হাজ্জাজ বিন ইউসুফের দূত যখন সিরাজে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে পৌছল, তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম রায়া অঞ্চলের বিদ্রোহীদের নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময় দূতকে দেখে পয়গাম দ্রুত হাতে নিয়ে চকিতে চোখ বুলালেন তিনি। তার চেহারার রং বদলে গেল, তিনি পয়গামটি একপাশে ফেলে দিলেন ছুঁড়ে মারার মতো করে।
“হু, চাচা তো এখনো ততোটা বুড়ো হয়নি। কিন্তু তার বিবেক এতোটা কমজোর হয়ে গেল কি করে? সিন্ধু অভিযানের জন্য কি আর কোন সেনাপতি ধারে কাছে ছিল না? আমাকে এতো দূর থেকে কেন যেতে হবে? তিনি কি জানেন না, রায়া উপজাতিদের বিদ্রোহ দমনে আমাকে কতোটা ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে? আমি এখান থেকে চলে গেলে আবারো কি বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে না? আর এমন কি ঘটলো যে, এখনও পর্যন্ত সিন্ধু রাজার কবল থেকে বন্দীদের মুক্ত করা গেল না?”
“আমীরে সিরাজ! আপনার ওপর আল্লাহ রহম করুন!” বলল দূত। বন্দীদের উদ্ধার করতে গিয়ে দু’টি অভিযান ব্যর্থ হয়েছে, দু’জন সেনাপতি ইতোমধ্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং দু’বার মুসলিম বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে।”
“দু’জন সেনাপতি প্রাণ দিয়েছেন? বলো কি? বিস্ময়ে হতবাক হলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। তিনি দূতকে বললেন, বলো, তাড়াতাড়ি বলো, কি ঘটেছিল সেখানে, কারা ছিলেন সেনাপতি?”
“প্রথম অভিযানে আব্দুল্লাহ বিন নাবহান সেনাপতি ছিলেন। তিনি সিন্ধু উপকূলের ডাভেল বন্দর দখলের অভিযানে শাহাদাত বরণ করেন। তার বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধাও শাহাদাত বরণ করে। দ্বিতীয় অভিযানের সেনাপতি ছিলেন বুদাইল বিন তোফায়েল। তিনিও শাহাদাত বরণ করেন।
তার শাহাদাত আমাদের বাহিনীর জন্য পরাজয়ের কারণ ঘটে। তৃতীয়বার সেনাপতি আমের বিন আব্দুল্লাহ তাকে সিন্ধু অভিযানে পাঠানোর জন্য আপনার চাচার কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু হাজ্জাজ বললেন, না, আর কারো প্রতি আমি আস্থা রাখতে পারছি না। আমার ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে আমি অভিযানে পাঠাব। আমার বিশ্বাস, বিজয় তার পদচুম্বন করতে বাধ্য হবে।”
দূতের কথা শুনে মুহাম্মদ বিন কাসিমের চেহারায় যে পরিবর্তন দেখা দিলো, তা ছিল ব্যাপক অর্থবোধক। একটা গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন করে ফেলল বিন কাসিমকে। তিনি দাঁড়িয়ে পিছনে হাত বেঁধে দৃঢ় পায়ে কক্ষ জুড়ে পায়চারী করছিলেন, আর দূত তার পিছু পিছু হাঁটছিল। তিনি গভীর দৃষ্টিতে নীচের দিকে তাকিয়ে কি যেন হিসাব করছিলেন। দূত নিবিষ্ট মনে তাকে অনুসরণ করছিল। “ইবনে নাবহান ও ইবনে তোফায়েল তো পরাজয় বরণ করার মতো সেনাপতি ছিলেন না।” দাঁড়িয়ে দূতকে লক্ষ্য করে বললেন বিন কাসিম।
‘আল্লাহর কসম! তারা রণাঙ্গনে পিঠ দেখানোর মতো ব্যক্তি ছিলেন না। উভয়েই বেপরোয়াভাবে শত্রু বাহিনীর রক্ষণভাগে ঢুকে পড়েছিলেন।”
দূত দুটি সিন্ধু অভিযান সম্পর্কে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা দিলো। আরো জানালো, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মানসিক অবস্থা।
“তার অবস্থা এমনটিই হওয়া উচিত।” বললেন বিন কাসিম। আরবদের নাওয়া খাওয়া হারাম হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। প্রতিটি আরব মুসলমানের স্ত্রী গমন হারাম করে দেয়া উচিত।”
ঠিক আছে। তুমি এখন গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করো। শরীরটা ঠিক হলে চলে যেয়ো। চাচাকে বলবে, আপনার ভাতিজা আপনার আশা পূরণ করবে ইনশাআল্লাহ! হ্যাঁ, আমি অবশ্যই আমাদের বন্দীদের মুক্ত করবো এবং আল্লাহ্ যদি সহায় হন, সিন্ধু অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু মন্দির চূড়ায় ইসলামের পতাকা উড্ডীন করব।”
দূত চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মুহাম্মদ বিন কাসিম তার পারিষদবর্গকে ডেকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের পয়গামের কথা ব্যক্ত করলেন।
পারিষদবর্গের একজন বললেন, আমীরে মুহতারাম! রায়া অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন মুলতবি করে দেয়ার কথাটা হাজ্জাজ ঠিক বলেননি। সিন্ধু
অভিযানে এখান থেকে শুধু আপনিই যাচ্ছেন। আর আপনার ক’জন দেহরক্ষী যাবে। আর আমরা তো এখানেই আছি। আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে, আপনার অবর্তমানেও বিদ্রোহ দমন অভিযান আমরা অব্যাহত রাখব।”
“আমরা যদি এ পর্যায়ে এসে বিদ্রোহ দমন অভিযান মুলতবি করে দেই, তাহলে উপজাতিদের গোয়ার্তুমী প্রকাশ্য বিদ্রোহের আকার ধারণ করবে।” বললেন অপর একজন কর্মকর্তা।
“আমি আপনাদের অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু এ কথাটি আপনাদেরকে মনে রাখতে হবে, দু’বার সিন্ধু অভিযানে পরাজিত হওয়ার পর তৃতীয় কোন পরাজয়ের সংবাদ হাজ্জাজ কোন অবস্থাতেই শুনতে চাইবেন না। পরাজয় তার কাছে অসহ্যকর হয়ে গেছে। তিনি পরাজয়ের জন্য আর কোন সৈনিক, সেনাপতিকে ক্ষমা করার কথা ভাবতেও রাজি হবেন না। আপনারা সবাই তাকে কমবেশী জানেন। আমি এখান থেকেই বুঝতে পারছি, তার মানসিক অবস্থা এখন কেমন।”
“পরিণতির কথা মাথায় রেখেই আমাদেরকে বিদ্রোহ দমনাভিযান অব্যাহত রাখতে হবে।” বললেন অপর কর্মকর্তা।
“হাজ্জাজের ওপরে আল্লাহ আছেন। আমাদের হাজ্জাজের সন্তুষ্টি নয় আল্লাহর সন্তুষ্টিই কাম্য হওয়া উচিত।” বললেন একজন সেনাপতি।
“তার পারিষদবর্গ কি বলছে সেদিকের চেয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বেশী মনোযোগ আকৃষ্ট করে ফেলেছিল সিন্ধু অঞ্চলের মানচিত্র। তিনি সিন্ধু অঞ্চলের মানচিত্র মেলে ধরে সেদিকে তাকিয়ে পারিষদবর্গের কথা শুনছিলেন। আর সিন্ধু অঞ্চলের অবস্থা চিন্তা করে গভীর ধ্যানে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মন-মানসিকতা অনুধাবন করা আর কারো পক্ষে তখন সম্ভব ছিল না। প্রতিশোধের নেশায় হাজ্জাজ প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। হাজ্জাজ যদি কারো ওপরে ক্ষেপে যেতেন, তবে কেবল সেই আন্দাজ করতে পারত ক্ষোভের গভীরতা। হাজ্জাজের মতের বিরুদ্ধে কেউ বাধা দিলে তিনি তার শিরচ্ছেদ করে ফেলতেন। কখনো এমন মনে হতো যে, স্বজাতির সকল মানুষকেই হত্যা করে ফেলবেন হাজ্জাজ। কোন অধীনস্থ তার হুকুমের ব্যতিক্রম করাকে তিনি মোটেই বরদাশত করতে পারতেন না।
মামুলী ব্যাপারেও অনেক ক্ষেত্রে হাজ্জাজ তার অধীনস্থদের কঠোর শাস্তি দিতেন। হাজ্জাজের হাতে স্বজাতির যতো লোক নিহত হয়েছে, এতো লোক। শত্রুপক্ষেরও নিহত হয়নি। যে পরিমাণ মুসলমানের রক্ত হাজ্জাজের হাতে প্রবাহিত হয়েছে, এ পরিমাণ দুশমনদেরও সম্ভবত হয়নি। সেই কঠোর কঠিন হাজ্জাজ কিভাবে নিরপরাধ আরব নারী শিশুদের এক লুটেরা হিন্দু রাজার হাতে নির্যাতিত হওয়াকে সহ্য করতে পারেন। অবশ্য একথা বলা চলে, হাজ্জাজ তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের জন্য ছিলেন কঠোর আর দুশমনদের জন্যে ছিলেন সাক্ষাত মৃত্যু।
রাতের বসরা হয়ে উঠল দিনের মতো কর্মমুখর। হাজ্জাজ যে নির্দেশ দিতেন, তিনি এর শতভাগ বাস্তবায়ন দেখতে চাইতেন। সিরীয় সৈন্যদের থেকে তিনি বেছে বেছে ছয় হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নির্বাচন করলেন এবং তাদেরকে বসরার উন্মুক্ত ময়দানে তাঁবু ফেলে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। এসব সৈন্যরা একাধারে রাতদিন তরবারী, তীর ও বর্শা চালনার উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে লাগল। সেই সাথে চলল অশ্বারোহণ মহড়া। কোন সৈন্য যদি ক্লান্ত হয়ে থেমে যেত কিংবা পড়ে যেত, তাহলে হাজ্জাজের নির্দেশ ছিল, “তাকে চাবুক মেরে তুলে দেবে।” সৈন্যদের প্রশিক্ষণ হাজ্জাজ নিজে তদারকি করতেন। হাজ্জাজ যখন
সৈন্যদের শরীর ক্লান্তি অবসাদে চুরচুর হয়ে গেছে। তখন তিনি সবাইকে একত্রিত করে বলতেন, “তোমরাই ইসলাম ও আরবের মর্যাদার রক্ষক। সেই সাথে একথা চিন্তা করো, যে সব নারী ও শিশুকে হিন্দু রাজা বন্দি করে রেখেছে, এরা তোমাদের কারো না কারো মা, বোন অথবা কন্যা।” অপর একদিন সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হাজ্জাজ বললেন, “আজ আবারো আমি তোমাদের বলছি, অসহায় এক আরব কন্যা আমাকে সাহায্যের ডাক দিয়েছে, আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছি…। আমি একাকী কি তাদের মুক্ত করতে পারব? তোমাদের আত্মমর্যাদা কি একথা সায় দেবে? তোমাদের নির্যাতিতা অসহায় বিপন্ন কন্যা-জায়াদের মুক্ত করতে আমি কোন চেষ্টা না করে তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে ভুলে থাকবো?… না, তোমরা আমার সঙ্গী
হলেও আমার পক্ষে তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা সম্ভব নয়, আমি একাকী হলেও তাদের ডাকে সাড়া দেবো…।”
“আমরাও যাবো।” এক বাক্যে সমবেত সৈন্যদের মুখে উচ্চারিত হলো। সৈন্যরা চিৎকার করে বলতে লাগল, “আপনি একা নন, আমরাও যাবো।”
এভাবে সারা দিনের কঠোর পরিশ্রমে অবসন্ন ক্লান্ত সৈন্যদেরকে নানা কথায় হাজ্জাজ উজ্জীবিত করতেন, তাদের আত্মমর্যাদাবোধকে চাঙ্গা করে তুলতেন এবং আবেগকে আন্দোলিত করতেন। যার ফলে কঠোর পরিশ্রান্ত সৈন্যরা সারাদিনের কষ্টকর প্রশিক্ষণের ক্লান্তি ভুলে গিয়ে আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠত।
ট্রেনিং এর পাশাপাশি বসরার উন্মুক্ত মাঠে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ অসি চালনা, ঘোড়দৌড় ও মল্লযুদ্ধের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। এসব আয়োজনের ফলে দৃশ্যত মনে হলো ইরাক ও সিরিয়ার সকল ঘোড়া ও উট। বসরার মাঠে এসে জড়ো হয়েছে। হাজ্জাজ সারা দেশে প্রচার করে দিয়েছিলেন, “বসরায় ঘোড়দৌড়, অশ্বচালনা, তরবারী চালনা, বর্শা নিক্ষেপ, মল্লযুদ্ধ, হাতিয়ার ও লাঠি খেলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এসব প্রতিযোগিতায় যারা বিজয়ী হবে কিংবা দক্ষতা দেখাবে, তাদেরকে সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে ভর্তি করে নেয়া হবে এবং দেশের বাইরে তাদেরকে এমন জায়গায় যুদ্ধে পাঠানো হবে, যেখান থেকে তারা লাভ করবে অঢেল ধন-সম্পদ।” সে সময় মুসলমানদের আত্মমর্যাদাবোধ যেমন ছিল উন্নত, তেমনি সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদে আসীন হওয়া এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী। সৈন্য হিসাবে মালে গনীমতের অধিকারী হওয়ার প্রতি আগ্রহ থাকতো যে কোন আরব যুবকের। সৈন্য ভর্তির মেলা ও প্রতিযোগিতা চলল টানা কয়েকদিন। দিন যতোই যেতে লাগল প্রতিযোগী যুবকদের ভীড় ও মেলাঙ্গনে মানুষের সমাগম আরো বাড়তে লাগল। হাজ্জাজ বসরার কিছু লোককে নিয়োগ করে রেখেছিলেন, যারা মেলাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে মানুষের মধ্যে প্রচার করতো সিন্ধু অঞ্চলের এক হিন্দু রাজা মুসলমানদের একটি জাহাজ লুট করে জাহাজে আরোহী বহু আরব নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুবককে বন্দি করে রেখেছে। আমাদের উচিত আরবের মর্যাদা রক্ষায় যুদ্ধ করে হিন্দু রাজাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে আরব শিশু কন্যাদের মুক্ত করে আনা। প্রচারক দল নানাভাবে ভাষার লালিত্য দিয়ে মেলায় আগত মানুষের মধ্যে জাত্যাভিমান জাগিয়ে দিচ্ছিল। যা হাজ্জাজ প্রত্যাশা করেছিলেন। এর ফলে মেলায় আগত সকল মানুষের
মধ্যে একটা প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকের মধ্যে জাত্যাভিমান ও ইসলামের চেতনা উজ্জীবনী শক্তিতে পরিণত হয়।
মেলা চলাকালে কয়েক দিন প্রতিযোগিদের উৎসাহ দিতে হাজ্জাজ নিজেও উপস্থিত হয়ে সমবেত দর্শক প্রতিযোগিদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি সেই কথাই পুনরাবৃত্তি করেন, যে কথা তিনি বসরার জামে মসজিদে সমবেত লোকদের উদ্দেশে বলেছিলেন। খলিফা আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান প্রতি বছর দামেশকে এ ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। সেই প্রতিযোগিতা দেখা ও অংশগ্রহণের জন্য বহু দূর থেকে লোকজন আসতো। ঘটনাক্রমে যেদিনগুলোতে খলিফা আব্দুল মালিক সামরিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন, ঠিই একই সময়ে বসরায় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বসলেন। কিন্তু হাজ্জাজের প্রতিযোগিতার প্রচারণা এতোটাই তুঙ্গে ছিল যে, দামেশকের অধিকাংশ লোক হাজ্জাজের মেলায় যোগদান করতে বসরায় চলে এলো।
সেদিন ছিল মেলার ষষ্ঠ দিন। অস্ত্রবিহীন চার অশ্বারোহী একে অন্যের সওয়ারী কেড়ে নেয়া এবং অশ্বপৃষ্ঠ থেকে প্রতিপক্ষকে ফেলে দেয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। চার প্রতিযোগির প্রত্যেকেই সমানে সমান। কেউ কাউকে হারাতে পারছে না। উর্ধ্বশ্বাসে সবাই ঘোড়া ছুটাচ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আর দর্শকদের চিঙ্কার উল্লাসে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠেছে। আর অশ্বারোহীদের কসরতে মাঠের ধুলোবালি আকাশে উঠে যাচ্ছে। মধ্য মাঠ ধুলোতে অন্ধকার হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে হাজ্জাজ প্রতিযোগিদের পাশাপাশি তার ঘোড়া হাঁকিয়ে তাদের উৎসাহ দিতে লাগলেন। হাজ্জাজের উপস্থিতিতে প্রতিযোগিরা যেমন উজ্জীবিত হলো দর্শকরাও উচ্ছাসে ফেটে পড়লো। দর্শকদের কোলাহলে বসরার সবকিছু চাপা পড়ে গেল। হাজ্জাজ প্রতিযোগিদের দিকে নিবিষ্ট ছিলেন ঠিক এ মুহূর্তে ধুলি অন্ধকারের মধ্য থেকে ধাবমান এক অশ্বারোহী এসে হাজ্জাজের ঘোড়ার পাশাপাশি নিজের ঘোড়া হাঁকাতে লাগল। কিন্তু হাজ্জাজের সেদিকে খেয়াল ছিল না, তার পাশেই আর এক অশ্বারোহী রয়েছে। হঠাৎ আরোহী হাজ্জাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, “বসরার আমীর কি আমাকে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ফেলে দিতে চান?” হাজ্জাজের কানে ভেসে এলো তাকে চ্যালেঞ্জ করার আওয়াজ। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে চাইলেন, কোন অশ্বারোহী তাকেই চ্যালেঞ্জ করছে কি-না। হাজ্জাজ দেখলেন তারপাশেই খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক।
খলিফাকে তার পাশে চলতে দেখে হাজ্জাজ না বিচলিত হলেন, না তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দিলো। অথচ তিনি জানতেন, খলিফা দামেশক থেকে এসেছেন, এ সময় তার দামেশকেই থাকার কথা। হাজ্জাজ খলিফার ঘোড়াকে ঠেলে ঠেলে দর্শকদের দৃষ্টি থেকে কিছুটা দূরে নিয়ে ঘোড়া থামালেন।
“মনে হচ্ছে ইবনে ইউসুফ আমাকে শুধু ঘোড়া থেকেই নয় মসনদে খেলাফত থেকেই ফেলে দিতে চাচ্ছেন” বললেন, খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক। নয়তো আপনি বসরায় এ ধরনের মেলার আয়োজন করছেন, তা অন্তত আমাকে জানাতে পারতেন। আপনি কি জানেন না, এ সময় দামেশকে সামরিক উৎসবের আয়োজন করা হয়?”
“খলিফাতুল মুসলিমীন! গুরু গম্ভীর সম্মোহনী কণ্ঠে বললেন হাজ্জাজ। আপনার প্রতিযোগিতা হয় একটি বিনোদনমূলক উৎসব। আর আমি এ আয়োজন করেছি প্রয়োজনের তাকিদে। আমি সিন্ধু আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠনের জন্য এ ব্যবস্থা করেছি। আশা করি আপনার গোয়েন্দারা আপনাকে সবই বলেছে। না বললে এ সময়ে আপনার এখানে আসার কথা নয়।”
“আপনি রীতি রক্ষার প্রয়োজনেও আমাকে এ সংবাদ দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি যে, দ্বিতীয় আরেকটি অভিযানে আমাদের সৈন্যরা সিন্ধু রাজ্যের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। এখন তৃতীয়বার আপনি অভিযানের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু… সেই পরাজয়ের লজ্জা কি আপনাকে আমার দরবারে আসার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে?” জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বললেন খলিফা। হাজ্জাজ ঠোটের কোণে ঈষৎ ক্রোড় হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, “লজ্জা যদি কাউকে করতে হয়, তাহলে আমি শুধু আল্লাহকেই করি। খলিফাতুল মুসলিমীন! স্বভাবত গাম্ভীর্যপূর্ণ কণ্ঠে বললেন হাজ্জাজ। আপনি সেই সময় দুনিয়াতে এসেছেন, যখন আমি পূর্ণ যুবক। আমি দুনিয়ায় যা দেখেছি, আপনি তা দেখেননি। আমি যা জানি, আপনি তা জানেন না। আমি এ বয়সেও যা করতে সক্ষম, আপনার পক্ষে তা হয়তো সম্ভব নয়। আপনি আপনার মসনদকে ঘিরে চিন্তা করেন, আমার চিন্তা সমগ্র আরব ও মুসলিম সালতানাতকে ঘিরে।
আমি জানি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন? আপনি চান আমি কেন অভিযানের আগে আপনার অনুমতি নিলাম না। আমি জানতাম, আপনি
আমাকে অভিযানের অনুমতি দেবেন না। আমি আপনাকে বলেছিলাম, সিন্ধু অভিযানে যে পরিমাণ সরকারী সম্পদ ব্যয় হবে, আমি তার দ্বিগুণ সম্পদ সরকারী কোষাগারে জমা দেবো। এখন আপনাকে এ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি সিন্ধু এলাকার কর্তৃত্ব আপনার পায়ের নীচে এনে দেবো।”
খলিফাকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে হাজ্জাজ আরো বললেন, আমি যদি এই হিন্দুরাজার ঔদ্ধত্যের জবাব না দেই, তাহলে এরা আজ আমাদের জাহাজ লুট করে আরোহীদের বন্দি করেছে, কাল এখানে এসে আমাদের স্ত্রী-কন্যাদের ধরে নিয়ে যাবে। দু’টি পরাজয় যদি আমরা হজম করে নেই, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয়, আপনি খেলাফতের মসনদে নয় নিজেকে দুশমনের বন্দিশালায় দেখতে পাবেন।”
খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কঠোর অবস্থান ও যুদ্ধ প্রস্তুতির পরিস্থিতি দেখে আর কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না। আসলে তখন মুসলমানদের অবস্থা পূর্বের মতো ছিল না। মসনদে সীমিত হয়ে পড়েছিল মুসলমানদের জাঁকজমক। খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিক সিন্ধু অভিযানের বিপক্ষে ছিলেন। চাহিদার পরিপন্থী হলেও এটা ছিল একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা। খলিফা নির্বিবাদে খেলাফতের মসনদে সমাসীন থাকাটাই পছন্দ করতেন। হাজ্জাজ সিরীয় সেনা ইউনিট থেকে সিন্ধু অভিযানের জন্য যে ছয় হাজার সেনাকে নির্বাচন করেছিলেন, এদের সবাই ছিল অশ্বারোহী কিংবা উষ্ট্রারোহী। এরা শুধু বাহনওয়ালাই ছিল না, প্রত্যেকেই ছিল টগবগে যুবক, তাগড়া। বয়ষ্ক দুর্বল ও অচৌকস কোন সেনাকেই হাজ্জাজ এ দলে অন্তর্ভুক্ত করেন নি। সামরিক মেলার আয়োজন করে মেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকেও ছয় হাজার যুবককে নির্বাচন করে হাজ্জাজ আরেকটি সেনা ইউনিট গড়ে তোলেন। এরা দীর্ঘ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য না হলেও ছিল দক্ষ, চৌকস ও উজ্জীবিত তারুণ্যের অধিকারী। এ বাহিনীকে গঠন করা হয় মূল বাহিনীর সহযোগী হিসাবে। সাপ্লাই ও রসদপত্র সরবরাহের সেচ্ছাসেবী এবং প্রয়োজনে সৈন্যবল বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য।
হাজ্জাজ সেনাদের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের কাজকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিলেন। সেনাদের প্রতিটি প্রয়োজন তিনি এভাবেই পূরণ করলেন, মনে হচ্ছিল এরা সৈনিক নয় যেন শাহী খান্দানের লোক। সুই সুতা থেকে নিয়ে খাদ্য বস্ত্র, অস্ত্রশস্ত্র সবকিছুই তিনি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশী ও
উন্নতমানের সরবরাহ করেন। তখন ইরাকের লোকেরা যে কোন আহারে সিরকা বেশী ব্যবহার করতো। হাজ্জাজ প্রতিটি সৈন্যের জন্যে পর্যাপ্ত সিরকার ব্যবস্থা করেন। তরল সিরকা পরিবহন সমস্যা মনে করে সিরকায় তুলা ভিজিয়ে তা শুকিয়ে প্যাকেট করে দেন। যাতে খাবার সময় সিরকা ভেজানো তুলা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে সৈন্যরা সাচ্ছন্দ্যে আহার করতে পারে। তিনি সেনাপতি ও কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সৈন্যদের খাবার ও ব্যক্তিগত প্রয়োজন পূরণে যেন কোনরূপ কৃতার আশ্রয় না নেয়। কারণ সৈনিকদের ব্যবহার্য সবকিছুই তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করেছেন। হাজ্জাজ সিন্ধু অভিযানে প্রাত্যহিক খরচ নির্বাহের জন্য ৩০ হাজার দীনার অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেন। সৈন্যদের খাবার ও রসদ পত্র জাহাজে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন এবং পদাতিক সৈন্যদের জন্য ছয় হাজার দ্রুতগামী উন্ত্রী জাহাজে প্রেরণ করেন। এ ছাড়াও পণ্য পরিবহণের জন্য দিয়েছিলেন কয়েক হাজার উট।
জাহাজে পাঠানো সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে অন্যতম ছিল মিনজানিক। ছোট বড় মিনজানিক ছিল কয়েকটি। তন্মধ্যে একটি মিনজানিক এতোটাই বিশাল ছিল যে, পাঁচশ মানুষ প্রয়োজন হতো এটাকে ঠেলে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় নেয়া এবং এটি দিয়ে পাথর নিক্ষেপের জন্য। এই মিনজানিকের নাম ছিল উরুস’। এটি দিয়ে বড় বড় পাথর নিক্ষেপ করা হতো। যে পাথর পাঁচ ছয় জন মানুষে গড়িয়ে গড়িয়ে মিনজানিকের মধ্যে তুলে দিতো। উরুসের নিক্ষিপ্ত বড় বড় পাথর যে কোন কঠিন দুর্গ প্রাচীরে ফাটল সৃষ্টি করতে এবং শত্রুদের জন্য এটি ছিল ভয়ানক ও ধ্বংসাত্মক হাতিয়ার।
তৃতীয় ও চূড়ান্ত সিন্ধু অভিযানের বিশাল ব্যবস্থাপনার জন্য হাজ্জাজ বহুমুখী প্রচারণার দ্বারা জনগণের মধ্যে যেমন জাত্যাভিমান ও ইসলামী চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন, দ্রুপ ইরাকের নারী পুরুষের মধ্যে জাগাতে পেরেছিলেন জিহাদী আবেগ। ইরাকের নারীরা তাদের স্বামী, সন্তানদেরকে জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করছিলেন এবং জিহাদের ব্যয় নির্বাহে নিজেদের সঞ্চিত সম্পদ ও অলংকারাদি হাজ্জাজের জিহাদ ফান্ডে অকাতরে ঢেলে দিয়েছিলেন। যার ফলে এতো বিশাল আয়োজন করা হাজ্জাজের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। হাজ্জাজের নবগঠিত সেনাবাহিনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করে যখন সিন্ধু অভিযানের উদ্দেশ্যে বসরা থেকে সিরাজের পথে রওয়ানা হলো, সেদিন
বসরার সকল নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সেনাবাহিনীর রণসজ্জা দেখা এবং তাদের বিদায় জানানোর জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। “আল্লাহু আকবার তাকবীর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। মুজাহিদদের সাফল্য ও শত্রুদের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়লো বসরার লোকজন। হাজ্জাজ যেন সবার বুকে আগুন ধরিয়ে দিলেন। জনতার মুহুর্মুহু শ্লোগান ও শুভ কামনায় সিক্ত হয়ে হাজ্জাজের নবগঠিত বাহিনী বসরা ছেড়ে সিরাজের পথে অগ্রসর হতে লাগল। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সেনাদের সাথে কিছুক্ষণ অগ্রসর হলেন। অবশেষে একটি উঁচু জায়গায় থেমে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে শেষ সৈন্যটি তাকে অতিক্রম করা পর্যন্ত তিনি সৈন্যদের গমন প্রত্যক্ষ করলেন এবং হাত নেড়ে তাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করতে থাকলেন। দীর্ঘক্ষণ সেনাদের আত্মীয়-স্বজনেরা সৈন্যদের গমন পথের ধুলা ওড়ার দৃশ্য অবলোকন করে তাদের পুত্র, স্বামী, ভাইদের বিজয়ের দোয়া করে অবশেষে ঘরে ফিরলেন। এই বাহিনীর সহ-সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হলো জাহাম বিন জাফর জাইফীর কাঁধে।
হাজ্জাজের প্রেরিত সেনাদের পৌছার জন্য বড় অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। সেনাদের পৌছার অপেক্ষা করাটা ছিল তার জন্য পীড়াদায়ক। তিনি কোন কাজে অহেতুক সময় ক্ষেপণ করাটা মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। মাঝে মধ্যে তিনি ঘোড়ায় চড়ে বসরার পথে বহু দূর পর্যন্ত সৈন্যদের আসার খবর জানার জন্য চলে যেতেন। একদিন নিজের কক্ষে কাজে মগ্ন ছিলেন বিন কাসিম। হঠাৎ তার কক্ষের দরজা সজোরে খুলে গেল এবং তিনি কিছুদিন যাবত যে সংবাদের জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলেন সে খবর পৌছে গেল।
“বসার দিকে বহু দূরে ধুলি ঝড় দেখা যাচ্ছে। আল্লাহর কসম! এটা ধুলিঝড় নয়।” বলল সংবাদদাতা। “ঘোড়া প্রস্তুত করো।” নির্দেশ দিলেন বিন কাসিম। ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে বেরিয়ে পড়লেন বিন কাসিম। দ্রুত ছুটালেন ঘোড়া। সাথে সাথে তাঁর দেহরক্ষী দল তাঁর অনুসরণ করলো। অনেক পথ অগ্রসর হয়ে বসরার সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানালেন বিন কাসিম। এখন হাজ্জাজের নির্দেশ মতো গোটা বাহিনীর সেনাপতির
দায়িত্ব নিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। জাহাম বিন জাইফী হলেন তার সহযোগী।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সিন্ধু অভিযানের খবরাখবর দ্রুত পাওয়া ও নির্দেশ পৌছানোর জন্য বসরা থেকে মাকরান পর্যন্ত বহু সংখ্যক সেনা চৌকি স্থাপন করলেন। এসব চৌকিতে কিছু সংখ্যক সৈন্য, দ্রুতগামী ঘোড়াসহ দক্ষ অশ্বারোহী সৈন্য অবস্থান করতো। তারা উভয় দিকের বার্তা দ্রুত অপর চৌকিতে পৌছে দিতো। এভাবে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে সংবাদ সরবরাহের ব্যবস্থা করলেন হাজ্জাজ। ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন, স্বাভাবিকভাবে বসরা থেকে মাকরান পৌছতে একজন মুসাফিরের সময় লাগতো যেখানে দেড়মাস, সেক্ষেত্রে হাজ্জাজ মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে সংবাদ পৌছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। জাহাম বিন জাইফীর কাছে হাজ্জাজ মৌখিকভাবে বলে দিয়েছিলেন বিন কাসিম তার পরবর্তী নির্দেশ পাওয়ার আগে যেনো আক্রমণ শুরু না করেন। ডাভেলে পৌছার আগেই কিছু ছোট ছোট দুর্গ অস্ত্রমুক্ত করার আবশ্যকতা ছিল।
কিন্তু হাজ্জাজ পুননির্দেশ দেয়ার শর্ত করায় বিন কাসিমকে হাজ্জাজের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিতে হলো। হাজ্জাজের প্রেরিত বাহিনী সিরাজ পৌছার পরদিনই মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলেন। সে সময় আরব সাগরের কুলে অবস্থিত মাকরানের যে অংশটি মুসলিম শাসনাধীন ছিল এর শাসক ছিলেন মুহাম্মদ বিন হারুন। তাকে আগেই সংবাদ পাঠানো হয়েছিল তৃতীয় এবং চূড়ান্ত আঘাতের জন্য নতুন সেনাবাহিনী আসছে। তাই মাকরানের শাসক বিন হারুন কিছুটা পথ এগিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের বাহিনীকে স্বাগত জানাতে ঘোড়ার পিঠে বসে রইলেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম মনে করেছিলেন মাকরানের শাসক হয়তো ঘোড়া দৌড়িয়ে তার কাছে চলে আসবেন। কিন্তু তিনি দেখলেন বিন হারুন ঘোড়ার পিঠে অধোমুখে ঠায় বসে আছেন। তিনি এ অবস্থা দেখে নিজেই ঘোড়া হাঁকিয়ে কাছে গিয়ে যখন তার সাথে মোসাহাফা করলেন, তখন অনুভব করলেন বিন হারুনের দেহে প্রচণ্ড জ্বর। জ্বর এতোটাই তীব্র যে তার ঘরের বাইরেই বের হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু মুহাম্মদ বিন হারুন স্বদেশী সৈন্যদের স্বাগত জানানোর আবেগকে ধরে রাখতে পারেন নি। প্রচণ্ড জ্বর নিয়েই তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই অসুখ নিয়েই তিনি বিন
কাসিমের বাহিনীকে সঙ্গ দেন, সার্বিক সহযোগিতা করেন। আর এই অসুখেই তার মৃত্যু ঘটে।
“যা, তাদের ব্যাপারে আমি উদ্বিগ্ন। কারণ তাদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। তাছাড়া আরবরা দক্ষ যোদ্ধা, লড়াকু। তারা নিশ্চয়ই রাজা দাহিরের পক্ষাবলম্বন করবে। কারণ রাজা দাহির আশ্রয় দিয়ে তাদের বিরাট উপকার করেছে।”
“আমাদের বিরুদ্ধে আগের দুই যুদ্ধে বিদ্রোহী আরবদের কেউ অংশ গ্রহণ করেছিল এমন কোন খবর আমরা পাইনি।” বললেন মাকরানের শাসক। আমাদের গোয়েন্দারা বলেছে, রাজা দাহির আলাফীকে তার সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তাব করেছিল এবং লোভও দেখিয়েছিল, কিন্তু আলাফী এতে সম্মত হয়নি।” “আল্লাহ আপনার ওপর রহম করুন, সম্মানিত আমীর। আমি আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতাকে শ্রদ্ধা করেই বলতে চাই, আপনার দেয়া তথ্যকে আমি বিশ্বাস করি। আপনি দেখেছেন বিগত দুইটি অভিযানের চেয়ে বসরা ও সিরিয়ার শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এবার অনেক বেশী সৈন্য পাঠিয়েছেন। এই বিশাল বাহিনীকে অবতরণ করতে দেখে রাজা দাহির নিশ্চয়ই তার সহযোগীদের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য জোর চেষ্টা চালাবে। এও তো সম্ভব, যে কোন মূল্যে সে আরব অভিবাসীদেরকে তার পক্ষে যুদ্ধ করতে সম্মত করবে।” বললেন বিন কাসিম।
“এ ব্যাপারে আমরা আলাফীকে ডেকে কথা বলতে পারি। আমরা আলাফীকে রাজা দাহিরের সহযোগিতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে পারি। অবশ্য এর আগে এরা এক যুদ্ধে রাজা দাহিরের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছিল এবং দাহিরের এক শক্তিশালী শত্রুকে এরাই শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিল। যাক, তুমি চাইলে আমি আলাফীকে এখানে ডেকে আনতে পারি।”
“তাকে কি এখানে ডেকে আনা সম্ভব?
“ডাকলে হয়তো নাও আসতে পারে, তবে খবর পাঠিয়ে দেখা যাক। আমি তাকে গোপনে এক জায়গায় আসার কথা বলবো, সেখানে গোপনে আমি এবং তুমি অথবা তুমি একাকী তার সাথে দেখা করে কথা বলবে।” বললেন মাকরানের শাসক।
“আমি তো তার ঠিকানায় গিয়ে কথা বলতেও প্রস্তুত।” বললেন বিন কাসিম।
“না ভাই! যে আমাদের শাসক ও খলিফার বিদ্রোহী। তার প্রতি এতোটা আস্থাবান হওয়া ঠিক হবে না। কারণ বিদ্রোহী মন কখন কি করে বসে ঠিক নেই। তুমি একজন দক্ষ সেনাপতি ও বিচক্ষণ যোদ্ধা হতে পারো, তারপরও আমি বলবো, এ ব্যাপারে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করাই সমীচীন হবে। আমি বরং এমন এক জায়গায় তাকে সাক্ষাতের কথা বলি যেটা আমাদের দখলে নয় আবার তার নিয়ন্ত্রণাধীনও নয়।” এই বলে মাকরানের শাসক এক ব্যক্তির নাম ধরে ডাকলেন।
ডাকে সাড়া দিলো এক মধ্যবয়সী লোক।
“ইবনে হায়সামা! তুমিই পারবে এ কাজটি করতে। বনী উসামার হারেস আলাফীকে আমার কথা বলবে। সেই সাথে বলবে অমুক জায়গায় সাক্ষাত করতে।”
“সম্মানিত শাসক। আলাফীকে ডাকার কারণ জানতে পারি কি? কারণ আমি কি তাকে বলবো মুহাম্মদ বিন হারুন আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চান। সে যদি আমার কাছে আরব সেনা উপস্থিতির কথা জানতে চায় তাহলে কি বলবো?” “সে সতর্ক মানুষ। আরবের সেনা উপস্থিতির কথা তার কাছে অস্বীকার করা ঠিক হবে না। তাছাড়া সৈন্য আগমনের বিষয়টিও তার না বোঝার কথা নয়। এসব কথা তোমাকে বলে দেয়ার বিষয় নয়
মান লোক। তোমার মূল কাজ হলো, তাকে সাক্ষাতের জন্য রাজি করানো। আশা করি তুমি তা পারবে। আমরা কেন তার সাথে সাক্ষাত করতে চাই, তাও তার বুঝতে অসুবিধে হবে না।” মুহাম্মদ বিন হারুন একটি জায়গার কথা বলে বললেন, আলাফীকে নিয়ে তুমি আজ রাত এশার পর সেখানে উপস্থিত হবে।”
মাকরানে আট দিন কেটে গেছে বিন কাসিমের। এ দিনগুলোতে জাহাজ থেকে আসবাবপত্র, পণ্য সামগ্রী ও রসদ নামানোতেই লেগে গেল। এ ছাড়া যেসব সামগ্রী ও রসদ ডাভেল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, সেগুলো যাচাই করে অন্য জাহাজে তোলা হলো। আর এরই মধ্যে যেসব এলাকা দিয়ে বিন
কাসিমকে অগ্রসর হতে হবে যুদ্ধের নীতি অনুযায়ী সেসব এলাকার আগাম পরিস্থিতি জানার জন্য বিন কাসিম অগ্রবর্তী গোয়েন্দাদের পাঠিয়ে দিলেন। মাকরানের যে এলাকায় সেনাবাহিনী অবতরণ করল, সেই এলাকাটি সেনাদের ব্যস্ততা ও কর্মচাঞ্চল্যে মুখরিত হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল যেন দিন রাত সবই একাকসার হয়ে গিয়েছে। আর বিন কাসিমের সেনারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল যথাযথ আক্রমণের।
এদিকে রাজা দাহির তার রাজ দরবারে সমাসীন। তার সভাসদবর্গ উপস্থিত। আরব সেনাদের আগমন সংবাদ পেয়ে রাজা দাহির জরুরী সভা তলব করেছে। সংবাদ বাহকদের সংবাদ পাওয়ার পর রাজা দাহিরের পারিষদবর্গ কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। এমতাবস্থায় প্রহরী এসে খবর দিলো, “এক উষ্ট্রারোহী বাইরে অপেক্ষা করছে মহারাজ! মনে হয় কোন জরুরী সংবাদ নিয়ে এসেছে।”
“ওকে এক্ষণই এখানে নিয়ে এসো।” আগন্তুক দৌড়ে রাজ দরবারে প্রবেশ করে মেঝেতে বসে দু’হাত প্রসারিত করে রাজাকে কুর্নিশ করে হাঁটু ভাঁজ করে বসলো।”
“কি খবর এনেছো?” “পানি, এক ঢোক পানি!”
সংবাদবাহী পানি ছাড়া আর কোন কথাই বলতে পারলো না। ক্ষুৎপিপাসায় লোকটির মুখ হাঁ করে আছে। রাজার নির্দেশে তড়িঘড়ি এক গ্লাস পানি আগন্তুককে পান করানো হলো। পানি পান করে আগন্তুক বলল, “মহারাজের জয় হোক। আরব দেশ থেকে এখন যে সেনাবাহিনী এসেছে, এটি কোন বাহিনী নয় উট, ঘোড়া আর মানুষের প্লাবন। জাহাজ থেকে যেসব রসদপত্র নামানো হয়েছে, এসবের কোন হিসাব কিতাব নেই। সৈন্য সংখ্যাও কতো তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। মাকরানের উপকূল জুড়ে জাহাজ ও নৌকার সংখ্যা এতো বিপুল যে, জাহাজের ভিড়ে কোন কিছুই আন্দাজ করা যায় না।” “এ আগন্তুক ছিল মাকরানের সীমান্ত এলাকায় নিয়োজিত দাহিরের এক গোয়েন্দা সদস্য। সে এক পথিকের কাছে শুনতে পায় যে, বহু জাহাজ ভরে আরব দেশ থেকে অগণিত সৈন্য মাকরানে অবতরণ করছে। খবর পেয়ে
রাজা দাহিরের এই গোয়েন্দা বেশ বদল করে মাকরানের মুসলিম শাসিত এলাকায় গিয়ে স্বচোখে আরব সৈন্য অবতরণের দৃশ্য দেখে দ্রুতগামী উটে সওয়ার হয়ে রাজ-দরবারে সংবাদ নিয়ে আসে।
দাহিরের এ গোয়েন্দা রাজাকে জানায়, “আমি শুনেছি, জাহাজে করে যে পরিমাণ সৈন্য এসেছে এর চেয়ে ঢের বেশী এসেছে স্থলপথে। আসলে রাজা দাহিরের সংবাদ বাহকের খবর ছিল অতিরঞ্জিত। সে নিজে যেমন মুসলিম বাহিনীর অবতরণ দৃশ্য দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল, সে অনুযায়ী রাজার কাছে যে রিপোর্ট দিলো তাও ছিল ভীতি জাগানিয়া। বাস্তবের চেয়ে বহুগুণ বেশী ভীতিকর হিসাবে চিত্রিত করেছিল সে বিন কাসিমের বাহিনীকে। যার ফলে রাজা দাহিরের মধ্যে দেখা দেয় মারাত্মক শঙ্কা। রাজা দাহির সাধারণ বৈঠক মুলতবি করে সামরিক অফিসারদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকে বসলো। প্রধান উজির বুদ্ধিমানকে রাখা হলো এ বৈঠকে।
বৈঠকে রাজা তার সেনা অফিসারদের জানালো, “আবার আরবরা আক্রমণ করতে এসেছে। বলো এবার আরব সেনাদের কিভাবে মোকাবেলা করা যাবে?” আমাদের হাতে দুটি সেনাপতি হারিয়ে এবং দু’বার পরাজিত হয়ে ওরা আমাদের শক্তির কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। এ জন্যই মনে হয় এবার বেশী সংখ্যক সৈন্য ও রসদপত্র নিয়ে এসেছে। ওদের দেমাগ খারাপ হয়ে গেছে। এবার একটা বড় সেনাবাহিনীকে বাজি খেলায় পাঠিয়েছে। আমরা এবারের বাজিতেও বিজয়ী হবে। এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত কি?” অন্যদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো রাজা।
রাজার সেনা কর্মকর্তারা রাজার মতোই উচ্চাশা নিয়ে রাজার মতকেই সমর্থন করলো। তাদের কেউই রাজার মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করার সাহস পেল না। ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র দাহিরের প্রধান উজির বুদ্ধিমান। বুদ্ধিমান গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল। সবার মতামত দেয়ার পালা শেষ হলে উজিরে আযম বুদ্ধিমান বলল, “মহারাজ! রণাঙ্গনে তরবারী কাজ করে অহংকার কাজ করে না। সেখানে তীর বল্লম কাজ করে, চাপাবাজি রণাঙ্গনে কোনই কাজে আসে না। কায়সার ও কিসরা আরব মুসলমানদের দুর্বল ভেবেছিল। ইয়াজ্বদেগিদ তো বলেছিল, আরব সৈন্যরা তার ঘোড়র পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু দেখা গেল, বিশাল ক্ষমতার অধিকারী শক্তিশালী নোম ও পারস্য বাহিনীকে আরবরা পরাজিতই শুধু করেনি, শোচনীয়ভাবে নাস্তানাবুদ করেছে। এটা কোন কাল্পনিক গল্প নয়, রূঢ় বাস্তব ঘটনা।
“যা, এটাতো সত্য ঘটনা। ওখানে মুসলমানরা হিন্দুস্তানের হাতিগুলো পর্যন্ত বেকার বানিয়ে ফেলেছিল” বলল রাজা। আচ্ছা কি যেন নাম ছিল সেই রণাঙ্গনের?” “কাদেসিয়া” বলল উজির বুদ্ধিমান। আগত মুসলমানরা ওইসব যোদ্ধারই সন্তান। এরা ইচ্ছা করলে আমাদেরও পরাজিত করতে পারে। এখন যদি ওরা অনেক বেশী সৈন্য নিয়ে এসে থাকে, তাহলে এই সৈন্যদের সেনাপতিও পূর্বের সেনাপতিদের তুলনায় বেশী অভিজ্ঞ ও দক্ষ। এমনও হতে পারে যে, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজেই কমান্ড করবে। মহারাজ তো হাজ্জাজের নির্মমতা ও কঠোরতার কাহিনী শুনেছেন। আশ্রিত আরবরা আমাকে বলেছিল, খলিফাকে হাজ্জাজ তেমন আমল দেয় না। হাজ্জাজ তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় তার ইচ্ছামতো শাসন চালায়।”
“হাজ্জাজ নিজে সেনাপতি হলে তাতে কি হবে?” জিজ্ঞেস করল রাজা দাহির। তাহলে আমিও আমার সেনাবাহিনীর কমান্ড আমার হাতে রাখবো। শুধু এটাই নয় মহারাজ। আপনার জেনে রাখা উচিত লড়াই শুধু রণাঙ্গনেই হয় না। সব লড়াই শুধু তীর ঢাল তলোয়ারে সীমাবদ্ধ থাকে না। সর্বক্ষেত্রে বিজয় শুধুই শক্তিশালী সামরিক শক্তির অধিকারীদের পক্ষে যায় না, দুর্বলের ভাগ্যেও কোন কোন সময় জয় লেখা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্বল প্রতিপক্ষও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পঙ্গু করে দেয়।”
“এটা কি করে সম্ভব?” রাজা দাহির উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইলে উজির বুদ্ধিমানের কাছে। জবাবের অপেক্ষা না করেই রাজা দাহির বলল, “উজির যদি মনে করে থাকো যে, আমরা রণাঙ্গনে মোকাবেলা না করে অন্য কোন ধোকা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শত্রুদের পরাভূত করতে পারবো সেটাকে আমাদের রক্ত প্রশ্রয় দেবে না। আমরা রণাঙ্গনে শত্রুদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে চাই এবং আমাদের তলোয়ারের কার্যকারিতা দেখাতে চাই। দু’বার আমরা যাদের হাঁটু ভেঙে দিয়েছি, তৃতীয়বারও অবশ্যই ওদের পরাজিত ও বিতাড়িত করতে সক্ষম হবো।” “কিন্তু বিষয়টা সে রকম নয় মহারাজ! আমি অন্য কথা বলছি। হাজ্জাজ নিজে যদি এই বাহিনীর কমান্ড দেয় তাহলে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভিন্ন ধরনের হয়ে যাবে মহারাজ! বলল উজির বুদ্ধিমান। আমি একথা বলছি না যে, মহারাজ দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকুন। লড়াই আমাদের করতেই হবে এবং রণাঙ্গনেই মোকাবেলা হবে। কিন্তু লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার আগে
শত্রুদেরকে যদি দুর্বল করে দেয়া যায়, তাহলে সেটি হবে বিজয়ের জন্য সহায়ক। তখন খুব তাড়াতাড়ি শত্রুদের মাথা কেটে দেয়া সম্ভব হবে।”
“কিভাবে শত্রুদেরকে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই দুর্বল করে দেয়া যায়?”
“কিছু কিছু দুর্বলতা মানুষের মধ্যে এমন থাকে যা বীর বাহাদুরকে দুর্বল এবং দুর্বলকেও বীর বাহাদুর করে ফেলে। রাজা যেমন রাজ সিংহাসন ছাড়া থাকতে পারে না, পুরুষ ও দ্রুপ নারীসঙ্গ ছাড়া স্বস্তি পায় না। রাজা যেমন তার মুকুট জগতের সবচেয়ে মূল্যবান মণিমুজ দিয়ে সাজাতে চায়, প্রতিটি সামর্থবান পুরুষও চায় তার চাহিদা মেটানোর জন্য সবচেয়ে সুন্দরী রূপসী নারীর সঙ্গ।”
‘কথাটা বুঝলাম না উজির। পরিষ্কার করে বলে এবং সেই কথা বলো যা কার্যকর করা সম্ভব।” উম্মা মাখা কণ্ঠে বলল রাজা।
“মহারাজ! নারী একটা নেশা। সম্পদ ও ক্ষমতা এই নেশাকে আরো তীব্র করে তোলে। ক্ষমতা হাতে এসে গেলে এ নেশা মেটানোর সুযোগ পূর্ণতা পায় এবং নেশাগ্রস্ত পুরুষ তার ব্যক্তিত্ব আত্মসম্মান ও কর্তব্যবোধ ভুলে যায়। পাচ ছয়শ মুসলমান অনেক দিন যাবত আমাদের আশ্রয়ে রয়েছে আমি তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি এবং আরবদেরও খবর নিয়েছি, এদের শাসকদের ব্যাপারেও জেনেছি, এদের মধ্যে নারী ও দৌলতের দুর্বলতা খুবই কাজ করে। কাজেই তলোয়ার দিয়ে আঘাত করার আগে এদেরকে নারী ও দৌলত দিয়ে অন্ধ বানিয়ে ফেলা হবে বেশী কার্যকর।”
“বুদ্ধিমান! তুমি কি হাজ্জাজ ও হাজ্জাজের বাহিনীর কথা বলছো?” পরিষ্কার বুঝে উঠতে না পেরে উজিরের কাছে জানতে চাইলো রাজা দাহির।
“না, আমি বলছি সেই আরবদের কথা যাদেরকে আপনি আপনার আশ্রয়ে রেখেছেন। বলল উজির। মহারাজ প্রথম যুদ্ধের বেলায়ই দেখেছেন এই আরবরা আক্রমণকারী আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেছে। অথচ শাসকরা ওদের ঘোর দুশমন। তাদের শত্রু কবিলার হাতে খেলাফতের ক্ষমতা। এসব আশ্রিত আরব হলো বনী উসামা গোত্রের। আর বর্তমান আরব শাসকরা হচ্ছে বনী উমাইয়া গোত্রের। তদুপরি স্বদেশীদের বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরতে এরা নারাজ। এখন এদের মধ্যে ওদের জাতিগত শত্রুতা আর শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষকে চাঙ্গা করতে হবে। এমন কোন পন্থা
অবলম্বন করতে হবে, যার ফলে আগত আরব সৈন্যদের প্রতি আশ্রিত আরবদের ঘৃণা ও হিংসা আক্রোশে পরিণত হয়।”
“তাতো বুঝলাম। কিন্তু এখন সেই কথা বলো, যা দিয়ে আমি এসব আরবের রক্তে শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আগুন ধরিয়ে দিতে পারি।” বলল রাজা দাহির।
“মহারাজের জয় হোক” উচ্ছসিত কণ্ঠে বলল উজির। এ কাজের দায়িত্ব আমি নিজের কাঁধে নিয়ে নিচ্ছি। মহারাজ সৈন্যদের দিকে নজর দিন, তাদের প্রস্তুত করুন। লড়াইয়ের কলাকৌশল মহারাজ আমার চেয়ে ঢের ভালো জানেন। তবে আমার মতামত হলো, দুর্গের বাইরে ময়দানে গিয়ে লড়াই করার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ মুসলিম বাহিনী ডাভেল পর্যন্ত আসবে। মহারাজের রাজধানী তাদের কাছে এতোটা মূল্যবান নয়, ডাভেল তাদের কাছে যতোটা দামী ও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডাভেল এ অঞ্চলের একমাত্র বড় সমদ্র বন্দর।
ডাভেলের আগে আমাদের আরো দুটি ছোট ছোট দুর্গ আছে। এগুলো মুসলমানরা হাতিয়ে নিতে পারবে। অবশ্য তাতে উপকার হবে মহারাজের। কারণ এসব দুর্গে মুসলমানদের যথেষ্ট শক্তি ক্ষয় হবে এবং অবরোধ আরোপ করে দীর্ঘদিন কাটাতে হবে। এতে করে তাদের আহার সামগ্রী ব্যয় হবে। ফলে ডাভেল পর্যন্ত পৌঁছতেই তাদের অর্ধেক সম্পদ ব্যয় হয়ে যাবে। তারা ডাভেলকে অবরোধ করলেও মহারাজ রাজধানীতেই অবস্থান করবেন, তাতে ফায়দা হবে এটাই যে, ডাভেল জয় করে যখন ওরা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হবে তখন ওদের সৈন্যরা ক্লান্তি, অবসাদ ও রসদপত্রের ঘাটতির শিকার হবে। এমতাবস্থায় আমরা আশ্রিত আরবদের প্রস্তুত করে ওদের দিয়ে হাজ্জাজের বাহিনীর ওপর আঘাত করাবো।”
উজির বুদ্ধিমানের পরিকল্পনা ছিল যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত। দৃঢ়তার ছাপ ছিল তার কথায়। রাজা ও রাজার অপর কোন সেনাপতি উজির বুদ্ধিমানের পরিকল্পনার বিপরীতে যৌক্তিক কোন কথাই বলতে পারেনি। তাই উজিরের পরামর্শ মেনে নিয়ে রাজা ও সেনাপতিরা সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করতে লেগে গেল। বুদ্ধিমানের পরামর্শে রাজা দাহিরের সেনাপতি কূটকৌশলের প্রতি বেশী নজর দিলো। অপর দিকে রাজা প্রধান সেনাপতিকে নির্দেশ দিলো কোন চৌকস গোয়েন্দাকে মাকরান পাঠিয়ে আরব বাহিনীর সৈন্যসংখ্যার সঠিক ধারণা নিয়ে আসার জন্য। রাজা এই নির্দেশও দিলো, গোয়েন্দাকে শুধু সৈন্য
সংখ্যা জেনে আসলে হবে না, মুসলিম বাহিনীর কমান্ড কে করছে তাও জেনে আসতে হবে।”
মাকরানের শাসক মুহাম্মদ বিন হারুন ও বিন কাসিম মনে করেছিলেন হারেস আলাফী তাদের সাথে সাক্ষাতে না আসার সম্ভাবনাই বেশী। এটা ছিল একটা অবিশ্বাস্য ধরনের ঘটনা যে, আলাফী শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সাথে সাক্ষাতের ওয়াদাই করেননি, আমীর মাকরানের পাঠানো দূতকে বিশেষ সম্মান ও ইজ্জত করে আগেই বিদায় করে দিয়েছেন এই বলে যে, তুমি গিয়ে আমীরে মাকরানকে বলল আমি অবশ্যই আসবো।” মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং আমীরে মাকরান ইবনে হারুন কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম দেহরক্ষী নেয়ার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু বিন হারুন বললেন, “উমাইয়া শাসকদের প্রতি এদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও ঘৃণা রয়েছে, তাতে এদের ওপর এতোটা আস্থা রাখা ঠিক হবে না। দেশ ত্যাগের বঞ্চনায় এদের মধ্যে কোন প্রতিহিংসা যে কোন সময় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম ও আমীরে মাকরান দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় সাক্ষাতের জায়গা পৌছে দেখেন হারেস আলাফী একাকী দাঁড়ানো। আমীরে মাকরান নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছার আগেই দেহরক্ষীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার কিছু আগে ইঙ্গিত পাওয়া মাত্রই তারা যেন গোটা এলাকাটিকে ঘিরে ফেলে এবং খুব সতর্ক থাকে যেন তাদের বেষ্টনীর মধ্য থেকে কেউ বেরিয়ে যেতে না পারে কিংবা কেউ ঢুকতে না পারে।
চাঁদনী রাত। চাঁদনী রাতের খোলা ময়দানের দৃশ্য যেনো এক স্বপ্নালোকের অবতারণা করেছে। চারদিকে ঝি ঝি পোকার ডাক আর শীতল বাতাসের ঝাপটায় গাছ গাছালী ও ঝোপ ঝাড়ের শাখা দোলার মায়াবী শব্দ। এমতাবস্থায় নিরাবেগ ভঙ্গিতে হারেস আলাফী তার ঘোড়র বাগ ধরে দাঁড়ানো।
আমীরে মাকরান ও মুহাম্মদ বিন কাসিম তার কাছে গিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে অগ্রসর হলে আলাফী উভয়ের সাথে মোসাফাহা করলেন। “আমরা পরস্পর পরিচিত। আলাফীর উদ্দেশ্যে বললেন আমীরে মাকরান।
“আমরা দু’জন পরিচিত না হলেও একজন অপরজনকে জানি।” বিন কাসিমের দিকে তাকিয়ে বললেন হারেস আলাফী। “আমি এই তরুণকে এই প্রথম দেখছি, তুমিই তো কাসিমের ছেলে, হাজ্জাজের ভাতিজা, তাই না?”
“দু’জন সেনাপতিকে হারানোর পরও হাজ্জাজ কি যুদ্ধটাকে শিশুদের খেলা মনে করেন না-কি?”
“জী’ হ্যাঁ, আমি বিন কাসিম। আমিই এ বাহিনীর সেনাপতি।”
“অভিজ্ঞ দু’জন সেনাপতি যেক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছেন, সেক্ষেত্রে তোমার মতো তরুণ কি করে সেনাপতির দায়িত্ব পালনের সাহস করতে পারে? তুমি কি তাদের চেয়েও বেশী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ? তুমি কি ভাবছ, এখানে তুমি জিতে যেতে পারবে? হাজ্জাজের ভাতিজা হওয়া ছাড়া তোমার সেনাপতি হওয়ার আর কি বিশেষ যোগ্যতা আছে?”
“জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে” বললেন মুহাম্মদ বিন কাসিম। আমি আমার গুণাবলী বলার জন্য আপনার কাছে আসিনি। তবে একথা নিশ্চয়ই বলবো, শুধু ভাতিজা হওয়ার সুবাদে আমাকে সেনাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়নি।…থাক এসব কথা। আমরা যে উদ্দেশ্যে এখানে মিলিত হয়েছি, এ ব্যাপারে কথা বলাই হবে বেশী যৌক্তিক।”। “হ্যাঁ, কাজের কথাই হওয়া উচিত” বললেন আলাফী। তবে এর আগে আমি একটা কথা বলে নিতে চাই। তোমরা কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতে পারোনি। যার ফলে বিরাট নিরাপত্তা দল নিয়ে এসেছে। অথচ অবিশ্বাস কিন্তু তোমাদেরকে আমার করা উচিত ছিল, কারণ আমি তোমাদের দৃষ্টিতে বিদ্রোহী। কাজেই গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কায় আমার তো ভয় করার কথা। এজন্য আমার সাথীরা আমাকে আসতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আমি তাদের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এসেছি।”
“আল্লাহর কসম! আপনি যে আত্মশক্তিতে আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন, এর মূল্য দেয়া আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়, আল্লাহ আপনার এ আত্মবিশ্বাসের প্রতিদান অবশ্যই দেবেন। আপনাকে আমীরে মাকরান নয় আমি ডেকেছি। আমি আপনাকে ডাকার স্পর্ধা পেয়েছি, আরব জাতির সম্মান ও আরবের মান রক্ষার প্রয়োজনে। আমি আপনাকে ডেকে পাঠাতে পারি না, অনুরোধ পাঠাতে পারি।”
“আমি জানি কেন তুমি আমার সাথে সাক্ষাত করতে চাও।” বললেন হারেস আলাফী। তুমি জানো না, যে কয়েদীদের মুক্ত করার জন্য তোমরা এসেছে,
এদের মুক্ত করতে গিয়ে ইতোমধ্যে তিন বিদ্রোহী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। তারা কয়েদখানার ভিতরে ঢুকে পড়েছিল কিন্তু কয়েদীদের মুক্তি বোধ হয় এ মুহূর্তে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না। তাই সম্ভব হলো না। আমি সেদিন আমার লোকজন নিয়ে দূরে অপেক্ষা করছিলাম। আমার কাজ ছিল মুক্ত কয়েদীদেরকে আরবে পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করা। কয়েদীদের মুক্ত করার অভিযানে যে নেতত্ব দিয়েছিল তার নাম বেলাল বিন উসমান। হারেস আলাফী বিন কাসিমকে বন্দি মুক্তির ব্যাপারে বেলালের চেষ্টার কথা বিস্তারিত জানালেন। “আমি সেই বন্দীদের মুক্ত করতেই এসেছি।” বললেন বিন কাসিম। কিন্তু আমি ব্যর্থ হতে আসিনি। তবে এ কাজে আপনার সহযোগিতা আমার খুব প্রয়োজন।”
“উমাইয়া শাসকরা কি তোমাকে বলেছে আলাফীকে তোমাদের সাথে মিলিয়ে নিতে? না হাজ্জাজের নির্দেশে তুমি এ পদক্ষেপ নিয়েছো? আলাফী আমীরে মাকরানের দিকে তাকিয়ে বলল। অবশ্য এটা আমীরে মাকরানের বুদ্ধিও হতে পারে।”
“না, দোস্ত! আমীরে মাকরান আলাফীর উদ্দেশ্যে বললেন। আপনার সাথে দেখা করে কথা বলার চিন্তাটা একান্ত বিন কাসিমের ব্যক্তিগত চিন্তা।”
“আমি সিরাজ থেকে সরাসরি এখানে এসেছি। আমি বসরায়ও যাইনি, দামেশকেও যাইনি। আমার কয়েকজন সেনাপতি এ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে, মাকরানে বসবাসকারী আরব মুসলমান বিদ্রোহীরা রাজার পক্ষাবলম্বন করতে পারে। বিষয়টিকে আমিও আশঙ্কা জনক মনে করেছি। সেই আশঙ্কা থেকেই আপনার সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন বোধ করেছি। আমি আপনাকে অনুরোধ করব। মনে না চাইলে আপনারা আমাদের সহযোগিতা নাই বা করলেন। কিন্তু সিন্ধু রাজের সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকবেন। নয়তো ইসলামের ইতিহাসে এটি একটি ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের কলংক হয়ে থাকবে। সেই সাথে একথাও বলা হবে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় আপন ভাইদের পরাজিত করতে আরব মুসলমানরা বেঈমান হিন্দুদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল…। যদিও আমি জানি, আমাদের শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আপনার হৃদয়ে প্রচণ্ড ঘৃণা রয়েছে কিন্তু মুসলমানদের সম্মান রক্ষায় আপনাকে এ অনুরোধ করতে আমি দুঃসাহস দেখাচ্ছি।”
“প্রিয় ভাতিজা বিন কাসিম! তোমার ওপর আল্লাহ রহম করুন। মনে হচ্ছে, বয়সের তুলনায় তুমি অনেক বেশী বুদ্ধিমান ও সতর্ক। শোন, আমার
ও আমার সাথীদের মনে বনী উমাইয়ার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্ষোভ আছে। তুমি নিজেও তো উমাইয়া গোত্রের ছেলে ও ছাকাফী বংশের সন্তান।”
বিন কাসিম…তোমার চাচা হাজ্জাজ আমাদের সাথে শত্রুতা সৃষ্টি করেছে। সে আমাদের কবিলার এক সর্দার সুলায়মান আলাফীকে প্রথমে কয়েদ করেছে। অতঃপর তার মাথা কেটে আমাদের বংশের ছেলেদের হাতে নিহত মাকরানের গভর্নর সাঈদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল গভর্নরের স্বজনদের সন্তুষ্ট করার জন্য।”
“এসবই আমাদের গোত্রীয় শত্রুতা।” বললেন বিন কাসিম। কিন্তু আমি আপনাকে এমন এক দুশমনের কথা বলছি, যে দুশমনের কারণে আমরা পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে বন্ধুতে পরিণত হতে পারি।” “এসব কথা আমাকে বলতে হবে না বিন কাসিম! তুমি এমনটি মনে করো
যে, খান্দানী শত্রুতার কারণে আমি চিহ্নিত শত্রুকেই বন্ধু বানিয়ে ফেলব” বললেন আলাফী। তোমার হতাশ হওয়ার কারণ নেই বিন কাসিম! আমি ধর্মীয় শত্রুকে আমার জাতির বিরুদ্ধে গিয়ে দোস্ত হিসাবে কোলে তুলে নেব না। আমি তোমাদের সহযোগিতা করবো বটে। তবে তোমাদের সঙ্গ দেবো না। একথা স্মরণ রেখো, আমাদের শত্রুতা শাসকদের সাথে আমার দেশ, আমার জাতি ও ধর্মের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই। অহংকারী ও জালেম শাসকদের বিরোধিতা করা গাদ্দারী নয়, বরং অযোগ্য ও অপরিণামদর্শী শাসকদের কব্জা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা দেশ প্রেমের অংশ। আমরা আমাদের শাসকদের বিদ্রোহী ঠিক; কিন্তু শাসন ব্যবস্থার বিদ্রোহী নই। আমরা তাদেরই প্রতিবাদ করেছিলাম, যারা শাসক হওয়ার যোগ্য ছিল না, অথচ জোর করে খেলাফতের মসনদ কব্জা করে রেখেছিল।” ঐতিহাসিক বালাজুরী লিখেন, এই সাক্ষাতে হারেস আলাফী বিন কাসিমের কথায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিন কাসিমও হারেস আলাফীর আচরণে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আলাফী বিন কাসিমকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি রাজা দাহিরকে কোন ধরনের সহযোগিতা করবেন না, বরং নেপথ্যে দাহিরের বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করবেন। তবে আলাফী একথা বলেননি কিভাবে তিনি রাজার বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য চেষ্টা করবেন। একথাও তিনি জিজ্ঞেস করেননি, বিন কাসিম কখন কিভাবে কোথায় আক্রমণ করবেন। কারণ তাতে সংশয় ও সন্দেহ দানা বাধতে পারে, সৃষ্টি হতে পারে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের উপাদান।
এখানকার সেনাবাহিনী কতটা লড়াকু? আলাফীর কাছে জানতে চাইলেন বিন কাসিম। আসলেই কি এখানকার বাহিনী এতোটা সাহসী, যার ফলে এরা দু’বার আমাদের দুটি অভিযানের সেনাপতিদের হত্যা করেছে এবং শোচনীয়ভাবে তাদের কাছে আমাদের সেনারা পরাজিত হয়েছে?
“তুমি যদি এদের ওপরে তোমার ভীতি ছড়িয়ে দিতে পারো তাহলে সহজেই রাজার বাহিনীকে কাবু করা সম্ভব।” বললেন আলাফী। এখানকার সেনাবাহিনী বাহাদুর নয় বটে তবে একেবারে কাপুরুষও নয়। আগের দুটি অভিযানে এজন্য এরা বাহাদুরী করেছে যে, তোমাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল কম এবং আক্রমণে ছিল তাড়াহুড়া। হাজ্জাজ দাহির বাহিনীর শক্তি সম্পর্কে সঠিক ধারণা করতে পারেনি। এতোটা দূরে এসে যুদ্ধ করার প্রস্তুতিটাই অন্য রকম হওয়া উচিত ছিল। আমি তোমাদের সৈন্যবাহিনী ও সাজ-সরঞ্জামের খবর পেয়েছি। এ বিপুল সৈন্যবাহিনীও সাজ-সরঞ্জামের সাথে যদি তোমাদের মধ্যে লড়াই করার মতো আবেগ ও চেতনা থেকে থাকে তাহলে তোমাদের বাহিনীকে ঠেকানোর মতো বাহাদুর সেনা এ অঞ্চলে নেই। আর যদি তোমার চাচা হাজ্জাজ ও খলিফাকে খুশী করার জন্য তোমরা যুদ্ধে এসে থাকো, তাহলে রাজা দাহিরের বাহিনীকে তোমাদের মোকাবেলায় বেশী শক্তিশালী দেখতে পাবে, আর পরাজয়ই হবে তোমাদের বিধিলিপি।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানে হারেস আলাফী ও বিন কাসিমের সাক্ষাতটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। সেদিন যদি বিন কাসিম আলাফীকে তাদের সহযোগিতার প্রশ্নে সম্মত ও রাজা দাহিরের পক্ষাবলম্বন না করতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ না করতে পারতেন, আর হারেস আলাফীর নেতৃত্বে পাঁচ ছয়শ বিদ্রোহী আরব রাজা দাহিরের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো, তাহলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যেতে পারতা, ইতিহাস হতে পারতো অন্য রকম। আলাফীকে রাজার পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত রাখার কূটনৈতিক আলোচনা পর্বটি ছিল বিন কাসিমের সিন্ধু অভিযানের সাফল্যের অন্যতম একটি দিক। কারণ তিনি একটি পরীক্ষিত ও অভিজ্ঞ শত্রুবাহিনীকে মায়া ও মমতা দিয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে পক্ষে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অবশ্য মাকরানের শাসক বিন হারুন আলাফীর প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থাবান ছিলেন না। তিনি মনে করেছিলেন আলাফীর কথা সঠিক নাও হতে পারে; অতএব তাকে বিরোধী শিবিরে রেখেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম আলাফীর সাক্ষাতের পর আক্রমণের জন্য সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত করলেন বটে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামরিক সরঞ্জাম জাহাজে পৌছার জন্য অন্তত আরো মাস খানিক মাকরানে তাঁকে অপেক্ষা করতে হলো। গুরুত্বপূর্ণ এসব সামরিক সরঞ্জামের মধ্যে অন্যতম ছিল মিনজানিক। বিন কাসিমের এ অভিযানে কয়েকটি মিনজানিক ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে সবচেয়ে বড় ছিল “উরুস” নামের মিনজানিক। অবশেষে প্রায় মাসখানিক পর মিনজানিক বহনকারী জাহাজও পৌছে গেল। এসব সামরিক সরঞ্জাম জাহাজ থেকে নামানোর পরই বিন কাসিম তার সেনাদের অভিযানের নির্দেশ দিলেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম যে দিন মাকরান থেকে ডাভেলের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী নিয়ে রওয়ানা হলেন তখন তিনি দেখলেন মাকরানের শাসক বিন হারুনও অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে এগুচ্ছেন। তিনি মাকরানের শাসককে আসতে দেখে ঘোড়া হাঁকিয়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিন হারুন ছিলেন খুবই অসুস্থ। “আমীরে মাকরান। আপনি অসুস্থ। এখন আপনি গিয়ে আরাম করুন। তিনি আমীরে মাকরানের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার জন্য দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। আপনি আমার ও সেনাবাহিনীর জন্য দোয়া করুন। “তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না আমি কোন পোশাকে এসেছি?” তোমাকে একাকী বিদায় করে আমি আরাম করতে পারি না।” বললেন আমীরে মাকরান মুহাম্মদ বিন হারুন। মুহাম্মদ বিন কাসিম ছিলেন বয়সে আমীরে মাকরানের ছেলের বয়সী। বহুবার নিষেধ করা সত্ত্বেও আমীরে মাকরান যখন বাড়িতে ফিরে যেতে সম্মত হলেন না, তখন বিন কাসিম তাকে সাথে নিয়েই রওয়ানা করলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের গন্তব্য ছিল ডাভেল। কিন্তু পথিমধ্যে তাকে কন্নৌজ পেরিয়ে যেতে হবে। কন্নৌজপুর ছিল রাজা দাহিরের একটি শক্ত ঘাঁটি। শহরটির পুরোটাই ছিল দুর্গ ঘেরা। দুর্গপ্রাচীর ছিল যথেষ্ট মজবুত। ইচ্ছা করলে বিন কাসিম কন্নৌজ এড়িয়ে ডাভেল যেতে পারতেন কিন্তু দুর্গম এ শহরে রাজা দাহিরের যথেষ্ট সেনা সমাবেশ করার আশঙ্কা ছিল। যার ফলে বিন কাসিম এ শহরকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করেন নি। তাই কন্নৌজ দুর্গকে শত্রু মুক্ত করার জন্য দুর্গ অবরোধ করা হলো।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের নির্দেশে তার এক ঘোষক কন্নৌজ দুর্গের সদর দরজার কাছে গিয়ে উচ্চ আওয়াজে ঘোষণা করলো, “দুর্গ আমাদের
কব্জায় ছেড়ে দাও, তাহলে শহরের বাসিন্দাদের জান-মালের নিরাপত্তা দেয়া হবে। আমাদের যদি দুর্গ কব্জা করতে হয়, তাহলে কারো জীবন সম্পদের নিরাপত্তার কোন দায় দায়িত্ব আমাদের ওপর থাকবে না। তখন আমাদেরকে কর দিতে হবে।” বিন কাসিমের ঘোষকের এ ঘোষণার জবাবে দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলো। এর অর্থ হলো, শক্তি থাকলে দুর্গ দখল করে নিতে পারো, আমরা দুর্গ তোমাদের হাতে ছেড়ে দেবো না।” মুহাম্মদ বিন কাসিমের সেনারা অবরোধ অক্ষুন্ন রেখে দুর্গের প্রধান ফটকের দিকে অগ্রসর হলে দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে বিপুল পরিমাণ তীর ও বর্শা নিক্ষেপ করা হলো। যারা প্রধান ফটকের দিকে অগ্রসর হয়েছিল তাদের কিছুসংখ্যক নিহত হলো। আর অধিকাংশই মারাত্মকভাবে আহত হলো। কয়েকবার দুর্গপ্রাচীরে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্য চেষ্টা করা হলো, কিন্তু প্রতিবারই মারাত্মক প্রতিরোধের মুখে পড়ে অধিকাংশ সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত কিংবা নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এমতাবস্থায় মিনজানিক ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো। সবচেয়ে বড় মিনজানিকটির ব্যবহার মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তাই ছোট ছোট মিনজানিক দিয়ে দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত হলো। ঠিক করা হলো মিনজানিক। পাথর নিক্ষেপ শুরু হলো। কিন্তু দুর্গরক্ষীরা খুবই সাহসিকতার পরিচয় দিলো। মিনজানিক চালকদের বেকার করে দেয়ার জন্য প্রধান ফটক খুলে ঝড়ের মতো কিছু সংখ্যক অশ্বারোহী বেরিয়ে এসে দ্রুতগতিতে মিনজানিক পরিচালকদের ওপর তীরবৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবার ঝড়ের বেগে কেল্লায় ফিরে যেতো। মুসলমান সৈন্যরা তাদের তাড়া করেও নাগাল পেতো না।
এভাবে টানা কয়েকদিন ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া চললো। দুর্গপ্রাচীরে যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল। দুর্গবাসীদের মধ্যে তেমন কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। মুহাম্মদ বিন হারুন অসুস্থ শরীর নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে দুর্গপ্রাচীরের চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে সৈন্যদের নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। বিন কাসিম প্রতিবারই তাকে তার তাঁবুতে বিশ্রাম নেয়ার জন্য অনুরোধ করতেন। কিন্তু বিন হারুন তাকে এই বলে নীরব করে দিতেন, “বাবা! তুমি আমার ছেলের বয়সী। আমি এ অবস্থায় তোমাকে ঠেলে দিয়ে আরাম করতে পারি না।”
দীর্ঘ একমাস কন্নৌজ দুর্গ অবরোধ করে রাখার পরও দুর্গবাসীদের মধ্যে পরাজয় বরণ করার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। কন্নৌজে সবচেয়ে দুপ্রাপ্য জিনিস ছিল পানি। খোঁজ নিয়ে বিন কাসিম জানতে পারলেন দুর্গের ভিতরে পানিরও কোন সমস্যা এ যাবত দেখা দেয়নি। তার অর্থ ছিল দুর্গবাসীরা দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার প্রস্তুতি আগেভাগেই সেরে নিয়েছিল। একদিন মুহাম্মদ বিন হারুন মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বললেন, “বিন কাসিম! আমার মনে হয় এ দুর্গ সহজে জয় করা যাবে না। আমার মতে দুর্গপ্রাচীরে আংটা লাগিয়ে ওপরে ওঠার ব্যবস্থা করা উচিত। নয়তো প্রচণ্ড আঘাত করে প্রধান ফটক খোলার উদ্যোগ নেয়া দরকার। এখানে আর কতদিন বসে থাকা যায়।” “সম্মানিত আমীর! আমি অল্প সময়ের মধ্যেই এ দুর্গ জয় করতে পারি। কিন্তু এখানে আমি শক্তিক্ষয় করতে চাই না। কারণ সামনে আমার আরো কঠিন প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হবে। দেখা যাক না, এরা আর কতদিন অবরুদ্ধ জীবন কাটাতে পারে। দুর্গের রক্ষিত খাবার ও পানি এক সময় অবশ্যই শেষ হবে। আমি চাই, দুর্গবাসীরা পানি ও খাবারের অভাবে সৈন্যদের জন্য মুসীবত হয়ে উঠুক। ততোদিন আমি আমার সেনাদের সুরক্ষিত ও নিরাপদে সংরক্ষণ করতে চাই।
আরো একমাস বিন কাসিম কন্নৌজ দুর্গ অবরোধ করে রাখলেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল দুর্গপ্রাচীর থেকে আগে যে মাত্রায় তীর বৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতো, তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। একদিন খুব সকালে মুসলিম বাহিনী খুব দ্রুততার সাথে আগের রাতের বিন কাসিমের দেয়া নির্দেশ পালনে ব্যস্ত হয়ে গেল। তারা দুর্গফটকের কাছেই অশ্বারোহণ করে পূর্ণ প্রস্তুতিতে রইলো, যাতে দুর্গ থেকে কোন সৈন্য বের হলেই ওদের তাড়া করা যায়। ওদিকে মিনজানিক গুলোকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো এবং মিনজানিক গুলোর নিরাপত্তার জন্য মিনজানিকের আগে বসানো হলো তীরন্দাজ ইউনিট। সূর্য ওঠার আগেই শুরু হলো দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপ। মিনজানিক এগিয়ে আনার কারণে মিনজানিক থেকে নিক্ষিপ্ত পাথর এখন সরাসরি দুর্গের ভিতরে আঘাত হানতে শুরু করল। প্রধান ফটক পেরিয়ে হিন্দু তীরন্দাজরা
মিনজানিক চালকদের বেকার করে দেয়ার চেষ্টা করতেই অশ্বারোহী বাহিনীর তাড়া খেয়ে আবার দুর্গের ভিতরে চলে গেল। দুর্গপ্রাচীরের ওপর থেকে মিনজানিক চালকদের উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ শুরু হলেও ওদের জবাবে মুসলিম তীরন্দাজরা ওদের দিকে তীর বৃষ্টি বর্ষণ করতে শুরু করল। এর ফলে হিন্দুরা আর মিনজানিককে বাধা দিতে পারল না।
মিনজানিকগুলো অবিরাম দুর্গপ্রাচীরের ওপর দিয়ে দুর্গের অভ্যন্তরে পাথর নিক্ষেপ করতে শুরু করল।
ঐতিহাসিকগণ লিখেন, এমনিতেই তখন দুর্গের ভিতরে পানির ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। পানির জন্য মানুষ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল। এর ওপর টানা কয়েক দিনের অবিরাম পাথর নিক্ষেপের ফলে দুর্গের অনেক ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেল, শীলা বৃষ্টির মতো নিক্ষিপ্ত হতে লাগল পাথর।
এমতাবস্থায় পাঁচদিন চলার পর দুর্গবাসীরা পরাজয় মেনে নিয়ে সাদা পতাকা উড়িয়ে দেয়ার জন্য সেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগল। দিন। যেতে না যেতেই দুর্গের ভিতরে দেখা দিলে সেনাদের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ। সেনাবাহিনীও ততোদিনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এমতাবস্থায় দুর্গশাসককে না জানিয়েই কিছু সৈনিক ও সাধারণ প্রজা মিলে দুর্গের প্রধান ফটকের ওপরে সাদা পতাকা উড়িয়ে দিলো এবং ফটক খুলে দিলো।
মুহাম্মদ বিন কাসিমের সৈন্যরা বিজয়ী বেশে দুর্গে প্রবেশ করল। বিন কাসিম দুর্গশাসককে নির্দেশ দিলেন, “যা কর নির্ধারণ করা হবে, নাগরিকদের কাছ থেকে তা সংগ্রহ করে যথাশীঘ্র বিজয়ী বাহিনীর হাতে পৌছাতে হবে।”
দুর্গের সকল সৈন্য ও পুরুষকে যুদ্ধবন্দি করা হলো এবং দুর্গ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে ওখানে কিছু সৈন্য রেখে একজনকে দুর্গের শাসক নিযুক্ত করে বিন কাসিম তার সৈন্যদের সামনে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন।
কন্নৌজের পরবর্তী শহর ছিল আরমান ভিলা। এবার মুহাম্মদ বিন কাসিম সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধের প্রতিও মনোযোগী হলেন। তিনি কন্নৌজের কয়েকজন বন্দিকে মুক্তি দিয়ে আরমান ভিলায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদের নির্দেশ দিলেন, “তোমরা আরমান ভিলায় গিয়ে বলবে, মুসলিম
বাহিনী আসছে, তোমরা কিছুতেই দুর্গ রক্ষা করতে পারবে না। দুর্গ বাঁচানোর চেষ্টা করলে আরো বেশী ক্ষগ্রিস্ত হবে।” মুহাম্মদ বিন কাসিমের নির্দেশে কন্নৌজের কিছু বাসিন্দা মুসলিম বাহিনী আরমান ভিলায় পৌছার আগে ওখানে গিয়ে ভীতিকর খবর ছড়িয়ে দিলো। ওরা বলল, “মুসলিম বাহিনী ভয়ানক শক্তিশালী। ওরা জিনের মতো শহরে বড় বড় পাথর দিয়ে ঢিল ছুড়ে ওদের সাথে কুলিয়ে ওঠা কোন মানুষের সাধ্য নেই। তবে এরা যতোটা ভয়ানক ততোটা হিংস্র নয়। আচার ব্যবহারে খুবই মায়াবী। তারা সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে কর নেয়ার বিনিময়ে জান-মাল ও ইজ্জত আক্রর নিরাপত্তা দেয়। কারো ব্যক্তিগত সম্পদ ও ইজ্জত সম্মানে আঘাত করে না। মানুষকে খুবই ইজ্জত করে। এরা বিজয়ী হলেও শহরে লুটতরাজ করে না।”
এর ফলে মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন দুর্গপ্রাচীরে ঘেরা দুর্গম শহর আরমান ভিলা অবরোধ করলেন, তখন দুর্গরক্ষীরা খুবই সামান্য প্রতিরোধ চেষ্টা করল বটে, কিন্তু এই প্রতিরোধ জোরালো ছিল না। বস্তুতঃ কয়েকদিন অবরোধ করে রেখে মিনজানিক থেকে পাথর নিক্ষেপ শুরু করলেই দুর্গবাসীরা ফটক খুলে দিল। সহজেই এই দুর্গও বিন কাসিমের দখলে চলে এলো। . মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর সেনা বাহিনীকে শক্তিক্ষয় থেকে রক্ষা করে কঠিন যুদ্ধের মোকাবেলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলেন। আরমান ভিলা ছিল সেনাদের বিশ্রামের খুবই উপযোগী; তাই কিছুদিন এখানে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। অবশ্য আরমান ভিলায় অবস্থানের অপর কারণ মাকরান শাসক মুহাম্মদ বিন হারুণের অসুখ বৃদ্ধি। সামরিক চিকিৎসকগণ শত চেষ্টা করেও মাকরান শাসকের জ্বর কমাতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আরমান ভিলাতেই তাকে দাফন করা হয়।
বর্তমানের বিখ্যাত হায়দারাবাদ শহর তখন ছিল নিক্সন নামে খ্যাত। রাসুল সাঃ-এর হিজরত ও নবুয়তের মাঝামাঝি সময়ে এই নিরূন শহরের গোড়া পত্তন হয়। পরবর্তীতে মোগল বিজয়ীরা নিরূনের নামকরণ করেন হায়দারাবাদ। কারণ হায়দারকুলী খান এটিকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম যখন কন্নৌজ জয় করেন, তখন নিরূনে একদল হিন্দু প্রবেশ করল। গায়ে তাদের গেরুয়া বর্ণের আলখেল্লা। এলোমেলো
উঙ্কো-খুশকো দীর্ঘ চুল। তাদের পা থেকে গলা পর্যন্ত কাঠ ও পুঁথির মালা প্যাচানো। এক হাতে তামার চুড়ি আর এক হাতে ত্রিশূল। তাদের পিছনে রয়েছে অনুরূপ বেশধারী কয়েকজন অনুচর। হিন্দু সাধু দলের গুরু আকাশের দিকে তাকিয়ে দু’হাত উঁচিয়ে চিক্কার করছে “লোক সকল! অপরাধের ক্ষমা ভিক্ষা করো! বিপদ ধেয়ে আসছে!!”
মানুষ তাকে ফেরাতে চেষ্টা করতো, থামাতে চেষ্টা করতো। কিন্তু কারো কথা তার কানে যায় বলে মনে হতো না। সে তার দু’হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে কতগুলো হুশিয়ারবাণী উচ্চারণ করে আপন মনে হাঁটতে থাকতো আর বলতো, “হে শহরবাসী! পালাও, শহর ছেড়ে চলে যাও! আগুন, আগুন আসছে। পাথর…। আসমান থেকে পাথর পড়বে।”…
তার বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল, যেই তার কথা শুনতো, তার মনে ভয়ানক ভীতির সঞ্চার হতো। সাধারণ লোকেরা তার অনুসারীদের জিজ্ঞেস করতো, এই সাধু বাবাজী কোথেকে এসেছেন? তিনি কি বলেন? এ সবের অর্থ কি?” তার অনুসারীরা লোকজনকে বলছিল, “বাবাজী তিন চার মাস যাবত চুপচাপ ছিলেন। কোন কথাই বলতেন না। হঠাৎ আসমানের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, “আসমান থেকে পাথর পড়বে… আগুন আসছে… ভগবানের বাহিনী আসছে!! পাপের প্রায়শ্চিত্ত করো, শহর ছেড়ে দাও।”
নিরূন শহর রাজা দাহিরের অধীনে থাকলেও এখানকার শাসক ছিলেন একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। রাজা দাহির কট্টর ব্রাহ্মণাবাদী ছিল। সে প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দীরগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও সেখানে প্রচুর সংখ্যক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বসবাস করতো এবং তাদের মতো করে ইবাদত উপাসনা করতো। এমন জায়গার মধ্যে নিরূন ছিল একটি। এখানে ছিল যথেষ্ট সংখ্যক বৌদ্ধের বসবাস।
দিনে দিনে সারা শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল সাধু সন্ন্যাসীর ভবিষ্যদ্বাণী। লোকজনের মধ্যে দেখা দিলে ভয়ংকর ভীতি। সাধুর প্রচারিত কথা নিক্সনের শাসককে জানানো হলো। সন্ন্যাসী সাধুর প্রচারিত শঙ্কাবাণীতেও সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। লোকজন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। একথা শুনে নিরূনের শাসক সন্ন্যাসীকে তার সকাশে হাজির করার নির্দেশ দিলেন। তার সৈন্যরা সন্ন্যাসীকে তার দরবারে নিয়ে গেল।
শাসক সাধুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আশঙ্কা বাণী প্রচার করছে সন্ন্যাসী!”
“এসব কথা আমার নয়। আসমানী কথা। আসমান থেকে পাথর পড়বে, সাগরের তীর থেকে এক শক্তিশালী রাজা আসবে। আগুনের মতো সব তছনছ করে তারা অগ্রসর হবে। কেউ তাদের মোকাবেলায় টিকতে পারবে না।
তার পথ রোধ করলে আসমান থেকে পাথর নিক্ষিপ্ত হবে…।” “সন্ন্যাসী! তুমি কি আরব বাহিনীর কথা বলছো? যে বাহিনী কন্নৌজ দখল করে নিয়েছে?”
“আমি কন্নৌজ যাইনি। আমি দুনিয়ার কোন খবর রাখি না। আমরা জঙ্গলে থাকি। জঙ্গলের মধ্যে আমি আসমানী আওয়াজ শুনেছি।”
“সন্ন্যাসী মহারাজ! বললেন, নিরূনের শাসক সুন্দরী। আমার শহরের প্রতি আপনি কেন এতোটা দরদী হয়ে উঠলেন? আপনি কি অন্য শহরেও গিয়েছিলেন? অন্য কোন শহরেও কি আপনি এ সতর্কবাণী প্রচার করেছেন?”
“হায়! সব পাগল। রাজাও পাগল। শোন বোকা! আমি এ শহরে এসেছি এখানকার রাজা বৌদ্ধ বলে। বৌদ্ধ ধর্ম শান্তির ধর্ম। শ্রী গৌতম বুদ্ধ সাম্যের বাণী প্রচার করতেন, কোন সংঘাত সংঘর্ষে যেতেন না। তোমার মনে যদি শান্তি প্রত্যাশা থাকে, তাহলে আসমানী গযব থেকে প্রভুর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করো। আমাদের কথা না মানলে নিজেও ধ্বংস হবে, শহরের বাসিন্দা এবং সকল সৃষ্টিকেও ধ্বংস করবে। তোমার মেয়েদেরকে জালেমরা কব্জা করে নেবে, শহরের কোন যুবতী নিরাপদ থাকবে না। খুনাখুনি হবে, লুটতরাজ হবে, আগুন জ্বলবে, আসমান থেকে পাথর পড়বে। শুভ কাজ করো, আসমানী গযব থেকে প্রভুর সৃষ্টিকে বাঁচাও, নিজেও শান্তিতে থাকো।”
বৌদ্ধরা শান্তি প্রিয়। যুদ্ধ বিগ্রহ, খুনোখুনিতে গৌতম বুদ্ধের ভক্তরা মোটেও আগ্রহী নয়। রাজা দাহির যেমন কট্টর ব্রাহ্মণাবাদী ছিল, নিরূনের শাসক সুন্দরী ততোটাই ছিলেন বৌদ্ধমতের প্রতি বিশ্বাসী। দাহিরের বৌদ্ধ পীড়ন এবং বৌদ্ধদের ধর্মালয় বিনাসের কারণে নিরূনের শাসক সুন্দরী রাজার প্রতি রুষ্ট ছিলেন। সন্ন্যাসী সুন্দরীর দরবার থেকে বিদায় হওয়ার পরই নিরূনে প্রবেশ করলো কয়েকজন হিন্দু বেশধারী উষ্ট্রারোহী। খুবই ছন্নছাড়া অবস্থা তাদের। এই উষ্ট্রারোহীরা লোকজনকে জানালো, “তারা কন্নৌজের বাসিন্দা। জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে ওখান থেকে। তারা লোকজনকে মুসলিম সেনাদের ভয়াবহ আক্রমণের কথা শোনালো। জানালো এরা যখন কেল্লা অবরোধ করে, তখন আসমান থেকে বড় বড় পাথর বৃষ্টি হয়, সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়।”
মুসাফিরদের এই ভয়াবহ কাহিনী আগ্নেয়গিরির মতো মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো সারা শহরে। এমনকি শাসক সুন্দরীর কানেও গেল এদের কথা। অবশ্য এর আগেই রাজা দাহির নিরূনে দূতের মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছে, “মাকরানে আরব সৈন্য অবতরণ করেছে। এই সৈন্য আগের মতো নয় অনেক বেশী সাহসী এবং খুব শক্তিশালী।
কন্নৌজ যখন বিন কাসিম দখল করে নিলেন, তখন দেশের সকল দুর্গে রাজা দাহির এই বলে পয়গাম পাঠালো, মুসলমানরা কন্নৌজ দখল করে নিয়েছে। তাদের কাছে দুর্গের ভিতরে পাথর নিক্ষেপক যন্ত্র রয়েছে। অবশ্য এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সবাই কেল্লাবন্দি হয়ে থাকবে। কেল্লার বাইরে গিয়ে কেউ যুদ্ধ করার চিন্তা করবে না।”
নিরূনের শাসক যখন চতুর্দিক থেকে ধ্বংস মারদাঙ্গা ও খুনোখুনির আভাস পেতে থাকলেন, তখন তার মধ্যে গৌতম বুদ্ধের শান্তিবাদী চেতনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। তার বিবেক বলতে লাগল, কেন আমি ওদের বিরোধিতা করে অর্থহীন রক্ত ঝরাবো। খুনোখুনি মহাপাপ। তিনি মানসিকভাবে মুসলিম বাহিনীর সাথে কোন ধরনের মোকাবেলা করার প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন এবং সব ধরনের সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়লেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলায় অবস্থান করে ডাভেল আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। তিনি এটাও বুঝে নিতে পারলেন, ডাভেল যুদ্ধেই জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যাবে। সেনাবাহিনী এখানে বিশ্রাম নেয়ার পাশাপাশি দুর্গপ্রাচীর ভাঙ্গার ট্রেনিংও নিতে শুরু করল। তিনি সেনাদের প্রশিক্ষণ ভাষণে একথা বুঝাতে চেষ্টা করলেন, “আমাদের এ যুদ্ধ কোন সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার ফসল নয়, একান্তই ধর্মীয় জিহাদ। মজলুম মা বোনদের উদ্ধার করে পৌত্তলিকদের নাগপাশ থেকে অগণিত বনি আদমকে মুক্তিদানের পবিত্র জিহাদ।”
ট্রেনিং চলার সময় একদিন বিন কাসিমকে খবর দেয়া হলো, “দু’জন হিন্দু সাধু আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চায়।” তিনি উভয়কেই ডেকে পাঠালেন। সাধু দু’জন ছিল সিন্ধী হিন্দু সাধুদের মতো পোশাকে আবৃত। কপালে তিলক ও মাথায় সিঁদুর পরিহিত। উভয়েই বিন কাসিমের কাছে। পৌছে পরিষ্কার আরবী শব্দে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে সালাম দিলো।
“আচ্ছা। আমাকে খুশী করার জন্য তোমরা আমার ধর্মের রীতিতে অভিবাদন জানিয়েছ?” বললেন বিন কাসিম। এটা যদি তোমাদের অন্তরের
বিশ্বাস হতো তাহলে কতোই না শান্তি পেতে। যে শব্দ তোমরা উচ্চারণ করেছ এর অর্থ জানো?”
“হ্যাঁ, জানি। আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক” জবাব দিলো একজন। “কে তোমাদের এই অর্থ শিখিয়েছে?” জানতে চাইলেন বিন কাসিম।
“মুহতারাম সেনাপতি! এটা আমাদের নিজ ধর্মের ভাষা। স্মীত হেসে বলল অপরজন। আমরা হিন্দু নই মুসলমান। আমরা সিন্ধি নই আরব। আমাদেরকে সর্দার হারেস আলাফী পাঠিয়েছেন।”
“তিনি কি পয়গাম দিয়েছেন?”
“ঠিক পয়গাম নয় সংবাদ, সম্মানিত সেনাপতি! বলল একজন। এখান থেকে সামনে যে শহর পড়বে সেটির নাম নিরূন। রাজা দাহিরের অধীনে হলেও এই শহরের শাসক সুন্দরী একজন বৌদ্ধ। তিনি শান্তিবাদী লোক। রাজা দাহিরকে না জানিয়ে তিনি বসরায় দু’জন লোক পাঠিয়ে আমীর হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে কর দেয়ার প্রস্তাব করেছেন এবং মুসলিম কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার পয়গাম পাঠিয়েছেন। শুনেছি, হাজ্জাজ তার মৈত্রী প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কর কতো ধার্য করা হয়েছে তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি। তবে এতটুকু জানা গেছে, হাজ্জাজ নিরূন শাসককে তার শহরের নাগরিকদের জান-মাল ইজ্জত আব্রু রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বলেছেন, মুসলিম সেনারা তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করবে।”
“আরে এতো দেখছি অলৌকিক ব্যাপার! বললেন বিন কাসিম। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে, রাজা দাহিরের একজন শাসক মুসলিম বাহিনী আক্রমণ করার আগেই নিজ থেকে দুর্গ আমাদের কর্তৃত্বে দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছে। আমার কাছে সংবাদটি বস্তুনিষ্ঠ মনে হচ্ছে না। আলাফী সাহেব কোন কূটচাল করেননি তো?”
“না, না, সম্মানিত সেনাপতি। আলাফী কোন কূটচালের মানুষ নন। এটাকে আপনি অস্বাভাবিক ঘটনা মনে করবেন না। কারণ এর পিছনে কার্যকারণ রয়েছে। সুন্দরীর আত্মসমর্পণের পিছনে ভূমিকা রয়েছে। আমরা সাধু সন্ন্যাসীর বেশ ধরে ওদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে খুনোখুনির প্রতি ঘৃণা জন্মে দিয়েছি। আমাদের অন্য একটি দল কন্নৌজের অধিবাসী সেজে ওদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যার ফলে বৌদ্ধ সুন্দরী আত্মসমর্পণ ও মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়েছে।”
“তোমরা কি এ ধরনের মিশন অন্য শহরেও চালাতে পারো না?”
“না, সম্মানিত সেনাপতি! অন্য সব শহর বিশেষ করে রাজধানী ও ডাভেল শহরে রাজা কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেছে। ওখানে কোন অপরিচিত লোক কেল্লার ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না এবং কেল্লা থেকে বাইরে যেতে পারে না। ওই শহরগুলোতে এ মিশন চালাতে গেলে গ্রেফতার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবুও আমরা আপনার পথ পরিষ্কার করার জন্য সম্ভাব্য সব। চেষ্টার কোন ত্রুটি করবো না। আমাদের সর্দার আলাফী জানিয়েছেন, এসব শুনে আপনি যেন এ সবের ওপর কোন ভরসা না করেন। সেনাদের মধ্যে যেন যুদ্ধের ব্যাপারে আবেগের কোন ঘাটতি সৃষ্টি না হয়।” “আমার পরবর্তী মঞ্জিল ডাভেল। সেখানকার অবস্থা কি? ওখানে কি পরিমাণ সৈন্য রয়েছে? সেনাদের মধ্যে লড়াইয়ের যোগ্যতা কতটুকু? এসব প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তোমরা যোদ্ধা, তোমরা ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানো, তোমাদের পক্ষে ডাভেলের বাস্তব পরিস্থিতি বলা সম্ভব।”
“আপনার এসব প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব দেয়ার চেষ্টা আমরা করবো।” বলল একজন। “রাজা দাহির কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন বিন কাসিম।
“সে রাজধানীতে” বলল একজন। অবশ্য একথা আমাদের পক্ষে বলা। সম্ভব নয়, সে ডাভেলে আসবে কি-না।”
“আমরা এ ব্যাপারটি বলতে পারি সম্মানিত সেনাপতি। মোকাবেলা খুবই কঠিন হবে।” বলল একজন। আমার তো মনে হয় রাজা দাহির রাজধানী উরুঢ়েই থাকবে। সে তখনই আপনার মোকাবেলায় আসবে, যখন আপনার সৈন্য সংখ্যা কমে যাবে এবং সৈন্যরা রণক্লান্ত হয়ে পড়বে। এখন আপনাকেই বুঝতে হবে সেই পরিস্থিতি আপনি কিভাবে সামলাবেন?”
মুহাম্মদ বিন কাসিম আলাফীর দুই সাথীকে সসম্মানে মোবারকবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় করলেন। এরপর থেকে তিনি এ বিষয়টি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলেন যে, আলাফী তাঁর বিরুদ্ধে নয় তার পক্ষেই নেপথ্যে ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করছে।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর অভিযান ও সাফল্যের বিস্তারিত বিবরণ প্রতিদিনই নির্দিষ্ট দূতের মাধ্যমে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠাচ্ছিলেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফও বিন কাসিমকে নিয়মিত নির্দেশ ও দিক-নির্দেশনামূলক পয়গাম প্রেরণ করছিলেন। সিন্ধু থেকে বসরা পর্যন্ত সংবাদবাহকেরা এক সপ্তাহের মধ্যে উভয়ের পয়গাম প্রাপকের কাছে পৌছে দিতো—
পরদিন হাজ্জাজের পক্ষ থেকে বিন কাসিম পয়গাম পেলেন, ডাভেলের আগে নিরূন নামের একটি শহর আছে। ওখানকার লোকজন আমাদের কাছে নিরাপত্তার দরখাস্ত করেছে এবং আমাদের কর দেয়ার প্রস্তাব করেছে।” আমরা তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি।” হাজ্জাজ যে পয়গাম লিখেছিলেন বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ হুবহু তা উদ্ধৃত করেছেন।
…অতঃপর তুমি যখন সিন্ধু সীমানায় প্রবেশ করবে, তখন তাঁবুর নিরাপত্তার দিকে খুব খেয়াল রাখবে। ডাভেলের যতো নিকটবর্তী হতে থাকবে তবু ও আসবাবপত্রের নিরাপত্তার প্রতি সতর্কতামূলক ব্যবস্থায় আরো বেশী যত্নবান হবে। যেখানে শিবির স্থাপন করবে, সেখানে চারপাশে প্রতিরক্ষা খাল খনন করবে। রাতের বেশী সময় জেগে থাকবে, কম সময় ঘুমাবে। সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা কুরআন শরীফ পাঠ করতে পারে, তাদেরকে রাতের বেলায় তেলাওয়াতের নির্দেশ দেবে, আর যারা তেলাওয়াত জানে না, তারা রাতের বেলা দোয়া ও যিকির করবে। তোমাদের সবাই আল্লাহর যিকির সব সময় করতে থাকবে। আল্লাহ তাআলার কাছে বিজয় ও সাফল্যের জন্যে একান্ত মনে দোয়া করবে। সুযোগ পেলেই লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ-এর তসবীহ জপে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে।…
আর ডাভেলের কাছাকাছি গিয়ে থামবে এবং তাঁবুর চারপাশে ১২ গজ চওড়া ও ৫ গজ গভীর পরিখা খনন করে শিবিরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করবে। এমতাবস্থায় শত্রুরা তোমাদের উস্কানী দিলেও তোমরা কোন জবাব দেবে না। শত্রুরা তোমাদের গালমন্দ করলেও তোমরা এসব গায়ে মাখবে না।
শত্রুরা যদি তোমাদের উত্তেজিত করতে উস্কানী দেয়, তবুও ধৈৰ্য্যধারণ করে স্থির থাকবে। আমার পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ শুরু করবে না। আমার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করবে এবং অক্ষরে অক্ষরে তা পালনের চেষ্টা করবে। আল্লাহর রহমতে আশা করি বিজয় তোমাদের হবেই।
ডাভেল পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়া মুহাম্মদ বিন কাসিমের গোয়েন্দারা এসে খবর দিতে লাগল কেল্লার দরজা বন্ধ। কেল্লার বাইরে কোন সৈন্য ও সামরিক তৎপরতা নেই।
এসব খবর থেকে বিন কাসিমের বুঝতে অসুবিধা হলো না, রাজা দাহির মুখোমুখি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না।
ঘটনাক্রমে এমন সময় রাজা দাহিরের আশ্রিত আরব বসতিতে ঘটে গেল একটা গোলযোগ। আশ্রিত আরবদের বসতি ছিল মাকরান ও সিন্ধু-এর সীমান্ত এলাকায়। মুহাম্মদ বিন কাসিম যেসব বিজিত এলাকায় সেনা চৌকি স্থাপন করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল আশ্রিত আরবদের বসতির নিকটবর্তী। প্রতিটি সেনা চৌকি থেকে চারজন করে অশ্বারোহী কিংবা উষ্ট্রারোহী পালা করে নিজ নিজ এলাকায় টহল দিতো। আরব বিদ্রোহীদের বসতির কাছে যে চৌকিটি তৈরী করা হয়েছিল এলাকাটি ছিল ঘন সবুজ গাছপালায় ভরা। সবুজ বন-বনানীর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে একটি সরু নদী। এ অঞ্চলে সবুজ শ্যামল অনেক মাঠ ছিল, ছিল গাছপালা আচ্ছাদিত ছোট বড় অসংখ্য টিলা, ঝোপ ঝাড়। নদীর পাশের ঘন সবুজ এলাকায় মাঝে মধ্যে আশ্রিত আরবদের ছেলেমেয়ে ও কিশোরীতরুণিরা ঘুরতে যেতো। অবশ্য নদীর তীরবর্তী এলাকাটি বসতির খুব কাছে ছিল না যে, প্রতিদিন এখানে আরব কিশোরী তরুণিরা বেড়াতে আসতো। মাঝে মধ্যে হঠাৎ হঠাৎই তরুণিরা দলবেঁধে এ জায়গাটিতে ঘুরতে আসতো।
একদিন আরব বসতি থেকে বিবাহিতা তিন তরুণী এই জায়গাটিতে ঘুরতে গেল। কিছুক্ষণ পর তিনজনের দু’জন সেখান থেকে চিৎকার করে ও কান্নাকাটি করতে করতে বস্তিতে ফিরলো। তৃতীয় তরুণী ওদের দুজনের সাথে ছিল না। তরুণীদের আর্তচিৎকার শুনে বসতির সব লোকজন বেরিয়ে এলো। তরুণিরা জানাল, “তারা নদীর তীরবর্তী এলাকায় পৌছলে আরব সেনাদের চার অশ্বারোহী সেখানে আসে এবং ঘোড়া থেকে নেমে তরুণীদের ওপর হামলে পড়ে। তারা দুজন কোন মতে ওদের পাঞ্জা থেকে পালিয়ে এসেছে কিন্তু তৃতীয়জনকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে।”
একথা শোনা মাত্রই তিন তরুণির স্বামী ও আরো কয়েকজন যুবক তরবারী ও বর্শা নিয়ে নদীর দিকে দৌড়ালো। তারা তৃতীয় তরুণীকে পা হেঁচড়ে হেঁচড়ে বসতির দিকে ফিরে আসতে দেখতে পেল। তার কাপড় চোপড় ছেড়া এবং মাথা
খালি। ওড়না নেই। মাথার চুল এলোমেলো, সে কেঁদে কেঁদে বাড়ির দিকে ফিরছে। তার স্বামী দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলে সে স্বামীর কোলে লুটিয়ে পড়লো। তার অবস্থাই বলে দিচ্ছিল তার সাথে ভয়ংকর আচরণ করা হয়েছে। অতএব আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন ছিল না। তরুণী স্বামীর কোলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
যারা তাৎক্ষণিকভাবে ওই তরুণির অবস্থা দেখতে পেলো, তারা এতোটাই ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত হয়ে গেল যে, এ মুহূর্তে তারা মুহাম্মদ বিন কাসিমের সকল সৈন্যকে পেলে খুন করেই শান্ত হবে।
“এরা কি সেই সেনাবাহিনী, আমাদের সর্দার হারেস আলাফী যাদের সহযোগিতা করছে?”
“আল্লাহর কসম! আরবরা কখনো এমন ছিল না। এসব পাষণ্ড বনী উমাইয়ার।” “চলো, এখনই ঐ চৌকিতে চলো। একটা জানোয়ারকেও জিন্দা রাখবো না।
“চলো, চলো, দেখতে দেখতে গোল জমে গেল। সবাই বলতে লাগল। ওখানে লোক দশ বারোজনের বেশী হবে না, সবগুলোকে সাফ করে ফেলো।
উত্তেজনা ছিল ঘূর্ণিঝড়ের মতো। মুহূর্তের মধ্যে সারা আরব বসতিতে তুফান ছড়িয়ে পড়লো। ছেলে বুড়ো সবাই উত্তেজিত, সবার হাতেই অস্ত্র। এরা সবাই আরব বংশজাত। কাজেই নারীর সম্ভ্রমহানি এদের সহ্যের বাইরে। সবাই চৌকির সেনাদের খুন করতে প্রস্তুত। আবার কেউ কেউ বলছিল, এদের সবাইকে ধরে এনে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে পাথর মেরে হত্যা করা হবে। আবার কেউ কেউ বলছিল, এদেরকে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে যতোক্ষণ পর্যন্ত ওদের শরীরের চামড়া খসে না পড়ে, ততোক্ষণ ঘোড়া দৌড়াতে হবে।”
উত্তেজিত বস্তিবাসী চৌকির দিকে রওয়ানা হয়েছে ঠিক এই মুহূর্তে গোত্র সর্দার হারেস আলাফী ঘোড়া হাঁকিয়ে সেখানে পৌছলেন। তার সাথে ছিল আরো বয়স্ক তিনজন লোক। তারা উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। আলাফীকে দেখে গোত্রের সকল মানুষ সর্বনাশ হয়ে গেছে, সব ধ্বংস হয়ে গেছে মাতম ও চিৎকার শুরু করে দিলো।”
আলাফী তাদের শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন।
“আপনি আমাদের সর্দার! আপনার হুকুম পালন করা আমাদের কর্তব্য। কিন্তু আজ এই চৌকির সব পাষণ্ডকে হত্যার নির্দেশ ছাড়া আপনার আর কোন নির্দেশ পালন করবো না।” বলল এক যুবক।
“আপনি বলেছিলেন, আরব সৈন্যদেরকে আমরা যেনো আপন মনে করি। কিন্তু এখন আমরা এই পাষণ্ডদের সেনাপতিকেও জীবিত ছাড়বো না।” বলল ক্ষুব্ধ আরেক যুবক।
“চুপ করে আছেন কেন সর্দার?” চিৎকার করে বলল আক্রান্ত এক তরুণির স্বামী। এখন কোন লজ্জা করার সময় নয়। একটা কিছু বলুন, আমাদের নির্দেশ দিন।”
“এই চার সৈন্যের শাস্তি অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু শাস্তি কার্যকর করার আগে আমাকে ওদের সেনাপতির সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দাও।”
“কোন্ সেনাপতির কথা বলছো তুমি? বলল এক অর্ধ বয়স্ক লোক। ঐ সেনাপতির কথা বলছে, যে হাজ্জাজের ভাতিজা! যে হাজ্জাজের কারণে আমাদেরকে দেশ ছাড়তে হয়েছে! বনী উমাইয়ার নন রুটি খেয়ে বেঁচে থাকা হাজ্জাজ আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। ওর পালিত ভাতিজার সাথে তুমি কি কথা বলবে? সে তো কিছু না শুনেই বলে দেবে এটা ডাহা মিথ্যা ঘটনা।”
“এটা ভুলে যেয়ো না আমরা আরব। আমাদের একটা রীতি আছে। আমি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে কিছু বিষয়ে ওয়াদা করেছি। সেও আমাকে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।”
এমতাবস্থায় আলাফীর আওয়াজ বেড়ে গেল, হঠাৎ তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “তোমরা শুনে রাখো, হাজ্জাজের ভাতিজা যদি আমার কথা শুনে বলে, “এটা মিথ্যা ঘটনা, তাহলে এই তরবারীতে তোমরা তার রক্ত দেখবে! আমি জানি এ ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তার প্রহরীরা আমার শরীরকে টুকরো টুকরো করে দেবে। তবুও আমাকে তার কাছে যেতে দাও, তোমরা স্থির হও। সে যদি কোনকিছু যাচাই না করে তার সৈন্যদের বাঁচাতে চেষ্টা করে, তাহলে তার জীবন থেকেই হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। আমি তোমাদের কাছে ওয়াদা করছি, আমি যা বলেছি তা করে দেখিয়ে দেবো।”
দৃশ্যত পরিস্থিতি এতোটাই উত্তাল হয়ে উঠেছিল যে, নিয়ন্ত্রণে আনার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু দেশত্যাগী এসব আরব ছিল খুবই সুশৃঙ্খল। তারা সর্দারের কথায় নিজেদের ক্ষোভ আপাত দৃষ্টিতে সামলে নিলো এবং
তরুণীকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে বস্তিতে নিয়ে এলো। ততোক্ষণে রাত অনেক হয়ে গেছে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলায় সেনাদের প্রস্তুতি কাজে ব্যস্ত। হারেস আলাফী অর্ধরাতের একটু আগে আর দু’জন সঙ্গী নিয়ে বিন কাসিমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
আলাফী ও সঙ্গীরা ফজরের নামাযের আযান শুনে ঘোড়াকে আরো তাড়া করলেন যাতে নামাযের সময় থাকতেই সেখানে পৌঁছতে পারেন। তারা যখন দুর্গের প্রধান ফটকের সামনে পৌছলেন, তখন ফটকের দরজা বন্ধ। কারো জন্য এতো সকালে দরজা খোলা হয় না। কিন্তু বিন কাসিম প্রহরীদের বলে রেখেছিলেন, হারেস আলাফী যখনই আসবেন, তার জন্য যেন দরজা খুলে দেয়া হয়। বস্তুতঃ তার পরিচয় পেয়ে দরজা খুলে দেয়া হলো। তিনি ঠিক এমন সময় বিন কাসিমের সকাশে পৌছলেন, যখন জামাত দাঁড়াচ্ছে। তারা তিনজন শেষের কাতারে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করলেন।
নামায শেষ হতেই হারেস আলাফী অন্যদের ডিঙিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কাছে পৌছলেন। বিন কাসিম এতো ভোরে আলাফীকে এখানে দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন।
“আপনার ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক সর্দার! নিশ্চয় আপনি কোন গুরুত্বপূর্ণ খবর এনেছেন? বললেন বিন কাসিম।
“হ্যাঁ, বিন কাসিম! খবর খুবই বড় এবং খুবই ভয়ানক! আলাফীর বলার ভঙ্গি শুনেই বিন কাসিমের চেহারায় উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। তিনি কোন মন্তব্য না করে আলাফী ও তার দুই সঙ্গীকে তার একান্ত কক্ষে নিয়ে গেলেন।
কক্ষে যাওয়ার পর আলাফী বললেন, “বিন কাসিম! তুমি যদি আলাফীর সাথে সত্যিকারের বন্ধুত্ব করে থাকো, তাহলে আজ বন্ধুত্বের হক আদায় করো।”
“হক অবশ্যই আদায় করবো। আপনি যদি উপকার করে এর প্রতিদান পেতে চান, তাহলে বলুন, কি প্রতিদান দিতে হবে?”
হারেস আলাফী তাকে পুরো ঘটনা জানালেন, যা তাদের বসতির পাশের চৌকিতে ঘটেছে এবং পরিস্থিতি কতোটা বিস্ফোরনুখ হয়ে রয়েছে। ঘটনা শুনে বিন কাসিম স্থবির হয়ে গেলেন।
হারেস আলাফী বললেন, “প্রিয় বিন কাসিম! তোমরা যাদেরকে বিদ্রোহী বলল, আমি অনেক কষ্টে তাদেরকে তোমাদের জন্যে নেপথ্যে সহযোগিতা করার জন্যে সম্মত করেছি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, এ মুহূর্তে তুমি যদি ওখানে যাও, তবে জানি না, তোমার দেহে কতগুলো বর্শা ও তরবারী আঘাত হানবে। আমি উত্তপ্ত পরিস্থিতি একটা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঠাণ্ডা করে এসেছি। আমি যদি তাদের ধারণার চেয়ে বেশী সময় এখানে কাটিয়ে ফিরে যাই, তাহলে আমাকে পথেই তারা পাবে এবং খুন করে ফেলবে।”
“ঠিকই বলেছেন সর্দার! এমন ঘটনায় তাদের এরচেয়ে বেশী বিক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ ঘটনাটা এমন নয় যে, কথায় তাদের ঠাণ্ডা করা যাবে।”
“আমাকে বলো বিন কাসিম! তুমি এখন কি করবে? যদি কিছু করার না থাকে, তাহলে আমাকে বলো, আমি কি করতে পারি?” “এ মুহূর্তে আমার কাজ ডাভেল আক্রমণ করা। কিন্তু এর আগে অবশ্যই আমি এ ব্যাপারটি সুরাহা করবো।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম তখনই তার ঘোড়া আনতে নির্দেশ দিলেন এবং গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফীকে সঙ্গে নিলেন। তার দেহরক্ষীরা তার রওয়ানা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রওয়ানা হলো। বলা হয়, যে কোন জটিল ঘটনার কারণ উদঘাটনে বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন শাবান ছাকাফী।
হারেস আলাফী তার দুই সঙ্গীসহ মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে রওয়ানা হলেন। তারা ভেবেছিলেন অন্তত দ্বিপ্রহরের দিকে বসতিতে পৌছে যেতে পারবেন, কিন্তু মুহাম্মদ বিন কাসিম আরমান ভিলা থেকে বের হয়েই এভাবে ঘোড়া ছুটালেন যেন তিনি উড়াল দিয়ে সেখানে চলে যাবেন। তিনি ছিলেন সবার আগে এবং গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী ছিলেন তার পাশাপাশি। তিনি শা’বান ছাকাফীর সাথে ঘটনা সম্পর্কে কথা বলতে বলতে অগ্রসর হতে লাগলেন।
দ্বিপ্রহরের অনেক আগেই তারা দুর্ঘটনা স্থলে পৌছে গেলেন। সেনাপতিদের আসতে দেখে চৌকির সব সিপাহী চৌকি থেকে বেরিয়ে এলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম চৌকির কাছে গিয়ে পিছনে চলে এলেন আর
শাবান ছাকাফী চৌকির সৈন্যদের কাছে চলে গেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন-গতকাল বিকেল বেলার টহলে কে কে ডিউটিতে ছিল?
চার সিপাহী হাত উঁচিয়ে নিজেদের ডিউটিতে থাকার কথা জানালো।
“তোমরা চারজনই কি তিন তরুণির ওপর হামলা করেছিলে? না। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ ছিল, যে চায়নি এ কাজে শরীক হতে?”
একথা শুনে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শাবান ছাকাফীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
“তোমরা দেখতেই পাচ্ছো, প্রধান সেনাপতি নিজে এসেছেন। তা থেকেই বুঝতে পারছো ব্যাপারটি কতো জটিল। আর এ ক্ষেত্রে তোমাদের অপরাধ পরিষ্কার। লুকানোর কোন অবকাশ নেই।”
“শত্রু ভূমিতে দাঁড়িয়ে যা তা বলবেন না সেনাপতি।” ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল চার অভিযুক্তের একজন। জন্মভূমি থেকে দূরে এনে এভাবে আমাদের অপমান করার কোন অধিকার আপনার নেই।”
“এক সিপাহীর কথা শেষ না হতেই বিন কাসিমের দিকে হাত প্রসারিত করে চার অভিযুক্তের অপর একজন বলল, “সম্মানিত সেনাপতি! সেই আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, যে আল্লাহর নামে আমরা আপনার সাথে এখানে জিহাদ করতে এসেছি। আপনার কাছে জানতে চাই, এ লোক আমাদের ওপর কেন অপবাদ দিচ্ছে? আমরা কি আপনার বাহিনীর সৈনিক নই?”
“সিপাহীর প্রশ্নের উত্তরে মুহাম্মদ বিন কাসিম কিছুই বললেন না। কারণ অনুসন্ধানের কাজটি তিনি শা’বান ছাকাফীর দায়িত্বে ন্যস্ত করেছিলেন। আসলেও এটি ছিল শা’বান ছাকাফীর কাজ। অভিযুক্ত হওয়ার পর চার সিপাহী হা-হুতাশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করল। আলাফী ও তার দুই সঙ্গী দূরে দাঁড়িয়ে নীরবে এসব দেখছিলেন।
শাবান ছাকাফী হারেস আলাফীকে বললেন, “সর্দার! আক্রান্ত তিন তরুণীকে বসতি থেকে এখানে নিয়ে আসুন এবং তাদের সাথে যতো লোক আসতে চায় আসতে বলুন।”
হারেস আলাফী বসতির উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পর চৌকির কমান্ডারকে গোয়েন্দা প্রধান ছাকাফী বললেন, এ মুহূর্তে যারা টহলে রয়েছে তাদেরকেও নিয়ে এসো। কমান্ডার সেনাপতির নির্দেশ পালনে চলে গেল। এমন সময় চৌকি থেকে একটু দূরে গিয়ে বিন কাসিম ও গোয়েন্দা প্রধান ছাকাফী পরস্পর কথা বললেন।
শুরুতে শুধু অভিযুক্ত চার সিপাহী নিজেদের ওপর মিথ্যা অভিযোগের জন্যে হা-হুতাশ করেছিল, কমান্ডার ও আলাফী চলে যাওয়ার পর সবাই চেচামেচি শুরু করে দিলো এবং সেনাপতিদের সম্পর্কে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলতে শুরু করল। মুহাম্মদ বিন কাসিমের কানে এসব কথা গেলেও তিনি নীরবে সিপাহীদের গালমন্দ সহ্য করলেন। অথচ এসব কটুবাক্য সাধারণ সৈনিকও সহ্য করত কি-না সন্দেহ। এক পর্যায়ে গোয়েন্দা প্রধান শা’বান ছাকাফী সিপাহীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমরা শান্ত হও। এ ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত থাকতে পারো, তোমাদের ওপর কোন ধরনের বে-ইনসাফী করা হবে না।”
একজন বয়স্ক সিপাহী বলল, “সম্মানিত সেনাপতি! দেখেতো মনে হলো যে তিনজন লোক আপনার সাথে এসেছিল এরা সেই লোক; যারা আরব থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে রাজার আশ্রয় নিয়েছে। পরিষ্কার বোঝা যায় এরা আমাদের বিরুদ্ধে রাজার নিমক হালালী করছে। আমি বলি, হিন্দুদের আগে-এদের পরিষ্কার করা জরুরী। এরা আমাদের ঘোরতর শত্রু।”
“কি ব্যাপার! তোমরা কি মুখ বন্ধ করবে না? ধমকের স্বরে সিপাহীদের উদ্দেশ্যে বললেন গোয়েন্দা প্রধান। আমি তো তোমাদের বলেছি, কারো প্রতি জুলুম করা হবে না। সত্যিকার অর্থে যে অপরাধী তারই বিচার হবে।”
পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল চৌকির সকল সিপাহীর মধ্যে বিদ্রোহী আরবদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ উপচে পড়ছে। এরা যেন গোটা বসতি নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে স্বস্তি পায়।”
দূর থেকেই দেখা গেল তিন তরুণীকে নিয়ে আলাফী বসতি থেকে চৌকির দিকে আসছেন। তার পিছনে বসতির কিছু লোকও আসছে। শাবান ছাকাফী দেখে তাদের দিকে ঘোড়া হাঁকালেন এবং তাদেরকে চৌকি থেকে দূরেই থামিয়ে দিলেন।
শাবান ছাকাফীর অনুরোধে সেই তরুণীকে তার সামনে আনা হলো যার সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, তাকে সৈন্যরা ধর্ষণ করেছে।
নদী কাছেই ছিল। শা’বান ছাকাফী ভিকটিম তরুণীকে গাছ গাছালী ও টিলার আড়ালে নদীর তীরে নিয়ে গিয়ে তার মাতৃভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, সিপাহীরা কোথায় তোমাকে ও তোমার বান্ধবীদেরকে জাপটে ধরেছিল?”
তরুণী শাবানের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। উত্তর না বলার কারণে শাবান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় তোমাকে ও তোমার বান্ধবীদেরকে সিপাহীরা আঘাত করেছিল? জায়গাটি কোথায়?”
এবার তরুণী ডানে বামে ঘাড় হেলিয়ে দুটি জায়গা দেখিয়ে দিলো।
“আমরা সুবিচার করতে এসেছি। যারা তোমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে, তাদেরকে তোমাদের সামনে হত্যা করা হবে। কাজেই তোমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারপর তরুণী আর কিছু বলল না।
শাবান সেই তরুণীকে ওখানেই রেখে টিলার এপাশে এসে উচ্চ আওয়াজে বললেন, এই তরুণীটি কি বোবা?
শাবানকে দেখে আলাফী তার কাছে এগিয়ে এলেন এবং বললেন, “শাবান! তুমি হয়তো এর সাথে আরবীতে কথা বলেছে। ঐ তরুণী আরবী জানে না। এ ছিল হিন্দু। এক বছর আগে আমাদের একতরুণকে বিয়ে করার জন্য মুসলমান হয়েছে।”
“ওর সাথে অন্য যে দুই তরুণী ছিল এরা কি তোমাদের কবিলার মেয়ে?” জিজ্ঞেস করলেন ছাকাফী।
“না, এরাও এখানকার অধিবাসী। এরাও কিছুদিন আগে মুসলমান হয়ে আমাদের গোত্রের তরুণের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।”
শাবান ছাকাফী কবিলার একজন এমন লোককে সঙ্গে নিলেন, যে সিন্ধী ও আরবী ভাষা বলতে ও বুঝতে পারত। শাবান তার মাধ্যমে তরুণীকে জিজ্ঞেস করলেন, তার ওপরে যে জায়গাটিতে সিপাহীরা আক্রমণ করেছিল, সেই জায়গাটি দেখিয়ে দিতে। তরুণী একটি জায়গা দেখিয়ে বলল, এইখানে। শা’বান তাকে পুরো ঘটনা বলার নির্দেশ দিলেন। তরুণী ঘটনা বলতে শুরু করল এবং গোত্রের লোকটি তা আরবীতে তাকে বুঝাতে লাগল। তরুণির বর্ণনা শুনে শাবান তরুণীকে বললেন, “সেই জায়গাটি দেখাও তো, যে জায়গাটিতে সিপাহীরা তোমাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিল? তরুণী একটি জায়গা দেখালো। শাবান তরুণীকে একটি টিলার আড়ালে পাঠিয়ে দিলেন।
এরপর শাবান অপর দুই তরুণির একজনকে টিলার আড়ালে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, এর স্বামীও এর সাথে আসুন।
আরবদের অনুসন্ধানী ক্ষমতা ছিল বিশ্বখ্যাত। আরব্য গল্প কাহিনীতেও তাদের অনুসন্ধানী প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়। শা’বান ছাকাফী ছিলেন স্বভাবজাত অস্বাভাবিক অনুসন্ধানী প্রতিভার অধিকারী।
দ্বিতীয় তরুণীকে শা’বান ছাকাফী দুভাষী ও তার স্বামীর সাথে অপর টিলার আড়ালে নিয়ে গেলেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সিপাহীরা তার ওপর কোথায় আক্রমণ করেছিল? তরুণী হাত দিয়ে একটি জায়গা দেখিয়ে দিলো। শাবান ছাকাফীর নির্দেশে পুরো ঘটনার একটা বর্ণনা দিলো তরুণী। দ্বিতীয় তরুণীকে অপর একটি টিলার আড়ালে দাঁড় করিয়ে তৃতীয় তরুণীকে তার স্বামীসহ ডাকলেন। শা’বান তাকেও অপর একটি টিলার আড়ালে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় তোমার ওপর সিপাহীরা হামলে পড়েছিল?”
তরুণী একটি জায়গার প্রতি ইশারা করল এবং শা’বানের নির্দেশে সেও ঘটনার পূর্বাপরুবর্ণনা দিলো। তৃতীয় তরুণীকে অপর একটি টিলার আড়ালে দাঁড় করিয়ে প্রথম তরুণীকে আবার ডেকে আনলেন শাবান এবং তার স্বামীকেও ডাকলেন। এই তরুণির স্বামী এতোই ক্ষুব্ধ ছিল যে, তার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল, চোখ কোঠর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। যেন সে শা’বানকে টুকরো করে ছিড়ে ফেলবে এমন তার অবস্থা। ক্ষোভে রাগে সে ফোস ফোস করছিল। শাবান এসবকে গায়ে না মেখে একান্ত মনে তার কাজ করে যাচ্ছিলেন।
শাবানের জিজ্ঞাসায় তরুণী বলল, সে চার সিপাহীকেই চিনতে পারবে।
চৌকির বারোজন সিপাহীকে একটি আলাদা জায়গায় দাঁড় করানো হলো এবং এই তরুণীকে স্বামীসহ তাদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, তুমি কোন চারজনকে চিনো?”
তরুণী দ্রুততার সাথে চারজনের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করল। তরুণির নির্দেশিত চার সিপাহীকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেয়া হলো এবং এই তরুণীকে তার স্বামীর সাথে আলাদা জায়গায় রাখা হলো।
এরপর শা’বানের নির্দেশে স্বামীসহ দ্বিতীয় তরুণীকে ডাকা হলো। এ তরুণী বলল, ‘একজন সিপাহীকে সে ভালোভাবেই চিনতে পারবে। তাকে সিপাহীদের কাছে নিয়ে গেলে মাঝখান থেকে একজনের প্রতি সে ইশারা করে দেখালো। এই সিপাহীকেও অন্যদের থেকে আলাদা করে নেয়া হলো। অতঃপর তৃতীয় তরুণীকে স্বামীসহ ডাকা হলে সেও জানালো; এক সিপাহীকে সেও চিনতে পারবে সিপাহীদের সামনে নিয়ে যাওয়ার পর সেও একজনের প্রতি ইঙ্গিত করল।
শাবান আলাফী ও তিন তরুণির স্বামীকে তার কাছে ডেকে আনলেন এবং বললেন, এই চার সিপাহী গতকাল বিকেলে টহল কাজে নিয়োজিত ছিল। যাদেরকে তোমরা এখানে দেখছে। আর তোমাদের তরুণিরা যাদেরকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে, এরা তখন চৌকিতে অবস্থান করছিল। শাবান তিন তরুণীকে ডেকে এনে তাদের স্বামীদের সাথে দাঁড় করালো।
অতঃপর সমবেত সবার উদ্দেশে শা’বান ছাকাফী বললেন, বন্ধুগণ! এ তিন তরুণী ভিন্ন ভিন্ন জায়গার কথা বলেছে। তোমরা মরু ভূমিতে জন্ম নিয়েছ এবং মরুতেই বড় হয়েছ। তোমরা জানো, মরুর ধুলিকণাও কথা বলে। চৌকির সৈনিক ঘোড়ায় সওয়ার ছিল। যে জায়গায় আক্রান্ত হওয়ার কথা এই তরুণিরা বলেছে, এই জায়গায় চারটি ঘোড়ার কোন চিহ্ন আছে কি
আমাকে দেখিয়ে দাও। ঘটনাটি গত সন্ধ্যার। এরপর না কোন মরুঝড় হয়েছে, না বৃষ্টি হয়েছে। এই তরুণী আমাকে জানিয়েছে তাকে মাটিতে ফেলে সম্ভ্রম হরণ করেছে। আমার সাথে তোমরা এসো এবং সেই জায়গাটি একটু দেখে নাও। শাবান তাদেরকে তরুণির দেখানো জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললেন, দেখাও তো এখানে এমন কোন চিহ্ন খুঁজে পাও কি-না? প্রিয় স্বদেশী বন্ধুরা! আশ্রিত আরব বস্তিবাসীদের উদ্দেশে বললেন শাবান। এই তরুণিরা ভিন্ন ভিন্ন তিনটি জায়গার কথা বলেছে। তোমরা একটু চিন্তা করে দেখো, তাদের ভাষায় সৈনিকরা ছিল অশ্বারোহী। অশ্বারোহী সৈনিকদের কাছ থেকে এই তরুণী দু’জন পালিয়ে গেল? এরা কি ঘোড়ার চেয়ে বেশী দৌড়াতে পারে? আর তিন তরুণী সেখানে আক্রমণকারী হিসাবে যাদের চিহ্নিত করেছে, তাদের কেউই সেখানে যায়নি। যারা তখন ডিউটিতে ছিল এরা তোমাদের সামনে দাঁড়ানো। শাবান তরুণীদের উপস্থিতিতে সিন্ধী ভাষায় তরুণীদের বর্ণনা শোনালেন এবং বললেন, তোমরা তাদের জিজ্ঞেস করে দেখো, তারা কি একথা বলেনি?” সম্মানিত হারেস আলাফী! বললেন ছাকাফী। বনী ছাকীফের রক্তে এখনো কোন মিশ্রণ ঘটেনি। বনী উসামা যদি গোত্রীয় শত্রুতা ভুলে বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়ায়, তাহলে বনী ছাকীফের সেনাপতি জীবন দিয়ে বন্ধুত্বের হক আদায় করবে। তোমরা এ ঘটনার ব্যাপারে কেন একটু চিন্তা করোনি, এই তরুণিরা কিছুদিন আগেও ছিল পৌত্তলিক ঘরের সন্তান। এরা শৈশব থেকে মূর্তিকে পূজা করে করে বড় হয়েছে। এরপর যৌবনে তিন আরব তরুণ এদের কাছে ভালো লাগায় এরা তাদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাদের রক্তে রয়েছে পৌত্তলিক মানসিকতা। পৌত্তলিক এক প্রকার
মিথ্যাচারিতা। এরা যদি আরব বংশোদ্ভূত হতো, তাহলে আমি এতোকিছু করতাম না। শুধু জিজ্ঞেস করতাম, বলল, কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা? আমি নিশ্চিত, তোমাদের ও আমাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টির জন্য এটা একটা চক্রান্ত। আলাফী এতটা উঁচু চিন্তার অধিকারী ছিলেন না, তাছাড়া দীর্ঘদিন এখানে থাকার কারণে মাকরান ও হিন্দু অঞ্চলের চিন্তা চেতনা তার আরব সাথীদের মধ্যে কিছুটা প্রভাব সৃষ্টি করেছিল।
ছাকাফী বললেন, তোমরা দেশে থাকতে বিদ্রোহ করেছিলে। আমি আল্লাহর কসম করে বলতে পারি তোমাদের বিদ্রোহ ছিল সঠিক। কিন্তু আজ তোমাদের সেই সাহসিকতা, বুদ্ধিমত্তা কোথায় গেল?…তোমরা সবাই বিশেষ করে এদের স্বামীরা যদি আমাকে অনুমতি দাও, তাহলে এ ঘটনার পিছনে লুকিয়ে থাকা সত্য ও মিথ্যাকে আমি আলাদা করে দেখিয়ে দেবো।
হঠাৎ কথিত সম্ভ্রমহানির শিকার হওয়া তরুণির স্বামী তরুণির ওপর হামলে পড়লো। চিতাবাঘ যেভাবে শিকারের ওপর হামলে পড়ে ঠিক সেভাবে তরুণির চুল ধরে ওকে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে মাটির ওপর আঁচড়ে ফেলল তার স্বামী। তরুণী চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। স্বামী ওর বুকে পা রেখে ওর গলার উপরে তরবারী ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “বাঁচতে চাস তো সত্য কথা বল হিন্দুর বাচ্চা!” অপর দিকে আলাফী নিজে তরবারী বের করে অপর দুই তরুণির মুখোমুখী দাঁড়িয়ে বললেন, বাঁচতে চাস্ তো সত্য কথা বল। অতঃপর সবার দিকে সম্বোধন করে আলাফী বললেন, “এদের চুলের সাথে রশি বেঁধে ঘোড়ার পিছনে বেঁধে দাও।”
একথা শোনার পর এক তরুণির মুখে উচ্চারিত হলো ভয়ার্ত আর্তনাদ। “না, আমি এভাবে মরতে চাই না! তোমরা যদি সত্য কথা শুনতে চাও, তবে শোনো।” অপর দিকে যে তরুণির গলায় তার স্বামী তরবারী ধরে রেখেছিল সেও সত্য কথা বলার জন্য সম্মত হলো। অবশেষে তিন তরুণির বক্তব্যে যা বেরিয়ে এলো এর সার কথা হলো, এদের তিনজনকে রাজা দাহিরের বোন ও স্ত্রী মায়ারাণী ফুসলিয়ে রাজী করায়
যে, এরা তিন আরব যুবককে বিয়ে করে যেন এদের ওপর যাদুকরী প্রভাব সৃষ্টি করে। মায়ারাণী এ কাজ করেছিল, হাজ্জাজের পাঠানো দ্বিতীয় সেনাপতি বুদাইল বিন তোফায়েলের মৃত্যুর পর। মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরানে আসার পর রাজা দাহিরের উজির বুদ্ধিমান তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, রণ ক্ষেত্রের পাশাপাশি কূটনৈতিক চালে মুসলমানদের দুর্বল করার জন্য এ দায়িত্ব উজির বুদ্ধিমান নিজের কাঁধে নিয়েছিল।
বুদ্ধিমানের জানা ছিল, মায়ারাণী এ অস্ত্র প্রয়োগের হাতিয়ার অনেক পূর্বেই প্রয়োগ করে রেখেছে। অতঃপর বুদ্ধিমান মায়ার সাথে যোগাযোগ করে এটিকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিলো। নারী গোয়েন্দা পাঠিয়ে এই তরুণী তিনজনকে পরামর্শ দিলো, “আলাফী ও আরব আশ্রিতা শত্রুদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করেছে। অতএব এদের মাঝে যে করেই হোক কঠিন শত্রুতার জন্ম দিতে হবে। বসতির পাশে বিন কাসিমের সেনা চৌকি স্থাপিত হলে এ তিন তরুণীকে ব্যবহার করে দু’পক্ষের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। কারণ আরবরা নারীর সম্ভ্রমহানির অপরাধকে কখনও ক্ষমা করে না। নারীর ইজ্জত রক্ষায় অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সেই সাথে নারীর অসম্মানকারীকে আরব মুসলমানরা প্রচণ্ড ঘৃণা করে।
এ তিন শয়তানীর ভাগ্যের সিদ্ধান্ত আমাদের সর্দার দেবেন? চিৎকার করে বলল এক তরুণির স্বামী।
“হ্যাঁ, এদের সবাইকে হত্যা করে ফেলো” বললেন আলাফী।
হত্যার কথা শুনে তরুণী তিনজন চিঙ্কার শুরু করে দিলো। তারা বলতে লাগল, এ কাজ তারা নিজেদের ইচ্ছায় করেনি। মায়ারাণী ও উজির বুদ্ধিমানের চক্রান্তে পড়ে করেছে। তারা কান্নাকাটি করে জীবন ভিক্ষা চাইলো। কিন্তু আলাফী আবারো ঘোষণা করলেন, না এদের ক্ষমা করা হবে না।”
“থামো আলাফী, বজ্র নির্ঘোষ আওয়াজে বললেন, সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম। এতক্ষণ পর্যন্তই তিনি এক পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে গোয়েন্দা প্রধান শাবান ছাকাফীর গোয়েন্দ তৎপরতা প্রত্যক্ষ করছিলেন। তিনি আলাফীর উদ্দেশে বললেন
“এদের নিরপরাধ মনে করো। রাজা দাহিরকে আমি একটি পয়গাম পাঠাতে চাই।” তিনি তরুণীদের উদ্দেশে বললেন, তোমাদেরকে আমার সৈন্যরা রাজধানীর পথে কোন বসতিতে রেখে আসবে। তোমরা রাজধানীতে
গিয়ে রাজা দাহির ও উজির বুদ্ধিমানকে বলবে, যুদ্ধ রণাঙ্গনে পুরুষে পুরুষে হয়ে থাকে, নারীকে যুদ্ধে ব্যবহার করা কোন বাহাদুরী নয়। যারা নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে যুদ্ধ জিততে চেষ্টা করে, তারা কাপুরুষ, তারা রণাঙ্গনে মোকাবেলা করার যোগ্যতা রাখে না। রাজাকে বলল, আপন বোনকে স্ত্রী বানিয়ে রাখার মতো অপরাধীর অপরাধের পরিমাণ অনেক হয়ে গেছে। তাকে তার কৃত অপরাধের শাস্তি ভোগ করতেই হবে। এজন্য সে যেন প্রস্তুত থাকে।”
মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রাণ ভরে আল্লাহর শোকর আদায় করে চৌকির কমান্ডারকে নির্দেশ দিলেন, এদেরকে ভিন্ন ভিন্ন ঘোড়র ওপরে বসিয়ে দু’জন সিপাহী দিয়ে রাজধানীর পথের কোন বসতিতে দায়িত্ববান কোন ব্যক্তির কাছে দিয়ে এসো। যাতে এদেরকে রাজধানীতে পৌছে দিতে পারে। সেই সময় মহাভারতের হিন্দুদের কূটকৌশল ছিল বিশ্বখ্যাত। তখন ভারতে মন্দির ও ব্রাহ্মণদের রাম রাজত্ব। মন্দিরগুলোই পরোক্ষভাবে দেশ শাসন করে এবং রাজাদের ওপর রাজত্ব করে। তখন মন্দিরগুলো ছিল রাজনীতি ও কূটনীতির আখড়া। এরা যে কোন শত্রুতায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতো নারী অস্ত্র। পক্ষান্তরে মুসলমান সংস্কৃতি ছিল এর সম্পূর্ণ বিরোধী। মুসলমানরা নারীর সম্মান ও ইজ্জতকে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস বলেই বিশ্বাস করতো। ফলে পরস্পর এই দুটি চেতনা ও সংস্কৃতির মধ্যে যখন সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে তখন জন্ম নেয় বহু বিস্ময় সৃষ্টিকারী ঘটনা। যা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে এবং আজো পাঠককে করে শিহরিত।
ডাভেলের চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরুর আগে এ ঘটনায় বিন কাসিম আন্দাজ করতে পারলেন, তার প্রতিপক্ষ তাকে কতোভাবে আঘাতের ব্যবস্থা নিয়েছে।
বিন কাসিম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চৌকি থেকে আরমান ভিলায় ফিরে গেলেন এবং পরদিনই ডাভেলের দিকে রওয়ানা হলেন।