০৪. রুনু টেবিল-ল্যাম্প জ্বলিয়ে

রুনু টেবিল-ল্যাম্প জ্বলিয়ে কী যেন একটা লিখছিল। আমাকে দেখেই হকচাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। লেখা কাগজটা সন্তৰ্পণে আড়াল করে বলল, কি দাদা?

কোথায় কি? কী করছিলি?

রুনু টেনে টেনে বলল, অঙ্ক করছিলাম। বলতে গিয়ে যেন কথা বেধে গোল মুখে। একটু বিক্ষিত হয়েই বেরিয়ে এলাম। রুনু কি কাউকে ভালোবাসার কথা লিখছে? বিচিত্র কিছু নয়। ওর যা স্বভাব, অকারণেই একে-ওকে চিঠি লিখে ফেলতে বাঁধবে না। রুনু-ঝনু দু জনেই মস্ত বড়ো হয়েছে। আগের চেহারার কিছুই অবশিষ্ট নেই। স্বভাবও বদলেছে কিছুটা। দুজনেই অকাতরে হাসে। সারা দিন ধরেই হাসির শব্দ শুনি। কিছু-না-কিছু নিয়ে খিলখিল লেগেই আছে।

ও মাগো, ঝিনুকে এই শাড়িতে কাজের বেটির মতো লাগছে! হি হি হি!

ও রুনু, দেখ দেখ, রাবেয়া আপা কী করছে, হিহিহি।

আপা শোন, আজ সকালে কি হয়েছে, আমি–হি হি হি, রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি।–হি হি হি–

আবার অতি সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কিছুক্ষণের ভেতর আবার মিটমাট। লুকিয়ে লুকিয়ে ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখা। সাজগোজের দিকে প্রচণ্ড নজর। সব মিলিয়ে বেশ একটা দ্রুত পরিবর্তন। আগের যে রুনু-ঝনুকে চিনতাম, এরা যেন সেই রুনু-ঝুনু নয়। বিশেষ করে সেই গোপন চিঠিলেখার ভঙ্গিটা খট করে চোখে লাগে।

রাবেয়া মোড়ায় বসে সোয়েটার সেলাই করছিল। তাকে বললাম, আচ্ছা, কোনো ছেলের সঙ্গে কি রুনুর চেনাজোনা হয়েছে নাকি?

রাবেয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কিটকির কথা রাতদিন ভেবে ভেবে তোর এমন হয়েছে। কিটকির চিঠি পাস নি নাকি?

না, আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। শরীফ সাহেবের ছেলেটা দেখি প্রায়ই আসে, মনসুর বোধ হয় নাম।

আসে আসুক না। যখন ন্যাংটা থাকত, তখন থেকে এ বাড়িতে এসে খেলেছে রুনু-ঝুনুর সঙ্গে।

যখন খেলেছে তখন খেলেছে। এখন রুনু-ঝনুও বড়ো হয়েছে, ও নিজেও বড়ো হয়েছে।

কি বাজে ব্যাপার নিয়ে ফ্যােচ ফ্যাচ করছিস! বেশ তো, যদি ভালোবাসাবাসি হয়, বিয়ে হবে। মনসুর চমৎকার ছেলে। ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে কোথায় যেন চাকরিও পেয়েছে।

এক কথায় সমস্যার সমাধান করে রাবেয়া সেলাই–এ মন দিল।

মন্টুন্টারও ভীষণ পরিবর্তন হয়েছে। মস্ত জোয়ান। পড়াশোনায় তেমন মন নেই। প্রায়ই অনেক রাতে বাড়ি ফেরে। কি এক কায়দা বের করেছে, বাইরে থেকেই টুকুস করে বন্ধ দরজা খুলে ফেলে।

পত্রিকায় নাকি মাঝে মাঝে তার কবিতা ছাপা হয়। যেদিন ছাপা হয়, সেদিন লজ্জায় মুখ তুলে তাকায় না। যেন মস্ত অপরাধ করে ফেলেছে এমন হাব-ভাব। চমৎকার গানের গলা হয়েছে। গানের মাস্টার রেখে শেখালে হয়তো ভালো গাইয়ে হত। মাঝে মাঝে আপন মনে গায়। কোনো কোনো দিন নিজেই অনুরোধ করি, মন্টু একটা গান কর তো।

কোনটা?

চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে।

রবীন্দ্রসংগীত না, একটা আধুনিক গাই, শোন।

বাতি নিবিয়ে দে, অন্ধকারে গান জমবে।

বাতি নিবিয়ে গান গাওয়া হয়। এবং গানের গলা শুনলেই বাবা টুকটুক করে হাজির। বাবার শরীর ভীষণ দুর্বল হয়েছে। হাঁপানি, বাত–সব একসঙ্গে চেপে ধরেছে। বিকেলবেলায় একটু হাঁটেন, বাকি সময় বসে বসে কাটে। রাবেয়া রাত অ্যাটটা বাজতেই গরম তেল এনে বুকে মালিশ করে দেয়। তখন বাবা বিড়বিড় করে আপন মনে ক–বলেন। রাবেয়া বলে, একা একা কী বলছেন বাবা?

