাদারা নিজেদের অফিসে সোমের জন্যে একটু চেষ্টা করে দেখুলেই পারে। আজ বশরের কাছে সেই প্রস্তাব তুললো কমলা।
দ্বৈপায়ন বললেন, “কথাটা যে আমার মাথায় আসেনি তা নয়। ভোম্বল এবং কাজল দুজনকেই খোঁজখবর করতে বলেছিলাম। কিন্তু উপায় নেই, নিজের ভাইকে অফিসে
কোলে ইউনিয়ন হৈ-চৈ বাধাবে। ভোম্বলের অফিসে তো বড় সায়েব গোপন সার্কুলার দিয়েছেন, কোনো অফিসারের আত্মীয়কে চাকরিতে ঢোকাতে হলে তাঁর কাছে পেপার পাঠাতে হবে। সোজাসুজি বলে দিয়েছেন ব্যাপারটা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না।”
“দুই ভাই যদি গণের হয়? তবু তারা এক অফিসে জায়গা পাবে না?” কমলা বড় সায়েবের সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারলো না।
দ্বৈপায়ন বললেন, “তা হলেও নয়। সায়েবদের ধারণা, একই পরিবারের বেশি লোক একই অফিসে ঢুকলে নানা সমস্যা দেখা দেয়।”
কমলার তবু ভালো লাগছে না। সে বললো, “একই পরিবারের লোক এক অফিসে থাকলে বরং সুবিধে। এ ওকে দেখবে।”
হাসলেন দ্বৈপায়ন। বললেন, “বউমা, কর্মস্থল এবং ফ্যামিলি এক নয়, তুমি ভোম্বলকে জিজ্ঞেস করে দেখো।”
কমলা কিছুতেই একমত হতে পারছে না। সে বললো, “কেন বাবা? ওঁদের অফিস থেকে যে হাউস-ম্যাগাজিন আসে তাতে যে প্রত্যেক সংখ্যায় লেখা হয়, কোম্পানিও একটা পরিবার। প্রত্যেকটি কর্মচারি এই পরিবারের লোক।”
হাসলেন দ্বৈপায়ন। “ওটা সত্যি কথা নয়, বউমা। নামকাওয়াস্তে বলতে হয়, তাই বড়-কর্তারা বলেন। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেন না। ভোম্বল একটা বই এনে দিয়েছিল, তাতে পড়েছিলাম—অফিসটা হলো পরিবারের উল্টো। অফিসে আদর্শের কোনো দাম নেই– সেখানে যে ভালো কাজ করে, যে বেশি লাভ দেখাতে পারে তারই খাতির। সে লোকটা মানুষ হিসেবে কেমন তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। অথচ ফ্যামিলিতে মনুষ্যত্বের দামটাই বেশি দেবার চেষ্টা করি আমরা। দয়া মায়া স্নেহ মমতা এসবের কোনো স্বীকৃতি নেই অফিসে। যে ভুল করে, দোষ করে, নিয়ম ভাঙে, ঠিক মতো প্রোডাকশন দেয় না, কর্মক্ষেত্রে তাকে নির্দয়ভাবে শাসন করতে হয়—সংসারে কিন্তু তা হয় না। অফিসে যে ভালো কাজ করে তার দাম। বাড়িতে কোনো ছেলে পরীক্ষায় ফেল করলেও তার ওপর ভালোবাসা কমে যায় না। বরং অনেক সময় ভালোবাসা বাড়ে।”
কমলা এতো বুঝতো না। সে সবিস্ময়ে সরল মনে বললো, “তাহলে পরিবারটাই তো অনেক ভালো জায়গা, বাবা।”
দ্বৈপায়ন হাসলেন। “সে-কথা বলে। সংসারটাই তো আমাদের আশ্রয়-সংসারের ভালোর জন্যেই তো লোকে আপিসে যায়।”
কমলা বললো, “আপিসে তো যাইনি, তাই ব্যাপারটা কখনও বুঝিনি, বাবা।”
“অনেকে সারাজন্ম আপিস গিয়েও ব্যাপারটা বোঝে না, মা। সংসারের মূল্যও তারা জানে না।”
কমলা তার পক্ষের মতো চোখ দুটো বড় বড় করে বিস্ময়ে বশরের দিকে তাকিয়ে থাকে। দ্বৈপায়ন বললেন, “ভোম্বলকে বোলো তো বইটা আবার নিয়ে আসতে। আর একবার উল্টে দেখবো, তুমিও পড়ে নিও। একটা কথা আমার খুব ভালো লেগেছিল—আমাদের এই সমাজটাও এক ধরনের অরণ্য। ইট-কাঠ-পাথর দিয়ে তৈরি এই অরণ্যে জঙ্গলের নিয়মই চালু রয়েছে। এরই মধ্যে পরিবারটা হলো ছোট্ট নিরাপদ কুড়েঘরের মতো। এখান থেকে। বেরোলেই সাবধান হতে হবে; সবসময় মনে রাখতে হবে আমরা মানুষের জঙ্গলে বিচরণ। করছি।”
হতাশ হয়ে পড়লো কমলা। “তাহলে বলছেন, ভাইদের অফিসে সোমের কোনো আশা নেই?”
দুঃখের সঙ্গেই দ্বৈপায়ন স্বীকার করলেন, “কোনো সম্ভাবনাই নেই। এবং চেষ্টা করাও ঠিক হবে না, কারণ তাতে দুই দাদার কাজৈর ক্ষতি হতে পারে।”
দ্বৈপায়ন এবার বাথরুমে গা মুছবার জন্যে ঢাকলেন। কমলা সেই ফাঁকে দ্রুত এক গ্লাস হরলিকস তৈরি করে নিয়ে এলো।
ঠাণ্ডা জলের সংস্পর্শে এসে দ্বৈপায়ন এবার বেশ তাজা অনুভব করছেন। শরীরের অবসাদ নষ্ট হয়েছে।
কমল উঠতে যাচ্ছিল। দ্বৈপায়ন বললেন, “রান্না তো শেষ হয়ে গিয়েছে?”
“খাবার লোক তো এবেলায় কম। নগেনদি কেবল রুটিগুলো সেকছেন,” কমলা জানালো। দ্বৈপায়নের ইচ্ছে বউমা আরও একটু বসে যায়। বললেন, “তোমার যদি অসুবিধে না হয়, তাহলে আরও একটু বসো না, বউমা।”
বাবার মন বোঝে কমলা। বউমার সঙ্গেই একমাত্র তিনি সহজ হতে পারেন। আর সবার সঙ্গে কথা বলার সময় কেমন যেন একটা দুরত্ব এসে যায়। এই দূরত্ব কীভাবে গড়ে উঠেছে কেউ জানে না। ছেলেরা কাছে এসে তাঁর কথা শুনে যায়, কিছু, খবর দেবার থাকলে দেয়, কিন্তু সহজ পরিবেশটা গড়ে ওঠে না। কমলা বাবাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, কিন্তু প্রয়োজন হলে প্রশ্ন তোলে। আর বাবারও যে বউমার ওপর বেশ দুর্বলতা আছে তা সহজেই বুঝতে পারা যায়! বউমা প্রশ্ন করলে রাগ তো দুরের কথা তিনি খুশী হন। ছেলেদের অত সাহস নেই। তারা প্রতিবাদও করে না, প্রশ্নও করে না। তবে তারা বাবার অবাধ্য হয় না।
কমলা বললো, “বাবা, আপনি দুবেলা বেড়াতে বেরোবেন।”
“বেশ তো আছি, বউমা। এখানে বসে বসেই তো পৃথিবীর অনেকটা দেখতে পাচ্ছি।” দ্বৈপায়ন সস্নেহে উত্তর দেন। তারপর একটু থেমে বললেন, “আজকাল আর হাঁটতে ভালো লাগছে না। বয়স তো হচ্ছে।”
“আপনার কিছুই বয়স হয়নি,” মৃদ, বকুনি লাগালো কমলা। “আপনার বন্ধ, দেবপ্রিয়বাবু তো আপনার থেকে ছ’মাস আগে রিটায়ার করেছেন। সকাল থেকে টো-টো করছেন, তাস খেলছেন।”
“দেবটা চিরকালই একটু ফচকে। তাসের নেশা অনেকদিনের। আমার আবার তাসটা মোটেই ভালো লাগে না,” দ্বৈপায়ন বললেন।
ছোট মেয়ের মতো উৎসাহে কমলা বললো, “কাকীমা ‘সেদিন দেবপ্রিয়বাবকে খুব বকছিলেন। কাকাবাবু নাকি কোনো সিনেমা বাদ দেন না। আজকাল ম্যাটিনী শোতে হিন্দী বই পর্যন্ত লাইন দিয়ে দেখে আসেন একা-একা।”
গভীর দ্বৈপায়ন এবার হাসি চাপতে পারলেন না। বললেন, “দেব, তাহলে বুড়ো বয়সে হিন্দী ছবির খপ্পরে পড়লো। বউকে নিয়ে গেলেই পারে—তাহলে বাড়িতে আর অশান্তি হয় না।”
“দোষটা তো কাকাবাবুর নয়,” কমলা জানায়। “কাকীমা যে ঠাকুর-দেবতার বই ছাড়া দেখতে যাবেন না।”
এই ধরনের কথাবার্তা বাবার সঙ্গে এ-বাড়ির কেউ বলতে সাহস করবে না।
বাবা যে আবার সোমনাথ সম্পর্কে চিন্তা আরম্ভ করেছেন তা কমলা ওঁর মুখের ভাব দেখেই বুঝলো।
দ্বৈপায়ন জিজ্ঞেস করলেন, “খোকন কোথায়?”
সোমনাথ এখনও ফেরেনি শুনে প্রথমে একটু বিরক্তি এলো দ্বৈপায়নের। ভাবলেন, কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই বেশ টো-টো করে ঘুরছে। তারপর নিজেকে সামলে নিলেন। ঘোরা ছাড়া ওর কী-ই বা করবার আছে?
ঠিক সময়ে সোমনাথ বাড়ি ফিরলে দ্বৈপায়ন তবু একটু নিশ্চিন্ত হতে পারেন। অজিকাল যেরকম খুনোখুনীর যুগ পড়েছে, তাতে মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হয় দ্বৈপায়নের। কয়েকবছর আগে সমর্থ মেয়েদেরই একলা বাইরে বেরতে দিতে ভয় করতে বাবা-মায়েরা। এখন জোয়ান ছেলেদের নিয়ে বেশি চিন্তা। গোপনে গোপনে এদের মনের মধ্যে কখন কীসের চিন্তা আসবে কে জানে। তারপর রাজনীতির নেশায় দলে পড়ে, সমাজের ওপর বিরক্ত হয়ে, কী করে বসবে কে জানে? দ্বৈপায়ন ভাবলেন, আত্মহনন ছাড়া এযুগের অভিমানী ছেলেগুলো অন্য কিছুই জানে না।
কমলা এবার বশরের চিতা নিরসন করলো। বললো, “সোমের বধূ অরবিন্দর বৌভাত আজ। যেতে চাইছিল না। আমি জোর করে পাঠিয়েছি।”
“অরবিন্দ তাহলে কাজ পেয়েছে। পড়াশুনোয় ও তো খুব ভালো ছিল না।” দ্বৈপায়ন নিজের মনেই বললেন।
“ওর বাবা চেষ্টা করে কোনো বড় অফিসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, সোম বলছিল।” ও দ্বৈপায়ন বউমার এই কথা শুনে অস্বস্তি বোধ করলেন। নিজের অক্ষমতাকে চাপা দেবার জন্যেই যেন সমস্ত দোষ সোমের ওপর চাপাবার চেষ্টা করলেন। বেশ বিরক্তির সঙ্গে বউমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন এমন হলো বলো তো?”
কমলা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো।
দ্বৈপায়ন বললেন, “আমি তো কখনও পরীক্ষায় খারাপ করিনি। নিজের চেষ্টায় কম্পিটিশনে স্ট্যান্ড করে সরকারী কাজে ঢুকেছিলাম। ওর দাদাদের জন্যে কোনোদিন তো মাস্টার পর্যন্ত রাখিনি। তারা অত ভালো করলো। অথচ খোকন কেন যে অত অর্ডিনারি হলো?”
কমলা বশরের সঙ্গে একমত হতে পারছে না। সোম মোটেই অর্ডিনারি নয়। ওর বেশ বুদ্ধি আছে। কমলা বললো, “পরীক্ষাটা আজকাল পুরোপুরি লটারি, বাবা। সোমনাথ তো বেশ বুদ্ধিমান ছেলে।”
দ্বৈপায়ন ঠোঁট উল্টোলেন। “তুমি বলতে চাও, ওর ওপর এগজামিনারের রাগ ছিল?”
“তা হয়তো নয়। কিন্তু আজকাল কীভাবে যে পরীক্ষা-টরিক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষকরাও বোঝেন না যে এর ওপর ছেলেমেয়েদের জীবন নির্ভর করছে।
“এর মধ্যেই অনেকে ভালো রেজাল্ট করছে, বউমা।” দ্বৈপায়নের গলার স্বরে ছোট ছেলে সম্পর্কে ব্যঙ্গ ফুটে উঠলো।
ছোট দেওর সম্পর্কে কমলার একটু দুর্বলতা আছে। বিয়ের পর থেকে এতোদিন ধরে ছেলেটাকে দেখছে কমলা। দুজনে খুব কাছাকাছি এসেছে।
“ওর মনটা খুব ভালো বাবা,” কমলা শান্তভাবে বললো।
“মন নিয়ে এ-সংসারে কেউ ধয়ে খাবে না, বউমা,” বিরক্ত দ্বৈপায়ন উত্তর দিলেন। “পড়াশোনায় ভালো না করলে, দুনিয়াতে কোনো দাম নেই।”
“পড়াশোনায় ভালো অথচ স্বভাবে পাজী এমন ছেলে আজকাল অনেক হচ্ছে, বাবা। তাদের আমার ভালো লাগে না,” কমলা বললো। তার ঘোমটা খসে পড়েছিল, সেটা আবার মাথার ওপর তুলে নিলো।
“যে-গোরু দুধ দেয় তার লাথি অনেকে সহ্য করতে রাজী থাকে বউমা,” দ্বৈপায়ন বিরক্তভাবেই উত্তর দিলেন।
“খোকন তো চেষ্টা করছে বাবা,” কমলা ব্যর্থ চেষ্টা করলো শ্বশুরকে বোঝাবার।
“চেষ্টা নিয়ে সংসারে কী হবে? রেজাল্ট কী, তাই দিয়েই মানুষের বিচার হবে,” দ্বৈপায়ন যে সোমনাথের ওপর বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছেন তা তাঁর কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু কমলা কী করে সোমনাথের বিরদ্ধে মতামত দেয়? সোমনাথ তো কখনও বড়দের অবাধ্য হয়নি। বাড়ির সব আইনকানন খোকন মেনে চলেছে। পড়ার সময় পড়তে বসেছে। অন্য কোনো দুষ্টমির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েনি। গোড়ার দিকে সে তো পড়াশোনায় খারাপ ছিল না কিন্তু মা দেহ রাখার পর কী যে হলো। ক্রমশ সোমনাথ পিছিয়ে পড়তে লাগলো। সেকেন্ড ডিভিসনে স্কুল ফাইনাল পাস করলো। বাবার ইচ্ছে ছিল এক ছেলে ইনজিনীয়ার, এক ছেলে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট এবং ছোট ছেলেকে ডাক্তার করবেন। কিন্তু ভালো নম্বর না থাকলে ডাক্তারিতে ঢোকা যায় না।
কমলার মনে পড়লো, সোমনাথ একবার বউদিকে বলেছিল, “আমাকে অত ভালোবাসবেন না বউদি। আপনার বিশ্বাসের দাম তো আমি দিতে পারবো না। আমি সব বিষয়ে অর্ডিনারি।”
কমলা বলেছিল, “তোমাকে আর পাকামো করতে হবে না।”
সোমনাথ বলেছিল, “মায়ের রং কত ফর্সা ছিল আপনি তো দেখেছেন। দাদারা ফর্সা। হয়েছে। আমার রং দেখুন কালো। ভাগ্যে মেয়ে হইনি, তাহলে বাবাকে এই বাড়ি বিক্রি করতে হতো। পড়াশোনায় কখনও ফাঁকি দিইনি—কিন্তু অর্ডিনারি থেকে গেছি। অনেকে গান-বাজনা কিংবা খেলাধুলোয় ভালো হয়। আমার তাও হলো না।
দুনিয়ার সব মানুষকে ব্রিলিয়ান্ট হতে হবে, এ কী রকম কথা? পৃথিবীর কেন, দেশে ক’টা লোক ব্রিলিয়ান্ট হয়? বেশির ভাগ মানুষই তো অতি সাধারণ। কিন্তু তারা কেমন সখে স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছে। কমলা বুঝতে পারে না, এই দেশের কী হতে চলেছে। ব্রিলিয়ান্ট হোক না-হোক সোমকে খুব ভালো লাগে কমলার। ছেলেটা খুব নরম। ওর মনে নোংরামি নেই। অনেক বাড়িতে এক ভাই আরেক ভাইকে হিংসা করে। সোমের শরীরে হিংসে নেই। আর বউদিকে সে যে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে তা কমলা ভালোভাবে জানে।
বাবাকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করলো কমলা। বললো, “আজকালকার ছেলেদের সম্বন্ধে যা শনি তার থেকে সোম অনেক ভালো। ওর মনটা এখনও সংসারের নোংরামিতে বিষিয়ে যায়নি বাবা।”
দ্বৈপায়ন বিশেষ ভিজলেন না। বললেন, “তোমার কাছে বলতে বাধা নেই, এক-এক সময় মনে হয় কাউকে বেশি প্রোটেকশন দিতে নেই। বেশি সুখ, বেশি স্বাচ্ছন্দ্য, বেশি নিশ্চয়তার মধ্যে থাকলে অনেক সময় মানুষের ভিতরের আগনটা জ্বলে ওঠবার সুযোগ পায় না। যাদের দেখবে প্রচণ্ড অভাব, প্রচণ্ড অপমান, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যাদের কোনো ভরসা। নেই—তারা অনেক সময় নিজেদের দুঃখের শিকল নিজেরাই ছিঁড়ে ফেলে। তারা অপরের মুখ চেয়ে বসে থাকে না।”
কমলা বুঝতে পারলো বাবা কী বলতে চাইছেন। কিন্তু সব সময় কথাটা সত্যি নয়। সুকুমারকে তো বাবা চেনেন, তাহলে সে তো এতোদিন আশ্চর্য কিছু একটা করে ফেলতো।
কমলা এবার একতলায় নেমে এলো। তার ভয়, সোমনাথ এসব না জেনে ফেলে। রাগের মাথায় বাবা কোনোদিন না সোমনাথের সঙ্গেই এসব আলোচনা করে বসেন। বাইরের সমস্ত দুনিয়া তো বেচারাকে অপমান করছে, এর পর বাড়ির আত্মসম্মানটুকু গেলে ছেলেটা কোথায় দাঁড়াবে?
দ্বৈপায়নও একটু লজ্জা পেলেন। সত্যি, এই সব ছেলে যে এখনও সভ্যভব্য রয়েছে, এটা কম কথা নয়। সুযোগ-সুবিধা না পেয়ে ঘরে ঘরে লক্ষ লক্ষ ছেলে যদি উচ্ছন্নে চলে যায়, তাহলে সেও এক ভয়াবহ ব্যাপার হবে। সত্যিই তো সোমনাথের বিরদ্ধে বেকারত্ব ছাড়া তাঁর আর কোনো অভিযোগ নেই। একটা চাকরি সে যোগাড় করতে পারেনি। কিন্তু আর কোনো কষ্ট সোমনাথ তো বাবাকে দেয়নি। আজকাল ছেলেপলে সম্বন্ধে যেসব কথা কানে আসে, তারা যেসব কাণ্ড বাধিয়ে বসেছে, তাতে বাপ-মায়ের পাগল হয়ে যাওয়া ছাড়া, উপায় নেই।
গতকালই তো দ্বৈপায়ন শুনলেন, অনেক বেকার ছেলে বাড়িতে, আজকাল চরম দুর্ব্যবহার করছে। তারা বাড়ির সব সুবিধে নিচ্ছে, অথচ চোখও রাঙাচ্ছে। তারা নিজেদের জামাকাপড় পর্যন্ত কাচে না, একগ্লাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খায় না, বাড়ির কোনো কাজ করে না এবং বাড়ির কোনো আইন মানতেও তারা প্রস্তুত নয়। বাড়িটাকেও ওরা জঙ্গল করে তুলছে।
দ্বৈপায়ন ভাবলেন, এই সব ছেলে বাইরে হেরে গিয়ে, বাড়ির ভিতরে এসে যেন-তেনউপায়ে জিততে চায়। এরা প্রত্যেকে এক-একটা সাইকলজিক কেস। গতকালই তো নগেনবাবরে কথা শুনলেন। ওঁর বড় ছেলেটা মস্তান হয়েছে। সকাল সাড়ে-ন’টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। জলখাবার খেয়ে বাড়ি থেকে কেটে পড়ে। ভাত খাবার জন্যে ফিরে আসে তিনটের সময়। আবার বেরিয়ে পড়ে। ফেরে রাত এগারোটায়। বিড়ি সিগারেট টানে। রাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছে। নগেনবাব খুব বকুনি লাগিয়ে বলেছিলেন, “তোমাকে ছেলে বলে পরিচয় দিতে আমার লজ্জা হয়।” ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, “দেবেন না।” চরম দুঃখে নগেনবাব বলেছিলেন, “এই জনেই বুঝি লোকে সন্তান কামনা করে?” ছোকরা এতোখানি বেয়াদপ, বাবার মুখের ওপর বলেছে, “ছেলের জন্ম হওয়ার পিছনে আপনার অন্য কামনাও ছিল, সন্তান একটা বাই-প্রোডাক্ট মাত্র।
ছেলের কথা শুনে নগেনবাব শয্যাশায়ী হয়েছিলেন দু’দিন। এখনও লকিয়ে-লুকিয়ে চোখের জল ফেলেন।
বউমাকে বলে দিলে হতো, খোকন যেন এদের কথাবার্তার কিছু জানতে না পারে। তারপর দ্বৈপায়ন ভাবলেন, বউমা বুদ্ধিমতী, ওকে সাবধান করবার প্রয়োজন নেই।