০৪.
শিউলির স্কুল বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এটুকু পথ হেঁটে যেতে দশ মিনিটও লাগার কথা নয় কিন্তু শিউলির প্রতিদিনই প্রায় ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। তার ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে তাই সোজাসুজি স্কুলে না গিয়ে প্রত্যেকদিনই একটু ঘুরপথে স্কুলে যায়। নতুন নতুন রাস্তা আবিষ্কার করে, নতুন নতুন জায়গা আবিষ্কার করে। সেই নতুন রাস্তায় নতুন জায়গায় কত বিচিত্র রকমের মানুষ, দেখতে শিউলির বড় ভালো লাগে। শিউলির সবচেয়ে ভালো লাগে বাসস্টেশনের মানুষজনকে দেখতে। ব্যস্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে লোকজন আসে, কেউ তাড়াতাড়ি উঠে যায়, কেউ উঠতে পারে না, মাঝে মাঝে গ্রামের মানুষজন আসে, তারা কোনো তাল খুঁজে পায় না। বাসের হেল্পারদের দেখতেও খুব মজা লাগে, যখন মনে হয় কিছুতেই তারা বাসে উঠতে পারবে না, তখনও তারা কীভাবে কীভাবে জানি দৌড়ে বাসে গিয়ে ঝুলে পড়ে।
এই বাসস্টেশনে শিউলি একদিন পকেটমারকে আবিষ্কার করল। শিউলি বিকেলবেলা স্কুল থেকে বাসায় আসতে আসতে বাসস্টেশনের কাছে থেমেছে। একপাশে কিছু খালি পাকিংবাক্স রাখা আছে। তার একটার উপর পা ঝুলিয়ে বসে মানুষজনকে বাসে উঠতে দেখছে তখন হঠাৎ সে ঘটনাটা ঘটতে দেখল। পকেটমারটা ভান করল সেও বাসে উঠছে। ভিড়ের মাঝে ঠেলাঠেলি করার ভান করে সে হঠাৎ সামনে হাত বাড়িয়ে একজন মানুষ ছাড়িয়ে তার পরের জনের পকেট থেকে মানিব্যাগটা তুলে নিল। পুরো ঘটনাটা ঘটল একেবারে চোখের পলকে, ম্যাজিকের মতন। যে-মানুষের পকেট মারা হয়েছে সে কিছু টেরই পেল না, দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আরেকজনের সাথে কথা বলতে বলতে বাসের ভেতরে ঢুকে গেল।
শিউলি চিৎকার করে পকেটমারটাকে ধরিয়ে দিতে পারত কিন্তু ধরিয়ে দিল না, তার কারণ পকেটমারটা আসলে বাচ্চা একটা ছেলে। দেখে মনে হয় তার থেকেও দুবছরের ছোট। এই টুকুন ছোট ছেলে হাত সাফাইয়ের এরকম চমৎকার কাজ শিখে গেছে দেখে শিউলি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। সে দেখল বাচ্চা পকেটমার বাস থেকে নেমে কিছুই হয়নি এরকম ভান করে হেঁটে যেতে শুরু করেছে। শিউলিও প্যাকিং বাক্স থেকে নেমে তার পিছুপিছু যেতে থাকল। ছেলেটা দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে উদাস-উদাস মুখে হেঁটে যেতে থাকে। শিউলি দেখতে পেল পকেটে তার হাত নড়ছে, নিশ্চয়ই মানিব্যাগের টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে একটা চিঠি ফেলার বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। শিউলি দেখল পকেটখালি মানিব্যাগটা বের করে সে চিঠি ফেলা বাক্সের ভেতর ফেলে দিল, সে যে মানিব্যাগটা সরিয়েছে তার কোনো প্রমাণ রইল না। একেবারে নিখুঁত কাজ।
ছেলেটা কিছুই হয়নি এরকম ভান করে মাথা ঘুরিয়ে চারদিক দেখে হেঁটে হেঁটে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে গেল। শিউলি বাইরে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত বাসায় ফিরে এল।
এরপর থেকে শিউলি সময় পেলেই বাসস্টেশনে এসে সেই বাচ্চা পকেটমারকে খুঁজে বের করত। গায়ের রং শ্যামলা, মাথায় চুল ধূলিধূসরিত। নীল রঙের একটা প্যান্ট, সবুজ রঙের চেক চেক শার্ট, খালি পা। ছেলেটার চোখে উদাস উদাস একরকম ভাব। কেউ দেখলে তাকে কবি নাহয় শিল্পী বলে সন্দেহ করতে পারে, কিন্তু কিছুতেই পকেটমার বলে সন্দেহ করবে না। ছেলেটা ফুটপাতে বসে একটা ঘাস চিবুতে চিবুতে কিছুই দেখছে না এরকম ভান করে চোখের কোণা দিয়ে কার পকেট মারা যায় সেটা তীক্ষ্ণচোখে লক্ষ করত। যখন একটা ভালো শিকার পাওয়া যেত তখন সে উঠে দাঁড়াত। শিউলি দেখত গলায় ঝুলানো একটা তাবিজ বের করে সে চোখ বন্ধ করে একবার চুমো খেয়ে নিত। তারপর উদাস উদাস ভান করে হেঁটে যেত। সাপ যেভাবে ছোবল মারে ছেলেটা সেভাবে মানুষের পকেটে ছোবল মারত। শিউলি তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারত না কীভাবে চোখের পলকের মাঝে সে পকেটটা খালি করে ফেলছে–এককথায় অপূর্ব একটা কাজ!
সেদিন ঠিক এভাবে শিউলি বাসস্টেশনে বসে বসে পকেটমার বাচ্চাটাকে দেখছে। ফুটপাতে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ সে উঠে দাঁড়াল। শিউলি দেখল গলা থেকে তাবিজটা বের করে একবার চুমো খেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। শিউলি আন্দাজ করার চেষ্টা করল কোন মানুষটার পকেট মারবে, কিন্তু বুঝতে পারল না।
সামনে একটা ছোটখাটো ভিড়। ছেলেটা সেই ভিড়ে ঢুকে গেল। প্রতিবার সে পকেট মারতে যায় শিউলির তখন কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকে, যদি ধরা পড়ে যায় তখন কী হবে? শিউলি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে আর ঠিক তখন হঠাৎ ভিড়ের মাঝে একটা হৈচৈ শুনতে পেল, কে যেন চিৎকার করে বলল, “পকেটমার! পকেটমার!”
শিউলির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, সর্বনাশ! এখন কী হবে? উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে যা দেখল তাতে আর হৃৎপিণ্ড থেমে যাবার মতো অবস্থা হল। শুকনোমতন রাগী-রাগী, চেহারার একজন মানুষ বাচ্চা পকেটমারের চুলের মুঠি ধরে মুখের মাঝে প্রচণ্ড একটা ঘুসি মেরে বসেছে, দেখতে দেখতে তার নাক দিয়ে ঝরঝর করে রক্ত বের হয়ে এল। শুকনো মানুষটা ছেলেটার চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “শুওরের বাচ্চা, হারামখোর, খুন করে ফেলব তোকে। জানে শেষ করে ফেলব।”
এই বলে মানুষটা আবার ছেলেটার মুখে আরেকটা ঘুসি মারল।
হাম এবং জলবসন্তের মতো মারপিট জিনিসটাও মনে হয় সংক্রামক। হঠাৎ করে ভিড়ের সবাই মিলে ছেলেটাকে ধরে মারতে লাগল, ইশ, সে কী ভয়ানক মার! দেখে মনে হল এক্ষুনি বুঝি ছেলেটাকে খুন করে ফেলবে। শিউলি আর সহ্য করতে পারল না, “থামান-থামান! বন্ধ করেন–কী করছেন–সর্বনাশ! মেরে ফেলবেন নাকি!” এইসব বলতে বলতে সে ভিড় ঠেলে প্রায় ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে আড়াল করার চেষ্টা করল এবং ফুটফুটে স্কুলের একটা মেয়েকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে সবাই এক সেকেন্ডের জন্যে মার বন্ধ করল।
শুকনোমতো যে-মানুষটা ছেলেটার চুল ধরে রেখেছিল সে তার মাথা ধরে একটা ঝাঁকুনি নিয়ে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
“ছেলেটাকে মারছেন কেন?”
“মারব না তো কোলে নিয়ে চুমা খাব? শালার ব্যাটা পকেটমার”
ছেলেটা এই প্রথম কথা বলল, মুখ থেকে রক্তমাখা থুতু ফেলে বলল, “কে বলছে আমি পকেটমার?”
মানুষটা বলল, “আমি বলছি। আমার পকেট থেকে মানিব্যাগ সরিয়েছিস তুই।”
“আমি? কোথায় মানিব্যাগ?”
“শালার ব্যাটা, তুই পকেটে ঢুকিয়েছিস আমি স্পষ্ট দেখেছি।”
“দেখেছেন? ছেলেটা হাতের উলটো পিঠ দিয়ে নাকের রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলল, “মিছা কথা!”
মানুষটা দাঁত-কিড়কিড় করে বলল, “যদি বের করতে পারি, হারামজাদা?”
ছেলেটা পিচিক করে আবার রক্তমাথা থুতু ফেলে বলল, “আর যদি না পারেন?”
মানুষটা কোনো কথা না বলে নিচু হয়ে তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। ছেলেটার পকেটে কোনো মানিব্যাগ নেই, চারটা মার্বেল আর একটা ওষুধের হ্যাঁন্ডবিল পাওয়া গেল। মানুসটার চোয়াল ঝুলে পড়ে এবং হঠাৎ করে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভাঙা গলায় বলল ”সর্বনাশ! মানিব্যাগ? আমার মানিব্যাগ!”
ছেলেটাকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের একজন বলল, “পকেট মেরেছে পকেটমার আর খামোকা এই বাচ্চাটাকে মারলেন!”
মানুষটার তখন তার মানিব্যাগের শোকে পাগল হয়ে গেছে। ধাক্কা মেরে ছেলেটাকে প্রায় ফেলে দিয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে থাকে। মনে হয় সে বুঝি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়েই আসল পকেটমারকে ধরে ফেলবে।
মানুষটা চলে যেতে চাইছিল ছেলেটা লোকটার শার্টের কোণা ধরে ফেলল, মুখ শক্ত করে বলল, “আপনি আমাকে মিছামিছি মারলেন কেন?”
একটু আগেই যারা ছেলেটাকে ধরে দুই-এক ঘা লাগিয়েছে তাদেরই একজন মনে হল এখন ছেলেটার পক্ষ নিয়ে শুকনো মানুষটাকে দুই-এক ঘা লাগাতে চাইছিল, মানুষটা শার্টের হাতা গুটিয়ে বলল, “এই যে ভদ্রলোক, ছেলেটাকে যে মিছিমিছি মারলেন? এখন আপনাকে ধরে দেই কয়েকটা?”
শুকনো মানুষটা মুখ খিঁচিয়ে বলল, “আমি মিছামিছি মারি নাই। এই হারামির বাচ্চার সাথে তার দলবল আছে, তাদের হাতে আমার ব্যাগ সরিয়ে দিয়েছে।”
“কখন সরাল? আপনি না ধরে রাখলেন?”
“আপনার এত দরদ কেন? তাদের দলের একজন নাকি?”
“কী? আপনি কী বলতে চান? আমি পকেটমার? আপনার এত বড় সাহস।”
দেখতে দেখতে মানুষগুলো ঝগড়া লাগিয়ে দিল, এই ফাঁকে শিউলি ছেলেটার হাতে ধরে টেনে বের করে আনে। অল্প সময়ের মাঝে ছেলেটাকে ধরে শক্ত মার দেওয়া হয়েছে, ছেলেটার নাকমুখ দিয়ে এখনও রক্ত ঝরছে। হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
ছেলেটা মাটিতে পিচিক করে থুতু ফেলে শিউলির দিকে তাকিয়ে বলল, “মানুষের মনে কোনো মায়া মহব্বত নাই।”
শিউলি চোখ পাকিয়ে বলল, “মানিব্যাগটা কী করেছ?”
ছেলেটা যেন খুব অবাক হয়ে গেছে সেরকম ভান করে বলল, “কোন মানিব্যাগ?”
“যেটা তুমি পকেট মেরেছ।”
“আমি? আমি পকেট মেরেছি?”
“হ্যাঁ।“
শিউলি চোখ ছোট ছোট করে বলল, “আমি তোমাকে বহুদিন থেকে লক্ষ করে আসছি। আমি সব জানি।”
ছেলেটার মুখে হঠাৎ ভয়ের একটা ছাপ পড়ল, কাঁপা গলায় বলল, “কী জান?”
“তোমার গলায় একটা তাবিজ থাকে। পকেটে মারার আগে তুমি সেটাকে চুমু খাও।”
ছেলেটার মুখ হঠাৎ হাঁ হয়ে গেল। শিউলি মুখ শক্ত করে বলল, “পকেট মেরে তুমি ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা সরিয়ে খালি ব্যাগটা ঐ চিঠির বাক্সে ফেল।”
ছেলেটার চোখেমুখে এবারে একটা আতঙ্ক এসে ভর করল। হঠাৎ সে ছুটতে আরম্ভ করল কিন্তু ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে খুব বেশিদূর যেতে পারল না। শিউলি পেছনে থেকে ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলল। শার্টের কলার ধরে বলল, “তুমি ভয় পেয়ো না। আমি কাউকে বলব না।”
“খোদার কসম?”
“খোদার কসম।”
“শান্নি পীরের কসম?”
শান্নি পীর কী জিনিস শিউলি জানে না কিন্তু তবু বলল, “শান্নি পীরের কসম।”
ছেলেটা মনে হল একটু শান্ত হল, পুরোপুরি নিশ্চিত হল সেটা অবিশ্যি বলা যায় না, একটু ভয়ে ভয়ে শিউলির দিকে তাকিয় রইল। শিউলি বলল, “আমি জানি তুমি ঐ মানুষটার পকেট মেরেছ। এখন বলল দেখি ম্যানিব্যাগটা কোথায় সরিয়েছ?”
ছেলেটা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার ব্যাগে।”
“আমার ব্যাগে?” শিউলি হতভম্ব হয়ে বলল, “কী বললে? আমার ব্যাগে?”
“হ্যাঁ।”
শিউলি ছেলেটার কথা একেবারেই বিশ্বাস করল না, কিন্তু তবুও তার স্কুলব্যাগ খুলে ভেতরে উঁকি দিয়ে হঠাৎ করে তার শরীর জমে গেল। সত্যি সত্যি তার স্কুলব্যাগের ভেতরে একটা পেটমোেটা মানিব্যাগ।
শিউলি হতবাক হয়ে বলল, “আ-আ-আমার ব্যাগের ভেতরে এটা কেমন করে এল?”
“আমি রেখেছি।”
“কখন রেখেছ?”
“তুমি যখন আমার কাছে দৌড়ে এসেছ তখন।”
ছেলেটা আবার পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “ম্যানিব্যাগটা সরাতে না পারলে কপালে দুঃখ ছিল।”
শিউলি চোখ লাল করে বলল, “আর যদি কেউ দেখত মানিব্যাগ আমার ব্যাগের ভিতরে রাখছ?”
ছেলেটা উদাস-উদাস মুখে বলল, “তা হলে তোমার কপালেও দুঃখ ছিল।”
শিউলি হতবাক হয়ে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা বলল, “মানিব্যাগটাও দাও, আমি যাই।”
“কী করবে মানিব্যাগ দিয়ে?”
“দেখি লাভ হল নাকি লোকসান হল। দিনকাল খুব খারাপ। আজকাল মানুষ পকেটে টাকা-পয়সা বেশি রাখে না।”
শিউলি আর ছেলেটা হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মোড়ে এসে হাজির হয়েছে, সেখানে দুজন ট্রাফিক পুলিশ কথা বলছে। কাছেই মোটরসাইকেলে একজন পুলিশ অফিসার বসে। ছেলেটা পুলিশকে ভয় পায় মনে হল, তাদেরকে দেখেই হঠাৎ করে কেমন জানি একেবারে সিটিয়ে গেল। শিউলির কী মনে হল কে জানে, হঠাৎ সে পুলিশগুলোর কাছে গিয়ে বলল, “এই যে, শোনেন।”
মোটরসাইকেলে বসে থাকা-পুলিশ অফিসার বললেন, “কী হল খুকি?”
শিউলি তার স্কুলব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বের করে পুলিশ অফিসারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এইটা রাস্তায় পড়েছিল।”
পুলিশ অফিসারটা মানিব্যাগটা হাতে নিয়ে শিস দেবার মতো শব্দ করে বললেন, “সর্বনাশ! অনেক টাকা ভেতরে!”
শিউলি জিজ্ঞেস করল, “ঠিকানা আছে ভেতরে?”
পুলিশ অফিসার মানিব্যাগের কাগজপত্র দেখে বললেন, “আছে মনে হচ্ছে।”
“মানিব্যাগটা পৌঁছে দেওয়া যাবে?”
“অবশ্যি পৌঁছে দেওয়া যাবে। তোমার নাম কী খুকি?”শিউলি।”
“আর তোমার?” বলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার হঠাৎ চমকে উঠলেন, “সে কী! তোমার একী অবস্থা!”
ছেলেটা কিছু বলার আগেই শিউলি বলল, “রিকশায় ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেছে।”
একজন ট্রাফিক পুলিশ দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “এই ব্যাটা রিকশাওয়ালাদের যন্ত্রণায় মরেও শান্তি নেই!”
পুলিশ অফিসার বললেন, “এসো আমার সাথে।”
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলল, “কোথায়?”
“ডাক্তারখানায়।”
ছেলেটা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “লাগবে না। ডাক্তার লাগবে না। আসলে বেশি ব্যথা পাই নাই। খালি একটু রক্ত বের হয়েছে।”
“ঠিক তো?”
“জে। ঠিক। এক্কেবারে ঠিক।”
“বেশ। তা কী নাম বললে?” ছেলেটা মুখ থেকে রক্ত মুছতে মুছতে বলল, “ইয়ে–আমার নাম আজিজ।”
“আজিজ, এখন থেকে রাস্তাঘাটে খুব সাবধান। রিকশায় ধাক্কা খেয়েছ বলে বেঁচে গেছ। যদি একটা ট্রাক হত তা হলে আর দেখতে হত না। আর এই যে খুকি তোমাকে মানিব্যাগের জন্যে একটা রিসিট দিয়ে দিই।”
রিসিট নিয়ে শিউলি আবার ছেলেটাকে নিয়ে হাঁটতে থাকে। পুলিশ থেকে খানিকটা দূরে সরে দিয়ে ছেলেটা বলল, “এই মেয়ে–আমার এত কষ্টের রোজগার তুমি পুলিশকে দিয়ে দিলে?”
শিউলি মুখ ভেংচে বলল, “বেশি কথা বললে তোমাকেও পুলিশকে দিয়ে দেব, বুঝেছ?”
ছেলেটা পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, “ইশ! কতগুলি টাকা!” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে, আমি গেলাম।”
“কই যাও আজিজ?”
“আমার নাম আজিজ না।”
শিউলি অবাক হয়ে বলল, “তা হলে পুলিশকে আজিজ বললে যে?”
“পুলিশকে আসল নাম বলে বিপদে পড়ব নাকি?”
“তা হলে তোমার আসল নাম কী?”
“বল্টু।”
“বল্টু! হি হি হি!” শিউলি হাসতে হাসতে বলল, “বল্টু কি কখনো কারও নাম হয়?”
“আমার বাবা গাড়ি মেকানিক ছিল তাই আমার নাম রেখেছিল বল্টু। আমার ছোট বোনের নাম রেখেছিল মোবিল।”
“তোমার বাবা এখন কী করে?”
“জানি না। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।”
“তোমার বোন?”
বল্টু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মরে গেছে। তখন একদিন মাও ঘর ছেড়ে চলে গেল।”
“তার মানে তুমি একা? তোমার কেউ নেই?”
বল্টু গম্ভীরমুখে বলল, “ওস্তাদজি আছে।”
“ওস্তাদজি? কিসের ওস্তাদজি?”
“পকেটমারা স্কুলের ওস্তাদজি।”
“তোমার পকেটমার ওস্তাদজি না থাকলেই ভালো ছিল।”
বল্টু কোনো কথা বলল না। হেঁটে হেঁটে দুজন একটা চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াল। তখন বল্টু আবার বলল, “আমি গেলাম।”
“কোথায় যাবে?”
“দেখি কিছু রুজিরোজগার করা যায় কি না।”
শিউলি ভুরু কুঁচকে বলল, “রুজিরোজগার? কিসের রুজিরোজগার? আবার গিয়ে পকেট মারবে?”
“না হলে কী করব? না খেয়ে থাকব নাকি?”
শিউলি খপ করে বল্টুর ঘাড় ধরে বলল, “আর যদি কোনোদিন পকেট মার একেবারে ঘাড় ভেঙে ফেলব।”
“তা হলে খাব কী?”
“তোমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা? আসো তোমাকে আমি খাওয়াব।”
কাজেই সেদিন বাসায় ফিরে রইসউদ্দিন আবিষ্কার করলেন বল্টু নামের নয় দশ বছরের শ্যামলামতন উদাস-উদাস চেহারার একটা ছেলে তার বাসায় উঠে এসেছে। শিউলি জানাল ছেলেটা নাকি রিকশার নিচে চাপা পড়ে ব্যথা পেয়েছে। কয়দিন এখানে থেকে একটু সুস্থ হয়েই চলে যাবে।
শিউলি বল্টুকে সাবান দিয়ে ডলে আচ্ছামতন গোসল করিয়ে আনল। বাসায় তার মাপমতো কোনো কাপড় ছিল না বলে মতলুব মিয়ার একটা লুঙ্গি আর রইসউদ্দিনের একটা পাঞ্জাবি পরিয়ে দেওয়া হল। পাঞ্জাবি পরার পর দেখা গেল সেটা তার পায়ের পাতা পর্যন্ত চলে এসেছে, নিচে লুঙ্গি না পরলেও ক্ষতি ছিল না। শিউলি বল্টুর নিজের ময়লা কাপড়জামা ধুয়ে বারান্দায় টানিয়ে দিল শুকানোর জন্যে।
রাত্রে খাবার টেবিলে রইসউদ্দিনের দুই পাশে খেতে বসেছে শিউলি আর বল্ট। মতলুব মিয়ার রান্না মুখে দিয়ে বল্টু হতাশভাবে মাথা নাড়ল রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?”
“দুই নম্বুরি রান্না।”
মতলুব মিয়া মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করল, “সেটা আবার কী?”
“যেই রান্না মুখে নেওয়া যায় সেইটা এক নম্বুরি, যেইটা মুখে নেওয়া যায় না সেইটা হচ্ছে দুই নম্বুরি।–”
শিউলি বলল, “কষ্ট করে খেয়ে নাও। মতলুব চাচা নাকি পঁচিশ বছর ধরে এই রান্না শিখেছে।”
রইসউদ্দিন ভাত খেতে খেতে বল্টুর খোঁজ-খবর নিলেন, মা-বাবা ভাই-বোন কেউ নেই, একেবারে একা থাকে শুনে জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করলেন। পড়াশোনা কিছু করেছে কি না জানতে চাইলে বল্টু বলল, “এমনিতে স্কুলে যাই নাই, কিন্তু ওস্তাদজির কাছে কিছু জিনিসপত্র শিখেছি।”
শিউলি খেতে খেতে বিষম খেল। ওস্তাদজির কাছে কী বিদ্যা শিখেছে ব্যাখ্যা করলে বিপদ হয়ে যাবে। রইসউদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, কী শিখেছে ওস্তাদের কাছে?”
“এই–হাতের কাজ।”
মতলুব মিয়া সরুচোখে বলল, “কীরকম হাতের কাজ?”
বল্টু কিছু বলার আগেই রইসউদ্দিন বললেন, “আজকাল কতরকম এন. জি. ও. আছে, মেয়েদের কাজকর্ম শেখায়, বাচ্চাদের কাজকর্ম শেখায়। ঠোঙা বানানো, টুকরি বানানো এইসব হবে আর কি!”
বল্টু কিছু বলল না, কিন্তু শিউলি জোরে জোরে কয়েকবার মাথা নাড়ল। রইসউদ্দিন বর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার হাতের কাজ কোথায় দেখাও?”
“আমাদের ওস্তাদের সাগরেদরা একেকজন একেক জায়গায় যাই। কেউ রেলস্টেশন, কেউ বাসস্টেশন। আমি বাসস্টেশনে যাই।”
“ঠিক নাই। কখনো বেশি কখনো কম।”
বল্টু হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, “আজকাল মানুষজন পকেটে টাকা-পয়সা নিয়ে বের হয় না।”
.
রাত্রে খাবারের পর শিউলি পড়তে গেল, তার নাকি অনেক হোমওয়ার্ক বাকি। বল্টর কিছু করার নেই তাই সে বাসায় ঘুরে বেড়াতে থাকে। বসার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই শুনতে পেল ভেতরে রইসউদ্দিন সাথে মতলুব মিয়া কথা বলছে। বল্টু চলে আসছিল কিন্তু হঠাৎ থেমে গেল মনে হল তাকে নিয়ে কথা হচ্ছে। শুনতে পেল মতলুব মিয়া বলছে, “ভাই, আমি লাখ টাকা বাজি ধরতে পারি এই ব্যাটা চোর।”
রইসউদ্দিন বললেন, “এইটুকু মানুষ চোর?”
“চোরের বয়স নাই ভাই, চোরের সাইজও নাই। যারা চোর তারা জন্ম থেকে চোর।”
“কী বলছ বাজে কথা!”
“আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? পোলাটার চোখের দৃষ্টি দেখেন নাই?”
“আমার তো এমন কিছু উনিশ-বিশ মনে হল না।”
মতলুব মিয়া ষড়যন্ত্রীর মতো গলা নিচু করে বলল, “একে বাসার মাঝে জায়গা দেবেন না ভাই। সর্বনাশ করে দেবে।”
“কী রকম সর্বনাশ করবে?”
“এদের বড় বড় চোর-ডাকাতদের সাথে যোগাযোগ থাকে, রাত্রিবেলা দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে আসবে।”
রইসউদ্দিন হোহো করে হেসে বললেন, “আমার বাসায় আছে কী যে চোর ডাকাত আসবে?”
মতলুব মিয়া গম্ভীর গলায় বলল, “এইটা হাসির কথা না ভাই। যদি ভালো চান তা হলে এই ছেলেকে বিদায় করেন।”
রইসউদ্দিন বললেন, “ছি ছি! এটা তুমি কী বলছ মতলুব মিয়া! অসুস্থ একটা ছেলে এসেছে, তাকে ঘর থেকে বের করে দেব? শরীর ভালো হলে সে তো নিজেই চলে যাবে।”
“ঠিক আছে, যদি বের করতে না চান তা হলে রাত্রে ঘরে তালা মেরে রাখবেন। ছোটলোকের জাতকে বিশ্বাস নাই।”
রইসউদ্দিন এবারে একটু রেগে উঠে ধমক দিয়ে বললেন, মতলুব মিয়া, তুমি বড় বাজে কথা বল, এখনও যাও দেখি!”
মতলুব মিয়া ঘর থেকে বের হওয়ার আগেই বল্টু দরজা থেকে সরে যাবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। তাকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মতলুব মিয়া বিশাল হৈচৈ শুরু করে দিল, “এই ছেলে, তুমি এইখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
বল্টু মিয়া উদাস-উদাস গলায় বলল, “তা হলে কোনখানে থাকব?”
“কত বড় সাহস তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার প্রাইভেট কথাবার্তা শোন।”
বল্টু কিছু বলল না–কী বলবে ঠিক বুঝতেও পারল না। মতলুব মিয়া চিৎকার করে বল্টুর হাত ধরে রইসউদ্দিনের কাছে নিয়ে গেল, “ভাই, বলেছিলাম
এই ছেলে চোরের জাত? এই দেখেন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছে।”
রইসউদ্দিন আমতা আমতা করে বললেন, “শুনলে সমস্যাটা কী?”
“সমস্যা বুঝতে পারছেন না? মাথায় বদ মতলব সেইজন্যে চোরের মতো কথাবার্তা শুনছে।”
মতলুব মিয়ার হৈচৈ চিৎকার শুনে শিউলিও চলে এসেছে, সে একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
মতলুব মিয়া বলল, “তুমি কোথা থেকে এই ছেলে ধরে এনেছ? পরিষ্কার চোর।”
শিউলি ঘাবড়ে গেল, ভয়ে ভয়ে বলল, “কী চুরি করেছে?”
“এখনও করে নাই, কিন্তু মনে হয় করবে।” মতলুব মিয়া মুখ শক্ত করে রইসউদ্দিনকে বলল, “ভাই আপনার টাকা-পয়সা মানিব্যাগ সাবধান।”
রইসউদ্দিন মতলুব মিয়াকে একটা কঠিন ধমক দিতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। বল্টু যে-টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে একটু আগে তার মানিব্যাগটা ছিল, এখন নেই। রইসউদ্দিন চমকে উঠে বললেন, “আমার মানিব্যাগ!”
মতলুব মিয়া দুই লাফ দিয়ে বল্টুকে ধরে ফেলল, চিৎকার করে বলল, “বের কর মানিব্যাগ।”
“মানিব্যাগ? কোন মানিব্যাগ?”
মতলুব মিয়া দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “ঢং করবি না ব্যাটা বদমাইশ। তোদেরকে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি।”
রইসউদ্দিন কিছু বলার আগেই মতলুব মিয়া বল্টুর ঢলঢলে পোশাকের ভেতরে সবকিছু দেখে ফেলেছে, কোথাও মানিব্যাগ লুকানো নেই। টেবিলে, টেবিলের নিচে আশপাশে আবার খুঁজে দেখা হল, মানিব্যাগের কোনো চিহ্ন নেই। রইসউদ্দিন কয়েকবার নিজের পকেট দেখলেন, ভুল করে ড্রয়ারের মাঝে রেখে দিয়েছেন কি না ভেবে ড্রয়ারটা খুলে দেখলেন এবং কোথাও না পেয়ে সত্যি সত্যি খুব দুশ্চিন্তিত হয়ে গেলেন। মাত্র বেতন পেয়েছেন, মানিব্যাগ-ভরা টাকা, তা ছাড়া নানারকম দরকারি কাগজপত্র রয়েছে, এখন এই মানিব্যাগ চুরি হয়ে গেলে তার মহা ঝামেলা হয়ে যাবে।
মতলুব মিয়া মোটামুটি নিশ্চিত ছিল বল্টুর সারা শরীর ভালো করে খুঁজলেই মানিব্যাগটা পাওয়া যাবে, না পেয়ে সেও খুব চিন্তিত হয়ে গেল। শিউলি কাছেই দাঁড়িয়েছিল, সে বল্টুর দিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে থাকে। বল্টু উদাস-উদাস চোখে শিউলির দিকে তাকাল এবং হঠাৎ তার চোখে একটা দুষ্টুমির হাসি ঝিলিক মেরে যায়। সাথে সাথে পুরো ব্যাপারটা শিউলির কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সে মুখ টিপে হেসে এক পা এগিয়ে এসে বলল, “রইস চাচা।”
“কী হল?”
”আপনার মানিব্যাগ তো এই ঘরেই ছিল?”
“চুরি হলে তো এই ঘর থেকেই চুরি হয়েছে?”
“হুঁ।“
“চোর তা হলে এই ঘরেই আছে?”
“কী বলছ তুমি?”
“বলছিলাম কি মতলুব চাচাকে–”
মতলুব মিয়া চিৎকার করে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “কী বললে ছেমড়ি? তোমার এত বড় সাহস!”
“আপনার পকেট দেখি!”
মতলুব মিয়া রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পকেটে হাত দিল এবং হঠাৎ সে একেবারে পাথরের মতো জমে গেল। তার মুখ প্রথমে ছাইয়ের মতো সাদা এবং একটু পরে সেখানে ছোপ ছোপ ছোট লাল এবং বেগুনি রং দেখা গেল। রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে মতলুব মিয়া?”
“আম-আ-আ-আম–”
“আম?”
“আমা-আমার আমার প-প-পকেট–”
”তোমার পকেটে কী?”
“আ-আ-আ আপনার মানিব্যাগ।”
মতলুব মিয়া সত্যি সত্যি তার পকেট থেকে রইসউদ্দিনের মানিব্যাগ বের করে আনল। রইসউদ্দিন খুব অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মতলুব মিয়া তোতলাতে তোতলাতে বলল, “কে-কে কেমন করে আ
আ আমার পকেটে এল!”
রইসউদ্দিন মেঘস্বরে বললেন”মতলুব মিয়া!”
“জে?”
“মানিব্যাগের তো পাখা নাই যে উড়ে উড়ে তোমার পকেটে চলে গেছে! নাকি আছে?”
“নাই।”
“তুমি কী উদ্দেশ্যে এইটা পকেটে ঢোকালে? আর কী উদ্দেশ্যে এই ছেলেটাকে চোর প্রমাণ করার জন্যে এত ব্যস্ত হলে?”
মতলুব মিয়া তোতলাতে লাগল, “ভাই, বি-বি-বিশ্বাস করেন, আ-আ-আমি কিছু জানি না।”
“তোমার পকেটে আমার মানিব্যাগ আর কিছু কিছু জান না?”
“খো-খো-খোদার কসম।”
“তোমার টাকার দরকার থাকে তো আমাকে বললে না কেন? আমার মানিব্যাগ কেন সরিয়ে নিলে?”
“খো-খো-খোদার কসম ভাই।”
“খবরদার মতলুব মিয়া, চুরি-চামারি করে আল্লাহ খোদার নাম টানাটানি শুরু কোরো না।”
শিউলি মুখ টিপে হেসে বলল, “আপনি কোনো চিন্তা করবেন রইস চাচা। আমরা সবসময় মতলুব চাচাকে চোখে-চোখে রাখব, মতলুব চাচা আর চুরি চামারি করতে পারবে না।”
মতলুব মিয়া বিস্ফারিত চোখে শিউলির দিকে তাকিয়ে রইল। শিউলি বলল, “রাত্রিবেলা মতলুব চাচাকে তালা মেরে রাখলে কেমন হয় রইস চাচা?”
.
ঘুমানোর সময় শিউলি বল্টুর ঘাড় ধরে বলল, “বল্টু!”
বল্টু ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ঘাড়ে কেন ধরেছ? শিউলি, ঘাড় ছাড়ো।”
“খবরদার, শিউলি বলবি তো ঘাড় ভেঙে দেব। বল শিউলি আপা।”
“ঘাড় ছাড়ো শিউলি আপা।”
“ছাড়ছি, তার আগে বল–আর কখনো চুরি করবি?”
“কখন চুরি করলাম?”
“এই যে মানিব্যাগ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরালি!”
“সেইটা কি চুরি হল? এইটা করলাম মতলুব চাচাকে টাইট দেওয়ার জন্যে।”
“ঠিক আছে, কিন্তু আর কখনো করবি না।”
“করব না।”
“বল খোদার কসম।”
“খোদার কসম।”
“বল শান্নি পীরের কসম।”
বল্টু কিছু না বলে চুপ করে রইল। শিউলি একটা ধমক দিয়ে বলল, “বল!”
বল্টু বিড়বিড় করে বলল, “শান্নি পীরের কসম।”
“এখন কাছে আয়।” বল্টু কাছে আসতেই শিউলি হ্যাঁচকা টানে তার গলার তাবিজটা ছিঁড়ে নিল। বল্টু প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “আমার তাবিজ!”
“তোর আর এই তাবিজের দরকার নাই বল্ট। তুই আর কোনোদিন চুরি করবি না।”
বল্টু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এই মেয়েটা সত্যি সত্যি তার এতদিনের ব্যবসাটার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিল। শান্নি পীরের কসম খেয়ে তাবিজ ছাড়া সে কি আর কখনো পকেট মারতে পারবে? অনেক দুঃখ নিয়ে বল্টু সেই রাতে ঘুমাতে গেল।