০৫. অনেকটা রাত

অনেকটা রাত হয়ে এসেছিল। এ-বাড়ি নিস্তব্ধ, নিঝুম। নিবিড় নীরবতার মধ্যে ভ্রমর জেগে ছিল।

কৃষ্ণা অকাতরে ঘুমোচ্ছে। অন্ধকারে তার ঘন ভরা নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচিছল। ভ্রমর স্থির ও শান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে। সে কখনও চোখের পাতা বন্ধ করছিল, কখনও চোখ খুলে অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে ছিল।

বাইরে শীতের অস্থির হাওয়া বইছিল আজ, কান পাতলে হুহু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কদাচিৎ একটি-দুটি শীতার্ত পাখি ডেকে উঠছিল। পুঞ্জীভূত কুয়াশা এবং শীতল আর্দ্র জ্যোৎস্না ভ্রমর দেখতে পাচ্ছিল না। জানলার খড়খড়ি ও শার্সি বন্ধ। ভেন্টিলেটারের গর্ত-দিয়ে-আসা আলোর একটু আভা সিলিঙের কাছে ঝুলে আছে।

গলা পর্যন্ত লেপ টেনে ভ্রমর এই স্তব্দতা ও সুপ্তির মধ্যে জেগে ছিল। তার ঘুম আসছে না, ঘুম না আসায় সে বিরক্ত বা অপ্রসন্নতা বোধ করছে না। কোনো নির্জন স্থানে বসে মানুষ যেমন অতিবিস্তৃত মনোরম ও রহস্যময় প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে থাকে, ভ্রমরও এই অন্ধকারে যেন সেই রকম কোনো দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল।

চকবাজার থেকে বাড়িতে ফেরার পরই ভ্রমর খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। ঠিক এই ধরনের চাঞ্চল্য সে আর কখনও অনুভব করে নি। এলোমেলো বাতাসের মতন তার মন নানাদিকে ছুটে যাচ্ছে; কখনও জ্যোৎস্নার মধ্য দিয়ে তাদের টাঙাগাড়ি ছুটে আসা দেখছে, কখনও অমলকে সিগারেট ধরাতে দেখছে, কখনও সেই পথে- গাওয়া গানটি তার কানের কাছে নিঃশব্দে যেন গাওয়া হচ্ছে; কখনো বা ভ্রমর অমলের মুখের গন্ধটি স্মৃতি থেকে বার বার অনুভব করার চেষ্টা করছিল।

আজ এ-রকম কেন হল ভ্রমর বুঝতে পারছিল না। টাঙা থেকে নামার পর সে কেমন বেহুঁশ ছিল, এত বেহুঁশ যে আয়াকে হিমানী-মা মনে করে কি একটা কথা বলে ফেলেছিল। সে ভাল করে কারও দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না। বাজারের হিসাব মেলাতে ক’বারই ভুল হয়ে যাওয়ায় সে কৃষ্ণাকে যোগটা করে দিতে বলে পোশাক বদলাতে লাগল। পোশাক বদলানোর সময় গায়ের জামায় সে গন্ধ শুঁকেছিল। ভ্রমর কিসের গন্ধ পেতে চাইছিল সে নিজেও জানে না। কোনো রকম গন্ধ সে পায় নি; না পেয়ে মন খারাপ লাগছিল। তারপর ভ্রমর তার শারীরিক অনুভূতিগুলি বোধ করতে পারল। তার কপাল এবং কান গরম, চোখের মণিতে জ্বালা জ্বালা ভাব, সর্দিজ্বরের মতন সর্বাঙ্গে কেমন শীত-শীত লাগছিল, নিশ্বাস-প্রশ্বাস উষ্ণ, বুকের মধ্যে কখনও খুব ফাঁকা লাগছিল, কখনও খুব ভরা ভরা লাগছিল।

এলোমেলো মন, কেমন অশ্চর্য এক জড়তা এবং চাপা অস্থিরতার মধ্যে বাকি সময়টুকু কেটে গেল। অমলের সঙ্গে একটি কথাও আর সে বলে নি, খাবার টেবিলে চুপ করে ছিল, নীচু মুখে বসে ছিল। তার ভয় হচ্ছিল, মুখ তুললে সে সকলের কাছে ধরা পড়ে যাবে।

শুতে এসে কৃষ্ণা মুখে হাতে গলায় ক্রীম মাখার সময় পুষ্পার শীঘ্রি বিয়ে হবে এই খবরটা দিল। ভ্রমর কান করে কথাটা শুনল না। ভ্রমর অন্য অন্য দিনের মতন রাত্রের ক্রীমও মাখল না। তার ভাল লাগল না। ক্রীমের গন্ধ যে মানুষের মুখের স্বাভাবিক সুন্দর গন্ধ নয়, ভ্রমর আজ তীব্র ভাবে অনুভব করছিল।

তারপর ঘর অন্ধকার করে, বেড়ালটাকে পায়ের দিকে সরিয়ে দিয়ে ভ্রমর শুয়েছে। তখন থেকে সে শুয়েই আছে। ঘুমোবার কথা একবারও ভাবে নি, রাত্রি এবং সময়ের কথাও তার খেয়াল হচ্ছিল না।

ছেলেবেলায় ভ্রমর তার কয়েকটি পুতুল, কিছু রঙীন ছিট কাপড়, ভাঙা চিরুনি, কাচের চুড়ির টুকরো নিয়ে একা একা সরাবেলা কাটাত। বড় হয়েও তার স্বভাব খুব একটা বদলায় নি। এখনও ভ্রমর খুব তুচ্ছ সামান্য কিছু নিয়ে নিজের মনে তন্ময় হয়ে থাকতে পারে। আজ রাত্রে সে কয়েকটি স্পষ্ট ও অস্পষ্ট ছবি, বিবিধ চিন্তার মধ্যে মগ্ন হয়ে গিয়েছিল।

অমল এ-বাড়িতে এল যেদিন সেদিনের ছবিটি ভ্রমর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। বাবার সঙ্গে টাঙা থেকে নামল অমল, তখন একেবারে সাত-সকাল, আলো ফুটেছে সবে, ঘাসের মাথা হিমের গুঁড়োয় সাদা হয়ে আছে তখনও। গাড়ি থেকে নেমে অমল গোবেচারীর মতন বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ধুলোয় ভরা, কয়লার গুঁড়োয় কালো, শুকনো, রুক্ষ চেহারা। ভ্রমর এবং হিমানী-মা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। অমলকে দেখে সেই সকালে বড় মায়া হয়েছিল ভ্রমরের। খুব কষ্ট পেয়েছে আসতে। মনে মনে অবশ্য সকৌতুক একটু হাসিও পাচ্ছিল। এই তবে অমল! ভ্রমর ভেবেছিল, আরও বড় হবে, লম্বা হবে, গোলগাল চেহারা হবে, গোঁফ থাকবে, দাড়ি কামানো মুখ হবে। কিন্তু দেখে মনে হল, সে-সবের কিছু নেই। একেবারে ছেলেছোকরা। ছিপছিপে গড়ন, পাতলা একটু গোঁফ, ভালো করে দাড়ি ওঠে নি। চোখে চশমাও নেই।

হিমানী-মাই চা তৈরী করে খাওয়ালে, ভ্রমর গেল অমলের গোছানো ঘর আরও একবার গুছিয়ে মানের গরম জল করে দিতে, সবান তোয়ালে রাখতে।

সেদিন ভ্রমর মনে-মনে বেশ অবাকও হচ্ছিল। মা যখন বেঁচে ছিল, ভ্রমর একেবারে বাচ্চা, বছর চার বয়েস, তখন একবার বাবার সঙ্গে বাঁকুড়ায় গিয়েছিল। বাঁকুড়া থেকে ফেরার পথে তারা রমামাসির বাড়ি হয়ে ফিরেছিল। ভ্রমরের সে-সব কথা একেবারে মনে নেই, শুধু, মনে আছে, একটা ফরসা গোলগাল ছেলে তাকে হাত ধরে কাঠের ঘোড়ায় চাপাত এবং দোলাত। বলত, মন্ত্র পড়ে দিলে এই ঘোড়াটা উড়ে আকাশে চলে যেতে পারে, কিন্তু সে মন্ত্র পড়বে না, কেননা আকাশে চলে গেলে ঘোড়াটা আর ফিরে আসবে না। ভ্রমর অবশ্য তখন সে-কথা বিশ্বাস করেছিল কি না, আজ আর তার মনে পড়ে না।

অমল কিন্তু কিছুতেই সে-কথা স্বীকার করতে চাইল না। তাদের বাড়িতে একটা ঘোড়া ছিল ঠিকই, তবে সেটা ঠুঁটো জগন্নাথ বলে তারা ঘোড়াটা গুদোম- ঘরে ফেলে দিয়েছিল। অমলের বয়স তখন ভ্রমরের চেয়ে বেশী ছিল, তবু তার পুরনো কথা কিছু মনে নেই। সে শুধু মেসোমশাইয়ের কথাটা মনে করতে পারে সামান্য। কেননা তাকে সকলে বলেছিল, মেসোমশাই খুব বিদ্বান, কলেজে পড়ান। বিদ্বান লোক দেখার আগ্রহে সে মেসোমশাইকে খুব নজর করে দেখত।

বাবা তার পরও বার দুই দেশের দিকে গিয়েছে। একবার একলা, ভ্রমর ছিল মামার বাড়িতে। সেবারও বাবা রমামাসিদের বাড়ি হয়ে ফিরেছিল। হিমানী-মাকে এবং কৃষ্ণাকে নিয়ে বাবা আবার যখন দেশে যায় তখন ভ্রমরও সঙ্গে ছিল। কিন্তু সেবার তারা রমামাসিদের বাড়ি হয়ে ফেরে নি।

প্রথম দিন অমলকে যেমন দেখিয়েছিল, অমল কিন্তু মোটেই সে-রকম নয়। একেবারে নতুন বলে মাত্র একটা বেলা মুখ বুজে বোবা-বোবা হয়ে থাকল। বিকেল থেকেই তার মুখ ফুটল অল্প। ভ্রমরকে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগল।—এখানে এত সাইকেল কেন? টমটম আর টাঙায় তফাতটা কি? এখানে ক’টা স্কুল? ক’টা কলেজ? এখানে কি-রকম করে হিন্দী বলে অমল বুঝতে পারে না, তাদের দিকে হিন্দী একেবারে সোজা।

একেবারে নতুন জামা যেমন প্রথম-প্রথম গায়ের সঙ্গে মিশ খায় না, একটু আড়ষ্ট লাগে, অমলকে মাত্র দুটো দিন সেই রকম লেগেছিল, নতুন-নতুন এবং বাইরের মনে হচ্ছিল, তারপর আর লাগল না। লাগতে দিল না। খুব সহজে, একেবারে এ-বাড়ির একজনের মতন করে মিশে গেল। বরং ভ্রমরের মনে হল, এ-বাড়ির আর তিনজনের চেয়ে অমল অনেক বেশী, অনেক নিকট আত্মীয় হয়ে তার সঙ্গে মিশে গেছে। অমলকে ভ্রমরের প্রথম-প্রথম ভাল লাগত এই জন্যে যে, যেন অমল তার মা, তাদের নিজেদের দেশ, ফেলে-আসা ভুলে-যাওয়া আত্মীয়- স্বজনের জগৎ থেকে এখানে এসে গেছে হঠাৎ। সেখানকার কত কথা, যা ভ্রমর জানে না, সেখানকার অনেক গল্প, যা ভ্রমর কোনোদিন শোনে নি, বহু আচার-আচরণ হাবভাব যা এ-প্রবাসে তারা দেখে নি—অমলের কাছ থেকে সেই সব জানতে শুনতে ও দেখতে পেয়ে ভ্রমর যেন একটি উত্তরাধিকার খুঁজে পাচ্ছিল। আত্মীয়সম সেই জগতটি অনুভব করার জন্যে ভ্রমর অমলকে নিবিড় করে লক্ষ করত, তার কথাবার্তা শুনত, গল্প করত।

অমলকে মনে মনে খুব পছন্দ করছিল যখন, তখনই ভ্রমর অনুভব করল, ওই ছটফটে হাসিখুশী চমৎকার স্বভাবের ছেলেটি তার সঙ্গীর মতন হয়ে গেছে। ওকে বন্ধুর মতন লাগল। ভ্রমরের কখনও কোনো সত্যিকারের বন্ধু ছিল না, নেইও। অমলকে বন্ধুর মতন সুন্দর ও নিবিড় লাগল। তারপরই ভ্রমর অনুভব করল, তার জন্যে খুব মায়া অমলের, কত মমতা! ভ্রমরের দুঃখ-কষ্টে অমল কষ্ট পায়, ভ্রমরের জন্যে উদ্বেগ বোধ করে। একদিন ভ্রমর রাস্তায় বেরিয়ে হোঁচট খেয়েছিল, মুখ থুবড়ে পড়ে যেত, অমল ধরে ফেলেছিল; তারপর থেকে অমল এত সাবধানী হয়েছে যে, রাস্তায় সব সময়ে ভ্রমরের পাশে পাশে থাকে, একটু উঁচু-নীচু জায়গা হলেই হাত ধরে।…জ্বর হবার কথা এবং অন্য আরও অনেক কথা ভ্রমর মনে করতে লাগল। অমল সব সময় ভ্রমরের জন্যে উতলা ও অধীর কেন?

ভ্রমর আজ শুয়ে-শুয়ে অমলের এই মায়া মমতা ও করুণার কথা ভাবছিল। মনে হচ্ছিল, এতদিন সে যেন বাইবেলের সেই ডুমুর গাছ হয়ে ছিল। অফলা ডুমুর গাছ। একটি ফল ফলত না কোনোদিন। তাকে হিমানী-মা’রা হয়ত কেটে ফেলত। কিন্তু অমল এসে তার চারধার খুঁড়ে যেন সার দিয়ে দিয়েছে।

নিজেকে ফলন্ত ডুমুর গাছের মতন কল্পনা করল ভ্রমর। সে ডুমুর গাছ চিনত না। তবু নিজেকে ফলন্ত অনুভব করে তার ভাল লাগছিল।

কৃষ্ণার বিছানার দিকে শব্দ হল। ঘুমের ঘোরে কৃষ্ণা উঠে বসে আবার ধপ করে শুয়ে পড়ল, লোহার খাটের স্পিঙে শব্দ হল, বিড়বিড় করে কি যেন বলল কৃষ্ণা, ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে কথা, তারপর আবার অকাতরে ঘুমোতে লাগল।

ভ্রমর অন্ধকারে কৃষ্ণার বিছানার দিকে তাকাল। এই ঘন স্তধতা ও রাত্রি, সময় ও ঘুমের কথা তার এবার খেয়াল হল। কতটা রাত হয়েছে বোঝা যায় না। বোধ হয় মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। গায়ের লেপ আরও ঘন করে জড়িয়ে নিল ভ্রমর। বুকের ওপর হাত রেখে শুয়ে থাকল।

শুয়ে থাকতে-থাকতে ভ্রমর চোখের পাতা বন্ধ করল। হঠাৎ মনে হল, ওর চোখের ওপর জ্যোৎস্নার আলো এসেছে, নির্মল আলো। সেই আলোর মধ্যে অমল বসে আছে। অনেকটা দূরে। একলা। অমলকে অতটা দূরে থাকতে দেখে ভ্রমর হেঁটে হেঁটে তার কাছে যাচ্ছিল ত যাচ্ছিলই। এমন সময় সে নিজের খোঁড়া পায়ে ব্যথা অনুভব করল। এবং ভাবল, অতটা পথ সে কি করে এগিয়ে গিয়ে অমলকে ডাকবে। নিজের পায়ের জন্যে ভ্রমরের বড় দুঃখ হল।

‘ভ্রমর, তোমার সব সময় যদি অসুখ হয় তুমি বাঁচবে কি করে?’—অমলের এই কথা যেন তার কানের কাছে বাজল; ম্লান বিষণ্ণ কাতর স্বরে অমল এই মুহূর্তে কথাটা আবার বলল। ভ্রমর দেখল, তার চোখের সামনে জ্যোৎস্নার আলো আর নেই।

বাঁচার কথা ভাবতে গিয়ে ভ্রমর আবার মা’র কথা ভাবল। মা অসুখের ধাত পেয়েছিল বলে বাঁচে নি। মা’র মুখে কোনোদিন হাসি ফোটে নি। কিন্তু এই অসুখ মা’র কোথায় ছিল ভ্রমর জানে। ভ্রমর বড় হয়ে সব অনুমান করতে পেরেছে। মা সংসারে ভালবাসা পায় নি। কেন পায় নি ভ্রমর জানে না। বোধ হয় এই জন্যে যে, মাকে তাদের সমাজ পতিত ভাবত; বাবা ঝোঁকের বশে মাকে বিয়ে করার পর নানাভাবে হেয় হয়েছিলেন, তাঁকে কেউ সাহায্য করে নি; বাবা ক্যাথলিক কোনো কলেজে চাকরি পান নি তখন; পেটের দায়ে বিদেশে বেরিয়ে পড়ে- ছিলেন। হয়ত বাবাও শেষ পর্যন্ত মার ওপর বিরূপ হয়ে পড়েছিলেন, হয়ত মা নিজেকে বরাবর দীন ও পাপীতাপী মনে করত। ভ্রমর ঠিক জানে না।

আজ ভ্রমর অনুভব করল, সে তার মা’র মতন মরে যেতে চায় না। বাঁচার আগ্রহ তাকে অস্থির করছিল। সে ফলন্ত ডমরগাছ হতে চায়। ঈশ্বরের কাছে ভ্রমর প্রার্থনা করল।

খুব নরম হাতে ভ্রমর গলার হারে গাঁথা ক্রুশটি স্পর্শ করল, মুঠোয় ধরে থাকল। সে আশ্বাস এবং নির্ভরতা চাইছিল। সে বেঁচে থাকার জন্য প্রভুর দয়া প্রার্থনা করছিল।

তার এ-সময় হঠাৎ মনে হল, ভালবাসাই মানুষকে বাঁচায়। যে-অন্ধজন, যে-কুষ্ঠরোগী এবং অন্য যারা যীশুর কৃপায় আরোগ্যলাভ করেছিল, তারা তাঁর ভালবাসার বলে অসুখ থেকে উদ্ধার পেয়েছিল। ভালবাসাই আরোগ্য; বিশ্বাস এবং ভালবাসাই সব। ভ্রমর মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে চাইল, সে এই অ-সুখ থেকে উদ্ধার পাবে, এবং বিড়বিড় করে ভ্রমর বলল; ভয় পেয়ো না, বিশ্বাস কর।

ভালবাসার চিন্তা ভ্রমরের কাছে নতুন লাগছিল। সে যখন মুঠো খুলে তার হাতটি বুকে রাখল আবার, তখন মনে হল, তার বুকের তলা চোখের পাতার মতন কাঁপছে। কোন অজ্ঞত ইন্দ্রিয় থেকে একটি উষ্ণতা তার সমস্ত চেতনাকে উষ্ণ ও আকুল করছে।

অনেকক্ষণ ভ্রমর অসাড় হয়ে শুয়ে থাকল। তার হৃদয় দুলন্ত দোলনার পিঁড়ির মতন দুলছিল, কখনও হর্ষে কখনও বিষাদে যাচ্ছিল। অবশেষে মুখ হাঁ, করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভ্রমর, পাশ ফিরে শুলো। পাশ ফিরতে গিয়ে বুঝতে পারল তার গাল ভিজে গেছে।

ভ্রমর কেন কাঁদছে, সে-কথা সে ভাবল না। বরং এই অশ্রু তাকে আরও নিবিড় করে নিজের কথা ও অমলের কথা ভাবাচ্ছিল, সে আজ এত কথা ভাবছিল, কেননা ভ্রমর অমলের সেই মুখের গন্ধ ভুলতে পারছিল না। ওই গন্ধের আশ্চর্য চেতনা তাকে হয় পথভ্রান্ত করেছে, সে মরীচিকা দর্শন করেছে, না-হয় ভ্রমর আজ নিজেকে ঐশ্বর্যসম্পন্ন যুবতী মনে করছিল।

সে এক রকম অদ্ভুত স্বাধীনতাও বোধ করতে পারছিল, যেন তার সামনে থেকে কোনো বিশ্রী জেলখানার শক্ত কঠিন এবং ঘৃণ্য লোহার গরাদ এক একটি করে কেউ ভেঙে দিয়েছে, বা খুলে নিয়ে গেছে। সব এখন উন্মুক্ত, তার সামনে সমস্ত কিছুই অবারিত। অনেকক্ষণ এই অবিশ্বাস্য মুক্তি ভ্রমর অনুভব করতে পারে নি, খাঁচায়-পোরা পাখির মতন সে তার ডানাকে গুটিয়ে রেখে বসেছিল, তারপর কখন এক সময় বিমূঢ় ও বিহ্বল ভাব কেটে গেলে অত্যন্ত আচমকা ভ্রমর দেখল, সে মুক্তি পেয়েছে।

প্রথমে আড়ষ্ট পায়ে, ভয়ে-ভয়ে ভ্রমর তার জেলখানা থেকে বেরিয়ে এল যেন। দেখল, অমল তার সামনে। অমলকে কতক্ষণ দেখার পরও সাধ মিটল না। জীবনে এমন একজন আছে তবে যাকে দেখে-দেখে সাধ মেটে না! কী ইচ্ছেই করতে লাগল অমলের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখতে। মনে হচ্ছিল, অমলের চোখের মধ্যে বুকের মধ্যে মিশে গিয়ে অশরীরী অবস্থায় সে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব দেখে।

নিজের অস্তিত্ব হারাবার জন্যে ভ্রমর এই প্রথম আকুল হল, সে কাতর হয়ে অমলের মনের পাশে গিয়ে বসতে চাইল; যে-চোখে অমল দেখছে, যে-মনে অমল ভাবছে, যে-স্বভাব নিয়ে অমল এত সুন্দর—ভ্রমর সেই চোখ মন স্বভাব সবকিছুর অংশীদার হতে চাইছিল। একজন মানুষ কখনও অন্য একজন মানুষের মধ্যে গিয়ে মিশে যেতে পারে না। যদি পারত, ভ্রমর হতাশ হয়ে এবং আক্ষেপ করেই ভাবছিল, যদি সে অমলের মনের মধ্যে ডুবে যেতে পারত, ওর সবকিছুর সঙ্গে মিশে যেতে পারত তবে সে ধন্য ও পূর্ণ হত!

খাঁচার দরজা খুলে গিয়েছিল বলে, এবং ভয়ে-ভয়ে বাইরে এসে ভ্রমর তার মুক্তি অনুভব করতে পারল বলেই পাখির মতন তার ডানা ঝাপটে শূন্য ঝাঁপ দিল। অনভ্যাসবশে সে বেশী উড়ল না, বেশী দূর যেতে সাহস করল না। যতটুকু এগিয়ে গেল, ততটুকুতেই সে আজ গভীর আনন্দ ও তৃপ্তি পেল, রোমাঞ্চ ও রহস্য অনুভব করল।

অনেকক্ষণ ভ্রমর তার আবেগগুলিকে কুণ্ডলী করে এইসব কথা ভাবল, বহু সময় সে অমলের সেই মুখের গন্ধ নিজের চেতনায় কখনও ফিকে কখনও উগ্রভাবে অনুভব করল; তারপর একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন ভ্রমর গায়ে অল্প-অল্প জ্বর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠল। তার চোখ ছলছল করছিল, মাথা ধরে ছিল, মুখ একটু শুকনো। ভ্রমর খুব সাবধানে থাকল। সে চাইছিল না তার জ্বর বাড়ুক। ঘরে স্যারিডন ছিল, লুকিয়ে ভ্রমর একটা বড়ি খেল। স্নান করল না, গরম জলে গা মুছে নিল। আজ সে গির্জায় যাবে, গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করবে। সে নিজের জন্যে এবং অমলের জন্যে আজ কি প্রার্থনা করবে তাও যেন ভেবে রেখেছিল।

জ্বরটা ঠিক গায়ের না গতরাত্রের অস্থিরতার জন্যে, ভ্রমর ঠিক বুঝতে পারল না। সারাটা বেলা তার গায়ে মাঝে মাঝে কাঁটা দিল, কখনও কখনও কপাল বেশ গরম লাগল, এবং ভ্রমরের মনে প্রতিবারই এই চিন্তা এল যে, তার শরীর খারাপ থাকবে না, সেরে যাবে।

দুপুরবেলায় বেশ শীত লাগছিল। ঘরের মধ্যে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল ভ্রমরের। হাত-পা ঠাণ্ডা কনকন করছিল। কৃষ্ণা বারান্দায় রোদে গিয়ে বসে অ্যানুয়েল পরীক্ষার পড়া করছে। দেখতে-দেখতে দুটো বেজে গেল। আর কিছুক্ষণ পরেই চুল বাঁধা, পোশাক বদলানোর তাড়া দেবে হিমানী-মা। চারটে নাগাদ গির্জায় বেরুবে সকলে।

ভ্রমর ঘরে থাকার সাহস পেল না। এই শীত ভাবটা যদি আরও বাড়ে তবে জ্বর আসবে। গায়ে চাদর জড়িয়ে ভ্রমর রোদে গিয়ে দাঁড়াল, রোদ থেকে একসময় পা-পা করে কলাগাছের ঝোপের সামনে, অমলের কাছে।

অমল আজ আর বাইবেল পড়ছিল না। অনন্দমোহন তাঁর বইয়ের আলমারি থেকে আজ সকালে পুরনো বাংলা মাসিকপত্রের বাঁধানো খণ্ড, বঙ্কিমচন্দ্র আর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গ্রন্থাবলী কিছু দিয়েছেন। তারই একটা হাতে নিয়ে অমল দুপুরে রোদে শুয়ে-শুয়ে পড়ছিল।

ভ্রমরকে দেখে অমল বই বন্ধ করল। বলল, “রত্নদীপ পড়ছি।” বলে হাসল।

ভ্রমর কিছু বলল না। সে সারা গা রোদে রেখে দাঁড়িয়ে থাকল।

“তুমি রত্নদীপ পড়েছ?” অমল শুধলো।

“না।” ভ্রমর মাথা নাড়ল।

“জমাট বই, খুব ভাল লাগছে। আমার হয়ে যাক, তোমায় দেব।”

ভ্রমর বইয়ের কথা ভাবছিল না। আজ সকাল থেকেই সে অমলের কাছাকাছি থাকছে না। ইচ্ছে করছিল সারাক্ষণই তবু কাছে আসতে পারছিল না। লজ্জা, নাকি ভয়, ভ্রমর নিজেও বুঝতে পারে নি।

“মেসোমশাইয়ের আলমারিতে অনেক বই আছে, ভাল ভাল বই। তুমি পড় না কেন?” অমল শুধলো।

“পড়েছি—” ভ্রমর অন্যমনস্ক ছিল বলে জবাবটা বোকার মতন হল।

“স-ব?”

“সব! না, সব নয়; পড়েছি ক’টা।” ভ্রমর অমলকে দেখল। দেখে বারান্দার দিকে তাকাল। কৃষ্ণা বসে বসে কখনও বই মুখে পড়ছে, কখনও রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।

সামান্য চুপচাপ। অমল হাই তুলল শব্দ করে। পা টান করল, হাত সামনে ছড়িয়ে আলস্য ভাঙল। বলল, “আজ বিকেলে কি করব তাই ভাবছি। রোববার দিন বিকেলটা একেবারে কাটতে চায় না।”

ভ্রমর অমলের দিকে তাকাল। কষ্ট হবারই কথা, একা একা সারা বিকেল সন্ধে কাটানো! গত রবিবার অমল লীলাদের বাড়ি গিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেছিল, তার আগের রবিবার একলা একলা ঘুরে বেড়িয়েছে। তারও আগের এই দিনটায় অবশ্য ভ্রমর বাড়িতে জ্বর গায়ে শুয়ে থাকায় অমল একা ছিল না।

“লীলাদের বাড়িতে চলে যেও—।” ভ্রমর বলল। রোদে মাথা রেখে ভ্রমর আঙুল দিয়ে তার শুকনো এলো চুলের জট ছাড়িয়ে নিচ্ছিল। রোদের তাত লাগছিল ঘাড়ে, বেশ আরাম পাচ্ছিল ভ্রমর।

অমল মাথা উঁচু করে ভ্রমরকে দেখল। বলল, “হ্যাত্‌, লীলাদের বাড়িতে সব ক’টা মেয়ে, ওদের সঙ্গে আমি কি খেলব!”

খুব সহজেই অমলের আপত্তিটা বুঝতে পারল ভ্রমর। অমলই বলেছিল তাকে। হেসে ফেলে ভ্রমর বলল, “হেরে গিয়ে রাগ!”

“রাগ!…রাগ নয়; মুখ থাকে না, বুঝলে না। লীলা দুর্দান্ত খেলে, আমি পারি না। আমার প্র্যাকটিস নেই।” বলে অমল তার নিজের অক্ষমতার জন্যে নিজেই কৌতুক অনুভব করে হাসল। কি ভেবে একটু পরে বলল, “এখানে আসার পর পরই একদিন ওই বাগানে খেলেছিলাম, তোমার মনে আছে? সেবার কিন্তু ড্র করেছিলাম।”

ভ্রমরের বসতে ইচ্ছে করছিল। বারান্দার দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণাকে দেখল কয়েক পলক। কৃষ্ণা হাঁ করে বাড়ির ফটকের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি দেখছে কে জানে! মাথার চুল ঘাড়ের পাশ দিয়ে বুকের ওপর আনল ভ্রমর।

“আমি ভাবছি আজ বিকেলেও বাজারের দিকে চলে যাব।” অমল বলল।

চুলের আগা থেকে জট ছাড়িয়ে, কিছু উঠে-আসা চুল হাতের আঙুলে নিয়ে জড় করছিল ভ্রমর। আজকাল তার ভীষণ চুল ওঠে। ময়লাটা ফেলে দিল।

“বাজারে গিয়ে কি করবে?” ভ্রমর শুধলো।

“এমনি। ঘুরে বেড়াব খানিক।” বলতে-বলতে কি যেন মনে পড়ল অমলের, “কাল যেন আমরা কি সিনেমা হচ্ছে দেখলাম, ভ্রমর? রাজাটাজা দেখলাম যে!”

ভ্রমর তেমন খেয়াল করে দেখে নি। বলল, “কি জানি! আমি দেখি নি।… বাজারে গিয়ে বায়োস্কোপ দেখবে?”

“দেখলে হয়।”

“যাঃ।” ভুরু কুঁচকে ছোট্ট করে যেন ভর্ৎসনা করল ভ্রমর। “বাজার বেড়িয়ে বায়োস্কোপ দেখে সময় কাটানো আবার কি! তুমি বরং…” ভ্রমর কথাটা শেষ করতে পারল না। সে ভেবে পেল না অমলকে কোন পরামর্শটা দেওয়া যায়।

ভ্রমর দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গল্প করছে দেখে অমল ভাবল তাকে বারান্দা থেকে একটা চেয়ার এনে দেয়। বলল, “তুমি বসো, আমি একটা চেয়ার টেনে আনি।”

ভ্রমর চেয়ার আনতে দিল না। বলল, “আমি মাটিতে বসছি।” বলে মাটিতে বড়-বড় ঘাসের ওপর ভ্রমর বসল, হাঁটু ভেঙে, পা ছড়িয়ে, গোড়ালিতে ভর রেখে।

অমল আবার হাই তুলল। দুপুরটা এবার পড়ার মুখে হেলে গেছে। রোদের তাত নিবে আসছে; শীতের বিকেল যেন সামান্য দূরে পা ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। কলাগাছের ওপরে লম্বা-লম্বা ছায়া পড়েছে। অমল কয়েক মুহূর্তে মরে-আসা দুপুরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি করতে বলছিলে?”

কি করতে বলবে ভ্রমর বুঝে উঠতে পারে নি বলেই চুপ করে গিয়েছিল। অমলের কথায় আবার একটু ভাবল। বলল, “এদিক ওদিক থেকে বেড়িয়ে এস। কতটুকু আর বিকেল! সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরে গল্পের বইটই পড়। তারপরই আমরা এসে যাচ্ছি।”

“থাক।” অমল হাত তুলে মজার একটা ভঙ্গি করে বাধা দিল। “বলতে সব জিনিসই সোজা; তুমি একটু বইটই পড়, আমরা এসে যাচ্ছি…যেন তোমরা এই যাবে আর এই আসবে! বাব্বা, সেই রাত আটটা-টাটটা পর্যন্ত একলা বসে থাকা…। আমি ত দেখছি ক’হপ্তা।”

ভ্রমর মজার চোখ করে অমলকে দেখছিল। অলিস্যের খুব পাতলা ছায়া তার মুখে মাখানো আছে, মাথার ওপর কুটো পড়েছে গাছ থেকে, সিঁথি ভেঙে গেছে, রোদের তাত সামান্য যেন শুকনো করেছে গালের চামড়া।

ভ্রমর বলল, “আজ তাড়াতাড়ি ফিরব।”

“রাখো, তোমাদের তাড়াতাড়ি আমার জানা আছে—”

“বলছি, দেখতে পাবে যখন ফিরব। অন্য দিন কি হয় জানো, গির্জা থেকে বেরিয়ে মা-বাবা এখানে ওখানে বসে একটু, দেখা-সাক্ষাৎ করে, গল্প করে, তাই অত দেরী হয়। চার্চে গেলে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়…।”

“তবে ত কথাই নেই।” অমল চোখ কপালে তুলে নিশ্বাস ফেলল ঠাট্টা করে।

“আজ দেরী হবে না। বাবার একটা মিটিং আছে কিসের যেন!”

অমল দু-মুহূর্ত ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন লক্ষ করল। বলল, “আমি একদিন গির্জায় গিয়ে দেখব তোমরা কি কর?”

ভ্রমর বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, “গির্জা প্রার্থনার জায়গা। তোমাদের মন্দির যেমন।”

“তুমি কি কি প্রার্থনা কর?”

ভ্রমর যেন অমলের ছেলেমানুষিতে বিব্রত হল। অমলকে দেখল, অথচ ভালো করে কিছু লক্ষ করল না। কি বলবে তার মনে আসছিল না। মাটির দিকে চোখ নামাল। ঘাসের শিষ বাতাসে মৃদু-মৃদু কাঁপছিল। হঠাৎ খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল ভ্রমর।

“এ প্রেয়ার ইজ এ প্লেজার।” অমল হুট করে বলল। এমনভাবে বলল যেন সে একটা দামী কথা শোনবার লোভ সামলাতে পারল না।

ভ্রমর কিছু বলল না। আগের মতনই বসে থাকল। কথাটা তার কানে গিয়েছিল।

“কথাটা কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস। বড়-বড় লোকেরা এক-একটা যা কথা বলে— দামী কথা। আমি আর একটা দামী কথা তোমায় শোনাতে পারি। আজ সকালে পড়েছি। বলবো? ‘চক্ষুই শরীরের প্রদীপ: অতএব তোমার চক্ষু যদি সরল হয়, তবে তোমার সমস্ত শরীর দীপ্তিময় হইবে।’ বলো কোথা থেকে বললাম? একেবারে মুখস্থ বলেছি।”

ভ্রমর মুখ তুলল। কিছু বলল না।

“বারে, বা! এটা তোমার বাইবেল থেকে স্যার। টেনে বার তিনেক পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছি।” অমল খুশী গলায় বলল, “পড়তে আমার খুব ভাল লাগল। একেবারে তোমার ডেসক্রিপসান! বুঝলে ভ্রমর, এক্কেবারে তুমি!”

চোখের সামনে অমলের মুখ যেন খুব বড় হয়ে হয়ে কেমন দূরে চলে গেল, পরিবর্তে গির্জার মতন একটি অতি পবিত্র গৃহ দেখতে পেল ভ্রমর। কলাপাতার ছায়া, রোদের কয়েকটি ফিতে অপরাহ্রে বেলায় কয়েক মুহূর্তের জন্যে বুঝি এই বিভ্রম সৃষ্টি করল। তারপর ভ্রমর খুবই আচমকা শীত অনুভব করল। শীত তার সমস্ত শরীরের রোমকূপে কম্পন জাগাল। ভ্রমর কাঁপল।

অমল বলল, “রোদে বসে-বসেও তোমার এত শীত ধরে গেল?”

ভ্রমর নিজের অজ্ঞাতেই জবাব দিল, “শরীরটা ভাল নেই।”

“কি হয়েছে?”

“জ্বরের মতন।”

“দেখি—” অমল হাত বাড়াল, ঝুঁকে পড়ে ভ্রমরের কোল থেকে তার হাত তুলে নিল। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই সবিস্ময়ে বলল, “জ্বরের মতন কি—, একেবারে সোজা জ্বর।”

ভ্রমর ভয় পেল। ভয় পেয়ে করুণ গলায় বলল, “বলো না কাউকে। লক্ষ্মীটি।… আজ আমি গির্জায় যাব।”

“তোমার মাথা খারাপ! বেশ জ্বর এসেছে।”

“সেরে যাবে।”

“কি আছে আজকে গির্জায়?”

ভ্রমর কিছু বলল না। সব প্রার্থনায় আনন্দ থাকে না। আজকের আনন্দময় প্রার্থনা থেকে সে বঞ্চিত হতে চাইছিল না।

শীতের মধ্যে ক’দিন মেঘ মেঘ করছিল। শুকনো মেঘলা নয়, আকাশ চুঁয়ে জল পড়ার মতন ফোঁটা-ফোটা জল পড়ছিল। আবহাওয়া খুব কনকনে এবং বিশ্রী হয়ে থাকত। একদিন বিকেলে বর্ষার মতন মেঘ করে বৃষ্টি হয়ে গেল এক পশলা। পরের দিন সকাল থেকে মেঘ বৃষ্টি বাদলা সরে গেল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলে গগন জুড়ে রোদ উঠল। এখানকার ভীষণ শীতটাও সেই সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সকাল থেকে যত ঝকঝকে সুন্দর আলো, গরম তুলোর মতন তপ্ত রোদ, তত বাতাস। দুপুরের গোড়া থেকে মনে হয়, রোদ যেন আর তাত ধরে রাখতে পারছে না, ক্রমশ নিবে আসছে। বাতাস আরও প্রখর দুঃসহ ও শীতল হয়ে ওঠে। বিকেল না ফুরোতেই দূরে পাতলা ধোঁয়ার মতন কুয়াশা দেখা যায়। অগ্রহায়ণের অপরাহ্ন যেন অতি দ্রুত সন্ধ্যা এবং অধকার এনে দিয়ে চলে যায় কোথাও।

এখানকার শীতের চেহারা দেখে অমল হয়ত মনে-মনে কিছুটা ভয় পেয়েছিল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতেই এই, শেষের দিকে কেমন হবে কে জানে! মুখে তার ভয় ছিল না; বলত: ‘ফার্স্টক্লাস। একেই ঠিক শীত বলে। বুঝলে ভ্রমর, শীতেই শরীর ভাল হয়। তুমি ঠিক ঠিক ভাবে থাক, তোমার চেহারাই বদলে যাবে।”

ভ্রমরের চেহারা বদলানোর দরকার হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় বারের জ্বর সহজে যায় নি। বাড়িতে ডাক্তার এসেছিল। ভাল করে দেখেশুনে এক গাদা ওষুধপত্র ইনজেকশান দিয়ে গেছে। ভ্রমর খুব অ্যানিমিক হয়ে গেছে; অ্যানিমিক হয়ে পড়ায় ও এত দুর্বল, ওর সামান্যতেই ঠাণ্ডা লেগে যাচ্ছে: লিমফ্‌প্ল্যাণ্ড ফুলেছে। সাবধানে থাকা, ওষুধপত্র খাওয়া, বিশ্রাম এবং দুধ ফল শাক-সব্জির পথ্য পরামর্শ দিয়ে ডাক্তার চলে গেছে। তার কম্পাউন্ডার বাড়ি বয়ে এসে ইনজেকশান দিয়ে যাচ্ছে ভ্রমরকে। একদিন অন্তর আসে।

মেসোমশাই বলেছেন, ভ্রমর খানিকটা দুর্বলতা কাটিয়ে উঠলে তিনি ওকে জব্বলপুরেই নিয়ে যাবেন, বড় ডাক্তার দেখিয়ে আনবেন, সে-ব্যবস্থা হচ্ছে।

যেতে-যেতে সেই বড়দিন হবে, কিংবা জানুয়ারির গোড়া। মেসোমশাই এখন কলেজের নানা কাজে ব্যস্ত। পরীক্ষা চলছে, খাতা দেখা চলছে: তার ওপর বি. এস-সি. ক্লাসের ফোর্থ ইয়ারের ছেলেগুলোর জন্যে স্পেশ্যাল ক্লাস নিতে হচ্ছে। বাড়িতে আগের মতন সন্ধেবেলায় বসে অমলদের সঙ্গে দুটো গল্প করার সময়ও তাঁর নেই।

কৃষ্ণাও চোখের জলে নাকের জলে হচ্ছে। আজ বাদে কাল তার পরীক্ষা। সারা বছর সে যত সাইকেল চড়ে ঘুরেছে, দোলনা দুলেছে, খেলেছে, লীলার সঙ্গে হইহুল্লোড় করেছে তার একশো ভাগের এক ভাগও বইয়ের পাতা দেখে নি। এখন মেয়ে দিন-রাত ভুলে বই মুখে করে বসে আছে। হিমানীমাসি বলেছেন, ক্লাস প্রমোশন না পেলে তুমি বাড়ি ঢুকো না। লীলাদের বাড়িতে আয়ার কাজ নিয়ো। বেচারী কৃষ্ণা কোনো রকমে ক্লাসে ওঠার জন্যে বই ছেড়ে আর নড়ছে না।

হিমানীমাসি বড় অদ্ভুত মানুষ। এই যে ভ্রমরের অসুখ, তাতে তাঁর কোনো উদ্বেগ নেই। তিনি কোনো রকম অযত্ন করবেন না ভ্রমরের, আবার গায়ে পড়ে যত্নও দেখাবেন না। তাঁকে ভ্রমরের জন্যে ব্যস্ত, উৎকণ্ঠিত হতে কেউ দেখল না। তাঁর মনের ভারটা যেন এই রকম: অসুখ করেছে শুয়ে থাকো, ওষুধ খাও, দুধ ফল খাও, সাবধানে থাকো, সকাল বিকেল দু-পা বেড়াও।

বাদলা কেটে যখন খুব কনকনে শীত পড়ল তখন একদিন এমরের চোখ- মুখের ভাব দেখে হিমানীমাসি বললেন, “তোমার এত কথায় কথায় ঠাণ্ডা লাগছে যখন, তখন ওই ঘরটা বদলে নাও। পূবের ঘরটায় থাকো।”

এ-বাড়িতে আর একটা ঘর ছিল। ভ্রমরের ঘরে রোদ না-ছিল এমন নয়, একটু বেলায় রোদ আসত এবং তাড়াতাড়ি চলে যেত। ঘরটা উত্তরের বাতাস পেত। হিমানীমাসি যে-ঘরটার কথা বললেন সেই ঘরটা ছিল খুব ছোট, বাড়ির পিছন অংশে। মালপত্র রাখা হত কিছু কিছু। আড়াল-না-পড়া আলাদা ঘর বলে সারা- বেলা রোদ পেত, ঘর থেকে আলো মুছত বিকেল পড়ে গেলে। উত্তরের বাতাস পেত না। ঘরটার একমাত্র অসুবিধে এই, মাথার ওপরকার সিলিংটা ছিল ময়লা, এক জায়গায় ছেঁড়া, টালি চুঁইয়ে জল পড়ত বর্ষাকালে। দরজা জানলার কাঠগুলো তেমন শক্ত ছিল না।

আয়া ঘরদোর পরিষ্কার করে দিল। পাশেই তার নিজের শোবার ঘর। টিসরি যে কত কাজের লোক, তার শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে সে কতখানি করতে পারে, ভ্রমরের নতুন ঘর সাজিয়ে দেওয়া দেখে সেটা বোঝা গেল। ছেঁড়া সিলিঙের গর্তটা সে কি করে যেন মেরামত করে দিল, দরজা জানলাগুলো ঠুকেঠাকে কাজে-চলা-গোছের করে দাঁড় করিয়ে ফেলল। তারপর সেই ঘরে ভ্রমরের খাট এল, বিছানা এল; একটা আলনা এনে রাখল আয়া; গোল মতন হালকা টেবিল এনে দিল ওষুধ- পত্র বাতি টুকিটাকি রাখার জন্যে।

অমলের প্রথমে মনে হয়েছিল, অসুখ হলে লোকে যেমন ঘরের মানুষকে সরিয়ে হাসপাতালে দিয়ে আসে, ভ্রমরকেও যেন সেই রকম হিমানীমাসি আলাদা ঘরে রোগশয্যা পেতে দিল। মনে হয়েছিল, ভ্রমরকে আলাদা করে দেওয়া হল। হয়ত ভ্রমরের অসুখ হিমানীমাসিকে শঙ্কিত ও সতর্ক করেছে।

পরে কিন্তু অমলের ঘরটা খারাপ লাগল না। নতুন ঘরে ভ্রমরকে যেন খুব সুন্দর মানিয়ে গেল। এ-বাড়ির সকলের থেকে সে যেমন আলাদা, সে যেমন আড়ালে-আড়ালেই থাকতে চাইত, তার যেমন নিজের একটি শান্ত নিভৃত স্বভাব ছিল—এই নতুন একফালি আলাদা ঘর সেই রকম ভ্রমরের নিভত ও স্বতন্ত্র স্বভাবের সঙ্গে মিশে গেল। তা ছাড়া অমল দেখল, তার ঘরের পিছন দিকের জানলা খুলে দিলে, একফালি বাঁধানো উঠোনের ওপাশে, ভ্রমরের ঘর দেখা যায়। অমলের খুব মজা লাগছিল। খোলা জানলা দিয়ে সে দেখত, ভ্রমর রোদভরা বিছানায় বসে কিছু সেলাই করছে হয়ত, হয়ত একটা বই মুখে করে শুয়ে আছে, কখনও বা গালে হাত রেখে বসে আছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। অমল পাথরের কুচি কিংবা কাগজের ডেলা পাকিয়ে ছুঁড়ে দিত। দিয়েই লুকোত।

ভ্রমর অবশ্য টের পেত। জানলা দিয়ে এ-পাশে তাকাত, হাসিচোখে তাকিয়ে থাকত।

“এই, কি করছ ?” অমল জানলায় দেখা দিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করত।

মাথা নাড়ত ভ্রমর; কিছুই করছে না।

“ঘুম মারছ?”

“না।”

“আমি আমার ফাদারকে চিঠি লিখলাম। এখন একবার পোস্টঅফিস যাবো।”

“যাও!”

“চিঠিটা পোস্ট করে দিয়ে আমি আসছি।”

ভ্রমর সমস্ত মুখে হাসি ছড়িয়ে মাথা নাড়ত। এস। আমি ত বসেই আছি।

আজকাল ভ্রমরের কাছাকাছি, ভ্রমরের পাশাপাশি থাকতেই অমলের ভাল লাগে। বাইরে ঘুরে বেড়াবার সঙ্গী ছিল ভ্রমর, কৃষ্ণাও থাকত কখনও-কখনও। ওরা ঘর ছেড়ে বেরোতে পারে না বলে অমলও বড় একটা বাইরে যায় না। একদিন টাওয়ার দেখতে গিয়েছিল একাই, কোনো সুখ পায় নি। আর একদিন গিয়েছিল বেশ একটু দূরে ঝরনা দেখতে, মেসোমশাই বলে-বলে পাঠিয়েছিলেন, ভাল লাগে নি অমলের। ঝরনা বলেই মনে হয় নি তার। পাথর চুঁইয়ে জল পড়লেই ঝরনা হয় নাকি!— দূর….।

ভ্রমর জিজ্ঞেস করেছিল, “রামধনু, দেখ নি?”

“কিসের রামধনু! ওই ঝরনার আবার রামধনু!” অমল নাক কুঁচকে বলেছিল।

ভ্রমর একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। ঝরনাটা এত খারাপ কিছু নয়। বলেছিল, “তুমি ভাল করে কিছু দেখ নি।”

“দেখি নি: দেখতে ইচ্ছেও করল না।”

“তবে! মিছিমিছি নিন্দে করছ কেন?”

“নিন্দে আবার কি! ভাল লাগে নি, লাগে নি।—তুমি যদি আমাদের দিকে যাও ঝরনা দেখিয়ে দেব। জল পড়ার শব্দ শুনলে মাথা ঘুরে যাবে তোমার।” বলেই অমল কি ভাবল একটু তারপর ভ্রমরের চোখে-চোখে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, “তুমি না থাকলে আমার বেড়াতে-টেড়াতে ভালই লাগে না। একা-একা!…হ্যাত্‌, অসুখ করে যা-কাণ্ড করলে একটা—সব মাটি হয়ে গেল।”

সত্যিই অমলের সব মাটি হয়ে গিয়েছিল। বাইরে আর তার বেরুতে ইচ্ছে করত না, ভাল লাগত না। ভ্রমরের অসুখ তাকে খুব হতাশ করেছিল, মন ভেঙে দিয়েছিল। সে এই অসুখের কথা চিন্তা করত। ভ্রমরের ওপর তার রাগ হত, দুঃখ হত। ইচ্ছে করে, নিজের অসুখ লুকিয়ে রেখে-রেখে ভ্রমর আজ এই রোগটা বাধিয়েছে। সব জিনিস কি আর চেপে রাখা যায়। মানুষের শরীর অন্য জিনিস। ভ্রমর যে কেন হোমসাইন্স পড়েছিল ভগবানই জানেন। সেই বেয়াড়া কথাটা অমলের মনে পড়ত। ইনকিউবেশন পিরিআড: ভ্রমরকে অমল শুনিয়ে দিয়েছে কথাটা— “বুঝলেন হোমসাইন্স-এর স্টুডেন্ট মশাই, একেই বলে ইনকিউবেশন পিরিআড। ভেতরে ভেতরে আপনি রোগটিতে তা দিচ্ছিলেন।”—এ-রকম বোকা কেন হয় মানুষ? বোকামির ফল এবার ভোগ কর।

ভ্রমরকে আজকাল দেখলেও বড় মায়া হয়। সমস্ত মুখটি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, যেন গালে মুখে কোথাও এক ফোঁটা রক্ত নেই। ভীষণ শুকনো দেখায়, খড়ি ওঠা-ওঠা। লাবণ্য নিবে যাচ্ছে। শীর্ণ প্রাণহীন চেহারা হয়ে এসেছে, হাত দুটি রোগা, আঙুলগুলো নিরক্ত। ভ্রমর যে এত দুর্বল ও নিস্তেজ হয়ে গেছে অমল বেশ বুঝতে পারে। শুধু চোখ দুটি এখনও টলটল করছে। যেন ভ্রমর বাইবেলের সেই সরল দুটি চোখ নিয়েই বেঁচে থাকবে।

এ-সব সত্ত্বেও অমল আশা করছিল, এতটা দুর্বল ভ্রমর থাকবে না। ডাক্তারে ওষুধে পথ্যে তার চিকিৎসা চলছে, সে ভাল হয়ে উঠবে, তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।

ভ্রমরের শরীর তখন একটু ভালর দিকেই ফিরছিল।

সেদিন খুব শীত পড়েছিল। দুপুর থেকেই মনে হচ্ছিল, বাতাস যেন বরফ-কুচির মতন ঠাণ্ডা, রোদ একেবারে ফিকে লাগছিল, গায়ের হাড়মাংসে কনকনে ভাবটা এমন করে জড়িয়ে ধরেছিল যে সব সময় কুঁকড়ে থাকতে হচ্ছিল। উত্তরের কোনো হিমেল হাওয়া এসে পড়েছিল বোধ হয়।

এই রকম ঠাণ্ডার দিনে হিমানীমাসি এবং মেসোমশাই বাড়ি ছিলেন না। বিকেলের পর একটা মোটর গাড়ি এসেছিল। শীতের সব রকম সাজগোজ করে তাঁরা বেরিয়ে গেছেন। ফিরতে রাত হবে।

মেসোমশাইরা কোথায় গেছেন অমল শুনেছে। এখান থেকে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। আজ এদিককার মিশনারীদের মস্ত এক দীনজনের মেলা আছে। সামনে বড়দিন। বড়দিনের আগে আগে প্রতি বছর একটা মেলা বসায় মিশনারী সোসাইটির লোক। অনেকটা এক্সিবিশানের মতনই। কিছু দোকানপত্র থাকে অবশ্য, কিন্তু এই মেলায় সব কিছুই “চ্যারিটি ফর পুয়োর”-এর জন্যে। আতুর সেবার উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ, পোশাক-আশাক সংগ্রহ, খাদ্য সংগ্রহ। লটারি খেলা হয়, কনসার্ট বাজানো হয়, বেবী-শো হয়।

হিমানীমাসি যাবার সময় দুটো উলের জামা, পুরনো চাদর একটা, কয়েকটা শাড়ি, আরও যেন সব কি-কি পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে গেছেন। মেসোমশাই যাবার সময় হঠাৎ বলেছিলেন, ‘অমল, তোমার নামে এবার লটারি খেলব। যদি জিতে যাই, টাকাটা তবে তোমার নামেই ডোনেট করে দেব।’ বলে মেসোমশাই হেসেছিলেন।

অমল তখন বুঝতে পারে নি, পরে ভ্রমর তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। ‘লটারির টাকা কেউ নেয় না। চ্যারিটিতেই দিয়ে দেয়।’

হিমানীমাসিরা চলে যাবার পর অমল কৃষ্ণাকে বাগানে ডেকে নিয়ে গিয়ে খানিক ব্যাডমিন্টন খেলল। শীতের জড়তা দূর করবার জন্যেই বোধ হয়। কিন্তু বাতাসের দাপটে খেলতে পারল না, বাইরেও থাকতে পারল না। চোখে মুখে গায়ে যেন কনকনে বাতাসটা কামড় দিচ্ছিল। হিহি করে কাঁপুনি উঠছিল সর্বাঙ্গে। বিকেলের মরা আলোটুকু দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল। কুয়াশা ঘন হয়ে চারপাশ ঢেকে ফেলল, ভার ধোঁয়ার মতন থিকথিক করছিল সর্বত্র।

কৃষ্ণার পরীক্ষা চলছে। কাল তার হিন্দী ভার্নাকুলার। মুখ হাত ধুয়ে পড়তে বসতে গেল।

অমল যখন ঘরে এল তখন আয়া বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছে ঘরে-ঘরে। জানলা বন্ধ করে দিচ্ছে। ভ্রমরের সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। অমল ভাবল, ভ্রমর তার ঘরে বসে আছে।

শীতের জন্যে অমল আরও একটু বেশী রকম জামা চাপল। সে যখন কোট গায়ে দিয়ে গলায় মাফলার বেঁধে শিস দিচ্ছিল, তখন তার কানে গেল ভ্রমর কি যেন বলছে আয়াকে করিডোর দিয়ে যেতে-যেতে। মনে হল, ভ্রমর ও-পাশে কোথাও যাচ্ছে। পা দুটো ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছিল বলে অমল বিছানায় বসে মোজা পরে নিল।

আজ এখন খুব গরম চা খেতে হবে। হিমানীমাসি যখন নেই তখন অমল মনে-মনে খুব খুশী হয়ে ভাবল, আয়াকে বললেই এখন চা করে দেবে।

মোজা পরে জুতোয় পা গলিয়ে অমল যখন বাইরে আসছে তখন তার কানে অর্গানের শব্দ এল। করিডোর প্রায় অন্ধকার, কৃষ্ণার ঘরে বাতি জ্বলছে, খাবার ঘর থেকে পাতলা একটু, আলো এসে পড়েছে। অর্গানের শব্দ শুনেই অমল বুঝতে পারল ভ্রমর অর্গানে গিয়ে বসেছে। অনেক দিন পরে আজ আবার ভ্রমর অর্গানে হাত দিল।

অমল খুশী হল। করিডোর দিয়ে যাবার সময় সে একবার কৃষ্ণার ঘরে উঁকি দিল। কৃষ্ণা খুব আয়াস করে পড়তে বসেছে। বিছানায় আসন করে বসে গায়ে র‍্যাপার জড়িয়েছে, পা চাপা দিয়েছে লেপে।

“আরে বাব্বা, এত চাপাচুপি দিয়ে পড়তে বসেছ! ঘুমিয়ে পড়বে যে!” অমল হেসে বলল।

“না, ঘুমোবো না! কী রকম জাড়া!”

“চা খাবে?”

“আপনি বানাবেন?”

“অ্যারেঞ্জমেন্ট করছি।” অমল আশ্বাস দিয়ে হাসল। “আয়াকে বলি—”

কৃষ্ণা স্প্রিঙের ওপর দুবার যেন বসে বসেই লাফিয়ে নিল। বলল, “আয়া আমায় দেবে না।”

“দেবে। জরুর দেবে।” অমল হেসে বলল, “তুমি পড়ো। চা পাবে। ওআর্ড ইজ ওআর্ড।”

অমল হাসিমুখে বেরিয়ে এল। করিডোর দিয়ে যেতে-যেতে শুনল আস্তে করে অর্গান বাজছে। খাবার ঘরের দরজার কাছে আয়ার সঙ্গে দেখা হল। অমল চা তৈরী করে দেবার কথা বলল। সে কৃষ্ণা এবং ভ্রমরের জন্যেও চা করতে বলল।

বসার ঘরে দরজা জানলা বন্ধ। পরদা টানা। বাতি জ্বলছে। ভ্রমর অর্গানের সামনে বসে অন্যমনস্কভাবে একটা সুর বাজাচ্ছিল। অমল দেখল, অমর পোশাক-আশাকের কোনো তাচ্ছিল্য করে নি। গরম পুরো-হাতা জামা গায়ে দিয়েছে। গলার কাছে ফ্লানেলের সাদা মাফলার জড়ানো। অর্গানের রিডের ওপর তার দু-হাতের আঙুল নরম করে বুলোচ্ছিলো: মুখ তুলে অমলকে দেখল।

কাছে এসে বসল অমল। ভ্রমর গাইছিল না, অন্যমনস্কভাবে সুরটা বাজিয়ে যাচ্ছিল। আজ ভ্রমরকে সামান্য ভাল দেখাচ্ছিল। তার মাথার চুলগুলি পরিষ্কার, একটু, চকচক করছে, কপালের সিঁথিটি স্পষ্ট, পিঠের ওপর বিনুনি ছড়ানো রয়েছে। চোখমুখে একটু, সতেজ ভাব ফুটেছে যেন!

“আরে ব্বাস, আজ একেবারে অর্গান বাজাতে বসে গেছ!” অমল খুব খুশী হয়েছিল বলে ঠাট্টা করে বলল। তার মুখে তৃপ্ত হাসি।

ভ্রমর ঠোঁট খুলে আরও একটু, হাসি ছড়াল।

অমল বলল, “গায়ে তাহলে তোমার বেশ শক্তিটক্তি হচ্ছে।”

“আমি শুধু, বিছানায় শুয়ে থাকি নাকি?” ভ্রমর জবাব দিল।

“না সব সময় শুয়ে থাকো না; তবে দেদার ফাঁকি মারছিলে।”

“ফাঁকি! ইস্‌—!” ভ্রমর চোখের ভুরু বাঁকা করে বলল, “কী মিথ্যুক!”

অমল হাসল। ভ্রমর সত্যিই সব সময় শুয়ে থাকত না; আগের মতন সংসারের নানা রকম ছোট-ছোট কাজ সে করতে পারত না আজকাল, তবু টুকটাক কিছু করত। এখনও ভোর বেলায় অমলকে সে ডেকে দেয় রোজ; মেসোমশাইয়ের ভোরের চায়ের সঙ্গে অমলকে চা করে দেয়।

“তোমাকে আজ খানিকটা ফ্রেশ দেখাচ্ছে—” ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে ভ্রমরকে দেখতে-দেখতে অমল বলল।

“আজ আমার ভাল লাগছে।” ভ্রমর সামনের দিকে তাকিয়ে আপন মনে কথা বলার মতন করে বলল। সে আনমনা অর্গান বাজিয়ে যাচ্ছিল, ধীরে-ধীরে।

“শরীর ভাল থাকলেই মন ভাল থাকবে।” অমল বিজ্ঞের মতন গলা করে জবাব দিল। এক মুহূর্ত থেমে আবার বলল, “তোমার শরীরও আজ ভাল দেখাচ্ছে। রক্তটক্ত হচ্ছে মুখে।”

ভ্রমর কিছু বলল না। আঙুল অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল বোধ হয়, অর্গানের দিকে তাকিয়ে সুরটা ঠিক করে নিল।

সামান্য সময় নীরব থেকে অমল কি ভেবে হঠাৎ গলা গম্ভীর ও ভারী করে বলল, “ভ্রমর, অনেকদিন তুমি কোনো উপাসনা গাও নি। তোমার কোনো কাজে মন নেই।” বলে অমল মুখ গম্ভীর করে থাকল।

ভ্রমর হেসে ফেলল। অমল মা’র মতন, মা’র বলার ধরন নকল করে কথাগুলো বলল। কী রকম দুষ্টু!

“তোমার খুব সাহস বেড়েছে।” ভ্রমর নকল গলায় ভর্ৎসনা করল। “দাঁড়াও, আমি মাকে বলে দেব।”

“দিও। আমি বলব, আমি ওকে উপাসনা গাইতে বলেছিলাম।”

“মা বিশ্বাস করবে না।”

“কেন?” হিমানীরানী বিশ্বাস, ভ্রমরলতা বিশ্বাস না হলে আর বিশ্বাস করা যায় না!” অমল মজার মুখ করে বলল।

“আমার নাম ভ্রমরলতা নয় মোটেই।” ভ্রমর হাসল।

অমল যেন কানই করল না, বলল, “ভ্রমররা লতাটতা ফুলটুলের কাছেই খালি ওড়ে। কি রকম একটা রাগের শব্দ করে, শুনেছ?”

ভ্রমর অর্গান বাজানো থামিয়ে দিয়েছিল। থামিয়ে অমলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলকে। বলল, “তুমি ভ্রমর দেখো নি। কেমন দেখতে হয় বল ত?”

“দেখি নি! কি বলছ!…” অমল কেমন রঙ্গর চোখমুখ করে বলতে লাগল, “দেখেছি। সামনেই দেখতে পাচ্ছি।” বলতে-বলতে অমল হোহো করে হেসে উঠল।

ভ্রমর কেমন বোকা হয়ে গেল। হেসে ফেলল। এবং অকস্মাৎ সে কেমন লজ্জা অনুভব করল।

খানিক পরে অমলই বলল, “একটা গান গাও না!”

“না।”

“কেন?”…আস্তে আস্তে গাও। ভ্রমরের মতন করেই গাও।”

ভ্রমরের চোখের দুই পাতা জুড়ে লজ্জা মাখানো ছিল তখনও। বলল, “তুমি দিন দিন খুব ইয়ার্কি শিখছ!”

“একটা কিছু, যদি এখান থেকে শিখে না যাই তবে লোকে বলবে কি! দেশ-ভ্রমণ থেকে শিক্ষা পাওয়া দরকার, বুঝলে না। স্কুলে পড়েছি।” অমল আবার হাসল।

ভ্রমর বুঝতে পারছিল অমলকে আজ আর কথায় পারা যাবে না। খুব বাক্য-বাগীশ হয়েছে ছেলে। এত আনন্দের আজ কি পেল অমল, ভ্রমর বুঝতে পারল না।

টিসরি চা নিয়ে এল। ট্রেতে করে চায়ের পেয়ালা সাজিয়ে এনেছে, তৈরী চা। অমল বলল, “আমি চা তৈরী করতে বলেছিলাম। যা শীত, বরফ হয়ে যাচ্ছি। তুমি এক পেয়ালা খাও, ভ্রমর; বেশ গরম লাগবে শরীর।”

আয়া চায়ের পেয়ালা তুলে দিল অমলের হাতে, ভ্রমরকে দিল। কৃষ্ণাকেও দিয়ে এসেছে। চা দিয়ে চলে যাবার সময় ভ্রমরকে বলল, ভ্রমরের ঘরে আগুন রেখে এসেছে।

অমল চা খেতে-খেতে বলল, “আমায় একটা জিনিস খাওয়াবে?”

ভ্রমর বুঝতে পারল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল। অমলের মুখে যেন কিসের ফন্দি।

“মেসোমশাইয়ের ঘর থেকে দুটো সিগ্রেট চুরি করে নিয়ে এস না। এই শীতে একটু, স্মোক করি।”

ভ্রমরের চোখের পাতার পলক পড়ল না। বড়-বড় চোখে সে তাকিয়ে থাকল। অমলের সত্যিই খুব সাহস বেড়ে গেছে। কয়েক পলক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর ভ্রমর জিবের কেমন একটা শব্দ করল, যার অর্থ, খুব পাকামি হচ্ছে, না?

“চোখ গোল্লা করে দেখছ কি?” অমল বলল, “বিকেল থেকেই খুব সিগ্রেট খেতে ইচ্ছে করছে। বাজারে যেতে পারলে আমি একটা গোটা প্যাকেট কিনে আনতাম।”

“তুমি খুব চালাকি শিখেছ আজকাল।” ভ্রমর বলল।

“চালাকি কিসের। সিগ্রেট খাওয়া কি মদ খাওয়া?”

“তোমার জন্যে আমায় বাবার ঘর থেকে সিগ্রেট চুরি করতে হবে! খুব মজা পেয়েছ—”

“চুরি না ভাবলেই চুরি নয়। সিগ্রেট চুরিতে পাপ হয় না। আমি দেখেছি, বউদি কতবার বাবার পকেট থেকে সিগ্রেট চুরি করে দাদাকে দিয়েছে।”

“আমি এনে দেব না। তুমি নিয়ে এস।” ভ্রমর বলল। বলে একটুও হাসল না। চায়ের পেয়ালায় মুখ নামিয়ে হাসি চেপে থাকল।

অমল লক্ষ করে দেখল ভ্রমরকে, বলল, “তুমি একেবারে—একেবারে—কি বলে যেন—পিউরিটান।”

“পিউরিটান—”

“গোঁড়া। গোঁড়া বোষ্টম একেবারে।”

ভ্রমর পাতলা দুটি ঠোঁট ভেঙে হেসে ফেলল, তার সাদা সুন্দর দাঁতগুলি দেখা গেল স্পষ্ট। ডালিমের দানার মতন দেখাল। বলল, “চুরি করতে না পারলে বুঝি গোঁড়া হয়?”

অমল ঠিক জবাব খুঁজে পেল না। জবাবের জন্যে তার চিন্তাও ছিল না। ভ্রমরের সুন্দর হাসিটি সে চোখ ভরে দেখছিল।

বসার ঘরের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। তবু সমস্ত দরজা জানলা বন্ধ থাকায় সেই আলো ঘরের মধ্যে যেন একটু ভাল করেই ছড়িয়ে পড়েছিল। অমল ভ্রমরকে ভাল করে দেখল; মনে হল, ভ্রমরকে এত অসুখের মধ্যেও আজ বড় মধুর দেখাচ্ছে। তার ছোট্ট কপালে চুলের একটু আঁশও নেই, তার সরু দুর্বল গালে খুব পাতলা একরকম খুশী ফুটে আছে, টলটলে দুটি চোখে চাপা হাসি। দেখতে দেখতে অমল বলল, “ভ্রমর, তুমি যখন আরও বড় হবে, তোর শরীর সেরে যাবে, তখন তুমি খুব বিউটিফুল হবে।”

কথাটা অমল আবেগবশে বলেছিল। সে আরও বলতে যাচ্ছিল কিছু। কথা খুঁজে না পেয়ে বলতে পারল না। মুগ্ধ আবেশ-চোখে তাকিয়ে থাকল।

ভ্রমর প্রথমটায় যেন বুঝতে পারে নি, বা খেয়াল করে নি। পরমুহূর্তে সে খেয়াল করতে পারল, অনুভব করতে পারল। দু-পলক অচেতনের মতন তাকিয়ে থাকল অমলের চোখের দিকে, তারপর পলক ফেলে মুখ নত করল।

দুজনেই চুপ করে থাকল। এবং দুজনেই বেশ অন্যমনস্ক ও বিমনা হয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে অন্য কিছু লক্ষ করছিল। কিছু সময় কেটে গেল। শেষে ভ্রমর বলল, “ও-ঘরে চলো; এখানে খুব ঠাণ্ডা লাগছে।”

ভ্রমরের ঘরে পা দিয়ে অমল বেশ আরাম পেল। আয়া বড় মাটির মালশায় কাঠকয়লার আগুন রেখে দিয়ে গেছে এক পাশে। ঘরের বাতাস কনকন করছিল না। খুব শীত পড়ার পর থেকে আয়া এইভাবে আগুন দিয়ে যায় রাত্তির-বেলায়, বসার ঘরে দেয়, হিমানীমাসিদের ঘরে দেয়, ভ্রমরের ঘরে দেয়। আজ বসার ঘর ফাঁকা বলে দেয় নি।

অমল এগিয়ে গিয়ে ভ্রমরের বিছানায় বসল। ভ্রমর আসছে। সে অমলকে আসতে বলে কোথায় গেল যেন। বিছানায় বসে অমল মাথার ওপরকার সিলিং দেখল। ছায়া মাখানো, অন্ধকার। ঘরের দুটি জানলাই একেবারে বন্ধ। বিছানাটা নরম। কেমন এক গন্ধ উঠছে—গন্ধটা ভ্রমরের গায়ের—অমল এই গন্ধ ঘ্রাণে চেনে। ক্যান্থারাইডিন তেল, ওটিন পাউডার আর যেন কি-কি মেশানো গন্ধ। কিন্তু ভ্রমরের শরীরের গন্ধে এর বেশীও কি যেন থাকে। দুর্বলতার গন্ধ কি? হয়ত। ভ্রমরের কোমল ও ভীরু, অসুস্থ ও শীর্ণতার কোনো গন্ধ আছে, নাকি ভ্রমরের নম্রতা ও মায়া-মমতার কোনো গন্ধ, অমল ঠিক বুঝতে পারল না।

অমল উন্মনা এবং উদাস হয়ে বিছানায় পিঠ দিয়ে লেপের ওপর শুয়ে পড়ল; তার পা মাটিতে, কোমর থেকে মাথাটা বিছানায়। শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গাইল: ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।’

প্রথমে মৃদু, গলায়, তারপর একটু গলা তুলে গানের প্রথম দু-কলি গাইতেই ভ্রমর ঘরে এল। ভ্রমর এসেছে অমল বুঝতে পারল। বুঝতে পেরেও উঠল না। আরও একবার দু-কলি গেয়ে শেষে পিঠ তুলে সোজা হয়ে বসল।

ভ্রমর দাঁড়িয়েছিল সামনে, দরজা থেকে মাত্র দু-পা এগিয়ে এসে। অবাক, নিঃশব্দ।

অমল খুব যেন একটা বিস্ময়কর কিছু করে ফেলেছে, এমন মুখ করে বলল, “কি রকম বিউটিফুল গান দেখলে ত! গাইতে না গাইতেই তুমি এসে গেলে!” বলে অমল গলার মাফলারটা খুলে বিছানায় রাখল। “গানটা খুব সুন্দর। আমি জানি না। মাত্র দুটো লাইন জানি। বউদি গায়।”

ভ্রমর একটু সরে এল। বিস্ময় ভাব সামান্য যেন কেটেছে। আড়ষ্টতা ছিল, তবু, ভ্রমর বলল, “সবটা শিখলেই পারতে!”

অমল দু-মুহূর্ত ভাবল। ভেবেই বলল, “আমি কি জানতাম এখানে একটা ভ্রমর আছে!” বলে অমল দুষ্টুমির মুখে হাসল।

ভ্রমর কেমন বিব্রত বোধ করল। মুখ ফিরিয়ে নিল। সত্যি, অমল জানত না এখানে ভ্রমর আছে।

সামান্যক্ষণ চুপচাপ। তারপর ভ্রমর হাতের মুঠো থেকে সিগারেট বের করে বাড়িয়ে দিল। “এই নাও।…তোমার জন্যে চুরি করতে হল।” বলে কত যেন দুষ্কর্ম করেছে এ-রকম একটা ভাব করে ঠোঁট গাল গম্ভীর করল ভ্রমর।

অমল হাততালি দিয়ে উঠল আনন্দে। বলল, “পরের জন্যে চুরি করলে তাকে চোর বলে না!” হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিল অমল। ভ্রমর একটা মাত্র সিগারেট এনেছে। ভীষণ কৃপণ। অমল কাঠকয়লার পাত্রর কাছে বসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, “তুমি খুব কঞ্জুস; মাইজার। মাত্র একটা সিগারেট আনলে।”

“একটাই খাও। নেশাখোর হতে হবে না।” ভ্রমর বড়জনের মতন গলা করে বলল।

“একটা আমি দু-মিনিটে উড়িয়ে দেব।” অমল সিগারেট ধরিয়ে নিল।

কি ভেবে ভ্রমর বলল, “বাড়ির মধ্যে সিগারেট খাচ্ছ। যদি কেউ দেখতে পায়?”

“পাবে না। কৃষ্ণা জানে। আমি একদিন তার সামনে খেয়েছি। সে এখন পড়ছে—আসবেও না।” অমল ধোঁয়া উড়িয়ে বলল। “আয়াও এখন আসছে না।”

“আহা, আমার ঘরে যে গন্ধ থাকবে!”

“উড়ে যাবে। খানিকটা পরেই উড়ে যাবে।”

বলে অমল দরজার কাছে গেল, মুখ বাড়িয়ে বাইরেটা দেখল তারপর খুব মেজাজ করে পা ফেলে ভ্রমরের বিছানার দিকে এল। “তোমার ঘরে তোমার বেশ একটা গন্ধ আছে।”

ভ্রমর বিছানায় বসেছে ততক্ষণে। অমলের কথায় চোখ তুলে তাকে দেখল।

অমল বলল, “তোমার বিছানায় শুয়ে ছিলাম—হঠাৎ আমি গন্ধটা পেলাম। ভেরী বিউটিফুল।”

ভ্রমর সর্বাঙ্গে শিহরন অনুভব করল। তার মন যেন উষ্ণতাবশে কেমন স্বাভাবিক থাকল না। অমলের মুখের গন্ধ সে পুনরায় স্মরণ করতে পারল। তার আবার সেই গন্ধ পেতে বাসনা জাগল।

অমল এগিয়ে এসে বিছানার কাছে দাঁড়াল। বলল, “আমি দেখেছি, মেয়েদের গায়ে কি রকম একটা গন্ধ থাকে। মা’র শাড়ির গন্ধ থেকে আমি বলে দিতে পারি এটা মা পরেছিল।…তুমি বিশ্বাসই করবে না! দিদির চিরুনি এনে দাও, আমি ঠিক বলে দেব ওটা মেজদির মাথার—” বলতে বলতে অমল থামল। হয়ত তার বাড়ির মা এবং দিদির কথা মনে পড়ে গেল। সামান্য অন্যমনস্ক হল। তারপর নিশ্বাস ফেলে আবার বলল, “আমার গন্ধের নাক খুব শার্প। তোমার গন্ধটাও আমার চেনা হয়ে গেছে। একদিন টেস্ট করে দেখো—ঠিক বলে দেবো।”

ভ্রমর কিছু শুনছিল না। সে শুনতে পাচ্ছিল না। তার সমস্ত চেতনা কোনো আশ্চর্য জগতে যেন ভেসে গিয়েছিল। সেখানে কোনো অদ্ভুত শক্তি তাকে চুম্বকের মতন ক্রমাগত আকর্ষণ করছিল। ভ্রমর ঘুমের মধ্যে সময় হারানোর মতন তার অনেকগুলি প্রখর চেতনা হারিয়ে এই স্রোতে ভেসে গেল। তার রোমাঞ্চ হয়েছিল, তার ভীরুতা হৃদয়কে কম্পিত করছিল।

অমল বিছানায় এসে বসল। বলল, “ছেলেদের কোনো রকম গন্ধ নেই গায়ে। আমরা সবাই এক রকম।”

“তোমার আছে।” ভ্রমর বিছানার ওপর চোখ স্থির রেখে যেন স্বপ্ন দেখতে-দেখতে অস্ফুট গলায় বলল আচ্ছন্নের মতন।

অমল ভ্রমরের চোখ লক্ষ করে বিছানার দিকে তাকাল, বিছানার ওপর একটু, ভাঁজ, ভাঁজটা আমলের কেমন রহস্যময় লাগল। চোখ তুলে ভ্রমরকে দেখল। ভ্রমরের সমস্ত মুখ কি রকম টকটক করছে, যেন রক্ত ছুটে এসেছে; ভ্রমরের চোখের পাতা প্রায় বোজা, নাকের ডগাটি ফুলে উঠেছে। অমল এ-রকম মুখ ভ্রমরের দেখে নি। তার চোখে ভ্রমর এই মুহূর্তে কেমন জ্ঞান ও বোধের অতীত এক অন্যরকম ভ্রমর হয়ে উঠল।

অমল কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বসে থেকে হঠাৎ হাত বাড়াল। ভ্রমরের কোলের ওপর থেকে হাত তুলে নিল। তার মনে হল, ভ্রমরের হাত কাঁপছে, মনে হল, তার নিজের হাত খুব গরম। সিগারেটটা ফেলে দিল অমল মাটিতে।

“এই—” অমল আস্তে করে ডাকল।

ভ্রমর মুখ তুলছিল না। অমল আবার ডাকল। ভ্রমর আনত মুখেই থাকল। অমল নীচু, মুখ করে ভ্রমরকে দেখতে গিয়ে দেখল ভ্রমরের চোখে জল, ভ্রমর কাঁদছে। ভ্রমর কেন কাঁদছে, অমল খানিকটা যেন বুঝল খানিকটা বুঝল না। তার খারাপ লাগল। মনে বড় কষ্ট পেল। তার বুকের মধ্যেও কি-রকম করছিল।

“এই— একি!” অমল হাত বাড়িয়ে ভ্রমরের থুতনি তুলে মুখ উঁচু করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। ভ্রমর কিছুতেই মুখ ওঠাবে না।

অমল ভ্রমরের আরও সামনে ঝুঁকে পড়ে ভ্রমরের মুখ তুলে ধরল। ভ্রমরের গাল ভিজে গেছে, ঠোঁট শক্ত করে ভ্রমর কান্না চাপবার চেষ্টা করছে, তার ঠোঁট থর-করে কাঁপছে।

অমল আদর করে, মায়াবশে, ভালবেসে ভ্রমরকে আরও কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছিল। তখন ভ্রমর অমলের বুকে মুখ লুকোলো। না, লুকোনো নয়, অমলের বুকের কাছে তার মাথা এবং মুখ সমর্পণ করে দিল।

ভ্রমরের চুল, ভ্রমরের মুখ, ভ্রমরের সর্বস্ব থেকে যে-গন্ধ উঠল—অমল সেই গন্ধে আচ্ছন্ন ও নিমগ্ন হয়ে ভ্রমরের মুখের পাশে নিজের গাল রাখল। ওরা পরষ্পর উভয়ের হৃদয় অনুভব করে আজ দুটি গাল জোড়া করে, দুটি মুখ একত্র করে এবং ওষ্ঠ স্পর্শ করে কোনো গম্ভীর অবিচ্ছিন্ন রহস্যময় আনন্দ অনুভব করছিল।

রাত্রে অমলের ঘুম ছিল না। সর্বক্ষণ সে ভ্রমরকে ভাবছিল। এই ভাবনা অন্য দিনের মতন নয়; অন্যান্য দিন সে যখন ভ্রমরের কথা ভাবত তখন সহানুভূতি করুণা মমতা ও প্রীতির মন নিয়ে ভাবত। হয়ত ভালবাসার মন নিয়েও। কিন্তু সে-ভালবাসা আজকের মতন নয়। আজ অমল তার ভালবাসাকে এত স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারছিল যে, তার মনে হচ্ছিল সে যেন দেখতে পাচ্ছে সব।

ভালবাসাকে দেখতে পাওয়ার জন্যেই এই অনুভূতিটা তার কাছে আবিষ্কার বলে মনে হচ্ছিল। সহসা কি যেন অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে গিয়ে সে এই নতুন দুর্লভ মূল্যবান জিনিসটা আবিষ্কার করে ফেলেছে। অমল প্রতি মুহূর্তে রোমাঞ্চিত ও শিহরিত হচ্ছিল। খুব বড় নদী, যার এ-পার ও-পার দেখা যায় না, সেই রকম নদী যদি কোনো নতুন সাঁতারু পার হয়ে আসে তবে তার মনে যে হর্ষ ও বিশ্বাস্‌ জাগে, দুঃসাধ্য সাধনের তৃপ্তিতে সে সর্বক্ষণ রোমাঞ্চিত হতে থাকে, অমলের মনে সেই রকম হর্ষ ও রোমাঞ্চ হচ্ছিল। নিজের এই নতুন চেতনা অমলকে প্রসারিত ও পূর্ণ করছিল। সে ভাবছিল, তার হাতে হঠাৎ এমন একটা কিছু এসে গেছে যা অত্যন্ত সুন্দর, যার অসম্ভব শক্তি, যা মানুষকে সবচেয়ে বেশী সুখ দেয়।

এই সুখ অমলকে আচ্ছন্ন করে রাখছিল। এ-রকম আশ্চর্য সুখ এবং আনন্দ অমল আগে আর কখনও অনুভব করে নি। তার মন কখনো কোনো কারণেই এত অধীর ও উতলা হয় নি। অমল হৃদয়ে অজস্র সুখ উপচে-ওঠা, সুখগুলির নরম ও অদ্ভুত ফেনা মাখামাখি হয়ে যাবার তৃপ্তি ও শিহরন অনুভব করছিল। সে বুঝতে পারছিল, তার বুক মাঝে মাঝেই থরথর করে কেঁপে উঠছে, তার হাত মুখ ঘাড় বেশ গরম, তার কপাল এবং কান জ্বালা করছে, তার চোখ ভ্রমর ছাড়া জগতের আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না।

বাইরের প্রচন্ড শীত অন্যদিন অমলকে সঙ্কুচিত ও আড়ষ্ট করত। আজ সে এত উত্তেজিত এবং অস্থির হয়েছিল যে, অমল শীত অনুভব করতে পারছিল না। সে ঘুমের জন্য কাতর হচ্ছিল না। বরং পায়ের পাতা গরম লাগায় পা থেকে লেপ সরিয়ে দিয়েছিল। সে ঘুম চাইছিল না। মানুষ নিজেকে কোনো-কোনো সময় স্বাভাবিক নিয়ম এবং স্বভাব ও প্রকৃতির ঊর্ধ্বে তুলে আনতে চায়। অমল সেই রকম চাইছিলঃ সে তার বয়স এবং অপরিণত মনকে বাস্তব কয়েকটি বাধা থেকে মুক্ত করে প্রসারিত করতে চাইছিল। সে ভাবছিল, তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে, সে পূর্ণবয়স্ক হয়েছে, সে নারীর প্রেম ও স্পর্শ পেয়েছে, সে আজ যথার্থ পরিণত। সাবালক এবং পরিণত ব্যক্তির মতন সে কোনো কোনো দুরূহ চিন্তাও করতে চাইছিল।

আজকের ঘটনাটি কি করে ঘটল অমল ভাববার চেষ্টা করেছিল। সে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল হঠাৎ কেমন করে সব ঘটে গেছে। সে কিছু বুঝতে পারে নি, ভ্রমর কিছু বুঝতে পারে নি—তবু, ও-রকম হয়ে গেল। ভ্রমরকে তখন অন্যরকম দেখাচ্ছিল, ভ্রমরের জন্যে তখন অমলের বুকের মধ্যে কি রকম যে করছিল বোঝানো যায় না। বোধ হয় তখন অমল ভ্রমরকে এত বেশী নিজের করে ভাবতে চাইছিল, তার জন্যে এত কিছু করতে চাইছিল, বলতে চাইছিল, ওকে সবই দিতে ইচ্ছে করছিল যে, ভ্রমরকে তার তীব্র ইচ্ছাটুকু না জানিয়ে পারে নি। এই আকাঙ্ক্ষাই কখন গড়ন পেয়ে ভালবাসা হয়েছিল। ভ্রমরও অমলের কাছে এই ভালবাসা চাইছিল।

পরে অমলের লজ্জা এবং ভয় হয়েছিল। সে ভেবেছিল, কেউ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু কেউ দেখে নি। অমল ভেবেছিল, ভ্রমর রাগ করবে, ভ্রমর তাকে খারাপ ভাববে। ভ্রমর রাগ করে নি, তাকে খারাপ ভাবে নি। ভ্রমর রাগ করলে কিংবা খারাপ কিছু ভাবলে ও-রকম মুখ করত না। তার মুখ তখন টলটল করছিল, আভা দিচ্ছিল রোদ-মাখা ফুলের মতন অনেকটা; সেখানে রাগ বিরক্তি ছিল না। ভ্রমর তারপর আর একটিবার মাত্র চোখ তুলেছিল। কোনো কথা বলে নি। অমল চলে এসেছিল। যদি ভ্রমর রাগ করত কিংবা তাকে খারাপ ভাবত তাহলে ফুলের মতন মুখ করে তাকে দেখত না। তার চোখের পাতা জড়ানো থাকত না।

খাবার সময় ভ্রমর কৃষ্ণা ও অমল তিনজনে বসে একসঙ্গে খেয়েছে। হিমানী-মাসিরা তখনও ফেরেন নি। খেতে বসে অমল এবং ভ্রমর দুজনেই কেমন লজ্জায়-লজ্জায় ছিল, চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না পরস্পরের দিকে। অথচ ইচ্ছে করছিল খুব। অমল চোরের মতন যখনই চোখ তুলেছে, দেখেছে ভ্রমর মুখ নীচু করে আছে, খাচ্ছে না বড়। তার মুখ নীচ, হওয়া সত্ত্বেও সে অমলকে দেখে নিচ্ছিল।

খাওয়া শেষ করে অমল তাড়াতাড়ি উঠে পড়ছিল। ভ্রমর বলল, “দুধ খেয়ে ওঠো” বলে উঠে গিয়ে আয়াকে দুধ দিতে বলল। অমল যখন দুধ খাচ্ছিল তখন কৃষ্ণা উঠে পড়ল। অমল এবং ভ্রমর খাবারঘরে হঠাৎ একলা হল। ভ্রমরকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার চোখ দুটি ঘুমে জড়িয়ে আছে। অমল বলল, “তোমরা শুয়ে পড় মাসিমারা না ফেরা পর্যন্ত আমি জেগে থাকব।”…ভ্রমর সামান্য চোখ তুলল, “তুমি পারবে না; আয়া জেগে থাকবে।”

ভ্রমর রাগ করে নি, তাকে খারাপ কিছু ভাবে নি বুঝতে পেরে অমল আর ভয় পাচ্ছিল না, তার কোনো অস্বস্তিও তেমন হচ্ছিল না। অন্যায়বোধ তার চেতনায় আপাতত তেমন কিছু ছিল না।

এক ধরনের তীব্র নেশার মতন, অথবা কোনো অসাধারণ সুন্দর স্বপ্ন দেখার মতন, অমল তার ভালবাসার মাদকতায় এবং স্বপ্নে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। কোনো অনুভূতিই তার কাছে স্বাভাবিক মাত্রায় ধরা দিচ্ছিল না। সে বিহ্বল হয়েছিল, উতলা হয়েছিল। ভালবাসার বিচিত্র এবং বিভিন্ন অনুভূতিগুলি তার কাছে জটিল ও অতিরিক্ত হয়ে দেখা দিচ্ছিল। সে যখন অতিরিক্ত আনন্দ অনুভব করছে, তখন সে কি কারণে যেন বেদনাও অনুভব করছিল, ভ্রমরের চিন্তায় সে কখনো পূর্ণতা বোধ করছিল; পরক্ষণেই তার মনে হচ্ছিল তার কোন ফাঁকা লাগছে সব। একই সময়ে তৃপ্তি ও বেদনা, আনন্দ ও নিরানন্দ অনুভব করার পরও তার চিন্তা ভ্রমরকে কেন্দ্র করেই ঘড়ির কাঁটার মতন ঘুরছিল। ভ্রমরের শরীরের গন্ধ, ভ্রমরের স্পর্শ, সান্নিধ্যলাভের জন্য তার ইন্দ্রিয়গুলি অস্থির হচ্ছিল। কতক-গুলি বাসনা সে অনুভব করছিল। মধুর এবং অনির্বচনীয় একটি স্বাদে তার মন এই রাত্রে আচ্ছন্ন থাকায় অমলের ঘুম আসছিল না, সে জেগে ছিল।

ভ্রমরও জেগে ছিল। সে আজ চঞ্চল বা অস্থির হয় নি। তার মনে এই মুহূর্তে কোনো বিক্ষিপ্ততা ছিল না। সে শান্ত হয়ে শুয়ে ছিল; কিছু-সুখ কিছু-বেদনায় আনত ও নম্র হয়ে সে যেন একটি অন্য জগতের দিকে তাকিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, ভ্রমর অনেকক্ষণ আগে কোনো নতুন জায়গায় বেড়াতে গিয়েছিল, স্থানটি তার কাছে বড় সুন্দর ও মনোরম লেগেছিল, সে মুগ্ধ উন্মনা হয়ে পড়েছিল, তারপর আবার এক সময় জায়গাটি ছেড়ে ফিরে এসেছে। ভ্রমরের মনের এই অবস্থাটির সঙ্গে একটি নৌকোর তুলনা করা চলে। যেন নৌকোটি কোনো কূল না পেয়ে অবিরত ভেসে বেড়াচ্ছিল, ভেসে বেড়াতে বেড়াতে কোনো একটি সুন্দর ঘাট পেয়ে গিয়েছিল, ঘাটে নৌকো বেঁধে ফেলেছিল, কিন্তু কিছু সময় পরে আবার ভ্রমর দেখল, সে ভেসে চলেছে, সুন্দর আশ্রয়টি তার চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে।

অমলকে আজ ভ্রমরের আরও ভাল লাগছিল। কেন লাগছিল ভ্রমর স্পষ্ট বুঝতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল, অমল তার বড় আপনার। এত আপনার জন তার আর কেউ নয়। অমলের কাছ থেকে সে যা পেয়েছে তার জীবনে তেমন পাওনা ছিল না। ভালবাসা পাওয়ার ভাগ্য সে কোনোদিন করে নি। মা মারা গিয়েছে এমন বয়সে যখন ভালবাসা বোঝার বয়স তার হয় নি। যখন বয়স হল, তখন থেকে সে হিমানী-মা’র নিষ্পৃহ অভিভাবকত্ব সহ্য করছে, সে বাবার কর্তব্য-পালন দেখেছে: কৃষ্ণা কখনও তার দুঃখ কষ্ট একাকিত্বে গা লাগায় নি। সংসারে যা ভালবাসা, যা বোঝা যায়, যা নিয়ে রাগ অভিমান আবদার করা চলে তেমন ভালবাসা ভ্রমর কারও কাছ থেকে কখনও পায় নি। বাবার ওপর ভ্রমর মনে-মনে অপ্রসন্ন ছিল। বাবা তার মাকে দুখী করেছে, বাবা তাকে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে হিমানী-মা এবং কৃষ্ণাকে ঘরে এনেছিল। বাবার এই কাজ নিষ্ঠুরের মতন। বাবা তার কথা ভাবে নি। বাবা মা’র দুঃখের কথা ভাবে নি। হিমানী-মাকে ভ্রমর চিরটাকাল মনে মনে অপছন্দ করে এসেছে। তার মনে হত, হিমানী-মা আত্মসুখীঃ হিমানী-মা দয়া-মায়া-মমতাহীন; হিমানী-মা এই সংসারে অন্যায়ভাবে ঢুকে পড়েছে। কৃষ্ণাকেও ভ্রমর ভালবাসতে পারত না।…তার ইচ্ছে করত, সে মনের এই সব কালিমা রাখবে না, সে সকলকে ভালবাসবে । সে তার বাবা এবং মা’র বিচার করবে না, সে বাবা-মাকে ভক্তি করবে, ভালবাসবে—কিন্তু ভ্রমর পারত না। পারত না বলে তার দুঃখ ছিল। যীশুর কাছে কতবার ভ্রমর এই ভালবাসার মন ও সহন-শক্তি চেয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করেছে।

অমলকে আজ সেই রকম একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল, যে ভ্রমরের জন্যে ভালবাসা নিয়ে এসেছে। এত ভালবাসা অনুভব করাও কত তৃপ্তির, ভ্রমর আজ মনে-মনে তা বোধ করতে পারছে। তার মনে হচ্ছিল, আর কিছু আকাক্ষা নেই ভ্রমরের। সে বাবা মা কৃষ্ণার কাছেও আর ভালবাসা চায় না। অমল তার সকল দুঃখ পূর্ণ করে দিয়েছে।

মাঝে মাঝে ভ্রমর সন্ধের ঘটনাটির কথা বেহুঁশ হয়ে ভাবছিল। সে দেখছিল, যা ঘটেছে তা খুব গোপনে এবং সবজনের অজ্ঞাতে ঘটেছে। এই গোপনতা তার মনে কোনো রকম ভাতি আনিছিল না। ভ্রমর আজীবন গোপনেই সব করেছে, তার ঈশ্বরপ্ৰেম গোপনে, তার সমস্ত দুঃখকষ্ট সহ্য গোপনে, সে বরাবর তার শরীর মন গোপন করেই রেখেছে, গোপনতার এবং নীরবতার মধ্য দিয়েই তার জীবন কেটে যাচ্ছিল। সে কখনও প্রকাশ্যে কিছু চায় নি। গোপনতাই তাকে তৃপ্তি দিত। সে এই নিভূতিটুকুই পছন্দ করত।

স্বভাববশে ভ্রমর গোপনতাকেই উচিত এবং সঙ্গত বলে মনে করছিল। গোপনতা এক ধরনের পবিত্রতা। মানুষের জীবনের অথবা মনের সমস্ত কিছু প্রকাশ্যে হয় না। হওয়া উচিত নয়। সুন্দর সৃষ্টির ও ভালবাসার খুব কম জিনিস প্রকাশ্যে হয়। ফুল কখনও চোখের সামনে পাপড়ি মেলে না, ভ্রমর দেখে নি। চোখের আড়ালেই একদিন ভগবান এই জগৎ সষ্টি করেছিলেন, জেহোভা আলো আকাশ জল মাটি নক্ষত্র সষ্টি করেন যখন, তখন কে তার সৃষ্টি দেখেছিল!

ভ্রমর স্বাভাবিক নারীজনোচিত সতর্কতা এবং মনোভাববশে জীবনের কতকগুলি অনুভূতিকে অত্যন্ত সঙ্গোপনে লালন করতে চাইছিল। অমলের স্পর্শে তাকে কেবলমাত্র পুরুষের ভালবাসা অনুভব করতে দেয় নি, ভ্রমর আরও কিছু-কিছু, আশ্চর্য ইচ্ছা অনুভব করেছিল। সেই ইচ্ছাগলি তাকে মাঝে-মাঝে বিব্রত ও লজ্জিত করছিল। ভ্রমর জোর করে এ-ধরনের ভাবনাকে সরিয়ে দিচ্ছিল। সে কুণ্ঠিত হয়ে ভাবছিল, এ-সব চিন্তা পাপ। নিষিদ্ধ ইচ্ছাগুলিকে ভ্রমর অন্ধকারে ভর্ৎসনা করছিল।

ভ্রমরের আজকের চেতনা অতিরিক্ত রকম বিস্তৃত ছিল। যেন সমুদ্র। সেখানে কোনো ঝড় বা ঢেউ উঠবে না, এমন নয়। ভ্রমর কখনও-কখনও ঝড়ে পড়ছিল, ঢেউয়ে ভেঙে যাচ্ছিল—তবু, সে তার চেতনাকে অমলিন রাখার চেষ্টায় শান্ত হতে চাইছিল। সে বার বার মনে-মনে বলছিল: না, না, না। সে যাকে না বলছিল সে ওই খল সাপ, জেহোভার তৈরী করা উদ্যানে যে ঢুকে পড়েছিল।

মনের কয়েকটি রন্ধ্র ভ্রমর বন্ধ করে দিল। সে সবরকম দৃশ্য দেখতে চাইছিল না। যা সুন্দর, যা প্রেম এবং যা পবিত্র বলে ভ্রমর জানে সেগুলি খুলে রাখল, এবং নিজেকে তাদের মধ্যে বিছিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন সকাল থেকে অমল এবং ভ্রমরের মধ্যে অদ্ভুত এক লুকোচুরি খেলা চলল যেন। ভ্রমর সকালে অমলকে ডাকল, অমল ঘুমোচ্ছিল, উঠল না। ভ্রমর রাগ করল। অমল যখন ঘুম থেকে উঠল, তখন বেলা হয়েছে; তার মনে হল, ভ্রমর তাকে ডাকে নি: অমল অভিমান করল। চা দেবার সময় ভ্রমরই চা করে দিল। হিমানীমাসির কাল ঠাণ্ডা লেগেছে, ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল খুব, রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে ভীষণ ভুগিয়েছে। ঠাণ্ডা লেগে আজ হিমানীমাসি শয্যাশায়ী, গা হাত মাথা ব্যথা করছে, চোখ ফুলে গেছে।

চায়ের সময় ভ্রমর দু-চারটি কথা বলল। অমলের দিকে ভাল করে তাকাচ্ছিল না। অমলও কেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকল।

একটু বেলায় দুজনে ভাব হল আবার। বাগানে রোদে দুজনে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ভ্রমর জমাদারকে দিয়ে মাঠ পরিষ্কার করাচ্ছিল। সামনে ক্রীশমাস। অমল পায়চারি করছিল, ফুল দেখছিল সকালের; রোদ দেখছিল, আকাশ দেখছিল; সব যেন আজ দেখার মতন।

কৃষ্ণা যখন স্কুলে যাচ্ছে তখন আবার দুজনে আলাদা হয়ে গেছে। ভ্রমর কি বলেছিল যেন, অমল কান করে শোনে নি। না শুনে অমল অকারণে বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেড়াতে বেরিয়ে গেল। ভ্রমর খুব রাগ করেছিল।

দুপুর বেলায় আবার অন্য রকম হল। ভ্রমরের ঘরে মধ্যবেলার রোদ ছিল, বিছানার পায়ের দিকে রোদের কণা গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে ঝরছিল, একটি চড়ুই ঢুকে ফরফর করে উড়ছিল, পালিয়ে যাচ্ছিল, ভ্রমর বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে ছিল। তার গায়ে চাদর। মাথার চুলগুলি বালিশের পাশে ছড়ানো ছিল। অমল কখন চোরের মতন ঘরে ঢুকে ভ্রমরের চোখের পাতায় ফুঁ, দিল। ভ্রমর জেগে উঠল। চোখের সামনে অমলের মুখ দেখে চমকে যেন বালিশ থেকে মাথা তুলে উঠে বসল। গায়ের চাদরটা টেনে নিল সামান্য।

অমল দুষ্টুমির চোখে হাসছিল, তার মুখ চকচক করছিল রোদে। “খুব ঘুমোচ্ছে!” অমল বলল, “বেশ মজায় আছি!”

ভ্রমরের রাগ হয়েছিল সামান্য। সে এই মুহূর্তে একটা স্বপ্নই যেন দেখতে যাচ্ছিল, অমল এসে ভাঙিয়ে দিল। ভ্রমর বলল, “ঘুম পেলে ঘুমোব না!”

অমল বিছানার ওপর লাফিয়ে উঠে বসল, লোহার স্প্রিং দুলে উঠল। দু-দিকে দু-হাত রেখে অমল ছেলেমানুষের মতন স্প্রিং নাচাতে লাগল, বলল, “তুমি কি করে ঘুম মারছ কে জানে! আমি ঘুমোতে পারছি না।

ভ্রমর পা গুটিয়ে নিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। হাত আড়াল করল মুখের কাছে। একটু হাই উঠল। “আমি অনেক সকালে উঠেছি।”

“তাতে কি! আমি কাল সারা রাত ঘুমোই নি।”

ভ্রমর অমলকে দেখল এক পলক। সে যা ভাবছিল তা বলল না, বরং ঠাট্টা করে বলল, “জাগন্ত মানুষকে আজ সকালে দেখেছি।”

অমল বুঝতে পারল। বুঝতে পেরে বলল, “শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লে ওরকম হয়।…তোমার মন ‘আয় ঘুম’ করলে আমার ঘুম আসে না।”

ভ্রমর কিছু বলল না। বাইরে কয়েকটা পাতা উড়ে-উড়ে পড়ল গাছি থেকে। সনসন করে বাতাস বয়ে গেল এক দমক। আজ সকাল থেকে বাতাসটা শান্ত হয়েছে অনেক। কুয়া থেকে জল তুলছে আয়া। চাকার শব্দ ভেসে আসছে, আয়াকে দেখা যাচ্ছে না।

“তাস খেলবে?” অমল জিজ্ঞেস করল।

“তাস!” ভ্রমর মুখ ফেরাল।

অমল জামার পকেট থেকে তাসের প্যাকেট বের করল, নতুন প্যাকেট। বলল, “কিনে এনেছি। এস দু-হাত হয়ে যাক।”

“আমি তাস জানি না।” ভ্রমর বলল। বুঝতে পারল, আজ যখন অমল সকাল-বেলায় বাইরে গিয়েছিল তখন এইসব করেছে, তাস কিনেছে, সিগারেট খেয়েছে, আরও কি কি করেছে কে জানে!

“তুমি কিছুই জানো না।” অমল ঘাড় উলটে কেমন একটা ভঙ্গি করে বলল, “যা বলব, অমনি বলবে আমি জানি না।…ধ্যাৎ, পয়সাটা গচ্চা গেল!”

“কে বলেছিল কিনতে?”

“কিনলাম।…দুপুরে খেলব বলে কিনলাম।” অমল বলল। ভাবল একটু, তারপর ভ্রমরকে চোখে-চোখে দেখল, বলল, “আমি দু-হাতে টুয়েন্টিনাইন, খেলার একটা কায়দা জানি। তোমায় শিখিয়ে দিচ্ছি।”

ভ্রমর মাথা নাড়ল। “না। তাস আমি খেলব না।”

“কেন?” অমল অবাক হল।

“বাড়িতে তাস খেললে মা তোমায় কান ধরে গেটের বাইরে বের করে দেবে।” ভ্রমর গম্ভীর হয়ে বলতে চাইল, কিন্তু পারল না, হেসে ফেলল।

অমল বোকা হয়ে গেল। সে কিছু বলতে পারল না। আসলে তাস-টাস কিছুই নয়; অমল নিজেও তাস খেলতে জানে না টুয়েন্টিনাইন ছাড়া; কিন্তু তাসটা সে কিনেছিল ভ্রমরের কাছে বসে সময় কাটাবার জন্যে। শুধু-শুধু একজনের মুখের সামনে বসে থাকতে কেমন লাগে, বসে থাকার কৈফিয়তও যেন থাকে না। তাস থাকলে খেলার নাম করে বসে থাকা যায়, গল্প করা যায়। কিন্তু সে জানত না এ-বাড়িতে তাস নিষিদ্ধ।

কেমন ক্ষুণ্ণ হয়ে অমল বলল, “তোমাদের বাড়িতে সবই বারণ। তাস তো ইনোসেন্ট খেলা!”

“মাকে বলো। ভ্রমর আড়চোখে অমলকে দেখল, ঠোঁট টিপে হাসল।”

অমল তাসের প্যাকেট হাতে তুলে নিল। কি করবে ভাবছিল যেন। শেষে হঠাৎ কি খেয়াল হল, জানলা দিয়ে তাসের প্যাকেটটা ছুঁড়ে মাঠে ফেলে দিল। দিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “ঠিক আছে। আমি আর কিছু আনব না। প্রমিস করছি…।” বলে অমল উঠে পড়ল। এবং ভ্রমরকে অবাক করে ঘর ছেড়ে চলে গেল। আর এল না।

ভ্রমর অনেকক্ষণ একই ভাবে বসে থাকল। সে অপেক্ষা করল। তার মনে হল, অমল ফিরে আসবে। অমল এল না দেখে ভ্রমরের খুব খারাপ লাগল। তার সমস্ত মন দুপুর বেলায় খাঁ-খাঁ করতে লাগল। জানলার বাইরে উদাস দুঃখিত চোখে তাকিয়ে সে বাকি দুপুরটুকু মরে যেতে দেখল।

বিকেলবেলায় অমলকে বাড়িতে দেখা গেল না। সে সাজগোজ করে কোথায় বেড়াতে বেরিয়ে গেল, কে জানে! ভ্রমরকে কিছু বলে নি। খুব রাগ করেছে অমল।

বিকেল পড়ে আসার পর ভ্রমর আজ একটু আলাদা করে চুল বাঁধলো, বাটির মতন খোঁপা করল, কাঁটা গুঁজল। নতুন একটা শাড়ি ভাঙল এবং যে-শাড়িটা তার নিজের খুব পছন্দ, নীল রঙ, চিকনের কাজ—সেই শাড়িটাই পরল, গায়ে পুরো-হাতা সোয়েটার দিল, ছোট শাল রাখল পিঠে। মুখে অল্প করে পাউডার মাখার সময় তার কি খেয়াল হল, সে কৃষ্ণার ঘর থেকে সুর্মা এনে চোখের কোণে অল্প করে ছোঁয়াল।

সন্ধের গোড়াতেই বোঝা গেল, আজকের শীত কালকের মতনই। বাতাস ছিল না বলে গায়ের চামড়া সকাল থেকে কেটে যাচ্ছিল না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে শীতটা যেন জমার অপেক্ষা করছিল। সন্ধের গোড়ায় শীত জমে গেল। ঘরের মাটি থেকে কনকন করে ঠাণ্ডা উঠছিল, বাইরের শূন্যতা থেকে হিম যেন সর্বক্ষণ ভেসে আসছিল, কুয়াশা থিকথিক করছিল সর্বত্র, আকাশের তারা দেখাচ্ছিল না।

অমল ফিরছিল না। বাড়িতে বাতি জ্বলে উঠল, জানলা-দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আয়া ঘরে-ঘরে আগুনের পাত্র দিল—তবু, অমল ফিরল না। মা তার ঘরে, বিছানায় শুয়ে। দুপুর থেকে জ্বর এসে গেছে। ভীষণ সর্দি হয়েছে। কপালে উইন্ট্রোজেন মেখে, লেপের মধ্যে শুয়ে মা বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বাবা কলেজের কাজ করছে। কৃষ্ণার কাল শেষ পরীক্ষা। জিওগ্রাফি। সে পড়তে বসে গেছে।

ভ্রমর উদ্বেগ বোধ করল। এই ঠাণ্ডায়, এতটা অন্ধকারে অমল যে কোথায় একলা-একলা ঘুরে বেড়াচ্ছে সে বুঝতে পারছিল না। অমল বড় রাগী, তার রাগের কোনো জ্ঞান নেই যেন। এই ভীষণ ঠাণ্ডায় ঘুরে বেড়ানোর কোনো দরকার ছিল না। ঠাণ্ডা লেগে ঠিক অসুখ বাঁধাবে। ভ্রমর কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না।

ভ্রমর যখন বেশ উদ্বিগ্ন এবং প্রতি মুহূর্তে অমলের পায়ের শব্দ গুনছে তখন অমল ফিরল। শীতে হিহি করে কাঁপছে, গলার মাফলার পাগড়ির মতন করে মাথায় বেঁধেছে কান চাপা দিয়ে, হাত দুটো কোটের পকেটে। নাকে জল, চোখ ছলছল করছে।

মনে-মনে ভ্রমরের অভিমান হয়েছিল। সারা বিকেল, সন্ধে উনি পথে-পথে ঘুরে এলেন, যেন বাড়িতে কেউ নেই। ভ্রমরের এতটা সময় কি কবে কাটল অমল দেখল না।

ভ্রমর নিজের ঘরেই ছিল, অমল কাঁপতে-কাঁপতে ঘরে ঢুকে বলল, “আজ বাইরে বরফ পড়েছে।” বলে ভ্রমরের দিকে এগিয়ে এল, “আমার হাত দুটো কি-রকম হয়েছে দেখবে—?” ভ্রমরের সামনে দাঁড়িয়ে অমল তার হাত ভ্রমরের গালে ছুঁইয়ে দিল।

ভীষণ ঠাণ্ডা। ভ্রমরের মনে হল, এক টুকরো বরফ কিংবা কনকনে জল কেউ ওর মুখে ছুঁইয়ে দিয়েছে। কেঁপে উঠল ভ্রমর। অমল হাত সরিয়ে নিল। নিয়ে দু-হাত ঘষতে লাগল, হাত ঘষতে ঘষতে মালসার আগুনের কাছে এসে বসল। আগুনে হাত সেঁকতে লাগল উবু, হয়ে বসে।

কথা বলব-না বলব-না করেও ভ্রমর কথা বলল। গলা গম্ভীর করে বলল, “কোথায় গিয়েছিলে?”

“বেড়াতে।”

“এতক্ষণ বেড়াচ্ছিলে?”

“ঘুরছিলাম। চকবাজার ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।” অমল বলল, যেন সে আর কিছু করার পায় নি, বাজারে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সামান্য থেমে অমল আবার বলল, “বাড়িতে থেকে কি লাভ। বোবা হয়ে বসে থাকতে হবে। নয়ত লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে হবে।”

ভ্রমর বুঝতে পারল দুপুরের রাগের জের টানছে অমল। হয়ত রাগ করেই এ-ঠাণ্ডা খেয়ে এল।

ভ্রমর বলল, “তুমি বোবা হয়ে বসে থাক কবে?”

“থাকি। দিনের মধ্যে আঠার ঘণ্টা থাকি।”

“হিসেব করেছ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। হিসেব না করে দুমদাম কথা আমি বলি না। আমি মেয়েদের মতন নই।” অমল মুখ ফিরিয়ে ভ্রমরকে দেখতে দেখতে বলল।

হাসি পেয়ে গিয়েছিল ভ্রমরের। কষ্ট করে হাসি চেপে ভ্রমর বলল, “মেয়েরা হিসেব করে কথা বলে না?”

“বাজে কথা বলে। সেন্স্‌লেস কথা বলে।”

ভ্রমর এবার হেসে ফেলল। তার গলায় ঢোঁক গেলার মতন সুন্দর শব্দ হল। গালে চোখে হাসি কাঁপছিল। ভ্রমর বলল, “তুমি মেয়েদের কি জানো?”

অমল আগুনের ওপর থেকে হাত উঠিয়ে নিজের গালে রাখল। সে ঝুঁকে বসেছিল বলে আগুনের তাত তার মুখেও অল্প-অল্প লাগছিল। ঠাণ্ডা মুখ গরম হয়ে এসেছিল। তপ্ত হাত গালে দিয়ে অমল আরও একটু, উষ্ণ করল তার মুখ। ভ্রমরের কথার জবাব দিল না। সে ভাবছিল, কি বলবে, কি বলা যায়।

ভ্রমর সামান্য অপেক্ষা করল। সে যখন অপেক্ষা করছিল তখন তার মনে কেমন অন্য ভাবনা এল হঠাৎ। ভ্রমর ভাবল, অমল হয়ত বলবে সে মেয়েদের একটা বড় জিনিস জানে। ভ্রমর কেমন কুণ্ঠিত হল।

আগুনের কাছ থেকে অমল উঠল। তার মাথা-কান জুড়ে আর মাফলার বাঁধা নেই, গলায় জড়ানো। ভ্রমরের দিকে তাকাল অমল। তার মুখে রাগ নেই, শীতের অসাড় ভাবটাও নেই। এগিয়ে আসতে আসতে অমল বলল, “আমি একটা মেয়েকে জানি।” বলে অমল একটি আঙ্গুল তুলে ঠোঁট চেপে হাসল।

ভ্রমর গায়ের চাদর বুকের কাছে জড়িয়ে নিল আরও। তার বুক একটু কেঁপে উঠল, গা শিরশির করল। বিছানার মাথার দিকে উঠে গুটিয়ে বসল।

বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে অমল বলল, “আমি যখন ফিরে যাব, বাড়ি থেকে চিঠি লিখে তোমায় সেই মেয়েটার কথা বলব।”

কথাটা অমল যত সহজে বলেছিল ভ্রমর তত সহজে শুনল না। তার হঠাৎ মনে হল, আর ক’দিন পরে তার ঘরে এমনি করে কেউ আসবে না, কেউ তার গালে ঠাণ্ডা হাত ছুঁইয়ে দেবে না, তাস কিনে এনে খেলতে বলবে না, রাগ করবে না। ভ্রমর অনুভব করতে পারল, তার বিছানায় বসে কেউ চোখের জল মুছিয়ে দেবার জন্যে তাকে কাছে টেনে নেবে না। কেউ ঠাট্টা করে গাইবে না, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল…।’ কথাগুলো মনে আসতেই হঠাৎ কেমন সব ফাঁকা হয়ে গেল, যেন ভ্রমরকে কেউ দু-হাতে তুলে নিয়ে গিয়ে বাইরে শীতে এবং অন্ধকারে ফাঁকায় বসিয়ে দিল।

অমল বিছানায় বসেছিল। হাঁটুতে হাত রেখে পা দোলাতে-দোলাতে অমল ভ্রমরের দিকে তাকাল। বলল, “সেই মেয়েটার জন্যে আমার—আমার খুব খারাপ লাগবে।”

ভ্রমর মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মুখ ক্রমশ মলিন ও করুণ হয়ে আসছিল। নিশ্বাস ভারী হয়ে গিয়েছিল।

“ভ্রমর, কাল আমার ঘুম হচ্ছিল না, কত কি ভাবছিলাম। খুব ভাল লাগছিল। আজ বিকেল থেকে আর কিছু ভাল লাগছিল না—” অমল মৃদু, গলায় মুখ নীচু করে বলল। সে আর পা দোলাচ্ছে না। তার মুখের চেহারা দুঃখীর মতন হয়ে উঠেছে।

ঘর হঠাৎ নীরব এবং স্তব্ধ হয়ে গেল। মনে হল, কোনো অনন্ত সমুদ্রের আলো-ঘরে দুটি পাখি বসে আছে। তারা আজ অতি ঘনিষ্ঠ কিন্তু তাদের কাল সকালে ভিন্ন পথে উড়ে যেতে হবে। চাপা দীর্ঘশ্বাসের মতন একটি আবহাওয়া ঘনিয়ে উঠল ঘরে। অমল মুখ হাঁ করে শ্বাস ফেলল।

অনেকক্ষণ পরে ভ্রমর অতি মৃদু গলায় বলল, “তুমি আর আসবে না?”

“আসব। আমার আসতে ইচ্ছে করবে খুব।…কিন্তু তুমি বড় দূরে থাক।” কথাটা বলার পর অমলের কেন যেন মনে হল, ভ্রমর তার এত কাছে—তবু, কত দূর-দূর মনে হচ্ছে আজ।

ভ্রমর ডান হাত ওঠাল, চিবুকের কাছে আনল, ঠোঁটের ওপর আঙুল রগড়াল, বলল, “আমাদের খুব কাছে কোনো ভাল জিনিসই থাকে না, না? ভগবানও কত দূরে…”

অমলের বুকে হঠাৎ শূন্য, একেবারে শূন্য হয়ে গেল এখন। বুকের মধ্যে কোনো কিছুই সে অনুভব করতে পারছিল না। তার গলা বুজে আসছিল, কান্না আসছিল। অমল বলল, “ভ্রমর, আমি রোজ তোমার কথা ভাবব, আমি ঘুমোবার সময় তোমায় ভাবব।…স্বপ্নে তোমায় দেখতে পাব।”

ভ্রমরের ঠোঁট ফুলে উঠেছিল, যন্ত্রণায় গলা টনটন করছিল, কণ্ঠস্বর বুজে গিয়েছিল। ভ্রমর কোনোরকমে বলল, “আমি তোমার জন্য রোজ প্রার্থনা করব। রোজ।”

ওরা আর কোনো কথা বলল না। বলতে পারল না।

ক’দিন ধরে বাড়িঘর পরিষ্কারের কাজ চলছিল। সামনে ক্রীশমাস। হিমানী নিজে দেখাশোনা করছিলেন। কথা ছিল বাড়ি চুনকাম হবে। কলেজ থেকে আনন্দমোহন লোক পেলেন না; কলেজে কিছু কাজকর্ম হচ্ছিল, শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোয়ার্টারে আসতে পারবে না। হিমানী ভেবেছিলেন বাড়ির কাজগুলো ক্রিশমাসের আগে শেষ হয়ে যাবে, না-হওয়ায় তিনি অখুশী হয়েছেন। আনন্দ-মোহন অবশ্য বলেছিলেন যে, মিস্ত্রী মজুর একবার বাড়িতে ঢোকালে তারা সহজে বেরুতে চায় না, এ বরং ভালই হয়েছে, পরে আসবে। এ-বাড়িতে কাজও অনেক, চুনকাম শুধু নয়, মেরামতির কাজও রয়েছে, দরজা জানলা সারা আছে, রঙ রয়েছে। তিন বছর অন্তর একবার করে কোয়ার্টারে মিস্ত্রী মজুর ঢোকে, যেখানে যা করার ওই একবারেই করিয়ে নিতে হবে, নয়ত পড়ে থাকবে।

আয়া একা পেরে উঠছিল না। একটা মেয়ে ধরে এনেছিল, কমবয়সী। সে ঘরের ঝুল ঝাড়ল ঝুলকাঠি মাথায় তুলে, মেঝে ঘরদোর পরিষ্কার করল, এটা ওটা ফরমাস খাটল, যাবার সময় ভ্রমরের গায়ের গরম স্কার্ফটা চুরি করে নিয়ে চলে গেল।

কথাটা ভ্রমর গোপন রেখেছিল। অমলকে শুধু বলেছিল আড়ালে। অমল হাসিঠাট্টা করেছিল খুব: ‘শীতের দিনে গরম বস্ত্র দান করা পুণ্যকাজ, বুঝলে ভ্রমর। তোমার অনেক পুণ্য হল।’ পরের দিন ধোবী এসেছিল। নিজের জামা-কাপড় কাচতে পাঠাবার সময় অমল অবাক হয়ে দেখল, তার একটা সুতির শার্ট, একটা গেঞ্জি এবং ময়লা পাজামাটা বেপাত্তা।

চুরির কথাটা বাড়িতে জানাজানি হলে হিমানী আয়াকে গালমন্দ করতেন। ভ্রমরও তার স্কার্ফ খখাওয়া যাওয়ার জন্যে মা’র বকুনি শুনত। বেচারী টিসরির কথা ভেবেই চুরির ঘটনাটা ওরা চাপা দিয়ে রাখল। আয়াকে ভ্রমর পরে কথাটা বলল, অমলের জামাটামা চুরি যাবার পর।

সেদিন দুপুরবেলা টিসরি তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ সেরে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। দিনটা ছিল রবিবার। কোনো-কোনো রবিবারে আয়া কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিত, সাধারণতঃ দুপুরের দিকে, হিমানীরা গির্জা যাবার সময়-সময় ফিরে আসত। এবারে বিকেল হবার মুখে-মুখে চলে গেল। ভ্রমররা বাড়িতে থাকবে জেনে তার ফেরার গা ছিল না তাড়াতাড়ি। ভ্রমর অন্তত বিকেল হয়ে গেছে দেখে সেই রকম ভাবছিল সেদিন।

হিমানী আনন্দমোহন কৃষ্ণা গির্জা চলে গিয়েছিলেন। আজ গির্জা থেকে বেরিয়ে হিমানীরা আসিবেন বাজারে, ক্ৰীশমাসের অনেক কেনাকাটা আছে। শীতের কথা ভেবে সবাই বেশ সাবধান হয়ে বেরিয়েছেন। আনন্দমোহন তাঁর মোটা ওভার-কোটটা হাতে নিয়েছেন; হিমানী গরমজামা গায়ে দিয়েছেন, পায়ে মোজা পরেছেন, শাল নিয়েছেন, কৃষ্ণাও তার পরোহাতার গরম কোর্ট নিয়েছে, মাথায় বাঁধার স্কার্ফ নিয়েছে।

ভ্রমরের গির্জায় যাবার ইচ্ছে ছিল। অসুখে পড়ে তার গির্জা বন্ধ হয়েছে। আনন্দমোহন সাহস করে নেন নি। ভ্রমরের শরীর না সারা পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ি করে দশ মাইল পথ এই ঠাণ্ডায় তাকে আসা-যাওয়া করতে দিতে তিনি রাজী নন। সামনে ক্রীশমাস; আর ছ’সাতটা দিন। ভ্রমর এ-সময় সুস্থ থাকুক।

বাড়ি একেবারে ফাঁকা। বিকেলের শুরু, আর শেষ চোখে দেখা গেল না। পৌষের আকাশ থেকে সন্ধ্যার জোয়ার এসে গেল। পাখিগুলি কিছুক্ষণ শূন্যে এবং বৃক্ষচূড়ায় তাদের কলরব ভরে রাখল, তারপর সর্বত্র একটি নীরবতা নামল ক্রমশ। হিম এবং কুয়াশা অন্ধকারে ঘনীভূত হয়ে এল।

আয়া ফিরছে না। ভ্রমর বিকেলের পোশাক বদলে ঘরে-ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। অমল দরজা জানলাগুলো বন্ধ করছিল ভ্রমরের সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে। বাতি জ্বালানো হয়ে গেলে ওরা রান্নার ঘরের দিকে গেল। একটা লোহার উনুন আয়া জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল, সে-আগুন নিবে গেছে। ভ্রমর ভাবছিল, কোনো রকমে একটু, আগুন জ্বালানো যায় কিনা। এই কাজটা সে পারে না। অমল বলছিল, সে পারবে; পিকনিকে গিয়ে তারা কতবার মাঠে ঘাটে পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়েছে।

“তুমি আমায় কেরোসিন তেল কোথায় আছে বলো, আমি জ্বালিয়ে দিচ্ছি। কাঠ দিয়ে আগুন ধরানো খুব ইজি।” অমল বলল।

ভ্রমর আগ্রহ বোধ করল না। বলল, “থাক; আর খানিকটা দেখি। আয়া ফিরবে এখুনি।”

“যখন ফিরবে তখন ফিরবে—আগুনটা আমরা ধরিয়ে দি। তোমার ঘরে আগুন রাখতে হবে। আমি চা খাব।” অমল বেশ উৎসাহের সঙ্গে আগুন জ্বালাবার তোড়জোড় শুরু করল।

ভ্রমর বলল, “তুমি অত হুড়োহুড়ি করছ কেন? একটু, সবুর করা যায় না!”

“সবুরে মেওয়া ফলবে নাকি!” অমল ঠাট্টা করে বলল, “বসে থাকলে আগুন জ্বলবে না।” বলে রান্নাঘরের বাইরে থেকে শুকনো কাঠ আনতে গেল।

আয়ার ওপর রাগই হচ্ছিল ভ্রমরের। কখন গেছে, এখনও ফেরার নাম নেই। কোথায় গেছে তাও বলে যায় নি। সারা বাড়ির কাজকর্ম ফেলে চলে গিয়ে সে কেমন করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে ভ্রমর বুঝতে পারছিল না। আয়া এ-রকম লোক নয়।

ভাবতে ভাবতে আয়া এসে গেল। অমল যখন সত্যি-সত্যি কেরোসিন তেলের বোতল কাঠের ওপর উপুড় করে ঢেলে দিয়ে দেশলাই কাঠি দিয়েছে এবং মুহূর্তে একটি ভয়ংকর অগ্নিশিখা দপ্‌ করে জ্বলে উঠেছে, সেই সময় আয়া পৌঁছে গেল। আয়া এসে না পড়লে আগুনটা সামলানো দায় হয়ে উঠত।

ভ্রমর রাগ করেই কিছু বলতে যাচ্ছিল আয়াকে, কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হল কিছু যেন হয়েছে একটা; ভ্রমর সামান্য অনুযোগ করল, কিছু বলল না আর।

অমল হাত ধুতে চলে গেল।

আগুন উঠোতে, মালসায় কাঠকয়লা তুলতে, চা করতে খানিকটা সময় গেল। ততক্ষণে সন্ধে পেরিয়ে গেছে। অমল তার নিজের ঘরে ছিল। ভ্রমর এসে ডাকল, “এস। তোমার চা হয়েছে।”

ভ্রমরের ঘরে এসে বসল অমল। মালসায় আগুন দেওয়া হয়েছে। দরজা বন্ধ, ঘর এখনও ঠাণ্ডা হয়ে আছে। এ ক’দিনে ভ্রমরের ঘরের চেহারা আরও কিছুটা বদলেছে। আয়না এসেছে, মেরীর ছবি এসেছে, ড্রয়ার বসেছে একপাশে।

ভ্রমর বলল, “আয়া কোথায় গিয়েছিল জানো?”

“কোথায়! গির্জায়?” অমল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল হালকা গলায়।

“ইয়ার্কি করো না।” ভ্রমর ধমক দেবার মতন গলা করল।

“ইয়ার্কির কি! আমি ত তোমায় আগেও বলেছি, আজ হয়ত ও ওদের গির্জায় গেছে।”

“গির্জায় যায় নি। সেই মেয়েটার বাড়ি গিয়েছিল খুঁজে খুঁজে। অনেক দূর।”

“চোর মেয়েটার!” অমল অবাক হয়ে তাকাল, ‘ধরতে পেরেছে?”

“আয়া বসে থেকে থেকে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করেছে।”

“কি বলল মেয়েটা?” চুরি করে নি?”

“চুরি করেছে।” ভ্রমর বলল, বলে কয়েক মুহূর্ত, কেমন নীরব থাকল। “আয়া তার কাছ থেকে সব ফেরত নিয়ে এসেছে।”

অমল লক্ষ করে বুঝল, ভ্রমর তার খোয়া-যাওয়া জিনিস ফেরত পাওয়ায় মোটেই খুশী নয়। তার মুখে তৃপ্তি নেই। চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, ভ্রমর যেন কিছু বলতে চাইছে। অমল খানিকটা চা খেল। বলল, “তুমি বেঁচে গেলে! মাসিমা যেদিন জানতে পারত তোমায় কাঁদিয়ে ছাড়ত।”

ভ্রমর চা খাচ্ছিল। কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বলল না। শেষে বলল, “আমি আয়াকে বলেছি, সব জিনিস আবার কাল দিয়ে আসতে।”

অমল রীতিমত অবাক হল। তার শার্ট বা পাজামার জন্যে সে বিন্দুমাত্র দুঃখিত ছিল না, কিন্তু চুরি-যাওয়া জিনিস ফেরত পেয়ে আবার সেটা চোরকে পাঠানোর মর্ম সে বুঝছিল না। তার কাছে ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতন লাগছিল। অমল হেসে বলল, “তুমি তো আগেও বলেছিলে, আহা বেচারী গরীব, নিয়েছে নিক, শীতে গায়ে দেবে…।” ঠাট্টা এবং রগড় করেই বলেছিল অমল কথাগুলো। স্কার্ফ খোওয়া যাওয়ার পর থেকে মরকে এই ভাবেই ঠাট্টা করে আসছিল সে।

ভ্রমর অমলের হাসিঠাট্টা গায়ে মাখল না। বলল, “মেয়েটা খুব দুঃখী। আয়া বলছিল, বিয়ে হয়েছে ক’মাস আগে। স্বামী কাঠকারখানায় কাজ করত, হাত কেটে ফেলেছে মেশিন-করাতে। চাকরি নেই। মেয়েটা এখানে-ওখানে কাজ করে যা পায় তাতেই চলে…।” ভ্রমর নিশ্বাস ফেলল।

অমল কৌতুহল অনুভব করল, “মেয়েটা ত ওইটুকু! ওর আবার বিয়ে!”

ভ্রমর জবাব দিল না। মেয়েটা আঠার-উনিশ বছরের হবে। অমল কেন ওইটুকু বলল সে বুঝতে পারল না। রোগাটে বলে নাকি?

“হাত কি একেবারে দু-আধখানা হয়ে গেছে লোকটার?” অমল শুধলো।

ভ্রমর আস্তে মাথা নাড়ল। বলল, “একটা আঙুল একেবারে কেটে গেছে, বড় জখম।”

“তা হলে আবার চাকরি পাবে।”

চায়ের কাপ ভ্রমর গোল টেবিলের ওপর সরিয়ে রাখল। সরিয়ে রেখে বিছানায় মাথার দিকে পা চাপা দিয়ে বসল।

অমল কি বলবে ভেবে না পেয়ে হঠাৎ বলল, “তুমি যাই বলল, মেয়েটা খুব হিসেবী চোর, হিসেব করে করে জিনিস নিয়েছে। নিজের জন্যে গরম স্কার্ফ আর তার বরের জন্যে শার্ট পাজামা—।” কথাটা বলে অমল হাসল, কিন্তু হাসতে গিয়েও তার কানে ‘বর’ শব্দ কেন যেন খচখচ করে বিঁধছিল। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। কি রকম এক অস্বস্তি বোধ করছিল অমল।

ভ্রমর অমলের চোখমুখ লক্ষ করল দু-মুহূর্ত। মনে-মনে কিছু ভাবছিল। মুখে বলল, “ওদের দরকার, ওরা নিক। আমার গরম জিনিস অনেক আছে।”

“তুমি…তোমার কথা আলাদা।” অমল হেসে বলল, “তোমার খুব দয়ামায়া। যীশুর মতন।”

ভ্রমর অসন্তুষ্ট হল। চোখ দিয়ে তিরস্কার করল অমলকে। বলল “ও-রকম কথা আর বলল না।” বলে দু-মুহূর্ত উদাস থেকে ভ্রমর অন্যমনস্ক গলায় আবার বলল, “যীশুর দয়ার শেষ ছিল না। ক্রুশে যাবার সময়ও দয়া তিনি করেছিলেন।”

অমল শেষ চুমুক চা খেল। কাপটা রেখে দিয়ে বলল, “আমি একটু কথা বলি। আমার শার্ট পাজামার জন্যে আমি কেয়ার করি না। মেয়েটা চাইলেই পারত, আমি দিয়ে দিতাম। তুমিও দিয়ে দিতে। ও চুরি করল কেন?”

ভ্রমর চোখে-চোখে তাকিয়ে দেখছিল অমলকে, যেন অমলের কথা ভাল করে বোঝার চেষ্টা করছিল। সামান্য ভেবে ভ্রমর বলল, “চাইতে সাহস হয় নি। সে ভেবেছিল আমরা দেব না।”

“আমরা দিতাম।”

“সকলে দেয় না।” ভ্রমর শান্ত গলায় বলল, বলে দু-মুহূর্ত থেমে বলল আবার, “দুঃখী মানুষকে সবাই যদি দিত তবে তারা দুঃখী থাকত না।”

অমল সঙ্গে-সঙ্গে আর কিছু বলল না। গা হাত ছড়িয়ে আরাম করে বসল, আধশোয়া হয়ে গালে হাত রেখে ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে থাকল। অমল অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিল।

ভ্রমর দু-হাত কোলের ওপর রেখে আঙুল আঙুল জড়িয়ে বলল, “আয়া কাল যখন জিনিসগুলো ফেরত দিয়ে আসবে মেয়েটা খুব খুশী হবে, হবে না?”

“হবে।” অমল ভাবুকের মতন মুখ করল; তারপর মজার গলা করে বলল, “সেই মেয়েটার স্বামী আমার জামাটামা পরে দিব্যি ঘুরে বেড়াবে। যাই বলো ভ্রমর, মেয়েটা নিজের জন্যে একটা মাত্র জিনিস নিয়েছে, শুধু একটা স্কার্ফ, দামী জিনিস, কিন্তু তার হাজবেন্ডের জন্যে ফুল ড্রেস। গরম স্কার্ফটা তার স্বামীও গায়ে পরতে পারে। পারে না—?”

ভ্রমর কোনো জবাব দিল না। অমলের কৌতুক সে লক্ষ করছিল, মনে-মনে ভাবছিল।

কথার জবাব না পেয়ে অমল বলল, “মেয়েরা হাজবেন্ডকে খুব ভালবাসে।” বলে অমল বিজ্ঞের মতন হাসল।

ভ্রমর যেন সামান্য লজ্জা পেয়েছিল। চোখ ফিরিয়ে নিল। তার ছোট পাতলা মুখের কোথাও সঙ্কোচজনিত আড়ষ্টতা ফুটল।

অমল গাল থেকে হাত সরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সিলিং দেখছিল। তার কোমর পর্যন্ত বিছানায়, পা মাটিতে ঝলছে। সিলিং দেখতে-দেখতে অমল বলল, “আমি কাল একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। তোমায় বলি নি। বলতাম ঠিক! এখন বলব?”

ভ্রমর নীরব থাকল। তার বেড়ালটা কখন দরজার সামনে এসেছিল। মুখ বাড়িয়ে বার কয় ডাকল, ভেতরে এল; আবার চলে গেল। যেন বেড়ালটা কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে বাড়িতে।

“আমি স্বপ্নটা বলব, কিন্তু ঠাট্টা করতে পারবে না।” অমল সামান্য মাথা ফিরিয়ে ভ্রমরকে আড়চোখে দেখে নিল। অল্পসময় চুপ করে থেকে হাসির গলায় বলল, “কাল আমি মজার একটা স্বপ্ন দেখলম; একেবারে বিয়ে-ফিয়ের।…আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।” অমল আর বলতে পারল না, লজ্জায় কৌতুকে এবং এক ধরনের অস্বস্তিতে জিনিসটা আরও হালকা করার জন্যে হেসে উঠল।

ভ্রমর অমলকে দেখল। নরম ঘন অথচ সকৌতুক চোখে দেখল কয়েক পলক। তারপর বলল, “ওইটুকু ছেলের আবার বিয়ে!”

‘ওইটুকু’ শব্দটা ভ্রমর যেন ইচ্ছে করেই বলল। একটু আগে অমল সেই মেয়েটার বিয়ের কথা শুনে ‘ওইটুকু মেয়ের’ বিয়ে বলে অবাক হচ্ছিল। ভ্রমর যেন এখন তার শোধ নিল। কেন নিল ভ্রমর বুঝল না।

অমল সামান্য ইতস্তত করল, একটু, বুঝি মুশকিলে পড়ে গেছে। তারপর বলল, “ওইটুকু ছেলে মানে কি? আমার এখন বয়স কত তুমি জানো?”

“উনিশ-টুনিশ হবে।” ভ্রমর গাল ঠোঁট টিপে হাসছিল।

“না স্যার, উনিশ আবার আসছে জন্মে হবে। আমি একুশে চলছি। তোমার মতন নয়।”

“একুশ বছর বয়সে বিয়ে হয় না ছেলেদের।” ভ্রমর চোখ ভর্তি করে হাসছিল। হাসির আভায় তার সারা মুখে টলটল করছিল।

“কে বলছে! এখন বিয়ের কথা আমি বলি নি।” বলতে-বলতে অমল উঠে বসল। তার মুখে দীপ্ত, এবং তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের গাম্ভীর্য রয়েছে। ভ্রমরকে একদৃষ্টে দেখতে-দেখতে অমল বলল, “আমি আরও পরের কথা বলছি। তিন-চার-পাঁচ বছর পরের কথা। আমি যখন অ্যাপ্রেনটিস শেষ করে বেরিয়ে এসেছি, চাকরি করছি। তখন আমি বেশ বড়। তুমিও বড় হয়ে গেছ আরও—তখন…” বলতে-বলতে অমল থেমে গেল; তার মনে হল একেবারে অজানতে তার মুখ দিয়ে কি রকম সব লুকোনো কথা যেন বেরিয়ে গেল। অমল থতমত খেয়ে চুপ; হঠাৎ বোবা; জিব আটকে এল যেন। বোকার মতন এবং অপরাধীর মতন ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে ভীষণ অস্বস্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিল অমল।

ভ্রমর নিঃসাড় হয়ে বসে থাকল। তার চোখের পাতা স্থির, দৃষ্টি স্থির। যেন ঠিক এই মুহূর্তে সে চেতনাকে খুব আবিল অস্পষ্ট করে অনুভব করছিল। বুঝল অথচ বুঝল না কথাটা। নিশ্বাস বন্ধ করে থাকল। তার বুকের কোথাও রক্ত ফুলে উঠল, ভ্রমর ব্যথা অনুভব করল; শীতের ঝাপটা খাওয়ার মতন কাঁপুনি উঠল পিঠের কাছটায়। মুখ নীচু, করল ভ্রমর।

অমল চোখ তুলে ভ্রমরকে দেখল। ভ্রমর কি রাগ করল? অসন্তুষ্ট হল? বুঝতে পারছিল না অমল। নিজের বিশ্রী বোকামির জন্যে তার অনুশোচনা হচ্ছিল। কেন বলতে গেল কথাটা। পরে, আরও পরে, বাড়ি ফিরে গিয়ে যখন ভ্রমরকে চিঠি লিখত, তখন একবার লিখলেই হত।…কিন্তু অমল মিথ্যে বলে নি, সে সত্যিই কাল বিয়ের স্বপ্ন দেখেছে। ভ্রমর বিশ্বাস করবে না, নয়ত তার গা ছুঁয়ে শপথ করে অমল বলতে পারত, সত্যি ভ্রমর, আমি কাল স্বপ্ন দেখেছি বিয়ের। আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। ট্রেনে এসে উঠলাম। রেলগাড়িতে চড়ে যখন বিয়ে করতে যাচ্ছি তখন ত জানা কথা, তোমাদের বাড়ি আসছি।

ভ্রমরের মুখে ক্রমশ যেন রক্ত এসে, লজ্জা এসে, অতিগোপনে ইচ্ছা এবং নিভৃত বাসনাগুলি এসে জমে উঠছিল। নিজের এই আশ্চর্য অনুভূতির সুখ সওয়া গেল না বলেই ভ্রমর তার চোখের পাতা দুটি বন্ধ করে ফেলল। এবং চোখের পাতার তলায় স্বপ্নের ছবির মতন দেখল, সে অমলের স্ত্রী হয়েছে, অমলের স্ত্রী হয়ে সে গির্জা থেকে বেরিয়ে আসছে, সোনার মতন গোধুলি যেন তখন। ভ্রমর স্বপ্নের একটি সুন্দর টুকরোর মতন এই দৃশ্যটি দেখল। অমল তাকে আর কিছু দেখতে দিল না। ভ্রমর অমলের গলা শুনতে পেল। অমল বলছিল, “স্বপ্নটপ্ন স্বপ্নই। কি বল ভ্রমর?”

ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছিল: অমল ভাসা-ভাসা গানের সুর শুনতে পেল। গভীর নিদ্রার মধ্যে মাছি এসে মুখে বসলে যেমন অস্বস্তির সঙ্গে মানুষ সামান্য মুখ সরিয়ে মাছিটা উড়িয়ে দেয়, অমল অনেকটা সেইভাবে শেষরাতের নিবিড় সুপ্তি এবং তৃপ্তি নষ্ট হতে দিতে চাইল না, গানের সুর উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। ঘুমিয়ে পড়ল। আবার জাগল সামান্য পরেই। গানের সুর শুনতে পেল। গলা থেকে লেপ টেনে মাথা ঢাকল, পাশ ফিরল। ঘুমিয়ে পড়ল আবার। অকাতর নিদ্রা আর এল না। কখনও ঘুম, কখনও জাগা-জাগা ভাব। অচেতনা এবং অর্ধ-চেতনার মধ্যে অল্প সময় কাটল। তারপর অমল ক্রমশ জেগে উঠল। চোখের পাতা খুলল মাথার লেপ সরিয়ে।

এখন ঠিক শেষরাত নয়, রাত ফুরিয়ে ভোর হচ্ছে, প্রত্যুষ। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বোঝার উপায় ছিল না, ভোর হয়ে এল। ঘর অন্ধকার: বাইরের জানলা আঁট করে বন্ধ, চারপাশ হিম-কনকন। বিছানার খোলা অংশ ঠাণ্ডা, লেপের পিঠ ঠাণ্ডা, নিশ্বাস নেবার সময় বাতাসও খুব শীতল মনে হচ্ছিল। ভেতর দিকের জানলা খোলা বলে অমল করিডোরে ঈষৎ আলো-আলো ভাব দেখতে পেল। এ-আলো ভোরের ফরসা নয়, বাতির আলো। তবু, অমল বুঝতে পারল, এখন ভোর হয়েছে। ভোর, হচ্ছে বলেই সে আজ গনি শুনতে পাচেছ। ভ্রমর বলেছিল, আজ ভোররাতে তাদের গান শুনে অমলের ঘুম ভাঙবে।

অমল এবার কান পাতল: শুনল—বসার ঘর থেকে ভ্রমর এবং কৃষ্ণার গলা ভেসে আসছে, হিমানীমাসি এবং মেসোমশাইও যেন থেমে-থেমে সেই গানে গলা দিচ্ছেন। সমবেতভাবে ওরা গান গাইছে বলে গানটা বেশ শোনা যাচ্ছে, নয়ত যেত না। মনোযোগ দিয়ে অমল শুনতে লাগল: ‘রজনী প্রভাত হল, জাগো, মন-বিহঙ্গম, জাগরিল সর্বপ্রাণী হেরি ভানু, মনোরম।’…গানের সুর শুনে অমলের কেমন অতি সহজে তাদের দেশের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল, দেশে বাউল বৈরাগীরা এইভাবে গান গায়; মনে পড়ে গেল, দুর্গা পুজোর আগে-আগে এক-আধদিন খুব ভোরে হঠাৎ মেজদির গলায় এই ধরনের গান শোনা যায় এখনও। শরৎকাল, সাদা কাচের মতন ভোর, শিউলি ফুল এইসব সঙ্গে-সঙ্গে পর-পর মনে, এসে যাবার পর অমল বুঝতে পারল, ভ্রমররা অনেকটা আগমনীর গানের মতন সুর করে ওই গানটা গাইছে: ‘রজনী প্রভাত হল…।’

লেপের তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে অমল বসার ঘরের দৃশ্যটি কল্পনা করতে-করতে গান শুনছিল। ভ্রমরের চেয়ে কৃষ্ণার গলা চমৎকার। মানাচ্ছিল এই গানে। হিমানীমাসি এবং মেসোমশাই যখন গানে গলা দিচ্ছেন তখন সমস্ত সুরটাই মোটা ও বাঁকাচোরা হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু খারাপ লাগছে না। খারাপ লাগা উচিতও নয়। অমল শুনল ভ্রমররা গাইছে; ‘প্রভাত-বন্দনা লয়ে, যীশু-পদে নত হয়ে, পূজ মন এ-সময়ে যীশু-পদ অনুপম।’

ভ্রমরদের যীশু, জন্মের উৎসব আজ এই হিম-কনকনে ভোর থেকে শুরু হয়। না, আজ ভোর থেকে কেন, কাল রাত থেকেই শুরু হয়েছে। কাল রাত থেকে এ-বাড়ির অন্যরকম চেহারা। খুব যে একটা হইচই চলছে তা নয়, তবে সবাই খুব হাসিখুশী, উৎফুল্ল। বাড়িটা যে-রকম উৎসবের চেহারা নিয়েছে তাতে অমলের স্কুল-কলেজের সরস্বতী পুজোর কথা মনে পড়ছিল। সেই দেবদারুপাতা আর গাঁদাফুল দিয়ে বাড়ির বারান্দা সাজানো, সেই লাল-নীল কাগজের লতা ফুল, সোনালী এবং রুপোলী ঘুরনপাত দিয়ে কারুকর্ম। কাল সন্ধে থেকে মোমবাতি জ্বলছে রাশীকৃত, ঠিক যেন দেওয়ালি। সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে বসার ঘর। ঝাউপাতার কচি-কচি ডাল ভেঙে ফুল গুঁজে তোড়া করেছে ভ্রমররা; দেওয়ালে সেই তোড়া ঝলছে। খৃস্ট-র মেহগনি কাঠের মূর্তিটির দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে আসে; বড়-বড় লাল গোলাপের তোড়া, পেতলের ঝকঝকে মোমদানে মোমবাতি, ধূপ পুড়ছে একপাশে। হিমানীমাসি অতি যত্ন করে দেরাজের মাথার ওপর রাখা মেরীর ছবিটি সাজিয়েছেন। অবিকল প্রতিমা সাজানোর মতন। লতানো গাছের ফুলপাতা দিয়ে যেন চালচিত্রের কাজ করেছেন ছবির পেছনটায়, ছবির তলায় এক থোকা টাটকা ফুল, ছোট-ছোট মোমবাতি, চন্দন ধূপ, ভাঁজ-ভাঙা বাইবেল। বসার ঘরে অন্য পাশে জানলার গা ঘেঁষে ভ্রমর আর কৃষ্ণা কাল সারা-দিন ক্রীশমাস ট্রি সাজিয়েছে। অমলও ছিল। অমল প্রায় প্রত্যেকটি সাজানো-গোছানোতেই ভ্রমরদের সাহায্য করেছে, দালালিও করেছে।

বিছানায় শুয়ে-শুয়ে অমল দু-মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে ক্রীশমাস ট্রি এখন কেমন দেখাচ্ছে ভাববার চেষ্টা করল। কাল রাত্তিরে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। একটা টুলের ওপর সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে তার ওপর টবে বসানো গাছ। টবের গা সবুজ কাগজে মোড়া। একটি মাত্র সরু, ফার-কাঠি যোগাড় করেছেন হিমানী-মাসি কোথা থেকে যেন, ঝাউ চারায় বেঁধে দিয়েছেন। ঝাউ গাছের সরু, ডালগুলো জরির ফিতে দিয়ে আগাগোড়া মুড়তে হয়েছে, রুপোলী লেসের চুমকি ঝোলাতে হয়েছে পাতার ফাঁকে-ফাঁকে, রাঙতা কেটে ঝিকিমিকি তৈরী করতে হয়েছে, এক কৌটো গায়ে-মাখা পাউডার ছড়িয়ে দিয়েছে কৃষ্ণা গাছের মাথায়, পাতায় কোথাও কোথাও পাউডারের গুঁড়ো ধরে সাদা দেখাচ্ছে। আরও কত কি, সোনালী ফাঁপা বল, চারপাশ গোল করে ঘিরে মোমবাতি সাজানো। সত্যি অপরূপ দেখাচ্ছিল।

কৃষ্ণা বলছিল, এ-রকম সুন্দর করে গাছ সাজানো আগে আর হয় নি কখনও। অমল নিজের কারুকর্মে কৃতিত্ব অনুভব করেছিল, কিন্তু ভ্রমর যখন গাছের মাথায় সুন্দর করে একটি বড় তারা জুড়ে দিল তখন অমল আফসোস করে ভেবেছিল, আহা, এই তারাটুকু সে কেন জুড়ে দিল না। ভ্রমর পরে ঠোঁট টিপে হেসে আড়ালে ফিসফিস করে বলল, তুমি কিচ্ছু, জানো না। বেথেলহেমের তারা এটা।

অমল বিছানার মধ্যে আরও একটু, আলস্য ভাঙল। তার ঘুম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু শীতের কথা ভেবে গা উঠছিল না। এখনও সূর্য ওঠে নি। বাইরে নিবিড় কুয়াশা হয়ে রয়েছে, ঘন পুঞ্জীভূত সাদা ধোঁয়ার মতন, তুষারকণা জমে আছে শূন্যে, ফরসা সাদা সিক্ত হিম হয়ে আছে জগৎ। শুয়ে-শুয়ে অমল বাইরের অবস্থাটা অনুমান করে নিল, এবং সারা শরীর কুঁকড়ে শুয়ে থাকল।

এ-সময় আবার নতুন করে অমল গান শুনতে পেল। হিমানীমাসি গাইছেন প্রেমের রাজা জনম নিল বেথেল গোশালাতে…।’ অদ্ভুত শোনাল গানটা। হিমানী-মাসির ভাঙা বেখাপ্পা গলায় এই গান একেবারে কীর্তন-কীর্তন লাগছিল। হিমানীমাসির সঙ্গে কে অর্গান বাজাচ্ছে কে জানে! কৃষ্ণা না ভ্রমর!

কয়েক মুহূর্তের জন্যে অমল হঠাৎ যীশুর জন্মের ছবিটি কল্পনা করল। বেথেলহেমের গোশালায় যীশু জন্মেছেন, মেষপালকরা ভিড় করে দেখতে এসেছে। যবপাত্রে কাপড় জড়ানো ছোট যীশু। মেরীর কোলে সন্তান যীশু। মেরীর মাথার পাশে সূর্যের মতন আভা। অমল বস্তুত কল্পনায় যে-ছবিটি দেখল, ভ্রমর কাল সেই ছবি তাকে বই থেকে দেখিয়েছিল। ছবির সঙ্গে তার কল্পনার, কোনো প্রভেদ ঘটল না, কিন্তু সে আশ্চর্য হয়ে অনুভব করল, ভ্রমরও যেন মেষ-পালকদের সঙ্গে মিশে যীশুকে দেখতে গেছে।

হিমানীমাসির গানের সঙ্গে এবার মেসোমশাই এবং ভ্রমররাও যোগ দিয়েছে। কান পেতে আরও একটু শুনল অমল, তারপর উঠে বসল। মনে হল, আর ঘুমোনো উচিত নয়। এ-বাড়িতে সকলেই যখন এই শীতের ভোরে উঠে যীশু, বন্দনা করছে তখন সে জেগে উঠে চুপচাপ শুয়ে কি করবে। বরং উঠে জামা-কাপড় পরে মুখ ধয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসাই ভাল।

কাল রাত্রে বেশী রকম খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল। মেসোমশাই কলেজের চার-পাঁচ বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। যোশী, মূলচাঁদ এঁরাও ছিলেন। বাঙালী প্রফেসার তিনজন; তিনজনেরই নেমন্তন্ন ছিল। একজন এসেছিলেন একেবারে পাকা সাহেব, কম বয়স বলেই মনে হয়; ইংরিজি পড়ান। একটু, মাতাল-মাতাল লাগছিল তাঁকে। হোহো করে হাসছিলেন, কোনো কাজে ভ্রমর কাছে গেলে ডাক-ছিলেন। অমলের খুব খারাপ লাগছিল তাঁকে। ভ্রমর পরে বলেছে, ওঁর নাম মিহিরকুমার সান্যাল। নতুন এসেছেন। একা থাকেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ে।

অমল বিছানা থেকে কাঁপতে-কাঁপতে উঠে গিয়ে তার ট্রাউজার, জামা, সোয়েটার, মোজা এক ছুটে নিয়ে এসে বিছানার ওপর ফেলল, এবং সঙ্গে-সঙ্গে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে কিছুক্ষণ হিহি করে কাঁপল। আরে শ্বাস, কী ঠাণ্ডা! বরফ পড়ছে যেন বাইরে। এই ঠাণ্ডায় ভ্রমররা কখন উঠেছে, কখন পোশাক বদলেছে, কখনই বা যীশুর গান গাইতে বসেছে কে জানে! ওদের কি শীত করছে না?

অমল ভেবে দেখল, সরস্বতী পুজোর দিন, মাঘ মাসের ভোরে তারা যখন দল মিলে সারা রাত এবং ভোরে ঠাকুর সাজিয়েছে তখন তারা শীত অনুভব করতে পারত না; ওই রকম ভোররাতে একবার অমলকে স্নান করতে হয়েছিল ঠাকুরের ফলফুল গোছানোর জন্যে। আসলে এসব সমর শীত করে না, মন এত খুশী থাকে যে শীত গায়ে লাগে না। ভ্রমরদেরও শীত লাগছে না নিশ্চয়।

দেখতে-দেখতে ভোর ফুটে উঠেছিল। ঘরের অন্ধকার যেন আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে এসে হালকা ধোঁয়ার মতন ভাসছে। দরজা জানলা দেখা যাচ্ছিল চোখে। অমল বিছানার মধ্যে বসে পায়ের মোজাটা আগে পরে নিল। তারপর সোয়েটার গায়ে চড়াল। কাল মাঝরাতের দিকে একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তখন তার হঠাৎ একটা কথা মনে হয়েছিল, কিন্তু অমল কথাটা বিশ্বাস করে নি এবং ঘুম জড়িয়ে থাকায় সে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। কথাটা এখন আবার অমলের মনে পড়ল। ভ্রমর বলেছিল, “সকালে উঠে তোমার ঘরে একটা জিনিস দেখতে পাবে। কাউকে বলবে না, চুপচাপ থাকবে।”

এখন ত সকাল হয়ে আসছে, কই কিছু দেখতে পাচ্ছে না অমল। ট্রাউজার পরতে-পরতে অমল চোখের দৃষ্টি যতদূর সম্ভব তীক্ষ্ম করে চারপাশে তাকাল। আলো ভালো করে না ফুটলে স্পষ্ট কিছু দেখা যাবে না অবশ্য। কিন্তু ভ্রমর কি জিনিসের কথা বলেছে অমল বুঝতে পারল না।…তার অনুমান, ভ্রমর তাকে কোনো উপহার দেবে। উপহারই হওয়া সম্ভব। মেসোমশাই অমলকে বড়দিনে খুব সুন্দর একটা উপহার দিয়েছেন, ফাউন্টেনপেন; মাসিমা দিয়েছেন একবাক্স রুমাল। কৃষ্ণা তাকে খুব চমৎকার একটা চামড়ার বাঁধানো নোট-বই কিনে দিয়েছে। এ সব উপহার আজ আর-একটু বেলায়, কিংবা দুপুরে অমল হাতে হাতে পাবে। ওরা সবাই যে যা কিনেছে অমলের জন্যে, অমল দেখেছে। ভ্রমর কিছু বলে নি, কিছু দেখায় নি। লুকিয়ে-লুকিয়ে একটা চমকে দেবার মতন কাণ্ড করেছে আর কি!

অমল হাসল মনে-মনে, হেসে ঘরের চারপাশে আবার তাকল। তাড়াতাড়ি কেন এই ঝাপসা অন্ধকার ফরসা হয়ে আসছে না ভেবে সে অধৈর্য হল।

একটা কাজ খুব বোকার মতন হয়ে গেছে অমলের। জুতো জোড়া খুঁজে পায়ে গলিয়ে নিতে নিতে অমল ভাবল, সে বোকার মতন এক কাণ্ড করেছে। ভ্রমর এবং কৃষ্ণার জন্যে তার কিছু কেনা উচিত ছিল। পরশু দিন সন্ধেবেলা বাজারে গিয়ে ওরা সবাই যখন কেনাকাটা করছিল তখন অমলের উচিত ছিল কিছু কেনা। সে কেনে নি। তার কাছে টাকাও ছিল না। বাড়তি তার কাছে যা টাকা আছে তাতে ভাল জিনিস কিছু কেনাও যাবে না। অমল ভেবে দেখেছে, তার টাকা দিয়ে সে যদি একটু, দামী জিনিস কেনে তবে বাড়ি ফেরার সময় বাবাকে চিঠি লিখে কিছু টাকা আনাতে হবে। লিখলে বাবা টাকা পাঠাবেন। গতকাল অমল মনে-মনে বাবাকে চিঠি লেখাই স্থির করে ফেলেছিল, কিন্তু চিঠি লেখার সময় পায় নি, ভ্রমরদের সঙ্গে বাড়ি সাজিয়েছে সমানে। আজ সে আর-একবার তার টাকার হিসাব-পত্র করে নেবে, করে বাবাকে চিঠি লিখবে। অমলের ইচ্ছে, আজ বেলায় কিংবা দুপুরের দিকে চকবাজারে গিয়ে মরদের জন্যে সে উপহার কিনে আনবে।

অমল এগিয়ে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল। বাইরে খুব ঠাণ্ডা, তবু, আজ এই ভোরে অমল জানলাগুলো খুলে দেবে। জানলা খুলতে-খুলতে অমল মেসোমশাই আর মাসিমার কথা ভাবল। ভ্রমর কৃষ্ণা বাবা-মার কাছ থেকে শাড়ি জামা-টামা উপহার পেয়েছে, অমলরা যেমন দূর্গাপুজোর সময় পায়। ব্যাপারটা প্রায় একই রকম। অমল ভেবে পেল না, সে কি ধরনের জিনিস কিনবে ভ্রমরদের জন্যে! ভ্রমরকে সে কি দিতে পারে?

জানলা খুলে দেবার সঙ্গে-সঙ্গে বাইরের ভোর ঘরে পা বাড়িয়ে দিল। সূর্য ওঠে নি। সামনে পুঞ্জীভূত নিবিড় কুয়াশা সাদা ধোঁয়ার মতন; প্রত্যুষের কনকনে বাতাস; গাছপালা ভিজে-ভিজে দেখাচ্ছিল, পাখিদের গলা শোনা যাচ্ছে। ঠাণ্ডার স্পর্শে্‌ অমল দাঁতে দাঁত চেপে থরথর করে কাঁপল।

বাইরের প্রখর বাতাস এবং আর্দ্র কুয়াশা এসে অমলের নাক মুখে এত ঠাণ্ডা করল যে তার চোখে নাকে জল এসে গেল। জানলার কাছ থেকে সরে এল অমল; অন্য জানলাটাও খুলে দিল। দিয়ে বাইরের চেহারাটা আর একবার দেখল। সকালটা খুব শুদ্র এবং সতেজ দেখাচ্ছিল, কিন্তু রোদ না ওঠায় উজ্জ্বল ও মনোরম লাগছিল না। মাঠ ঘাস গাছপালা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর যেমন দেখায় সেই রকম ভিজে দেখাচ্ছিল।

ঘরে ফরসা ভাব এসে পড়ায় অমল এবার চারপাশে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখল, এ-দেওয়াল থেকে ও-দেওয়াল পর্যন্ত হেঁটে গেল, নীচু, হয়ে-হয়ে লক্ষ করল, কিন্তু ভ্রমরের কথামতন কিছু খুঁজে পেল না। ভ্রমর কি তাহলে ভুলে গেছে রেখে দিতে? অমলের সে-রকম মনে হল না। ভ্রমর এ-ব্যাপারে ঠাট্টা করবে তার সঙ্গে এ-রকম হতে পারে না। অমলের খারাপ লাগছিল। সে দুঃখিত এবং বিমর্ষ বোধ করল। ভ্রমরের রেখে যাওয়া জিনিসটা পাবে এই প্রত্যাশা এবং লোভে সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে; বরং অমলের এখন মনে হচ্ছিল, এতক্ষণ যেন ইচ্ছে করে সে নিশ্চিত কিছু প্রাপ্তির প্রতীক্ষা করে-করে কোনো সুখ সইছিল।

কাল রাত্রে অনেকবারই ভ্রমর এ-ঘরে এসেছে। অমল শুয়ে পড়ার আগেও একবার এসেছিল। ভেতর দিকে জানলা সারা রাত খোলা পড়ে আছে। ভ্রমর যা দিতে চেয়েছিল অনায়াসে দিতে পারত। সে কেন দিল না, কি অসুবিধে তার হয় কে জানে!

ভোরবেলায় অমলের মন ভেঙে গেল, অভিমান এবং দুঃখ হল। একপাশ থেকে মাফলারটা উঠিয়ে নিয়ে অমল আরও একবার ঘর দেখল, দেখে দরজার ছিটকিনি খুলে বাথরুমে চলে গেল।

সূৰ্য উঠল যখন তখন বাড়িতে বেশ চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। আজ সকালে গির্জায় ক্রীশমাসের বিশেষ প্রার্থনা। হিমানীরা সবাই চার্চে চলেছেন। সাজ-গোজ এখনও শেষ হয় নি সকলের। কৃষ্ণা যেন সারা বাড়ি ছুটোছুটি করছিল, তার গলা শোনা যাচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে, ভ্রমর ঘর বন্ধ করে পোশাক বদলাচ্ছে, মেসো-মশাই বাদামী রঙের একটি স্যুট পরে বাইরে ফুলবাগানে রোদে দাঁড়িয়ে পাখিদের কেক-বিস্কুটের গুঁড়ো খাওয়াচ্ছেন, ফলের টুকরো ছুঁড়ে-ছুঁড়ে দিচ্ছেন। হিমানী-মাসি এখনও ঘর ছেড়ে বাইরে আসেন নি।

অমল চা খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মেসোমশাই মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সকালটি এখন রোদ আলো ও সর্বরকম উজ্জ্বলতা নিয়ে ফুটে উঠেছে। আকাশে কোথাও একটু, মলিন ভাব নেই, ছিমছাম পরিষ্কার আকাশ, আগুনের নরম আঁচের মতন রঙ ধরেছে রোদের, গাছপালার সবুজ পাতা-গুলি খুব ঝকঝকে দেখাচ্ছে, মরসুমী ফলের বাগানের সব ফুলই প্রায় তুলে নেওয়া, দু-একটি সদ্য-প্রস্ফুটিত পুষ্প পাতার মধ্যে ফাঁকে-ফাঁকে দেখাচ্ছিল। গোলাপ গাছে মাত্র একটি লাল গোলাপ। ঘাসের ওপর সকালের রোদ সোনার জলের মতন ছড়িয়ে যাচ্ছিল। মেসোমশাইয়ের চারপাশে পাখির ঝাঁক, কতক চড়ুই কতক শালিক, কাক এসেছে দল বেঁধে। ওর মধ্যে অমল একটি বেগুনী-লাল পালকের ছোট্ট পাখি দেখল। সে আলাদা একপাশে দাঁড়িয়ে ভীরুর মতন বিক্ষিপ্ত খাদ্যকণা খুঁটে নিচ্ছিল।

বাড়ির ফটকের কাছে টাঙা এসে গেল। মেসোমশাই টাঙা দেখে ব্যস্ত হলেন, হাতের ঘড়ি দেখলেন। পাখিদের খাবার দেওয়া বন্ধ হল; রুমাল বের করে হাত মুছলেন। মুছে অমলকে একবার তাগাদা দিতে পাঠালেন।

কৃষ্ণা সাজগোজ শেষ করে ফেলেছে। খুবই অবাক হয়ে অমল দেখল, কৃষ্ণা আজ শাড়ি পরেছে। নীল রঙের জংলী ছিট-ছিট সিল্কের শাড়িতে কৃষ্ণাকে একেবারে নতুন ও সুন্দর দেখাচ্ছিল। শাড়িটা যেন সে দু-হাত দিয়ে বয়ে-বয়ে হাঁটছে। গায়ে সাদা ফ্লানেলের মেয়েলী কোট, কোটের বকে নানা রকম কারকার্য। মাথায় খোঁপা বেঁধেছে। কানে ইয়ারিং, হাতে বালা। অমল মুগ্ধ হয়ে বলল, “বারে! তোমায় একেবারে…একেবারে বিরাট বড় দেখাচ্ছে!”

রুমাল দিয়ে কৃষ্ণা কপালের পাউডার মুছছিল। সারা মুখ খুশীতে উথলে উঠল। বলল, “ভাল দেখাচ্ছে?”

“খুব ভাল। বিউটিফুল!”

“হ্যাত্‌!”

“বলছি। তুমি আর কাউকে গিয়ে দেখাও।”

“টিকলি পরবো একটা?”

“টিকলি! টিকলি কি?”

“টিপ, এক কিসমের টিপ; আমার কাছে আছে।”

“হিন্দুস্থানী টিপ!” অমল হা-হা করে উঠল, “পরো না। মার্ডার হয়ে যাবে সব। এমনিতেই বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।” বলে অমল স্নেহবশে কৃষ্ণার মাথার ওপর থেকে সুতোর একটা আঁশ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। বলল, “মেসোমশাই ডাকাডাকি করছেন—তাড়াতাড়ি নাও।”

কৃষ্ণার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভ্রমরকে ডাকতে গেল অমল। ভ্রমরের ঘরের সামনেই দেখা। দরজা খুলে সবে বেরিয়েছে। অমল থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, অপলক চোখে দেখতে লাগল ভ্রমরকে।

ভ্রমর দুধের মত সাদা একটি শাড়ি পরেছে; সিল্ক নয়, অথচ সিল্কের মতন নরম মসৃণ ও ঝকঝকে, শাড়ির পাড় নেই, কমলা রঙের সুতো দিয়ে ধার মোড়া আগাগোড়া; গায়ে সাদা জামা; বাদামী রঙের সামান্য কাজ করা শাল গায়ে, চুল এলো, ঘাড়ের কাছে ফিতের একটা ফাঁস দেওয়া রয়েছে। মুখে কোথাও কোনো প্রসাধন নেই, হয়ত সামান্য পাউডার ছোঁয়ানো। ভ্রমরের হাতে ছোট বাইবেল। অমল অভিভূত হল। তার মনে হচ্ছিল, ভ্রমরের সমস্ত চেহারায় কেমন যেন অতি পবিত্র একটি আভা ফুটে রয়েছে, আশ্চর্য শুভ্রতা এবং শুদ্ধতা। মুহূর্তের জন্যে অমলের মনে হল, ভ্রমরকে এখন ঠিক যেন ছবির মতন দেখাচ্ছে। তার গায়ে সকালের আলো, পায়ের তলায় রোদ।

অভিভূত অমল কেমন শব্দ করল একটু, বিমোহিত মানুষ যেমন করে। পরক্ষণেই তার মনে হল, সকাল থেকে সে ভ্রমরের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। ভ্রমর তাকে অকারণে প্রতীক্ষা করিয়েছে, সারা ঘর খুঁজিয়েছে, অথচ অমল পায় নি।

ভ্রমরই কথা বলল প্রথমে, “তুমি পোশাক বদলাও নি?”

“আমি!…না।”

“তুমি যে কাল বলেছিলে আমাদের সঙ্গে যাবে।”

অমল বলেছিল: তার যাবার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে সে ভেবে দেখল, তার যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আজ চার্চের অন্য চেহারা। ইংলিশ চার্চে এবং আজকের এই বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে গিয়ে সে মুশকিলে পড়ে যাবে। কিছু বুঝবে না, অন্যদের মতন যা-যা করার করতে পারবে না, অত লোকের মধ্যে বোকার মতন, গেঁয়োর মতন মুখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অমল যত এই সব কথা ভেবেছে, তত অস্বস্তি বোধ করেছে, কুণ্ঠা অনুভব করেছে। তা ছাড়া, অমল আরও ভেবে দেখেছে, সে যখন কৃশ্চান নয় তখন ভ্রমরদের আজকের পবিত্র উপাসনায় যোগ দেওয়া তার উচিত হবে না। উপাসনা জিনিসটা ঠাট্টা তামাশা নয়, ম্যাজিক কিংবা সার্কাস নয় যে অমল কৌতূহলবশে দেখতে যাবে! মন খুঁতখুঁত করছিল অমলের। সে শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছিল, সে যাবে না।

অমল এখন কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল ভ্রমরের কথায়। ইতস্তত করে বলল, “আমি আজ যাব না।…” বলে একটু থেমে আবার বলল, “আজ আমার গির্জায় যাওয়া ভাল দেখায় না।”

ভ্রমর বেশ অবাক হল যেন। বলল, “ভাল দেখাবে না কেন?”

“না, দেখাবে না।…আমি পরে তোমায় বুঝিয়ে বলব!” তাড়াতাড়ি অমল বলল। বলে হাসির মুখ করল সুন্দর করে। “তোমায় খুব চমৎকার দেখাচ্ছে। কেমন সন্ন্যাসিনী-টন্ন্যাসিনী। পবিত্র-পবিত্র লাগছে।”

ভ্রমরের চোখে শান্ত মধুর একটু হাসি নামল, মুখের ভাব সেই রকম নরম ও আনন্দময়। ভ্রমর বলল, “আমি একদিন সন্ন্যাসিনী হব ভাবতাম কি না, তাই!”

অমল কান করে শুনতে চায়নি, তবু ভ্রমরের কথাটা তার কানে বাজল। চোখ চঞ্চল হল অমলের। “সন্ন্যাসিনী হবে ভাবতে!”

“ভাবতাম—।” ভ্রমর যাবার জন্যে পা বাড়াল, এক মুঠো রোদ তার গালে পড়ল তখন। পা বাড়িয়ে ভ্রমর বলল, “তুমি তবে একলা একলা থাক বাড়িতে, আমাদের ফিরতে বেলা হবে।”

অমলও ভ্রমরের পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল। “আমি এখন বেরুবো।”

“কোথায়?”

“বেড়াতে। বাজারের দিকে।” অমল কেন বাজারের দিকে যাবে তা গোপন রাখল।

দু-পা এগিয়ে অমল হঠাৎ বলল, “ভ্রমর, তুমি আজ আমায় খুব ঠকিয়েছ।”

যেতে-যেতে ভ্রমর দাঁড়াল; দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে অমলকে দেখল। অবাক হয়েছিল ভ্রমর। তার চোখের দৃষ্টি বলছিল, ঠকালাম! কি ঠকালাম!

অমল বলল, “আমি সকালে উঠে ঘরে কিছু পাই নি।”

“পাও নি?” ভ্রমরের চোখের পাতা বড় হয়ে এল।

“না, কিচ্ছু না। সমস্ত ঘর খুঁজেছি।”

ভ্রমর অমলের চোখে চোখে তাকিয়ে থাকল দু-মুহূর্ত। “ঘরে খুঁজেছে!”

“ঘরেই ত বলেছিলে!”

“তাহলে ঘরেই আছে।” ভ্রমর এবার যেন সব বুঝে ফেলে সকৌতুক মুখে হাসল, হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল।

ও-পাশ থেকে কৃষ্ণা ডাকাডাকি করছে, হিমানীমাসির গলাও পাওয়া গেল। ভ্রমর চলে যাচ্ছিল।

অমল বলল, “ঘরে কিছু নেই। কিচ্ছু না।”

“চোখ থাকলে ঠিক খুঁজে পাবে।” ভ্রমর মুখ ফিরিয়ে, ঘাড় হেলিয়ে খুব মিষ্টি করে বলল। বলে চলে গেল।

অমল রীতিমত বোকা হয়ে থাকল।

সারাটা দিন আনন্দে কাটল। গীর্জা থেকে ভ্রমরদের ফিরতে বেলা হয়ে গিয়েছিল। ওরা যখন ফিরল, ওদের সঙ্গে বিচিত্র সব অতিথি। মেয়ে-পুরুষ বাচ্চা-কাচ্চা। সবাই অবাঙ্গালী। মেয়ে-পুরুষেরা বসার ঘরে বসল, চা কেক খেল, হোহো করে হাসল, গল্পগুজব করল; আর বাচ্চাগুলো বাইরে মাঠে ছুটোছুটি করে খেলা করল, দোলনায় দুলল। ওরই মধ্যে কৃষ্ণা শাড়ি বদলে তার এক সমবয়সীর সঙ্গে খানিকটা ব্যাডমিন্টন খেলে নিল। কাল মেসোমশাই ঝুড়ি সাজিয়ে কোথায় যেন ডালি পাঠিয়ে-ছিলেন, আজ দু-দফা এ-বাড়িতে ডালি এল। অমল অবাক হয়ে দেখল, একটা ঝুড়িতে এক বোতল মদ এসেছে। হিমানীমাসি নিজের হাতে সেটা সরিয়ে রাখলেন।

হু-হু করে দুপুরে এসে গেল, দেখতে-দেখতে দুপুরও ফুরিয়ে গেল। দুপুর থেকেই বাড়ি আবার ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মনে হল, সামান্য যেন ক্লান্তি নেমেছে এ-বাড়িতে। আজ দিনটাও সেই রকম শুকনো, কনকনে প্রবল শীত যত, তত তপ্ত অনাবিল রোদ আর আলো; যত ঝোড়ো বাতাস, তত যেন দেবদারুপাতার সুগন্ধ। দুপুরবেলায় অমল আজ ঘুমিয়ে পড়েছিল।

বিকেলে আবার বাড়ি জেগে উঠল। মেসোমশাই, মাসিমা যাবেন এক নিমন্ত্রণে; কৃষ্ণা যাচ্ছে তার বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে করে কোথায় যেন সার্কাস দেখতে। ফিরতে। বেশ রাত হবে, বেশী রাত হয়ে গেলে ওরা ফিরবে না, লীলাদের আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে যাবে।

কৃষ্ণা বিকেলের গোড়াতেই চলে গেল; হিমানীরা বেরোলেন সন্ধের দিকে। টিসরিকেও আজ ছুটি দেওয়া হয়েছে বিকেলে। কাজকর্ম সেরে সে বেরিয়ে গেছে, ঠিরবে সন্ধের পর।

কাল থেকে ক্রমাগত যে-রকম পরিশ্রম, হই-হই চলছিল, তাতে ভ্রমর বেশ ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। অবেলায় সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমিয়ে উঠল যখন, তখন বিকেল ফুরিয়ে গেছে, কৃষ্ণা বাড়ি নেই। কিছু খুচরো কাজ ছিল, ভ্রমর আর গা পেল না, বাঁ পায়ে কেমন যেন ব্যথা হয়েছে, টান ধরে আছে। টুকটাক এটা-ওটা সেরে ভ্রমর বাথরুমে গেল। কলঘর থেকে ফিরে বিকেলের পোশাক বদলাতে সন্ধে হয়ে এল। হিমানীরা আর একটু পরেই নিমন্ত্রণে চলে গেলেন।

সমস্ত বাড়ি ফাঁকা, নিস্তব্ধ। উৎসবটা যেন হঠাৎ এসেছিল এ-বাড়িতে, হঠাৎই চলে গেল, সারা বাড়ি নিরিবিলি নীরব শান্ত রেখে গেল। বসার ঘরটি সেই রকম সাজানো থাকল, বারান্দায় দেবদারুপাতা এবং লাল নীল কাগজের ফুল বাতাসে ছিঁড়ে যেতে লাগল। তবু, বারান্দায় একটি উজ্জ্বল বাতি জ্বালানো থাকল, ভাড়া-করা পেট্রম্যাক্স।

হিমানীরা চলে যেতেই অমল নিজের হাতে মালসায় আগনে রেখে ভ্রমরের ঘরে দিল, নিজেই চা করল। মাথা খাটিয়ে গরম জল করে হট্‌ ওয়াটার ব্যাগে ভরল, ভরে ভ্রমরের পায়ের তলায় দিল, বলল, “পায়ে টান ধরেছে, শিরার টান, গরম দাও সেরে যাবে।”

সামান্য সময় আর পাঁচটা কথা বলে অমল যেন একটা ভূমিকা লুকিয়ে-লুকিয়ে সেরে নিল, তারপর বলল, “আচ্ছা ভ্রমর, তুমি সবচেয়ে কি বেশী ভালবাস?”

ভ্রমর বুঝল না। না বুঝে সরল অবাক চোখ তুলে চেয়ে থাকল।

অমল অপেক্ষা করল সামান্য, পকেটে হাত ঢোকাল আড়াল করে। বলল, “বাইবেল বাদ দিয়ে বলছি। কি ভালবাস বেশী?”

“কেন?”

“জিজ্ঞেস করছি।…জিজ্ঞেস করতে নেই?”

“আমি সব ভালবাসি।” ভ্রমর হেসে বলল।

“সব কেউ ভালবাসতে পারে না।” অমল অতি নিশ্চিন্ত গলায় বলল, বলে পকেট থেকে আস্তে-আস্তে হাতের মুঠো বের করছিল।

ভ্রমর বোধ হয় আন্দাজ করতে পেরেছিল অমল বুদ্ধি খাটিয়ে কিছু একটা ঢাকবার চেষ্টা করছে। অমলকে লক্ষ করল ভ্রমর ভালো করে; বলল, “তোমার ফন্দি আছে।”

“কিচ্ছু না।” অমল মাথা নাড়ল খুব জোরে-জোরে।

“তবে?”

“তোমার চেয়ে ভাল ফন্দি কারও নেই। কী মাথা একটা!…আমায়-বোকা বুদ্ধু করে দিয়েছ?”

ভ্রমর এবার ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। ডালিমের দানার মতন দাঁত দেখা গেল। চোখ দুটি হাসিতে থইথই করছিল। যেন কিছু জানে না, এইরকম ভাব করে, ঠোঁটের কাছে আঙুল এনে ভ্রমর বলল, “তোমার ঘরেই সেই জিনিসটা ছিল তবে—!”

“বালিশের তলায়—”

ভ্রমর ঠোঁটের আঙুল তাড়াতাড়ি জোড়া-ওষ্ঠের ওপর রাখল। বলল, “আর বলবে না কিছু। বলেছি না, চুপচুপ থাকবে; কাউকে কিছু বলবে না।”

অমল গ্রাহ্য করল না। ভ্রমরের দিকে হেলে শুয়ে পড়ল যেন বিছানায়। বলল, “তোমার ছবি ছিল আমি জানতামই না। নয়ত কবেই স্টিলিং করতাম।”

“কি করতে?”

“চুরি। স্টিলিং বোঝো না! সেই মেয়েটা যা করেছে—” বলে অমল খুব সন্তর্পণে তার পকেট থেকে হাত বের করে সাঁতার দেওয়ার ভঙ্গিতে ভ্রমরের কোলের কাছে হাত বাড়াল। “ছবিটা, বুঝলে ভ্রমর, খুব বিউটিফুল। তোমায় যা সন্দর দেখাচ্ছে। কবে তুলেছ?”

“গত বছর ক্রীশমাসে।”

“ক্রীশমাসে?” অমল একমুহূর্ত, কি ভাবল, বলল, “তবে তুমি জানতে এ-বছর ক্রীশমাসে আমি আসব।” বলে অমল আশ্চর্য সুন্দর মুখ করে হাসল।

ভ্রমর জানত না অমল আসবে। গত বছর যখন তারা ছবি তোলায় ক্রীশ-মাসে, তখন মেঘলা-মেঘলা দিন, রোদ আলো দেখা যাচ্ছিল না তেমন, চারপাশ মনমরা হয়ে ছিল, বিষণ্ণ; এবারে এত রোদ এত আলো। এত হাসিখুশী হয়ে ক্রীশমাস আসবে, কে জানত! হয়ত ভ্রমরের সমস্ত জীবনে এই প্রথম এক ক্রীশ-মাস এল, যার সখ সে আর কখনও অনুভব করে নি।

অস্ফুট গলায় ভ্রমর কেমন আচ্ছন্নের মতন বলল, “ভগবান জানতেন।”

ঠিক এই সময় অমল ভ্রমরের কোলের ওপর তার মুঠো খুলে একটা কি যেন ফেলে দিল। দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ বলল, “আরে বাবা, তোমার আজ খুব ভাল দিন। গায়ে প্রজাপতি বসছে।”

ভ্রমর অমলের চোখ দেখল, দেখে নিজের কোলের ওপর চোখ নামাল। তার কোলে ছোট্ট একটি প্রজাপতি, সোনার যেন। ভ্রমর কয়েক পলকের মতন বিহ্বল হয়ে থাকল। সে বুঝতে পারে নি প্রথমে, তারপর বুঝতে পারল। আস্তে করে ডানহাত বাড়িয়ে সেই প্রজাপতি তুলে নিল। রুপোর পাখনায় সোনার জল ধরানো, মিনের সুন্দর কাজ, প্রজাপতির চোখ দুটিতে সবুজ দুটি পাথরের কণা। ভ্রমরের মনে হল, সত্যিই যেন এক ছোট্ট প্রজাপতি তার হাতের মুঠোয় এসে বসেছে।

অমল ভ্রমরের মুখ দেখছিল। ভ্রমরের বিস্ময় খুশী এবং আনন্দ অনুভব করবার জন্যে সে নিষ্পলক নয়নে মুহূর্তে গুনছিল।

ভ্রমর চোখ ওঠাল, অমলের চোখে-চোখে তাকাল। যেন ভাবল একটু, কি বলবে। হঠাৎ তার কি মনে পড়ে যাওয়ায় মুখে চাপা হাসি নামল; বলল, “খুব বিউটিফুল।” অবিকল অমলের বলার ভঙ্গি নকল করে, অমলের মুদ্রাদোষটির মতন করেই বলল ভ্রমর। তারপর দুজনেই হেসে উঠল এক সঙ্গে।

অমল বলল, “তোমাদের এখানে কিছু পাওয়া যায় না। সব রন্দি জিনিস। ওই ব্রোচ কিনতে আমায় যা ভুগতে হয়েছে…”

অমলকে কথা শেষ করতে দিল না ভ্রমর, বলল, “অনেক দাম নিয়েছে।”

“ভাল জিনিস হলেই বেশী দাম।” অমল অভিজ্ঞের মতন বলল।

“বেশী দাম দিয়ে তুমি কিনলে কেন? তুমি কি চাকরি করো?”

ভ্রমরের গলায় বোধ হয় অমলের অবিবেচনার জন্যে সামান্য ভর্ৎসনা ছিল। অমল গ্রাহ্য করল না। বলল, “মেয়েদের নেচার খালি দামটাম দেখা! আমরা ও-সব কেয়ার করি না। যা ভাল দেখব নিয়ে নেব।” বলে অমল এবার বিছানার ওপর গড়িয়ে শুয়ে পড়ল। সিলিঙের দিকে চোখ রাখল কয়েক পলক, বলল, “আমি একটা ভোমরা খুঁজলাম কত! বলল—হয় না। হ্যাত, জানে না কিছু…। প্রজাপতি ব্রোচ হলে ভোমরা হবে না কেন?—যদি একটা ভ্রমর পেয়ে যেতাম, বুঝলে স্যার, তবে…’

“পেলে না?” ভ্রমর এবার সকৌতুক করে বলল।

“না। এখানে বিউটিফুল কিছু পাওয়া যায় না।”

এবার ভ্রমর ‘ইস্‌’—মতন শব্দ করলে জিবে। শব্দ শুনে অমল মাথা ফেরাল, ভ্রমরের দিকে তাকাল। ভ্রমরের মুখে বিচিত্র ও মনোহর হাসি, অথচ হাসির তলায় যেন কোনো একটা কৃত্রিম অভিমান রয়েছে। ভুরু, দুটি ঈষৎ বাঁকা, ঠোঁটের ডগাও সামান্য বঙ্কিম। অমল মুগ্ধ হয়ে সেই মুখ দেখছিল। দেখতে-দেখতে সে অনুভব করল ভ্রমর তাকে ঠাট্টা করছে। কিসের ঠাট্টা অমল তাও ধরতে পারল।

এবার অমল খুব বিচক্ষণের মতন যেন তার ভ্রম সংশোধন করে নিয়ে বলল, “আমার একটু, ভুল হয়েছে, এখানে একটা শুধু বিউটিফুল ভ্রমর পাওয়া যায়।” বলে কথাটা যেন ভ্রমরকে বুঝতে সময় দিল এক মুহূর্ত, তারপর জোরে হেসে উঠল।

ভ্রমর যদিও ওই কথাটি মনে-মনে শুনতে চাইছিল, তবু এখন সে লজ্জা পেল। লজ্জা তার মুখের সৌন্দর্য আরও কমনীয় করে তুলেছিল। চোখের পাতা নামিয়ে নিল ভ্রমর, যেন চোখ বুজে ফেলল।

অল্প সময় চুপচাপ কাটল। ভ্রমর একই ভাবে বসে থাকল, অমল অন্য-মনস্কভাবে কিছু ভাবল। নিঃশব্দ অবস্থাটি ক্রমে ঘন হয়ে এসে দুজনের চেতনায় কেমন উদাসীনতার বোধ জাগাল। কেন, কেউ বুঝল না। অমল নিশ্বাস ফেলল দীর্ঘ করে, ভ্রমর তার মুঠোর প্রজাপতিটি বালিশের পাশে রাখল।

অমল মনের বিষণ্ণ ভাবটি আর যেন সহ্য করতে পারল না, সামান্য নড়েচড়ে হঠাৎ গুন-গুন করে গান গাইল, তারপর উঠে বসল। কোটের বুক-পকেটে একটা সিগারেট রেখেছিল অমল। সিগারেটটা চেপটে গেছে। আঙুলের ডগা দিয়ে সিগারেট গোল করতে-করতে অমল উঠল।

“ভ্রমর—!” অমল উবু হয়ে বসে সিগারেট ধরাচ্ছিল মালসার আগুনে।

“উঁ—”

“আজ সকালে তোমাদের গান শুনে ঘুম ভেঙেছে।” সিগারেট ধরানো হয়ে গিয়েছিল বলে অমল একমখ ধোঁয়া টেনে নিল। কিছুটা গলায় গেল, কিছুটা ঘরের বাতাসে মিশল। ফাঁকা হলে অমল ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে এবার বলল, “আমি বলি এবার তুমি একটা ক্লোজিং সঙ্‌ গাও।” কথাটা হালকা এবং লঘু করেই বলল অমল।

ভ্রমর জবাব দিল না। অমল অপেক্ষা করল। মালসার আগুন যেন আজ তেমন করে জ্বলছে না। ছাই হয়ে আসছে।

সহসা ভ্রমর খুব মৃদু, মিহি এবং নিবিড় গলায় গান গাইতে শুরু করল। অমল উঠল না। মেঝের ওপর বসে গান শুনতে লাগল। ‘হাত ধরে মোরে নিয়ে চলল সখা, আমি যে পথ চিনি না…’

গানের মধ্যে অমল ভাবল, ভ্রমর তাকে সত্যি-সত্যি শেষ-গান শোনাচ্ছে।

গান শেষ হলে অমল বলল, “বাঃ; ওআল্ডারফুল! আমি এ-গান আগে শুনেছি।” বলে অমল কি ভেবে হঠাৎ হেসে বলল, “আচ্ছা ভ্রমর, এই ‘সখা’-টা কে?”

ভ্রমর যেন আশা করে নি এ-রকম প্রশ্ন। ইতস্তত করল। বলল, “কেন, ভগবান।”

“ভগবান!”…অমল কেমন থতমত খেয়ে গেল, তারপর কেমন অদ্ভুত গলায় বলল, “আমি ভেবেছিলাম, আমি।”

“তুমিও!” ভ্রমর বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *