সারাদিন আকাশে মেঘের ছিটেফোটাও ছিল না। সন্ধ্যায় আকাশ কালো করে মেঘ করল। বৃষ্টি এবং ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করল রাত আটটা থেকে। একেকবার বাতাসের ঝাপ্টা আসে, বাগানের লোহার দোলনা দুলে উঠে কটকট শব্দ হয়। শহরের বাড়ি-ঘরে বৃষ্টির শব্দ পাওয়া যায় না। মায়া লজে পাওয়া যায়। টিনের চালে বৃষ্টির যে শব্দ ওঠে, কোনো এক অদ্ভুত কারণে এ বাড়িতেও ওঠে।
মোতাহার হোসেন শুভ্রর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘরের সবকটিা জানালা খোলা। বাতাসে জানালার পর্দা উড়ছে। বৃষ্টির ছাট ঘরে ঢুকছে। শুভ্র বসে আছে কম্পিউটারের সামনে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে তার কোনো যোগ আছে। বাইরের ঝড়-বৃষ্টির খবরই হয়তো সে জানে না। মোতাহার হোসেন খুশি খুশি গলায় বললেন, Hello young man!
শুভ্ৰ কম্পিউটার থেকে চোখ ফেরাল বাবার দিকে। তার মুখও হাসি হাসি। সে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, Hello old man and the sea!
মোতাহার হোসেন বললেন, সিরিয়াস বৃষ্টি-বাদলার দিনে তুই কম্পিউটারের সামনে বসে আছিস কেন?
শুভ্র বলল, বৃষ্টি-বাদলার দিনে আমার কী করা উচিত?
বৃষ্টিতে ভিজবি? আয় বৃষ্টিতে ভিজি। আগে কম্পিউটার অফ কর। বৃষ্টির সঙ্গে কম্পিউটার যায় না।
শুভ্ৰ কম্পিউটার অফ করতে করতে বলল, বাবা, ভেতরে এসো। গল্প করি। মোতাহার হোসেন ঘরে ঢুকলেন। ছেলের মুখোমুখি না বসে তার পাশে বসলেন। পাশাপাশি বসলে মাঝে-মধ্যে ছেলের গায়ে হাত রেখে কথা বলা যায়। মুখোমুখি বসলে সেটা সম্ভব হয় না।
শুভ্ৰ! জ্বি বাবা।
প্রবল বৃষ্টিকে ইংরেজিতে বলে Raining cats and dogs. কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক কী তুই জানিস?
শুভ্র বলল, কুকুর এবং বিড়াল- এরা হলো একজন আরেকজনের শত্রু। এরা যখন ঝগড়া শুরু করে, তখন একজন অন্যজনের উপর প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই জন্যেই প্রবল বেগের বৃষ্টি হলো ক্যাটস অ্যান্ড ডগস।
মোতাহার হোসেন মুগ্ধ গলায় বললেন, এমন কোনো বিষয় কি আছে যা তোর জানা নেই?
শুভ্র বলল, তুমি এত মুগ্ধ হয়ো না। বাবা। Cats and Dogs-এর যে ব্যাখ্যাটা দিয়েছি সেটা বানিয়ে দিয়েছি। আমি আসল ব্যাখ্যা জানি না।
তুই জানিস না?
না।
ব্যাখ্যাটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং। আমার পছন্দ হয়েছে। তোর মা যে তোর উপর ভয়ঙ্কর রেগে আছে— এটা কি তুই জানিস? তুই না-কি ম্যাজিকের কথা বলে একটা দড়ি কেটে তার হাতে দিয়ে দিয়েছিস? দড়ি যে-রকম ছিল সে-রকম আছে। সে খুবই অপমানিত বোধ করছে। হা-হা-হা।
মার অপমান হয়েছে- তুমি তাতে এত খুশি কেন?
তাকে বোকা বানানো গেছে— এতেই মনে হয়। আমি খুশি।
শুভ্র বলল, মাকে বোকা বানানোর তো কিছু নেই। বেচারি তো বোকাই।
মোতাহার হোসেন আগ্রহ নিয়ে বললেন, তোর মা বোকা?
শুভ্র বলল, হ্যাঁ।
বুদ্ধির স্কেল যদি এক থেকে দশ হয়, তুই তোর মাকে কত দিবি?
তিন দেব।
আর আমাকে?
তোমাকে নয় দেব।
নয় কেন? দিশ না কেন?
শুভ্র বলল, নিজের বুদ্ধি নিয়ে তোমার অহঙ্কার আছে, এই জন্যেই এক পয়েন্ট কাটলাম। যাদের বুদ্ধি দশে দশ— তারা তাদের বুদ্ধি নিয়ে অহঙ্কার করবে না। অস্বস্তি বোধ করবে।
অস্বস্তি বোধ করবে। কেন?
বুদ্ধি বেশি কেন— এই নিয়ে অস্বস্তি।
তোর বুদ্ধি কি দশে দশ?
হ্যাঁ।
তোর কথার মধ্যেও তো অহঙ্কার প্রকাশ পাচ্ছে।
তুমি জিজ্ঞেস করেছ বলেই অহঙ্কারের কথাটা বলেছি। জিজ্ঞেস না করলে বলতাম না।
তোর বুদ্ধি যে দশে দশ- তার কিছু প্রমাণ দে।
শুভ্র বলল, যে আমাকে যে-রকম দেখতে চায়, আমি তার কাছে সে-রকম থাকি। মা আমাকে একটা অসহায় ছেলে হিসেবে দেখতে চায়, যে ছেলে নিজের কোনো কাজই গুছিয়ে করতে পারে না। দাঁত ব্ৰাশ করে টুথপেস্টের মুখ লাগাতে ভুলে যায়। বাইরে বের হবার সময় চুল আঁচড়াতে ভুলে যায়। রোজ শেভ করার কথা ভুলে যায়। মাকে খুশি করার জন্যে এই কাজগুলি আমি ইচ্ছা করে করি। আর তুমি আমাকে একজন সুপার ইন্টেলিজেন্ট ছেলে হিসেবে দেখতে চাও! এখন তুমিই বলো, তোমার কাছে কি আমি সুপার ইন্টেলিজেন্ট ছেলে হিসেবে নিজেকে উপস্থিত করি নি?
তুই বলতে চাচ্ছিস যে, তুই আসলে ইন্টেলিজেন্ট না, অথচ ভান করছিস ইন্টেলিজেন্ট। ইন্টেলিজেন্স কি ভান করা যায়?
একেবারেই যে করা যায় না তা-না। স্যার আলেক গিনিসের মতো বড় অভিনেতারা বোকার অভিনয় যেমন করতে পারেন, বুদ্ধিমানের অভিনয়ও পারেন। পারেন না?
সেই ক্ষেত্রে তোকে আমি অভিনয়ে দশে দশ দিতে পারি। বুদ্ধিতে কেন দেব?
শুভ্র বলল, আচ্ছা দিও না। মোতাহার হোসেন বললেন, রোজ সকালে তুই কম্পিউটারে কি বাজনা বাজাস?
শুভ্র আগ্রহ নিয়ে বলল, তোমার কাছে কি বাজনার মতো মনে হয়? না-কি Noise-এর মতো লাগে?
বাজনার মতোই লাগে, তবে উল্টাপাল্টা বাজনা। তুই কি কোনো বাজনা শিখতে চাস? পিয়ানো, বেহালা?
শুভ্র বলল, না।
মোতাহার হোসেন ছেলের গায়ে হাত রাখলেন।
শুভ্র বলল, বাবা, কফি খাবে? আমার ঘরে কফি-মেশিন বসিয়েছি। এই দেখ। কফি খেতে চাইলে আমি তোমাকে এক্সপ্রেসো কফি বানিয়ে খাওয়াতে পারি। এই মেশিনে এক্সপ্রেসো কফি হয়।
কফি খাব না।
একটা ছবিতে আমি দেখেছিলাম— ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ছবির নায়ক গরম এক মগ কফি নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে কফি খাচ্ছে। ছবিটা দেখার পর আমি ঠিক করেছিলাম— কোনো একদিন যদি সিরিয়াস বৃষ্টি নামে, তাহলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কফি খাব।
মোতাহার হোসেন বললেন, ঠিক আছে, কফি খাওয়া যাক।
শুভ্র আগ্রহ নিয়ে বলল, কোথায় ভিজবে বাবা, ছাদে না বাগানে?
তোর যেখানে ইচ্ছা।
তাহলে বাগানে চল। দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে কফি-উৎসব।
AS you wish.
বৃষ্টি ভালোই নেমেছে। কফির মাগে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। শুভ্র বলল, বাবা, মগে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে কিন্তু কফি ঠাণ্ডা হচ্ছে না কেন বলে তো?
মোতাহার হোসেন বললেন, জানি না।
শুভ্র বলল, সব কিছুই রিলেটিভ। কফি যে হারে ঠাণ্ডা হচ্ছে। আমরাও হচ্ছি। কাজেই টেম্পারেচার ডিফারেন্স থেকেই যাচ্ছে।
ও আচ্ছা।
বাবা, তুমি কি জানো মাঝে-মাঝে অন্ধকারেও বৃষ্টি দেখা যায়?
না জানি না।
প্রকৃতি নানান মজা করে। সমুদ্র-ফেনায় ফ্লোরেসেন্ট আলো দিয়ে দেয় বলে অন্ধকারে সমুদ্র-ফেনা দেখা যায়। একইভাবে বৃষ্টির পানিতেও হঠাৎ হঠাৎ ফ্লোরেসেন্ট দিয়ে দেয়, তখন অন্ধকারে বৃষ্টি দেখা যায়।
ও আচ্ছা।
বাবা, আমি এখন কী করছি জানো? সুন্দর সুন্দর দৃশ্য গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছি— যাতে অন্ধ হয়ে যাবার পরেও স্মৃতি থেকে দৃশ্যগুলি দেখতে পারি।
মোতাহার হোসেন জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।
জাহানারা মাইগ্রেনের ব্যথায় কাতর হয়েছিলেন। ব্যথা প্ৰবল হলে তিনি দরজাজানালা বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। ঘর থাকে অন্ধকার। এই সময় তার ঘরে কারোরই আসার হুকুম নেই। শুধু সকিনা আসতে পারে। সে বাটি ভর্তি বরফ মেশানো পানি নিয়ে আসে। সেই হিমশীতল পানি দিয়ে তার পায়ের তালু মুছিয়ে দেয়। এতে মাইগ্রেনের ব্যথা সামান্য আরাম হয়।
সকিনা বাটি ভর্তি পানি এনেছে। পায়ের তালু মুছিয়ে দিচ্ছে। জাহানারা আরাম পাচ্ছেন। সকিনা নিচু গলায় বলল, মা, উত্তরের জানালাটা একটু খুলব? জাহানারা বিস্মিত হয়ে বললেন, বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, তুমি জানালা খুলবে কেন? তাছাড়া জানালা কেন বন্ধ করা হয়েছে তুমি জানো। মাইগ্রেনের ব্যথা উঠলে আমি জানালা বন্ধ করি। মাঝে-মাঝে তুমি যে উদ্ভট কথা বলো, আমার খুব রাগ লাগে।
সকিনা বলল, মা, আমার ভুল হয়েছে। ক্ষমা করে দেন।
জাহানারা বললেন, হঠাৎ জানালা খোলার কথাটা তোমার মনে এসেছে কেন— এটা বলো।
জানালা খুললে একটা মজার দৃশ্য দেখতে পেতেন।
কী মজার দৃশ্য?
সকিনা জবাব দিল না। জাহানারার পায়ে হাত বুলাতে থাকল। জাহানারার ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে পা দিয়ে একটা লাথি দিতে। এই মেয়ে মাঝে-মাঝে রাগ দেখায়। রাগ দেখিয়ে কথা বন্ধ করে দেয়। তুই দুই পয়সার চাকরানি, তোর আবার রাগ কী?
সকিনা!
জি মা।
জানালা খুললে কী মজার দৃশ্য দেখব?
সকিনা জবাব দিল না। জাহানারার পায়ে ঠাণ্ডা হাত ঘষতে লাগল। জাহানারা উঠে বসতে বসতে কঠিন গলায় বললেন, যাও জানালা খোল। দেখি কী দৃশ্য। আর একটা কথা মন দিয়ে শোন সকিনা। আমি যে-কোনো দিন তোমাকে বিদায় করে দেব। তোমাকে দিয়ে আমার পোযাচ্ছে না। তুমি গাট্টি-বোচক নিয়ে চলে যাবে। যে গর্ত থেকে এসেছিলে সেই গর্তে ঢুকবে। সেটা কাল সকালেও হতে পারে, আবার একমাস পরেও হতে পারে।
জাহানারা এসে জানালার পাশে দাঁড়ালেন এবং হতভম্ব হয়ে গেলেন। শুভ্র এবং শুভ্রর বাবা দোলনায় বসে আছে। তাদের দুজনের হাতেই মগ। তারা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মাগে চুমুক দিচ্ছে। জাহানারা বললেন, কী হচ্ছে এসব?
সকিনা বলল, দুজনে মজা করছেন।
এটা কী রকম মজা? শুভ্রর বাবা কি জানে না যে শুভ্রর ঠাণ্ডার ধাত? সকিনা যাও, আমার জন্যে ছাতা নিয়ে আসা। আমি জিজ্ঞেস করব। এই ফাজলামির মানে কী?
সকিনা ক্ষীণ স্বরে বলল, মজা করছে করুক না মা।
জাহানারা তীব্র গলায় বললেন, এটার নাম মজা? একে মজা বলে?
সকিনা জবাব দিল না। রাগে-দুঃখে জাহানারার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি লুকানোর চেষ্টাও করছেন না। দুজনে মিলে বৃষ্টিতে মজা করে ভিজছে, তাকে কিছু বলেও নি। তিনিও নিশ্চয়ই কফির মগ হাতে নিয়ে তাদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজতে পারতেন।
সকিনা! –
জি মা।
শুভ্র এবং শুভ্রর বাবা এরা আমাকে দেখতে পারে না— এটা তুমি জানো? এই বাড়িতে তোমার যে অবস্থান আমার অবস্থান তারচে আলাদা কিছু না।
শুধু শুধু মন খারাপ করবেন না মা।
শুধু শুধু মন খারাপ করছি না, আমি সত্যি কথা বলছি। আমার ছেলে সবাইকে ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। রাম, শ্যাম, যদু, মধু, আধু, বন্ধু, গদু কেউ বাদ নেই, শুধু আমি বাদ।
ভাইজান ভেবেছেন। আপনি ম্যাজিক দেখলে মজা পাবেন না— এই জন্যে আপনাকে দেখান নি।
তুমি উল্টা-পাল্টা কথা বলবে না। থাপ্পর খাবে। তোমাকে ছেলের হয়ে উকালতি করতে হবে না। তুমি হাইকোর্টের ব্যারিস্টার না। তুমি দুই পয়সার চাকরানি। বুঝেছি?
জি মা বুঝেছি।
একটা টাওয়েল রেডি করে রাখ। শুভ্রর বৃষ্টি-বৃষ্টি খেলা শেষ হলেই নিজে উপস্থিত থেকে তাকে মাথা মোছানোর ব্যবস্থা করবে। গরম চা বানিয়ে দেবে। টাওয়েল দিয়ে মাথা পুরোপুরি শুকানো যাবে না। হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকাবে। কাজটা আমিই করতাম। কিন্তু আমি আগামী দুদিন ছেলের মুখ দেখব না।
মা, আপনি শুয়ে পড়ুন।
আমাকে নিয়ে তোমার ব্যস্ত হতে হবে না। ওরা যতক্ষণ বাগানে বসে। থাকবে, ততক্ষণ আমি ওদের দিকে তাকিয়ে থাকব। আচ্ছা, ওরা কি আমাকে দেখতে পাচ্ছে?
জি-না, দেখতে পাচ্ছে না। ঘর তো অন্ধকার, এই জন্যে দেখতে পাচ্ছে না।
দেখতে পাচ্ছে না। এইটুকু বললেই হবে। কেন দেখতে পাচ্ছে না— সেই ব্যাখ্যা তোমাকে দিতে হবে না। তুমি সায়েনটিস্ট না। তুমি আইনস্টাইনের ভাতিজি না। তুমি দুই পয়সা দামের চাকরানি। এই কথাটা তো তোমার মনে থাকে না। তুমি মনে রাখবে।
সকিনা বলল, মা, আমার মনে থাকে।
জাহানারা বললেন, আবার মুখে মুখে কথা?
তিনি সকিনার দিকে ঘুরে তাকালেন এবং শরীরের সব শক্তি দিয়ে তার গালে চড় মারলেন। সকিনা চমকাল না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। জাহানারা খুবই স্বাভাবিক গলায় বললেন, ওরা তো কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ বসে আছে। ঠিক না সকিনা?
সকিনা জবাব দিল না। জাহানারা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, তার মাইগ্রেনের ব্যথা সেরে গেছে।
বৃষ্টি কমে এসেছে। ঝিরঝির করে এখনো পড়ছে, সেটা না পড়ারই শামিল। তবে বাতাস আছে। বাতাস অসম্ভব শীতল। হাড়ে কাপন লাগিয়ে দেয়। মোতাহার হোসেন বললেন, ঠাণ্ডা কেমন দেখেছিস? এক্কেবারে সাইবেরিয়ার ঠাণ্ডা। চল উঠে পড়ি।
শুভ্ৰ জবাব দিল না। মোতাহার হোসেন বললেন, তোর যদি ঠাণ্ডা লাগে, তোর মা আমাকে জ্যান্ত পুতে ফেলবে। তোর শীত লাগছে না?
শুভ্র বলল, লাগছে। আবার বসে থাকতেও ভালো লাগছে।
মোতাহার হোসেন বললেন, তাহলে বরং আরো কিছুক্ষণ বসে ঠাণ্ডা খাই। আচ্ছা শোন, আমাদের ধর্মে যে সাতটা দোজখের কথা আছে- এর মধ্যে একটা না-কি ঠাণ্ডা দোজখ?
ঠাণ্ডা দোজখ বলে কিছু নেই। তবে একটা দোজখ আছে যেখানে শারীরিক শাস্তি দেয়া হয় না। মানসিক শাস্তি দেয়া হয়।
দোজখটার নাম কী?
হোতামা।
আমার মনে হয় আমার স্থান হবে হোতামায়।
শুভ্র বলল, তুমি কোনো দোজখেই যাবে না। You are a good man. তুমি কোনো অন্যায় কর নি।
মোতাহার হোসেন বললেন, Thank you my son. আমি বড় অন্যায় আসলেই করি নি, তবে ছোটখাটো অন্যায় করেছি।
শুভ্র বলল, ছোটখাটো অন্যায় করে থাকলে বড় অন্যায়ও করেছ।
মোতাহার হোসেন বললেন, তার মানে কী?
অন্যায়ের ব্যাপারটা রিলেটিভ। আইনস্টাইনের দুটা থিওরি আছে- থিওরি অব রিলেটিভিটি এবং স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি। এই থিওরি বস্তুজগতের জন্যে যেমন সত্যি, আমার ধারণা মনোজগতের জন্যেও সত্যি। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলব বাবা?
বল।
মনে কর তুমি তোমার অফিসের একজন লোককে চাকরি থেকে ছাটাই করে দিলে। তোমার দিক থেকে ছোট একটা অন্যায় করলে। চাকরি ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার কারণে লোকটা পড়ল। মহাবিপদে। সে দ্বিতীয় চাকরি জোগাড় করতে পারল না। তার ছেলেমেয়েরা না খেয়ে দিন কাটাতে শুরু করল। একটা ছেলে মারা গেল বিনা চিকিৎসায়। তার বড় মেয়েটি প্রসটিটিউট হয়ে গেল। এখন তুমি বলো, এই লোকটির কাছে তোমার সামান্য অপরাধটাই কি অনেক বড় অপরাধ না?
হ্যাঁ,
আবার তৃতীয় একজনের কাছে কী মনে হবে? এই হচ্ছে থিওরি অব রিলেটিভিটি। Absolute বলে কিছু নেই, সবই রিলেটিভ। এই আমি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি- এই ব্যাপারটা আমার কাছে এক রকম। তোমার কাছে আরেক রকম। আবার অন্য একজন অবজারভারের কাছে অন্য রকম।
মোতাহার হোসেন বললেন, প্রসঙ্গটা থাক।
শুভ্ৰ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা থাক।
শুভ্র টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছছে। সকিনা পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র বলল, চা খাব না।
সকিনা বলল, একটা চুমুক হলেও দিন। নয়তো মা রাগ করবেন।
শুভ্ৰ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিল। চুমুক দিয়ে বলল, মসলা চা না-কি? গরম মসলার গন্ধ। চা-টা ভালো হয়েছে। আমি পুরোটাই খাব।
সকিনা ইতস্তত করে বলল, ভাইজান, আপনাকে একটা কথা বলব। যদি রাগ না করেন।
শুভ্ৰ বিস্মিত হয়ে বলল, কী কথা?
সকিনা বলল, আমাদের গ্রামে একটা অদ্ভুত গাছ আছে। লোকে বলে বহু কাল আগে কুমিরের পিঠে চড়ে এক সাধু এসেছিলেন। তিনি এই গাছ পুঁতেছেন। সাত বছর পরে পরে সেই গাছে ফুল ফোটে। সবুজ আর নীল রঙের মিশাল দেয়া ফুল। আমি খবর পেয়েছি গাছে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। আমার খুবই শখ আপনারে এই গাছের ফুলগুলো দেখাব।
গাছটার নাম কী?
কেউ নাম জানে না ভাইজান। সবাই বলে অচিনবৃক্ষ।
বাহ কী সুন্দর নাম— অচিনবৃক্ষ!
সবাই বলে গাছে যখন ফুল ফুটে, তখন গাছে হাত দিয়ে আল্লাহপাকের কাছে যা চাওয়া যায়। তাই পাওয়া যায়।
কত বড় গাছ?
অনেক বড় ভাইজান। রেন্টি গাছের মতো বড়। তেঁতুল গাছের পাতার মতো চিরল চিরল পাতা।
তুমি কি এই গাছের কাছে কখনো কিছু চেয়েছ? সাত বছর আগে যখন ফুল ফুটিল তখন?
ভাইজান, তখন তো আমার বিচার-বুদ্ধি ছিল না।
শুভ্র আগ্রহ নিয়ে বলল, এখন তো তোমার বিচার-বুদ্ধি হয়েছে। এখন তুমি গাছের কাছে কী চাইবে?
সকিনা জবাব দিল না। শুভ্র বলল, তোমাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
সকিনা বলল, কুষ্টিয়ার মেহেরপুর। গ্রামের নাম নিমতলি, পোস্টাফিস নিমতলি।
শুভ্র বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের গ্রামের অচিনবৃক্ষ দেখতে যাব।
বর্ষার মধ্যে যেতে হবে ভাইজান। আষাঢ়-শ্রাবণ— এই দুই মাস ফুল থাকে।
শুভ্র বলল, আমি এই বর্ষার মধ্যেই যাব। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।
সকিনা দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হয় আরো কিছু বলার আছে। শুভ্র বলল, আর কিছু বলবে?
সকিনা না-সূচক মাথা নাড়ল। তারপর অতিরিক্ত ব্যস্ততায় ঘর থেকে বের হতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা খেল।
শুভ্ৰ কম্পিউটার খুলল। নোটবুকে লিখে রাখতে হবে অচিনবৃক্ষের ব্যাপারটা।
নিমাতলি গ্রামের অচিনবৃক্ষ দেখতে যাব। বর্ষাকালে এই বৃক্ষে সবুজ আর নীল রঙের ফুল ফোটে। এই গাছটির পাতা তেঁতুল পাতার মতো চিরল বিরল।
শুভ্রর নোট বই ভর্তি নানান পরিকল্পনা। যার কোনোটিই এখনো করা হয় নি।
বনের ভেতর আষাঢ়ি পূর্ণিমা দেখতে যাব। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সবসময় বৃষ্টি হয়। যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে বনের জোছনা খুব সুন্দর হওয়া উচিত। বৃষ্টি হলেও বা ক্ষতি কী! বনের মধ্যে বৃষ্টির শব্দ শোনাও ইন্টারেস্টিং হবার কথা। আচ্ছা গৌতম বুদ্ধ যে গৃহত্যাগ করেছিলেন তার সঙ্গে কি পূর্ণিমার কোনো সম্পর্ক ছিল? পূর্ণিমা কি তাঁকে গৃহত্যাগে প্রভাবিত করেছে?
বরফের দেশে জোছনা দেখতে যেতে হবে। বরফের দেশে আমি অনেকবার গিয়েছি। সবই সামারে। আমার ধারণা বরফে জোছনা খুব সুন্দর হবে। শীতের সময় জোছনার খবরাখবর নিয়ে ভুটান গেলে ভালো হবে।
শুভ্র ফাইল বন্ধ করে ইন্টারনেটে গেল। আত্রলিতার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছা করছে। বৃষ্টিতে ভেজার অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতাটা আত্রলিতাকে বলতে ইচ্ছা করছে।
কেমন আছ আত্রলিতা?
ভালো। খুব ভালো। অসম্ভব ভালো।
বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝামেলা মিটে গেছে?
হ্যাঁ।
দুজন একসঙ্গে কনসার্টে বাজনা বাজাচ্ছ?
হ্যাঁ।
কী বাজনা?
নাচের বাজনা ওয়াল্টজ।
তোমার আনন্দে আমি আনন্দিত।
তোমার চোখ কেমন?
এখনো দেখতে পাচ্ছি।
আজ সারাদিনের সবচে সুন্দর দৃশ্য কী?
দোলনায় দোল খেতে খেতে বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য।
তোমার মা কি এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছেন?
এখনো দাঁড়ান নি। তবে দাঁড়াবেন।
তোমার প্রতি তোমার মা যে ভালোবাসা দেখাচ্ছেন, তোমার কি মনে হয় না। তাতে বাড়াবাড়ি আছে?
হ্যাঁ মনে হয়।
বাড়াবাড়ি ভালোবাসার কারণ কী তুমি জানো?
জানি।
আমাকে বলবো?
শুভ্র ক্যাপিটাল লেটারে অনেক বড় অক্ষরে লিখল- NO.