০৪. সব জায়গার আলাদা গন্ধ আছে

সব জায়গার আলাদা গন্ধ আছে। এই জায়গার গান্ধটা বুনো। লতাপাতার কষটা কড়া গন্ধ। তার পরেও লীলার কাছে মনে হলো, কেমন যেন আপন—আপন গন্ধ। যেন অনেক দিন আগে গভীর কোনো জঙ্গলে সে পথ হারিয়ে খুব ছোটাছুটি করেছিল। পথ হারানোর দুশ্চিন্তায় সেই গভীর বনের কিছুই লীলার মনে নেই, কিন্তু লতাপাতার গন্ধটা নাকে লেগে আছে। অনেক দিন পর আবার সেই বুনো ঘাণ পাওয়া গেল। লীলা নিজের মনেই বলল— বাহ, ভালো তো! নিজের মনে কারণে অকারণে বাহ, ভালো তো বলা লীলার অনেক দিনের অভ্যাস।

গন্ধটা কিসের কাউকে জিজ্ঞেস করলে হতো। লীলা তেমন কাউকে দেখছে। না। টিন এবং কাঠের প্রকাণ্ড বাড়িটা প্ৰায় ফাঁকা। তবে এই ফাকাও অন্যরকম ফাকা। মনে হচ্ছে। এ-বাড়ির লোকজন কাছেই কোথাও বেড়াতে গেছে। সন্ধ্যায়সন্ধ্যায় ফিরে আসবে। তখন খুব হৈচৈ শুরু হবে। বাড়ির এত বড় উঠেন। এই উঠোনে ছসাতজন শিশু কাদা মেখে ছোটাছুটি না করলে কি মানায়? কেউ পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদবে, কেউ হাসবে।

সবুজ গেঞ্জি পরা প্রচণ্ড বলশালী একজন লোককে দেখা গেল গভীর কৌতূহলে আড়চোখে লীলাকে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই লোকটা চট করে চোখ নামিয়ে ফেলল। মেঝের দিকে তাকিয়ে খাম্বার মতো হয়ে গোল। যেন সে ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধ করেছে। এই অপরাধের শাস্তি হলো মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা। লীলা বলল, আপনার নাম কী? লোকটা মেঝে থেকে চোখ না। তুলে বলল, সুলেমান!

এই বাড়ির আর লোকজন কোথায়?

চাচাজি ছাড়া এইখানে আর কেউ থাকে না।

বাকিরা কোথায় থাকে?

শহরবাড়িত থাকে।

শহরে থাকে?

জি না। এইখানেই থাকে–শহরবাড়িত থাকে।

আপনার কথা বুঝতে পারছি না। শহরবাড়িত জিনিসটা কী?

সুলেমান আঙুল তুলে দেখাল। যে-জায়গাটা দেখাল সেখানে ঘন বাঁশের জঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। সুলেমান বলতে পারল না যে— শহরবাড়ি হলো শহরের মতো বাড়ি, সে-বাড়িতে সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের ছেলেমেয়েরা থাকে। বেশি কথা বলার অভ্যাস তার নেই। চাচাজির বড় মেয়েটির সামনে কী কারণে যেন তার খুব অসহায় লাগছে।

সুলেমানের সঙ্গে কথা বলে লীলা খুব মজা পাচ্ছে। লোকটা এখন পর্যন্ত একবারও চোখ তোলে নি। মেঝের দিকেই তাকিয়ে আছে। লোকটা আঙুল তুলে শহরবাড়ি কোনদিকে দেখিয়েছে। সেই আঙুল সঙ্গে সঙ্গে নামায় নি। অনেকক্ষণ তুলে রেখেছে। লীলা বলল, আপনি মাটির দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন কেন? আমার সঙ্গে যখন কথা বলবেন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবেন।

জি আচ্ছা।

আমার সঙ্গে যে-মানুষটা এসেছেন। উনি সম্পর্কে আমার মামা হয়। উনি কোথায়?

জানি না।

উনাকে খুঁজে বের করুন। উনার খুব ঘনঘন চা খাবার অভ্যাস। উনাকে চা বানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করুন। চাপাতা, চিনি, দুধ সব উনার সঙ্গে আছে। ভালো চা ছাড়া উনি খেতে পারেন না বলে এই অবস্থা। উনাকে চা বানিয়ে খাওয়াতে পারবেন না?

জি পারব।

আপনি কিন্তু এখনো একবারও আমার দিকে তাকান নি। আমি কে–সেটা জানেন তো? আমি আপনার চাচাজির মেয়ে। যেহেতু আমার বাবাকে আপনি চাচা ডাকছেন— এখন আমি সম্পর্কে হচ্ছি। আপনার বোন। বোনের দিকে চোখ তুলে তাকানো যায়।

সুলেমান এই প্রথম একটু নড়ল। চোখ তুলে এক ঝলক লীলাকে দেখেই চোখ নামিয়ে ফেলল। লীলা মনে মনে হাসল। সুলেমান নামের খাম্বা টাইপ মানুষটা যে লীলার এই কথায় অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাবে তা লীলা জানত। যেরকম ভাবা হয়। ঘটনা সেরকম ঘটলে বেশ মজা লাগে।

এই বাড়িতে শুধু চাচাজি থাকে আর কেউ থাকে না— কথাটা মিথ্যা। কিছুক্ষণের মধ্যেই লীলা তার প্রমাণ পেল। দুটা বেণি দুলানো মেয়েকে দেখা গেল। সারাক্ষণই আড়াল থেকে তাকে দেখছে। হাত ইশারা করে কাছে ডাকলেই তারা সরে যাচ্ছে। এই মেয়ে দুটি কে? বাড়ির শেষ মাথায় একটা ঘরে একজন মহিলাকে দেখা গেল। মহিলা লীলাকে দেখে ভয় পেলেন বলে মনে হলো। মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরের এক কোনায় সরে গেলেন। মাথায় বড় করে ঘোমটা দেয়ায় তার কপাল ঢাকা পড়েছে। চোেখও খানিকটা ঢাকা পড়েছে। তবু বোঝা যাচ্ছে তিনি খুবই কৌতূহল নিয়ে লীলাকে দেখছেন। লীলা বলল, স্লামালিকুম। মহিলা জবাব দিলেন না। মহিলাকে ভালোভাবে দেখতে হলে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। লীলা দরজার কাছে গিয়ে খুবই অবাক হলো। দরজার কড়ায় ভারী একটা তালা ঝুলছে। মহিলাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। লীলা আবারো জানালার কাছে ফিরে গেল। বিস্মিত গলায় বলল, এই যে শুনুন! আপনি কি একটু সামনে আসবেন? আপনার সঙ্গে কথা বলব।

মহিলা আড়াল থেকে বললেন, আমি সামনে আসব না গো মা। আমার লজ্জা লাগে।

আপনাকে তালাবন্ধ করে রেখেছে কেন?

আমার মাথার ঠিক নাই, এই জন্যে তালাবদ্ধ কইরা রাখে। পাগল-মানুষ, কখন কী করি তার কি ঠিক আছে?

লীলা বুঝতে পারছে এই মহিলা কে। তারপরেও সে বোকার মতো বলল, আপনি কে?

আমি মাসুদের মা।

মাসুদটা কে?

মহিলা জবাব দিলেন না। আড়াল থেকেই শব্দ করে হাসলেন। ভদ্রমহিলার অনেক বয়স। কিন্তু তিনি হাসলেন ঝনঝনে কিশোরীর মতো গলায়। লীলা বলল, আমার নাম লীলা।

আমি জানি, তুমি লীলাবতী।

কীভাবে জানেন?

আমি তোমারে খোয়াবে দেখেছি। খোয়াবে তোমারে যত সুন্দর দেখেছি তুমি তার চেয়েও সুন্দর। তয় গায়ের রঙ সামান্য ময়লা। মা গো, গায়ের রঙ নিয়ে মনে কষ্ট রাখবা না।

লীলা বলল, আমার কোনো কষ্ট নাই।

মহিলা বললেন, গায়ের রঙ নিয়া কষ্ট সব মেয়ের আছে, তোমারও আছে। গায়ের রঙ ঠিক করনের উপায় আছে। তুমি জানতে চাইলে বলব।

লীলা বলল, আচ্ছা কী উপায়?

মহিলা হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন— গায়ের রঙ নিয়া তোমার যদি কষ্ট না থাকত, রঙ ঠিক করনের উপায় জানতে চাইত না।

আপনার বুদ্ধি ভালো।

পাগলের বুদ্ধি মা। পাগলের বুদ্ধির কোনো ভালো-মন্দ নাই। গায়ের রঙ ঠিক করনের উপায়টা বলব?

বলুন।

জ্যৈষ্ঠমাসে কালো জামের রস সারা শইল্যে মাখবা। সেই রস শুকাইয়া যখন শইল্যে টান দিব তখন কুসুম কুসুম গরম পানিতে গোসল করবা।

একবার করলেই হবে?

না। যতদিন কালোজাম পাওয়া যায় ততদিন করবা। ইনশাল্লাহ রঙ ফুটব।

আপনি সামনে আসুন, আড়াল থেকে কথা বলছেন আমার ভালো লাগছে না। সামনে এসে মুখের ঘোমটা সরান।

সামনে আসব না মা।

কেন আসবেন না?

আমার লজ্জা করে।

আমি আপনার মেয়ে। মেয়ের সঙ্গে কিসের লজা!

আমি পাগল-মানুষ। পাগল-মানুষ সবেরে লজ্জা করে। নিজের মেয়েরেও লজ্জা করে। তুমি তো আমার নিজের মেয়ে না।

আপনার সঙ্গে কি সবসময় আড়াল থেকে কথা বলতে হবে?

জানি না। মা গো, তুমি এই বাড়িতে কয়দিন থাকবা?

আমি বাবাকে দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়েছে, কাজেই কালপরশু চলে যাব।

আইচ্ছা। তোমারে আমার খুবই মনে ধরেছে। পাগল হওনের পর থাইক্যা কাউরে মনে ধরত না। এই প্ৰথম মনে ধরল। এখন যাও, নিজের মনে বেড়াও। বাড়ির পেছনে বাগান আছে, বাগান দেইখ্যা আসো।

বাগান আপনি করেছিলেন?

না। তোমার পিতার বাগান।

গ্রামের বাড়ির বাগান ঝোপেঝাড়ে ভরতি থাকে। লীলা অবাক হয়ে দেখল বাগানটা বাকবীক করছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগে কেউ এসে বাট দিয়ে শুকনো পাতা সরিয়েছে। সবই দেশী ফুলের গাছ। নানান জাতের জবা ফুলের গাছ। কামিনী গাছ, কাঠগোলাপের গাছ, বেলি ফুলের গাছ। বাঁশের বেড়া দেয়া অনেকখানি জায়গায় গোলাপের চাষ করা হয়েছে। গ্রামের মানুষজন শখ করে গোলাপবাগান করে না। এখানে করা হয়েছে। প্রচুর গোলাপ ফুটেছে। লীলা মুগ্ধ হয়ে গেল।

মাঝামাঝি জায়গায় বাঁধানো কুয়া। কুয়া শহর এবং শহরতলির জিনিস। গ্রামে পুকুর কাটা হয়, কুয়া কাটা হয় না। কুয়ার পাড় বাঁধানো। লীলা তার অভ্যাসমতো বলল, বাহ ভালো তো! বাগানের শেষপ্রান্তে বেদির মতো বানানো। হয়তো বসে বিশ্রাম করার জায়গা। এই জায়গাটা ঝোপঝাড়ে ভরতি। বাগান দেখাশোনার দায়িত্বে যে আছে সে নিশ্চয়ই এখানে আসে না। লীলা বেদিতে বসল। সঙ্গে এক কাপ চা থাকলে ভালো হতো। বেদিতে বসে নিরিবিলি চা খাওয়া যেত। তার সামান্য মাথা ধরেছে। যেভাবেই হোক মাথা ধরাটা দূর করতে হবে। দূর করতে না পারলে মাথার এই যন্ত্রণা একসময় খুব বাড়বে। তার নিজের জগতটা এলোমেলো করে ফেলবে। বাগানের খোলা হওয়ায় হয়তো উপকার হবে। লীলা বেদিতে পা তুলে বসল। তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। শুয়ে পড়লে ক্ষতি নেই, কেউ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে না। বাড়ির পেছনের এই জায়গাটার তিন দিকেই জঙ্গল। একদিকে বাঁশঝাড়, বাকি দুদিকে আমকাঁঠালের বন। এত ঘন করে কেউ আম-কাঠালের গাছ লাগায় না। মনে হচ্ছে ইচ্ছা করেই বন তৈরি করা হয়েছে, যেন বাগানের দিকে কারো চোখ না যায়। লীলা শাড়ির আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল।

মাথার উপরের আকাশ এখনো কালো হয়ে আছে। বড় কেটে গেছে, আকাশের মেঘ এখনো কাটে নি। শুয়ে শুয়ে মেঘলা আকাশ দেখতে ভালো লাগছে। গত রাতটা নানান ঝামেলায় কেটেছে। একফোঁটা ঘুম হয় নি। এখনো যে ঘুম পাচ্ছে তা না, ঝিমঝিম লাগছে। বেলা কত হয়েছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। তার হাতে ঘড়ি নেই। তবে বেলা বেশি হয় নি। এ বাড়িতে সে এসে পৌছেছে। ফজরের আজানের পরপর। খুব বেশি হলে ঘণ্টাখানিক সময় পার হয়েছে। এই একঘণ্টায় অনেক কিছু ঘটে গেল। বাবার সঙ্গে প্রথম দেখা হলো। প্রথম দেখাটা কেমন হবে এ নিয়ে সে অনেককিছু ভেবেছিল। বাস্তবের সঙ্গে ভাবনা কিছুই মেলে নি। তার বাবা বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়েছিলেন। সে বাবার কাছে ঝুঁকে এসে বলেছিল, বাবা আমি লীলা, লীলাবতী। আপনার কি শরীর খারাপ? তিনি তার দিকে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টিতে বিস্ময় ছিল কি না লীলা বুঝতে পারল না। আধো-অন্ধকারে চোখের বিস্ময় ধরা পড়ে না। তবে তাঁর চোখ দিয়ে যে পানি পড়ছিল সেটা দেখা গেছে। চোখের জল অন্ধকারেও চিকচিক করে। হঠাৎ কোনোরকম কারণ ছাড়া সে বাবার জন্যে তীব্র মমতা বোধ করল। কোনোরকম কারণ ছাড়া— কথাটা ঠিক হলো না। বাবার চোখের জল একটা কারণ হতে পারে। মানুষের চোখের জল তীব্র অ্যাসিডের মতো ক্ষমতাধর। কঠিন লোহার মতো হৃদয়ও এই অ্যাসিড গলিয়ে ফেলে। লীলা অসঙ্কোচে তার বাবার বুকের উপর হাত রাখল। মানুষটা একটু কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেলেন। মেয়ের উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বাবা-মানুষটা যেরকম হবেন বলে লীলা ভেবেছিল মানুষটা মোটেই সেরকম না। রোগা ছোটখাটো একজন মানুষ। মুখের চামড়া শক্ত। আবেগশূন্য মানুষ— যারা হাসেও না, কাদেও না— তাদের মুখের চামড়া শক্ত হয়ে যায়। তবে মানুষটার চোখ বড় বড়। আল্লাহ যেসব মানুষকে বিস্মিত হবার জন্যে পৃথিবীতে পাঠান তাদের চোখ বড় বড় করে দেন। কে জানে লীলার বাবাকে তিনি হয়তো বিস্মিত হবার জন্যে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। লীলা তার বাবার একটি ব্যাপারে খুবই অবাক হয়েছে। আবেগকে অতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। যার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তিনি মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে সহজ গলায় লীলাকে বললেন, পরিশ্রম করে এসেছ— ভেতরের বাড়িতে যাও। হাতমুখ ধোও। যেন লীলা এ-বাড়িতে প্রায়ই আসে। তার এই আসা নতুন কিছু না।

ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ হচ্ছে। লীলা চোখ মেলে দেখল তার মাথার উপর চিল উড়াউড়ি করছে। দুটা সোনালি রঙের চিল। চিল আকাশের অনেক উপরে উড়ে। এই দুজন নিচে নেমে এসেছে। চিলের গলার আওয়াজ এত কৰ্কশ হয় তাও লীলা জানত না। সে ধড়মড় করে উঠে বসল। তখনি মনে হলো সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম বেশিক্ষণ হয় নি। হয়তো পাঁচ মিনিট কিংবা দশ মিনিট। কিন্তু তার কাছে মনে হচ্ছে সে দীর্ঘসময় বেদিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ঘুমাবার জন্যে জায়গাটা খুবই আরামের। লীলা বাড়ির দিকে রওনা হলো। মঞ্জু মামার খোঁজ নেয়া দরকার— বেচারা তার চা পেয়েছে কি না। কেউ কি আছে তার সঙ্গে? নাকি সে একা একাই ঘুরছে?

 

মঞ্জুর পা কেটেছে। তিনি শহরবাড়ি নামের পাকা দালানের বারান্দায় মোড়ায় বসে আছেন। তাঁর সামনে আরেকটা মোড়া। সেই মোড়ায় তাঁর কেটে যাওয়া পা রাখা আছে। নয়-দশ বছরের একটি মেয়ে কাটা পায়ের চিকিৎসা করছে। বেশ গুছিয়েই করছে। সে একটা কুপি জ্বলিয়েছে। কুপির আগুনে কাপড় পুড়িয়ে ছাই বানাচ্ছে। সেই ছাই পায়ের কাটা জায়গায় যত্ন করে লাগিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার মুখ গোল। মায়া-মায়া চেহারা। মঞ্জু মেয়েটির আদর-যত্নে মোহিত হলে বললেন, নাম কী গো মা তোমার?

কইতরী।

কইতর থেকে কইতরী? বাহ সুন্দর নাম! তুমি কি সিদ্দিক সাহেবের কেউ হও?

মেয়ে হই।

বলো কী! তুমি সিদ্দিক সাহেবের মেয়ে? উনার মেয়ে হয়ে আমার পায়ের ময়লা পরিষ্কার করছ এটা কেমন কথা?

কিছু হবে না।

মঞ্জু খুশি খুশি গলায় বললেন, কিছু হবে না–এটা ঠিক। বিখ্যাত একটা কবিতা আছে—

বাদশা আলমগীর
কুমারে তাহারে পড়াইত এক মৌলভী দিল্লির…।

কবিতাটা জানো?

জি না!

আমিও তো মাত্র দুই লাইন জানি–ধুনছে আমারে। তুলা ধুনা করছে।

মঞ্জু হতভম্ব হবার মতো মুখভঙ্গি করলেন।

কইতরী এই দৃশ্য দেখে এতই মজা পেল যে, হেসে কুটি কুটি হলো।

মঞ্জু বাচ্চা মেয়েটির হাসি দেখে আনন্দে অভিভূত হলেন। তার কাছে মনে হলো— ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে এ বাড়িতে আসা সার্থক হয়েছে। আরেকটি মেয়েকে দরজার আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখা যাচ্ছে।

মঞ্জু একবার বললেন, এই তুমি কে?

মেয়েটি কথা শুনে প্রায় উড়ে চলে গেল।

লীলা শহরবাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল। মাঝপথ থেকে ফিরে এলো। অবাক হয়ে মূল বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল। শূন্য বাড়ি লোকজনে ভরতি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা ঘটনা ঘটেছে। সবার চোখে-মুখে সংশয়। বাড়ির খুঁটি ধরে তরুণী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটিকে দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পাচ্ছে। লীলাকে ঢুকতে দেখে মেয়েটি চোখ তুলে লীলার দিকে তাকাল। লীলা সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বলল, বাহ, সুন্দর তো মেয়েটি!

 

সিদ্দিকুর রহমানের বাড়ির উঠানে বিচারসভা বসেছে। লোকমান কিছুক্ষণ আগে কুদ্দুস মিয়া এবং তার মেয়ে পরীবানুকে নিয়ে এসেছে। সিদ্দিকুর রহমানের বড় ছেলে মাসুদ তাদের সঙ্গে এসেছে। আশপাশের কৌতূহলী কিছু লোকজন চলে এসেছে। মসজিদের ইমাম সাহেব এসেছেন। ফুটফুটে দুটি মেয়ের একটিকে দেখা যাচ্ছে। সে খুঁটির আড়ালে দাঁড়িয়ে। এই মেয়েটির মনে হয় লজ্জা বেশি।

সিদ্দিকুর রহমান তাঁর আগের জায়গাতেই আছেন। ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। তাকে সামান্য বিরক্ত মনে হচ্ছে। লীলা তার বাবার পাশে দাঁড়াল। সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন— যাও, ভেতরে যাও। এইখানে দাড়ানোর দরকার নাই।

লীলা দাঁড়িয়েই রইল, নড়ল না।

সিদ্দিকুর রহমান হাত-ইশারায় মাসুদকে ডাকলেন। মাসুদ সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো। ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। ফর্স মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সে তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে না। সে তাকাচ্ছে লীলার দিকে। এই মেয়েটিকে সে চিনতে পারছে না। অপরিচিত একটি তরুণী মেয়ের সামনে তাকে কী শাস্তি দেয়া হবে কে জানে!, তার চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছা করছে। কাঁদতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। লীলা ছেলেটাকে চেনে না, আগে কখনো দেখে নি। তারপরেও সে স্পষ্ট বুঝল, এই ছেলেটা সম্পর্কে তার ভাই। তাদের দুজনের মা ভিন্ন হলেও তারা ভাইবোন। ছেলেটার ভীতমুখ দেখে লীলার মায়া লাগছে। বেচারা এত ভয় পাচ্ছে কেন? ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধ কি সে করেছে? নিতান্তই বালক চেহারার একজন ভয়ঙ্কর কী করতে পারে? এর বয়স কত হতে পারে ষোল সতেরো না-কি আঠারো?

সিদ্দিকুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নাকি ইদানিং গান-বাজনা শিখছ?

এই প্রশ্ন করতে করতে তিনি আধশোয়া অবস্থা থেকে বসা অবস্থায় চলে এলেন। তার গলার আওয়াজ শান্ত। যেন তিনি তার ছেলের সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। পড়াশোনার খবর যেভাবে নিতে হয় সেভাবেই গান-বাজনার খবর নিচ্ছেন।

কথার জবাব দাও না কেন? গান-বাজনা নাকি শিখছ?

জি।

গান দু’একটা শিখেছ?

জি না।

তাহলে কি বাদ্য-বাজনায় আছ?

জি।

কী শিখছ? তবলা? ছেলেপুলে বখাটে হয়ে গেলে প্রথম শিখে তবলা। তবলা শিখেছ?

জি।

কতটুকু শিখেছি?

মাসুদ জবাব দিল না। সিদ্দিকুর রহমান লোকমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, দৌড় দিয়া যাও, কুদ্দুসের বাড়ি থেকে তবলা আর বাঁয়া নিয়ে আসো। আমার পুত্ৰ তবলা কেমন শিখেছে তার পরীক্ষা হবে। এত কষ্ট করে একটা বিদ্যা শিখেছে। দেখি সেই বিদ্যার কী অবস্থা!

লীলার হাসি পাচ্ছে। শুরুতে তার বাবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল— ভয়ঙ্কর কোনো বিচার হবে। এখন সে-রকম মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরো বিচার ব্যবস্থার মধ্যে হালকা মজা আছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, একজন আবার সত্যি সত্যি দৌড়ে তবলা আনতে গেছে। সবচে ভালো হয় ছেলেটা যদি চমৎকার তবলা বাজিয়ে সবাইকে হতভম্ব করে দেয়। সেটা মনে হয় বেচারা পারবে না। কারণ সে থারথার করে কাঁপছে। এত ভয় পাচ্ছে কেন? লীলার ইচ্ছা করছে ছেলেটাকে সে বলে— এত ভয় পােচ্ছ কেন? উনি তোমার সঙ্গে মজা করছেন। তোমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করার চেষ্টা করছেন। হাসি-তামাশা গায়ে না। মাখলেই হয়।

সিদ্দিকুর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় ডাকলেন, মাসুদ!

মাসুদ ক্ষীণস্বরে বলল, জি?

তবলা এমন কঠিন বিদ্যা যে এটা শেখার জন্যে মানুষের বাড়িতে রাত কাটাতে হয় এটা জানতাম না। তুমি কি সারারাত তবলা বাজাও, নাকি তবলা শেখার পাশে পাশে কুদ্দুসের মেয়েটার সাথে তবলা বিষয়ে কথা বলে? কুদ্দুসের মেয়ে যেহেতু গান-বাজনার মধ্যে আছে সেও নিশ্চয়ই তবলা বিষয়ে জানে। এই মেয়ে, তুমি জানো না?

পরীবানু কিছু বলল না। খুঁটির আড়ালে চলে গেল।

তোমার নাম কী?

পরীবানু জবাব দিল না। পরীবানুর বাবা কুদ্দুস ভীত গলায় বলল, জনাব, আমার মেয়ের নাম পরীবানু।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মেয়ে যেমন সুন্দর, নামও সুন্দর। এই মাসুদ, পরীবানু সুন্দর মেয়ে না?

মাসুদ পুরোপুরি পাংশুবৰ্ণ হয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর কিছু যে আসছে। সে বুঝতে পারছে। কতটা ভয়ঙ্কর সে-সম্পর্কে তার ধারণা নেই।

সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মাসুদ যাও, পরীবানুর পায়ে কদমবুসি করে বলো— তুমি আমার মা। এটা বলতে দোষের কিছু নাই। মেয়েছেলে মায়ের জাত। বয়সে ছোট মেয়েকেও মা ডাকা যায়। যাও, দেরি করবা না। দেরি আমার ভালো লাগে না। পরীবানু এখন থেকে তোমার মা।

লীলার কাছে মনে হচ্ছে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা এখন আর হাসিতামাশা রসিকতার পর্যায়ে নেই। বাড়াবাড়ি ভালো জিনিস না। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাসুদ পরীবানুর কাছে এসে বসে পড়ল। হাত দিয়ে পা স্পর্শ করল না, তবে মুখ বিড়বিড় করে বলল, আপনি আমার মা।

পরীবানু কাঁদছে। কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে না, তবে শরীর কাপা দেখে বোঝা যাচ্ছে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, শাস্তি সামান্য বাকি আছে। আমার এই ছেলে লজার মাথা খেয়েছে। তার এখন লাজলজা নাই। যে-মেয়ের সঙ্গে ভাব ভালোবাসার চেষ্টা করেছে তারেই মা ডাকতেছে। সুলেমান, এখন আমার বেহায়া ছেলেরে কানো ধরে সারা গ্রামে একটা চক্কর দেবার ব্যবস্থা করো। ন্যাংটা করে চক্কর দেয়াবে। গায়ে যেন একটা সুতাও না থাকে। লজ্জা যখন নষ্ট হয়েছে পুরোপুরি নষ্ট হোক। দেরি করবা না, এরে ন্যাংটা করো। এইখানেই করো। মেয়েরা উপস্থিত আছে তাতে কোনো অসুবিধা নাই। মেয়েদের মধ্যে একজন এখন সম্পর্কে তার মা হয়, মার সামনে পুত্র নগ্ন হতে পারে। এতে লজ্জা নাই।

লীলা অবাক হয়ে দেখল, সত্যি সত্যি সুলেমান নামের লোকটা মাসুদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যে-ভঙ্গিতে এগোচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে নগ্ন করার কাজটা সে করবে। লীলা সুলেমানের দিকে এক পা এগিয়ে কঠিন গলায় বলল, সুলেমান শুনুন, খবরদার! যথেষ্ট হয়েছে।

সুলেমান থমকে দাঁড়াল। হতভম্ব হয়ে তাকাল। একবার লীলার দিকে আরেকবার সিদ্দিক সাহেবের দিকে। সিদ্দিক সাহেব এখন সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছেন। বাতাসের কারণে সিগারেট ধরানো যাচ্ছে না। দেয়াশলাই বারবার নিভে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আশেপাশে কী ঘটছে না-ঘটছে তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।

মাসুদ মেঝেতে বসেছিল। লীলা তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। লীলা হাত বাড়িয়ে বলল, আসো আমার সঙ্গে। মাসুদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। লীলা হাত ধরে তাকে নিয়ে বাগানের দিকে রওনা হলো। মাসুদ এখন কাঁদতে শুরু করেছে। শব্দ করেই কাঁদছে।

 

সিদ্দিক সাহেবের সিগারেট শেষ পর্যন্ত ধরেছে। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন– এ আমার বড় মেয়ে। আমার বড় মেয়ের কথার উপরে আর কোনো কথা নাই। আজ থেকে তার কথাই খাবাড়ির শেষ কথা। তোমরা ভিড় করে থাকবে না। যাও, যে যার কাজে যাও।

অতি দ্রুত লোকজন সরে গেল। সিদ্দিকুর রহমান আবারো ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে বললেন— সুলেমান, আমার বড় মেয়েকে কেমন দেখিলা? বাপকা বেটি না?

জি, বাপকা বেটি।

মাসুদরে আমি ন্যাংটা করে শাস্তি দিতাম না। এই শাস্তি দেয়া যায় না। তারপরেও এরকম একটা শাস্তির কথা কেন বললাম জানো?

জি না।

আমার বড় মেয়ে কী করে সেটা দেখার জন্যে। যেরকম করবে ভেবেছিলাম সে-রকম করেছে। মাশাল্লাহ! মেয়েটা হয়েছে অবিকল তার মার মতো। যেরকম চেহারা, সেরকম স্বভাবচরিত্র।

সিদ্দিকুর রহমানের চোখে দ্বিতীয়বার পানি এসেছে। তার বড় ভালো লাগছে।

সুলেমান!

জি?

আবার জিজ্ঞেস করতেছি, ভেবেচিন্তে বলো। এই মেয়ে বাপকা বেটি না?

জি, বাপকা বেটি।

একটা মজার কথা বলি শোনো— আমার দাদাজান একবার সন্ধ্যাকালে করলেন কী, লম্বা একটা বাঁশের মাথায় একটা হারিকেন ঝুলায়ে বাশটা বাড়ির উঠানে পুতে দিলেন। সবাই জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী? দাদাজান বললেন, একটা ঘটনায় আমার মনে খুব আনন্দ হয়েছে। এইজন্যে কাজটা করলাম। সবাই জানতে চাইল, ঘটনা কী? দাদাজান বললেন— ঘটনা। কী আমি বলব না। আমার মনের আনন্দটা সবাই দ্যাখা। আনন্দের পেছনে ঘটনা জানার দরকার নাই। দাদাজানের মতো আজ আমার মনেও আনন্দ হয়েছে। বাশের আগায় একটা হারিকেন আজকেও ঝুলাও।

সুলেমান বলল, জি আচ্ছা।

কেউ যদি জানতে চায় ঘটনা কী— কিছু বলব না। সব ঘটনা সবার জানার দরকার নাই। সকখঘটনা শুধু আল্লাহপাকই জানবেন। আর কেউ না।

জি আচ্ছা।

রাতে বড়খানার ব্যবস্থা করো। মাংস রান্নার জন্যে ফজলুরে খবর দিয়া আনো।

জি আচ্ছা। পশ্চিমের পুকুরে জাল ফেলব?

হুঁ, ফেলো। জাল টানার সময় আমার মেয়েরে নিয়া যাবে। সে দেখে মজা পেতে পারে।

জি আচ্ছা।

আজি দুপুরে আমি কিছু খাব না। উপবাসে যাব। রাতে বড় মেয়ের সাথে খানা খাব।

জি আচ্ছা। উনার থাকার ব্যবস্থা কোনখানে করব?

লীলা থাকবে পুরনো বাড়িতে। শহরবাড়িতে না। আমার ঘরের উত্তরের ঘরটা তারে দেও। ঘরের তালা খুলার ব্যবস্থা করো।

জি আচ্ছা।

 

রাত আটটা বাজে।

এশার নামাজ শেষ করে সিদ্দিকুর রহমান পুরনো বাড়ির বারান্দায় চাদর গায়ে বসে আছেন। তার বসার জন্যে উঠানে পাটি পাতা হয়েছে। পাটির উপর সতরঞ্জি বিছানো। বাড়ির উঠানে মাংসের বিখ্যাত কারিগর ফজলু মিয়া মাটির বড় হাঁড়িতে খাসির মাংস বসিয়েছে। শুধুমাত্র পিয়াজের রসে মাংস দমে সিদ্ধ করা হচ্ছে। কাজটা জটিল। আগুনের আঁচ বেশি হতে পারবে না। আবার কমও হতে পারবে না। হাঁড়ির মুখের ঢাকনা আটা দিয়ে আটকানো। ফজলুর দৃষ্টি আটার দিকে— ফুটো হয়ে বাষ্প বের হয়ে যাচ্ছে কি-না।

মাছ রান্না হচ্ছে ভেতর বাড়িতে। পশ্চিম পুকুর থেকে ছটা বড় মাছ ধরা হয়েছে। একটা কাতল, ওজন আঠারো সের। আরেকটা নানিদ মাছের ওজন সাত সের। এত বড় আকৃতির নানিদ মাছ। সচরাচর পাওয়া যায় না। লীলার ভাগ্যে এত বড় নানিদ ধরা পড়েছে। এটা একটা সৌভাগ্যের লক্ষণ। কারো নাম করে পুকুরে জাল ফেললে কী মাছ ধরা পড়ে তা দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা হয়ে যায়। একবার ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব এসেছিলেন, তার নামে জাল ফেলার পর কয়েকটা গজার মাছ ছাড়া কিছু উঠে নি।

ভেতরবাড়ি থেকে লীলা বের হয়েছে। সে উঠানে নেমে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল বাঁশবাগানের দিকে। বাঁশবাগানে লণ্ঠন ঝুলানো হয়েছে। সে লণ্ঠন থেকে চোখ নামিয়ে তাকাল বাবার দিকে। সিদ্দিকুর রহমান জানতেন তাঁর মেয়ে এই কাজ করবে। চোখে যেন চোখ না পড়ে সে-জন্যেই তিনি আগে থেকেই অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। তবে মেয়ে কী করছে না করছে তা তিনি লক্ষ রাখছেন। মানুষ অন্যদিকে তাকিয়েও আশেপাশের কিছু দৃশ্য দেখতে পারে। লীলা ফজলু মিয়ার কাছে গেল। ফজলু মিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এখন আবার লীলা তাকাচ্ছে বাঁশবনের দিকে। লণ্ঠনের ব্যাপারটা মনে হয়। মেয়ের মাথা থেকে যাচ্ছে না। মেয়ে এখন এগিয়ে আসছে তার দিকে। এখন মেয়ের দিকে তাকানো উচিত। লীলা বলল, বসি আপনার পাশে?

সিদ্দিকুর রহমান হাতের ইশারায় লীলার বসার জায়গা দেখিয়ে দিলেন। এই মেয়ে কত সহজেই না তার সঙ্গে কথা বলছে!

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তোমার থাকার ঘর পছন্দ হয়েছে?

লীলা কিছু বলল না। ঘর তার পছন্দ হয় নি। অন্ধকার ঘর, ছোট জানালা। বিশাল ঘরের প্রায় পুরোটা জুড়েই গাবদা এক খাট। শহরবাড়ি নামের বাংলোর ঘরগুলি অনেক সুন্দর। সেখানে থাকতে পারলে হতো। কিন্তু তাকে বলা হয়েছে এই ঘরে থাকতে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি যে ঘরে থাকবে সেই ঘরে তোমার মা থাকতেন।

লীলা বিস্মিত হয়ে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ। তোমার মা চলে যাবার পর আমি এই ঘর তালাবন্ধ করে দেই। আজ তোমার জন্যে তালা খোলা হয়েছে।

এই গাবদা খাট মার পছন্দ ছিল?

হুঁ। এই খাটের একটা নাম আছে— ময়ূরখাট। আমার দাদা খান বাহাদুর হামিদুর রহমান সাহেব তার স্ত্রীর জন্যে বানিয়েছিলেন। তবে তিনি এই খাট কখনো ব্যবহার করেন নাই।

কেন করেন নাই?

সেটা জানি না। মানুষ সব জানতে চায়। কিন্তু জানতে পারে না। আমরা অল্পই জানি। কিন্তু ভাব করি অনেক জানি।

লীলা বাবার কথায় সামান্য চমকালো। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি এখন নিজের কথা বলো। তোমার বিষয়ে জানতে ইচ্ছা করছে।

কী জানতে চান?

পড়াশোনা কতদূর করেছ?

বিএ অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি। সামনের মাসে রেজাল্ট হবে।

বলে কি! পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

ভালো হয়েছে।

পড়াশোনা কোথায় করেছ?

ঢাকায়। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছি ইডেন কলেজ থেকে। তারপর ঢাকা ইউনিভার্সিটি।

তুমি পড়াশোনায় কেমন?

ভালো। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ছেলেমেয়ে সবার মধ্যে থার্ড হয়েছিলাম।

সিদ্দিক সাহেব তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখে আনন্দের চেয়েও যেটা বেশি তার নাম বিস্ময়।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, হঠাৎ যে আমাকে দেখতে আসছ— এর পিছনে কি কোনো কারণ আছে?

কোনো কারণ নাই।

সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বললেন, সামান্য যে পশু সেও কারণ ছাড়া কিছু করে না। মানুষ তো কখনোই করে না। তবে সব কারণ মানুষ নিজে জানে না। অন্য একজন জানে।

অন্য একজনটা কে?

আল্লাহপাক। মা, তুমি কি নামাজ পড়ো?

মাঝে মাঝে পড়ি।

কোরআন মজিদ পড়তে পারো?

পারি।

তোমার নাম যে লীলাবতী রাখা হয়েছে, কেন রাখা হয়েছে সেই কারণ কি জানো?

জানি না, আমি শুধু জানি মা সবাইকে বলে রেখেছিল তাঁর যদি মেয়ে হয় তার নাম যেন লীলাবতী রাখা হয়।

ছেলে হলে কী নাম রাখা হবে বলে নাই?

না। আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি— বাঁশগাছের মাথায় হারিকেন ঝুলছে কেন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার মনে খুব আনন্দ হয়েছে এটা জানানোর জন্যে বাঁশগাছের আগায় হারিকেন। আনন্দ পেলে মানুষ তার আনন্দের খবর সবাইকে জানাতে চেষ্টা করে। মানুষ দুঃখ পেলে কিংবা কষ্ট পেলে তার খবর কিন্তু জানাতে চায় না। গোপন করে রাখে। মানুষ ছাড়া অন্যসব পশুপ্রাণীজগতের নিয়ম কিন্তু ভিন্ন। পশু বা পক্ষীজগতের নিয়ম হলো, দুঃখ-কষ্ট চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে জানাও। আনন্দের খবর গোপন রাখো।

লীলা হেসে ফেলল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, মা, তুমি হাসো কেন?

আপনার কথা শুনে হাসি।

আমার কথা শুনে কেন হাসলে?

লীলা বলল, কী জন্যে হেসেছি তার কারণ আমি জানি না। অন্য একজন হয়তো জানেন। কিন্তু তিনি তো কিছু বলেন না।

সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। লীলা তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে। কেউ চোখের পাতা ফেলছে না। মনে হয়। একজন অন্যজনকে বোঝার চেষ্টা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *