০৪. সাতটি পটার
হ্যারি দৌড়ে দোতালায় বেডরুমে গেল। সেখান থেকে ঠিক সময়মতো জানালায় উঁকি দিয়ে দেখল, ডারসলেদের গাড়িটি বের হয়ে বাঁক নিয়ে রাস্তায় উঠে যাচ্ছে। পেছনের সিটে আন্ট পেটুনিয়া এবং ডাউলের মাঝখানে ডেডালুসের টুপির উপরের অংশ দেখা যাচ্ছে। প্রাইভেট ড্রাইভের শেষ প্রান্তে গাড়িটা বাঁক নেয়ার সময় শেষ বিকেলের রোদ গাড়ির কাঁচে ঝলক দিয়ে উঠল। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল।
হ্যারি হেডউইগের খাচা, ফায়ারবোল্ট এবং তার পিঠে ঝোলানো ব্যাগটা নিল। তার অস্বাভাবিক ছোট শোয়ার রুমটির দিকে একবার চোখ বুলালো। তারপর বিষণ্ণভাবে নিচের তলায় নেমে এলো। খাঁচা, ব্রুমস্টিক এবং ব্যাগটি সি ড়ির কাছে রাখল। তখন দিনের আলো দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আলোর ছায়ায় ঘর ভরে উঠেছে। এই নিস্তব্ধতার ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে হ্যারির অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। বিশেষ করে যখন তার মনে হলো যে শেষবারের মতো এখান থেকে বিদায় নিচ্ছে। অনেক আগে, যখন ডারসলে পরিবার তাকে একা রেখে বেড়াতে যেত, তখন সে সময়টাতে তার কিছু করার থাকত না। মাঝে মাঝে ফ্রিজ থেকে মজার মজার খাবার বের করে খাওয়া এবং দোতালায় উঠে ডাডলির কম্পিউটার নিয়ে খেলা। অথবা টিভি খুলে প্রিয় অনুষ্ঠানের জন্য চ্যানেল ঘোরাতো।
ওরা বাড়িতে থাকলে এগুলো সে কখোনই করতে পারত না। ওই সময়ের কথা ভেবে একটা অস্বাভাবিক শুন্যতা দেখা দিল হ্যারির। এমন মনে হলো যেন ছোট ভাইকে হারানোর বেদনা তাকে আকুল করছে।
এই জায়গাটিকে তুমি শেষ বারের মতো দেখে নিতে চাও না? সে হেডউগকে জিজ্ঞেস করল। হেডউইগ তখনো মাথা পালকের নিচে গুঁজে দিয়ে গোমড়া হয়ে বসে আছে। ভাবতে পার আমরা আর কখনো এখানে আসব না। তুমি কি এখানকার চমৎকার সময়গুলো একবারও মনে করতে চাও না? দরোজার পাপোষটা দেখো, কিছু মনে পড়ে… ডেমেনটরদের হাত থেকে আমি যখন ডাডলিকে রক্ষা করেছিলাম তখন ও এটার উপর বমি করে দিয়েছিল… চলে যাওয়ার সময় ডাডলি আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে, তুমি কী এটা বিশ্বাস করতে পারো?… এবং গত গ্রীষ্মে ডাম্বলডোর এই দরোজা দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল…
হ্যারি কিছু সময়ের জন্য চিন্তায় হারিয়ে গেল। হেডউইগ হ্যারির চিন্তায় বাধা দিল না, নীরবে পাখার নিচে মুখ গুঁজে রইল। হ্যারি সামনের দরোজার দিক থেকে পেছনের দিকে ফিরল।
আর এই জায়গায় হেডউইগ হ্যারি সিঁড়ির নিচের দরোজাটা টেনে খুলল। এখানেই আমি ঘুমাতাম। সে সময় তুমি আমাকে জানতে না। আহা, এই জায়গাটা যে ছোট সে কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম…
হ্যারি চারদিকে তাকিয়ে জুতো আর ছাতাগুলো দেখল। মনে পড়ল প্রতিদিন সকালে সে কীভাবে ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ির ধাপের দিকে তাকাতো একটা বা দুটো মাকড়শা দেখতে। সেই দিনগুলো ছিল নিজের প্রকৃত পরিচয় জানার আগের সময়। তখনো সে জানত না তার বাবা-মা কীভাবে মারা গেছে, অথবা কেন তার আশে-পাশে এতসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। কিন্তু হ্যারির এখনো মনে আছে যে সে সময়ের স্বপ্নগুলো তাকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। সেই নানা রকম এলোমেলো অস্পষ্ট স্বপ্নগুলোতে সবুজ আলোর আভা ছড়িয়ে থাকত। একবার হ্যারির স্বপ্নে দেখা
একটি উড়ন্ত মটরসাইকেলে এমন একটি বর্ণনা শুনে ভেরনন প্রায় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফিলেছিলেন….
কোথা থেকে হঠাৎ একটি কান ফাটানো বিকট শব্দ ভেসে এলো। হ্যারি মাথা ঝাঁকি দিয়ে সোজা করল এবং নিচু দরোজার ফ্রেমের সঙ্গে মাথা ঠুকে গেল। সে অল্প একটু সময় নিয়ে ভেরননের প্রিয় আপ্ত বাক্যগুলো আওড়ালো। এরপর এলোমেলো পায়ে রান্নাঘরের দিকে ফিরে গেল। মাথাটা চেপে ধরে পেছনের বাগানের দিকে তাকাল।
বাইরের অন্ধকার যেন দুলে দুলে উঠছে। বাতাস কাঁপছে। এরপর একে একে ছায়া অবয়বগুলো শব্দ করে দৃশ্যমান হতে থাকল এবং ধীরে ধীরে আরো স্পষ্ট হলো। দৃশ্যে সর্বপ্রথম দেখা গেল হ্যাগ্রিডকে। তার মাথায় হেলমেট এবং চোখে সানগ্লাস। সে একটি বিশাল মোটরসাইকেলের ওপর বসে আছে। সাইকেলটির সঙ্গে কালো সাইডকার যুক্ত। অন্য সবাই লম্বা ঝাড়ুর ওপর বসে তাকে ঘিরে আছে। এছাড়া ছিল দুটি কঙ্কালের মতো লিকলিকে পাখাওয়ালা ঘোড়া।
ধাক্কা দিয়ে পেছনের দরোজা খুলে হ্যারি দ্রুত ওদের মাঝখানে চলে এলো। হ্যারিকে পেয়ে সকলেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত। হারমিয়ন হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হ্যারিকে জড়িয়ে ধরল। রন ওর পিঠের উপর চাপড় দিল এবং হ্যাগ্রিড বলল, সব ঠিক আছে হ্যারি? এখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুত?
অবশ্যই, হ্যারি বলল। সবার দিকে তাকিয়ে বড় করে হাসল, কিন্তু তোমরা এতজন আসবে এটা একেবারেই আমি আশা করিনি।
পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, ম্যাড-আই গম্ভীরভাবে বলল। তার হাতে বিশাল দুটি ব্যাগ। তার যাদুর চোখ দুটো অন্ধকার আকাশের দিক থেকে শুরু করে ঘর এবং বাগানের দিকে দ্রুত ঘুরছে। চলো তোমার সঙ্গে কথা বলার আগে আমরা ভেতরে যাই।
হ্যারি সবাইকে কিচেনে নিয়ে এলো। কেউ চেয়ারে বসল, কেউ ঝকঝকে মেঝেতে বসল। কেউবা আন্ট পেটুনিয়ার ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসগুলোর সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসি-তামাশা করে গল্প করতে থাকল। রন লম্বা, একহারা গড়নের, হারমিয়নের ঝাকড়া চুলগুলো লম্বা সিল্কের ফিতা দিয়ে পেছনে টেনে বাঁধা। ফ্রেড এবং জর্জ একই রকম করে হাসছে। বিলের গায়ের চামড়ায় ভয়ানক রকমের লাল তিল, মাথায় লম্বা চুল। মি.উইসলির মায়াভরা মুখ, মাথায় টাক। তার চশমাটা চোখের ঠিক জায়গায় নেই। ম্যাড-আই লড়াইয়ে একটা পা হারিয়েছে। তার তীব্র নীল চোখ দুটো কোটরের ভেতর দ্রুত ঘোরাফেরা করছে। টঙ্কের ছোট করে ছাটা চুলের ওপর উজ্জ্বল গোলাপি রং করা যা সে খুবই পছন্দ করে। ফ্লয়ার, একহাড়া গড়নের এবং তার লম্বা সোনালি চুলগুলো খুবই সুন্দর। কিংসলে কালো, মাথায় টাক, চওড়া কাঁধ। হ্যাগ্রিডের মাথায় বন্যচুল এবং মুখভরা দাড়ি। সে বাকা হয়ে দাঁড়িয়েছে যাতে মাথাটা ছাদের সঙ্গে না লাগে। আর মুন্ডুস ছোট খাটো,নোংরা এবং মলিন চেহারা। নিচের দিকে নামানো চোখ দুটো ছোট পাওয়ালা কুকুরের মতো। জট পাকানো চুল। সবাইকে দেখে হ্যারির মনটা আনন্দে ভরে উঠল। সে সবার প্রতি বিশেষ কৃতঙ্গতা অনুভব করল। এমনকি মুন্ডুঙ্গুসের জন্যও, যাকে সে এর আগে একবার গলা টিপে মেরেই ফেলতে চেয়েছিল।
কিংসলে, আমি ভেবেছিলাম তুমি মাগলদের প্রধানমন্ত্রীর দেখাশোনা করছ। রুমের এক প্রান্ত থেকে হ্যারি বলল।
আমাকে ছাড়া তিনি একরাত থাকাত পারবেন, অসুবিধা হবে না, কিংসলে বলল। তুমি বরং এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
হ্যারি, ধারণা কর তো বিষয়টি কি? সে ওয়াশিং মেশিনের উপরে যে জায়গাটিতে বসে আছে সেখান থেকে বাঁ হাতটি একটু বাড়িয়ে বলল, তার হাতের আঙুলে একটি আংটি চকচক করছে।
তুমি বিয়ে করেছ! হ্যারি চোখ বিস্ফারিত করে চিৎকার করে বলে উঠল। সে এখন টংকস এবং লুপিনের দিকে তাকাল।
আমি দুঃখিত হ্যারি যে বিয়েতে তোমার থাকা হয়নি। এটা ছিল একেবারে কোনো অনুষ্ঠানবিহীন।
খুবই ভালো কথা, অভিনন্দন।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, আরো সময় আছে আমরা পরে ঘটা করে একটা আয়োজন করব। সবার গুঞ্জনের মধ্যে মুডি উচ্চস্বরে বলল। কিচেনে একটা নিস্ত ব্ধতা নেমে এলো। মুডি ব্যাগগুলো তার পায়ের উপর ফেলল এবং হ্যারির দিকে ফিরে তাকাল।
সম্ভবত ডেডালুস তোমাকে বলেছে, আমাদেরকে প্ল্যান পরিবর্তন করতে হয়েছে। পিয়াস থিকনেসে আমাদের পক্ষ ত্যাগ করায় আমাদের একটা সমস্যা হয়ে গেছে। সে এই হাউসকে ফুঁ নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য অপরাধ করেছে। ভিতরে-বাইরে সে পোর্টকি ব্যবহার করেছে। এগুলো সে করেছে তোমার নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে, যেন ইউ-নো-হু তোমার ক্ষতি না করতে পারে এই অজুহাতে। তোমার মার রক্ষাকবচ আছে জেনেও এটা করা একেবারেই নিরর্থক। সে আসলে এখান থেকে তোমার নিরাপদে বের হয়ে যাওয়াটা বন্ধ করেছে।
দ্বিতীয় সমস্যা হলো তোমার বয়স এখনো কম, তার মানে তুমি এখনো ট্রেসের নিয়ন্ত্রণাধীন
আমি মনে করি না।
ট্রেস, ট্রেস! অস্থিরভাবে বলল ম্যাড-আই। এটা হলো মন্ত্র যা নাকি সতেরো বছরের কম বয়সীদের যাদু কর্মকাণ্ডকে খুঁজে বের করে। এই কাজটির মাধ্যমেই মন্ত্রণালয় কম বয়সীদের যাদু করা রোধ করে। যাদুর অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য। তুমি বা তোমার আশেপাশের কেউ যদি এখান থেকে যাওয়ার সময় যাদু ব্যবহার করো, সঙ্গে সঙ্গে তা থিকনেসে জেনে যাবে এবং এর মাধ্যমে জেনে যাবে ডেথ ইটাররা।
আবার আমারা ট্রেস ভেঙে যাওয়া সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি না। কারণ যখন ঠিক সতেরো বছরে পা দেবে তখন তুমি তোমার মায়ের দেয়া সব নিরাপত্তা হারাবে। মোটকথা পিয়াস থিকনেসে ভাবছে সে তোমাকে তার নাগালের মধ্যে পেয়েছে।
হ্যারির আর কিছু করার ছিল না, অচেনা থিকনেসের বেড়াজাল মেনে নেয়া ছাড়া।
তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? অসহায় ভাবে হ্যারি জিজ্ঞেস করে।
এখন আমরা এসবের বাইরে অন্য যে সব ট্রান্সপোর্ট আছে সে সব ব্যবহার। করতে পারি। যা ট্রেস খুঁজে বের করতে পারবে না। কারণ ওগুলো ব্যবহার করতে আমাদের কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করতে হবে না। ওগুলো হলো ঝাড়ু, থেস্ট্রালস এবং হ্যাগ্রিডের মোটরবাইক।
হ্যারি এই পরিকল্পনার মধ্যে ফাঁক দেখতে পেল। কিন্তু তারপরও চুপ থাকল। ম্যাড-আইকে সুযোগ দিল বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে।
এখন দুটি শর্তের ওপর তোমার মায়ের মন্ত্র ভেঙে যেতে পারে। যখন তোমার বয়সটা পুরণ হবে, অথবা–মুডি পরিচ্ছন্ন রান্নাঘরটির চারদিকে ইঙ্গিত করল। এই বাড়িটিকে তুমি আর নিজের বাড়ি বলতে পারবে না। আজ রাত থেকেই তুমি এবং তোমার আঙ্কল আর আন্ট আলাদা হয়ে যাচ্ছ। নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে তোমরা আর কখনো এক জায়গায় থাকবে না। ঠিক?
হ্যারি মাথা দোলাল।
সুতরাং তুমি যখন এখান থেকে চলে যাবে তখন আর ফেরা চলবে না। তুমি রেঞ্জের বাইরে চলে গেলে মন্ত্র আর কোনো কাজ করবে না। আমরা চাই এটা তাড়াড়াড়ি ভেঙে তোমাকে বিকল্প নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে। সতেরো বছর বয়স হওয়া মাত্রই ইউ-নো-হু তোমাকে আক্রমণ করতে চলে আসবে।
আমাদের সূত্র থেকে একটা বিষয় জানতে পেরেছি তা হলো ইউ-নো-হু জানে যে আমরা আগেভাগেই তোমাকে আজ সরিয়ে নিচ্ছি। আর আমরা মিনিস্ট্রিতে ভুল তথ্য প্রচার করেছি যে তুমি তিরিশ তারিখের আগে এখান থেকে যাচ্ছ না। তা সত্ত্বেও আমরা আরো নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছি। শুধুমাত্র ভুল তারিখের ওপর নির্ভর করে থাকছি না। কে জানে সে এই অঞ্চলের আকাশে কয়েকটি ডেথ-ইটার পাঠিয়ে দিয়ে থাকতে পারে পাহাড়া দিতে। এমন হতে পারেই। তাই আমরা এক ডজন আলাদা আলাদা বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছি এই কারণে। আমরা তোমাকে যেখানে লুকাতে পারি সে স্থানগুলো দেখতে সব একই রকম। সে সব বাড়িগুলোর সবগুলোর সঙ্গে অর্ডারের একটি যোগাযোগ আছে। আমার বাড়ি, কিংসলের স্থান, মলির আন্ট মুরিয়েলসের বাড়ি–তুমি বুঝতে পেরেছ নিশ্চই?
উম-হা, হ্যারি বলল। কিন্তু পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ সে পরিকল্পনার ভেতর এখনো ফাঁক দেখতে পাচ্ছে।
তোমাকে ওই বাড়িতে নিরাপত্তা মন্ত্রে সুরক্ষিত রাখা হবে, আর সেখানে লুকানো জায়গায় তুমি পোর্টকি ব্যবহারের সুযোগ পাবে। আর কোনো প্রশ্ন?
এহ… হ্যাঁ হ্যারি বলল। প্রথমে হয়তো তারা বারোটি নিরাপদ বাড়ির কোনটি তে যাচ্ছি তা বুঝতে পারবে না, কিন্তু এটা কি তারা পরে বের করতে পারবে না- সে দ্রুত উপস্থিত মুখগুলো একবার দেখল–যখন আমাদের চৌদ্দজন টঙ্কের বাবা-মায়ের বাড়ির দিকে যাবে?
আহ, মুডি বলল। আমি মূল পয়েন্টটা বলতে ভুলে গেছি। আমরা চৌদ্দজনই টঙ্কের বাবা-মায়ের বাড়ির দিকে উড়ে যাব না। আজ রাতে সাতটি হ্যারি পটার আকাশে উড়ে যাবে। প্রত্যেকের সঙ্গে একজন করে সঙ্গী থাকবে। প্রতিটি জোড়া একটি করে নিরাপদ বাড়ির দিকে যাবে।
আলখাল্লার ভেতর থেকে মুডি এবার একটি বোতল বের করল। দেখতে কাদার মতো। তাকে আর মুখে কোনো কথা বলতে হলো না। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনার বাকি বিষয়টুকু বুঝে ফেলল।
না!, সে উচ্চস্বরে বলল। তার গলার আওয়াজ পুরো কিচেনে ঘুরপাক খেল। কোনো মতেই না!
আমি আগেই ভেবেছিলমি, তাদেরকে বলেছিও তুমি বিষয়টি এভাবেই নেবে, হারমিয়ন বলল। তার ভেতরে একটি স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল এই ভেবে যে ওর কথাটাই ঠিক হলো। হ্যারি কখনোই নিজের জন্য অন্যকে বিপদে ফেলতে চাইবে না।
তোমরা কি মনে করো, আমি আরো ছয় জনের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারি।
এই কারণে যে আমাদের সবার জন্য এটা প্রথম অভিজ্ঞতা, রন বলল।
এটা নয়, আমার রূপ ধারণ করে বিপদের ঝুঁকিতে পরা আর এক কথা-
তোমার কথা বুঝেছি, আমরা কেউ বিষয়টিকে হালকা করে দেখছি না হ্যারি, সাগ্রহে ফ্রেড বলল। ভেবে দেখো, তোমার যদি বিপদ ঘটে যায় তাহলে চির জীবনের জন্য আমাদের গ্লানি থেকে যাবে।
হ্যারি হাসতে পারল না।
আমাকে ছাড়া এ কাজ তোমরা করতে পারবে না, এটা তো জানো। চুলের জন্য তোমাদের আমার দরকার হবেই।
এর মানে হলো এই পরিকল্পনা ঝেড়ে ফেলা, জর্জ বলল। তুমি না চাইলে তোমার চুল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই আমাদের নেই।
আমরা তেরোজন যা চাই, তার বিরুদ্ধে একজন যে আমাদেরকে যাদু ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। তাহলে আমাদের কোনো সুযোগই নেই। ফ্রেড বলল।
ফানি, হ্যারি বলল। সত্যিই মজার ব্যাপার।
যদি জোর করা যায় তাহলে হবে, মুডি ক্ষুব্ধস্বরে বলল। তার যাদুর চোখ দুটো কোটরের ভিতরে কেঁপে উঠল। সে হ্যারির দিকে তাকাল। এখানে সবারই পরিণত বয়স হয়েছে পটার, তারা প্রত্যেকেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত।
মুন্ডুঙ্গুস বিরক্তির ভাব নিয়ে মাথা দোলালো। তার যাদুর চোখ দুটো ঘুরিয়ে চারদিকে দেখল। তারপর মুডির মাথার ওপর দিয়ে হ্যারির দিকে তাকাল।
এখন আর কোনো বিতর্ক নয়। সময় বয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার সামান্য কিছু চুল চাই এবং এখন।
কিন্তু এটা পাগলামি, এর কোনো প্রয়োজন নেই
কোনো প্রয়োজন নেই! রাগতস্বরে মুডি বলল। সেখানে ইউ-নো-হু আছে এবং তার সঙ্গে আছে অর্ধেক মন্ত্রণালয়। পটার, আমাদের ভাগ্য যদি ভালো হয় তাহলে সে টোপ গিলবে এবং তিরিশ তারিখে তোমাকে আক্রমণের পরিকল্পনা করবে, কিন্তু সে যদি পাগল না হয়ে থাকে তা হলে চোখ রাখার জন্য একটা বা দুটো ডেথ ইটার পাহারায় বসাবেই, আমি হলে তাই করতাম। তোমার কাছে তারা আসতে পারেনি কারণ এই বাড়ি তোমার মায়ের মন্ত্র দ্বারা বেষ্টিত। কিন্তু এখন সেটা ভেঙে যাওয়ার পথে এবং এলাকার অবস্থা সম্পর্কে তারা মোটামুটি জানে। আমাদের একমাত্র সুযোগ হলো ওদের ধোকা দিতে চেষ্টা করা। এমনকি ইউ-নো -হুঁ সাতটি অংশে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে না। হ্যারির চোখ হারমিয়নের চোখে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যদিকে তাকাল।
দেখ পটার, তোমার কিছু চুল, যদি তুমি দয়া করে দাও।
হ্যারি রনের দিকে তাকাল। রন কটকট করে তার দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত দিল দিয়ে দাওয়ার জন্য।
এখন! মুডি চিৎকার করে বলল।
সবার চোখ তখন হ্যারির দিকে। হ্যারি মাথার উপর হাত রেখে কোঁকড়ানো চুল টান দিয়ে তুলল।
গুড, মুডি বলল। ফ্লাস্কের মুখ টেনে খুলতে খুলতে বলল, ঠিক এর ভিতরে, যদি দয়া করো।
হ্যারি চুলগুলো কাদার মতো দেখতে তরল পদার্থের মধ্যে ফেলল। কাদার মতো তরল পদার্থের সংশ্রবে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ফোমের মত বুদ্বুদ আকার ধারণ করে থোয়ায় পরিণত হলো। একই সঙ্গে উজ্জ্বল সোনালি রঙ ধারণ করল।
উহ, তোমাকে এখন ক্র্যাবল এবং গয়েলের চেয়ে অনেক বেশি মজার দেখাচ্ছে হ্যারি। হারমিয়ন বলল। সঙ্গে সঙ্গে রনের ভুরু তোলাটা দেখল। লজ্জায় একটু লাল হয়ে সে আবার বলল, ওহ! তুমি বুঝতে পেরেছে আমি কী বলতে চেয়েছি, মানে গয়েলের পোশন দেখতে অনেকটা কাদার মতো।
তাহলে এখন, নকল পটাররা দয়া করে লাইন ধরে দাঁড়াও। মুডি বলল।
রন, হারমিয়ন, ফ্রেড, জর্জ এবং ফ্লয়ার লাইন ধরে দাঁড়াল পেটুনিয়া আন্টের ঝকঝকে বেসিনের সামনে।
আমাদের একজন কম, লুপিন বলল।
এই যে, অকস্মাৎ বলে উঠল হ্যাগ্রিড। সে মুন্ডুঙ্গুসকে তার ঘাড়ের কাছে ধরে উঁচু করে এনে ফ্লয়ারের কাছাকাছি ধপাস করে ফেলল। ফ্লয়ার নাক চুলকাতে চুলকাতে ফ্রেড এবং জর্জের মাঝখানে চলে এলো।
আমার কাছে টোল্ডজার আছে, আমি শীঘ্রই প্রোটেক্টর হতে পারি। মুন্ডুঙ্গুস বলল।
এসব বন্ধ করো, মুডি বলল। আমি ইতিমধ্যেই তোমাদের বলেছি আমাদের যাওয়ার পথে যদি ডেথ-ইটার থাকতে পারে, তারা চাইবে হ্যারিকে ধরতে, কিন্তু তাকে তারা নিজেরাই হত্যা করবে না। ডাম্বলডোর সব সময় বলতেন যে ইউ-নো -হুঁ পটারকে নিজের হাতে হত্যা করতে চায়। কিন্তু যারা তাকে নিরাপত্তা দেবে তাদেরই সবচেয়ে বড় ভয়, ডেথ-ইটাররা বরং তাদেরকেই হত্যা করতে চাইবে।
মুন্ডুঙ্গুসকে বিশেষ করে খুব একটা স্বস্তি পেল বলে মনে হলো না, কিন্তু মুডি আধা ডজন ডিমের আকারের গ্লাস বের করল তার আলখাল্লার ভেতর থেকে। সবার হাতে সেগুলো দিয়ে একটু একটু করে পোশন ঢালল প্রত্যেকটিতে।
সবাই একসঙ্গে, তারপর…
রন, হারমিয়ন, ফ্রেড, জর্জ, ফ্লয়ার এবং মুন্ডুঙ্গুস একতালে পান করল। পোশন গলায় ধরার কারণে সবাই মুখ বিকৃত করল এবং তার হেঁচকি উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ওদের কিছু কিছু শারিরীক বৈশিষ্ট পাল্টে গিয়ে তেলতেলে পিচ্ছিল ভাব এলো। হারমিয়ন এবং মুন্ডুস সাইজে কিছুটা বড় হয়ে গেল। আর রন ফ্রেড এবং জর্জ কিছুটা খাটো হলো। ওদের চুলগুলো কালো হয়ে গেল। হারমিয়ন এবং ফ্লয়ারের মনে হলো শরীরের বাড়ন্ত অংশ মাথার খুলির ভিতরের দিকে চলে এলো।
মুভিকে দেখা গেল পুরোপুরি নিরুত্তাপ। সে তার সঙ্গে করে আনা বড় ব্যাগটির মুখ খুলছিল। যখন সে সোজা হয়ে দাঁড়াল তখন দেখল ছয়টি হ্যারি পটার তার সামনে জোরে জোরে এবং ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
ফ্রেড এবং জর্জ দুজন দুজনের দিকে ফিরে একই সঙ্গে বলল, ও! আমরা এখন হুবহু এক রকম!
যদিও আমি নিজেকে এখন দেখিনি, কিন্তু আমার মনে হয় আমি দেখতে বেশি ভালো। ফ্রেড চকচকে কেতলির ওপর নিজেকে দেখতে চেষ্টা করে বলল।
এহ্, মাইক্রোওয়েভের ডালায় নিজেকে দেখে ফ্লয়ার বলল, বিল, আমার দিকে তাকাবে না। আমি এখন অন্যরকম।
যাদের পোশাক একটু ঢিলেঢালা হয়ে গেছে তাদের জন্য এখানে ছোট কাপড় আছে, মুডি তার ব্যাগটির দিকে নির্দেশ করে বলল। এবং একই রকমভাবে উল্টোটাও আছে। চশমার কথা ভুলো না। এখানে ব্যাগের সাইড পকেটে ছয় জোড়া চশমা আছে। তোমাদের পোশাক পড়া হলে দেখবে অন্য ব্যাগটার ভিতরে লাগেজ আছে।
আসল হ্যারি ভাবল, সে জীবনে অনেক চরম অস্বাভাবিক ঘটনা দেখেছে, কিন্তু এটা হবে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে অদ্ভুত ঘটনা। সে দেখল তার নকল ছয়জন পটার বড় ব্যাগের ভেতরে হাতাহাতি করছে। কাপড় বের করছে, চশমা বের করে পড়ছে, কেউবা নিজের জিনিসগুলো আলাদা করে রাখছে। হ্যারির মনে হলো ওদেরকে বলা দরকার তার নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি সবার ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকা উচিত। কারণ ওরা সবাই নির্দ্বিধায় জামাকাপড় খুলতে শুরু করেছে। ওরা হ্যারির শরীর ধারণ করায় অনেক সহজে কাপড় খুলতে পারছে, নিজেদের শরীর হলে এতটা সহজ হতে পারত না।
আমি জানতাম গিন্নি ওই টাটু নিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে, রন নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে বলল।
হ্যারি, তোমার চোখের দৃষ্টিটা ভারি খারাপ, হারমিয়ন চশমা পড়তে পড়তে –বলল।
পোশাক পড়ার পর নকল হ্যারিরা পিঠে ঝোলানো ছোট ব্যাগ নিল। বড় ব্যাগটি থেকে একটা করে পেচার খাঁচা নিল। ভেতরে একটি করে মোটাতাজা বরফের মতো সাদা পেঁচা।
গুড, চশমা পরিহিত, কাঁধে ব্যাগের বোঝা নিয়ে প্রস্তুত সব কজন হ্যারিকে দেখে মুডি বলল। প্রতিটি জোড়া হবে এরকম, মুন্ডুঙ্গুস যাবে আমার সঙ্গে, আমরা ব্রুমে যাব।
আমি তোমার সঙ্গে কেন? পেছনের দরোজার কাছাকাছি থেকে ওই হ্যারিটা বলল।
কারণ তুমিই একমাত্র যাকে লক্ষ্য রাখা দরকার। গম্ভীরভাবে মুডি বলল। এটা নিশ্চিত যে তার যাদুর চোখ মুভুক্ষুসের থেকে সরেনি। সে বলতে থাকল, আর্থার এবং ফ্রেড-
আমি জর্জ, মুডি যে দুজনকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছিল তাদের একজন বলল। আমরা হ্যারি হওয়ার পর তুমি আমাদের আলাদা করে বলতে পারছ না?
দুঃখিত জর্জ
আমি শুধু তোমার যাদু কাঠিটা ঝাঁকি দিলাম, আমি আসলে ফ্রেড
অনেক ঝামেলা হচ্ছে! ধমকের সুরে মুডি বলল। অন্যজন, জর্জ বা ফ্রেড বা যেই হও তুমি যাবে রেমুসের সঙ্গে। মিস ডেলাকুর
আমি ফ্লয়ারকে থেস্ট্রালে করে নিচ্ছি, বিল বলল। সে ব্রুম অতটা পছন্দ করে না।
ফ্লয়ার হেঁটে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এমন বিনয় ও মমতার সঙ্গে তাকাল যে হ্যারির অন্তরের ভেতর থেকে আশা করল সে যেন আর নিজের মুখটি ফিরে না পায়।
মিস গ্র্যাঞ্জার যাবে কিংসলের সঙ্গে, ওরাও থ্রেস্টালে
কিংসলের হাসির উত্তর দেয়ার সময় হারমিয়নকে বেশ স্বস্তিতে দেখা গেল। হ্যারি জানে যে হারমিয়নও ব্রুমস্টিক খুব একটা পছন্দ করে না।
এখন তুমি আর আমি বাকী, রন! টঙ্কস আনন্দের সঙ্গে বলল। সে রনের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে পাশের মাটির একটি গাছে ধাক্কা খেল।
রনকে হারমিয়নের মতো অতটা শান্ত দেখাচ্ছে না।
আর তুমি আমার সঙ্গে হ্যারি, এটা ঠিক আছে? হ্যাগ্রিড বলল। তাকে একটু একটু উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছে। আমরা বাইকে চড়ে যাব, ব্রুম অথবা প্রেস্ট্রাল আমার ভার বইতে পারবে না। বাইকের সিটে ওপর জায়গা নেই, সুতরাং তুমি বসবে বাইকের সাইডকার-এ।
ওহ! তাহলে তো ভালোই! হ্যারি বলল। কিন্তু তার বলাটা পুরোপুরি সত্য না।
আমাদের ধারণা ডেথ ইটাররা তোমাকে একটি ব্রুমে আশা করবে, মুডি বলল। সে হ্যারির অনুভূতিটা ধরতে চেষ্টা করছে। স্নেইপ অনেক সময় পেয়েছে। তোমার সম্পর্কে বিস্তারিত তাদেরকে বলার জন্য, যা সে এর আগে বলতে পারেনি। সুতরাং আমরা যদি ডেথ ইটারদের মধ্য দিয়ে যাই তাহলে আসল হ্যারি হিসাবে তাকেই বেছে নেবে যে ব্রুমস্টিকে করে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। তাহলে ঠিক আছে সব, সে নকল হ্যারিদের জামা কাপড় বড় ব্যাগে ঢুকিয়ে বাঁধল এবং দরোজার দিকে যেতে যেতে বলল। আমরা এখান থেকে রওয়ানা হব ঠিক তিন মিনিট পর। দরোজা বন্ধ করে যাওয়ার কোনো অর্থ নেই, ডেথ ইটাররা যখন আসবে তখন বন্ধ দরোজা তাদের আটকাতে পারবে না… এসো…।
হ্যারি দ্রুত হলে ফিরে গেল তার পিঠে নেয়ার ব্যাগটি, ফায়ারবোল্ট এবং হেডউইগের খাঁচা আনতে। তারপর পেছনের অন্ধকার বাগানে অন্য সবার কাছে চলে এলো। চারদিকে ব্রুমস্টিকগুলো সবার হাতে লাফাচ্ছে। হারমিয়ন ইতিমধ্যেই কিংসলের সঙ্গে চমৎকার কালো থেস্ট্রালে উঠেছে। ফ্লয়ার বিলের সঙ্গে আরেকটিতে। হ্যাগ্রিড তার মটরবাইকের পাশে প্রস্তুত হয়ে আছে। তার চোখে সানগ্লাস।
এটাই সেটা, এটাই সাইরাসের বাইকটা?
একই রকম, হ্যাগ্রিড হ্যারির দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল। এবং শেষবার তুমি এটাতেই চড়েছিলে। আমার একহাতের জন্য এটা উপযুক্ত!
হ্যারি বাইকের সাইডকারে গিয়ে বসল। সে নিজে একটু অপমানিত বোধ করলেও কিছুই করার রইল না। এর ফলে অন্য সবার চেয়ে হ্যারি কয়েক ফুট নিচে রইল। রন তার পাশ থেকে গর্বের হাসি দিল ঠিক একটা বাচ্চা যেমন গাড়ির বাম্পারে বসে গর্বের হাসি দেয়। হ্যারি তার মস্টিক এবং ব্যাগটি পায়ের কাছে নামিয়ে রাখল। আর হেডউইগের খাঁচাটি দু হাঁটুর মাঝে চেপে ধরে রাখল। তার জন্য একেবারে চরম অস্বস্তিকর অবস্থা।
আর্থার একটুআধটু মেরামতের কাজ করেছে, হ্যারির অস্বস্তির দিকে কোনো লক্ষ্য না করেই হ্যাগ্রিড বলল। সে মটর বাইকের ওপর আসন নিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলটি তার ভারে সামান্য কয়েক ইঞ্চি মাটির দিকে দেবে গেল। এখন এটির হাতলে কয়েকটি ভালো কৌশল আছে। এটা ছিল আমার আইডিয়া।
সে তার মোটা আঙুল দিয়ে স্পিডমিটারের কাছে লাল একটা বোম দেখালো।
প্লিজ মি. হ্যাগ্রিড, সাবধান থাকবেন, ওদের পাশে দাঁড়ানো মি. উইসলি বলল। সে তার হাতে নিজের ব্রুমস্টিকটা ধরে আছে। আমার এখনো মনে হয় না যে এটার প্রয়োজন আছে। এটা শুধুমাত্র ইমার্জেন্সিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তাহলে ঠিক আছে সব, মুডি বলল। সবাই দয়া করে প্রস্তুত হও। আমি চাই আমরা সবাই একসঙ্গে রওয়ানা, অথবা মুখ্য সময়গুলোতে আমরা একসঙ্গে থাকব।
সবাই যার যার ব্রুম উঁচু করে ধরল।
শক্ত করে ধরো রন, টঙ্কস বলল। হ্যারি দেখল, রন টঙ্কসের কোমরের দু পাশে হাত রাখতে রাখতে লুপেনের দিকে একটি দুষ্টামি ও লজ্জার চাহনি দিল। হ্যাগ্রিড কিক দিয়ে মটর বাইকটা চালু করল। সঙ্গে সঙ্গে বাইকটা ড্রাগনের মতো গর্জন করতে থাকল আর সাইডকারটি থর থর করে কাঁপতে শুরু করল।
গুড লাক এভরিবডি, মুডি বলল। তোমাদের সবার সঙ্গে বারোওতে দেখা হবে। তিন গোনার পর। এক… দুই… তিন
মটর বাইক থেকে বিকট গর্জন হলো এবং হ্যারির মনে হলো সাইডকারটি বিশ্রীভাবে ঝাঁকি খাচ্ছে। সে বাতাসের ভেতর দিয়ে দ্রুত উপরে উঠে যাচ্ছে। চোখের কোনো দিয়ে সামান্য পানি বের হয়ে আসল। গতির কারণে চুলগুলো পিছনের দিকে উড়ছে। তাকে ঘিরে ব্রুমগুলো নিয়ে বাকিরা উপরের দিকে উঠছে। থেস্ট্রালের লম্বা কালো লেজ সুরুত করে সামনে চলে গেল। হ্যারির দুপা এতক্ষণ সাইডকারে হেডউইগের খাঁচা এবং ব্যাগের সঙ্গে লেগে ছিল। এতক্ষণ ব্যাথা অনুভূত হচ্ছিল কিন্তু এবার পায়ে ফোস্কা পড়তে শুরু করেছে। একটাই অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিল সে যে চার নম্বর প্রাইভেট ড্রাইভ এক ঝলক দেখে নিতেও ভুলে গেল। সে সাইডকারের ওপর থেকে যখন নিচে তাকানোর সুযোগ পেল, কিন্তু বলতে পারবে না যে সেটা কোন স্থান। তারা আকাশে উঁচু থেকে আরো উঁচুতে উঠে গেল
ঠিক তখনই কোনো দিক থেকে নয়, কোনো কিছুর থেকে নয়, অকস্মাৎ তাদেরকে ঘিরে ফেলা হলো। অন্তত তিরিশটা মাথা ঢাকা শরীর শূন্য আকাশে একটি বিশাল বৃত্ত রচনা করল অর্ডার সদস্যদের উঠে আসার জায়গা ঘিরে।
চিৎকারের শব্দ, চারদিক থেকে সবুজ আলো জ্বলে উঠল। হ্যাগ্রিড উচ্চস্বরে শব্দ করল এবং মটরবাইক জোরে টান দিল। হ্যারি জানে না সে কোথায়। তার মাথার উপর তখন রাস্তার বাতির আলো। আশেপাশে চিৎকারের শব্দ। সে প্রিয় জীবনের মায়ায় শক্ত করে সাইডকারটি আঁকড়ে ধরে আছে। হেডউইগের খাঁচা, ছোট ব্যাগটি এবং ফায়ারবোল্ট পিছলে হাঁটুর নিচ থেকে সরে গেছে
না, হেডউইগ!
ব্রুমস্টিকটি নিচে পড়ে ভনভন করে ঘুড়ছে। মটরবাইকটি আবার ডান দিকে বাক নিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলে সে কোনোক্রমে ব্যাগটির ফিতা এবং খাঁচার উপরের অংশ টেনে ধরল। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে আবার তীব্র সবুজ আলো ঝলকে উঠল। পেঁচাটি ডেকে উঠল এবং খাঁচার ভেতর পড়ে গেল।
না! না!
মটরবাইক আবার দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেল। হ্যারি পলকের মধ্যে দেখল হ্যাগ্রিড বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ায় ডেথ-ইটারগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে।
হেডউইগ! হেডউইগ!
কিন্তু পেঁচাটি নিথর হয়ে পড়ে আছে খাঁচার ভেতর, যেন একটা খেলনা। সে ডেউগের বিষয়টি মানতে পারছে না। এবং অন্যদের জন্য তার উদ্বেগ আরো বেড়ে চলেছে। সে কাধের উপর দিয়ে সবুজ আলোর ঝলকের ভেতর দেখতে পেল অনেক মানুষ চলাফেরা করছে। দেখল ক্ৰমে করে দুই জোড়া লোক উড়ে দূরে একথাও চলে যাচ্ছে। কিন্তু সে বুঝতে পারল না ওরা দুজন কারা —
হ্যাগ্রিড, আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে! ফিরে যেতে হবে! ইঞ্জিনের বিকট শপের ভেতর হ্যারি চিৎকার করে বলল। নিজের যাদুর কাঠিটা টেনে বের করল। সেটা দিয়ে হেডউইগের খাঁচাটিতে ঢুকিয়ে তুলে নিল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে হেডউইগ মৃত। হ্যাগ্রিড ঘুরে যাও!
আমার কাজ হলো তোমাকে নিরাপদ করা হ্যারি! সে হ্যারির উদ্দেশে চিৎকার করে বলল এবং মটর বাইকের থ্রটল টেনে ধরল।
থামো! থামো! হ্যারি উচ্চস্বরে বলল। কিন্তু সে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখল দুই খন্ড সবুজ আলো। তার বাম পাশের কানের কাছ দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। চারটি ডেথ ইটার বৃত্ত ভেঙে তাদের পিছু নিয়েছে। ওরা হ্যাগ্রিডের চওড়া শরীরের পেছনের দিকটাকে টার্গেট করেছে। হ্যাগ্রিড আচমকা দিক পরিবর্তন করল। কিন্তু ডেথ-ইটারগুলো পিছু ছাড়ল না। তাদের আরো কাছে চলে এলো। হ্যারিকে মাথা নিচু করতে হলো ওদের সঙ্গে সংঘর্ষ যাতে না হয়। হ্যারি শরীর মোচড় দিয়ে চিৎকার করে বলল,স্টুপিফাই! তার যাদুর ছড়ি থেকে এটা লাল আলো বের হয়ে ছুটে গেল ডেথ ইটারদের দিকে। পেছনে ধাওয়া করা চার ডেথ ইটার দ্রুত সরে গেল যাতে গায়ে না লাগে। সেই ফাঁক গলে আলোটা বেরিয়ে গেল।
শক্ত করে ধরো, হ্যারি! এবার এটা ওদের বিরুদ্ধে কাজ হবে, হ্যাগ্রিড গর্জন করে বলল। হ্যারি মাথা তুলে তাকাতেই দেখল হ্যাগ্রিড মোটা আঙুল দিয়ে একটি সবুজ বোতামে চাপ দিচ্ছে। এক্সজস্ট পাইপ থেকে পরিষ্কারভাবে একটি ইটের দেয়াল বের হয়ে আসল। গলা পর্যন্ত ওঠার পর হ্যারি দেখল সেগুলো শূন্যে ছড়িয়ে পড়ল। তিনটি ডেথ-ইটার আঘাত থেকে সরে গেল। কিন্তু চতুর্থটির ভাগ্য ভালো ছিল না, সে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল এবং ধপাস করে একটা বোল্ডারের মতো পড়ে গেল। তার ব্রুমস্টিকটি কয়েক টুকরা হয়ে গেল। সহযোগী এক ডেথ-ইটার তাকে রক্ষা করতে গতি কমিয়েছিল। কিন্তু হ্যাগ্রিড তার গতি বাড়ানোর জন্য হ্যান্ডেলের ওপর ভর দিতেই ইটের দেয়াল ধোয়ার মাঝে ঢেকে গেল।
বাকী দুই ডেথ-ইটারের যাদু কাঠি থেকে হত্যা করার মতো মন্ত্র হ্যারির মাথার কাছ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ওরা হ্যাগ্রিডকে লক্ষ্য করে ওগুলো ছুড়ছে। হ্যারি নিজের যাদু কাঠি থেকে অন্য আরেকটি স্পেল ছুঁড়ে দিল। মধ্যপথে লাল আর সবুজে সংঘর্ষ হল। চারদিকে বহু রঙ হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ল। হ্যারির আতশবাজি ছোঁড়ার কথা মনে হলো। নিচের সাধারণ মানুষ যাদের কোনো ধারণা নেই কি হচ্ছে তাদের কথাও মনে হলো
আবারো হ্যারি, শক্ত করে ধরো! উচ্চস্বরে হ্যাগ্রিড বলল। সে আরেকটি বোতামে চাপ দিল। এবার পাইপ দিয়ে একটি বিশাল জাল বের হয়ে আসল। কিন্তু ডেথ ইটাররা সে জন্য প্রস্তুত ছিল। তারা যে শুধু জাল থেকে সরে গেল তাই নয়, যে সহযোগীটি অজ্ঞান বন্ধুকে সাহায্য করতে পিছিয়ে পড়েছিল সে ওটা ধরে ফেলল। সে হঠাৎ অন্ধকারের ভেতর থেকে আবির্ভূত হলো। এবার তিনজনই মটরবাইকের পেছনে ধাওয়া করল। তিনজনই তাদের কার্স ছুঁড়তে থাকল।
এবার কাজ হবে, হ্যারি, শক্ত করে ধরো! হ্যাগ্রিড চিৎকার করে বলল। হ্যারি দেখল সে স্পিডমিটারের পাশে একটি রঙীন বাটনের উপর জোরে চাপ দিল।
সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড গর্জনে ড্রাগন ফায়ার বের হয়ে এলো এক্সজস্ট পাইপের ভেতর থেকে। সেগুলো প্রচণ্ড উত্তপ্ত এবং নীল রঙের। ধাতব একটি ঘর্ষণের শব্দের সঙ্গে মটরবাইকটি বুলেট ছোঁড়ার মতো সামনে এগিয়ে গেল। হ্যারি দেখল এই ভয়ানক ধোয়া থেকে রক্ষা পেতে ডেথ ইটাররা চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। একই সঙ্গে লক্ষ্য করল সাইডকারটি বিপজ্জনকভাবে দুলছে। দ্রুত গতির ফলে মটরবাইকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে এর ধাতব সংযোগ প্রায় টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
এখন সব ঠিক আছে হ্যারি, চিৎকার করে হ্যাগ্রিড বলল। এবার গতির কারণে তার পিঠ টানটান করল। এখন কেউ বাইকটা চালাচ্ছে না। বাইকের সংযুক্ত অংশের সঙ্গে সাইডকারটা ভয়ানক ভাবে ঝাঁকি খেতে শুরু করেছে।
আমি বাইকের ওপর আছি হ্যারি, ভয় নেই, হ্যাগ্রিড উচ্চস্বরে বলল। তার জ্যাকেটের পকেট থেকে সে গোলাপি রঙের ছাতাটা টেনে বের করল।
হ্যাগ্রিড! না! আমাকে দাও!
রিপারো!
একটা কান ফাটানো শব্দ হলো। এবং সাইডকারটা বাইক থেকে পুরোপুরি খসে গেল।
হ্যারি তীব্র গতিতে সামনের দিকে চলে গেল বাইকের গতি থেকে গতি পাওয়ার কারণে। তারপর সাইডকারটি ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করল
অস্থির হয়ে হ্যারি তার যাদুর কাঠিটা সাইডকারের দিকে তাক করে বলল, উইনগার্ডিয়াম লেভিওসা!
বোতলের ছিপির মতো এবার সাইডকারটি উপরে উঠতে শুরু করল। দিক পরিবর্তন করা যাচ্ছে না, কিন্তু অন্তত পক্ষে বাতাসে ভেসে রইল। সেকেন্ডের কয়েক ভাগের একভাগ পরই ডেথ ইটারদের কার্স তাকে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে গেল। ডেথ ইটার তিনটি অনেক কাছে চলে এসেছে।
আমি আসছি হ্যারি! হ্যাগ্রিড অন্ধকারের ভেতর থেকে উচ্চস্বরে বলে উঠল। কিন্তু হ্যারি বুঝতে পারল যে সাইডকারটি আবার তলের দিকে নেমে যাচ্ছে। যতটা সব ঝুঁকে পড়ে হ্যারি এগিয়ে আসা অবয়বগুলোর দিকে যাদুকাঠি তাক করল এবং উচ্চস্বরে বলল, ইমপেডিমেনতা!
কার্সটি মাঝখানের ডেথ ইটারের ঠিক বুকের উপর লাগল। এক মুহূর্তের জন্য সে ঈগলের মতো নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে আকাশে রইল এবং তারপর একটি অদৃশ্য বাধার উপর আছড়ে পড়ল। তার সহযোগী একজনের সঙ্গে প্রায় তার ধাক্কা লেগে গিয়েছিল।
সত্যি সত্যি সাইডকারটি পড়তে শুরু করল। অন্য ডেথ-ইটাররা হ্যারির দিকে এত কাছ থেকে কার্স ছুঁড়তে থাকল যে তাকে একেবারে সাইডকারের প্রান্ত পর্যন্ত নিচু হতে হলো। তো লেগে একটি দাঁত ভেঙে সিটের কাছে পড়ল।
আমি আসছি! হ্যারি আমি আসছি!
একটি বিশাল হাত হ্যারিকে তুলে নিল পতনোম্মুখ সাইডকার থেকে। মটর বাইক সিটে বসার আগেই হ্যারি সাইডকার থেকে নিজের ব্যাগটি ধরে ফেলল। নিজেকে আবিষ্কার করল হ্যাগ্রিডের পিঠের সঙ্গে মিশে বসে আছে। ওরা ডেথ-ইটার দুটো থেকে অনেক উপরে উঠে গেল। হ্যারির মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। সে পড়ে যেতে থাকা সাইডকারটির দিকে যাদুর কাঠিটা তাক করে উচ্চস্বরে বলল,কনফ্রিঙগো!
সে জানে যখন বিস্ফোরণ হবে তখন হেডউইগের জন্য মারাত্মক যন্ত্রণাদায়ক হবে। সাইডকারের কাছাকাছি ডেথ ইটারের ব্রুমটি ফেটে গেল এবং দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার সঙ্গী ডেথ-ইটারটি পিছনে চলে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হ্যারি, আমি দুঃখিত, খুবই দুঃখিত অনুশেচনার সঙ্গে হ্যাগ্রিড বলল। আমার নিজের এটা মেরামত করতে চেষ্টা করা উচিত হয়নি। এখন তোমার বসার জায়গার অসুবিধা হচ্ছে
কোনো সমস্যা নেই, তুমি চলতে থাক। হ্যারি উচ্চস্বরে বলল। ঠিক তখনই দেখা গেল দুটো ডেথ-ইটার আবার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওদের কাছাকাছি চলে আসছে।
আবার দুপক্ষের মধ্যে কার্স ছোঁড়া শুরু হতেই হ্যাগ্রিড এঁকেবেঁকে, উল্টো পথ নিল। হ্যারি জানে যে সে খুবই ঝুঁকির মধ্যে বসে আছে, সুতরাং হ্যাগ্রিড ড্রাগন ফায়ার ব্যবহার করবে না। হ্যারি ওদের পিছু নেয়া ডেথ ইটারদের দিকে একটার পর একটা স্টানিং স্পেল ছুঁড়ে দিচ্ছে। সে আরো একটি কার্স ছুঁড়ে দিতেই কাছের ডেথ-ইটারটি দ্রুত সরে যেতে চেষ্টা করল এবং তার মাথা ঢেকে রাখা কাপড়টা মাথা থেকে সরে গেল! হ্যারি দেখল স্ট্যানলি শানপাইকের অদ্ভুত ভাবলেশহীন চেহারাটা… স্ট্যান
এক্সপেলিয়ারমাস! হ্যারি চিৎকার করে বলল।
এটাই ও! এটাই আসল হ্যারি!
মাথা ঢাকা ডেথ-ইটারটি চিৎকার করে বলল। মটরবাইকের ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে হ্যারির কানে এলো। পর মুহূর্তে পিছু ধাওয়াকারী দুই ডেথ ইটার পেছনে পড়ে গেল এবং চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হ্যারি, কী হয়েছে? হ্যাগ্রিড উচ্চস্বরে জানতে চাইল। ওরা কোথায় গেল?
আমি বুঝতে পারছি না!
কিন্তু হ্যারির ভেতরে ভয় কাজ করতে থাকল। মাথা ঢাকা ডেথ-ইটারটা চিৎকার করে বলছিল, এটাই আসল। সে জানলো কীভাবে? সে চারদিকের অন্ধকারের দিকে চোখ বুলালো এবং আতঙ্কিত হলো। ওরা ছিল কোথায়?
হ্যারি ঘুরে মটরবাইকের সামনের দিকে মুখ করে বসল এবং হ্যাগ্রিডের জ্যাকেটটা ধরে বসল।
হ্যাগ্রিড, আবার ড্রাগনফায়ার ছুঁড়ে দাও। তারপর চললো এখান থেকে সরে যাই!
তাহলে শক্ত করে ধরো হ্যারি!
আরো একবার কান ফাটানো শব্দ হলো এবং মটরবাইকের এক্সজস্ট পাইপ থেকে নীল-সাদা আলো বের হয়ে গেল। হ্যারির মনে হলো সে অল্প যে জায়গাটুকুতে বসেছিল সেখান থেকে পিছলে পেছনের দিকে পড়ে যাচ্ছে। হ্যাগ্রিড কোনোক্রমে একহাতে বাইকের হ্যান্ডেল ধরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ধরে ফেলল।
আমার মনে হয় আমরা ওদেরকে খুইয়েছি। আমরা কাজ করে ফেলেছি। চিৎকার করে হ্যাগ্রিড বলল।
কিন্তু হ্যারি পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারল না। সে ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাতে থাকল শত্রুদের উদ্দেশ্যে। সে নিশ্চিত যে ওরা ফিরে আসবে… তা না হলে কেন ওরা পিছনে পড়ছিল? ওদের একজনের হাতে তখনো একটি যাদুর কাঠি ছিল… হ্যারি যখন স্ট্যানকে নিরস্ত্র করছিল ঠিক তখনই ওদের একজন বলেছে… এটাই হলো আসল, এটাই আসল হ্যারি…
আমরা প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি হ্যারি! হ্যাগ্রিড উচ্চস্বরে বলল।
হ্যারি বুঝতে পারল বাইক ধপ করে কিছুটা নেমে এসেছে। যদিও নিচের আলোকে এখনো দূরের নক্ষত্র বলে মনে হচ্ছে।
তারপরই হ্যারির কপালের ওপর দাগটি পুড়ে উঠল। বাইকের দুপাশে দুটি ডেথ-ইটার উদয় হলো। দুটি ভয়ানক মৃত্যু ঘটানোর মতো ভয়ানক কার্স এক মিলিমিটার দূরত্বে হ্যারির পাশ দিয়ে চলে গেল। ওগুলো ছোঁড়া হয়েছে হ্যারির পেছন থেকে
এবং তখনই হ্যারি তাকে দেখল। হ্যারি দেখল ভোল্ডেমর্ট বাতাসের মধ্যে (দয়া হয়ে উড়ছে। সে কোনো ব্রুমস্টিক বা থ্রেস্ট্রাল ব্যবহার করেনি। অন্ধকারেভিতরে তার সাপের মতো মুখটি জ্বলছে। তার সাদা নখগুলো দিয়ে আবার সে যাদুর ছড়ি উঁচু করল
হ্যাগ্রিড ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে মটারবাইকটি ঘুরিয়ে খাড়াভাবে ডাইভ দিল। জীবনের মায়ায় শক্তহাতে ধরা যাদুর কাঠি থেকে হ্যারি স্টানিং স্পেল ছুঁড়তে থাকল সমানে। সেগুলো রাতের আধারে ঘুরপাক খেতে থাকল। সে দেখল একটি শরীর তাকে অতিক্রম করে সামনে চলে গেল এবং বুঝতে পারল যে একটিকে অন্তত সে আঘাত করেছে। কিন্তু তখনই সে একটি বিকট শব্দ পেল এবং দেখল ইঞ্জিনের ভেতর থেকে ঝলকে উঠল। মটরবাইকটি সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ঘুরপাক খেতে থাকল। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
সবুজ আলো বিদ্যুতগতিতে আবার তাদের পাস করে গেল। কোনটা উপর আর কোনটা নিচ সে সম্পর্কে হ্যারির কোনো ধারণাই তখন নেই। তার কপালের দাগটি তখনো জ্বালাপোড়া করছে। মনে হলো যে কোনো সময় সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। একটি মুখ ঢাকা শরীর ব্রুমস্টিক নিয়ে হ্যারির উপরে চলে এলো। হ্যারি দেখল সে তার হাতটা উঁচু করেছে
না!
ভয়ানক চিৎকার দিয়ে হ্যাগ্রিড বাইক ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডেথ-ইটারটির উপর। হ্যারি দেখল হ্যাগ্রিড এবং ডেথ-ইটার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ব্রুমস্টিক দুজনের ভার বইতে পারছে না।
পতনোম্মুখ বাইকটি কোনোক্রমে হ্যারি হাঁটু দিয়ে জড়িয়ে ধরল। হ্যারি শুনতে পেল ভোল্ডেমর্ট চিৎকার করে বলছে, আমার!
ব্যাস, ও পর্যন্তই। সে দেখতে পেল না বা বুঝতে পারল না ভোল্টেমর্টের অবস্থান। ঠিক তার সামনে আরেকটি ডেথ ইটার ঝলকে উঠল এবং শুনতে পেল অভাড়া-।
কপালের দাগটির যন্ত্রণায় হ্যারির চোখ বুজে আসছে। হ্যারির যাদুকাঠি তখন আপনাআপনিই কাজ করছে। অনুভব করল যাদুকাঠিটা তার হাতটাকে চুম্বকের মতো বিভিন্ন দিকে ঘোরাচ্ছে। অর্ধ নির্মিলিত চোখে হ্যারি দেখল একটি সোনালি আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ক্র্যাক করে একটি শব্দ হলো এবং ভয়ানক একটি চিৎকার শোনা গেল। বাকী ডেথ-ইটারটি আর্তনাদ করে উঠল। ভোল্ডেমর্টে চিৎকার করে উঠল, না! হঠাৎ হ্যারি আবিষ্কার করল যে ড্রাগন ফায়ারের বোতামের মাত্র এক ইঞ্চি দূরে তার নাকটা। সে যে হাতটায় যাদু কাঠি নেই সেই হাত দিয়ে বোতামের উপর চাপ দিল। বাইক থেকে প্রচণ্ড ধোয়া বের হয়ে আকাশ কালো করে ফেলল। বাইকটি দ্রুত সোজা নিচের দিকে পড়তে থাকল।
হ্যাগ্রিড!, হ্যারি ডাকল। সে জীবনের মায়ায় শক্ত করে মটরবাইক ধরে আছে। হ্যাগ্রিড! অ্যাসিও হ্যাথিড!
মটর বাইকটি আরো দ্রুত মাটির দিকে নেমে যাচ্ছে। হ্যারির মুখের সামনে বাইকের হাতল। সে কছুই দেখতে পাচ্ছে না। শুধু দেখতে পাচ্ছে নিচের আলো কাছে থেকে আরো কাছে চলে আসছে। সে এখনই মাটির উপর গুঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু তার কিছুই করার নেই। তার পেছনে সে আরো একটি চিৎকারের শব্দ শুনতে পেল
তোমার যাদু কাঠিটা সেলুইন! তোমার যাদুকাঠিটা আমাকে দাও!
দেখার আগেই হ্যারি বুঝতে পারল এটা ভোল্ডেমর্ট। পাশের দিকে ফিরে দেখল ভোল্টেমর্টের লাল চোখ। হ্যারি নিশ্চিত যে এটাই তার শেষ কিছু দেখা। ভোল্ডেমর্ট আরো একবার তার দিকে কার্স ছুঁড়ে দিতে প্রস্তুত হলো
ঠিক তখনই ভোল্ডেমর্ট চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল। হ্যারি নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল ঠিক তার নিচে হ্যাগ্রিড বাজপাখির মতো মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার সকল শক্তি দিয়ে বাইকের হাতল টান দিয়ে ঘোরাল এবং ব্রেক করতে চেষ্টা করল যেন হ্যাগ্রিডের গায়ের ওপর আছড়ে না পড়ে। কিন্তু আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সে কাদা পানির পুকুরের ভেতর আছড়ে পড়ল।