শওকত সাহেব বারান্দায় বসেছিলেন।
আজো তাঁর খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘুম ভেঙ্গেছে পাখির ডাকে। পাখির দল যে ভোরবেলা এত হৈ চৈ করে তিনি আগে কল্পনাও করেন নি। কবিরা পাখির ডাক নিয়ে এত মাতামাতি কেন করেন তিনি বুঝতে পারছেন না। তাঁর কাছে যন্ত্রণার মত মনে হচ্ছে। তবে রাত কেটে ভোর হবার দৃশ্য অসাধারণ। শুধু মাত্র এই দৃশ্য দেখার জন্যে রোজ ভোরবেলায় ওঠা যেতে পারে।
পুষ্প চা নিয়ে ঢুকল।
শওকত সাহেব বললেন, তুমি কি রোজই এত ভোরে ওঠ, না আমার জন্যে উঠতে হচ্ছে?
পুষ্প এই কথার জবাব দিল না, আসল। মেয়েটি বুদ্ধিমতী–হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল সে রোজ এত ভোরে ওঠে না। মেয়েটি তার বাবার বকবকানির স্বভাব পায় নি–এও এক দিক দিয়ে রক্ষা। দুজনের কথা শুনতে হলে সৰ্বনাশ হয়ে যেত।
তোমার বাবা কি আছেন না স্কুলে চলে গেছেন?
স্কুলে গেছেন। আজ সকাল সকাল ফিরবেন। হাফস্কুল। বস পুষ্প, চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে গকরি।
বারান্দায় বসার কোন জায়গা নেই। একটি মাত্র চেয়ার সেখানে তিনি বসে আছেন।
শওকত সাহেব বললেন, টেবিটায় বস। আর টেবিলে যদি বসতে অসুবিধা হয় তাহলে ভেতর থেকে চেয়ার নিয়ে এসো। পুষ্প টেবিলেই বসল। তবে টেবিলটা একটু দূরে সরিয়ে নিল।
এখন বল তুমি কেমন আছ?
ভাল।
দেখে খুব ভাল মনে হচ্ছে না। রাতে ঘুম হয়নি তাই না?
পুষ্প হা সূচক মাথা নাড়ল। এই মানুষটার দৃষ্টি তীক্ষ। পুষ্প বলল, রাতে ঘুম হয়নি কি করে বুঝলেন?
চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম। রাতে ঘুম না হলে চোখের নীচ একটু কালচে হয়ে যায়। তোমার হয়েছে। তবে তুমি যদি এত ফশা না হতে হলে ধরতে পারতাম না। চা খুব ভাল হয়েছে।
আরেক কাপ দেই?
না। ভাল হয়েছে বলেই দ্বিতীয় কাপ খাব না। হয়ত দ্বিতীয়টা এত ভাল হবে না। সেই মন্দ চা খেয়ে প্রথম কাপের আনন্দ মাটি হবে। আচ্ছা এখন বল, তুমি আমার কোন লেখা পড়েছ?
একটা পড়েছি।
একটা? মোটে একটা?
জ্বি। আপনি আসবেন যখন কথা হল তখন বাবা নেত্রকোনা থেকে আপনার একটা বই কিনে আনলেন।
কোন বইটা কিনলেন?
বাবা দোকানদারকে বললেন, উনার সবচে কমদামী বই যেটা সেটাই দেন। দোকানদার একটা চটি বই দিয়ে দিল–প্রথম দিবস, দ্বিতীয় রজনী।
কমদামী বই, হলেও এটা আমার ভাল লেখার মধ্যে একটা। এই বই নিয়ে সুন্দর একটা গল্প আছে–দাঁড়াও তোমাকে বলি। বৈশাখ মাসের এক তারিখে বই বের হবার কথা। প্রকাশকের দোকানে সকাল থেকে বসে আছি। তখনতো আর আমার এত বই ছিল না—ঐটি হচ্ছে দ্বিতীয় বই। বই বেরুবে আমার আগ্রহ সীমাহীন। বাইডারের বই দেয়ার কথা সে আসছে না। দুপুরবেলা প্রকাশক বললেন, আপনি বাসায় চলে যান বই বের হলে আপনাকে বাসায় দিয়ে আসব। আমি রাজি হলাম না। এসেছি যখন বই নিয়েই যাব। বিকেল পর্যন্ত বসে রইলাম, বাইরের দেখা নেই। প্রকাশক বললেন, আপনি কাজ করুন বাইন্ডারের ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি–গিয়ে দেখুন কি ব্যাপার।
বাইন্ডারকে আওলাদ হোসেন লেনে ধরলাম। সে সবে মাত্ৰ লেই লাগাচ্ছে। আমার খুব মেজাজ খারাপ হল। বাইন্ডার বলল, কিছুক্ষণ বসেন একটা কাঁচা বই দিয়ে দেই।
সেই কিছুক্ষণ মানে চার ঘণ্টা। বাসায় ফিরলাম রাত নটার পর। বাসায় এসে দেখি–রেনুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। তার তখন নমাস চলছে। ডেলিভারী ডেটের এখনো অনেক দেরী। ব্যথা উঠে গেছে আগেই। ছুটে গেলাম হাসপাতালে। স্বাতীর জন্ম হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় তাকে মার পাশে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমার লজ্জার সীমা রইল না। আমার প্রথম বাচ্চা অথচ আমি পাশে নেই। আমার লজ্জা এবং দুঃখ স্বাতী ঠিকই বুঝল। আমার লজ্জা ঢাকার জন্যে বলল, কই দেখি তোমার বই। বাহ কি সুন্দর। বলেই শুধু মাত্র আমাকে খুশী করার জন্যে এই
অবস্থায় বইটি পড়তে শুরু করল। আমার চোখে পানি এসে গেল।
পুষ্প বলল, আপনি এত সুন্দর করে গল্পটা বললেন যে আমার চোখেই পানি এসে গেছে।
রেনু অনেক বড় ভুল করে। নানান ভাবে আমাকে কষ্ট দেয় কিন্তু ঐ রাতের ঘটনার কথা মনে হলেই ওর সব অপরাধ আমি ক্ষমা করে দেই।
যে মেয়ে ঐ রাতে এমন কাড করতে পারেন তিনি ভুল করতে পারেন না।
তাও অবশ্যি ঠিক। এখন তুমি বল, বইটা তোমার কেমন লাগল?
পুষ্প চুপ করে রইল।
শওকত সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, বইটা কি তোমার ভাল লাগেনি?
জ্বি না।
ভাল না লাগারতো কথা না। তুমি কি পড়েছু ভাল মত?
জি।
কেন ভাল লাগল না বলতে পারবে?
পারব।
তাহলে বলতো শুনি।
আপনি কি আমার কথায় রাগ করছেন?
না রাগ করছি না। আমার লেখার বিপক্ষে কঠিন কঠিন কথা আমি সব সময় শুনি। সাহিত্যের অধ্যাপকরা বলেন, পণ্ডিত ব্যক্তিরা বলেন, বিদগ্ধ জনের বলেন, তোমার মত অল্প বয়স্ক মেয়ে বলবে তা ঠিক ভাবি নি। বিশেষ করে যে আমার একটি মাত্র বই পড়েছে। এখন তুমি আমাকে বল, কেন ভাল লাগল না।
পুষ্প নীচু গলায় বলল,
বইটার মূল বিষয়টাই ভূল।
মূল বিষয়ই ভূল? কি বলছ তুমি?
ঐটি একটি প্রেমের উপন্যাস। উপন্যাসের মূল বিষয় হল ভালবাসলে ভালবাসা ফেরত দিতে হয়। আপনার বই এর চরিত্ররা তাই করেছে। কিন্তু এমনতো কখনো হয় না। মনে করুন একটা কালো, কুদর্শন মেয়ে প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে একটি রূপবান ছেলেকে ভালবাসল। সেই ছেলে কি তার ভালবাসা ফেরত দেবে? কখনো না। আপনি লিখেছেন মানুষ হচ্ছে আয়নার মত। ভালবাসার আলো সেই আয়নায় পড়লে তা ফিরে আসবে। মানুষ আয়নার মত না। আমার চেয়ে আপনি তা অনেক ভাল করে জানেন। একটা ভুল কথা লিখেছেন–কিন্তু এমন সুন্দর করে লিখেছেন যে পড়লে সত্যি মনে হয়। মন অসম্ভব ভাল হয়ে যায়।
মন ভাল হওয়াটাকে তুমি তুচ্ছ করছ কেন?
ভুল কথা বলে মন ভাল করলে সেটাকে তুচ্ছ করা কি উচিত না?
পুষ্প আমি আরেক কাপ চা খাব।
পুষ্প উঠে গেল। শওকত সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন।
পুষ্প চা নিয়ে ফিরে এল।
তিনি বললেন, থ্যাংক ইউ। বলেই হাসলেন। হাসিব অৰ্থ তুমি যা বলেছ শুনলাম। আমি রাগ করিনি। কিন্তু তিনি যে রাগ করেছেন তা ঢাকতে পারছেন
না।
স্যার আমি কি আপনার নাশতা নিয়ে আসব?
নিয়ে আস।
মেয়েটিকে প্রচণ্ড ধমক দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। বলতে ইচ্ছা করছে–শোন বোকা মেয়ে, আমি এই পৃথিবীটাকে যেমন দেখি, যেমন ভাবি তেমন করেই লিখি। সত্যিকার পৃথিবীটা কেমন তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। সত্যিকার ছবি হচ্ছে ফটোগ্রাফী। সাহিত্য ফটোগ্রাফী নয়, তৈলচিত্র। সেই তৈলচিত্রে আমি কিছু রঙ বেশী ব্যবহার করেছি। মানুষকে যেভাবে দেখতে ভালবাসি আমি সেইভাবে আঁকি। যদিও জানি মানুষ সে রকম নয়। আমি নিজেও তেমন নই। কিন্তু আমার সে রকম হতে ইচ্ছে করে। কাজেই আমি ধরে নিয়েছি অন্যদেরও তাই হতে ইচ্ছে করে। আমি মানুষের ইচ্ছের ছবি এঁকেছি।
এইসব কথার কিছুই বলা হল না। তিনি নিঃশব্দে নাশতা খেলেন। নাশতা শেষ করে লেখার টেবিলে গিয়ে বসলেন। পুষ্প পেছনে পেছনে এল।
কিছু বলবে পুষ্প?
পুষ্প নরম গলায় বলল, আপনি আমার কথায় এতটা মন খারাপ করবেন। আমি ভাবি নি। আমি অতি সামান্য মেয়ে, আমার কথার কি গুরুত্ব আছে।
আমার সহজে মন খারাপ হয় না। কঠিন আঘাতও আমি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু এই বইটির ব্যাপারে আমার এক ধরনের স্পর্শকাতরতা। আছে। লেখক হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। প্রথম বইটি প্রকাশিত হবার পর তিন বছর একটি লাইন লিখতে পারিনি। তারপর এই বইটি লিখলাম। লেখার পর মনে হল নিজের স্বপ্ন অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে। হোক না স্বপ্নটা মিথ্যা।
আপনি নিজে যদি এটা বিশ্বাস করেন তাহলে আমার উপর এত রাগ করলেন কেন?
তোমার উপর রাগ করেছি কারণ তুমি আমাকে যা বলেছে তাও কিন্তু আমি বিশ্বাস করি।
তা কেমন করে হয়?
হয়। একই সঙ্গে আমরা ভালবাসি, আবার যাকে ভালবাসি তাকে ঘৃণাও করি। তুমি সম্ভবত এখনো কারো প্রেমে পড়নি। প্রেমে পড়লে বুঝতে পারতে।
আপনি কি এখন লিখবেন?
হ্যাঁ।
লেখার সময় আমি যদি পাশে বসে থাকি আপনি কি রাগ করবেন?
আমি চাই না লেখার সময় কেউ আমার আশে-পাশে থাকে। লিখতে লিখতে প্রায়ই আমার চোখে পানি আসে। এই দৃশ্য অন্যের কাছে হাস্যকর মনে হবারই কথা।
তাহলে আমি যাই।
আচ্ছা যাও–ভাল কথা, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। Young lady, you are smart. এখন যাও আমি লেখা শুরু করি।
আজও কি দুপুরে খাবেন না?
খাব। এখানে খাবার আনতে হবে না। ঠিক দুটার সময় আমি তোমাদের ঘরে আসিব।
বিকেলে কি আমার সঙ্গে মঠটা দেখতে যাবেন?
যাব।
সত্যি যাবেন?
হ্যাঁ, সত্যি যাব।
মঠ ব্যাপারটা আসলে ইটের বিশাল স্তূপ।
বোঝা যাচ্ছে এক সময় অনেক উঁচু ছিল, এখন ভেঙ্গে একাকার হয়ে আছে। চল্লিশ পঞ্চাশ ফিটের মত উঁচু। উপরে উঠার সিড়ি আছে। মোফাজ্জল করিম সাহেবও সঙ্গে আছেন। তিনিই সবচে অবাক হলেন, এইটা কি ব্যাপার? জিনিসটা কি?
শওকত সাহেব বললেন, আপনি কখনো আসেন নি?
আসবে না কেন? এই রাস্তায় কত আনাগোনা করেছি। জঙ্গলের ভিতর কখনো ঢুকি নাই। অবশ্য শুনেছি মঠের কথা।
পুষ্প বলল, বাবা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে কেমন হয়?
করিম সাহেব আঁৎকে উঠলেন, পাগল হয়েছিস? এটা সাপের আড্ডাখানা। তার উপর বর্ষাকাল। কাছে পিছেই বেশীক্ষণ থাকা উচিত না।
শওকত সাহেব বললেন, জিনিসটা কি কেউ কি বলতে পারে? দেখতে অনেকটা বাতিঘরের মত। এই জায়গায় বাতিঘর থাকবে কেন? বৌদ্ধদের কিছু নাতো?
করিম সাহেব বললেন, না। এই অঞ্চলে কোন বৌদ্ধ নাই।
এরকম স্তূপ কি একটাই না আরো আছে?
জানি না তো।
খোঁজ নেয়া যায়?
অবশ্যই খোঁজ নেয়া যায়। স্কুলে একটা নোটিশ দিয়ে দিলেই হবে। দূর দূর থেকে ছেলেরা পড়তে আসে।
তাহলে একটা নোটিশ দিয়ে দেবেন তো? আমি খুবই অবাক হচ্ছি। জঙ্গলের ভেতর এমন বিশাল ব্যাপার দেখব আশা করিনি বলেই বোধ হয় অবাক হচ্ছি।
শীতকালে একবার আসবেন স্যার। আমি সব পরিষ্কার-টরিষ্কার করে রাখব। শীতকালে জায়গাটা এমিতেও খুব সুন্দর হয়। সোহাগী নদীর দুই ধারে কাশফুল ফোটে। আহ দেখার মত। চলেন স্যার, আজ ফেরা যাক। কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছেন।
চলুন।
আপনার জন্যে স্যার একটা ভাল খবর আছে।
বলুন শুনি।
ওসি সাহেবকে বলেছিলাম একটা বজরার ব্যবস্থা করতে। উনি খুবই করিকর্মা লোক। ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। সন্ধ্যার মধ্যে বজরা ঘাটে চলে আসবে।
শওকত সাহেব অবাক হয়ে বললেন, বজরা দিয়ে আমি কি করব?
বজরায় বসে লেখালেখি করবেন। ঘুরবেন।
আমি তো ভাই রবীন্দ্রনাথ না। আমি যেখানে আছি ভাল আছি।
সেটা তো স্যার রইলই। বজরাও রইল।
আগে আগে যাচ্ছেন করিম সাহেব, তার পেছনে শওকত সাহেব। পুষ্প এবং নৌকার মাঝি সবার পেছনে। পুষ্প নৌকার মাঝির সঙ্গে গল্প করতে করতে আসছে। চুল দুবেণী করায় তাকে খুকী-খুকী লাগছে। আজ সে সুন্দর একটা শাড়ি পরেছিল। কাদায় শাড়ির অনেকখানিই নষ্ট। কাদার দাগ উঠবে বলে মনে হয় না। শওকত সাহেব লক্ষ্য করলেন, পুষ্প মাঝির সঙ্গে ময়মনসিংহের স্থানীয় ভাষায় টেনে টেনে কথা বলছে। মাঝির মত করেই বলছে। করিম সাহেব যদিও তা করছেন না। ভাষার ব্যাপারে তিনি যে খুব সাবধান তা বোঝা যাচ্ছে।
করিম সাহেব বললেন, স্যার কি গোমাংস খান?
খাব না কেন?
অনেকে খায় না। এই জন্যে জিজ্ঞেস করছি। আমি লোক পাঠিয়েছি।
কোথায় লোক পাঠিয়েছেন?
এখানে তো স্যার গোমাংস পাওয়া যায় না। আশে-পাশে মাংসের দোকান নাই। হাটবারে গরু জবেহ হয়। আজ সেঁজুতখালির হাট। ঐখানে লোক পাঠিয়েছি।
ও আচ্ছা।
সেঁজুতখালির হাটে আজে-বাজে গরু জবেহ করে। বাছা-বাছা গরু জবেহ হয় হলদিয়া হাটে। সোমবারে হাট আছে। আমি নিজেই যাব। তবে সেঁজুতখালির হাটে মাঝে মধ্যে ভাল গোশত পাওয়া যায়–এখন দেখি আপনার ভাগ্য।
গোশত কেমন তা দিয়ে আমার ভাগ্য বিচার করবেন?
ছিঃ ছিঃ স্যার এটা কি বললেন? আমি একটা কথার কথা বলেছি।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল। উঠোনে জলচৌকি পেতে কে একজন বসে আছে। বারান্দায় একটা বেতের ঝুড়ি এবং একটা সুটকেস। যে বসে আছে তার বয়স বাইশ তেইশ। বেঁটেখাট একজন যুবক। বেশ স্বাস্থ্যবান। মনে হচ্ছে সম্প্রতি গোফ রেখেছে। গোঁফের পেছনে অনেক যত্ন এবং সাধনা। আছে তা বোঝা যাচ্ছে।
তাকে দেখেই পুষ্প দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল ওমা বাবু ভাই। বাবু ভাই তুমি কোত্থেকে?
শওকত সাহেব লক্ষ্য করলেন, বাৰু ভাই নামধারী যুবক এই উদ্যাসের প্রতি বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেখাল না। যেন সে ধরেই নিয়েছে তাকে দেখামাত্র এমন রূপবতী একটি মেয়ে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠবে।
করিম সাহেব বললেন, ও আমার দূর সম্পর্কের ভাগ্নে হয়। পুষ্পের সঙ্গে তার খুব ভাব।
শওকত সাহেব বললেন, ও আচ্ছা।
তিনি দোতলায় উঠে এলেন। রেনুকে আরেকটা চিঠি লেখা দরকার। প্রথম চিঠিটিও পাঠানো হয় নি। আশ্চর্য ব্যাপার এখানে এসে পা দেয়ার পর রেণুর কথা তাঁর মনে হয় নি। স্বাতীর কথাও না। যেন ঐ জীবন তিনি পিছনে ফেলে এসেছেন। সেখানে ফিরে যাবার আর প্রয়োজন নেই।
তিনি জানালার পাশে দাড়িয়ে আছেন। এখান থেকে কুয়োতলাটা দেখা যাচ্ছে। পুষ্প কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে–ঐ ছেলেটি কি যেন নাম–বাবু। হ্যা বাবু, বালতি বালতি পানি তুলে পুষ্পের পায়ে ঢালছে। কিছু বোধ হয় বলছেও–কারণ পুষ্প কিছুক্ষণ পর পর খিল খিল করে হেসে উঠছে। আশ্চর্য, এত আনন্দিত হয়েছে মেয়েটা? তিনি কি কখনো কাউকে এত আনন্দিত করতে পেরেছেন?
শওকত সাহেবের মনে পড়ল কাদা পায়েই তিনি তাঁর ঘরে ঢুকেছেন। সারা ঘর কাদায় মাখামাখি। তিনি ঘর ছেড়ে বাথরুমে ঢুকলেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে গা ধুলেন। কাজটা বোধ হয় ঠিক হল না। আবার জ্বর না এলে হয়।
গোসল শেষ করে ঘরে ঢুকে দেখেন ময়নাল স্কুলের দপ্তরি ইউনুস মিয়া ঘরে কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালাচ্ছে।
ইউনুস মিয়া!
জি স্যার।
কাদা-পায়ে ঘরে ঢুকে ঘরের অবস্থা কি করেছি দেখ। একটু পরিষ্কার করে দিবে?
দিতাছি স্যার।
নীচে গিয়ে পুস্পকে বলবে এক কাপ চা দিতে?
জি স্যার, বলছি।
তোমার কি মনে হয়–আজ রাতে বৃষ্টি হবে?
এইটা স্যার ক্যামনে বলব? আল্লাহতালার ইচ্ছার উপরে সব নির্ভর।
তা ঠিক।
শওকত সাহেব লেখার টেবিলে বসলেন। রেনুকে চিঠি লিখতে হবে। ভাগিস চশমার কাছে ডান হাত কাটে নি। ডান হাত কাটিলে কিছুই লিখতে পারতেন না। বা হাতে যন্ত্রণা হচ্ছে। সারাদিন এই যন্ত্ৰণা টের পাননি কেন?
কল্যাণীয়া,
রানু, প্রথম চিঠি (যা নৌকায় লেখা) তোমাকে পাঠাতে পারি নি। এর মধ্যে দ্বিতীয় চিঠি লেখা হল। দুটোই এক সঙ্গে পাঠাচ্ছি। এখানে কেমন আছি তা বলে লাভ নেই। ভাল আছি। মহাকবি বজলুর রহমান যেমন বলেছেন–বাড়ি তেমন নয় তাতো বুঝতেই পারছ। তবু খারাপ না। মোফাজ্জল করিম সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করছেন। আলাদা বাবুচির ব্যবস্থা করা যায় নি। শুরুতে বেশ কয়েকবার বলেছি–অজ পাড়াগাঁয় তা বোধ হয় সম্ভবও নয়।
এখানকার বর্ষা খুব enjoy করছি। এর মধ্যে ঝড়ের মধ্যে পড়েছিলাম। অনেকদিন পর ছেলেবেলার মত বৃষ্টিতে ভিড়লাম। সেই রাতে একটু জ্বরের মত হয়েছিল। তুমি এই খবরে আঁৎকে উঠবে না। এমন জ্বর–যা থার্মোমিটারেও মাপা যায় না। এখন তোমার বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অভিযোগ–তুমি অষ্টাঙ্গ সহ বলে একটি বই সুটকেসে ঢুকিয়ে দিয়েছ। আমার যতদূর ধারণা এইসব বই সাধু সন্ন্যাসীদের জন্যে। তুমি কি ভাবছ আমি সন্ন্যাসী হবার জন্যে এখানে এসেছি? অষ্টাঙ্গ সংগ্রহ থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। পড়লেই বুঝবে কি জিনিস পাঠিয়েছ—
যে ব্যক্তি সপ্তৰ্ষি মণ্ডলের সীমান্তে অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখতে পায় না সেই ব্যক্তি এক বৎসর পর মৃত্যু বরণ করে।
ভক্তি, সদাচার, স্মৃতি, দানশীলতা, বুদ্ধি ও বল এই ছয়টি গুণ যাহার নষ্ট হয় তাহার মৃত্যু হয় মাসের মধ্যে ঘটে।
বই পড়ার পর অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি–কাজেই ভয়ে ভয়ে আছি। ছয়টি সগুণের মধ্যে মাত্র দুটি–বুদ্ধি ও স্মৃতি এখনো আছে। এই দুটি চলে গেলে কি যে হবে কে জানে।
এতক্ষণ রসিকতা করলেও মৃত্যু নিয়ে আমি কিন্তু প্রায়ই ভাবি। এতদিন যা লিখেছি তার কিছু কি টিকে থাকবে? তীর ছেলেমেয়েরা কি পড়তে পারবে, না তার আগেই সব শেষ? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–
আমার কীৰ্তিরে আমি করি না বিশ্বাস।
জানি, কাল সিন্ধু তারে
নিয়ত তরঙ্গাঘাতে
দিনে দিনে দিবে লুপ্ত করি।
সেখানে আমি কে?
আজ এই পর্যন্তই।
পুনশ্চঃ আমার স্মৃতিশক্তি যে এখনো আছে–কবিতার চারটি চরণ লিখে তা প্রমাণ করলাম। কাজেই আরো কিছু দিন টিকে থাকব। কি সৰ্বনাশ, আসল খবর দিতে ভুলে গিয়েছি লেখা খুব ভাল এগুচ্ছে–পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি।
স্যার আপনের চা।
চা নিয়ে এসেছে। ইউনুস মিয়। শওকত সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। তিনি কি মনে মনে আশা করছিলেন পুষ্প আসবে?
ইউনুস মিয়া।
জে।
পুষ্প কি করছে?
গল্প করতেছেন।
কার সঙ্গে?
ঐ যে আসছেন বাবু ভাই।
সে কি প্রায়ই আসে?
জে আসেন।
পুষ্প গল্প করলে রান্নাবান্না কে করছে?
মতির মা চইল্যা আসেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও।
তিনি রানুর কাছে লেখা চিঠিটি আবার পড়লেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন চিঠির কোথাও পুষ্পের কথা নেই। রানু এই চিঠি পড়ে বুঝতেও পারবে না এ বাড়িতে পুষ্প নামের রূপবতী একটি মেয়ে আছে। তিনি এই কাজটি কেন করলেন? ইচ্ছাকৃতভাবে করেন নি। অবচেতন মন তাকে বাধা দিয়েছে।
স্যার আসব?
শওকত সাহেব দেখলেন দরজার কাছে বাবু দাড়িয়ে। পান খেয়ে ঠোট লাল। করে এসেছে।
আপনার সাথে পরিচয় করবার জন্য আসলাম। আপনাদের মত মানুষের দেখা পাওয়া আর হাতে আসমানের চান পাওয়া এক কথা।
আমাকে তুমি চেন?
জি না–পুষ্প আমারে বলেছে।
তাকে ভেতরে আসার কথা বলতে হল না। সে নিজ থেকেই ঘরে ঢুকে পালঙ্কে পা তুলে বসল। তার মধ্যে অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে কথা বলার প্রাথমিক সংকোচটুকুও পুরোপুরি অনুপস্থিত।
তুমি কি পড়াশোনা কর?
জি। বি, এ দিছিলাম–রেফার্ড হয়ে গেল। অবশ্য আই এ একচাপ্সে পাশ। করেছি।
এস, এস, সি এক চান্স পার নি?
জ্বি না। এস, এস, সি এক চান্সে পাশ করা খুবই কঠিন ব্যাপার। জুয়েল ছেলেমেয়েরা পারে।
তুমি নিজেকে জুয়েল মনে করে না?
আরে না। কি যে স্যার আপনে বলেন।
পাশ করার পর কি করবে চাকরি বাকরি?
চাকরি বাকরি আমারে কে দিবে? তারপরেও ধরেন যদি ভুল করে কেউ দেয় তা হইলেও তো সাড়ে সর্বনাশ।
সাড়ে সর্বনাশ কেন?
লেখাপড়া কিছুই জানি না। আই এ তে তাও কিছু পড়েছিলাম। বি, এতে কিছুই পড়ি নাই। নকলের উপর পাশ করেছি। এইবার বাইরে থাইক্যা খুব ষ্ট্যাণ্ডার্ড নকল আসছে।
তারপরেও রেফার্ড পেয়ে গেলে?
না পাইয়া উপায় কি বলেন–ঐ দিন হঠাৎ ম্যাজিষ্ট্রেট আইস উপস্থিত। সাপ্লাই বন্ধ। এই এক পেপারে আমার সর্বনাশ হইছে। অন্য গুলোয় ফিফটি ওয়ান পার্সেন্ট নম্বর আছে।
নাম্বারতো খুব ভাল পেয়েছ।
আপনারে কি বললাম স্যার খুব ষ্ট্যাণ্ডার্ড নকল ছিল এই বৎসর। ভেরি হাই স্ট্যান্ডার্ড।
পাশ করে কি করবে তা কিন্তু এখনো বলনি—
আমাদের মত ছেলেদের ব্যবসা ছাড়া গতি কি বলেন। বাবার একটা ফার্মেসী আছে নেত্রকোনা সদরে–আল মদিনা ড্রাগ ষ্টোর। ঐটা দেখাশোনা করব। আপনে স্যার আমার জন্য দোয়া রাখবেন। আপনি জ্ঞানী মানুষ। পুষ্প যে সব কথা আপনার সম্বন্ধে বলল, শুনে চোখে পানি এসে গেল।
শওকত সাহেব চুপ করে বসে রইলেন। পুষ্প তাঁর সম্পর্কে এমন কি বলতে পারে যে বাবু নামের এই ছেলের চোখে পানি এসে যায়।
পুষ্প কি বলেছে আমার সম্পর্কে?
ঐ যে স্যার ঝড়ের মধ্যে পড়লেন–তারপর ব্রেইন ডিফেক্ট হয়ে গেল–খালি উল্টাপাল্টা কবিতা! স্যার এখন তাহলে যাই। স্লামালিকুম।
তিনি সালামের উত্তর দিলেন না। উত্তর দেবার মত অবস্থা তার ছিল না। তিনি পুরোপুরি হতভম্ব।