০৫. অপালা তার খাতা নিয়ে বসেছে

আজ অনেক দিন পর অপালা তার খাতা নিয়ে বসেছে। কোনো কিছু লেখার উদ্দেশ্যে নয়। পুরনো লেখায় চোখ বোলানোর জন্যে। রাজ-নর্তকী গল্পটি সে পড়েছিল। এ-রকম একটা অদ্ভুত গল্প। এত অল্প বয়সে সে কেন লিখেছিল ভাবতে-ভাবতে লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠল। এই গল্পটি ছিঁড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু খাতা থেকে পাতা ছিড়তে মায়া লাগে। এই গল্পটি এখন ভাল লাগছে। না, আজ থেকে কুড়ি বছর পর হয়তবা ভাল লাগবে।

আফা।

অপালা চমকে তাকাল। রমিলা যে উঠে এসেছে, তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, সে লক্ষই করেনি।

আপনেরে নিচে ডাকে।

কে?

ঐ যে দাড়িওয়ালা লোকটা, ঘর ঠিক করে যে।

ও, আচ্ছা। বসতে বল, আমি আসছি।

রমিলা গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। অপালা শান্ত স্বরে বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?

আপনে দুপুরে কিছু খাইলেন না আফা।

খিদে ছিল না।

অখন এটু নাস্তাপানি আনি?

আন, আর ঐ লোকটাকে আগামীকাল আসতে বল। আমার নিচে নামতে ইচ্ছে করছে না।

জি আচ্ছা।

 

ফিরোজ ঘড়ি আনতে ভুলে গিয়েছে, কাজেই কতক্ষণ পার হয়েছে বলতে পারছে না। এই অতি আধুনিক বসার ঘরটিতে কোনো ঘড়ি নেই। সাধারণত থাকে কোকিল-ঘড়ি বা এ জাতীয় কিছু। এক ঘণ্টা পার হলেই খুট করে দরজা খুলে একটা কোকিল বের হয়। কু-কু করে মাথা ধরিয়ে দেয়। সময় পার হচ্ছে, ব্যাপারটা যন্ত্রণাদায়ক। এর মধ্যে কু-কু করে কেউ যদি সেটা মনে করিয়ে দেয়, তাহলে আরো খারাপ লাগার কথা। ঘড়ি চলবে নিঃশব্দে। কেউ জানতে চাইলে সময় দেখবে। যদি কেউ জানতে না চায়, তাকে জোর করে জানানোর দরকার কী?

অ্যাশট্রেতে চারটি সিগারেট পড়ে আছে। এই থেকে বলা যেতে পারে, পঞ্চাশ মিনিটের মতো পার হয়েছে। পঞ্চাশ মিনিট অবশ্যি একজন রাজকন্যার দর্শনালাভের জন্যে যথেষ্ট নয়। রাজকন্যাদের জন্যে পঞ্চাশ ঘণ্টা বসে থাকা যায়।

পর্দা সরিয়ে রমিলা ঢুকল, দাঁত কেলিয়ে বলল, আফা আসন্তাছে। ফিরোজ মনে-মনে বলল, ধন্য হলাম। রাজকন্যার আগমনবার্তা নাকিব ঘোষণা করল। এখন সম্ভবত জাতীয় সঙ্গীত বাজাবে।–আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।

ফিরোজ সাহেব, আপনি কি ভাল আছেন?

জি, ভাল।

আপনি ঐ দিন এসেছিলেন, আমার মনটা খুব খারাপ ছিল, নিচে নামতে ইচ্ছা করছিল না। আপনি কিছু মনে করেননি তো?

না না, কিছু মনে করিনি। এক-একা বসে থাকতে আমার ভালই লাগে।

আপনার ঐ কাজের ব্যাপারটা নিয়ে বাবার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। তিনি ওকে বলেছেন।

প্রথমে তো আপনি নো বলে দিয়েছিলেন, আবার কেন…

আপনার চাকরি চলে যাবে বলেছিলেন যে, তাই। আপনি বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

ফিরোজ বসল। বসতে গিয়ে মনে হল, এই মেয়েটি বসবে না। কথা বলবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যে-কোনোভাবেই হোক, বুঝিয়ে দেবে, তুমি আর আমি একই আসনে পাশাপাশি বসতে পারি না। সেটা শোভন নয়। কিন্তু অবাক কাণ্ড, মেয়েটি বসল! ফিরোজ বলল, আমি অবশ্যি খুব ভয়ে-ভয়ে এসেছি। ভেবেছি আপনি গালাগালি করবার জন্যে আমাকে ডেকেছেন।

কী আশ্চর্য! গালাগালি করব কেন?

যেদিন আপনি আমার কাজ বন্ধ করে দিলেন, সেদিন রাগ করে আপনাদের একটা দামি কাপ ভেঙে ফেলেছিলাম।

তাই নাকি! বাহ, বেশ তো!

আপনি জানতেন না? অপালা অবাক হয়ে বলল, সামান্য কাপ ভাঙার ব্যাপারে আমি জানব কেন?

ও, আচ্ছা।

আপনি যে দিন ইচ্ছা শুরু করতে পারেন। যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে কথা বললেই হবে। আমি পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত, নিচে সাধারণত নামি না।

কিসের এত পড়াশোনা?

অনার্স ফাইনাল।

ও আচ্ছা! আপনাকে অবশ্যি অনার্স ফাইন্যালের ছাত্রী মনে হয় না। মনে হয় কলেজ-টলেজে পড়েন।

অপালা কিছু বলল না। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। ফিরোজ সেটা লক্ষ্য করল না। ফুর্তির ভঙ্গিতে বলতে লাগল, পড়াশোনা করতে-করতে যদি ব্ৰেইন টায়ার্ড হয়ে যায়, তাহলে চলে আসবেন, আমি কাজ বন্ধ রেখে আপনার সঙ্গে গল্প-গুজব করব, ব্ৰেইন আবার ফ্রেশ হয়ে যাবে।

তার মানে? আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

ফিরোজ অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটির মুখ রাগে। লাল হয়ে গেছে। ঠোঁট অল্প-অল্প কাঁপছে। এতটা রেগে যাবার মত কিছু কী সে বলেছে?

আপনি হঠাৎ এমন রেগে গেলেন কেন? আমি অন্য কিছু ভেবে এটা বলিনি। আপনার চেয়ে অনেক-অনেক রূপবতী একটি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। সেই মেয়েটিকে আগামী সপ্তাহে আমি বিয়ে করছি। দেখুন, তার ছবি দেখুন।

ফিরোজ হাজি সাহেবের মেয়ের ছবিটি টেবিলে রাখল। ভাগ্যিস ছবিটি সঙ্গে ছিল। মেয়েটি একদৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। ফিরোজ সহজ স্বরে বলল, আপনাকে গল্প করতে এখানে আসতে বলার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আশা করি এটা আপনি বুঝতে পারছেন। আরেকটি কথা, যদি সে-রকম কোনো উদ্দেশ্যে আমার থাকে, তাহলে সেটা কী খুব দোষের কিছু? ভাগ্যগুণে বিরাট এক বড়লোকের ঘরে আপনার জন্ম হয়েছে, আমার ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই বলে আমার যদি আপনাকে ভাল লাগে, সেটা আমি বলতে পারব না? যদি বলি সেটা দোষের হয়ে যাবে?

অপালা উঠে দাঁড়াল। ফিরোজ বলল, কথার জবাব-না দিয়েই চলে যাচ্ছেন? আমি কাজ করব কী করব না, সেটা অন্তত বলে যান।

কাজ করবেন না কেন? অবশ্যি আপনার ইচ্ছা না-করলে ভিন্ন কথা।

 

ফিরোজ কাজে লেগে পড়ল। মতিনের ডিজাইন রাখল না। সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনা। পছন্দ হলে হবে, না হলে হবে না। এক সপ্তাহ সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত কাজ। এর মধ্যে অপালাকে একটি বারের জন্যেও নিচে নামতে দেখা গেল না। এক বার কিছু সময়ের জন্যে বারান্দায় এসেছিল, ফিরোজের দিকে চোখ পড়তেই চট করে সরে গেল। অপমানিত হবার মত ঘটনা, কিন্তু ফিরোজকে তা স্পর্শ করল না। এক বার কাজে ডুবে গেলে অন্য কিছু তার মনে থাকে না। দেয়ালের ডিসটেম্পার বদলাতে গিয়ে মনে-মনে ভাবল–এই অহঙ্কারী মেয়ে থাকুক তার অহঙ্কার নিয়ে, আমার কিছুই যায়-আসে না। ডিসটেম্পরের রঙ কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। তার প্রয়োজন আকাশি রঙ, কিন্তু সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। হয় বেশি গাঢ় হয়ে যাচ্ছে কিংবা বেশি হালকা। কড়া হলুদ এক বার দিয়ে দেখলে হয়। এতে রোদের এফেক্ট চলে আসতে পারে। হলুদ সবার অপছন্দের রঙ। ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে ম্যাজিকের মত এফেক্ট সৃষ্টি হতে পারে। সে চতুর্থ বার ডিসটেম্পার বদলে আবার আগের নীল রঙে ফিরে গেল। গৃহসজ্জায় দেয়াল খুবই জরুরি। এই দেয়ালের রঙ ঘরকে বন্দি করে ফেলবে কিংবা মুক্তি দেবে।

কাজ শেষ হবার পরও অপালা দেখতে গেল না। রমিলাকে বলল, চলে যেতে বল। আর ম্যানেজার বাবুকে বল টাকা পয়সা মিটিয়ে দিতে।

দাড়িওয়ালা লোকটা আফনের পছন্দ হয়েছে কী না জানাতে চায়।

পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে।

দেখলেন না তো আফা!

দেখতে ইচ্ছা করছে না।

অপালা তার দু দিন পর নিশানাথবাবুর সঙ্গে ঘর দেখতে গেল। তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! কি-রকম ফাঁকা-ফাকা শান্তি-শান্তি ভাব। মেঝেতে এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত কাঁপেটের মতো শীতল পাটি। ছোট-ছোট বেতের চেয়ারে হালকা নীল রঙের গাদি। চেয়াবগুলি একটি গোল সেন্ট্রাল টেবিলের চারপাশে এমনভাবে সাজানো, যেন পদ্মফুল ফুটে আছে। শীতল পাটিটিকে লাগছে দিঘির কালো জলের মত। দেয়ালে একটিমাত্র জলরঙ ছবি। ঘন বন, মাঝখানে ছোট্ট একটি জলা। সেই জলার পানিতে আকাশের নীল রঙের ছাযা পড়েছে। একটি ছোট্ট মেয়ে সেই পানিতে ভাসছে। সমস্ত ঘরটায় একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন ভার চলে এসেছে। অপালার বিস্ময, কাটতে দীর্ঘ সময় লাগল।

ম্যানেজার কাকু, কেমন লাগছে আপনার কাছে?

ভালই তো!

শুধু ভালই তো! আরো কিছু বলুন।

ছোকরা এলেমদার, তবে বিরাট ফক্কড়। যত টাকা নিয়েছে এই ঘর করতে, এর সিকি টাকাও লাগে না। ছোকরা বিরাট ফোরটোয়েন্টি।

অপালা খিলখিল করে হেসে উঠল। এ-রকম শব্দ করে সে কখনো হাসে না। নিশানাথবাবু এই মেয়েটির হঠাৎ এই উচ্ছাসের কারণ বুঝতে পারলেন না।

ম্যানেজার কাকু।

বল মা।

আপনি ফিরোজ সাহেবকে জানিয়ে দেবেন যে তার সাজানো ঘর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাবেন।

দরকার কী? কাজ করেছে পয়সা নিয়েছে।

না, আপনি লিখবেন। আজই লিখবেন। কী লিখলেন, সেটা আমাকে দেখিয়ে নেবেন।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

ম্যানেজার কাকু, ঐ ছবিটার দিকে দেখুন। একটা ছোট্ট মেয়ে পানিতে ভাসছে। আচ্ছা, মেয়েটা কী সাঁতার কাটছে, না পানিতে ডুবে মারা গেছে?

হবে একটা কিছু।

ছবিটার মধ্যে একটা গল্প আছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, আপনার মধ্যে একটা কষ্টের ভাব হবে।

নিশানাথবাবু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বললেন, কই, আমার তো কিছু হচ্ছে না।

অপালা আবার খিলখিল করে হেসে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *