যেখানে স্বর্ণকুমারী ও জ্ঞানদানন্দিনীর শিক্ষার গোড়াপত্তন হয়েছিল সেই ঠাকুরবাড়ির ঘরোয়া স্কুলটিতে আবার ফিরে যাওয়া যাক। এই ঘরোয়া স্কুলে কেউ স্পেশাল ক্লাস যদি করে থাকেন তবে তিনি নীপময়ী। প্রবল বিদ্যানুরাগী হেমেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী করে তুলতে চেয়েছিলেন। তার সে সাধ পূর্ণ করেছিলেন তার মেয়েরা। নীপময়ীই কি অপূর্ণ রেখেছিলেন স্বামীর মনোবাসনা? জ্ঞানদানন্দিনীর মতো নীপময়ী কোন হৈচৈ তোলেননি সত্যি, তবু এই বিরাট বাড়িটির অন্দরমহলে নারী জাগরণের কি রকম প্রস্তুতি চলেছিল, কি ভাবে তাদের স্বামীরা তাদের গ্রহণ করতেন জানবার জন্যেই পেছন ফিরে তাকানো যেতে পারে।
নীপময়ী দেবেন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু হরদেব চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে। তার ছোট বোন প্রফুল্লময়ীও ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়েছিলেন। হরদেব বন্ধুর অনুরোধে সৌদামিনীর সঙ্গে তাঁর নিজের দুই মেয়েকেও বেথুনে পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য যারা বেগুনে পড়তে গিয়েছিলেন, তারা নীপময়ী-প্রফুল্লময়ী নন, তাদের দিদি অন্নদা ও সৌদামিনী। মহর্ষি এবং হরদেব দুই বন্ধু হলেও তাদের মধ্যে সামাজিক অবস্থার দুস্তর প্রভেদ ছিল। তাই নীপময়ীর বিয়ে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়নি। খুব গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল।
গণ্ডগোল হবে নাই বা কেন? হরদেব চট্টোপাধ্যায় কুলীন ব্রাহ্মণ, তিনি ব্রাহ্ম মতে পিরালী ব্রাহ্মণের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলে জ্ঞাতি কুটুষেরা দিশাহারা হয়ে ভাবলেন তাদের সবারই জাত যাবে। জাতকুল রক্ষার তোড়জোড় চলল ভালমতো। হরদেবের বড় ছেলে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন অন্য জায়গায়। শিশু পৌত্রের জন্যে বুকটা ফেটে গেলেও সংকল্পচ্যুত হলেন না হরদেব। দেবেন্দ্র যে তার প্রাণের বন্ধু, তার ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন, সেখানে সমাজ বাধা দেবার কে? এখন সমাজের ক্ষমতা আর তো নেই। এই তো সেদিন এক কুলীনের বউ স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে খোরপোষ আদায় করলেন, খুব বেশিদিনের কথা নয়, মাত্র ১৮৫৬ সালের ঘটনা। বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ দিয়েছেন। সমাজ কি আর করতে পারে? হরদেব ভয় পেলেন না।
অপর পক্ষও যে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসেছিল তা নয়। একশ জন লাঠিয়াল নিয়ে তারা তৈরি হলেন যাতে বর এলেই লাঠির ঘায়ে তার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি ঘটিয়ে কনেকে তুলে নিয়ে চম্পট দেওয়া যায়। তারপর? হয়ত দ্বাদশী নীপময়ীর জন্যে এক অন্তর্জলী যাত্রী কুলীন পাত্রকেও তারা জোগাড় করে রেখেছিলেন; তবে ব্যাপারটা এতদূর গড়াতে পারেনি। খবরটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় পুলিশপাহারা বসল বিয়েবাড়িতে। গোধূলি লগ্নে বরবেশে এলেন হেমেন্দ্রনাথ যেমন রূপ তেমনি সাজের বাহার, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল যেন। বেনারসী জোড়ের ওপর নানারকম গয়না—গলায় মুক্তোর মালা, হীরের হার, হাতে বাল, আঙুলে নানারকম আংটি ঝলমল করছে। বালিকা প্রফুল্লময়ীর দেখে মনে হয়েছিল বরবেশে বুঝি মহাদেব এসেছেন তার দিদিকে বিয়ে করতে।
সালঙ্কারা নীপময়ী হেমেন্দ্রকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে পরিয়ে দিলেন বরণমালা। ব্রহ্মোপাসনা শেষ করে তারা বাসরে প্রবেশ করলেন। কৌতূহল হলে সেখানেও একটু উঁকি মেরে আস। চলে; কারণ হেমেন্দ্র আমার বিবাহ পুস্তিকায় সমস্ত খুঁটিনাটি বিবরণ লিখে রেখেছেন। ব্রাহ্ম বিবাহ বলে বাসরে অব্রাহ্ম মহিলারা আসেননি। তাই হেমেন্দ্রকেও অব্রাহ্মিক পরিহাস সহ্য করতে হয়নি। শুধু তাই নয়, পাছে তারা কোন পরিহাস করেন সেই ভয়ে হেমেন্দ্র স্ত্রীশিক্ষার প্রসঙ্গ তুললেন এবং তাদের বাড়ির অনেক মেয়ে সংস্কৃত ও ইংরেজী পড়তে পারেন বলে সমবেত মহিলাদের অবাক করে দিলেন। হেমেন্দ্রর এই উক্তি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, সেকালে সব ব্রাহ্ম মহিলাই উচ্চশিক্ষিতা ছিলেন না। সাধারণত আমরা ব্রাহ্মিকা বলতেই যা বুঝি তার বাইরেও অনেকে ছিলেন। সুকুমারী ও হেমেন্দ্রর এই ধরনের ব্রাহ্ম বিবাহ দেওয়ায় মহর্ষিভবনের সামাজিক গণ্ডিটি আরো ছোট হয়ে এল। কিন্তু সেদিকে তাকাবার সময় কারুর ছিল কি?
ঠাকুরবাড়িতে তখন নতুন ভাবের স্রোত বইছে। উৎসাহ-উদ্দীপনায় দিন কাটছে খেয়ালখুশির হালকা হাওয়ায় ওড়া পাখির মতো। বাইরের শিক্ষিত সমাজেও চলছে উৎসাহ উদ্দীপনা। সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন নিয়ে আসছে ব্রাহ্ম সমাজ। কেশব সেন একদিন একদল ব্রাহ্ম মহিলাকে নিয়ে বরস নামে এক পাত্রীর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ রাখতে গেলেন। চায়ের পেয়ালায় তুফান রোজই ওঠে। হেমেন্দ্রও এই ফাঁকে একটা কাজ করলেন। তিনি স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে গান শেখাবার ব্যবস্থা করে দিলেন।
এমন দুর্জয় সাহসের কথা তখন কেউ ভাবত না কারণ ভদ্রঘরের বাঙালী মেয়েরা মোটেই গান শিখতেন না। কবে থেকে এ ব্যবস্থা চালু হল বলা মুস্কিল, হয়ত ঔরঙ্গজেবের সময় থেকেই গানের চর্চা বন্ধ হয়েছিল। বাংলাদেশে গান শিখতেন পুরুষেরা, গান শিখত বাঈজীরাও। নটীর নূপুর নিক্কণে আর বাঈজীর কোকিল কণ্ঠের কাছে বাবুরা নিজেদের সর্বস্ব বিকিয়ে দিলেও সমাজের দিক থেকে ভদ্রঘরের মেয়েদের নাচগান শেখানো ছিল বড় নিন্দনীয়, গহিত ব্যাপার। মেয়েরা গান শোনার শখ মেটাত বৈষ্ণবীদের গান শুনে। তবে বাড়ির মধ্যে নিজের মনে তারা গুনগুন করতেন না এ কথা মোটেই বিশ্বাস্য নয় কারণ স্বর্ণকুমারী আর কাদম্বরী দুজনেই গান জানতেন। তবে ওস্তাদী হিন্দুস্থানী গান সঙ্গীতজ্ঞের কাছে শেখেননি।
হেমেন্দ্রনাথ এ বাধা না মেনে স্ত্রীকে গান শেখাবার জন্যে মহর্ষির কাছে অনুমতি চাইলেন। মহর্ষির রক্ষণশীল মন প্রথমটায় বুঝি সায় দিতে চায়নি। কিন্তু যা সত্যিই মন্দ নয় তাকে তিনি বাধা দেবেন কেন? পিতার অনুমতি পেয়ে হেমেন্দ্র বাড়ির গয়ক বিষ্ণু চক্রবর্তীর কাছে নীপময়ীর গান শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন।
তারপর?
তারপর কি হল? যিনি একটা বড়সড় সংবাদ হয়ে উঠতে পারতেন, যাকে নিয়ে সমাজপতিরা আর একবার হাঁ হাঁ করে সমাজকে রসাতলে পাঠাতে পারতেন, পড়শিনীরা আর একবার গালে হাত দিয়ে ভাববার সুযোগ পেতেন, তাঁকে নিয়ে একটা গুঞ্জন পর্যন্ত উঠল না। কেন? মেজবৌ জ্ঞানদানন্দিনীর মতো নীপময়ী বাইরে ছড়িয়ে পড়েননি বলে? বিচিত্র মানুষের মন! দুই ভাইয়ের একজন স্ত্রীকে ভারতীয় নারীর আদর্শ করে তুলতে বিলেত পাঠান, আরেকজন স্ত্রীকে সর্ববিদ্যায় পারদর্শিনী করে তোলেন নীরবে নিভৃতে। জ্ঞানদানন্দিনী যদি নারী জাতির আদর্শ হন নীপময়ীও তো তাই। তবু দুজনের মধ্যে কত প্রভেদ।
নীপময়ী সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল শেষ পর্যন্ত থেকেই যায়। এগারোটি সুযোগ্য-সার্থক সন্তানের জননী নীপময়ী গান জানতেন, ছবি আঁকতেন, নানা ভাষার বই পড়তেন, দেশী বিলিতি রান্না করতেন। আমরা জানি, নতুন বৌ এলে তাকে ঠাকুরবাড়ির আদব-কায়দা শেখাবার ভার পড়ত নীপময়ীর ওপরে। মহর্ষির নির্দেশে ফুলতলির ভবতারিণীকেও গড়ে পিটে মৃণালিনী করে তুলেছিলেন আর কেউ নয়, এই নীপময়ী। অথচ কোনদিন তাকে নিজের কথা বলতে শোনা গেল না। বোঝা গেল না, সর্বগুণান্বিতা নীপময়ী জীবনকে কি ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। একথা সত্যি, তিনি বহির্জগতে কোন প্রভাব বিস্তার করেননি। অন্যান্য সম্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত বন্ধুর মতোই তার জীবন কেটেছে।
নীপময়ীর একটি সংবাদ আমাদের সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে সেটি হল তার ছবি আঁকা। সেদিন পুণ্য পত্রিকায় নীপময়ীর একটা ছবি চোখে পড়ল। ১৩০৭ সালের পুণ্যতে প্রকাশিত হরপার্বতী অতি সাধারণ একটি ছবি। চিত্রশিল্পী হিসেবে নীপময়ী হয়ত কিছুই হতে পারেননি তবু জানতে ইচ্ছে করে বৈকি। বাংলাদেশে ছবি আঁকার চর্চা প্রায় ছিলই না। পূর্ব যুগের পটশিল্প অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছিল। ভারতীয় শিল্পের অবস্থাও খুব ভাল নয়। এ সময় নীপময়ী ছবি আঁকা শিখেছিলেন। ডঃ অমৃতময় মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে তার মাতামহ ক্ষিতীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত একটি খাতা মহর্ষিপরিবার-এর কিছুটা দেখবার সুযোগ হয়েছিল। তাতে ক্ষিতীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের কথা কিছু কিছু লিখেছেন, ছবি আঁকার কথাও আছে :
মায়ের আঁকা ছবি এখনও আমাদের তিন ভাইয়ের ঘরে কয়েকখানা আছে। কালিদাস পালের শিক্ষকতায় মা ইরুদিদির একটা ছবি এঁকেছিলেন। তাছাড়া একটা ক্লিওপেট্রার ছবি এঁকেছিলেন। White সাহেবের শিক্ষকতায় দিদির ছবি একেছিলেন।
দুঃখের বিষয় নীপময়ীর আঁকা ছবিগুলি সবই নষ্ট হয়ে গেছে। বিবরণ পড়ে মনে হয় নীপময়ী এদেশী এবং বিদেশী চিত্রশিল্পীর কাছে ছবি আঁকা। শিখলেও অঙ্কনশৈলীতে তার নিজস্ব কিন্তু ফুটে ওঠেনি। নীপময়ীর ছেলেমেয়েরাও ভাল ছবি আঁকতেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ তাঁর মায়ের শিক্ষকদের কথাও লিখেছেন। কালিদাস পালের মাসিক বেতন ছিল ত্রিশ টাকা আর white পেতেন একশ টাকা।
ছবি আঁকা ছাড়াও নীপময়ী সেকালের সুপ্রসিদ্ধ বেণীমাধববাবুর কাছে শিখেছিলেন বায়া-তবলা ও করতাল বাজাতে। নীপময়ীকে হেমেন্দ্রনাথ শেখাননি এমন বিষয় খুব কম ছিল। ক্ষিতীন্দ্রনাথ তাঁকে মিন্টনের প্যারাডাইস লস্ট ও সংস্কৃত অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ পড়তে দেখেছিলেন। তবে নীপময়ীর সঙ্গীতচর্চা, চিত্রচর্চা, সবই নেপথ্যে রয়ে গেছে। শিক্ষার ফল শুধু দেখা গেছে তার মেয়েদের অসাধারণ গুণাবলীর মধ্যে। হয়ত তার ছোট বোন প্রফুল্লময়ীও এমনি আড়ালে থেকে যেতেন যদি-না তাঁর স্মৃতিকথাটি আমাদের কাছে পৌছে দিতেন সুধীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে রমা। তিনিও জ্ঞানদানন্দিনী-স্বর্ণকুমারীর মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে বাংলার মেয়েদের চোখের সামনে কোন নজির সৃষ্টি করেননি। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে সর্বসুন্দরী, নীপময়ী, প্রফুল্লময়ীরাও তো ছিলেন।
প্রফুল্লময়ীর মতো হতভাগিনী নারীর সংখ্যা বেশি নেই। নাম তার প্রফুল্লময়ী, কিন্তু সারাটা জীবন তিনি চোখের জল ফেলে ঘরের কোণে বসে কাটিয়েছেন। রূপকথার রাজপ্রাসাদের মতো এই বিশাল ঠাকুরবাড়ির একটা ঘরে যে এত অশ্রুবিন্দু জমাট বেঁধে পাথর হয়ে উঠেছে সে কথাই বা কে জানত? জীবনের একেবারে শেষ পর্বে প্রফুল্লময়ী ব্যক্ত করলেন নিজেকে। না কর েঠাকুরবাড়ির সমস্ত আনন্দ উল্লাস ছাপিয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণাক্লিষ্ট একটি অশ্রুসিক্ত অপরূপ মুখশ্র কি কোনদিন স্পষ্ট হয়ে উঠত? সুখ-দুঃখ আর হাসি-কান্নার টানাপোড়েনে তবেই না বোনা হয়েছে নারীজীবনের সার্থক ছবি।
প্রফুল্লময়ীর দুঃখ কোন সময়েই খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। কি করে উঠবে? হঠাৎ-হারানোর হাহাকার রূপ পেতে পারে, তিল তিল করে জমে ওঠা বুকভাঙা বেদনার তো কোন রূপ নেই। অথচ প্রফুল্লময়ী পেয়েছিলেন সবই। ছোটবেলায় পুণ্যিপুকুর ব্রত করবার সময় সব মেয়েই যা চায়, সেই সব। দিদির বিয়ে হয়েছে বড় ঘরে। মহাদেবের মতো সুন্দর ভগ্নিপতি। গবে মাঝে মায়ের সঙ্গে দিদিকে দেখতে যেতেন ছোট্ট প্রফুল্লমঙ্গী। অবাক বিস্ময়ে দেখতেন দেউড়িদালানওয়ালা তিন মহলা বাড়িটিকে। কত ঘর, কত থাম, জানলা, রেলিং, দাসদাসী, আসবাবপত্র, আলমারিতে সাজানো কাঁচের-পুতুল–কত কী! তাঁকে দেখেও পছন্দ হয়ে গেল শরৎকুমারী ও স্বর্ণকুমারীর। কেমন স্বর্ণচাপার পাপড়ির ফিকে সোনার মতো চমৎকার গায়ের রঙ, পদ্মের পাপড়ির মতো টানা-টানা ডাগর দুটি ভ্রমরকৃষ্ণ চোখ, নিখুত মুখশ্রী, চমৎকার গড়ন, মিষ্টি গলা—আচ্ছা, বীরেন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে দিলে কেমন হয়? যেমন ভাবা তেমন কাজ।
দুই বোনে তাড়াতাড়ি মেয়ে দেখার ব্যবস্থা করলেন। বীরেন্দ্র মহর্ষির চতুর্থ পুত্র, অত্যন্ত মেধাবী, বিশেষ করে অঙ্কে অসাধারণ আসক্তি। সুদর্শন। বেশ মানাবে দুজনকে। তাই মেয়ে দেখার প্রস্তাষ। এর আগে ঠাকুরবাড়িতে মেয়ে দেখা হত সাবেকীমতে। বাড়ির পুরনো ঝি খেলনা নিয়ে মেয়ে দেখতে যেত এবং তারা যাদের পছন্দ করে আসত তাদের সঙ্গেই বিয়ে হত। কিন্তু দিন বদলাচ্ছে সুতরাং আধুনিক মেয়ে দেখার পদ্ধতি যদি চালু করা হয় দোষ কি? একদিন প্রফুল্লময়ী আসতেই দুই বোনে মিলে তাকে সাজিয়ে বীরেন্দ্রকে দেখাবার জন্য টেনেটুনে বাইরের দিকের বারান্দায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। গ্রামবালিকা প্রফুল্লময়ী, তখন তাঁর লজ্জাই বেশি। কাজেই তিনি কিছুতেই বীরেন্দ্রের সামনে বেরোলেন না। কোন রকমে ভেতরের দিকে চলে এলেন। তাতে অবশ্য বিয়ে আটকাল না। অতি বৃদ্ধা বয়সে স্মৃতিকথা বলার সময় প্রফুল্লময়ীর সব কথাই মনে পড়েছিল। সেই সব সুখের দিনের স্মৃতি।
এক ফাল্গুনী অপরাহ্নে দিদির মতোই একহাত ঘোমটা টেনে তাঞ্জামে চেপে প্রফুল্লময়ী এলেন স্বামীর ঘরে। শাশুড়ী-ননদ-জা-দিদির আদরে দিনগুলো শুরু হল স্বপ্নের মতো। ঠাকুরবাড়ি থেকে নতুন বৌ যৌতুক পেলেন গা-ভরা গয়না। গলায়—চিক, ঝিলদানা, হাতে চুড়ি, বালা, বাজুবন্দ; . কানে— মুক্তার গেচ্ছা, বীরবৌলি, কানবালা; মাথায় জড়োয়া সিথি; পায়ে গোড়ে, পায়জোড়, মল, ছানলা, চুটকী; কোমরে—দশ ভরির গেট, আরো কত কী! মনে হল সুখের বুঝি সীমা নেই।
স্মৃতিচারণের সময় প্রফুল্লময়ী ঠাকুরবাড়ির ছোট ছোট ছবি এঁকেছেন। সে ছবিগুলি আশ্চর্যরকমের ঘবোয়া। বাড়ির মধ্যে যে বিরাট পরিবর্তন হচ্ছিল, নারী পুরুষ সকলেই প্রগতির নেশায় মেতে উঠেছিলেন, প্রফুল্লময়ীর লেখা পড়ে তা বোঝাই যায় না। প্রফুল্লময়ী জানাচ্ছেন সাবেকী সব বাড়িতে যেমন হয়, তাদের বাড়িতেও ননদ-জায়েরা সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে বসতেন। গায়ের মেয়ে বলে প্রফুল্লময়ী টানতেন দীর্ঘ ঘোমটা। একহাত ঘোমটার মধ্যে তিনি কি করে খান ভেবে না পেয়ে লুকিয়ে-কিয়ে উঁকি মারতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং খাওয়ার রকম দেখিয়া থাকিতে না পারিয়া নানারকম ঠাট্টা করিতে ছাড়িতেন না।
এরকম করেই দিন কাটছিল। মিষ্টি গলা। বলে তার গান শেখারও ব্যবস্থা হল। মাঝে মাঝে গলা মিলিয়ে গান করতেন কিশোর দেবর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। কিন্তু চার বছর পরে সমস্ত সুখস্বপ্ন মিলিয়ে গেল ক্ষণিক বুদ্ধদের মতো। স্নান আহার ত্যাগ করে দিনে দিনে অস্বাভাবিক হয়ে উঠলেন বীরেন্দ্র। ক্রমশই অস্থিরতা বাড়তে বাড়তে রূপ নিল পাগলামির। লোকে বলে অঙ্ক কষতে কষতে বীরেন্দ্র পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। ঘরের চার দেয়ালে বড় বড় অঙ্ক কষে রাখতেন কাঠকয়লা দিয়ে। শোনা যায়, একজন ইংরেজ অঙ্কবিদ সেই অঙ্কগুলি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। কিন্তু অন্য সময়ে বীরেন্দ্রের মধ্যে এই স্থিরতা ছিল না। প্রকাণ্ড সন্দেহের বিষে সবাইকে জর্জরিত করে তুলতেন। জোর করে তাকে এক চামচ ভাত বা একটি পটল পোড় খাওয়াতে হিমসিম খেতে হত সবাইকে। এমনি করে আরো তিন বছর কাটে কিন্তু প্রফুল্লময়ীর ভাঙা কপাল আর জোড়া লাগেনি। ধীরে ধীরে অতি অকালে ম্লান হয়ে আসে সদাহাস্যময়ী মুখখানি।
বাড়িতে যখন বসন্ত-উৎসব আর পুনর্বসন্তের মহড়া চলছে পুরোদমে, প্রফুল্লময়ীর চোখে তখন ঘন বর্ষার শ্রাবণধারা। মাঝে মাঝে বড় বিস্ময় লাগে। কেন এমন হয়? কি করে হয়? কিন্তু ভরা-ভোগের প্রাচুর্যের মধ্যে বদ্ধদুয়ার ঘরে একটি মেয়ের তিল-তিল করে শুকিয়ে যাওয়া চিরদিন কে মনে রাখে? প্রথমে দুঃখ পায়, সান্ত্বনা দেয়। তারপর ভুলে যায়। এ ঘটনা তো যে কোন বাড়িতে ঘটে। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির মতো আলোকপ্রাপ্ত পরিবারেও এর কোন পরিবর্তন হল না? উন্নতমনা মহর্ষিও কি এই বিষাদ প্রতিমাটিকে কোন ভাবে সার্থক হয়ে ওঠার পথ দেখাতে পারতেন না? প্রফুল্লময়ী সমস্ত শোক তাপের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন অধ্যাত্ম চিন্তার মধ্যে দিয়েই। কিন্তু সে তার একান্ত নিজস্ব উপলব্ধি, মহর্ষির উপদেশ বা সান্ত্বনাবাক্য কোনদিন তার পাথেয় বা পথের দিশারী কোনটাই হয়ে উঠেছিল বলে শোনা যায়নি।
এত দুঃখের মধ্যেও প্রফুল্লময়ীর ভাগ্য মাঝে কিছুদিন সুপ্রসন্ন হয়েছিল। না হলে অন্ধের নড়ির মতো রুগ্ন সন্তান বলেন্দ্রনাথের অল্প বয়সেই এত নামডাক হবে কেন? কিছুদিন পরে টুকটুকে বউ হয়ে এলেন সুশী বা সাহানা। এবার বোধহয় দুঃখ ঘুচল। প্রফুল্লময়ী আপনমনে স্বামীর পরিচর্যা করেন। ছেলে ও ছেলের বৌকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। আবার বাদ সাধলেন বিধাতা। মাত্র কদিনের অরবিকারে শয্যা নিলেন বলে। যমে-মানুষে টানাটানি চলে কদিন। হিতাহিত জ্ঞান হারালেন প্রফুল্লময়ী! তারপর এল সেই দুর্যোগভরা ভয়ানক রাত্রি। ঘরে-বাইরে অশ্রুর তুফান। বলেন্দ্রের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হয়ে আসছে। তার যন্ত্রণা চোখে দেখতে না পেরে বারবার বাইরে গিয়ে বসেছেন হতভাগিনী জননী। এক সময়ে রবীন্দ্রনাথ এসে বললেন, তুমি একবার তার কাছে যাও। প্রফুল্লময়ী জানতেন এ ডাক আসবে। তা বলে এত শীঘ্র! পুত্রের মৃত্যুশয্যার পাশে এসে দাঁড়ালেন প্রফুল্লময়ী।
সব শেষ হইয়া গেল। তখন ভোর হইয়াছে। সূর্যদেব ধীরে ধীরে কিরণচ্ছটায় পৃথিবীকে সজীব করিয়া তুলিতেছিলেন, ঠিক সেই সময় তাহার জীবনদীপ নিভিয়া গেল।
প্রফুল্লময়ী সব আঘাত সহ্য করলেন শান্ত মুখে, ঘোড়শী পুত্রবধুর মুখ চেয়ে। এমনই তার কপাল যে পুত্রবিয়োগ ব্যথায় তিনি শোকে তাপে ভেঙে পড়েননি বলে বাড়ির সবাই আশ্চর্য, বুঝি-বা বিরক্তও হলেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে লিখলেন, নবোঠানের এক ছেলে, সংসারের একমাত্র বন্ধন নষ্ট হয়েছে তবু তিনি টাকাকড়ি কেনাবেচা নিয়ে দিনরাত যে রকম ব্যাপৃত হয়ে আছেন তাই দেখে সকলেই অশ্চর্য এবং বিরক্ত হয়ে গেছে। কবি চিঠিটা লিখেছিলেন বলেন্দ্রের শ্রাদ্ধের আগের দিন। প্রফুল্লময়ীর স্মৃতিকথা পড়ে মনে হয় কেনাবেচা কাজ-কর্ম নিয়ে তিনি দুঃখ ভোলার চেষ্টা করছিলেন। নয়ত তিনি জল-ঝড় উপেক্ষা করে বলেরে ঘরের সামনে দিনরাত পড়ে থাকতেন কেন?
এরপরেও পুত্রবধূর মৃত্যু, স্বামীর মৃত্যু, ভাইয়ের মৃত্যু, বিষয় থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অর্থাভাব প্রভৃতি নানা বিপর্যয় প্রফুল্লময়ীর জীবনে আনাগোনা করেছে। তিনি তার হিসেব রাখেননি। বুকজোড়া শূন্যতার হাহাকার প্রশমিত হবার পর তিনি যখন আমাদের কথা বলতে বসেছেন তখন আর কারুর বিরুদ্ধে তাঁর কোন অভিযোগ নেই, নেই কোন বঞ্চনার গ্লানি। নির্বেদ বিষণ্ণতার মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে তিনি যে শান্তি পেয়েছেন, দুঃখশোকহীন সুখের তরঙ্গে ভেসে বেড়ালে তা কোনদিনই পেতেন না। যে স্পর্শমণি পাবার জন্য মানুষ আকুল হয়ে ঘুরে বেড়ায়, বেদনার সিন্ধু মন্থন করে সেই অমৃতের সন্ধান প্রফুল্লময়ী যেদিন পেলেন, সেইদিন তিনি বিশ্বচরাচরের সব কিছুর মধ্যে বলেন্দ্রকে আবার ফিরে পেলেন। এই পাওয়াই তাঁর জীবনের চরম প্রাপ্তি। তিনি লিখেছেন,
মনে হয়, সে আঙিনায় সেই পূর্বের মতো হাসিয়া খেলিয়া বেড়ায়। পূর্বাকাশে ভোরের আলোতে তাহারই মুখখানি জ্বলজ্বল করে। সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে সেও যেন ঘুমের অচেতনে আমার কোলে ঢলিয়া পড়ে। আমার বলুকে আমি হারাইয়াও হারাই নাই বরং তাহাকে আরও নিকটে পাইয়াছি বলিয়া মনে হয়। এক সে আমার বহু হইয়া অহরহ আমার সম্মুখে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, আজ সে অনন্তরূপে অনন্ত বাহু মেলিয়া আমার বুকে ঝাপাইয়া পড়িয়াছে।
ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরকে সার্থক করে তোলার জন্যে প্রফুল্লমঙ্গীর এই ঐশ্বরিক উপলব্ধিরও প্রয়োজন ছিল। নইলে মনে হতে পারত ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরিকারা নানা-কেতায় পোষাক পরে, বেড়াতে বেরিয়ে, ঘোড়ায় চেপে, চুল বেঁধে আর রান্না করে বাঙালী মেয়েদের শুধু বহির্মুখী করেই তুলেছেন। কিন্তু তা তো নয়। এ বাড়িতে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মহাসঙ্গম ঘটেছে। বহিমু খী ধারার সঙ্গে মিশেছে অন্তর্মুখী সাধনার ধারা। প্রফুল্লময়ী সর্বপ্রথম শোকসাগর মন্থন করে সেই অমৃতের সন্ধান এনে দিলেন।
কোন কিছুই কারুর জন্যে থেমে থাকে না। বিশাল ঠাকুরবাড়ির এক কোণে যখন প্রফুল্লময়ীর জীবনে দুর্ভাগ্যের কালোছায়া নেমে আসছে ঠিক তখনই বাড়ির আরেক প্রান্তে বেজে উঠছে খুশির সানাই বারোয়া সুরে। চতুর্দোলায় চড়ে আর একটি ছোট্ট মেয়ে গোধূলি লগ্নের সিঁদুরি রঙে-রাঙ্গা চেলি পরে প্রবেশ করলেন ঠাকুরবাড়িতে। তার কঁচা শামলা হাতে সরু সোনার চুড়ি, গলায় মোতির মালা সোনার চরণচক্র পয়ে। বাড়ির ছোট্ট ছেলেটির হঠাৎ মনে হল এতদিন যে রাজার বাড়ি খুঁজে খুঁজে সে হয়রাণ হয়েছে, খুজে পায়নি, সেই বাড়িটিরই বুঝি খবর নিয়ে এল এই রূপকথার রাজকন্যে, তার নতুন বৌঠান। কল্পনার দৌড় গেল বেড়ে।
কাদম্বরী যশোরের সেই পরিচিত রায়বংশের মেয়ে নন, তিনি কলকাতাবাসিনী। তার বাবা শ্যামলাল গাঙ্গুলির সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগাযোগ অনেকদিন ধরেই ছিল। কাদম্বরীর পিতামহ জগন্মোহনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দ্বারকানাথের মামাতো বোন শিরোমণির। কাজেই এ বিবাহে মহর্ষির আপত্তি ছিল না। বাধা দিয়েছিলেন তার মেজ ছেলে সত্যেন্দ্র। তিনি তখন বিলেত থেকে ফিরে এসেছেন, চোখে কত রঙ্গিন স্বপ্ন! ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্রর বধূ রূপে তিনি মনে মনে মনোনীত করে রেখেছেন ডাঃ সূর্যকুমার গুডিব চক্রবর্তীর মেয়েকে। শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে ভাইয়ের বিয়ে হবে, তার বদলে কিনা বাল্যবিবাহ! আট বছরের একটি খুকি? এরপরে কি জ্যোতি বিলেত যাবে? যদি যায় তো ফিরে এসে কি এই ছোট্ট মেয়েটিকে জীবনসঙ্গিনীরূপে গ্রহণ করতে পারবে? শেষে নষ্ট হয়ে যাবে না তো দুটি অমূল্য জীবন! কিছুতেই কিছু হল না। একে পিরালী তায় ব্রাহ্ম ঠাকুরবাড়ির অবস্থা তখন একঘরে হওয়ার মতো, তাই জ্যোতিরিন্দ্রের জন্যে যে মেয়ে পাওয়া গেছে তার সঙ্গেই বিয়ে হল। সত্যেন্ত্রের সমস্ত আশংকা মিথ্যে করে দিয়ে কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির যোগ্যতম বধূ হয়ে উঠলেন।
তিনি এ বাড়িতে এসে তিন তলার ছাদের ওপর গড়ে তুললেন নন্দন কানন। বসানো হল পিল্পের ওপর সারি সারি লম্বা পাম গাছ, আশেপাশে চামেলি, গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, করবী, দোলনচাঁপা। এল নানারকম পাখি। দেখতে দেখতে বাড়িটার চেহারা যেন বদলে গেল। গৃহসজ্জার দিকে নববধূর প্রথম থেকেই সতর্ক দৃষ্টি ছিল। কিশোর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধকে সবচেয়ে উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন এই কাদম্বরী, সেই বাধন কোনদিন শিথিল হয়নি।
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের যা কিছু দান, তার সব কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কাদম্বরী। অথচ, খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, নিজে তিনি কোন কিছুতেই অংশ গ্রহণ করতেন না। শুধু অপরের প্রাণে প্রেরণার প্রদীপটিকে উজ্জীবিত করে ভোলাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। আসলে আমরা যাকে বলি রোম্যান্টিক সৌন্দর্যবোধ, কাদম্বরীর সেটি পুরোমাত্রায় ছিল। ঠাকুরবাড়িতে এসে অনুকূল পরিবেশ হয়ত বৃদ্ধি পেয়েছিল কিন্তু এই চেতনা ছিল তার মানস-গভীরে। তাই বাইরে থেকে এসে এ বাড়ির প্রাণপুরুষকে জাগিয়ে দিতে তিনি যতখানি সফল হয়েছেন আর কেউ তা পারেননি।
কাদম্বরীকে নিয়ে এত বেশি আলোচনা হয়েছে যে তার সম্বন্ধে নতুন করে কিছু বলতে চেষ্টা করা বাহুল্যমাত্র। অবশ্য এই আলোচনা-সমালোচনার কারণ রবীন্দ্রনাথ। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনোগঠনে কাদম্বরীর দান অসামান্য। তার অকালমৃত্যু রবীন্দ্রমানসে গভীর ছাপ রেখে যায়। একথা কবি নিজেই অসংখ্য কবিতা ও গানের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। সুতরাং যারা তাদের নিয়ে অনেক কল্পনা এবং কষ্ট-কল্পনা করেন তাদের সুযোগ করে দিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, একথা বললে খুব ভুল বলা হবে না। কবি নিজেও জানতেন সেকথা। তাই কৌতুক করে শেষ বয়সে বলতেন, ভাগ্যিস নতুন বৌঠান মারা গিয়েছিলেন তাই আজও তাকে নিয়ে কবিতা লিখছি—বেঁচে থাকলে হয়ত বিষয় নিয়ে মামলা হত।
জোতিরিন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে কিছুটা গোঁড়ামির পরিচয় দিলেও সত্যেন্দ্রজ্ঞানদানন্দিনীর প্রভাবে নব্যভাবের নেশায় মেতে উঠলেন। সাবেক সংস্কার ত্যাগ করে তিনি কাদম্বরীকেও ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিলেন এবং গঙ্গার ধারে নির্জনে শিক্ষাপর্ব শেষ হলে কাদম্বরী প্রতিদিন স্বামীর সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যেতেন। তাঁদের দেখে অবাক বিস্ময়ে যারা কানাকানি করত তাদের কথা প্রথমেই বলেছি। কাদম্বরীর অশ্বারোহণ বেশ আলোড়ন জাগিয়েছিল। কাদম্বরী ঠিক কোন সময় ঘোড়ায় চড়তেন সেকথাও জানা যায়নি। কেউই সঠিক সময় নির্দেশ করেননি। তবে এ ব্যাপারে কাদম্বরীকে একমাত্র অশ্বারোহিণী বঙ্গললনা বলা চলে না। কারণ আরো কয়েকজনের কথা আমরা শুনেছি। তারা কাদম্বরীর পূর্ববর্তিনী হয়ত নন কিন্তু সমসাময়িক বা অল্প পরবর্তী যে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। য়ুরোপীয় শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে আধুনিকারা ঘোড়ায় চড়া শিখতেন। সাহেবদের অনুকরণ করতেন দেশী সাহেব অর্থাৎ ভারতীয় আই. সি. এস. অফিসারেরা। সত্যেন্দ্রনাথকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তার স্ত্রী ঘোড়ায় চড়তে পারেন কিনা। সত্যেরে পরেই যে তিনজন বাঙালী সিভিলিয়ান অফিসার হয়েছিলেন তারা—রমেশচন্দ্র দত্ত, বিহারী লাল গুপ্ত ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এঁরা আচার-বিচার চালচলনে পুরো সাহেব হয়ে গিয়েছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের স্ত্রী শ্রীহট্টে ঘোড়ায় চড়ে বিকেলে হাওয়া খেতে বেরোতেন। লর্ড সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহের মেয়ে রমলা এবং কুচবিহারের মহারাণী সুনীতিদেবীর মেয়েরাও ঘোড়ায় চড়তে জানতেন। হেমেন্দ্রনাথের মেয়েরাও কেউ কেউ এ ব্যাপারে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তবে এর এসেছেন অনেক পরে। সেকালের আধুনিক মেয়েরা অনেক ব্যাপারেই অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। এঁদের সবচেয়ে আধুনিকতা ছিল স্বামী বা সঙ্গীনির্বাচনের অভিনবত্বে। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বৌরা ঠিক এই ধরনের মানসিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। তারা সনাতন ধারাটিতেই এনেছেন নতুন কালের ছন্দ। বগহীন উন্মত্ত মুক্তির স্রোতে হয়ত উন্মাদনা আছে কিন্তু সুস্থ মানসিকতা কোথায়? ঠাকুরবাড়ির কোন মেয়েই এমন হালকা হাওয়ার খেয়ালী নেশায় মেতে ওঠেননি। তাই নারী সমাজের ওপর তাদের মোহরের ছাপটাই সবচেয়ে গভীর!
কাদম্বরী শুধু ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতেই বেরিয়েছিলেন তা নয়, সাধারণী নারীদের চোখে এঁকে দিয়েছিলেন এক দুঃসহ স্পধার মায়াঞ্জন, অনেকের বুকে তিনি জাগিয়েছিলেন দুঃসাহস। মেয়েরা দেখল হালকা-হাওয়ায় উড়ে আসা। বুদ্বুদের ফেনার মতো পশ্চিমীধারায় মানুষ হওয়া মেয়ে নয়, পথে ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন তাদেরই মতো এক গৃহবধূ। বাস্তবিকই মেয়েলি কাজে কাদম্বরীর সুতীব্র আগ্রহ ছিল। সুপুরি কাটতেন নিয়মিত। প্রতিদিনের তরকারি কাঁটার আসরে তিনি যেমন উপস্থিত থাকতেন তেমনি দেখাশোনা করতেন বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের। কারুর জ্বর হলে আর রক্ষে নেই, কাদম্বরী গিয়ে বসতেন তার শিয়রে। সদ্য মাতৃহারা বালক দেবরটিকেও তিনি পরম স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন অথচ কতই বা বয়স তার? রবীন্দ্রনাথের চেয়ে মাত্র এক বছরের বড়।
কাদম্বরীর প্রধান পরিচয় তিনি অসাধারণ সাহিত্যপ্রেমিকা ছিলেন। বাংলা বই তিনি পড়তেন শুধু সময় কাঁটাবার জন্য নয়, সত্যিই উপভোগ করতেন। পড়তেন দ্বিজেন্দ্রনাথের স্বপ্নপ্রয়াণ, বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ। দুপুর বেলায় রবীন্দ্রনাথও পড়ে শোনাতেন তাকে। হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করতেন কাদম্বরী, কারণ আপন মনে পড়ার চেয়ে শুনতেই বেশি ভাল লাগত তার। ভারতী পত্রিকা নিয়েও তার ভাবনা ছিল। ভারতীর ছাপার হরফে তাঁর নাম নেই সত্যি কিন্তু তিনিই ছিলেন ঐ পত্রিকার প্রাণ। সে কথা বোঝা গিয়েছিল তার মৃত্যুর পরে। পূর্বোক্ত নন্দন কাননে সন্ধ্যেবেলা বসত গান ও সাহিত-পাঠের আসর। আসরে যোগ দিতেন বাড়ির অনেকে, বাইরে থেকে আসতেন অক্ষয়। চৌধুরী ও তার স্ত্রী শরৎকুমারী লাহোরিণী, জানকীনাথও থাকতেন সেখানে, আর মাঝে মাঝে আসতেন কবি বিহারীলাল! জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ও স্বর্ণকুমারী ছিলেন এ সভার স্থায়ী সভ্য। কাদম্বরী বিহারীলালের কবিতা পড়তে খুব ভালবাসতেন ও মাঝে মাঝে তাকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। শুধু তাই নধু, নিজের হাতে একটা আসন বুনে উপহার দিয়েছিলেন। আসনের ওপর, প্রশ্নচ্ছলে কার্পেটের অক্ষরে লেখা ছিল সারদামঙ্গল কাব্যেরই কয়েকটা লাইন। কবি সে উত্তর দেবার জন্যে আর একটা কাব্য যখন রচনা করেন,
তখন কাদম্বরী ইহলোকে নেই। বিহারীলাল তাঁর উপহারকে স্মরণ করে। কাব্যের নাম দিয়েছিলেন সাধের আসন। আসনদাত্রী দেবীর উদ্দেশে লিখেছিলেন?
তোমার সে আসনখানি
আদরে আদরে আনি,
রেখেছি যতন করে চিরদিন রাখিব;
এ জীবনে আমি আর
তোমার সে সদাচার,
সেই স্নেহমাখা মুখ পাশরিতে নারিব।
ছাদের বাগানে সন্ধ্যেবেলা বসত পরিপাটি গানের আসর। মাদুরের ওপর তাকিয়া, রূপোর রেকাবে ভিজে রুমালের ওপর বেলফুলের গোড়ের মালা, এক গ্লাস বরফজল, বাটা ভরতি হুঁচি পান সাজানো থাকত। কাদম্বরী গা ধুয়ে চুল বেঁধে তৈরি হয়ে বসতেন সেখানে, জ্যোতিরিন্দ্র বাজাতেন বেহালা, রবীন্দ্র ধরতেন চড়া সুরের গান, সে গান সূর্য ডোবা আকাশে ছাদে ছাদে ছড়িয়ে যেত। হু হু করে দক্ষিণে বাতাস উঠত দূর সমুদ্র থেকে, তারায় তারায় যেত আকাশ ভরে। কিশোর রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনাকে জাগাবার জন্য এই পরিবেশ এই সৌন্দর্যদৃষ্টি ও কল্পনার একান্ত প্রয়োজন ছিল।
পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরীকে নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। মাঝে মাঝে অনুচিত সন্দেহ এসে যে কাঁটা বেঁধায়নি তাও নয়। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের বিবাহের কয়েকমাসের মধ্যে কাদম্বরীর মৃত্যু সংশয় সৃষ্টি করেছিল। রবীন্দ্রমানস গঠনে এই অসামান্যা নারীর দান চিরস্মরণীয়। তার কবি হয়ে ওঠার কথা পড়ে মনে হয় তাঁর আন্তরিক চেষ্টার মূলে ছিলেন কাদম্বরী। বৌদিদির চোখে নিজেকে যত দামী করে তোলার চেষ্টা চলছিল, কাদম্বরী মুখ টিপে হেসে ততই অগ্রাহ্য করে গেছেন দেবরটিকে :
রবি সবচেয়ে কালো, দেখতে একেবারেই ভালো নয়, গলা যেন কী রকম। ও কোনোদিন গাইতে পারবে না, ওর চেয়ে সত্য ভালো গায়।
বলতেন :
কোনোকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো লিখতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথের তখন শুধুই মনে হত কী করে এমন হব যে আর কোন দোষ তিনি খুঁজে পাবেন না। বুঝতেন না, সেই সাধনাই করছেন কাদম্বরী, যাতে কেউ কোনদিন রবির দোষ খুঁজে না পায়। যখন একথাটা বোঝার মতো করে বুঝলেন তখন কাদম্বরী হারিয়ে গেছেন চির অন্ধকারে, প্রতিভার প্রদীপে তেল-সলতে যোগানো সারা, আলো জ্বালার কাজ শেষ। কবির কথায় বারবার এসেছে কাদম্বরীর কথা, খুব ভালবাসতুম,তাকে। তিনিও আমায় খুব ভালবাসতেন। এই ভালবাসায় নতুন বৌঠান বাঙালী মেয়েদের সঙ্গে আমার প্রাণের তার বেঁধে দিয়ে গেছেন। তাই তো সারাজীবন ধরে চলে তার অনুসন্ধান :
নয়ন সম্মুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।
আমরা রবীন্দ্রকাব্য আলোচনায় যাব না, তবে তার বহু কবিতায় বহু গানে মিশে রয়েছেন কাদম্বরী, ছবিতে ধরা পড়েছে তার চোখের আভাস। সব মিলে কাদম্বরী আজ আমাদের কাছে বাস্তবে-কল্পনায় মেশা একটা অপরূপ চরিত্র হয়ে আছেন। কবি নারীকে বলেছেন, অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা— কাদম্বরীও তাই। রোম্যান্টিক স্বপ্ন-সঞ্চারিণী নতুন বৌঠানের মধ্যে হারিয়ে গেছেন মানবী কাদম্বরী।
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে কাদম্বরীর আরেকটি ভূমিকাও স্মরণীয়। তিনি ছিলেন সুঅভিনেত্রী এবং সুগায়িকা। নাট্যরসিক জ্যোতিরিন্দ্রর মন আরো উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল গুণবতী স্ত্রীকে পেয়ে। বাইরের জোড়াসাঁকো-থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি নিজেই লিখতে শুরু করলেন নাটক-প্রহসন-গীতিনাট্য, অভিনয়ের ব্যবস্থাও হল। একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে, বাড়ির উঠোনে। বাড়ির মধ্যে অভিনয়ে মেয়েদের যোগ দিতে বাধা কি? কাদম্বরীকে কেউ বাধা দিলেন না। তিনি এসে দাঁড়ালেন পাদপ্রদীপের আলোয়। প্রথম অভিনয় স্বর্ণকুমারীর বসন্ত উৎসব, না কি জ্যোতিরিন্দ্রর অলীকবাবু? প্রথমে যার নাম ছিল এমন কর্ম আর করব না। রচনার সময় হিসেবে এমন কর্ম আর করব না পূর্ববর্তী। সুতরাং বসন্ত-উৎসবের চেয়ে তার দাবি বেশি। যদি ধরে নেওয়া যায় এ প্রহসন লেখার পরই অভিনয়ের ব্যবস্থা হয় এবং রবীন্দ্রনাথ নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে প্রহসনটি অভিনীত হয়েছে রবীন্দ্রের প্রথম য়ুরোপযাত্রার আগে এবং এটাই ছিল কাদম্ববীর প্রথম অভিনয়।
প্রথম বা দ্বিতীয় যাই হোক না কেন এমন কর্ম আর করব না মঞ্চসফল নাটক। এই নাটকে বাড়ির অনেকেই সানন্দে যোগ দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অলীক বাবু, দ্বিজেন্দ্রনাথ সত্যসন্ধ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ চীনেম্যান, অলীকের বন্ধু অরুণেন্দ্রনাথ, গদাধর শরৎকুমারীর স্বামী যদুনাথ মুখোপাধ্যায়। পিসনি বা প্রসন্নাসীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলের মহর্ষির ছোট মেয়ে বর্ণকুমারী।
রবীন্দ্রনাথের ছোট দিদি বর্ণকুমারী সম্বন্ধে আমরা খুব কম জানি। অথচ তিনি রবীন্দ্রনাথের পরেও অনেকদিন জীবিত ছিলেন। শিল্প বা সাহিত্যের দিকে নজর দিতে না পারলেও বর্ণকুমারী ভাল অভিনয়ের নজির সৃষ্ট করে গেছেন প্রসন্ন চরিত্রাভিনয়ে। বালিকা ইন্দিরার মনে সে অভিনয় দাগ কাটে, তিনি প্রসন্ন সেজে দাসীদের অতি স্বাভাবিক আচরণ অভিনয় করে দেখালেন একদিন। অন্যান্য বড় নাটকে তাকে অংশগ্রহণ করতে দেখা না গেলেও অভিনয়ের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। বহু বার নাটকে রিহার্সালে তিনি উপদেষ্টার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার নিজের অভিনয়ের কথা বড় একটা শোনা যায়নি। বর্ণকুমারীর বিয়ে হয়েছিল কবি-সাহিত্যিক রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছোটভাই সতীশচন্দ্রের সঙ্গে। চিকিৎসক হিসেবে তিনি দেশ-বিদেশে খ্যাতি লাভ করেন। কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের (আর. জি. কর) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতারূপে তিনি সর্বজন-পরিচিত। জার্মান ভাষাতেও তার অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল কিন্তু দুরারোগ্য ক্যানসারে তার অকাল মৃত্যু হয়।
বর্ণকুমারী শরৎকুমারীর মতোই অতিমাত্রায় সাংসারিক ছিলেন। খুব ভাল রাখতে পারতেন, সেলাই করতেন, আবার গানও জানতেন। ভালবাসতেন উপাসনা সেরে দেবেন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে। কিছু কিছু লিখেছেনও কিন্তু লজ্জায় সংকোচে নিজের নামে প্রকাশ করতে পারেননি। তাই আজ পুরনো ভারতীর পাতা থেকে তার বেনামী লেখাগুলো খুঁজে বার করা খুবই কঠিন। খুব বৃদ্ধ বয়সেও ভাইফোঁটার দিন জোড়াসাঁকোয় এসে কবিকে ফোঁটা দিয়ে যেতেন বর্ণকুমারী। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের যোগাযোগ অটুট ছিল।
আবার ফিরে আসি নাটকের কথায়। এই নাটকের সবচেয়ে দুরূহ ভূমিকাটিই হচ্ছে হেমাঙ্গিনীর। বঙ্কিম-উপন্যাস পড়া উনিশ শতকের রোম্যান্টিক নায়িকা এমন কর্ম আর করব না-র হেমাঙ্গিনী। আবেগগর্ভ আদিরসকে পরিহাসতরল হাস্যরসে পরিণত করে আজও সে অমর হয়ে আছে। অনেকেই মনে করেন এই ভূমিকাভিনেত্রী ছিলেন কাদম্বরী। অথচ ইন্দিরার স্মৃতিতে অলীকবাবুর যে অভিনয়টি স্মরণীয় হয়ে আছে সেটিতে হেমাঙ্গিনী সেজেছিলেন অক্ষয় চৌধুরীর স্ত্রী শরৎকুমারী। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও ইন্দিরাকে অনুসরণ করে শরৎকুমারীকেই হেমাঙ্গিনীর ভূমিকাভিনেত্রী বলেছেন। অপরদিকে সজনীকান্ত দাস সরাসরি কবিকে প্রশ্ন করেছিলেন, হে কে? প্রশ্ন করার কারণ, কবি ভগ্নহৃদয় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবার সময় সেটি উৎসর্গ করেন শ্ৰীমতী হে—কে। কবি সজনীকান্তকে পাল্টা প্রশ্ন করেন, তোমার কি মনে হয়? সজনীকান্ত বলেছিলেন, হেমাঙ্গিনী। অলীকবাবুতে আপনি অলীক ও কাদম্বরীদেবী হেমাঙ্গিনী সাজিয়াছিলেন। সেই নামের আড়ালের সুযোগ। আপনি গ্রহণ করিয়াছিলেন।
কবি স্বীকার করেন, ইহাই সত্য অন্য সব অনুমান মিথ্যা।
এই শ্ৰীমতী হে নিয়েও কম সংশয় নেই। ইন্দিরা মনে করেন হের পুরো নাম হেকে টি, গ্রীক পুরাণের ত্রিমুণ্ড দেবী, সংক্ষেপে কাদম্বরীর ডাকনাম। তবে ইন্দিরা দেখেননি বলেই যে কাদম্বরী হেমাঙ্গিনীর ভূমিকায় কখনো অভিনয় করেননি তা মনে হয় না। ১৮৭৭ সালে যদি প্রথম অভিনয় হয়ে থাকে তখন ইন্দিরা এদেশে ছিলেন না, পরেও তিনি যে সব সময় ঠাকুরবাড়িতে থাকতেন তা নয়। এসব অভিনয়ে আমরা জ্ঞানদানন্দিনীকেও অভিনয় করতে দেখিনি। অলীকবাবুর অভিনয় পরেও অনেকবার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের প্রযোজনায় পরবর্তীকালের অভিনয়ে কবি গল্পটিকে ঈষৎ বদলে হেমাঙ্গিনীকে সারাক্ষণ নেপথ্যে রেখেছিলেন! অবন ঠাকুর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, তখন মেয়েই বা কই এ্যাকটিং করবার। অসম্ভব নয়। তবু এক একবার মনে হয় সত্যিই কি শুধু অভিনেত্রীর অভাব? সে অভাব কখনও পূরণ হয়নি? না, কাদম্বরীর সমকক্ষ মনে হয়নি কাউকে? যাক, অলীক কষ্টকল্পনা করে তো লাভ নেই।
হেমাঙ্গিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও বসন্ত-উৎসব ও মানময়ীতে কাদম্বরীর ভূমিকা স্পষ্ট। এ দুটি অভিনয়ে কাদম্বরী শুধু ভাল অভিনয়ই করেননি, ভাল গানও গেয়েছিলেন। অবশ্য সঙ্গীতে কাদম্বরীর অধিকার ছিল। বিখ্যাত সঙ্গীত জগন্মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌত্রী তিনি, গান তার রক্তে। তিনি আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন তলার ঘরে শুধু পিয়ানো আসেনি, জ্যোতিরিন্দ্র ও রবীন্দ্রের অনুশীলনও শুরু হয়ে গেছে। তাঁর নন্দনকাননের সান্ধ্য-সভাতেও বসত গানের আসর। এসব দেখে মনে হয় অভিনয়, গান, সাহিত্য নিয়ে কাদম্বরী সবাইকে একেবারে মাতিয়ে রেখেছিলেন। ভারতী পত্রিকার কথাই ধরা যাক না। দ্বিজেন্দ্রনাথ সম্পাদক, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দেখাশোনা করতেন, রবীন্দ্রনাথ লিখতেন। কাদম্বরীর কাজ কি ছিল? শরৎকুমারীর ভাষায়, তিনি ছিলেন ফুলের তোড়ার বাঁধন। সবাইকে একসঙ্গে তিনিই বেঁধে রেখেছিলেন, সবার অলক্ষ্যে। বাঁধন যেদিন ছিড়ল সেদিন শুধু সেদিনই বোঝা গেল কাদম্বরী কি ছিলেন।
নিজের হাতে জীবনদীপটি নিবিয়ে দিয়ে অন্তরালে চলে না গেলে তিনি হয়ত ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরের রসের উৎসটিকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই জোড়াসাঁকোর বাড়ি থেকে সোনালি দিনগুলি শীতের পাখির মতো বিদায় নিতে শুরু করল। এরপরে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সম্মিলিত ভূমিকার চেয়ে একক ভূমিকাই বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন চলে গেলেন কাদম্বরী? কেন? কেন? এ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর আজও পাওয়া যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের বিবাহের মাত্র কয়েক মাস পরেই কাদম্বরীর মৃত্যু হয়। ঘটনাটি আকস্মিক। তবে একেবারে অভাবনীয় নয় হয়ত। পূর্কেও তিনি একবার। আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এই সুরসিকা, রুচিসম্পন্না, প্রতিভাময়ী নারীর জীবনেও শান্তির অভাব ছিল। রবীন্দ্র জীবনীকারের ভাষায় কাদম্বরী ছিলেন যেমন অভিমানিনী, তেমনি সেন্টিমেন্টাল এবং আরো বলিব ইনট্রোভার্ট, স্কিজোফ্রেনিক। তাঁর মতের সঙ্গে সবাই একমত না হলেও কাদম্বরীকে অভিমানিনী আরো অনেকেই বলেছেন। তাঁর নিঃসন্তান-জীবনের বেদনা অভিমানকে আরো তীব্র করে তুলেছিল। তাই প্রাণের গভীরে লুকিয়ে থাকা দুঃখের ফধারা হঠাৎ এক আঘাতে নিজেকে হারিয়ে বাঁধভাঙা বন্যার মতো নেমে এল দুকূল ছাপিয়ে।
পরবর্তীকালে এ নিয়ে জল্পনার শেষ নেই। অনেকেই অনেক রকম গল্প রচনা করে ফেলেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনীটি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। বিশেষ করে তার বিবাহ এবং কাদম্বরীর মৃত্যুর মধ্যে একটি যোগসূত্র কল্পনা করে নেওয়া যখন সত্যিই খুব কষ্টকর নয়। কারণ রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীকে কাদম্বরী কি ভাবে গ্রহণ করেছিলেন তা কেউ জানে না। কাদম্বরীর সঙ্গে মৃণালিনীর কথাবার্তা বা দেখা-সাক্ষাতের কোন বিবরণ পাওয়া যায়নি। ভবতারিণীকে মৃণালিনী করে তোলার ভার কাদম্বরী না পেয়ে নীপময়ী পেলেন কেন তাও অজানা। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের খুঁটিনাটি বিবরণ পাওয়া গেছে। হেমলতার প্রবন্ধে, সেখানেও কাদম্বরী আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত। মেয়ে দেখার সময় যার এত উৎসাহ ছিল, তিনি চুপ করে গেলেন কেন? প্রবীন্দ্রনাথের জন্যে পাত্রী নির্বাচনের সময় কি তার সঙ্গে মতান্তর হয়েছিল অন্য কারুর? প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এজন্যই বোধহয় একবার মন্তব্য করেন কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যুর কারণ হচ্ছে, মহিলাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিণাম। তবে এই মহিলা কবিপত্নী নন, তিনি তখন বালিকামাত্র। সম্ভবত জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গেই তার মতান্তর হয়। মনের গভীরে এর হয়ত অন্য কারণ ছিল। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল একটা সামান্য ঘটনা উপলক্ষ্য করে। তাই সমসাময়িক কালে কেউ কেউ এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে।
কাদম্বরীর মৃত্যু সংক্রান্ত যে সব খবর পাওয়া গেছে তাতে নিশ্চিত উত্তর কিছু পাওয়া যায় না। ইন্দিরা আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে লিখেছেন, জ্যোতিকাকামশাই প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না। তার প্রধান আড্ডা ছিল বির্জিতলাওয়ে আমাদের বাড়ি। আমার মা জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে ওঁর খুব ভাব ছিল। এরই মধ্যে একদিন অভিমানিনী কাদম্বরী স্বামীকে বলেছিলেন তাড়াতাড়ি ফিরতে। গানে গানে আডডায় আড়ায় সেদিন এত দেরি হয়ে গেল যে জ্যোতিরিন্দ্রের বাড়ি ফেরাই হল না। প্রচণ্ড অভিমানে কাদম্বরী ধ্বংসের পথই বেছে নিলেন। বাড়িতে কাপড় নিয়ে আসত বিশু বা বিশ্বেশ্বরী তাতিনী। সেই বিশুকে দিয়ে লুকিয়ে আফিম আনিয়ে, সেই আফিম খেয়েই কাদম্বরী মর্ত জীবনের মায়া কাঁটালেন।
আবার বর্ণকুমারীকে প্রশ্ন করে অমল হোম শুনেছিলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেট থেকে কাদম্বরী পেয়েছিলেন তখনকার দিনের একজন বিখ্যাত অভিনেত্রীর মতান্তরে নটী বিনোদিনীর কয়েকখানি চিঠি। চিঠিগুলি উভয়ের অন্তরঙ্গতার পরিচায়ক। এই চিঠিগুলি পেয়ে কাদম্বরী কয়েকদিন বিমনা হয়ে কাঁটান তারপর আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গিয়েছিলেন যে ঐ চিঠিগুলিই তাঁর আত্মহত্যার কারণ। মহর্ষির আদেশে সেসব চিঠি ও তাঁর স্বীকারোক্তি নষ্ট করে ফেলা হয়। কাজী আবদুল ওদুদ লিখেছেন যে, তিনি ঠাকুরবাড়ির একজন খ্যাতনামা ব্যক্তির মুখে শুনেছেন, যে মহিলার সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অন্তরঙ্গত জন্মেছিল তিনি অভিনেত্রী নন তবে সেই অন্তরঙ্গতার জন্য কাদম্বরী নাকি আগেও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।
সমসাময়িক কালের অন্যান্য কবিদের কোন কোন লেখা থেকে মনে হয় তারাও জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেই দায়ী করেছেন। নিঃসন্তান স্ত্রীর সঙ্গহীন-শূন্যতা ভরিয়ে তোলার জন্যে স্বামীর যতটা মনোযোগী হওয়া উচিত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তা ছিলেন না। হয়ত এ ব্যাপারে তিনি খানিকটা উদাসীন ছিলেন। নিত্য নতুন সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠা, হঠাৎ একেকটা খেয়ালের বশবর্তী হয়ে চলা, সত্যেন্দ্র-জ্ঞানদানন্দিনীর সান্নিধ্য, তাদের পুত্র-কন্যার সাহচর্য তাঁকে কাদম্বরীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে এনেছিল। তৎকালীন রুচি ও রীতির পরিপ্রেক্ষিতে জ্যোতিরিন্দ্রর পক্ষে থিয়েটারের অভিনেত্রী বা নটীদের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনাও বিচিত্র নয়। সেকালে একান্নবর্তী সংসারে বন্ধ্যা নারী ছিলেন উপেক্ষার পাত্রী। তাঁর বিশেষ আদর ছিল না। কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির বৃহৎ সংসারেও তার যথার্থ স্থানটি কোনদিন পাননি। যাই হোক, সব মিলে কাদম্বরীর মনে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। সযত্ন স্বামীসেবা, গৃহ পরিচর্যা, সাহিত্যশিল্প নিয়ে তিনি নিজেকে ভুলিয়ে রাখলেও শেষরক্ষা করতে পারেননি। সত্যেন্দ্রজ্ঞানদানন্দিনীর কলকাতায় প্রত্যাবর্তন ও বির্জিতলাও বাস এবং রবীন্দ্রনাথের বিবাহ দুটি ঘটনায় তার নিঃসঙ্গতা প্রচণ্ড বৃদ্ধি পায়। সেই অবস্থায় স্বামীর অবহেলায় কাদম্বরী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন ও আত্মহননের পথ বেছে নেন। এর পটভূমিতে ইন্দিরা-কথিত বা বর্ণকুমারী-কথিত যে কোন একটি বা দুটি কাহিনীই থাকতে পারে তবে তৃতীয় কোন অনুমানের অবকাশ বোধহয় নেই।
এই ঘটনার কিছু আগে এবং পরে লেখা কয়েকটা কবিতার প্রতি এজন্যেই সমালোচকদের দৃষ্টি পড়েছিল। প্রথম কবিতাটির কবি অক্ষয় চৌধুরী। জগদীশ ভট্টাচার্যের মতে অন্যাসক্ত স্বামীর প্রতি নারীর অভিমানই অভিমানিনী নিঝরিণী এবং এই নিঝরিণী আর কেউ নন, জ্যোতিরিন্দ্র-পত্নী কাদম্বরী।
রাখিতে তাহার মন, প্রতিক্ষণে সযতন
হাসে হাসি কাঁদে কাঁদি—মন রেখে যাই,
মরমে মরমে ঢাকি তাহারি সম্মান রাখি,
নিজের নিজস্ব ভুলে তারেই ধেয়াই,
কিন্তু সে ত আমা পানে ফিরেও না চায়।
প্রভৃতি অংশ পড়ে অবশ্য সেবাপরায়ণ গুণবতী কাদম্বরীর কথাই মনে পড়ে। অপর দিকে রবীন্দ্রজীবনীকার তারকার আত্মহত্যায় দেখেছেন কাদম্বরীর প্রথম আত্মহনন চেষ্টার প্রতিচ্ছবি। কিশোর রবীন্দ্রনাথ জানতেন তার নতুন বৌঠানের মনোবেদনার কথা।
যদি কেহ শুধাইত
আমি জানি কী যে সে কহিত
যতদিন বেঁচে ছিল
আমি জানি কী তারে দহিত।…
তাই জ্যোতির্ময় জগৎ থেকে আঁধার জগতে তারকার স্বেচ্ছা নির্বাসন। কাদম্বরীর মৃত্যুর পরেও পুষ্পাঞ্জলিতে কবি লিখেছেন, যাহারা ভাল, যাহারা ভালবাসিতে পারে, যাহাদের হৃদয় আছে, সংসারে তাহাদের কিসের সুখ! কিছু না। কিছু না। তাহার যন্ত্রের মতো, বীণার মতো—তাহাদের প্রত্যেক শিরা সংসারের প্রতি আঘাতে বাজিয়া উঠিতেছে। সে গান সকলেই শুনে, শুনিয়া সকলেই। মুগ্ধ হয়—তাহাদের বিলাপধ্বনি রাগিনী হইয়া উঠে, শুনিয়া কেহ নিঃশ্বাস ফেলে না। বেশ বোঝা যায় এই বীণাটি আর কেউ নন, কাদম্বরী। কারণ তার পরেই আছে, পাষণ্ড নরাধম পাষাণ হৃদয় যে ইচ্ছা সেই ঝন্ঝন্ করিয়া চলিয়া যায়, আর মনে রাখে না। এ বীণাটিকে তাহারা দেবতার অনুগ্রহ বলিয়া মনে করে না—তাহারা আপনাকেই প্রভু বলিয়া জানে—এই জন্যে কখনো বা উপহাস করিয়া, কখনো বা অনাবশ্যক জ্ঞান করিয়া, এই সুমধুর সুকোমল পবিত্রতার উপরে তাহাদের কঠিন চরণের আঘাত করে।
আরো একজন কবি জ্যোতিরিন্দ্রকে শালীনতার আড়াল না রেখেই তীব্র ভৎসনা করেছিলেন। বিহারীলাল তার সাধের আসনে পতিব্রতা সতীকে বললেন আর এস না ধরায় কারণ :
পুরুষ কিস্তৃতমতি চেনে না তোমায়।
মন প্রাণ যৌবন
কি দিয়া পাইবে মন।
পশুর মতন এর নিতুই নতুন চায়।
সমসাময়িক ব্যক্তিদের সাক্ষ্য এবং কবিদের রচনা থেকে বোঝা যায়, কাদম্বরীর মৃত্যুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাছকে জড়িয়ে যে অনুচিত কল্পনা মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয় তার কোন ভিত্তি নেই। দেবর রবীন্দ্রনাথের প্রতি যদি কাদম্বরীর অনুচিত আসক্তি সত্যিই প্রকাশ পেত তাহলে তিনি সবার অন্তরে এই শ্রদ্ধার আসন পেতেন কি?
এই মৃত্যুকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কি ভাবে গ্রহণ করেছিলেন? এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কাদম্বরীর মৃত্যুর এক মাস পরেই তিনি জ্ঞানদানন্দিনী, সুরেন্দ্র, ইন্দিরা ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সরোজিনী জাহাজে চেপে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তারকার আত্মহত্যার কিশোর কবির অনুমানই বোধহয় ঠিক, যেমন আছিল আগে তেমনি রয়েছে জ্যোতি। কিন্তু প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে আমরা বোধহয় শুধু একটি কথাই বলতে পারি, কাদম্বরীর জীবনাহুতি জ্যোতিরিন্দ্রকে একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছিল। তাই শুধু বাণিজ্যেই তাকে পর্যুদস্ত হতে হল তা নয়, তাকে পরাস্ত হতে হল জীবনের কাছেও। না হলে তার মতো প্রতিভাবান নাট্যকার কাদম্বরীর মৃত্যুর পর সব ছেড়ে দিয়ে শুধু অনুবাদ নিয়ে পড়ে থাকবেন কেন? জমাটি আর মজলিশ ছেড়ে কেন চলে যাবেন দূরে? এ যে নিজেকেই ভুলে থাকা। কাদম্বরীর মৃত্যুকালে তার বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর কিন্তু তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ করেননি। কেন করেননি সে প্রশ্ন করা হলে তিনি শুধু বলেছিলেন, তাকে ভালবাসি।
যুক্তিবাদীরা হয়ত বলবেন অনুশোচনা। হয়ত সত্যিই তাই। নিজেকে সমাজ-সংসার থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন দিয়ে তিনি তিল তিল করে শাস্তি দিয়েছেন নিজেকেই। শাস্তি দিয়েছেন কাদম্বরীর প্রতি অমনোেযোগী উদাসীন কর্তব্যচ্যুত স্বামীকে। দুঃখের বিষয় আমরা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মনোভাবের কথা একেবারেই জানতে পারি না। শোনা যায় কিছুদিনের জন্য মানসিক ভারসাম্যও হারিয়েছিলেন তিনি। আমার জীবনস্মৃতি কিংবা শেষ বয়সে লেখা:ডায়রি, কোথাও জ্যোতিরিন্দ্রের মনের কথা ধরা নেই। কোথাও নেই কাদম্বরীর কথা। জীবনস্মৃতিতেও দু-একটি সংবাদ ছাড়া কাদম্বরী সর্বত্রই আশ্চর্যভাবে অনুপস্থিত। অথচ ব্রাচিতে তার নিজের বাড়ি শান্তিধামের যে নিরাভরণ ঘরখানিতে তিনি থাকতেন তার দেয়ালে ছিল একটি মাত্র ছবি, তার নিজের হাতে আঁকা কাদম্বরীর পেন্সিল স্কেচ। সুতরাং এই ভুলে থাকা নয় সে তো ভোলা। জ্যোতিরিন্দ্র সেই নির্জন বিষণ্ণ শান্তিধামের নিরালা অবসরে হয়ত বারবার অনুভব করতে চেয়েছেন সেই অসামান্যাকে, যার প্রেরণায় রবীন্দ্রনাথের কবি-মন উজ্জীবিত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি যদিও সেটি ঠিক প্রমীলা সংবাদ নয়। সাম্প্রতিক কালের কোন কোন সমালোচক ভাবতে শুরু করেছেন যে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কোন এক অজ্ঞাত কারণে ছিন্ন হয়ে যায়। এর কারণ হিসেবেও তারা নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের ক্রমবর্ধমান খ্যাতি এবং নতুন বৌঠানের আত্মহত্যা ঘটনাটিকে। কিন্তু দুটি সম্ভাবনাই অসার মনে হয়, কারণ রবীন্দ্রের প্রতি জ্যোতিরিন্দ্র কোনদিন ঈর্ষান্বিত হবেন ভাবা যায় না। বিশেষ করে পরবর্তীকালে যখন তিনি জীবন থেকে সরে গিয়েছেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার যোগ স্ত্রীর মৃত্যুর পরে তো ছিলই, অন্য সময়েও বিচ্ছিন্ন হয়নি। সরোজিনী জাহাজে ভ্রমণ করা ছাড়াও তারা দুই ভাই বহুদিন সত্যেন্দ্রনাথের বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে বাস করেছেন। তাঁর শেষ বয়সের ডায়রিতেও দেখা যাবে দু-তিনবার রবীন্দ্র প্রসঙ্গ আছে। রবির বক্তৃতা, দাড়ি রাখা, গান কিছুই তার চোখ এড়ায়নি। এমন কি ছবিও এঁকেছেন। তবে এ সময় জ্যোতিরিন্দ্র সব কিছু থেকেই অনেক দূরে সরে যাচ্ছিলেন।
অপরদিকে রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিতেও দেখা যাবে অন্তরঙ্গতার সুর। ভাই জ্যোতিদাদার ছবির এ্যালবাম ছাপার ব্যাপারে তিনিই উদ্যোক্তা এবং আগ্রহী। পরবর্তী জীবনে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। তার পারিবারিক জীবনেও নেমে এসেছে। নিয়মিত দুর্বার দণ্ড। স্ত্রী ও পুত্রকন্যাদের মৃত্যু, শান্তিনিকেতনের সমস্যা নিয়ে বিব্রত কবি তখন নিজের কোন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখতে পারছেন না, জীবনবিরাগী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তো সেখানে আরো দূরের মানুষ। সুতরাং কাদম্বরীর মৃত্যু দুই ভাইয়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেনি। এই মৃত্যুর মধ্যেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ খুজেছেন কাদম্বরীর বিদেহী সত্তাকে আর রবীন্দ্রনাথ নতুন করে চিনেছেন নিজেকে। কাদম্বরীর দেহহীন সভা মিশে রইল তাঁর কবিতায়, গানে, ছবিতে।