পঞ্চম পরিচ্ছেদ
অভয়পদ ভাল হয়ে উঠে ঠিকানা সংগ্রহ করার আগেই কান্তির কাছ থেকে একটা চিঠি এল। সম্ভবত রতনদের দিক থেকে কোন রকম তাড়া দেবারই ফল এটা। সামান্য চিঠি, তবে তারই হাতের লেখা বটে।
গোনা দুটি ছত্র লিখেছে সে, ‘আমি ভালই আছি, আমার জন্য চিন্তা করিবেন না।
চিঠির সঙ্গে ঠিকানাও আছে। আরামবাগ এলাকারই ছোট গ্রাম একটা। তারকেশ্বর লাইনের এক স্টেশন থেকে নেমে গোরুর গাড়ি করে যেতে হয়– বেশ খানিকটা পথ।’
ঠিকানা পাওয়ার আগে যতটা ব্যাকুলতা ছিল– পাওয়ার পর আর ততটা রইল না। এখন যেন সে অনেকটা ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে এসে গেছে– ইচ্ছে করলেই আনিয়ে নেওয়া যায়। সুতরাং এখন আর তেমন দুশ্চিন্তা নেই।
কনক অবশ্য বলল, ‘আপনি লিখেই দিন না আসতে। যা হবার এখানে এলে হবে। পড়াশুনো করতে চায়, এখানেও তো ইস্কুল আছে।’
শ্যামাও ভেবেছেন অনেক। তিনি বললেন, ‘তা তো আছে কিন্তু সেখানে একগাদা খরচ-পত্তর করে ভর্তি হয়েছে নিশ্চয়, বইও কিনে দিয়েছে ওরা সব। এখানে এলে সে সমস্তই বরবাদ হবে। সেখানকার এক রকম বই, এখানে হয়ত অন্য রকম। একটা বছর নষ্ট হল, আবারও একটা বছর নষ্ট করব? খানিকটা পড়তে পড়তে চলে আসবে আধাখ্যাঁচড়া হয়ে– এখানে এসে যদি এখানের পড়া ধরতে না পারে? খরচও তো হবে একগাদা। ইস্কুলের মাইনে আছে, বই কেনা আছে। অত পেরে উঠব কেন? থাক্ কাদায় গুণ ফেলে এই ক’টা মাস, যা হয় হবে!’
তবু কনক একবার বলতে গেল, ‘কিন্তু পাসের পড়া তো সব ইস্কুলেই এক রকম হয় শুনেছি মা!’
শ্যামা বললেন, ‘না না। আমি হেমকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, সে বললে, মোটামুটি পড়াটা এক– কিন্তু বই আছে অনেক রকম। এক এক ইস্কুলে নাকি এক এক বই পড়ায়। যে ইস্কুলে ভর্তি হবে, সেই ইস্কুলের মতো বইও নাকি চাই। নইলে নাকি খুব মুস্কিল হয়ে পড়ে, রোজের পড়াটা পড়তে পারে না।’
প্রসঙ্গটা ঐখানেই চাপা পড়ে যায়।….
কনকের– কে জানে কেন– খুব ভাল লাগে না এদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু কিছু বলতেও পারে না সে। শাশুড়ীর কাছে জোর করে বা জেদ করে কিছু বলার সাহস তার নেই। বলতে পারত হয়ত হেমের কাছে– কিন্তু সেখানেও একটা বাধা দেখা দিয়েছে! বেশি বললে হেম মনে করতে পারে যে তার ভাইয়ের কল্যাণ-চিন্তার চেয়ে কনকের স্বার্থ-চিন্তাটাই বড় কথা এর মধ্যে। তার কারণ খুব সম্প্রতি, মাত্র দুদিন আগেই কথাটা উঠেছিল। হেমের বদলির কথা।
হেম বলেছিল, ‘এদিকে দ্যাখো না মজাটা। অন্য সময় কোন আর্জি জানালে ওপর- ওলাদের কাছে, কত অসুবিধে হয়–এখন বলতে না বলতেই তো মঞ্জুর হয়ে যাচ্ছে দেখছি। জামালপুরে নাকি লোক দরকার– কেউ নাকি যেতে রাজি হচ্ছে না। আমি বলতেই বড়বাবু লাফিয়ে উঠলেন একেবারে। বললেন– এক্ষুনি, এক্ষুনি। বল তো নতুন কোয়ার্টার ভাল দেখে দিয়ে দিচ্ছি ব্যবস্থা করে!’
‘তারপর?’ রুদ্ধনিঃশ্বাসে প্রশ্ন করে কনক।
‘মুশকিল হয়ে গেছে যে। আমি এখন যাই কী ক’রে? কথাটা তুমি সেদিন ঠিকই তুলেছিলে। তখন অত ভাবি নি। কিন্তু এখন যত ভাবছি ততই দেখছি যে ঐ জন্যেই শেষ পর্যন্ত যাওয়া আটকাবে আমার। বাড়িতে কে থাকবে। খেঁদির ওপর তো কোন ভরসাই নেই। খোকাকে ওখান থেকে ইস্কুল ছাড়িয়ে আনতে গেলে সেখানের সব বই নষ্ট হবে, এখানে আবার নতুন করে কিনতে হবে। বছরের গোড়াতে হ’লে তবু এর-ওর কাছে চেয়ে- চিন্তে পাওয়া যায়– অন্তত কতকগুলো তো পাওয়া যায়ই– এখন আর কে দেবে? মা শুনলেই ক্ষেপে যাবে। তবু তো মা মনে করে সেখানের সব খরচাই মেসোমশাই দেন, মা তো অত জানে না যে আমিও কিছু কিছু দিই।…. সেও না হয় হল–কিন্তু অঘ্রাণ মাস না এলে কিছুই করা যাচ্ছে না দেখছি। একটা ক্লাসে উঠলে ছাড়িয়ে আনা অনেকটা সহজ হয়ে পড়ে। সেখানে ছোট মাসিরও অবশ্য খুব কষ্ট হবে, হাত-নুড়কুৎ হয়ে উঠেছিল তো খানিকটা!’
সেই সময়েই কনক বলেছিল কথাটা। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি কি একেবারে না বলে দিয়েছ?’
‘বলি নি এখনও, কিন্তু বলতেই তো হবে। উপায় কি বলো?’
‘দুটো একটা দিন দ্যাখো না। ঠিকানাটা আসুক– যদি মেজ ঠাকুরপোকে এখানে আনানোই হয় তো–। তোমার অত ইচ্ছে বলেই বলছি।’
তাড়াতাড়ি যোগ করে সে শেষের কথাগুলো।
‘হ্যাঁ–তাহ’লে তবু হয় বটে একটা উপায়। তবে তারও তো পাসের পড়া। তার ঘাড়ে সব ফেলে দিয়ে চলে যাওয়া-। সেও ভাবছি। দেখি। ওর খবর তো আসুক আগে।’
এই কথার পর কনকের তরফ থেকে তাকে আনানোর জন্য পীড়াপীড়ি করলে একটা কদর্থ হওয়া স্বাভাবিক।
কী মনে করবে হেম। বড় বেশি লোভী আর স্বার্থপর ভাববে হয়ত। ছিঃ। সে ভাল নয়।
ওদের ছেলে– ভাল-মন্দ ওরা না বোঝে, তারই বা এত দায় কি!
তার বাইরে গিয়ে সংসার পাতার প্রশ্ন? সে না হয় আর কিছুদিন পরেই হবে। এত দিন যখন এখানে থাকতে পেরেছে, আরও কটা মাস অনায়াসে পারবে। তার সে-জন্যে অত তাড়াও নেই! স্বামীকে যদি পায় সে– সব কষ্টই সহ্য হবে তার। আর হেম তো বলেইছে, অঘ্রাণ মাসে খোকাকে আনানো যেতে পারে, সেই সময়ই বরং সুযোগ বুঝে কথাটা মনে করিয়ে দেবে একবার!
কিন্তু অঘ্রাণ মাসে আর কথাটা পাড়া যায় না।
অনির্দিষ্টকালের জন্যে চাপা পড়ে যায় কথাটা তার আগেই।
আশ্বিন মাসের গোড়াতেই ঐন্দ্রিলা চলে গেল।
তার চলে যাওয়া কিছু এমন অভিনব নয়, ওটা আজকাল বরং নিয়মিত হয়ে উঠেছে; দু-তিন মাস ওখানে– দু-তিন মাস এখানে, এই ভাবেই চলে। তাই এবারও, যাওয়ার সময় কিছুই বুঝতে পারেন নি শ্যামা। কোন সন্দেহও হয় নি তাঁর। বরং এখন দুটো-তিনটে মাস অন্তত কলহ-কচকচির হাত থেকে অব্যাহতি পাবেন–এই ভেবে মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন।
খুব একটা কিছু নতুন রকমের অপ্রীতিকর ব্যাপারও ঘটে নি।
যেমন হয়– ঝগড়াটা একদিন চরমে উঠলে মেয়ের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে আর গালাগাল দিতে দিতে বেরিয়ে যায়– তেমনি গেছে। শুধু এবার একেবারে ভোর থেকেই আরম্ভ করেছিল বলে এক সময় হেম তেড়ে এসেছিল, চুপ করবি, না কি? এবার একদিন বুকে বসে সাঁড়াশি দিয়ে জিভ্ ছিঁড়ে বার করব– চিৎকার করা জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেব!’
এই! তারপরই তো সে অফিসে বেরিয়ে গেছে। ঐন্দ্রিলা চালিয়েছে দুপুর পর্যন্ত। আর হেমের তেড়ে আসাও একেবারে নতুন নয়। এর আগেও– তার সামনে খুব বাড়া-বাড়ি হলে– এমন তেড়ে এসেছে, গাল-মন্দও দিয়েছে।
সুতরাং অকস্মাৎ এ কাণ্ডর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না শ্যামা আদৌ।
খবরটা পাওয়া গেল কদিন পরেই– ঠিক পূজোর মুখটাতে।
সেদিন বোধ হয় পঞ্চমী কি ষষ্ঠী I
খবর আনল– চিরকাল যে ভগ্নদূতের কাজ করছে– সেই মহাশ্বেতাই
দূর থেকে তার আসার ভঙ্গি দেখেই কনকের বুক কেঁপে উঠেছিল। ও রকম ছুটতে ছুটতে, মহাশ্বেতার নিজের ভাষায় ‘রুদ্ধ শ্বাসে’, আসা মানেই কোন নিদারুণ সংবাদ। সুসংবাদ আর তাদের কী আসবে– নিশ্চয়ই দুঃসংবাদ।
আর সেই আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হল।
সেদিন গোটা বাগান ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে বেলা তিনটের সময় সবে খেতে বসেছেন শ্যামা– মহাশ্বেতা এসে সামনে বসে পড়েই বলল, ‘শুনেছ, তোমার মেজ মেয়ের কীত্তি!’
কনক ভেবেছিল চোখ টিপে দেবে, সারা দিনের পর খেতে বসেছেন বেচারি, কোন দুঃসংবাদ হয় তো দু মিনিট পরে বলাই ভাল– কিন্তু সে সুযোগই পেল না সে। মহাশ্বেতা কোন দিকেই চাইল না। মা এত বেলায় কেন খেতে বসেছেন সে প্রশ্নও করল না। যখন কোন বড় খবর তার মাথার মধ্যে থাকে– তখন আর কোন কিছুই মাথায় ঢোকে না। সে নিজে থেকে অবস্থা বুঝে বিবেচনা করবে– খেয়ে নিতে সময় দেবে সে আশা বৃথা।
শ্যামার উদ্যত আহার্যের গ্রাস মুখের কাছ থেকে নেমে আসে আবার। তাঁরও বুকটা ধ্বক করে ওঠে। দুঃসংবাদ আর অমঙ্গল– এইতেই তো অভ্যস্ত তিনি। তবু এখনও একবার বুকটা কেঁপে ওঠে বৈকি!।
‘না তো। কী কীর্তি?’
‘তিনি যে রাঁধুনীর চাকরি নিয়েছেন!’
‘চাকরি নিয়েছে? রাঁধুনীর? সে কি!
খাবারের থালাটা ঠেলে দিয়ে সরে বসেন শ্যামা।
‘আপনি খেয়ে নিন্ মা–খাওয়াটা শেষ করে উঠুন। সারা দিনের পর–। ঠাকুর-ঝিও আর কথাটা বলার সময় পেলেন না। যা হবার তা তো হয়েইছে আর হবেও, খাওয়ার মধ্যেই কথাটা না বললে হত না?’
কনক আর থাকতে পারে না। তার কণ্ঠস্বরটা আপনা থেকেই একটু তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
মহাশ্বেতও এবার একটু অপ্রস্তুত হয়।
‘সত্যিই তো, তুমি বাপু খেয়েই নাও না! কথা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। আমি না হয় বসছি দু দণ্ড। যা হবার তো হয়েই গেছে। সে কথা যথার্থ, লেহ্য কথা। তা তোমারই বা এমন তিনপোর বেলায় খাওয়া কেন?’
কিন্তু শ্যামা ঘাড় নাড়েন, ‘আমি আর খাব না। থালা সরিয়ে দিয়েছি, বিধবা মানুষ আর খাওয়া চলবেও না। একটু তো খেয়েছি– ওতেই চলে যাবে আমার। তুই বল।’
‘বলব আর কি বলো। মুখটা তো দিন দিনই ওজ্জ্বল হচ্ছে আমার! এক-একজন এক- একবার করে মুখ পোড়াচ্ছেন আর শত্তুর হাসছে। এই তো খবর দিলেন মেজগিন্নি স্বয়ং–কী হেসে হেসে আর টিপ্পুনি কেটে কেটে বলার ঢং। যেন আমার দুঃখে গলে পড়ছেন একেবারে।’
‘তা সে কবে নিলে এ কাজ? কোথায়ই বা নিলে!
‘নিয়েছে নাকি পরশু থেকে। কি তার আগের দিন থেকে। অত পোষ্কার করে শুনি নি বাপু। নিয়েছে আবার কোথায়– যাতে আমাদের মুখটা বেশি করে পোড়ে তাই করা চাই তো তার! মেজগিন্নীরই কে মামাতো বোনের বে হয়েছে ঐ ওদিকে কোথায় ডোমজুড়ের কাছে– বর বুঝি উকিল, মস্ত সংসার তাদের– সেইখানে চাকরি নিয়েছেন। তা নিলি নিলি পরিচয়টি হাটিপাটি পেড়ে না দিলে হ’ত না। সেই উকিল বোনাই ওঁর সঙ্গে সঙ্গে খবর পাঠিয়েছেন মেজকত্তার আপিসে– ওদের আবার কে যেন কাজ করে ঐ আপিসে– সেই-ই এসে বলে গেছে মেজকত্তাকে। ছি ছি। কথাটা যখন বললে মেজগিন্নী, তখন মনে হল ধরিত্তির দ্বিধা হও মা, আমি প্রেবেশ করি। কোন দিক দিয়ে আর আমার মুখ পুড়তে বাকি রইল না। নিত্যি এক এক কেলেঙ্কার লেগেই আছে আমার বাপের বাড়িতে।’
আড়ষ্ট হয়ে বসে শুনছিলেন শ্যামা এতক্ষণ।
এইবার শুধু প্রশ্ন করলেন, ‘তা তার মেয়ে? মেয়েকে নিয়ে গেছে?’
কৈ মেয়ের কথা তো বললে না কিছু। মেয়ে সুদ্ধ আর কে চাকরি দেবে। মেয়ে বোধ হয় রেখে গেছে শ্বশুরবাড়ি। কে জানে? কে আবার খবর নিচ্ছে খুঁটিয়ে। আমি কি আর এই সুখবর কানে শোনবার পর কোন কিছু জিজ্ঞেস করেছি! যা বলেছে, ওরাই বলে গেছে নিজগুণে।’
তারপর একটু থেমে বললে, ‘মুখটা কি আর তোমার এক মেয়ের বাড়ি পুড়ল– তা যেন স্বপ্নেও ভেবো না। সব মেয়েরই মুখ ওজ্জ্বল হল একেবারে। মেজাবোয়ের ঐ মমাতো বোনের বড় জা আবার হ’ল কে জানো– হারানের ঠাকুমার সম্পর্কে ভাইঝি। আপনার ভায়ের মেয়ে নয়, বুড়ির নাকি নিজের ভাই কেউ ছিল না, খুড়তুতো জাঠতুতো ভাই হবে। জ্ঞাতি। তা খবরটা কি আর সেখানে পৌঁছচ্ছে না মনে করো!
শ্যামা উঠে পড়েছেন ততক্ষণ।
পাতের খাবার কনক গুছিয়ে রাখবে। তাকেই খেতে হবে রাত্রে। এ বাড়িতে খাদ্য কিছু ফেলার রেওয়াজ নেই। সীতা থাকলে সে খায়– নইলে কনককেই উদ্ধার করতে হয়। নেহাৎ ডাল ঝোল মাখা ভাত থাকলে ফেলা যায়– তাও সীতা থাকলে তাকে খাওয়ানো হয়– কিন্তু সাদা ভাত বা আস্ত রুটি– রুটি কদাচিৎ হয়– চালের ক্ষুদ ও ডালের ক্ষুদ মিশিয়ে সরুচাকলিই বেশি– এসব ফেলার কথা ভাবতেই পারেন না শ্যামা। যদিচ একটা অদ্ভুত উদারতা তাঁর আছে–বোধ হয় নিজে বহুদিন ধরে অন্নের কষ্ট পেয়েছেন, উপবাস করে দিনের পর দিন কেটেছে বলেই– দুপুরের দিকে কোন ভিখারি এলে ফেরান না। পাতা পেতে উঠোনে বসিয়ে ভাত খাইয়ে দেন। নিজের ভাতও অনেকদিন ধরে দিয়েছেন, পাতার জ্বালে নিজের মতো ভাত ফুটিয়ে নিয়েছেন পরে। তেমন বেলা হলে নিজের জন্যে আর রান্নাও করেন না, যা হোক মুড়ি বা ক্ষুদ-ভাজা খেয়ে কাটিয়ে দেন। কিন্তু তাদেরও– পাতের এঁটো ভাত দেন না। বলেন, ‘বাপরে, ওরা হ’ল নারায়ণ, জন্মের মধ্যে কম্ম একদিন দুটো ভাত খেতে বসেছে আমার বাড়ি, এঁটো ভাত দিতে পারব না!
শ্যামা পুকুরে চলে গেলেন আঁচাতে, কিন্তু তাতে মহাশ্বেতার উৎসাহ কিছুমাত্র কমল না। সে কনককে উদ্দেশ করেই বলে চলল, ‘ঐ হারানই কি কম কেলেঙ্কারটা করল! সে নিয়ে অমনি আমার বাড়িতে কথায় কথায় হাসাহাসি আর টিটকিরি। আমার ছেলেগুলো সুদ্দু এমন বোকা– মুর্খর ডিম তো সব তার হবে কি– আপনার পর হাস্যিদিঘ্যি জ্ঞান আছে?–ওরা সুদ্দু শত্রুরদের সঙ্গে হেসে গড়িয়ে পড়ে একেবারে–কথা উঠলে হয়। আবার আমার গুণের মেয়ে মেসোমশাই বলেন না, বলেন, তোমার বোনাই, তোমার ভগ্গিনপোত– এই সব! হবে কি, দিন রাত ঐ মহারাজা মহারাণীর কাছে শিখনে পাচ্ছে তো– কত ভাল আর হবে বলো! ঐ মেয়ে হতে আমার হাড় ভাজাভাজা যদি না হয় এর পরে তো আমি কী বলেছি। তোমরা দেখে নিও!’
হারানের ব্যাপারটা হাসবার মতোই বটে। মনে হলে কনকেরও হাসি পায়। শুনেছে সেও মহার ছেলে-মেয়েদের কাছেই। মহার কোন ভাগ্নে বুঝি হারানের সঙ্গে কাজ করে– সেই এসে বলেছে। প্রথম যেদিন শুনেছিল কনক, সেদিন মুখে কাপড় গুঁজেও হাসি চাপতে পারে নি। ও-ঘর থেকে এসে রান্না-ঘরে শুয়ে পড়েছিল হাসতে হাসতে।
তরুর একটি ছেলে হয়েছে। তরুর সতীনও নাকি পূর্ণ গর্ভবতী। ঘরে জোড়া খাটে বড় একটা ঢালা বিছানা করে দুই বৌকে নিয়ে এক বিছানাতেই শোয়। দুই বৌ দুদিকে থাকে, মাঝে হারান।
এ সব কথা হারানই নাকি গল্প করেছে আফিসে।
বেশ গর্বের সঙ্গেই নাকি সে এ সব গল্প করে।
আফিসের বন্ধু বুঝি কে একদিন এই কথা শুনে একটু খোঁচা দিয়ে বলেছিল, ‘কী করে দুটোকে সামলাও ভায়া–কীভাবে জল খাওয়াও বাঘে গরুকে এক ঘাটে– একটু শিখিয়ে দাও না!’ তাতে উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে থিয়েটারি বক্তৃতার মতো বলেছে হারান, হুঁ হুঁ– তোমাদের মতো ছটাকখানেক প্রাণ নিয়ে ঘর করে না এ শর্মা। মরদ বাচ্ছা, বুঝলে? যে খাওয়াতে জানে সে বাঘে গরুকে এক ঘাটেই জল খাওয়ায়। আমার কাছে ও সব নেই। ঢাকঢাক নেই, অর্শদর্শও নেই। দুজনেই সমান আমার কাছে, সমান ব্যবহার পাবে। কম- বেশি কাউকে দেখব না–ব্যস। এক ঘরে এক বিছানায় শান্তিতেই শুচ্ছি। লোকের বাড়িতে সতীন থাকলে আলাদা আলাদা ঘরে রেখেও শান্তি পায় না, বাড়িতে কাক-চিল বসে না একেবারে। আমার বাড়িতে যাও, দেখবে টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। শব্দ করবে কেন, পুরুষের দাপট থাকলে মেয়েদের সাধ্যি কি যে চুঁ শব্দ করে! আমার খুশি, আমি দুটো ছেড়ে চারটে বে করব– তোমার কি? তুমি তোমার পাওনাগণ্ডা পেলেই তো হল! বুঝলে, এ তোমরা নও। সংসারে আদর্শ স্থাপন ক’রে যাব– দেখবে এর পর লোকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলবে– হ্যাঁ, মরদ বাচ্ছা বটে। মরবার পর জীবনী লিখে বাহা বাহা করবে।’
সত্যিই বাপু বাহাদুরী আছে হারানের! শান্তিতেই তো আছে। তরুকে অনেক জেরা করেছে কনক– মোটামুটি শান্তিতেই আছে, ঝগড়া কচকচি নেই। তরু না হয় ভালমানুষ কিন্তু তার সতীনটি যেমন পাড়াগাঁয়ের সাধারণ মুখরা মেয়ে হয় তেমনিই। তার ওপর আবার বাপসোহাগী, আদুরী মেয়ে। তাকে যে শাসনে রেখেছে সেটা খুব কম কথা নয়!…
মহা আরও খানিকটা বকে কথঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেল। শ্যামা খুব যে একটা বিচলিত হয়েছেন তা তাঁর আচরণে বোঝা গেল না– অভ্যস্ত কাজ-কর্ম সবই ক’রে যেতে লাগলেন তিনি– কিন্তু তাঁর গম্ভীর মুখ দেখেই বুঝতে পারল কনক যে মনের মধ্যে তাঁর গভীর আলোড়ন চলছে একটা। দুটি ওষ্ঠের এই বিশেষ ভঙ্গি এতদিনে কনকের পরিচিত হয়ে গেছে। শ্যামার পূর্ব সৌন্দর্যের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই বিশেষ– শুধু মুক্তোর মতো সাজানো দাঁত এবং পাতলা ঠোঁট দুটি এখনও অবশিষ্ট আছে। হাসলে এখনও সুন্দর দেখায়, তেমনি ঐ দুটি ঠোঁট যখন পরস্পরের সঙ্গে গাঢ়সম্বন্ধ হয়ে চেপে বসে– তখন সমস্ত মুখটা এমন কঠিন ও পুরুষ দেখায় যে এখনও কনকের বুকের মধ্যেটা গুরগুর করতে থাকে! রূঢ় ভাষা যে বেশি ব্যবহার করেন শ্যামা তা নয়, অভদ্র ভাষা এখনও তাঁর মুখে আটকে যায়– কিন্তু এই সব সময়গুলোতে যখন কথা বলেন কিছু, তখন যার সম্বন্ধে বলেন তার গায়ে যেন কেটে কেটে বসে। একেই বুঝি কবিরা বলেছেন বাক্যবাণ। এমন তীক্ষ্ণ ও অন্তর্ঘাতী ভাষা যে কোথায় পান শ্যামা তা কনক অনেক চেষ্টা করেও ভেবে পায় না। আবার এক এক সময় ভাবে সে, এ হয়ত দীর্ঘকালব্যাপী কঠোর জীবন-সংগ্রামেরই ফল, হয়ত এই বয়সে তারও মুখে এই ধরনের কথা আপনিই যোগাবে।
আজ কিন্তু সে রকম আঘাত কারুর ওপর পড়ল না। পাতা চাঁচতে চাঁচতে অনেকক্ষণ পরে শুধু একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন শ্যামা, ‘ঐ মেয়ে নিয়ে বৌমা আমার শ্মশানে গিয়েও শান্তি হবে না। পরের বাড়ি গিয়ে যদি শান্ত হয়ে থাকতে পারত, যদি টিকে থাকত তো আমার বলবার কিছু ছিল না। একটা কাজ নিয়ে থাকা তো ভালই– আমার অত লজ্জা-সরম নেই, রাজ-রাজেশ্বরের মেয়ে নয় তো যে খেটে খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আমার ভাবনা হচ্ছে যে জাতও যাবে পেটও ভরবে না। ওখানেও টিকতে পারবে না– দেখো ঝগড়াঝাঁটি করে অপমান হয়ে বেরিয়ে আসবে। যারা পয়সা দিয়ে লোক রাখবে তারা অত ঝাল সহ্য করবে না তো। শুধু এর জন্যে কুটুম্ব-সাক্ষাতের কাছে মাথা হেঁট করা– মুখ পুড়নোই সার হবে!’
খানিকটা পরে আবার বলেন, ‘শুধু কি একটা ভয়? এখনও ঐ রূপ দেখছ তো– আগুনের মতো। পরের বাড়ি হয়ত এক ঘর পুরুষের মধ্যে থাকা। কার খপ্পরে পড়বে, কী করবে– সেই আরও ভয়। আরও কত মুখ পুড়বে এই ভয়ে সর্বদা কাঁটা হয়ে থাকা!’
কনক চুপ করেই শোনে বসে বসে। কী বলবে সে! আর উত্তরের জন্যও বলেন নি শ্যামা, এটা তাঁর স্বগতোক্তি কতকটা।
খানিকটা আরও নিঃশব্দে পাতা চাঁচবার পর বললেন তিনি, ‘গৈল তো মেয়েটাকেই বা ওখানে রেখে গেল কেন? সেই মতলবই যদি ছিল তো এখানে রেখে গেলেই হত। তবু তুমি একটু দেখতে শুনতে পারতে। এখানে একা থাকলে একেবারে চাষার ঘরের মেয়ে তৈরি হবে, তুমি দেখো!’
এইবার কনক কথা বলল, ‘তা ওকে না হয় আনিয়ে নিন না মা!’
‘কখনও না!’ তীব্রকণ্ঠে বলে ওঠেন শ্যামা, ‘এমন অন্ধ মায়া আমার নেই মা। এক তো যেচে অপমান হতে যাওয়া– তারা যদি বলে ওর মা আমাদের কাছে দিয়ে গেছে, তোমাদের বাড়ি পাঠাব না– তখন মুখটা কোথায় থাকবে! তার ওপর তাঁকেও তো চিনি, এখানে এনে রাখব– যদি কোন রকম পান থেকে চুন খসে তো কৈফিয়ৎ চাইবেন– কেন আমার মেয়েকে আনতে গিছলে তোমরা, কিসের জন্যে!…. না মা, বেশ আছি। অত টান আমার কারুর ওপর নেইও আর। ঢের শিক্ষা হয়েছে– ঢের পেয়েছি, আর কেন! ও মেয়ে যদি ওখানে মরেও যায় তো নিজে থেকে আনতে যাব না!’
এর পর আর বলবার কিছু নেই। কনক চুপ করেই থাকে। কিন্তু ওর সত্যিই মন- কেমন করে মেয়েটার জন্যে। কাছে থাকলে তবু সময় কাটে একটু। তার সঙ্গেই তবু গল্প করা যায়। এ নিঃসঙ্গ ও নিঃশব্দ পুরীতে যেন মাঝে মাঝে দম আটকে আসে কনকের
॥২॥
অঘ্রান মাসের পয়লা তারিখেই হঠাৎ একটা পালকি এসে থামল কনকদের বাগানে। দুপুর পার হয়ে গেছে বিকেল শুরু হয় নি– এমনি সময়টা, শ্যামা খেয়ে আঁচিয়ে উঠে ঘাটের ধারে দাঁড়িয়েই রোদ পোয়াচ্ছেন। উঠোনে এত গাছপালা হয়েছে যে ভাল করে রোদ নামেই না কখনও।
হঠাৎ পাকি আসতে দেখে শ্যামা তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন, কনকও বাড়ির ভেতর থেকে শব্দ পেয়েছিল, সেও ছুটে বেরিয়ে এল। তাদের বাড়িতে আবার পাল্কি করে কে আসবে। এতকালের মধ্যে তো কাউকে আসতে দেখে নি সে।
পাকির পিছনে পিছনে একজন পিলেরোগা ধরনের ক্ষয়া-ঘষা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আসছিলেন, এতক্ষণ ওরা দেখতে পায় নি। তিনি পাল্কি-বেয়ারাদের সঙ্গে অত দ্রুত চলতে পারেন নি– পিছিয়ে পড়েছিলেন। এইবার তিনি ছুটে এগিয়ে এসে পাল্কির দোর খুলে কাকে যেন হাত ধরে আস্তে আস্তে টেনে বার করলেন। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে প্রায় বয়ে আনার মত করেই বাইরের ঘরের রকে বসিয়ে দিলেন। একটা সাদা বোম্বাই চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষ–ঠকঠক করে কাঁপছে সে, আর কী রকম একটা অব্যক্ত আওয়াজ করছে।
মুড়ি দেওয়া হলেও মেয়েছেলে নয় এটা বোঝা-গেল। খানিকটা কোঁচা ঝুলে পড়েছে এদিকে– অর্থাৎ পুরুষ।
সঙ্গের অভিভাবকটি এতক্ষণ এদের সঙ্গে একটিও কথা বলেন নি, এদিকে ফিরে তাকান নি। এবার এদিকে ফিরে কাকে নমস্কার করবেন ঠিক করতে না পেরে, শ্যামা ও কনকের মাঝামাঝি একটা জায়গা লক্ষ্য করে নমস্কার করলেন। শ্যামা বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও একখানি কাটো ময়লা ধুতি পরেছিলেন– তাই বাড়ির গৃহিণী না দাসী বুঝতে পারেন নি ভদ্রলোক।
সে ভদ্রলোকটিও অবশ্য খুব সুস্থ নন। তাঁর মুখের চেহারাও যৎপরোনাস্তি শীর্ণ ও দুর্বল– অনেকদিন কোনো রোগে ভুগছেন বলেই মনে হয়। বেশভূষাও তথৈবচ। অত্যন্ত মলিন ধুতি পরনে– জীর্ণ গলাবন্ধ ময়লা কোটের ওপর ততোধিক ময়লা একটি উড়ুনি। নমস্কার করা হয়ে গেলে দু-হাত উড়ুনির দুই প্রান্ত ধরে ওধারের তুলসী গাছটার দিকে চেয়ে রইলেন।
শ্যামা এতক্ষণ অবাক হয়ে চেয়েছিলেন শুধু, এবার বিস্মিত এবং ঈষৎ বিরক্ত ভাবেই বললেন,
‘এসব কী ব্যাপার? কারা আপনারা? কোথা থেকে আসছেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। নিশ্চয় আপনাদের বাড়ি ভুল হয়েছে। কোন্ ঠিকানা খুঁজছেন বলুন তো?’
গলার আওয়াজে নিঃসংশয়ে শ্যামাকেই বাড়ির কর্ত্রী বুঝতে পেরে তিনি চাদর ছেড়ে দিয়ে জোড় হাতে আর একটি নমস্কার করলেন, তারপর বিনীত কণ্ঠেই বললেন, ‘আজ্ঞে না মা-ঠাকরুণ, বাড়ি ও-ই চিনিয়ে দিয়েছে। আপনার ছেলে!’
আপনার ছেলে!
চমকে শিউরে উঠলেন শ্যামা। কনকও।
বোধ হয় সামনে ভূত দেখলেও অত চমকাত না তারা।
‘ছেলে!’ খানিকটা পরে বাক্যস্ফূর্তি হয় শ্যামার, ‘আমার ছেলে? কোন্ ছেলে!’
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে এগিয়ে যান তিনিই সেই মুড়ি-দেওয়া কম্পমান মূর্তিটার দিকে। সামনের দিকে ঝুঁকে ভাল করে মুখটা দেখার চেষ্টা করেন।
অনেকক্ষণ পরে চিনতেও পারেন।
কান্তি!
সঙ্গে সঙ্গে– এতকাল পরে তাঁর সমস্ত সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। চিৎকার করে– মড়া কান্নার মতো। কনক ছুটে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে, কিন্তু কোন সান্ত্বনা দিতে পারে না। তারও দু’চোখ জলে ভরে গিয়েছে। চিনতে পেরেছে সেও।
কান্তিই– কিন্তু এ কী চেহারা তার!
শেষ যেবার আসে সে– কনক দেখেছিল– একেবারে রূপকথার রাজপুত্রের মতো।
উজ্জ্বল গৌর বর্ণ, অপূর্ব মুখশ্রী; কান্তিমান তরুণ ছেলে। দীঘল সুস্থ গঠন, দীর্ঘায়ত টানা চোখে ঘন পল্লব, সুন্দর বঙ্কিম ঠোঁটের ওপর ঘন শ্যামল রেখা। আর তেমনি সরল ঋজু চেহারা– আর কিছুদিন পরে শুধু সুন্দর নয়, সুপুরুষ হয়ে উঠবে– তা তখনই দেখে বোঝা যাচ্ছিল।
আর এ যে এসেছে– তার রং রোদেপোড়া তামাটে কালো গায়ে খড়ি উড়ছে, রুক্ষপালা চুল, হাত-পা কাঠিকাঠি। মুখে যেন– বলতে নেই– মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে এসেছে একেবারে। তেমনি ঘোলাটে শূন্য দৃষ্টি।
এ কী সেই লোক? বিশ্বাস হয় না কিছুতেই।
শ্যামার মড়া-কান্না শুনে আশপাশের বাড়ি থেকে ছুটে এল অনেকে। স্বয়ং মল্লিক- গিন্নীও এসে দাঁড়ালেন। তিনি প্রবীণ লোক, বহুদর্শী। এক নজরে দেখে নিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। শ্যামাকে ধমক দিয়ে উঠলেন, ষাট্ ষাট্, ও কি কথা। অমন মড়া-কান্না জুড়ে দিয়েছ কেন গা! এ কী অলুক্ষণে কাণ্ড, ঠিক দুপুর বেলা! রোগা ছেলে এসেছে- আগে তাকে ঘরে তোল, তার মুখে একটু জল দাও– তা নয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কান্না জুড়ে দিলে! আর তুমিও তো তেমনি বৌমা। নাও ওকে ছাড়, দেওরকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যাও। এত কান্নাকাটির হয়েছেই বা কী, অসুখ করলে সকলেরই চেহারা খারাপ হয়– তায় পুরুষ মানুষ, সুন্দর চেহারা ওর কী কাজেই বা আসবে। নিশ্চয় ম্যালেরিয়া জ্বর হয়েছে তাই অমন কাঁপছে– আহা বাছা রে।’
সঙ্গের ভদ্রলোকটি এই কান্নাকাটি দেখে হকচকিয়ে গেছলেন। মল্লিক-গিন্নীর কথাতে তিনিও খানিকটা ধাতস্ত হলেন। অকারণেই তাঁকেও একটা নমস্কার করে বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ মা-ঠাকরুন, ঠিক ধরেছেন। ম্যালেরিয়াই বটে। ঐ এক কালরোগেই দিলে আমাদের দেশটাকে উচ্ছন্ন করে। কী কালব্যাধি যে তা বলবার নয়। এ ছেলেটিও অনেকদিন ধরে ভুগছে মা– পুরনো রোগে দাঁড়িয়ে গেছে। এখনও চিকিচ্ছে করলে হয়ত বাঁচবে, যেভাবে পড়ে ছিল, না চিকিচ্ছে না কিছু– বেঘোরে, সে ভাবে থাকলে আর বাঁচত না।’
মল্লিক-গিন্নী বললেন, ‘তা তুমি কে বাছা? একে পেলেই বা কোথায়?
‘আজ্ঞে মা, আমি ওখানকার ইস্কুলের জয়েন্ট হেডমাস্টার। আমাদের ইস্কুলেই পড়ত। জ্বরে পড়েছে অনেকদিন। সেই বর্ষার গোড়া থেকে ধরুন। ভোগেই বেশি, মাঝে মাঝে একটু ভাল থাকলে ইস্কুলেও আসে। আমাদের হোস্টেলে তো থাকে না– থাকে বাবুদের কাছারি-বাড়িতে। সেইখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা– গোমস্তা-মুহুরীদের সঙ্গে। আমাদের অত দায়ও নেই তাই। এবারে অনেকদিন ইস্কুলে আসে না দেখে– পরীক্ষার সময় এসে গেল ওর, হেডমাস্টারমশাই আর আমি পরশু দেখতে গেলুম। গিয়ে দেখি এই অবস্থা– উঠতে পারে না, মড়ার আকৃতি। ওদের জিজ্ঞাসা করলুম যে ডাক্তার দেখিয়েছ? বলে সে রকম তো হুকুম নেই। আমরা কলকাতায় লিখেছি– কোন উত্তর পাই নি। খরচা করলে দেবে কে? তা মাস্টার মশাই বললেন, বাপু হাসপাতালেও তো দেখাতে পারতে– তা বলে, আজ্ঞে দুকোশ পথ, গোরুর গাড়ি ছাড়া তো যাওয়া চলবে না– সে ভাড়া দেবে কে? চোর চোর– বুঝলেন না, মহা চোর। জ্বর হলে শুধু একটু নিলক্ষে জল-সাবু দিয়ে ফেলে রাখত। একটা চাকর আছে কাছারির হরিহর বলে– সে নাকি মধ্যে মধ্যে তার নিজের পয়সায় পোস্টাপিস থেকে কুইনাইন এনে খাওয়াত, র’ কুইনাইন, খেয়ে খেয়ে কান ভোঁ ভোঁ করছে, কানে শুনতে পায় না। কেন মা– আপনিই বলুন, বাবুরা ওর খোরাকির পয়সা দেয় তো– তা থেকেও তো বাঁচে কিছু, অসুখ হ’লে তো এক পয়সার সাবুতেই চলে যায়– তা এক দিন আর গ্রামের বটুক ডাক্তারকে ডাকা যেত না। তার তো মোটে এক টাকা ফি আমাদেরও খবর দিলে পারত!’
‘এখানে চিঠি দেয় নি কেন, এদের ছেলে, এরা গিয়ে নিয়ে আসত!’ মল্লিক-গিন্নী প্রশ্ন করেন।
‘কি জানি মা, তা বলতে পারব না। ওরা তো বলে ছেলে নাকি বারণ করেছিল! বলেছিল শুধু ব্যস্ত করা তাঁদের, এমন পয়সা নেই যে আসবেন বা চিকিৎসার টাকা পাঠাবেন।……. তা আমাদের হেডমাস্টারমশাই বললেন, এ তো ছেলেটা এখানে থাকলে এক মাসও বাঁচবে না ভাই জয়কেষ্ট, একে দিয়ে আসতে হবে। সব মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে দু-আনা, চার-আনা চাঁদা তুলে, ইস্কুল থেকেও বই বাঁধাই চার্জ বলে কিছু লিখিয়ে নিয়ে– আমাকে দিয়ে পাঠালেন।’
পাল্কি-বেয়ারারা এতক্ষণে অনেকটা জিরিয়ে নিয়েছে, তারা ভাড়ার তাগাদা দিয়ে উঠল। জয়কৃষ্ণবাবুর বোধ করি ওদের কথাটা মনেই ছিল না, তিনি অকারণেই এতখানি জিভ কেটে বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বাবারা, দিচ্ছি। এক মিনিট!’
যথারীতি ভাড়া নিয়ে খানিকটা তকরার করার পর পয়সা বুঝে পেয়ে যখন তারা চলে গেল, তখন জয়কৃষ্ণবাবু তাকিয়ে দেখলেন যে চারিদিক খালি হয়ে গিয়েছে। শ্যামা ও কনক ধরাধরি করে কান্তিকে নিয়ে ঘরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশে যারা ছিল তারাও ঘরে গিয়ে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। শুধু মাল্লিক-গিন্নীই তখনও সদরের চৌকাঠে একটা পা দিয়ে ইতস্ততঃ করছেন। বোধ হয় জয়কৃষ্ণবাবুর কথাটা ভেবেই ভেতরে যেতে পারেন নি।
খানিকটা বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবার পর জয়কৃষ্ণবাবুর সম্ভবত বোধগম্য হল এই তথ্যটা যে, এখন তিনি অনাবশ্যক।
বাড়িতে যে অবস্থা চলছে, তাঁর দিকে কারুর মনোযোগ দেওয়া সম্ভব নয় তা তিনি বুঝতে পারলেন। লোকও বেশি নেই–ঐ দুটি স্ত্রীলোক ছাড়া– নইলে তাদের কাউকে দেখা যেত। পুরুষ-মানুষ কেউ এখন থাকার কথাও নয়।
সুতরাং এখন চলে যাওয়াই উচিত।
কিন্তু কাউকে বলে যাওয়া উচিত কিনা, এবং কাকেই বা বলে যাবেন বুঝতে না পেরে মল্লিক-গিন্নীকেই উদ্দেশ করে বললেন, ‘তাহলে আমি মা এখন যাই, ওঁদের বলে দেবেন। ভাল হয়ে যদি আবার যেতে চায় তো যাবে। তবে এ বছরের টেস্ট বোধ হয় আর দিতে পারবে না– সে তো এসে পড়ল বলে। আর তা যদি দিতে না-ই পারে তো গিয়েই বা লাভ কি। ওখানে থাকলে আবারও পড়বে। আমরা ফি হপ্তায় কুইনাইন খাই নিয়মিত– তাই দেখুন না হাল।’
তিনি একটা ছোট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চাদরের খুঁট-দুটি আবার দুহাতে চেপে ধরলেন, অর্থাৎ রওনা দেবার জন্যে প্রস্তুত হলেন।
মল্লিক-গিন্নী মিনিটখানেক ইতস্তত করলেন, ভেতরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একবার, তারপর আবার বেরিয়ে এসে বললেন, ‘যাবেন? কিন্তু আপনার তো খাওয়া-দাওয়া কিছু হয় নি বোধ হয়!’
‘আজ্ঞে কখন আর হবে বলুন। রাত থাকতে গোরুর গাড়িতে চেপেছি তো–অনেকটা পথ তাই গাড়োয়ানকে বলে বোর্ডিং-এই গাড়ি মজুত রেখেছিলুম রাত্তিরে। তারপর তো ধরুন তিনবার ট্রেন বদলে আসা। সকালে সেওড়াফুলিতে একটু যা চা খেয়ে নিয়েছিলুম ওকেও দিয়েছিলুম, সহ্য করতে পারলে না, বমি হয়ে গেল।…….. তা সে যা হোক, আমার জন্যে ভাববেন না, এই যাবার পথে যা হয় জলটল খেয়ে নেব এখন। দিয়েছেন, মাস্টারমশাই পয়সা সব হিসেব করেই দিয়েছেন। এই পাল্কিটাতে যা আনা চারেক বেশি লাগল। তা তাতেও আটকাবে না। যা হোক করে হয়েই যাবে।’
তিনি একটু হেসে যাওয়ার জন্যে ফিরে দাঁড়ালেন। মল্লিক-গিন্নী বললেন, ‘না না, সে কখনও হয়! আপনি এত কষ্ট করে নিয়ে এলেন আমাদের ছেলেকে, মহা উপকার করলেন, প্রাণরক্ষাই করলেন ওর বলতে গেলে। এরা বড্ড কাতর হয়ে পড়েছে, বুঝলেন না– অমন সোনার চাঁদ ছেলের এই ছিরি, আঘাতটা লেগেছে খুব। তাই আর হুঁশপব্ব কিছু নেই। নইলে এখানেই সব ব্যবস্থা করে দিত এরা। ছেলের দাদা থাকলে খরচপত্রও দিয়ে দিত। তা আপনি বরং আমার ওখানেই– যা হয় দুটো মুখে দিয়ে নেবেন। ডাল তরকারি সবই কিছু কিছু আছে– দুটো ভাত ফুটিয়ে দিতে বেশি দেরি লাগবে না। আমরাও ব্রাহ্মণ, আমাদের ওখানে খেতে আশা করি আপনার আপত্তি হবে না।’
‘না, না– সে সব কোন-কিছুই নেই আমাদের। আমরা পাল–ঐ মৃত্তিকার কাজ আমাদের কুলকর্ম। তা চলুন। তবে বিকেলের গাড়ি না ধরতে পারলে ওদিকে ইস্টিশানে পড়ে থাকতে হবে। যা পথ, রাত বেশি হয়ে গেলে আর যেতে ভরসা হয় না। নেই কি, বাঘ ভালুক থেকে সাপখোপ সব আছে। বুনো শিয়ালরাও কম যান না। অবিশ্যি আছে, ইস্টিশানের কাছেই একঘর কুটুম্বও আমাদের আছে। অনেককাল দেখা-সাক্ষাৎ নেই এই যা– তবে গিয়ে দাঁড়ালে চিনতে পারবে। সে যা হয় একটা হবেই’খন ব্যবস্থা। আপনাদের প্রসাদ দু’টি পেয়েই যাই।’
মল্লিক-গিন্নী একটু হেসে বললেন, ‘না না, আমি বেশিক্ষণ আটকাব না। ট্রেন আপনি পাবেন। না হয় একগাল আলোচালই চড়িয়ে দিচ্ছি, পাঁচ মিনিটে হয়ে যাবে। আপনি স্নান করতে করতেই–’
এতখানি জিভ কেটে জয়কৃষ্ণবাবু বললেন, ‘স্নান? ঐটি মাপ করবেন মা। স্নান করি আমি ধরুন মাসে একদিন। তাও ফুটনো জল ছাড়া চলে না। তাতেই কি নিস্তার আছে– যতদিন পরে যেভাবেই করি না কেন, মাথায় জল পড়লেই জ্বর আসবে। ঐ জন্য ছুটিছাটা দেখে করতে হয়– যাতে একদিন শুয়ে থাকলেও কোন ক্ষতি হয় না। স্নান করার দরকারও নেই তেমন– মুখ হাত ধুয়ে নিলেই চলবে।’
‘তা হলে চলুন।’ বলে মল্লিক-গিন্নী আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান তাঁকে।
.
হেম সেদিন এসে পৌঁছল রাত ন’টারও পর। সব শুনে সে অবশ্য তখনই ছুটল ডাক্তারের বাড়িতে কিন্তু ডাক্তার এলেন না। তাঁর কোমরে ব্যথা, রাত্রে আর বেরোতে পারবেন না। আর একজন নতুন ডাক্তার বসেছেন বটে, তাঁর দু’টাকা ফি, ডাক্তারও তত সুবিধের নন। এমনিতেই তো শ্যামা ডাক্তার ডাকাতে আপত্তি করছিলেন, পরের দিন সকালে হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথাই বলেছিলেন। হেম ধমক দিয়ে উঠেছিল বলে খুব বেশি কিছু বলতে পারেন নি।
তোমার যেমন কথা! অজ্ঞান অচৈতন্য রুগী, বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে, একে টেনে নিয়ে যাব হাসপাতালে! তা হলে তো পাল্কি করতে হয়, সেও তো যাতায়াতে অন্তত দেড় টাকা। তাছাড়া ও অবস্থায় পাকিতেই বা ওঠাব কী করে! একটু ধাতে না এলে ওকে নড়ানোই উচিত নয়!
সুতরাং সে রাত্রে চিকিৎসার কোন ব্যবস্থাই হল না। এরা শুধু সবাই মিলে জেগে ঘিরে বসে রইল সারারাত। রোগীর কোন জ্ঞানই নেই, অসাড়ের মতো পড়ে আছে। শেষরাত্রের দিকে জ্বর একটু কমল কিন্তু তখনও জ্ঞানের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। বেঁচে আছে কিনা– এক এক সময় সেই ভয় হতে লাগল। কেবল মধ্যে মধ্যে ঠোঁট নড়ে উঠছে একটু– মনে হয় জল খেতে চাইছে, অল্প অল্প জল দিলে খাচ্ছেও– সেই যা ভরসা। তাও শ্যামা একবার একটু বেশি জল দিয়ে ফেলেছিলেন, দুদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল, মুখে রেখে একটু একটু করে খেতে পারল না।
সকালবেলাই হেম আবার গেল ডাক্তারের কাছে। ফকির ডাক্তার–দক্ষিণ পাড়ায় বাড়ি, খুব দূর নয়, কিন্তু একবার বেরিয়ে পড়লে ধরা মুশকিল। ফকির এককালে এখানকার এক বড় ডাক্তারের কম্পাউন্ডার ছিলেন, তিনি মারা যেতে বাজারে এক ডিপেন্সারী সাজিয়ে বসেছেন, নিজেই চিকিৎসা করেন। সবাই বলে ফকির বিচক্ষণ ডাক্তার– এম-বি পাস ডাক্তারের চেয়েও ভাল। হয়ত আরও বলে, মাত্র এক টাকা ফি বলে। কোথাও কোথাও আট আনাও নেন। ডিপেন্সারীতে গেলে (ফকির বলেন চেম্বার) তাও লাগে না, অথচ প্রত্যেককেই যত্ন করে দেখেন। ওষুধও অনেক সময় বাকিতে দেন– ওষুধের দামও কম। যে মিক্সচারটা সব জায়গায় বারো আনা–কলিকাতায় এক টাকা পাঁচসিকে– উনি সেইটাকেই নেন দশ আনা করে। গরিব দুঃখীর ক্ষেত্রে আরও কমিয়ে দেন দাম। আট আনা সাত আনা– যার কাছে যা পান তাই নেন।
ডাক্তার এসে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন। এসেছিলেন হাসি হাসি মুখে কিন্তু দেখতে দেখতেই মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বললেন, ‘শুনেছিলুম বটে ওদেশের ম্যালেরিয়ায় বাঘ সুদ্ধ জব্দ হয়ে যায়–কিন্তু ভাবতুম ওটা কথার কথা। এখন দেখছি সাংঘাতিক সত্যি। ইস্! এখানেও তো কম নেই, কিন্তু এমন ব্যাড টাইপের ম্যালেরিয়া তো কখনও দেখি নি মশাই। সমস্ত রক্ত শুষে খেয়েছে একেবারে! বললে বিশ্বাস করবেন না–বোধ হয় এক ছটাক রক্তও আর দেহে নেই। এধারে পিলে লিভার দুই-ই বেশ ডাগর। খুব সাবধানে রাখতে হবে। দুধ দেবার আর চেষ্টা করবেন না এখন, লিভারের যা অবস্থা– সইতে পারবে না। ফলের রস মিছরির জল– এইসব খাওয়ান। ওষুধ দিচ্ছি দুরকম– তবে ওষুধের চেয়ে পথ্যির দিকেই মন দিতে হবে বেশি। পাৎলা সাবুর জল আর মিছরির জল, এই-ই এখন চলুক। নাড়াচড়া করতে যাবেন না–যে কোন সময়ে হার্টফেল করতে পারে– দেহের এমনি অবস্থা। এতটা পথ এল কী করে তাই ভাবছি।’
এর পর দশবারোদিন ধরে চলল– বলতে গেলে যমে-মানুষে টানাটানি। শ্যামা দিনরাতই আগলে বসে রইলেন। হেম অফিসের ফেরৎ এসে কাছে বসলে তিনি একটু উঠতেন। তাও হেমকে সন্ধ্যা-বেলাই ডাক্তারের কাছে ছুটতে হত দুদিন একদিন অন্তর। ভোরে তার সময় হলেও ডাক্তার ভোরে উঠবে কেন? কনকের ওপর সারা সংসার পড়েছে– বাড়ির পাট বাসন-মাজা রান্না সব। দুপুর ছাড়া সে কাছে এসে বসবার ফুরসৎ পেত না। সেই সময়ই যা একটু ছাড়া পেতেন শ্যামা। প্রাতঃকৃত্য থেকে স্নানাহার একসঙ্গে সেরে নিতে হ’ত। ঐ সময়েই ঘণ্টা দুই একটু গড়িয়েও নিতেন তিনি। রাত্রে ঘুম হত না। একটি প্রদীপ জ্বেলে রেখে রুগ্ন ছেলেকে নিয়ে একা জেগে বসে থাকতেন। জেগে না থেকে উপায়ও নেই। অজ্ঞান অচৈতন্য ছেলে মুহূর্মুহূ শুধু হাঁ করছে আর ঠোঁট নাড়ছে অর্থাৎ জল। সাবুর জল ফলের রস মিশ্রীর জল–সবই ঝিনুকে ক’রে ক’রে খাওয়াতে হচ্ছে। অচৈতন্য অবস্থায় খাওয়া। ডাক্তার শাসিয়ে গেছেন, ‘খুব সাবধানে পথ্যি দেবেন– এ অবস্থায় বিষম লাগলেই বিপদ!’
দিনের বেলা আসে অনেকেই। তরু আর হারান এসে একদিন লেবু আঙুর দিয়ে গেছে। বড় জামাই এসে খবর নিয়ে যান প্রায় নিত্য। নিত্যই এক জোড়া করে কমলালেবু এনে রেখে যান। এ ছাড়া ডাক্তারের ফল খাওয়াবার নির্দেশ মানা যেত না। সাবু, মিশ্ৰি ছাড়া আর কিছু কিনতে দেন নি শ্যামা। ফলের কথায় বলেছিলেন, ‘ওসব বড়লোকের জন্যে ব্যবস্থা। ফল না খেলে যদি ছেলে সারবে না– তবে ডাক্তার দেখাচ্ছি কেন? রাশ রাশ ওষুধই বা কিসের জন্যে? না, অত পারব না। তা ছাড়া, কমলালেবুতে ঠাণ্ডা করে– আমরা দেখেছি কবরেজরা খেতে দিত না। জ্বর থাকতে লেবু খেলে মুখে ঘা হয়!
কিন্তু পরে কিনে দিয়ে যেতে খুব আর আপত্তি করেন নি।
যারাই আসত দিনের বেলা। একদিন পাল্কি ক’রে এসে মঙ্গলাও দেখে গেলেন। একেবারেই অথর্ব হয়ে পড়েছেন আজকাল। চুঁচিবাইয়ের দরুন জল ঘেঁটে ঘেঁটে হাতে- পায়ে হাজা দগ্দগ্ করছে। ফিসফিস করে বলেন ‘আসতে কি দেয়! সবস্ব ছেলেরা বার করে নিয়েছে, এখন তো ওদের এন্তাজারি! একটা পয়সা খরচ করতে গেলেও ওদের কাছে হাত পাততে হয়। আর হাত পাতলেই কী চোখ-রাঙ্গানি বাবুদের– পারব না অতসব, অত লবাবি চলবে না! এইসব। কী করব– হাতি যখন দঁকে পড়ে ব্যাঙেও তাকে চাট্ মারে!’ তারপর গলাটা আরও একটু নামিয়ে বললেন, ‘কী জানিস বামনি, আছে, এখনও কি দুচার টাকা নুকুনো নেই মনে করিস– তা আছে। কিন্তু তবুও ছেলেদের কাছে চাইতে হয়। না চাইলেই সন্দ করবে যে, তবে তো মা-মাগীর কাছে এখনও দুপয়সা আছে– আর অমনি ভাগাড়ে গরু পড়ার মতো চিলশকুনের দল এসে পড়ে দুয়ে বার করে নেবে। এই শেষ বয়সে একটা পয়সার আজির হয়ে পড়ব নাকি? এখন কতদিন বাঁচতে হবে তার ঠিক কি?’
তারপর মুখ বাড়িয়ে হাতে ক’রে বয়ে আনা পিকদানিটায় খানিকটা পিক ফেলে বললেন, ‘দেখলি তো বামনি– তখন যদি ছেলেটাকে ঘরজামাই দিতিস তাহলে আজ আর ওর এই হাল হত না। সেই যে বলেছিলাম তোকে–মনে আছে? সে মেয়ের তো বে হয়ে গেছে। বে দিয়েই তো বাপ মিসে অক্কা– এখন জামাইয়ের বাপ, মা, ভাই ঘরে এসে জুড়ে বসে রাজত্ব করছে, তাদেরই যথাসব্বস্ব। জামাইকে পোষ মানিয়ে পর করে নেবার তো আর সময় হল না– তার বাপমায়ের দিকে টান ষোল আনাই থেকে গেল যে মেয়ে শাশুড়ীর ঘর করতে গেলে দুঃখু পাবে বলে এত কাণ্ড করলে মিসে, সেই মেয়েই এখন উঠতে বসতে শাশুড়ীর ঠোনা খাচ্ছে! তুই যদি দিতিস তা’লে তোরও আজ অমনি দম্ভজ্জি বজায় থাকত।’
তারপর একটু থেমে বললেন, ‘তোর কপাল তো ভাল নয়– বারবার তো দেখছিস। তোর উচিত ছিল দিয়ে দেওয়া। পরের কপালে ছেলে ঠিক থাকত। এখন গেল তো– ছেলের রূপের দেমাক, নেকাপড়ার দেমাক কিছুই তো রইল না আর– এখন কেঁদে কেঁদে মর্। আর কী হয় তাই দ্যাখ। এই রকম শক্ত অসুখ হলে শুনেছি একটা অঙ্গ নিয়ে তবে রোগ যায়। ভাল যদিবা হয়, আস্ত ছেলে ফিরে পাবি কিনা সন্দেহ!
শ্যামা এতক্ষণে কথা বলার অবকাশ পেলেন, ‘ওসব কথা বলবেন না মা, বরং আশীর্বাদ করুন ছেলে ভাল হয়ে উঠুক!’
‘ও কী লো, বামুনের ছেলেকে আশীর্বাদ করে কি অকল্যেণ টেনে আনব আমার ঐ শত্তুরগুনোর মাথায়! বেশ বললি তো! ভগবানকে ডাক, তাঁর কাছে মাপ চা। গেল জন্মে এ জন্মে ঢের পাপ করেচিস– তাই এত দুগ্গতি। ভগবানের কাছে মানৎ কর তবে যদি গোটা ছেলে ফিরে পাস!’
তারপর আঁচল খুলে দুটো টাকা বার করে কান্তির বিছানার পাশে রেখে বললেন, ‘তোর অভাব নেই আর– তবু আমার একটা কৰ্ত্তব্য আছে তো। সাবু, মিছরি কিনে দিস ছেলেটাকে। পেটের শত্রুরদের ভয়ে ওখান থেকে কিনে আনতে পারি নি– তাহলেই জেনে যাবে হাতে টাকা আছে। আর একবার টাকার গন্ধ পেলে হয়, ছিনে জোঁকের মতো ছুটে আসবে অমনি!’
আরও অনেকেই খবর পেয়ে এসে দেখে গেল।
মল্লিক-গিন্নীও দুপুরবেলা এসে বসেন।
কিন্তু রাত্রে কেউ থাকে না। একা একটা ঘরে মিটমিটে আলোতে জেগে বসে থেকে অজ্ঞান কঙ্কালসার ছেলের মুখের দিকে চেয়ে বুক কেঁপে ওঠে– বহুদিনের শুকিয়ে যাওয়া কান্না গলার কাছে এসে আকুলিবিকুলি করতে থাকে, ছেলের অকল্যাণের ভয়ে কাঁদতেও পারেন না।
মঙ্গলার কথাটা মনে হয়ে আরও বুকের মধ্যেটা যেন হিম-হিম ঠেকে। তিনি কি আর সত্যিই গোটা ছেলেকে ফিরে পাবেন? অমন রূপবান, কান্তিমান ছেলে তাঁর।
হে মা সিদ্ধেশ্বরী! এ কী করলে মা!
আর তখনই মনে হয় ছোট খোকাটাকে বোনের কাছ থেকে আনিয়ে নেবেন এবার। বিশ্বাস নেই আর কাউকেই।
॥৩॥
এখানে আসবার ঠিক বারো দিন পরে ভাল করে জ্ঞান হল কান্তির। চোখের চাউনি থেকে ঘোলাটে ভাবটা চলে গিয়ে পরিচয়ের দীপ্তি ফিরে এল। মনে হল তাকে ঘিরে মা-দাদা-বৌদির বসে থাকবার কারণটাও বুঝতে পারল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে দৃষ্টিতে ফুটে উঠল একটা নিরতিশয় লজ্জা। যেন সেই লজ্জা থেকে পালিয়ে বাঁচবার জন্যই আবার চোখ বুজল সে।
শ্যামা তখনই সাগ্রহে কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কনক বেশ একটু দৃঢ়-কণ্ঠেই নিবৃত্ত করল তাঁকে, ‘এখন নয় মা, আরও কিছুদিন যাক, দুর্বল শরীর মাথাও দুর্বল– এখন কি কোন কথা ভাল করে গুছিয়ে ভাবতে পারে? সেটা ভাবতে দেওয়াও ঠিক নয়। আর একটু সারুক শরীরটা!’
শ্যামা তা বুঝলেন, চুপ করে গেলেন খানিকটা।
আরও চার-পাঁচ দিন পরে কথা কইল সে। জল চেয়ে খেল, খাবার চাইল।
কিন্তু সেই সময়ই তার সঙ্গে কথা কইতে গিয়ে প্রথম আবিষ্কার করলেন শ্যামা যে সে কানে ভাল শুনতে পাচ্ছে না। মুখের দিকে চেয়ে থাকলে ঠোঁট-নাড়া দেখে তবু বোধ হয় খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে, জবাবও দিচ্ছে কিছু কিছু–কিন্তু মুখ ফিরিয়ে কিছু বললে বা শিয়রের দিক থেকে কোন প্রশ্ন করলে একটা উত্তরও পাওয়া যাচ্ছে না। রীতিমতো চেঁচিয়ে বললে তবে শুনতে পাচ্ছে।
.
পরের দিনই ফকির ডাক্তারকে খবর দিয়ে পাঠালেন শ্যামা। তিনি এসে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, ‘ভয় নেই– ও কুইনাইনের এফেক্ট, সারতে দেরি লাগবে। ওর প্রাণটা যখন ফিরিয়ে আনতে পেরেছি তখন কানটাও ফেরাতে পারব। তা ছাড়া একটু জোর পেলে না হয় কলকাতার কলেজে নিয়ে যাবেন, সেখানে বড় বড় ডাক্তার আছে, ভাল চিকিৎসা হলে সেরে যাবে। শরীরে রক্ত নেই, একটু দুধ পেটে পড়ে নি, শুধু খানিকটা করে র কুইনাইন খেয়েছে তার আর কী হবে বলুন।…. না, ও ভাল হয়ে যাবে তবে সময় লাগবে ঢের–তা বলে দিচ্ছি। রোগটি খুব সহজ হয় নি ওর, এটা মনে রাখবেন। পিলে-লিভার এখনও জেঁকে বসে আছেন। জ্বরও– এখন তো তিনচার দিন অন্তর আসছে, ওটা কমে গেলেও দেখবেন একাদশী আমাবস্যে পুন্নিমেতে গা-গরম হবে এখন দু-চার বছর। তবে বেলপাতার রস শিউলিপাতার রস এইসব টোকা খাওয়াবেন– খরচ নেই, অথচ উপকার হবে।
কিন্তু ফকির ডাক্তার যতই আশা ও আশ্বাস দিয়ে যান–জ্বর আসবার দিনগুলোর মধ্যেকার সময়টা দীর্ঘতর হয়ে এলেও কানের কোন উপকার হল না। বরং আরও যেন সেটা শ্যামার যত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও বেশি কালা হয়ে যেতে লাগল দিন দিন। কনকের চোখ এড়ায় নি। সে চুপি চুপি হেমের দৃষ্টি আকর্ষণ করাল সেদিকে। বলল, তুমি আর দেরি করো না– বড় কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। ফকিরবাবু যা জানেন তা করেছেন, এর বেশি আর ওর কাছে আশা করাও অন্যায়!
হেমও লক্ষ করল ব্যাপারটা। কিন্তু বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার মতো অবস্থা তাদের নয়। নিয়ে গেল সে মৌড়ীর হাসপাতালেই। তাঁরা দেখে বললেন, ‘কানের পর্দা তো ঠিক আছে, কালা হবার তো কথা নয়। সম্ভবত দুর্বলতার জন্যেই হয়েছে, একটু ভাল করে খাওয়ান দুধ-টুধ– তাহ’লেই ভাল হয়ে যাবে। তাড়াহুড়োর কাজ নয়– অত ব্যাড টাইপের ম্যালেরিয়া হয়েছিল বলছেন– তাহলে সারতে সময় লাগবে বৈকি!’
ভাল করে কীই বা খাওয়াতে পারে ওরা। খুব অসুখের সময় তবু পাঁচজন ফলটল দিত– এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ভেবে হেম একপো করে দুধের রোজানি করে দিল। তাও মায়ের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া করেই। শ্যামা রুক্ষকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘কেন, কিসের জন্যে– ও ছেলে আমার কী স্বগে বাতি দেবে তাই শুনি। ওর ইহকাল পরকাল সব গেছে। আমার সর্বনাশ করে ঘরে-বাইরে মুখ পুড়িয়ে পঙ্গু হয়ে এসে বসলেন চিরকালের মতো– একটা বিধবা মেয়ে নিয়ে জ্বলে মরছি আবার একটা হয়ত পুষতে হবে। তার আবার অত কেন–একগাদা পয়সা খরচ করে দুধ খাওয়ানো!
হেম বললে, ‘তোমার যেমন কথা। বেটাছেলে বিধবা মেয়ের মতো বসেই বা খাবে কেন। লেখাপড়া যদি আর না-ই করে, তা ব’লে রোজগার করে খেতে পারবে না? কানটা যদি যায় বরং সেই একটা ভাবনার কথা। ওটা যাতে ফিরে পায়, সেটা আগে দেখা দরকার নয়?’
তাতেও হয় নি অবশ্য। শেষ অবধি বলতে হয়েছে হেমকে যে দুধের টাকা সে আলাদা দেবে, মাসের খরচ ছাড়া। হেম যে মাইনের সব টাকা মাকে দেয় না– এ শ্যামা জানেন। হেমও গোপন করে না। মাসে কুড়ি টাকা করে দেয় সে– এ ছাড়া সে কত রাখে, ঠিক কত তার এখন আয় তা শ্যামা জানেন না। এ নিয়ে প্রচ্ছন্ন অনুযোগ যে করতে যান নি শ্যামা তা নয় কিন্তু সুবিধা হয় নি, হেম স্পষ্টই জবাব দিয়েছে, ‘এই থেকেই তো বাঁচিয়ে তুমি টাকা জমাচ্ছ, তেজারতি খাটাচ্ছ। আর দরকার কী? সবই বা ধরে দেব কেন? আমারও তো আপদ-বিপদ আছে।’
আর কিছু বলতে পারেন নি শ্যামা। আজও কিছু বলতে পারলেন না। হয়ত বলারও কিছু নেই। হয়ত এটাই চেয়েছিলেন। টাকাটা ওপক্ষ থেকে বার করার জন্যেই এত কঠিন হয়েছিলেন তিনি।
ছেলে একটু সুস্থ হয়ে উঠতেই– অর্থাৎ উঠে বসবার মতো হতেই শ্যামা তাঁর নিরুদ্ধ প্রশ্নের স্রোতকে ছেড়ে দেন।
‘কেন এমন হ’ল? কী করেছিলি যে ওরা এত বড় শাস্তিটা দিলে? তুই এখানে চলে এলি না কেন? এমন হয়েছিল যখন তখনই বা চলে এলি না কিসের জন্যে? কি এত লজ্জা তোর? খুন-জখম করেছিলি না রাহাজানি করেছিলি? কী জন্য তুই আমার এত বড় সর্বনাশটা করলি! এখন যদি কানটা তোর না সারে? যদি জন্মের মতো কালা হয়ে যাস? লেখাপড়া তো গেলই– এরপর যে ভিক্ষে করে খেতে হবে তা হলে! এমন করে শরীরটা পাত করলি কী কারণে? এমন দুর্বুদ্ধি কেন হল তোর আমার মাথাটা চিবিয়ে খেতে!’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রশ্নগুলো বেশ চেঁচিয়েই করেন শ্যামা। কান্তির শ্রুতিগম্য করেই। শুনতে যে পেয়েছে সে সম্বন্ধেও সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না। কারণ প্রতিক্রিয়া জাগে সঙ্গে সঙ্গেই। কথা উঠলেই সেই যে মাথা হেঁট করে–সে মাথা আর তোলে না কিছুতেই। কিন্তু উত্তরও দেয় না। একটি কথাও বলে না। দিনের পর দিন সহস্র প্রশ্ন তেমনি নিরুত্তরই থেকে যায় সেই প্রথম দিনটির মতো। ক্রমশ রুক্ষতর হয়ে ওঠে শ্যামার মেজাজ– ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। কণ্ঠের স্বর ও প্রশ্নের ভঙ্গি দুইই কঠোরতর হয়ে ওঠে। নির্মমভাবে বাক্যবাণ প্রয়োগ করেন তিনি– আর এই জিনিসটা প্রয়োগে তিনি সিদ্ধহস্ত। তবু কান্তির কণ্ঠ থেকে একটি শব্দমাত্র উচ্চারিত হয় না। সমস্ত প্রশ্নবাণই নিশ্ছিদ্র নীরবতার গ্রাচীরে প্রতিহত হয়ে ফিরে আসে। এক এক সময় প্রায় ক্ষেপে ওঠেন শ্যামা, গায়ে হাত তুলতেও যান– কনক কাছে থাকলে হাত ধরে প্রতিনিবৃত্ত করে। কিন্তু কান্তি চুপ করেই থাকে, শুধু দুই চোখ দিয়ে এই সময়গুলোয় নিঃশব্দে যে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে অবিরল ধারায়– তাইতে বোঝা যায় যে শ্যামার কথাগুলো যথাস্থানে গিয়েই পৌচেছে– কথাগুলোর প্রয়োগ কিছুমাত্র ব্যর্থ হয় নি। বাইরের নীরবতার চর্ম ভেদ করে সে বাক্যবাণ মর্মে গিয়ে বিঁধেছে।
অবশেষে এক সময় হার মানেন শ্যামা।
হাহাকার করে ওঠেন নিজে নিজেই। ললাটে করাঘাত করতে থাকেন বার বার। গাল পাড়েন তাঁর চিরন্তন ভাগ্যকে আর নবতম দুর্ভাগ্যের উপলক্ষ তাঁর এই ছেলেকে। সে সময় সমস্ত রকম শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে যায় তাঁর মুখের ভাষা। কুৎসিত ইতর গালিগালাজ বেরোয় মুখ দিয়ে। দীর্ঘকাল পল্লীগ্রামে থাকার ফলে যা শুনে এসেছে, কিন্তু এতকাল কিছুতেই উচ্চারণ করতে পারেন নি– এমন সব ভাষা। সে সময় কনকের সামনে থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। হেম প্রায়ই সে সব সময়গুলোয় থাকে না– তার উপস্থিতিকালে অপেক্ষাকৃত ধৈর্য ধরেই থাকেন শ্যামা–থাকলে সে ধমক দেয়, নয় তো অর্ধবিহ্বল ভাইকে হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দেয় সেখান থেকে।
গালাগাল দেন তিনি রতনকেও।
সে সময় এ খেয়ালও থাকে না যে তার আসল পরিচয় এতকাল সযত্নে পুত্রবধূর কাছে গোপন করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। মনে থাকে না যে এ গালাগাল তাঁদের গায়েই এসে পড়েছে। সে স্ত্রীলোকটার যে পরিচয় আজ তিনি উদ্ঘাটিত করছেন, সে পরিচয় জানার পর কোন ভদ্র ব্রাহ্মণ সন্তান পাঠানো বাপ-মা-অভিভাবকদের পক্ষে অমার্জনীয় অপরাধ। এ ধরনের মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা স্বীকার করার কোন অধিকার পর্যন্ত তাঁদের নেই। হিতাহিত-জ্ঞানশূন্য হয়েই গালাগাল দেন, তিনি তাঁর ছেলের সর্বনাশরূপিণী সেই নারীকে। দেখতে শুনতে যদি না-ই পারবে, যদি নজর রাখা সম্ভবই না হরে– তবে কেন সে এমন করে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল তাঁর ছেলেকে। আর যখন বুঝল যে ওখানে রাখা আর উচিত নয়– কেন সে জোর করে পাঠিয়ে দেয় নি তার ছেলেকে তাঁর কাছে! কেন? কেন? কী এমন শত্রুতা করতে গেছলেন তিনি তার? কী তার পাকাধানে মই দিতে গেছলেন– কিম্বা বুকে বাঁশ দিয়ে ডলেছিলেন!’
অভিসম্পাত করেন তাকে– ‘সর্বনাশ হোক। সর্বনাশ হোক। যে পয়সার অহঙ্কারে এমন ধরাকে সরা দেখা, সে পয়সা যেন একটিও না থাকে– মালা হাতে করে যেন পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াতে হয়। সর্ব অঙ্গ থাকতে যেন চোখটি যায় আগে। হাতে যেন মহাব্যাধি হয়।’ ইত্যাদি–
তবুও কোন কথা বলে না কান্তি। শুধু নীরবে অশ্রুপাত করে বসে বসে।
উত্তর দিতে পারে না কান্তি তার কারণ উত্তর দেবার মতো কিছু নেই ওর। কিছুই বলবার নেই। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা সম্ভব নয় সে সুগভীর কলঙ্কের ইতিহাস। অন্তত ওর পক্ষে সম্ভব নয় এটুকু লজ্জা ও ঘৃণা তার এখনও অবশিষ্ট আছে।
যা ঘটেছিল তা বলবার আগে ওর আত্মহত্যা করা উচিত ছিল। এমনিই হয়ত করা উচিত ছিল, অনেক আগেই,– এই কৈফিয়ৎ দেবার মুহূর্ত উপস্থিত হবার আগেই উচিত ছিল এ-পৃথিবী থেকে সরে যাওয়া, কিন্তু পারে নি সে। আসলে বড় দুর্বল সে ভেতরে ভেতরে। দুর্বল বলেই পারে নি সেদিন আত্মহত্যা করতে। দুর্বল বলেই ভাগ্য ওর জীবন নিয়ে এই মর্মান্তিক খেলা খেলতে পারল।….
ঠিকই বলছেন মা। সেই সর্বনাশিনীই ওর এই দুর্গতির প্রধান কারণ–কিন্তু ওর নিজের দিক থেকেও দায়িত্ব কাটিয়ে ফেলবার উপায় নেই যে। তার সমস্ত অন্যায়, সমস্ত অপরাধ একদিকের পাল্লায় তুললেও ওর নিজের অপরাধের বোঝা কিছুমাত্র হাল্কা হয় না– ওর দিকের পাল্লাও তেমনি ভারী হয়ে ঝুঁকে থাকে। ওর অন্যায়ও তো কম নয়। বরং আরও বেশি, আরও অমার্জনীয়। ওর অন্তরের দিকে তাকালে যতদূর দৃষ্টি যায়– সেখানেও তো কলুষ কম জমা হয়ে নেই। দেবার মতো কৈফিয়ৎ বরং তার কিছু আছে– কারণ সে যা তাই, তার বেশি নিচে তো নামে নি। কোন কৈফিয়ৎ নেই ওরই, এই জঘন্য আচরণের কোন জবাব নেই। ওর নিজের মনেই যে সীমাহীন গ্লানি আর লজ্জার ইতিহাস লিখিত হয়েছে, যে অপরাধবোধ রয়েছে পুঞ্জীভূত– তারপর আর কাউকে দোষ দিতে যাওয়া, অপরাধের দায়িত্বটা আর কারুর ঘাড়ে চাপাতে যাওয়া আরও একটা বিপুলতর অন্যায় আর একটা অক্ষমণীয় অপরাধ হয়ে উঠবে
না, দোষ ও দেবে না রতনদিকে। যদিও সে-ই হাত ধরে নামিয়ে নিয়ে গেছে এই সর্বনাশের দিকে, অধঃপতনের দিকে। কিন্তু কান্তিও তো বাধা দেয় নি কিছু, কোন প্রতিবাদ করে নি। নিজের জন্ম, নিজের অবস্থা– আত্মীয়স্বজন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সব কিছুই তো ভুলে বসেছিল সেদিন। ওরই তো বাধা দেওয়া উচিত ছিল– এমন অস্বাভাবিক, অন্যায় পথে পা দেবার আগে। এটুকু জ্ঞান যে সেদিন তার না ছিল তাও তো নয়– একেবারে সরল শিশু ছিল না সেদিনও। এটা ঠিক যে, এই গত কমাস একরকম বনবাসে এমন একা পড়ে থাকতে থাকতে– রোগশয্যায় একা শুয়ে ছট্ফট্ করতে করতে যতটা গুছিয়ে ভাবতে শিখেছে সে, যতটা বয়স তার দেহের তুলনায় বেড়ে গেছে– ততটা জ্ঞান অভিজ্ঞতা চিন্তাশক্তি কিছুই ছিল না সেদিন, তবু মোটামুটি ন্যায়-অন্যায় বোধ একটা ছিল বৈকি। কাজটা যে ভাল নয়, তাও সেদিন সে জানত। তাকে মানুষ হ’তে হবে, লেখাপড়া শিখতে হবে– সেইজন্যই তাকে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে– এসবও জানত। তার মা দাদা ভাইবোনেরা তার মুখ চেয়ে আছেন, সেটাও সেদিন অজানা ছিল না।…তবে?
বাধা সেদিন দেয় নি তার কারণ সেই আপাতরমণীয়, আপাতমধুর সর্বনাশের পথে নামতে তার তরফ থেকেও বুঝি উৎসাহের অভাব ছিল না।
মনে আছে তার– কিছুই ভোলে নি। প্রতিটি দিনের ইতিহাস তার মনে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বিপলের। মনে গাঁথা আছে প্রতিটি ঘটনা। চরম সর্বনাশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ইতিহাস।
এ ইতিহাস শুরু হয়েছে অনেকদিন– দু-তিন বছর আগেই।
সেই দাদার বিয়ের সময় থেকে। কিম্বা বলা যায় তারও আগে থেকে।
তবে ঐ সময়টায়ই প্রথম সে রতনদির আচরণে একটা পরিবর্তন লক্ষ করেছিল। অদ্ভুত লেগেছিল তার ব্যাপারটা : অকারণে লজ্জাও হয়েছিল একটু। এখানে যে দিন আসবে– দাদার বৌভাতের দিন–হঠাৎ নিজে হাতে ওকে সাজাতে বসলেন রতনদি। এরকম কখনও করেন নি। পরিবর্তনটা শুরু হয়েছে তার আগেই অবশ্য, কিন্তু তখন অতটা বুঝতে পারে নি কিছুদিন ধরেই পাগলের মতো ওর জন্যে জামার ওপর জামা করাতে দিচ্ছিলেন, ধুতির ওপর ধুতি কিনছিলেন। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনেই। আদ্দি আরোয়া রেশমের পাঞ্জাবি– দেশি ফরাসডাঙ্গার দামি মিহি ধুতি। সেই সঙ্গে মুসলমান দর্জি ডেকে চুড়িদার পাজামা-আচকান।
অবাক হয়ে যেত কান্তি, কিছুই বুঝতে পারত না রতনদির মতিগতি। প্রতিবাদ করতে যেত প্রথম প্রথম, ব্যাকুলভাবে বাধা দেবার চেষ্টা করত, ‘এ কী করছেন রতনদি, মিছিমিছি কেন এত খরচ করছেন বলুন তো! আমার তো একগাদা জামাকাপড় রয়েছে। একেই তো কত খরচ করাচ্ছি আপনার, তার ওপর অকারণে এ সব করছেন কেন?’
রতনদি কিন্তু উড়িয়ে দিতেন কথাটা। কখনও ধমক দিতেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা– হয়েছে, যাও, তোমাকে আর অত পাকা-পাকা কথা বলতে হবে না।’ কখনও বা ওর কাঁধে হাত রেখে ওর মুখের দিকে দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে চেয়ে বলতেন, ‘কী হবে আমার এত পয়সা রে? কার জন্যে রেখে যাব? তোকে সাজিয়ে যদি আমার সুখ হয়, করলুমই নয় দুটো পয়সা খরচ। তোর কি?’ আবার এক একদিন বলতেন, ‘সুন্দর চেহারাতেই তো সুন্দর পোশাকের দাম। এই তো তার সার্থকতা। আমাদের আর কি– দেখেই তৃপ্তি।’
ওঁর মনের ভাবটা ঠিক ধরতে পারত না কান্তি, আরও কুণ্ঠিত, আরও অপ্রতিভ হয়ে পড়ত।
সে যে এত সুন্দর দেখতে তাও তো আগে সে জানত না। রতনদির মুখে বার বার শুনেই কতকটা সচেতন হয়েছিল সে। ইদানীং আয়নায় নিজেকে দেখে ভাববার চেষ্টা করত সত্যিই সে সুন্দর কিনা। আবার ভাবত রতনদিটা পাগল। সুন্দর সুন্দর করে এত মাথা ঘামাবার কী আছে। রতনদিও তো কী সুন্দর দেখতে। নিজেকে সাজালেই তো পারে, আর সাজাচ্ছেও তো–তবে আর কি!
আগে কুণ্ঠিত হত সে শুধু খরচের কথাটা ভেবেই। কিন্তু ঐদিন– দাদার বৌভাতের দিন থেকে লজ্জার ও সঙ্কোচের আরও একটা কারণ দেখা দিল। কেন লজ্জা তা বলা মুশকিল ছিল সেদিন– আর সেই জন্যেই কথাটা কাউকে বলতে পারে নি। প্রথমত বিয়ের দিন তো যেতেই দিলেন না রতনদি, পড়াশুনোর ক্ষতি হবে বলে; দাদার বিয়েতে একদিন বরযাত্রী গেলে এমন কি ক্ষতি হতে পারে তা তার মাথাতে যায় নি সেদিন, মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণই হয়েছিল। বৌভাতের দিন সকালেই যাবার কথা, কী খেয়াল গেল রতনদির, তাঁর সেই অত শখের দেড় ঘণ্টা ধরে চান তাড়াহুড়ো করে সেরে এলেন ওকে সাজাতে। নিজে হাতে পরিপাটি করে সাজিয়ে ওর চিবুকটি ধরে কিছুক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন,’সত্যি, কী সুন্দর দেখাচ্ছে ভাই তোমাকে কান্তি, যেন সত্যিকারের রাজপুত্তর!’
আর তারপরই দুহাতে ওর মুখটি ধরে কাছে এনে একটি চুমো খেয়ে বলেছিলেন, ‘যাও, সাবধানে যেও। সকাল ক’রে চলে এসো। দারোয়ান যাচ্ছে সঙ্গে, আমার হয়ে ও-ই নৌকতা করবে।’
লজ্জার পরিসীমা ছিল না সেদিন, কিন্তু তবু সে নিতান্তই নির্দোষ গ্লানিহীন লজ্জা। অনেকটা সুখের ও আত্মপ্রসাদেরও বটে। রতনদির মাথাটা খারাপ এই কথাই বার বার বোঝাতে চেয়েছিল সে নিজেকে। সেই সঙ্গে এ কথাটাও মনে উঁকি মেরেছিল যে সে সুন্দর দেখতে– আর রতনদি সত্যি-সত্যিই ছোট ভায়ের মতো দেখেন ওকে।
তবু– মনের মধ্যে অস্বস্তিও একটা কোথায় ছিল।
কেমন একটু ভয়-ভয়ও করেছিল যেন সেদিন। নাম-না-জানা ভয়। মনে হয়েছিল এতটা ভাল নয়, এতটা সইবে না। হয়ত সকলের চোখ টাটাবে, রতনদির বাবাও বিরক্ত হবেন হয়ত– ওর জন্য এত খরচ করছে জানতে পারলে।
কিন্তু রতনদির যেন সব ভয়ডর হঠাৎ ঘুচে গেল। সমস্ত হিসেবের বাঁধ গেল ভেঙ্গে। সাবধান হওয়া তো দূরের কথা, এর পর থেকে বড্ড বাড়াবাড়ি শুরু করলেন। প্রত্যহই ওকে নিজে হাতে সাজাতে যেতেন– ভাল ভাল দামি দামি পোশাক পরাতেন। নিতান্ত কান্তি খুব বিদ্রোহ করত বলে– ইস্কুলের সময়টা পাগলামি একটু বন্ধ রাখতেন। রতনদিদের পুরনো ঝি মোক্ষদাও ওর পক্ষে যোগ দিয়েছিল, তাই আরও সংযত হয়েছিলেন খানিকটা। মোক্ষদা বলেছিল, সত্যিই তো বাপু, তুমি যেন পাগল হয়েছো তাই বলে ও তো আর হয় নি যে অমনি লব-কাত্তিক সেজে ইস্কুল পাঠশালে যাবে। অপর ছেলেরা ক্ষেপিয়ে শেষ করবে যে জামাইবাবু বলে।’
কিন্তু ইস্কুল থেকে এলে আর রক্ষে নেই। ইস্কুলের জামা-কাপড় ছেড়ে মুখহাত ধুয়েই ভালভাল জামাকাপড় পরতে হবে, সেজেগুজে রতনদির কাছে বসতে হবে খানিকটা। এ সময়টা তাঁরও প্রসাধনের সময়, কান্তিকে সাজিয়ে বসিয়ে রেখে নিজে সাজতেন––কোনদিন বলতেন, ‘চলো ছাদে বেড়াতে যাই।’ ছাদে গিয়ে ওর একটা হাত ধরে কিংবা কাঁধে হাত দিয়ে পায়চারি করতেন। কোনদিন বা শুধুই মুখোমুখি বসে গল্প করতেন। ইস্কুল থেকে ফিরে বেড়াতে যাওয়া বা খেলাধুলোর পাট ছিল না কান্তির– পাড়াটা খারাপ বলে বিকেলের দিকে বেরোতে নিষেধ করতেন এঁরা, তাছাড়া তার নিজেরও ভাল লাগত না। ইস্কুলের ছেলেরা আগে আগে ওর ঐ পাড়ায় থাকা নিয়ে নানারকম বাঁকা মন্তব্য করত, ওর সম্বন্ধে একটা হীন ধারণাও করে নিয়েছিল, সেটার পুরো কারণটা না বুঝলেও ঐ পাড়ায় বাস করা যে কোন ভদ্রসন্তানের পক্ষে শোভন নয় এটা সে বুঝেছিল। তাই যেটুকু না বেরোলে নয় সেইটুকুই শুধু বেরোত! আর পড়বার সময় তো সেটা নয়ই, মাস্টার মশাইরা বলতেন; ‘All work and no play makes Jack a dull boy’–রতনদিও বলতেন, ইস্কুল থেকে এসেই আবার বই নিয়ে বসতে নেই, ওতে পড়াশুনো এগোয় না। মাথাকে বিশ্রাম দিতে হয় একটু।’
কিন্তু সন্ধ্যে হলে, যখন পড়াশুনোর সময় হত, তখনও রতনদি ওকে ছাড়তে চাইতো না। সঙ্গে সঙ্গে তেতলায় ওর ঘরে এসে বলতেন, ‘তুমি পড়, আমি তোমার সঙ্গে গল্প করব না, শুধু চুপ করে বসে থাকব!’
ওর ওপরের ভোল পালটে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। সে মেঝেতে পাতা তোশকের বিছানা আর নেই (যদিচ সেই শয্যাতে শুয়েই কান্তির প্রথম মনে হয়েছিল সুখস্বর্গ!), সে জায়গায় একজনের মতো বোম্বাই খাট এসেছে, গদি তোশক ঝালর-দেওয়া বালিশে সাজানো হয়েছে বিছানা। পড়বার জন্যে একটা ছোট টেবিল চেয়ারও আনিয়ে দিয়েছেন রতনদি!
কান্তি গিয়ে চেয়ার টেবিলে বই খাতা নিয়ে বসলে রতনদি ওর পাশে বিছানার ওপর বসতেন। রতনদির বর নটার আগে আসেন না কোনদিনই। আগে আগে এ-সময়টা রতনদি বই পড়তেন শুয়ে শুয়ে– এখন আর বই ছোঁন না। ওঁর বর রাশীকৃত বাংলা বই কিনে পাঠিয়ে দেন, সে সব গাদামারা পড়ে থাকে। এখন ওঁর এই নতুন নেশায় পেয়ে বসেছে– হাঁ করে কান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা।
চুপ করে বসে থাকব বললেই কিন্তু আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। রতনদিও বসতে পারতেন না। দু’চার মিনিট পরেই উশখুশ করে উঠতেন, একথা সেকথা পাড়তেন। কান্তিরও অস্বস্তি লাগত, একটা মানুষ দুহাতের মধ্যে বসে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে– এ অবস্থায় বই-খাতায় ডুবে থাকে কী করে? ওর মাস্টার আসতেন সকালে; এক এক সময় কান্তির মনে হ’ত, মাস্টারমশাই যদি পড়াবার সময়টা বদলে দেন তো ভাল হয়। কিন্তু পাড়া খারাপ বলেই বোধ হয়– সন্ধ্যার দিকে তিনি আসতে চাইতেন না।
প্রথম প্রথম পড়ার ব্যাঘাত হত বলে এ ব্যাপারটা আদৌ ভাল লাগত না কান্তির ন’টা বাজলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচত। কারণ ন’টা বাজলেই ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক রতনদিকে নেমে যেতে হত নিচে। জামাইবাবুর আসবার সময় হত। কিছুদিন পর থেকে আর তত খারাপ লাগত না। তারপর এক সময় কান্তি আবিষ্কার করল যে তারও ভালই লাগে এই গল্প করাটা। ক্রমশ এমনও হল যে, রতনদি নিচে চলে গেলেও অনেকক্ষণ পর্যন্ত মন বসাতে পারত না পড়ায়। কেবলই মনের মধ্যে ঘুরেফিরে কিছুক্ষণ আগেকার কথাগুলোরই রোমন্থন চলতে থাকত। মনে হত বেশ মানুষ রতনদি। যেমন মিষ্টি কথা, তেমনি জমিয়ে গল্প করতে পারেন। যার ভাল হয় তার সব ভাল হয়। যেমন সুন্দর দেখতে তেমনি স্বভাবটিও সুন্দর। সত্যি দেখতেও কেমন চমৎকার, যখন সেজেগুজে বসেন তখন যেন মনে হয় পটে-আঁকা কোন ঠাকুর-দেবতার ছবি।… তারপর সময়ের হিসাবটাও যেতে লাগল গুলিয়ে, কোথা দিয়ে ঘড়ির কাঁটাটা ঘুরে নটার ঘরে আসত তা দুজনের কেউই টের পেত না। অসহিষ্ণু মোক্ষদা গলির মোড়ে ‘দাদাবাবু’র গাড়ির আওয়াজ পেয়ে যখন ওপরে এসে ঝঙ্কার দিয়ে উঠত–তখন খেয়াল হত ওদের।’কী গো তোমাদের আর কথার ঝুলি ফুরোবে না–না কি? ওদিকে মানুষটা এসে দেখতে না পেলে যে রগ্নিরস্ত পাতালস্ত করবে তার ঠিক আছে? গাড়ি এসে ভ্যাঁক্ ভ্যাঁক্ করতেছে তাও কি কানে শুনতে পাও না? একেবারে রুন্মত্ত হয়ে বসে গল্প করা যে দেখতে পাই– জ্ঞানগম্যি থাকে না একটু? এখনি তো রোপরে উঠে আসবে– ত্যাখন আমি কী জবাব দেব মানুষটাকে!’ চমকে উঠত রতনদি, ‘ওমা, নটা বেজে গেছে নাকি রে? কখন বাজল? টের পাই নি তো?’
‘তা টের পাবে কেন? নটা কি আজ বেজেছে– কুড়ি পঁচিশ মিনিট পার হয়ে গেছে দ্যাখো গে যাও! বলি তোমার না হয় পয়সার অভাব নেই, ঐ গরিবের ছেলেটার মাথা খাচ্ছ কেন বল দিকি অমন কড়মড়িয়ে চিবিয়ে? নেকাপড়া তো ওর শিকেয় উঠল দেখতে পাই একটা পাসও কি করতে দেবে না?’
‘তুই থাম মুকী। তোর বড্ড আসপদ্দা বেড়েছে।’ এই বলে, কান্তিরই ছোট আয়নাটায় মুখখানা দেখে নিয়ে আলতো হাতে চুলটা একটু ঠিক করে দ্রুত নেমে যেতেন রতনদি
মোক্ষদার এই তিরস্কারের দিনগুলোতে একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়ত কান্তি, অনুতপ্ত হ’ত একটু। জোর করে পড়ায় মন বসাবার চেষ্টা করত। কিন্তু মন আবার কখন বইখাতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে স্মৃতির রোমন্থন শুরু করত তা নিজেই টের পেত না। সত্যি কোথা দিয়ে নটা বেজে গেল– আশ্চর্য তো! এই তো মনে হচ্ছে একটু আগেই ছাদ থেকে ঘরে এসে ঢুকেছে ওরা!…. না, কাল থেকে একটু হুঁশ রাখতে হবে। রতনদিকে শাসনও করতে হবে একটু। রোজ রোজ মজার গল্প ফেঁদে ওর পড়া নষ্ট করা! আর কি বাজে কথাই বলতে পারে রতনদি, এত কথা পায় কোথা থেকে! তবে ঐ যে বইয়ের গল্পগুলো বলে– ওগুেলো কিন্তু বেশ। বঙ্কিমবাবুর বইগুলো এবার পরীক্ষা হয়ে গেলে পড়বে সে। রতনদির কিন্তু মনেও থাকে খুব– এক-এক সময় তো মুখস্থ বলে যায়। লেখাপড়া করলে ভাল হত।
এমনি করে কখন আবার ডুবে যায় সে রতনদিরই চিন্তায়, তা বুঝতেও পারে না। টেবিলের ওপর আলোটা জ্বলতে থাকে, বইখাতা মেলাও থাকে সামনে–ওর মুগ্ধ দৃষ্টি কিছুক্ষণ-পূর্বে-বসে-থাকা রতনদির শূন্য জায়গাটায় স্থির-নিবদ্ধ করে বসে বসে কত কী ভাবতে থাকে।