দেখলে কত বড় বাড়ি?
সে এমনভাবে বলল যেন বাড়িটা ওর নিজের। আমি হাসলাম। ওর ছেলেমানুষিগুলো এখন আমার চোখে পড়তে শুরু করেছে। দোকানে কেনাকাটার সময় প্রথম চোখে পড়ল। যা দেখছে তা-ই দাম করছে। জাপানি একটা ডিনার সেট দাম করল। বাহান্ন পিসের সেট— দাম তের হাজার টাকা। সে গম্ভীর গলায় বলল, ফিক্সড প্রাইস? ভাবটা এ-রকম যেন ফিক্স্ড প্রাইস না হলে সে দরদাম করে কিনে ফেলবে। দোকানদাররা মানুষ চেনে। কে কি কিনবে বা কিনবে না তা চট করে ধরে ফেলে। সে জবাব পর্যন্ত দিল না। নোমান তাতে অপমানিত বোধ করল না বা রাগ করল না, পাশের দোকানে ফুলদানি দরদম করতে লাগল। এক একটার দাম দুহাজার টাকা। এমনভাবে দাম করছে যেন দুহাজার টাকা দামের ফুলদানি কয়েকটা কিনবে।
সফিক সাহেবের বাড়িতে ঢোকার পর থেকে সে আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে এত সুন্দর বাড়ি এই শহরে আর নেই। বাড়িতে কয়টা ঘর, কয়টা বাথরুম সমানে বলে যাচ্ছে। আমরা বসার ঘরে বসে আছি। ঝাড় বাতি টাতি দিয়ে এই ঘর এমন সাজানো যে এখানে বসে থাকতে ভাল লাগে না। মনে হয়। সিনেমার একটা বাড়িতে বসে আছি। সফিক সাহেবকে খবর পাঠানো হয়েছে। তিনি এখনো নামছেন না। আমরা যেখানে বসে আছি সেখান থেকেই দোতলার সিঁড়ি চলে গেছে। ভদ্রলোক এই সিঁড়ি ধরেই নামবেন। মার্বেল পাথরের সিঁড়ি। এই সিঁড়িতে কোনদিন হয়ত এক কণা ধূলিও পড়ে থাকে না। আমি সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আছি।
নবনী, বল তো এ বাড়ির বৈশিষ্ট্য কি?
তা তো বটেই, এ ছাড়া কি?
বলতে পারছি না।
এ বাড়ির ছাদে কি আছে বল?
ফুলের বাগান?
বাগান তো আছেই। রোজ গার্ডেন। এ ছাড়া কি আছে বল তোমাকে আগে বলেছিলাম। বাসর রাতে। মনে নেই?
মনে করতে পারছি না।
সুইমিং পুল। বিশাল সুইমিং পুল। বাড়ির ছাদে সুইমিং পুল থাকে কখনো শুনেছ?
না।
সফিকের আছে। চাঁদনী রাতে যে কি সুন্দর দেখা যায়! পানিতে চাঁদের ছায়া পড়ে। তখন বাড়ির সব বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। মেজাজ ভাল থাকলে অহনা ভাবী গান গান। উনি খুব সুন্দর গান জানেন।
তাই না-কি?
হ্যাঁ। উনি টিভির এ গ্রেডের শিল্পী। তবে টিভিতে খুব কম যান। গত মাসে প্রোগ্রাম পেয়েছিলেন যান নি।
সফিক সাহেব দোতলা থেকে নামছেন না। আমরা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। নোমানের তাতে অসুবিধা হচ্ছে না। সে বাড়ির গল্প করেই যাচ্ছে। আমার অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে খানিকক্ষণ পর দোতলা থেকে একটা কাজের লোক নেমে এসে বলবে, আজ উনার শরীরটা ভাল না, আরেকদিন আসুন। বুঝতে পারছি না। আমরা কতক্ষণ বসে থাকব। নোমানের মনে হয় বসে থাকতে ভালই লাগছে।
নবনী!
উঁ।
ছাদের উপর এই যে এত বড় সুইমিংপুল কিন্তু সফিক এখন পর্যন্ত পানিতে নেমে দেখে নি।
কেন?
ও না-কি সুইমিং পুল বানিয়েছে পানি দেখার জন্যে। গোসলের জন্যে তার শাওয়ারই ভাল। অন্যের গোসল করা নোংরা পানিতে সে নামবে না। হা হা হা। ওর কথাবার্তার তুমি কোন ঠিক পাবে না। তবে ও যা বলবে মনে হবে সেটাই সত্যি।
উনাদের ছেলেমেয়ে কি?
এখানো ছেলেমেয়ে হয় নি। মাত্র দুবছর আগে বিয়ে করেছে। ভাবী হলেন খুলনার মেয়ে।
ও আচ্ছা।
এত সুন্দর বাড়ি কিন্তু সফিকের পছন্দ না। ও তার নিজের ডিজাইনে আরেকটা বাড়ি বানাবে। ডিজাইন না-কি করা শুরু করেছে।
উনি কি আর্কিটেক্ট?
আরে না। পড়াশুনা করেছে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে, তবে সে ইচ্ছা করলে বাড়ি ডিজাইন আর্কিটেক্টের চেয়ে অনেক ভাল করবে। যে কোন আর্কিটেক্টের কান কেটে নিয়ে আসবে। ও পারে না এমন জিনিস নেই। এখন কি ঠিক করেছে জান? ছবি বানাবে। মুভি ক্যামেরা, লাইট ফাইট কিনে এলাহি কারবার করেছে।
তাই বুঝি?
মুভি ক্যামেরার দামই পড়েছে ১৪ লাখ টাকা। টাকা অবশ্যি তার কাছে কোন ব্যাপার না। ওর কাছে ১৪ লাখ যা ১৪ হাজারও তা।
উনি এখনো আসছেন না কেন?
আসবে। কাজে আটকা পড়ে গেছে আর কি? তোমার কি বসে থাকতে খারাপ লাগছে?
হ্যাঁ লাগছে।
এসো তাহলে সফিকের লাইব্রেরিটা দেখ। লাইব্রেরি দেখলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। দেখার মত জিনিস। হেন বই নাই যা তুমি লাইব্রেরিতে পাবে না। আসি তোমাকে লাইব্রেরি দেখাই।
লাইব্রেরি দেখতে ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছা করছে না কেন?
বুঝতে পারছি না। মনে হয়। শরীর খারাপ করেছে।
মাথা ধরেছে?
হুঁ।
জ্বর না-কি দেখি, কাছে আস তো।
সে আমার জ্বর দেখল। আর তখনি সফিক সাহেব দোতলা থেকে নেমে এলেন।
ফর্সা লম্বা একজন মানুষ। মাথাভরতি কোঁকড়ানো চুল। বড় বড় চোখ। তার গায়ে নীল রঙের। হাফ হাওয়াই শার্ট। পরনের প্যান্ট ধবধবে সাদা। ভদ্রলোক নামছেন হাসতে হাসতে। পায়ে চটি থাকার জন্যেই সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ফটফট শব্দ হচ্ছে। চটিতে এত শব্দ হবার কথা না। তিনি বোধহয় ইচ্ছে করেই শব্দ করছেন। কিংবা কে জানে বড়লোকরা হয়ত এই ভাবেই নামে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘদিনের পরিচিত ভঙ্গিতে বললেন, দাঁড়িয়ে পড়েছ যখন তখন আর বসার দরকার নেই—চল আমরা সরাসরি গাড়িতে উঠবো। আর শোন নবনী, তোমার আমি তুমি করে বলছি। নোমানকে তুই করে বলি, তার স্ত্রীকে আপনি করে বলা সেই কারণেই শোভন না। তবু তোমার আপত্তি থাকলে এক্ষুণি বলে ফেল। প্রথমেই ডিসিসান হয়ে যাক। আপনি না তুমি?
আপনি আমাকে তুমি করেই বলবেন।
আমার ইচ্ছা ছিল এ বাড়িতেই তোমাদের খাওয়াব। আমার স্ত্রী সেই উপলক্ষে রান্নাবান্নাও করেছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর ঝগড়া করে সে বাড়ি থেকে উধাও হয়েছে। কাজেই হোটেল ছাড়া গতি নেই। আমি যে নিচে নামতেই দেরি করেছি তার মূল কারণ অহনাকে টেলিফোনে ট্রেস করার চেষ্টা করছিলাম। ঢাকা শহরে তার একলক্ষ পরিচিত মানুষ। সে কোথায় গিয়ে বসে আছে কে জানে।
নোমান বলল, ভাবী নেই! বলিস কি?
তুই দেখি আকাশ থেকে পড়লি! ও তো এরকম করেই।
আমি বললাম, আজ না হয় বাদ থাকুক। আমরা অন্য একদিন আসব।
অন্য একদিন যে অহনাকে পাওয়া যাবে তোমাকে কে বলল? হোটেলে রিজার্ভেশন নেয়া আছে। চল যাই।
ভদ্রলোক এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। অপরিচিত একজন মানুষ যখন এভাবে তাকিয়ে থাকেন তখন অস্বস্তি লাগে। কিন্তু উনি যে তাকিয়ে আছেন— তাতে অস্বস্তি লাগছে না। কেন লাগছে না, তাও আমি বুঝতে পারছি না। তিনি হঠাৎ বললেন, নবনী দাড়াও। তোমার একটা ছবি তুলে রাখি। এই মুহূর্তে তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। সৌন্দর্য কোন ধ্রুব ব্যাপার না। ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। আজ তোমাকে অপূর্ব লাগছে তার মানে এই না যে কালও লাগবে। সুন্দর যখন লাগছে তখন তা ধরে রাখা যাক। তুমি দাড়াও।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। নোমান বলল ওর আচার-আচরণ আধা পাগলের মত। তুমি ওর কথায় অস্বস্তি বোধ করছ না তো?
না।
অস্বস্তি বোধ করবে না। সফিকের স্বভাবই এরকম। ওর মধ্যে লোকাছাপার কোন ব্যাপার নেই।
এত বড় হোটেলে আমি আগে কখনো আসি নি। পুরোপুরি হকচকিয়ে যাবার মত ব্যাপার। অথচ নোমান খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে। মনে হচ্ছে ও তার বন্ধুর সঙ্গে আগেও অনেকবার এসেছে। সফিক সাহেব হোটেলে পা দেবার পর থেকে আমার দিকে তেমন লক্ষ্য করছেন না। তিনি তাঁর বন্ধুকেই নিচু গলায় ক্রমাগত কি-সব যেন বলছেন। সেও খুব চিন্তিত মুখে শুনছে। আমি যে তার সামনে আছি। এটা বোধহয় সে আর জানে না।
ডাইনিং হলের ঠিক মাঝখানে চারজনের টেবিলে আমরা আছি। আমি এবং নোমান পাশাপাশি বসেছি। সফিক সাহেব বসেছেন আমাদের সামনে। তিনি নোমানের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে হঠাৎ আমাকে বললেন, চারজনের টেবিল কেন নিয়েছি জানি নবনী? চারজনের টেবিল নিয়েছি, কারণ হঠাৎ অহনা এসে উপস্থিত হতে পারে। তার রাগ যেমন চট করে উঠে আবার তেমনি চট করে পড়ে যায়। যদি এ রকম কোন ঘটনা ঘটে তাহলে সে খুঁজে পেতে বের করবে আমরা কোথায় আছি। তারপর হাসিমুখে উপস্থিত হবে। যেন কিছুই হয় নি। এ জন্যেই আমি খাবারের অর্ডার এখনো দিচ্ছি না। অপেক্ষা করছি। তোমার খিদে পায় নি তো?
জি না।
গুড। খিদেটা জমুক। খিদে ভালমত না জমলে খেতে পারবে না। যে হোটেল যত জমকালো তার খাবার তত খারাপ। নোমান, তুই মৃণালদের বাড়িতে একবার টেলিফোন করে দেখ তো। অহনা সেখানেও থাকতে পারে। আমি করেছিলাম, আমাকে নো বলে দিয়েছে। তোকে বোধহয় বলবে না।
ও উঠে চলে গেল। সফিক সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে আমার দিকে না তাকিয়ে হঠাৎ করে বললেন, নবনী শোন! তোমার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা
কথা শুনে ওর মনে বোধহয় কনফিউশন তৈরি হয়েছিল। আমি তাকে বলেছি এসব কথাবার্তায় কান না দিতে। মফস্বল শহরে মোটামুটি যারা রূপবতী তাদের নিয়ে নানা গল্পগাথা তৈরি হয়। মেয়েগুলোর জীবন হয় অতিষ্ঠ। তুমিতো আর মোটামুটি রূপবতী না। ভয়ঙ্কর রূপবতী। তোমাকে নিয়ে একশ একটা গল্প তৈরি হবার কথা। যাই হোক আমি নোমানকে বলে দিয়েছি ও যেন তোমার অতীত নিয়ে কখনোই প্রশ্ন না করে। ওকি কিছু জিজ্ঞেস করেছে?
না।
একবার যখন না বলে দিয়েছি তখন আর প্রশ্ন করবে না। আর যদি করেও তুমি কিছু বলবে না।
আমার বলার মত কিছু নেই।
থাকলেও বলবে না। নতুন বিয়ে হওয়া স্বামীর সঙ্গে দ্রুত ভাব করার জন্যে গড় গড় করে অনেক কিছু বলে দেয়। পরে সমস্যা হয়। নোমান ভাল ছেলে। আমি তাকে খুব পছন্দ করি। আমি চাই না— তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে…
সফিক সাহেব চুপ করে গেলেন, কারণ নোমান ফিরে আসছে। আমার বিরক্ত লাগছে। আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপারে উনি কথা বলছেন কেন? তাছাড়া আমার সঙ্গে আজই তার প্রথম কথা হচ্ছে। প্রথম আলাপে এ জাতীয় প্ৰসঙ্গ তোলার কোন কারণ আছে কি?
সফিক সাহেব ওর দিকে তাকিয়ে বললেন–পাওয়া গেছে?
না।
কোথায় আছে কিছু বলল?
নোমান মিটিমিটি হাসছে। কোন একটা আনন্দের খবর গোপন করতে গিয়ে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা যেভাবে হাসে সে রকম হাসি। সফিক ওর হাসি দেখেই বললেন, ও কি হোটেলের দিকেই রওনা হয়েছে?
হ্যাঁ।
গুড। তাহলে খাবারের অর্ডার দেয়া যাক। আমি আমার পছন্দেই খাবার দিতে বলি। এদের সব খাবার মুখে দেয়া যায় না। দু-একটা আইটেম শুধু এরা ভাল করে।
সফিক সাহেব আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, আমি যে একটা ছবি বানাচ্ছি। নোমান কি তোমাকে বলেছে?
জ্বি বলেছে।
সেই ছবির নায়িকাকে কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবে। তবে নায়িকার গায়ের রং কালো। কালো রঙের নায়িকা বাংলাদেশে চলবে বলে মনে হয় না। এদেশের নায়িকাদের গায়ের রং হতে হয় দুধে আলতায় এবং ওজন হতে হয় তিন মণের বেশি।
আমি লক্ষ্য করলাম। সফিক সাহেব আনন্দে ঝলমল করছেন। স্ত্রী আসছে। এই খবরে কারও মুখ এত আনন্দময় হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। ভদ্রলোককে এখন আমার ভাল লাগছে। অহনা নামের মেয়েটি মনে হচ্ছে খুব ভাগ্যবতী। আমি ভদ্রমহিলার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি।
তিনি চলে এলেন দশ মিনিটের মাথায়। তার গায়ের রঙ কালো। বেশ কালো। কিন্তু সেই কালো রঙেও একটা মানুষকে যে এত সুন্দর দেখা যায় আমি জানতাম না। হালকা কমলা রঙের সিল্ক শাড়ি পরেছেন। বেণী করা চুলের গোড়ায় ছোট ছোট নীল রঙের ফুল। নিশ্চয়ই প্লাস্টিকের ফুল। সত্যিকার ফুল নীল হয় না। তবে দেখাচ্ছে সত্যি ফুলের মতই। তিনি হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকলেন। তার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ডাইনিং রুমটাও যেন হেসে উঠল।
সফিক সাহেব বললেন, তুমি যে আসবে আমি জানতাম। এই দেখ তোমার জন্যেই ডাইনিং রুমের মাঝখানে টেবিল নিয়েছি। নবনী শোন, এই কালো মেয়েটা কোণার দিকের টেবিলে বসতে পারে না। ও সব সময় বসবে মাঝখানে।
অহনা বললেন, অবশ্যই আমি মাঝখানে বসব। এমনভাবে বসব যেন সবাই তাকায় আমার দিকে। এই দেখ এক্ষুণি তাকানো শুরু করেছে।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি। ওরা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছেন। আমরা দুজন যে আছি সেদিকে ওঁদের খেয়াল নেই। সফিক সাহেব একবার বললেন, অহনা, নোমানের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বল। ওর নাম নবনী। দেখা কি ভয়ঙ্কর সুন্দর! প্ৰায় তোমার কাছাকাছি।
ভয়ঙ্কর বলছি কেন? সুন্দর কি ভয়ঙ্কর হয়?
মাঝে মাঝে হয়।
অহনা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। হেসেই অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন–চিংড়ি মাছ খেলে কোলেস্টরেল বাড়ে না কমে এটা নিয়ে আলোচনা শুরু হল। অহনার ধারণা, কোলেক্টরেল কমে যায়। সফিক সাহেবের ধারণা তা না।
সফিক সাহেব বললেন, এত জিনিস থাকতে আমরা চিংড়ি মাছ নিয়ে আলোচনা করছি কেন?
অহনা এতে খিলখিল করে হাসতে শুরু করলেন। যেন দারুণ মজার কথা। এদের সঙ্গে চুপচাপ বসে থাকতে আমার এত খারাপ লাগছে! নোমানের লাগছে না। ওরা যখন হাসছে নোমানও হাসছে। এরা যখন গভীর কোন বিষয় নিয়ে কথা বলছে তখন সেও গম্ভীর মুখে কথা শুনছে। অহনা বললেন, নোমান, চিংড়ি মাছ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা?
আমার কোন ধারণা নেই ভাবী।
চিংড়ি মাছ খাওয়াটা কি মকরু না হালাল?
তাও জানি না।
তুমি দেখি কিছুই জান না। আচ্ছা একটা কাজ কর। চট করে হোটেলের শাপ থেকে আমার জন্যে একটা জিনিস নিয়ে এসো… মাথা ধরার টেবলেট। প্ৰচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথা ধরা না কমলে কিছু খেতে পারব না।
ও সঙ্গে সঙ্গে রওনা হল। আমার ভাল লাগছে না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই মহিলা খুব সূক্ষ্মভাবে আমাকে দেখিয়ে দিতে চাচ্ছেন যে আমার অবস্থান অনেক নিচে। তাদের চাকর-বাকদের কাছাকাছি।
সফিক সাহেব কি বুঝতে পারছেন যে আমি নোমানকে এভাবে উঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারটা পছন্দ করি নি। কারণ তিনি কেমন যেন লজ্জিত ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। তিনি কোমল গলায় বললেন, নবনী!
জ্বি।
চিংড়ি মাছ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? এটা খাওয়া কি হালাল, মকরু না নিষিদ্ধ।
সামুদ্রিক চিংড়ি যদি হয় তাহলে হালাল। আমার একজন স্যার ছিলেন এই সব ব্যাপার খুব ভাল জানতেন। তিনি বলেছেন কোরান শরীফের একটা আয়াত আছে তাতে বলা হয়েছে— সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য তোমাদের জন্যে হালাল।
সমুদ্রেতো সাপও আছে। সেই সাপও কি হালাল?
আমি কিছু বললাম না। সফিক সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বিশেষ কিছু ধরার চেষ্টা করছেন। উনি কি আমার স্যারের ব্যাপারটা জানেন? জানলে কতটুকু জানেন?
অহনা আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, আপনাদের বিয়েতে আমাদের দুজনেরই যাবার কথা ছিল। ও ব্যাংকক চলে যাওয়ায় যেতে পারি নি।
আমি কিছু বললাম না। অহনা বললেন, আমি ডিনারের সঙ্গে রেড ওয়াইন নেব। এবং ডিনারের শেষে একটা সিগারেট খাব। আশা করি কিছু মনে করবেন না।
জ্বি না। কিছু মনে করব না।
খাবার চলে এসেছে। কত পদের খাবার যে আসছে। আমার ভালই খিদে কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছা করছে না। নোমান ওষুধ নিয়ে ফিরে এসেছে। অহনা সেই ওষুধ টেবিলের এক কোণায় ফেলে রেখেছেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে না এই ওষুধ তিনি খাবেন।
অহনা বললেন, চিংড়ি মাছ বিষয়ে আমি একটা কথা বলতে পারি। এই কথা শোনার পর নবনী আর চিংড়ি মাছ খাবে না বলে আমার ধারণা। কথাটা হল— চিংড়ি, কাঁকড়া এবং মাকড়শা এরা তিনজনই একই গোত্রের প্রাণী। এদের ডিম থাকে শরীরের বাইরে। চিংড়ি মাছ খাওয়া আর মাকড়সা খাওয়া একই ব্যাপার।
অহনার কথা শোনার পর আমি সতি সত্যি চিংড়ি মাছ খেতে পারলাম না। নোমান কয়েকবার সাধাসাধি করল। মুখ কাচুমাচু করে বলল, খাও না, খাও না। কত বড় বড় চিংড়ি। এগুলো তো আর মাকড়সা না।
অহনা কিছুই বললেন না। শুধু হাসলেন। সেই হাসি আমার ভাল লাগল না।
আমার খুব ক্লান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে এই খাবার টেবিলেই আমি ঘুমিয়ে পড়বা। আমার এ রকম মাঝে মাঝে হয়। হঠাৎ নিজেকে অসহায় এবং খুব ক্লান্ত মনে হয়। আশেপাশে কোথায় কি হচ্ছে, কে কি বলছে কিছুই বুঝতে পারি না। কারোর কোন কথাবার্তাও তখন কানে আসে না। চারপাশের কোলাহলের শব্দ স্তিমিত হয়ে আসে। মনে হয় আমি একাকী দূরে কোথাও চলে যাচ্ছি। এইত আমার পাশেই নোমান বসে আছে। সে মাঝে মাঝেই হো হো করে হোসে উঠছে। গল্প শুনে হাসছে। হাসির গল্পগুলো যিনি বলছেন তার নাম অহনা। কালো একটি মেয়ে। কালো হয়েও পৃথিবীর সব রূপ যিনি নিজের শরীরে নিয়ে নিয়েছেন। তিনি নিশ্চয়ই খুব ভাল গল্প করতে পারেন। কারণ গল্প শুনে শুধু যে নোমান হাসছে তা-না। সফিক সাহেব হাসছেন, অহনা নিজেও হাসছেন। তাদের হাসির শব্দে আশেপাশের সবাই ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। মজার মজার সব গল্প কিন্তু আমার কানে আসছে না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সফিক সাহেব হঠাৎ আমার দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, নবনী তোমার কি শরীর খারাপ?
আমি বললাম, না।
তুমি কিছু খাচ্ছ না। খাবার ভাল লাগছে না?
লাগছে। চামচ দিয়ে আমি খাবার নাড়াচাড়া করছি। চামচগুলো কি রূপার? ঝকঝাক করছে। সারাক্ষণই ভয় হচ্ছে এই বুঝি হাত থেকে চামচ পড়ে যাবে। রূপার চামচ মেঝেতে পড়লে কেমন শব্দ হয়? রিনিঝিনি করে বাজে?
সফিক সাহেবের গাড়ি আমাদের বাসায় নামিয়ে দিল। নোমান বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলল, এরা কি রকম অসাধারণ মানুষ লক্ষ্য করলে? অহঙ্কার বলে এক বস্তু স্বামীস্ত্রী কারো মধ্যে নেই। ওয়াইন খেতে দেখলে তুমি অস্বস্তি বোধ কর, এই জন্যে অহনা ভাবী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওয়াইন নেয় নি। সিগারেটও খান নি। অহনা সিগারেট ছাড়া থাকতে পারে না। নবনী! নাও এই খামটা যত্ন করে তুলে রাখ।
আমি বললাম, কি আছে। এই খামে?
নোমান হতভম্ব গলায় বলল, কি আছে তুমি জান না।
না।
কি আশ্চৰ্য। অহনা নিজের হাতে এই খাম আমাকে দিল। তোমার সামনেই তো দিল। আমাদের বিয়ে উপলক্ষে গিফট?
আমি লক্ষ্য করি নি?
লক্ষ্য করি নি মানে?
অন্যমনস্ক ছিলাম।
সফিক তাহলে ঠিকই ধরেছিল–তোমার শরীর খারাপ।
কি আছে। এই খামে?
দশ হাজার টাকার একটা চেক আছে। ক্যাশ টাকা দিয়েছে আমরা নিজেরা যাতে নিজেদের পছন্দ মত কিছু কিনতে পারি। এই খাম নিয়ে কত কথাবার্তা হল— তুমি কিছুই শুনানি?
না।
খাম হাতে নোমান বোকা বোকা মুখ করে দীর্ঘক্ষণ বসে রইল। আমার এই আচরণ সে যেন মিলাতে পারছে না। এক সময় বলল, চল ঘুমুতে যাই।
আমি বললাম, তুমি ঘুমাও আমি একটু পরে যাব।
তুমি কি করবে?
নিজের হাতে চা বানিয়ে এক কাপ চা খাব। তারপর ইরাকে একটা চিঠি লিখব। আসার পর ইরাকে কোন খবর দেয়া হয় নি। ও নিশ্চয়ই চিঠির জন্যে অপেক্ষা করছে।
চিঠি দিনের বেলা লিখলেই হয়।
দিনে আমি চিঠি লিখতে পারি না।
ও আচ্ছা।
তুমি কি চা খাবে? বানাবো তোমার জন্যে?
আমিতো চা একেবারেই খাই না। রাতে খেলে ঘুম হবে না।
প্রতি রাতে ঘুমুতে হবে। এমনতো কোন কথা নেই। চা খেয়ে তুমি জেগে। থাক। আমি এর মধ্যে চিঠি শেষ করে ফেলি। তারপর দুজন এক সঙ্গে ঘুমুতে যাব।
আচ্ছা।
আমি চা বানাচ্ছি। ও বসে আছে বারান্দায়। তার মাথার উপর ময়নার খাঁচা। খাঁচাটা এখন আবার কালো কাপড়ে ঢাকা। ময়নার খাঁচা না-কি কালো কাপড় দিয়ে না ঢাকলে ময়না ঘুমুতে পারে না। নোমান মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছে আমার দিকে। সম্ভবত আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছে।
ইরা,
এই কিছুক্ষণ আগে আমি আমার সংসার শুরু করেছি। কেরোসিনের চুলায় চা বানিয়েছি দুজনের জন্যে। আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রান্না। চা তেমন ভাল হয় নি। ও কোথেকে যেন সস্তা ধরনের চায়ের পাতা এনেছে। অনেকক্ষণ জ্বাল দেবার পরেও রং আসেনি। পানসে ধরনের চা খেয়ে সে। বলেছে–এত ভাল চা সে জীবনেও খায় নি। এখন থেকে সে না-কি রোজ রাতে বারান্দায় বসে চা খাবে।
এখনো সে বারান্দায় বসে আছে। বেচারার বোধহয় ইচ্ছা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমুতে যাবে। যেহেতু আমি চিঠি লিখতে বসেছি সে অপেক্ষা করছে। বারান্দায়। একজন আদর্শ স্ত্রীর উচিত এই অবস্থায় চিঠি লেখা বন্ধ করে। স্বামীর সঙ্গে ঘুমুতে যাওয়া। আমার মনে হয় আমি কোনদিনও আদর্শ স্ত্রী হতে পারব না–কারণ তোকে চিঠি লিখতেই আমার ভাল লাগছে। ও অপেক্ষা করুক। অপেক্ষায় আনন্দ আছে।
অপেক্ষা করুক। অপেক্ষায় আনন্দ আছে। তাছাড়া আমার মনে হয় বারান্দায় বসে থাকতেও তার ভাল লাগছে। অন্তত বসে থাকার ভঙ্গি থেকে তাই মনে হয়। বসে থাকার মধ্যেও সুখী সুখী এবং দুখী দুখী ভঙ্গি আছে। ও বসে আছে সুখী সুখী ভঙ্গিতে।
আমি কেমন আছি। এই দিয়ে শুরু করি। ভাল আছি। নিরিবিলিতে শান্তিতে আছি। আমাদের দুজনের ছোট্ট এক কামরার ঘর। দুটি মাত্ৰ প্ৰাণী। ভুল বললাম, দুটি না তিনটি প্রাণী। একটা পোষা ময়না। ও বলছে ময়না না-কি রাজনীতিবিদদের মত ক্রমাগত কথা বলে। তবে আমি এখনো তার কোন কথা শুনি নি। ও আচ্ছা একবার শোনেছি। ময়নাটা পুরুষের মত গলায় বলেছে নবনী! ঠিক করেছি। কাল ভোর থেকে সংসার গুছাব। তবে সংসা গুছানোরও কিছু নেই। সবই গোছানো। আমার কাজ হল এই গোছানো সংসারে নিজের জায়গা করে নেয়া। সেই জায়গা করে নিতে খুব অসুবিধা হয় নি। কোন মেয়েরই বোধহয় হয় না। নোমান সম্পর্কে বলি (স্বামীর নাম ধরে লিখলাম বলে ভুরু কুঁচকাচ্ছিসনাতো?) মানুষটা ভালই। ওর মধ্যে সরল সরল ব্যাপার আছে। জটিলতা তেমন নেই। নেই বলেই ভয়ে ভয়ে আছি। আমরা মানুষের জটিলতা দেখেই অভ্যস্ত। সারল্যাকে আমরা ভয় করি। কারো ভেতর ঐ ব্যাপারটি দেখতে পেলে থমকে যাই এবং আমাদের মনের একটি অংশ বলতে থাকে–নিশ্চয়ই কোন একটা রহস্য আছে।
মানুষটার ভেতর রহস্য তেমন নেই। সাদাসিধা মানুষ। একটু বোধ হয় কৃপণ। প্রতিটি পয়সা হিসেব করে খরচ করে। চা খাব বলে চিনি কিনে এনেছে–ছোট্ট একটা পুটলায় এতটুকু চিনি। তার ময়না পাখিটার জন্যে কলা কিনে এনেছে। একটা কলার অর্ধেকটা কেটে খাইয়েছে বাকি অর্ধেক পলিথিনের ব্যাগে মোড়ে রেখে দিয়েছে। পরে খাওয়াবে।
আমি বাথরুমে গোসল করলাম। সাবানটা মেঝেতে ফেলে এসেছিলাম। পরের বার ঘরে ঢুকে দেখি সেই সাবান সে সোপকেসে তুলে রেখে বাথরুমের মেঝে ন্যাকরা দিয়া মুছেছে। যাতে মেঝেটা শুকনো খটখট করে। আমাকে অবশ্যি কিছু বলে নি। পৃথিবীর সব স্বামীই বিয়ের পর পর স্ত্রীদের উপর তাদের যে অধিকার আছে সেই অধিকার ফলাতে চেষ্টা করে। কেউ কেউ স্থূলভাবে করে কেউ সূক্ষ্মভাবে করে। যেমন ধরা হঠাৎ বলবে—এক গ্রাস পানি দাওতো। অথচ হাতের কাছেই হয়ত পানির গ্লাস। এই মানুষটা এখন পর্যন্ত তা করছে না। মনে হয় করবে না। শুরুতে যে করে না সে পরেও করে না। মানুষের চরিত্রের সব দোষ গুণ চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরই ধারা পড়ার কথা।
ইরা, তোকে বসিয়ে রেখে আমি এখন বারান্দায় যাব। দেখে আসিব মানুষটা কি করছে। এখনো জেগে আছে না ঘুমিয়ে পড়েছে। তাছাড়া কলামটাও বদলাতে হবে। এই কলম দিয়ে ভাল লিখতে পারছি না। আরেকটা কলম দরকার। ঘরে আর কলম আছে কি-না জানি না। ওকে বলতে হবে। যদি দেখি ও ঘুমিয়ে পড়েছে তাহলে আজ আর চিঠি শেষ হবে না। তোকে যে কথা দিয়েছিলাম পৌঁছেই চিঠি দেব তা আর সম্ভব হবে না। দেরী হয়ে যাবে। কাল হয়ত আর চিঠি লিখতে ইচ্ছা করবে না।
মানুষটা জেগেই ছিল। আমাকে দেখে আগ্রহ নিয়ে বলল, চিঠি লেখা কি শেষ? আমার মায়াই লাগল, আহা বেচারা। কিন্তু মায়াকে প্রশ্ৰয় দিলাম না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, ঘরে কি আর কলম আছে? সে বলল, ড্রয়ারে আছে। দাঁড়াও আমি বের করে দি। দুটা কলম টেবিলের উপর রেখে মুগ্ধ গলায় বলল, তোমার হাতের লেখা এত সুন্দর! তার বলার ভঙ্গিটি এমন যেন আমি আমার মস্তবড় কোন গুণ এতক্ষণ তার চোখের আড়াল করে রেখেছিলাম।
আমি বললাম, তোমার হাতের লেখা কি খুব খারাপ?
সে বলল, না। আমার হাতের লেখাও খুব সুন্দর। দাঁড়াও তোমাকে দেখাই বলেই এক টুকরা কাগজ নিয়ে লিখল–নবনী। নবনী!
ইরা তোকে বললাম না, লোকটা সরল ধরনের। সরল না হলে কখনোই কাগজ নিয়ে তার হাতের লেখার পরীক্ষা দিতে বসতো না। বুদ্ধিমানরা এই কাজ কখনো করে না।
আমি বললাম, তোমার হাতের লেখা আমার চেয়েও সুন্দর। এখন এক কাজ করা বিছানায় শুয়ে থাক। আমার চিঠি প্ৰায় শেষ হয়ে এসেছে। আর মাত্ৰ দশ পনেরো মিনিট। চিঠি শেষ করেই আমি চলে আসিব। ও বাধ্য ছেলের মত ঘুমুতে গেল। আমি চিঠি নিয়ে বসলাম।
অনেক কিছুই তোকে লিখতে ইচ্ছা করছে। যেমন ধর, আমরা যে অ্যাজ ওরা এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল তাঁর কথা। সেই ভদ্রলোকের নাম সফিক। তিনি ওর অফিসের প্রধান ব্যক্তি। অফিসটাই তাঁর। মানুষের কি পরিমাণ টাকা যে থাকতে পারে তা তাঁকে না দেখলে বোঝা যাবে না। ভদ্রলোক ওরা ছেলেবেলার বন্ধু। এতে আমার আনন্দিত হওয়া উচিত। কিন্তু আনন্দিত হতে পারছি না। আকাশের সঙ্গে পাতালের বন্ধুত্ব হয় না। হওয়া বোধহয় ঠিকও নয়। ভদ্রলোকের ব্যবহার চমৎকার, কথাবার্তা চমৎকার। কিন্তু তবু আমার ভাল লাগল না। কেন লাগল না তাও বুঝতে পারছি না। ভদ্রলোকের স্ত্রীর নাম হল অহনা। আমি প্ৰথম ভেবেছিলাম–নামি গহনা। পরে শুনি অহনা। নামটা সুন্দর তাই না? এই ভদ্রমহিলার গায়ের রঙ কালো। কালো রঙ্গের মেয়ে যে এত রূপবতী হতে পারে কে জানত–ইনাদের সম্পর্কে তোকে আরো লিখব। আপাতত এইটুক।
তোদের কথা আমি কিছুই জানতে চাচ্ছি না। জানি তুই নিজ থেকেই সব লিখবি। কিছুই বাদ দিবি না।
তোকে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার। সুটকেস খুলে দেখি লাইব্রেরি থাকে আনা উপন্যাসটা তিথির নীল তোয়ালে। তুই স্যুটকেসে দিয়ে দিয়েছিস। বই পড়ার সময় পাচ্ছি না। কাহিনী কি তাও ভুলে গেছি। আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। তোর চোখ কান এতটা খোলা তা বুঝতে পারি নি। তোর এত বুদ্ধি কেন?
ভাল থাকিস। ইতি তোর আপা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দুটা দশ। ও বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে। বারান্দায় দরজা খোলা। তাকে যতটা সাবধানী এবং গোছানো বলে মনে হচ্ছিল। আসলে সে ততটা না। বারান্দার দরজা খোলা রেখে সে ঘুমাতো না।
আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলো পড়েছে বারান্দায়। সরল ধরনের আলো আসত। সে রকম জটিল নকশাদার আলো নয়। ও জেগে থাকলে তাকে নিয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসা যেত। এমন চট করে ঘুমিয়ে পড়বে তা ভাবি নি। ওকে কি ডেকে তুলব?
আমি এসে তার গায়ে হাত রাখলাম। সে পাথরের মত হয়ে আছে। ঘুমন্ত মানুষের গা স্পর্শ করলে সে একটু না একটু নড়ে উঠবেই। নোমান নড়ল না। সমান তালে তার নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। আমরা দুজন পাশাপাশি হয়ে আছি। ওর গায়ের পুরুষ পুরুষ ঘামের গন্ধে আমি কি অভ্যস্ত হয়ে গেছি? আজতো তেমন খারাপ লাগছে না। বরং ইচ্ছা করছে। ওর গা ঘেঁসে ঘুমুতে। একটা হাত ওর শরীরে তুলে দিলে ওকি জেগে উঠবে? না-কি ঘুমের ঘোরে সে হাত সরিয়ে দেবে? দীর্ঘদিন ধরে সে নিশ্চয়ই একা একা ঘুমুচ্ছে। একা ঘুমিয়েই সে অভ্যস্ত। শরীরের উপর একটা বাড়তি হাতের চাপ কি সে সহ্য করবে?
জানালা গলে চাঁদের আলো আমাদের হাঁটুর উপর এসে পড়েছে। শরীরের একটি অংশ আলোকিত হয়ে আছে। নোমান বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। দুঃস্বপ্ন দেখছে কি? বারান্দায় কালো কাপড়ে ঢাকা ময়নাটাও ছটফট করছে। কে জানে হয়ত এরা দুজন একই সঙ্গে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। পাখিদের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন বলে কি কিছু আছে?
আমি ওর গা থেকে হাত সরিয়ে নিজের মত শুয়ে পড়লাম। শাড়ির আঁচলে শরীর ঢেকে শোয়া। পাশ ফিরতেই খাট নড়ে উঠল। এই খাটের পায়াগুলো সমান না, বড় ছোট আছে। একটু নড়লেই খটখট শব্দ হয়। আমি একটা হাত ওর গায়ে রাখলাম ও ধড়মড় করে উঠে বসে ভয়ার্তা গলায় বলল, কে?
আমি বললাম, কেউ না। তুমি ঘুমাও।
সে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। আবার তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। সে যে উঠে বসে, কে বলে চেঁচিয়েছে তা ঘুমের মধ্যেই করেছে। ঘুমন্ত মানুষের আচার-আচরণ আমার মত ভাল কেউ জানে না। রাতের পর রাত আমি অম্বুমো কাটিয়েছি। আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছে ইরা। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি— ঘুমন্ত মানুষ কি করে। ঘুমন্ত মানুষের আচার আরণের ব্যাপারে আমাকে একজন এক্সপার্ট বলা যেতে পারে।
আজো ঘুম আসছে না। প্রচণ্ড ইচ্ছা করছে। ওকে ডেকে তুলে বলি–এই শোন আমার ঘুম আসছে না। আমার খুব খারাপ ধরনের একটা অসুখ আছে। আমার রাতে ঘুম হয় না। একা একা জেগে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়। তুমি এসে আমার সঙ্গে বারান্দায় খানিকক্ষণ বস। আমার জীবনের ভয়াবহ একটা গল্প আছে। গল্পটা এখনো তোমাকে বলা হয় নি–আজ খানিকটা বলব।
চাঁদের আলো ওর হাঁটুর উপর থেকে সরে গেছে। এখন আলো এসে পড়েছে বিছানার উপর। যেন টর্চ ফেলে ফেলে কেউ বিছানাটা পরীক্ষা করছে।
আমি উঠে বসলাম। খাটটা আবার ক্যাচ করে শব্দ করে উঠল। ও বলল, কে? আমি এবার কোন জবাব দিলাম না। ও আবারো গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ল। খাঁচার ময়না পাখি খচ খচ শব্দ করছে।–
আশ্চর্যের ব্যাপার আমাদের স্যারেরও একটা পাখি ছিল। তিনি একটা কাক পুষেছিলেন। তার কোন খাঁচা ছিল না। কাকটা এসে প্রায় সারাদিনই রেলিং-এ বসে থাকত। কাকটার বোধহয় বয়স হয়ে গিয়েছিল। খাবার খুঁজে বেড়াবার সামর্থ্য ছিল না। কিংবা কে জানে হয়ত স্যারকে তার পছন্দ হয়েছিল।
স্যার যখন আমাদের বাড়িতে থাকতে এলেন তখন ব্যাপারটা আমার তেমন পছন্দ হয় নি। মৌলানা। টাইপের একজন লোক বাসায় থাকবে। নানা ধরনের উপদেশ দেবে। কি দরকার? বাড়ি ভাড়া দিয়ে আমাদের যে টাকা পেতে হবে এমনও না। কিন্তু বাবার তাকে খুব পছন্দ হয়ে গেল। তিনি দরাজ গলায় বললেন, সুফি টাইপের একজন মানুষ থাকছে। থাক না। অসুবিধা কি? পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে। আল্লাহ বিল্লাহ করবে। এই বাড়ি থেকেতো আল্লাহ খোদার নাম উঠেই গেছে।
মা ক্ষীণ গলায় বললেন, বাইরের একজন মানুষ!
বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, সেতো আর তোমার বিছানায় এসে শুয়ে থাকবে না। সে থাকবে তার মত। উত্তরের দরজাটা পার্মানেন্ট বন্ধ করে দিলেই সে আলাদা হয়ে যাবে। নিজের মত থাকবে। নিজে রান্না করে খাবে।
উত্তরের দরজা আমরা ভেতর থেকে বন্ধ করে স্যারকে থাকতে দিলাম। তিনি তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে একদিন দুপুর বেলা দুটা রিকশা করে উপস্থিত।
প্রথম কিছুদিন আমি শঙ্কিত ছিলাম— হয়ত যখন স্যারকে দেখা যাবে আমাদের বসার ঘরে বসে আছেন। হয়ত ছাদে গিয়েছি দেখব জায়নামাজ হাতে তিনিও ছাদে উঠে এসেছেন নামায পড়ার জন্যে। কিংবা কলেজে দেখা হলে তিনি পরিচিত ভঙ্গিতে বলবেন, এই যে নবনী খবর কি? আর ক্লাসের সব ছাত্রী আমাকে ক্ষেপাবে।
বাস্তবে তার কিছুই হল না। স্যার কলেজে যান। কলেজ থেকে ফিরে বাসায় আসেন। আর তার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। আমাদের বাড়ির একটা অংশে যে একজন মানুষ বাস করে তা মনেই হয় না। শুধু ছাদ থেকে আমি মাঝে মাঝে দেখি তিনি বারান্দায় রান্না চড়িয়েছেন। একদিন তাঁর পোষা কাকটাকে দেখলাম। শুরুতে কাকটা রেলিং-এ বসেছিল। তারপর রেলিং থেকে নেমে গম্ভীর ভঙ্গিতে হেঁটে স্যারের পাশে বসে থাকল। ভাবটা এ রকম যেন সেও রান্নাবান্না তদারক করছে। এরকম মজার দৃশ্য আমি আমার জীবনে আর দেখি নি।
আমি যখনই ছাদে উঠতাম কিছুটা সময় কাটাতাম কাকটাকে দেখার জন্যে। কি করে সে এ বাড়ির একজন সদস্যের মত চলাফেরা করে। গম্ভীর তার ভাবভঙ্গি।
একদিন ছাদে গিয়ে যথারীতি উঁকি দিয়েছি–দেখি বাঁশের চাটাই দিয়ে বারান্দার অংশটা ঢাকা। ছাদ থেকে বারান্দা দেখার কোনই উপায় নেই। আমার খুব মেজাজ খারাপ হল। কাণ্ডটা নিশ্চয়ই স্যার করেছেন। যাতে বারান্দা থেকে তাকে একজন তরুণী মেয়ের মুখ দেখতে না হয়। ধর্মে বাধা নিষেধ আছে। আমার কাছে মনে হল তিনি ইচ্ছা করে আমাকে অপমান করলেন।
সেদিন সন্ধ্যায়। মা তালের পিঠা করেছেন। ইরাকে বললেন, মাস্টার সাহেবকে কয়েকটা পিঠা দিয়ে আয়তো ইরা। বেচারা একা একা থাকে। কি খায় না খায় কে জানে? ইরা বলল, আমি পারব না। আপাকে পিঠা নিয়ে যেতে বল। ওর কলেজের স্যার। ওরই নিয়ে যাওয়া উচিত।
আমি আপত্তি করলাম না। স্যারকে কিছু কঠিন কথা শুনাতে ইচ্ছা করছিল। পিঠা দিতে গিয়ে সেই কথাগুলো শুনিয়ে আসা যাবে।
স্যার আমাকে দেখে এতাই অবাক হলেন যে বলার কথা নয়। যেন এ রকম অস্বাভাবিক ঘটনা। এর আগে তাঁর জীবনে কখনো ঘটে নি। আমি বললাম, স্যার মা আপনার জন্যে কিছু তালের পিঠা পাঠিয়েছেন।
তিনি হড়বড় করে বললেন, শুকরিয়া। শুকরিয়া। তোমার মাকে হাজার শুকরিয়া।
স্যার আমাকে বসতে বলছেন না। আমি যে কথাগুলো বলব বলে ভেবে এসেছি সেগুলো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে চলে যাওয়া যায় না। আমাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও বসতে হবে। আমি বললাম, স্যার আমি কি কিছুক্ষণের জন্যে আপনার এখানে বসতে পারি?
অবশ্যই পার। বোস। বোস।
তিনি অতিরিক্ত রকমের ব্যস্ত হয় পড়লেন। নিজেই ছুটে গিয়ে বারান্দা থেকে চেয়ার নিয়ে এলেন। আমি বসলাম না। কঠিন গলায় বললাম, স্যার বসতে ভয় লাগছে। আমারতো বোরকা পরা নেই। এইভাবে আপনার সামনে আসাই হয়ত ঠিক হয় নি। মা পিঠা দিয়ে যেতে বললেন বলেই এসেছি। নয়ত আসতাম না। আপনাকে বিব্রত করার আমার কোন ইচ্ছা নেই।
আমি বিব্রত হচ্ছি না।
অবশ্যই হচ্ছেন। বিব্রত না হলে বারান্দায় চাটাইয়ের বেড়া দিতেন না। এই কাণ্ডটা করেছেন কারণ চাটাইয়ের বেড়াটা না দিলে বোরকা নেই এমন একটা মেয়েকে মাঝে মাঝে আপনার দেখতে হয়। বিরাট একটা পাপ হয়। এত বড় পাপের শাস্তি হল দোজখ। আমাকে দেখার কারণে আপনি দোজখে যাবেন তা-কি হয়? দোজখে সুন্দর সুন্দর পরী অপেক্ষা করছে।
আমি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করলাম। কঠিন কিছু কথা বলার ছিল বলতে পারলাম না, কারণ আমি দেখলাম। তিনি খুবই দুঃখিত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, স্যার যাই।
তিনি বললেন, একটু বোস। এক মিনিট। আমার উপর এরকম রাগ করে চলে গেলে আমার খারাপ লাগবে। একটু বসে যাও।
আমি বসলাম।
তিনি বললেন–চাটাইয়ের বেড়াটা আমি আমার জন্যে দেই নি। তোমার জন্যে দিয়েছি। আমার মনে হয়েছিল–তোমার একা একা ছাদে হাঁটার অভ্যাস— আমার জন্যে স্বাধীনভাবে তা করতে পারছ না। তোমাকে এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেবার জন্যেই এটা করেছি। তুমি যে এমন রেগে যাবে বুঝতে পারি নি। তোমর রাগ কি একটু কমেছে?
আমি কিছু বললাম না। তিনি যেন নিজের মনে কথা বলছেন এমন ভঙ্গিতে বললেন–বোরকা নিয়ে তোমার মনে বড় ধরনের ক্ষোভ আছে বলে মনে হয়। এরকম থাকা উচিত না। আমাদের প্রফেটের সময়ের যুগটা ছিল আলমে জাহিলিয়াতে যুগ। মানুষের প্রবৃত্তি ছিল পশুদের কাছাকাছি। মেয়েরা রাস্তায় বের হলে মানুষেরা নানাভাবে তাদের উত্যক্ত করত। মেয়েরাও যে ছেলেদের চেয়ে আলাদা ছিল তা না। তারাও এতে মজা পেত। তারাও চাইতো যেন পুরুষরা তাদের উত্যক্ত করে, তাদেরকে দেখে অশ্ৰীল অঙ্গ ভঙ্গি করে। কারণ যুগটাই হচ্ছে পশুত্বের যুগ। কাজেই আমাদের নবী এমন একটা ব্যবস্থা করলেন যাতে সবাই বুঝতে পারে— মুসলমান মেয়েরা অন্যদের মত না। তারা পবিত্র। তারা আলাদা। তাদেরকে নিয়ে এসব করা যাবে না। তারা তা চায়ও না। কাজেই নবী আদেশ দিলেন মেয়েরা যেন চাদরে তাদের শরীর ঢেকে নিজেদের অন্যদের চেয়ে আলাদা করে ফেলে। চাদরে ঢাকা একটা মেয়ে দেখলে সবাই যেন বোঝে এই মেয়ে আর দশটা মেয়ের মত না। এর সঙ্গে ভদ্র আচরণ করতে হবে। তুমি কি বুঝতে পারছি নবনী?
আমি কিছু বললাম না। স্যার বললেন, বেহেশতে পরী পাওয়া সম্পর্কে তুমি যা বললে সেটা নিয়েও কথা আছে। তুমি যেমন স্থূলভাবে বললে তা কিন্তু না। পরে তোমাকে বুঝিয়ে বলব।
আমাকে বুঝিয়ে বলার কোন দরকার নেই। আপনি বুঝলেই হল।
আমি দাঁড়ালাম। স্যার হেসে ফেললেন। এত সুন্দর করে আমি বোধহয় কাউকে হাসতে দেখি নি। আমার সারা শরীর ঝনঝনি করে উঠল। ঘণ্টা বেজে উঠার মত শব্দ। এই ঘণ্টা সর্বনাশের ঘণ্টা। আমি প্ৰায় ছুটে চলে এলাম। মেয়েরা ঠিক কিভাবে ছেলেদের প্রেমে পড়ে? একজনের প্রতি অন্যজনের তীব্র আকর্ষণটা কিভাবে তৈরি হয়। গল্প উপন্যাসের ব্যাপার। আর বাস্তবের ব্যাপার কি এক রকম না আলাদা? প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা তার ভালবাসও কি আলাদা?
একজন আরেকজনকে দেখেই পাগলের মত হয়ে গেল এমনকি সত্যি কখনো হয়েছে? না-কি এগুলি শুধু কথার কথা?
আমার কি হয়েছে? আমি কি এই মানুষটির প্রেমে পড়ে গেছি? প্রেমের মত কি আছে। এই মানুষটার? মানুষটি যদি বিবাহিত হত, তার কয়েকটা ছেলেমেয়ে থাকতো তাহলেও কি আমি ঠিক এইভাবেই আকৰ্ষিত হতাম।
সারারাত আমার ঘুম হল না। জীবনে এই প্রথম আমার ঘুমহীন রাত্রি যাপন। কি যে এক ভয়ঙ্কর কষ্ট। বিছানায় এপাশ ও পাশ করছি আর ভাবছি ভোর হচ্ছে না কেন? ভোর হোক। মনে হচ্ছে ভোর হলে আমার কষ্টটা কমবে।
সূৰ্য উঠার আগে আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম। দরজা খুলে বারান্দায় এসে দেখি মা ফজরের নামাযের জন্যে অজু করছেন। আমাকে দেখে বললেন, কিরে আজ এত সকালে ঘুম ভাঙলো যে।
একবার ভোরবেলা উঠে দেখলাম কেমন লাগে।
রোজ ভোরে উঠে ছাদে ঘোরাঘুরি করবি দেখবি শরীরটা কেমন ভাল লাগে।
তুমি তাই কর না-কি মা?
হুঁ। তোরা ছাদে যাস সন্ধ্যাবেলায় আমি যাই ভোরবেলায়।
মা আনন্দিত ভঙ্গিতে হাসছেন। আমি ছাদে চলে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় মনে হতে লাগল আচ্ছা ছাদে উঠে যদি দেখি স্যার ছাদে হাঁটাহাঁটি করছেন। তাহলে কি হবে? ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। খুবই স্বাভাবিক। উনি নিশ্চয়ই নামায পড়ার জন্যে ভোরবেলায় উঠেছেন। একবার উঠলে ছাদে কি আর যাবেন না। এত সুন্দর একটা ছাদ।
ছাদে কাউকে পেলাম না। আশাভঙ্গের তীব্ৰ কষ্টে প্রায় কান্না পাওয়ার মত হয়ে গেল। আমার ইচ্ছা করতে লাগল–এক্ষুণি ছুটে গিয়ে উনার দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলি– স্যার আমাদের ছাদটা খুব সুন্দর। আসুন আপনাকে দেখাই। এখন থেকে রোজ ভোরবেলা ছাদে বেড়াতে আসবেন। এতে আপনার শরীর খুব ভাল থাকবে।
সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ। উনি কি আসছেন। ছাদে? অবশ্যই আসছেন। উনি ছাড়া আর কে হবে? আমি আমার শাড়িটার দিকে তাকালাম। বেছে বেছে আজকের দিনে আমি এমন একটা বাজে শাড়ি পরেছি। আচ্ছা আমার চোখে ময়লা জমে নেইতো? আমার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। কি বলব আমি স্যারকে?
না। স্যার না। মা এসেছেন। মার হাতে দুকাপ চা। আমার জন্যে চা এনেছেন। এত ভাল আমার মা কিন্তু সেদিন ভোরবেলায় মাকে দেখে মনটা ভেঙে গেল। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করল, তুমি এসেছ কেন মা? কেন তুমি এসেছ? কে তোমাকে আসতে বলেছ?…
চাঁদের আলো খাট থেকে নেমে গেছে। নোমানের ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে বসতে বসতে অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে?
আমি বললাম, কিছু হয় নি?
ঘুমুচ্ছ না?
না। আমার ঘুম আসছে না।
শরীর খারাপ করেছে না-কি?
জ্বর? সে হাত বাড়িয়ে আমার কপাল স্পর্শ করল। আহ তার হাতটা কি ঠাণ্ডা।