০৪. সবার সাথে পরিচয়
রাশার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে, বাইরে তখনো ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি। শুয়ে থেকেই সে শুনতে পেল নানি উঠোন ঝাট দিচ্ছেন। এত সকালে কেন উঠান ঝাট দিতে হবে রাশা বুঝতে পারে না। সে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, নানি তাকে দেখে ঝাঁট দেয়া বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, “তুই এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছিস কেন?”
“ঘুম ভেঙে গেল। তুমি এত সকালে উঠান ঝাট দিচ্ছ কেন?”
“জানি না।”
“জানো না?”
“নাই। কিছু একটা না করলে সময় কাটে না, তাই কাজকর্ম করি।”
“আমাকে দাও ঝাঁটাটা, আমি উঠানটা ঝাড় দিই।” নানি হাসলেন, বললেন, “তোকে উঠান ঝাট দিতে হবে না।”
“আমি পারব নানি।”
“আমি জানি তুই পারবি। না পারার কী আছে?”
“তাহলে?”
“আমার মাথা আউলাঝাউলা, তাই আমি এরকম উল্টাপাল্টা কাজ করি। তুই কেন করবি?”
রাশা বারান্দা থেকে নেমে বলল, “তাহলে কী করব বলো।”
“কিছু একটা যদি করতেই চাস, তাহলে মোরগ আর হাঁসের ঘরের দরজাগুলো খুলে দে।
রাশা তখন উঠানের এক কোনায় হাঁস-মোরগের ঘরের দরজাটা খুলে দিল, সাথে সাথে কক কক শব্দ করে প্রথমে মোরগ-মুরগি তাদের পিছু পিছু থপথপ করে হাঁসগুলো বের হয়ে এলো। মুরগিটা বারকয়েক ডানা ঝাঁপটিয়ে শব্দ করতে থাকে তখন বাচ্চাগুলো কিচিমিচি শব্দ করে তার মাকে ঘিরে ধরে। কী মজার একটা দৃশ্য!
নানি বললেন, “ভিতরে ডিম আছে না দেখ দেখি।”
রাশা মাথা নিচু করে তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি সেখানে দুটি ডিম। সে হাত দিয়ে ডিম দুটি বের করে এনে বলে, “কী আশ্চর্য!”
“কোন জিনিসটা আশ্চর্য?”
“এই যে ডিম! আমি ধরেই নিয়েছিলাম ডিম ফ্রিজের ভিতরে পাওয়া যায়! ভুলেই গিয়েছিলাম যে আসলে হাঁস-মুরগি ডিম পাড়ে।”
“হাত-মুখ ধুয়ে আয় তোকে ডিম ভাজি করে দিই। নাস্তা করবি।”
.
একটু বেলা হতেই গ্রামের বউ-ঝিরা আসতে শুরু করল, সবাই রাশাকে একনজর দেখতে চায়। যে মেয়েটির বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে এবং যার মা তাকে গ্রামের বাড়িতে পাগলি নানির কাছে ফেলে রেখে চলে গেছে সেই মেয়েটি দেখতে কেমন সেটা জানার জন্য সবার মাঝেই কৌতূহল। রাশা প্রথমে কিছুক্ষণ কাঠ হয়ে বসে থাকে কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই তার কাছে পুরো ব্যাপারটা অসহ্য মনে হতে থাকে। খুব মাথা ধরেছে বলে সে একসময় বাড়ির ভেতরে ঢুকে বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল।
বউ-ঝিরা হতাশ হয়ে চলে যাবার পর নানি এসে রাশার মাথার কাছে বসলেন, কপালে হাত রেখে বললেন, “শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে?”
রাশা উঠে বসল, বলল, “না, নানি। আমার শরীর ঠিকই আছে কিন্তু এই যে মানুষজন আমাকে দেখতে আসছে, আমি সেটা সহ্য করতে পারছি না।”
নানি বললেন, “ও।”
“আমি কী আজগুবি একটা জন্তু যে মানুষ আমাকে দেখতে আসবে?”
নানি একটু হাসলেন, বললেন, “এই গ্রামের মানুষের কাছে তুই আসলেই আজগুবি একটা জন্তু।”
“থ্যাংক ইউ নানি!”
“আমি বলি কী–তুই নিজেই গ্রামটা ঘুরে আয়। সবার সাথে পরিচয় করে আয়। তাহলে কেউ তোকে আর বিরক্ত করবে না।”
“আমি? আমি নিজে?”
নানি মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ।”
“তুমি আমার সাথে যাবে?”
“নাহ্!” নানি মাথা নাড়লেন, “আমি পাগলছাগল মানুষ, আমার ঘর থেকে বের হতে ভালো লাগে না।”
“তাহলে? আমি তো কিছুই চিনি না।”
এই সমস্যাটা সমাধান করার জন্যেই মনে হলো ঠিক এই সময় জিতু ঘরের ভেতর উঁকি দিল, উদ্বিগ্ন মুখে বলল, “রাশপুর নাকি শরীর খারাপ। কলেরা?”
রাশা চোখ কপালে তুলে বলল, “কলেরা? আমার?”
জিতু ঘরে ঢুকে বলল, “হ্যাঁ। জোবেদা ফুপু তোমাকে দেখতে আসছিলেন, তোমার শরীর খারাপ সেই জন্যে দেখতে পারেন নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। ফুপু বললেন, জানি না, মনে হয় কলেরা।
শহরের মানুষ গ্রামে আসলেই পেটে অসুখ হয়। কলেরা হয়।”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না। আমার কলেরা হয় নাই।”
“তাহলে কী হয়েছে?”
“কিছুই হয় নাই।”
“কিন্তু–“
রাশা জিতুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “জিতু মিয়া তুমি একটা কাজ করতে পারবে?”
“পারব না কেন? একশবার পারব।”
রাশা ভুরু কুঁচকে বলল, “কাজটা কী না শুনেই যে বলে দিলে পরব? আমি যদি এখন বলি আমাকে ঘাড়ে করে বাজারে নিয়ে যেতে হবে?”
জিতু দাঁত বের করে হেসে বলল, “আজিব! তুমি আজিব!”
রাশা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমি এখন এই গ্রামটা ঘুরে ঘুরে দেখব। সবার বাড়িতে বেড়াতে যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?”
জিতুর চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাতে কিল মেরে বলল, “সবার আগে আমাদের বাড়ি।”
রাশা বলল, “সেটা দেখা যাবে!”
জিতুকে নিয়ে বের হওয়ার পর রাশা বুঝতে পারল এ কাজের জন্যে জিতু থেকে ভালো আর কেউ হতে পারে না। সে যে শুধু এই গ্রামের সব মানুষকে চিনে তা নয়, গরু-ছাগল-ভেড়া এমন কি গাছগুলোকেও চিনে। সে যে শুধু কোন মানুষ কী রকম সেটা বলতে পারে তা নয়, কোন গরু ছাগলের কী রকম মেজাজ সেটাও বলতে পারে। বাড়ি থেকে বের হয়েই সে দূরে একটা গরুকে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে কালো গাইটা দেখছ, খবরদার ঐটার ধারেকাছে যাবা না।”
রাশা জানতে চাইল “কেন?”
“এই গাইটা পাগল। কাছে গেলেই ঢুঁস দিবে।”
“পাগল কেমন করে হলো?”
“সেইটা জানি না। অমাবস্যার রাত্রে ছাড়া পেয়ে একবার শুশানঘাটে ঢুকে গিয়েছিল, মনে হয় সেই থেকে পাগল।”
রাশা এই ব্যাখ্যাটার কোনো ব্যাখ্যা চাইল না। জিতু হাঁটতে হাঁটতে একটা ঝাঁপড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বলল, “রাত্রিবেলা কখনো এই গাছের নিচ দিয়ে হাঁটবা না।”
“কেন?”
“এইটা শ্যাওড়াগাছ। এই গাছে ভূত আছে।”
“কী করে ভূতে?”
“রাত্রিবেলা কেউ নিচে দিয়ে গেলে তার শরীরে পেশাব করে দেয়।”
ভূতদের নিশ্চয়ই কাজকর্ম থাকে, তারপরেও শুধু মানুষের ওপর পেশাব করার জন্যে শ্যাওড়াগাছে কেন বসে থাকতে হয় রাশা সেটা বুঝতে পারল না। কিন্তু রাশা সেটা নিয়ে জিতুর সাথে তর্ক করল না, এতক্ষণে সে বুঝে গিয়েছে জিতুর সব কথাতেই ভূত-প্রেত জিন-পরীর গন্ধ থাকে।
প্রথমে তারা যে বাড়িটাতে গেল তার সামনে একটা বড় উঠোন, আর সেখানে ধান বিছিয়ে শুকানো হচ্ছে। ধান খাবার জন্য কিছু পাখি ওড়াউড়ি করছে; কমবয়সী একটা মেয়ে একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে সেগুলোকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। জিতু মেয়েটাকে বলল, “শিউলী দেখ তোদের বাড়িতে কোন অতিথকে নিয়ে এসেছি।”
রাশা গলা নামিয়ে বলল, “শব্দটা অতিথ না, অতিথি।” জিতু শুদ্ধ শব্দ বলায় কোনো উৎসাহ দেখাল না, গলা উঁচিয়ে বলল, “সফুরা খালা, আপনার বাড়িতে বিদেশি অতিথ নিয়ে আসছি।”
রাশা কেমন করে বিদেশি অতিথি হলো সে বুঝতে পারল না। দেখা গেল বাড়ির চারপাশ থেকে পিলপিল করে নানা আকারের মানুষজন বের হয়ে এলো। বিদেশি অতিথিটা কে সবাই জানে এবং সবারই তাকে দেখার একটা কৌতূহল আছে। কেউ কিছু বলার আগেই রাশা বলল, “আমি তো আগে কখনো এই গ্রামে আসি নাই, কারো সাথে পরিচয় নাই। তাই জিতু মিয়াকে নিয়ে বের হয়েছি সবার সাথে পরিচয় করতে।”।
বয়স্ক একজন মহিলা রাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “খুব ভালো করেছ মা। আমরা খালি তোমাদের কথা শুনি। কোনোদিন দেখি নাই। আজকে দেখলাম, দেখে আমাদের বুকটা ভরে গেল।”
রাশা একটু অবাক হয়ে বয়স্কা মহিলাটার মুখের দিকে তাকাল, তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কথাটা শুধু বলার জন্যে বলেনি, সত্যি সত্যি বলেছে। সত্যি রাশাকে দেখে তার বুকটা ভরে গেছে। তাকে চেনে না, জানে না, কোনোদিন দেখেনি কিন্তু তার পরেও তাকে দেখে এই সাদাসিধে বয়স্কা মহিলার বুকটা ভরে গেছে। কী আশ্চর্য। ঠিক কী কারণ জানা নেই, রাশার চোখের কোনায় হঠাৎ একটু পানি চিকচিক করে ওঠে। সেটা গোপন করে সে সহজ গলায় বলল, “আমি তো এখন নতুন এসেছি, আপনাদের কাউকেই চিনি না! আস্তে আস্তে পরিচয় হবে।”
আরেকজন এসে তার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি কি আসলেই এখানে থাকবে নাকি আমাদের ভেতর মায়া জাগিয়ে চলে যাবে?”
রাশা বলল, “আসলেই থাকব।”
ছোট একটা মেয়ে হাততালি দিয়ে বলল, “কী মজা!”
মধ্যবয়স্কা মহিলাটা বলল, “এই, জলচৌকিটা এনে দে। মেয়েটা বসুক।”
রাশা বলল, “আজকে বসব না। গ্রামের সব বাড়িতে যাব তো তাই দেরি করব না। আরেক দিন এসে বসব।”
“তাই বলে তুমি খালি মুখে চলে যাবে নাকি? কিছু একটা খেতে হবে।”
রাশা বলল, “না-না-না, কিছু খাব না।”
মহিলা মাথা নাড়লেন, “কিছু একটা খেতে হবে।”
রাশা মহিলার হাত স্পর্শ করল, বলল, ‘বিশ্বাস করেন, আমি খেয়ে বের হয়েছি। আরেক দিন খাব।”
“ঠিক আছে তাহলে একটা ডাব খেয়ে যাও। ডাবের পানি খেতে তো আর পেটে জায়গা থাকতে হয় না।”
মহিলাটি একটা শুকনো কালো ছেলেকে ডেকে বললেন, “এই মতি। তাড়াতাড়ি কয়টা ডাব পাড় দেখি।”
মতি নামের শুকনো টিংটিংয়ে ছেলেটা সাথে সাথে তার লুঙ্গি মালকোচা মেরে পরে কোথা থেকে একটা ধারালো দা এনে পিছনে গুঁজে নিল। তারপর উঠানের কয়েকটা নারকেল গাছের দিকে তাকিয়ে একটাকে বেছে নিয়ে সেটা বেয়ে তরতর করে উঠে যেতে লাগল। রাশা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, এরকমভাবে কেউ যে নারকেল গাছে উঠে যেতে পারে সেটা সে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না। দেখে মনে হচ্ছে মতি নামের ছেলেটা বুঝি মানুষ না, যেন সে একটা টিকটিকি!
রাশা নিশ্বাস আটকে বলল, “হায় খোদা! যদি পড়ে যায়?”
ছোট মেয়েটা বলল, “পড়বে না! মতি বান্দরের বাচ্চার মতো গাছে উঠে। এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দিতে পারে।”
রাশা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “সর্বনাশ!”
মতি সত্যি সত্যি একটা বানরের মতো নারকেল গাছের উপরে উঠে যায়, পিছন থেকে দা-টা বের করে দক্ষ হাতে কোপ দিয়ে দুটি ডাব কেটে নেয়, তারপর যেভাবে উঠেছিল ঠিক সেভাবে তরতর করে নেমে এলো। তাকে দেখে মনে হয় শুকনো মাটিতে হাঁটাহাঁটি করার থেকে গাছ বেয়ে উঠা এবং নমা তার জন্যে সহজ।
মতি ডাবটার পেছন দিকটা কেটে একটা ছোট ফুটো করে সেটা রাশার হাতে তুলে দিল। রাশা জিজ্ঞেস করল, “কেমন করে খাব?”
“মুখে লাগিয়ে!”
“সত্যি?”
মতি নামের শুকনো কালো ছেলেটা তার ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল, “সত্যি!”
রাশ ডাবটা তার মুখে লাগিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করল, যতটুকু তার মুখের ভেতর গেল তার থেকে অনেক বেশি তার গাল বেয়ে গড়িয়ে গলা-বুক ভিজিয়ে দিল। সেই দৃশ্য দেখে ছোট বাচ্চাগুলো আনন্দে হি হি করে হেসে গড়াগড়ি খেতে থাকে। এত অল্পে মানুষকে এত আনন্দ দেয়া যায় রাশা আগে কোনোদিন টের পায়নি।
বহুদিন আগে রাশার যখন চিকেন পক্স হয়েছিল তখন তার কিছুদিন জোর করে ডাবের পানি খেতে হয়েছিল, তার কাছে মনে হয়েছিল এটা আঁশটে গন্ধের বিস্বাদ একটা তরল। কিন্তু গাছ থেকে পেড়ে আনা এই ডাবটার পানি মিষ্টি এবং সুস্বাদু। গন্ধটাও সুন্দর। রাশা শখ করে খানিকটা খেয়ে বলল, “আর পারছি না।”
মধ্যবয়সী মহিলাটি বললেন, “জিতু তুই খেয়ে ফেল।”
জিতু কোনো আপত্তি না করে সাথে সাথে রাশার হাত থেকে নিয়ে ডাটা মুখে লাগিয়ে ঢকঢক করে খেতে শুরু করল।
বিদায় নিয়ে আসার সময় রাশা হঠাৎ থেমে গেল। পাশের মাটির একটা ঘরের বারান্দায় পেট মোটা একটা বাচ্চা পা ছড়িয়ে বসে আছে, তার শরীরে কোনো কাপড় নেই। সামনে মাটিতে কিছু মুড়ি ছড়ানো, সে গভীর মনোযোগ দিয়ে মাটি থেকে তুলে তুলে একটা একটা করে মুড়ি খাচ্ছে। কাছাকাছি একটা শালিক পাখি মুড়িতে ভাগ বসানোর চেষ্টা করছে। বাচ্চাটা একটু অসতর্ক হলেই শালিক পাখিটা ছুটে এসে একটা-দুইটা মুড়ি খেয়ে নিচ্ছে।
রাশা যখন অবাক হয়ে এই দৃশ্যটি দেখছে তখন জিতু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রাশাপু?”
“এই বাচ্চাটা কার?”
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন কমবয়সী মেয়ে বলল, “আমার।”
“মাটি থেকে মুড়ি তুলে খাচ্ছে ওর তো অসুখ করবে।”
মেয়েটা একটু বিব্রতভাবে হেসে বলল, “করবে না। ওর অভ্যাস আছে।”
রাশা বলল, “কিন্তু এইটা তো খুব খারাপ অভ্যাস! মাটিতে কত রোগ জীবাণু। আমাদের স্কুলে একটা মাইক্রোস্কোপ আছে, আমাদের স্যার দেখিয়েছিলেন, জীবাণুরা গিজগিজ করছে। ওকে একটা বাটিতে না হয় থালায় করে দিন।”
মেয়েটি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “থালা বাটিতে দিলে তাড়াতাড়ি খেয়ে ফেলে। মাটিতে ছিটিয়ে দিলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খায়।”
রাশা থতমত খেয়ে গেল। একটু ইতস্তত করে বলল, “কিন্তু মাটি থেকে তুলে খেলে তো অসুখ হবে।”
“একটু-আধটু অসুখ হলে কী হয়? সবারই হয়।”
রাশা অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, কী বিচিত্র একটা যুক্তি! সে অবশ্যি এত সহজে মেয়েটার যুক্তি মেনে নিল না, মাটি থেকে মুড়িগুলো সরিয়ে একটা বাটিতে মুড়ি দিতে তাকে বাধ্য করে ছাড়ল। মজার ব্যাপার হচ্ছে যারা হাজির ছিল তারা সবাই ধরে নিল পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে শহরের একটা মেয়ের ছেলেমানুষি কাজকারবার। তারা হাসি হাসি মুখে ব্যাপারটা দেখল যেন একটা নাটক দেখছে, কিন্তু তার কথাটাকে কেউ কোনো গুরুত্ব দিল বলে মনে হলো না।
.
গ্রাম ঘুরে দেখার জন্যে বের হয়ে রাশা প্রথম বাড়িটাতে এসেছিল শুধু জিতুকে নিয়ে, এখান থেকে যখন বের হলো তখন তার সাথে যোগ দিল মতি এবং আরো দুটি কমবয়সী বাচ্চা।
পরের বাড়িটাতে গিয়ে সে আবিষ্কার করে সেখানে কিভাবে কিভাবে যেন খবর চলে গেছে যে সে আসছে, এবং সবাই তার জন্যে অপেক্ষা করছে। এখানেও মোটামুটি একই ব্যাপার ঘটল, সবাই রাশাকে এমনভাবে ঘিরে ধরল যেন সে ভিনদেশি রাজকন্যা, ভুল করে একটা গ্রাম ঘরে চলে এসেছে। এ বাড়িতেও তাকে একটা জলচৌকিতে বসানো হলো এবং একটা থালায় করে তার জন্যে নারকেলের নাড় আর চিড়ে ভাজা আনা হলো। রাশা খাবে না, খাবে না বলে আপত্তি জানালেও তাকে একটা নাড় আর খানিকটা চিড়া খেতে হলো। সে এর মাঝে টের পেতে শুরু করেছে এখানে খাওয়া ব্যাপারটার সাথে খিদে কিংবা খাওয়ার ইচ্ছের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা একটা সামাজিক ব্যাপার, সে যদি না খায় তাহলে সবাই মন খারাপ করে ফেলে।
রাশা এই গ্রামের মানুষদের আন্তরিক ভালোবাসাটুকু বুঝতে পারে, কিন্তু একই সাথে তাদের নিষ্ঠুরতাটুকু বুঝতে পারে না। যখন সে নারকেলের নাড়টাতে কামড় দিয়েছে, তখন একজন জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা তোমার মাকে ছেড়ে দিয়ে নাকি লন্ডন চলে গেছে?”
রাশা বিষম খেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “লন্ডন না, কানাড়া।”
“সেইটা কোথায়?”
“আমেরিকার কাছে।”
“তোমার বাবা আবার বিয়ে করেছে?”
রাশা মাথা নাড়ল।
মহিলাটি জিজ্ঞেস করল, “তোমার মা?”
রাশা হতবাক হয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আবিষ্কার করল সে বলছে, “হ্যাঁ। করেছে।”
“তোমার সৎ বাপ কী করে?”
“আমি জানি না। আমি তাকে দেখি নাই।”
মহিলাটি আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল তখন ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে বাধা দিল, বলল, “মা, তুমি রাশাকে শান্তিমতো একটু খেতেও দিবা না? একটু খেতে বসেছে তখন হাজারটা প্রশ্ন।
মহিলাটি তখন থতমত খেয়ে থেমে গেল। রাশা কৃতজ্ঞ চোখে মেয়েটার দিকে তাকাল, শুকনো ছিপছিপে তার বয়সী একটা মেয়ে।
যখন সে বিদায় নিয়ে বের হচ্ছে তখন মেয়েটি তার সাথে সাথে বের হয়ে এলো। বাড়ির বাইরে এসে মেয়েটি তার হাত ধরে বলল, “তুমি কিছু মনে করো নাই তো?”
মেয়েটি কী নিয়ে কথা বলছে রাশা বুঝতে পারল, তারপরেও সে না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করল, “কী নিয়ে কিছু মনে করি নাই?”
“এই যে আমার মা-ফুপু তোমাকে তোমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে, তোমার বাবার কথা জিজ্ঞেস করে।”
রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না, কিছু মনে করি নাই।”
মেয়েটা মুখ শক্ত করে বলল, “কারো কোনো আক্কেল নাই। কখন কাকে কী জিজ্ঞেস করা যায় কেউ জানে না। এত বড় হয়েছে কিন্তু কারো বুদ্ধি হয় নাই। সবাই বাচ্চা মানুষের মতো।”
মেয়েটার রাগ রাগ কথাগুলো শুনে রাশা হেসে ফেলল, এই গ্রামে অন্তত একজন মানুষ আছে যার খানিকটা কাণ্ডজ্ঞান আছে। রাশা জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
“জয়নব।”
“তুমি কী পড়?”
“ক্লাস সেভেনে উঠেছি টেনে টুনে।”
রাশা বলল, “আমি এইটে। তুমি কোন স্কুলে পড়?”
“স্কুলটার নাম আহাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়।”
“কতদূর এখান থেকে?”
“অনেক দূর। তিন মাইলের কম না। এখন তবু যাওয়া যায়। বর্ষার পানি নামলে আর যাওয়া যায় না।”
“স্কুলটা কী রকম?”
জয়নব হাসার চেষ্টা করে বলল, “গ্রামের স্কুল যেরকম হয়। কোনো লেখাপড়া হয় না। ক্লাস হয় না। স্যারের কাছে প্রাইভেট না পড়লে স্যারেরা পরীক্ষায় নম্বর দেয় না।”
“ও।”
“কোনোমতে স্কুল যাই। কতদিন লেখাপড়া করতে পারব জানি না।”
“কেন?”
“এতদূরে স্কুল, বাবা-মা যেতে দিতে চায় না। বলে মেয়েমানুষ লেখাপড়া করে কী করবে? বিয়ে করার পর তো রান্নাবান্না করেই জীবন কাটাতে হবে।”
প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে গিয়ে রাশা থেমে গেল। বলল, “ও।”
জয়নব রাশার সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আমি তোমার সাথে আসি?”
রাশা খুশি হয়ে বলল, “হ্যাঁ আসো।”
.
রাশা সেদিন পুরো গ্রামটা ঘুরে শেষ করতে পারল না, তবে যে কয়টা বাড়িতে গেল জয়নব তাকে সেখানে দুটো জিনিস থেকে রক্ষা করল। কেউ তাকে তার বাবা-মায়ের বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করতে পারল না, কেউ তাকে কিছু জোর করে খাওয়াতেও পারল না।
সন্ধ্যাবেলা রাশা যখন নানি বাড়ি ফিরে এলোসে আবিষ্কার করল, এই গ্রামে তার মন খুলে কথা বলার অন্তত একজন মানুষ হয়েছে। মানুষটি জয়নব।
.
রাশা পরের দিন গ্রামের অন্যান্য বাড়ি ঘুরে এলো। সাথে ছিল জয়নব, মাঝপথে জিতুও এসে যোগ দিল। গ্রাম ঘুরে ঘুরে রাশা কিছু মজার জিনিস জানতে পারল, যেমন প্রত্যেক গ্রামে একটা পাগল থাকে, যে পাগলকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় এবং যে ছাড়া পেলে তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলে। এই গ্রামে সেরকম একজন পাগল আছে তার নাম নূরা পাগলা। তারা দূর থেকে নূরা পাগলাকে দেখল, দড়ি দিয়ে একটা খেজুর গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। গায়ে নোংরা কাপড়, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, সে বিড়বিড় করে কথা বলছে, যখন রাশা আর জয়নবকে দেখল তখন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তাদেরকে একটু ভয় দেখাল।
প্রত্যেক গ্রামে একটা চোরও থাকে, এই গ্রামের চোরের নাম মাকিদ আলী কিন্তু সবাই তাকে ডাকে মাক্কু চোরা। গভীর রাতে সে নাকি সারা গায়ে তেল মেখে চুরি করতে বের হয়। নিজের গ্রামের জন্যে তার মায়া আছে তাই সে এখানে চুরি করে না। দূরে দূরে চুরি করতে যায়। তবে আশেপাশে দশ গ্রামে কোনো চুরি হলেই পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। সেটা তার জন্যে একটা যন্ত্রণা। মাক্কু চোরা দেখতে কেমন জিতুকে একটু জিজ্ঞেস করতেই জিতু তাদের নিয়ে মাক্কু চোরার বাড়িতে ঢুকে গেল। দাওয়ায় বসে খুবই শুকনো একটা মানুষ বিড়ি টানতে টানতে বাঁশের চাই দিয়ে একটা খলুই বানাচ্ছে, সে-ই নাকি মাক্কু চোরা। তাদের দেখে মাক্কু চোরা সন্দেহের চোখে তাকাল, জিতু বলল, “মাক্কু চাচা, বিদেশি অতিথ আসছে তাই সবার বাড়ি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।”
মাক্কু চোরা বলল, “ও।”
“এর বাবা লন্ডন থাকে।”
তথ্যে ভুল আছে কিন্তু রাশা শুদ্ধ করে দেবার চেষ্টা করল না। মাক্কু চোরী বলল, “ও।”
“মাস্টারবাড়ির নাতনি।”
“ও।“
“নাম হচ্ছে রাশা। শহরে থাকে তো সে জন্যে নাম ইটিস মিটিস।”
মাক্কু চোরা বিড়িতে টান দিয়ে বলল, “ও।”
জিতু আলাপ চালিয়ে যাবার জন্যে এর পরে কী বলত কে জানে কিন্তু তখন বাড়ির ভেতর থেকে একেবারে পরীর মতো সুন্দর একটা বউ বের হয়ে এল, রাশা তার জীবনে এত সুন্দর একটা মেয়ে দেখেনি। জিতু বলল, “চাচি বিদেশি অতিথ নিয়ে আসছিলাম।”
পরীর মতো সুন্দর বউটা বলল, “অতিথকে গরিবের বাড়ি আনছ, বসতে দিব কোথায়?”
রাশা বলল, “না, না–বসতে হবে না। আমরা এখন যাই। অনেক জায়গায় যেতে হবে তো।”
রাশা জয়নব আর জিতুকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকাল, পরীর মতো সুন্দর বউটি ঘরের দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাশা নিশ্বাস আটকে রেখে ফিসফিস করে বলল, “ইশ! কী সুন্দর বউ!”
জয়নব বলল, “হ্যাঁ। খুব সুন্দর।”
“একজন চোর মানুষ কেমন করে এত সুন্দর একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে?”
“জানি না।”
“বউটা তার হাজবেন্ডকে চুরি করতে না করে না?”
জানি না। বউয়ের কথা কেউ কি কোনোদিন শোনে?”
.
সব গ্রামে যেরকম একটা পাগল আর একটা চোর থাকে ঠিক সেরকম কিছু অপদার্থ মানুষও থাকে। এই অপদার্থ মানুষগুলোর একজনের সাথে ওদের রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। তার পরনে চোঙ্গা প্যান্ট, ক্যান্ট ক্যাটে লাল রঙের টি-শার্ট আর চোখে কালো চশমা। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। রাশা, জয়নব আর জিতুকে দেখে সে ঘুরে তাকাল, জিতু আর জয়নব তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন মানুষটা তাদের থামাল, জিজ্ঞেস করল, “কে জিতু নাকি? সাথে এইটা কে?”
রাশাপু! মাস্টারবাড়ির নাতনি।”
“ও।“
“ঢাকা থেকে আসছে।”
“ঢাকা থেকে এই গেরামে আসছে? এই গাঁও-গেরামে মানুষ থাকে নাকি? ইলেকট্রিসিটি নাই। টেলিভিশন নাই।”
রাশা কোনো কথা বলল না। মানুষটা বলল, “আর এখানে থাকব না।” জিতু জানতে চাইল, “কই যাবেন?”
“বিদেশ। পাসপোর্ট হয়ে গেছে।”
“কোনদিন যাবেন?”
“তারিখ ঠিক হয় নাই। দুবাই চলে যাব। বিশাল জায়গা। টাকা পয়সার ছড়াছড়ি, খালি ধরব আর পকেটে ভরব।” মানুষটা কেমন করে টাকা ধরে পকেটে ভরবে সেটা অভিনয় করে দেখাল।
জয়নৰ বলল, “আমরা যাই।”
তারপর রাশার হাত ধরে টেনে হাঁটতে থাকে। মানুষটা পিছন থেকে বলল, “বাবারে সালাম দিও। নতুন ওসি সাহেবকে নিয়ে একদিন তোমাদের বাড়িতে আসব।”
রাশা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে মানুষটা?”
“ফালতু মজিদ। এই গ্রামে দুইজন মজিদ, একজনের বাজারে একটা দোকান আছে। সে হচ্ছে আসল মজিদ। আর এ হচ্ছে ফালতু মজিদ। কোনো কামকাজ করে না, খালি বড় বড় কথা বলে!”
রাশা মুখ টিপে হাসল, বলল, “লোকটার পোশাক দেখছ? একেবারে জোকার!”
“হ্যাঁ। সবসময় পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়াচ্ছে।”
.
গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে তিনজন হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ জয়নব থেমে গেল। রাশা দেখল একটা পুকুরের পাশে একটা বড় গাছ, সেই গাছে হেলান দিয়ে একজন বয়স্ক মানুষ খুব মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে। মানুষটা নিশ্চয়ই চোখে ভালো দেখতে পায় না। তাই বইটা চোখের খুব কাছে নিয়ে ধরেছে। তিনজন কথা বলতে বলতে আসছে সেটা শুনেও মানুষটা মুখ তুলে তাকাল না। জয়নব আর জিতু তখন কাছাকাছি গিয়ে বলল, “মালেকুম চাচাজি।”
মানুষটা মুখ তুলে তাকাল, মাথায় পাকা চুল, চোখে চশমা, বলল, “ওয়ালাইকুম সালাম জয়নব বেটি। ওয়ালাইকুম সালাম জিতু মিয়া। তোমাদের সাথে এই মেয়েটি কে?”
জয়নব বলল, “মাস্টারবাড়ির নাতনি।”
জিতু যোগ করল, “রাশাপু।”
মানুষটা তখন সোজা হয়ে বসে, বইয়ের পৃষ্ঠা ভঁজ করে রাখল, বলল, “তুমি আজিজ মাস্টারের নাতনি? একটু কাছে আসো, তোমাকে ভালো করে দেখি।”
রাশা একটু এগিয়ে যায়, মানুষটা তার হাত ধরে সামনে বসিয়ে তাকে ভালো করে দেখল, তার মুখ কেমন একটা নরম হাসিতে ভরে যায়, তোমার চেহারায় আজিজ ভাই সাহেবের ছাড় আছে।
রাশা ঠিক কী করবে বুঝতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, আপনি আমার নাকে চিনতেন?
মানুষটি একটা হাসল, বলল, চিনতাম বললে কম বলা হবে। তোমার নানা আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন! বুঝেছ? দুইজন মানুষের সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে খাঁটি বন্ধুত্ব হয় কখন জানো? যখন দুইজন পাশাপাশি যুদ্ধ করে। তোমার নানা আর আমি একসাথে যুদ্ধ করেছি। তোমার নানা চিল আমাদের কামন্ডার।
মানুষটি পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে তার চশমা খুলে শার্টের কোনা দিয়ে মুছে বলল, তোমার নানা ধরা পড়ার পর যখন তাকে ধরে নিয়ে গেল, বুঝলে মেয়ে, আমাদের মনে হলে আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। ইস!
রাশা একটু বিস্ময় নিয়ে এই বয়স্ক মানুটির দিকে তাকিয়ে রাইল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল সে আসলে তার নানা কেমন মানুষ ছিলেন, কিভাবে মারা গিয়েছিলেন সে তার কিছুই জানে না।
মানুষটি একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যমনস্কভাবে বললত, আজিজ ভাই সাহেবকে আমি না করেছিলাম। বলেছিলাম এখন যাবেন না। তোমার মায়ের মাত্র জন্ম হয়েছে, দেখার জন্যে পাগল হয়ে গেল। এসে ধরা পড়ল। ভাবীর ওপর সেটা যে কী একটা ধাক্কা–আহারে! মানুষটা রাতারাতি অ্যাবনরমাল হয়ে গেল।
রাশা কিছুই জানে না, তার খুব জানার ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সে একটাও প্রশ্ন করল না। চুপ করে মানুষটার সামনে বসে রইল। মানুষটা বলল, সেই দেশের জন্যে তোমর নানা জান দিয়েছিল সেই দেখটাও বেঁচে আছি, চিন্তা করলে মাঝে মাঝে খুব অপরাধী লাগে।
রাশা বলল, “অপরাধী লাগবে কেন?”
“লাগার কথা না। কিন্তু অপরাধী লাগে। কী করব?” মানুষটা গলার স্বর পাল্টে বলল, “যাও মা। কোথায় যাচ্ছিলে যাও। বুড়ো মানুষ তো তোমাদের বয়সী মানুষ দেখলেই কথা বলতে ইচ্ছা করে। আর তুমি হচ্ছ-”
“রাশা।”
“হ্যাঁ। রাশা। তুমি হচ্ছ আজিজ ভাই সাহেবের নাতনি। তার মানে তুমি আমারও নাতনি। আমি হচ্ছি তোমার সালাম না।
“সালাম নানা?”
“হ্যাঁ। আজিজ নানার বন্ধু সালাম নানা।” মানুষটি রাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমি বুড়ো মানুষ নানা ডাকা ঠিক আছে। আজিজ ভাইয়ের সাথে কিন্তু নানা কথাটা যায় না। যখন শহীদ হয়েছে তখন তার বয়স তেইশ না হয় চব্বিশ। হাট্টাকাট্টা জোয়ান। কী সুন্দর রাজপুত্রের মতো চেহারা। কুচকুচে কালো চুল, যুদ্ধের সময় দাড়ি কাটতে পারে নাই বলে চে গুয়েভারার মতো দাড়ি। সে তো আমার মতো বুড়ো হয় নাই। তাকে কিন্তু
তুমি নানা ডাকবে না।”
“তাহলে কী ডাকব?”
“ভাই ডাকবে। আজিজ ভাই।”
মানুষটি গাছে হেলান দিয়ে ভারী চশমার ভেতর দিয়ে রাশার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইলেন।
সালাম নানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় রাশা লক্ষ করল, গাছে দুটি ক্রাচ হেলান দিয়ে রাখা আছে। কাঠের ক্রাচ, অনেক ব্যবহারে মসৃণ হয়ে আছে। তার মানে সালাম নানার পা নেই।
জয়নব বলল, “সালাম চাচা, আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় পায়ে গুলি খেয়েছিলেন, তাই পা কেটে ফেলেছে। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটেন।”
রাশা বলল, “ও।”
“আমাদের গ্রামে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা। একজন তোমার নানা–”
“আমার ভাই।”
জয়নব হাসল, বলল, “হ্যাঁ, তোমার ভাই, শহীদ। আরেকজন আমাদের সালাম চাচা।”
“এই গ্রামে কোনো রাজাকার নাই?”
“না। কোনো রাজাকার নাই। পাশের গ্রামে আছে।”
“কী নাম?”
“আহাদ আলী।”
রাশা নামটা যেন কোথায় শুনেছে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারল না।