সোমার শোবার জায়গা ঠিক হয়েছে ঊর্মির সঙ্গে। এই ঘরে দুটো খাট। একটায় ঘুমায় বিজু, অন্যটায় ঊৰ্মি। ঘরে কোনো ফ্যান নেই। গরমের সময় অসহ্য গুমোট। দক্ষিণের জানালা একটা। ঐ জানালা বিজুর খাটের পাশে। বাতাস যা লাগে বিজুর গায়ে লাগে। ঘরে এখন আছে সোমা এবং ঊর্মি। বিজু বারান্দায় টেবিল পেতে পড়ছে। তার পড়া সশব্দ। এত বড় ছেলে এমন শব্দ করে পড়ে কেন কে জানে! সোমার খুব বিরক্তি লাগছে। ঊর্মি বলল, তুমি আসায় খুব সুবিধা হযেছে আপা। বিজু ভাইয়া আর এই ঘরে সিগারেট খাবে না। সিগারেট খেয়ে ঘর অন্ধকার করে রাখে।
তাই নাকি?
হুঁ। সিগারেটের উপরই আছে। ঘুম ভাঙলেই হাতে সিগারেট। এক বার তো মশারিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।
সোমা কিছু বলল না।
ঊর্মি বলল, ঘুম পাচ্ছে আপা?
না।
কী রকম গরম পড়েছে দেখেছ? বৃষ্টিতেও গরম কমল না। আরেকবার গা ধুতে ইচ্ছা করছে। তুমি গা ধোবে আপঃ পানি কিন্তু আছে।
না।
তুমি খাটের কোন দিকে শোবে?
এক দিকে শুলেই হল।
ঐ বাড়িতে কোন দিকে শুতে?
প্রশ্নটা করেই ঊর্মি লজ্জা পেয়ে গেল। তার মনে হল প্রশ্নটা অনুচিত হয়েছে। ঐ বাড়ি প্রসঙ্গে কোনো কথাই এখন বলা উচিত না। যদিও তার অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করছে। কেন এরকম হল? মানুষটা খারাপ এটা সে জানে। কতটুকু খারাপ? কেমন খারাপ? আপাকে কি জিজ্ঞেস করা যাবে? আজই জিজ্ঞেস করবে? নাকি আরো কিছুদিন পর?
সোমা বলল, বাবার রোজগারপাতি এখন কেমন রে ঊর্মি?
ভালো না। এল এম এফ ডাক্তারদের কাছে ঢাকা শহরে কেউ আসে? সব যায় স্পেশালিস্টদের কাছে। বাবা অবশ্যি রোজ ইয়াং ফার্মেসিতে বসে। ওরা মাসে মাসে বাবাকে কিছু টাকা দেয়। রুগী কিছু হয়। সংসার তো চলছে।
সোমা সহজ গলায় বলল, খুব ভালো চলছে বলে তো মনে হয় না।
তা চলছে না। চলবে কোত্থেকে? প্রাকটিস নেই। তা ছাড়া আমার মনে হয়, বাবা ডাক্তারিও ভালো জানে না। আমার এক বার অসুখ হল। বাবা সমানে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াচ্ছে, শেষে দেখা গেল টাইফয়েড। এ দিকে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে খেয়ে আমার চুল উঠে গেল।
চুল উঠল কোথায়? মাথা ভর্তি তো চুল।
বাতি নিবিয়ে দিই আপাং বাতি নেবালে ঘর একটু ঠাণ্ডা হবে।
ঊর্মি বাতি নিবিয়ে দিল। ঘর অবশ্যি পুরোপুরি অন্ধকার হল না। বিজুর পড়া শেষ হয়েছে। সে একনাগাড়ে বেশিক্ষণ পড়তে পারে না। ঘুম ধরে যায়। তখন পানির ঝাপটা দিতে হয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে চা খেতে হয়। তার জন্যে ফ্লাস্কে চা বানানো থাকে। বিজু ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে বাইরের বারান্দায় চলে গেল। একটা সিগারেট ধরিয়ে চা খাবে। সিগারেট ধরানোর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই সোমা এল বারান্দায়। বিজু সিগারেট নিয়ে খানিকক্ষণ ইতস্তত করল। ফেলে দেবে না রাখবে? শেষ পর্যন্ত রেখে দেওয়াই ঠিক করল। এতটুকু একটা বাড়ি এর মধ্যে যদি তিন জনের সামনে সিগারেট খাওয়া বন্ধ রাখতে হয় তা হলে তো বিরাট যন্ত্ৰণা।
বিজু বলল, এখন ঘুমাও নি, শুয়ে পড় আপা।
তুই কখন শুবি?
আমার দেরি আছে। দেড়টা-দুটার আগে ঘুমাতে যাই না।
এতক্ষণ কি করিস? পড়াশোনা?
হু।
ভালোই তো। আগের মতো রেজাল্ট করতে পারলে তো খুবই আনন্দের ব্যাপার হবে।
ঐ সব হবে না। কিছু মনে থাকে না। যা পড়ি সব ভুলে যাই। আপা তুমি শুয়ে। পড়। এক কাজ কর, আমার বিছানায় শোও। দু জন একখাটে ঘুমুতে পারবে না। আমি বারান্দায় পার্টি পেতে শোব। একস্ট্রা মশারি আছে, অসুবিধা হবে না।
রাতে বৃষ্টিটিষ্টি হয় যদি?
কোনো অসুবিধা নেই। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টিতে বিজুর কিছু হয় না।
সোমা দাঁড়িয়েই রইল। তার ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু ঐ অসহ্য গরমে ঘরের ভেতর শুতে ইচ্ছা হচ্ছে না। সে বারান্দায় চেয়ারে এসে বসল। মৃদু সুরে ডাকল, বিজু
কি আপা?
তুই কি ওর সঙ্গে ঝগড়া করেছিলি না-কি?
কার সাথে?
সোমা কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, তোর দুলাভাইয়ের কথা বলছি। ঝগড়া করেছিলি?
বিজু তিক্ত গলায় বলল, কি আশ্চর্য। দুলাভাই শব্দটা তুমি ব্যবহার করলে কেন? ঐ লোকের কথা যদি ওঠে এখন থেকে তুমি সোজাসুজি বলবেকামাল। নো দুলাভাই বিজনেস।
তুই আমার কথার জবাব দিস নি। ঝগড়া করেছিলি?
হ্যাঁ। লোকজন ছিল নয়তো চড় দিয়ে শালার দাঁত খুলে ফেলতাম।
এইসব তুই কি বলছিস?
তুমিই-বা উল্টা কথা বলছ কেন? ঐ শালাকে আমি কোলে নিয়ে চুমু খাব না-কি? সাপের যেভাবে খোলস ছাড়ায় ঐ ব্যাটার চামড়া আমি ঐভাবে খুলে নেব।
তোর এত রাগ কেন? তোর সঙ্গে তো কিছু হয় নি। রাগ যদি কারো হবার হয়। সেটা হবে আমার।
তোমার হবে না। তোমার মধ্যে রাগ বলে কিছু নেই। থাকলে এত দিন লোকটার সঙ্গে থাকতে পারতে না।
সোমা বলল, তোর কাছে আমার অনুরোধ বুঝলি বিজু, রাস্তায় যদি কোনোদিন ওর সঙ্গে দেখা হয় তা হলে হৈ চৈ করব না।
বিজু চুপ করে রইল। তার খুব রাগ লাগছে। এসব আপা কী বলছে? সোমা বলল, সব তো চুকেবুকেই গেছে আর হৈ চৈ কেন? ঠিক না?
আচ্ছা ঠিক আছে। যাও হৈ চৈ করব না। এখন ঘুমুতে যাও। আমার বিছানায় ঘুমিও আপা। দু-একদিনের মধ্যে ফ্যানের ব্যবস্থা করব। তখন আরাম হবে।
সোমা আবার তার ঘরে ঢুকল। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। অস্থির অস্থির লাগছে।
ঊর্মি বলল, আপা ঘুমুবে না?
সোমা জবাব দিল না। তার খুব ইচ্ছা করছে প্রফেসর সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করতে। ঊর্মি তাতে কিছু মনে করবে কি না কে জানে। মনে করার অবশ্যি কিছুই নেই। আর যদি মনে করে তাতেই বা কি।
আপা।
কি?
এ বাড়িতে এসে তোমার কি খারাপ লাগছে?
না।
আমার নিজের খুবই ভালো লাগছে। এ বাড়িতে আমার গল্প করার কেউ নেই। তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারব।
দোতলায় যাঁরা থাকেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই?
না। বুডোমতো এক ভদ্রলোক থাকেন। আর তাঁর এক খালা না কি কে যেন থাকেন। আমি ও বাড়িতে যাই না। চাচাঁদের বাসাতেও যাই না। আমার জীবন এই ঘরটার মধ্যে কেটে যাচ্ছে আপা।
সোমা চুপ করে রইল। পাশের ঘর থেকে চাপা অথচ রাগী গলা শোনা যাচ্ছে। সোমা বলল, এরকম করে কথা বলছে কে রে?
বড় চাচা। মাঝেমাঝে চাচা এরকম করে। মাথা গরম হয়ে যায় তখন এই সব শুরু করে।
তাই নাকি?
হুঁ। আমার মনে হয় বড়ো চাচা পাগলটাগল হয়ে যাচ্ছে।
সোমা চুপ করে বড়ো চাচার কথাগুলো শুনতে চেষ্টা করল। তেমন কিছু বোঝা যায় না তবে কেটে ফেলব পুতে ফেলব—এইসব শব্দ কানে আসছে।