০৪. শুক্লযজুর্বেদ – চতুর্থ অধ্যায়

চতুর্থ অধ্যায়

মন্ত্রঃ– এদমগন্ম দেবযজনং পৃথিব্যা যত্র দেবাসো অজুযন্ত বিশ্বে। ঋকসামাভ্যাং সন্তরন্তো যজুভী রায়পোষেণ সমিষা মদেম। ইমা আপঃ শমু মে সন্তু দেবীরোষধে ত্ৰায়স্ব স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ ॥১॥ আপো অস্মান্মাতরঃ শুন্ধয়ন্তু ঘৃতেন নো মৃত পুনন্তু। বিশ্বং হি রিপ্রং প্রবহন্তি দেবীরূদিদাভ্যঃ শুচিরা পূত এমি। দীক্ষাতপসোস্তুরসি তাং ত্বা শিব্যাং শৰ্মাং পরি দধে ভদ্রং বর্ণং পুষ্য৷৷২৷৷ মহীনাং পয়োহসি বর্গোদা অসি বৰ্চো মে দেহি। বৃত্রস্যাসি কানীনকশ্চক্ষুদা অসি চক্ষুর্মে দেহি৷৷৩৷৷ চিৎপতিৰ্মা পুনাতু বাকপতিৰ্মা পুনাতু দেববা মা সবিতা পুনত্বচ্ছিদ্রেণ পবিত্রেণ সূর্যস্য রশ্মিভিঃ। তস্য তে পবিত্রপতে পবিত্রপূতস্য যক্কামঃ পুনে তচ্ছকেয়৷৷৷ আ বো দেবাস ঈমহে, বামং প্রযত্যধ্বরে। আ বো দেবাস আশিষো যজ্ঞিয়াসসা হবামহে৷৫৷৷ স্বাহা যজ্ঞং মনসঃ স্বাহোরোরন্তরিক্ষাৎ স্বাহা দ্যাবাপৃথিবীভ্যাং স্বাহা বাতাদারভে স্বাহা৷৬৷ আকূত্যৈ প্রযুজেহগুয়ে স্বাহা মেধায়ৈ মনসেংগ্নয়ে স্বাহা দীক্ষায়ৈ তপসেহগ্নয়ে স্বাহা সরস্বত্যৈ পূষ্ণেগ্নয়ে স্বাহা। আপো দেবীবৃহতীবিশ্বশম্ভুবো দ্যাবাপৃথিবী উরো অন্তরিক্ষ। বৃহস্পতিয়ে হবিষা বিধেম স্বাহা৷৷৭৷ বিশ্বে দেবস্য নেতৃর্মতা বুরীত সখ্য। বিশ্বে রায় ইষুধতি দ্যুম্নং বৃণীত পুষ্যাসে স্বাহা।৮৷৷ ঋময়োঃ শিল্পে হস্তে বামারভে তে মা পাতমাস্য যজ্ঞস্যোদৃচঃ। শর্মাসি শর্ম মে যচ্ছ নমস্তে অস্তু মা মা হিংসীঃ৯৷৷ ঊর্গস্যাঙ্গিরস্যর্ণদা ঊর্জংময়ি ধেহি। সোমস্য নীবিরসি বিষ্ণোঃ শৰ্মাসি শর্ম যজমানস্যেন্দ্রস্য যোনিরসি সুসস্যা কৃষীস্কৃধি। উচ্ছয়স্ব বনস্পত উদ্ধো মা পাহ্যংহস আস্য যজ্ঞস্যোচঃ৷১০াব্রতংকৃণুতাগ্নিব্রহ্মাগ্নিযজ্ঞো বনস্পাত্যজ্ঞিয়ঃ। দৈবীং ধিয়ং মনামহে সুমৃড়াকামভিষ্টয়ে বর্চোধাং যজ্ঞবাহসং সুতীর্থা নো অসদশে। যে দেবা মনোজাতা মনোযুজো দক্ষতবস্তে নোহবন্তু তে নঃ পান্তু তেভ্যঃ স্বাহা।।১১। শ্বাত্রাঃ পীতা ভবত ঘৃয়মাপো অস্মাকম্যুরুদরে সুশেবাঃ। তা অস্মভ্যমযক্ষ্মা অনমীবা অনাগসঃ স্বদন্তু দেবীরমৃতা ঋতা বৃধঃ ॥১২৷৷ ইয়ং তে যজ্ঞিয়া তনুরপো মুঞ্চামি ন প্রজা। অংহোমুচঃ স্বাহাকৃতাঃ পৃথিবীমা বিশত পৃথিব্যা সম্ভব৷৷১৩ অগ্নে ত্বং সু জাগৃহি বয়ং সু মন্দিৰীমহি। রক্ষা পো অপ্রযুচ্ছ প্রবুধে নঃ পুনস্কৃধি৷৷১৪৷৷ পুনৰ্মনঃ পুনরায়র্ম আগন্ পুনঃ প্রাণঃ পুনরাত্মা ম আগন্ পুনশ্চক্ষুঃ পুনঃ শ্রোত্রং ম আগন্। বৈশ্বানররা অদব্ধস্তনূপা অগ্নিৰ্নঃ পাতু দুরিতাদবদ্যাত্ ৷৷১৫৷৷ ত্বমগ্নে ব্রতপা অসি দেব আ মর্ত্যেবা। ত্বং যজ্ঞেস্বীড্যঃ। রাস্বেয়ৎসোমা ভূয়ো ভর দেবো নঃ সবিতা বসোদাতা বস্বদাৎ ১৬ এষা তে শুক্র। তনুরেতদ্বস্তয়া সম্ভব ভ্ৰাজং গচ্ছ। জ্বরসি ধৃতা মনসা জুষ্টা বিষ্ণবে।১৭৷৷ তস্যাস্তে সত্যসবসঃ প্রসবে তম্বো যন্ত্রমশীয় স্বাহা। শুক্রমসি চন্দ্রমসামৃতমসি বৈশ্বদেবমসি৷৷১৮৷৷ চিদসি মনোসি ধীরসি দক্ষিণাসি ক্ষত্রিয়াসি যজ্ঞিয়াস্যদিতিরস্যুভয়তঃ শীষ্ণী। সা নঃ সুপ্রাচী সুপ্রতীচ্যেধি মিত্রা পদি বীতাং পূষাহধ্বনস্পত্বিায়াধ্যক্ষায়।১৯৷ অনু ত্বা মাতা মন্যতামনু পিতাইনুভ্রাতা সগর্ভোহনু সখা সযূথ্যঃ। সা দেবি দেবমচ্ছেহীন্দ্রায় সোমং রুদ্রাস্ত্ৰা বৰ্ত্তয়তু স্বস্তি সোমসখা পুনরেহি৷৷২০৷৷ ব্যস্যদিতিরস্যাদিত্যাসি রুদ্রাসি চন্দ্রাসি। বৃহস্পতিবা সুমে রাতু রূদ্রো বসুভিরা চকে৷৷২১৷৷ আদিত্যাস্থা মূর্ধন্নাজিঘর্মি দেব্যজনে পৃথিব্যা ইড়ায়াস্পদমসি ঘৃতব স্বাহা। অস্মে রমস্বাস্মে তে বন্ধুত্বেরায়ো মেরায়ো মা বয়ং রায়ম্পোষেণ বিষৌষ্ম তোতো রায়ঃ।।২২৷৷ সমখ্যে দেব্যা ধিয়া সং দক্ষিণখোরাচক্ষ মা ম আয়ুঃ প্রমমাষীর্মো অহং তব বীরং বিদেয় তব দেবি সশি৷৷২৩৷৷ এষ তে গায়ত্রো ভাগ ইতি মে সোমায় ক্ৰতাদেষ তে ত্রৈভো ভাগ ইতি মে সোমায় ক্ৰতাদেষ তে জাগতো ভাগ ইতি মে সোমায় ক্ৰতাচ্ছন্দোনামানাং সাম্রাজ্যং গচ্ছেতি মে সোমায়। ব্ধতাদাস্মাকোহসি শুক্ৰস্তে গ্রাহ্যো বিচিতত্ত্বা বি চিন্তুস্তু৷৷২৪৷ অভি ত্যং দেবং সবিতারমেণ্যোঃ কবিতুমৰ্চামি সত্যসবং রত্নধামভি প্রিয়ং মতি কবিম। ঊর্ধ্বা স্যামতিৰ্মা আদিদ্যুতসবীমনি হিরণ্যপাণিরমিমীত শুক্রতুঃ। কৃপা স্বঃ। প্রজাভ্যা প্রজাস্থাহনুপ্রাপন্তু প্রজাস্তু মনু প্রাণিহি৷৷২৫৷৷ শুক্রং ত্ব শুক্রেণ ক্ৰীণামি চন্দ্রং চন্দ্রেণামৃতমমৃতেন। সম্মু তে গৌম্মু তে চন্দ্রাণি তপসস্তনুরসি প্রজাপতের্বর্ণঃ পরমেণ পশুনা ক্ৰীয়সে সহস্রপোষং। পুষেয়৷৷২৬৷ মিত্রো ন এহি সুমিত্রধ ইন্দ্রস্যোরূমা বিশ দক্ষিণমুশনুশন্তং স্যোনঃ স্যোন। স্বান ভ্রাজাঙঘারে বম্ভারে হস্ত সুহস্ত কৃশানবেতে বঃ সোময়ণাস্তন্ত্ৰক্ষধ্বং মা বো দভ৷৷২৭৷ পরি মাহগ্নে দুশ্চরিতাদ্ধাধস্বা। মা সুচরিতে ভজ। উদায়ুষা স্বায়ুযোদস্থামমৃহ্যাঁ অনু৷৷২৮৷৷ প্রতি পন্থামপদ্মহি স্বস্তি গামনেহস। যেন বিশ্ব পরি দ্বিষো বৃত্তি বিন্দতে বসু৷৷২৯৷৷ অদিত্যাগস্যদিত্যে সদ আসীদ। অস্তভদ্দ্যাং বৃষভো অন্তরিক্ষমমিমীত বরিমাণং পৃথিব্যাঃ। আহসীদঘিশ্বা ভুবিনানি সম্রাড় বিশ্বেত্তানি বরুণস্য ব্ৰতানি৷৷৩০৷ বনেষু ব্যন্তরিক্ষং ততান বাজমৎসু পয় উসিয়াসু। হৃত্স তুং বরুণ্যে বিগ্নিং দিবি সূর্যমদধাত্ সোমমট্রেী।।৩১৷৷ সূর্যস্য চক্ষুরায়রাহাগ্নের কনীনক। যত্রৈতশেভিরীয়সে ভ্ৰাজমানো বিপশ্চিতা৷৩২৷৷ উস্রাবেতং ধূর্ষাহৌ যুজ্যেথামন অবীরহণেী ব্ৰহ্মচোদ্দনৌ। স্বস্তি যজমানস্য গৃহান্ গচ্ছত৷৩৩৷ ভদ্ৰো মেহসি চ্যবস্ব ভূবম্পতে বিশ্বান্যভি ধামানি। মা ত্বা পরিপরিণো বিদন্ মা ত্বা পরিপন্থিনো বিদন্ মা ত্বা বৃকা অঘায়বো বিদ। শ্যেনো ভূত্বা পরা পত যজমানস্য গৃহান্ গচ্ছ তন্নৌ সংস্কৃত৷৩৪৷নমো মিত্রস্য বরুণস্য চক্ষুসে মহো দেবায় ততং সপৰ্যত। দূরেদৃশে দেবজাতায় কেতবে দিবপুত্ৰায় সূর্যায় শংসত৷৷৩৫৷৷ বরুণস্যোত্তম্ভনমসি বরুণস্য স্কম্ভসর্জনী ছো বরুণস্য ঋতসদন্যসি বরুণস্য ঋতসদনমসি বরুণস্য । ঋতসদনমা সীদ৷৷৩৬৷ যা তে ধামানি হবিষা যজন্তি তা তে বিশ্বা পরিভূরস্তু যজ্ঞ। গয়স্ফানঃ প্রতরণঃ সুবীরোহবীরহা প্র চরা সোম

.

মন্ত্ৰার্থঃ– ১। যে হৃৎ-প্রদেশে (অথবা যে যজ্ঞভূমিতে) নিখিল সঙ্ঘভাব (দেববিভূতি) অধিষ্ঠান করেন, হে ভগবন্। এমন হৃদয়প্রদেশ (যজ্ঞভূমি) এই মর্ত্যলোকে (সংসারে) থেকেই আমরা যেন প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে, –এই সংসারে অবস্থিত থেকেই আমরা যেন সত্ত্বভাব সমন্বিত হতে পারি)। [যত্র যস্মিন্ হৃদ্দেশে যজ্ঞভূমৌ বা; যজনং–হৃদ্দেশং, যজ্ঞভূমিং বা; আ পৃথিব্যাঃ–অস্মিন্ মর্ত্যলোকে এব, সংসারে এবং ইতি ভাবঃ] (১)। অজ্ঞানতা-সমুদ্র সমুত্তীর্ণ হতে ইচ্ছুক আমরা (যেন) ঋক সাম ও যজুমন্ত্র রূপ স্তরের দ্বারা এবং পরমধন তত্ত্বজ্ঞানের পোষক সত্ত্বভাবের দ্বারা সম্যক্ প্রকারের হৃষ্ট হই। (ভাব এই যে, ভগবানের উপাসনায় অজ্ঞানতার বিনাশে আমরা যেন প্রজ্ঞান লাভ করি। [সংতরন্তঃ–অজ্ঞানতাসমুদ্রং সমুদ্ধরন্তঃ] (২)। প্রসিদ্ধ (সাধকগণের অনুভূত) এই জলাধিষ্ঠাত্রী দেববিভূতিগণ (সত্ত্বভাব) আমার সুখদায়িনী হোন। (ভাব এই যে,ভগবান্ সর্বভূতে বিরাজমান; তার এই জলাধিষ্ঠাত্রী স্নেহকারুণ্য রূপী–বিভূতিসমূহ আমার কুশল বিধান করুন)। [ইমাঃ–প্রসিদ্ধাঃ, সাধকৈরনুভূতাঃ; আপঃ অপানধিষ্ঠাত্রঃ, সত্ত্বভাবানাং প্রদায়িঃ ] (৩)। হে কর্মফলপ্রদানকারিন্! আমাকে অজ্ঞানতা হতে উদ্ধার করুন। (ভাব এই যে, হে দেব! শীঘ্র আমার কর্মফল ধ্বংস করুন)। [ওষধে কর্মফলদায়ক দেব; ত্রায়স্ব–অজ্ঞানাদুদ্ধারয়] (৪)। হে ভববন্ধনছেদনকারী দেব! এই জনের (আমার) প্রতি প্রতিকূল হবেন না। (ভাব এই যে,আমাকে ভববন্ধন হতে মুক্ত করুন)। [স্বধিতে–ভববন্ধনচ্ছেদক দেব!;এনং জনং–মামিতি যাবৎ] (৫)।

২। জগতের নির্মাণকৰ্জী (অথবা মাতার ন্যায় পালনকর্তী) সত্ত্বভাবের দ্বারা পবিত্ৰকারিণী এবং দ্যুতিশালিনী জলের অধিষ্ঠাত্রী দেববিভূতিগণ, আমাদের পাপসমূহকে অপনীত করুন; সত্ত্বভাবের দ্বারা আমাদের পবিত্র করুন; এবং এই জন্মজরামৃত্যুরূপ সংসার হতে (অথবা অজ্ঞানী আমাদের) উদ্ধার করুন।(ভাব এই যে,–দেববিভূতিগণ আমাদের পাপসমূহকে বিনষ্ট করে সত্ত্বভাবের দ্বারা আমাদের এই সংসার হতে উদ্ধার করুন। এই প্রার্থনা)। [মাতরঃ–জগন্নির্মাঃ, মাতৃবৎ পালয়িত্রো বা; ঘৃতপৃঃসত্ত্বভাবেন পবিত্ৰকারিণ্যঃ; ঘৃতেন–ঘৃতবৎ আর্দকারিণা, সত্ত্বভাবেনেতি ভাবঃ; অস্মাৎ–জন্মজরামৃত্যুরূপাৎ সংসারা]।(১)। আমরা জলের অধিষ্ঠাত্রী দেববিভূতি হতে স্নানের দ্বারা (বহিঃশুদ্ধ) ও আচমনের দ্বারা (অন্তঃশুদ্ধ) শুদ্ধসত্ত্বভাবাপন্ন হয়ে ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হই। (ভাব এই যে, দেববিভূতির প্রসাদে বাহির ও অন্তর শুদ্ধ হয়ে আমরা যেন ব্রহ্মলোক অর্থাৎ মুক্তি প্রাপ্ত হই– এই প্রার্থনা)। [আভ্যঃ–অদ্ভঃ, অপামধিষ্ঠাতৃ-দেববিভূতিভ্যঃ; শুচিঃ–স্নানেন শুদ্ধঃ, বহিঃশুদ্ধিযুক্ত ইতি ভাবঃ, পূতঃ–আচমনাদিভিরন্তঃশুদ্ধঃ, সত্ত্বভাবাপন্ন ইতি ভাবঃ] (২)। হে দেববিভূতি! তুমি দীক্ষণীয় ও উপসদ ইষ্টির (অর্থাৎ সকর্ম-সমূহের) তনু অর্থাৎ শরীরের মতো প্রধান হয়ে থাকো। ৬ কল্যাণপ্রদা সুখস্বরূপা সেই তোমাকে শুভঙ্কর সত্ত্বভাব পাবার জন্য আশ্রয় করছি। (ভাব এই যে, সত্ত্বভাব পাবার জন্য সৎকর্মের ফলদানকারী দেবকে আশ্রয় করছি)। [দীক্ষাতপসোঃ– দীক্ষণীয়োপসদিষ্টিকর্মণণাঃ, সৎকর্মসমূহস্য ইতি ভাব; তঃ–শরীরবদ অঙ্গী, প্রধানা ইতি ভাবঃ; শিবাং-কল্যাণপ্রদাং; শগ্নাং–সুখস্বরূপাং; ভদ্রং–মঙ্গলময়ং]।(৩)

৩। হে দেব! আপনি এই ভূমির অর্থাৎ এই মর্ত্যলোকের জলরূপ (জ্ঞানভক্তিস্বরূপ) হন। (ভাব এই যে, জল যেমন ভূমির আর্দ্রভাব জন্মায়, তেমন আপনি মর্ত্যলোকের রসাদ্রভাব অর্থাৎ ভক্তি ও জ্ঞান জন্মিয়ে থাকেন); এবং আপনি জ্ঞানতেজঃ প্রদ হন; অতএব আমাকে (জ্ঞানতেজোহীনকে) জ্ঞানরূপ তেজঃ বিতরণ করুন। [মহীনাং– ভূমীনাং, মত্যলোকানামিতি ভাবঃ; পয়ঃ– জলরূপ; জ্ঞানভক্তিরূপঃ ইতি ভাবঃ; বৰ্চঃ জ্ঞানতেজঃ] (১)। হে দেব! আপনি, অজ্ঞানরূপ অথবা বাহ্য ও অন্তর শত্রুরূপ অসুরের নাশে শক্তিস্বরূপ হন; (ভাব এই যে,–যেমন কণীনিকা দৃষ্টিশক্তির মূল কারণ, তেমনই আপনি অজ্ঞান নাশের অথবা বাহ্য ও অন্তর শত্রু নাশের মূল কারণ) হে দেব! আপনি অজ্ঞানতানাশক অথবা শত্রুনাশক বলে জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদ হন। অতএব, আমায় জ্ঞানচক্ষু প্রদান করুন। (ভাব এই যে,–হে দেব আপনি অজ্ঞানতানাশক ও বহিরন্তঃশত্রুনাশক; অতএব আপনি আমাদের অজ্ঞানতা ও বহিরন্তঃশত্রু বিনাশ করে আমাদের জ্ঞানচক্ষুঃ প্রদান করুন)। [বৃত্রস্য–অসুরস্য–অজ্ঞানরূপস্য, বহিরন্তঃরূপস্য; কনীনকঃ তস্য নাশশক্তিরূপঃ; চক্ষুঃজ্ঞানচক্ষুঃ]](২)

৪। জ্ঞানাধিপতে, আমাকে পবিত্র করুন। [চিৎপতি–জ্ঞানাধিপতিঃ; পুনাতু–পবিত্রীকরতু]।(১)। বাত্ময়াধিদেব, আমাকে পবিত্র করুন। [বাপতিঃ– বাত্ময়াধিদেবঃ]](২)। জগৎপ্রসবকর্তা (অর্থাৎ জগতের আদি-কারণ) লীলাময় ভগবান, অবিচ্ছিন্ন শুদ্ধিকারক (অজ্ঞানতা-নাশক) সেই জ্ঞানরশ্মির দ্বারা আমাকে জ্ঞানেনাদীপ্ত করুন। হে জ্ঞানাধিপতে। আপনি জ্ঞানপূত (জ্ঞানময়) ও প্রসিদ্ধ (সাধকগণ কর্তৃক অনুভূত)। আপনার যে স্বরূপ (জ্ঞানময়ত্ব-জ্ঞান) আমি কামনা করছি, সেই স্বরূপ যেন পেতে পারি এবং তার দ্বারা পূত হতে সমর্থ হই। (ভাব এই যে, –হে ভগবন্! আমি তত্ত্বজ্ঞানাভিলাষী। যাতে সেই বস্তু প্রাপ্ত হয়ে পূত হতে পারি, আপনি তার বিধান করুন)। [সবিতাজগৎপ্রসবকর্তা, জগতামাদিকারণঃ; সূর্যস্য-জ্ঞানালোকস্য; পবিত্ৰপতে জ্ঞানাধিপতে]।(৩)। [এই কণ্ডিকার তিনটি মন্ত্রই প্রার্থনামূলক]।

৫। হে দেবভাব অর্থাৎ দেববিভূতিগণ! আমাদের অনুষ্ঠিত এই আন্তরযজ্ঞে (অথবা আত্মার উদ্বোধন যজ্ঞে) আমরা আপনাদের আনুকূল্য প্রার্থনা করছি। আর, হে দেববিভূতিগণ! এই যজ্ঞসম্বন্ধিনী আর্শীবাণী (অর্থাৎ এই যজ্ঞের শুভফল) পাবার জন্য আপনাদের আহ্বান করছি। (ভাব এই যে, হে দেবগণ! আমাদের এই মানস-যজ্ঞে অথবা আমাদের উদ্বোধনরূপ যজ্ঞে আপনাদের অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। আপনারা এই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করে দিন এবং সকর্মের শুভফল–মোক্ষফল প্রদান করুন)। [দেবাসঃ–হে দেবভাবঃ; বামং বননীয়ত্বং, আনুকূল্যং ইতি। ভাবঃ] (১)। [কণ্ডিকার এই মন্ত্রটি প্রার্থনার ভাব প্রকাশ করছে।

৬। চিত্তের উদ্বোধনরূপ যজ্ঞকে যেন স্বাহার (স্বাহা নামক অগ্নির স্ত্রীর) মতো প্রাপ্ত হই। অথবা, চিত্তের দ্বারা দর্শপৌর্ণমাস ইত্যাদিরূপ সৎকর্ম যেন পাই। (ভাব এই যে, আমার মানস-যজ্ঞ যেন সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়)। [মনসঃ–চিত্তস্য; যজ্ঞং–আত্ম-উদ্বোধনরূপং যজ্ঞং; অথবা, মনসঃ–মনসা–চিত্তেন; যজ্ঞং-দর্শপৌর্ণমাসাদিরূপং সৎকর্ম; স্বাহা–প্রাপ্লেমি, সম্যক্ সাধয়ামিতি ভাবঃ)।(১)। সেই উদ্বোধনরূপ যজ্ঞ (মানস-যজ্ঞ) অথবা সৎকর্ম মহৎ অন্তরিক্ষলোক (বিশ্ব) ব্যাপিয়া প্রকাশ পায়। (ভাব এই যে, সঙ্কর্মের দ্বারা সত্ত্বভাব উপজিত হলে বিরাট বিশ্বময়ের স্বরূপ অবগত হওয়া যায়)। [স্বাহা–স উদ্বোধন যজ্ঞঃ, সকর্ম। বা]।(২)। সেই উদ্বোধন-রূপ যজ্ঞ অথবা সৎকর্ম ভূলোক ও স্বর্গলোক ব্যেপে প্রকাশ পায়। (ভাব এই যে,–সৎকর্মের প্রভাবে দেববিভূতি অধিগত হয়) (৩)। সেই উদ্বোধন-যজ্ঞ অথবা সকর্মকে যেন আমি সত্ত্বভাব হতে আরম্ভ করি অর্থাৎ সত্ত্বভাব সহযুত হয়ে আমি যেন সেই কার্যে প্রবৃত হতে পারি। সেই কার্য (আমার মানস-যজ্ঞ) সিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে, যে জ্ঞানময় দেব উদ্বোধনরূপে বিরাজ করেন, যিনি স্বর্গ অন্তরীক্ষ মর্ত–এই ত্রিলোক ব্যেপে আছেন, তাকে যেন সত্ত্বভাবের দ্বারা অধিগত করতে সক্ষম হই)। [স্বাহা–তৎ উদ্বোধনযজ্ঞং, সৎকর্ম বা; স্বাহা–তৎসিদ্ধমস্তু ইত্যর্থঃ] (৪)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র চারটিতে আত্মার উদ্বোধনের ভাব প্রকাশ পেয়েছে]।

৭। আত্মার উদ্বোধন করব এমন সঙ্কল্প-সিদ্ধির জন্য (আমার অনুষ্ঠিত মানস-যজ্ঞ পরিপূরণার্থ) সঙ্কল্প-সিদ্ধির প্রযোজক (অথবা সিদ্ধিদাতা) সেই জ্ঞানদেবের উদ্দেশ্যে আমার এই সত্ত্বভাব সমর্পিত হোক। [আকুত্যৈ–আত্মেঘদ্বাধনং করিষ্যামীত্যেৰং বিধায় সঙ্কল্পায় তৎসিদ্ধর্থমিতি ভাবঃ, অনুষ্ঠীয়মানমানস যজ্ঞপূর্ণার্থমিতি যাবৎ; অগ্নয়ে-জ্ঞানদেবায়]।(১)। ভগবৎ বিষয়ে ধারণাশক্তি-লাভের জন্য, মনের অধিষ্ঠাতা সেই জ্ঞানদেবের উদ্দেশ্যে (আমার) এই সত্ত্বভাব সমর্পিত হোক। [মেধায়ৈ–ভগবদ্ধারণাশক্তয়ে, তল্লাভার্থমিতি.ভাবঃ]। ব্রত-নিয়ম অর্থাৎ সর্মসমূহ সিদ্ধির জন্য তপঃস্বরূপ সেই জ্ঞানদেবের উদ্দেশ্যে (আমার) এই সত্ত্বভাব সমর্পিত হোক। [দীক্ষয়ৈ–ব্রতনিয়মায়, সৎকর্মানিবহায়তৎসিদ্ধ্যর্থমিতি ভাবঃ] (৩)। বাসিদ্ধির জন্য, বাগিন্দ্রিয়পোষক সেই জ্ঞানদেবের উদ্দেশ্যে (আমার) এই সত্ত্বভাব সমর্পিত হোক। [সরস্বত্যৈ-বাচে, বাসিদ্ধয়ে ইতি ভাবঃ; পূষ্ণে-বাগিন্দ্রিয়পোষকায়]।(৪)। হে জলের অধিষ্ঠাত্রী! হে স্বর্গমর্তের অধিষ্ঠাত্রী! হে অন্তরীক্ষের অধিষ্ঠাত্রী! হে মহান্! হে বিশ্বব্যাপক! হে সকল সুখের জননী! হে দেববিভূতিসমূহ! তোমাদের ও দেবাধিদেবকে আমরা এই আমাদের হৃদয়গত সত্ত্বভাব দান করছি। এটি (সেই সত্ত্বভাব) তোমাদের প্রীতিপ্রদ হোক। [বিশ্বসম্ভুবঃ–সকলসুখজনয়িঃ; বৃহস্পতয়ে–দেবাধিদেবায়](৫)। [এই কণ্ডিকার পাঁচটি মন্ত্রই প্রার্থনা-মূলক]।

৮। সকল মনুষ্য, ফলদাতা সেই ভগবানের সাহায্য (আনুকূল্য) প্রার্থনা করেন। সকল জনই ধনের জন্য অর্থাৎ জ্ঞানধনের জন্য (পরমধন লাভের জন্য) ভগবানকে প্রার্থনা করেন। পুষ্টির জন্য (সত্ত্বভাব লাভের জন্য) দীপ্তিশালী যশঃ, অন্ন অথবা সত্ত্বভাব প্রার্থনা করেন। স্বাহা অর্থাৎ আমাদের প্রার্থনা সিদ্ধ হোক (অথবা আমাদের অনুষ্ঠিত কর্ম সুসম্পন্ন হোক) [এই কণ্ডিকার মন্ত্রটির ভাগবানের মহিমা প্রকাশ করছে]।(১)

৯। হে দেববিভূতিদ্বয় (অন্তৰ্বাধিবহিব্যাধিনাশক অশ্বিনীদ্বয়) আপনারা ঋক্ ও সাম বেদের (অথবা নিখিল শুদ্ধসত্ত্বভাবের) শিল্পী অর্থাৎ অভিব্যঞ্জক হন; সেই প্রসিদ্ধ (সাধকগণের অনুভূত) আপনাদের দুই জনকে আরাধনা করি; আপনারা আমাদের এই আরব্ধ আত্ম-উদ্বোধন যজ্ঞের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত আমাকে রক্ষা করুন।(ভাব এই যে,–দেবতা আর দেববিভূতি অভিন্ন; সুতরাং আপনারা দুই জনও বেদের অভিব্যঞ্জক; অর্থাৎ নিখিল শুদ্ধসত্ত্বপ্রদাতা আপনারা আমাদের কর্তৃক আরাধিত হয়ে আমাকে রক্ষা করুন)। [ঋক্‌সাময়ো–তন্নামকবেদয়ো, যদ্বা নিখিলশুদ্ধসত্ত্বানামিতি ভাবঃ; যজ্ঞস্য–আত্মদ্বধনরূপস্য কর্মণঃ] (১)। হে দেব! আপনি মঙ্গলময় ও পরমসুখপ্রদাতা; আপনি আমাকে সুখ অর্থাৎ মঙ্গল প্রদান করুন। আপনাকে নমস্কার করি। আমাকে হিংসা করবেন না অর্থাৎ আমার প্রতি বিরূপ হবেন না। আমাকে পরিত্রাণ করুন।(২)। [আমরা মনে করি–এই মন্ত্র দুটি প্রার্থনার ভাব ব্যক্ত করছে। স্থঃ এই দ্বিবচনান্ত ক্রিয়াপদে দ্বিবচনান্ত কর্তৃপদ দ্যোতনা করছে। সেই অনুসারে দেববিভূতি অশ্বিদ্বয়কে (আধিব্যাধি-নাশক দেবতা দুজনকে) আমরা সম্বোধ্য মনে করেছি। তাদের নিকট প্রার্থনা জানান হচ্ছে, মা পাতমাস্য যজ্ঞস্যোদৃঢ়ঃ; অর্থাৎ, আমার এই আরব্ধ উদ্বোধনযজ্ঞের সমাপ্তি পর্যন্ত আমাকে পালন করুন; অর্থাৎ হে বহিরন্তৰ্বাধিনাশক দেবদ্বয়! যাতে এই ব্যাধি দুটি উদ্বোধন কার্যে ব্যাঘাত জন্মাতে না পারে, আপনারা তা-ই করুন। আমার শারীরিক ও মানসিক ব্যাধি (পীড়া) বিনাশ করুন। সেই দেববিভূতি অশ্বিনী কুমারদ্বয় কেমন? ঋকসাময়য়াঃ শিল্পে অর্থাৎ ঋক্ ও সামবেদের শিল্পী অর্থাৎ অভিব্যঞ্জক। দেবতা ও দেববিভূতি–তত্ত্বতঃ একই পদার্থ। বিভূতিসমষ্টিই দেব বা ভগবান্। ব্যষ্টি তার বিভূতি। সুতরাং ভগবৎ-বিভূতি অশ্বিকুমার দুজনকে ঋক্ বা সামবেদের অতিব্যঞ্জক বলা যেতে পারে। তাদের বামারভে বলে আরাধনা করি–এই ভাব প্রকাশ করা যেতে পারে। যজ্ঞ শব্দের সাধারণ সোমবাগ ইত্যাদি অর্থ না ধরে বিশেষ উদ্বোধন-যজ্ঞ অর্থ আমরা গ্রহণ করি]।

১০। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি অঙ্গিরস ঋষিদের অর্থাৎ সমস্ত মানবের অন্নরসস্বরূপ অর্থাৎ সত্ত্বভাবরূপ এবং উর্ণাতন্তর মতো মৃদুস্বভাব হন। সুতরাং আমার মতো দীনজনে অন্নরস অর্থাৎ সত্ত্বভাব স্থাপিত করুন। [আঙ্গিরস অঙ্গিরসাং ঋষীণাং সর্বজনানামিতি ভাবঃ সম্বধিনী]।(১)। হে ভগবৎ-বিভূতৈ! আপনি সত্ত্বভাবের গ্রন্থি অর্থাৎ সংযোজক হন। (প্রার্থনা,–আমাতে সত্ত্বভাব সংযোজিত করুন)। [সসামস্য–সত্ত্বভাবস্য]।(২)। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি, ব্যাপক সৎকর্মসমূহের অর্থাৎ সেই নিমিত্তক সুখ-প্রাপ্তির হেতুভূত হন; অতএব যজমানকে (সকর্মকারী আমাকে) সুখ (পরমসুখ) প্রদান করুন। [বিষ্ণোঃব্যাপস্য, সৎকর্মনিবহস্য ইতি ভাবঃ; যজমানস্য–সকর্মকতুঃ]. (৩)। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি, পরমেশ্বর্যশালী ভগবানের প্রাপ্তির কারণ হন। (প্রার্থনা–আমাকে ভগবৎপ্রাপ্তি-সামর্থ্য প্রদান করুন) [ইস্য–পরমৈশ্বর্যশালিনে ভগবতঃ; যোনি–প্রাপ্তিকারণং]।(৪)। হে ভগবৎ-বিভূতে! আপনি, কৃষ্টভূমিকে (অথবা চিত্তরূপ উৎকৃষ্ট ভূমিকে) ব্রীহিযব ইত্যাদি যুক্ত (অথবা সত্ত্বভাবাদিযুক্ত করুন। (প্রার্থনা, যাতে আমার হৃদয়ে সত্ত্বভাব উপচিত হয়, আপনি তার বিধান করুন)। [সুসস্যাঃ ব্রীহিযবাদিযুক্তাঃ, সত্ত্বভাবাদিশস্যযুক্তা বা]।(৫) হে সংসার-কাননের অধিপতি! আপনি সংসারীবর্গের আশ্রয়স্বরূপ হন। আপনি (আমাদের প্রতি) অনুকূল হয়ে (আমাদের) এই আরব্ধ সঙ্কর্মের উত্তরা (শেষ) ঋক্ পর্যন্ত অর্থাৎ সমাপ্তি পর্যন্ত আমাকে পাপ হতে রক্ষা করুন। (প্রার্থনা, সমস্ত পাপ থেকে বিমুক্ত করে আমাকে সৎকর্মের শুভফল প্রদান করুন)। [বনস্পতে–হে সংসারারণ্যানাং পতেঃ; যজ্ঞস্য সৎকর্মণঃ; আ উদৃচঃ–উত্তরায়া, ঋচঃ পর্যন্তং, সমাপ্তিং যাবৎ ইতি ভাবঃ] (৬)

১১। হে আমার মনোবৃত্তিসমূহ! ভগবৎ-আরাধনা ইত্যাদি কর্ম অনুষ্ঠান করো; জ্ঞানস্বরূপ দেব, সর্বভূতে বিদ্যমান্ পরমাত্মা, যাগ ইত্যাদি সৎকর্ম, সঙ্কর্ম সাধনের উপযোগী বিবেক বা সৎ-জ্ঞান, সম্মুখে বিদ্যমান রয়েছেন–অবলোকন করো। (ভাব এই যে, বিভিন্নরূপে প্রকটিত থেকে, ঐ দেখ, ভগবান্ তোমাকে সৎকর্মের সাধনে উদ্বুদ্ধ করছেন)। [ব্রহ্মাগ্নি–সর্বভূতে বিদ্যমান্ পরমাত্মা; বনস্পতি–বিবেক, সৎ জ্ঞানং, হিংস্র জন্তুপূর্ণস্য অরণ্যসদৃশস্য হৃদয়স্য রক্ষকঃ] (১)। হে ভগবন্! দেবকার্যে স্বতঃপ্রবৃত্তা, পরমসুখপ্রদায়িকা, তেজের ধারয়িত্রী (তেজোয়মী), সৎকর্মসাধয়িত্রী, বুদ্ধি (প্রজ্ঞা) আমরা প্রার্থনা করছি; সুখলভ্যা হয়ে, সেই বুদ্ধি (প্রজ্ঞা) আমাদের বশতাপন্ন হোক। (ভাব এই যে, আমরা যেন সর্বসিদ্ধিপ্রদা সুবুদ্ধির অধিকারী হই; হে ভগবন্! তা-ই বিধান করুন)। [দৈবীং–দেবতোদ্দেশেন স্বতঃপ্রবৃত্তাং; যজ্ঞবাহসংসকর্মসাধয়িত্রীং]।(২)। হৃদয়ে উৎপন্ন, হৃদয়ের সাথে সম্বন্ধবিশিষ্ট, সৎকর্মের সাধক, সকলেরই অনুভূত, যে দেবভাবসমূহ, তারা সকলে আমাদের পরিত্রাণ করুন এবং রক্ষা করুন। সেই পরিত্রাণকারী দেবতাবর্গকে এই স্বাহা মন্ত্র সহযোগে হবিঃ অর্পণ করছি; অভীষ্ট সিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারা আমাদের হৃদয় পরিপূর্ণ হোক; আমাদের সকল কর্ম তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হোক)। [মনোজাতাঃ–হৃদি উৎপন্নাঃ; মনোযুজঃ–হৃদা সম্বন্ধবিশিষ্টা; দক্ষতবঃ–সৎকর্ম সাধিকাঃ] (৩)।

১২। হে শুদ্ধসত্ত্ববাবরূপী দেবীগণ! আপনারা আমার অন্তরস্থ হয়ে (আমার পক্ষে) ত্বরায় সকাৰ্যসাধিকা হোন। আর, আমাদের হৃদয়ের অভ্যন্তরে অবস্থিত থেকে আমাদের সুখহেতুভূত হোন; অক্ষরা, অজরা, পাপনাশিকা, জ্যোতীরূপা, অমরত্বপ্রদায়িকা, সৎকর্মমূলীভূতা, সত্ত্বভাবরূপিণী সেই প্রসিদ্ধ দেবীগণ, আমাদের উপকারের নিমিত্ত আমাদের প্রতি প্রসন্না হোন। (ভাব এই যে, হৃদয়ে সত্ত্বভাবের বিকাশ হোক; আর তার দ্বারা আমরা পরাগতি লাভ করি)। [শ্বাত্রাঃ ক্ষিপ্ৰপরিণামাঃ, ত্বরয়া সকার্যসাধিকাঃ; অযক্ষ্মাঃ–ক্ষয়রহিতাঃ, অক্ষরাঃ; ঋতাবৃধঃ সৎকর্মমূলীভূতাঃ]।(১)

১৩। হে ভগবন্! এই যে পরিদৃশ্যমান আমার দেহ, এটি আপনার যজ্ঞের উপযুক্ত স্থান। [তনুং–দেশঃ] (১)। কিন্তু আমি আমার যজ্ঞের উপযোগী দ্রব্যসমূহকে শুদ্ধসত্ত্বভাবনিবহকে–পরিত্যাগ করছি, আর আমার আশ্রিত হৃদয়স্থিত কাম ইত্যাদি রিপুবর্গকে পরিত্যাগ করছি না (২)। [মন্ত্র দুটির ভাব এই যে, ভগবানের পূজায় সত্ত্বভাব ইত্যাদিরই প্রয়োজন, সে পূজায় রিপুদের বলিদান দেওয়াই কর্তব্য; কিন্তু আমি বিপরীত কর্ম করছি]। হে আপঃ (শুদ্ধসত্ত্বভাবানিবহ)! আপনারা ভগবৎসম্বন্ধযুত পাপের নিবারক হয়ে, সংসারকে প্রাপ্ত হোন (ইহলোককে উদ্ধার করুন)। [পৃথিবীং–ধরিত্রীং, ইহলোক] (৩)। হে ভগবন্! আপনি পার্থিবদেহধারী আমার সাথে মিলিত হয়ে আমাকে সত্ত্বভাবান্বিত করুন–এই প্রার্থনা। [পৃথিব্যা পার্থিবদেহধারিণা ময়া সহ]।(৪)। [শেষের এই মন্ত্র দুটির ভাব এই যে,–লোকের পরিত্রাণের জন্য ইহজগতে সত্ত্বভাবের আবির্ভাব, অজ্ঞানতাজনিত উপেক্ষায় আমি তার সঙ্গ ত্যাগ করি। প্রার্থনা–হে ভগবন্! আমায় সেই সত্ত্বভাব পুনরায় প্রদান করুন।

১৪। হে জ্ঞানময় দেব! আপনি আমাদের হৃদয়ে চিরজাগরুক থাকুন; আপনার প্রার্থনাকারী আমরা মোহঘোরে সংজ্ঞারহিত হয়ে আছি। (ভাব এই যে, অজ্ঞানতা-হেতু অথবা মোহবশতঃ আমরা যদি বিপথগামী হই, হে জ্ঞানময়, বিবেকরূপে হৃদয়ে উদিত হয়ে আমাদের সৎপথ প্রদর্শন করুন)। [অগ্নে–হে জ্ঞানময় দেব] (১)। হে ভগবন্! আমাদের সর্বতোভাবে পরিত্রাণ করুন; আর আমাদের প্রবোধ দিয়ে (সুবুদ্ধি প্রদান করে) আমাদের প্রমাদ দূর করুন, এবং পুনরায় আমাদের সৎকর্মান্বিত সত্ত্বভাবযুত করুন। (ভাব এই যে, হে ভগবন্। আপনার কৃপায় সৎ-উপদেশ লাভ করে আমরা যাতে সৎপথাবলম্বী হতে পারি তা-ই বিহিত করুন। [পুনস্কৃধি–এবং পুনরপি সৎকর্মান্বিতান সত্ত্বভাবযুতান করু]।(২)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র দুটি জ্ঞানস্বরূপ অগ্নিদেবকে লক্ষ্য করে প্রযুক্ত হয়েছে]।

১৫। ভগবন্! আপনার কৃপায় আমার বিশুদ্ধ অনন্তঃকরণ আমাতে প্রত্যাগত হোক, সৎকর্মশীল জীবন আমাতে প্রত্যাগত হোক; আমার সকর্মসাধনপরায়ণা শক্তি আমাতে প্রত্যাগত হোক,–পরমাত্মার অংশীভূত চৈতন্য আমাতে প্রত্যাগত হোক; সৎ বস্তুর দর্শন সমর্থ আমার চক্ষু আমাতে প্রত্যাগত হোক,ভগবৎ-মহিমা শ্রবণ-পরায়ণ কর্ণ আমাতে প্রত্যাগত হোক। (ভাব এই যে, আমার জন্মসহজাত সৎ-ভাব-সকল আমাতে আবার স্ফূর্তিলাভ করুক)। [আয়ু– জীবনং–সকর্মশীলং; প্রাণশক্তিঃসঙ্কর্মসাধনশীলা; আত্মা-চৈতন্যং–পরমাত্মনোহংশী ভূতং; পুনঃময়ি প্রত্যাগতো ভবতু] (১)। বিশ্বহিতসাধক (বৈশ্বানরঃ), হিংসাতীত (অদব্ধ), দেহরক্ষক (তপা), সেই জ্ঞানময় দেবতা (অগ্নি) আমাদের নিন্দিত (অবদ্যাৎ) পাপ হতে (পাপা) পরিত্রাণ করুণ (পাতু)(২)। [মন্ত্র দুটি ভগবৎ সম্বোধনে প্রযুক্ত]। [ভাষ্যকার মহীধর একভাবে এই মন্ত্রের সাথে পূর্ব-মন্ত্রের সম্বন্ধ রক্ষা করেছেন; আর, আমরা একভাবে এই মন্ত্রের সাথে পূর্ব মন্ত্রের সম্বন্ধ স্বীকার করছি। ভাষ্যের মত এই যে,–অগ্নি প্রজ্বালিত করে যাজ্ঞিক বা যজমান নিদ্রিত হয়েছিলেন; এখন ঋত্বিক বা পুরোহিত যেন সেই যজমানকে উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি বলছেন, নিদ্রিতাবস্থায় যজমানের মন সুপ্তিতে বিলীন হয়েছিল, সেইমন আমার জাগ্রত হোক। এমন, তিনি আরও বলছেন, যজমানের আয়ুঃ সুপ্তিতে বিঘোর অবস্থায় ছিল; সেই আয়ুঃ পুনরায় জাগ্রৎ হোক। তার প্রাণ, আত্মা, চক্ষু, কর্ণ, সকলই সুপ্তিতে কর্মসামর্থ্যহীন হয়ে পড়েছিল, যজমানের নিদ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে তারা সকলে জাগ্রৎ হোক।–প্রভাতে, যজমানের নিদ্রাভঙ্গ উপলক্ষে, ঋত্বিক বা পুরোহিত এই মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকেন। ভাষ্যাভাসে এই ভাব পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা মনে করি, সেই যে পূর্ব-মন্ত্রের পুনস্কৃধি পদ দেখেছি, এ মন্ত্রে তা-ই বিশ্লেষিত হয়েছে।–হে ভগবন্! আমার সেই সকল ফিরে আসুক,–এতে কি মনে হয়? মনে হয় না কি, –কি যেন ছিল। এখন যেন হারিয়েছি, আর সেই হারানিধি পাবার জন্য যেন আকুল আকাঙ্ক্ষা এসেছে। যদি বলি–আমার মন ফিরে আসুক–তাকে কি ভাব মনে আসে? মনে হয় না কি, সেই যে সরল অকপট শুদ্ধসত্ত্বভাবান্বিত অন্তর আমি আমার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে প্রাপ্ত হয়েছিলাম, সংসারের কুটিলতার মধ্যে পড়ে সে আজ বক্রগতি প্রাপ্ত হয়েছে, কলুষ লাঞ্ছনে লাঞ্ছিত হয়েছে!– এখানে, প্রার্থী সেই মন ফিরে পাবার কামনা করছেন। ভগবানের সেবাপরায়ণ হতে হলে, ভগবৎকার্যে জীবন বিনিযুক্ত করতে হলে, শিশুর মতো সরলতা আবশ্যক;-কুটিল মন ভগবৎ-সেবার অধিকারী হয়। এখানে তাই সরল অন্তরের প্রার্থনা দেখতে পাই। পঞ্চমবর্ষীয় বালক সেই ধ্রুবের সরলতায় সিংহও স্তম্ভিত হয়েছিল। ভগবৎ-প্রাপ্তির-মূলক সারল্য তেমনই হওয়া চাই। হে ভগবন! আমার মন ফিরে আসুক–এমন প্রার্থনার ভাবই এই যে, আমি যেন সরল বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে ভগবানের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারি।–মন্ত্রে বলা হয়েছে,–আমার আয়ুঃ ফিরে আসুক।আমি কি মারা গিয়েছি? কৈ–আমি তো মরিনি! জলজ্যান্ত জীবন্ত! তবে এমন প্রার্থনা কেন করছি? অতএব, বুঝতে হবে, এখানে সে আয়ুর কামনা নেই। এখানকার প্রার্থনা–আমি যেন এমন আয়ুঃ পাই, যে আয়ুঃ আমায় সঙ্কর্মের পথে নিয়ে যেতে পারে। আহার-মৈথুন-নিদ্রা এই নিয়েই তো জীবন নয়। তেমন জীবন তো পশুতেও ধারণ করে। তেমন আয়ুঃ তো অতি নীচ পাষণ্ডেরও অধিকারে আছে! প্রার্থী কি এখানে ভগবানের কাছে সেই আয়ুঃ প্রার্থনা করছেন? কখনই তা মনে করতে পারি না। সৎকর্মশীল পুণ্যপূত আয়ুর কামনাই এখানে প্রকাশ পেয়েছে। মন্ত্রে আর বলা হয়েছে, আমার প্রাণ ফিরে আসুক, আমার আত্মা ফিরে আসুক। আমাদের প্রাণ থাকতেও যে প্রাণ নেই, আমাদের আত্মা থাকতেও যে আমরা আত্মশূন্য, তা কি আর বোঝাবার প্রয়োজন হয়? কোথায় আমার প্রাণ? আমি অনায়াসে অপরের মুখের গ্রাস কেড়ে নিই, আমি ভাই হয়ে ভাইকে প্রবঞ্চনায় প্রলুব্ধ হই; আমার আবার প্রাণ আছে? প্রাণ ছিল বটে–সেই দিন; শিশুকালে যেদিন পুত্তলিকার প্রতিও মমতার সঞ্চার হতো, ক্ষুদ্র একটি কীটের বিয়োগ ব্যথায় প্রাণ ফেটে যেত। চৈতন্য? সে তো অনেক দিনই অচৈতন্য অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছে। চৈতন্য থাকলে কি আর, নিত্য নূতন অপকর্ম করে, মাথার উপরে যিনি বিদ্যমান থেকে সবই দর্শন করছেন– তাকেও লুকাবার চেষ্টা করতাম? অপকর্ম করি, আর মনকে প্রবোধ দিই,-কেউ দেখতে পেল না। এই কি চৈতন্যের কাজ? চৈতন্য ছিল বটে তখন–যখন পাপের পথে প্রথম অগ্রসর হতে সঙ্কুচিত হয়েছিলাম কিন্তু এখন পাপে এতই অভ্যস্ত যে, পাপকার্যে এখন আর হৃদয় একবারও কম্পিত হয় না। নরবলি প্রদান করতে করতে জল্লাদের প্রাণ এতই কঠিন হয়ে পড়ে যে, শেষে আর নরহত্যার প্রতি তার কোনও বৃত্তিই বিমুখ হতে চায় না। যতই বয়স বাড়ছে, আমরা ততই সেই জল্লাদ-বৃত্তিতে অভ্যস্ত হচ্ছি। এখানে সাধক তা যেন বুঝতে পেরেছেন; তাই কাতর কণ্ঠে ভগবানকে ডেকে বলছেন, হে ভগবন্! আমার সেই হারিয়ে যাওয়া চৈতন্যটুকুকে ফিরিয়ে দাও। মন্ত্রে আর প্রার্থনা আছে, আমার চক্ষুকে আর কর্ণকে আমি যেন পুনঃপ্রাপ্ত হই। কেন? আমার কি চক্ষু নেই? এমন, শ্রোত্রও তো কৈ বধির নয়! নিন্দা সুখ্যাতি কোন্ কথাই বা আমি শুনতে না পাই! তবে আবার শ্রোত্রের প্রার্থনা কেন, চোখেও দেখতে পাই, কানেও শুনতে পাই; তবে আবার কি ফিরে পাবার কামনা করি? –সে এ চোখ–এ কান নয়! এ কি আর চোখ? –এ কি আর কান? যে চক্ষু ভগবানের অনিন্দ্য-মূর্তি দেখতে না পেল, যে শ্রোত্র ভগবানের গুণকথা শুনতে পেল না; পরন্তু যে চক্ষু কেবলই বিষয়-বিভবে আকৃষ্ট রইল, যে কর্ণ কেবলই আত্ম-প্রশংসা ও পরগ্লানি শ্রবণরূপ বিষম-বিষে পূর্ণ রইল; সে চক্ষু কি আর চক্ষু?–সে কর্ণ কি আর কর্ণ নামে বাচ্য? সাধক এখানে ভগবানের নিকট তাই প্রার্থনা করছেন, হে ভগবন্! আমায় সেই চক্ষু দাও–যে চক্ষু কেবল তোমারই রূপ দেখে তন্ময় হয়ে থাকে। আর আমায় সেই কর্ণ দাও–যে কর্ণ কেবল তোমারই কথা-রূপ সুধারসে পরিপূর্ণ থাকে। আমরা যাঁর কাছ থেকে যে কার্য সাধনের জন্য এ সংসারে এসেছি, তার স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে এখন অন্য পথে চলছি। এই মন্ত্র আমাদের সেই পথ পুনঃ প্রদর্শন করছে। এ মন্ত্র প্রতি জনের অনুধ্যানের বিষয়ীভূত। সে অনুধ্যানের দিন কবে আসবে? কবে আমরা নরনারী সমস্বরে বলতে পারব,পুনর্মনঃ পুনরায়ুম…।–কণ্ডিকার দ্বিতীয় মন্ত্রটি সরল প্রার্থনামূলক। একটু বিবেচনা করলেই বোঝা যায়, জ্বলন্ত অগ্নির প্রতি লক্ষ্য নির্দিষ্ট থাকলেও জ্ঞানস্বরূপ ভগবানের কাছেই ঐ প্রার্থনা জানান হয়েছে।

১৬। হে জ্ঞানময় দেব! স্বপ্ৰকাশ আপনি, মনুষ্য পর্যন্ত সকল প্রাণীর সঙ্কর্মের পালক হন; আর সকল যজ্ঞেসকল সৎকর্মানুষ্ঠানে আপনি পূজনীয় হন।(ভাব এই যে, সকল কর্মেই জ্ঞানদেবের প্রভাব বিদ্যমান্ রয়েছে)। [অগ্নে-হে জ্ঞানময়]।(১)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আমায় শ্রেষ্ঠধন প্রদান করো; আর, প্রচুর পরিমাণে সেই ধন-দানে আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করো। পরমধন প্রদাতা দ্যোতমান সবিতৃদেব যে ধন প্রদান করেন, সেই ধনেরই প্রার্থনা করছি। (ভাব এই যে,– আমাদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে শুদ্ধসত্ত্বভাব প্রাপ্ত হই, হে দেব, প্রচুররূপে সেই ধন আমাদের প্রদান করুন)। [সোম—হে শুদ্ধসত্ত্ব; দেবঃ সবিতা-দ্যোতমানঃ জ্ঞানদেবঃ; বসু-যৎ ধনং] (২)।

১৭। হে জ্যোতির্ময় জ্ঞানদেব! আমার এই দেহলক্ষণ বিদ্যমানতাই (শরীরই) আপনার আশ্রয়স্থান; সকলের অনুভূয়মান্ শুদ্ধসত্ত্বই আপনার তেজঃ অর্থাৎ প্রকাশ-রূপ; আমার এই দেহের সাথে একীভূত হোন, (অথবা–একীভূত হয়ে) আপনি শুদ্ধসত্ত্বকে প্রাপ্ত হোন। (প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন্! আপনি জ্ঞান-রূপে হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে, আমার এই হৃদয়স্থিত শুদ্ধসত্ত্বের সাথে মিলিত হোন)। [শুক্র–হে শুক্ল, হে জ্যোর্তিময় জ্ঞানদেব; তঃ–আধাররূপাঃ, আশ্রয়স্থানং শরীরং ইতি ভাবঃ] (১)। হে শুদ্ধসত্ত্বের অঙ্গীভূত ভক্তি! আপনি আমার হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত থেকে, বিশ্বব্যাপী সেই ভগবানের প্রতি প্রীতিযুক্ত হয়ে, আমার শক্তি বর্ধক হোন। (ভাব এই যে, ভগবৎ-প্রীতিসাধিকা ভক্তি আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হয়ে আমার প্রাণশক্তি বর্ধন করুন–এই আকাঙ্ক্ষা]। [মনসা–হৃদি; বিষ্ণবে ব্যাপকায় ভগবতে]।

১৮। পূর্বোক্তগুণান্বিতা সভ্যসহজাতা ভক্তির অনুবর্তী হলে, আমি আমার এই জীবনের দৃঢ়তা প্রাপ্ত হতে পারি। সেই সঙ্কল্পে স্বাহামন্ত্রে হবিঃ অর্পণ করছি–সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে, আমার হৃদয় ভগবৎ-ভক্তিতে পূর্ণ হোক)। [সত্যসবসঃসত্ত্বসহজাতয়াঃ; তন্বঃ শরীরস্য, মদীয়স্য দেহস্য, ইহজীবনস্য]।(১)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি তেজঃস্বরূপ হও, পরমানন্দদায়ক হও, মরণরহিত নিত্য হও, সর্বদেবভাবের প্রাপক হও। (ভাব এই যে, সেই শুদ্ধসত্ত্ব আমাতে জাগরিত হোক)। [শুক্রং–তেজঃস্বরূপং; চন্দ্রং–আহ্লাদকং, পরমানন্দদায়কং; বৈশ্বদেবং–সর্বদেব সম্বন্ধিনং, সর্বদেবভাবপ্রাপকং] (২)।

১৯। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনি চিৎস্বরূপা চৈতন্যরূপা চিন্ময়ী অথবা অচেতনে চেতনা-সম্পাদয়িত্রী হন; আপনি মনঃস্বরূপা সর্বজ্ঞা অথবা সঙ্কল্পবিকল্পবিরহিতা নির্বিকল্পরূপা হন; আপনি নিশ্চয়রূপাত্মিকা প্রজ্ঞাস্বরূপা হন; আপনি সঙ্কর্মসমূহের পূর্ণতসাধনকত্রী অথবা অভীষ্টপূরণকত্রী হন; আপনি অমিততেজা অজেয় হন; আপনি যজ্ঞস্বরূপা অথবা সকলের বন্দনীয়া ও নিখিলপ্রাণিগণের হৃদয়ে ধারণযোগ্যা হন; আপনি আদ্যন্তরহিতা অনন্তরূপা হন; (অতএব) আপনি আদ্যন্ত সর্বত্র সর্বতোভাবে শ্রেষ্ঠা অথবা সকলের বরণীয় হন। (এই মন্ত্রাংশে দেবী ভগবতীর স্বরূপ ব্যক্ত হয়েছে। ভাব এই যে, হে দেবি! আপনি সর্বাত্মিকা সৎ-চিৎ-আনন্দরূপা ষড়েশ্বর্যশালিনী। অতএব, আপনি সকলেরই বরণীয়া পূজ্যা। বিশ্বের সকল লোকই আপনাকে কামনা করে। আমরাও আপনার করুণা প্রার্থনা করছি। কৃপা করে, আপনি আমাদের নিকট আপনার মহিমা ব্যক্ত করুন এবং আমাদের আপনার সাথে যুক্ত করুন)। [চিৎ–চিৎস্বরূপিণী, চৈতন্যরূপা চিন্ময়ী বা, যদ্বা– অচেতনস্য চৈতন্যসম্পাদয়িত্ৰী; দক্ষিণা সৎকর্মণঃ পূর্ণতাসাধনকত্রী অভীষ্টপূরয়িত্রী বা; ক্ষত্রিয়া অমিততেজা, অজেয়া ইত্যর্থ; যজ্ঞিয়া-যজ্ঞস্বরূপা, সৎকর্মরূপা, যদ্বাসবৈবন্দনীয়া, নিখিলপ্রাণিজাতস্য হৃদি ধারণাহা; অদিতি–আদ্যন্তরহিতা অনন্তরূপা চ; উভয়তঃ–আদ্যন্তয়োঃ, সর্বত ইতি ভাবঃ; শী–শ্রেষ্ঠাঃ; সবৈর্বরনীয়া ইত্যর্থঃ] (১)। হে দেবি! পূর্বোক্তগুণেপেতা আপনি, আমাদের পরিত্রাণের জন্য সুষ্ঠুভাবে আমাদের অভিমুখী অর্থাৎ আমাদের সহজপ্রাপ্য হোন; অথবা, প্রথমতঃ আমাদের সত্ত্বসমন্বিত করুন, পশ্চাৎ আমাদের সম্যক্ রকমে আপনার অভিমুখী করুন; অথবা, আমাদের শুদ্ধসত্ত্ব নিয়ে আমাদের হৃদয়ে আপনি প্রতিষ্ঠিত হোন। প্রজ্ঞানরূপী সেই মিত্রদেব, আপনাকে শ্রেষ্ঠপ্রদেশে বন্ধন করুন অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করুন। সর্বদর্শী সৎকর্মস্বামী ভগবানের প্রীতির জন্য সৎ-ভাবের পোষক সবরক্ষক পূষা দেবতা (আমাদের) অসৎমার্গ হতে রক্ষা করুন। (মন্ত্রের এই অংশের ভাব এই যে,—হে দেবি। আপনি আমাদের সত্ত্ব-সমন্বিত করুন, আর সেই সত্ত্বভাব-সহযুত হয়ে আপনি আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হোন। যেন অকিঞ্চন আমরা ভগবৎপ্রীতি সাধনসমর্থ হই এবং মোক্ষ লাভ করি)। [সা–পূর্বোক্ত গুণোপেতা; সুপ্রতীচী—প্রকৃষ্টরূপেণ অস্মান তদভিমুখিনঃ কৃত্বা, যদ্বা–শুদ্ধসত্ত্বং গৃহীত্ব অস্মাকং হৃদি ইতি যাবৎ; মিত্র–অস্মাকং প্রজ্ঞানরূপী মিত্রদেবঃ; ইন্দ্রায়–ভগবদর্থং যদ্বা–ভগবৎপ্রতিনিমিত্তং পূষা সম্ভাবপোষকো দেবঃ, যদ্বা সর্বস্য রক্ষকো দেবঃ] (২)।

২০। ভক্তিরূপিণি হে দেবি! সন্তাননের মঙ্গল-অভিলাষিণী সকল জননীই আপনাকে অনুস্মরণ করুন; (অর্থাৎ ইহজগতে সকল জননীই ভগবৎ-ভক্তিপরায়ণা হোন); সেইরকম, সন্তানহিতকামী সকল জনকই আপনাকে অনুস্মরণ করুন; (অর্থাৎ, সংসারের সকল পিতাই ভগবৎ ভক্তি-পরায়ণ হোন); এইরকম সমান গৰ্ভস্যুত অর্থাৎ মনুষ্য পর্যায়ভুক্ত সকল ভ্রাতাই আপনাকে অনুসরণ করুন (অর্থাৎ, ভগবৎ ভক্তি সমন্বিত হোন) এইরকম স্বদলভুক্ত সকল মিত্রজন আপনাকে অনুসরণ করুন; (অর্থাৎ, সকল মনুষ্যই ভগবৎ-ভক্তিপরায়ণ হোন)।(১)। হে দ্যোতনাত্মনে! অশেষহিতসাধিকা সেই আপনি, আমাদের দেবভাব প্রদান করুন; আর, ভগবান্ ইন্দ্রদেবের জন্য আমাদের শুদ্ধসত্ত্বকে বহন করে নিন; রুদ্রভাবাপন্ন দেব (অর্থাৎ দেবতার কঠোর ভাব) আপনাতে অবস্থিত হোন, অর্থাৎ আপনাকে পেয়ে আমাদের প্রতি রোষ-প্রকাশে প্রতিনিবৃত্ত হোন; আর, শুদ্ধসত্ত্বভাবের সহযুতা হয়ে আপনি আমাদের ৬ হৃদয়ে চিরবিদ্যমান থাকুন। (মন্ত্রের তাৎপর্য এই যে, সংসারের সকলেই ভগবৎ-ভক্তিপরায়ণ হোক; ভগবানে ভক্তিই মানুষকে পরমপদ প্রদান করে)। [সা–অশেষোপকারসাধিকা; ইন্দ্রায়–ভগবতে ইন্দ্রদেবায়; সোমং–অস্মাকং শুদ্ধসত্ত্বং; রুদ্রঃ-রুদ্রভাবাপন্না দেবঃ, দেবস্য কঠোরো ভাবঃ; সোমসখা–সত্ত্বভাবসহযুতা সতী]।(২)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র দুটিও পূর্বের কণ্ডিকার মতোই সেই ভক্তিরূপিণী দেবীর সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে]।

২১। হে ভক্তিরূপিণি, দেবি! আপনি বসুরূপা অর্থাৎ পৃথ্বীরূপা হন, আপনি অনন্তরূপা অর্থাৎ অশেষরূপধারণী হন, আপনি অনন্তের অংশীভূতা (আদিত্যা) অর্থাৎ দেবস্বরূপা হন, আপনি রুদ্ররূপা অর্থাৎ কঠোরতাময়ী হন, আপনি চন্দ্ররূপা অর্থাৎ হ্লাদিনী কোমলতাময়ী হন। (এই মন্ত্রাংশ, ভক্তিরূপে অবস্থিত দেবীর স্বরূপ পরিকীর্তন করছে। সেই দেবীই পৃথ্বীরূপে বিরাজিতা, সেই দেবীই সমষ্টিভূতা, সেই দেবীই অংশরূপা, সেই দেবীই সংহারমূর্তিধারিণী, সেই দেবীই আনন্দরূপিণী। কোমল-কঠোর সকল ভাব এবং ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল রূপ সেই দেবীতেই যুগপৎ বিদ্যমান আছে]। [অদিতি–অনন্তরূপা, অশেষরূপধারিণী] (১)। জ্ঞানী (জ্ঞানদেব) সংসারের সুখের জন্য আপনাকে সংযমন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রিত করুন; (ভাব এই যে,–জ্ঞানিগণের সহায়তায় আপনার প্রসাদে ইহলোক পরমানন্দ লাভ করুক) কঠোরভাবে (রুদ্রদেব) সর্বংসহা ধরিত্রীর সাথে আপনাকে রক্ষা করবার কামনা করুন; অর্থাৎ আপনার প্রভাবে সৃষ্টি সংহারমূর্তি-রুদ্ররোষ হতে রক্ষা-প্রাপ্ত হোক। (তাৎপর্যার্থে,ভগবৎ-ভক্তি সকল সুখের মূলীভূতা। তার কৃপাতেই মানুষ রক্ষা প্রাপ্ত হয়)। [বৃহস্পতি–জ্ঞানী, যদ্বা–জ্ঞানদেবঃ; বসুভিঃ–সর্বংসহাভিঃ ধরিত্রীভিঃ সহ, যদ্বা–অপবৈঃ পার্থিবৈদেধৈঃ সহ] (২)

২২। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! অখণ্ডিতা পৃথিবীর (অর্থাৎ বিশ্বের) শীর্ষস্থানে দেব-যজন-প্রদেশে অবস্থিতা আপনাকে অনুক্রমে আমি আমার প্রতি ক্ষরণ প্রবহন বা আকর্ষণ করছি। (মন্ত্রাংশ সঙ্কল্পমূলক আত্ম-উদ্বোধক)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি ভগবৎসম্বন্ধযুত কর্মের অবলম্বন হও। অথবা–হে আমার কর্ম। তুমি ভক্তিযুতা স্তুতির আশ্রয় হও; (ভাব এই যে, আমার কর্ম ভগবৎ ভক্তিযুত হোক)। ভক্তিসহযুত করে, হে আমার কর্ম, স্বাহা-মন্ত্রে তোমাকে আমি ভগবানে সমর্পণ করছি। [অদিত্যাঃ–অখণ্ডিতায়াঃ; ত্বং ইড়ায়াঃ–ভগবৎ সম্বন্ধযুতস্য কর্মণঃ; ত্বং ইড়ায়াঃ ভক্তিযুতায়াঃ ঔত্যাঃ] (১)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আমাদের মধ্যে তুমি ক্রীড়া করো; অর্থাৎ, আনন্দরূপে আমাদের সাথে চিরসম্বন্ধযুত থাকো।(২)। হে ভক্তরূপিণি দেবি! তোমার মিত্রস্বরূপ সেই ভগবান্ আমাদের মধ্যে ক্রীড়াপর হোন, (অর্থাৎ তোমার সাথে আমাদের মধ্যে এসে বিরাজমান্ থাকুন)। [বন্ধু–নিত্যস্বরূপঃ স ভগবান] (৩)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনাতে প্রমার্থ ধন সমূহ আছে. [রায়ঃ–পরমার্থরূপাণি ধনানি]।(৪)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! সেই ধনসমূহ আমাকে (আমাদের) দান করুন এই প্রার্থনা।(৫)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! অর্চনাকারী আমরা সেই ধনের সঞ্চয়ে অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয়ে যেন বিযুক্ত না হই; (অর্থাৎ আমাদের পরমার্থরূপ ধন-সঞ্চয়ে যেন কোনও বিঘ্ন না ঘটে, তা-ই করুন) (৬)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনাতে পরমার্থরূপ যে ধনসমূহ আছে, সেই ধন পাবার জন্য আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি। [তোতঃত্বয়ি]।(৭)।

২৩। হে ভক্তিরূপিনি দেবি! সম্যক্ শুভফলপ্রদায়িণি অতীত ও অনাগত কর্মফলের দর্শনকারিণী, দ্যোতনাত্মিকা প্রজ্ঞার সাথে আপনি আমার দর্শনীয়া হোন। (তাৎপর্য এই যে, আমাতে জ্ঞান-ভক্তির সম্মিলন হোক–এটাই আকাঙ্ক্ষা)। [সন্দক্ষিণয়া–সম্যশুভফলপ্রদায়িণ্যা; ঊরুচক্ষসা–বিস্তীর্ণদর্শনয়া, অতীতানাগতস্য কর্মফলস্য দর্শনকারিণ্যা; দেব্যা দ্যোতনাত্মিকয়] (১)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আমার জীবনকে কখনও খণ্ডিত (অর্থাৎ আপনার সম্বন্ধ ৬ হতে বিচ্ছিন্ন) করবেন না। প্রার্থনাকারী আমি যেন কখনও আপনার সম্বন্ধচ্যুত না হই। (তাৎপর্য এই যে,–ভগবৎ-ভক্তি আমার সাথে চিরসম্বন্ধযুতা হোন–এটাই আকাঙ্ক্ষা।(২)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! আপনার সদর্শন পেয়ে যেন সকর্ম-সাধনের সামর্থ্য লাভ করতে পারি। (ভাব এই যে–আপনার প্রসাদে ও সহচারিত্বে সৎকর্মের সাধনে সামর্থ্য পাবার কামনা করছি)।(৩)।

২৪। ভক্তিরূপিণি দেবি! আমার উচ্চারিত এই গায়ত্রীছন্দোবদ্ধ মন্ত্র, আপনার অংশ বা অঙ্গীভূত হোক;–এই উপদেশ শুদ্ধসত্ত্বসঞ্চয়ের জন্য আমার বিবেক আমায় বলে থাকেন। (ভাব এই যে, গায়ত্রীছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্র যখন ভক্তিসহযুত হয়, তখনই তা সুফল প্রদান করে;–এই তত্ত্ব বিবেকের সাহায্যে আমরা অবগত হই)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি। আমার উচ্চারিত এই ত্রিষ্টছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্র, আপনার অংশ বা অঙ্গীভূত হোক; এই উপদেশ শুদ্ধসত্ত্ব-সঞ্চয়ের জন্য আমার বিবেক আমায় বলে থাকেন। (ভাব এই যে, ত্রিষ্টুভছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্র যখন ভক্তিসহযুত হয়, তখনই তা সুফল প্রদান করে; এই তত্ত্ব বিবেকের সাহায্যে আমরা অবগত হই)। হে ভক্তিরূপিনি দেবি! আমার উচ্চারিত জগতীছন্দোবিশিষ্ট এই মন্ত্র, আপনার অংশ বা অঙ্গীভূত হোক; –এই উপদেশ, শুদ্ধসত্ত্বসঞ্চয়ের জন্য আমার বিবেক আমায় বলে থাকেন। (ভাব এই যে, –জগতীছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্র যখন ভক্তিসহযুত হয়, তখনই তা সুফল প্রদান করে;–এই তত্ত্ব বিবেকের সাহায্যে আমরা অবগত হই)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি। আপনি উষ্ণিক ইত্যাদি অন্যান্য ছন্দোবিশিষ্ট মন্ত্রসমূহের আধিপত্য প্রাপ্ত হোন; আপনার এইরকম আধিপত্যরূপ কার্য, শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয়ের সহায় হয়; –আমার বিবেক এমন বলে থাকেন। (ভাব এই যে, মন্ত্রসমূহের সহচারিণী দেবী-ভক্তির দ্বারা আমরা পরম মঙ্গল লাভ করি)। [সোমায়–শুদ্ধসত্ত্বসঞ্চয়ায়]।(১)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি আমাদের মধ্যেই সঞ্জাত হন।(ভাব এই যে, আমাদের কর্মের দ্বারাই আমাদের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্বভাব সঞ্জাত হয়ে থাকে)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! অনাবিল জ্যোতিঃ (সত্যই) আপনার আধার। (ভাব এই যে–তেজের অথবা সত্যের সাথেই শুদ্ধসত্ত্বের অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! বিবেকী জনগণ সারাসার বিচারপূর্বক আপনাকে গ্রহণ করুন। (ভাব এই যে,–বিবেকসম্পন্ন সাধুবর্গ জনহিতের জন্য সংসারের সারস্বরূপ আপনাকে সংসারে প্রকাশ করেন)। [শুক্র–শুভ্রঃ; অনাবিলঃ, তেজ, জোতি, সত্য ইতি ভাবঃ; হ্যঃ–আধারঃ; বিচিতঃ বিবেকেন চয়নস্য কর্তারঃ, বিবেকিননা জনাঃ; বিচিন্বন্তু–সারাসারবিবেকং কৃত্বা গৃহ্বান্তু] (২)। [কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রের চারটি অংশে ভক্তিরূপিনী দেরীকে এবং দ্বিতীয় মন্ত্রের তিনটি অংশে শুদ্ধসত্ত্বকে সম্বোধনে প্রযুক্ত হয়েছে]।

২৫। দ্যাবা পৃথিবীর অভ্যন্তরে বর্তমান অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী, মেধাবী অথবা অশেষ প্রজ্ঞাসম্পন্ন, সত্যস্বরূপ অথবা অর্চনাকারিবর্গকে সৎপথে নয়নকর্তা, সৎকর্মের ফল-রূপ রত্নধারণকারী অথবা মোক্ষফল-রূপ শ্রেষ্ঠরত্নের ধারক বা পোষক, সকলের প্রীতির সামগ্রী অথবা সকলের প্রতি প্রীতিসম্পন্ন–নিখিলবিশ্বের প্রতিস্থানীয়, মননযোগ্য অথবা অর্চনাকারিবর্গের সুমতিবিধায়ক, ক্রান্তদর্শী (সর্বদর্শী) সেই প্রসিদ্ধ সবিতৃদেবকে (জ্ঞানপ্রেরক দেবতাকে) প্রকৃষ্টরূপে অৰ্চনা করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি। (এই মন্ত্রাংশ সঙ্কল্পমূলক এবং আত্ম-উদ্বোধনসূচক)।[ঔণ্যোঃ–দ্যাবাপৃথিব্যোরভ্যন্তরে সর্বত্র বর্তমানং, যদ্বা বিশ্বব্যাপকং; সত্যসবং–সত্যস্বরূপং যদ্বা–অর্চনাকারিণাং সৎপথি নয়নকর্তারং]।(১)। যে সবিতৃদেবের (জ্ঞানদেবতার) অপরিমেয় অর্থাৎ সর্বপ্রকাশশীল দীপ্তি বা জ্ঞানকিরণ, নিখিল সভাবের বিধানের জন্য (নিখিল সৎ-ভাবের জননের জন্য) গগন অভিমুখী অর্থাৎ সাধকদের উচ্চহৃদয়াভিমুখী হয়ে সকল বস্তুকে দীপ্তিশালী করে অর্থাৎইহজগতে সত্ত্বভাব ইত্যাদি উৎপন্ন করে; জ্ঞানপ্রদ অর্থাৎ হিরণের মতো জ্ঞানধনপ্রদানে মুক্তহস্ত, শোভনকুতুসম্পন্ন অথবা সৎকর্ম মণ্ডিত, সেই সবিতৃদেব, লোকসমূহের হিতসাধনে অসীম শক্তিসম্পন্ন হন, অর্থাৎ কল্পনায়ও তার শক্তির শেষ জানা যায় না। এই মন্ত্রাংশে ভগবানের গুণ তার স্বরূপ পরিব্যক্ত হয়েছে)। [ভাঃদীপ্তিঃ–জ্ঞানকিরণ ইত্যর্থঃ; সবীমনি–নিখিলসৎকর্মবিধায়িতুং, যদ্বা–নিখিল সদ্ভাবজননার্থং, হিরণ্যপাণিঃ–জ্ঞানপ্রদঃ, যদ্বা হিরণ্যবজ্ঞানধনপ্রদানে মুক্তহস্তঃ] (২)। হে দেব! নিখিল জনগণের শ্রেয়ঃ সাধনের জন্য আপনাকে অর্চনা অর্থাৎ পূজা করছি। [প্রজাভ্যঃ–নিখিলজনানাং শ্রেয়সাধনায়]।(৩)। হে দেব! সকল প্রজা (অর্থাৎ বিশ্ববাসী সকলে) আপনাকে জীবিত অর্থাৎ হৃদয়ে উদ্দীপিত করুক। (ভাব এই যে, বিশ্বের সকলে যাতে আপনাকে হৃদয়ে ধারণে উদ্বুদ্ধ হয়, আপনি তা করুন)। [প্রজাঃ–সর্বাঃ লোকা, বিশ্ববাসিনঃ সর্বে জনাঃ] (৪)। হে দেব! বিশ্ববাসী সকলকে আপনি অনুপ্রাণিত করুন অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বাদানে জীবনদান করুন। (এই মন্ত্রাংশও প্রার্থনামূলক। প্রাণীগণের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবান্ জ্ঞানকিরণের দ্বারা তাদের শুদ্ধসত্ত্বসমন্বিত সৎ-মার্গগামী করুন, অপিচ তাদের মৃত্যুতুল্য অজ্ঞান-আবরণ অপসারিত করুন–এটাই প্রার্থনা)।(৫)।

২৬। হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ দেব! তেজঃস্বরূপ জ্যোতির্ময় অথবা সৎস্বরূপ আপনাকে তেজের বা জ্ঞানের সাহায্যে অথবা শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে ক্রয় করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি; পরমানন্দদায়ক বা কমনীয় আপনাকে, কমনীয় শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা অথবা পরমানন্দদায়ক ভক্তির প্রভাবে ক্রয় করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি; অপিচ, অক্ষর ক্ষয়রহিত আপনাকে ক্ষয়রহিত সৎকর্মের প্রভাবে ক্রয় করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি। (এ মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক আত্ম-উদ্বোধনসূচক। ভাব এই যে, অক্ষর অব্যয় সেই ভগবানকে জ্ঞানভক্তিবিমিশ্র শুদ্ধসত্ত্বের বা সঙ্কর্মের দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায়। অতএব, তাঁর অনুগ্রহলাভ করতে হলে শুদ্ধসত্ত্বসঞ্চয় এবং সৎকর্মের অনুষ্ঠান একান্ত কর্তব্য)। [শুক্রং তেজস্বরূপং, জ্যোতির্ময়ং, সৎস্বরূপং বা শুক্রেণ-তেজসা, জ্ঞানেন, যদ্বা–শুদ্ধসত্ত্বেন, সত্যেন বা; চন্দ্রং–আহ্লাদকং, পরমানন্দদায়কং, কমনীয়ং বা, চন্দ্রেণকমনীয়েন, শুদ্ধসত্ত্বেন, যদ্বা– পরমানন্দদায়কেন ভক্তিপ্রভাবেণ; অমৃতং–অক্ষরং, ক্ষয়রহিতং; অমৃতেণ–ক্ষয়রহিতেন সৎকর্মপ্রভাবেণ]](১)। হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ দেব! আপনার সম্বন্ধি যে জ্ঞান, তা আমাতে অবস্থিত হোক। (ভাব এই যে, হে দেব! আপনি প্রজ্ঞনাধার। কৃপা করে আপনার অনন্ত প্রজ্ঞানের কর্ণামাত্রও আমাদের প্রদান করুন)। [গোঃ–গৌঃ, যজ্ঞানং; সম্মে–উপাসকে, প্রার্থনাকারিণে, ময়ি ইতি ভাবঃ] ।(২)। হে শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ দেব! আপনার সম্বন্ধি পরমানন্দদায়ক সৎ-ভাবসমূহ আমাদের মধ্যে অবস্থিত করুক। (ভাব এই যে,হে দেব! আপনি সৎ-ভাবের আধার। আপনাতে যে সকল সৎ-ভাব বিদ্যমান আছে, তাদের কিছুটা আমাদের প্রদান করুনঃ। [চন্দ্রাণি–পরমানন্দ-দায়কানি সদ্ভাবাদীনি](৩) হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনি সৎকর্মের অথবা সৎকর্মপরায়ণ জনের আধাররূপে অথবা শরীরবৎ অঙ্গী অর্থাৎ প্রধানস্থানীয় হন; (ভাব এই যে, তপঃ প্রভাবে সৎকর্মের দ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব উপজিত হয়)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবানের : আধাররূপ অথবা শরীরবৎ অঙ্গীভূত হও। (ভাব এই যে, ভগবান্ শুদ্ধসত্ত্বে চিরাবস্থিত)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের প্রভাবে (অর্থাৎ বহু আয়াসে) অধিগত হও; অতএব, তোমার প্রসাদে আমি সংসারের লোক-সকলের পালনকার্যে পরিপুষ্ট অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ লোকপালক হব। (ভাব এই যে,–শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের দ্বারাই শুদ্ধসত্ত্ব অধিগত হয়। তার দ্বারা যাতে বিশ্ববাসিগণের পরিপুষ্টি সাধিত হয়, আমি তাই করব; অর্থাৎ জনহিতসাধনই যেন আমার জীবনের একমাত্র ব্রত হয়)। [তপসঃ–সৎকর্মণঃ, যদ্বা– সৎকর্মপরায়ণস্য জনস্য; প্রজাপতেঃ–ভগবতঃ; বর্ণঃ–আধাররূপঃ, অঙ্গীভূত; পরমেণ-উত্তমেন, শ্রেষ্ঠেন; পশুনা-দর্শনেন, জ্ঞানেন ইত্যর্থঃ; সহস্রপোষং–সর্বেষাং পালনকাযৈঃ; পুষেয়ং–পুষ্টো ৬ ভূয়াসং] (৪)। [এই কণ্ডিকার চারটি মন্ত্রের প্রথম তিনটি শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ ভগবানের সম্বন্ধমূলক; চতুর্থ মন্ত্রটি শুদ্ধসত্ত্ব-সম্বোধনে প্রযুক্ত]।

২৭। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবন্। আপনি সুমিত্র অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ সুহৃৎ হন। মিত্রভূত সহায়ক-রূপে আপনি আগমন করুন; অথবা, জ্ঞানজ্যোতিরূপ আপনি আমাদের প্রতি অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে আগমন করুন, অর্থাৎ জ্ঞানজ্যোতির দ্বারা আমাদের হৃদয় আলোকিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনা–আমাতে শুদ্ধসত্ত্ব অবিচলিত থাকুক)। [সুমিত্রধঃ–শোভনমিত্রঃ, শ্রেষ্ঠঃ সুহৃৎ ভবদীতি যাবৎ; মিত্রো ন–মিত্রভূতঃ সহায়ক ইব; অথবা মিত্রঃ মিত্রভূতঃ, জ্ঞানজ্যোতিরূপস্তং; নঃ–অস্মন্ প্রতি ইতি যাবৎ, যদ্বা,–অস্মাকং হৃদি ইতি ভাবঃ] ১)। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! ভগবানের কামনা-পরায়ণ, সুখহেতুভূত অর্থাৎ পরমসুখনিদান তুমি, ভগবানের অঙ্গীভূত সুখস্বরূপ পরমানন্দপ্রদ বিশ্বের আধারস্বরূপ অনন্তত্বে প্রবেশ করো অর্থাৎ অনন্ত সত্ত্বের সমুদ্রে মিশে যাও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। মন্ত্রে প্রার্থনাকারীর আত্মসম্মিলনের কামনা সূচিত হচ্ছে। ভাব এই যে, আমাতে শুদ্ধসত্ত্বের ভগবানের সম্মিলন ঘটুক)। [ইস্য-ভগবতঃ–অঙ্গীভূতস্য ইতি ভারঃ; দক্ষিণং বিশ্বসাধাররূপং; ঊরুং–অনন্তং সত্ত্বসমুদ্রং]।(২)। হে নাদরূপ! হে দীপ্তিম স্বপ্রকাশ! হে। পাপহারক! হে বিশ্বপালক! হে সদানন্দরূপ! হে সকলের পোষক! হে সকলের জীবন অথবা আত্ম উৎকর্ষসম্পন্ন জনের প্রাণস্বরূপ! হে আপনারা সপ্তদেবগণ! আপনারা সম্মুখে বর্তমান অর্থাৎ আমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত, সোমক্রয়ের জন্য আনীত অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের ধারণে উদ্বোধিত, সঙ্কর্মের সামর্থ্যকে বা সৎ-ভাব ইত্যাদিকে পোষণ করুন (রক্ষা করুন); অপিচ, আপনারা আমাদের হিংসা করবেন না অর্থাৎ আমাদের সৎসম্বন্ধচ্যুত করবেন না, অথবা আমাদের পরিত্যাগ করে যাবেন না। অথবা, শত্রুগণ যেন, আপনাদের হিংসা না করে; অর্থাৎ হে দেবগণ! আপনারা এমন করুন, যেন আমাদের হৃদয়ের অন্তঃশত্রুগণ (কামক্রোধ ইত্যাদি) আমাদের হৃদয় থেকে আপনাকে অপসারিত করতে সমর্থ না হয়। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনা–হে দেবগণ! আপনারা এমন করুন, যেন আমাতে সক্কর্মের সামর্থ্য সকল এবং সৎ-ভাবসমূহ অবিচলিত থাকে; তাতেই আমি ভগবানকে প্রাপ্ত হবো)। [স্বান-হে নাদরূপ; অঙারে-হে পাপহারক; বম্ভারে–হে বিশ্বপালক; হস্ত–হে সদানন্দরূপ; সুহস্ত–হে সর্বস্য পোষক ধারক বা; সোমব্রুয়ণাঃ–সোমং ক্রেমানীতাঃ, যদ্বা শুদ্ধসত্ত্বং ধারয়িমুদ্বোধিতাঃ] (৩)।[এই কণ্ডিকার তিনটি মন্ত্রে দুরকমের সম্বোধন দেখা যায়। প্রথম মন্ত্রে শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানকে এবং দ্বিতীয় মন্ত্রে হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বকে এবং তৃতীয় মন্ত্রে সপ্ত দেবতাকে সম্বোধন করা হয়েছে। কণ্ডিকার প্রথম ও তৃতীয় মন্ত্র প্রার্থনামূলক এবং দ্বিতীয় মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনা সূচিত করছে]।

২৮। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবন্! অসৎ কর্ম হতে অর্থাৎ পাপ (পাপাঁচরণ) হতে আমাকে পরিত্রাণ করুন; (ভাব এই যে,–পাপপ্রবৃত্তি যেন আমাকে অভিভূত করতে না পারে)। অপিচ, অর্চনাকারী আমাকে, শোভন চরিত্রে অর্থাৎ সদাচার-রূপ (সৎকর্মরূপ) পুণ্যে সংস্থাপিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনা-মূলক। প্রার্থনার ভাব–হে ভগবন্! এমন করুন, যেন আমি সদাচারসম্পন্ন সৎকর্মপরায়ণ হই। অপিচ, পাপ যেন আমাকে স্পর্শ করতে না পারে)। [অগ্নে-হে প্রজ্ঞানরূপিন্ ভগব; দুশ্চরিতাৎ–অসৎকর্মণঃ, পাপাৎ পাপাঁচরণাদ্বা; সুচরিতে– শোভনে চরিত্রে, সদাচাররূপে পুণ্যে ইত্যর্থঃ] (১)। অক্ষয়-জীবন-লাভের জন্য. আমি উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। অপিচ, সৎকর্ম সাধন ইত্যাদির দ্বারা শোভনজীবন ধারণের জন্য অক্ষয়শুদ্ধসত্ত্বের অনুসরণে (অর্থাৎ তাদের হৃদয়ে ধারণের জন্য) আমি প্রবুদ্ধ হলাম। [মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক ও সঙ্কল্পসূচক। ভাব এই যে, হে দেব! আত্ম-উৎকর্ষ-সাধনে ভগবানের প্রাপ্তির জন্য যেন আমি উদ্বুদ্ধ হই]। [উৎ– ৬ উত্তিষ্ঠামি, উদ্বো ভবামি; আয়ুষা–সকর্মসাধনাদিনা শোভনজীবনধারণায়; অণু–উদ্দিশ্য, অনুসৃত্য, যদ্বা–তা হৃদি ধারণায়] (২)।

২৯। যে প্রসিদ্ধ পথে গমন করলে নিখিল শত্রুদের অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি পাপসম্বন্ধসমূহকে সর্বতোভাবে বর্জন করা যায়; হে শুদ্ধসত্ত্ব! আপনার প্রসাদে সেই মুখে গমন-যোগ্য অর্থাৎ সৎসম্বন্ধ মণ্ডিত ও পাপ-সম্বন্ধরহিত (অথবা যে পথে গমন করলে, গমনকারীকে কোনও অপরাধ স্পর্শ করতে পারে না) সেই পথকে আমরা প্রাপ্ত হবো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক এবং আত্ম উদ্বোধনসূচক। ভাব এই যে,–শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সকর্ম ইত্যাদির দ্বারা ভগবানকে পাওয়া যায়। অতএব, সকর্মের দ্বারা সৎপথ আশ্রয় করে আমরা ভগবৎ-অভিমুখী হবো)। [যেন–প্রসিদ্ধেন, যস্মিন পথি গমনেনেত্যর্থঃ স্বস্তিগাং–স্বক্তিনা ক্ষেমেণ সুখেন বা গন্তুং যোগং, যদ্বা সৎ সম্বন্ধসমন্বিতং] (১)

৩০। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি অনন্তস্বরূপ ভগবানের শরীররূপ বা অঙ্গীভূত হও। (ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বই ভগবানের স্বরূপ; শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। [অদিত্যাঃ অনন্তস্বরূপস্য ভগবতঃ; ত্ব–শরীররূপঃ, অঙ্গীভূতঃ ইত্যৰ্থঃ] (১)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎসম্বন্ধি স্থানকে অথবা নির্মল হৃদয়কে সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হও, অথবা সেখানে উপবেশন করো। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমরা ভগবানকে হৃদয়ে ধারণ বা প্রতিষ্ঠিত করি)। [অদিত্যৈ সং-ভগবৎসম্বন্ধিনং স্থানং, নির্মলং হৃদয়ং]।(২)। অভীষ্টবর্ষণকারী অথবা সকলের বরণীয় সেই ভগবান্ দ্যুলোককে এবং অন্তরিক্ষলোককে (ব্যোমকে, অর্থাৎ সর্বলোককে) স্তম্ভিত করেন, অথবা ব্যেপে আছেন। অপিচ, পৃথিবীতে সেই ভগবানের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহিমা অপরিমেয়। (ভাব এই যে, ভগবান্ আপন প্রভাবের দ্বারা সর্বলোককে ধারণ করে আছেন। কিন্তু তার মহিমার সীমা কেউই অবগত নন। প্রার্থনা–সেই ভগবান্ আমার হৃদয় অধিকার করুন)। [বৃষভঃ–অভীষ্টবর্ষকঃ, যদ্বা– সর্বৈবরণীয়ঃ; দ্যাং–দ্যুলোকং, স্বলোকং; অন্তরিক্ষং-ব্যোমং, সর্বলোকং ইতি ভাবঃ]।(৩)। সম্যক রূপে রাজমা অথবা সকলের স্বামী সেই ভগবান, নিখিল বিশ্বভুবন ব্যেপে আছেন। বিশ্বের সকলেই সেই সর্বশক্তিমান্ অথবা করুণাপরায়ণ সেই ভগবানের কার্য অর্থাৎ মহিমা ঘোষণা করে। (ভাব এই যে,–বিশ্বব্যাপকতাই ভগবানের কর্ম বা ধর্ম। সেই ভগবান্ আমার হৃদয় ব্যেপে অবস্থিতি করুন)। [সম্রাট–সম্যগ্রাজমানঃ, যদ্বা–সর্বেষাং স্বামী স ভগবান; বরুণস্য–তস্য সর্বশক্তিমতঃ করুণাপরস্য বা ভগবতঃ] (৪)।

৩১। যে ভগবান্ বণানীর অগ্রভাগে অন্তরিক্ষকে, পুরুষগণের মধ্যে বীর্যকে এবং গাভীগণের মধ্যে দুগ্ধকে বিস্তারিত করে রেখেছেন; সেই করুণাধারই অন্তরের মধ্যে সকর্ম সাধনসঙ্কল্পকে, লোকসমূহের মধ্যে জ্ঞানাগ্নিকে, স্বর্গলোকপ্রাপ্ত সাধুগণের হৃদ্‌য়ে জ্ঞানসূর্যকে বা পূর্ণজ্ঞানকে এবং পাষাণের ন্যায় কঠোর আমাদের এই হৃদয়ের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বকে স্থাপন করেছেন। (ভাব এই যে, সকল বস্তুরই শ্রেষ্ঠ বা সার অংশ ভগবানের করুণা-সাপেক্ষ)। [বণেষু–বলীনাং অগ্রভাগে, বৃক্ষাগ্ৰেষু, অন্তরিক্ষং–আকাশং; অবৎসু–পুরুষেযু; বাজং বীর্যং; উস্ৰিয়াসু গোষু; পয়ঃ–দুগ্ধং, ক্ষীরং; বি-ততান–বিস্তারিতবান্, স বরুণঃ–স করুণাধারঃ এব; হৃৎসু– অন্তরেষু; তুংসকর্ম, সৎকর্মসাধনসঙ্কল্পং; বিক্ষু–লোকে; অগ্নিং–জ্ঞানাগ্নিং; সূর্য জ্ঞানসূর্যং পূর্ণজ্ঞানং; তথা অদ্রৌ–অস্মাকং পাষাণবৎ কঠোর হৃদয়য়েষু; সোমং–শুদ্ধসত্ত্বং] (১ ২)। অথবা–যে করুণাধার ভগবান্ অরণ্যের মতো হৃদয়ের মধ্যে অন্তরিক্ষের মতো অনন্ত প্রসারিত স্নেহকারুণ্যকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন জনগণের মধ্যে সকর্ম সাধনের সামর্থ্যকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং জ্ঞানের অভ্যন্তরে ভক্তিকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং ভগবৎ প্রাপ্তির অভিলাষ অন্তরের মধ্যে সকর্ম সাধনের সঙ্কল্পকে বিস্তৃত করে রেখেছেন এবং লোকসমূহের মধ্যে জ্ঞানাগ্নিকে বিস্তৃত করে রেখেছেন; সেই ভগবানই স্বর্গে জ্ঞান-সূর্যকে (পূর্ণজ্ঞানকে) এবং পাষাণের। শুক্লযজুর্বেদসংহিতা। [চতুর্থ অধ্যায়  মতো কঠোর আমাদের হৃদয়ের মধ্যে শুদ্ধসত্ত্বকে স্থাপিত করেছেন। (ভাব এই যে, ভগবানের কৃপাতেই আমাদের মধ্যেই সত্ত্বভাবের উন্মেষ হয়)। [য বরুণঃকরুণাধারঃ ভগবান; বনেষু– অরণ্যসদৃশেষু হৃদয়েষু; অন্তরিক্ষং–অন্তরিক্ষবৎ অনন্তপ্রসারিতং স্নেহকারুণ্যং; বি-ততানং– বিস্তারিতবান; তথা অবৎসু–আত্মোৎকর্ষসম্পন্নেষু জনেষু; বাজং–সকর্ম সাধনসামর্থ্যং; উস্ৰিয়াসু– জ্ঞানকিরণেষু, জ্ঞানাভ্যন্তবে্যু; পয়ঃসত্ত্বভাবং, ভক্তিং; দিবি-দুলোকে, স্বর্গে।(১-২)

৩২। হে আমার মন তুমি জ্ঞানাধারের দৃষ্টিকে প্রাপ্ত হও, এবং জ্ঞানদেবের নেত্রের তারকাকে প্রাপ্ত হও; (ভাব এই যে,–জ্ঞানের দৃষ্টি তোমার প্রতি পতিত হোক, অর্থাৎ তুমি একান্তে জ্ঞানের অনুসারী হও)। (১)। যে অবস্থায় গমনের জন্য তুমি জ্ঞানীর সাথে দীপ্যমান্ অর্থাৎ সম্মিলিত হও, শীঘ্র-সকর্ম পরতার দ্বারা সেই অবস্থায় অগ্রসর বা উপনীত হও।(ভাব এই যে, জ্ঞানীকে অনুসরণ করে সৎকর্মের অনুষ্ঠানে তুমি জ্ঞানবান্ হও)। [এতশেভিঃ–ত্বরিতসঙ্কর্মপরতাভিঃ] (২)

৩৩। বৃষের ন্যায় বলবীর্য সম্পন্ন জ্ঞানভক্তিরূপ অথবা সকাম-নিষ্কাম-রূপ হে বাহকদ্বয়! শকটধূর অথবা ভার বহনসমর্থ অথবা দেবতা বা সংবহনোপযোগী দেবভাব (অর্থাৎ বৃষদ্বয় যেমন শকটের ধূর বা ভার বহন করতে পারে, তেমন জ্ঞান ও ভক্তি-রূপ বাহকদ্বয় দেবভাবসমূহকে মানুষের হৃদয়ে বহন করে আনে; অপিচ, অকিঞ্চন জনকে ভগবানের নিকট নিয়ে যায়), ক্লান্তিরহিত অর্থাৎ সদানন্দরূপ, দুর্বলের অহিংসাকারী অথবা অজ্ঞান জনকে সৎপথে নয়নকারী, অর্চনাকারিদের সঙ্কর্মসাধনের অথবা ভগবানের প্রতি প্রেরণকারী,–এমন তোমরা (আমাদের হৃদয়ে) আগমন করো, আমাদের মনোরথে স্বয়ং যুক্ত হও, এবং মঙ্গলপ্রদ হয়ে সকৰ্ম-সাধনে প্রবৃত্ত জনের আমাদের হৃদয়রূপ যজ্ঞাগার প্রাপ্ত হও অর্থাৎ সেখানে প্রবেশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনা-মূলক এবং আত্ম-উদ্বোধনসূচক। দেবগণের আনয়নোপযোগী সংবাহন করে জ্ঞান এবং ভক্তিকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি–মন্ত্রে এই ভাব প্রকাশ পেয়েছে)। [উগ্রৌ–হে বৃষবহ্বলবীর্যসম্পন্নৌ বাহকৌজ্ঞানভক্তিরূপৌ, যদ্বা–সকামনিষ্কামরূপৌ ইত্যর্থঃ; অবীরহণৌ-বীরাণাং হননমকুর্বাণৌ, অজ্ঞানানাং সৎপথিনয়নকর্তারৌ ইতি ভাবঃ]।(১)।

৩৪। হে ভগবন্! আপনি আমার (আমাদের) উপকার সাধনের জন্য অর্থাৎ মোক্ষপ্রদানের জন্য কল্যাণরূপ হন। হে ভূতসমূহের অধিপতি বা পালক! আপনি, নিখিল সৎকর্মের আগারকে অথবা ভগবানের নিবাসযোগ্য সকল হৃদয়কে লক্ষ্য করে প্রকৃষ্টভাবে গমন করুন এবং সেখানে অধিষ্ঠিত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমাদের মঙ্গলের জন্য মোক্ষবিধায়ক সেই ভগবান্ আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন, এই মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত)। (১)। হে ভগবন্! সর্বতঃ সঞ্চারী সৎ-ভাবনাশক বহিঃশত্রু যেন আপনাকে জানতে অর্থাৎ হিংসা করতে না পারে; অপিচ, সৎকর্মের প্রতিষেধক কাম ইত্যাদি অন্তঃশত্রুও যেন আপনাকে জানতে অর্থাৎ হিংসা করতে সমর্থ না হয়; বিকর্তনশীল অর্থাৎ সৎসম্বন্ধ ছেদনকারী পাপশত্রুগণও যেন আপনাকে জানতে না পারে ও হিংসা করতে না পারে। (এ মন্ত্রটিও প্রার্থনা-মূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে দেব! আপনি এমনভাবে আগমন করুন, কিবা অন্তঃশত্ৰু কিবা বহিঃশত্ৰু কেউ যেন আপনার আগমন বার্তা জানতে সমর্থ না হয় এবং আমাদের সাথে আপনার সম্বন্ধ ছিন্ন করতে না পারে। অর্থাৎ আপনার প্রভাবে আমাদের সকল শত্রু বিনষ্ট হোক) (২)। অপিচ, হে ভগবন্! আপনি শ্যেনপক্ষীর মতো ক্ষিপ্রগামী হয়ে আগমন করুন। অতঃপর, সকর্ম-সাধনে প্রবৃত্ত জনের (আমাদের) গৃহে অর্থাৎ হৃদয়রূপ যজ্ঞাগারে গমন (প্রবেশ) করুন। আপনার এবং আমার জন্য অর্থাৎ আপনার গ্রহণযোগ্য এবং আমার মঙ্গলপ্রদ সে গৃহ (সেই হৃদয়) সুসংস্কৃত হয়ে আছে অর্থাৎ ক্লেদ-কলঙ্ক-পরিশূন্য নির্মল হয়ে আছে। (এ মন্ত্রে ভগবানের সন্নিকর্ষ-লাভের জন্য প্রার্থনাকারীর প্রবল আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে)। (ভাব এই যে,–হে ভগবন্! আমাদের শীঘ্র পরিত্রাণ করুন)।(৩)।

 ৩৫। হে আমার চিত্তবৃত্তিনিবহ! জ্যোতিরূপ পরব্রহ্মকে নমস্কার (স্তুতি) করো। সকলের মিত্রভূত অপিচ স্নেহকারুণ্যরূপ অথবা জগতের হিতকারী, সকল জগতের (নিখিল বিশ্বের) দ্রষ্টা অথবা সকল দ্যাবাপৃথিবী-নিবাসী লোকের দ্রষ্টা, তেজোরূপে দ্যোতমান্, অতীত-অনাগত বর্তমান ত্রিকালভূত প্রাণিগণের দ্রষ্টা (সর্বস্রষ্টা বা ত্রিকালাভিজ্ঞ), দেবগণের অনুগ্রহের জন্য জাত অথবা দেবগণের জন্মকারণ, প্রজ্ঞানস্বরূপ অথবা বিজ্ঞান-ধনানন্দ-স্বভাব, দ্যুলোকের পুত্রের মতো প্রিয় অথবা বিশ্বের উৎপত্তির হেতুভূত, জ্যোতিরূপ পরব্রহ্মকে–তিনিই সত্য জেনে, পূজা করো; অপিচ তাকে স্তুতি করো। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। বিশ্বহেতুভূত, সর্বদ্রষ্টা জ্যোতিস্বরূপ পরব্রহ্মকে অর্চনা করি–এমন সঙ্কল্প মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে)। [মিত্রস্য বরুণস্য–মিত্রবরুণদেবতারূপেণ বর্তমানায়, সর্বেষাং সখিভূতায় অপিচ স্নেহকারুণ্যরূপায়, যদ্বা-জগতাং হিতকারিণে ইত্যর্থঃ; অথবা, মিত্রস্য বরুণস্য চক্ষসে সর্বদ্যাবাপৃথিবী নিবাসিনাং লোকানং দ্রষ্টে; দিবসুত্রায় দ্যুলোকস্য পুত্রবৎ প্রিয়ায়, যদ্বা–বিশ্বস্য উৎপত্তিহেতুভূতায় জ্যোতীরূপায় পরব্রহ্মণে] (১)

৩৬। হে আমার হৃদয়-নিহিত সৎ-বৃত্তি! তুমি (কর্মরূপ যানে) স্নেহকরুণাধার ভগবানকে উন্নতভাবে স্থাপনকর্তা হও। (অতএব প্রার্থনা কর্মের প্রভাবে যাতে আমরা শুদ্ধসত্ত্বরূপ ভগবানকে পেতে পারি, তা বিহিত করুন, অথবা আমাদের কর্মসমূহ ভগবৎ সম্বন্ধযুত হোক)। [বরুণস্য-স্নেহ করুণাধারস্য ভগবতঃ] (১)। হে জ্ঞানভক্তি! তোমরা (আমাদের হৃদয়ে বা কর্মরূপ যানে) স্নেহ-করুণাধার ভগবানকে অচঞ্চলভাবে স্থাপন কর্তা হও।(প্রার্থনা–আমাদের কর্মসমূহের সাথে ভগবৎ-সম্বন্ধ অবিচ্ছিন্ন হোক)। [স্কিম্ভসর্জনী–অচঞ্চলেন স্থাপয়িত্রী-হৃদি, কর্মরূপে যানে বা ইতি ভাবঃ] (২)। হে আমার হৃদয়-নিহিত সবৃত্তি! তুমি ভগবৎ-সম্বন্ধি সৎকর্মের আধারভূতা অথবা সৎকর্মের সাধনের জন্য ভগবানের আশ্রয়যোগ্য হও। (ভাব এই যে, আমার হৃদয় নিহিত সৎ-বৃত্তির সাথে ভগবান্ অবিচলিতভাবে অবস্থান করুন)। [বরুণস্য–ভগবৎসম্বন্ধি; ঋতসদনী–সৎকর্মণামাধারভূতা, যদ্বাসকর্মসাধনায় ভগবদায়যোগ্যা ইত্যর্থঃ]।(৩)। অতএব হে আমার হৃদয়! তুমি ভগবৎসম্বন্ধি সৎকর্মের আধাররূপ অথবা সৎকর্ম সাধনের জন্য সত্যের আশ্রয়ভূতা হও। (ভাব এই যে, যাতে অন্তরকে ভগবৎ-অভিমুখী করতে সমর্থ হই, তা-ই বিহিত করুন। মন্ত্রে এমন প্রার্থনা প্রকটিত)। [ঋতসদনং–সকর্মর্ণমাধাররূপং, যদ্বা–সৎকর্মসাধনার্থং সত্যস্যাশ্রয় ভূতং]।(৪)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি স্নেহকারুণ্যরূপী ভগবানের সত্যরূপ আশ্রয়স্থানকে (আমার এই হৃদয়কে) প্রাপ্ত হও অর্থাৎ আশ্রয় করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা এবং সৎকর্মের সাহায্যে ভগবানকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করবার উপদেশ এই মন্ত্রে নিহিত আছে)।(৫)। [এই কণ্ডিকার প্রথম ও তৃতীয় মন্ত্র হৃদয়-নিহিত সৎ-বৃত্তির সম্বোধনে, দ্বিতীয় মন্ত্র জ্ঞান-ভক্তির সম্বোধনে, চতুর্থ মন্ত্র হৃদয়ের বা অন্তরের সম্বোধনে এবং পঞ্চম মন্ত্র শুদ্ধসত্বের সম্বোধনে প্রযুক্ত]।৩৭। হে ভগবন্! আপনার সম্বন্ধি যে সকল স্থান বা নাম অবলম্বন করে, জ্ঞান ও ভক্তির দ্বারা মানুষ যজ্ঞ করে অথবা আপনার অর্চনা করে, আপনার সম্বন্ধি সেই যজ্ঞ বা অৰ্চন আপনার যাবতীয় স্থানে বা নামে আপনি সর্বতোভাবে প্রাপ্ত হোন। (ভার এই যে, হে ভগব! যে জন যেখান থেকে যে নামেই আপনাকে জ্ঞান ও ভক্তি সহকারে অর্চনা করে, আপনি সেখান থেকে সেই নামেই পরিতুষ্ট হয়ে তাকে উদ্ধার করেন)।(১)। হে ভগবন্! গৃহাভিবর্ধক অথবা শ্রেয়ঃসাধক, প্রকৃষ্ট বিপদ-উদ্ধারকারী অথবা সংসারপারে নয়নকর্তা, শোভনবীর্যসম্পন্ন এবং বীরগণের পরিপালক অর্থাৎ অজ্ঞান অকিঞ্চন জনের আশ্রয়দাতা; (আপনি অকিঞ্চন আমাদের আশ্রয় দান করুন এবং সংসার-সমুদ্র থেকে ত্রাণ করুন)। [গয়স্ফানঃ ও গৃহাভিবর্ধক, যদ্বা-শ্রেয়ঃসাধকঃ, দুর্যান–গৃহা, অস্মাকং হৃপা যজ্ঞাগারানিতি ভাবঃ] (২)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *