০৪. শুধু পানি আর পানি

শুধু পানি আর পানি। যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই পানি। সারা জাহানে যেন পানি ছাড়া অন্য কিছুরই অস্তিত্ব নেই। পানির উপর দিয়ে রুতুন্দা জাহাজটা হাঁসের ছোট বাচ্চাটির মতো সাঁতার কেটে চলেছে। সাঁতার কেটে চলেছে মালবাহী জাহাজ রুতুন্দা। এ সাঁতারের যেন বিরাম নেই, ছেদ নেই। এ বন্দর থেকে সে বন্দর। সে বন্দর থেকে আর এক বন্দর। বিচিত্র বিপণি বুকে ধরে অবিশ্রান্ত তার ছুটাছুটি। ইঞ্জিন ঘরে অতন্দ্র নাবিক কদম, রুতুন্দার ছোট সারেং। রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে ও। চোখ তার স্থির নিবদ্ধ কম্পাসের কাঁটায়। কম্পাসের কাঁটাটা কাঁপছে। কম্পাসের কাঁটাটা হেলে গেল ডানে। কম্পাসের কাঁটার সাথে সাথে চোখের পাতাটা নড়ে কদমের। ভ্রূ জোড়া কুঁচকে গিয়ে স্থির হয় আবার।

ইঞ্জিন ঘরের গরমটা যেন রোয়ায় রোয়ায় সেঁদে গিয়ে সেদ্ধ করে চলেছে কদমের গোটা শরীরটা। খালি গা, দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে। ভিজে গেছে মাথার চুল। কপালের দিকে ঝুঁকে পড়া চুলের আগা থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে। লোনা ঘাম চোখে গিয়ে জ্বালা ধরিয়েছে চোখে। প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল আর মুখের ঘামটা মুছে নেয় কদম। ইঞ্জিনের গর্ত ছেড়ে উঠে আসে পাদানিতে।

এখানে ক্রনোমিটারে চোখ পড়ে বিরক্তিতে ভরে যায় কদমের মুখখানি। অকারণেই ধপাধপ কয়েকটা লাথি ছুঁড়ে মারে রেলিংয়ের গায়ে। কঠিন ইস্পাতে বাড়ি খেয়ে পা ওর ফিরে আসে, জুতোর ভেতর পায়ের পাতাটা বুঝি ব্যথায় টনটন করে ওঠে। পা ছেড়ে এবার হাতের জোর লাগায় কদম। দুহাতে চেপে ইস্পাতের রডটাকে প্রচণ্ড রাগে বাঁকিয়ে চলে। জড় কঠিন ইস্পাতের দেহ অনড়, অটল। এতটুকু কাঁপে না, বাঁকায় না। কদমের শক্তিটাই প্রতিঘাতে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে কদমের মাঝে। বিদ্যুতের মতো সঞ্চারিত হয় ওর সারা অঙ্গে।

ঝাঁকুনি খায় ওর সারা গা। বিড়বিড়িয়ে বলে কদম– শালার ইঞ্জিনিয়ার, শালার কাপ্তান। শালা। জুচ্চোর। ফাঁকিবাজ।

ডেকের দিকে দেখা যায় বড় সারেং মন্তু মিয়াকে। মন্তু সারেংকে দেখে কাপ্তানের বিরুদ্ধে আক্রোশটা যেন চতুর্গুণ বেড়ে যায় কদমের। অনুপস্থিত কাপ্তানের পূর্বপুরুষ এবং ভাবী পুরুষ কেউ বাদ যায় না ওর আক্রোশের অভিশাপ থেকে।

কদমের রাগের কারণ অনেক।

এ-সময়টা কদমের ডিউটি দেবার কথা নয়। তবু ডিউটি দেয়া হচ্ছে, কেনো এটা শাস্তি। কিছুই না, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারের সাথে মামুলি একটা কথা কাটাকাটি হয়েছিল কদমের দিন চারেক আগে। তার জেরে কাপ্তান আর ফার্স্ট ইঞ্জিনিয়ার মিলে কি গালিটাই না দিল। তার ওপর দিল তিন রাতের একস্ট্রা ডিউটি। সেই একস্ট্রা ডিইটির আজ প্রথম রাত।

ইঞ্জিন রুমের অয়েলম্যান, কদম ওদের সর্দার, ইঞ্জিন ঘরের ছোট সারেংয়ের পদমর্যাদায় এবং সৌহার্দের সম্পর্কেও শাস্তির ব্যাপারটা ওদের মাঝে একটা ছোটখাটো উত্তেজনার সঞ্চার করেছিল। আর সেই উত্তেজনার সুমুখে পড়ে ওয়াদা দিতে হয়েছে কাপ্তানকে, শাস্তিটা এক রাতে কমিয়ে দেয়ার কথাটা বিবেচনা করবে সে।

কিন্তু ভোর হয়ে গেছে কখন, এখনো পাত্তা নেই কাপ্তানের। একে অন্যায় শাস্তি, গরমে সিদ্ধ হয়ে রাত জাগা, তার ওপর কাপ্তানের নেই দেখা তাই মেজাজটা অমন খিঁচে গেছে কদমের।

শালার সাহেবগুলোই এমন, পায়ের উপর পা ফেলে খালি খবরদারি করবে। কথায় কথায় ড্যাম ব্লাডি সোয়াইন যা তা বলে মুখ খারাপ করবে। গালিগুলো যেন ব্যাটাদের ভগবানের নাম। ভগবানের নামের মতো অষ্টপ্রহর জপে চলেছে, ড্যাম সোয়াইন।

কার ওপর এমন নাখোশ হলে ভাতিজা?

মন্তু সারেংয়ের গলা পেয়ে বন্ধ হয় কদমের বিড়বিড়ানি। বলে– কার ওপর আবার, ওই শালা হিক সাহেব?

আ-র হিক সাহেব। হিক সাহেব এখন হিক্কা তুলেছে দেখে এসো। কেমন টেনে টেনে বলে মন্তু সারেং।

হিক্কা তুলছে কেন?

কেন আবার কি? রাতভর চো চো মদ গিলেছে, এখন বমি করছে।

মদ গিলেছে? তবে যে ব্যাটা বলে গেল আমার তবিয়ত খারাপ? বুঝি অবাক হয় কদম!

তা আর বেঠিক কি বলেছে। তবিয়ত তো খারাপই, মানে মন খারাপ আর মন খারাপ হলে মদ ছাড়া অন্য কি দাওয়াই আছে এই জাহাজে?

মনটা খারাপ? কাপ্তানের বিরুদ্ধে এতক্ষণের রাগটা যেন ঝুপ করে পড়ে যায় কদমের। মনটা যেন ওরও মাঝে মাঝে কেমন খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে যায় বামনছড়ি গ্রামে সারেং বাড়ির সেই ছনে ছাওয়া ঘরখানার কথা, নবিতুনের কথা। মনটা তখন শুধু খারাপ হয় না কেমন যেন বিগড়ে যায়। ভালো লাগে না কাজ কর্ম, কারো সাথে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না তখন। কদম সারেং বোঝে মন খারাপ হওয়াটা বড় যন্ত্রণার। এমন যন্ত্রণার সাথে আগে কখনো পরিচয় ছিল না কদমের।

সাঁইতিরিশ ডিগ্রি দক্ষিণ ল্যাটিচ্যুড, পুবে বিশ লংগিচ্যুড বরাবর চলছে জাহাজ। বুঝি মন্তু সারেংয়ের অনুক্ত প্রশ্নের জবাবেই বলল কদম।

ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞ নাবিক মন্তু সারেং। পলকে মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিল ছোট সারেংটিকে। কি এক আনন্দ খুশিতে উদ্ভাসিত মন্তু সারেংয়ের মুখখানি। ল্যাটিচ্যুড লংগিচ্যুডের হিসেব রাখা বা করা কদমের দায়িত্ব নয়। এসবের দায়িত্ব ইঞ্জিন রুমের মাথায় বসে রয়েছে সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার কদমের দুশমন সেই সাহেবের বাচ্চাটি। ওর কাজ ইঞ্জিন রুমের গ্রিজার, অয়েলম্যান, খালাসি ওদের সর্দারি করা। আর কদমের মতে, এ কাজ টিপ সইয়ের বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন পড়ে না।

কিন্তু কদম শিখেছে। ওস্তাদ ওর মন্তু সারেং। কদম শিখেছে মুখে মুখে যেমন করে শিখেছে মন্তু সারেং, তার ওস্তাদ আর এক সারেংয়ের কাছ থেকে এখন আত্মা যার বেহেশতে।

মুখে-মুখে শিখেই পরীক্ষা দিয়েছে মন্তু সারেং, সার্টিফিকেট পেয়েছে। রুতুন্দা জাহাজে মন্তু সারেংয়ের এটাই হয়তো শেষ খ্যাপ। এর পরই মন্তু সারেং চাকরি নেবে সিংগাপুর পেনাং অথবা হংকং লাইনে। যে জাহাজগুলো ছোট, ওই সার্টিফিকেটের বলে মন্তু সারেংই হবে সেসব জাহাজের সর্বময় কর্তা। কদম সারেংয়ের বাসনা, সেও শিখবে, পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নেবে, তারপর ছোট লাইনের কোন একটি ক্ষুদ্র জাহাজে সবচেয়ে গৌরবের আসনটিতে বসবে ও। তাই ইঞ্জিন রুমে এসে চোখ ওর স্থির হয়ে থাকে দিকমান যন্ত্রের কাঁটায়, ইঞ্জিনের বিচিত্র যন্ত্রবিন্যাসে।

মন্তু সারেংয়ের উৎসাহের হাতটা আস্তে-আস্তে নেবে আসে ছোট সারেংয়ের কাঁধে। ছোট সারেংয়ের কাঁধে লাগে ছোট্ট একটা ঝাঁকি। মন্তু সারেং বলছে, শাবাস কদম সারেং, শাবাস। এভাবে শিখলে, আমি বলছি, শিগগিরই বড় সারেংয়ের উপর দিয়ে যাবে তুমি। কে রোখে তোমাকে। বৃদ্ধ নাবিকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় হাসি খেলে যায় তরুণ নাবিকের মুখে। সে বুঝি তুষ্টীর, তৃপ্তির, গর্বের হাসি। পায়ের নিচে উত্তাল তরঙ্গ নাচন, পপেলারের একটানা পানি ভাঙার শব্দতান, ইঞ্জিনের ধাতব গর্জন– ওই একটি প্রশংসায় যেন সবকিছুরই রূপগুণ যায় বদলে। বদলে যায় নীরেট বস্তু আর যন্ত্রগুলোর একঘেয়েমি, কানে তালা দেয়। গর্জনটাও। মনে হয় যন্ত্রে আর সমুদ্রে এ এক ঐকতান পানির কলকল রবে যন্ত্র গীতে এ এক ঝংকার। আর মনে হয় ইস্পাতের ওই বিশাল দেহটা ওই চকচকে রড বিম– সবই ওর একান্ত আপনার, সবই ওর আপন কলজেরই অংশ।

এমন তো কখনো মনে হয়নি? এমন করে তো কোনদিন ভাবেনি তরুণ নাবিক? আপন কাজের প্রশংসা আর স্বীকৃতি পেলে সব জাহাজের সব নাবিকেরই বুঝি এমনি মনে হয়।

এসো ভাতিজা আরো শিখিয়ে দিই তোমাকে। মন্তু সারেং রুট ম্যাপটার দিকে নিয়ে যায় কদমকে।

পৃথিবীর মতো সমুদ্র বন্দরের মানচিত্র। সমুদ্রের বুক চিরে চিরে লাল লাল সরু মোটা রেখা আন্তর্জাতিক জলপথের চিহ্ন।

এ পথ দিয়ে তো তুমি কখনো যাওনি এ্যাংরাজের দেশে, গেছ এ্যাডেন হয়ে। এই যে আমরা যাচ্ছি কেপটাউনের দিকে, এ পথ ধরেই উল্টাদিক থেকে এসেছিল ভাসকোডা সাহেব। পয়লা সাদা চামড়া যে নাকি জাহাজে চড়ে পৌঁছল হিন্দুস্তানে।

কান খাড়া করে মন লাগিয়ে শোনে কদম। এসব কথা একেবারেই নতুন ওর কাছে।

মন্তু সারেং বলে চলেছে হিন্দুস্তানের ধন-দৌলত, সোনা মাণিক হীরা জহরতের বড় লোভ ওই সাহেবগুলোর। কিন্তু জাহাজে করে হিন্দুস্তানে আসবার পথ জানা নেই ওদের। পালের জাহাজ ভাসিয়ে বেরিয়ে পড়ল ভাসকোডা সাহেব।

পালের জাহাজ? অবাক হয়ে শুধাল কদম।

আরে হ্যাঁ, তখন কি ওই ইঞ্জিন ছিল, না ছিল ওই প্রপেলার। এসব তো অনেক পরের ব্যাপার!

সাগরে ভাসল পালের জাহাজ? ভয় করল না লোকটার? আবারও শুধাল কদম।

আর ভয়। হিন্দুস্তানের সোনা-দানা শান-শওকতের গল্প শুনে শুনে ওরা তখন দেওয়ানা। লোভীর আবার ভয় আছে না কি?

আমাদের দেশে বুঝি তখন খুব সোনা ছিল চাচা?

কদমের প্রশ্নটা শুনে মৃদু মৃদু হাসে মন্তু সারেং। বলে, সারা দেশটাই তখন সোনায় মোড়া ছিল রে, পথে পথে ছড়িয়ে থাকত হীরে মাণিক। কিসের অভাব ছিল তখন।

কান খাড়া করে মন লাগিয়ে শোনে কদম। সোনা-দানার, কথা ওই, দুঃসাহসী লোকটার কথা– সবই যেন কোন আজব দেশের তাজ্জব কিসসা। শুনতে শুনতে কেমন রোমাঞ্চের শিহরণ জাগে বুকে।

তা ওই পালতোলা জাহাজ চড়েই ভাসকোডা সাহেব বের করে ফেলল হিন্দুস্তানে আসার পথটা। তারপরের কিসসা তো একেবারে সাফ কিসসা। সাহেবগুলো এই সেদিন পর্যন্ত লুটে-পুটে খেল দেশের যত সোনা-দানা।

ও সে জন্যই বুঝি আজ আমরা এত গরিব? হঠাৎ জিজ্ঞেস করল কদম। ওর কথাটার জবাব না দিয়ে দাড়ির ভেতর আঙুল চালিয়ে গাল চুলকোয় মন্তু সারেং। গাল চুলকিয়ে রুট ম্যাপটার সেই সরু মোটা লাল লাল রেখাগুলোর দিকে স্থির নজরে চেয়ে থাকে মন্তু সারেং। চেয়ে চেয়ে কি এক ভাবনায় যেন ডুবে যায় মন্তু সারেং।

কি হলো চাচা?

এবারও কোন জবাব দেয় না মন্তু সারেং। রুট ম্যাপটার দিকেই স্থির তার দৃষ্টি। বিগত দিনের সেই ধন-দৌলত, হীরা-মানিক্যে উজ্জ্বল, সোনা ছড়ানো দেশটার কথাই বুঝি ভাবছে মন্তু সারেং। বুঝি ভাবছে সেই শানদার অতীত কি আবার ফিরে আসতে পারে না?

বুঝি ভাবতে ভাবতেই মানচিত্রের কাঁচের কেসটির উপর এক জায়গায় আঙুল রাখল মন্তু সারেং। বলল, এই যে আমরা বলছি ২০ পূর্ব ল্যাংগিচ্যুড ঠিক আঠারোতে এসে জাহাজটা আমাদের ঘুরে যাবে ডাইনে। নোঙর ফেলবে কেপ শহরে। সেখান থেকে কোনাকোনি পাড়ি আটলান্টিক। এই যে দেখছ সাগরটা, এ-আফ্রিকা ও-পারে আমেরিকা, ওর নাম আটলান্টিক মহাসাগর। বড় নচ্ছার এর পানি।

পূর্ববঙ্গের বামনছড়ি গ্রামের কদম সারেং, চৌদ্দ বছর বয়সে যার প্রথম সমুদ্র যাত্রা, যোল বছর থেকে মহাসাগরের বুকে বুকে যার দিন কাটে। দিন কাটে পানি কেটে কেটে ঢেউ ভেঙে। মহাদেশের বিলীন তটরেখার মতো পানির রাজ্যে হারিয়ে গিয়ে। কি এক আগ্রহে মানচিত্রটার ওপর ঝুঁকে পড়ে কদম সারেং।

মানচিত্রের স্বচ্ছ কাঁচের ওপর আঙুল টেনে টেনে বলে চলেছে মন্তু সারেং—ওই যে আমেরিকা মহাদেশ সেও ইউরোপীয় এক সাহেবের আবিষ্কার। নাম তার কলম্বাস। সাহেব বেরিয়েছে হিন্দুস্তানের সোনা-দানার খোঁজে, পেয়ে গেল আমেরিকা।

এ্যাঁ বলো কি চাচা? বিস্ময়ে যেন চোখ ফাটে কদমের। সাহেবরা এমন ভুলও করেছিল তাহলে?

সেই আমেরিকা দেশ। দক্ষিণ আর উত্তর আমেরিকা। সেখানে তিনটে লম্বা বিশ্রাম আমাদের। তারপর এই যে দেখছ নিউপোর্ট সেখান থেকে সোজা আটলান্টিকের ওপারে, রানীর দেশে, সাবটমটম বন্দরে।

এতকিছু শুদ্ধভাবেই জানে এবং বলে মন্তু সারেং কিন্তু সাদাম্পটন বন্দরের বিকৃত উচ্চারণের উদ্ভট নামকরণটা বুঝি শোধরাতে পারবে না কখনো। ইঞ্জিনের মুখে খোলা চাতালের উপর থেকে মুখ বাড়িয়ে কি যেন বলল সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার। অমনি মুখ-চোখের রেখাগুলো কঠিন হয়ে উঠল মন্তু সারেংয়ের।

দিকমান যন্ত্রের কাঁটাটা ঘুরছে আস্তে-আস্তে। লম্বা বেড় নিয়ে দিক পরিবর্তন করছে রুতুন্দা। ভোঁ বাজার চাবিতে একটি টিপ দিল মন্তু সারেং। অপরেটারকে কি যেন একটু সংকেত পাঠাল। তারপর ইঞ্জিনের বিচিত্র কলকব্জাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করতে লেগে গেল। বলল কদমকে, যাও, সারা রাত জেগেছ। একটু শরবত খেয়ে ঘুম দাও গে। যাবার জন্যে সিঁড়ি ধরে কদম। কয়েক পা নেমেও আসে। কিন্তু হিক সাহেবের ব্যাপারটা পুরাপুরি না জেনে কেমন যেন স্বস্তি পাচ্ছে না ও। কেমন মন খারাপ হিক সাহেবের এটা জানবার ভারি ইচ্ছে ওর। সেই শোনার পর থেকেই জিজ্ঞেস করবে বলে ভাবছে, সাহসে কুলোচ্ছে না ওর। মন্তু সারেং তো শুধু রুতুন্দার বড় সারেং, কদমের উপরওয়ালা নয়? মন্তু কদমের বাপজান মজল সারেংয়ের দোস্ত, সহকর্মী। সেই সূত্রেই মন্তু সারেং কদমের চাচা, মুরুব্বিজন। তাই একসাথে কাজ করেও একই ক্যাবিনে শুয়েও কদমের সাথে মন্তু সারেংয়ের একটা সমীহ আর সংকোচের দূরত্ব।

আচ্ছা চাচা, হিক সাহেবের  মনটা এত খারাপ কেন? এক রকম মরীয়া হয়েই জিজ্ঞেস করে ফেলল কদম।

কেমন রহস্য করে হাসল মন্তু সারেং। বলল, ডারবানে নেবে চিঠি পেয়েছে, বৌর অবস্থা সঙ্গীণ। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে বৌ।

আবার ইঞ্জিনের দিকে মন দেয় মন্তু সারেং। অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলে, শালার আবার বৌ, তার জন্য আবার মন খারাপ! আমি তো দেখে আসছি কলম্বো, এদিকে নাটাল, ওদিকে এ্যাডেন, সব জায়গায়ই একটা করে ঠিকে বৌ রেখে দিয়েছে ব্যাটা।

সিঁড়িটা ধরে আস্তে-আস্তে নেবে আসে কদম। মন্তু সারেংয়ের মন্তব্যটা বড় নির্মম বলে মনে হয় ওর। সাদা আদমিই হোক আর কালো আদমিই হোক, হাজার নোংরামি থাকুক মনের ভেতরে তবু বৌ বৌ-ই। বৌয়ের অসুস্থতার খবরে সব বর্ণের পুরুষদেরই তো মন খারাপ হয়। মন্তু সারেং যে কি। সাদা চামড়া বলে যেন হিক সাহেবের মন খারাপ করতে নেই বৌর জন্য, মন্তু সারেংয়ের ভাবটা তাই। না, মন্তু সারেংয়ের বিদ্রূপোক্তিতে কদমের মনটা কিছুতেই সায় দেয় না।

বেলা বেশ বেড়ে গেছে। এ-সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে ক্যাবিনে নাক ডাকতে ইচ্ছে হলো না কদমের। ও গেল ডেকের দিকটায়।

মালবাহী জাহাজ হলেও ডেকে এবং ক্যাবিনে দুজায়গায়ই যাত্রী রয়েছে কিছু। বেশির ভাগই গরিব হিন্দুস্তানি আর পাকিস্তানি। আফ্রিকার নানা জায়গায় ওদের রোজগারের ব্যবস্থা। পকেট ওদের বড় টান। তাই সস্তায় মালবাহী জাহাজেই সফর করে ওরা।

সবারই লম্বা সফর। কদমের সাথে কমবেশি পরিচয় ওদের সকলের। কেউ হয়তো খিচুরি পাকিয়েছে তারই একটু চেখে দেখতে হয় কদমকে। কেউবা ডাকে– গরম-গরম চাপাটি আর গুড়ের একটু সাধ নিয়ে যাও সারেং। স্নেহের ধারাটি ওদের অকৃত্রিম। আত্মীয়তার পরশ ওদের কথায়, ওদের নৈকট্যে।

চৌতিরিশ থেকে পঁয়তিরিশ দক্ষিণ অক্ষাংশ আর আঠার উনিশ পুবের দ্রাঘিমার উত্তমাশা অন্তরীপের যতটুকু পানি বিশাল সমুদ্র জগতে স্থান তার অতি নগণ্য। কিন্তু জলস্থল মিলিয়ে যে বিরাট পৃথিবী সে পৃথিবীর ভূগোল আর ইতিহাসে অনেক জায়গা জুড়ে রয়েছে উত্তমাশা অন্তরীপ। সেই ইতিবৃত্ত কোন একদিন মন্তু সারেংয়ের মতোই কণ্ঠস্থ হবে কদম সারেংয়ের। তরুণ নাবিককে উদ্দেশ্য করে সেদিন হয়তো কথার বান ছোটাবে কদম সারেং, বলবে, এই সেই উত্তমাশা অন্তরীপ ভাসকোড়া সাহেব এখানে এসেই অধীর আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ওই যে, ওই যে দেখা যায় হিন্দুস্তান।

কিন্ত আজ এই চৌতিরিশ থেকে পঁয়তিরিশ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ আর আঠার উনিশ পুবের দ্রাঘিমায় জলভাগটুকুর উপর দাঁড়িয়ে শুধু একটি কথাই মনে পড়েছে কদমের, উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে অনেক দূর বামনছড়ি গ্রামের সারেং বাড়ি। অনেক দূর বৌ নবিতুন আর ছোট্ট মেয়ে আককির মমতা জড়ানো গৃহ কোণটি।

বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে কেমন সংসার পেতে বসেছে ডেকের যাত্রীরা। ওদের সহজ ডাক, ওদের হৃদয়ের স্পর্শে অভিভূত হয় কদম। ওর মনে হয় উত্তমাশা অন্তরীপে এই রুতুন্দা জাহাজের বুকেও ওর জন্য রয়েছে নবিতুনের ছোট্ট সেই গৃহ কোণটির মমতার পরশ।

কদমের দল– অবিরাম জলের বুকে ভেসে চলা মানুষ ওরা। ওরা নির্বান্ধব। ওরা নিঃসঙ্গ। অত আত্মীয় থেকেও ওদের যেন কেউ নেই। ভীষণ ভয়ংকর হিংস্র সমুদ্রের মাঝে প্রাণটাকে হাতে লয়ে ওদের চলা।

ডাঙার মাটি যে ওদের কেমন করে টানে সেটা হয়তো বোঝে না ডাঙার মানুষ। ডাঙার মানুষ বোঝে না জলের মানুষগুলোর বুকে কত দীর্ঘশ্বাস। বোঝে না নীড় বাঁধা ডাঙার মানুষ, ডাঙার মানুষের একটুখানি হৃদ্যতা, একটুখানি মমতার জন্যে কেমন কঙ্কালের মতো লালায়িত জাহাজি মানুষ।

কিন্তু রুতুন্দা জাহাজের ওই ডেকের যাত্রীরা ওর যেন বোঝে। তাই ডাক পড়ে কদমের। কদম যেন ওদেরই একজন। ডাঙার মানুষের মমতার ছোঁয়ায় ধন্য হয় কদম।

মাদাগাস্কারের মরসুমি মজুর আবদুল আজিজ। বৌ আর ছেলেকে নিয়ে চলেছে কেপ শহরে। আজিজের বৌ ভাইয়ের সম্পর্কে পেতেছে কদমের সাথে, ভাই ডাকে কদমকে।

নেবে তো যাচ্ছি কেপ শহরে। কখনো কি দেখা হবে আবার? কে জানে। বুঝি এখনি বিদায় নিচ্ছে আজিজ।

আলবৎ দেখা হবে। কদম যখন সারেং আর জাহাজের যখন পানি ছেড়ে আকাশে উড়বার কস্মিনকালেও কোন ভরসা নেই, তখন এ পথ দিয়ে শতবার আসবে যাবে কদম। তখন দেখা হবে না? আমার বইন কি বলে? কদমের সতেজ উৎফুল্লতায় ওরাও যেন খুশি হয়ে ওঠে।

আজিজের বৌ পোটলা খুলে বের করে আনে মস্ত বড় থালার মতো গোল চান্দা মাছের শুঁটকি।

বৌর হাতে শুঁটকিটা দেখেই হো হো করে হেসে দেয় আজিজ। বলে, জানো কদম, ভারি চালাক আমার বৌটি। শুঁটকি খাওয়ার সুবিধে হবে বলেই ভাই ডেকে বসেছে তোমায়।

আধো ঘোমটার তলা থেকে কটমটিয়ে তাকায় বৌটি। কদমের দিকে তাকিয়ে আগেও যেমন নিমন্ত্রণ দিয়েছে তেমনি আজও দাওয়াত জানাল। কদম খাবে ওদের সাথে। কদমের চুলোতেই রান্না হোক শুঁটকিটা। শুঁটকিটা নিয়ে নিজের ক্যাবিনে পাঠিয়ে দেয় কদম। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ায় কাপ্তানের এলাকার দিকে।

ডেকের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে কদম, বিচিত্র স্বভাব মানুষ জাতটার। সারা জন্ম, কখনোবা জন্ম জন্ম কাটিয়ে দেবে ভিন্ন দেশে, তবুও স্বদেশের অভ্যাসটাকে পুরাপুরি ভুলতে পারে না ওরা।

ক্যাবিনের বাইরে খোলা জায়গায় ডেক চেয়ারে বসে আছে কাপ্তান হিকস। খালি গা। দুহাতের তালুতে ন্যস্ত তার চিবুকটা। কি এক উদাসীনতায় চোখ স্থির সমুদ্রের বুকে।

কাছে এসে মনে হলো কদমের, কাঁদছে হিক সাহেব। আরো কাছে এলে কদম দেখল, ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে হিক সাহেবের চিবুক বেয়ে। যেন চোখে পড়বার জন্যই একেবারে হিক সাহেবের সামনে এসে রেলিং ধরে দাঁড়াল কদম। অন্য সময় অসন্তোষের ভ্রূ উঁচিয়ে একবার তাকাত কাপ্তান হিকস। কিন্তু আজ এই রুতুন্দা জাহাজের শাসন শৃঙ্খলার ক্ষুদ্র জগৎটা ডিংগিয়ে যেন অন্য কোন উদার বিশাল দুঃখময়ের জগতে পৌঁছে গেছে কাপ্তান হিকস। সেখানে অধঃস্তনের ত্রুটিগুলো উপক্ষেণীয়।

হঠাই বুঝি ওর দিকে নজর পড়ল হিক সাহেবের। আর ওকে দেখেই ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুটা ভাঙা সয়লাবের স্রোতের মতো নেমে আসে সাহেবের চোখ ঠেলে। চিবুক-ধরা হাতের তালু হয়ে কনুই বেয়ে নেবে যায় সেই অশ্রু সয়লাব!

ঠিক এই মুহূর্তে কি করা যায়, ভেবে পায় না কদম।

অকস্মাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে হিক সাহেব। অশ্রুভরা গলাটা গোঁ গোঁ অস্ফুট এক শব্দ তুলে যায়। অবুঝ কোন শিশুর মতোই ডেক চেয়ারে হেলানপিঠে গড়াগড়ি খায় হিক সাহেবের মাথাটা। শরীরটা তার কি এক বেদনার পীড়নে অস্থির।

কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথাই বলে গেল হিক সাহেব। কদম তার সবকিছু বুঝলও না, শুনলও না। কদম শুধু বুঝল, বলছে হিক সাহেব ও কডম! আমার ডার্লিং আমার ওয়াইফ আমার ডিয়ার রোজি বোধহয় বেঁচে নেই।

সান্ত্বনা দেয় কদম –খামোকাই উতলা হচ্ছ সাহেব। তোমাদের দেশে তো ওষুধ ডাক্তার কোনটারই কমতি নেই। তার ওপর অভাব নেই তোমাদের টাকার। চিকিৎসা হচ্ছে বৌর, সেরে যাবে। শুধু শুধু কান্নাকাটি করে বুক ভাসাচ্ছ তুমি।

কিন্তু সান্ত্বনা পায় না সাহেব। বলে, না না কডম, তুমি জানো না। ও মরবে, আমিই মারলাম ওকে। আমিই মেরে ফেললাম, খুন করলাম কডম, বড় ভালো মেয়ে ছিল রোজি।

ছিল বলছ কেন সাহেব? বলো আছে, আছে।

আছে? যেন আশ্চর্য হলো কাপ্তান হিকস।

হ্যাঁ, আছে বৈ কি! সুনিশ্চয়তার স্বর কদমের।

না না, নেই রোজি বেঁচে নেই। ও কডম, আমি যে আসবার সময় ঝগড়া করে এসেছিলাম ওর সাথে। আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে হিক সাহেব। চেয়ারের বেতের পিঠে আছড়ে পরে তার মাথাটা।

অন্য সময়ে কোন সাহেবকে এমন করে কাঁদতে দেখলে হাসিই পেত কদমের। সাহেব মানেই উপরওয়ালা, হুকুম দেনেওয়ালা; জবরদস্ত খিটমিটে দয়াহীন-মায়াহীন। সেই সাহেবও কাঁদে তাও এমনি ডুকরে ডুকরে, ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে, হাউ মাউ করে, মাথা কুটে? এত যে সাহেবসুবো দেখেছে, সেই কদমের পক্ষেও এ এক দর্শনীয় বস্তু বটে।

কিন্তু হিক সাহেবকে কাঁদতে দেখে আজ হাসি পেল না কদমের। বরং কেমন এক মায়া জাগল আপন জনের স্নেহ-পরশ-বঞ্চিত-নীরস একঘেয়ে সমুদ্র জীবনে ওরই মতো নিঃসঙ্গ এই নাবিকটির জন্য। নবিতুনের পাশাপাশি আর এক দেশের আর এক বিরহিণী বধূর মুখও বুঝি ভেসে উঠে কদমের মনের পর্দায়। সে মুখ অচেনা-অজানা। কদম কখনো দেখেনি, কখনো দেখবে না হিক সাহেবের বৌকে। তবু মনে হয় ওর সে যেন ওর চেনা মুখ। নবিতুনের সাথে একটুও তফাৎ নেই তার, ওই গায়ের রঙটুকু ছাড়া।

রাতভর ঘুমোয়নি হিক সাহেব। জেগে জেগে মদ গিলেছে আর বুঝি চোখের জল ফেলেছে। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে, লাল মুখটা আরো লাল হয়েছে হিক সাহেবের । অত বড় একখানি বন্ধু হিক সাহেবের । কিন্তু দূর ডাঙার রুগণা বধূর চিন্তায় কাতর হয়ে কেমন নেতিয়ে পড়েছে সেই বিশাল দেহখানি।

আর একটু মমতা আর একটু সহানুভূতির ছোঁয়া দেবার জন্য রেলিং ছেড়ে ডেক চেয়ারটির দিকে এগিয়ে এলো কদম। কদম দাঁড়াল হিক সাহেবের  চেয়ারটি ঘেঁষে। বলল কদম, সাহেব, তুমি একটা অবুঝ খোকার মতোই কাঁদছ। মানে হয় কাঁদার? আমি বলছি কেপ শহরে পৌঁছেই সুখবর পাবে তুমি। ভালই আছে মেম সাহেব।

এ্যাঁ, যেন চৈতন্যহীনতার কোন গহ্বর থেকে আচমকা উঠে এলো কাপ্তান হিকস। অথবা কোন কিছুর ওপর চোখ পড়ে চমকে উঠল, সম্বিত পেল। বুঝি বিদ্যুতের কামড় খেয়ে উঠে দাঁড়াল হিকস। উলটে যাওয়া হাফ প্যান্টের কিনারাটা সিধা করল। বেরিয়ে আসা হাফ শার্টের ঝুলটা ভালো করে ঢুকিয়ে নিল কোমড়ের নিচে প্যান্টের তলার দিকে। তারপর ফোলা চোখের মণিগুলো যেন এক ধৃষ্টতার জবাবে বার দুই কেঁপে গেল। মণিকাঁপা অযুক্ত সেই চোখ জোড়া ক্ষণিক স্থির হয়ে থাকল কদমের মুখের ওপর।

সাহেবের হঠাৎ ভাবান্তরে কেমন বোকা বনে যায় কদম। বোকার মতো চেয়ে থাকে সাহেবের মুখের দিকে।

গটগট জুতোর আওয়াজ তুলে ক্যাবিনের দিকে চলে গেল হিক সাহেব। খট করে বন্ধ করে দিল ক্যাবিনের দরজাটা।

কদম তখন মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছে দিগন্তবিস্তারি সমুদ্রের দিকে। সমুদ্রটা এখনও কোথাও সাদা, কোথাও কালো, কোথাও ফিকে, কোথাও ঘনকৃষ্ণ। এ হলো রৌদ্র আর মেঘের খেলা সমুদ্রের বুকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *