০৪. সম্পর্ক

সম্পর্ক

তা হলে প্রশ্ন আসে, বিবাহ কী ভাবে হওয়া উচিত? অনুষ্ঠান বা রেজিস্ট্রির প্রশ্ন নয়— দুটি মানুষের একত্র বাসের জন্য নির্বাচনের ভিত্তি কী হওয়া উচিত? এখন পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুটি পরিবারের সামাজিক আর্থিক নিরিখ দিয়েই মূলত এই নির্বাচন হয়। এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত পাশ্চাত্য দেশেও এই নিরিখ চলিত ছিল। ‘বিবাহে সঙ্গী/সঙ্গিনী নির্বাচন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হত প্রেম বা স্নেহ দিয়ে নয়, বরং পরিবারে নির্ভরশীল আশ্রিতদের দেখাশোনার জন্যে সামাজিক ও আর্থিক প্রয়োজন দিয়ে এবং পারিবারিক বাণিজ্য বা শিল্পকে চালিয়ে দিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়ে।’[১] সে দেশে জাতিভেদ ছিল না, কিন্তু বিত্তকৌলীন্য ও বংশমর্যাদার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই বিত্তবানের পরিবারে বিবাহ নিষ্পন্ন হত। এ দেশে বাড়তি অভিশাপ হল জাতিভেদ। বিদ্যাবুদ্ধি, যোগ্যতা, স্বভাব, রুচি সব মিললেও বহু ক্ষেত্রে বিবাহটি ঘটতে পারে না, পাত্রপাত্রীর জাতে মিল নেই বলে। এখনও খবরের কাগজে ‘পাত্রপাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপনে শুধুমাত্র তফসিলি বা তথাকথিত নিম্নবর্ণের পাত্র-পাত্রীর ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ‘অসবর্ণ চলিবে’; অর্থাৎ সামাজিক অধিরোহণের পথটা খোলা থাকে, যাকে চলতি ভাষায় বলে ‘জাতে ওঠা’। হয়তো হাজারে একটি ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ কায়স্থ পাত্রপাত্রীর ক্ষেত্রেও ‘অসবর্ণে বাধা নাই’ দেখা যায়। আসলে এই বাধা থেকে যারা মানসিক ভাবে মুক্ত তারা বেশির ভাগই নিজের পছন্দে বিয়ে করে, বিজ্ঞাপন দিয়ে নয়।

[১. ‘Choice of a marriage partner was controlled primarily not by love and affection but by social and economic needs associated with the case of dependants and the continuation of the family enterprise or of the lineage.’ The European Family. p. 122]

বিয়ের ব্যাপারে পাত্রপাত্রীর মতামত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রাহ্য করা হয়। মোটা দাগের কিছু চাহিদা, যেমন ফরসা চাই, বেশি লম্বা নয়, গ্র্যাজুয়েট চাই, গান-জানা চাই, ইত্যাদি হয়তো গুরুজনেরা কখনও কখনও মনে রাখেন, সর্বদা নয়। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এমন ঘটেছে যে তাঁদের চাহিদা, বংশ, জাত, দেনাপাওনা, উচ্চপদ, ইত্যাদি মিললেও পাত্রপাত্রীর পছন্দ গৌণ হয়ে উপেক্ষিত হয়েছে। এ সব দাম্পত্য শুরুই হয় মনের একটা চাপা নালিশ দিয়ে, যে-নালিশ প্রকৃতপক্ষে তাদের মা-বাবার বিরুদ্ধে। তাঁদের খেয়ালের দেনা শোধ করে বর বা বধূ, বা উভয়েই। কখনও এ নালিশ উচ্চারিতও হয় না, শুধু অতৃপ্তি জমিয়ে তোলে জীবনভর। আবার কখনও অন্যদিকে ক্ষতিপূরণ থাকলে নালিশও কখন মিলিয়ে যায়।

বিবাহোত্তর জীবনে দাম্পত্যকে নানা সমস্যা পেরিয়ে এগোতে হয়। দুটি মানুষ তো বিচ্ছিন্ন দুটি দ্বীপ নয়। বর, বধূ উভয়েরই পরিবার আছে। সেখানে সকলেই যে আগন্তুককে আন্তরিক স্বাগত জানায়, তা নয়। এবং নতুন জীবনে প্রবেশের মুখে দুটি প্রাপ্তবয়স্কের চেতনায় প্রায়ই যে সূক্ষ্ম স্পর্শকাতরতা দেখা দেয়, তাতে খুব দ্রুত ধরা পড়ে আন্তরিক অভ্যর্থনার অভাব। রূপ, গুণ, স্বভাব, সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য, বংশ, দেনাপাওনা এগুলো পরিবারের তথা তৎসংলগ্ন সমাজের প্রত্যাশার সঙ্গে না মিললে প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মৃদু গুঞ্জন, এবং অচিরেই তা মৃদুতা হারিয়ে, সরব এবং কটু হয়ে ওঠে। অবশ্যই, এর বড় ধকলটা সইতে হয় বধূটিকে। একে, তার জীবনে অন্য একটি মানুষকে মেনে-নেওয়ার পালাটি তখন চলছে, তার ওপর ঝাপটা এসে লাগে সেই মানুষটির আত্মীয়-পরিজনের অসমর্থন, বিরূপতা, সমালোচনায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার মূল আশ্রয়স্থল যে মানুষটি, সে তাকে এ সময়ে মানসিক আশ্রয় দেয় না, বধূর যে অন্যায় সমালোচনা তার পরিবারে চলে তার প্রতিবাদ করে না। করাটা সে দুরূহ মনে করে, কারণ তার আবাল্য পরিচিত আত্মীয়-পরিজন তাতে ক্ষুণ্ণ হয়ে তাকে স্ত্রৈণ ভাববে, অসভ্য মনে করবে। কিন্তু নবাগত বধূটির মানসিক স্বস্তির জন্যে তার যে দায়িত্ব আছে, সে কথা মনে করে সে অন্তত কিছুকালের জন্যেও পরিবারের অপ্রীতিভাজন হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছবিটা এই রকমই। মেয়েটি মনে মনে তাকে কাপুরুষ ও অবিচারের সমর্থক মনে করে তার সম্বন্ধে শ্রদ্ধা হারায়- যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা দাম্পত্যের একটি দৃঢ় ভিত্তি। বহু ক্ষেত্রে প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই উৎসব হইচই মিটে গেলেই একটি অসহায় মেয়ে, তার স্বামীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণ না পেয়ে ভেতরে ভেতরে বিমুখ হয়ে ওঠে। মজা হল, সম্বন্ধ করে অর্থাৎ দু’পরিবারের পাত্রপাত্রী পছন্দের ব্যাপারে যে সব বিয়ে হয় সেখানেও এমন ‘খুঁত’ বের করা হয় যা সত্যিই অযৌক্তিক। নতুন মানুষটিকে সাদর স্বাগত জানানোর বদলে বহু ক্ষেত্রে তাকে প্রচ্ছন্ন শত্রুজ্ঞানে কেবল বিচার করে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। যেন প্রত্যাশা ছিল মেয়েটি নিখুঁত, সর্বংসহা ও সর্বগুণসম্পন্না হবে। এ ধরনের কোনও প্রত্যাশা বরের সম্বন্ধে সমাজে বা পরিবারে থাকে না, কারণ সে পুরুষ। শোনা যায়, ‘সোনার বাটি, তার আবার চেহারা দেখা’। এমন ধরনের বিবাহে দাম্পত্য গড়ে ওঠার আগেই তার ভিত ভেঙে যায়, যদি না স্বামীর প্রশ্রয় সমর্থন স্পষ্ট ভাবে স্ত্রীকে রক্ষা করে।

দেনাপাওনার ব্যাপারেও বারে বারে দেখা যায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছেলে এ ব্যাপারে ব্রজেশ্বর হয়ে ওঠে: বাবা যা ভাল বোঝেন, করবেন ও বিষয়ে আমি কোনও কথা বলব না। বস্তুত, সে-ও জানে নিজে দেনাপাওনার কথা বললে শুধু দৃষ্টিকটু হবে তাই নয়, দরাদরি মাঝপথে ভেস্তে যেতে পারে, পক্ষান্তরে বিষয়ী বাবা ওটা দেখলে প্রাপ্তিযোগটা বেশি হওয়ারই সম্ভাবনা। বলা বাহুল্য, যে মেয়েটির বাবাকে এই দণ্ডটা দিতে হচ্ছে সেও এতে প্রসন্ন হতে পারে না, কারণ এখানেও ভাবী স্বামীর নীরবতা যে প্রচ্ছন্ন কাপুরুষতাই, সেটা সে বেশ বুঝতে পারে। এ তো সবে কলির সন্ধে; প্রাপ্তির স্বাদ-পাওয়া শ্বশুরবাড়ির লোভ চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে চলে। বেড়ে চলে বধূ ও তার বাপের বাড়ির কাছে দামি জুলুম, এবং দাবি না মেটালে বধূটির ওপরে অত্যাচার। সে অত্যাচার কখনও সমাপ্ত হয় অগ্নিদাহে, বিষে বা অন্য অপঘাতে। কখনও পথ না পেয়ে মেয়েটি আত্মঘাতিনী হয়।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করব একটি টেলিফোন সংলাপ— দৈবাৎ দূরভাষজটে সংলাপটা মিনিট দুয়েক শুনতে হয়। আলাপটার শেষ মিনিটে ছিল প্রেমালাপের উপসংহার। ছেলেটি বলে, ‘তা হলে আর দেরি করে কী হবে? কালই আমি যাই তোমার বাবার কাছে তাঁর মত চাইতে।’

মেয়েটি আতঙ্কিত স্বরে বলে, ‘খবরদার, অমন কাজও কোরো না। মত চাইতে গেলে শুধু মতটাই পাবে আর কিছু নয়। গত অঘ্রাণেই সেজদির বিয়েতে বাবা সাঁইত্রিশ হাজার টাকা খরচ করলেন। মত চাইলে এ সব কিন্তু পুরো ফাঁকি দেবেন।’

শুনে খুব হতাশ লাগে। এরা গাছেরও খাবে, তলারও কুড়োবে। প্রেমের বিয়ে, কিন্তু প্রাপ্তিযোগের হিসেবটা খুব মজবুত। মেয়েদের এখনও মেরুদণ্ডে সে জোর এল না যে বলে, ‘যে-মানুষ আমার সঙ্গে পণও চাইবে তার ঘরে আমি যাব না।’ ছেলেদেরও চেতনা জন্মাল না যে বোঝে ‘পণ’ কথাটার মানে দাম, অর্থাৎ মেয়ের বাবা জামাইকে টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছেন। মেয়েরা কেন বলতে পারে না, ‘কেনা মানুষের সঙ্গে বাস করতে পারব না?’ ছেলেরাই বা বলতে পারে না কেন, ‘পণদ্রব্য হতে রাজি নই?’ আসলে ওই লোভ। উভয়তই। অনর্জিত বস্তু ও বিত্ত ভোগ করার মধ্যে যে অসম্মান অন্তর্নিহিত আছে তা টের পাওয়ার মতো আত্মসম্মানবোধই জন্মায়নি অথবা লোভের চাপে তা গৌণ হয়ে গেছে।

সদ্যবিবাহিত বান্ধবীদের মধ্যে যৌতুকে পাওয়া বস্তু-সম্ভারের সুতৃপ্ত আলোচনায় যে আত্মপ্রসাদের সুর লাগে তা শুনে বিবমিষা জাগে। এটা আপাত ভাবে পিতার বিত্তকৌলীন্যের গৌরব সূচনা করে কিন্তু তা ছাড়াও এর মধ্যে আছে শ্বশুরবাড়িতে প্রত্যাশিত অভ্যর্থনা, প্রতিবেশীদের ঈর্ষা উদ্রেক, পরিজনদের তাক লাগিয়ে দেওয়া, বান্ধবীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং স্বামীর কাছে নিজের আর্থসামাজিক বাজারদরের ঘোষণা। এর প্রত্যেকটিই এক নীচ অশালীনতার দ্যোতক। শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা শুধু যে এর থেকে মুক্ত নয় তাই নয়, বরং ক্ষোভের কথা হল এই যে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে সমাজে এ হীনতা ক্রমশ যেন বেড়েই চলেছে। দাম্পত্যের ভিত্তিতে লোভের এই ক্লেদ থাকলে তা কখনওই সুস্থ ও নির্মল হয়ে উঠতে পারে না। অবশ্য ব্যতিক্রম আছে। নিম্নমধ্যবিত্ত একটি ছাত্রীর বিবাহ সামাজিক ভাবে সমপর্যায়ের, উন্নতমনস্ক ও পূর্বপরিচিত একটি তরুণের। সে মেয়েটিকে বলে, বাড়িতে বিবাহ উপলক্ষে কোনও কাপড় গয়না, আসবাব বা তৈজসপত্র যেন সে কিনতে না দেয়। যুক্তি দেয়, ‘আমিও তো বিয়ে করছি, কই আমি তো আমার বাবা-মাকে পীড়ন করছি না, তুমি কেন করবে? আমরা চাকরি করে আস্তে আস্তে যে সংসার গড়ে তুলব তাতেই আমাদের যথেষ্ট হবে। পীড়ন শোষণের ভিত্তিতে কোনও ভাল জিনিস গড়ে উঠতে পারে না। মেয়ের বাড়ির থেকে স্বেচ্ছায় যা দিতে তাঁরা উদ্যত ছিলেন তাও নিতে অস্বীকার করে ছেলেটি। তার যুক্তি: তার বাড়ি থেকে তো অনুরূপ কোনও দানসামগ্রী মেয়ের বাড়িতে আসছে না। কুড়ি বছর আগে এই বিয়েতেই পাত্রপাত্রীপক্ষ এক সঙ্গে একটি সাদাসিধে সুরুচিপূর্ণ নৈশভোজনের আয়োজন করেন। নানা দিক থেকেই এঁরা একটি আদর্শ স্থাপন করেন, সমাজে যা প্রচলিত হলে সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হতে পারে।

দাম্পত্য জীবন যদি যৌথ পরিবারে কাটাতে হয় তা হলে পরিবারে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের মন্তব্য নিয়ে অশান্তি দাম্পত্যের সুখশান্তি নষ্ট করে। যদি শ্বশুরবাড়িতে বধূটি মানবিক ব্যবহার পায়, তা হলে, দম্পতিটির পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক ভাল থাকলে, শান্তি থাকে। কিন্তু প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া বিরূপ হলে তার প্রভাবও দম্পতির জীবনে প্রতিঘাত সৃষ্টি করে। প্রতিবেশীদের মারফতে সামাজিক প্রতিক্রিয়াও এসে পৌঁছয় এবং তার প্রতিকূল হলে শান্তি নষ্ট হয়। প্রতিবাসীরা সমাজের প্রতীক, যে সমাজকে অদৃশ্য থেকে অন্তরাল থেকে নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্র। বিত্তকৌলীন্য, পুরুষতন্ত্র, বর্ণবৈষম্যের মূল্যবোধে রাষ্ট্রের নির্মাণ; এবং এই সব যেন কায়েম থাকে, সে ব্যবস্থা সে নেপথ্য থেকে আইন, সাহিত্য, গণমাধ্যম সব দিয়েই প্রতিষ্ঠা করে।

সমস্যার মৌলিক উৎপত্তিস্থল দম্পতির একান্ত ব্যক্তিগত মানসিক সম্পর্কে। দু’জনের শিক্ষাদীক্ষার মানে (প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে নয়) যদি দুস্তর ব্যবধান থাকে তবে তা মানসিক সাহচর্যের পথে অন্তরায় হতে পারে। তেমনই অথবা হয়তো তার চেয়েও বেশি দুরতিক্রম্য হল রুচির ব্যবধান। একজন রবীন্দ্রসঙ্গীত পছন্দ করে আধুনিক সঙ্গীত একেবারেই সহ্য করতে পারে না, অপরজন ঠিক তার বিপরীত। এ ক্ষেত্রে দাম্পত্য হয়তো ভাঙে না কিন্তু যতটা মানসিক সাযুজ্য হতে পারত তা হতে পারে না। এর চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর হল স্বভাবে গরমিল।

“তেতাল্লিশ বছর একত্রে সংসার করার পর এক বৃদ্ধা গৃহিণী প্রতিবেশীর কন্যার কাছে চোখ মুছে বলছেন, ‘চারটে পয়সা কখনও কাউকে হাত তুলে দিতে পারিনি। টাকাপয়সা সব ওঁর কাছে। প্রতিটি পাইপয়সার হিসাব আছে। মরণাপন্ন মায়ের অসুখে চিকিৎসার খরচ কিছু দিতে পাইনি। আমার ভাই নেই তা উনি জানেন, বাবা তাঁর শেষ কপর্দক দিয়ে মায়ের চিকিৎসা করেছেন; চিঠি পড়ে বলতে গেলুম, ‘কিছু সাহায্য করি?’ বললেন, ‘ও বাড়ির দায় তোমার নয়। তোমাকে তো শাড়ি গয়না দিয়ে আরামে রেখেছি, তোমার মা বাবার খরচা দেওয়া আমার দ্বারা হবে না।’ ঠাকুরকে বলি, এঁকে এত ধন দিলে, মনটা কেন দিলেন না, ঠাকুর?’”

এই শোক নিষ্প্রতিকার। ভদ্রমহিলা দুঃখীর দুঃখ সহ্য করতে পারতেন না। অথচ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটালেন। কার্পণ্য ও উদারতার সংঘাত খুবই মর্মান্তিক। শাস্ত্র এবং সমাজনির্দেশ অনুসারে বৃদ্ধের কোনও দায়িত্ব ছিল না ঠিকই, কিন্তু মানবিকতার ক্ষেত্রে যে দুস্তর ব্যবধান তা শাড়ি গয়নায় ঘোচেনি। সেই বৃদ্ধার অশ্রুপাত একার নয়, এমন বহু দম্পতি দেখা যায় যাঁরা এই ধরনের মানসিক বৈষম্যের ফলে সারা জীবন দুঃসহ কষ্টে কাটান। এ ছাড়াও আছে আদর্শগত ব্যবধান। একজন হয়তো কোনও রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী, অন্যজন তার বিপরীত পন্থার অনুগামী, কিংবা দেশ বা সমাজে কল্যাণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। এ অবস্থায় একের ঔদাসীন্য অপরকে তার সত্তার খুব গভীর স্তরেই আঘাত করে, কিংবা দুই বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত দুজনকেই করে। এ ধরনের বৈষম্য উপেক্ষণীয় নয়, বিশেষত যদি দু’জনের বা একজনেরও আদর্শে বিশ্বাসটা আন্তরিক হয়, তার জীবনের তাৎপর্যবোধের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে জড়িত থাকে। এগুলো বেশির ভাগই ঘটে সম্বন্ধ করা বিয়েতে। বিয়ের আগে দু’জনের কিছুকাল আলাপ পরিচয় থাকলে এ ধরনের দুস্তর ব্যবধানে হয় দু’পক্ষ দূরে সরে যায় অথবা যদি সম্ভব হয় তো একে অন্যকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে স্বমতে আনতে পারলে ব্যবধান আর থাকে না। অবশ্য বিয়ের আগের মতবাদও পরিবর্তিত হতে পারে, দম্পতির অন্য জন সে পরিবর্তনকে অন্তরে স্বীকার করতে না পারলেও দেখা যায় সংঘাত।

বেশ বেশি সংখ্যায় বিয়ে ভাঙে আর্থিক কারণে। অভাবে, অথবা প্রত্যাশিত সচ্ছলতার অভাবে। আজকের দিনে আয় সে অনুপাতে বাড়ছে না এবং সন্তানসন্ততি এলে প্রত্যাশিত ভাবে পারিবারিক ব্যয়ভার দুর্বহ বোধ হচ্ছে। এমন অবস্থায় দেখা দেয় পরস্পরকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা। প্রথমে আয় বাড়াবার চেষ্টা, তা ব্যর্থ হলে ব্যয়সংকোচের প্রয়াস এবং বর্তমান পৃথিবীতে যেহেতু সমস্ত গণমাধ্যমই ব্যয়বাহুল্যের রাস্তাই বাতলে চলেছে, তাই অচিরেই দু’পক্ষই যেন দেখতে পায় ব্যয়সংকোচের পথটা একটা কানাগলিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর ওপরে আছে, প্রতিবেশী ও পরিচিত পরিবারগুলির জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে, চেতনে অথবা অবচেতনে, নিজেদের অবস্থার একটা তুলনার প্রয়াস: প্রায়শই নিজেদের জীবনযাত্রার মান, অত্যন্ত উচ্চবিত্ত বাদে আর সকলের ক্ষেত্রেই যে ক্রমাগতই নেমে যাবে এই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াটিকে স্বরূপে বোঝবার মতো মুক্ত দৃষ্টি বেশি জনের থাকে না। বাকিরা ক্রমবর্ধমান অভাবের অন্ধ গলিতে মাথা ঠোকে ও মনে মনে বা প্রকাশ্যে একে অপরকে পরিবারের অর্থনৈতিক মানের অবনমনের জন্য দোষ দেয়। আর মুক্ত দৃষ্টিতে বুঝলেও তো সত্যিকার অভাব থেকেই যায়। বিশেষত কালো টাকার হঠাৎ-নবাবদের অবিশ্বাস্য আয়বৃদ্ধির দিনে, যখন তারা দেখে, চারপাশের কিছু লোকের গায়ে অভাবের আঁচটিও লাগছে না, আটশো টাকা কিলোর মাছও তারা অনায়াসে নিয়মিত ভাবে কেনে। বিদেশি মদ বা প্রসাধনদ্রব্য, সেলুলার-ফোন, টেম্পল শাড়ি বা বিদেশি গাড়ি এবং দূর বিদেশে ছুটি কাটানো যেহেতু তাদের কাছে সহজ হয়ে গেছে, তাই সেই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে নিজেদের অভাব যেন অহেতুক ক্রুরতার চেহারা নিয়ে দেখা দেয়। হঠাৎ-নবাবদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার প্রবৃত্তি নিজের অপ্রতিকার্য অভাবকে আরও দুঃসহ করে তোলে। আদর্শগত কোনও স্থৈর্য বা স্বল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার সহজাত বা সাধনায় আয়ত্ত-করার ক্ষমতা যার নেই, এই পরিবেশে তার মর্মপীড়া বাড়বেই। এই আর্থিক ক্লেশের দিনে বহু দাম্পত্যে চিড় ধরতে দেখা গেছে। দু’জনের মধ্যে সহমর্মিতা যদি এমন গভীরে না পৌঁছয় যেখানে বাইরের এই সব ঝড়ঝাপটা এসে দাম্পত্যের ভিত্তিতে না লাগে, তা হলে অকারণে ভুলবোঝাবুঝি শুরু হয় ও ক্রমাগত বেড়েই চলে। স্থূল জীবনযাত্রাকে পেরিয়ে গভীরে কোনও এক জায়গায় দাম্পত্য সম্পর্কের নোঙর থাকলে তবেই এই সব ঝড় সওয়া যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *