০৪. সে কী ঘন বন

সে কী ঘন বন। চার দিক থেকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। খোলা জায়গায় তবু চারপাশটা দেখতে পাচ্ছিলাম, এখানে তারার আলো পৌঁছায় না। হাজার হাজার বর্ষার জল খেয়ে খেয়ে গাছপালাগুলো অসম্ভবরকম বেড়ে গিয়ে, মাথার ওপরেও আরেকটা জমাট অন্ধকার বানিয়েছে। তার ওপর বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সেই বৃষ্টির জল পাতা থেকে পাতায় খসে, টুপটাপ করে আমাদের গায়ে মাথায় ঝরে পড়ছে। সে যে কী দারুণ ঠান্ডা ভাবা যায় না। পায়ের নীচে ঝরাপাতার গালচে পাতা, পায়ের শব্দ শোনা যায় না। শুধু একটা শুকনো ডালে কারো পা পড়লে, সেটা মটাত করে ভেঙে যাচ্ছে, আর সেই শব্দে চারদিকটা ঝনঝন করে উঠেছে। আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।

সকলের মনে দারুণ দুশ্চিন্তা, বিশেষ করে আমার নিজের মনে। তার কারণ খানিক আগেই যে সর্বনাশটা হয়ে গেছে, সে বিষয় কাউকে কিছু বলবার সাহস নেই আমার।

যাই হোক, সরু বনপথ ধরে, এক জনের পেছন এক জন, কাছাকাছি ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে চলেছি। টর্চ-ফর্চের বালাই নেই।

বেশ শীত করছে, আবার খিদে খিদেও পাচ্ছে। পকেটের লুচির ঘিগুলো অন্য জিনিসে লেগে গিয়ে, একটা জাবড়া মতো পাকিয়ে যাচ্ছে। ও বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়।

এমনি সময় দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে, ক্ষীণ একটু আলোর রেখা দেখা দিল। ব্যস, আর কী ভাবনা! তার মানে বনের মধ্যে মানুষের বাস আছে, খাবার পাওয়া যাবে, আর শোবার জায়গা পাওয়া যাবে।

অন্ধকারে পকেটে হাত পুরে দিয়ে লুচির দলাটা বের করে ক্যাচর-ম্যাচর করে খেয়ে ফেললাম। সে কী শব্দ রে বাবা। চারদিকের গাছপালাগুলো পর্যন্ত রিরি করে উঠল। ওরা ব্যস্ত হয়ে বলল, ওকী রে, কী হল?

ভাঙা গলায় বললাম, ওই দেখো আলো।

তাই দেখে সবাই তো আহ্লাদে আটখানা! এতক্ষণ মুণ্ড ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে, ঘষটাতে ঘষটাতে চলেছিল, এবার তাড়াতাড়ি হাঁটা দিল। আলোটা ক্রমে কাছে আসতে লাগল।

যখন খুব কাছে পৌঁছোলাম, দেখলাম একটা ফাঁকা মতো জায়গা, তার মাঝখানে ছাই রঙের প্রকাণ্ড পুরোনো বাড়ি, তার চুনবালি খসে যাচ্ছে, দরজা জানালা ঝুলে পড়ছে, দেয়াল ছুঁড়ে বট-অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে। তবু একটা আশ্রয় তো বটে।

সদর দরজাটা বন্ধ! জানলার ভাঙা খড়খড়ির ভেতর দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে। সেই আলোটুকু লম্বা হয়ে কত দূর অবধি পড়েছে।

বিরিঞ্চিদা এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিল। আমরা বাকিরা ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে দাঁড়িয়ে, এ-ওর ঘাড়ে গরম নিশ্বাস ফেলতে লাগলাম।

কোনো সাড়াশব্দ নেই।

তখন শ্যামাদাসকাকাও আর থাকতে না পেরে, সাহস করে গিয়ে দরজাতে এমনি জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল যে আশেপাশের জানলাগুলোর ভাঙা খড়খড়িও খটখট করতে শুরু করে দিল।

আমরা ওপর দিকেও তাকাচ্ছিলাম, মনে হল খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে কারা যেন আমাদের খুব নজর করে দেখছে। সিঁড়িটা থেকে নেমে একটু সরে দাঁড়ালাম।

অনেক ডাকাডাকি ধাক্কাধাক্তির পর শুনতে পেলাম ভারী পায়ের শব্দ। কেমন একটু ভয় ভয় করতে লাগল। মনে হল কাজ কী আশ্রয়ে। গাড়ির মধ্যেই কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে সকালে যা হয় একটা-কিছু করলেই হয়।

ঠিক সেই সময়ে খট করে দরজার মাঝখানে একটা ছোট্ট খোপ মতো খুলে গেল। সেই ফাঁক দিয়ে একটা কালো বুনো ভুরুর নীচে থেকে একটা কালো জ্বলজ্বলে চোখ আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

ঠানদিদি ডেকে বললেন, আমরা চোর-ডাকাত নই গো! ক্লান্ত পথিক, জলে ভিজে, খিদেয় কাতর হয়ে, একটু আশ্রয় চাইছি। খোলোই-না বাপু।

চোখটা আস্তে আস্তে সরে গেল। তার পর কত সব ছিটকিনি নামানোর, হুড়কো সরানোর, চেন খোলার, চাবি ঘোরানোর আওয়াজ। শেষটা দরজাটা ধীরে ধীরে ফাঁক হয়ে গেল।

অমনি আমরাও হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

মস্ত চারকোনা ঘর, এবড়ো-খেবড়ো দেয়াল, অসমান টালি-ওঠা মেঝে, এক পাশে একটা তেপায়া টুলের ওপর তেলের বাতি জ্বলছে, তার কাছ দিয়ে পুরোনো একটা কাঠের সিঁড়ি ওপরে উঠে অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে।

ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এই তাল-ঢ্যাঙা, ইয়া ষণ্ডামার্কা এক বুড়ি। মাথার ওপর তার ঝুঁটি করে চুল বাঁধা। ঘরময় ভুরভুর করছে খিচুড়ির গন্ধ।

আমরা এদিকে কাগভেজা, গা বেয়ে জল ঝরছে, সেই জল ঘরের মেঝেতে জমা হয়ে ছোটো ছোটো পুকুর তৈরি হচ্ছে। বুড়ি হতাশভাবে সেই দিকে তাকিয়ে রইল।

ভাবলাম বোধ করি বাঙালি নয়, কথা বোঝেনি। শ্যামাদাসকাকা বলতে লাগল, হামলুগ দুষ্টু আদমি নেই। জলমে কাদামে হোঁচট খাকে খাকে–

বুড়ি বললে, ঢের হয়েছে বাছা। কিন্তু খোঁজ নেই খবর নেই, হঠাৎ এত লোকের ব্যবস্থা কেমন করে হয় বলতে পার?

শ্যামাদাসকাকা অনুনয় করে বলল, কোনো ব্যবস্থা চাই না। শুধু শুকনো গামছা যদি দিতে পারেন ভালো হয়। নিদেন দুটো ছেঁড়া জামা দিলেও তাই দিয়ে গা মাথা মুছে নিতে পারব।

ঠানদিদি আবার জুড়ে দিলেন, আমার বাছা তাও লাগবে না। ওই যার-তার জামা আমি মাথায় ঘষতে পারব না। কিছু দরকার নেই, আমার আঁচলই যথেষ্ট।

বুড়ি ঝড়ের মতো মুখ করে আমাদের কথা শুনতে লাগল। মুখে কথা নেই।

ঠিক সেই সময় শুনতে পেলাম দূরে কড়া নাড়ার শব্দ। এরা তিন জন এমনি আঁতকে উঠল যেন ভূত দেখেছে।

বুড়িও যেন এরই জন্য অপেক্ষা করছিল, টুপ করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আমরা চার জন যে-যার পুকুরে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম এই জলে ঝড়ে আঁধার রাতে কে আবার এল!

কিন্তু হুলিয়ারা কি এমনি জানান দিয়ে আসে? তার চাইতে ঝোঁপের পেছন থেকে হু–স্ করে–

কানে গেল দরজা খোলার শব্দ। কী বলব, ভাবতে পর্যন্ত ভুলে গেলাম! কার সঙ্গে বুড়ি চাপা গলায় কথা কইছে। তারপর সে শব্দও দূরে মিলিয়ে গেল; একেবারে চুপচাপ, একটা প্রজাপতির মতো জানোয়ার বাতির চার দিকে উড়ে বেড়াচ্ছিল, তার ডানার ঝুপঝাঁপ অবধি কানে আসতে লাগল।

হঠাৎ বুড়ি ফিরে এল। দেখলাম তার হাবভাব একদম বদলে গেছে। ই কী, হাতে হাত কচলাতে কচলাতে বললে, গরিবের বাড়িতে এমন অতিথি পাওয়া সৌভাগ্য। তারপর ইয়ে কী যেন বলল মনে পড়ছে না তো– ও হ্যাঁ, চলুন ওপরে চলুন। গরম জল দেব, গামছা দেব, চার জনকে চারখানা শুকনো কাপড় দেব, মাঠাকরুনকে শুদ্ধ কাপড়ই দেব, ভয় নেই। সামান্য যা রান্না হয়েছে, দয়া করে তাই দিয়ে কোনোরকমে ক্ষেমা-ঘেন্না করে চালিয়ে দেবেন, অপরাধ নেবেন না, ইত্যাদি।

খালি খালি মনে হচ্ছিল এখানে না এলেই ছিল ভালো। তবু ওপরে গেলাম বুড়ির সঙ্গে।

ধুলোমাখা পুরোনো কাঠের সিঁড়ির ধাপে ধাপে নানা রকমের আওয়াজ হয়। কত জায়গায় রেলিং নেই, কত জায়গায় কাঠে ঘুণ ধরে গেছে। ওপরে গিয়ে দেখি প্রকাণ্ড ঘর, তার দেয়ালময় কতরকম ছবি আঁকা, তার রং সব জ্বলে গেছে, হরিণ, মানুষ কত কী। বুড়ির হাতের তেলের বাতির আলোতে কীরকম মনে হতে লাগল তারা বুঝি নড়াচড়া করে বেড়াচ্ছে। শীত করতে লাগল।

কাঠের মেঝেতে পুরু হয়ে ধুলো জমেছে, যেন কতকাল কেউ এসব ঘরে বাস করেনি। চলতে গেলে পায়ের চাপে মনে হয় ধোঁয়া উড়ছে।

তবে সামনের দিকের একটা মস্ত ঘর খানিকটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারটে বিশাল বিশাল তক্তাপোশ, সর্বাঙ্গে কারিকুরি করা, আর কোথাও কোনো আসবাব নেই। তার পাশেই স্নানের ঘর।

বুড়ি তেলের বাতিটি দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রেখে নিজেই আমাদের জন্য বালতি করে গরম জল এনে দিল। সাবান দিয়ে কাঁচা, রোদের গন্ধলাগা চারখানা কাপড় আর গামছাও এনে দিল। ঘন বনের মধ্যে খালি পুরোনো বাড়িতে এত আয়োজন দেখে আমরা সবাই থ।

তার ওপর ঘণ্টা খানেক বাদে, চারখানা কানাতোলা থালায় করে খিচুড়ি আর মাংস এল। চমৎকার রান্না। ঠানদিদি অবিশ্যি কিছু ছুঁলেন না, আমরা তিন জনেই চার থালা মেরে দিলাম। ঠানদিদির জন্য একটু দুঃখ লাগছিল, বললাম, তা হলে কি একটু চুইংগাম খাবে?

চোখ বুজে বললেন, না বাছা, ওসব মুরগির ডিম-লাগানো জিনিস আমি খাই নে জানোই তো।

আসলে ব্যাপার দেখে আমরা যেমনি অবাক হচ্ছিলাম, তেমনি সন্দেহও হচ্ছিল।

খাওয়া-দাওয়ার পর বুড়ি তক্তাপোশে মাদুর বিছিয়ে, চারখানি ছোটো বালিশ দিয়ে গেল। আমরাও তখুনি যে-যার শুয়ে পড়লাম। বাবা! সারাদিনটা যা গেছে।

কিন্তু কিছুতেই আর ঘুম আসে না। ওরা তিন জন দু-একটা কথা বলবার পর চুপ হয়ে গেল, আর আমি বহুক্ষণ জেগে থেকে থেকে কতরকম যে শব্দ শুনতে লাগলাম সে আর কী বলব!

বৃষ্টি তখনও পড়ছে, ঝুপ ঝুপ, ঝম ঝম করে পুরোনো বাড়িটার ছাদে, কোথায় একটা টিনের চালে, চারদিকের বড়ো বড়ো গাছপালার ওপর। নীচে বুড়ি বাসন-কোসন ধুচ্ছে মাজছে। গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে, ভাঙা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইছে, জলের ছাঁট ঘরে আসছে।

মনে হল থেকে থেকে গোরুর ডাকও শুনতে পাচ্ছি। শুয়ে থাকতে পাচ্ছিলাম না, ও ধারের জানলার ভাঙা খড়খড়ির ভেতর দিয়ে দেখলাম একটা টিনের শেডের নীচে একটা পিদিম জ্বলছে আর একজন নিরীহ মতো বুড়ো একটা বিষম হিংস্র আমিষশোর চেহারার গোরু দুইছে। এত রাতে গোরু দোয়ানো কীসের জন্য ভেবে পেলাম না।

যাই হোক, বাড়িতে তা হলে অন্য লোকও আছে। কেমন যেন ভয়টা খানিকটা কেটে গেল।

জানলা থেকে যেই ফিরেছি, অমনি মনে হল আমাদের ঘরের দরজাটা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল।

আমার গায়ের রক্তও জল হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *