সমস্ত দুপুর অদ্ভুত এক উত্তেজনার মধ্যে কাটল অর্জুনের। শেষপর্যন্ত আড়াইটে নাগাদ সে জগুদার বাড়িতে গেল। জগুদা এখন শিলিগুড়ির স্টেট ব্যাঙ্কে বদলি হয়ে গিয়েছেন। বউদি তাকে দেখে খুব খুশি। অর্জুন ভি সি আরে স্পিলবার্গের ইটি ছবিটা দেখতে চাইলে তিনি তৎক্ষণাৎ সেটাকে চালু করে দিলেন। অর্জুন অনেকবার দেখা ছবিটাকে আর একবার খুঁটিয়ে দেখল। কিন্তু তার মনে হল স্পিলবার্গ যেভাবে দেখিয়েছেন, অন্য গ্রহের মানুষেরা এমন হয় না।
বউদিকে ভি সি আর বন্ধ করতে বলে সে বেরিয়ে এসে বাইকে স্টার্ট দিল। এখন বিকেল। কদমতলার মোড় জমজমাট। অর্জুন কালীবাড়ির রাস্তাটা ধরল। সে ক্রমশ নিঃসন্দেহ হচ্ছিল ওই যন্ত্রটির সঙ্গে মহাকাশের অন্য গ্রহের জীবদের একটা সম্পর্ক আছে। এ ছাড়া অন্য কোনও ব্যাখ্যা হতে পারে না। ব্যাপারটা নিয়ে যত সে ভাবছিল, তত এক ধরনের রোমাঞ্চে সে আপ্লুত হচ্ছিল।
থানায় পৌঁছে সে অবাক! এরই মধ্যে মহাদেব সেন এবং রামচন্দ্র রায় অবনীবাবুর সামনে বসে আছেন। মহাদেব সেনের ছেলে সুব্রত সেনও সঙ্গে আছেন। মহাদেব সেন তাকে দেখে বললেন, যাক, ঠিক সময়েই এসেছে।
অর্জুন হেসে আর-একটা চেয়ারে বসল।
অবনীবাবু বললেন, ডি আই জি হেড কোয়াটার্স একটু আগে টেলিফোন করেছিলেন এস পি সাহেবকে। বলেছেন আমাকে কিছুদিনের জন্যে বিশ্রাম নিতে।
কেন? অর্জুন অবাক।
ওঁর ধারণা ওভারস্ট্রেন করে আমার মাথা সুস্থ নেই। আমি ওই যন্ত্রটার ব্যাপারটা রিপোর্ট করেছিলাম।
আশ্চর্য!
হ্যাঁ, আপনাদের জন্যে আমার এই দশা। যাকগে, আজকের প্ল্যান কী?
আমরা যন্ত্রটার কাজকর্ম ভালভাবে দেখতে চাই।
কীভাবে?
এই সময় মহাদেব সেন কথা বললেন, আমি একটা উপায় ভেবেছি। সুব্রত জিনিসটা বের করো তো।
মহাদেববাবুর ছেলে একটা ব্যাগ খুলে দুটো হেডফোন জাতীয় জিনিস বের করে তাঁর বাবার হাতে দিলেন। মহাদেব সেন বললেন, এটা কানে পরলে কোনওরকম বাইরের শব্দ কানে যাবে না। আমি দেখতে চাই শেষপর্যন্ত ঘটনাটা কোনদিকে যায়!
রামচন্দ্র রায় বললেন, সরি! ওটা আমি ব্যবহার করব না।
কেন? মহাদেব সেন একটু বিরক্ত হলেন।
আমি শব্দটাকে শুনতে চাই।
মহাদেব সেন কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অর্জুন বাধা দিল, ঠিক আছে, উনি যা চাইছেন তাই হোক। আপনি হেডফোনটাকে ব্যবহার করুন। আজ রাত্রে আপনার স্বাভাবিক থাকা প্রয়োজন।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মহাদেববাবু প্রস্তাবটা মেনে নিলেন। অবনীবাবু বললেন, আমি আর-একটা ব্যবস্থা করেছি। সেটা এখন বলব না।
সন্ধে হওয়ার আগে চা খাওয়ালেন অবনীবাবু। তারপর সবাই ঘর থেকে বের হলেন। শঙ্করবাবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্জুনকে দেখে ইশারায় কাছে আসতে বললেন তিনি। অর্জুন এগিয়ে যেতে শঙ্করবাবু বললেন, আমার বাবা চোখে দেখতেই পান না। যদি মহাদেববাবু ওই যন্ত্রটির সাহায্যে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান তা হলে আমার বাবাও পেতে পারেন। স্যারকে বলুন না, আমি ওঁকে নিয়ে আসতে পারি?
উনি কোথায় আছেন?
আমার কোয়ার্টার্সে।
বেশ, ওঁকে আগে জিজ্ঞেস করুন কোনও সিগন্যালের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন কি না। যদি পান, তা হলে নিয়ে আসুন। অর্জুন হেসে এগিয়ে গেল।
আজ বিকেলে মহাদেব সেনের দৃষ্টিশক্তি আরও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। সুব্রত সেনের হাত ধরে হাঁটছেন তিনি। সকালবেলায় যে-লোকটা টগবগে ছিল, এখন তাঁকে ছেলের হাত ধরে হাঁটতে হচ্ছে। বাইরে দিন ফুরিয়ে আসছে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি কিছু ভেবেছেন?
মহাদেব সেন বললেন, হ্যাঁ। আমি আগে থানায় এসেছি, কারণ অবনীবাবুকে দিয়ে ওই ভল্টের ঘরের মেঝে জুড়ে সাদা চুন ছড়িয়ে দিয়েছি। যে ওই ঘরে ঢুকবে তার পায়ের ছাপ ওখানে পড়বে। আমি হেডফোন ব্যবহার করব। যদি সিগন্যালের শব্দ না শুনতে পাই তা হলে আশা করি নর্মাল থাকব।
ওরা নীচে নেমে ভল্টের দরজার সামনে দাঁড়াল। অবনীবাবু আগে থেকেই সেখানে কয়েকটা চেয়ারের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। সেগুলোয় বসে গল্পগুজব হচ্ছিল। হঠাৎ রামচন্দ্র রায় সোজা হয়ে বসলেন, শুনতে পাচ্ছি।
মহাদেব সেন কান খাড়া করলেন, হ্যাঁ, আমিও পাচ্ছি। সুব্রত?
সুব্রত সেন তাঁর হাতে হেডফোন এগিয়ে দিতে তিনি সেটা ভাল করে কানে ঢেকে মাথায় পরে নিলেন।
রামচন্দ্র রায় বললেন, বিপ বিপ শব্দ হচ্ছে।
অবনীবাবুর নির্দেশে একজন সেপাই ভল্টের আলো নিভিয়ে দিল। যন্ত্রটাকে সুটকেস থেকে বের করে ভল্টের মাঝখানে একটা টেবিলের ওপর রেখে দেওয়া হয়েছিল। অন্ধকার হতেই তা থেকে মাঝে-মাঝে আলো বের হতে দেখা গেল। মহাদেববাবু পাশে বসা অর্জুনকে বললেন, তোমার ধারণাটা ঠিক। সিগন্যাল আসামাত্র যন্ত্রটা থেকে আলো বের হয়।
করিডোরে আলো আছে, ভেতরে নেই। আলোটা ক্রমশ জোরালো হয়ে নিভছে-জ্বলছে। হঠাৎ রামচন্দ্র রায় বললেন, ডিনারটা করে নিতে পারলে ভাল হত। আজ সারারাত অভুক্ত থাকতে হবে।
অর্জুন হাসল। ভদ্রলোক নিঘাত খেতে খুব ভালোবাসেন, নইলে এই সময়ে ডিনারের চিন্তা করতেন না।
হঠাৎ মহাদেব সেন বলে উঠলেন, এ কী! সর্বনাশ!
সবাই ওঁর দিকে চমকে তাকাল। মহাদেব সেন বললেন, আমি শব্দটাকে শুনতে পাচ্ছি। আমার কান ঢেকে রাখা সত্ত্বেও পাচ্ছি। মনে হচ্ছে শরীরের অন্যসব রন্ধ্রপথ দিয়ে শব্দটা ঢুকে যাচ্ছে। খুবই ক্ষীণ তাই না মিস্টার রায়? মহাদেব সেন হেডফোন খুলে ফেললেন মাথা থেকে।
রামচন্দ্র রায় মাথা নাড়লেন, ঠিক, ঠিক। গোটা রাত সামনে পড়ে আছে, না খেলে খুব দুর্বল হয়ে যাব। শরীর ঠিক না থাকলে কোনও আনন্দকেই। আনন্দ বলে মনে হয় না।
অর্জুন বলল, কী খেতে চান?
মহাদেব সেন ধমকালেন, থামো। আপনি এ সময়ে খাওয়ার কথা চিন্তা করছেন?
রামচন্দ্র রায় হাসলেন, একবার জলদস্যুদের পাল্লায় পড়েছিলাম। ভোর হলেই খুন করবে বলে গেল। সবাই কান্নাকাটি করছিল। আমি কিন্তু রাতের খাবারটা চেয়ে নিলাম। আমার যুক্তি হল কান্নাকাটি করে দুর্বল হওয়ার চেয়ে খেয়েদেয়ে শক্তিশালী হওয়া অনেক ভাল। শব্দটা বাড়ছে!
মহাদেব সেন একমত হলেন, া। এখন আর বিপ বিপ নয়, একটানা। বাড়ছে কিন্তু বেশ সহ্য করার মধ্যেই আছে। শরীরে একটা রিমঝিম ভাব এসে গেছে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেউ আপনাকে সম্মোহন করছে বলে মনে হচ্ছে?
আমেজ লাগছে কিন্তু কারও অস্তিত্ব টের পাচ্ছি না। তাই না মিস্টার রায়?
ঠিক, ঠিক। চোখ বন্ধ রামচন্দ্র রায় মাথা নাড়লেন।
অর্জুন লক্ষ করল, টেবিলে রাখা যন্ত্রটা থেকে যে দপদপ আলোর ঝলকানি বেরিয়ে আসছিল, তা বদলে গেছে। এখন মৃদু নীলচে আলো বের হচ্ছে। আলোর রেখাটা মাঝে-মাঝে দিক পরিবর্তন করছে মাত্র। সে মহাদেব সেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
ব্যাপারটা লক্ষ করে মহাদেব সেন বললেন, সঠিক দিকনির্ণয়ে সাহায্য করছে যন্ত্রটা। কিছু একটা আসছে আর তার আসার পথটা জানিয়ে দিচ্ছে ও।
ঘণ্টাখানেক ধরে এই ধরনের কথাবার্তা চলল। মহাদেব সেন এবং রামচন্দ্র রায় সিগন্যালিং সাউন্ড শুনেই যাচ্ছেন। শুধু তার পরদা বাড়ছে। এঁদের কথাবার্তা এখনও স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে সুব্রত সেন তাঁর বাবাকে সতর্ক করেছিলেন শরীর খারাপ হওয়ার আশঙ্কা জানিয়ে, কিন্তু তিনি কান দেননি। জরুরি কিছু কাজের খবর নিয়ে শঙ্করবাবু এসেছিলেন অবনীবাবুর কাছে। অবনীবাবু নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন কেউ যেন তাঁকে বিরক্ত না করে।
রাত দশটা নাগাদ অর্জুনেরই মনে হতে লাগল, বেশ খিদে পেয়ে গিয়েছে। খেতে হলে এই চেয়ার ছেড়ে উঠতে হয়। কিন্তু ওঠবার ঝুঁকি নেওয়া অসম্ভব। কখন কোন মুহূর্তে কী ঘটে যাবে তা কেউ জানে না। রামচন্দ্র রায় আর খাওয়ার কথা বলছেন না। তাঁকে এখন ঠিক একটি নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো দেখাচ্ছে। শব্দটা বেড়ে গেছে অনেক। মহাদেব সেন গত রাত্রে রিকশায় বসে যেভাবে কান চেপে ধরেছিলেন, এখন সেই ভঙ্গিতে বসে আছেন। যন্ত্র থেকে বের হওয়া আলোটা এখন অতীব উজ্জ্বল। যেন টর্চের আলোর মতো সেটা বাঁ-ডান করে একটা দেওয়ালের ওপর আছড়ে পড়েছে। সেটা দেখে মহাদেব সেন উঠে দাঁড়ালেন, গতি উত্তর দিকে। শব্দটা আসছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। দূরত্ব খুবই কমে এসেছে, খুবই কম, আঃ! আস্তে-আস্তে ওঁর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। অর্জুন সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সুব্রত সেনকে ইশারা করে সে মহাদেব সেনকে ধরতে বলে প্রায় পাঁজাকোলা করেই ওপরে নিয়ে এল। সামনে পুলিশ জিপের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন শঙ্করবাবু। মহাদেব সেনের শরীর জিপে তুলে দিয়ে অর্জুন বলল, আপনার ড্রাইভারকে বলুন থানা থেকে সিকি মাইল দূরে গাড়িটাকে নিয়ে যেতে। ওই যন্ত্রটার প্রভাবের বাইরে এখন ওঁকে রাখতে চাই, নইলে গতকালের অবস্থা হবে।
শঙ্করবাবু ব্যাপারটা বুঝে ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন। সুব্রত সেন মহাদেব সেনকে ধরে বসে ছিলেন। জিপটা সাত-তাড়াতাড়ি থানার চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। অর্জুন আবার ফিরে গেল নীচে। গিয়ে দেখল রামচন্দ্রবাবুকে দুজন সেপাই ধরে রেখেছে দুপাশ থেকে। অবনীবাবু বললেন, উনি ওই যন্ত্রটাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইছেন। কথা জড়িয়ে গেছে, কিন্তু গায়ে শক্তি এসেছে। মহাদেববাবুকে কোথায় নিয়ে গেলেন?
অর্জুন বলল, থানার বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। গত রাত্রে উনি থানার গেটের কাছে এসে শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন। ওই যন্ত্র থেকে কিছুটা দূরে সরে গেলে ওঁর ওপর কোনও রি-অ্যাকশন পড়বে না। গত রাত্রের অবস্থা হওয়ার আগে উনি নর্মাল হয়ে যেতে পারবেন।
রামচন্দ্র রায়ের এখন কোনও হুঁশ নেই। তাঁর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেপাই দুজনের জন্যে তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। অর্জুন যন্ত্রটির দিকে তাকাল। আলো বেশ চড়া এখন। দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে চারধার বেশ আলোকিত। গত রাত্রে সুটকেসের ভেতর ওটা থাকায় সে আলোর এই চেহারা ঠাওর করতে পারেনি। ঘরের মেঝের দিকে তাকাল সে। কোনও দাগ নেই। কোনও প্রাণী বা বস্তু ওখানে গেলে ছাপ ফুটে উঠত।
অর্জুন ঘড়ি দেখল। এখন প্রায় এগারোটা বাজে। মহাদেব সেনের কথা মনে পড়ল তার। গতি উত্তর দিকে, শব্দটা আসছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, দূরত্ব বেশি নয়। কিন্তু বেশি নয় মানে কতটা? সে পিছিয়ে এসে অবনীবাবুর কানে নিচু গলায় কিছু বলল। ভদ্রলোক অবাক হলেন, কিন্তু–
একবার দেখাই যাক না।
বেশ। অবনীবাবু নিজেই তালা খুললেন। সাদা মেঝেতে তাঁর জুতোর ছাপ পড়ল। র্যাক থেকে থামোকোল বের করে যন্ত্রটাকে ঢুকিয়ে দিতেই আলো ঢেকে গেল। এবার যেমন ছিল তেমনই সুটকেসে সব জিনিস ভরে ওটাকে টেবিলে রেখে তিনি বেরিয়ে এসে সেপাইদের বললেন, মিস্টার রায়কে ছেড়ে দাও।
সেপাইরা আদেশ পালন করামাত্র রামচন্দ্রবাবু তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন। একরকম ছুটেই তিনি টেবিলের কাছে পৌঁছে সুটকেসটাকে তুলে ধরলেন। তাঁর মুখের অভিব্যক্তি একদম অন্যরকম এখন। নিজের জিনিস নিজেই নিয়ে যাচ্ছেন, কারও অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই এমন ভঙ্গিতে সুটকেসটাকে তুলে তিনি সোজা হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। বোঝাই যাচ্ছিল এখন তিনি কাউকে চিনতে পারছেন না।
অর্জুন এবং অবনীবাবু ওঁকে অনুসরণ করে ওপরে উঠে আসতেই দেখা গেল শঙ্করবাবু রামচন্দ্র রায়কে জিজ্ঞেস করছেন, এ কী! সুটকেস নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?
রামচন্দ্র রায় জবাব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না। হনহনিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে লাগলেন। শঙ্করবাবুকে ইশারায় শান্ত হতে বলে অবনীবাবু বললেন, আমরা ঘুরে আসছি।
জলপাইগুড়ির রাস্তা এখন সুনসান। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় কোনও রিকশা নেই। রামচন্দ্র রায় সুটকেস নিয়ে সোজা দিনবাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন, তার হাত-পনেরো দূরে অর্জুনরা। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন বলে মনে হয় আপনার?
উনি রোজ রাত্রে বের হতেন। ভোরের আগে ফিরে আসতেন সুটকেস নিয়ে। এ গল্প নিজেই করেছেন। কোথায় যেতেন, কী করতেন সেটা পরে খেয়াল করতে পারতেন না। অর্জুন হাঁটতে-হাঁটতে বলল।
করলা পার হয়ে রায়কতপাড়ার দিকে যাচ্ছেন।
হ্যাঁ, এদিকেই ওঁর বাড়ি।
বাড়িতে যাচ্ছেন নাকি?
মনে হয় না। এটা উত্তর দিক না?
হ্যাঁ, থানার উত্তর দিক।
অর্জুন বেশ উত্তেজিত হল। মহাদেব সেন যদি ভুল না করে থাকেন, যদি ওই সময়েও ওঁর মস্তিষ্ক ঠিক কাজ করে থাকে তা হলে এতক্ষণে একটা সূত্র পাওয়া যাচ্ছে। গতি উত্তর দিকে। দূরত্ব বেশি নয়। রামচন্দ্র রায় উত্তর দিকেই যাচ্ছেন।
রাজবাড়ি ছাড়িয়ে নিজের বাড়ির সামনে পৌঁছে থমকে দাঁড়ালেন রামচন্দ্র রায়। দেখে মনে হল, তিনি কিছু ভাবছেন। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এটাই ওঁর বাড়ি?
অর্জুন জবাব দিল, হ্যাঁ। কিন্তু বাড়িতে আলো জ্বলছে কেন?
আর কেউ থাকেন না?
না।
হয়তো ভদ্রলোক কাল রাত থেকেই আর আলো নেভাননি। উনি আবার হাঁটা শুরু করেছেন। এই বয়সেও এত শক্তি, ভাবা যায় না। অবনীবাবু আবার অনুসরণ আরম্ভ করলেন। অর্জুনের ইচ্ছে ছিল রামচন্দ্র রায়ের বাড়িটাকে একবার দেখে যাওয়া। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। জলপাইগুড়ি বাইপাসের রাস্তায় এসে বোঝা যাচ্ছিল রামচন্দ্র রায় আর চলতে পারছেন না। এখানে রাস্তার আলো নেই। তারাদের শরীর থেকে নেমে আসা আলোয় এখন চোখ অভ্যস্ত হয়েছে। রামচন্দ্র রায় টলছেন। হঠাৎ ধুপ করে বসে পড়লেন একপাশে। বসার সময়েও সুটকেসটার দখল ছাড়েননি। অন্তত চার-পাঁচ কিলোমিটার পথ তিনি হেঁটেছেন ভারী সুটকেস নিয়ে। এই বয়সে এটাই অস্বাভাবিক।
একটু অপেক্ষা করে অবনীবাবু বললেন, চলুন দেখা যাক।
ওরা পাশে এসে দাঁড়াতেও ভদ্রলোকের সম্বিৎ ফিরল না। অর্জুন সুটকেসটা বেশ সন্তর্পণে ওঁর হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে ডালা খুলল। থামোকোলের আড়াল থেকে যন্ত্রটা বের করতে চারধার আলোকিত হয়ে গেল। যন্ত্রের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা সেই আলো এখন উত্তরমুখী। অবনীবাবু রামচন্দ্র রায়ের নাড়ি পরীক্ষা করলেন, খুব চঞ্চল, কিন্তু ভয়ের কিছু নেই বলে মনে হচ্ছে। ভদ্রলোককে ফিরিয়ে নেওয়া দরকার।
অর্জুন বলল, উনি এখন ক্লান্ত এবং আচ্ছন্ন। আসুন ওঁকে ধরে ওই গাছটার নিচে শুইয়ে দিই। যদি এটাকে ঘুম বলে তা হলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকুন। ফেরার সময় নিয়ে যাব।
ফেরার সময় মানে? আপনি কোথায় যাবেন?
মহাদেব সেন বলেছেন গতি উত্তরে, দূরত্ব বেশি নয়। এই আলোটাও দেখুন উত্তর দিকই নির্দেশ করছে। যন্ত্রটাকে অন্য মুখে ঘুরিয়ে দিলেই আলোটা উত্তর দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে। মনে হয় রামচন্দ্র রায় ঘোরের মধ্যে প্রতি রাত্রে এই উত্তর দিকেই যেতে চেষ্টা করতেন। শরীরের ক্ষমতা ফুরিয়ে যেতে আর পারতেন না, ভোর হলে এই যন্ত্র অকেজো হয়ে যাওয়ায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আবার বাড়ির দিকে হাঁটতেন। সুটকেসটাকে নেব না, যন্ত্রটাকে হাতে নিয়ে উত্তর দিকে না হয় কিছুটা হাঁটা যাক। অর্জুন এখন বেশ সিরিয়াস।
অবনীবাবু রাজি হলেন। রামচন্দ্র রায়কে ওরা রাস্তার পাশে একটা গাছের নীচে শুইয়ে দিলেন। যন্ত্রটি নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলে দেখা গেল দূরে একটা গাড়ি আসছে। যন্ত্রটির আলো টর্চের আলোর মতো ওদের পথ দেখাচ্ছিল। গাড়িটা কাছে আসতেই অবনীবাবু হাত তুললেন কিন্তু ড্রাইভার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। অর্জুন বলল, এরকম ফাঁকা জায়গায় এত রাত্রে আপনাকে ডাকাত বলে মনে করা অস্বাভাবিক নয়।
যা বলেছেন। এখন মনে হচ্ছে জিপটাকে নিয়ে এলে হত।
জিপে চেপে রামচন্দ্রবাবুর পেছনে হাঁটাটা স্বাভাবিক ছিল না।
এখন মশাই আমারই পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি?
ডান দিকে তিস্তা ব্রিজ, বাঁ দিকে জলপাইগুড়ি রোড স্টেশন, আলো যাচ্ছে এ-দুটোর মাঝামাঝি সোজা। এই এখন আমাদের গাইড।
একটু বাদেই রাস্তা শেষ। পথ এখন ডান এবং বাঁ দিকে চলে গিয়েছে। সোজা যেতে হলে মাঠে নামতে হবে। অর্জুন ইতস্তত করছিল। এই মাঠ হাঁটার পক্ষে নিরাপদ নয়। মাটি নরম। কোনও আল চোখে পড়ছে না। কিন্তু হঠাৎ অবনীবাবু উৎসাহী হলেন, চলুন, এত দূর যখন এসেছি তখন তিস্তা পর্যন্ত যাওয়া যাক।।
অর্জুন দেখল, আলোটা এতক্ষণ একটানা বেরোচ্ছিল, এখন একটু কমছে বাড়ছে। অবনীবাবুও সেটা দেখলেন। বললেন, চলুন না। তিস্তা
তো পার হতে পারব না। ওই অবধি গিয়ে না হয় ফিরে আসা যাবে।
অতএব ওরা মাঠে নামল। আলোয় পা ফেলছে সাবধানে। জুতো বসে যাচ্ছে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি স্পিলবার্গের ইটি দেখেছেন?
নাঃ। পুলিশের চাকরি করে সময় হয় না।
আপনার কথা মানতে পারছি না।
কেন?
আমি অনেক পুলিশ অফিসারের কথা শুনেছি যাঁরা প্রচুর বই পড়েন, ভাল ছবি দ্যাখেন। একজন অধ্যাপকের সঙ্গে চট করে তাঁদের তফাত বোঝা যাবে না।
তাঁরা নিশ্চয়ই অনেক ওপরতলার অফিসার, থানা চালাতে হয় না।
নিজের জুতোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল, ও দুটো খুলে ফেলতে পারলেই ভাল হত। মাঝমাঠ পেরিয়ে একটা উঁচু বালির ঢিবিতে উঠতে হল। এবং সেখানে উঠেই ওরা দূরে তিস্তা দেখতে পেল। আলোটা এখন দপদপ করছে। জায়গাটা বেশ গরম।
অবনীবাবু চাপা গলায় বললেন, হঠাৎ যেন চারধার গুমোট হয়ে গেল।
অর্জুনের মনে হল এখনই কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ওরা ঢিবি থেকে নেমে নদীর দিকে এগিয়ে চলল। তিস্তায় এখন জল নেই। একটি মোটা ধারা মাঝখান। দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ওরা বালির চরের পাশে এসে দাঁড়াতে মনে হল নদীর চরে বালির ওপর যেন কিছু নড়ে বেড়াচ্ছে। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, দেখতে পেয়েছেন?
হুঁ।
জিনিসটা কী বলুন তো? শেয়াল ছাড়া তো এখানে কোনও প্রাণী নেই। অবনীবাবু বেশ হতাশ গলায় বললেন, বেরোবার সময় তাড়াহুড়োয় রিভলভার নিয়ে আসার কথা খেয়াল করিনি।
অর্জুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। অন্ধকার তিস্তার চরে যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে এত দূর থেকে ঠাওর করা যাচ্ছে না। যন্ত্রটির আলো এমন স্তিমিত হয়ে এসেছে যে, দুহাত দূরেও সেটা পৌঁছচ্ছে না। অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এগোবেন না?
এখন কটা বাজে?
দুটো।
এখনও ঘন্টা দুয়েক সময় আছে।
মানে?
ভোর না হওয়া পর্যন্ত এই যন্ত্রটি সক্রিয় থাকে।
তা থাকে, কিন্তু তার সঙ্গে এগিয়ে ব্যাপারটা দেখার কী সম্পর্ক?
অবনীবাবু প্রশ্নটি করা-মাত্র তিস্তার চরে আলো জ্বলে উঠল। অদ্ভুত নীল আলো। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটির আলো জোরালো হল। নীল আলোটি চর ছেড়ে ধীরে-ধীরে অর্জুনদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। অবনীবাবু উত্তেজিত হলেন, আরে ভাই, ওটা এদিকে আসছে, কী করবেন?
অর্জুন বলল, কিছু করার নেই। বালির ওপরে শুয়ে পড়ুন।
কথা শেষ হওয়ামাত্রই অবনীবাবু সাষ্টাঙ্গে শুয়ে পড়লেন। নীল আলোটা একটা বিশাল বেলুনের চেহারা নিয়ে এগিয়ে আসছিল। অর্জুন যন্ত্রটিকে মাটিতে রেখে খানিকটা তফাতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। নীল আলোর বেলুনটা তখন মাত্র কুড়ি গজ দূরে। সামনে তাকানো যাচ্ছে না। সেই নীল জ্যোতিতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।
নীল আলোর বেলুনটা ধীরে-ধীরে বালির ওপর নামল। অর্জুন দু হাতে চোখ ঢেকে আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। তার মনে হল বেলুনের ভেতরে শিম্পাজির মতো একটা কিছু বসে আছে। বেলুন স্থির হলে সেটা ওইরকম ভঙ্গি করে। প্রাণীটির মুখ দেখা যাচ্ছে না আলো পেছনে থাকায়, কিন্তু ওর দুটো কান যে অস্বাভাবিক রকমের বড়, তা বোঝা যাচ্ছে। প্রাণীটি খানিকটা স্থির থেকে আবার পর-পর দুবার ঝুঁকল। একটু অপেক্ষা করল যেন। অর্জুন বুঝতে পারছিল না এমন ক্ষেত্রে কী করা উচিত। এবার প্রাণীটির হাতে কিছু একটা জ্বলে উঠল যার আলোর রেখা সোজা এগিয়ে এল যন্ত্রটির গায়ে।
অর্জুন দেখল আলোটা বারংবার যন্ত্রের গায়ে লেগে পেছনে যাচ্ছে। যেন প্রাণীটি মরিয়া হয়ে যন্ত্রটিকে সচল করতে চাইছে অথচ যন্ত্রটি সাড়া দিচ্ছে না। প্রায় মিনিট দশেক ধরে এইরকম চলার পরে প্রাণীটি আবার বেলুনের মধ্যে ফিরে গেল। এবং সেইসময় অর্জুন পরিষ্কার সিগন্যালিং সাউন্ড শুনতে পেল। পাশ থেকে অবনীবাবু বলে উঠলেন, শুনতে পাচ্ছেন?
অর্জুন চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ।
তা হলে কি আমরাও?
না। এটা অনুভূতিতে নয়, পরিষ্কার কানে শুনেছি। ও বেলুনে ফিরে গিয়ে শব্দটা করছে যন্ত্রটাকে সচল করতে। অর্জুন বলল।
কিন্তু প্রাণীটির সব চেষ্টা বিফলে গেল। যন্ত্রটি আগের মতোই পড়ে রইল।
এইবার সেই প্রাণীটি যেন মরিয়া হয়ে নীল আলোর বেলুন থেকে বেরিয়ে এল। অর্জুন দেখল, ওটা এদিকে এগিয়ে আসছে। যন্ত্রটির সামনে যখন ওটা পৌঁছে গেছে তখন স্পষ্ট দেখতে পেল। প্রাণীটির শরীরে কোনও লোম নেই। স্পিলবার্গের ছবির মতো বেঁটেখাটো চেহারা, কান দুটো অসম্ভব বড়। মুখের আদল চৌকো, নাক, চোখ, ঠোঁট বোঝা যাচ্ছে না। প্রাণীটি যন্ত্রটিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে যেন খুব হতাশ হল। তারপর সেটিকে শায়িত অর্জুনের সামনে বালিতে রেখে হাত রাখল সেই জায়গায়, যেখান থেকে কিছু খুলে নেওয়া হয়েছে বলে মহাদেব সেন মন্তব্য করেছেন। অর্জুন হতভম্বের মতো উঠে বসল। ওর মনে হল প্রাণীটি তাকে জিজ্ঞেস করছে যন্ত্রের বাকি অংশ কোথায় গেল? তার উত্তর দেওয়া দরকার।
সে মাথা নাড়ল। নাড়তেই প্রাণীটিও মাথা নাড়ল। অর্জুন দুপাশে নেড়েছিল, প্রাণীটি ওপর-নীচে। অর্থাৎ, অর্জুনের কথা সে বিশ্বাস করেনি।
অর্জুন এবার পরিষ্কার বলল, আমি কিছুই জানি না।
প্রাণীটি স্থির হয়ে রইল। তারপর দু হাতে মুখ ঢাকল।
এই সময় অর্জুনের কানে এল অবনীবাবু বলছেন, ধরে ফেলুন মশাই। জাম্প, জাম্প।
অর্জুন কিছু বলার আগে প্রাণীটি হাত সরিয়ে প্রসারিত করতেই অবনীবাবু কোঁক করে একটা শব্দ তুলে স্থির হয়ে গেলেন।
প্রাণীটি এবার অর্জুনের মুখখামুখি হল। তার হাত একবার যন্ত্রে আর-একবার নিজের বুকে ঘুরে আকাশটাকে দেখাতে লাগল। কয়েকবার এমন দেখানোর পর অর্জুন বলল, এই যন্ত্রটা সম্পূর্ণ হলে তুমি আকাশে যেতে পারবে?
প্রাণীটি স্থির হয়ে রইল খানিক। তারপর আবার একই ভঙ্গি করতে লাগল।
অর্জুন বলল, বুঝতে পেরেছি। এই যন্ত্রটাকে সম্পূর্ণভাবে পাওয়া দরকার, তাই তো? বলার সময় ওর হাতও নড়ছিল।
প্রাণীটি এবার যেন খুশি হল। এই খুশির প্রকাশ বোঝা গেল ওর দুটো হাত পরস্পরকে আঘাত করে করতালির মতো আওয়াজ তোলাতে। যন্ত্রটাকে অর্জুনের দিকে সরিয়ে দিয়ে সে তিস্তার চর হাত তুলে দেখাল।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, বুঝতেই পারছি তুমি গ্রহান্তরের প্রাণী। কোন গ্রহ?
প্রাণীটি মাথা গুঁজে রইল।
তুমি পৃথিবীতে কেন এসেছিলে?
প্রাণীটি এরও জবাব দিল না। অর্জুনের মনে হল বাংলা ভাষাটাকে ও রপ্ত করতে পারেনি। মজা করার জন্যে সে বাংলা স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের সবকটা অক্ষর আবৃত্তির ভঙ্গিতে আওড়ে গেল। সেই সময় প্রাণীটির কান খাড়া হয়ে উঠল। অর্জুন শেষ করতেই প্রাণীটি স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণগুলো পর-পর উচ্চারণ করে গেল। যেন অর্জুন ওগুলো টেপ রেকর্ড করেছিল, এবার বাজানো হচ্ছে।
অর্জুন বলল, এগুলো বাংলা অক্ষর। এর ওপরে আমাদের ভাষা দাঁড়িয়ে।
অনেক ধন্যবাদ। অর্জুন স্পষ্ট শুনতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেল, আপনি আমাদের ভাষা এর মধ্যেই শিখে গেলেন?
খুব সহজ ভাষা।
আমার শুনতে ভাল লাগল। কিন্তু ওঁকে আপনি কী করলেন?
তখন আপনার ভাষা আমি জানতাম না। ওঁর কথা থেকে মনে হয়েছিল মতলব ভাল নয়। কিছুক্ষণ বাদে ঠিক হয়ে যাবেন।
আমি বুঝতে পেরেছি এই যন্ত্রটা কাজ করছে না ঠিকভাবে, তাই তো?
হ্যাঁ। এর সঙ্গে আর-একটা অংশ ছিল। ওটা না পেলে আমি এই গ্রহের আবর্ত ছেড়ে বেরোতে পারব না। আমার হাতে বেশি সময় নেই।
আপনি এখানে এসেছিলেন কেন?
প্রাণীটি হাত নাড়ল এমনভাবে, যাতে বোঝা গেল সে উত্তর দেবে না। তারপর বলল, আমি একটা জলের ধারেব শহরে নেমেছিলাম। কৌতূহল হয়েছিল। ফিরে যাওয়ার সময় আকাশে উঠে আবিষ্কার করলাম ওটা আমার সঙ্গে নেই। তারপর থেকে আমি খবর পাঠাতাম, ওটা তা গ্রহণ করত। কিন্তু আমাকে ফিরিয়ে দিত না। সেই জলের ধারের শহর থেকে শেষপর্যন্ত ওকে অনুসরণ করে এখানে আমাকেও আসতে হল। তোমাকে খারাপ বলে মনে হচ্ছে না। ওর বাকি অংশটি পেতে তুমি আমাকে সাহায্য করবে?
নিশ্চয়ই। আমার সন্দেহ হচ্ছে কার্ভালো নামের একটি লোক সেটা নিয়ে অসমে গিয়েছে। লোকটা না ফেরা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু আমার সময় নেই। এর মধ্যে আমার সন্ধান শুরু হয়ে গেছে। অসম কোথায়?
অনেক দূরে। অবশ্য আমাদের হিসেবে।
আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।
কিন্তু কার্ভালোকে আমি চিনি না, যে চেনে তাকে নিয়ে আসতে হবে।
আনো। রোজ রাত্রে আমি এই যন্ত্রটাকে চালু করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু একই সঙ্গে অন্য যন্ত্র সাড়া দিত। ফলে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
ওহো, সেটা অন্য যন্ত্র নয়। আমাদের শহরে দুজন মানুষ আপনার পাঠানো শব্দ শুনতে পেত। কিন্তু আমরা পেতাম না। এটা কী করে সম্ভব?
আমি জানি না। হয়তো ওদের মস্তিষ্কের গঠন এই যন্ত্রটির মতো।
দুজনের দুরকম অসুখ ছিল। আপনার এই যন্ত্রের সঙ্গে থেকে সেই অসুখগুলো কমে গিয়েছিল। কিন্তু দিন বাড়তেই আবার সেগুলো ফিরে আসে।
স্বাভাবিক। ওরা শুধু যন্ত্রটার প্রভাবে পড়েছিল। ওদের এখানে নিয়ে এলে ভাল কাজ হত। তুমি ভাল লোক, আমার উপকার করো। কাল রাত্রে এখানে এসে ওই যন্ত্রটাকে সম্পূর্ণ করে। আজ চলি।
অর্জুন দেখল অদ্ভুতদর্শন প্রাণীটি সেই নীল বেলুনের মতো জিনিসটায় ফিরে গেল। বেলুন ধীরে ধীরে আকাশে উঠে গেল। তারপর চোখের বাইরে। অর্জুন হতভম্বের মতো বসে রইল কিছুক্ষণ। এইমাত্র যে ঘটনা ঘটে গেল তা শুনলে যে কোনও মানুষ তাকে পাগল বলবে।
ভোর হয়ে আসছে। সে উঠে অবনীবাবুর পাশে গিয়ে কয়েকবার ডাকলেও তিনি সাড়া দিতে একটু দেরি করলেন। জামার বোম খুলে দিয়ে অর্জুন বসিয়ে দিতে চেষ্টা করল। অবনীবাবুর ঘুম ভাঙছিল না। অন্ধকার নদীর চরে নামল সে। পুবের আকাশ ইতিমধ্যেই লালচে ছোপ মাখছে। অর্জুন দেখল, তিস্তার চরে কোনও প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। একটু আগে যে কিছু আবছা দেখছিল, তা যেন এখন উধাও হয়ে গিয়েছে। সুনসান বালিব চরে এখন। হাওয়ারা উত্তাল। অনেকটা হাঁটার পরে সে জলের কাছে পৌঁছল। কোনও পাত্র নেই, পকেট থেকে রুমাল বের করে ভাল করে ভিজিয়ে সে দ্রুত ফিরে এল অবনীবাবুর কাছে। এই সময় শেয়াল ডেকে উঠল। এতক্ষণ শিয়ালগুলো কোথায় ছিল?
অবনীবাবুর সম্বিৎ ঠিকমতো ফিরতে আকাশে যেন আলোর জলসা বসে গেছে। কত রং আর রঙের মিশেল। এখন আর অন্ধকার নেই। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি হাঁটতে পারবেন?
নিজের এই অবস্থার জন্যে বেশ লজ্জিত অবনীবাবু বললেন, হ্যাঁ, তা পারব।
ওঁকে কোনওমতে ধরে-ধরে তিস্তা ব্রিজের কাছে নিয়ে আসতেই অর্জুন একটা টেম্পো পেয়ে গেল। এই ভোরে টেম্পোটা ময়নাগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ির দিকে যাচ্ছে। হাত দেখাতেই সেটা দাঁড়িয়ে গেল। অবনীবাবুকে ড্রাইভারের পাশে বসিয়ে অর্জুন পেছনে উঠল। ড্রাইভার যেই বুঝল তার পাশে দারোগা বসেছে তখনই খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে চালাতে লাগল।
সারারাত জেগে এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা! গত রাত্রেও জাগতে হয়েছিল। তখন একটা প্রায়-ভুতুড়ে ব্যাপার ছিল। কিন্তু আজ? সাইত্মাত্স ফিকশন ছবি বা গল্পকে লোকে ফ্যানটাসি বলে। আজকের এই অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে জানালে কী শুনতে হবে? ওই প্রাণীটি, যদিও প্রাণী বলতে এখন একটু অস্বস্তি হচ্ছে অর্জুনের, মানুষকে আমরা সরাসরি প্রাণী বলে সম্বোধন করি না যখন, তখন মানুষের চেয়ে উন্নত শ্ৰেণীকে কি প্রাণী বলা উচিত? উন্নত যে, তা হাড়ে-হাড়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ওর জন্যে এক ধরনের কষ্ট হচ্ছিল। বারংবার বলছিল যে, ওর বেশি সময় নেই। দলছাড়া, দেশছাড়া হয়ে পৃথিবীর আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওই যন্ত্রটি সম্পূর্ণ না পেলে কোনওদিন ফিরতে পারবে না ও! অর্জুন হাতে-ধরা যন্ত্রটির দিকে তাকাল। অন্ধকার চলে যাওয়ামাত্র এটি আবার নিশ্চল হয়ে গিয়েছে। কোনও আলো জ্বলছে না।
রামচন্দ্র রায়কে যেখানে শুইয়ে রেখে এসেছিল সেখানে পৌঁছে টেম্পো থামাতে বলল অর্জুন। নীচে নেমে চারপাশে দেখল। ভদ্রলোক কোথাও নেই। এমনকী ওই সুটকেসটাকেও চোখে পড়ছে না। অবনীবাবু এখন অনেকটা সুস্থ। তিনিও নামলেন, গেলেন কোথায় ভদ্রলোক?
বোধ হয় ঘুম ভাঙার পর বাড়ি ফিরে গেছেন! অর্জুন বলল।
অর্জুনবাবু। হঠাৎ অবনীবাবুর গলা অন্যরকম শোনাল।
বলুন।
আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?
নিশ্চয়ই।
গতরাত্রের কথা কাউকে বলবেন না। আমি যে কী করে এমন একটা স্বপ্ন দেখে শরীর খারাপ করে ফেললাম, তা এখন মাথায় ঢুকছে না। ওপরওয়ালারা জানতে পারলে আমার সার্ভিস বুকে নোট দেবে। মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে।
আপনার মনে হচ্ছে আপনি স্বপ্ন দেখেছেন?
তা ছাড়া আর কী! নীল আলো, অদ্ভুত জীব, হাত নাড়ল আর আমার জ্ঞান নেই?
ঠিকই। কিন্তু এটাকে আপনার স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে কেন?
তার মানে? আপনি কি বলতে চান এগুলো সত্যি ঘটেছে?
সত্যি না হলে আপনি অসুস্থ হলেন কী করে?
ও। ওই জীবটি আমাকে আহত করেছে?
হ্যাঁ।
কেন? আমার কথা ও বুঝতে পেরেছিল নাকি?
অনুমান করেছিল। আপনার গলার স্বরে ও অনুমান করেছিল আপনি আক্রমণ করতে বলছেন।
বিশ্বাস করতে পারছি না। আর হাত নাড়তেই আমি পড়ে গেলাম। গুলি করল না, ছুরি মারল না অথচ আহত হলাম। কিন্তু এখন কোনও চিহ্ন নেই শরীরে।
আপনাকে নিঃসাড় করে দিয়েছিল।
জীবটি সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
আমাদের পৃথিবীর কেউ নয়। আমরা ওর মতো উন্নত নই।
আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।
অর্জুন কথাটা শুনে হাসল, আচ্ছা অবনীবাবু, আপনাকে যদি জাপানি ভাষার অ্যালফাবেটগুলো কেউ একবার শোনায় তা হলে তৎক্ষণাৎ আপনি জাপানি বলতে পারবেন?
দূর! তা কি সম্ভব?
আমার মুখে বাংলা অক্ষরগুলো শুনেই ও পরিষ্কার বাংলা বলতে পেরেছে। উন্নত না হলে পারত না। চলুন, ফেরা যাক। অর্জুন টেম্পোর দিকে এগোল।
দাঁড়ান ভাই। আপনি বলছেন আমরা গ্রহান্তরের জীবের দেখা পেয়েছিলাম? ওই যন্ত্রটির সঙ্গে গ্রহান্তরের জীবের সম্পর্ক আছে? ও যে সিগন্যাল পাঠাত তা মহাদেব সেন আর রামচন্দ্র রায় শুনতে পেতেন? সেই সিগন্যাল পাঠিয়ে ও তাঁদের প্রায় উন্মাদ করে দিত? আপনি বলছেন এসব সত্যি? অবনীবাবু উত্তেজিত হলেন।
এরা কেন উন্মাদের মতো আচবণ করতেন তা আমি জানি না, কিন্তু বাকিগুলি সত্যি।
অর্জুনের কথা শুনে আকাশে হাত ছুড়লেন অবনীবাবু, মাই গড! এ কথা ঘোষণা করলে পৃথিবীর সব সাংবাদিক আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
অর্জুন ফিরে দাঁড়াল, এখনই এটা আমরা ঘোষণা করব না।
কেন? অবনীবাবু অবাক।
কারণ, আপনার ওপরওয়ালাবা আপনাকে সুস্থ নাও ভাবতে পারেন। আপনি যে কথা বলবেন তার স্বপক্ষে তো কোনও প্রমাণ দিতে পারবেন না।
হঠাৎ যেন বুঝতে পারলেন ভদ্রলোক, ও, হ্যাঁ, তাই তো? কোনও প্রমাণ নেই। ইস, কাল যদি রিভলভারটাকে সঙ্গে নিয়ে বের হতাম। জানেন, আমি ভাল করে ওর মুখটাকে দেখিনি।
ভাল করেছেন। এখন মুখ বন্ধ রাখুন। চলুন।
দেড় কিলোমিটার পথ আসার পর অবনীবাবু চিল্কার করলেন ড্রাইভারের পাশে বসে, অর্জুনবাবু, দেখতে পাচ্ছেন? সুটকেসটা নিয়ে ভদ্রলোক হেঁটে ফিরছেন। দাঁড়াও, দাঁড়াও।
টেম্পো রামচন্দ্র রায়ের পাশে গিয়ে থামল। অর্জুন দেখল ভদ্রলোক বেশ থতমত হয়ে গেলেন। অন্যায় ধরা পড়ে গেলে মানুষের মুখের অবস্থা যেমন হয়। কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠলেন চটপট, আপনারা? এই ভোরে কোখেকে আসছেন?
অবনীবাবু কিছু বলার আগেই অর্জুন বলল, একটু কাজে গিয়েছিলাম। আপনি?
রামচন্দ্র রায় হাসলেন, মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলাম। অনেক দিনের অভ্যেস।
জাহাজে যখন চাকরি করতেন তখন কী করতেন?
সঙ্গে-সঙ্গে যেন নিজের জায়গা পেয়ে গেলেন ভদ্রলোক, আর বলবেন না, ডেকে পায়চারি করতাম। জাহাজের এ-মাথা থেকে ও-মাথা হাঁটতাম।
অবনীবাবু চুপচাপ শুনছিলেন, আপনার হাতে ওটা কী?
হাতে? ও, সুটকেস!
সুটকেস হাতে আপনি মর্নিং ওয়াক করেন বুঝি?
এটা! ভদ্রলোক বিচলিত হলেন, অনেকেই বলেন। কিন্তু নেওয়ার সময় খেয়াল থাকে না।
অর্জুন বলল, উঠে আসুন। আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছি।
না, না, এটুকুই তো পথ, ঠিক চলে যাব।
আপনার বাড়ির সামনে দিয়েই তো যেতে হবে আমাদের। আসুন। অবনীবাবু ওপরে উঠে এসে রামচন্দ্র রায়কে ড্রাইভারের পাশের আসন ছেড়ে দিলেন।
টেম্পো চললে অবনীবাবু বললেন, কীরকম মিথ্যে কথা বললেন, আঁ?
মিথ্যে কথা, কিন্তু না জেনে বলেছেন। কাল রাত্রে কোথায় ছিলেন তা ওঁর খেয়ালই নেই।
তাই নাকি?
আমার তাই বিশ্বাস। উনি যখন হেঁটে গিয়েছিলেন তখনও জানতেন না কোথায় যাচ্ছেন।
নিশির ডাকে লোকে হেঁটে যায় শুনেছি।
এ-ও সেরকম।
রামচন্দ্র রায়ের বাড়ির সামনে টেম্পো থামলে তিনি নামলেন। অর্জুন বলল, আপনি সুটকেসটাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখুন।
রামচন্দ্রবাবু বললেন, কিন্তু সুটকেসটাকে খুব হালকা লাগছে।
কারণ যন্ত্রটা আমার সঙ্গে আছে। এই দেখুন।
রামচন্দ্র রায় তাজ্জব হয়ে গেলেন, কী ব্যাপার বলুন তো?
আপনার কিছুই মনে পড়ছে না?
একদম না।
এক কাপ চা খাওয়ালে ভেতরে গিয়ে আপনাকে সব বলতে পারি।
নিশ্চয়ই। আসুন, আসুন।
অবনীবাবু বললেন, আমাকে বাদ দিতে হবে। কাল রাত থেকে থানার বাইরে আছি। এর মধ্যে কোথাও কিছু হয়ে গেলে শঙ্করের পক্ষে সামলানো মুশকিল হবে। আপনি চা খান, আমি চলি।
অর্জন মাথা নেড়ে নেমে পড়ল টেম্পো থেকে। যন্ত্রটাকে দিতে বলল সে। অবনীবাবু বললেন, এটার তো থানায় থাকা উচিত।
মালিক না পাওয়া গেলে থানায় থাকা উচিত। মনে হচ্ছে মালিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য আপনার যদি দিতে আপত্তি থাকে। অর্জুন হাসল।
মানে, আর কিছু নয়, আমি ওপরওয়ালাকে যন্ত্রটার কথা জানিয়েছি তো! ফট করে কেউ যদি চলে আসে তখন অপ্রস্তুত হব। আপনার যদি তেমন দরকার না থাকে তা হলে আমি ভল্টে রেখে দিতে পারি। আর দরকার হলে না হয় চলে আসবেন।
অর্জুন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
টেম্পো বেরিয়ে গেল।
রামচন্দ্র রায় বললেন, পুলিশরা কাউকে বিশ্বাস করে না, না?
অর্জুন বলল, নিরাপদে রাখাই তো ভাল। যাক গে, আপনার মাথার পেছনে, জামায় প্রচুর ঘাসের টুকরো লেগে আছে। রাত্রে ঘুমিয়েছিলেন কোথায়?
নিজের শরীরে হাত বোলাতে-বোলাতে ভদ্রলোক বোকার মতো তাকালেন। অর্জুন হেসে বলল, চলুন ভেতরে যাই। এক কাপ চা খেয়েই চলে যাব। এখন ঘুম দরকার।
রামচন্দ্র রায় বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করতে গিয়ে থমকে গেলেন, আরে, তালা দেওয়া নেই?
অর্জুন দেখল, তালাটা একটা কড়ায় ঝুলছে বন্ধ অবস্থায়, দুটো কড়াকে আটকায়নি। সে দরজা ঠেলল। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি তালা দিয়েছিলেন?
না দিয়ে বের হব কেন?
কখন বেরিয়েছিলেন?
কখন? মনে পড়ছে না।
আপনি বিকেলে বেরিয়েছিলেন। তারপর আর বাড়িতে ফেরেননি। কাল রাত্রে বাইপাসের পাশে একটা গাছের তলায় ঘুমিয়েছিলেন। এসব আমরা জানি। তাই বিকেলে বেরোবার সময় তালা দেননি। তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ঘরের সব আলো জ্বেলে রেখে গিয়েছিলেন। দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছিল। তার কারণ কাল রাত্রে আপনার মাথায় ওগুলো নেভানোর কথা ঢোকেনি।
তাই যদি হয়, ভেতর থেকে বন্ধ কেন?
আর কোনও দরজা আছে?
না, একটাই দরজা। ভেতরে উঠোনের পাশে পাঁচিল।
অর্জুন এবার দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। এই সময় পাশের বাড়ির এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, এই যে মিস্টার রায়, সারারাত কোথায় ছিলেন?
এই একটু…। রামচন্দ্রবাবু উত্তর খুঁজে পেলেন না।
আবার সেই সুটকেস! যাক গে, কাল ঘরদোর খোলা রেখে চলে গিয়েছিলেন? চুরি হয়ে যেতে পারত মশাই। সন্ধের পর আপনার বন্ধু এসে দেখেন সব ভোলা। তখন তিনি বলাতে আমরা জানতে পারি। ভদ্রলোক বললেন।
বন্ধু? কোন বন্ধু? রামচন্দ্র রায় হতভম্ব।
তা জানি না। একদিন দেখেছিলাম আপনার সঙ্গে এই বাড়িতে। রাত্রে কিছু খেলেন না তিনি। ওঁকেই বলেছিলাম ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়তে। মনে হয় একটু নেশাটেশা করেন, তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হচ্ছে। আওয়াজ করুন। ভদ্রলোক চলে গেলেন। রামচন্দ্র রায় বললেন, যাচ্চলে। কে এসে ঘুমোচ্ছে এখানে?
বিস্তর শব্দ করার পর ভেতরে মানুষের সাড়া পাওয়া গেল।
দরজাটা খুলছে। অর্জুন দেখল খুব রোগাপটকা একটি মানুষ ঘুমচোখে দাঁড়িয়ে। সঙ্গে-সঙ্গে রামচন্দ্র রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। উনি যে ভাষায় কথা বললেন তা অর্জুনের বোধগম্য হল না। লোকটাও হাঁ-হাঁ করে উঠল। দুজনে নিজেদের উত্তেজনা কমাতে কিছুক্ষণ সময় নিল। এবার রামচন্দ্রবাবু অর্জুনের দিকে ফিরলেন, এই ব্যাটাই হল কার্ভালো। কাল সন্ধেবেলায় অসম থেকে ফিরেছে।
অর্জুন হাত বাড়াল, পরিচয় পেয়ে খুশি হলাম।
ভদ্রলোক হাত মেলালেন, আমিও।
রামচন্দ্র রায়ের চেহারাই যেন পালটে গিয়েছে। তিনি বাড়িতে ঢুকে হইহই করতে লাগলেন। তিনি যে মাঝে-মাঝে কার্ভালোর মাতৃভাষায় কথা বলছেন তাও অর্জুনকে বলে ফেললেন। মুখে জলটল দিয়ে চা পেতে মিনিট কুড়ি লাগল। চায়ে চুমুক দিয়ে চেয়ারে বসে অর্জুন কার্ভালোকে বলল, আপনার ফিরতে খুব দেরি হয়ে গেল, তাই না?
হ্যাঁ। দেরি হয়ে গেল। কার্ভালোর গলার স্বর খুব মিহি।
আগে তো জাহাজে কাজ করতেন, এখন কী, ব্যবসা?
অ্যাঁ, হ্যাঁ, ওইরকমই। বয়স হচ্ছে আর কি তেমন পারি? এবং এতক্ষণে কার্ভালোর খেয়াল হল, রায়, আমার সুটকেসটা নিয়ে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
সুটকেস? ওটা একটা শয়তান। শয়তান রেখে গিয়েছিলে তুমি আমার কাছে। জাহাজে চাকরি করার সময় আমাকে যেমন জ্বালাতে, এখনও তাই করছ! প্রচণ্ড রেগে গেলেন ভদ্রলোক।
কার্ভালো অবাক, কেন, কী হয়েছে?
কী হয়েছে তুমি জানো না?
কী করে জানব? আমি কি এখানে ছিলাম?
ওই যন্ত্রটার কথা তুমি জান না? থার্মোকলের ভেতর যেটা প্যাক করে রেখেছিলে?
কেন, যন্ত্রটা কী করেছে?
কী করেছে? আবার প্রশ্ন করছ?
বিশ্বাস করো, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
রোজ সন্ধেবেলায় আমার কানে বিপ বিপ শব্দ বাজত। রাত যত বাড়ত শব্দটাও বেড়ে যেত। তারপর একসময় কানে তালা লাগার উপক্রম। তখন আর কিছু খেয়াল থাকত না। সারারাত কী করতাম আমি জানি না। তখন মানুষ খুন করে ফেললেও টের পেতাম না। বুঝতে পারছ। রোজ হত, রোজ।
শুধু তোমাকেই ওটা এমন করত?
হ্যাঁ। আর কাউকে নয়। অর্জুনকেও নয়। না, পরে আর একজনকে করেছিল।
স্ট্রেঞ্জ। যন্ত্রটা কোথায়?
পুলিশের কাছে।
পুলিশ? চমকে উঠল কার্ভালো, পুলিশ এর মধ্যে এল কী করে?
আসবে না? আমিই গিয়ে বলেছি ওই যন্ত্রটার মালিক তুমি। পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। কার্ভালোকে এবার খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সে সুটকেসটার দিকে তাকাচ্ছিল বারংবার।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি যন্ত্রটা কোথায় পেলেন?
আমি পেলাম, মানে?
যন্ত্রটা আপনার সুটকেসে ছিল।
হ্যাঁ ছিল। কিন্তু তার মানে এই নয় আমি পেয়েছি।
কিন্তু ওটা এমনি-এমনি আপনার সুটকেসে ঢুকে পড়তে পারে না।
প্রশ্ন শুনে কার্ভালো প্রথমে গোঁজ হয়ে রইল।
রামচন্দ্র রায় বললেন, কার্ভালো, তুমি কি কোনও গোলমালে পড়েছ?
কার্ভালো মাথা নাড়ল, হ্যাঁ ভাই। পড়েছি। কিন্তু সত্যি কথা বললে কি তোমরা বিশ্বাস করবে?
আমরা এতদিন একসঙ্গে কাজ করেছি, তখনও মিথ্যে কথা বলিনি কেউ, আজ কেন তুমি বলতে যাবে? রামচন্দ্র রায় খুবই আন্তরিক গলায় কথাগুলো বললেন।
কার্ভালো অর্জুনের দিকে তাকাল, সারাজীবন যা রোজগার করেছি তা হেসেখেলে উড়িয়ে দিয়েছি। সঞ্চয় বলতে তেমন কিছুই ছিল না। ইদানীং বেশ অর্থকষ্টে দিন যাচ্ছিল। এই বয়সে নতুন করে কাজকর্ম শুরু করা খুবই মুশকিল। আপনি হয়তো জানেন না আমি সমুদ্রের ধারের মানুষ। সমুদ্র ওদিকের বেশ কিছু মানুষকে অন্ন দেয়। অবশ্যই সেটা বেআইনি পথে। যা কিছু বিদেশি জিনিস রাতের অন্ধকারে সমুদ্রপথে আমাদের ওখানে আসত তাই বয়ে নিয়ে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যে গরিব মানুষেরা টাকা পেত। কিছুই না পেয়ে শেষপর্যন্ত আমি ওই বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করব বলে স্থির করলাম।
কার্ভালো থামতেই রামচন্দ্র রায় চিৎকার করে উঠলেন, ছি ছি ছি। কার্ভালো, তুমি শেষপর্যন্ত স্মাগলারদের দলে ভিড়েছ?
ভিড়িনি। চাইলেই যে ওরা আমাকে কাজ দেবে ভাবছ কেন? ওরা আমাকে প্রথমে যাচাই করবে, আমার সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইবে। তা ছাড়া ঠিক কাকে বললে কাজটা পাওয়া যায় তাও জানতাম না। রাত্রে সমুদ্রের ধারে কেউ যেত না। আমাদের ওখানে প্রবাদ আছে তোমার যদি সমস্যাহীনতার কষ্ট বেশি হয় তা হলে মাঝরাত্রে সমুদ্রের ধারে গিয়ে দাঁড়াও। একরাত্রে আমি গেলাম। এলোমেলো ঘুরলাম। হঠাৎ শুনি একটা লোক যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বালির ঢিবির আড়ালে। কৌতূহলী হয়ে কাছে যেতেই সে আমাকে গুলি করতে চাইল। আমি তাকে বললাম, আপনার যন্ত্রণা শুনে এসেছি, আমার অন্য মতলব নেই। দয়া করে আমাকে মারবেন না। নিজের পরিচয় দিতে হল। কাছাকাছি আমার বাড়ি শুনে সে জিজ্ঞেস করল আমি তাকে সাহায্য করতে পারি কি না! আমি রাজি হলাম। আমার শরীরের ওপর ভর দিয়ে লোকটা কোনওমতে বাড়িতে এল। দেখলাম ওর পায়ে ক্ষতচিহ্ন। সম্ভবত গুলি লেগেছে। কিছুতেই সে সেটা বলল না। লোকটার নাম হেম বড়য়া, বাড়ি গুয়াহাটির কাছে। কার্ভালো থামল।
আপনি হেম বড়য়ার কাছে গিয়েছিলেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। সেটা পরে বলছি। হেম কিছুতেই ডাক্তার ডাকতে দেবে না। তার ধারণা ডাক্তার ফিরে গিয়ে পুলিশকে খবর দেবেই। অথচ ক্ষতর চেহারা খুব খারাপ দেখাচ্ছিল। আমার বাড়িতে আসার সময় ও একটা বড় থলি এনেছিল। থলিটাকে ও ছুঁতে দিত না। দ্বিতীয় দিনে হেমের জ্বর এল। আমার পরিচিত এক ডাক্তারকে ডেকে আনতে বাধ্য হলাম। তিনি দেখে বললেন, তখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে। নইলে পা বাঁচানো যাবে না। কিন্তু হেম কিছুতেই হাসপাতালে যাবে না। ডাক্তার সাধারণ ওষুধ দিয়ে আমাকে আড়ালে বলে গেল এমন রোগীকে যেন বাড়িতে না রাখি। সেই রাত্রে আমার সামনে হেম ওই যন্ত্রটাকে থলি থেকে বের করল। করে বলল, এটা কী ধাতু দিয়ে তৈবি জানো?
বললাম, না।
সে বলল, তুমি মানুষটা খারাপ নয় তাই বলা যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ধাতু এটা। বিক্রি করলে কোটি টাকা পাওয়া যাবে।
জানতে চাইলাম, জিনিসটা কী?
এর জন্যেই তো গুলিটা লাগল। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার ঘণ্টাতিনেক আগে আমি একটা জিনিস নিতে সমুদ্রে এসেছিলাম। মাইকেলের নাম শুনেছ? এ-তল্লাটের এখন ওই সেরা স্মাগলার। মাইকেলের সঙ্গেই কাজ ছিল। আমি আর মাইকেল যখন কথা বলছি তখন হঠাৎ আকাশে নীল আলোর বেলুন দেখতে পেলাম। বেলুনটা নীচে নামল। আমাদের থেকে একশো গজ দূরে। কিছু একটা বেলুন থেকে বেরিয়ে এল। মাইকেল ব্যাপারটা দেখে মিনিটখানেক সময় নিল। আমিও কৌতূহলী হয়ে উঠেছি। আমরা দুজনেই দৌড়লাম বেলুনের দিকে। আর যেহেতু আমি ভাল দৌড়তাম তাই এগিয়ে গেলাম। মাইকেল মরিয়া হয়ে আমাকে গুলি করল। আমি পড়ে গেলাম। মাইকেল আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে গেল। ওই অবস্থাতেও দেখলাম বেলুন আকাশে উঠে গেল। মাইকেলের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। মিনিট পনেরো বাদে আমি কোনওমতে নিজেকে টেনে নিয়ে গেলাম সামনে। মাইকেলের শরীরের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখলাম, এই জিনিসটা বালির ওপর পড়ে আছে। পাতলা অন্ধকারেই এটা এমন চকচক করছিল যে, বুঝলাম এর মূল্য অনেক। এর শরীর থেকে অদ্ভুত এক আলো বের হচ্ছিল। আমি যন্ত্রটাকে নিয়ে কোনওরকমে ফিরে আসি যেখানে মাইকেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মাইকেলের একটা ব্যাগে এটাকে পুরে একটা বালির ঢিবির পাশে শুয়ে পড়েছিলাম আমি। গতরাত্রে এই ঘরে শুয়ে আবার জিনিসটা দেখলাম। অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু। কিন্তু এটা আমি অসমে নিয়ে যেতে চাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে? যা দাম পাব তার টেন পার্সেন্ট তোমাকে দেব। বলো রাজি আছ?
কিন্তু আপনি এই শরীর নিয়ে আসামে যাবেন কী করে?
আমি মরব না। হাসপাতালে গেলেই পুলিশ আমাকে ধরবে। আর যদি মরেই যাই তা হলে আমি ঠিকানা দিচ্ছি, সেই ঠিকানায় এইটে পৌঁছে দেবে। তারা যে টাকা দেবে তার নব্বইভাগ তুমি আমার পরিবারকে দেবে। কথা দাও।
আমি রাজি হলাম। সে আমাকে দুটো ঠিকানা লিখে দিল। এইভাবে হঠাৎই টাকা রোজগারের সুযোগ আসায় আমি খুব আনন্দিত হলাম। কিন্তু সেই রাত্রে ওর অবস্থা এত খারাপ হল আমি হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে পারিনি। পরে খবর নিয়ে জেনেছি ওর ডান পা বাদ দিতে হয়েছে। পুলিশ ওকে গ্রেফতার করেছে। আমার ভয় হত আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পুলিশ আমাকেও ধরবে। তাই আমার সুটকেসে ওটাকে ভরে অসমে যাব বলে বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতায় এসে মনে পড়ল রায় এখানে আছে। তাই একটা রাত ওর কাছে কাটিয়ে আমি গুয়াহাটি চলে গিয়েছিলাম।
সম্পূর্ণ যন্ত্রটাকে নিয়ে যাননি কেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
তার মানে? কার্ভালো চমকেউঠল।
আপনি জানেন। যাওয়ার আগে আপনি সুটকেস খুলেছিলেন। যন্ত্রটার আর-একটা অংশ আপনি বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু কেন? অর্জুন স্পষ্ট বলল।
কার্ভালো মুখ নিচু করল। তারপর বলল, আপনি বুঝতে পেরেছেন দেখছি। হ্যাঁ, ঠিক তাই। বাড়িতে বসেই দেখেছিলাম মূল যন্ত্রটার গায়ে আর-একটা যন্ত্র লাগানো আছে। দুটোই একই ধাতুতে তৈরি। সেই ছোট যন্ত্রটিকে খুলে আমি অসমে নিয়ে যাব বলে ঠিক করলাম। যদি ওখানে ভাল দাম পাই তা হলে বাকিটাকে নিয়ে যাব। রায়ের কাছে রেখে গেলে সেটা কখনওই হাতছাড়া হবে না বলে বিশ্বাস ছিল।
বিশ্বাস ছিল? রামচন্দ্র রায় চিৎকার করে উঠলেন, তুমি আমাকে পাগল হওয়ার আয়োজন করে চলে গেলে, আর বলছ বিশ্বাস ছিল।
কার্ভালো বলল, আমি এইটে বিশ্বাস করতে পারছি না। এই যন্ত্র কী করে তোমাকে পাগল করবে? আর শুধু তোমাকেই করবে কেন?
অর্জুন বলল, এ নিয়ে অনেক ভেবেছি আমরা। পরে শুনবেন। কিন্তু হেম বড়য়ার যে লোকের কাছে ওটা বিক্রি করেছেন তার ঠিকানাটা বলুন।
বিক্রি? কে বলল বিক্রি করেছি?
তার মানে? কী করেছেন ওটা নিয়ে?
ফিরিয়ে এনেছি।
অর্জুন উল্লসিত হল, গুড। কী ভাল কাজ করেছেন আপনি জানেন না। কোথায় সেটা?
কেন?
আগে দেখান, তারপর বলছি।
কার্ভালো একটা ব্যাগ খুলল। তার মধ্যে কাপড়ের পুঁটলি। তার ভেতর থেকে টর্চ লাইটের আকৃতির একটি ধাতব যন্ত্র বের করল সে। অর্জুন কার্ভালোর হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটাকে বিক্রি করেননি কেন?
আমি গুয়াহাটিতে পৌঁছবার দিন-দুই আগে মাইকেলের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ লোকটাকে গ্রেফতার করেছিল। আমি শহরে পৌঁছতেই পুলিশ আমার পেছনে লাগে। অনেক কষ্ট করেছি ওদের চোখে ধূলো দেওয়ার। আমার পকেটের পয়সাও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কার্ভালো বলল।
এত দেরি করলে কেন এখানে ফিরতে? রামচন্দ্র রায় জিজ্ঞেস করলেন।
পুলিশের ভয়ে। রাজাভাতখাওয়া নামের একটা জায়গায় ধর্মশালায় অন্য নাম নিয়ে পড়ে ছিলাম কিছুদিন। তারপর আমি কুচবিহারে। আমার দ্বারা স্মাগলিং ব্যবসা হবে না। কিন্তু তুমিও পুলিশকে সব বলে দিয়েছ। এখন আর আমার পরিত্রাণ নেই। কার্ভালো খুব দুঃখের সঙ্গে নিঃশ্বাস ফেলল।
কিন্তু তুমি তো কোনও বড় অন্যায় করনি? রামচন্দ্র রায় বললেন।
পুলিশ সেকথা বিশ্বাস করবে বলে ভেবেছ? করবে না। মাথা নাড়ল কার্ভালো।
অর্জুন যন্ত্রটিকে দেখছিল। আগাগোড়াই ধাতব বস্তুতে মোড়া। নীচে একটা আংটা রয়েছে। ওর মনে পড়ল যে যন্ত্র নিয়ে অবনীবাবু চলে গিয়েছেন, তার গায়ে এমন একটা ব্যবস্থা ছিল। অথাৎ, এই বস্তুটি ওই যন্ত্রের গায়ে আটকে যাবে। সে শুনতে পেল, কার্ভালো তার মাতৃভাষায় কিছু বলল রামচন্দ্রকে। রামচন্দ্রবাবু উত্তর দিলেন কিন্তু সেটা কার্ভালোকে খুশি করল না। এবার রামচন্দ্র রায় অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি মনে হয় পুলিশ কার্ভালোকে অ্যারেস্ট করতে পারে? ও যে অথাভাবে স্মাগলিং বিজনেসে যেতে চেয়েছিল তা সত্যি, কিন্তু ও সেটা আরম্ভ করেনি। এই যন্ত্রটার মালিক কে তাই বোঝা যাচ্ছে না। ও নীল আলোর বেলুনে চাপা একজনের কথা বলছে। সে কে বলে আপনার মনে হয়?
ভিন্ন গ্রহের মানুষ।
আঁ। যাঃ, কী যে বলেন! পৃথিবীর বাইরের কোনও গ্রহে মানুষ আছে নাকি? দানিকেনের গপ্পো নিশ্চয়ই শোনাবেন না। যা বলছিলাম, কাভালোকে একটু সাহায্য করুন। আপনার সঙ্গে দারোগাবাবুর বেশ ভাব আছে, দেখুন না। রামচন্দ্র রায় বললেন।
অর্জুনের ঘুম পাচ্ছিল না আর। দ্বিতীয় যন্ত্রাংশ হাতে পাওয়ার পর বেশ তাজা লাগছিল নিজেকে। সে কার্ভালোকে জিজ্ঞেস করল, নীল আলোর বেলুনটাকে আপনার কী মনে হয়?
আমি তো দেখিনি। মনে হয় ব্যাপারটা সত্যি নয়।
আপনি কী চান?
বাড়ি যেতে চাই। কোনওদিন অন্যায় কাজ করিনি, এবার করার কথা ভেবেছি। কিন্তু সত্যি বলছি, করিনি। আর কখনও করব না।
তা হলে আপনার চলবে কী করে?
জানি না।
আপনি জানেন আপনার ওই যন্ত্রের কল্যাণে রামচন্দ্রবাবুর পায়ের পুরনো বাতের ব্যথা কমে গিয়েছিল। মাঝরাত্রে মাইলের পর মাইল ওই শরীরেও তিনি হেঁটে গেছেন রোজ। অজান্তে একটা উপকার করেছেন আপনি?
এই সময় রামচন্দ্রবাবু ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, কোথায় আর সারল? আজ সকালেই ওটা একটু একটু করে ফিরে আসছে।
অর্জুন উঠল, মিস্টার কার্ভালো, এখন কয়েকটা দিন আপনি আপনার বন্ধুর কাছে বিশ্রাম নিন। উনি যন্ত্রটির অভাবে রাত্রে ঘুমোত পারছেন না। আপনার সঙ্গ পেলে সমস্যাটির সমাধান হবে। যেহেতু এই যন্ত্রাংশটি আপনি যে-কোনও কারণেই তোক ফিরিয়ে এনেছেন, তাই মনে হয় পুলিশ আপনার বিরুদ্ধে কোনও স্টেপ নেবে না। আচ্ছা, চলি, নমস্কার।
কৃতজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠল কার্ভালোর মুখে। অর্জুন যন্ত্রাংশ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। এখন রোদ উঠে গেছে। সে একটা রিকশায় চেপে সোজা কদমতলায় যেতে বলল। আজ বিকেল পর্যন্ত একটানা ঘুমোবার জন্যে ছটফট করছিল সে।