অঞ্জু খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। যত রাতেই ঘুমাতে যাক সূর্য ওঠার আগে তার ঘুম ভাঙবেই। এত ভোরে আর কেউ ওঠে না। অঞ্জু তাই একা-একা বারান্দার বেঞ্চিটায় বসে থাকে। অবশ্যি গত কয়েক মাস ধরে তাকে একা-একা বেঞ্চিতে বসে থাকতে হচ্ছে না। অঞ্জু পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে তিনটি গোলাপের কলম এনেছে। কলম তিনটি বহু যতে লাগান হয়েছে বাড়ির পেছনের ফাঁকা জায়গায়। অঞ্জু সকালবেলাটা গাছগুলোর পাশে বসে কাটায়। পানি দেয়। মাটি কুপিয়ে দেয়। এবং যেদিন মন-টন খুব খারাপ থাকে, তখন কথা বলে। হঠাৎ শুনলে মনে হবে সে গাছগুললার সঙ্গেই কথা বলছে। আসলে তা নয়, সে কথা বলে নিজের মনে। যেমন আজ সকালে সে বলছিল, মেয়েরা বড়ো হলে তাদের গায়ে হাত ভোলা ঠিক না। খুব খারাপ। রাগ হলে বুঝিয়ে বলতে হয়। বোঝালে সবাই বোঝে। বোঝলে যখন। বোঝ তখনই তো সবাই বড়ো হয়। ঠিক না?
অঞ্জু কথাগুলো বলছিল ফিসফিস করে। যেন খুব গোপন কিছু বান্ধবীকে বলা হচ্ছে। টিউবওয়েলে পানি নিতে এসে জহুর অবাক হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করল। অঞ্জু নিচু গলায় গাছের সঙ্গে কথা বলছে।
আমি কখনন আমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে রাগ করব না। রাগ করলে কষ্ট পায় না? মন খারাপ হয় না? রাগ করার দরকার কী?
জহুর অবাক হয়ে ডাকল, এই অঞ্জু।
অঞ্জু চমকে পেছন ফিরল।
গাছের সঙ্গে কথা বলছি নাকি রে?
যাও মামা, গাছের সঙ্গে কথা বলব কেন?
অঞ্জু লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল।
রোজ এত সকালে উঠিস?
হুঁ। তুমিও ওঠ?
উঠি। জেলখানার অভ্যেস।
অঞ্জু উঠে দাঁড়াল। জহুর দেখল এই মেয়েটি দেখতে বেশ হয়েছে। ছোটবেলায় কদাকার ছিল। নাক দিয়ে সব সময় সর্দি পড়ত। বুকের পকেট ভর্তি থাকত রেললাইন থেকে আনা পাথরের টুকরোয়। জহুর যত বারই জিজ্ঞেস করত, পকেটে পাথর নিয়ে কী করিস তুই? তত বারই সে নাকের সর্দি টেনে বলত, পাথর না মামা, গোগেলের ডিম।
জহুর মুখে পানির ঝাপ্টা দিতে দিতে বলল, গোগেলের ডিমের কথা মনে আছে তোর? অঞ্জু লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।
কি রে, আছে?
আছে।
এখন আর গোগেলের ডিম আনিস না?
অজু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, চা খাবে মামা?
চা?
হুঁ, একটা হিটার আছে। চট করে বানাব।
ঠিক আছে আন। তুই এ রকম সকালবেলা উঠে একা-একা চা-টা খাস নাকি?
না, তোমার জন্যে বানাব।
অঞ্জু চা নিয়ে আসবার পর জহুর একটা জিনিস লক্ষ করল, অঞ্জু যেন খুঁড়িয়ে। খুঁড়িয়ে হাঁটছে।
চিনি ঠিক আছে মামা?
ঠিক আছে।
অঞ্জু মামার পাশে বসে নরম গলায় বলল, তুমি কি আবার কলেজে ভর্তি হবে?
নাহ্।
তুমি কী করবে?
জহুর জবাব দিল না। অজু বলল, বাবা বলছিলেন তুমি তার সঙ্গে লঞ্চের ব্যবসা করবে।
জহুর হালকা গলায় বলল, দুলাভাইয়ের অনেক টাকা হয়েছে নাকি রে?
হুঁ।
ঘর-দুয়ার তো কিছু ঠিকঠাক করে নাই।
বাবা টাকা খরচ করে না।
তাই নাকি?
হুঁ। সবাই বলছিল বড়োপাকে দুই-একটা গানটান শেখাতে। তাহলে চট করে বিয়ে হবে। তা বাবা শেখাবে না। হারমোনিয়াম কিনতে হবে যে!
এখন বিয়ে হবার জন্যে গান শিখতে হয়?
হুঁ, হয়। যাদের গায়ের রঙ কালো তাদের হয়।
এখানে গান শেখায় কে?
কে আবার, বগা ভাই।
বগা ভাইটা কে?
তুমি চিনবে না, সাইফুল ইসলাম। বকের মত হাঁটে, তাই নাম বগা ভাই।
অঞ্জু মুখ নিচু করে হাসল। পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, অনেকে আবার ডাকে জেলি ফিশ। খুব মজার লোক মামা।
জহুর কিছু বলল না। বাবলু এবং বাহাদুরের কান্ন শোনা যেতে লাগল। দবির মিয়ার গর্জনও ভেসে এল, খুন করে ফেলব। আজকে আমি দুটাকেই জানে শেষ করে দেব।
জহুর বলল, ব্যাপার কি অঞ্জু?
ওরা আজ আবার বিছানা ভিজিয়ে ফেলেছে।
দবির মিয়ার রাগ ক্রমেই চড়ছে : হারামজাদাদের আজ আমি বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। ধামড়া ধামড়া একটা, আর কাণ্ডটা দেখ।
জহুর বলল, আমি একটু ঘুরে আসি অঞ্জু।
কোথায় যাও?
এই এনি একটু হাঁটব।
নাস্তা খেয়ে যাও।
এসে পড়ব, বেশি দেরি হবে না।
ছোট চৌধুরী নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজছিলেন। দাঁত মাজার পর্বটি তাঁর দীর্ঘ। বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করেন এবং দাঁত মাজেন। তাঁর পরনে একটি লুঙ্গি এবং পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির বোম সবগুলো খোলা। মুখ থেকে কম পড়ে পাঞ্জাবির জায়গায় জায়গায় ভিজে উঠেছে। তিনি এটা তেমন গ্রাহ্য করছেন না। কারণ দাঁত মাজা শেষ হলেই তিনি গোসল করেন। গোসলের পানি গরম হচ্ছে।
বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যে-ই হেঁটে যাচ্ছে, তাকেই তিনি দু-একটা ছোটখাটো প্রশ্ন করছেন, কে, জলিল না? আছ কেমন? বড়োছেলের চিঠিপত্র পাও? মনু মিয়া, তোমার বাতের ব্যথা কি কমতির দিকে? এ্যাঁ, আরো বাড়ছে? বল কি!
আজকের রুটিন অন্য রকম হল। তিনি দেখলেন, জহুর আলি হনহন করে আসছে। জহুর আলিকে দেখতে পেয়ে তিনি তেমন অবাক হলেন না। সে যে ছাড়া পেয়েছে এবং এখানে এসে পৌছেছে সে খবর তাঁর জানা। কিন্তু তার হনহন করে হাঁটার ভঙ্গিটা চোখে লাগে। কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া কেউ এ রকম হাঁটে না। কিন্তু এই সকালবেলা তার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
চৌধুরী সাহেব ভালো আছেন?
চৌধুরী সাহেব চট করে জবাব দিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ সময় লাগল।
জহুর না?
হ্যাঁ।
ছাড়া পেয়েছ নাকি?
হ্যাঁ, ছাড়া পেয়েছি।
ভালো, ভালো। খুব ভালো।
ছোট চৌধুরী লক্ষ করলেন জহুর আলি যেন হাসছে। নাকি চোখের ভুল? ইদানীং তিনি চোখে ভালো দেখতে পান না।
জহুর, বসবে নাকি?
নাহ।
জহুর না বলেই গেট ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এর মানে কী? কী বোঝাতে চায় সে?
নীলগঞ্জের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কি বল জহুর?
জহুর তার উত্তরে থেমে থেমে বলল, চৌধুরী সাহেব, কিছু-কিছু জিনিসের কোনো পরিবর্তন হয় না।
বলতে চাও কী তুমি?
না, কিছু বলতে চাই না।
জহুর আলি লোহার গেটে ভর দিয়ে দাঁড়াল। চৌধুরী সাহেবের গোসলের পানি। গরম হয়েছে খবর আসতেই তিনি ভেতরে চলে গেলেন। জহুর গেটে হেলান দিয়ে তবু দাঁড়িয়ে রইল। চৌধুরী সাহেবের পানি গরম হবার খবর যে দিতে এসেছিল সে বলল, কিছু চান মিয়াভাই?
জহুর বলল, কিছু চাই না।