না মা, কিছু বলছি না, কী আর বলব!

একটু আরাম হয়েছে?

হবে না কেন মা? তোর মতো মেয়ে যার আছে, তার হাজার দুঃখ-কষ্ট থাকলেও কিছু হয় না; লক্ষ্মী মা আমার। আমার সোনার মা।

আহ্‌ বাবা, কি বলেন, লজ্জা লাগে।

তাহলে থাক। মনে মনে তোর গুণ গাই।

বাবা চুপ করেন।

সবচেয়ে ছোট যে নিনু সেও দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে গেল। মার চেয়েও রূপসী হয়েছে সে। পাতলা ঠোঁট, একটু থ্যাবড়া নাক, বড়ো বড়ো ভাসা চোখ সব সময় ছলছল করছে। ঐ তো সেদিন হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াত। থ থ থ বলে আপনি মনে গান করত, আর আজ একা একা স্কুলে যায়। সাবলীল গর্বিত হাঁটার ভঙ্গি। একটু পাগলাটে হয়েছে সে। স্কুল থেকে ফিরে এসেই বই-খাতা ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে, তারপর জাপটে ধরে রাবেয়াকে।

ছাড় ছাড়, কি করিস? ছাড়।

না, ছাড়ব না। কী বাজে অভ্যেস হয়েছে তোর!

হোক।

হাত-মুখ ধুয়ে চা খা।

পরে খাব, এখন তোমাকে ধরে রাখব।

বেশ থাক ধরে।

রাবেয়া আপা।

কি?

কোলে নাও।

এত বড়ো মেয়ে, কোলে নেব কি রে বোকা।

না-না, নিতেই হবে।

তারপর দেখি নিনুরোবেয়ার কোলে উঠে। লাজুক হাসি হাসছে। আমার সঙ্গেও বেশ ভাব হয়েছে তার। রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে আমার বিছানায় উঠে এসে বালিশ নিয়ে কিছুক্ষণ দাপাদাপি করে।

কি হচ্ছে রে নিনু?

যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলছি। দাদা।

কি?

গল্প বলবে কখন?

আরো পরে, এখন পড়াশোনা কর।

না, আমি পড়ব না, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলাব।

বেশ খেলা।

তুমি খেলবে, দাদা?

না।

আস না? এই বালিশটা তুমি নাও। হ্যাঁ, এবার মার তো দেখি আমাকে?

 

রাবেয়ার আগের হাসিখুশি ভােব আর নেই। সারাক্ষণ দেখি একা একা থাকে। অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘরে বাতি জ্বলে। রাত জেগে সে কী করে কে জানে? রাবেয়াটার জন্যে ভারি কষ্ট হয়। বিয়ে করল না শেষ পর্যন্ত। মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম। হয় নি। আমি মনে-প্ৰাণে চাই তাকে হাসিখুশি রাখতে। মাঝে মাঝে বলি, রাবেয়া সিনেমা দেখবি?

না।

চল না, যাই সবাই মিলে। কত দিন ছবি দেখি না।

তুই যা রুনু-ঝনুদের নিয়ে–কত কাজ ঘরের।

যা কাজ, রুনু-ঝুনুই করতে পারবে। আয়, তুই আর আমি দু জনে যাই।

না রে, ইচ্ছে করছে না।

তাহলে চল, একটু বেড়িয়ে আসি।

কোথায়?

তুই যেখানে বলিস।

আজ থাক।

আমি অস্বস্তিতে ছট্‌ফটু করি। রাবেয়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা হয়। যেন তার মানসিক দুঃখ-কষ্টের অনেকটা দায়ভাগ আমার।

এক দিন রাবেয়া নিজেই বলল, চল খোকা, বেড়িয়ে আসি?

আমি খুশি হয়ে বললাম, চল, সারা দিন আজ ঘুরব। বল কোথায় কোথায় যাবি?

প্রথম যাব আমার এক বন্ধুর বাসায়। একটা রিক্সা নে!

রিক্সা যে-বাড়ির সামনে থামল, তা দেখে চমকালাম। রাজপ্রসাদ নাকি? বাড়ির সামনে কি প্রকাণ্ড ফুলের বাগান! আমি বললাম, রাবেয়া, তুই ঠিক জায়গায় এসেছিস তো? কার বাড়ি এটা?

আবিদ হোসেনের, ঐ যে ছোটবেলায় আমাকে গাড়িতে করে স্কুলে পৌঁছে দিত।

বাসা কী করে চিনলি?

এসেছিলাম তো তাঁর সঙ্গে বাসায়।

 

আবিদ হোসেন বাসায় ছিলেন না। এক জন বিদেশিনী মহিলা খুব আন্তরিকভাবে আমাদের বসতে বললেন। কী দরকার, বারবার জিজ্ঞেস করলেন। চমৎকার বাংলা বলেন তিনি।

রাবেয়া বলল, কোনো প্রয়োজন নেই। এমনি বেড়াতে এসেছি। ছোটবেলায় তিনি আমার খুব বন্ধু ছিলেন।

ভদ্রমহিলা কফি করে খাওয়ালেন। বেরিয়ে আসবার সময় মস্ত বড়ো বড়ো কটি গোলাপ তুলে তোড়া করে দিলেন রাবেয়ার হাতে। এক জন অপরিচিত বিদেশিনীর এমন ব্যবহার সত্যিই আশা করা যায় না।

রাবেয়া বেরিয়ে এসে বলল, চল খোকা, এই ফুলগুলি মার কবরে দিয়ে আসি। এই তিনটা দিবি তুই, বাকি তিনটা দেব আমি। আয় যাই।

 

বেশ কেটে যাচ্ছে দিন। কিটকির চিঠি হঠাৎ মাঝে মাঝে এসে পড়ে। কেমন আছেন ভালো আছি গোছের। একঘেয়ে জীবনের মধ্যে এইটুকুই যেন ব্যতিক্রম। হঠাৎ করে। এক দিন সবার একঘেয়েমী কেটে গেল। মনসুরের বাবা এক সন্ধ্যায় বেড়াতে এসে অনেক ভণিতার পর বাবাকে বললেন, আপনার মেয়ে রুনুকে যদি দেন। আমাদের কাছে, বড়ো খুশি হই। মনসুরের নিজের খুব ইচ্ছা। মনসুরকে আপনি ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন। চাকরিও পেয়েছে চিটাগাং স্টীল মিলে, নয় শ টাকার মতো বেতন, কোয়ার্টার আছে। তা ছাড়া আপনার মেয়েরও মনে হয় কোনো অমত নেই।

বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। বারোই আশ্বিন বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল। এক মিনিটে বদলে গেল। সারাটা বাড়ি। বাবার সমস্ত অসুস্থতা কোথায় যে পালাল! বিয়ে নিয়ে এর সঙ্গে আলাপ করা, ওর কাছে যাওয়া, বাজারের হাল অবস্থা দেখা, মেয়েকে কী দিয়ে সাজিয়ে দেবেন। সে সম্বন্ধে খোঁজ নেওয়া–এক মুহূর্ত বিশ্রাম রইল না তাঁর।

মন্টু তার বন্ধুদের নিয়ে এসে সারাক্ষণই হৈচৈ করছে। গেট কোথায় হবে, ইলেকটিকের বাম্বে সাজান হবে কি না, কার্ড কয়টি ছাপাতে হবে, নিমন্ত্রণের ভাষাটা কী রকম হবে, এ নিয়ে তার ব্যস্ততা প্রায় সীমাহীন। রাবেয়াকে নিয়ে আমি কেনাকাটা করতে প্ৰায় প্রতিদিনই বেরিয়ে যাই। ঝুনুটা সারাক্ষণ আহাদী করে বেড়ায়। শীতের শুরুতে ঠাণ্ডা আবহাওয়াতে এমনিতেই একটু উৎসবের ছোঁয়াচ থাকে, বিয়ের উৎসবটা যুক্ত হয়েছে তার সাথে।

রুনুর চাঞ্চল্য কমে গেছে। হৈচৈ করার স্বভাব মুছে গেছে একেবারে। সারা দিন শুয়ে শুয়ে গান শোনে। একটু যে কোথাও যাবে, আমাদের সঙ্গে কিংবা বাইরের বারান্দায় এসে বসবে।–তাও নয়। দুপুরটা কাটায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে–বড় ভালো লাগে দেখে। যদি বলি, কিরে রুনু, বিয়ের আগেই বদলে গেছিস দেখি।

যাও দাদা, ভালো লাগে না।

তোর চিটাগাং-এর বাড়িতে বেড়াতে গেলে খাতির-যত্ন করবি তো?

না, করব না। তোমাকে বাইরে দাঁড়া করিয়ে রাখব।

রুনুর চোখ জ্বলজ্বল করে। সারা শরীরে আসন্ন উৎসবের কী গভীর ছায়া। মনসুর দেখি প্রায়ই আসে। এক দিন সিনেমার টিকেট নিয়ে এল রুনু-ঝনুর জনে}। রুণু কিছুতে যাবে না। রুনু বলে, নিনুকে নিয়ে যাক। নিনুও যাবে না, আমার জন্যে তো আনে নি। আমি কেন যাব?

এই বয়সেই পাকা পাকা কথা।

এক দিন সে মনসুরের সঙ্গে হেসে হেসে সারা দুপুর গল্প করেছে, আজকে তার সাড়া পেলেই রুনু বন্দী হয়ে যায় নিজের ঘরে। রাবেয়া হেসে হেসে বলে, বেচারা বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঝি ধরিয়ে ফেলেছে, রুনু যা, বেচারাকে দর্শন দিয়ে আয়।

থাকুক বসে, আমি যাচ্ছি না।

কোন যাবি না?

রোজ রোজ বেহায়ার মতো আসবে, লজ্জা লাগে না বুঝি?

ঝুনু আর নিনুকে নিয়ে গল্প করে বেচারা সময় কাটায়।

 

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে পড়ল। বাবার দু জন ফুফু এলেন, তাঁর চাচাত ভাইও ছেলে-মেয়ে নিয়ে এলেন। বাড়ি লোকজনে গমগম করতে লাগল। মন্টু কোথেকে একটি রেকর্ড-প্লেয়ার এনেছে। সেখানে তারস্বরে রাত-দিন আধুনিক গান হচ্ছে। ফুফুর ছেলেমেয়ে কটির হল্লায় কান পাত যাচ্ছে না, আশেপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরাও যোগ দিয়েছে তাদের সঙ্গে। পাড়ার ছেলেরা নিজেরাই বাঁশ কেটে ম্যারাপ বাঁধার যোগাড় করছে। বেশ লাগছে। উৎসবের নেশা-ধরান আমেজ। কলেজ থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে নিলাম।

তিন দিন পর বিয়ে। দম ফেলার ফুরসৎ নেই। দুপুরের ঘুম বিসর্জন দিয়ে কিসের যেন হিসেব কষছি। রাবেয়া পাশেই বসে। রুনু, ঝানু আর ফুফুর দু মেয়ে লুড় খেলছে বসে বসে। বাবা গেছেন নানার বাড়ি। নিনুটা এল এমন সময়। হাসিমুখে বলল, দাদা, তোমাকে ডাকে।

কে?

নতুন দুলাভাই ইঞ্জিনীয়ার সাহেব।

রুনু লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। রাবেয়া বলে বসে, আহা, বেচারার আর তর সইছে না। আমি স্যাণ্ডেল পায়ে নিচে নামি। বসার ঘরে মনসুর মুখ নিচু করে বসে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার ভাই? কিছু বলবে?

ঝুনু দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতে লাগল। মনসুর বলল, আপনি যদি একটু বাইরে আসেন, খুব জরুরী।

আমি চমকে উঠলাম। কিছু কি হয়েছে। এর মধ্যে?

ঘরে না, আসেন ঐ চায়ের দোকানটায় বসি।

মনুসুরের মুখ শুকনো! চোখের নিচে কালি পড়েছে। অপ্রকৃতস্থের মতো চাউনি। চায়ের দোকানে বসে সে কাশতে লাগল। আমি বললাম, কী ব্যাপার, খুলে বল।

এই চিঠিটা পড়েন একটু।

গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। আধপাতার একটা চিঠি। সবুজ নামে একটি ছেলেকে লেখা। সবুজের সঙ্গে সে সিনেমায় যেতে পারবে না। বাসার সবাই সন্দেহ করবে। রুনুই লিখেছে মাস তিনেক আগে। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

কই পেয়েছ এই চিঠি?

সবুজ কাল রাতে আমাকে দিয়ে গিয়েছে।

ও।

কথা বলতে আমার সময় লাগল। আর বলবই-বা কী?

শুকনো গলায় বললাম, আমাকে কী করতে বল? বিয়ে ভেঙে দিতে চাও?

না-মানে এত আয়োজন, এত কিছু, মানে–

তুমি কি রুনুর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চাও?

না-না, কী বলব আমি?

তবে?

আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে ঝুনুকে আমি বিয়ে করতে পারি।

সে কী করে হয়! সব করা হয়েছে রুনুর নামে। আজ হঠাৎ করে…

আপনি ভালো করে ভেবে দেখুন, তা হলে সব রক্ষা হয়।

সব দিক রক্ষার তেমন দরকার নেই। একটা মেয়ে একটা চিঠি লিখে ফেলেছে। এই বয়সে খুব অস্বাভাবিক নয় সেটা।

সবুজ আমাকে আরো বলেছে।

কী বলেছে?

না, সে আমি আপনাকে বলতে পারব না।

সে তো মিথ্যা কথাও বলতে পারে।

আপনি বরঞ্চ ঝুনুর সঙ্গে-

না।

আমি তাহলে রুনুর সঙ্গে একটা কথা বলি।

না। রুনুকে আর কী বলবে? যা বলবার আমিই বলব।

 

আমি রুনুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলাম না। আসন্ন উৎসবের আনন্দ তার চোখে-মুখে। সমস্ত ব্যাপারটার জন্যে রুনুকেই দায়ী করা উচিত। কিন্তু কিছুতেই তা পারছি না। রুনুকে আমি বড়ো ভালোবাসি। এ ঘটনাটা তাকে এক্ষুণি জানান উচিত। কিন্তু কী করে বলব, ভেবে বুক ভেঙে গেল। রাবেয়াকেই জানালাম প্রথম। রাবেয়া প্রথমটায় হকচাকিয়ে গেল। শেষটায় কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। রাবেয়া বড়ো শক্ত ধাঁচের মেয়ে, চোখে পানি দেখেছি খুব কম।

রাবেয়া বলল, তুই রুনুকে সমস্ত বল। ওকে নিয়ে বাইরে কোথাও বেড়াতে যা। বাবাকে আমি বলব।

রুণুকে এক চাইনীজ রেস্তোরায় নিয়ে গেলাম। ফ্যামিলি কেবিনে তার মুখোমুখি বসে আমার গভীর বেদনা বোধ হচ্ছিল। রুনুই প্রথম কথা বলল, দাদা, তুমি কি কিছু বলবে? না শেষ বারের মতো ভালো খাওয়াবে?

না রে, কিছু কথা আছে।

বুঝতে পারছি, তুমি কী বলবে।

বল ত?

তুমি কিটকির কথা কিছু বলবে, তাই না?

না। কিটকির কথা নয়। আচ্ছা রুনু ধর–তোর বিয়েটা যদি ভেঙে যায় কোনো কারণে? মনে কর বিয়েটা হল না।

এসব বলছ কেন দাদা, কী হয়েছে?

তুই সবুজ নামে কোনো ছেলেকে চিঠি লিখেছিলি?

রুনু বড়ো বড়ো চোখে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে বলল, হ্যাঁ, লিখেছিলাম। তার জন্য কিছু হয়েছে?

হ্যাঁ, মনসুর তোকে বিয়ে করতে চাইছে না।

কী বলে সে?

সে ঝুনুকে বিয়ে করতে রাজি।

রুনু চেষ্টা করল খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে; কিন্তু মানুষের মন ভেঙে গেলে সে আর যাই পারুক, স্বাভাবিক হতে পারে না। খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে রুনু সিনেমার কথা তুলল, কোন বন্ধু এক কবিকে বিয়ে করে রোজ রাতে এক গাদা আধুনিক কবিতা শুনছে, সেকথা খুব হেসে হেসে বলতে চেষ্ট করল, ঝুনু কেন যে এত মোটা হয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করল। এবং এক সময় খাবারটা এত ঝাল বলে রুমাল বের করে চোখ মুছতে লাগল। আমি চুপ করে বসে রইলাম। রুনু ধরা গলায় বলল, দাদা, তুমি মন খারাপ করো না। তোমার মন খারাপ দেখলে আমি সত্যি কেঁদে ফেলব।

আমি বললাম, কোথাও বেড়াতে যাবি রুনু?

কোথায়?

সীতাকুন্ড যাবি? চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে দূরের সমুদ্র খুব সুন্দর দেখা যায়।

রুলু কাতর গলায় বলল, যাব দাদা, কবে নিয়ে যাবে?

চল, কালই যাই।

না, ঝুনুর বিয়ের পর চাল।

ঝুনুর সঙ্গে এই ছেলের বিয়ে আমি হতে দেব না।

তুমি বুঝতে পারছ না। দাদা–

খুব বুঝছি।

বিয়ে হলে ঝুনু খুশি হবে।

হোক খুশি, এই নিয়ে আমি আর কোনো কিছু বলতে চাই না রুনু।

রুনুকে নিয়ে বের হয়ে এলাম। তখন সন্ধ্যা উৎরে গেছে। রাতের নিয়ন আলো জ্বলে গেছে দোকানপাটে। ঝকঝকি করছে আলো। রুনু খুব ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে লাগল। আমি তাকে কী আর বলি!

 

বারোই আশ্বিন ঝুনুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল মনসুরের।

বাবা আর রাবেয়ার প্রবল মতের সামনে টিকতে পারলাম না। ঝুনু বেশ অবাক হয়েছিল। তাকে কিছু বলা হয় নি, তবে সে যে আঁচ করতে পেরেছে।–তা বোঝা যাচ্ছিল। ঝানু যতটা আপত্তি করবে মনে করেছিলাম, ততটা করে নি দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। আত্মীয়স্বজনরা কী বুঝল কে জানে, বিশেষ উচ্চবাচ্য করল না। শুধু মন্টু বিয়ের আগের দিন বাসা ছেড়ে চলে গেল। তার নাকি কোথায় যাওয়া অত্যন্ত শুয়োজন, বিয়ের পর ফিরবে। বাবা স্থবির আলস্যে ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে সিগারেট টানতে লাগলেন।

 

বিয়েতে রুনুটা আহ্লাদ করল সবচেয়ে বেশি। গান গেয়ে গল্প বলে আসর জমিয়ে রাখল। তার জন্যে ফুফুর ফাজিল মেয়েটা পর্যন্ত ঢং করার সুযোগ পেল না। আসর ভাঙল অনেক রাতে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মেয়েরা আড়ি পেতেছে বাসরঘরে। বরযাত্রীরা হৈচৈ করে করে তাস খেলছে। সারা দিনের পরিশ্রমে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে রুনুর ঘরে এসে দাঁড়ালাম। টেবিল ল্যাম্পে শেড দিয়ে রেখেছে। ঘরে আড়াআড়িভাবে একটা লম্বা ছায়া পড়েছে আমার। রুনুর মুখ দেখা যাচ্ছে না। এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা তার অবসান শরীর চুপচাপ পড়ে আছে। আমি নিঃশব্দে বসলাম রুনুর পাশে। রুনু চমকে উঠে বলল, কে? ও, দাদা। কখন এসেছে? কী হয়েছে?

না, কিছু হয় নি। ভাবলাম তোর সঙ্গে একটু গল্প করি।

রুনু অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হঠাৎ করেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, তোমার গা ছুঁয়ে বলছি দাদা, আমার একটুও খারাপ লাগছে না। আমি বেশ আছি।

সবুজকে বিয়ে করবি রুনু?

ন্‌-না। ছিঃ!

না কেন?

না-কক্ষনো না, ওটা একটা বদমাশ!

তবে যে চিঠি লিখেছিলি?

এমনি, তামাসা করতে, ও যে লিখত খালি খালি।

আয় রুনু, বাইরে হাঁটি একটু দেখ কি জোছনা

রুনু জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সত্যি অপরূপ জোছনায় সব যেন ভেসে যাচ্ছে। চারদিক চিকচিক করছে নরম আলোয়। আপনাতেই মনের ভেতর একটা বিষন্নতা জমা হয়। আমি বললাম, এটা কী মাস বল তো রুনু।

অক্টোবর মাস।

বাংলা বল।

বাংলাটা জানি না। ফাল্গুন?

না, আশ্বিন। আশ্বিন মাসে সবচেয়ে সুন্দর জোছনা হয়। আয়, বাইরে গিয়ে দেখি।

ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াতেই মন জুড়িয়ে গেল। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। ফুটফুটে জোছনা চারদিকে। সব কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়। বড়ো ভালো লাগে।

ওটা কে দাদা? ঐ যে চেয়ারে বসে?

তাকিয়ে দেখি কে যেন ইজিচেয়ারে মূর্তির মতো বসে আছে। একটা হাত অবসান্নভাবে ঝুলছে। অন্য হাতটি বুকের উপর রাখা। বসে থাকার সমস্ত ভঙ্গিটাই কেমন দীন-হীন, কেমন দুঃখী। আমি বললাম, ও হচ্ছে রাবেয়া। চিনতে পারছিস না?

না তো। চল, আপার কাছেন যাই।

না, ও থাকুক একা একা। আয়, এদিকে আয়।

রুনু হাঁটতে হাঁটতে আমার একটা হাত ধরল। ছোটবেলায় যেমন করত, তেমনিভাবে হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করতে করতে হালকা গলায় বলল, দাদা, তোমরা কি আমার ওপর বিরক্ত হয়েছ?

কেন?

চিঠি লিখেছি বলে?

তোর কী মনে হয়?

রুনু কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটতে থাকল! আমি খুললাম, রুনু, ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে?

কোন কথা?

তুই যে এক দিন পালিয়েছিলি?

ও মনে আছে। ঝানু একটা কাপ ভেঙে ফেলেছে। ভেঙেই দৌড়ে পালাল, আর আম্মা এসে আমার গালে ঠাস করে এক চড়!

রুনু বলতে বলতে হাসতে লাগল। আমি বললাম, তারপর কি ঝামেলায় পড়লাম সবাই। তোর কোনো খোঁজ নেই। সকাল গেল, দুপুর গেল, সন্ধ্যা গিয়ে রাত, তবু তের খবর নেই। বাসায় খাওয়াদাওয়া বন্ধ। বাবা সারা দিন খুঁজেছেন। এখানে ওখানে। আড়ালে আড়ালে চোখের পানি ফেলেছেন। আমি থানায় খবর দিতে গেছি। মা কিন্তু বেশ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয় নি। আর ঝুনুটা করল কি, সন্ধ্যাবেলায় রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে ভেউ ভেউ করে সে কী কান্না। কোনোমতে বলল, আপা আমিই ভেঙেছি কাপটা, রুনু ভাঙে নি!

তোর সব মনে আছে রুনু?

খুব মনে আছে। আমি চুপচাপ বসে আছি ছাদে। তোমরা তো কেউ ছাদে খুঁজতে আস নি। সারা দিন একা এক বসেছিলাম। রাত হতেই ভূতের ভয়ে নেমে এসেছি।

তারপর কী হল বল তো রুনু?

আরেকটা চড় খেলাম।

চড়টা কে দিয়েছিল মনে আছে?

হ্যাঁ, তুমি।

সশব্দে দু জনে হেসে উঠলাম।

কে? কে হাসছে?

তাকিয়ে দেখি রাবেয়া টলতে টলতে আসছে।

ও তোরা। বেশ ভয় পেয়েছি। হঠাৎ করে হাসলি। ধক করে উঠছে বুকটা।

বস রাবেয়া, গল্প করি।

না, ভোর হয়ে আসছে দেখছিস না। সবাই চা-টা খাবে। এত মানুষের ব্যাপার, আমি রান্নাঘরে যাই।

চল আপা, আমিও যাই।

আমি একা একা বসে রইলাম।

ভোরের কাকের কা-কা শোনা যাচ্ছে। আকাশ ফর্সা হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে।

বুঝতে পারছি মনের ভেতর জমে থাকা অবসাদ কেটে যাচ্ছে। ঠিক ভোর হবার মুহূর্তে মনের গ্লানি কেটে যায়। সুন্দর সুখের স্মৃতিগুলি ফিরে আসে। কিটকি লিখেছে, ‘গতকাল নৌকায় করে ৬ মেইল উত্তরের ক্যানসি সিটিতে গিয়েছিলাম বেড়াতে। ওমা! আমাদের দেশের ময়লা ঘিঞ্জি চাঁদপুরের মতো দেখতে। এটিকে আবার বাহার করে বলা হচ্ছে সিটি। শহরটা বাজে, বমি আসে। কিন্তু শহর থেকে বেরুলেই চোখ ভরে ওঠে। নীল সমুদ্র, নীল নীল পাহাড়, ঘন নীল আকাশ। উহ্‌, কী অদ্ভুত! আপনি যদি আসতেন, তাহলে খুব ভালো লাগত আপনার। সত্যি বলছি।

 

আই. এ পরীক্ষায় রুনু ফেল করল।

বেশ অবাক হলাম। আমরা। পড়াশোনায় আমার সব ভাইবোনই ভালো। রুনু নিজে সাত শর উপর নম্বর পেয়ে ম্যাটিক পাশ করেছিল। অঙ্কে আর ভূগোলে লেটার মার্ক ছিল। পরীক্ষায় একেবারে ফেল করে বসবে, এটা কখনো ভাবা যায় না। কাগজে তার রোল নাম্বার যখন কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না এবং রোল নম্বরটি পাওয়া যাবে না এটিও ধারণা করতে পারছি না, তখন রুনু বলল, খুঁজে লাভ হবে না দাদা, আমি ফেল করেছি।

ফেল করবি কেন?

খাতায় যে কিছুই লিখি নি। ইতিহাসের খাতায় সম্রাট বাবরের ছবি এঁকে দিয়ে এসেছি।

কার ছবি?

সম্রাট বাবরের।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। রুনু অবশ্যি বদলে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিবর্তনটা এত ধীর গতিতে হচ্ছিল যে আমি ঠিক ধরতে পারিনি। হয়তো বই নিয়ে পড়তে বসেছে, আমি যাচ্ছি পাশ দিয়ে–হঠাৎ ডাকল, দাদা, শোন একটু।

কি?

মানুষের গোস্ত যদি বাজারে বিক্রি হত তাহলে তোমার গোস্ত হত সবচে সস্তা, তুমি যা রোগ।

এই জাতীয় কথাবার্তা রুনু আগে বলত না। কিংবা আরেকটি উদাহরণ ধরা যাক।

এক দিন রাবেয়াকে গিয়ে সে বলছে, আপা, একটা কথা শুনবে?

বল।

তোমার মাথাটা কামিয়ে ফেলবো?

রাবেয়া বিস্মিত হয়ে বলল, কেন রে?

এমনি বলছি। ঠাট্টা করছি।

রুনুর এ জাতীয় কথাবার্তা কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। রুনু বদলে যাচ্ছিল। কথাবার্তা কমিয়ে দিচ্ছিল। অথচ তার মতো হৈচৈ করা মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। বাসায় যতক্ষণ আছে, গুনগুন করে গান গাইছে। রেডিও ক্যানের কাছে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়! সিনেমার তো কথাই নেই, প্রতি সপ্তায় দেখা চাই। তার হাতে টাকা পড়তে না পড়তে ধোঁয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে। যখনই দেখতাম রাতের খাওয়ার পর রুনু আমার ঘরে ঘুরঘুর করছে কিংবা আমার টাকায় প্রয়োজন।

কি রে রুনু, টাকা দরকার?

ন্‌-না।

সেদিন যে দশ টাকা দিলাম, খরচ করে ফেলেছিস?

হুঁ,

আরো চাই?

ন্‌-না।

আচ্ছা আচ্ছা, প্যান্টের পকেটে হাত দে, মানি ব্যাগ পেয়েছিস? খোল। নে একটা নোট, নিয়ে যা! আরে আরে, দশ টাকারটাই নিলি? ডাকাত একেবারে! রুনু খিলখিল হেসে পালিয়ে যায় দ্রুত।

সেই রুনু এমন বদলে গেল। আমরা কেউ বুঝতেই পারলাম না। পরীক্ষার রেজাল্ট শুনে তার কোনোই ভাবান্তর নেই। সেদিন শুনি জানালা দিয়ে মুখ বের করে ওভারশীয়ার চাচাকে বলছে, ও চাচাজি, শুনছেন?

কি মা?

কি রেজাল্ট?

আমি ফেল করেছি। চাচাজি।

একমাত্র বাবাই রুনুকে ধরতে পেরেছিলেন। প্রায়ই বলতেন, রুলুটার কি কোনো অসুখ করেছে? এমন দেখায় কেন? এক দিন রুনিকে আসমানী রঙের একটি চমৎকার শাড়ি এনে দিলেন। সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত মন ভালো থাকবে বলে পাঠালেন। ঝুনুর কাছে।

ঝুনুর বাসা থেকে ফিরে এসেই রুনু অসুখে পড়ল। প্রথমে একটু জ্বর-জ্বর ভাব, সর্দি, গা ম্যাজম্যাজ। শেষটায় একেবারে শয্যাশায়ী।

এক দিন দু দিন করে দিন পনের হয়ে গেল, অসুখ আর সারে না। ডাক্তার কখনো বলে দুর্বলতা, কখনো বলে রক্তহীনতা, কখনো-বা লিভার টাবল। সঠিক রোগটা আর ধরা পড়ে না।

রাতে সে বড়ো ঝামেলা করে। নিজে একটুও ঘুমোয় না, কাউকে ঘুমুতেও দেয় না। রাবেয়া প্রায় সারা রাত জেগে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, গল্প পড়ে শোনায়, পিঠ চুলকে দেয়। অনেক রাতে যখন রাবেয়া বলে, আমি একটু শুই, রুনু?

না-না, শুলেই তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।

তোর বালিশে একটু মাথাটা রাখি, ভীষণ মাথা ধরেছে।

উঁহু, তুমি বরং এক কাপ চা খেয়ে আসা। ঘুমুতে পারবে না।

খোকাকে ডাকি, ও বসবে তোর পাশে।

না, তুমি বসে থাকবে।

কলেজ থেকে ফিরে আমি এসে বসি রুনুর পাশে।

কি রে, জ্বর কমেছে।

হা, কমেছে?

কপালে হাত দিয়েই প্রবল জ্বরের আচা পাই। রুনু ঘোলাটে চোখে তাকায়। আমি বলি, বেশ জ্বর তো! কি রে, খারাপ লাগে?

না, লাগে না।

মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?

দাও।

চিটাগাং ভালো লেগেছিল রুনু?

হুঁ।

সমুদ্র দেখতে গিয়েছিলি?

না।

আচ্ছা, এক বার তোদের সবাইকে নিয়ে সমুদ্র দেখতে যাব। কক্সবাজারে হোটেল ভাড়া করে থাকব। খুব ফুর্তি করব, কি বলিস?

হুঁ করব।

জ্বরের ঘোরে রুনু ছটফট করতে লাগল। হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বলে উঠল, দাদা, ঝুনু এখন আর আমাকে একুটুও দেখতে পারে না।

কেন দেখতে পারে না?

কী জানি কেন। আমার সঙ্গে কথা বলে নি। কিন্তু আমার কী দোষ?

রুনুর জ্বর বাড়তেই থাকে। মন্টু চলে যায় ডাক্তার আনতে। রুনু আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে থাকে। ভাত খেতে খেতে রাবেয়া বলে, খোকা শোন, তোকে একটা কথা বলি?

কী কথা?

রুনুটা বাঁচবে না রে!

কী বলছিস আরোল-তাবোল!

আমার কেন জানি শুধু মনে হচ্ছে। কাল রাতে রুনুর জন্যে গরম পানি করে নিয়ে গেছি, দেখি ওর মাথার পাশে কে এক জন মেয়ে বসে আছে।

কী বলছিস এ সব!

হ্যাঁ সত্যি। কে যে বসে ছিল, ঠিক বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, তিনি মা। অল্প কিছুক্ষণের জন্যে দেখেছি।

যত সব রাবিশ।

না রে, ঠিকই। আমি ভয় পেয়ে বাবাকে ডেকে আনি।

বাবাকে বলেছিস কিছু?

না, বলি নি।

দেখতে দেখতে রুনুর জ্বর খুব বাড়ল। ছটফট করতে লাগল সে। ডাক্তার এসে দুটি ইনজেকশন করলেন। মাথায় পানি ঢালতে বললেন। জ্বরের ঘোরে রুনু ভুল বকতে লাগল, বেশ করেছেন আপনি! হ্যাঁ, বেশ তো। ঠিক আছে ঠিক আছে!

কী বলছিস রুনু?

রুনু স্বাভাবিক মানুষের মতো বলল, কই দাদা, কিছু বলছি না তো। রাবেয়াকে বলল, আপা এক গ্লাস পানি আন। কানায় কানায় ভরা থাকে যেন। আমি সবটা চুমুক দিয়ে খাব।

রুনু এক চুমুক পানি খেল। খুব স্বাভাবিক গলায় ডাকল, বাবা।

এই তো আমি। কী মা?

একটু কোলে নেন না।

বাবা রুনুকে কোলে নিলেন। বাবার পা কাঁপছিল। আমি বাবার একটা হাত ধরলাম। রুনুটা এই কদিনে ভীষণ রোগা হয়েছে। বাবার পিঠের ওপর তার দুটি শীর্ণ হাত আড়াআড়ি ঝুলছে। রুনু বলল, বাবা বাইরে চলেন। বাইরে যাব।

সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। সে রাতে–খুব জোছনা হয়েছিল। জামগাছের পাতা চিকচিক করছিল জোছনায়। উঠোনে চমৎকার সব নকশা হয়েছিল গাছের পাতার ছায়ায়। রুনু ফিসফিস করে বলল, বাবা, কাল রাতে আমি মাকে দেখেছি। মা আমার মাথার পাশে এসে বসেছিলেন। আমি কি মারা যাচ্ছি। বাবা?

না মা, ছিঃ! মারা যাবে কেন?

তোমরা কি রাগ করেছ আমার ওপর?

রাগ করব কেন? মিষ্টি মা আমার।

বাবা চুমু খেলেন রুনুর পিঠে। রুনু বলল, আমি য়ে আরেকটি ছেলেকে চিঠি লিখেছিলাম।

রাবেয়া রুনুকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবা আর মন্টু গেছে ডাক্তার ডেকে আনতে। রুনু চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তার ফর্সা সরু আঙুল থরথর করে কাঁপছে। সবাই বুঝতে পারছি, রুনু মারা যাচ্ছে… ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *