অনেকদিন পর রাত্রে গলা পর্যন্ত আউশের নতুন চালের ভাত, গোরুর গোশত ও হাতিবান্দার দৈ এবং এর আগে দুপুরবেলা ভাত ও আলু দিয়ে পাক-করা বোয়াল মাছের ঘাঁটি সালুন এবং সকাল থেকে দুপুর ও দুপুরে ভাত খাবার পর থেকে রাতে খাবার আগে পর্যন্ত দুই দফায় মুড়ি, বাতাসা ও খাগড়াই খেয়ে বাড়ি ফিরে তমিজের বাপ টইটম্বুর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাঝরাতে তলপেটের ব্যথায় সে জেগে ওঠে এবং দরজা খুলে বাইরের উঠান পেরিয়ে বাঁশঝাড়ে পৌঁছুবার আগেই তাকে বসে পড়তে হয় ডোবার অনেকটা এদিকেই। কোনোমতে-ধোয়া নষ্ট লুঙি এবং নিজের পাছা উরু ও পা ধুয়ে শরীর টেনে ঘরে ঢোকার আগেই তাকে ফের বসে পড়তে হয় দরজার বাইরে এবং সেখানে বসেই বিপুল আওয়াজে শুরু করে বমি করতে। পায়খানা করার সময় শরীরের বেআক্কেলে নিয়মে মলদ্বারে খাদ্যবস্তুর স্বাদ একটুও পায় নি, এখন বমি করতে গিয়ে গলা দিয়ে ওগরানো ভালো ভালো জিনিসের স্বাদ পেয়ে সে একটু চাঙা হয়ে ওঠে। বমি করার সময় গলার মাত্রাছাড়া আওয়াজে ব্যামাক খাবারের পেট খালি করে বেরিয়ে যাবার জন্যে হাহাকারটিও ছিলো। এই আওয়াজে শমশের পরামাণিকের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ থাকাটাও অসম্ভব নয়। শমশের হলো আদি চাষাঘরের মানুষ, পাছায় ত্যানা না জুটলেও কথাবার্তায় এরা সব লবারের বেটা। কথা সবটা সে রাখে নি। পরশু গোলাবাড়ি হাটে দেখা হলে বললো, নরেশের দোকানের। রসগোল্লা দুটো করে হলেও দেবে। না, পাকা মিষ্টি শালা দিলো না। তাতে তমিজের বাপের ততো দুঃখ নাই। হাতিবান্ধার গোপাল ঘোষের দৈ আর দৈয়ের সঙ্গে আখের গুড় যে পরিমাণ দিয়েছে তাতে পাকা মিষ্টি না দিলেও চলে। কিন্তু কপাল মন্দ, এতোগুলো ভালো ভালো জিনিস, পেটে বুঝি কিছুই রইলো না।
তা পেটের কী দোষ? রাত্রে তার খাওয়া নিয়ে নিজের বেটা যেমন চটাং চটাং কথা বললো তাতে গোরুর গোশত আর বোয়াল মাছ কি পেটের মধ্যে জুত করে দুই দণ্ড বসতে পারে? এসব খানদানি খানার ইজ্জত নাই? তমিজের খালি এক কথা, যে মানুষ। এক ছটাক জমি রাখতে পারে নি, সে মাঙন কামলা খাটতে যায় কোন আক্কেলে? ওই শমশেরই তো ওই একই আকালের সময় জগদীশ সাহার দেনা শোধ করতে মণ্ডলের কাছে সব বেচে দিয়েও বিঘা দুয়েক জমি কিছুতেই হাতছাড়া করলো না। হোক না তার দোপা জমি, আউশ ছাড়া আর কিছুই হয় না, কিন্তু এ জমি নিতে মণ্ডল তো কম চেষ্টা করে নি। তবু শমসের জমিটা ছাড়লো না। এর রহস্য কী? –ভরপেটে তমিজের বাপ এই রহস্যের কোনো কিনারা করতে না পারলে দায়িত্বটি পালন করতে হয় তমিজকেই।-আরে, শমশের পরামাণিক হলো খাটি চাষার বংশ, এক ছটাক হলেও চাষের জমি তার রাখা চাই। আর তমিজের বাপ হলো মাঝি, মাছ মেরে খাওয়া তার বংশের পেশা। মুসলমান মাঝি আর হিন্দু চাড়ালে ফারাক কী? জমির ইজ্জত এই মাঝির জাত বুঝবে কী?—নিজের বংশ নিয়ে বেটার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলা কথা শুনতে শুনতেই তমিজের বাপের পেটে অস্বস্তি শুরু হয় এবং তখন থেকেই পেট গুড়গুড় করতে থাকে।
বাপের এইসব মন-খারাপ কি পেট-চিনচিনকে পরোয়া না করে তমিজ বলেই চলে মানুষের বাড়ি বাড়ি এরকম খাবার ললিচ বাদ দিয়ে বাপ বরং মণ্ডলের হাতে পায়ে ধরে বুলুর চাষ-করা জমিটা বর্গা নেওয়ার ব্যবস্থা করুক। মণ্ডল রাজি হচ্ছে না। তমিজকে আজ ফিরিয়ে দিয়েছে, তবে কাল ফের যেতে বললো। তমিজের বাপ একটু চেষ্টা করুক না! সে গিয়ে কারুরু করলেই মণ্ডল তাকে মাফ করে দেবে।
তমিজের বাপের দোষটা কী যে তাকে মাফ চাইতে হবে? পেটের সঙ্গে তার গোটা শরীর এবার গরগর করে রাগে : সে কী অপরাধ করলো?
নিন্দের মদ্যে হলেও তুমি কালাহার বিলে যাও না? তমিজের প্রশ্ন শুনে বুড়া ফ্যালফ্যাল করে তাকায়, গেলোই বা, তাতে দোষের কী?
আত্রে ঘাড়ত জাল লিয়া তুমি বিলত যাও কিসক? জানো না, লায়েববাবুর সাথে ন্যাকাপড়া করা মণ্ডলে ওই বিল জমা লিছে। তাক খাজনা না দিয়া বিলেত কেউ কিছু। করবার পারবি না। আর তুমি লিত্যি ওটি যাও মাছ ধরবার, মণ্ডল যদি চৌকিদার দিয়া তোমাক ধরায়, তুমি কিছু কবার পারবা?
তমিজের মুখে মণ্ডলের অভিযোগ শুনে তমিজের বাপের চোখ জুড়ে মেঘ নামে। বাপদাদাপরদাদা সোগলি ওই বিলের মাছ ম্যারা সংসার চালায়া গেছে, এখন আবার– তার এই অসম্পূর্ণ বাক্য মুখ দিয়ে বেরুতে না বেরুতে সমস্ত মুখ-ঢেকে-ফেলা অন্ধকারে ধাক্কা খেয়ে ঢুকে পড়ে মুখের ভেতর এবং নালী অনুনালী হয়ে পেটে ঢুকে যায় হজম বা বদহজম-হতে-থাকা ভাত, গোরুর গোশত, বোয়াল মাছ ও গুড়-দিয়া-মাখা হাতিবান্ধার দৈয়ের কোমল আশ্রয়ে। তার ঘরের ওপরে মণ্ডলবাড়ির কয়েকটা সাদা বকের সুনসান উড়ালে তার কালোকিষ্টি রোগাপটকা শরীর শিরশির করে উঠলে সে তার ঘরের চালের দিকে তাকায় না। ঐসব বকের ছাইরঙের ছায়া থেকে নিজের মাথা বাঁচানোর চেয়েও পেটের খাদ্যিখাওয়াগুলোর হেফাজত করা বেশি জরুরি। বকের নজর থেকে পেটের খাবার বাঁচাতে দুই হাতে সে তার পেট চেপে ধরে এবং তমিজের কথা শুনতে শুনতেই তাড়াতাড়ি করে লুকিয়ে পড়ে ঘুমের আড়ালে। কিন্তু ঘুম কি ছাই ওইসব ছাইরঙের ছায়া-ফেলা বকদের ক্রমপ্রসারমাণ অন্ধকারকে মুছে ফেলতে পারে? তাদের নিনজরে পেটের খাবার তার পেটে থাকতে পারে না। দরজায় বসে বমি করার বিকট আওয়াজে তার পেট থেকে গোরুর গোশত, বোয়াল মাছ, বাতাসা, খাগড়াই ও দৈ বেরিয়ে যাবার জন্যে হাহাকার তো ছিলোই, ওই আওয়াজ ব্যবচ্ছেদ করলে বৈকুণ্ঠের গলায়-গাওয়া চেরাগ আলি ফকিরের গানের টুকরাটাকরাও পাওয়া যেতে পারে,
মজনু হুঙ্কারে যতো মাদারি ফকির।
আন্ধার পাগড়িত বান্ধো নিজ নিজ শির।
সিনাতে জিঞ্জির পরো আঁখির ভিতর।
সুরমা করিয়া মাখো সুরুজের কর।।
তুমি ফকিরের সব গানই জানো, না? ইগলান মারফতি গান তুমি বোঝো?-শমশের পরামাণিকের এই সংশয়ে বৈকুণ্ঠের কিছুমাত্র বিকার নাই। পাঁচটা গান না গেয়ে সে এখান থেকে উঠবে না। ফর্সা গেঞ্জি ও ময়লা ধুতি পরে মুখভরা পান নিয়ে সে যাচ্ছিলো সাবগ্রাম হাটের দিকে; বাবুর আড়তের জন্যে জিরা কিনবে আর জিরার ভেজাল দিতে শটিবীজের বায়না দিয়ে আসবে ছাইহাটার ভক্তদাস কুণ্ডুর গদিতে। একেবারে সন্ধ্যা পার করে দিয়ে জিরা আর জিরার ভেজাল নিয়ে গোরুর গাড়িতে ফিরবে গোলাবাড়ি।
তা সাবগ্রামের পথে এখানে পড়ে গেলো শমশেরের দোপাজমি, জমিতে মাঙুন খাটা মা হচ্ছে শুনেই বৈকুণ্ঠ বসে পড়লো জমির আলে আমগাছের তলে।
ক্যা গো, মাঙুন কামলা খাটো, তা মুখখাতু গান নাই? বলে বৈকুণ্ঠ নিজেই গাইতে শুরু করলে শমশের ভয় পায়, এই মানুষটার বোধশোধ কম,এই যে গান শুরু করলো এর আর থামাথামি নাই। কামলাদের কাজে ঢিল না পড়ে। সে তাই তাকে তাগাদা দেয়, সাবগ্রাম যাবা বলে? হাট তো বস্যা গেছে বেনবেলা।
আরে জিরা তো পাওয়াই যাবি। শটির বিচি পাওয়ার জন্যে ঐ শালা কুণ্ডুর পাও ধরা লাগবি। শালা ভ্যাজাল বেচে, তারও দাপট কতো। কয় বছর হলো ভ্যাজাল না দিলে জিরা বেচ্যা বাবুর নাকি লোকসান।
হাটে যাওয়া তার মাথায় ওঠে। গান শুনতে কামলাদের উৎসাহও কম নয়, বাপু, হাট তো পাছাবেলা পর্যন্ত চলবিই। আরো কয়টা গান করো। আর একজন বলে, গান না হলে কামের জুত হয়? চেরাগ আলি ফকির থাকতে মাঙুন খাটার সুখ আছিলো গো। মাঙুন খাটার খবর পালেই ফকির লিজে অ্যাসা গান ধরিচ্ছিলো, কাম খুব আগাছে। তা চেরাগ আলির কথাই আলাদা। কোথাও মাঙুন কামলা খাটা হবে শুনলেই সে ঠিক। হাজির হতো তার নাতনিকে নিয়ে। দোতারা বাজিয়ে একটার পর একটা গান করে অন্তত এক বেলা নাতনিকে নিয়ে পেট ভরে খেয়ে তারপর উঠেছে জমি থেকে। বৈকুণ্ঠের খাওয়া দাওয়ার দিকে নজরটা কম, পান ছাড়া তার মুখে খুব একটা কিছু দেখা যায় না। এমন কি আমগাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা হুঁকা হাতে নিয়ে মুখে লাগাতে গিয়েও সে রেখে দেয়, না বাপু থাক।
তামুক খালেও জাত যাবি? মোসলমান ফকিরের গান ধরিছো, তাত তোমার জাত যায় না? শমশেরের এই মিষ্টি ধিক্কারে কান না দিয়ে বৈকুণ্ঠ তার ময়লা ধুতির কোঁচা থেকে পেতলের কৌটা বার করে সাজা পান মুখে দেয়। কৌটার ভেতরেই আরেকটি ছোটো কৌটা, সেটা হাতের তালুতে উপুড় করে জর্দা নিয়ে মুখে ফেললে মিষ্টি তামাকের গন্ধে আমতলা ম ম করে। কিছুক্ষণ আয়েশ করে পান চিবিয়ে কৃপণের মতো অল্প একটু পিক ফেলে সে বলে, কাম করো গো কাম করো। গান শুনলে কামের জোর বাড়ে। সাধুজনের বাক্য আছে, সংগীতে লজ্জিবি গিরি, পঙ্গুরে কহিল গিরি। গিরি কয়, ওরে পঙ্গু, সংগীত দিয়া পাহাড় ডিঙাবার পারবু। এই গিরি কেটা?—শোনো সেই গিরির গান ধরি। আগেও শুনিছো, এখন আবার শোনো। প্রস্তাবনা সেরে গুনগুন করে গানের সুর ভেজে নিয়ে অদৃশ্য কারো উদ্দেশ্যে দুই হাত জোড় করে নমস্কার করে। তারপর গায়,
দশনামী প্রভুগণে বন্দিয়া পবিত্র মনে
গিরিসেনা দাড়ায় কাতারে।
ভবানী নামিল রণে পাঠান সেনাপতি সনে
গোরা কাটো আদেশে হুঙ্কারে।
ভবানীর কণ্ঠধ্বনি মৃগরাজধ্বনি জিনি
গর্জনে শার্দুলে লজ্জিত।
সেই ডাকে চঞ্চল মানাস নদীর জল
হইল গোরা শোণিতে রঞ্জিত।
কোম্পানির গোরাসবে পাঠাঁইয়া যমভবে
জলে প্রভু করে আচমন।
বন হইতে সঙ্গোপনে গোরাগণ আক্রমণে
প্রভু সেথা ত্যাজিল জীবন।
গিরিগণে নামে জলে যতনে লইল কোলে
কৃষ্ণ কোলে যেন শত রাই।
পাষাণে হৃদয় বান্ধো কান্দো গিরিগণে কান্দো
ভবানী পাঠক ভবে নাই।
কীর্তনের সুরে হাওয়ার ভ্যাপসা ভাব কাটে, এতে কামলাদের কাস্তের ধার বাড়ে এবং বৈকুণ্ঠের শেষ কথা না-আ-আ-ই-এর লম্বা টানে তমিজের বাপ কেটে ফেলে ধানের মোটা মোেটা আঁটি। এমন কি ভবানী পাঠকের মৃত্যুর শোকে বৈকুণ্ঠের পানের পিক-গেলা গলা চিরে গেলেও তাতে ঘাতকের বিরুদ্ধে ক্রোধ মেশানো থাকায় তার ঝঝে প্রত্যেকের কাস্তের গতি বাড়ে। গান থামার পর গোটা মাঠের হাওয়া এসে ঝাপটা মারে আমগাছের পাতায় পাতায় ও ধানের শীষে শীষে। কেঁচড় ভরা মুড়ি আর বাতাসা আর খাগড়াই নিয়ে বৈকুণ্ঠ সাবগ্রামের দিকে রওয়ানা হলো তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে।
এখন এই এতোক্ষণ পর, এই মধ্যরাতে তুমুল আওয়াজে বমি করতে করতে তমিজের বাপের সামনে বৈকুণ্ঠ গিরির লেশমাত্র ছায়া নাই। গানের কথাগুলি সে বার করে নেয় তার বমির আওয়াজ থেকে। এই গানে তমিজের বাপের রোগাপটকা শরীরে এমনি কাঁপুনি ওঠে যে উঠে দাঁড়াবার বলটুকু তার থাকে না, উঠতে গেলে সে পড়ে যায় চৌকাঠেই। তার মাথা পড়ে থাকে মাচার অন্য প্রান্তের খুঁটির সঙ্গে ঠেকানো এবং পা ঠেকে চৌকাঠে। ঘুম থেকে উঠে আসা তমিজ তন্দ্রা জড়ানো গলায় অক্ষেপ করে, বুড়া হয়া মরবার ধরিছে, জিভার লালচ এখনো গেলো না। এখন আত হচ্ছে কতো, আরো কতবার যে ওঠা লাগবি আল্লাই মালুম। তার উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ কথা তমিজের বাপের কানে নিশ্চয়ই ঢোকে; কিন্তু মশার ভনভনানি, ঝিঝির ডাক, বাঁশঝাড়ের অবিরাম শনশন আওয়াজ, ডোবার পানিতে ঘুমিয়ে-থাকা খলসে পুটি বেলে মাছের চমকে ওঠায় পানির উত্তেজনা এবং তমিজের ঘুমে-জড়ানো জিভের কথার সঙ্গতে তার কানে বাজতে থাকে এলোমেলো ছন্দের একটানা সুর,
পাষাণে হৃদয় বান্ধো কান্দো গিরিগণে কান্দো
ভাঙা ডিমে হলুদবরণ হইল সকল ঠাঁই।
বিবিবেটা নিন্দে মগন ফকির ঘরত নাই।
হায়রে ভবানী পাঠক ভবে নাই।।