সমস্ত শরীর মনে হচ্ছিল অবশ হয়ে যাচ্ছে। কোমরে কাছে চিনচিনে ব্যথা ক্রমশ তীব্র ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। সে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছল। ব্যাথাটা শুরু হলেই ভীষণ ঘাম হয় ও পানির প্রবল তৃষ্ণা হয়। আজ টেবিলে পানির জগটি শূন্য। বিয়েবাড়ির ব্যস্ততার জন্যেই হয়তো রাত্রিতে পানি রেখে যেতে কারো মনে নেই। আনিস উন্টোদিকে এক শ থেকে গুনতে শুরু করল। এক শ, নিরানব্বুই, আটানব্বুই-। কোনো একটা ব্যাপারে নিজেকে ব্যস্ত রাখা, যাতে ব্যথাটা ভুলে থাকা যায়।
ঘড়িতে সাড়ে ছটা বাজে। অন্য দিন এই সময়ে টিংকু এসে পড়ে। আজ আসে নি। বিয়েবাড়ির হৈচৈ ফেলে সে যে আসবে, এরকম মনে হয় না। তবু দরজার পাশে কোনো একটা শব্দ হতেই আনিস উৎকৰ্ণ হয়ে ওঠে। না, টিংকু নয়। আবার স্লোয়ালে দিয়ে মুখের ঘাম মুছে আনিস কাৎরাতে থাকে। আশি, উনআশি, আটাত্তর, সাতাত্তির,। সাতটা বেজে গেছে। আজ তাহলে টিংকু আর এলই না।
অন্য দিন ভোর ছটার মধ্যে দরজায় ছোট ছোট হাতের থাবা পড়ত। চিনচিনে গলা শোনা যেত, আনিস, আনিস।
কী টিংকুমনি?
আমি এসেছি, দরজা খোল।
আনিসের খাটটি এমনভাবে রাখা, যেন সে শুয়ে শুয়েই দরজার হুঁক নাগাল পায়। টিংকুর সাড়া পেলেই সে দরজা খুলে দিত। দেখা যেত ঘুম-ঘুম ফোলা মুখে চার বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথাভর্তি লাল চুল। গায়ে কোনো ফ্রক নেই বলে শীতে কাঁপছে। দরজা খুলতেই সে গম্ভীর হয়ে বলবে, আনিস, তোমার ব্যথা কমেছে?
হ্যাঁ টিংকু।
আচ্ছা।
তারপর সেই লাল চুলের মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়বে বিছানায়। তার হৈচৈ-এর কোনো সীমা থাকবে না। একসময় বলবে, আমি হাতি-হাতি খেলব। তখন কালো কম্বলটা তার গায়ে জড়িয়ে দিতে হবে। একটি কোলবালিশ ধরতে হবে তার নাকের সামনে এবং সে ঘনঘন হুঁঙ্কার দিতে থাকবে। আনিস বারবার বলবে, আমি ভয় পাচ্ছি, আমি ভয় পাচ্ছি। এক সময় ক্লান্ত হয়ে কম্বল ফেলে বেরিয়ে আসবে সে। হাসিমুখে বলবে, আনিস, এখন সিগারেট খাও। টিংকু নতুন দেয়াশলাই জ্বালাতে শিখেছে, সে সিগারেট ধরিয়ে দেবে। কিন্ত আজ দিনটি শুরু হয়েছে অন্যরকম ভাবে।
আজ টিংকু আসে নি। আনিস আবার ঘড়ি দেখল। সাড়ে সাতটা বাজে। অন্য দিন এ সময়ের মধ্যে তার দাড়ি কামান হয়ে যেত। বাসি জামা-কাপড় বদলে ফেলত। ভোরের প্রথম কাপ চা খাওয়াও শেষ হত। আজ হয় নি। রাত থাকতেই যে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়েছে দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে তা যেন ক্রমেই বাড়ছে। পিপাসায় বুক-মুখ শুকিয়ে কাঠ।
খুট করে শব্দ হল দরজায়। আনিস চমকে উঠে বলল, কে, টিংকু নাকি? টিংকু? কিন্তু টিংকু আসে নি, একটি অপরিচিত ছেলে উঁকি দিচ্ছে। আনিস কড়া গলায় ধমক দিল, গেট এওয়ে, গেট এওয়ে।
ভয়ে ছেলেটির চোখে জল এসে গেল। তার পরনে স্ট্রাইপ-দেওয়া লাল ব্লেজারের শার্ট ও মাপে বড়ো একটি সাদা প্যান্ট। প্যান্ট বারবার খুলে পড়ছে, আর সে টেনে টেনে তুলছে।
আনিস ক্ষেপে গিয়ে বলল, যাও এখানে থেকে–যাও।
ছেলেটি প্যান্ট ছেড়ে দিয়ে হাত দিয়ে চোখের জল মুছল। অনেক দূর নেমে গেল প্যান্ট। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমি হারিয়ে গেছি। আম্মাকে খুঁজে পাই না।
কী নাম তোমার?
বাবু।
আনিস খাণিকক্ষণ তাকিয়ে রইল বাবুর দিকে। হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে কোমল সুরে বলল, ভেতরে এস বাবু।
বাবু সংকুচিত ভঙ্গিতে ভেতরে এসে ঢুকল। একটু ইতস্তত করে বলল, তুমি কাঁদছ কেন?
আমার অসুখ করেছে।
পেটে ব্যথা?
হুঁ।
বস তুমি চেয়ারে। তোমার আম্মাকে খুঁজে দেব! তুমি কোথায় থাক?
বাসায় থাকি।
কী নাম তোমার?
বলেছি তো এক বার।
ও, তোমার নাম বাবু। বস একটু।
আনিস তোয়ালে দিয়ে আবার কপালের ঘাম মুছল। নটা বেজে গেছে। রোদ এসেছে ঘরের ভেতরে। একটা ভ্যাপসা ধরনের গরম পড়েছে। বাসি-বিছানা থেকে এক ধরনের ভেজা গন্ধ আসছে। বাবু বসে আছে চুপচাপ, সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনিসের দিকে।
আনিস ভাই, ভিতরে আসব?
দরজার ওপাশে জরীর বন্ধুরা কৌতূহলী চোখে উঁকি দিচ্ছে। এদের মধ্যে এক রুনুকেই আনিস চিনতে পারল।
আনিস বলল, জরী আসে নি?
না। সে একতলায় আটকা পড়েছে।
জরীর গায়ে-হলুদের আয়োজন চলছে নিচে। পরীর জন্যে অপেক্ষা করতে করতেই গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠান পিছিয়ে গেল। পরীর আসবার সময় হয়েছে। তাকে আনতে স্টেশনে গাড়ি গিয়েছে।