০৪. বিবাহ ও গৃহাশ্রমের ব্যবহার

বিবাহ ও গৃহাশ্রমের ব্যবহার

অথ চতুর্থ সমুল্লাসারম্ভঃ
অথ সমাবর্তন-বিবাহ-গৃহাশ্রমবিধিং বক্ষ্যামঃ

বেদানধীত্য বেদৌ বা বেদং বাপিয়থাক্রম। অবিপ্লুতব্রহ্মচয়ো গৃহস্থাশ্রমমাবিশেৎ ॥ মনু।

যথাবিধি ব্রহ্মচর্যাশ্রমে আচার্য্যের অনুকূল আচরণ করিয়া ধর্মানুসারে সাঙ্গোপাঙ্গ চারি,তিন, দুই অথবা এক বেদ অধ্যয়ন পূর্বক অখণ্ডিত ব্রহ্মচর্য পুরুষ বা স্ত্রী গৃহাশ্রমে প্রবেশ করিবে ॥

তং প্রতীতং স্বধর্মেণ ব্রহ্মদায়হরং পিতুঃ। গ্বিণং তল্প আসীনমহয়েৎ প্রথমং গবা৷ মনু

স্বধর্ম অর্থাৎ আচার্য্য এবং শিষ্যের যথার্থ ধর্মযুক্ত, পিতা, জনক বা অধ্যাপকের নিকট হইতে ব্রহ্মদায় অর্থাৎ বিদ্যাভাগের ও মাল্যধারণকারী শিষ্য স্বীয় পালঙ্কে উপবিষ্ট আচার্য্যকে প্রথমে গোদানের দ্বারা সম্মানিত করিবে। উক্ত লক্ষণযুক্ত বিদ্যার্থীকেও কন্যার পিতা গোদানের দ্বারা সম্মানিত করিবেন।

গুরুণানুমতঃ স্নাত্বা সমাবৃত্তোয়থাবিধি। উদ্বহে দ্বিজো ভায়াং সবর্ণাং লক্ষণান্বিতাম্ ॥ মনু

গুরুর আজ্ঞানুসারে স্নানান্তে গুরুকুল হইতে যথাবিধি (গৃহে) প্রত্যাবর্তন করিয়া ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য স্বর্ণানুকূল সুলক্ষণান্বিতা কন্যাকে বিবাহ করিবে।

অসপিণ্ডা চ য়া মাতুরসগোত্রা চ য়া পিতুঃ। সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে৷ মনু

যে কন্যা মাতৃকূলের ছয় পুরুষের মধ্যে নহে এবং পিতৃ গোত্রীয় নহে সেইরূপ কন্যাকে বিবাহ করা উচিত। ইহার প্রয়োজনীয়তা এই যে–

পরোক্ষপ্রিয়া ইব হি দেবাঃ প্রত্যক্ষষিঃ ॥ শতপথ

ইহা নিশ্চিত যে পরোক্ষ বস্তুতে যেমন প্রীতি হয়, প্রত্যক্ষ বস্তুতে তেমন হয় না। যেমন কেহ মিছরির গুণ শুনিয়াছে, কিন্তু কখনও খায় নাই, সে অবস্থায় তাহার মন উহাতেই লাগিয়া থাকে। কোন পরোক্ষ বস্তুর প্রশংসা শুনিয়া উহা পাইবার জন্য উকট ইচ্ছা হয়, সেইরূপ যে কন্যা দূরস্থা অর্থাৎ স্বগোত্রীয়া বা মাতৃকুলের সহিত নিকট সম্বন্ধযুক্তা নহে, সেই কন্যার সহিত বরের বিবাহ হওয়া উচিত।

নিকটে ও দূরে বিবাহ করিবার এইগুলি দোষ ও গুণ–

প্রথম (১) –যে বালক বালিকা বাল্যাবস্থা হইতে পরস্পর নিকটে থাকে, পরস্পর প্রীতি, ক্রীড়া এবং কলহ করে, একে অন্যের দোষ, গুণ, স্বভাব ও বাল্যকালের অসঙ্গত আচরণ জানে এবং একে অন্যকে উলঙ্গও দেখে তাহাদের মধ্যে বিবাহ হইলে কখনও প্রেম হইতে পারে না।

দ্বিতীয় (২) –যেরূপ জলের সহিত জল মিশ্রিত হইলে কোন বিলক্ষণ গুণ উৎপন্ন হয় না সেইরূপ একগোত্রে, পিতৃ বা মাতৃকুলে বিবাহ হইলে ধাতুর বিনিময় না হওয়ায় উন্নতি হয় না।

তৃতীয় (৩) –যেরূপ দুগ্ধে মিছরি বা শুষ্ঠি প্রভৃতি ওষধি মিশ্রিত করিলে উত্তম গুণ জন্মে, সেইরূপ ভিন্ন গোত্রীয়, মাতৃকুল এবং পিতৃকুল হইতে পৃথকস্থানীয় স্ত্রীপুরুষের বিবাহ হওয়া প্রশস্ত।

চতুর্থ (৪) –যেরূপ এক দেশের রোগী অন্য দেশে বায়ু এবং পানাহার পরিবর্তনের দ্বারা। নীরোগ হয়, সেইরূপ দূর দেশস্থদের মধ্যে বিবাহ হইলে উত্তমতা হয়।

পঞ্চম (৫) –নিকট সম্বন্ধ করিলে একে অন্যের নিকটস্থ হওয়াতে একের সুখ-দুঃখ অন্যকে অভিভূত করে এবং পরস্পরের মধ্যে বিরোধ হওয়া সম্ভব। দূর দেশস্থলের মধ্যে এরূপ হয় না। আর দূর দেশস্থদের বিবাহে প্রেমের সূত্র উত্তেরোত্তর বৃদ্ধি পাইয়া থাকে কিন্তু নিকটস্থ বিবাহে তাহা। হয় না।

ষষ্ঠ (৬) –দূর দূর দেশে বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপিত হইলে পদার্থ সমূহের প্রাপ্তি সহজেই সম্ভব হয়, নিকটে বিবাহ হইলে এরূপ হয় না।

দুহিতা দুহিতাদূরে হিতা ভবতীতি৷ নিরু০

কন্যার বিবাহ দূর দেশে হইলে হিতকর হয় এইজন্য কন্যার নাম দুহিতা। নিকটে হইলে সেরূপ হয় না।

সপ্তম (৭) –কন্যার পিতৃকূলে দারিদ্র্য হওয়াও সম্ভব। কারণ যখনই কন্যা পিতৃগৃহে আসে তখনই তাহাকে কিছু না কিছু দিতেই হয়।

অষ্টম (৮) –কেহ নিকটে থাকিলে তাহারা নিজ পিতৃকুলের সহায়তার গর্ব করিবে এবং যখনই উভয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হইবে, তখনই স্ত্রী সত্বর পিত্রালয়ে চলিয়া যাইবে। পরস্পর অধিক নিন্দা হইবে, বিরোধও ঘটিবে, কারণ প্রায়ই স্ত্রীদের স্বভাব তীক্ষ্ম ও মৃদু। এই সকল কারণ বশতঃ পিতৃগোত্রে, মাতার ছয় পুরুষের মধ্যে এবং নিকটবর্তী দেশে বিবাহ প্রশস্ত নহে।

মহান্ত্যপি সমৃদ্ধানি গো জাবিধনধান্যতঃ। স্ত্রীসম্বন্ধেদশৈতানি কুলানি পরিবর্জয়েৎ ॥১॥ মনু

ধন, ধান্য, গো, অজা, হস্তী, অশ্ব, রাজ্য এবং ঐশ্বৰ্য্যাদি দ্বারা যে বংশ যতই সমৃদ্ধ হউক না। কেন, বিবাহ সম্বন্ধে নিম্নলিখিত দশ কুল পরিত্যাগ করিবে ॥১॥

হীনক্রিয়ংনিপুরুষংনিচ্ছন্দো রোমশার্শসম। ক্ষয়্যাময়া ব্যপপ্যারিশ্বিত্রি কুষ্টিকুলাণি চ ॥ মনু ॥

যে কুল সৎক্রিয়াহীন এবং সৎপুরুষ রহিত, যে কুল বেদাধ্যয়ন বিমুখ, দীর্ঘ লোমযুক্ত শরীর এবং অর্শ, শ্বাস, কাশ, আমাশয় মৃগী এবং শ্বেত কুষ্ঠ ও গলিত কুষ্ঠযুক্ত সেই কুলের কন্যা বা বরের সহিত বিবাহ হওয়া উচিত নহে। এই সমস্ত দুগুণ এবং রোগ বিবাহকারীদের বংশে প্রবেশ করে। এইজন্য উত্তম কুলের ছেলে মেয়ের মধ্যে বিবাহ হওয়া উচিত ॥২ ॥

নোদ্বহেৎ কপিলাং কন্যাং না ধিকাঙ্গীং ন রোগিণীম্। নালোমিকাং নাতিলোমাং ন বাচাটাং ন পিঙ্গলাম ॥ ৩ ॥ মনু

কপিলবর্ণা, অধিকাঙ্গী অর্থাৎ পুরুষ অপেক্ষা লম্বা, স্থূলকায় ও অধিক বলশালিনী, রোগযুক্তা, লোমবিহীনা, অধিক লোমযুক্তা, প্রগল্‌ভা এবং পিঙ্গলনেত্রা কন্যাকে বিবাহ করিবে না ॥৩ ॥

নক্ষবৃক্ষনদীনাম্নীংনান্ত্যপর্বৰ্তনামিকা। ন পক্ষ্যহিষ্যেনাম্নীং ন চ ভীষণনামিকা ॥ ৪ ॥ মনু।

ঋক্ষ অর্থাৎ অশ্বিনী, ভরণী, রোহিনী, রেবতীবাঈ এবং চিত্রা প্রভৃতি নক্ষত্র নাম যুক্তা; তুলসী, গেদা, গোলাপী, চম্পা, চামেলী, অশ্বত্থ, বট প্রভৃতি বৃক্ষ নামযুক্তা; গঙ্গা যমুনা প্রভৃতি নদী নামযুক্তা; চন্ডালী প্রভৃতি অন্ত্যনামযুক্তা; বিন্ধ্যা, হিমালয়া, পার্বতী প্রভৃতি পর্বৰ্তনামযুক্তা; কোকিলা, ময়না প্রভৃতি পক্ষী নামযুক্তা; নাগী, ভূজঙ্গা ইত্যাদি সৰ্পনামযুক্তা; মাধোদাসী, মীরাদাসী ইত্যাদি পরিচারিকা নামযুক্তা ও ভীমকুমারী, চণ্ডিকা, কালী আদি ভীষণ নামযুক্তা কন্যার সহিত বিবাহ হওয়া উচিত নহে, কারণ এই নামগুলি কুৎসিৎ এবং অন্যান্য পদার্থেরও ঐ সকল নাম আছে।

অব্যঙ্গাঙ্গীং সৌম্যনাম্নীংহংসবারণগামিনীম ॥ তনুলোমকেশদশনাংমৃদ্ধসীমুদ্বহেস্ত্রিয়ম্ ॥ ৫ ॥ মনু।

যাহার অঙ্গ সরল ও সুঠাম, তাহার বিপরীত নহে; যাহার নাম সুন্দর অর্থাৎ যশোদা, সুখদা ইত্যাদি; যাহার গতি হংস ও হস্তিনীর তুল্য; যে সূক্ষ্মলোমযুক্তা, সুকেশা ও সুদন্ত এবং যাহার সর্বাঙ্গ কোমল, তাদৃশী কন্যার সহিত বিবাহ হওয়া উচিত ॥ ৫ ॥

প্রশ্ন –বিবাহের বয়স এবং রীতি কোনটি উত্তম?

উত্তর –ষোড়শ বর্ষ হইতে চতুর্বিংশতি বর্ষ পৰ্য্যন্ত কন্যার এবং পঞ্চবিংশতি বর্ষ হইতে অষ্টাচত্বারিংশৎ বর্ষ পর্যন্ত পুরুষের বিবাহের উত্তম বয়স। ষোড়শ এবং পঞ্চবিংশ বৎসর বয়সে বিবাহ নিকৃষ্ট। অষ্টাদশ অথবা বিংশ বৎসরের স্ত্রীর সহিত ত্রিংশ, পঞ্চত্রিংশ বা চত্বারিংশ বর্ষের পুরুষের বিবাহ মধ্যম’, চতুর্বিংশ বর্ষের স্ত্রী এবং অষ্টাচত্বারিংশ বর্ষের পুরুষের বিবাহ উত্তম। যে দেশের বিবাহবিধি এইরূপ উৎকৃষ্ট এবং যে দেশে ব্রহ্মচর্য্য ও বিদ্যাভ্যাস অধিক হয়, সেই দেশ সুখী এবং যে যে দেশে বাল্যাবস্থায় তথা অযোগ্যদের বিবাহ হয়, সেই দেশ দুঃখে নিমজ্জিত হয়। কেননা, ব্রহ্মচর্য্য ও বিদ্যাধ্যয়ন পূর্বক বিবাহের সংস্কার দ্বারাই সকল বিষয়ের সংস্কার এবং উহার বিকৃতি দ্বারাই সকল বিষয়ের বিকৃতি ঘটিয়া থাকে।

(প্রশ্ন) –অষ্টবর্ষা ভবেদ গৌরী নববর্ষা চ রোহিণী ॥ দশবর্ষা ভবেৎ কন্যা তত উৰ্দ্ধং রজস্বলা ॥১॥ মাতা চৈব পিতা তস্যা জ্যেষ্ঠে ভ্রাতা তথৈব চ। এয়স্তেনরকং য়ান্তি দৃষ্টা কন্যাং রজস্বলাম্ ॥ ২ ॥

এই শ্লোক পারাশরী এবং শীঘ্রবোধে লিখিত আছে। ইহার অর্থ এই যে, কন্যার অষ্টম বর্ষে গৌরী, নবম বর্ষে রোহিণী এবং দশম বর্ষে কন্যা এবং তৎপর রজস্বলা সংজ্ঞা হইয়া থাকে৷১ ॥ যদি দশম বর্ষ পৰ্য্যন্ত বিবাহ না দিয়া রজস্বলা কন্যাকে তাহার মাতা, পিতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দেখেন, তবে তাহারা তিন জনেই নরকে পতিত হন।

(উত্তর) ব্রহ্মেবাচ– একক্ষণা ভবেদ গৌরী দ্বিক্ষণেয়ন্তু রোহিণী। ত্ৰিক্ষণা সা ভবেৎ কন্যা হ্যত উৰ্দ্ধং রজস্বলা ॥১॥ মাতা পিতা তথা ভ্রাতা মাতুলো ভগিনী স্বকা। সর্বে তে নরকংয়ান্তি দৃষ্টা কন্যাং রজস্বলাম্ ॥ ২ ॥ ইহা সদ্যোনিৰ্ম্মিত ব্রহ্মপুরাণের বচন।

অর্থ –যতটা সময়ের মধ্যে পরমাণু একবার আবর্তিত হয়, ততটা সময়কে ক্ষণ বলে। কন্যা জন্মের প্রথম ক্ষণে গৌরী, দ্বিতীয় ক্ষণে রোহিণী, তৃতীয় ক্ষণে কন্যা এবং চতুর্থ ক্ষণে রজস্বলা হইয়া থাকে ৷১৷ সেই রজস্বলাকে দেখিয়া তাহার মাতা, পিতা, ভ্রাতা, মাতুল এবং সহোদরা ভগ্নী, সকলেই নরকে গমন করেন ॥ ২ ॥

প্রশ্ন –এই শ্লোকগুলি প্রমাণ নহে।

উত্তর –কেন প্রমাণ নহে? যদি ব্রহ্মার শ্লোক প্রমাণ নহে, তবে তোমার শ্লোকও প্রমাণ হইতে পারে না।

প্রশ্ন –বাঃ বাঃ! পরাশর এবং কাশীনাথের প্রমাণও মানিবেন না?

উত্তর –বাঃ বাঃ! তুমি কি ব্রহ্মার প্রমাণও মানিবে না! পরাশর এবং কাশীনাথ অপেক্ষা ব্রহ্মা কি শ্রেষ্ঠ নহেন? যদি তুমি ব্রহ্মার শ্লোকগুলি না মান তবে আমি কাশীনাথ এবং পরাশরের শ্লোকগুলি মানি না।

প্রশ্ন– তোমার শ্লোকগুলি অসম্ভব বলিয়া প্রমাণ নহে। কারণ, সহস্ৰ ক্ষণ তো জন্মকালেই কাটিয়া যায়, তবে বিবাহ কীরূপে হইতে পারে? আর ঐ সময়ে বিবাহের কোনও ফলও দেখা যায় না।

উত্তর –যদি আমার শ্লোকগুলি অসম্ভব হয়, তবে তোমার শ্লোকগুলিও অসম্ভব। কারণ, আট, নয় এবং দশ বৎসরে বিবাহ নিষ্ফল। কন্যার ষোড়শ বৎসরের পর চতুর্বিংশতি বর্ষ পর্যন্ত বয়সের মধ্যে বিবাহ হইলে পুরুষের বীর্য পরিপক্ক ও শরীর বলিষ্ঠ হওয়ায় এবং স্ত্রীর গর্ভাশয় পূর্ণ ও শরীর সবল হওয়ায় সন্তান উত্তম হইয়া থাকে।*

[* উপযুক্ত সময় অপেক্ষা ন্যূন বয়স্ক স্ত্রী পুরুষদের গর্ভাধান সম্বন্ধে মুনিবর ধন্বন্তরি সুশ্রুতে নিষেধ করিয়াছেন:
ঊনষোডশ ব্যায়াম প্রাপ্ত: পঞ্চবিংশতি। অদ্যাধত্তে পুমান গর্ভং কুক্ষিস্থ: স বিপদ্যতে জাতো বা ন চিরঞ্জীবের জীবেদ্বা দুৰ্ব্বলেন্দ্রিয় । তদত্যন্তবালায়ং গভাধানং ন কারয়েৎ ॥ ২॥ [ সুশ্রুত শরীরস্থান অ:১০। শ্লোক। ৫৭ ৫৮]
অর্থ–ষোল বৎসরের নূন বয়স্কা স্ত্রীতে পঁচিশ বৎসরের নূন বয়স্ক পুরুষ গর্ভাধান করিলে সেই কুক্ষিস্থ গর্ভ বিপন্ন হয় অর্থাৎ পূর্ণকাল পর্যন্ত গর্ভাশয়ে থাকিয়া উৎপন্ন হয় না ॥১॥ অথবা উৎপন্ন হইলে ও দীর্ঘকাল পর্যন্ত থাকে না; জীবিত থাকিলেও দুৰ্ব্বলেন্দ্রিয় হয়। এই জন্য অতি অল্প বয়স্কা স্ত্রীতে গর্ভ-স্থাপন করিবে না৷২ ॥
ঈদৃশ শাস্ত্রোক্ত নিয়ম ও সৃষ্টিক্রম দেখিলে ও বুদ্ধির সহিত বিচার করিলে ইহাই সিদ্ধ হয় যে, ১৬ বৎসরের ন্যূন বয়স্কা স্ত্রী এবং ২৫ বৎসরের ন্যূন বয়স্ক পুরুষ কখনও গর্ভাধানের উপযুক্ত নহে। যাহারা এই সকল নিয়মের বিপরীত আচরণ করে, তাহাদের দু:খভাগী হইতে হয়।]

অষ্টম বর্ষীয়া কন্যার সন্তান হওয়া যেরূপ অসম্ভব, গৌরী এবং রোহিণী প্রভৃতি নাম দেওয়াও সেইরূপ অযৌক্তিক। যদি কন্যা গৌরবর্ণা না হয়, কিন্তু কৃষ্ণবর্ণা হয়, তবে তাহার নাম গৌরী রাখা বৃথা। গৌরী মহাদেবের স্ত্রী এবং রোহিণী ছিলেন বসুদেবের স্ত্রী। তোমরা পৌরণিকেরা তাহাকে মাতৃতুল্য মনে কর। যখন কন্যা মাত্রেই গৌরী প্রভৃতি ভাবনা করিতেছ, তখন আবার। তাহাদিগকে বিবাহ করা কীরূপে ধর্মসঙ্গত এবং সম্ভবপর হইতে পারে। সুতরাং তোমাদের ও। আমাদের দুই শ্লোকই মিথ্যা। যেরূপ আমি ‘ব্রহ্মোবাচ’ বলিয়া শ্লোক রচনা করিয়াছি, সেইরূপ পরাশরাদির নামে তাহারাও শ্লোক রচনা করিয়াছে। অতএব এই সকল প্রমাণ পরিত্যাগ করিয়া বেদ প্রমাণ অনুসারে সকল কর্ম করিতে থাক। দেখ মনুতে লিখিত আছে?–

ত্রীণি বাদীক্ষেত কুমাৰ্যতুমতী সতী ॥ ঊর্ধং তু কালাদেতম্মাদ্বিন্দেত সদৃশং পতিম্ ॥ মনু

কন্যা রজস্বলা হইবার পর, তিন বৎসর পর্যন্ত পতি অন্বেষণ করিয়া স্বসদৃশ পতিলাভ করিবে। যেহেতু প্রত্যেক মাসে রজোদর্শন হয়, সুতরাং তিন বৎসরে ছত্রিশ বার রজোদর্শনের পর বিবাহ করা উচিত, তৎপূর্বে নহে।

কামমামরণাত্তিষ্ঠে গৃহে কন্যওঁমত্যপি। ব চৈবৈং প্রয়চ্ছে, গুণহীনায় কহিঁচিৎ ॥ মনু ॥

বরং পুত্রকন্যা মৃত্যু পর্যন্ত অবিবাহিত থাকুন, তথাপি অসৃদশ অর্থাৎ পরস্পর বিরুদ্ধ গুণ-কর্ম-স্বভাবযুক্ত (বরকন্যার) বিবাহ হওয়া কখনও উচিত নহে। ইহাতে সিদ্ধ হইলে পূর্বোক্ত সময়ের পূর্বে এবং অসদৃশ (বরকন্যার) মধ্যে বিবাহ হওয়া অনুচিত।

(প্রশ্ন) –বিবাহ কি মাতা পিতার অধীনে হওয়া উচিত অথবা বর কন্যার অধীনে হওয়া উচিত?

(উত্তর) –বিবাহ বর কন্যার ইচ্ছাধীন হওয়া উত্তম। মাতা পিতা বিবাহের কথা বিবেচনা করিলেও বরকন্যার প্রসন্নতা ব্যতীত বিবাহ হওয়া উচিত নহে। কারণ পরস্পরে প্রসন্নতার সহিত বিবাহ হইলে বিরোধ নিতন্ত কম হয় এবং উত্তম সন্তান জন্মে। অপ্রসন্নতার সহিত বিবাহ হইলে সর্বদা ক্লেশ হইতে থাকে। বিবাহের প্রয়োজন মুখ্যতঃ বরকন্যার; মাতা পিতার নহে। কেননা, বর কন্যার মধ্যে প্রসন্নতা থাকিলে তাহারাই সুখী হয়, বিরোধে তাহারাই দুঃখভোগ করে। আর–

সন্তুষ্টা ভায়য়া ভর্তা ভর্তা ভায়া তথৈবচ। য়স্মিন্নেব কুলে নিত্যং কল্যাণং তত্র বৈ ধ্রুবম। মনু

যে পরিবারে স্ত্রীর প্রতি পুরুষ ও পুরুষের প্রতি স্ত্রী সর্বদা প্রসন্ন থাকে, সেই পরিবারে আনন্দ, লক্ষ্মী এবং কীর্তি নিবাস করে। আর যেখানে বিরোধ ও কলহ হয়, সেখানে দুঃখ দারিদ্র্য ও নিন্দা নিবাস করে।

সুতরাং যেরূপ স্বয়ম্বর প্রথা আৰ্য্যাবৰ্তে পরস্পরাক্রমে প্রচলিত ছিল সেই বিবাহই উত্তম। স্ত্রী-পুরুষ বিবাহ করিতে ইচ্ছুক হইলে তাহাদের বিদ্যা, বিনয়, শীল, রূপ, আয়ু, বল, কুল এবং শরীরের পরিমাণাদি বিষয়ে যথাযোগ্য ভাবে অবহিত হওয়া উচিত। যে পৰ্য্যন্ত ইহাদের মিল না হইবে সে পর্যন্ত বিবাহে কোন সুখ হয় না এবং বাল্যকালে বিবাহেও সুখ হয় না।

য়ুবা সুবাসাঃ পরিবীত আগাৎ স উ শ্রেয়া ভবতি জায়মানঃ। তং ধীরাসঃ কবয় উন্নয়ন্তি স্বাধ্যো৩ মনসা দেবয়ন্তঃ ॥১॥ ঋ০ ৩। ৮ ॥|৪ আ ধেনবো ধুনয়ন্তামশিখীঃ সবর্দুৰ্ঘাঃ শশয়া অপ্রদুগ্ধাঃ। নব্যানব্যায়ুবতয়ো ভবন্তীমহদ্দেবানামসুরত্বমেকম্ ॥ ২ন ॥ ঋ ০৩৫৫১৬ পুর্বীরহংশরদঃশশ্রমাণ দোষা বস্তোরুসো জরয়ন্তীঃ। মিনাতি শ্রিয়ং জরিমা তনূনামপ্যূ নু পত্নীৰ্বৰ্ষণো জগমঃ ॥ ৩ ॥ ঋ০১। ১৭৯১ ॥

যে পুরুষ (পরিবীতঃ) সর্বতোভাবে যজ্ঞোপবীত ধারণ ও ব্রহ্মচর্য সেবন দ্বারা বিদ্বান্ এবং সু শিক্ষিত হইয়া, (সুবাসাঃ) সুন্দর বস্ত্র পরিধান পূর্বক, ব্রহ্মচর্য্যযুক্ত (যুবা) পূর্ণ যৌবন প্রাপ্ত হইয়া, বিদ্যাগ্রহণ করিয়া গৃহাশ্রমে (আগাৎ) প্রবেশ করেন, (স,উ) তিনিই দ্বিতীয় বিদ্যাজন্মে (জায়মানঃ) প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া (শ্রেয়া) অতিশয় শোভাযুক্ত ও মঙ্গলকারী (ভবতি) হন। (স্বাধ্যঃ) উত্তম ধ্যানযুক্ত (মনসা) বিজ্ঞান দ্বারা বিদ্বানেরা (ত) সেই পুরুষকে (উন্নয়ন্তি) উন্নতিশীল করিয়া প্রতিষ্ঠিত করেন। আর যে স্ত্রী পুরুষ, ব্রহ্মচর্য্য ধারণ, বিদ্যা এবং সুশিক্ষা গ্রহণ না করিয়া বাল্যাবস্থায় বিবাহ করে তাহারা নষ্ট-ভ্রষ্ট হইয়া বিদ্বান্ ব্যাক্তিদের মধ্যে সম্মান লাভ করেনা ॥১॥

(অপ্রদুগ্ধাঃ) যে সকল গাভীর দুগ্ধ দোহন করা হয় নাই, সেই (ধেনবঃ) সকল গাভীর ন্যায় (অশিশ্বীঃ)। যাঁহাদের বাল্যাবস্থা অতিক্রান্ত হইয়াছে, (শবদুর্ঘাঃ) যাঁহারা সকল প্রকার সদাচার পালন করেন এবং (শশয়াঃ) যাঁহারা কুমারাবস্থা অতিক্রম করিয়াছেন, (নব্যা নব্যাঃ) নব নব শিক্ষা ও অবস্থায় পরিপূর্ণ (ভবন্তী) হইয়াছেন (য়ুবতয়ঃ) সেই পূর্ণযৌবনা স্ত্রীসকল (দেবানা) ব্রহ্মচর্য্যের সুনিয়মে পূর্ণতাপ্রাপ্ত বিদ্বানদের (এক) অদ্বিতীয়, (মহৎ) মহান (অসুরত্বম) প্রজ্ঞা শাস্ত্র শিক্ষাযুক্ত। ও প্রজায় আনন্দভোগের তত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়া তরুণ পতি লাভ করিয়া (আধুনয়ন্তাম) গর্ভধারণ করিবেন। কেননা তাহারা কখনও ভুলক্রমেও বাল্যাবস্থায় মনে মনেও পুরুষের চিন্তা করিবেন না। এইরূপ কাৰ্য্যই তাহাদের ইহলোক এবং পরলোকের সুখের সাধন। বাল্যবিবাহের দ্বারা পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোকেরই অধিক ক্ষতি হইয়া থাকে। ॥২॥

যাহাতে (নু) শীঘ্র (শমানাঃ) অত্যন্ত পরিশ্রমী (বৃষণঃ) বীৰ্য্যসিঞ্চনে সমর্থ ও পূর্ণযৌবন সম্পন্ন পুরুষ (পত্নীঃ) যুবতী প্রাণপ্রিয় স্ত্রী (জগমঃ) লাভ করিয়া পূর্ণ শতবর্ষ বা ততোধিক আয়ু আনন্দের সহিত ভোগ করিতে এবং পুত্র পৌত্রাদির সহিত মিলিত থাকিতে পারে স্ত্রী-পুরুষ সর্বদা এইরূপ আচরণ করিবে। যেহেতু (পূর্বাঃ) পূর্ববর্তী (শারদঃ) শরদ ঋতু সকল এবং (জরয়ন্তীঃ) বার্ধক্য আনয়নকারী (উষসঃ) উষাকাল, (দোষাঃ) রাত্রি এবং (বস্তোঃ)দিন (তনুনা) শরীরের। (শিয়ং) শোভাকে, বল এবং সৌন্দর্যকে (জরিমা) দূরীভূত করিয়া অতিশয় বার্ধক্য আনয়ন করে, (অহ) আমি, স্ত্রী বা পুরুষ, (উ) উত্তমরূপে (অপি) নিশ্চয় করিয়া, ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা বিদ্যা, সুশিক্ষা, শারীরিক ও আত্মিক বল এবং যৌবন প্রাপ্ত হইয়া বিবাহ করিব। ইহার বিরুদ্ধ কাৰ্য্য বেদবিরুদ্ধ বলিয়া বিবাহ কখনও সুখের হয় না।

যতদিন ঋষি মুনি এবং রাজা মহারাজা প্রভৃতি আরো ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা বিদাধ্যয়ন করিয়া স্বয়স্বর বিবাহ করিতেন, ততদিন পর্যন্ত এদেশের সর্বদা উন্নতি হইতেছিল। যখন হইতে ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা বিদ্যাধ্যয়ন রহিত হইল এবং বাল্যাবস্থায় পরাধীন অর্থাৎ মাতা পিতার অধীন বিবাহ হইতে লাগিল তখন হইতে আৰ্য্যাবৰ্ত্ত দেশে ক্রমশঃ অকল্যাণ হইতে লাগিল। অতএব এই কুপ্রথা পরিত্যাগ করিয়া সজ্জনগণ পূর্বোক্ত রীতি অনুসারে স্বয়স্বর বিবাহ করিবে। বিবাহ বর্ণানুক্রম অনুসারে করিবে এবং বর্ণব্যবস্থাও গুণ-কর্ম-স্বভাব অনুসারে হওয়া উচিত।

প্রশ্ন –যাহার মাতা পিতা ব্রাহ্মণ, সে কি ব্রাহ্মণ বা ব্রাহ্মণী হইবে? আর যাহাদের মাতা পিতা ভিন্ন বর্ণের তাহাদের সন্তান কখনও কি ব্রাহ্মণ হইতে পারিবে?

উত্তর –হ্যাঁ, অনেক হইয়াছে, হইতেছে, এবংহইবেও। যেমন ছান্দোগ্য উপনিষদে অজ্ঞাতকুল জাবাল ঋষি, মহাভারতে ক্ষত্রিয় বর্গের বিশ্বামিত্র এবং চন্ডাল কুলের মাতঙ্গ ঋষি ব্রাহ্মণ হইয়াছিলেন। সেইরূপ যিনি এখনও উত্তম বিদ্যা ও স্বভাব সম্পন্ন, তিনি ব্রাহ্মণ’ হইবার উপযুক্ত এবং মুখ শূদ্র হইবার যোগ্য এবং ভবিষ্যতেও এইরূপ হইবে।

প্রশ্ন –আচ্ছা রজোবীৰ্য্য হইতে উৎপন্ন শরীর কীরূপে পরিবর্তিত হইয়া অন্য বর্ণের যোগ্য হইতে পারে?

উত্তর –রজোবীর্য্যের যোগে ব্রাহ্মণ শরীর হয় না। কিন্তু –

স্বাধ্যায়েন জপৈহোঁমৈস্ত্রৈবিদ্যেনেজ্যয়া সুতৈঃ ॥ মহায়জ্ঞৈশ্চয়শ্চৈব্রাহ্মীয়ংক্রিয়তে তনুঃ ॥ মনু ॥

ইহার অর্থ পূর্বে বলা হইয়াছে। এস্থলেও সংক্ষেপে বলা হইতেছে;–(স্বাধ্যায়েন) অধ্যয়ন করা ও অধ্যাপনা করান (জপৈঃ) বিচার বিবেচনা করা ও করান (হোমৈঃ) নানাবিধ হোমানুষ্ঠান (ত্রৈবিদ্যেন) সম্পূর্ণ বেদের শব্দ, অর্থ, সম্বন্ধ, জ্ঞান এবং স্বর উচ্চারণ সহকারে অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা দ্বারা, (ইজ্যয়া) পৌর্ণমাসী, ইষ্টি ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা (সুতৈঃ) পূর্বোক্ত বিধি অনুযায়ী ধর্মানুসারে সন্তানোৎপত্তি (মহায়জ্ঞৈশ্চ) পূর্বোক্ত ব্রহ্মযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ,পিতৃযজ্ঞ বৈশ্যদেবযজ্ঞ এবং অতিথি যজ্ঞ (য়জ্ঞৈশ্চ) অগ্নিষ্টোমাদি যজ্ঞ বিদ্বাদিগের সঙ্গ ও সম্মান, সত্যভাষণ, পরোপকারাদি সত্য কর্ম এবং সম্পূর্ণ শিল্পবিদ্যাদি শিক্ষা করিয়া দুষ্টাচার বর্জন পূর্বক শ্ৰেষ্ঠাচার প্রতিপালন দ্বারা (ইয়) এই (তনু) শরীর (ব্রাহ্মী) ব্রাহ্মণের (ক্রিয়তে) করা যায়। এই শ্লোকটি কি তুমি মান না? যদি মানো তবে কেন রজোবীর্য্যের সংযোগে বর্ণ-ব্যবস্থা মান?— আমি একাই মানি না, কিন্তু বহু লোকপরম্পরাক্রমে এইরূপই মানিয়া থাকে।

প্রশ্ন –তুমি কি পরম্পরাও খণ্ডন করিবে?

উত্তর –না, কিন্তু তোমার বিপরীত বুদ্ধিকে না মানিয়া খণ্ডনও করিতেছি ॥

প্রশ্ন –আমার বুদ্ধি বিপরীত আর তোমার বুদ্ধিই যথার্থ ইহাতে প্রমাণ কী?

উত্তর –প্রমাণ এই যে, তুমি পাঁচ অথবা সাত পুরুষের বর্তমান প্রথাকে সনাতন রীতি মনে করিতেছ। আর আমি বেদ এবং সৃষ্টির প্রারম্ভ হইতে আজ পর্যন্ত পরম্পরা স্বীকার করিতেছি। দেখ, পিতা শ্রেষ্ঠ হইলেও তাহার পুত্র দুষ্ট এবং পুত্র শ্রেষ্ঠ হইলেও পিতা দুষ্ট দেখা যায় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে উভয়ই শ্রেষ্ঠ অথবা দুষ্ট দেখা যায় ।অতএব তোমরা ভ্রমে পড়িয়াছ। দেখ, মনু মহারাজ কী বলিয়াছেন–

য়েনাস্য পিতরোয়ালা যেন যাতাঃপিতামহাঃ। তেন য়ায়াৎসতাংমার্গং তেন গছন্ন রিষ্যতে ॥ মনু।

যে পথে পিতা এবং পিতামহ গমন করিয়াছেন সেইপথে সন্তানও গমন করিবে। কিন্তু ‘সতাম’ যদি পিতা এবং পিতামহ সৎপুরুষ হন্ তবে তঁহাদের পথে চলিবে; যদি পিতা, পিতামহ দুষ্ট হন, তবে তাঁহাদের পথে কখনও চলিবে না। কারণ শ্রেষ্ঠ ধর্মাত্মা পুরুষদিগের পথে চলিলে কখনও দুঃখ হয় না। তুমি কি ইহা মান না?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ, মানি ॥

আর দেখ, পরমেশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত বেদোক্ত বাক্যই সনাতন। যাহা বেদবিরুদ্ধ তাহা কখনও সনাতন হইতে পারে না। এইরূপ সকলেরই স্বীকার করা কর্তব্য কি না?

অবশ্য কর্তব্য।

যে এইরূপ মানে না তাহকে বল যে, যদি কোন পিতা দরিদ্র হয় ও তাহার পুত্র ধনাঢ্য হয়, তবে কি সে পিতার দরিদ্রাবস্থার অভিমানে ধন পরিত্যাগ করিবে? যাহার পিতা অন্ধ, তাহার পুত্র কি নিজের চক্ষু নষ্ট করিবে? যাহার পিতা কুকর্মা তাহার পুত্রও কি কুকর্ম করিবে? না। কিন্তু পূর্বপুরুষের যে সমস্ত সৎকর্ম রহিয়াছে উহার আচরণ এবং দুষ্টকর্ম সমূহ পরিত্যাগ করা সকলের পক্ষে নিত্যন্ত আবশ্যক।

যদি কেহ রজোবীর্য্যের সংযোগে বর্ণাশ্রম স্বীকার করে এবং গুণ-কর্ম অনুসারে বর্ণ স্বীকার না করে, তবে তাহাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে, কেহ স্বীয় বর্ণ পরিত্যাগ করিয়া নীচ, অন্ত্যজ, খ্রীষ্টান অথবা মুসলমান হইয়া গেলে তাহাকেও ব্রাহ্মণ বলিয়া স্বীকার কর না কেন? এস্থলে তুমি ইহাই বলিবে যে, সে ব্রাহ্মণের কর্ম ত্যাগ করিয়াছে, এইজন্য সে ব্রাহ্মণ নহে। ইহা দ্বারা ইহাও সিদ্ধ হয় যে, যে সব ব্রাহ্মণ উত্তম কর্ম করেন তঁহারাই ব্রাহ্মণ এবং যদি নিম্ন বর্ণের কেহ উচ্চবর্ণের গুণ-কর্ম- স্বভাব বিশিষ্ট হয়, তবে তাহাকেও উচ্চবর্ণে এবং যদি কেহ উচ্চবর্ণ হইয়াও নীচ কর্ম করে, তবে তাহাকেও নীচবর্ণের মধ্যে গণনা করা অবশ্য কর্তব্য।

প্রশ্ন –ব্রাহ্মণোস্য মুখমাসীবাহু রাজন্যঃ কৃতঃ। উরূ তদস্য য়দ্বৈশ্যঃ পভ্যাওঁশূদ্রো অজায়ত ॥

ইহা যজুর্বেদের একত্রিংশ অধ্যায়ের একাদশ মন্ত্র।

ইহার অর্থ এই যে, ব্রাহ্মণ ঈশ্বরের মুখ হইতে, ক্ষত্রিয় বাহু হইতে, বৈশ্য উরূ হইতে এবং শূদ্র চরণ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে সুতরাং যেমন মুখ বাহু হয় না এবং বাহু মুখ হয় না, সেইরূপ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়াদি হয় না এবং ক্ষত্রিয়াদিও ব্রাহ্মণ হইতে পারে না।

উত্তর –তুমি এই মন্ত্রের যে অর্থ করিয়াছ তাহা ঠিক নহে। কারণ এস্থলে ‘পুরুষ’ অর্থাৎ নিরাকার ব্যাপক পরমাত্মার অনুবৃত্তি রহিয়াছে। তিনি নিরাকার বলিয়া তাঁহার মুখাদি অঙ্গ হইতে পারে না, আর মুখাদি অঙ্গবিশিষ্ট হইলে তিনি সর্বশক্তিমান, জগতের স্রষ্টা ধর্তা, প্রলয়কর্তা, জীব সমূহের পাপ-পুণ্যের জ্ঞাতা, নিয়ন্তা, সর্বজ্ঞ, অজ এবং অমর ইত্যাদি বিশেষণযুক্ত হইতে পারেন না। অতএব ইহার অর্থ এই যে, যিনি (অস্য) পূর্ণ ব্যাপক পরমাত্মার সৃষ্টিতে মুখের ন্যায় সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তিনি (ব্রাহ্মণঃ) ব্রাহ্মণ। (বাহু) ‘বাহুবৈবলং’’বাহুর্বৈ বীর্য্য”শতপথ ব্রাহ্মণ। ৬/৩২। ৩৫ বল বীর্য্যের নাম ‘বাহু’। যাহার মধ্যে ইহা অধিক, তিনি (রাজন্যঃ) ‘ক্ষত্রিয়। (উরূ) কটির। অধোভাগ এবং জানুর উপরিভাগের নাম (উরূ)। যিনি সকল পদার্থে এবং সকল দেশে উরূবলে গমনাগমন এবং প্রবেশ করেন তিনি (বৈশ্যঃ) ‘বৈশ্য। আর (প্যাম) যে ব্যক্তি পদ বা নিম্ন অঙ্গের ন্যায় মুখর্তাদি দুগুণ বিশিষ্ট, সেই ব্যক্তি শূদ্র। অন্যত্র শতপথ ব্রাহ্মণাদিতেও এই মন্ত্রের এইরূপই অর্থ করা হইয়াছে যথা

‘য়ম্মাদেতেমুখ্যাস্তস্মমুখতো হ্যসৃজ্যন্ত’ ইত্যাদি।

যেহেতু ইহারা মুখ্য, অতএব মুখ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে এইরূপ বলা সঙ্গত। অর্থাৎ যেমন সকল অঙ্গের মধ্যে মুখ শ্রেষ্ঠ সেইরূপ যে মনুষ্যজাতির মধ্যে সম্পূর্ণবিদ্যা এবং উত্তম গুণ-কর্ম-স্বভাবসম্পন্ন তাহাকে উত্তম ‘ব্রাহ্মণ’ বলে। যেহেতু পরমেশ্বর নিরাকার তাঁহার মুখাদি অঙ্গই নাই, অতএব মুখাদি হইতে উৎপন্ন হওয়া অসম্ভব, যথা–বন্ধ্যা স্ত্রীর পুত্রের বিবাহ। যদি মুখাদি অঙ্গ হইতে ব্রাহ্মণ আদি উৎপন্ন হইত তবে তাহাদের আকৃতিও উপাদান কারণের সদৃশ হইত। যেরূপ মুখের আকার গোল, সেইরূপ তাহাদের শরীরও মুখের ন্যায়, বৈশ্যের ঊরুর ন্যায় এবং শূদ্রের পায়ের ন্যায় আকৃতি বিশিষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু তাহা হয় না। যদি কেহ, তোমাকে প্রশ্ন করে যে, যাহারা মুখাদি হইতে উৎপন্ন হইয়াছিল তাহাদের সংজ্ঞা ব্রাহ্মণ হউক কিন্তু সে যুক্তিও তোমাদের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হইতে পারে না। কেননা অপর সকলে যেমন গর্ভাশয় হইতে উৎপন্ন হয় তোমরাও সেইরূপ হইয়াছ। তুমি মুখাদি হইতে উৎপন্ন না হইয়াও ব্রাহ্মণাদি সংজ্ঞার অভিমান করিতেছ। অতএব তোমাদের উক্ত অর্থ ব্যর্থ। আর আমি যে অর্থ করিয়াছি তাহাই সত্য।

এইরূপ অন্যত্রও কথিত হইয়াছে, যথা :– শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চৈতিশূদ্রতা। ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবস্তু বিদ্যা বৈশাত্তথৈব চ ॥ মনু

যদি কেহ শূদ্রকুলে উৎপন্ন হইয়া ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যের গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট হয়। তবে সেশূদ্র, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্য হইবে। সেইরূপ, কেহ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, অথবা বৈশ্যকুলে জন্মগ্রহণ করিয়া শূদ্রের গুণ-কর্ম-স্বভাব বিশিষ্ট হইলে সে শূদ্র হইবে। এইরূপ কেহ ক্ষত্রিয় বৈশ্যকূলে জন্মগ্রহণ করিয়া ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্র সদৃশ হইলে, ব্রাহ্মণ অথবা শূদ্রই হইয়া যায়। অর্থাৎ যে পুরুষ বা স্ত্রী, চারি বর্ণের মধ্যে যে বর্ণের সদৃশ হইবে, সে সেই বর্ণেরই হইবে।

ধর্মচর্যয় জঘন্যো বর্ণঃ পূর্বং পূর্বং বর্ণপদ্যতে জাতিপরিবৃত্তেী ॥১॥ অধর্মচর্য্যয়া পূর্বোবর্ণো জঘন্যং জঘন্যং বর্ণমাপদ্যতে জাতিপরিবৃত্তেী ॥২॥৷ ইহা আপস্তম্ব সূত্র।

অর্থ –ধর্মাচরণ দ্বারা নিকৃষ্ট বর্ণ স্ববর্ণ অপেক্ষা উচ্চ বর্ণ প্রাপ্ত হয় এবং যে যে বর্ণের উপযুক্ত সে, সেই বর্ণে গণ্য হইবে৷১ ॥ সেইরূপ অধর্মাচরণ দ্বারা পূর্ব পূর্ব অর্থাৎ উচ্চবর্ণের মনুষ্য নিজ বর্ণ অপেক্ষা নিম্ন বর্ণ প্রাপ্ত হয় এবং সে সেই বর্ণে গণ্য হইবে।

পুরুষেরা যেমন স্ব স্ব বর্ণের যোগ্য হয় তেমন স্ত্রীলোকের ব্যবস্থাও বুঝিতে হইবে। এতদ্বারা সিদ্ধ হইল যে, এইরূপ ব্যবস্থা হইলে সকল বর্ণ নিজ নিজ গুণ-কর্ম-স্বভাববিশিষ্ট হইয়া শুদ্ধতার সহিত থাকিবে। অর্থাৎ ব্রাহ্মণকুলে কেহ ক্ষত্রিয়, বৈশ্য অথবা শূদ্রবৎ যেন না থাকে এবং ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র বর্ণও বিশুদ্ধ থাকিবে, অর্থাৎ বর্ণ-সঙ্করত্ব প্রাপ্ত হইবে না। তাহাতে কোন বর্ণের নিন্দা বা অযোগ্যতাও হইবে না।

প্রশ্ন –যদি কাহারও একটি মাত্র পুত্র বা কন্যা থাকে এবং সেই পুত্র বা কন্যা অন্য বর্ণে প্রবিষ্ট হয়, তবে তাহার মাতা বা পিতার সেবা করিবে কে? তাহাতে বংশচ্ছেদ ঘটিবে। ইহার কী ব্যবস্থা হওয়া উচিত?

উত্তর –কাহারও সেবাভঙ্গ অথবা বংশচ্ছেদ হইবে না। কারণ তাহারা নিজ নিজ পুত্র কন্যার পরিবর্তে বিদ্যাসভা ও রাজসভার ব্যবস্থা অনুসারে স্বর্ণযোগ্য অন্য সন্তান প্রাপ্ত হইবে। সুতরাং কোন অব্যবস্থা হইবে না।

এই বর্ণব্যবস্থা কন্যার ষোড়শবর্ষে এবং পুরুষের পঞ্চবিংশতি বর্ষে গুণকর্মানুসারে পরীক্ষাপূর্বক নিয়ন্ত্রিত হওয়া আবশ্যক। এই নিয়মানুসারে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ বর্ণের ব্রাহ্মণীর, ক্ষত্রিয় বর্ণের সহিত ক্ষত্রিয়ার, বৈশ্য বর্ণের সহিত বৈশ্যার এবং শূদ্রবর্ণের সহিত শূদ্রার বিবাহ হওয়া উচিত। তাহা হইলেই স্ব স্ব বর্ণের যথোচিত কর্ম এবং প্রীতি থাকিবে।

চারিবর্ণের কর্তব্য এবং গুণ এইরূপ। (ব্রাহ্মণ) অধ্যাপনমধ্যয়নংয়জনংয়াজনং তথা ॥ দানং প্রতিগ্ৰহশ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ ॥১॥ শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ ॥ জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম ॥ ২। ভ০গী ॥

ব্রাহ্মণের অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজ্ঞ করা ও কান, দান দেওয়া এবং দান গ্রহণ করা এই ছয়টি কর্ম। কিন্তু ‘প্রতিগ্রহঃ প্রত্যবরঃ’– মনু। অর্থাৎ প্রতিগ্ৰহ (গ্রহণ করা) হীন কর্ম॥১॥ (শম) মনে মনে কুকর্ম করিবার ইচ্ছাও না করা এবং মনকে কখনও অধর্মে প্রবৃত্ত হইতে না দেওয়া। (দম) শোত্র ও চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয় সমূহকে অন্যায় আচরণ হইতে নিবৃত্ত করিয়া ধর্মে পরিচালিত করা। (তপ) সর্বদা ব্রহ্মচারী ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া ধর্মানুষ্ঠান করা। শৌচ–

অদ্ভিগ্নাত্রাণি শুধ্যন্তি, মনঃসত্যেন শুধতি। বিদ্যাতপোভ্যাংভূতাত্মা, বুদ্ধিজ্ঞানেন শুধ্যতি৷ মনু ০ ॥

জল দ্বারা বহিরঙ্গ, সত্যাচরণ দ্বারা মন, বিদ্যা ও ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা জীবাত্মা এবং জ্ঞান দ্বারা বুদ্ধি পবিত্র হয়। আভ্যন্তরীণ রাগদ্বেষাদি দোষ এবং বাহিরের মল দূর করিয়া শুদ্ধ থাকা, অর্থাৎসত্যাসত্য বিচার করিয়া সত্যগ্রহণ ও অসত্যবর্জন দ্বারা নিশ্চয়ই পবিত্র হওয়া যায় (ক্ষান্তি) অর্থাৎ নিন্দা-স্তুতি, সুখ-দুঃখ, শীত-উষ্ণ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, হানি-লাভ, মান- অপমানাদি, হর্ষ-শোক পরিত্যাগ করিয়া ধর্মে দৃঢ়নিশ্চয় থাকা (আর্জব) কোমলতা, নিরভিমানতা, সরলতা ও সরল স্বভাব রাখা এবং কুটিলতাদি দোষ পরিত্যাগ করা (জ্ঞান) সাঙ্গোপাঙ্গ বেদাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়া অধ্যাপনা করিবার। সামর্থ্য; ‘বিবেক’ সত্য নির্ণয় যে বস্তু যেমন, তাহাকে সেইরূপ জানা অর্থাৎ জড়কে জড় এবং চেতনকে চেতন জানা ও স্বীকার করা। (বিজ্ঞান) পৃথিবী হইতে পরমেশ্বর পর্যন্ত যাবতীয় পদার্থকে বিশেষ রূপে জানিয়া ঐ সকলকে যথোচিত কার্য্যে প্রয়োগ করা। (আস্তিক্য) বেদ, ঈশ্বর ও মুক্তিতে বিশ্বাস; পূর্ব পরজন্ম স্বীকার করা; ধর্ম, বিদ্যা ও সৎসঙ্গ; এবং মাতৃ পিতৃ ও অতিথি সেবাকে কখনও পরিত্যাগ না করা এবং কখনও নিন্দা না করা এই পঞ্চদশ কর্ম ও গুণ ব্রাহ্মণ বর্ণস্থ মনুষ্যের মধ্যে অবশ্যই থাকা উচিত ॥২ ॥

ক্ষত্রিয়– প্রজানাং রক্ষণং দানমিজাধ্যয়নমেব চ। বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ ॥১॥মনু শৌয়ং তেজো ধৃতিদাক্ষ্যংয়ুদ্ধে চাপ্যপলায়ন। দামীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্ ॥২॥ ভ০গী০

(প্রজা০) ন্যায়ানুসারে ‘প্রজারক্ষা’ অর্থাৎ পক্ষপাত পরিত্যাগ পূর্বক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্মান এবং দুষ্ট ব্যক্তিদের তিরস্কার করা; সর্বপ্রকারে সকলকে পালন করা, (দান) বিদ্যাধর্মে প্রবৃত্তি ও সুপাত্রের সেবায় ধনাদি সামগ্রী ব্যয় করা। (ঈজ্যা) অগ্নিহোত্রাদি যজ্ঞ করা ও করান। (অধ্যয়ন)। বেদাদি শাস্ত্র সমূহের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা;(বিষয়ে প্রসক্তি ) বিষয়সমূহে আসক্ত না হইয়া সর্বদা। জিতেন্দ্রিয় এবং শরীর ও আত্মায় বলবান থাকা ॥১॥

(শৌৰ্য) একাকী শত সহস্রের সঙ্গেও যুদ্ধ করিতে ভীত না হওয়া (তেজঃ) সর্বদা তেজস্বী অর্থাৎ দীনতাশূণ্য প্রগম্ভ এবং দৃঢ় থাকা। (ধৃতি) ধৈৰ্য্যবান হওয়া। (দাক্ষ্য) রাজা-প্রজা বিষয়ক ব্যবহার এবং সকল শাস্ত্রে অতিশয় নিপুণ হওয়া (যুদ্ধে) যুদ্ধে দৃঢ় ও নিঃশঙ্ক থাকিয়া, কখনও তাহাতে পরাঙ্খ না হওয়া ও পলায়ন না করা; অর্থাৎ এইরূপ যুদ্ধ করা যাহাতে নিশ্চিতরূপে। বিজয় হইবে এবং আত্মরক্ষা করিবে। যদি পলায়ন বা শক্র প্রতারণা করিলে বিজয় লাভ হয়, তবে তাহাও করা। (দান) দানশীল থাকা (ঈশ্বরভাব) পক্ষপাতশূন্য হইয়া সকলের সহিত যথাযোগ্য। ব্যবহার করা, বিচারপূর্বক দান করা, প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করা এবং কখনও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ না হইতে দেওয়া। এই একাদশটি ক্ষত্রিয়বর্ণের কর্ম এবং গুণ৷২ ॥

বৈশ্য– পশুনাংরক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ। বণিপথং কুসীদং চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ ॥৩ ॥ মনু

(পশুরক্ষা) গবাদি পশুর পালন এবং বৃদ্ধি করা। (দান) বিদ্যা ও ধর্মের বৃদ্ধি করিতে ও করাইতে ধনসম্পত্তি ব্যয় করা। (ইজ্যা) অগ্নিহোত্রদি যজ্ঞ করা। (অধ্যয়ন) বেদাদি শাস্ত্রের অধ্যয়ন করা। (বণিকপথ) সর্বপ্রকার বাণিজ্য করা। (কুসীদ) শতকরা চারি আনা, ছয় আনা, আট আনা, বার আনা, ষোল আনা, বা বিশ আনার অধিক সুদ গ্রহণ না করা এবং মূলধনের দ্বিগুণের অধিক অর্থাৎ এক টাকা দিয়া একশত বৎসরের দুই টাকার অধিক গ্রহণ না করা ও না দেওয়া। (কৃষি) কৃষিকাৰ্য্য করা। এই [সাতটি] বৈশ্যের গুণ ও কর্ম।

শূদ্র– একমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ। এতেষামেব বর্ণনাং শুশ্রূষামনসূয়য়া ॥৪॥ মনু

নিন্দা, ঈর্ষা এবং অভিমানাদি দোষ পরিত্যাগ করিয়া ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, এবং বৈশ্যদিগকে যথোচিত সেবা করা শূদ্রের কর্তব্য এবং তদ্বারাই জীবন যাত্রা নির্বাহ করা। ইহাই একমাত্র শূদ্রের গুণ এবং কর্ম॥৪॥

সংক্ষেপে এই সব বর্ণ সমূহের গুণ এবং কর্মবিষয়ে লিখিত হইল। যে যে ব্যক্তির মধ্যে যে যে বর্ণের গুণ-কৰ্ম্ম থাকিবে সেই সেই ব্যক্তিকে সেই সেই বর্ণের অধিকার দান করিবে। এইরূপ ব্যবস্থা রাখিলে সব মনুষ্য উন্নতিশীল হয়। কারণ উত্তম বর্ণের ভয় হইবে যে, তাহার সন্তান মূর্খত্নাদি দোষ যুক্ত হইলে শূদ্র বলিয়া গণ্য হইবে। সন্তানদের ভয় থাকিবে যে, তাহারা পূর্বোক্ত আচার-ব্যবহার ও বিদ্যাসম্পন্ন না হইলে তাহাদের শুদ্র হইতে হইবে। আর নিম্ন বর্ণেরাও উচ্চ বর্ণস্থ হইবার জন্য উৎসাহ পাইবে।

বিদ্যা এবং ধর্ম প্রচারের অধিকার ব্রাহ্মণকে দিবে। কারণ, তাঁহারা পূর্ণ বিদ্বান্ এবং ধার্মিক বলিয়া সেই কাৰ্য্য যথোচিত রূপে সম্পাদন করিতে পারেন।

ক্ষত্রিয়কে রাজাধিকার দান করিলে রাজ্যের কখনও হানি অথবা বিঘ্ন হয় না।

পশুপালন প্রভৃতি অধিকার বৈশ্যকেই দান করা উচিত। কারণ তাঁহারা এ কাৰ্য্য উত্তমরূপে করিতে পারে।

শূদ্রকে সেবাধিকার দানের কারণ এই যে সে বিদ্যাহীন এবং মূর্খ বলিয়া বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় কাৰ্য্য কিছুই করিতে পারে না কিন্তু সে শারীরিক কাৰ্য্য সবই করিতে পারে। এইরূপ সকল বর্ণকে স্ব স্ব অধিকারে প্রবৃত্ত করা রাজাদের কর্তব্য।

.

বিবাহের লক্ষণ

ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্ষঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ। গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচস্টাষ্টমোSধমঃ ॥ মনু

আট প্রকারের বিবাহ প্রথম ব্রাহ্ম, দ্বিতীয় দৈব, তৃতীয় আর্য, চতুর্থ প্রাজাপত্য, পঞ্চম আসুর, ষষ্ঠ গান্ধর্ব, সপ্তম রাক্ষস এবং অষ্টম পৈশাচ। এই সকল বিবাহের ব্যবস্থা এই রূপ —

বর-কন্যা উভয়ে যথোচিত ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া পূর্ণ বিদ্যাসম্পন্ন ধার্মিক ও সুশীল হইবে। তাহাদের পরস্পর প্রসন্নতার সহিত বিবাহ হওয়াকে ‘ব্রাহ্ম’ বিবাহ বলে ॥

বিস্তৃত যজ্ঞে ঋত্বিকর্মে নিযুক্ত জামাতাকে সালঙ্কারা কন্যা দান করাকে ‘দৈব’ বিবাহ বলে। বরের নিকট হইতে কিছু গ্রহণের পরিবর্তে বিবাহ হওয়াকে ‘আ’, ধর্মোন্নতিকল্পে দুই জনের বিবাহ হওয়াকে প্রাজাপত্য,বর এবং কন্যাকে কিছু প্রদানপূর্বক বিবাহ হওয়াকে ‘আসুর’; অনিয়মে এবং অসময়ে বরকন্যা উভয়ে স্বেচ্ছায় কোন কারণ বশতঃ সংযোগ হওয়াকে ‘গান্ধর্ব। যুদ্ধ করিয়া, বলাৎকার দ্বারা অর্থাৎ বলপূর্বক ছিনাইয়া লইয়া অথবা কপটতার দ্বারা কন্যাগ্রহণ করাকে রাক্ষস’ এবং নিদ্রিত অথবা মদ্যাদি পান অবস্থায় প্রমত্ত কন্যার সহিত বলাকার পূর্বক সংযোগ ‘পৈশাচ’ বিবাহ বলে। এই সকল বিবাহের মধ্যে ব্রাহ্ম বিবাহ সর্বোৎকৃষ্ট; ‘দৈব’ [ও প্রাজাপত্য] মধ্যম; আর্ষ, আসুর এবং ‘গন্ধর্ব নিকৃষ্ট; ‘রাক্ষস’ অধম এবং ‘পৈশাচ’ মহাভ্রষ্ট।

সুতরাং এইরূপই নিশ্চয় রাখা উচিত যে, বিবাহের পূর্বে বর-কন্যা নির্জন স্থানে মিলিত হইবে না। কারণ যৌবনকালে স্ত্রী-পুরুষের নির্জনবাস দোষাবহ।

কিন্তু যখন বর কন্যার বিবাহ কাল উপস্থিত হইবে, অর্থাৎ যখন ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং বিদ্যা পূর্ণ হইবার এক বৎসর বা ছয় মাস বাকী থাকবে সেই সময় পৰ্য্যন্তরকন্যার প্রতিবিম্ব (যাহাকেফটোগ্রাফ বলা হয়) অথবা প্রতিকৃতি তুলিয়া কন্যাদের অধ্যাপিকাদের নিকট কুমারের প্রতিকৃতি এবং কুমারের অধ্যাপকদিগের নিকট কন্যার প্রতিকৃতি প্রেরণ করবে। যাহাদের আকৃতির মিল হইবে তাহাদের ইতিহাস অর্থাৎ জন্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সেই দিন পর্যন্ত জীবন চরিত্রের পুস্তক থাকিলে তাহা

অধ্যাপকেরা আনাইয়া দেখিবেন। যদি উভয়ের মধ্যে গুণ- কর্ম স্বভাবের সাদৃশ্য থাকে তবে তাহার সঙ্গে যাহার বিবাহ হওয়া উচিত সেই সেই পুরুষ ও স্ত্রীর প্রতিবিম্ব ও ইতিহাস কন্যার এবং বরের হস্তে দিয়া বলিবে,–”এ বিষয়ে তোমাদের যেরূপ অভিমত হয়, আমাদিগকে জানাইবে।”

সেই দুইজন পরস্পর বিবাহ করিতে কৃতনিশ্চয় হইলে একই সময়ে তাহাদের সমাবর্তন হইবে। যদি ইহারা উভয়ে অধ্যাপকদিগের সম্মুখে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে, তবে সে স্থানে, নতুবা কন্যার । মাতাপিতার গৃহে বিবাহ হওয়া উচিত। যখন তাহারা পরস্পর সম্মুখীন হইবে, তখন অধ্যাপকগণ। অথবা কন্যার মাতাপিতা প্রভৃতি সজ্জনদিগের সম্মুখে দুইজনের দ্বারা পরস্পর কথোপকথন এবং শাস্ত্রাৰ্থ করাইবে। যদি কাহারও কোন গোপনীয় ব্যবহার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা থাকে তবে তাহাও লিখিয়া একে অন্যের হস্তে দিয়া প্রশ্নোত্তর করিয়া লইবে ॥

উভয়ের মধ্যে বিবাহের জন্য গাঢ় প্রেম জন্মিলে, তাহাদের ভোজ্য ও পানীয় সম্বন্ধে উত্তম ব্যবস্থাও আবশ্যক। তাহাতে তাহাদের পূর্ব ব্রহ্মচর্য্য এবং বিদ্যাধ্যয়নরূপ তপশ্চৰ্য্যা ও ক্লেশ হেতু শরীর যে শীর্ণ হইয়াছিল তাহা চন্দ্রকলার ন্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া অল্পকালের মধ্যেই হৃষ্টপুষ্ট হইয়া। উঠিবে।

পরে যে দিন রজস্বলা হইবার পর শুদ্ধা হইবে সেইদিন বেদী ও মণ্ডপ রচনা করিয়া বহু সুগন্ধ। দ্রব্য, ঘৃতাদি দ্বারা হোম করিবে। সে সময় বিদ্বান স্ত্রী পুরুষদিগকে যথোচিত সংবর্ধনা করিবে। অনন্তর যে দিনটি ঋতুদানের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হইবে সেইদিন সংস্কার-বিধি’ গ্রন্থোক্ত বিধি অনুসারে সকল কর্ম করিবার পর মধ্যরাত্রিতে অথবা রাত্রি দশ ঘটিকায় সময় অতি প্রসন্নতার সহিত সকলের সমক্ষে পাণিগ্রহণপূর্বক বিবাহবিধি সম্পূর্ণ করিয়া নির্জনে অবস্থান করিবে।

পুরুষ বীর্যস্থাপন ও স্ত্রী বীর্যাকর্ষণের বিধি অনুসারে কাৰ্য্য করিবে। যতদূর সম্ভব ব্রহ্মচর্য্যের বীৰ্য্য নষ্ট হইতে দিবে না। কারণ ঐ বীৰ্য্য হইতে রজসংযোগে যে শরীর উৎপন্ন হইয়া থাকে তাহাতে অপূর্ব উৎকৃষ্ট সন্তান জন্মে। গর্ভাশয়ে বীর্য পতনের সময় স্ত্রীপুরুষ উভয়ে স্থির থাকিবে এবং নাসিকার সম্মুখে নাসিকা এবং চক্ষুর সম্মুখে চক্ষু রাখিবে, অর্থাৎ শরীর সরলভাবে রাখিবে এবং অত্যন্ত প্রসন্নচিত্ত থাকিবে, হেলিবে দুলিবে না; পুরুষ নিজ শরীর শিথিল করিয়া রাখিবে। স্ত্রী বীৰ্য্যগ্রহণের সময় অপান বায়ুকে উর্ধে আকর্ষণ করিবে এবং যোনি সঙ্কোচন পূর্বক বীৰ্য্য আকর্ষণ করিয়া গর্ভাশয়ে স্থাপন করিবে। তাহার পর উভয়ে বিশুদ্ধ জলে স্নান করিবে।* [*এই সকল গোপনীয় কথা। এইজন্য এতটুকু হইতেই সমস্ত বুঝিয়া লইবে।] বিশেষ লেখা উচিত নহে। গর্ভস্থিতি সম্বন্ধে বিদুষী স্ত্রী সেই সময়েই জানিতে পারে কিন্তু একমাস পরে রজস্বলা না হইলেই সকলেই ইহা নিশ্চিতরূপে জানিতে পারে।

অনন্তর শুণ্ঠি, কেশর, অশ্বগন্ধা, ছোট এলাচ ও সালম মিছরি দুগ্ধের সহিত মিশ্রিত করিয়া নিজ নিজ শয্যায় পৃথক পৃথক শয়ন করিবে। প্রত্যেকবার গর্ভাধান কালে এই বিধি পালন করা উচিত। এক মাসের পর রজস্বলা না হইলে গর্ভস্থিতি সম্বন্ধে নিশ্চয়তা হয়। তখন হইতে এক বৎসর পর্যন্ত স্ত্রী পুরুষের কখনও সমাগম হওয়া উচিত নহে। কারণ তাহা হইলে সন্তান উত্তম হয়, এবং পরবর্তী সন্তানও তদ্রপ হইয়া থাকে; অন্যথা বীৰ্য্য বৃথা নষ্ট হয়, উভয়ের আয়ু হ্রাস প্রাপ্ত হয় ও নানা রোগ জন্মে। কিন্তু বাহ্য প্রেমালাপ প্রভৃতি ব্যবহার অবশ্য থাকা উচিত।

পুরুষ বীৰ্য্যস্থিতি এবং স্ত্রী গর্ভরক্ষা করিয়া এইরূপ ভোজন ও পরিধেয় গ্রহণ করিবে যেন। পুরুষের বীর্য্য স্বপ্নেও নষ্ট না হয় এবং স্ত্রীর গর্ভে সন্তানের শরীর অত্যুত্তম রূপ, লাবণ্য, পুষ্টি বল ও পরাক্রমযুক্ত হইয়া দশম মাসে ভূমিষ্ঠ হয়। চতুর্থ মাস হইতে বিশেষ রূপে এবং অষ্টম মাসের পর হইতে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত গৰ্ভরক্ষা করা আবশ্যক। গর্ভবতী স্ত্রী রেচক, রুক্ষ, মাদকদ্রব্য এবং বলবুদ্ধিনাশক পদার্থ কখনও সেবন করিবে না। কিন্তু ঘৃত, দুগ্ধ, উত্তম তণ্ডুল, গোধুম, মুগ এবং মাষ কলাই প্রভৃতি পানাহার দেশ-কাল অনুসারে বিচার পূর্বক যথাযোগ্য গ্রহণ করিবে।

গর্ভাবস্থায় দুইটি সংস্কার–প্রথমতঃ চতুর্থ মাসে ‘পুংসবন’, দ্বিতীয়তঃ অষ্টম মাসে ‘সীমন্তোন্নয়ন’ যথাবিধি সম্পন্ন করিবে।

সন্তান ভূমিষ্ঠ হইবার পর, স্ত্রী এবং সন্তানের শরীরকে বিশেষ সাবধানতার সহিত রক্ষা করা আবশ্যক; অর্থাৎ পূর্বেই শুন্তিপাক অথবা সৌভাগ্য শুন্তিপাক প্রস্তুত করাইয়া রাখিবে। ঐ সময়ে স্ত্রী ঈষদুষ্ণ সুবাসিত জলে স্নান করিবে এবং শিশুকেও স্নান করাইবে। তাহার পর নাড়িচ্ছেদন করিবে। শিশুর নাভিমূলে এক কোমল সূত্র বাঁধিয়া চারি অঙ্গুলি পরিমাণ ছাড়িয়া উপর হইতে কৰ্ত্তণ করিবে। সূত্র এইরূপে বাঁধিবে যেন শরীর হইতে একবিন্দু রক্ত ও পতিত না হয়। পরে উক্ত স্থান শুদ্ধ করিয়া (প্রসূতির গৃহের) দ্বারদেশে সুগন্ধ ঘৃতাদির দ্বারা হোম করিবে। অনন্তর শিশুর পিতা শিশুর কর্ণে ‘বেদো সী’ অর্থাৎ “তোমার নাম বেদ”,ঐ বচন শুনাইয়া ঘৃত ও মধু লইয়া স্বর্ণ শলাকা দ্বারা শিশুর জিহ্বার উপর ওম্ অক্ষর লিখিয়া তদ্বারা লেপন করাইবে। পরে শিশুকে মাতার হস্তে দিবে। শিশু দুগ্ধ পান করিতে ইচ্ছা করিলে মাতা তাহাকে স্তন্যদান করিবে। মাতার দুগ্ধ না থাকিলে কোন স্ত্রীলোককে পরীক্ষা করিয়া শিশুকে তাহার স্তন্য পান করাইবে। তাহার পর বিশুদ্ধ বায়ুযুক্ত অপর এক গৃহে সায়ংপ্রাতঃ সুগন্ধিত ঘৃতের হোম করিবে। প্রসূতি ও শিশুকে সেই গৃহেই রাখিবে।

শিশু ছয়দিন পর্যন্ত মাতৃস্তন্য পান করিবে। মাতাও নিজ শরীরের পুষ্টির জন্য নানাবিধ উত্তম সামগ্রী ভোজন করিবে এবং যোনি-সংকোচনও করিবে। ষষ্ঠ দিবসে স্ত্রী বাহিরে আসিবে এবং দুগ্ধপানের জন্য একজন ধাত্রী নিযুক্ত করিবে। ধাত্রীরও উত্তম আহাৰ্য্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করাইবে। ধাত্রী শিশুকে দুগ্ধপান করাইবে এবং পালনও করিবে কিন্তু মাতা শিশুর উপর পূর্ণদৃষ্টি রাখিবে যেন তাহার লালন-পালনে কোনরূপ ক্রটি না হয়। প্রসূতি দুগ্ধ রোধ করিবার জন্য তাহার স্তনের অগ্রভাগের উপর এইরূপ প্রলেপ দিবে যাহাতে দুগ্ধ ক্ষরিত না হয়। সেইরূপ যথোচিত পান ভোজনও করিবে। তদনন্তর ‘সংস্কারবিধি অনুসারে নামকরণাদি সংস্কারগুলি যথাকালে করিতে থাকিবে। পুনরায় স্ত্রী রজস্বলা হইয়া শুদ্ধ হইবার পরে সেইভাবে ঋতুদান করিবে।

ঋতুকালাভিগামী স্যাৎ স্বারনিরত্রঃ সদা ॥ ব্রহ্মচায়েব ভবতি যত্র তত্রাশ্রমে বসন্ ॥ মনু ॥

যিনি নিজ ভাষাতেই সন্তুষ্ট থাকেন এবং ঋতুগামী হন, তিনি গৃহস্থ হইলেও ব্রহ্মচারী সদৃশ।

সন্তুষ্টো ভায়য়া ভর্তা ভর্তা ভায়া তথৈব চ ॥ য়স্মিন্নেব কুলে নিত্যং কল্যাণং তত্র বৈ ধ্রুবম্ ॥১॥ যদি হি স্ত্রী ন রোচেত পূমাংসন্ন প্রমোদয়েৎ। অপ্রমোদাৎ পুনঃ পুংসঃ প্রজনং ন প্রবর্ততে॥২॥ স্ক্রিয়াংতু রোমানায়াং সর্বং তদ্ৰোচতে কুলম্ ॥ তস্যাং ত্বরোচমানায়াং সৰ্বমেব ন রোচতে ॥ ৩ ॥ মনু

যে পরিবারে ভায্যার প্রতি স্বামী এবং স্বামীর প্রতি ভাৰ্য্যা সুপ্রসন্ন থাকে, সেই পরিবারেই সমস্ত সৌভাগ্য এবং ঐশ্বৰ্য্য নিবাস করে। যেখানে কলহ হয়, সেখানে দৌভাগ্য এবং দারিদ্র স্থায়ী হয় ॥ ১ ॥

স্ত্রী-স্বামীর প্রতি প্রীতি না রাখিলে এবং স্বামীকে প্রসন্ন না করিলে পতির অপ্রসন্নতা বশতঃ কামোৎপত্তি হয় না ॥ ২ ॥

স্ত্রী প্রসন্ন থাকিলে সমস্ত পরিবার প্রসন্ন থাকে, স্ত্রীর অপ্রসন্নতায় সব অপ্রসন্ন অর্থাৎ দুঃখদায়ক হইয়া যায় ॥ ৩ ॥

পিতৃভিভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভিদেরৈস্তথা। পূজা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীসুভিঃ ॥১॥ য়ত্র নায়স্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। য়ত্রৈতাস্তুন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্ৰাফলাঃক্রিয়া ॥২॥ শোচন্তি জাময়য়ায় বিনশ্যতা তকুল ॥ ন শোচন্তি তুয়ত্রৈতা বর্ধতে তদ্ধি সর্বদা ॥৩ তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ। ভূতিকামৈরৈনিত্যং সৎকারেযুৎসবেষু চ ॥8 ॥ মনু।

পিতা, ভ্রাতা, পতি এবং দেবর ইহাদিগকে সসম্মানে অলঙ্কার প্রভৃতি দ্বারা প্রসন্ন রাখিবে। যাহারা অতীব কল্যাণকামী, তাহারা এইরূপ করিবেন ৷১

যে গৃহে নারীর সম্মান হয়, সেই গৃহে পুরুষেরা বিদ্বান্ হইয়া দেবসংজ্ঞা প্রাপ্ত হন এবং আনন্দে ক্রীড়া করেন, যে গৃহে নারীর সম্মান হয় না সে গৃহে সকল ক্রিয়া নিষ্ফল হইয়া যায় ॥২॥

যে গৃহে বা কুলে নারী শোকাতুরা হইয়া দুঃখভোগ করে, সেই কুল শীঘ্র নষ্ট-ভ্রষ্ট হইয়া যায়। যে গৃহে বা কুলে নারী আনন্দে উৎসাহের সহিত নিবাস করে সে পরিবার সর্বদা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে ৷৩ ॥

এইজন্য ঐশ্বৰ্য্যকামী মনুষ্যদের সমাদর ও উৎসবের সময় ভূষণ, বস্ত্র এবং আহাৰ্য্যাদি দ্বারা সর্বদা নারীদিগকে সম্মান প্রদর্শন করা উচিত ॥৪॥

সর্বদা মনে রাখা আবশ্যক যে, পূজা শব্দের অর্থ সম্মান; দিন রাত্রির মধ্যে প্রত্যেক বার মিলিত অথবা পৃথক হইবার সময় একে অন্যকে প্রীতি সহকারে ‘নমস্তে’ বলিবে।

সদা প্রহৃষ্টয়া ভাব্যংগৃহকায়েষু দক্ষয়া ॥ সুসংস্কৃতোপস্করয়া ব্যয়ে চামুক্তহস্তয়া ৷ মনু০ ॥

অত্যন্ত প্রসন্নতার সহিত গৃহিণী গৃহকর্ম করিবে, নিপুণতার সহিত যাবতীয় গৃহসামগ্রী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং গৃহে পবিত্রতা রাখা গৃহিণীর কর্ত্তব্য। তাহারা ব্যয় সম্বন্ধে অত্যন্ত উদার হইবে না। অর্থাৎ মিতব্যয়ী হইবে। সকল সামগ্রী পবিত্র রাখিবে এবং এইরূপ রন্ধন করিবে যেন তাহা ঔষধের ন্যায় শরীর বা আত্মাতে রোগ না আসিতে দেয়। যাবতীয় ব্যয়ের হিসাব যথাযথ ভাবে রাখিয়া পতি ও অন্যান্যকে শুনাইয়া দিবে। গৃহে ভূত্যদিগের নিকট হইতে যথোচিত কাৰ্য্য আদায় করিবে এবং গৃহের কোন কর্মকে নষ্ট হইতে দিবে না।

স্ক্রিয়ো রত্নান্যথো বিদ্যা সত্যাং শৌচং সুভাষিতম্ ॥ বিবিধানি চ শিল্পানি সমাদেয়ানি সর্বর্তঃ ॥ মনু।

উত্তম স্ত্রী নানাবিধ রত্ন, সত্য, পবিত্রতা, বাণী এবং নানাবিধ শিল্পবিদ্যা অর্থাৎ কারুকার্য্যের। জ্ঞান সকল দেশ ও মনুষ্যের নিকট হইতে গ্রহণ করিবে।

সত্যং ক্ৰয়াৎ প্রিয়ং ব্রয়ান্ন ক্ৰয়াৎ সত্যমপ্রিয়। প্রিয়ং চ নানৃতৃং ক্রয়াদেষ ধর্মঃ সনাতনঃ ॥ মনু ৪।

ভদ্রং ভদ্রমিতি ক্ৰয়া ভদ্ৰমিত্যেব বা বদেৎ। শুষ্কবৈরং বিবাদং চ ন কুয়াৎ কেনচিৎসহ ॥ মনু

সর্বদা অন্যের হিতকর প্রিয়সত্য বলিবে। অপ্রিয় সত্য, যেমন কাণাকে কাণা বলিবে না। অন্যকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য অর্থাৎ মিথ্যা বলিবে না ॥১॥ সর্বদা ভদ্র অর্থাৎ সকলের হিতকর বাক্য বলিবে। শুষ্ক বৈর অর্থাৎ বিনা অপরাধে কাহারও সহিত বিরোধ বা বিবাদ করিবে না ॥ ২॥

যাহা যাহা অপরের পক্ষে হিতকারক তাহা অপ্রিয় হইলেও না বলিয়া ছাড়িবে না।

পুরুষা বহবো রাজন্ প্রিয়বাদিনঃ। অপ্রিয়স্য তু পথ্যস্য বক্তা শ্রোতা চ দুর্লভঃ ॥ মহাভারত উদ্যোগ–বিদুর নীতি

হে ধৃতরাষ্ট্র। এই সংসারে অন্যকে সর্বদা সন্তুষ্ট করিবার জন্য অনেক প্রিয়বাদী ও প্রশংসাকারী লোক আছে, কিন্তু শ্রুতিকটু ও হিতকর বাক্যের বক্তা এবং শ্রোতা দুর্লভ। কেননা, অন্যের দোষ মুখের উপর বলা, নিজের দোষ শ্রবণ করা এবং পরোক্ষে সর্বদা অন্যের প্রশংসা করা সৎপুরুষদিগের যোগ্য। সম্মুখে গুণ বর্ণনা করা এবং পিছনে দোষ প্রকাশ করা দুষ্ট ব্যক্তিদের নীতি। যে পর্যন্ত না মনুষ্য নিজের দোষ অপরের মুখে শ্রবণ করে এবং সমালোচক তাহার সমালোচনা না করে সে। পৰ্য্যন্ত মানুষ দোষমুক্ত হইয়া গুণবান হইতে পারে না।

কখনও কাহারও নিন্দা করিবে না। যথা—’গুণেষু দোষারোপণমসূয়া’ অর্থাৎ ‘দোষে গুণারোপণমপ্যসূয়া’; ‘গুণেষু’ গুণারোপণং দোষে দোষারোপণং চ স্তুতিঃ। গুণে দোষারোপ, দোষে গুণারোপ করাকে ‘নিন্দা’ বলে। গুণে গুণারোপ এবং দোষে দোষারোপ করাকে ‘স্তুতি’ বলে অর্থাৎ মিথ্যা ভাষণের নাম ‘নিন্দা’ এবং সত্য ভাষণের নাম ‘স্তুতি’।

বুদ্ধিবৃদ্ধিকরাণ্যা ধন্যানি চ হিতানি চ ॥ নিত্যংশাস্ত্রাণ্যবেক্ষেত নিগমাংশ্চৈব বৈদিকান ॥১॥ যথায়থা হি পুরুষঃশাস্ত্রং সমধিগচ্ছতি। তথা তথা বিজানাতি বিজ্ঞানং চাস্য রোচতে ॥ ২ ॥ মনু০ ॥

বুদ্ধি, ধন ও কল্যাণের শীঘ্র বৃদ্ধিকারী শাস্ত্র এবং বেদ নিত্য শুনিবে ও অপরকে শুনাইবে। ব্রহ্মচর্যাশ্রমে পঠিত বিষয়গুলি স্ত্রী-পুরুষ নিত্য বিচার করিবে এবং পড়াইবে।১ ॥

যেমন যেমন মনুষ্য শাস্ত্রকে যথাবৎ জানিতে থাকে তেমন তেমন সেই বিদ্যায় জ্ঞান বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং তাহাতেই রুচি হইতে থাকে ॥২॥

ঋষিয়জ্ঞং দেবয়জ্ঞং ভূতয়জ্ঞং চ সর্বদা। নৃয়জ্ঞং পিতৃযজ্ঞং চয়থাশক্তিন হাপয়েৎ ॥১॥ অধ্যাপনংব্রহ্ময়জ্ঞঃ পিতৃয়জ্ঞশ্চ তর্পণম্ ॥ হোমো দৈববা বলিভৌতো নৃয়জ্ঞো তিথিপূজন৷২ ॥ স্বাধ্যায়েনাৰ্চয়েতর্ষীন হোমৈর্দেৰ্বান যথাবিধি। পিতৃশ্রাদ্ধেশ্চ নৃননৈর্ভূতানি বলিবর্মণ ॥৩ ॥ মনু ॥

ব্রহ্মচর্য বিষয়ে দুইটি যজ্ঞের কথা লিখিত হইয়াছে। উহাদের প্রথমটি ‘ঋষিযজ্ঞ’ বেদাদিশাস্ত্রের পঠন-পাঠন, সন্ধ্যোপাসনা এবং যোগাভ্যাস। দ্বিতীয়টি ‘দেবযজ্ঞ’–বিদ্বান ব্যক্তিদের সঙ্গ, সেবা, পবিত্রতা, দিব্যগুণধারণ, দাতৃত্ব এবং বিদ্যার উন্নতি করা। এই দুই যজ্ঞ সন্ধ্যা এবং প্রাতঃকালে করিতে হয়।

সায়ংসায়ং গৃহপতিনো অগ্নিঃ প্রাতঃপ্রাতঃ সৌমনসস্য দাতা ॥১ প্রাতঃ প্রার্তগৃহপতিনো অগ্নি সায়ংসায়ং সৌমনসস্য দাতা ॥ ২॥ অ০১৯/৭/৩.৪। তস্মাদহোরাত্রস্য সংয়োগেব্রাহ্মণঃ সন্ধ্যামুপাসীত। উদ্যন্তমস্তং য়ান্তমাদিত্যমভিধ্যায় ॥৩ ব্রাহ্মণে ॥ ন তিষ্ঠতি তুয়ঃ পূর্বাং নোপাস্তে য়স্তু পশ্চিমা। স সাধুভিহিষ্কায়ঃ সর্বম্মাদ দ্বিজকর্মণঃ ॥৪ ॥ মনু (২ । ১০৩)

প্রত্যহ সন্ধ্যাকালে যে হোম হয় সেই সমস্ত হুতদ্রব্য প্রাতঃকাল পর্যন্ত বায়ু শুদ্ধ করিয়া সুখকারী হইয়া থাকে ৷১ ॥

প্রত্যহ প্রাতঃকালে অগ্নিতে যে হোম করা হয় সেই সমস্ত হুতদ্রব্য সায়ং কাল পর্যন্ত বায়ুর শুদ্ধিদ্বারা বল, বুদ্ধি এবং আরোগ্যকারী হইয়া থাকে ॥২॥

এই কারণে দিন ও রাত্রির সন্ধিকালে অর্থাৎ সূর্যের উদয় ও অস্তকালে পরমেশ্বরের ধ্যান এবং অগ্নিহোত্র করা অবশ্য কর্তব্য ॥৩ ॥

আর যিনি সন্ধ্যা এবং প্রাতঃকালে এই দুই কাৰ্য্য না করিবেন তাহাকে সৎপুরুষেরা সমস্ত দ্বিজকাৰ্য্য হইতে বাহির করিয়া দিবেন, অর্থাৎ তাহাকে শূদ্রবৎ মনে করিবেন ॥৪॥

প্রশ্ন –ত্রিকাল সন্ধ্যা করা যাইবে না কেন?

উত্তর –তিন কালে সন্ধি হয় না। আলোক এবং অন্ধকারের সন্ধি সায়ং এবং প্রাতঃ এই দুই কালেই হইয়া থাকে। যিনি ইহা মানিয়া মধ্যাহ্ন কালে তৃতীয় সন্ধ্যা মানেন, তিনি মধ্যরাত্রিতেও উপাসনা করেন না কেন? যদি মধ্যরাত্রিতে সন্ধ্যা করিতে ইচ্ছা করেন, তবে প্রতি প্রহরে, প্রতি ঘটিকায়, প্রতি পলে এবং প্রতিক্ষণেও সন্ধি হইয়া থাকে তখনও সন্ধ্যোপাসনা করিতে থাকুন। যদি এইরূপ করিতে ইচ্ছা করেন, তবে তাহা হইতেই পারে না। কোন শাস্ত্রে মধ্যাহ্ন সন্ধ্যা সম্বন্ধে প্রমাণও নাই। অতএব দুইকালেই সন্ধ্যা ও অগ্নিহোত্র করা সমুচিত, তৃতীয় কালে নহে। ভুত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান তিন কাল হইয়া থাকে, সন্ধ্যোপাসনা ভেদে নহে।

তৃতীয় ‘পিতৃযজ্ঞ’ অর্থাৎ যাঁহারা দেব অর্থাৎ বিদ্বান ঋষি যাঁহারা অধ্যাপনা করেন এবং পিতর অর্থাৎ মাতা, পিতা, বুদ্ধ, জ্ঞানী এবং পরম যোগী–ইহাদের সেবা করা। পিতৃযজ্ঞ’ দ্বিবিধ–প্রথম শ্রাদ্ধ দ্বিতীয় তর্পণ। শ্রাদ্ধ অর্থাৎ ‘এ’ সত্যের নাম, শ্ৰৎ সত্যং দধাতি য়য়া ক্রিয়য়া সা শ্রদ্ধা, শ্রদ্ধয়া য়ৎ ক্রিয়তে তচ্ছুদ্ধ। যে ক্রিয়া দ্বারা সত্য গ্রহণ করা যায় তাহাকে শ্রদ্ধা বলে এবং শ্রদ্ধা পূর্বক যে কর্ম অনুষ্ঠিত হয়, তাহার নাম শ্রাদ্ধ’। আর তৃপ্যন্তি তৰ্পয়ন্তি য়েন পিতৃণ তত্তৰ্পণ যে যে সকল কর্মের দ্বারা বিদ্যমান মাতা-পিতা প্রভৃতি পিতৃগণ তৃপ্ত অর্থাৎ প্রসন্ন হন, এবং যে সকল ক্রিয়ার দ্বারা তাহাদিগকে প্রসন্ন করা যায় তাহার নাম ‘তর্পণ। কিন্তু তাহা জীবিত ব্যক্তিদের জন্য, মৃতদের জন্য নহে।

অথ দেবতৰ্পণ
ওব্রহ্মাদয়ো দেবাস্তৃপ্যাম। ব্রহ্মাদিদেবপত্নস্তৃপ্যন্তা।
ব্রহ্মাদিদেবসুতাস্তৃপ্যন্তাম্। ব্রহ্মাদিদেবগণস্তৃপ্যাম ॥ পারস্পর ও আশ্বালায়ন গৃহ্যসূত্র ইতি দেবতৰ্পণ৷

‘বিদ্বান সো হি দেবাঃ’ ইহা শতপথ ব্রাহ্মণের বচন (৩৭/৩১০) বিদ্বান্‌দিগকেই ‘দেব’ বলে। যাঁহারা সাঙ্গোপাঙ্গ চারিবেদ জানেন, তাহাদেরও নাম ব্রহ্মা। যাঁহারা তাহাদের অপেক্ষা অল্প বিদ্যাভ্যাস করেন, তাঁহাদের নাম ‘দেব’ অর্থাৎ বিদ্বান ॥ বিদ্বান ব্যক্তিদের সদৃশ বিদুষী স্ত্রী তাঁহাদের নাম ‘ব্রাহ্মণী’ এবং ‘দেবী’। তাঁহাদের সদৃশ পুত্র ও শিষ্য তথা তৎসদৃশগণ অর্থাৎ সেবক; তাহাদের সকলের সেবা করার নাম ‘শ্রাদ্ধ’ ও ‘তর্পণ’।

অথর্ষিতর্পণম
ওম মরীচ্যাদয় ঋষয়স্তৃপ্যন্তাম। মরীচ্যাদৃষিপত্নস্তু প্যাম। মরীচ্যাদৃষিসুতা প্যন্তাম্। মরীচ্যাদৃষিগণাস্তৃপ্যন্তাম্ ॥ পারস্র ও আলায়নগৃহ্যসূত্র ইতি ঋষিতৰ্পণ ॥

যাঁহারা ব্রহ্মার প্রপৌত্র মরীচির ন্যায় বিদ্বান্ হইয়া অধ্যাপনা করেন এবং তৎসদৃশ তাহাদের পুত্র ও শিষ্য এবং তৎসদৃশ সেবকদিগকে সেবা ও সম্মান করার নাম ‘ঋষি তর্পণ’।

অথ পিতৃতর্পণম্ । ওম্ সোমসদঃ পিতরস্তূপন্তাম্। অগ্নিদাত্তাঃ পিতরস্তৃপ্যন্তাম্। বহিষদঃ পিতরস্তু প্যন্তাম। সোমপাঃ পিতরস্তৃপ্যন্তাম্। হবির্ভুজঃ পিতরস্থ প্যন্তাম্। আজ্যপাঃ পিতরস্তৃপ্যা৷ (সুকালিনঃ পিতরস্তৃপ্যাম) য়মাদিভ্যো নমঃ মাদীংস্তৰ্পয়ামি। পিত্রে স্বধা নমঃ পিতরং তৰ্পয়ামি। পিতামহায় স্বধা নমঃ পিতামহং তৰ্পয়ামি। (প্রপিতামহায় স্বধা নমঃ প্রপিতামহং তৰ্পয়ামি।) মাত্রে স্বধা নমো মাতরং তৰ্পয়ামি পিতামহৈ স্বধা নমঃ পিতামহীং তৰ্পয়ামি। (প্রপিতামহ্যৈ স্বধা নমঃ প্রপিতামহীং তৰ্পয়ামি।) স্বপত্নৈ স্বধা নমঃ স্বপত্নীং তৰ্পয়ামি। সম্বন্ধিভ্যঃ স্বধা নমঃ সম্বন্ধিনস্তৰ্পয়ামি। সগোত্রেভ্যঃ স্বধা নমঃ সগোত্রাংস্তৰ্পয়ামি ॥ মনু০। পারাশর স্মৃতি।

ইতি পিতৃতর্পণ ॥

য়ে সোমে জগদীশ্বরে পদার্থবিদ্যায়াংচসীদন্তি তে সোমসদঃ’যাঁহারা পরমাত্মা এবং পদার্থবিদ্যা বিষয়ে নিপুণ তাহারা ‘সোমসদ।’ য়ৈরগ্নের্বিদ্যুত বিদ্যা গৃহীতা তে অগ্নিদাত্তাঃ’ যাঁহারা অগ্নি অর্থাৎ বিদ্যৎ প্রভৃতি পদার্থের জ্ঞাতা তাহারা ‘অগ্নিষ্বাত্ত’।’য়ে বর্হির্ষি উত্তমে ব্যবহারে সীদন্তি তে বর্হিষদঃ’, যাঁহারা উত্তম বিদ্যাবুদ্ধিযুক্ত ব্যবহারে নিযুক্ত থাকেন, তাহারা বহিষদ’ ‘য়ে সোমমৈশ্বয়মোষধীরসং বা পান্তি পিবন্তি বা তে সোমপাঃ’, যাঁহারা ঐশ্বের্যের রক্ষাকর্তা এবং মহৌষধি রসপিন দ্বারা রোগরহিত তথা অপরের ঐশ্বর্যের রক্ষক যাঁহারা ঔষধ প্রদান করিয়া অন্যকে রোগমুক্ত করেন তাহারা ‘সোমপাঃ।’য়ে হবিহোতুমমহং ভুঞ্জতে ভোজয়ন্তি বা তে হর্বিভুজঃ’, যাঁহারা মাদক পদার্থ এবং দ্বিংসাকারক দ্রব্য পরিত্যাগ করিয়া ভোজন করেন তাহারা। হর্বিভুজঃ।’য়ে আজ্যাং জ্ঞাতুং প্রাপ্তং বা মোগ্যং রক্ষন্তি বা পিবন্তি তে আজ্যপাঃ, যাঁহারা জ্ঞাতব্য বস্তুর রক্ষক এবং যাঁহারা ঘৃত-দুগ্ধাদি সেবন করেন তাহারা ‘আজ্যপা।’শোভনঃ কালো বিদ্যুতে য়েষাৎ তে সুকালিনঃউৎকৃষ্ট ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা যাঁহাদের সময় সুখময়, তাঁহারা সুকালিন্। ‘য়ে দুষ্টান্ য়চ্ছন্তি নিগৃহুন্তি তে য়মাঃ ন্যায়াধীশাঃ, যাঁহারা দুষ্টজনের দণ্ডদাতা এবং শ্রেষ্ঠজনের। পালনকর্তা এবং যাঁহারা ন্যায়কারী তাঁহারা যম।

‘য়ঃ পাতি স পিতা’ যিনি সন্তানগণের অন্নদাতা ও যিনি স্নেহের সহিত তাহাদিগকে রক্ষা করেন অথবা যিনি জন্মদাতা পিতা। পিতুঃ পিতা পিতামহঃ, পিতামহস্য পিতা প্রপিতামহঃ যিনি পিতার পিতা তিনি পিতামহ যিনি পিতামহের পিতা তিনি প্রপিতামহ। য়া মানয়তি সা মাতা’ যিনি অন্ন। এবং আদর যত্ন সহকারে সন্তানদের মান্য করেন তিনি মাতা’। য়া পিতৃমাতা সা পিতামহী, পিতামহস্য মাতা, প্রপিতামহী, যিনি পিতার মাতা তিনি পিতামহী’ এবং যিনি পিতামহের মাতা। তিনি প্রপিতামহী’। নিজের স্ত্রী, ভগ্নী, আত্মীয়, সগোত্র এবং অপর কোন ভদ্রপুরুষ বা বৃদ্ধ–তাহাদের সকলকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সহিত উত্তম অন্ন, বস্ত্র এবং সুন্দর যান প্রভৃতি প্রদান। করিয়া সম্যকরূপে তাহাদের পরিতৃপ্ত করা, অর্থাৎ যে সকল কাৰ্য্য দ্বারা তাহাদের আত্মা তৃপ্ত হয় ও শরীর সুস্থ থাকে, সেই সকল কাৰ্য্য করিয়া প্রীতির সহিত তাহাদের সেবা করাকে ‘শ্রাদ্ধ’ এবং তর্পণ’ বলে।

চতুর্থ –‘বৈশ্বদেব’ অর্থাৎ ভোজন প্রস্তুত হইলে সেই ভোজ্যবস্তু হইতে অম্ল, লবণাক্ত ও ক্ষারযুক্ত পদার্থ ব্যতীত ঘৃত মিশ্রিত মিষ্টান্ন লইয়া চুল্লী হইতে অগ্নিকে পৃথক করিয়া সেই অগ্নিতে নিম্নলিখিত মন্ত্র দ্বারা আহুতি প্রদান করিবে এবং অন্ন ভাগ করিবে :

বৈশ্যদেবস্য সিদ্ধস্য গৃহ্যেগ্নেী বিধিপূর্বকম্ ॥ আভ্যঃ কুয়াদ্দেবতাভ্যো ব্রাহ্মণণা হোমমন্বহম্ ॥মনু ॥

ভোজনার্থ পাকশালায় যাহা পাক করা হয়, তাহার দিব্যগুণের জন্য সেই পাকাগ্নিতে নিম্নলিখিত মন্ত্র দ্বারা বিধিপূর্বক নিত্য হোম করিবে —

[হোমের মন্ত্রী]

ওঅগ্নয়ে স্বাহা। সোমায় স্বাহা। অগ্নীষোমাভ্যাং স্বাহা। বিশ্বভ্যো দেবেভ্যঃ স্বাহা। ধন্বন্তরয়ে স্বাহা। কুহ্বৈ স্বাহা। অনুমত্যৈ স্বাহা। প্রজাপতয়ে স্বাহা। সহ দ্যাবাপৃথিবীভ্যাং স্বাহা। স্বিষ্টকৃতে স্বাহা ॥

উল্লিখিত প্রত্যেক মন্ত্র দ্বারা প্রজ্বলিত অগ্নিতে এক একবার আহুতি দিবে। পরে থালায় অথবা। ভূমিতে পাতা রাখিয়া উহাতে পূর্বদিক হইতে যথাক্রমে এই মন্ত্রসমূহ দ্বারা (পান্ন) ভাগ করিবে :–

ও সানুগায়েন্দ্রায় নমঃ। সানুগায় য়মায় নমঃ। সানুগায় বরুণায় নমঃ। সানুগায় সোমায় নম। মরুদূভ্যো নমঃ। অভ্যো নমঃ। বনস্পতিভ্যো নমঃ। শ্রিয়ৈ নমঃ। ভদ্রকাল্যৈ নমঃ। ব্রহ্মপতয়ে নমঃ। বাস্তূপতয়ে নমঃ। বিশ্বেভ্যো দেবেভ্যো নমঃ। দিবাচরেভ্যো ভূতেভ্যো নমঃ। নক্তঞ্চারিভ্যো ভূতেভ্যো নমঃ। সর্বাত্মভূতয়ে নমঃ ॥ [মনু০৩। ৮৭-৯১-র আধারে।]

এই ভাগগুলি কোনও অতিথি থাকিলে তাহাকে ভোজন করাইবে, নতুবা অগ্নিতে অর্পণ। করিবে। অতঃপর লবণান্ন অর্থাৎ ডাল, ভাত, তরকারী, রুটী, প্রভৃতি লইয়া ভূমিতে ছয়টি ভাগ করিবে। এ বিষয়ে প্রমাণ —

শুনাং চ পতিতানাঞ্চ শপচাং পাপরোগিণাম। বায়সানাংকৃমীণাং চশনকৈনিবপেদভূবি ॥ মনু০ ॥

এইরূপে ‘শ্বভ্যো নমঃ’, ‘পতিতেভ্যো নমঃ’, ‘শ্বপভ্যো নমঃ ‘পাপরোগিভ্যো নমঃ’, বায়সেভ্যো নমঃ’, কৃমিভ্যো নমঃ’ বলিয়া পৃথক পৃথক ভাগ রাখিয়া পরে কোন দুঃখী, ক্ষুধার্ত প্রাণী অথবা কুকুর, কাক প্রভৃতিকে দিবে। এস্থলে নমঃ শব্দের অর্থ–অন্ন। কুকুর, পাপী, চণ্ডাল এবং কৃমি অর্থাৎ পিপীলিকা আদিতে অন্নদানের বিধি মনুস্মৃতি ইত্যাদিতে আছে।

হবন করিবার প্রয়োজন এই যে, তদ্বারা পাকশালাস্থ বায়ু শুদ্ধ, এবং (পাকের জন্য অনেক অজ্ঞাত এবং অদৃষ্ট জীবের যে হত্যা করা হয় তজ্জন্য প্রত্যুপকার করা।

পঞ্চম ‘অতিথি সেবা’–যাহার কোন তিথি নিশ্চিত থাকে না, তাহাকে ‘অতিথি’ বলে। অর্থাৎ কোন ধার্মিক, সত্যোপদেশক, সকলের উপকারার্থে সর্বত্র ভ্রমণকারী, পূর্ণ বিদ্বান, পরমযোগী, সন্ন্যাসী অকস্মাৎ গৃহস্থের বাড়ীতে উপস্থিত হইলে তাহাকে প্রথমতঃ পাদ্য, অর্ঘ্য, এবং আচমনীয় এই তিন প্রকার জল দিয়া, পরে সসম্মানে আসনে বসাইয়া ভোজ্য ও পানীয় উত্তম সামগ্রী দ্বারা সেবা, শুশ্রূষা করিয়া সন্তুষ্ট করিবে। তৎপর তাহার সৎসঙ্গ লাভ করিয়া তাহার নিকট ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষজনক জ্ঞান-বিজ্ঞানাদি বিষয়ক উপদেশ শ্রবণ এবং তাহার সদুপদেশ অনুসারে আচরণ করিবে। সময়ানুসারে গৃহস্থ এবং রাজা প্রভৃতিও অতিথির ন্যায় সম্মানযোগ্য। কিন্তু ও

পাষণ্ডিনো বিকৰ্মস্থা বৈডালবৃত্তিকাঠা। হৈতুকা বকবৃত্তীংশ্চ বাঙমাত্রেণাপিনাৰ্চয়েৎ ॥ মনু।

(অর্থ) ‘পাষণ্ডী অর্থাৎ বেদনিন্দক ও বেদবিরুদ্ধ আচরণকারী, বিকর্মস্থ’ বেদবিরুদ্ধ কর্মের কৰ্ত্তা, মিথ্যাবাদী, ‘বৈডালবৃত্তিক’ যথা, বিড়াল যেমন স্থিরভাবে লুক্কায়িত থাকিয়া দেখিতে দেখিতে সহসা মুষিকাদি প্রাণীকে বধ করিয়া উদর পূর্ণ করে, সেইরূপ আচরণকারীকে বৈড়ালবৃত্তিক বলে; শঠ’অর্থাৎ হঠকারী, দুরাগ্রহী, অভিমানী, যাহারা স্বয়ং জানে না এবং অন্যের কথা গ্রাহ্যও করে না। “হৈতুক =কুতার্কিক, বৃথাবাক্যব্যয়কারী, যেমন আধুনিক বেদান্তিগণ বলিয়া থাকে, ‘আমি ব্রহ্ম, জগৎ মিথ্যা; বেদাদি শাস্ত্র, ঈশ্বরও কল্পিত ইত্যাদি গালভরা গল্প যাহারা করে এবং ‘বকবৃত্তি’ যথা,–বক যেমন এক পা উঠাইয়া ধ্যানাবস্থিতের ন্যায় থাকিয়া নিমেষে মৎস্যের প্রাণ হরণ করিয়া স্বার্থসিদ্ধি করে, সেইরূপ এখানকার যে সকল বৈরাগী এবং খাখী প্রভৃতি হঠকারী, দুরাগ্রহী এবং বেদবিরোধী আছে বাক্য দ্বারাও তাহাদের সম্মান করা উচিত নহে। কারণ ইহাদের সম্মান করিলে ইহারা প্রবল হইয়া সংসারকে অধর্ম যুক্ত করে। নিজেরা ত অবনতির কর্ম করেই, সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় সেবকদেরও অবিদ্যা রূপী মহাসাগরে ডুবায়।

এই পঞ্চ মহাযজ্ঞের ফল এই যে, ব্রহ্মযজ্ঞ দ্বারা বিদ্যা, শিক্ষা, ধর্ম এবং সভ্যতা ইত্যাদি শুভ গুণের বৃদ্ধি হয়। অগ্নিহোত্র’ দ্বারা বায়ু, বৃষ্টি এবং জলের শুদ্ধি হয়। বৃষ্টি দ্বারা জগতের সুখলাভ হয়, অর্থাৎ বিশুদ্ধ বায়ুর নিঃশ্বাস, স্পর্শ এবং পান ভোজন দ্বারা আরোগ্য, বুদ্ধি, বল এবং পরাক্রম বর্ধিত হয়। তদ্বারা ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষের অনুষ্ঠান পূর্ণ হয়। এই জন্য ইহাকে ‘দেবযজ্ঞ’ বলা হয়।

‘পিতৃযজ্ঞ’ দ্বারা মাতা,পিতা এবং জ্ঞানী মহাত্মাজনের সেবা করিলে জ্ঞান বৃদ্ধি হইবে। উহা দ্বারা সত্যাসত্য নির্ণয় করিয়া সত্যগ্রহণ এবং অসত্য বর্জন করিয়া করিয়া সুখী হইবে। দ্বিতীয়তঃ কৃতজ্ঞতা অর্থাৎ মাতা, পিতা এবং আচাৰ্য্য সন্তান ও শিষ্যদিগের যে উপকার করেন, তাহার প্রতিদান দেওয়া অবশ্য কর্তব্য।

বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞের ফল পূর্বে যাহা বলা হইয়াছে তাহাই জানিবে। অতিথিযজ্ঞ যতদিন পর্যন্ত জগতে শ্রেষ্ঠ অতিথির আবির্ভাব না ঘটে, ততদিন পর্যন্ত উন্নতিও হয় না। তাহারা বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করিয়া সত্যোপদেশ প্রদান করেন বলিয়া ভণ্ডামি বৃদ্ধি পায় না। গৃহস্থদিগের সর্বত্র সহজে সত্যবিজ্ঞান। লাভ হইতে থাকে এবং সকল মনুষ্য একই ধর্মে স্থির থাকে। অতিথি ব্যতীত সংশয়ের নিবৃত্তি হয় না। এবং সংশয়-নিবৃত্তি ব্যতীত দৃঢ়নিশ্চয়ও হয় না। দৃঢ় নিশ্চয় না হইলে সুখ কোথায়?

ব্রাহ্মো মুহূর্তে বুধ্যে ধর্মার্থেী চানুচিন্তয়েৎ। কায়ক্লেশাংশ্চ তন্মুলাং বেদতত্ত্বাৰ্থমেব চ ॥১॥ মনু ৪।৯২

রাত্রির চতুর্থ প্রহরে অথবা চারি ঘটিকার সময় উঠিয়া আবশ্যকীয় কর্ম করিবার পর ধর্ম ও অর্থ, শারীরিক রোগ সমূহের নিদান বিষয়ে চিন্তা এবং পরমাত্মার ধ্যান করিবে। কখনও অধর্মাচরণ করিবে না ॥১॥ কারণ :

নাধর্মশ্চরিতো লোকে সদ্যঃ ফলতি গৌরিব। শনৈরাবৰ্তমানস্তু কর্মুলানি কৃতি ॥ ২ ॥ মনু।

কৃত অধর্ম কখনও নিষ্ফল হয় না। তবে যে সময় অধর্ম করা হয় সেই সময়ই ফল হয় না। এই কারণে অজ্ঞ লোকেরা অধর্ম হইতে ভীত হয় না। তথাপি নিশ্চয় জানিতে হইবে যে, সেই অধর্মাচারণ ধীরে ধীরে তোমাদের সুখের মূলোচ্ছেদ করিতে থাকে ॥ ২৷ এই নিয়মানুসারে —

অধর্মেণৈধতে তাবত্ততো ভদ্ৰাণি পশ্যতি ॥ ততঃ সপত্নান্ জয়তি সমূলস্তুবিনশ্যতি ॥ ৩ ॥ মনু

(জলাশয়ে জল যেমন বাঁধ ভাঙিয়া চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়ে, সেইরূপ) অধর্মাত্মিক মনুষ্য ধর্মের মর্যাদা হারাইয়া মিথ্যা ভাষণ, কপটতা, পাষণ্ডোচিত আচরণ করে অর্থাৎ রক্ষাকারী বেদ সমূহের। খণ্ডন এবং বিশ্বাসঘাতকতা প্রভৃতি কুকর্ম দ্বারা পরস্পাপহরণ করিয়া প্রথমে সমৃদ্ধশালী হয়, পরে ধন এবং ঐশ্বৰ্য্য দ্বারা ভোজ্য, পানীয়, বস্ত্র, আভূষণ, যান, মান, খ্যাতি, প্রতিপত্তি লাভ করে। যে অন্যায়ের সাহায্যে শত্রুকেও জয় করে, অবশেষে শীঘ্রই সেই অধর্মাচরণকারী ব্যক্তি ছিন্নমূল বৃক্ষের ন্যায় নষ্ট হইয়া যায় ॥ ৩ ॥

সত্যধর্মায়বৃত্তে শৌচে চৈবারমেৎ সদা। শিষ্যাংশ্চ শিষ্যাদ্ধর্মের্ণ বাগ্ৰাহুদরসহয়তঃ ॥ ৪ ॥ মনু

বেদোক্ত ‘সত্যধর্ম অর্থাৎ পক্ষপাত রহিত হইয়া সত্যগ্রহণ ও অসত্যবর্জন করিয়া ন্যায়রূপ বেদোক্ত ধর্মাদি; আৰ্য্য (বৃত্তেফ্ট) অর্থাৎ উত্তম পুরুষদের গুণ, কর্ম, স্বভাব; এবং সদা পবিত্রতায়। বিচরণ করিবে। বাণী, বাহু, উদর আদি অঙ্গের সংযম অর্থাৎ ধর্মপথে চালনা করিয়া শিষ্যাদিগকে ধর্ম শিক্ষাদান করিতে থাকিবে৷ ৪ ॥

ঋত্বিকপুরোহিতাচাৰ্যৰ্মাতুলাতিথিসংশিতৈঃ। বালবৃদ্ধাতুরৈর্বৈদৈৰ্জাতিসম্বন্ধিবান্ধবৈঃ ॥১॥ মাতাপিতৃভ্যাংয়ামীভির্ভাতা পুত্রেণভায়য়া ॥ দুহিত্রা দাসবর্গেণ বিবাদং ন সমাচরেৎ ॥ ২ ॥ মনু

(ঋত্বিক) যজ্ঞকর্তা, (পুরোহিত) সর্বদা সদাচার শিক্ষাদাতা, (আচাৰ্য) বিদ্যা অধ্যাপনকারী, (মাতুল) মামা, (অতিথি) অর্থাৎ যাঁহার কোনও গমনাগমনের নিশ্চিত তিথি নাই, (সংশিত) নিজের আশ্রিত, (বাল) বালক, (বৃদ্ধ) বয়স্ক ব্যক্তি, (আতুর) পীড়িত, (বৈদ্য), আয়ুবেদের জ্ঞাতা, (জাতি) স্বগোত্রীয় বা স্ববর্ণস্থ, (সম্বন্ধী) শ্বশুরাদি, (বান্ধব) মিত্র ॥১॥

(মাতা) মাতা, (পিতা) পিতা, (আমি) ভগ্নী, (ভ্রাতা) ভাই, (ভায়া) স্ত্রী, (পুত্র) পুত্র, (দুহিতা) কন্যা এবং (দাসবর্গ), সেবকদের সহিত কলহ বিবাদ অর্থাৎ বিরুদ্ধাচারণ করিবে না।

অতপান্ত্বনধীয়ানঃ প্রতিগ্রহরুচির্জিঃ ॥ অম্ভস্যশ্মপ্লবেনৈব সহ তেনৈব মজ্জতি ॥১॥ মনু

প্রথম (অপাঃ) ব্রহ্মচর্য্য এবং সত্যভাষণাদি তপবিহীন, দ্বিতীয় (অনধীয়ানঃ) অধ্যয়ন হীন, তৃতীয় (প্রতি গ্রহরুচিঃ) ধর্মার্থ অন্যের নিকট হইতে অত্যধিক গ্রহণকারী এই তিনজন প্রস্তর নির্মিত নৌকা যাত্রায় সমুদ্রতরণকারীর ন্যায় স্বকীয় দুষ্কর্মের সহিতই দুঃখসাগরে নিমজ্জিত হয়। তাহারা স্বয়ং ত ডুবিয়াই থাকে, সঙ্গে সঙ্গে দাতাকেও ডুবাইয়া মারে ॥১॥

ত্রিম্বপ্যেতেষু দত্তং হিবিধিনাপ্যর্জিতং ধনম। দাতুৰ্ভবত্যনৰ্থায় পরত্রাদাতুরে চ ॥ ২ ॥ মনু

যে ব্যক্তি ধর্ম দ্বারা উপলব্ধ ধন উক্ত তিনজনকে দান করে, সে দাতার ইহজন্মেই এবং গ্রহীতার পরজন্মে নাশ ঘটে৷২ ॥

যদি তাহারা এরূপ হয় তাহা হইলে কী হইবে?

যথা প্লবেনৌপলেন নিমজ্জত্যুদকে তরম্ ॥ তথা নিমজ্জতো ধস্তাদজ্ঞেী দাতৃপ্রতীচ্ছকৌ ॥ ৩ ॥ মনু

যেরূপ প্রস্তরের নৌকায় বসিয়া সন্তরণকারী জলে ডুবিয়া যায়; সেইরূপ অজ্ঞানী দাতা এবং গ্রহীতা উভয়ই অধোগতি অর্থাৎ দুঃখভোগ করে ৷৩ ॥

পান্ডদের লক্ষণ
ধৰ্ম্মজী সদা লুব্ধচ্ছাদ্মিকো লোকদম্ভকঃ। বৈডালতিকো জ্ঞেয়য়া হিংস্র সর্বাভিসন্ধকঃ ॥১॥ অধোদৃষ্টিনৈষ্কৃতিকঃ স্বার্থসাধনতৎপরঃ। শঠো মিথ্যাবিনীতশ্চ বকব্রতচরো দ্বিজঃ ॥ ২॥ মনু

(ধর্মধ্বজী) যে ব্যক্তি ধর্মের কিছুই করে না, কিন্তু ধর্মের নামে মানুষকে প্রতারণা করে,(সদালুব্ধ) সর্বদা লোভী, (ছাদ্মিকঃ) কপট, (লোকদম্ভকঃ) সংসারী লোকের সম্মুখে নিজ মহত্ত্বের গল্প করে (হিংস্রঃ) প্রাণিঘাতক, অন্যের প্রতি বৈরবুদ্ধি সম্পন্ন, (সর্বাভিসন্ধকঃ) উত্তম, অধম সকলের সহিত মিলিয়া মিশিয়া থাকে, তাহাকে ‘বৈডালব্ৰতিকঃ”অর্থাৎ বিড়ালের ন্যায় ধূৰ্ত্ত ও নীচ মনে করিবে ॥ ১।

(অধোদৃষ্টি) যে কীর্তির জন্য নিম্নদিকে দৃষ্টিপাত করে, (নৈষ্কৃতিকঃ) ঈষা যুক্ত অর্থাৎ কেহ তাহার বিরুদ্ধে তিলমাত্র অপরাধ করিলেও সে তাহাকে হত্যা পর্যন্ত করিতে প্রস্তুত হয়, (স্বার্থসাধনতৎপরঃ) কপটতা, অধর্ম এবং বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াও স্বার্থসিদ্ধি করিতে নিপুণ (শঠঃ) নিজের কথা মিথ্যা হইলেও যে কখনও জিদ ছাড়ে না, (মিথ্যাবিনীতঃ) মিছামিছি উপর উপর শীল, সন্তোষ ও সাধুতা দেখায়, তাহাকে (বকব্রতঃ) বকের ন্যায় নীচ মনে করিবে। এই সকল লক্ষণান্বিত লোকেরা পাষণ্ড। তাহাদের কখনও বিশ্বাস করিবে না ॥ ২॥

ধর্মং শনৈঃ সঞ্চিনুয়াদ্বল্মীকমিব পুত্তিকাঃ ॥ পরলোকসহায়ার্থং সর্বভূতানপীডয়ন ॥১॥ নামুত্র হিসহায়ার্থং পিতা মাতা চতিষ্ঠতঃ। ন পুত্রদারংন জ্ঞাতিধর্মস্তিষ্ঠতি কেবলঃ ॥২॥ একঃ প্রজায়তে জন্তুরেক এব প্রলীয়তে। একোনুভুঙক্তে সুকৃতমেক এব চ দুষ্কৃতম্ ॥৩ ॥ মনু ॥ একঃ পাপানি কুরুতে ফলং ভুতে মহাজনঃ। ভোক্তারো বিপ্রমুচ্যন্তে কৰ্ত্তা দোষেণ লিপ্যতে ॥ ৪ ॥ মহা উদ্যোগ পর্ব। মৃতং শরীরমুৎসৃজ্য কাষ্ঠলোষ্ঠসমং ক্ষিতৌ। বিমুখা বান্ধবায়ান্তি ধর্মমনুগচ্ছতি ॥ ৫ ॥ মনু ০ ॥

পুত্তিকা অর্থাৎ উইপোকা যেরূপ বল্মীক (উই ঢিপি) প্রস্তুত করে, সেইরূপ কোনও প্রাণীকে উৎপীড়িত না করিয়া পরলোক অর্থাৎ পরজন্মের সুখার্থে ধীরে ধীরে ধর্ম সঞ্চয় করা নরনারীর একমাত্র কর্তব্য ॥১॥

কেননা, পরলোকে মাতা-পিতা, পুত্র, স্ত্রী এবং জ্ঞাতি কেহই সহায়তা করিতে পারে না, কিন্তু ধর্মই একমাত্র সহায়ক হইয়া থাকে ॥ ২॥

দেখুন। জীব একাকীই জন্মগ্রহণ করে, একাকীই মৃত্যুমুখে যায়, এবং একাকীই ধর্মের ফল সুখ এবং অধর্মের দুঃখ ভোগ করে ৷ ৩ ॥

ইহাও বুঝা উচিত, পরিবারের একজন পাপ করিয়া যাহা সংগ্রহ করে, মহাজন অর্থাৎ আত্মীয় স্বজন সকলেই তাহা ভোগ করে। যাহারা ভোগ করে, তাহারা পাপের ভাগী হয় না, কিন্তু যে পাপ। করে, সেই পাপের ফল ভোগ করে। ॥ ৪ ॥

যখন কাহারও কোন আত্মীয়ের মৃত্যু হয়, তখন তাহাকে কাষ্ঠখণ্ড ও মৃৎপিণ্ডের ন্যায় ভূমিতে ফেলিয়া চলিয়া যায়, বন্ধুগণ বিমুখ হইয়া প্রস্থান করে। কেহই তাহার সহিত যাইতে চায় না। কিন্তু একমাত্র ধর্মই তাহার সঙ্গী হইয়া গমন করে ॥ ৫ ॥

তস্মাদ্ধৰ্মংসহায়ার্থং নিত্যংসঞ্চিনুয়াচ্ছনৈঃ। ধর্মেণ হি সহায়েন তমস্তরতি দুস্তরম্ ॥১॥ ধর্মপ্রধানং পুরুষং তপসা হতকিন্বিষম্ ॥ পরলোকে নয়ত্যাশু ভাস্বন্তং খশরীরিণম ॥ ২॥ মনু ॥

অতএব, পরলোক অর্থাৎ পরজন্মে সুখ এবং [এই] জন্মের সাহায্যার্থে ধীরে ধীরে সর্বদা ধৰ্ম্ম সঞ্চয় করিতে থাকিবে। কারণ ধর্মের সাহায্যে বিশাল এবং দুস্তর দুঃখসাগর পার হওয়া যায় ॥১ ॥

কিন্তু যিনি ধর্মকে প্রধান মনে করেন এবং ধর্মানুষ্ঠান দ্বারা যাঁহার কৃত পাপ দূরীভূত হইয়াছে, তাহাকে প্রকাশস্বরূপ এবং আকাশ যাহার শরীর তুল্য সেই পরলোককে অর্থাৎ পরম দর্শনীয়। পরমাত্মাকে ধর্মই শীঘ্র প্রাপ্ত করাইয়া থাকে ॥ ২৷ অতএব—

দৃঢ়কারী মৃদুর্দান্তঃ ক্রুরাচারৈরসংবস। অহিংস্রো দমদানাভ্যাং জয়েৎস্বর্গংতথাব্ৰতঃ ॥১॥ বাচ্যার্থানিয়তাঃ সর্বে বাঙ্মূলা বাঘিনিঃসৃতাঃ। তান্তুয়ঃ স্তেনয়ে বাচংস সর্বস্তেয়কৃন্নরঃ ॥২॥ আচারল্লভতে হ্যাঁয়ুরাচারাদীপ্সিতাঃ প্রজাঃ। আচারান্ধনমক্ষয়্যমাচারো হত্যলক্ষণ ॥ ৩ ॥ মনু ॥

যিনি ধর্মাত্মা তিনি সর্বদা দৃঢ়কর্মা, কোমল স্বভাব ও জিতেন্দ্রিয়, যিনি হিংসক, ক্রুর এবং দুষ্টাচারীদিগের নিকট হইতে দূরে থাকেন, তিনি মনকে জয় করিয়া বিদ্যাদি দান দ্বারা সুখ লাভ করিয়া থাকেন ॥ ১ ॥

কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, বাণীর মধ্যে (সকল) অর্থ অর্থাৎ ব্যবহার নিশ্চিত থাকে, সেই বাণীই তাহার মূল এবং সেই বাণীর দ্বারা সকল ব্যবহার নিষ্পন্ন হইয়া থাকে যে ব্যক্তি সেই বাণীকে অপহরণ করে, অর্থাৎ মিথ্যা কথা বলে, সে চৌর্য্য প্রভৃতি সমস্ত পাপের কর্তা ॥২॥

সুতরাং যিনি মিথ্যাভাষণদিরূপ অধর্ম পরিত্যাগ করিয়া ধর্মাচরণ অর্থাৎব্রহ্মচর্য্য ও জিতেন্দ্রিয়তা দ্বারা পূর্ণ আয়ু, ধর্মাচরণ দ্বারা উত্তম প্রজা এবং অক্ষয় ধন প্রাপ্ত হন এবং যিনি ধর্মাচরণে রত থাকিয়া কু-লক্ষণ সমূহ নাশ করেন, তাঁহার ন্যায় আচরণ সর্বদা কর্তব্য ॥৩৷ কারণ : দুরাচারো হি পুরুষো লোকে ভবতি নিন্দিতঃ।

দুঃখভোগী চ সততং ব্যাধিতো ল্পায়ুরেব চ ॥১॥ মনু

যে ব্যক্তি দুরাচারী সে সংসারে সৎপুরুষদিগের মধ্যে নিন্দাভাজন ও দুঃখভাগী হয় এবং নিরন্তর ব্যাধিগ্রস্ত হইয়া অল্পায়ু ভোগ করে ॥ ১৷ অতএব এরূপ চেষ্টা করিবে :

অদ্যৎ পরবশং কর্ম তত্তদ্যত্নেন বর্জয়েৎ । অদ্যদাত্মবশং তু স্যাত্তৎ সেবেতয়ত্নতঃ ॥১॥ সর্বং পরবশং দুঃখং সর্বাত্মবশং সুখম্। এতদ্বিদ্যাৎ সমাসেন লক্ষণং সুখদুঃখয়োঃ ॥ ২ ॥ মনু ॥

যাহা যাহা পরাধীন কর্ম তাহা তাহা যত্ন পূর্বক পরিত্যাগ করিবে এবং যাহা যাহা স্বাধীন কর্ম তাহা তাহা যত্ন সহকারে গ্রহণ করিবে ॥১॥

কারণ, যাহা যাহা পরাধীন কর্ম তাহা তাহা দুঃখ এবং যাহা যাহা স্বাধীন কর্ম তাহা তাহা সুখ। ইহাই সংক্ষেপে সুখদুঃখের লক্ষণ বলিয়া জানা উচিত ॥২॥

কিন্তু যে কর্ম পরস্পরের অধীন, তাহা অধীন ভাবেই করা কর্ত্তব্য। যেমন স্ত্রী পুরুষের মধ্যে পরস্পরের অধীন ব্যবহার। অর্থাৎ স্ত্রী-পুরুষের প্রতি এবং পুরুষ স্ত্রীর প্রতি পরস্পর প্রিয় আচরণ করিবে এবং পরস্পরের অনুকূল থাকিবে। তাহারা কখনও ব্যাভিচার এবং বিরোধ করিবে না। স্ত্রী পুরুষের আজ্ঞানুসারে গৃহকর্ম করিবে এবং বাহিরের কাৰ্য্য পুরুষের অধীনে থাকিবে। স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরকে দুষ্ট ব্যসনে আসক্ত হইতে বাধা দিবে। ইহা নিশ্চয় জানা আবশ্যক যে, বিবাহের পর পুরুষ স্ত্রীর নিকট এবং স্ত্রী পুরুষের নিকট বিক্রীত হইয়া যায়, অর্থাৎ স্ত্রী পুরুষদের হাবভাব এমন কি নখশিখাগ্র পর্যন্ত এবং বীৰ্য্যাদি সমস্ত পরস্পরের অধীন হইয়া যায়। স্ত্রীপুরুষ পরস্পরের প্রসন্নতা ব্যতীত কোন ব্যবহার করিবে না। তাহাদের মধ্যে ব্যভিচার অর্থাৎ বেশ্যাগমন এবং পরপুরুষ সংসর্গ প্রভৃতি বড়ই অপ্রীতিকর কাৰ্য। এই সকল পরিত্যাগ করিয়া স্ত্রী স্বামীর প্রতি এবং স্বামী স্ত্রীর প্রতি সর্বদা প্রসন্ন থাকিবে।

পুরুষ ব্রাহ্মণ বর্ণের হইলে বালকদিগকে এবং স্ত্রী সুশিক্ষিতা হইলে বালিকাদিগকে বিদ্যা শিক্ষা দিবে। তাহারা বহুবিধ উপদেশ ও বক্তৃতা দ্বারা তাহাদিগকে বিদ্বান্ করিবে, পত্নীর পূজনীয় দেব পতি এবং পতির পুজনীয়া পত্নী অর্থাৎ সম্মান যোগ্য দেবী। ইহারা যতদিন গুরুকুলে থাকিবে, ততদিন অধ্যাপকদিগকে মাতা পিতার তুল্য মনে করিবে। অধ্যাপকগণেরাও শিষ্যদিগকে নিজ সন্তান সদৃশ মনে করিবে ॥

অধ্যাপক ও অধ্যাপিকা কীরূপ হইয়া উচিত : আত্মজ্ঞানং সমারম্ভস্তিতিক্ষা ধর্মনিত্যতা। সমর্থা নাপকর্ষন্তি স বৈ পণ্ডিত উচ্যতে ॥ ১ ॥ নিষেবতে প্রশস্তানি নিন্দিতানিন সেবতে। অনাস্তিকঃ শ্ৰদ্দধান এতৎ পণ্ডিতলক্ষণম ॥ ২ ॥ ক্ষিপ্রংবিজানাতি চিরংশৃণোতি, বিজ্ঞায় চার্থং ভজতেন কামাৎ। নাসম্পৃষ্টোন্ধ্যপয়ুঙক্তে পরার্থে, । তৎ প্রজ্ঞানং প্রথমং পণ্ডিতস্য ॥ ৩ ॥ নাপ্রাপ্যমভিবাঞ্ছন্তি নষ্টং নেচ্ছন্তি শাচিতুম্‌। আপৎসু চন মুহান্তি নরাঃ পণ্ডিতবুদ্ধয়ঃ ॥ ৪ ॥ প্রবৃত্তবাচিত্রকথউহবা প্রতিভাবান ॥ আশু গ্রন্থস্য বক্তা চ য়ঃ স পণ্ডিত উচ্যতে ॥ ৫ ॥

তং প্রজ্ঞানুগং য়স্য প্রজ্ঞা চৈব শ্রুতানুগা। অসংভিন্নায়মর্যাদঃ পণ্ডিতাখ্যাংলতে সঃ ॥ ৬ ॥ এগুলি মহাভারতের উদ্যোগ পর্বের বিদুর প্রজাগরের শ্লোক ॥

অর্থ :- যাঁহার আত্মজ্ঞান; সম্যক্ আরম্ভ অর্থাৎ যিনি কখনও নিষ্কর্মা ও অলস থাকেন না, যিনি সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি, মান-অপমান এবং নিন্দা স্তুতিতে কখনও হর্ষ, শোক করেন না, যিনি

সর্বদাই ধর্মেই স্থির থাকেন এবং উৎকৃষ্ট পদার্থ অর্থাৎ বিষয় বিষয়ক বস্তু যাঁহার চিত্তকে আকর্ষণ। করিতে পারে না তাহাকেই ‘পণ্ডিত’ বলে ॥ ১ ॥

সর্বদা ধর্মসঙ্গতকাৰ্য্য করা, অধর্মযুক্ত কাৰ্য্য পরিত্যাগ করা, বেদ ও সদাচারের নিন্দা না করা। এবং ঈশ্বরাদিতে অত্যন্ত শ্রদ্ধবান্ হওয়া –ইহাই ‘পণ্ডিতদের কর্তব্য কর্ম ॥ ২ ॥

যিনি কঠিন বিষয়ও শীঘ্ৰ বুঝিতে পারেন, যিনি দীর্ঘকাল শাস্ত্রাধ্যয়ন, শ্রবণ এবং বিচার করেন, যিনি তাহার সমস্ত জ্ঞান পরোপকারে নিয়োজিত করেন, যিনি স্বার্থের জন্য কোনও কাৰ্য্য করেন না

এবং যিনি জিজ্ঞাসিত না হইয়া অথবা উপযুক্ত সময় না বুঝিয়া অন্যের ব্যাপারে সম্মতিদান করেন। না, তাঁহাকেই শ্রেষ্ঠ প্রাজ্ঞ ‘পণ্ডিত’ বলিয়া জানিবে ॥৩ ॥

যিনি প্রাপ্তির অযোগ্য বস্তু কখনও পাইতে ইচ্ছা করেন না। যিনি নষ্ট পদার্থের জন্য শোক। করেন না এবং যিনি বিপদের সময় মোহগ্রন্ত অর্থাৎ ব্যাকুল হন না, তিনিই বুদ্ধিমান পণ্ডিত ॥ ৪ ॥

যাঁহার বাণী সমস্ত বিদ্যা বিষয়ে প্রশ্নোত্তর করিতে অতিনিপুণ, যিনি বিচিত্র শাস্ত্র প্রকরণের। বক্তা, যথাযোগ্য তার্কিক ও স্মৃতিবান। যিনি গ্রন্থের যথার্থ অর্থের শীঘ্র বক্তা, তাঁহাকেই ‘পণ্ডিত’ বলে ॥ ৫ ॥

যাহার প্রজ্ঞা শ্রুত সত্যার্থের অনুকূল, যাঁহার শ্রবণ বুদ্ধির অনুযায়ী এবং যিনি কখনও আৰ্য অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ধার্মিক ব্যক্তিদিগের মর্যাদা ভঙ্গ করেন না, তাহাকেই ‘পণ্ডিত’ বলে ॥ ৬ ॥

যে স্থানে ঈদৃশ স্ত্রীপুরুষ অধ্যাপক ও অধ্যাপিকা থাকেন, সে স্থানে বিদ্যা ধর্ম এবং সদাচার বৰ্ধিত হয় বলিয়া প্রতিদিন আনন্দ বৃদ্ধি পাইতে থাকে।

অধ্যয়নের অযোগ্য এবং মুখের লক্ষণ : অঞতশ্চসমুন্নদ্ধো দরিদ্রশ্চ মহামনাঃ। অর্থাংশ্চাকর্মণা পেলুমূঢ় ইত্যুচ্যতে বুধৈঃ ॥ ১ ॥ অনাহূতঃ প্রবিশতিহ্যপৃষ্টো বহু ভাষতে অবিশ্বস্তে বিশ্বসিতি মূঢ়চেতানরাধমঃ ॥ ২ ॥ এই শ্লোকমহাভারতের উদ্যোগ পর্বে বিদুর প্রজাগরে আছে ॥ ৷

অর্থ : –যে ব্যক্তি কোনও শাস্ত্র পাঠ বা শ্রবণ করে নাই, যে অতিশয় গর্বিত, যে দরিদ্র হইয়াও উচ্চাকাঙ্খী এবং যে কর্ম না করিয়াও ধন সম্পত্তি পাইবার ইচ্ছা করে, তাহাকেই বুদ্ধিমান লোকেরা মূঢ়’ বলে ॥ ১ ॥

যে বিনা আমন্ত্রণে কোন সভায় অথবা কাহারও গৃহে প্রবেশ করিয়া, উচ্চাসনে উপবেশন করিতে ইচ্ছা করে, জিজ্ঞাসা না করিলেও সভায় বহু বৃথাবাক্য ব্যয় করে এবং যে বিশ্বাসের অযোগ্য বস্তুতে বামনুষ্যে বিশ্বাস করে তাহাকেই মূঢ়’এবং নরাধম বলে ॥ ২ ॥

যে স্থানে ঈদৃশ পুরুষ অধ্যাপক, উপদেশক, গুরু এবং মাননীয় ব্যক্তি থাকে সে স্থানে অবিদ্যা, অধর্ম, অসভ্যতা, কলহ, বিরোধ এবং বিভেদ বর্ধিত হওয়াতে দুঃখই বাড়িয়া যায়।

এখন বিদ্যার্থীদিগের লক্ষণ–
আলস্যং মদমোহৌ চ চাপল্যং গোষ্ঠিরেব চ। স্তব্ধতা চাভিমানিত্বং তথাগিত্বমেব চ ॥ এতে বৈ সপ্ত দোষাঃ স্যুঃ সদা বিদ্যার্থিনাং মতাঃ ॥ ১ ॥ সুখার্থিনঃ কুতো বিদ্যা নাস্তি বিদ্যার্থিনঃ সুখম্ ॥ সুখার্থী বা ত্যজেদ্বিদ্যাং বিদ্যার্থী বা ত্যজেৎ সুখম৷ ২৷ ইহাও বিদুর প্রজাগরের শ্লোক। ॥

অর্থ : –(আলস্য) শরীর ও বুদ্ধিতে জড়তা, মাদকতা, মোহ– কোনও বস্তু বিশেষের প্রতি আসক্তি, চপলতা, এবং নানা বিষয়ে বৃথা বাক্য ব্যয় করা ও শ্রবণ করা, পঠন-পাঠন বন্ধ হওয়া, দাম্ভিকতা ও ত্যাগবিমুখ হওয়া, বিদ্যার্থীর এই ‘সপ্ত দোষ’ ঘটিয়া থাকে ॥ ১ ॥

এইরপ ব্যক্তিদের কখনও বিদ্যালাভ হয় না। সুখাভিলাষীর বিদ্যা কোথায়? আর বিদ্যার্থীর সুখ কোথায়? কেননা বিষয় সুখার্থী বিদ্যাকে এবং বিদ্যার্থী বিষয়সুখকে পরিত্যাগ করিবে ॥ ২ ॥

এইরূপ না করিলে বিদ্যালাভ কখনও হইতে পারে না এবং এইরূপ ব্যক্তির বিদ্যালাভ হয়–

সত্যে রতানাং সততং দান্তানামূৰ্দ্ধরেতসাম্। ব্রহ্মচর্য্যং দহেদ্রাজ সর্বপাপাপাসিতম্ ॥ ২ ॥ মহা০ অনুশাসন পর্ব।

অর্থ :- যাঁহারা সর্বদা সত্যাচরণে রত থাকেন এবং যাঁহাদের ব্রহ্মচর্য সত্য, তাঁহারাই বিদ্বান্ হইয়া থাকেন। ১।

সুতরাং অধ্যাপক এবং বিদ্যার্থীদিগকে শুভ লক্ষণান্বিত হওয়া আবশ্যক। অধ্যাপকগণ এইরূপ যত্ন করিবেন যেন বিদ্যার্থীরা সত্যবাদী, সত্যবিশ্বাসী, সত্যকারী, সভ্যতা, জিতেন্দ্রিয়তা, সুশীলতাদি শুভগুণসম্পন্ন হইয়া শরীর ও আত্মার সম্পূর্ণ (বল) বৃদ্ধি করিয়া সমগ্র বেদাদিশাস্ত্রের বিদ্বান হয়। তাঁহারা বিদ্যার্থীদের কুচেষ্টা পরিহার করাইতে এবং বিদ্যাভ্যাস করাইতে সর্বদা যত্নবান হইবেন। বিদ্যার্থীরা সর্বদা জিতেন্দ্রিয়, শান্ত, সহপাঠিগণের প্রতি প্রীতিসম্পন্ন, বিচারশীল এবং পরিশ্রমী হইয়া এইরূপ পুরুষকার করিবে, যাহাতে পূর্ণ বিদ্যা, পূর্ণ আয়ু, পরিপূর্ণ ধর্ম লাভ এবং পুরুষার্থ করিতে সমর্থ হয়। এইগুলি ব্রাহ্মণবর্ণের কর্ম। ক্ষত্রিয়দের কর্ম রাজধর্মে বলা হইবে। বৈশ্যের কর্ম ব্রহ্মচৰ্য্যাদি দ্বারা বেদাদি বিদ্যা অধ্যয়ন পূর্বক বিবাহ করিয়া নানা দেশীয় ভাষা, নানাবিধ বাণ্যিজের। রীতি এবং পণ্য সামগ্রীর দর জানা, ক্রয়-বিক্রয়, দ্বীপ-দ্বীপান্তরে গমনাগমন, লাভার্থ কাৰ্য্যারম্ভ, পশু পালন এবং নিপুণতার সহিত কৃষির উন্নতি সাধন করা ও করান, ধনবৃদ্ধি, বিদ্যা ও ধর্মোন্নোতির। জন্য অর্থব্যয়, সত্যবাদী ও নিষ্কপট হইয়া সতোর সহিত সকল প্রকার ব্যাপার করা এবং এইরূপে সমস্ত বস্তু রক্ষা এরূপভাবে করিবে যাহাতে কোনও কিছু নষ্ট না হইতে পারে।

শূদ্রগণ সর্বপ্রকার সেবাকাৰ্য্যে চতুর, রন্ধন বিদ্যায় সুনিপুণ হইয়া অত্যন্ত শ্রদ্ধার সহিত দ্বিজগণের সেবা করিবে এবং তাহাদের সেবাকে স্বীয় জীবিকা রূপে গ্রহণ করিবে। দ্বিজগণ ইহাদিগের পান, ভোজন, বস্ত্র, স্থান এবং বিবাহাদিতে যাহা ব্যয় হইবে সমস্তই দিবার ব্যবস্থা করিবে অথবা, তাহাদিগকে মাসিক বেতন দিবে।

চারিবর্ণ পরস্পর প্রীতির সহিত উপকার, সৌজন্য, সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি একমত থাকিয়া। রাজ্য ও প্রজাদের উন্নতি সাধনে শরীর, মন এবং ধন ব্যয় করিতে থাকিবে ॥

স্বামী ও স্ত্রী কখনও ছাড়াছাড়ি হওয়া উচিত নয়। কারণ—

পানং দুর্জনসংসর্গঃ পত্যা চ বিরহোটন। স্বপ্নোন্যগেহবাসশ্চ নারীসদূষণানি ॥ মনু ॥

অর্থ :–মদ্য ও সিদ্ধি প্রভৃতি মাদক দ্রব্য সেবন, দুষ্ট লোকের সংসর্গ, পতি বিয়োগ, ভণ্ড (সাধু) দর্শনের ছলে একাকিনী যেখানে সেখানে বৃথা ভ্রমণ, পরগৃহে যাইয়া শয়ন করা অথবা বাস। এই ছয়টি নারী চরিত্রের দূষণকারী দুর্গুণ। পুরুষদেরও এই দোষ ঘটিয়া থাকে।

পতিপত্নীর মধ্যে দুই প্রকার বিয়োগ ঘটে। (প্রথম) কোন ক্ষেত্রে কাৰ্য্যবশতঃ দেশান্তর গমন, (দ্বিতীয়) মৃত্যুবশতঃ বিচ্ছেদ ঘটা। প্রথমোক্ত ক্ষেত্রের প্রতিকার এই যে, দুরদেশে যাত্রা করিতে হইলে স্ত্রীকেও সঙ্গে রাখিবে। ইহার প্রয়োজন এই যে, বহুকাল পর্যন্ত (পতি পত্নীর) পৃথক অবস্থান সঙ্গত নহে।

প্রশ্ন –স্ত্রী এবং পুরুষদের বহু বিবাহ হওয়া উচিত কিনা?

উত্তর –যুগপৎ নহে অর্থাৎ একই সময়ে নহে।

প্রশ্ন –তবে কি সময়ান্তরে বহুবিবাহ হওয়া উচিত?

উত্তর –হাঁ, যেমন –

য়া স্ত্রীত্বক্ষতয়োনিঃ স্যাদ্গতপ্রত্যাগতাপি বা। পৌনর্ভবেন ভত্রা সা পুনঃ সংস্কারমর্তুতি ॥ মনু ॥

অর্থ : –যে স্ত্রী পুরুষের পাণিগ্রহণ মাত্র সংস্কার হইয়াছে, কিন্তু সংযোগ হয় নাই,অর্থাৎ স্ত্রী অক্ষতযোনি এবং পুরুষ অক্ষতবীৰ্য্য থাকিলে তাহাদের অন্য পুরুষ এবং স্ত্রীর সহিত পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত। কিন্তু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য বর্ণের মধ্যে ক্ষতযোনি স্ত্রী এবং ক্ষতবীৰ্য্য পুরুষের পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত নহে।

প্রশ্ন –পুনর্বিবাহে দোষ কী?

উত্তর –প্রথমতঃ-স্ত্রী পুরুষের মধ্যে প্রেমের ন্যূনতা ঘটে। কারণ যখন ইচ্ছা তখনই স্ত্রী পতিকে এবং পতি স্ত্রীকে ত্যাগ করিয়া অন্যের সহিত সম্বন্ধ যুক্ত করিবে।

দ্বিতীয়তঃ –স্ত্রী বা পুরুষ পতি বা স্ত্রীর মৃত্যুর পর দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে চাহিলে পূর্ব স্ত্রীর অথবা পতির সম্পত্তি লইয়া যাইবে এবং তাহাদের কুটুম্বদিগের মধ্যে বিবাদ হইবে।

তৃতীয়তঃ–বহু ভদ্র পরিবারের নাম চিহ্ন থাকিবে না এবং তাহাদের সম্পত্তি ছিন্নভিন্ন হইয়া যাইবে।

চতুর্থতঃ –পতিব্রত এবং স্ত্রীব্রত ধর্ম নষ্ট হইয়া যাইবে। এই সকল দোষের জন্য দ্বিজদিগের মধ্যে পুনবিবাহ বা বহুবিবাহ কখনও হওয়া উচিত নহে ॥

প্রশ্ন –সন্তানোৎপত্তি না হইলে বংশনাশ ঘটিবে এবং স্ত্রীপুরুষ ব্যাভিচারাদি কর্ম করিয়া গর্ভপাতাদি বহু কুচেষ্টা করিবে। এই কারণে পুনর্বিবাহ হওয়া সঙ্গত।

উত্তর–না, না। যদি স্ত্রীপুরুষ ব্রহ্মচর্য্যে স্থির থাকিতে ইচ্ছা করে, তবে কোন উপদ্রব হইবে না। আর যদি বংশপরম্পরা রক্ষার জন্য স্বজাতির কোন বালককে পোষ্যগ্রহণ করা হয়, তবে তাহাতে বংরক্ষা হইবে এবং ব্যভিচার হইবে না। ব্রহ্মচর্য রক্ষা করিতে না পারিলে নিয়োগ দ্বারা সন্তানোৎপত্তি করিয়া লইবে।

প্রশ্ন –পুনবিবাহ এবং নিয়োগের মধ্যে প্রভেদ কী?

উত্তর –প্রথমতঃ –বিবাহ হইলে যেমন কন্যা পিতৃগৃহ ছাড়িয়া পতিগৃহে গমন করে, পিতার সহিত তাহার বিশেষ সম্বন্ধ থাকে না। সেইরূপ বিধবা স্ত্রী বিবাহিত পতির গৃহেই অবস্থান করে।

দ্বিতীয়তঃ –সেই বিবাহিতা স্ত্রীর পুত্র সেই বিবাহিত পতির উত্তরাধিকারী হইয়া থাকে, কিন্তু বিধবা স্ত্রীর পুত্র বীৰ্য্যদাতার পুত্র হয় না, তাহার গোত্রীয়ও হয় না, পুত্রের উপর তাহার কোন স্বত্ব থাকে না। কিন্তু সে বিধবার মৃত পতিরই পুত্ররূপে পরিগণিত হয় এবং তাহারই গোষ্ঠীর ও তাহারই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইয়া তাহারই গৃহে বাস করে।

তৃতীয়তঃ — বিবাহিত স্ত্রীপুরুষের পক্ষে পরস্পরের সেবা এবং পালন করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের কোন সম্বন্ধই থাকে না।

চতুর্থতঃ –বিবাহিত স্ত্রী পুরুষের আমরণ সম্বন্ধ থাকে, কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধ কাৰ্য্যান্তে ছিন্ন হইয়া যায়।

পঞ্চমতঃ –বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ পরস্পর মিলিত হইয়া গৃহকর্ম সম্পাদনে যত্নবান্ হইয়া থাকে কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষ নিজ নিজ গৃহকর্ম করিতে থাকে।

প্রশ্ন –বিবাহ এবং নিয়োগের নিয়ম কি একই প্রকার, না,–পৃথক পৃথক?

উত্তর –কিঞ্চিৎ প্রভেদ আছে তাহা পূর্বে বলা হইয়াছে। তদ্ব্যতীত বিবাহিত স্ত্রীপুরুষ একপতি এবং এক স্ত্রী মিলিত হইয়া দশটি সন্তান উৎপন্ন করিতে পারে। কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষ দুই চারিটির অধিক সন্তান উৎপন্ন করিতে পারে না অর্থাৎ যেরূপ কুমার ও কুমারীর বিবাহ হইয়া থাকে, তদ্রূপ যাহার স্ত্রী বা পতি বিয়োগ হইয়াছে তাহাদেরই নিয়োগ করা হইয়া থাকে, কুমার বা কুমারীর নহে।

যেরূপ বিবাহিত স্ত্রী পুরুষ সর্বদা সঙ্গে থাকে কিন্তু নিযুক্ত স্ত্রীপুরুষের ব্যবহার সেইরূপ নহে। কিন্তু ঋতুদানের সময় ব্যতীত (অন্য সময়) তাহারা একত্র হইবে না। যদি স্ত্রী নিজ প্রয়োজনে নিয়োগ করে, তবে দ্বিতীয় গর্ভস্থিতির দিন হইতে তাহার সহিত নিযুক্ত পুরুষের সম্পর্ক ছিন্ন হইয়া যায়। পুরুষ নিজের জন্য নিয়োগ করিলেও দ্বিতীয় গর্ভস্থিতির পর হইতে সম্বন্ধ থাকে না। কিন্তু সেই নিযুক্ত স্ত্রী দুই তিন বৎসর কাল পৰ্য্যন্ত সন্তানগুলিকে পালন করিয়া নিযুক্ত পুরুষকে দিবে। এইরূপে এককালে বিধবা স্ত্রী নিজের জন্য দুইটি এবং অন্য চারিজন নিযুক্ত পুরুষের প্রত্যেকের জন্য দুইটি দুইটি করিয়া সন্তান উৎপন্ন করিতে পারে। একজন বিপত্নীক পুরুষও নিজের জন্য দুইটি এবং অন্য চারটি বিধবার জন্য দুইটি করিয়া পুত্র উৎপন্ন করিতে পারে। এইরূপে মোট দশটি সন্তান উৎপত্তির আজ্ঞা বেদে আছে, যথা —

ইমাং ভৃমিন্দ্র মীঢ়বঃসুপুত্ৰাংসুভগাংকৃণু ॥ দশাস্যাং পুত্রানা ধেহি পতিমেকাদশং কৃধি৷ ঋ০ ১০ ॥ ৮৫। ৪৫

অর্থ : –হে ‘মীঢ্‌ব ইন্দ্র’ বীৰ্যসিঞ্চনে সমর্থ ঐশ্বর্যশালী পুরুষ। তুমি এই বিবাহিত স্ত্রী বা স্ত্রীকে শ্রেষ্ঠ পুত্রের মাতা এবং সৌভাগ্যবতী কর। বিবাহিতা স্ত্রীতে দশ পুত্র উৎপন্ন কর এবং স্ত্রীকে একাদশ বলিয়া মনে কর। হে স্ত্রী। তুমিও বিবাহিত বা নিযুক্ত পুরুষ কর্তৃক দশটি সন্তান উৎপন্ন কর এবং পতিকে একাদশ বলিয়া মনে কর ॥

বেদের এই আজ্ঞানুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যবর্ণের স্ত্রীপুরুষ দশটির অধিক সন্তান উৎপন্ন করিবে না। কারণ অধিক সন্তান হইলে সন্তানগুলি দুর্বল, নিবুদ্ধি, অল্পায়ু হয় এবং স্ত্রী পুরুষও অল্পায়ু এবং রুগ্ন হইয়া বৃদ্ধাবস্থায় বহু দুঃখ ভোগ করে।

প্রশ্ন –এই নিয়োগের ব্যাপার ব্যভিচারের ন্যায় দেখাইতেছে।

উত্তর –যেমন অবিবাহিতদিগের (সংসর্গ) ব্যভিচার, সেইরূপ নিয়োগ ব্যতীত সংসর্গ করাকে ব্যভিচার বলা যাইতে পারে। ইহাতে সিদ্ধ হইলে যে, যেমন বিধিসঙ্গত বিবাহকে ব্যভিচার বলা যায় না, সেইরূপ বিধিসঙ্গত নিয়োগকেও ব্যভিচার বলা যাইবে না। যেমন, শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে। একজনের কন্যার সহিত অপর একজন পুত্রের বিবাহের পর সমাগমে ব্যভিচার, পাপ এবং লজ্জা হয় না, সেইরূপ বেদ শাস্ত্রোক্ত নিয়োগকেও ব্যভিচার পাপ (বা) লজ্জা মনে করা উচিত নহে।

প্রশ্ন –যথাথই বটে, কিন্তু ইহা বেশ্যাবৃত্তির ন্যায় দেখাইতেছে।

উত্তর –না, কারণ বেশ্যাসমাগমে কোন নিশ্চিত পুরুষ বা কোনও নিয়মের নিশ্চয়তা নাই। কিন্তু নিয়োগে বিবাহের ন্যায় নিয়ম আছে। যেমন একজনের কন্যা অপরকে সম্প্রদান করা হইলে বিবাহের পর সমাগমে লজ্জা হয় না, সেইরূপ নিয়োগেও লজ্জা না হওয়া উচিত। ব্যভিচারী পুরুষ বা ব্যভিচারিণী নারী কি বিবাহের পরেও কুকর্ম হইতে রক্ষা পায়?

প্রশ্ন –নিয়োগের কথা আমার নিকট পাপ বলিয়াই মনে হইতেছে।

উত্তর –যদি নিয়োগকে পাপ বলিয়া মনে কর, তবে বিবাহকে পাপ বলিয়া মনে কর না কেন? নিয়োগে বাধা দান করিলেই ত পাপ হয়। কেননা বৈরাগ্যবান্ পূর্ণ বিদ্বান্ যোগী ব্যতীত ঈশ্বরের সৃষ্টির ক্রম অনুসারে স্ত্রী-পুরুষের স্বাভাবিক ব্যবহার রুদ্ধ করিতে পারে না। গর্ভপাতরূপ ভ্রণহত্যা এবং বিধবা ও বিপত্নীক পুরুষের মহাদুঃখকে কি পাপের মধ্যে গণ্য কর না? যতদিন। তাহাদের যৌবন থাকে, ততদিন তাহারা মনে মনে সন্তানকামী এবং বিষয়ভোগবিলাসী থাকে। যদি কোন রাজ্য বা সমাজ ব্যবস্থা দ্বারা তাহাদিগকে বাধা দেওয়া হয় তবে গোপনে বহু কুকর্ম হইতে পারে।

এই সকল ব্যভিচার ও কুকর্ম রোধ করিবার একটিই শ্রেষ্ঠ উপায় আছে, যদি সে জিতেন্দ্রিয় হইতে পারে তাহা হইলে তাহার পক্ষে বিবাহ ও নিয়োগ না করাই ভালো। কিন্তু যে এরূপ করিতে পারে না তাহার পক্ষে বিবাহ এবং আপকালে নিয়োগ অবশ্য কর্তব্য। ইহাতে ব্যভিচার হ্রাস পায় এবং প্রেম বশতঃ উত্তম সন্তান উৎপন্ন হওয়ায় মনুষ্যজাতির উন্নতি হওয়া সম্ভব। গর্ভপাতও সর্বপ্রকারে নিবারিত হয়।

নীচ পুরুষের সহিত উত্তম স্ত্রীর এবং বেশ্যাদি নীচ স্ত্রীর সহিত উত্তম পুরুষের ব্যভিচার রূপ কুকর্ম সকুলের কলঙ্ক, বংশোচ্ছেদ, স্ত্রী পুরুষের সন্তাপ এবং গর্ভহত্যাদি কুকর্ম বিবাহ ও নিয়োগ দ্বারা নিবারিত হয়। এইজন্য নিয়োগ করা কর্ত্তব্য।

প্রশ্ন –নিয়োগে কী কী নিয়ম থাকা আবশ্যক?

উত্তর –বিবাহ যেরূপ প্রসিদ্ধির সহিত হয় তদ্রপ প্রসিদ্ধির সহিত নিয়োগও। যেরূপ বিবাহের জন্য ভদ্র পুরুষদিগের অনুমতি এবং বরকন্যার প্রসন্নতা থাকা আবশ্যক, তদ্রূপ নিয়োগ। অর্থাৎ যখন পুরুষের নিয়োগ হয়, তখন তাহারা স্বীয় আত্মীয়-কুটুম্ব, স্ত্রী-পুরুষদিগের সমক্ষে (প্রকাশ করিবে) “আমরা উভয়ে সন্তানোৎপত্তির জন্য নিয়োগ করিতেছি, নিয়োগের নিয়ম পূর্ণ হইলে আমরা আর সংযুক্ত হইব না। যদি ইহার বিরুদ্ধ কাৰ্য্য করি, তবে পাপী এবং জাতি বা রাষ্ট্রের নিকট দণ্ডনীয় হইব। প্রতিমাসে একবার গর্ভাধান কৃত্য করিব এবং গর্ভস্থিতির পর এক বৎসর পর্যন্ত পৃথক থাকিব।”

(প্রশ্ন) –নিয়োগ কি সবর্ণে হওয়া উচিত না ভিন্ন বর্ণের সহিতও?

(উত্তর) –সবর্ণ অথবা সবর্ণ অপেক্ষা উত্তম বর্ণের পুরুষের সহিত। অর্থাৎ বৈশ্যা স্ত্রীর সঙ্গে বৈশ্য; ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণের সহিত; ক্ষত্রিয়ার ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণের সহিত এবং ব্রাহ্মণীর ব্রাহ্মণের সহিত নিয়োগ হইতে পারে। ইহার তাৎপৰ্য্য এই যে, বীৰ্য্য সমান বা উত্তম বর্ণের হওয়া উচিত, নিজ অপেক্ষা নিম্নবর্ণের হওয়া উচিত নহে। ধর্ম অর্থাৎ বেদোক্ত রীতি অনুসারে বিবাহ অথবা নিয়োগ দ্বারা সন্তানোৎপত্তি করা সৃষ্টিতে স্ত্রীপুরুষের ইহাই প্রয়োজন।

প্রশ্ন– পুরুষ যখন দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পারে, তখন তাহার নিয়োগ করিবার আবশ্যকতা কী?

উত্তর –পূর্বে লিখিয়াছি যে,দ্বিজগণের মধ্যে স্ত্রী পুরুষে একবার মাত্রই বিবাহ হওয়া সঙ্গত, দ্বিতীয়বার নহে, বেদাদি শাস্ত্রে ইহার উল্লেখ আছে। কুমারের সহিত কুমারীর বিবাহ হওয়া সঙ্গত। বিধবার সহিত কুমারের এবং কুমারীর সহিত বিবাহ ন্যায়বিরুদ্ধ অর্থাৎ অধর্ম। বিবাহিত পুরুষ যেমন বিধবাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে না, সেইরূপ যে পুরুষ স্ত্রী সমাগম করিয়াছে, কুমারীও তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করে না। কুমারী কন্যা বিবাহিত পুরুষকে এবং কুমার বিধবা স্ত্রীকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা না করিলে স্ত্রী পুরুষের নিয়োগের প্রয়োজন হইবে। যে ব্যক্তি যেমন তাহার সহিত তেমন ব্যক্তিরই সম্বন্ধ হওয়া উচিত এবং তাহাই ধর্ম।

প্রশ্ন –বিবাহ বিষয়ে বেদাদি শাস্ত্রে যেরূপ প্রমাণ আছে, নিয়োগ বিষয়েও কি সেইরূপ প্রমাণ আছে, — না নাই?

উত্তর –এবিষয়ে বহু প্রমাণ আছে। দেখ, শোন—

কুহস্বিদ্দোষা কুহ বস্তোরখিনা কুহাভিপিত্বং করতঃ কুহেতুঃ। কো বাংশয়ুত্রা বিধবের দেবরং ময়ংন য়ো কৃণুতে সধস্থ আ ॥ ১ ॥ ঋ০ম০১০ ॥ ৪০ ॥ ২

উদীৰ্ধনায়ভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপ শেষ এহি।
হস্তগ্রাভস্য দিধিযোস্তবেদং পত্যুজনিত্বমভি সংবভূথ ॥ ২ ॥ ঋ০ম০১০।১৮৮

অর্থ : –হে (অশ্বিনা) স্ত্রী-পুরুষগহণ! যেরূপ (দেবরং বিধবেব) দেবর বিধবার সহিত এবং (য়োষা ময়াং ন) বিবাহিতা স্ত্রী স্বীয় পতির সহিত (সধস্তে) এক স্থানে শষ্যায় একত্র হইয়া সন্তান। (আ কৃণুতে) সর্বপ্রকারে উৎপন্ন করে, সেইরূপ তোমরা উভয়ে স্ত্রী-পুরুষ (কুহস্বিদ্দোষা) কোথায় রাত্রিতে এবং (কুহ বস্তঃ) কোথায় দিবসে একত্র বাস করিয়াছিলে? (কুহভিপিত্ব) কোথায়। পদার্থ লাভ (করতঃ) করিয়াছ? এবং (কুহোষতুঃ) কোন সময়ে কোথায় বাস করিয়াছিলে? (কো বাং শয়ুত্রা) তোমাদের শয়নস্থান কোথায়? তোমরা কে এবং কোন্ দেশবাসী? ॥১ ॥

ইহা দ্বারা সিদ্ধ হইল যে, দেশে বিদেশে স্ত্রী পুরুষ সঙ্গেই থাকিবে এবং বিধবা ও স্ত্রী নিযুক্ত পতিকে বিবাহিতা পতির ন্যায় গ্রহণ করিয়া সন্তানোৎপত্তি করিবে।

প্রশ্ন –যদি কাহারও কনিষ্ঠ ভ্রাতা না থাকে, তবে বিধবা কাহার সহিত নিয়োগ করিবে?

উত্তর –দেবরের সহিত। কিন্তু ‘দেবর’ শব্দের অর্থ তুমি যাহা বুঝিতেছে তাহা নহে। দেখ নিরুক্তে–

‘দেবরঃ কস্মাদ দ্বিতীয়ো বর উচ্যতে। নিরুঅ০৩১৫।

বিধবার দ্বিতীয় পতিকে ‘দেবর’ বলে। সে পতির কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই হোক অথবা সুবর্ণ বা নিজ অপেক্ষা উত্তম বর্ণের হউক, যাহার সহিত নিয়োগ হইবে তাহার নাম ‘দেবর’।

অর্থ : হে (নারি) বিধবে! তুমি (এতং গতাসুম) এই মৃত পতির আশা পরিত্যাগ করিয়া (শেষে) অবশিষ্ট পুরুষদিগের মধ্যে (অভিজীবলোকম) জীবিত দ্বিতীয় পতিকে (উপৈহি) প্রাপ্ত হও। এবং (উদীৰ্ধ) ইহা বিচার করিবে এবং নিশ্চয় জানিবে যে, (হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোঃ) তোমার [বিধবার] পুনঃ পাণিগ্রহণকারী নিযুক্ত পতির সম্বন্ধের জন্য যদি নিয়োগ হয় তবে (ইদ) এই (জনিত্বম) উৎপন্ন পুত্র, উক্ত নিযুক্ত (পত্যুঃ) পতির হইবে। আর তোমার প্রয়োজনে নিয়োগ। করিলে এই সন্তান (তব) তোমার হইবে। তুমি এইরূপ স্থিরনিশ্চিত (অভি সম্ বভুথ) হও। নিযুক্ত পুরুষও এই নিয়ম পালন করিবে ৷২ ॥

অদেবৃগ্নপতিঘ্নীহৈধি শিবা পশুভ্যঃ সুয়মা সুবৰ্চাঃ। প্রজবতী বীরসুদেবৃকামা স্যোনেমমগ্নিং গাহপত্যং সপয় ॥৩ ॥ অর্থব-কা- ১৪।২।১৮

হে নারি! (অপতিষ্যদেবৃঘ্নি) তুমি পতি এবং দেবরের দুঃখদায়িনী নহ। তুমি (ইহ) এই গৃহাশ্রমে (পশুভ্যঃ) পশুদের জন্য (শিবা) কল্যাণকারিণী, (সুষমাঃ) উত্তমরূপে ধর্মের নিয়মপালনকারিণী, (সুবৰ্চাঃ) রূপবতী এবং সর্বশাস্ত্র বিদুষী, (প্রজাবতি) উত্তম পুত্র পৌত্রাদিযুক্তা, (বীরসূঃ) শূর পুত্রের জননী, (দেবকামা) দেবরের কামনাকারিণী, (স্যোনা) সুখদায়িনী, পতি বা দেবরকে (এধি) প্রাপ্ত হইয়া (ইম) এই (গার্হপত্য) গৃহস্থ সম্বন্ধীয় (অগ্নি) অগ্নিহোত্রকে (সর্পয়) সেবন করিতে থাক।

মনেন বিধানেন নিজো বিন্দেত দেবরঃ। মনু।

যদি অক্ষতযোনি স্ত্রী বিধবা হয়, তবে পতির আপন কনিষ্ঠ সহোদরও তাহাকে বিবাহ করিতে পারে।

প্রশ্ন –এক স্ত্রী বা পুরুষ কত নিয়োগ করিতে পারে এবং বিবাহিত ও নিযুক্ত পতিগণ কী কী নামে অভিহিত হয়?

উত্তর–সোমঃ প্রথমো বিবিদে গন্ধর্বো বিবিদ উত্তরঃ। তৃতীয়ো অগ্নিষ্টে পতিস্তুরীয়স্তে মনুষ্যজাঃ ॥ ঋ০ম০১০। ৮৫। ৪০।

অর্থ : — হে স্ত্রী! (তে) তোমার যে (প্রথমঃ) প্রথম বিবাহিত (পতিঃ) পতি তোমাকে (বিবিদে) প্রাপ্ত হয়, তাহার নাম (সোমঃ) সুকুমারতা প্রভৃতি গুণযুক্ত বলিয়া ‘সোম। যে দ্বিতীয়বার নিয়োগ দ্বারা তোমাকে (বিবিদে) প্রাপ্ত হয় সে (গন্ধর্বঃ) এক স্ত্রীর সহিত সম্ভোগ করিয়াছে বলিয়া ‘গন্ধর্ব। যে (তৃতীয় উত্তরঃ) দুই পতির পরবর্তী তৃতীয় পতি,সে (অগ্নিঃ) অতি উষ্ণতাযুক্ত হওয়ায় ‘অগ্নিসংজ্ঞক’, এবং যাহারা (তো) তোমার (তুরীয়) চতুর্থ হইতে একাদশ পর্যন্ত নিযুক্ত পতি তাহারা (মনুষ্যজাঃ) ‘মনুষ্য’ নামে অভিহিত হয়। যেরূপ (ইমাং ত্বমি) এই মন্ত্র দ্বারা একাদশ পুরুষ পৰ্য্যন্ত নিয়োগ করিতে পারে, সেইরূপ পুরুষও একাদশ স্ত্রী পৰ্য্যন্ত নিয়োগ করিতে পারে।

প্রশ্ন –একাদশ দ্বারা দশ পুত্র এবং পতিকে একাদশ গণনা করা হইবে কেন?

উত্তর –যদি এইরূপ অর্থ করা হয় তবে ‘বিধবেব দেবরম; দেবরঃ কম্মাদ দ্বিতীয়োবর উচ্যতে; অদেবৃগ্নি’; এবং ‘গন্ধর্বো বিবিদ উত্তরঃ ইত্যাদি বৈদিক প্রমাণ সমূহের বিরুদ্ধ অর্থ হইবে। কারণ তোমার অর্থ অনুসারে দ্বিতীয় পতিও প্রাপ্ত হওয়া যায় না।

দেবরাদ্বা সপিণ্ডাদ্বা স্ক্রিয়া সম্যনিযুক্তয়া ॥ প্রজেন্সিতাধিগন্তব্যা সন্তানস্য পরিক্ষয়ে৷১ ॥ জ্যেষ্ঠোয়বীয়সসা ভায়াংয়বীয়ান্থাগ্রজস্ক্রিয়। পতিতৌ ভবতো গত্বা নিয়ুক্তাবপ্যনাপদি ॥ ২ ॥ ঔরসঃ ক্ষেত্ৰজশ্চৈব ॥ ৩ ॥ মনু ॥

মনু এইসব লিখিয়াছেন যে, “সপিণ্ড” অর্থাৎ পতির ছয় পুরুষের মধ্যে, পতির কনিষ্ঠ বা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, অথবা স্বজাতীয় এবং নিজ অপেক্ষা উচ্চ জাতিস্থ পুরুষের সহিত বিধবা স্ত্রীর নিয়োগ হওয়া উচিত। যদি বিপত্নীক পুরুষ এবং বিধবা স্ত্রী সন্তান কামনা করে,তবে তাহার নিয়োগ হওয়া উচিত। সর্বথা সন্তানের অভাব হইলে নিয়োগ হইবে। আপকালে অর্থাৎ সন্তান ব্যতীত, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সহিত কনিষ্ঠ ভ্রাতার অথবা কনিষ্ঠ ভ্রাতার স্ত্রীর সহিত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিয়োগ হইলে এবং সন্তানোৎপত্তির পরেও নিযুক্তগণ পরপর সমাগম করিলে পতিত বলিয়া গণ্য হইবে অর্থাৎ এক নিয়োগের সীমা দ্বিতীয় সন্তানের গর্ভধারণ পৰ্য্যন্ত। তাহার পর সমাগম করিবে না। যদি উভয়ের প্রয়োজনে নিয়োগ হয় তবে চতুর্থ গর্ভ পৰ্য্যন্ত অর্থাৎ পূর্বোক্ত রীতি অনুসারে দশ সপ্তাহ পর্যন্ত হইতে পারে। তদন্তর তাহা বিষয়াসক্তি বলিয়া গণ্য করা হয়। তাহাতে তাহারা পতিত বলিয়া গণ্য হয়। বিবাহিত স্ত্রী পুরুষও দশম গর্ভের পরে সমাগম করিলে কামুক বলিয়া নিন্দিত হয়। অর্থাৎ বিবাহ বা নিয়োগ সন্তানের জন্য; পশুবৎ ক্রীড়ার জন্য নহে।

প্রশ্ন–কেবল পতির মৃত্যু হইলে নিয়োগ হয়, অথবা পতির জীবদ্দশাতেও নিয়োগ হইতে পারে?

উত্তর –পতির জীবদ্দশাতেও হইতে পারে।

অন্যমিচ্ছস্ব সুভগে পতিং মৎ। ঋ ০১০১০১০১০ ॥

পতি সন্তানোৎপাদনে অসমর্থ হইলে স্বীয় স্ত্রীকে আজ্ঞা দিবে, সুভগে! সৌভাগেচ্ছ! তুমি (মৎ) আমা ভিন্ন (অন্য) অন্য পতি ইচ্ছা কর, কারণ এখন আমার দ্বারা সন্তানোৎপত্তির আশা করিও না। (তখন স্ত্রী অন্যের সহিত নিয়োগ করিয়া সন্তানোৎপত্তি করিবে), কিন্তু সেই বিবাহিত সদাশয় পতির সেবায়–তৎপর থাকিবে। স্ত্রীও রোগাদি দোষগ্রস্ত হইয়া সন্তানোৎপাদনে অসমর্থ হইলে নিজ পতিকে আজ্ঞা দিবে, হে স্বামিন! আপনি আমাতে সন্তানোৎপত্তির ইচ্ছা পরিত্যাগ করিয়া অন্য কোন বিধবার সহিত নিয়োগ করিয়া সন্তান উৎপন্ন করুন।

পাণ্ডু রাজার স্ত্রী ও মাদ্রী প্রভৃতি এইরূপ করিয়াছিলেন। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য্যের মৃত্যুর পর ব্যাসদেব তাহার ভ্রাতৃবধু অম্বিকা ও অম্বালিকার সহিত নিয়োগ করিয়া যথাক্রমে ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর এবং দাসীগর্ভে বিদুরের জন্মদান করিয়াছিলেন। এই সব ইতিহাসও এ বিষয়ে প্রমাণ।

প্রোষিত ধর্মকায়ার্থং প্রতীক্ষ্যোষ্টেরঃ সমাঃ। বিদ্যার্থং ষড়য়শোর্থং বা কামার্থং ক্রীংস্তু বৎসরা ॥ ॥ বন্ধ্যাষ্টমে ধিবেদ্যাব্দে দশমে তু মৃতপ্রজা ॥ একাদশে স্ত্রীজননী সদ্যস্তৃপ্রিয়বাদিনী ॥ ২॥ মনু

বিবাহিত পতি ধর্মার্থে বিদেশ গমন করিলে বিবাহিতা স্ত্রী আট বৎসর, বিদ্যা ও কীর্তির জন্য গমন করিয়া থাকিলে ছয় বৎসর এবং ধনাদি কামনায় গমন করিয়া থাকিলে তিন বৎসর অবধি প্রতীক্ষা করিয়া পরে সন্তনোৎপত্তি করিবে। বিবাহিত পতি ফিরিয়া। আসলে নিযুক্ত পতির সহিত কোন সম্বন্ধ থাকিবে না ॥১॥

সেইরূপ পুরুষের পক্ষেও নিয়ম এই যে স্ত্রী বন্ধ্যা হইলে আট বৎসর (বিবাহের পর আট বৎসর পর্যন্ত তাঁহার গর্ভ না হইলে) সন্তান হইয়া মরিয়া গেলে দশ বৎসর এবং গর্ভবতী হইয়া প্রত্যেক বার পুত্র প্রসব না করিয়া কন্যা প্রসব করিলে একাদশ বৎসর অপেক্ষা করিবে। কিন্তু স্ত্রী অপ্রিয়বাদিনী হইলে তাহাকে সদ্য পরিত্যাগ করিয়া অন্য স্ত্রীর সহিত নিয়োগ দ্বারা সন্তানোৎপওি করিবে ॥২॥

সেইরূপ, পতি অত্যন্ত দুঃখদায়ক হইলে স্ত্রী তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য পুরুষের সহিত নিয়োগ দ্বারা সেই বিবাহিত পতির উত্তরাধিকারী সন্তান উৎপন্ন করিয়া লইবে।

এই সকল প্রমাণ এবং যুক্তি অনুসারে স্বয়ম্বর বিবাহ ও নিয়োগ দ্বারা স্ব স্ব কুলের উন্নতিসাধন করা কর্তব্য। ঔরস’অর্থাৎ বিবাহিত পতির দ্বারা উৎপন্ন পুত্র যেমন পিতৃ-সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হইয়া থাকে, সেইরূপ ক্ষেত্রজ’ অর্থাৎ নিয়োগজাত পুত্রও মৃত পিতার সম্পত্তির অধিকারী হয়।

এ বিষয়ে স্ত্রী-পুরুষের স্মরণে রাখা আবশ্যক যে, বীৰ্য্য ও রজঃ অমুল্য পদার্থ। যে ব্যক্তি এই। অমূল্য পদার্থকে পরস্ত্রী, বেশ্যা অথবা দুষ্ট পুরুষের সংসর্গে নষ্ট করে সে মহামুখ। কারণ কৃষক এবং মালী মুখ হইয়াও স্ব স্ব উদ্যান ব্যতীত অন্যত্র বীজ বপন করে না। যদি সামান্য বীজ এবং মুখ সম্বন্ধে এই কথা হয়, তাহা হইলে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব-দেহরূপ বৃক্ষের বীজ কুক্ষেত্রে নাশকারীকে মহামুখ বলা হইবে। কেননা, সেই বীজের ফল সে পায় না; এবং

‘আত্মা বৈ জায়তে পুত্রঃ ব্রাহ্মণ গ্রন্থের বচন। অঙ্গদঙ্গাৎসম্ভবসি হৃদয়াদধিজায়সে। আত্মাসি পুত্র মা মৃথাঃ স জীব শরদঃ শত৷ ইহা সামবেদীয় ব্রাহ্মণের বচন।

‘হে পুত্র! তুমি আমার প্রত্যেক অঙ্গজাত বীৰ্য্য ও হৃদয় হইতে উৎপন্ন হইয়াছ, অতএব তুমি আমার আত্মা। তুমি আমার পূর্বে মরিও না, কিন্তু একশত বৎসর জীবিত থাক। যদ্বারা এবম্বিধ মহাত্মা ও মহাশয়ের শরীর উৎপন্ন হয়, উহাকে বেশ্যাদি দুষ্টক্ষেত্রে বপন করা অথবা দুষ্টবীজ উৎকৃষ্ট ক্ষেত্রে বপন করান মহা-পাপকর্ম।

প্রশ্ন–বিবাহ করিবার কী প্রয়োজন? স্ত্রীপুরুষকে বন্ধনের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া বহুবিধ সঙ্কোচন এবং দুঃখ ভোগ করিতে হয়। অতএব যাহার সহিত যতদিন প্রীতি থাকে, সে ততদিন তাহার সহিত মিলিত থাকিবে। যদি প্রীতির অবসান ঘটে ত্যাগ করিবে।

উত্তর– ইহা পশুপক্ষীর ব্যবহার, মনুষ্যের নহে। মনুষ্যের মধ্যে বিবাহের নিয়ম না থাকিলে গৃহাশ্রমের যাবতীয় উৎকৃষ্ট আচরণ সব নষ্ট-ভ্রষ্ট হইয়া যাইবে, যদি কেহ কাহারও সেবা না করে তাহা হইলে ব্যভিচার বৃদ্ধি পাইয়া সকলে রোগী, নির্বল ও অল্পায়ু হইয়া অতিশীঘ্র মরিয়া যাইবে। কেহ কাহাকেও ভয় বা লজ্জা করিবে না। বৃদ্ধাবস্থায় কেহ কাহারও সেবা করিবে না। এবং মহাব্যভিচার বৃদ্ধি হইয়া সকলে রোগী, নির্বল ও স্বল্পায়ু হইয়া সবংশে বিনষ্ট হইবে। কেহ কাহারও পদার্থের স্বামী অথবা উত্তরাধিকারী হইতে পারিবে না। কাহারও কোন সম্পত্তির উপর দীর্ঘকাল পর্যন্ত স্বত্ত্ব থাকিবে না। এই সকল দোষ নিবারণার্থে বিবাহ হওয়া সর্বৰ্থা উচিত।

প্রশ্ন –বিবাহ হইলে এক পুরুষের এক স্ত্রী এবং এক স্ত্রীর এক স্বামী থাকিবে। স্ত্রী গর্ভবতী বা চিররোগিণী হইলে অথবা পুরুষ চিররোগী হইলে, এবং উভয় যুবাবস্থায় হইলে, যদি সংযমে থাকা সম্ভব না হয় তখন কী করা কর্তব্য?

উত্তর –ইহার উত্তর নিয়োগ প্রসঙ্গে দেওয়া হইয়াছে। গর্ভবতী স্ত্রীর সহিত এক বৎসর সমাগম বন্ধ থাকা কালে, পুরুষ, অথবা চিররোগী পুরুষের স্ত্রী সংযমে অসমর্থ হইলে স্ত্রী কাহারও সহিত নিয়োগ করিয়া তাহার জন্য পুত্রোৎপত্তি করিবে, কিন্তু কখনও বেশ্যা গমন বা ব্যভিচার করিবে না।

(দেশের হিতার্থে) যথাসম্ভব অপ্রাপ্ত বস্তু পাইবার ইচ্ছা, প্রাপ্তবস্তুর রক্ষা, রক্ষিত বস্তুর বৃদ্ধি এবং বর্ধিত ধন ব্যয় করিতে থাকিবে। পূর্বোক্ত সর্বপ্রকার রীতি অনুসারে নিজ নিজ বর্ণাশ্রমের ব্যবহার অনুযায়ী অত্যন্ত উৎসাহ ও যত্নের সহিত কায় মনে বাক্যে (তন-মন-ধন) পরমার্থ সাধন করিবে। মাতা, পিতা,শ্বশুর এবং শাশুড়ীকে অত্যন্ত শুশ্রূষা করিবে। মিত্র,প্রতিবেশী, রাজা, বিদ্বান চিকিৎসক এবং সজ্জনদিগের সহিত প্রীতি রাখিবে এবং দুষ্টঅধার্মিকদিগকে উপেক্ষা করিয়া, অর্থাৎ দ্রোহ পরিত্যাগ করিয়া তাহাদের সংশোধনের চেষ্টা করিবে। যথাসাধ্য প্রীতি সহকারে নিজ সন্তানদিগকে বিদ্বান ও সুশিক্ষিত করিবার জন্য সম্পত্তি ব্যয় করিবে। আর ধর্মাচরণ করিয়া মোক্ষ সাধনে রত থাকিবে। তদ্বারা পরমানন্দ ভোগ করিতে সমর্থ হইবে। নিম্নলিখিত শ্লোকগুলিকে মান্য করিবে না। যথা

পতিতো পি দ্বিজঃ শ্রেষ্ঠো ন চ শূদ্রো জিতেন্দ্রিয়ঃ। নির্দুগ্ধা চাপি গৌঃ পূজা ন চ দুগ্ধবতী খরী ॥১॥ অশ্বালম্ভং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈত্রিক। দেবরাচ্চ সুতোৎপত্তিং কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ ॥ ২ ॥ নষ্টেমৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ ॥ পঞ্চাস্বাপসুনারীণাং পতিরন্যো বিধীয়তে ॥ ৩ ॥ এগুলি কপোলকল্পিত পারাশরী শ্লোক।

কুকর্মা দ্বিজকে শ্রেষ্ঠ এবং শ্রেষ্ঠকর্মা শূদ্রকে নীচ মনে করা অপেক্ষা পক্ষপাত, অন্যায় অধর্ম আর কী হইতে পারে? দুগ্ধবতী অথবা দুগ্ধহীনা গাভী সবই কি গোপালকের পালনীয়া? কুম্ভকারেরা কি গাধা পালন করে না? কিন্তু এই দৃষ্টান্ত বিষম, কারণ দ্বিজ ও শূদ্র মনুষ্য জাতি, গাভী ও গর্দভী ভিন্ন জাতি। পশু জাতির সহিত দৃষ্টান্তের সীমানা কোন বিষয়ের সামঞ্জস্য থাকা সত্ত্বেও এই শ্লোকের অভিপ্রায় যুক্তিহীন বলিয়া কখনও বিদ্বাদিগের অনুমোদনীয় হইতে পারে না ॥১॥

যখন অশ্বালম্ভ অর্থাৎ অশ্ববধ করিয়া অথবা (গবালম্ভ) গোবধ করিয়া হোম করাই বেদবিহিত নহে, তখন কলিযুগে তাহার নিষেধ বেদবিরুদ্ধ হইবে না কেন? কলিযুগে এই হীনকর্মের নিষেধ স্বীকার করা হইলে ত্রেতা যুগে ইহার বিধি হইয়া পড়িবে। কোন শ্রেষ্ঠ যুগে এইরূপ জঘন্য কর্ম হওয়া সৰ্বৰ্থ অসম্ভব। বেদাদি শাস্ত্রে সন্ন্যাসের বিধি আছে। ইহার নিষেধ ভিত্তিহীন। যখন মাংসের নিষেধ আছে, তখন চিরকালের জন্য নিষেধ আছে। যখন দেবরের দ্বারা পুত্রোৎপাদন বেদে লিখিত আছে, তখন এই শ্লোক রচয়িতা হাঁক ছাড়িতেছে কেন? ॥ ২ ॥

যদি (নষ্টে) অর্থাৎ পতি কোনও দেশান্তরে গমন করিয়াছে, গৃহে স্ত্রী নিয়োগ করে, এবং সেই সময়ে বিবাহিত পতি প্রত্যাগমন করে সেই স্ত্রী কাহার হইবে? যদি কেহ বলে যে, বিবাহিত পতির হইবে, তাহা না হয় আমরা স্বীকার করিলাম। কিন্তু এইরূপ ব্যাখ্যার উল্লেখ পারাশরীতে নাই। স্ত্রীর কি কেবল পাঁচটিই আপৎকাল? রুগ্ন হইয়া পড়িয়া থাকা এবং কলহ-বিবাদ ইত্যাদি আপকাল পাঁচেরও অধিক। অতএব এই সকল শ্লোক কখনও স্বীকাৰ্য্য নহে।

প্রশ্ন –কেন মহাশয়! আপনি কি পরাশর মুনির বচনও মানেন না?

উত্তর –যাহারই বচন হউক না কেন, বেদবিরুদ্ধ হইলে মানি না। আর ইহা ত পরাশরের বচন নহে। কারণ ব্রহ্মোবাচ, বশিষ্ঠ উবাচ, রাম উবাচ, শিব উবাচ, বিষ্ণুরুবা, এবং দেবুবাচ ইত্যাদি শ্রেষ্ঠ পুরুষদের নাম উল্লেখ করিয়া গ্রন্থ রচনা করার উদ্দেশ্য হইল– সর্বমান্যদের নামে। ঐ সকল গ্রন্থ সমস্ত সংসার স্বীকার করুক এবং গ্রন্থকারেরও প্রচুর জীবিকার উপায় হোক। কতিপয় প্রক্ষিপ্ত শ্লোক ব্যতীত কেবল মনস্মৃতিই বেদানুকূল, অন্য স্মৃতি নহে। এইরূপে অন্যান্য। জাল গ্রন্থ সম্বন্ধেও বুঝিতে হইবে।

প্রশ্ন –গৃহাম সকল আশ্রম অপেক্ষা নিকৃষ্ট না শ্রেষ্ঠ?

উত্তর –নিজ নিজ কর্তব্য কর্মে সকলেই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু যথানদীনদাঃ সর্বে সাগরেয়ান্তি সংস্থিতি। তথৈবাশ্রমিণঃ সর্বে গৃহস্থেয়ান্তি সংস্থিতি ॥ ১ ॥ যথা বায়ুংসমাশ্ৰিত্য বৰ্ত্তন্তে সর্বজন্তবঃ।

তথা গৃহস্থমাশ্ৰিত্য বৰ্ত্তন্তে সর্ব আশ্রমঃ ॥ ২ ॥

স্মাৎত্ৰয়োপ্যাশ্রমিণে দানেনান্নেন চান্বহ। গৃহস্থেনৈব ধার্যন্তে তস্মজ্জ্যেষ্ঠামো গৃহী৷ ৩ ॥ স সংধায়ঃ প্রয়ত্নেন স্বৰ্গৰ্মক্ষয়মিচ্ছতা। সুখং চেহেচ্ছতা নিত্যং যোধায়ো দুর্বলেন্দ্রিয়ৈঃ ॥ ৪ ॥ মনু ॥

যেমন নদী ও বিশাল নদ যতকাল সমুদ্রে পতিত না হয় ততকাল সে ভ্রমণ করিতেই থাকে, সেইরূপ সকল আশ্রমবাসী গৃহস্থকেই আশ্রয় করিয়া স্থির থাকে।॥১॥

(যেরূপ বায়ুকে আশ্রয় করিয়া সমস্ত জীবের অস্তিত্ব বর্তমান থাকে) সেইরূপ–এই আশ্রম ব্যতীত কোন আশ্রমের ব্যবহার সিদ্ধ হয় না ॥২ ॥

ব্রহ্মচারী, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাসী–এই তিন আশ্রমবাসীকে দান এবং অন্নাদি দ্বারা গৃহস্থই প্রত্যহ ধারণ করে। অতএব গৃহস্থ জ্যেষ্ঠাশ্ৰম অর্থাৎ সর্ববিধ ব্যবহারেই উৎকৃষ্ট ৷৩ ॥

সুতরাং যিনি অক্ষয় মোক্ষ এবং সাংসারিক সুখ ইচ্ছা করেন, তিনি যত্ন সহকারে গৃহস্থাশ্রম ধারণ করিবেন। দুর্বলেন্দ্রিয় অর্থাৎ ভীরু ও দুর্বল পুরুষ যে গৃহস্থাশ্রমের অযোগ্য, সেই আশ্রমকে উত্তম রূপে ধারণ করিবে ॥ ৪ ॥

এই জন্য গৃহস্থাশ্রম যাবতীয় সাংসারিক ব্যবহারের আধার। যদি এই গৃহস্থাশ্রম না থাকিত তাহা হইলে সন্তানোৎপত্তি না হইলে ব্রহ্মচর্য্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস আশ্রম কীরূপে প্রতিষ্ঠিত হইত? যিনি গৃহস্থাশ্রমের নিন্দা করেন, তিনি নিন্দনীয় এবং যিনি ইহার প্রশংসা করেন তিনি প্রশংসনীয়। কিন্তু এই আশ্রমের সুখ তখনই হয় যখন স্ত্রী-পুরুষ উভয়ে পরস্পরের প্রতি প্রসন্ন থাকে, উভয়ে বিদ্যা ও পুরুষকারসম্পন্ন এবং সর্ববিধ ব্যবহারের জ্ঞাতা হয়। এইজন্য ব্রহ্মচর্য্য

এবং পূর্বোক্ত স্বয়ম্বর বিবাহ গৃহস্থাশ্রমের সুখের মুখ্য কারণ।

এ স্থলে সমাবর্তন, বিবাহ এবং গৃহাশ্রমের শিক্ষা বিষয়ে সংক্ষেপে লিখিত হইল। ইহার পর বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাসের বিষয় লিখিত হইবে।

ইতি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতী স্বামীকৃতে সত্যার্থপ্রকাশে
সুভাষাবিভূষিতে সমাবর্তন-বিবাহ-গৃহাশ্রম-বিষয়ে
চতুর্থঃ সমুল্লাসঃ সম্পূর্ণ ॥ ৪ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *