০৪. সপ্তাহে একদিন মিজান সাহেব

সপ্তাহে একদিন মিজান সাহেব লীনা ও বাবলুকে নিয়ে পড়াতে বসেন। দিনটা হচ্ছে বৃহস্পতিবার। গত সপ্তাহে তিনি পড়ানোর কাজটি করেন নি। বাবলুর মনে ক্ষীণ আশা—হয়ত আজও পড়াবেন না। বাসার পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। ভাইয়া এখনো ফেরে নি। তার কোনোরকম খোঁজও নেই। বড় আপা ঐ রাতের ঘটনার পর কারো সঙ্গে কথা বলছে না। মার শরীরও খুব খারাপ। এখন বেশিরভাগ সময় বিছানাতেই থাকেন। এ রকম একটা অস্বাভাবিক পরিবেশে বাবা নিশ্চয়ই বই নিয়ে পড়াতে বসবেন না। তবু বাবলুর বুক ধকধক করছে। সন্ধ্যা মিলানোর আগেই হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে গেছে। পড়ছে খুব উঁচু গলায়, যাতে বাবা ধারণা করে নেন পড়াশোনা তো ভালোই হচ্ছে।

বাবলু এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। তার রোল নাম্বার চার। ধর্ম পরীক্ষায় সে একশতে মাত্র চল্লিশ পেয়েছে বলে এই অবস্থা হয়েছে। ধর্ম স্যার কেন জানি বাবলুকে দেখতে পারেন না। ধর্ম মৌখিক পরীক্ষায় তাকে পচিশের মধ্যে মাত্র পাঁচ দিয়েছেন অথচ সে ধর্মের পাঁচটি ভিত কী বলেছে, এশার নামাজের নিয়ত বলেছে, কুলহুআল্লা সুরা বলেছে, চার সাহাবাদের নাম বলেছে। শুধুবী কত বৎসর বয়সে নবুয়ত পেয়েছেন এটা বলতে পারে নি। দুঃখের ব্যাপার হল এটা বলতে না পারার জন্যে স্যার তাকে একটা চড় মারলেন। পরীক্ষার সময় কেউ কিছু না পারলে কি চড় মারা ঠিক? বাবলু অনেক ভেবেও বের করতে পারে নি কেন ধর্ম স্যার তাকে দেখতে পারেন না। তার অপরাধটা কী? সে তো ক্লাসে কোনো গণ্ডগোল করে না। হৈ-চৈ করে না বা হেড স্যারকে অন্যদের মতো হেড়ু বলে না।

বাবলুর ধারণা বাবাও তাকে দেখতে পারেন না। বৃহস্পতিবারে পড়তে বসা মানেই মার খাওয়া। অথচ সে সব প্রশ্নের উত্তর জানে। সে যদি না জেনে মার খেত তাহলেও একটা কথা ছিল। বাবলু ঠিক করে রেখেছে আর একটু বড় হলেই সে ভাইয়ার মতো পালিয়ে যাবে।

বাবলুর সামনে লীনা বসে আছে। তার মুখও ফ্যাকাশে। সে একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ঘড়িতে কোনোক্ৰমে আটটা বেজে গেলে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে। আটটার পর বাবা আর পড়াতে বসেন না।

লীনা এ বছর ক্লাস টেনে উঠেছে। পড়াশোনায় সেও ভালো। যদিও পরীক্ষায় ভালো করতে পারে না। পরীক্ষার হলে বসলেই তার হাত কাঁপে। যে জিনিসটা জানা আছে। তাও লিখতে পারে না। লীনা ফিসফিস করে বলল, বাবা বোধ হয় আজ পড়াবে না। তাই নারে বাবলু? আটটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট।

বাবলুর মুখে আনন্দের একটা আভা খেলে গেল। ঠিক তখন মিজান সাহেব ডাকলেন, লীনা। লীনার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি।

বীণাকে বল আমাকে এক কাপ আদা চা দিতে।

লীনার মুখে রক্ত ফিরে এল। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। বাবা চা খাবেন—চা খেতেখেতে আটটা বেজে যাবে। খবরের টাইম হয়ে যাবে। তিনি আধা ঘন্টা খবর শুনবেন তারপর ভাত খাবার সময় হয়ে যাবে। লীনা বীণাকে চায়ের কথা বলতে গেল। যাবার আগে বাবলুর দিকে তাকিয়ে আনন্দের হাসি হাসল।

এমনিতেই বাবার সঙ্গে বীণার তেমন কথাবার্তা হয় না। ঐ রাতের ঘটনার পর কথাবার্তা একেবারেই বন্ধ। শুধু কথাবার্তা না, বীণা বাবার দিকে মুখ তুলে তাকায়ও না। মিজান সাহেব যতক্ষণ বাসায় থাকেন ততক্ষণ বীণা হয় তার নিজের ঘরে কিংবা রান্নাঘরে থাকে।

অন্ধকার বারান্দায় মিজান সাহেব চুপ করে বসে আছেন। বীণা বাবার পাশে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। মিজান সাহেব দেখলেন বীর হাতে ঘড়ি নেই। কয়েকদিন ধরেই তিনি ব্যাপারটা লক্ষ করছেন। বীণা তার বাবার দেয়া ঘড়ি পরছে না। একবার জিজ্ঞেস করা যায় না কেন?

মিজান সাহেব চা শেষ করে শীতল গলায় বললেন, লীনা বাবলু বই নিয়ে আয়।

বীণা মার জন্যে সাগু বানাচ্ছিল। বাবলু পাংশু মুখে পাশে এসে দাঁড়াল। ফিস ফিস করে বলল, আপা, বাবা আমাকে মারবে।

মারবে কেন?

অঙ্ক বই হারিয়ে ফেলেছি আপা।

আজ অন্য পড়া পড়। অঙ্ক না কালি।

যদি অঙ্ক করতে বলে?

বীণা উত্তরে কিছু বলতে পারল না। বারান্দা থেকে মিজান সাহেব কঠিন গলায়। বললেন, বাবলু রান্নাঘরে তুই কী করছিস? এদিকে আয়।

বাবল অঙ্ক বই হারিয়ে ফেলেছে এটা কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়ল। শুধু অঙ্ক বই না, সে জ্যামিতি বাক্সও হারিয়ে ফেলেছে। জ্যামিতি বাক্স হারিয়েছে দশ দিন আগে। বাবলু ভয়ে কাউকে কিছু বলে নি।

মিজান সাহেব বাবলুকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। ফরিদাকে বললেন, তুমি একটু বাইরে যাও। কোন কথা বলবে না। বাইরে যেতে বলছি বাইরে যাও। ফরিদা শুকনো মুখে বের হয়ে এলেন। মিজান সাহেব দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে দিলেন। কঠিন শাসনের সময় তিনি সাধারণত বাতি নিভিয়ে দেন।

রান্নাঘরের কাজ ফেলে বীণা বন্ধ দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ফরিদা জলচৌকিতে বসে আছেন। লীনা এখন চোখের সামনে বই ধরে আছে। তার মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। সে অল্প অল্প কাঁপছে। তার ইচ্ছা করছে দৌড়ে দাদীর কাছে চলে যেতে। আবার কেন জানি সে সাহসও হচ্ছে না। দাদীকেও সে খানিকটা ভয় করে।

মার শুরু হয়েছে।

রাগে অন্ধ হয়ে মার।

বাবলু গোঙাতে গোঙাতে বলল, তুমি আমার একটা কথা শোন বাবা। তুমি আমার একটা কথা শুধু শোন।

কী কথা?

আমি আর বই হারাব না।

কথা শেষ হয়েছে?

হ্যাঁ।

মার আবার শুরু হল। বাবলু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কোনোদিন বই হারাব না বাবা। কোনোদিন বই হারাব না।

চুপ।

বাবা, আমার একটা কথা শুধু শোন। একটা মাত্ৰ কথা।

চুপ।

কিছুক্ষণ মারের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না। তারপর শোনা গেল বাবলুক্ষীণ স্বরে ডাকছে—আপা, ও আপা, ও বড় আপা।

বীণা বন্ধ দরজায় হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের ঘর থেকে বীণার দাদী চিৎকার করছেন, বিষয় কি? বিষয় কি? ও হারামজাদার দল বিষয় কি?

কেউ তাঁর কোনো জবাব দিচ্ছে না।

 

বাবলু রাতে কিছুই খেতে পারল না। তার সমস্ত গা ফুলে উঠেছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। বীণা এক গ্লাস গরম দুধ এনে দিয়েছিল, খানিকটা খেয়েই বমি করে ফেলল। রাত দশটার দিকে মিজান সাহেব এক জন ডাক্তার ডেকে আনলেন। হতভম্ব ডাক্তার বললেন, এরকম হল কীভাবে?

মিজান সাহেব বললেন, আমি মেরেছি। হাড় গোড় ভেঙেছে কিনা এইটা আপনি দেখুন।

ডাক্তার স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বাবলুকে যখন জিজ্ঞেস করলেন, ব্যথা লাগছে খোকা?

বাবলু বলল, জ্বি না।

ডাক্তার সাহেব বললেন, এত মেরেছেন কেন? ছেলে কী করেছে?

মিজান সাহেব শীতল গলায় বললেন, কী জন্যে মেরেছি তা দিয়ে তো আপনার দরকার নেই ভাই। চিকিৎসা করতে এসেছেন চিকিৎসা করে চলে যাবেন।

মিজান সাহেব ভিজিটের টাকা বের করলেন।

বীণা রাতে কিছু খায় নি। কয়ার পাশে একা একা বসে আছে। ফরিদাও খান নি। তিনি দুজনের জন্যে ভাত বেড়ে কুয়ার পাড়ে মেয়েকে ডাকতে এলেন।

ভাত খাবি আয়রে বীণা।

ভাত খাব না মা। কেন খাবি না?

ইচ্ছে করছে না। তাই খাব না।

তোর বাবার উপর রাগ করেছিস?

না। বাবার উপর আমি রাগ করি নি মা। রাগ করেছি তোমার ওপর। কেন তুমি বাবাকে আটকাও না? কেন এই সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক?

ফরিদা ক্ষীণ স্বরে কী বললেন কিছু বোঝা গেল না। বীণা বলল, আমাকে সাধাসাধি করে কিছু হবে না মা। আমি ভাত খাব না। তুমি বরং বাবলুর কাছে যাও। বাবলুকে একটু আদর টাদর কর।

বাবলু ঘুমিয়ে পড়েছে।

ঘুমিয়ে পড়লে তো ভালোই। তুমিও খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়।

তুই এখানে বসে থাকবি নাকি?

না আমিও ঘুমুব। এখানে শুধু শুধু বসে থাকব কেন?

ফরিদা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলেন।

বাবলু ঘুমায় নি। সে এবং লীনা এক খাটে ঘুমায়। অন্য খাটে বুলু। বুলু নেই বলে দুজন দুখাটে ঘুমুচ্ছে। আজ লীনা শুয়েছে বাবলুর সঙ্গে। তারা দুই ভাইৰােন প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করে। নিছ গলায় গল্প। সেই সব গল্পের কোনো আগা নেই। মাথা নেই। আজও দুজন গল্প করছে। বেশিরভাগ কথা লীনাই বলছে। বাবলু হা হু দিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে লীনা হঠাৎ বলল, বেশি ব্যথা পেয়েছিলি বাবলু?

বাবলু বলল, হ্যাঁ। লীনার সঙ্গে নিশিরাতের কথা বার্তায় সে কখনো মিথ্যা বলে না।

 

বীণা অনেক রাতে ঘুমুতে গেল।

দাদী তখনো জেগে। বীণার পায়ের শব্দ শুনেই বললেন, তোর বাবার মাথায় কী হইছে রে বীণা? আইজ আবার মারল? এরা হইল পাগলের বংশ বুঝলি। আমার শশুরের বাপ ছিল পাগল। বদ্ধ পাগল। হেই বংশের ধারা। রক্ত বড় কঠিন জিনিস। মানুষ মইরা যায় রক্ত থাকে। বাপের কাছ থাইক্যা পায় পুলা। পুলার কাছ থাইকা তার পুলা। তার পুলার কাছ থাইকা তার পুলা। তার পুলার কাছ থাইক্যা…..

চুপ কর দাদী।

তুই চুপ কর হারামজাদী। তুই মর।

বীণা কথা বাড়ায় না। শুয়ে পড়ে। অসহ্য গরমে তার ঘুম আসে না। জেগে জেগে শুনে বারান্দায় বাবা হাঁটাহাঁটি করছেন। এ মাথা থেকে ও মাথায় যাচ্ছেন। আবার ফিরে আসছে। বীণা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

গরম লাগছে। গা ঘেমে যাচ্ছে। ই একটা ফ্যান যদি এ ঘরে থাকত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *