অমল ছিল গান-পাগল। ওইখানেই বনানীর জিত, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় সে নিশ্চয়ই সুপ্রিয়ার কাছে হেরে যাবে। কিন্তু অমল যখন মুগ্ধ হয়ে বনানীর গান শুনত, তখন হিংসেয় জ্বলে যেত সুপ্রিয়ার বুক। যদিও সে নিজেই জানত, এ-রকম হিংসে করা খুব খারাপ, ছোটোমনের পরিচয়। কিন্তু উপায় কী, তার হিংসে হলে সে, আটকাবে কী করে? হিংসে তো ভালোবাসারই মতন, কখন কী করে আসে বোঝা যায় না।
বনানীর গান শোনার জন্য অমল ঘন ঘন তার বাড়ি যাওয়া-আসা শুরু করতেই একদিন সুপ্রিয়া রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে গেল।
সেদিন অমল তাকে দুপুর সাড়ে তিনটের সময় তার বাড়িতে আসতে বলেছিল। ঠিক সময় পৌঁছে শুনল, অমল বাড়ি নেই। বাড়ির বুড়ো চাকরটি সদর দরজার সামনেই বসেছিল। সে বলল, দাদাবাবু পাশের বাড়িতে গেছেন। আপনি একটু বসুন দিদিমণি। দাদাবাবু আপনাকে বসতে বলে গেছেন।
অমলের মা তখন ঘুমোচ্ছেন, তাঁকে জাগাল না সুপ্রিয়া। সে একা অমলের ঘরে বসে রইল। পাশের বাড়ি থেকে বনানীর গান ভেসে আসছে। খুব ঢিমে লয়ে তান বিস্তার রেওয়াজ করছে। অমল বসে আছে ওখানে। শুধু অমল আর বনানী? না, তবলার আওয়াজ শোনা
যাচ্ছে যখন, তখন একজন তবলচিও আছে। তবু সুপ্রিয়ার বুকটা পুড়ে যেতে লাগল। অমলের সময়ের হুঁশও নেই? তাকে আসতে বলে সে এখন বনানীর কাছে বসে আছে? সুপ্রিয়ার চেয়েও গান তার কাছে বড়! ওর থেকে অনেক ভালো গান তো রেকর্ড বাজিয়ে শোনা যায়।
এক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর, রাগের বদলে সুপ্রিয়ার বুক থেকে একটা দুঃখের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। তার মনে হল, অমল তাকে বিয়ে করে কোনোদিন সুখী হবে না, কারণ সে গান গাইতে পারে না। এমনকী বিয়ের পরেও যদি অমল বনানীকে তাদের বাড়িতে গান গাইবার জন্য নিয়ে আসে? সুপ্রিয়া তা সহ্য করতে পারবে না কিছুতেই। তার চেয়ে থাক অমল বনানীকে নিয়েই। অমলকে জব্দ করার জন্যই যেন সুপ্রিয়া তক্ষুনি দুম করে বিয়ে করে ফেলল। হাতের কাছেই সুযোগ্য পাত্র ছিল দীপংকর। বাবা-মায়ের সামান্য ইঙ্গিতেই সুপ্রিয়া তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল।
এমনই নিষ্ঠুর অমল যে সুপ্রিয়ার বিয়ের কথা শুনেও সে একটিবার আসেনি তার কাছে। একটিবারও অনুনয় করেনি সুপ্রিয়াকে। সে যেন ধরেই নিয়েছিল, সুপ্রিয়া সম্পূর্ণ তার নিজস্ব। সুপ্রিয়ার আলাদাভাবে ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো দামই নেই। সুপ্রিয়া বিদ্রোহ করতেই সে যেন একবারে তাচ্ছিল্য করল ব্যাপারটাকে। হয়তো সে ভেবেছিল, বিয়ের আসর থেকেও শেষমুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পেরে, সুপ্রিয়া দৌড়ে চলে আসবে তার কাছে। সেই অহংকার নিয়ে অমল দূরেই রয়ে গেল।
দীপংকর অবশ্য স্বামী হিসেবে খুবই ভালো। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। সে নিরাপত্তা বোধ জাগিয়ে রাখতে পারে সবসময়। এক-একজন মানুষ থাকে এ-রকম, যাদের কাছাকাছি এলেই মনে হয়, এরা কখনো অন্য কারুকে কিছুতেই কোনো বিপদে পড়তে দেবে না। দীপংকরের স্নেহ, দয়া, মায়া সবই ঠিক ঠিক আছে। অবশ্য এরমধ্যে ভালোবাসার কোনো প্রশ্নই নেই। দীপংকর ভালোবাসতে জানে না। যারা ভালোবাসতে জানে না, তারাই মুখে সবসময় বলে, আমি তোমায় ভালোবাসি, আমি তোমায় ভালোবাসি! সুপ্রিয়া একবার নিজে ভালোবেসেছে বলেই জানে, ভালোবাসা কাকে বলে? দীপংকরের কাছ থেকে সেই জিনিস সে কখনো পাবে না। যাক তাতে তো কোনো ক্ষতি নেই। বিবাহিত জীবনে ভালোবাসা এমনিতেই আস্তে আস্তে মরে যায়। বিয়ের সাত বছর বাদে সুপ্রিয়া বুঝতে পেরেছে, অন্য অনেকের জীবনেও দেখেছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে-বন্ধনে সংসারটা টিকে থাকে, তার নাম ভালোবাসা নয়। সেটা এক ধরনের বোঝাপড়া।
বিয়ের দু-বছর বাদে একটা নেমন্তন্নবাড়িতে হঠাৎ অমলের সঙ্গে দেখা। দোতলার একটা ছোটো ছাদে দাঁড়িয়েছিল অমল, তাকে একপলক দেখেই সুপ্রিয়া যেন পাথর হয়ে গেল। বুকের মধ্যে এমন ঢিপ ঢিপ শব্দ হতে লাগল, যেন পাশের লোকও শুনতে পেয়ে যাবে। সুপ্রিয়া চট করে সরে গেল।
মেয়েদের কতরকম অভিনয় করতে হয়। সুপ্রিয়াকে হাসি মাখিয়ে রাখতে হল মুখে, চেনাশুনো কতরকম লোকের সঙ্গে কতরকম কথা বলতে হল, এদিকে তার ভেতরে ভেতরে একটা ঝড় বইছে, শরীরটা কাঁপছে একটু একটু। এত ভালোবাসাও ছিল বুকের মধ্যে। সুপ্রিয়া তো ভেবেছিল, সে অমলকে একেবারে ভুলে যেতে পারবে। আর কোনোদিন সে অমলের কথা চিন্তাও করবে না। এই দু-বছরে, তো সে অমলের কোনো খবর নেওয়ার চেষ্টাও করেনি। আজ একবারমাত্র চোখের দেখায় সব বাঁধ ভেসে গেল!
তারপর যতবারই সুপ্রিয়া সেই ছাদের দিকে এসেছে, ততবারই দেখেছে, অমল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সেই একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সে স্বভাব-গম্ভীর, তাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেউ কিছু ভাববে না। অমলের চোখে চোখ পড়ল সুপ্রিয়ার, অমল একদৃষ্টিতে তাকেই দেখছে, কিন্তু আর কোনো উত্তেজনার চিহ্ন নেই। সুপ্রিয়াকে দেখে সে খুশি হয়েছে, না রেগে গেছে, তাও বোঝা যায় না।
সেদিন সুপ্রিয়া বুঝেছিল, সে কত দুর্বল। অমলকে দেখামাত্র সে সব পুরোনো রাগ ভুলে গেছে। অমলের মতন কঠিন সে থাকতে পারে না। অমলের ভেতরে চুম্বকটা তাকে সাংঘাতিকভাবে এখনও টানছে।
সেদিন অমলের সঙ্গে তার একটাও কথা হল না। অমলের সঙ্গে কথা বলতে তার ভয় করছিল। তা ছাড়া আর একটা ভয় ছিল, যদি দীপংকরের সঙ্গে অমলের আলাপ হয়ে যায়। না, না, তার দরকার নেই। দীপংকর যেন কোনো কারণেই অমলকে না লক্ষ করে।
তারপর থেকে মাঝে মাঝেই সুপ্রিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়। বড্ড বেশি মনে পড়ে অমলের কথা। কিন্তু সে তো আর নিজে থেকে দেখা করতে পারবে না অমলের সঙ্গে। অমল তো কিছু বলেনি!
বিয়ের পর, সন্তান হওয়ার আগে পর্যন্ত সুপ্রিয়া প্রায়ই দুপুরের দিকে বাপের বাড়ি চলে আসত। নতুন বাড়িতে একা একা দুপুর বেলা কিছুতেই ভালো লাগে না। দুপুর বেলা সে নিজে নিজে বাপের বাড়িতে চলে আসে, সন্ধ্যে বেলা দীপংকর এসে তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। কখনো-কখনো দীপংকরের অফিসে বেশি কাজের চাপ থাকলে সুপ্রিয়া একাই ফেরে।
সে-বছর প্রথম শীত পড়তে শুরু করেছে, রোদুরটাকে ভালো লাগছে আস্তে আস্তে, সেই সময়ে এক দুপুরে বাপের বাড়ির কাছাকাছি রাস্তায় ট্রাম থেকে নেমেই সুপ্রিয়া দেখল অমলকে। তার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখেই মনে হয় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হওয়ার পরও সুপ্রিয়া বুঝতে পারল না সে নিজে থেকে কথা বলবে কিনা।
অমল এগিয়ে এসে বলল, আমি চার-পাঁচদিন ধরে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকছি—
সুপ্রিয়া মুখ নীচু করে বলল, কেন?
অমল সে-প্রশ্নের উত্তর দিল না। আপনমনেই বলে চলল, তুমি এখন কোথায় থাক, আমি সে-বাড়ি চিনি না। কিন্তু জানতাম, তুমি বাপের বাড়িতে মাঝে মাঝে আসবেই। পরশুদিনও তোমাকে দেখেছি, কিন্তু কথা বলতে সাহস করিনি।
সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, অমলদা, তুমি ভালো আছ?
না।
সুপ্রিয়া এদিক-ওদিক তাকাল। অমলের সঙ্গে এখানে দাঁড়িয়ে তাকে কথা বলতে দেখলে কেউ কি কিছু মনে করবে? একপাড়ারই ছেলে-মেয়ে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু-মিনিট কথা বললে কী আর এমন দোষ?
অমল বলল, আমার ভয় হচ্ছিল, তুমি রাগ করে আছ, আমি কথা বললেও কি তুমি–
অমলের কথা এবং ব্যবহার দুটোই খুব নতুন লাগল সুপ্রিয়ার কাছে। অমল তো এ-রকম বিনীতভাবে কক্ষনো কথা বলে না। সে ভয় পাচ্ছিল? অমলও তাহলে ভয় পায়? অমল সুপ্রিয়ার জন্য চার-পাঁচদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে—এও তো আগে ভাবাই যেত না। সেই অহংকারী অমল।
অমল বলল, চলো—
সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
আমার সঙ্গে।
সুপ্রিয়া কেঁপে উঠে বলল, না না, না, আমি এখন কী করে যাব?
অমল কাতরভাবে অনুনয় করে বলল, সুপ্রিয়া, তোমাকে আমার ভীষণ দরকার। প্লিজ চলো, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে–
না অমলদা, আজ নয়, মাকে বলে এসেছি—
কিছু হবে না, তুমি এক ঘণ্টা বাদে ফিরে আসবে।
সুপ্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ল। আর আপত্তি করতে পারল না। এক ঘণ্টার মধ্যে ফিরে এলে এমন কী আর ক্ষতি হবে।
একটু এগিয়ে গিয়ে অমল ট্যাক্সি ধরল। ট্যাক্সিতে উঠে সে সুপ্রিয়ার নতুন চুড়ি-গয়না পরা একটা হাত তুলে নিল নিজের মুঠোয়। একটাও কথা বলল না। সুপ্রিয়াও কিছু বলতে পারল না। বুকের মধ্যে যখন অনেক কথা জমে থাকে আজ প্রথম কোন কথাটা বলবে, সেটাই মনে আসে না।
ট্যাক্সি এল অমলের বাড়ির সামনে। দুপুর বেলার সেই নির্জন, শব্দহীন বাড়ি। অমলের মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ। তিনতলার সেই চেনা ঘর।
ঘরে ঢুকেও একটাও কথা বলল না অমল। আগে যা কখনো সে করেনি, সেদিন তাই করল। দস্যুর মতন ঝাঁপিয়ে পড়ল সুপ্রিয়ার শরীরে। আগে সে যখন সুপ্রিয়াকে আদর করত, তখন কত নরম, কত শান্ত ছিল তার হাত। এখন সে এক মিনিটও অপেক্ষা করতে পারছে না।
সুপ্রিয়া প্রথমে একটু আপত্তি করার চেষ্টা করেছিল। কোথায় তা ভেসে গেল। বোধ হয়। তার মধ্যেও এই ব্যাকুলতা সুপ্ত ছিল। অমলের স্পর্শে তার যে-আনন্দ, এ-রকম আনন্দ সে আর কখনো পায় না। অমল তাকে সম্পূর্ণ করে নিয়ে নেয়।
একটু বাদে। লজ্জাকর মুখে সুপ্রিয়া আবার বেশবাস সংযত করে নিল।
অমল বলল, সুপ্রিয়া, তোমাকে ছেড়ে আমি কী করে থাকব? কেন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে?
সুপ্রিয়া বলল, কেন তুমি আমাকে যেতে দিলে?
অমল চুপ করে গেল।
সারাবাড়িটা বড়ো বেশি নিস্তব্ধ! এমনকী রাস্তাঘাটেও কোনো আওয়াজ নেই। তখন সুপ্রিয়ার খেয়াল হল। পাশের বাড়িতে বনানীর গানও তো শোনা যাচ্ছে না!
সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করল, বনানী কোথায়?
অমল নিষ্ঠুরের মতন বলল, বনানী মরে গেছে।
কী?
কাগজে পড়নি? থিয়েটার রোডের মুখে মিনিবাস চাপা দেয়। এই তো মাস ছয়েক আগে। হাসপাতালে পৌঁছোবার আগেই।
সুপ্রিয়া হুহু করে কেঁদে ফেলল। বনানীর জন্যই। বনানীকে সে তার নিজের জায়গাটাই ছেড়ে দিয়েছিল। বনানী তা-ও নিতে পারল না। এত ভাগ্যহীনা মেয়েটা–!
বনানীর জন্যই সুপ্রিয়া অমলকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। বনানী আর নেই। তবে কেন সুপ্রিয়া বিয়ে করল দীপংকরকে? এখন সমস্ত জীবনটাই তাহলে তার ব্যর্থ হয়ে যায় না? আর তো ফেরারও কোনো পথ নেই।
অমল কথা না বলে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সুপ্রিয়ার দিকে। যেমন সে একটা উত্তর চাইছে। কিন্তু সুপ্রিয়া কী উত্তর দেবে?
অমল হাতের তালু দিয়ে সুপ্রিয়ার চোখের জল মুছিয়ে দিল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, আমি তোমাকে চাই, আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না।
কিন্তু আর যে উপায় নেই?
নিশ্চয়ই উপায় আছে।
সুপ্রিয়া ভেবেছিল অমল ডিভোর্সের কথা বলবে। যদিও সেটা একটা অসম্ভব কথা। কী যুক্তি দেখাবে ডিভোর্সের? দীপংকর কি কোনোদিন তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে? দীপংকর চমৎকার লোক। সুপ্রিয়ার কোনো অধিকার নেই তাকে অপমান করার।
অমল কিন্তু ডিভোর্সের কথা বলল না। সে বলল, তুমি যারই বউ হও, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তুমি আমার, তুমি আমারই থাকবে।
কিন্তু শুধু মনে মনে থাকা নয়। অমল চায়, সুপ্রিয়া মাঝে মাঝে আসবে তার কাছে।
অমলের পীড়াপীড়িতে সুপ্রিয়া রাজি হয়ে গিয়েছিল। মাসে অন্তত একবার।
সে-দিনই অমলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একা একা রাস্তা দিয়ে আসবার সময় সুপ্রিয়ার মনে হয়েছিল, এটা ভুল। এ-রকম হতে পারে না। নিজেকে তার কলঙ্কিনীর মতন মনে হয়। মনের মধ্যে একটা সৎ আর অসতের দ্বন্দ্ব থাকেই। আগে থেকে নির্দিষ্ট ধারণা সহজে বদলানো যায় না। সকলে জানে, দীপংকরকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে সুপ্রিয়া, এরপর তাকে ঠকিয়ে অন্য একজনের সঙ্গে গোপন জীবন কাটানো কি পাপ নয়? পৃথিবীতে একজন নারী শুধু একজন পুরুষের, সভ্যসমাজ এইরকম নিয়ম করেছে। কিন্তু এর সঙ্গে যদি ভালোবাসা না মেলে? না মিললেও নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাহস সুপ্রিয়ার নেই; সবচেয়ে বড়োকথা, লোকে যদি জেনে ফেলে? একদিন-না-একদিন জানাজানি হবেই! তখন, সুপ্রিয়ার মা-বাবা, আত্মীয়রা কী ভাববে? দীপংকর কত দুঃখ পাবে? না, না সুপ্রিয়া পারবে না। সে আর আসবে না অমলের কাছে। সুপ্রিয়া ভালোবাসতে চায়, কিন্তু বদনাম নিতে পারবে না কিছুতেই।
তবু ঠিক এক মাস বাদে সুপ্রিয়া এসেছিল অমলের কাছে। সেবারও একইরকমভাবে অমল হিংস্র আদর করেছিল তাকে। যেমন অমল একটা বুভুক্ষু।
সেদিনও অমলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুপ্রিয়ার দ্বিগুণ মন খারাপ হয়েছিল। আগের কথাগুলিই আবার মনে হয়েছিল। এবার সুপ্রিয়া প্রতিজ্ঞা করেছিল, আর না, আর না, আর কিছুতেই সে আসবে না। অমল যতই বলুক, সে শুনবে না। সুপ্রিয়া যদি নিজেকে সামলাতে না পারে, যদি আবার কখনো আসে, তাহলে তারপর সে ঠিক আত্মহত্যা করবে।
তারপর আর আসেনি সুপ্রিয়া।
বুলান জন্মাবার পর সুপ্রিয়া নিজেকে আরও দৃঢ় করতে পেরেছে। এখন তো সে আর শুধু প্রেমিকা নয়, এখন সে মা। এখন তার দায়িত্ব অনেক বেশি।
অমলের বাড়িতে আর কখনো না এলেও অমলের সঙ্গে দেখা হয়েছে সুপ্রিয়ার। ব্যবস্থা করে নিজেরাই দেখা করেছে। এটুকু সুপ্রিয়া এড়াতে পারেনি। নিজের মনকে বুঝিয়েছে, শুধু দেখা করায় কী দোষ থাকতে পারে? বিয়ে মানেই তো আর সর্বস্ব বিকিয়ে দেওয়া নয়। অন্য একজনকে ভালো লাগতে পারে না? তার সঙ্গে একটু মেলামেশা, একটু গল্প করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়।
সুপ্রিয়া অমলের বাড়িতে আর আসবে না বলে প্রথম প্রথম অমল খুব রাগ করেছিল। কিছুদিন আর যোগাযোগ রাখেনি। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর দূরে থাকতে পারেনি। আবার তাকেই আসতে হয়েছে সুপ্রিয়ার কাছে।
দীপংকর যখন প্রথমবার বিলেতে যায়, তখন অমল দেখা করার জন্য সুপ্রিয়াকে খুব পীড়াপীড়ি করত। সুপ্রিয়া আস্তে আস্তে নরম হয়ে পড়েছে। অবশ্য অমলকে সে কোনোদিন নিজের ফ্ল্যাটে আনেনি। অমলের অস্তিত্বই জানে না দীপংকর। কোনোদিন যেন জানতে না পারে।
এতগুলি বছর কেটে গেল, তবু অমল বিয়ে করল না। সুপ্রিয়া নিজেই কতবার বলেছে। অমল কিছুতেই রাজি হয় না। ওই প্রসঙ্গ তুললেই অমল মুখ গোঁজ করে বলেছে, আমার মেয়েদের ভালো লাগে না।
সুপ্রিয়া বলেছে, বাঃ, আমিও তো মেয়ে!
অমল বলেছে, না তুমি মেয়ে নও! তুমি সুপ্রিয়া।
একথাটা শুনলে সুপ্রিয়ার শরীরে একটা ভালো লাগার আচ্ছন্নতা আসে। আবার একটু একটু অপরাধবোধও জাগে। সুপ্রিয়ার স্বামী-সংসার রয়েছে, অমলের কিছুই থাকবে না? নারীর সাহচর্য ছাড়া পুরুষমানুষ বাঁচতে পারে? অমল এত গোঁয়ার কেন, কেন সে অন্য মেয়েদের সঙ্গে মিশতে চায় না? সুপ্রিয়াকেই কিছু সাহচর্য দিতে হয় সেই জন্য। তবে খুব সাবধানে, নিজের শরীর বাঁচিয়ে।
সুপ্রিয়া তাই দেখা করত বাইরে। খুব লুকিয়ে-চুরিয়ে। কোথাও তো গোপন জায়গা নেই। অমলের তো কোনো দায়িত্ব নেই। সে যেকোনো জায়গায় দেখা করতে রাজি সুপ্রিয়ার সঙ্গে। কিন্তু সুপ্রিয়া তো সব জায়গায় আসতে পারে না। অমল কোনো হোটেলে ঘর নেওয়ার কথা বলেছে, সুপ্রিয়া রাজি হয়নি। অমল সিনেমার টিকিট কেটেছে, সুপ্রিয়া যায়নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ কথা বলা যায়। কিন্তু তাতে আশ মেটে না। আর ক-দিনই বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলা যায়? একদিন তো সেজদার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিল প্রায়। সবসময় এ-রকম ভয়ে ভয়ে কি দেখা করা যায়? শেষপর্যন্ত অমল একটা নিরাপদ জায়গার কথা বলেছিল।
অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর সুপ্রিয়া একা একা এসেছিল গঙ্গার ঘাটে। অমল দাঁড়িয়ে ছিল আউটরাম জেটির পাশে। আগে থেকেই একটা নৌকো ভাড়া করে রেখেছিল। টপ করে উঠে পড়ল দু-জনে। তারপর নৌকো গঙ্গায় ভেসে পড়তেই আর কারুর দেখে ফেলার ভয় ছিল না।
সেই দিনটার কথা সুপ্রিয়া কখনো ভুলবে না। ভাবলেই এখন শিহরন হয় শরীরে। চমৎকার জ্যোৎস্নার রাত ছিল সেদিন! মিগ্ধ হাওয়া ছিল। অমলকে অত কাছাকাছি নিশ্চিন্তভাবে যে কোনোদিন আর পাবে, সেকথা ভাবেনি সুপ্রিয়া। দু-টি দুঃখী হৃদয়ের কত কথা।
অমলের খুব ইচ্ছে ছিল সুপ্রিয়ার সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করার। কিন্তু মাঝিরা দেখে ফেলবে যে। যতবার অমল বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে, ততবারই সুপ্রিয়া বলেছে, না, লক্ষ্মীটি, ওসব না!
অমল তখন চেয়েছে সুপ্রিয়ার কোলে মাথা দিয়ে শুতে। এই দাবিটা সে কিছুতেই ছাড়বে। যেন শিশুর মতন আবদার। সুপ্রিয়া কিছুতেই আটকাতে পারেনি। তার কোলে মাথা রেখে অমল শুয়ে পড়েছিল পা ছড়িয়ে, সুপ্রিয়া বিলি কেটে দিচ্ছিল তার চুলে।
মনের মধ্যে সেই পুরোনো অপরাধবোেধটা তখন কাজ করে। সুপ্রিয়া নিজেকে প্রশ্ন করে, এটাও কি অন্যায়? এই যে-অমল তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, এক হাতে জড়িয়ে আছে কোমর, সুপ্রিয়াও যে একটু-একটু আদর করছে মাঝে মাঝে, সেটা পাপ?
সুপ্রিয়া নিজেই এর উত্তর তৈরি করে নেয়। মনকে বোঝায়, না, এটা পাপ নয়! সতীত্বের সংজ্ঞা কি চিরকাল একই থাকবে? না তা হতেই পারে না! সুপ্রিয়া তো নিজেকে অনেক সংযত করেছে। অমলের বাড়িতে যাওয়া সে নিজেই বন্ধ করেনি? অমল যদি আর কোনো মেয়ের সঙ্গে না মেশে, যদি আর কারুর কোলে মাথা রেখে না শোয়, তাহলে সুপ্রিয়া তাকে এইটুকু দিতে পারবে না?
কষ্ট কি সুপ্রিয়ারও কম? তারও কি ইচ্ছে করে না, অমলের কাছ থেকে আরও বেশি আদর পেতে? অমলকে আরও বেশি আদর করতে? সে-কথা সে অমলকে জানতে দেয় না। আজ অনেকদিন বাদে শুধু এই একটুখানি—এখানে কেউ দেখছে না, এখানে সমাজের ভ্রূকুটি নেই–
মাঝ গঙ্গাতেও বখাটে ছেলেদের হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই। আর দু-একখানা নৌকো থেকে মাঝে মাঝে ছেলেদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। অমল সুপ্রিয়ার হাত ধরে বলেছিল, ওদিকে কান দিয়ো না। মনে করো, এখন পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আমি তো শুধু দেখতে পাচ্ছি আকাশটাকে আর তোমাকে।
সুপ্রিয়া দুঃখিতভাবে বলল, ওরা কেন যে এখানেও আসে!
অমল বলল, ওদিকে তাকিয়ো না। ওরা একটু বাদেই দূরে চলে যাবে।
যদি আমাদের কেউ দেখে ফেলে?
এখানে কে দেখবে? তোমার এখনও ভয়! এখানে এই অন্ধকারের মধ্যে আমাদের দেখলেই বা চিনবে কে? একটা নৌকো খুব কাছাকাছি এসে পড়েছিল। তার মধ্যে থেকে কর্কশ গলায় একটি ছেলে একটি অসভ্য গান গাইছিল আর মাঝে মাঝে হাসির ধুম পড়ে যাচ্ছিল। নিশ্চয়ই সেটা সুপ্রিয়া আর অমলকে উদ্দেশ্য করেই।
একবার সেই নৌকো থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, দাদা, আপনার কাছে দেশলাই আছে?
সুপ্রিয়া অমলকে বলল, এই, তুমি উঠে বোসো।
অমল দৃঢ়স্বরে বলল, না।
সুপ্রিয়ার দারুণ লজ্জা করছে। সে অমলের মাথাটা ধরে তবু বলতে লাগল, ওঠো, এবার ওঠো, লক্ষ্মীটি।