০৫. আকাশ দেখে কে বলবে

আকাশ দেখে কে বলবে কাল রাতে এত বর্ষণ হয়েছে? শাহানার চোখ বার বার আকাশে চলে যাচ্ছে। রোদ উঠেছে কড়া। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ। শাহানা চায়ের কাপ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ বাড়ির সবই বড় বড়, শুধু চায়ের কাপগুলো ছোট। শাহানার অভ্যাস মগভর্তি চা নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খাওয়া। শুরুতে মগের চা গরম থাকে, আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হতে থাকে। সেটা টের পাওয়া যায় না।

শাহানা শোবার ঘরে ঢুকল। নীতু গম্ভীর ভঙ্গিতে কি যেন লিখছে। নীতুর লেখালেখির সময় আশেপাশে না থাকাই ভাল। সে একটু পর পর বানান জিজ্ঞেস . করবে। শাহানা আবার বারান্দায় চলে এল। বারান্দায় মাছ কাটা হচ্ছে। প্রকাণ্ড এক চিতল মাছ–তিনজন লাগছে মাছ কাটতে। দুজন মাছ ধরে আছে, একজন বটি। প্রতিদিনই কি এমন সাইজের মাছ আনা হবে?

ইরতাজুদ্দিন বেতের মোড়ায় বসে আছেন। নাতনীর দিকে তাকিয়ে বললেন–আয়, মাছ কাটা দেখে যা।

জীবন্ত একটা প্রাণীকে কাটা হবে। সেই দৃশ্য পাশে দাঁড়িয়ে দেখার মধ্যে কোন আনন্দ নেই। দাদাজানকে এই কথা বুঝানোও যাবে না। শাহানা তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইরতাজুদ্দিন এগিয়ে এলেন–

চোখ বড় বড় করে কি দেখছিস?

বাড়ি দেখছি। কি প্রকাণ্ড বাড়ি! এত বড় বাড়ি বানানোর দরকার কি?

বাড়ি বড় না হলে মন বড় হয় না।

শাহানা হাসতে হাসতে বলল, ঠিক বলেননি দাদাজান, এই পৃথিবীর বেশির ভাগ বড় মনের মানুষের জন্ম হয়েছে ছোট ছোট বাড়িতে। অন্ধকার খুপরিতে।

ভূল তর্ক আমার সঙ্গে করবি না। রবীন্দ্রনাথ কি খুপরি ঘরে জন্মেছেন? টলস্টয় ছিলেন জমিদার। তুই দশটা বড় মনের মানুষের নাম বল যে খুপরি ঘরে জন্মেছে। খুপরি ঘরে থাকলে মনটাও খুপরির মত হয়ে যায়…

শাহানা খুব চেষ্টা করছে দরিদ্র ঘরে জন্মানো কিছু ভুবন-বিখ্যাত মানুষের নাম মনে করতে, মনে পড়ছে না। অথচ সে জানে তার কথাই ঠিক। নামগুলি এক সময় মনে পড়বে, তখন কোন কাজে আসবে না।

ইরতাজুদ্দিন বললেন, বাড়ি পছন্দ হয়েছে কি না বল।

হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে। খুব পছন্দ হয়েছে–ছাদে যাবার ব্যবস্থা থাকলে আরও পছন্দ হত।

ছাদে যেতে চাস? সেটা কোন ব্যাপারই না, মিস্ত্রি ডাকিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে লাগিয়ে দেব।

দরকার নেই দাদাজান।

ইরতাজুদ্দিন খুশি খুশি গলায় বললেন, অবশ্যই দরকার আছে। আমার বংশের একটা মেয়ে, তার শখ হয়েছে, সেই শখ মেটানো হবে না তা হয় না।

এই বংশের মানুষদের সব শখ মেটানো হয়?

যতক্ষণ ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ মেটানো হয়। আমার যে দাদাজান তার একবার শখ হল আম খাবেন। তখন মাঘ মাস–কোথায় পাওয়া যাবে আম? শখ বলে কথা–সেই আম জোগাড় করা হল–পাঞ্জাব থেকে আনা হল। সেই আমলে আম আনতে খরচ হয়েছিল সাত হাজার টাকা।

আম খেয়ে উনি খুশি হয়েছিলেন?

অবশ্যই হয়েছিলেন। শখ মেটাতে পেরেছেন এটাই খুশির ব্যাপার।

উনি কি উনার সব শখ মিটিয়ে যেতে পেরেছিলেন?

তা জানি না।

আপনি কি আপনার সব শখ মেটাতে পেরেছেন?

ইরতাজুদ্দিন জবাব দিলেন না। তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল। শাহানা বলল, দাদাজান, মতি বলে যে ভদ্রলোক আমাদের নিয়ে এসেছিলেন তাকে রাতে আমাদের সঙ্গে খেতে বলুন তো।

ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, কেন?

বেচারা খুব কষ্ট করে আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন।

আপনি আপনি করছিস কেন?

আপনি বলব না?

অবশ্যই না। আপনি–তুমি–তুই এইগুলি সৃষ্টি ইয়েছে কেন? প্রয়োজন আছে বলেই সৃষ্টি হয়েছে। ফকির যখন ঢাকায় তোদের বাসায় ভিক্ষা চায় তখন তুই কি বলিস–যাও মাফ কর, না- কি দয়া করে ক্ষমা করুন?

ফকির আমাদের বাসায় আসতে পারে না। দুজন দারোয়ান, তিনটা এলসেশিয়ান কুকুর ডিঙিয়ে আসা সম্ভব না। অবশ্যি গাড়ি করে যাবার সময় মাঝে মাঝে ভিক্ষা চায়–তখন কিন্তু আমি আপনি বলি–তুমি বলি না, তুই বলি না।

এখানে বলতে হবে। আজ তুই মতি গাধাটাকে আপনি বলবি, সে লাই পেয়ে যাবে, ভাববে… সমানে সমান।

দাদাজান আপনি পুরানো দিনের জমিদারদের মত কথা বলছেন। একটা মানুষ গরীব হলেই তাকে তুই বলতে হবে?

ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন–তোদের বয়সে এইসব আদর্শবাদী কথা বলতে ভাল লাগে। শুনতেও ভাল লাগে। এই বয়সে মনে হয় মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। ভেদাভেদ অবশ্যই আছে। তোর কাছেও আছে। মতি হল এই গ্রামের অপদার্থ একজন বাউন্ডেলে। কাজকর্ম কিছুই করে না–ঘুরে বেড়ায়–জ্ঞানীর মত কথা বলার চেষ্টা করে। গানের দল করেছে–দলের কাজ হল রাত জেগে হুল্লোড় করা–সব কটা চোর একত্র হয়ে…

শাহানা অবাক হয়ে বলল, এই ভাবে কথা বলছেন কেন? তাকে পছন্দ করেন না–ভাল কথা–চোর বলার দরকার কি?

ইরতাজুদ্দিন কিছুক্ষণ কড়া চোখে নাতনীর দিকে তাকিয়ে বাংলোঘরের দিকে রওনা হলেন! ছাদে ওঠার সিড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।

কাঠের সিঁড়ি সন্ধ্যা নাগাদ পঁড়িয়ে গেল। সিড়ি খানিকটা নড়বড়ে। একজনকে সিড়ির গোড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ইরতাজুদ্দিন কাঠ মিস্ত্রিকেই রেখে দিয়েছেন। দশদিন সে এ বাড়িতেই থাকবে, খাবে–তার নাতনীরা যখন সিঁড়ি বেয়ে উঠবে-নামবে সে সিড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। নড়বড়ে সিড়ি বানানোর এই তার শাস্তি।

শাহানার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে ইচ্ছা করল না। সে ছাদে হাঁটবে আর একজন সিড়ির কাছে অপেক্ষা করবে–কখন সে ছাদ থেকে নামবে–খুব অস্বস্তিকর ব্যাপার। দরকার নেই তার ছাদে যাওয়ার।

শুরুতে নীতুর যত খারাপ লেগেছে এখন আর তত খারাপ লাগছে না। হরিকেন হাতে নিয়ে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে নীতুর ভাল লাগছে। হারিকেন তার খুব পছন্দ হয়েছে–হারিকেনে নিজের চারপাশটাই শুধু আলোকিত হয় আর সব অন্ধকার। নীতুর একা একা ঘুরতে খারাপ লাগত–এখন স্রে একা একা যাচ্ছে না। ইরতাজুদ্দিন নীতুর বয়েসী একটা মেয়েকে খবর দিয়ে এনেছেন–মেয়েটার নাম পুষ্প। তার কাজ হচ্ছে নীতুর সঙ্গে থাকা, তার ফুট-ফরমাস করে দেয়া।

পুষ্প শুরুতে খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। এখন তার ভয় কেটে গেছে। সে নীতুর সঙ্গে ছায়ার মত আছে তবে ফুট-ফরমাস করার কোন সুযোগ পাওয়া পাচ্ছে না। হারিকেনটা হাতে নিয়ে হাঁটলেও কিছু কাজ হত। নীতু হারিকেন হাতছাড়া করছে না। পুষ্পকে নীতুর খুব পছন্দ হয়েছে। শুধু সেয়েটা যদি একটু ফর্সা হত! মেয়েটা ভয়ংকর কালো। নীতু পুষ্পকে দেখে প্রথমেই বলেছে–তুমি এত কালো কেন?

পুষ্প তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছে–খালাম্মা, আমরা তো গরীব মানুষ এই জন্যে কালো।

গরীব মানুষ হলেই কালো হয়।

জ্বি খালাম্মা, হয়। বালা বালা সাবান না মাখলে কি আর শইল্যে রঙ ফুটে? গরীব মাইনষে সাবান কই পাইব!

শোন, আমাকে খালাম্মা ডাকছ কেন?

কি ডাকমু?

তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে আমার চেয়ে বয়সে বড়। আমাকে নীতু ডাকবে।

আফনে কি যে কন! ছিঃ, ছিঃ। থুক।

পুষ্প থু করে একদলা থুথু ফেলল। নীতু রাগী গলায় বলল, ছিঃ ছিঃ বলে থুথু ফেললে কেন? ঘরের ভেতর থুথু ফেলা নোংরামি। থুথুতে ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়া চারদিকে রোগ ছড়ায়। বুঝতে পারছ?

পুষ্প তেমন কিছু বুঝল না তারপরও বলল, পারতাছি।

তুমি অনেক কিছুই জান না। আমার কাছ থেকে শিখে নিবে। গরীব হলে গায়ের রঙ কালো হয় না। আর যদি গায়ের রঙ কালো হয় সাবান মেখে কিছু হবে না। অনেক ধনী মানুষের কালো কালো মেয়ে আছে। আমার এক বান্ধবী আছে, তৃণা নাম–ও ভয়ংকর কালো। ওর সাবানের অভাব নেই।

ভাল সাবান দিলে কাম হয়।

কোন সাবানেই কাজ হয় না। তুমি লেখাপড়া জান?

জ্বে না। সে কি! সত্যি জান না?

জ্বে না।

আমরা তো এখানে আরো নদিন থাকব। এই কদিনে তোমাকে আমি লেখাপড়া শিখিয়ে দেব। আজ প্রথম দিনে পড়াব না। কাল বই-খাতা নিয়ে আসবে।

বই-খাতা কই পামু?

বই-খাতাও নেই? আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করব।

পুষ্পকে নীতুর খুব পছন্দ হলেও মাঝে মাঝে মেয়েটার বোকামি ধরনের কথায় গা জ্বলে যেতে লাগল। যেমন–নীতু অন্দর বাড়ি থেকে বাংলোঘরে যাবে–পুষ্প বলল, একটু খাড়ান বুবু, চুল বাইন্দা দেই।

নীতু বলল, কেন?

অহন সইন্ধাকাল তো। সইন্ধাকালে চুল বান্দা না থাকলে জীন-ভূতে ধরে।

চুল বাঁধা থাকলে ধরে না?

জ্বে না।

কেন?

চুল খোলা থাকলে চুলের আগা বাইয়া এরা শইল্যে উঠে। চুলের আগা না ধরলে এরা উঠতে পারে না।

আজেবাজে কথা আমাকে কখনো বলবে না পুষ্প। আজেবাজে কথা শুনলে আমি খুব রাগ করি। ভূত-প্রেত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।

আফনেরার শহর-বন্দরে নাই। আমরার গেরামদেশে আছে।

কোথাও নেই। ভূত-প্রেত সব মানুষের বানানো।

তাইলে বুবু আফনেরে একটা গফ কই, শুইন্যা নিজেই বিবেচনা করেন–গত বছর বইস্যা মাসে… বাপজান গেছে হাটে। টেকা লইয়া গেছে। কুসুম বুর জন্যে শাড়ি কিনব। কুসুম হইল আমার বুবুর নাম। আমরা তিন ভইন ছিলাম। মাইঝলা ভইন পানিত ড়িবা মারা গেছে। হেইডাও জ্বীনের কারবার। আফনেরে পরে বলব। যেটা বলতেছিলাম–বুবুর জন্যে বাপজান শাড়ি কিনব। মুসুল্লীর হাট। নৌকা লইয়া গেছে। মুসুল্লীর হাট তো আফনের হাতের তালুর মইদ্যে না–মেলা দূর। ফিরতে দিরং হইছে। নৌকা বাইয়া একা আসতাছে, হঠাৎ শুনে কাশির শব্দ। কে জানি কাশে। নৌকার মইদ্যে লোক নাই জন নাই, কাশে কে? বাপজান চাইয়া দেখে–নৌকার ছইয়ের ভিতরে সুন্দরপানা একটা মাইয়া। পান খাইয়া ঠোঁট করছে লাল। পরনে আগুনের লাহান এক শাড়ি। পায়ে আলতা। বাপজান অবাক হইয়া বলল–আফনে কেডা?

মেয়েছেলেটা সুন্দর কইরা হাসল, তারপরে বলল, আমি কে তা দিয়ক প্রয়োজন? তোমার নৌকা বাওনের কাম, তুমি নৌকা বাও।

বাপজানের মনে খুব ভয় হইল। সইন্ধাকালে কি বিপদ! তার আর হাত চলে না। নৌকার বইঠার ওজন মনে হয় তিন মন। মেয়েছেলেটা বাপজানরে কলল–ও মাঝির পুত মাঝি, নৌকা বাওন তোমার কাম, তুমি নৌকা বাও। খবরদার, আমারে আড়ে আড়ে দেখবা না। তোমার পুটলির মধ্যে কি?

বাপজান বলল, শাড়ি। নয়া শাড়ি। কুসুমের জন্যে কিহি আমার বড় মাইয়া।

তোমার মাইয়ার নয়া শাড়ি আমি অখন পরব। খবরদার, শাড়ি বদলানির সময় আড়ে আড়ে আমারে দেখবা না। দেখলে নিজেই ভয় পাইবা।

এই বইল্যা সেই মাইয়া নিজের পরনের শাড়ি এক টানে খুইল্যা ফেলল। বাপজান দেখব না দেখব না ভাইব্যাও একক তাকাইল। তার শইলের রক্ত ঠাণ্ডা অইয়া গেল।

নীতু ভীতু গলায় বলল, উনার শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হল কেন?

পুষ্প ফিস ফিস করে বলল, কারণ বাপজান তাকাইয়া দেখে, এই মেয়েছেলের বুকে তিনটা দুধ। দেইখ্যাই বাপজান এক চিৎকার দিয়া ফিট পড়ছে। ফিট ভাঙলে দেহে–ঘাটে নৌকা, মেয়েছেলেটা নাই।

তোমার বাপজান এই গল্প তোমাদের বলেছেন?

না, আমরারে বলে নাই। মারে বলছে–গেরামের লোকরে বলছে।

তোমরা বিশ্বাস করছ?

বিশ্বাস না করনের কি? বিলের মইধ্যে ডাকিনী মেয়েছেলে থাকে… এবারে কয় মায়া ডাকিনী।

নীতু রাগী গলায় বলল, বিলের মধ্যে মাছ ছাড়া আর কিছু থাকে না। তোমার বাপজান বানিয়ে বানিয়ে এই গল্প করেছেন। কারণ তোমার বুবুর শাড়ি কেনার কথা। ছিল তো। তিনি শাড়ি না কিনে টাকাটা অন্য কোথাও খরচ করে ফেলেছেন কিংবা হারিয়ে ফেলেছেন। কাজেই তিনি একটা গল্প বানিয়েছেন। তোমরা বোকা তো, তোমরা বিশ্বাস করেছ।

পুষ্প হাসছে। খিলখিল করে হাসছে। নীতু বলল, হাসছ কেন?

বাপজান কিন্তুক বুবুর শাড়ি আনছে। ঐ মেয়েছেলে শাড়ি থুইয়া গেছে। যেমন ভঁজ ছিল তেমন ভঁজে ভঁজে রাইখ্যা গেছে। তয় বুবু এই শাড়ি পিন্দে না। মা কয়–জ্বীন-ভূতের পরা শাড়ি শইল্যে দিস না। শাড়ি ঘরে তোলা আছে–লাল শাড়ি–আফনেরে দেখামু নে।

নীতু ধাঁধায় পড়ে গেল। তার ভয় ভয়ও করতে লাগল। পুষ্প গলার স্বর নামিয়ে বলল–গেরামদেশ হইল বুবু জ্বীন-ভূতের দেশ। আমার মাইঝলা ভইনরে ক্যাসুনে পানিত ড়িবাইয়া মারছে এইটা শুনেন… জ্বীনে ধরল… মাঘ মাসের শীত। জব্বর শীত পড়ছে…

নীতু বলল, জ্বীন-ভূতের গল্প আর শুনব না।

 

শাহানা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখছে। শহরে অন্ধকার দেখার সুযোগ নেই। এখন আবার পথে পথে সোডিয়াম ল্যাম্প। রাত হলেই মনে হয় শহরটার জণ্ডিস হয়েছে। অন্ধকারও যে দেখতে ভাল লাগে তা এখানে এসেই শাহানা বুঝতে পারছে। দেখতে ভাল লাগার প্রধান কারণ বোধহয় গ্রাম কখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয় না। ঐ তো জোনাকি পোকা জ্বেলছে, নিভছে। কি অদ্ভুত সুন্দর। জোনাকি পোকারা শহর পছন্দ করে না, কারণটা কি–শহরে প্রচুর আলো এই জন্যে? এরা শুধু অন্ধকার খুঁজে বেড়ায়।

একা একা এখানে কি করছিস?

জোনাকি পোকা দেখছি। আপনি কোথায় ছিলেন?

এশার নামাজ পড়লাম–তুই কি নামাজ টামাজ পরিস, না তোর বাবার মত হয়েছিস?

শাহানা হাসতে হাসতে বলল, বাবার মত হয়েছি।

তোদের বাসায় কেউ নামাজ পড়ে না?

মা খুব পড়ে। তাহাজুদও পড়ে। এখন এক পীর সাহেবের মুরিদ হয়েছে। বাবা মাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করেন।

ইরতাজুদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন–হাসাহাসি করার কি আছে?

পীর সাহেব-টাহেব নিয়ে মার মাতামাতি দেখে হাসাহাসি করেন। ধর্ম বিষয়ে মজার মজার তর্ক তুলে মাকে রাগিয়ে দেন। রেগে গেলে মা একেবারে নীতুর মত–কেঁদে কেটে একাকার।

ইরতাজুদ্দিন আরো গম্ভীর হয়ে বললেন–ধর্ম বিষয়ে মজার তর্ক কি?

শাহানা হাসল। অন্ধকারে ইরতাজুদ্দিন তার হাসি দেখলেন না। শাহানা বলল–বাবা বলেন, আমাদের আল্লাহর অংক জ্ঞান তেমন সুবিধার ছিল না–অংকে তিনি সামান্য কাঁচা। সম্পত্তি ভাগের যে আইন কোরান শরীফে আছে সেখানে ভুল আছে। যে ভুল হযরত আলী পরে ঠিক করেছিলেন, যাকে বলে আউল।

ইরতাজুদ্দিন রাগী গলায় বললেন–ফারায়েজী আইনে ভুল, এইসব তুই কি বলছিস?

আমি কিছু বলছি না, বাবা বলছেন। ভুলটা কেমন আপনাকে বলি দাদাজান। যেমন ধরুন, এক লোকের বাবা আছে, মা আছে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী আছে সে মারা গেল। ফারায়েজী আইনে তার সম্পত্তি কি ভাবে ভাগ হবে? মা পাবে ১/৬, বাবা ১/৬, দুই মেয়ে ২/৩, স্ত্রী ১/৮, এদের যোগ করলে হয় ২৭/২৪, তা তো হতে পারে না।

তোর বাবা এখন কি এইসবই করে বেড়ায়? ভুল-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায়? সে নিজেকে কি মনে করে–দি পারফেক্ট?

আপনি ব্যাপারটাকে অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছেন দাদাজান।

আমি অন্যদিকে নিচ্ছি না। আমি শুধু তোর বাবার স্পর্ধা ও সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। সে আমারও ভুল ধরে। তার কত বড় সাহস, সে আমাকে চিঠি লিখে–আপনি যে অন্যায় করেছেন তার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত…। আমি তার জন্মদাতা পিতা, সে আমার ভুল ধরে আমাকে শাস্তি দিতে চায়…

ইরতাজুদ্দিন রাগে থর থর করে কাপছেন। শাহানা দারুণ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। জোনাকি পোকা এখনো জ্বলছে, নিড়ছে, কিন্তু তার আলো এখন আর দেখতে ভাল লাগছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *