পঞ্চম পরিচ্ছেদ
অপু ডাক্তার দেখাইতে গিয়াছিল। ডাক্তারবাবু চশমাটা নাকের উপর ঠিকভাবে আঁটিয়া লইয়া বলিলেন—আসল কথা এই, বাংলাদেশের হিউমিড আরহাওয়া আপনার স্যুট করছে না। আপনি কিছুদিন বাংলার বাইরে থেকে দেখুন তো, মনে হয় সুস্থ হবেন।
কথাটা অপুর মনে ধরিল। মধ্যপ্রদেশে সে যে কয়েক বৎসর কাটাইয়াছে, সে সময়। তাহার অসুখবিসুখ কিছু হয় নাই। প্রচণ্ড উল্লাসে হৈ হৈ করিয়া প্রায় একটা বন্য জীবন যাপন করিয়াছে। বিহারের দিকে কোথাও গিয়া থাকিলে মন্দ হয় না।
রাত্রে শুইয়া একদিন সে হৈমন্তীর সঙ্গে পবামর্শ করিল। হৈমন্তী কিছুটা অবাক হইয়া বলিল– নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে চলে যাবে? অন্য কোথাও ভালো লাগবে তোমার?
—একেবারে যাবো না হৈমন্তী। আমাদের গা ছেড়ে পৃথিবীতে কোথাও গিয়ে শাস্তি পাব না। এ বাড়িও রইল, ইচ্ছে হলেই চলে আসব।
আসল কথা, অপুর বক্তে ভবঘুরেমি আবার জাগিয়া উঠিতেছে! স্থবিরতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিতেছে। অসুখের জন্যই সে যাইতেছে, এ কথা সম্পূর্ণ সত্য নহে! এক সমস্ত জীবন কাটানো তাহার পক্ষে অসম্ভব। এ তাহার পূর্বপুরুষদেব নিকট হইতে প্রাপ্ত। তাহাদের ভবঘুরে রক্ত তাহাকেও স্থির থাকিতে দিতেছে না। সে যাইবে, আমৃত্যু সে পৃথিবীর ধূলিতে পা ডুবাইয়া হাঁটিবে।
সামান্য সময়ের ভিতরেই অপু কিছু টাকা জোগাড় করিয়া ফেলিল। সবাই তাহাকে আগাম টাকা দেয়, তাহার বই পাইবার জন্য হাঁটাহাঁটি করে। সকালে দুপুরে বিকালে প্রচু্র চিঠি আসে। পাঠকেরা মুগ্ধ হইয়া লিখিতেছে। অপু সবার চিঠির উত্তর দেয়, সামান্য এক লাইনে চিঠি দেয়। প্রত্যেককে দীর্ঘ চিঠি দেওয়া সম্ভব নহে।
জীবন কানায় কানায় পূর্ণ হইয়া উঠিতেছে। আর কী প্রত্যাশা করিবার আছে? টাকা পাইতেছে এবং নাম করিয়াছে এটাই বড়ো কথা নহে–সে দুই চোখ ভরিয়া প্ৰাণ ভরিয়া জগৎটা দেখিয়া লইয়াছে। আরও দেখিবে। থামিবে না। গাৰ্হস্থ্য তাহার কপালে লেখা নাই।
টাকা আনিতে পাবলিশারের কাছে গিয়া একদিন জিজ্ঞাসা করিল–আপনার সন্ধ্যানে কোন ভালো জায়গা আছে বিহারের দিকে? ভাবছি কিছুদিন ওদিকে থাকবো।–
প্রকাশক হাসিয়া বলিল–আপনার ঘোরা বাতিকটা আর গেল না। হ্যাঁ, জায়গার খোঁজ দিতে পারি। অল্প কয়েকদিন থাকবেন, না–
–ভাবছি। একটা ছোটমতো বাড়ি পেলে কিনে নিতাম।
অপুকে তিনি একটা জায়গার কথা বলিলেন, কলিকাতা হইতে খুব দূর নহে, জামসেদপুরের কাছাকাছি। হাওড়া হইতে ট্রেনে মাত্ৰ ঘণ্টা পাঁচেক লাগে। পাহাড়ি এলাকা-অপুর ভালো লাগিবে, তিনি বার বার বলিতে লাগিলেন।
–জঙ্গল আছে? প্রাকৃতিক দৃশ্য কেমন?
—খুব ভালো। সে আপনি নিজের চোখে দেখবেন। আপনাকে তো চিনি। ভালো না হলে আমি আপনার কাছে ও জায়গার নাম করি। কখনও!
অপু আরও দু’পাঁচজনকে জিজ্ঞাসা করিল। অনেকে বিশেষ কোন খবর দিতে পারিল না। কেবল দুইজন লোক, যাদের কথার অপু মূল্য দেয়, জায়গাটার সম্বন্ধে প্রশংসা করিল।
প্রকাশকই খোঁজ করিয়া একটা বাড়ি বাহির করিলেন এবং অপু বিশেষ দেরি না করিয়া বাড়িটা কিনিয়া ফেলিল। কিনিবার জন্য সে নিজে যায় নাই, বাড়ির ছবি দেখিয়াছিল মাত্র। টালির ছাদওয়ালা ছোট সুন্দর বাড়ি। পাশে দুইটা ইউক্যালিপটাস গাছ পাশাপাশি যমজ ভাইয়ের মতো উঠিয়াছে। বহু পিছনে একটা পাহাড় দেখা যায়। ছবিতে বেশ একটা রহস্যের ভাব ফুটিয়াছিল। বিশেষত পিছনের পাহাড়টা অপুকে আকর্ষণ করিল। ছবিটা প্রকাশককে ফেরত দিয়া সে বলিল–আমি আর দেখতে যাবো না। আপনার ওপর ভরসা করে কিনছি। আপনি লোক পাঠিয়ে দিন টাকা সঙ্গে দিয়ে। দলিলপত্রে আমি একেবারে গিয়ে সই কবব।
রাত্রে শুইয়া শুইয়া অপু বলিল–খোকা, তুই তো পাহাড় দেখিস নি? এবার দেখবি’খন। কাজল পাহাড় দেখে নাই। বাবার কাছে শুনিয়া সে মনে মনে জিনিসটা সম্বন্ধে একটা ধারণা করিবার চেষ্টা করে। চড়কতলার ডাইনে যে মাটির উঁচু ঢিবিটা আছে, অনেকটা সেইরূপ কি?
–সেখানে নদী নেই বাবা?
–আছে। কী নাম জনিস?
–কী বাবা?
–সুবর্ণরেখা। নামটা তাহার পছন্দ হয়। সুবর্ণরেখা। এক নিঃশ্বাসে বলিবার মতো নাম। সাঁই করিয়া একবার তলোয়ার ঘুরাইবার মতো। কত নূতন জিনিস সে দেখিবে–পাহাড়, শালবন, সুবৰ্ণরেখা। সুবর্ণরেখা মিষ্টি নাম, সুন্দর নাম।
সুবৰ্ণরেখা। সু-ব-র্ণ-রেখা–নামটা কাজলকে ঘুম পাড়াইয়া ফেলে।
কাজল ঘুমাইলে অপু বলিল–ঠিক বুঝতে পারছিনে হৈমন্তী, কাজটা ভালো হল বিকা। সবে এসে নিশ্চিন্দিপুরে বসতে না বসতেই আবার রওনা দেওয়া-অবশ্য ডাক্তার বলল যেতে, তবু—
হৈমন্তী একটু ভাবিয়া বলিল–না, চলো কিছুদিন থেকেই দেখি তোমার শরীরটা সারে কিনা। এই ভালো, এক জায়গায় না থেকে বেশ ঘুরে ঘুরে বেড়ানো। ও রকম শেকড় গেড়ে সংসায় করতে আমিও ভালোবাসিনে।
–আচ্ছা, তোমার পাহাড়ি দেশ ভালো লাগে, না আমাদের এই পাড়াগাঁ ভালো লাগে?
–দুই-ই। এক এক দেশের এক এক রকম সৌন্দৰ্য–
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া অপু বলিল–তুমি তো সমুদ্র দেখনি, না?
–না। কী করে দেখবো বল? বরাবর তো বাবার সঙ্গেই ঘুরেছি, সমুদ্রের কাছাকাছি বাবা কখনও বদলি হননি।
–যাবে?
হৈমন্তী উৎসাহে বিছানায় উঠিয়া বসিল।
–সত্যি বলছো? কবে নিয়ে যাবে? চলো দু’এক দিনেব মধ্যেই যাই।
– কোথায় যাবে?
হৈমন্তী চিন্তা করিয়া বলিল–তুমি বলো।
-পুরী যাবে?
পুরী যাওয়াই ঠিক হইল। কাজলের কিছুদিন বাদেই পরীক্ষা। সে রানির কাছে থাকিবে। অপুরা কাজলের পরীক্ষার আগেই ফিরিবে। রানির কাছে থাকিতে কাজলের কোন অসুবিধা নাই। কাজল সঙ্গে যাইবে বলিয়া অবশ্য হাত-পা ছুঁড়িয়ছিল এবং অপু রাজিও হইয়াছিল। কিন্তু রানি আসিয়া বলিল–তোরা যাচ্ছিস যা। এ ছেলেটার সামনে পরীক্ষা। এটাকে আবার দলে টনছিস কেন? ও আমার কাছে থাকুক, দুবেলা পড়াতে বসাব এখন। তোরা একা যা
কাজল রানির কাছে থাকিয়া গেল। অবশ্য অপুকে বাববার প্রতিশ্রুতি দিতে হইল যে, পরীক্ষার পরেই কাজলকে লইয়া সে পুবী যাইবে।
অপু হাসিয়া হৈমন্তীকে বলিতেছিল–আমাকে কোথাও একদণ্ড তিষ্ঠোতে দিচ্চে না, বুঝলে? দুই জায়গায় তো সংসার পেতে ফেললাম, তাতেও দেখচি খালি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা কবীচে। বেশিক্ষণ ঘরের মধ্যে থাকলে মন কেমন হ্যাঁপিয়ে ওঠে, জানো!
—তোমার তো ওইরকমই। খালি বেড়ানো, খালি ঘুরে বেড়ানো! এখন তোমার যাযাবববৃত্তি একটু বন্ধ ব্যাখতে হবে, নইলে ছেলেটার পড়াশুনো আব্ব কিছু হবে ভেবেছ?
–হবে হবে। সে কি আমি ভাবিনি মনে করচো? কাজল এতে ভালো কবে মানুষ হয়ে উঠেচে। পড়াশুনায় ওর ঝোঁক বড়ো বেশি, সব সময় বই মুখে করে বসে আছে। নতুন বাড়িতে গিয়েই ওকে আবার সেখানকার ইস্কুলে ভর্তি করে দেব।
হৈমন্তী বলিল–আচ্ছা, সমুদ্রে স্নান করা যাবে তো? নাকি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ঢেউয়েব টানে?
–তা কেন, কত লোক স্নান কবচে দেখবে। সবাইকে কি জলে ভাসিযে নিয়ে যাচ্ছে? তা ছাড়া নুলিয়া আছে–
–নুলিয়ারা কখনও ডোবে না, না?
অপু হাসিয়া বলিল–তুমি বড়ো ছেলেমানুষ হৈমন্তী। একেবারে বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করছে। এই জন্যেই তোমাকে এত ভালো লাগে।
–আর তুমি খুব বুড়ো হয়ে গেছ, না?
-হয়েছিই তো।
–উঃ, একেবারে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে–
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া অপু বলিল–কাপড়চোপড় গুছিয়ে নাও। শীগগিরই রওনা দেবো।
অপু আর হৈমন্তী পুরী যাইবার দিন চারেক পর নিশ্চিন্দিপুরে একদিন বৃষ্টি নামিল। রাস্তার ধূলা নিমেষের মধ্যে কাদায় রূপান্তরিত হইয়া গেল। গ্রামের ভিতরের সমস্ত রাস্তা কাদায় ভর্তি, বালকের দল সেখানে আছাড় খাইতে লাগিল। বড়ো বড়ো আম কাঁঠাল গাছ হইতে টুপটাপ করিয়া অবিশ্রান্ত জল পড়িতেছে নিচের কচুবনের উপর। বৃষ্টি এক-একবার ধরিয়া আসে, কিন্তু উঁচু গাছ হইতে জল পড়া থামে না।
মেঘাচ্ছন্ন দিনে কাজলের বড়ো মন কেমন করে। কেন করে, তা সে বোঝে না। ঘন মেঘে। আকাশ কালো, গুম গুম করিয়া মেঘ ডাকিতেছে, ঝপ ঝুপ করিয়া অবিরাম বৃষ্টির শব্দ। কেমন একটা মনখারাপ-করা চাপা আলো চারিদিকে– এই আলোটা কাজলকে উদাস করিয়া দেয়।
রানুপিসির উত্তরের জানালায় বসিয়া সে দেখে, বাহিরের অন্ধকার ক্রমশ ঘন হইতেছে, দুপুরটা সন্ধ্যাবেলার মতো দেখাইতেছে। রানি বৃষ্টিতে তাহাকে বাহির হইতে দেয় নাই। জানালায় বসিয়া সে দেখিল, চণু একটা পুঁটিমাছধরা ছিপ আর একটা চটের থলে হাতে কোথায় যাইতেছে।
কাজল তাহাকে ডাকিয়া বলিল–কোথায় যাচ্ছিস রে?
–মাছ ধরতে।
— কোথায়? নদীতে?
—দূর! নদীর পথে বেজায় কাদা। বামুনপুকুরে যাবো। যাবি?
কাজল মাথা নাড়িল।
— যাবি না?
–না।
— কেন রে, জ্বর হযেছে?
–না।
–তবে?
—ইচ্ছে করছে না যেতে। তুই ধরগে যা মাছ।
ইচ্ছা খুবই করিতেছে। কিন্তু পিসি ঘরে বন্দী করিয়া রাখিয়াছে—এ কথা বলিলে চনুর কাছে দর কমিয়া যায়। চনুব মা-বাবা কেমন ছাড়িয়া দিয়াছে, তাহার বেলা সবার যত কড়াকড়ি।
একটু পরে রানি ঘরে ঢুকিলে সে বলিল–চানু কেমন মাছ ধরতে গেল এই একটু আগে! ওকে তো বেশ ছেড়ে দিয়েছে, আমাকে তুমি একটু বেরুতে দাও না কোথাও–
–দিই না তো বেশ করি। ও সব হাভাতে ছোঁড়ারা তো ঘুরবেই–
অনুমতি মিলিল না। অতঃপর জানালায় বসিয়া শিকে গাল রাখিয়া নির্মিমেষ দৃষ্টিতে বাহিরে তাকাইয়া থাকা ছাড়া উপায় নাই।
বাহিরে জল জমিয়াছে। একটা চড়ুই পাখি হঠাৎ কোথা হইতে উড়িয়া আসিয়া রাস্তার ধারের জমা জলে স্নান করিতে লাগিল। মাথা ড়ুবাইয়া জল তুলিয়া গায়ে দেয়, কখনও সমস্ত শরীরটা ড়ুবাইয়া দেয় জলে। বৃষ্টি হওয়ায় মহাস্মৃতি–এদিকে ওদিকে অনেক পাখি ঝোপঝাড়ে কিচমিচ করিতেছে। ভয়ানক গরম পড়িয়াছিল, তাহা হইতে মুক্তি পাইয়া সবাই খুশি! একটা শেয়াল সামনের বাগানটা পার হইয়া গিয়া একবারে রানুপিসিদের উঠানে আসিয়া পড়িল। কাজল দিনের বেলা এত কাছ হইতে কখনও শেযাল দেখে নাই, উৎসাহে সে উঠিয়া দাঁড়াইল। শেয়াল বড়ো চালাক, দিনমানে মনুষ্যবসতির নিকটে ঘোরাফেরা করিতে বড়ো দেখা যায় না। কাজলের চোখ বিস্ময়ে কোটার হইতে বাহির হইয়া আসিতেছিল। শেয়ালটা মিনিটখানেক স্থাণুবৎ দাঁড়াইয়া হঠাৎ তীরবেগে পাশের কচুবনে ঢুকিয়া পড়িল।
বিকালের দিকে কাজলের মনটা খারাপ লাগিতেছিল। বাবা বাড়ি নাই। এ সময়টা সে সাধারণত বাবার সঙ্গে কাটায়। পড়ন্ত বেলার চাপা আলো তাহার মনে বেদনার একটা সুর ছড়াইয়া দিল। শুধুই কি বাবার জন্য মন খারাপ? কাজল অবাক হইয়া আবিষ্কার করিল, মায়ের জন্যও তাহার মন কেমন করিতেছে। কদিনই বা হইল মা তাহাদের দুইজনের সংসারে আসিয়াছে—তাহার জন্য মন খারাপ হয় তবুও।
জানালা দিয়া বাহিরে তাকাইয়া ভেজা গাছপালা দেখিতে দেখিতে কাজলের মনে হইল, মাকে সে সত্যই খুব ভালোবাসিয়া ফেলিয়াছে।
পুরী হৈমন্তীর ভালো লাগিতেছিল। জীবনের প্রথম সমুদ্রদর্শনে তাহার মন অকস্মাৎ আকাশের মতো খোলামেলা হইয়া গেল।
সারাদিন বেশ গরম থাকে। বিকালে দুইজনে সমুদ্রের ধারে যায়। পায়ে পায়ে হাঁটিয়া হঠাৎ আবিষ্কার করে শহর অনেকটা পেছনে ফেলিয়া আসিয়াছে। বাঁ-পাশে উঁচু বালির ডিাঙা, এদিকে বিস্তৃত একখানি নীল আয়নার মতো সমুদ্র। প্রথম দিন রেল স্টেশন হইতে আসিবাব সময় পথের বাঁক ফিরিয়াই হঠাৎ সামনে সমুদ্র দেখিয়া হৈমন্তী অবাক হইয়া গিয়াছিল। সমুদ্র সম্বন্ধে তাহার মনে যে ধারণাটা ছিল সেটাকে চুরমার করিয়া আসল সমুদ্র চোখের সামনে একটা অগাধ বিস্তুতি খুলিয়া দিল।
সেদিন তাহারা বেড়াইতে বেড়াইতে অনেক দূর গিয়াছিল। অপু বলিল–কেমন লাগছে?
–ভালো।
–শুধু ভালো? আর কিছু না?
—বিরাট ভালোর বর্ণনা কী করে দিই বলে তো? মোটামুটি ভালো লাগলে বেশ বড়ো করে বলা যায়। খুব বেশি ভালো লাগলে তখন আর প্রগল্ভ হওয়া যায় না।
অপু বলিল–ভালো করে অনুভব করে দেখো, সমুদ্রের সঙ্গে মানুষেব জীবণের একটা আশ্চর্য সাদৃশ্য পাবে। জীবনও সমুদ্রের মতো বড়। জীবনেও সমুদ্রের মতো ঝড় ওঠে। সমুদ্র যেমন সৃষ্টির আদি থেকে অবিশ্রাম তীরে এসে আঘাত করছে, বাধা পেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে– আবার নতুন করে আসছে, তেমনি জীবনও একটা লোহার পর্দায় বাব বার আঘাত করছে যেন। কিছুতেই ভাঙতে পারছে না। কী একটা যেন জানবার কথা আছে–কিছুতেই জানা যাচ্ছে না–
অপু থামিতেই হৈমন্তীর কানে সমুদ্রের শো শো শব্দটা খুব স্পষ্ট হইয়া উঠিল।
সন্ধ্যা নামিয়াছে। দিগন্ত পর্যন্ত অন্ধকার।–কেবল এখানে ওখানে সাদা ফেনা অন্ধকারেও দেখা যাইতেছে।
হৈমন্তী চুপি চুপি প্রশ্ন করিল–কী জানবার আছে মানুষের?
অপু ঘাড় ফিরাইয়া চোখ তীক্ষ্ণ করিয়া দূরে তাকাইয়া ছিল। অনেকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে বলিল–প্রশ্নটা জানা আছে, উত্তরটা কেউ জানি না।
ফিরিবার সময় হৈমন্তীর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে লইয়া অপু বলিল– কেন চিন্তা করতে শিখলাম বল তো? জীবনটা তো এমনিতেই বেশ কাটিয়ে দেওয়া যেতো।
পরের দিন সকালে অপু বলিল–সব ঠিক করে ফেললাম। চল, কাল কোনারক থেকে ঘুরে আসি। পুরী এসে কোনারক না দেখে ফেরা যায় না।
হৈমন্তীর আপত্তির কোন কারণ ছিল না। আরও একটি পরিবাব কোনারক দেখিতে যাইতেছে-অপুও তাঁহাদের সহিত যাইবে ঠিক করিয়াছে, কথাবার্তা সব ঠিক।
সারাদিন একটু একটু করিয়া কোনারকের ইতিহাসটা হৈমন্তী অপুর নিকট হইতে শুনিয়া লইল। ইতিহাস জানিবার পর কোনারক দেখিবার ইচ্ছা আরও বাড়িল। পরদিন সূর্যমন্দিরের চূড়াটা উঁচু গাছের পাতার ফাঁক দিয়া একটু একটু করিয়া স্পষ্ট হইয়া উঠিতেই আনন্দে হৈমন্তীর গলার কাছে কী একটা পাকাইয়া উঠিল।
বিরাট মন্দির। প্রশস্ত উঠানের অপর প্রান্তে বিশাল প্রধান দ্বার। মন্দিরের ভিত্তিতে রথচক্রের অনুকরণে বড়ো বড়ো পাথরের চক্ৰ খোদাই করা। হু হু করিয়া বাতাস বহিতেছে। মন্দিরের ওপাশের উঁচু গাছে হাওয়া লাগিয়া একটা মাতামাতি কাণ্ড হইতেছে। চারিদিক একেবারে স্তব্ধ। এত স্তব্ধ যে, হৈমন্তী নিজের শান্তিপুরী শাড়ির খস-খাস শব্দ শুনিতে পাইতেছে স্পষ্ট।
সহযাত্রী পরিবারটি খাওয়ার ব্যবস্থায় লাগিল। তাহারা সঙ্গে লুচি-তরকারি ও মিষ্টি আনিয়াছে। শতরঞ্চি বিছাইয়া সেগুলিকে পাত্র হইতে বাহির করিয়া পাতায় সাজাইতে আরম্ভ করিল। কর্তাটি অপুকে ডাকিয়া বলিলেন-অপূর্ববাবু, খাবেন তো এখন? আমার মশাই, সত্যি বলতে কি, ভীষণ খিদে পেয়েছে–
—আপনারা শুরু করুন, আমরা একটু ঘুরে আসি। আমাদেরটা রেখে দিন ববং।
অপু হৈমন্তীকে লইয়া মন্দিরটা ঘুরিয়া দেখিতে লাগিল। বিরাট প্রাঙ্গণের মধ্যে ধূসর পাথরের মন্দিরটা কেমন উদাস ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। মাটি হইতে ক্ৰমশ চুড়ার দিকে উঠিবার কয়েকটি সংকীর্ণ পথ আছে। তাহারই একটা দিয়া অপু, হৈমন্তীকে লইয়া উঠিতেছিল। একদিকে মন্দিরের পাথর–অপবদিকে অনেক নিচে মাটি। হঠাৎ তাকাইলে মাথা ঘোরে। হৈমন্তী অপুকে ধরিয়া উঠিতেছিল।
অপু বলিল–ভালো করে ধরে থেকে। হাওয়া দিচ্ছে বেশ, বেসামাল হলে ঝুপ করে পড়ে যাবে।
অদ্ভুত! অদ্ভুত! শতাব্দীর ইতিহাসবাহী মৌন প্রান্তর, দূরে গাছের সারি, সুন্দর বাতাস। আকাশের রঙ তাহদেরই মনোলোকের স্বপ্নের মতো নীল। ধীরে ধীরে হৈমন্তীর মনের ভিতর কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব ছড়াইয়া পড়িতেছিল। বহু-তারবিশিষ্ট যন্ত্রের ঝিমঝিম বাজনার মতো আবেশ।
কিন্তু এত সব ভালো লাগিবার মধ্যে একটা কী চিন্তা যেন হৈমন্তীকে খোঁচা দিতেছে। অনেক আনন্দের মধ্যে একটু কী অতৃপ্তির আভাস। কযেকদিন হইতেই হৈমন্তী নিজের অতৃপ্তির কারণ অনুসন্ধান করিতে করিতে আজ এই সূর্যমন্দিরের ভগ্নসোপানে দাঁড়াইয়া উত্তরটা পাইল। সে অনুচ্চকণ্ঠে বলিল—শুনিছো?
-এবার চলো বাড়ি ফিরে যাই।
-সে কী? এই তো সবে এলে। ভালো কবে সব দেখাও তো হল না। তোমার জন্যেই তো আসা।
–তা হোক। আর ভালো লাগছে না।
–কেন?
একটু স্তব্ধ থাকিয়া হৈমন্তী বলিল–খোকাকে ছেড়ে থাকতে পারছি নে।
ফেরা হইল।
কাজলের ষান্মাসিক পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছে। অপু ঠিক করিয়াছে এখন বিহারের নতুন বাড়িতে যাইবে না, কাজলের বাৎসরিক পরীক্ষা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করিবে। নতুন জায়গায় একেবারে নতুন শ্রেণীতে ছেলেকে ভর্তি করিলে। এখন গেলে কাজলের একটা বৎসর নষ্ট হয়।
পরীক্ষার পর কাজল বেশ মজায় আছে। পড়ার চাপ কমিয়াছে। সারাদিন সে ঘুরিয়া কাটাইতেছে। বনজঙ্গল ভাঙিয়া মাঝে মাঝে চলিয়া যায় পাশের গ্রামে।
একদিন কাজল বেড়াইতে বেড়াইতে একটা বাড়ির উঠানে গিয়া হাজির হইল। বেশি সুন্দর ঝকঝকে বাড়ি, উঠানে ধানের গোলা, সিঁদুর দিয়া তাহাতে মঙ্গলচিহ্ন আঁকা। কয়েকটা ছেলে ছোটাছুটি করিতেছে। গোয়ালের একটা গরু বাছুরের গা চাটিতেছে। উঠানে ক্ৰীড়ারত চারটি কুকুরছনা। সে মুগ্ধ নয়নে হৃষ্টপুষ্ট বাচ্চাগুলির খেলা দেখিতেছিল। এমন সময় একটি ছেলে আসিয়া তাহার সামনে দাঁড়াইল।
-কী দেখছ?
তাই সে আমতা আমতা করিয়া বলিল–না, এই–মানে–ওই বাচ্চাগুলো বেশ সুন্দর কিনা, তাই–
–তুমি নেবে একটা?
অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের সম্মুখীন হইয়া কাজল প্রথমটা কিছু বলিতে পারিল না। পরে বলিল–একেবারে দিয়ে দেবে? তোমার বাড়ির লোক কিছু বলবে না?
—দুর! আরও তো তিনটে রইল।–তুমি একটা নাও।
প্রথমে কাজল ধরিতে ভয় পাইতেছিল। পরে গায়ে হাত বুলাইয়া বুলি তাহারা নিতান্তই নিরীহ।
একটা বাচ্চা বগলদাবা করিয়া দ্রুত সে স্থানত্যাগ করিল। প্রতি মুহূর্তে ভয় হইতেছিল, পেছন হইতে ছেলেটি ডাকিয়া বলিবে–না ভাই, বাচ্চা দেবো না। তুমি রেখে যাও।
দ্রুত বড়ো মাঠটা পার হইয়া কাজল নিশ্চিন্দিপুরে ঢুকিল।
হৈমন্তী রাগ করিয়া বলিল–এঃ, এটা আবার কোত্থেকে জুটিয়ে আনলি, নেড়ির বাচ্চা—
হাত-পা নাড়িয়া কাজল দুর্বল জীবটির পক্ষে অনেক ওকালতি করিল। অবশেষে অনুমতি মিলিল। এবারে বাচ্চাকে তো কিছু খাওয়ানো প্রয়োজন। কুকুরের বাচ্চা কী খায়, এ সম্বন্ধে ধারণা না থাকায় হৈমন্তীর কাছে আবার গিয়া দাঁড়াইতে হইল।
–মা।
–কী রে?
–ওটাকে কী খেতে দিই এখন?
রাগ করিতে গিয়া হৈমন্তী হাসিয়া ফেলিল। ছেলেকে কাছে টানিষা লইয়া বলিল–বড্ড বাচ্চা যে, দুধ ছাড়া কি অন্য কিছু খেতে পারবে? বরং রান্নাঘরের কড়া থেকে খানিকটা দুধ নারকোলের মালায় নিয়ে খাওয়াগে।
খাদ্যের প্রতি বাচ্চাটার একটা দার্শনিকসুলভ নিস্পৃহতা দেখা গেল। কাজল জোর করিয়া দুধের মধ্যে মুখ ড়ুবাইয়া দিলে নাকের মধ্যে দুধ ঢুকিয়া হ্যাঁচিয়া সে অস্থির হইল। এক মালা দুধ খাওয়াইতে বেলা গড়াইয়া অন্ধকার নামিল।
দুই-তিনদিনের মধ্যে কুকুরছানা নূতন জায়গায় অভ্যস্ত হইয়া আসিল! কাজল বাবাকে বলিয়াছে, কলিকাতা হইতে কুকুরের গলার চেন আনিয়া দিতে। চেন গলায় দিয়া সকাল বিকাল কাজল তাহাকে লইয়া গ্রাম পরিক্ৰমা করিবে। ওয়াইড ওয়ার্লড ম্যাগাজিনে কুকুরের বীরত্ব সম্বন্ধে ভালো ভালো গল্প ছাপা হয়–বাবার কাছে কাজল তেমন অনেক গল্প শুনিয়াছে। সেও ইহাকে সুশিক্ষিত করিয়া বীরত্বপূর্ণ অভিযানের সঙ্গী করবে।
কুকুরের নাম রাখা হইল–কালু। সাতদিনের মধ্যেই কালু কাজলের পরম ভক্ত হইয়া উঠিল। কাজল নিজে আসিয়া খাইতে না দিলে খায় না, সর্বদা কাজলের পেছনে পেছনে ঘোরে। বেশ ভালো চলিতেছিল, কিন্তু মাসখানেক বাদে হঠাৎ কালুর কী অসুখ করিল। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝিমায়, খাওয়াদাওয়া একদম ছাড়িয়া দিয়াছে। প্রথমে কাজল আমল দেয় নাই, পরে দেখিল কালুর উঠিবার ক্ষমতা লুপ্ত হইয়াছে। তিনদিন আগেও লাফালাফি করিয়া বেড়াইয়াছে, ইদানীং সৰ্বক্ষণ শুইয়া থাকে। কাজলের সাড়া পাইলে অতিকষ্টে একবার মাথা তুলিয়া তাকায়। অশক্ত ঘাড়ের উপর মাথাটা কাঁপে, কিছুক্ষণ বাদে আবার চটের উপর পড়িয়া যায়।
অপু দেখিয়া বলিল–আহা রে! কালু বোধ হয় আর বাঁচিবে না।
গোঙানি। কালু মারা যাইতেছে, কালু ভীষণ কষ্ট পাইতেছে, অথচ কাজলের কিছুই করিবার নাই। চাপা গোঙানির শব্দ তাহাকে কিছুতেই ঘুমাইতে দিল না। রাত্রে মায়ের বুকের কাছে শুইয়া তাহার মনে হইল তাহার অসুখ করিলে মা-বাবা ব্যস্ত হইয়া সেবা করে, আর বেচারা কালু অন্ধকারের ভিতর একা একা কষ্ট পাইয়া মরিতেছে।
কাজল ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
হৈমন্তী তাহাকে কাছে টানিয়া বলিল–কাঁদতে নেই মানিক আমার। ছিঃ—
আদরের কথা শুনিয়া কান্নাটা আরও বাড়িল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে কাজল বলিল–কালু কত কষ্ট পাচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে–
হৈমন্তী তাহার মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল–একা কোথায় পাগলা! ওর কাছে ঠিক ভগবান এসে বসে আছেন, জানিস! যারা কষ্ট পেয়ে মারা যায়, তাদের আত্মাকে ভগবান নিজের হাতে স্বৰ্গে নিয়ে যান। ঠিক ওর পাশে ভগবান এসে বসেছেন
কাজলের দুঃখের বেগটা একটু কমিয়া আসিল। এভাবে সে কখনও ভাবিয়া দেখে নাই। একথা যদি সত্য হয়, তবে দুঃখের কিছুই নাই। ভগবান যদি আসিয়া থাকেন—তবে ভালোই তো। কাজল স্পষ্ট দেখিল, কালুর পাশে এক জ্যোতির্ময়দেহ বিশাল পুরুষ–উন্নতললাট, দীপ্তনয়ন। তাঁহার হাতে পৃথিবীর শাসনের স্বর্ণদণ্ড। তিনি আসিয়াছেন ক্লিষ্ট আত্মাকে স্বহস্তে স্বৰ্গে লইয়া যাইবার জন্য।