০৪. রিকশা যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত যাবে না

আমার এই রিকশা নিশ্চয়ই যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত যাবে না। তবু একবার জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। আমি বললাম, এই, যাত্রাবাড়ি যাবে?

না।

না কেন? যাত্রাবাড়িতে অসুবিধা কি?

যামু না—যামু না। ব্যাস ফুরাইল।

এত সহজে ফুরালে তো হবে না। কেন তুমি যাবে না সেটা বল।

রিকশাওয়ালা রিকশা থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। লোকটা বয়সে সম্ভবত আমার বাবার কাছাকাছি। তাকাচ্ছেও আমার বাবার মতো করে, যেন আমার আচরণে মৰ্মাহত। আমাকে নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। রাগে যে সে কাঁপছে তা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। এক জন মানুষকে রাগিয়ে-রাগিয়ে ব্ৰেকিং পয়েন্টে নিয়ে যাওয়ার একটা আলাদা মজা আছে। আমি অনেকটা সময় নিয়ে সিগারেট ধরালাম। কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়লাম এবং বরফ-শীতল গলায় বললাম, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ কেন? বল, তুমি কেন যাবে না?

রিকশা বদলির টাইম হইছে।

ও, এই ব্যাপার। আমি ভাবলাম আমাকে বোধহয় তোমার পছন্দ হচ্ছে না, এই জন্যে যেতে চাচ্ছ না। আচ্ছা এখন বল রিকশা বদলির কথাটা তুমি আগে কেন বললে না।

কি কইলেন?

রিকশা বদলির টাইম হয়েছে এই কথাটা তুমি আগে কেন বললে না। আগে বলতে কি অসুবিধা ছিল?

এমুন করতাছেন ক্যান ভাইজান? আমি আপনেরে কী করছি?

লোকটির গলা শুনে মনে হল সে এক্ষনি কেটে ফেলবে। এই শ্রেণীর লোকরা ব্ৰেকিং পয়েন্টে এসে রুখে দাঁড়ায়। এর বেলায় অন্যরকম হচ্ছে। এ কেঁদে ফেলতে যাচ্ছে। শহরের খাঁটি রিকশাওয়ালা সে এখনো হয়ে ওঠে নি। হয়তো কিছুদিন আগেও পান্তাভাত খেয়ে সূর্য ওঠার আগে জমি চাষ করতে যেত। এর গায়ে এখনো শস্যের গন্ধ লেগে আছে। আমি রিকশা থেকে নেমে পকেটে হাত দিলাম। তাপ্পি মারা নোট, না তাকে আমি চকচকে নোটই দেব। যা ন্যায্য ভাড়া, তার সঙ্গে বকশিশ হিসেবে দুটি টাকা ধরে দেব।

রিকশাওয়ালা ভাড়া নিল না। পকেট থেকে হাত বের করবার আগেই সে দ্রুত প্যাডেল চাপতে শুরু করল। একবার পিছনে ফিরল না। এ্যাই এ্যাই করে দু বার তাকে আমি ডাকলাম। সে আমাকে পুরোপরি উপেক্ষা করে বিপজ্জনকভাবে একটা বেবি ট্যাক্সিকে ওভারটেক করল। এই রিকশাওয়ালাটা অভিমানী। কে জানে। হয়তো ইতিমধ্যে তার চোখে পানি এসে গেছে।

এই রিকশাওয়ালার সঙ্গে নিশ্চয়ই আরো অনেকবার আমার দেখা হবে কিন্তু তাকে চিনতে পারব না। আমরা রিকশাওয়ালার চেহারা কখনো ভালো করে দেখি না। তাদের পেছনটাই দেখি।

এক জন রিকশাওয়ালা ভাড়া না নিয়ে চলে গিয়েছে এটা এমন কোন বড় ব্যাপার নয়। অনেক রিকশাওয়ালা আমাকে ঠকিয়েছে। ভাংতি হিসেবে অচল নোট দিয়েছে। জোর করে বেশি আদায় করেছে। এক জন তো দল পাকিয়ে আমাকে মারতে পর্যন্ত এসেছিল। সেইভাবে হিসেব করলে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। কিন্তু হচ্ছে না।

এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে ঢাকা শহরে আমার যাবার কোনো জায়গা নেই। বাবার ইউরিন-ভর্তি শিশি পকেটে নিয়ে আমি ঢাকার রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়াব। এই বোধহয় আমার নিয়তি। বাবার পেচ্ছাবের শিশি পকেটে আছে বলেই কি এরকম হচ্ছে? অসম্ভব নয়। সব জিনিসেরই কিছু-না-কিছু আছর আছে। There are many things in heaven and earth….. স্বয়ং শেক্সপিয়ারের কথা। শিশিটা পকেট থেকে ফেলে দিলে কেমন হয়? এটা তো এমন মহামূল্যবান কিছু নয়। কালও জোগাড় করা যেতে পারে। এবং সেটাই বোধহয় ভালো হবে। ফ্রেশ জিনিস নিয়ে ডাক্তারের কাছে পৌঁছে দেব। এমিতেই তো এই বস্তু অনেকক্ষণ পকেটে আছে, বাসি হয়ে যাবার কথা। তবে কে জানে মলমূত্র হয়তো যত বাসি হয় ততই ফ্রেশ হয়।

আমি শিশিটা নর্দমায় ফেলে দিলাম। আশ্চর্য কাণ্ড ফেলে দেবার পরপর মনে হল আমি একটা অন্যায় করেছি। বেচারা বাবা হয়তো অপেক্ষা করে থাকবে।

অল্প সময়ের মধ্যেই অপরাধবোেধ আমাকে কাবু করে ফেলল। এর হাত থেকে বাঁচবার একমাত্র উপায় হচ্ছে কোনো-একটা কাজ করা। অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেওয়া জাতীয় কিছু। কিংবা মার কথামতো নাখালপাড়া চলে যাওয়া। বাবার কাজটি করতে না-পারার অপরাধ মোচন হবে মার কাজটি নিখুঁতভাবে যদি করা যায়।

নাখালপাড়া যাওয়াটা কোনো সমস্যা নয়। গুলিস্তানে গেলেই টেম্পো পাওয়া যাবে। চমৎকার জিনিস। আধুনিক ঢাকার যানবাহনের জগতে বিপ্লব। একের মধ্যে কুড়ি। ইদানীং আবার মহিলারা উঠতে শুরু করেছেন। আগে উঠত মাতারিশ্রেণীর মহিলা। ওদের দেশে-দেখে ভরসা পেয়ে আধুনিকারা উঠতে শুরু করেছেন। এমিতে তাঁদের গায়ের সঙ্গে একটু ছোঁয়া লাগলেই ছাৎ করে ওঠেন। টেম্পোতে অন্য ব্যাপার। গায়ের সঙ্গে গা লেপ্টে থাকে, তবু আধুনিকারা শব্দ করেন না। চোখে চোখ পড়লে বড় বোনসুলত হাসি দেন। মেয়ে যাত্রী যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে মহিলা টেম্পো চালু হবে। এরশাদ সাহেবের মহিলাবিষয়ক কোনো মন্ত্রী এসে শুভ উদ্বোধন করবেন। গলা কাঁপিয়ে একটি ভাষণ দেবেন—এ দেশের নির্যাতিত অবহেলিত নারীজাতির জন্যে আজ একটি ঐতিহাসিক দিন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিনটির কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মহিলাদের স্বাধিকার অর্জনের একটি ধাপ হচ্ছে এই মহিলা টেম্পো। আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা জনগণের চোখের মণি আলহাজ্জ হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ মহিলাদের জন্যে যা করেছেন, তা অতীতে কেউ করেন নি, ভবিষ্যতেও কেউ করবে না। এই যে কুৎসিত যৌতুক প্রথা……

মহিলা বিষয়ক মন্ত্রীর ভাষণ সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে আমি একটি টেম্পোতে উঠে পড়লাম। টেম্পো ছাড়বার সঙ্গে-সঙ্গে রাজনীতি শুরু হয়ে গেল। দেখা গেল প্রাণপ্রিয় নেতার দিন যে শেষ, এই বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। একজন খবর দিল লন্ডনে একটি হোটেল কেনা হয়েছে। নেতা দেশ ছেড়ে দিয়ে সরাসরি হোটেলের ম্যানেজারি শুরু করবেন। সেই হোেটলে উন্নতমানের বাংলাদেশি খাবার সরবরাহ করা হবে।

ঘড়িতে বাজছে বারটা দশ। অনু আপার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে বারটা বেজে যাবে। এটা বেশ ভালোই হল। দুলাভাই নামক প্রাণীটির সঙ্গে দেখা হবে না। তিনি থাকবেন অফিসে। দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে না, এই আনন্দেই টেম্পোযাত্রার কষ্ট সহ্য করা যায়।

আমার দুলাভাই লোকটি অতি ভদ্র। তাঁর আচার-ব্যবহার সবই মোলায়েম। তাঁর সবকিছুই সূক্ষ্ম রুচিবোধ সূক্ষ্ম, বুদ্ধি সূক্ষ্ম, চিন্তা-ভাবনা সূক্ষ্ম এমনকি তার গোঁফ জোড়াটাও সূক্ষ্ম। জোৎস্না দেখবার জন্যে তিনি ছাদে বসে থাকেন। মাসে এক বার গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দেখেন। গ্ৰন্থমেলা থেকে কবিতার বই ছাড়া কিছু কেনেন না। বাসায় রবীন্দ্রনাথের বিরাট ছবি। ২৫শে বৈশাখ এবং ২২শে শ্রাবণ এই দুদিন রবীন্দ্রনাথের ছবিতে মালা দেয়া হয়।

দুলাভাইয়ের তুলনায় অনু আপার সব কিছুই স্থূল ধরনের। বুদ্ধি স্থূল। আচারআচরণও সেই রকম। শরীরও মোটা। অবশ্য মোটাটা ইদানীং হয়েছে। আগে ছিল ছিপছিপে ধরনের। বুদ্ধির অভাব অনু আপা রূপ দিয়ে বহুগুণে পুষিয়ে দিয়েছিল। কাটাকাটা চোখ-মুখ। বইপত্রে কাঁচাহলুদ বর্ণের যে-সব নায়িকাদের কথা থাকে, তাদের সবার চেয়েই অনু আপা সুন্দর। সুন্দরী মেয়েদের বোকা-বোকা কথাও শুনতে ভালো লাগে, এটা বোধহয় সত্যি। অনু আপার মুগ্ধ ভক্ত প্রচুর জুটে গেল। বিরাট যন্ত্রণা! অনু আপা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে গেছে। তাকে নকল সাপ্লাই দেবার জন্যে সঙ্গে গেল এ পাড়ার ছসাত জন ভক্তের একটা জঙ্গীদল। কোন খাতা কার কাছে যাবে, সেই খবরও এক জন নিয়ে এল। এত করেও লাভ হল না। অনু আপা ম্যাট্রিক পাশ করতে পারল না।

তাতে অসুবিধা তেমন হল না।

বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে লোকজন আসতেই লাগল। প্রায় বিকেলেই দেখা যেত বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সেই গাড়ি থেকে মোটা ধরনের গয়নায় মোড়া মহিলারা বের হচ্ছেন। তাঁদের সবার মুখে তেলতেলে একটা ভাব। বাংলাদেশে রূপবতী মেয়েদের যে আকাল যাচ্ছে, তা এই প্রথম আমরা বুঝলাম। প্রফেসর, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্মি অফিসার। কত রকম ঝোলাঝুলি, ধরাধরি। বিশ্রী ব্যাপার।

বাবা খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। অহঙ্কারী-অহঙ্কারী একটা ভাব চলে এল তাঁর মধ্যে। এ রকম রূপবতী একটি কন্যাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন—অহঙ্কার হবারই কথা। তাঁর কথাবার্তার ধরন পর্যন্ত বদলে গেল। পাত্রপক্ষের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলবার সময় তাঁর গলার স্বর কেমন সরু হয়ে যেতে শুরু করল।

আপনাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে ভালো কথা। শুনে সুখী হলাম। আমাদের তো ছেলে পছন্দের একটা ব্যাপার আছে। বংশ দেখতে হবে, আচার-ব্যবহার দেখতে হবে। একটা মেয়েকে জন্মের মতো দিয়ে দেবনা দেখেশুনে দেই কীভাবে?

বাবার দেখাশোনা এবং বাছাবাছি চলতেই লাগল। কাউকে পছন্দ হয়, কথাবার্তা প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে আসে তখন বাবা বললেন, উঁহু, বংশে গণ্ডগোল আছে। সব কিছুর রুট হচ্ছে বংশ। ঐ জায়গায় গণ্ডগোল থাকলে সবই গণ্ডগোল।

আমরা দিন কাটাচ্ছি আতঙ্কের মধ্যে। গুজব রটে গেছে কে নাকি অ্যাসিডের বোতল নিয়ে ঘুরছে। সুযোগমত অনু আপার মুখে ঢালবে। সুযোগ পাচ্ছে না। অনু আপার বন্দিজীবন কাটছে। ঘর থেকে বেরুনো বন্ধ। জানালার পাশে যাওয়া বন্ধ। বারান্দায় দাঁড়ানো বন্ধ। বেচার শুধু কাঁদে আর হয়তো মনে-মনে ভাবে-একটা বিয়ে হোক, ঝামেলা শেষ হোক।

আমার প্রতিভাবান বাবা অনেক দেখেশুনে যে চিজটিকে বের করলেন, তার নাম ইসমাইল হোসেন। শ্রাবণ মাসে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের সাত দিন পর অনু আপা ফিরাযাত্রায় এল। মা জিজ্ঞেস করলেন, বর কেমন রে?

অনু আপা মুখ শুকনো করে বলল, ভালোই। কিন্তু মারধোর করে। মা আকাশ থেকে পড়লেন, মারধোর করে মানে কী সর্বনাশের কথা! মারধোর করবে কেন?

জানি না মা

বাবা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, বেকুব মেয়ে, কী বুঝতে কী বুঝেছে। গায়ে ধাক্কাটাক্কা লেগেছে বোধহয়।

অনু আপা ঠিকই বুঝেছিল। লোকটা অসুস্থ নির্বিকার মারধোর করে। অথচ কথা বলবার সময় কী মিষ্টি-মিষ্টি কথা! হারামজাদা ছোটলোক।

কেমন আছিসরে আপা?

অনু আপা বলল, আমি ভালো আছি, তোর কী হয়েছে? এরকম লাগছে কেন তোকে?

কী রকম লাগছে?

অসুখ অসুখ লাগছে।

আমার শরীর ঠিকই আছে। বাবার অবস্থা কাহিল।

সে কী! কী হয়েছে?

ভয়াবহ কাশি। শতিনেক টাকা থাকলে দে। চলে যাব। সময় নেই।

দিচ্ছি, তুই বোস।

আমি অনু আপার বসার ঘরে বসে রইলাম। অনু আপা অদৃশ্য। এদের বাড়িটা এজমালি। তিন ভাই এবং দুববানের মধ্যে ভাগ হয়ে অনু আপাদের ভাগে দুতলার একটা বড় ঘর, একতলার দুখানা ছোট ঘর এবং দুতলার বারান্দার খানিকটা অংশ পড়েছে। দুতলার বড় ঘরটা দুভাগ করে বসার এবং শোবার ঘর করা হয়েছে। বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা। বিয়ের আগে বলা হয়েছিল সমস্ত বাড়িটাই আমার দুলাভাইয়ের। বাবাকে তারা বাড়ি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখিয়েছে। বাবা আবেগ আল্পত কণ্ঠে আমাদের এসে বলেছেন, রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি! বিরাট খানদানী ব্যাপার।

অনুর কপাল ফিরে গেল।

এই নে বীরু, খা।

অনু আপা প্লেটে করে দুখানা ভাজা ইলিশমাছের ডিম নিয়ে এল।

গরম-গরম ভেজেছি, খেয়ে ফে। টপ করে মুখে ফেলে দে।

টপ করে ফেলা যাবে না, আগুন-গরম। চামুচ আন, ধীরে সুস্থে খাই।

অনু আপা প্লেট নামাবার সঙ্গে-সঙ্গে অন্য হাতে অতি দ্রুত আমার পকেটে টাকা। চালান করে দিল। এর মানে দুলাভাই বাড়িতেই উপস্থিত।

দুলাভাই বাসায়?

হুঁ। অফিসে যায় নি। বীরু, ময়না ভাই, তুই ওকে রাগিয়ে দিস না।

আরে পাগল, আমি রাগাব কেন?

তুই ইচ্ছা করে ওকে রাগাস, পরে খুব যন্ত্ৰণা করে।

যন্ত্ৰণা করলে তুমিও যন্ত্রণা করবে। তোমাকে একটা চড় দিলে তুমি একটা চড। লাগাবে। সে যদি বাঁ পায়ে লাথি বসায় তুমি বসাবে ডান পায়ে। ফ্রিস্টাইল পদ্ধতি।

আস্তে কথা বলতো।

আমি উঠি আপা, অনেক কাজ।

ওর সঙ্গে দেখা না করে চলে যাবি কী যে অদ্ভুত কথাবার্তা তুই বলিস ও রাগ করবে না।

ঠিক আছে, বসছি। পাঠাও দুলাভাইকে। তোমার পুত্র কোথায়।

শাশুড়ির কাছে আছে। নিয়ে আসব?

কোনো দরকার নেই। শিশু জিনিসটাই আমার অসহ্য।

দুলাভাই হাসিমুখে ঢুকলেন। দু-এক দিনের মধ্যে চুল কাটিয়েছেন বলে মনে হল। দেখাচ্ছে অবিকল বানরের মত। যতই দিন যাচ্ছে লোটার চেহারা ততই কুৎসিত হচ্ছে। রহস্যটা কী, কে জানে।

বড় শ্যালক, খবর কি?

খবর ভালোই।

শ্বশুরসাহেবের অসুখ শুনলাম। সিরিয়াস নাকি?

না, সিরিয়াস কিছু না। আপনাকে এমন অদ্ভূত লাগছে কেন দুলাভাই? চুল কেটেছেন নাকি?

হুঁ। বেশি ছোট করে ফেলেছে। খুব খারাপ লাগছে?

লাগছে। বদরের মতো দেখাচ্ছে। দিন সাতেক ঘর থেকে বেরুবেন না। ঘরেই থাকুন। ঘরে বসে কাটলা খান।

কথাগুলো মুখ ফসকেই বলে ফেললাম। দুলাভাই সামনে থাকলে আমার নিজের উপর কোনো কন্ট্রোল থাকে না। কঠিন-কঠিন কথা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলতে থাকি। আজকের ঠাট্টাটা মনে হচ্ছে একটু কড়া হয়ে গেছে। দুলাভাইয়ের মুখ থমথমে। ভাস্যিস অনু আপা সামনে নেই। থাকলে সে কী করত কে জানে। হয়তো কেঁদে-টেদে ফেলত। তবে দুলাভাই ব্যাপারটা ভালোই হজম করলেন। স্বাভাবিকভাবেই বললেন, অসুখের খবর দেবার জন্যে এসেছ, না অন্য কোনো উদ্দেশ্য?

আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে। আপনার কাছে কিছু টাকা হবে দুলাভাই?

কিছু মানে কত?

এই ধরুন হাজার পাঁচ।

মাথা খারাপ হয়েছে? দশ-বিশ হলে দিতে পারি।

বেশ, তাই না হয় দিন।

দুলাভাই বিরস মুখে একটি কুড়ি টাকার নোট বের করলেন। আমি বললাম, উঠি দুলাভাই?

এই বাড়িতে ঢাকা এবং বের হওয়া দুইই বিরক্তিকর। নানান ঘর-দুয়ার পার হতে হয়। অপরিচিত সব মহিলারা সামনে পড়ে যায়। তারা এমনভাবে তাকায়…. বিশেষ করে দুলাভাইয়ের এক বোন মলিনা না ফলিনা কী যেন নাম। আমার সঙ্গে তার অনেক বারই দেখা হয়েছে। দেখা হওয়ামাত্র সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়,ভূ কোঁচকায়। সামনে থেকে বিশ্রী ভঙ্গিতে উঠে চলে যায়। এ রকম ভাবে উঠে যায়, যে নিজিকে খুব ছোট মনে হয়।

আজও বেরুবার সময় মেয়েটিকে দেখলাম। বারন্দায় মোড়ায় বসে আছে, হাতে মোটা একটা বই। আমাকে দেখেই সে বই বন্ধ করে চোখ কুঁচকে ফেলল। যেন মহা বিরক্ত। অনু আপা আমাকে এগিয়ে দিতে আসছিল। আমি উঁচু গলায় বললাম, আপা, তোর শ্বশুরবাড়ির সবার মুখ কেমন যেন লম্বাটে। ছুঁচোর মতো। তোর পুত্রও এ রকম হয়েছে। ব্যাপারটা কি বল তো?

বলেই আমি আর দাঁড়ালাম না। লম্বা-লম্বা পা ফেলতে শুরু করলাম। মনে-মনে আশা করছি ঘাটা ঠিক জায়গায় গিয়ে লাগবে। একবার পিছন ফিরে দেখতে পারলে হত। সাহসে কুলুচ্ছে না।

মাথার উপর রোদ চড়চড় করছে।

কোথায় যাওয়া যায়? ভর-দুপুরে যাবার মতো জায়গা আমার খুব বেশি নেই। শহীদুল্লাহ হলের দিকে যাওয়া যায়। রমিজের কাছে। রমিজ তার নিজের রুমেই রান্না-বান্না করে। ভালোই করে। রুমভৰ্তি রান্না-বান্নার আয়োজন। শিলপাটা পর্যন্ত আছে। একটা কাজের মেয়ে মাঝেমাঝে এসে মশলা পিশে দিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর চমৎকার সব ব্যবহার হচ্ছে। কোনো কোনো রুম ভাড়া দেওয়া হয়েছে বাইরের ব্যাচেলর চাকুরিজীবীদের কাছে। তারা দিব্যি মাসের পর মাস থাকছে। ভাড়া, ছাত্রদের কোনো একটা বিশেষ দলের কাছে চলে যাচ্ছে। সুন্দর সিসেটম!

রাহাজানিছিনতাইয়ের দল তাড়া খেলে ঢুকে পড়ছে হলে। হল হচ্ছে অত্যন্ত পবিত্র জায়গা। এখানে পুলিশ ঢুকবে না। যে-কেউ এখানে কিছু দিন নিশ্চিন্তে থাকতে পারে।

রমিজকে তার ঘরে পাওয়া গেল। আমি বললাম, রান্না কী?

রমিজ বিরক্ত মুখে বলল, ইলিশ-সর্ষে। তুই ঠিক খাওয়ার আগে আগে আসিস কেন বল তো? ভাত সৰ্ট পড়বে।

পড়ুক।

গোসল করবি? গোসল করলে সেরে আয়। খিদেয় প্ৰাণ যাচ্ছে এক্ষুনি ভাত নিয়ে বসব।

হলের গেটের সামনে তুমুল হৈচৈ হচ্ছে। ফট করে একটা ফাঁকা গুলি হল। এক জন হকিষ্টিক নিয়ে দৌড়াচ্ছে। হকিস্টিকের মতো অচল অস্ত্র নিয়ে এই বেকুব কী করছে, কে জানে। আমি বললাম, গোলমাল হচ্ছে কিসের? কোনো সমস্যা আছে? রুম ভাঙাভাঙি হবে?

না, অন্য ব্যাপার। তেমন কিছু না। একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। মালিককে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। আটক আছে। টাকা দিলে ছাড়া হবে।

কোন পার্টি ধরল?

জানি না। জাগ্রত ছাত্ৰ সমাজ হবে। বেচারার অবস্থা কাহিল। হেভি মারধোর হচ্ছে।

স্যাররা আসছেন না।

পাগল হয়েছিস। স্যাররা এখন বেরুবে? সব ঝামেলা মিটলে দু-এক জন উঁকি দেবে। জাগ্রত ছাত্ৰ সমাজকে ধমক দেবে, এমন সাহস কোনো স্যারের নেই। সব ভেড়ুয়া। ঝামেলা লাগলে স্ত্রীর আঁচলের বাতাস খায়।

অ্যাক্সিডেন্টে যে আহত হয়েছে, সে হলের ছাত্র নয়। বাইরের লোক। সে বাড়ি চলে গেছে। গাড়িওয়ালাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। এই ক্ষতিপূরণ কার কাছে যাবে কেউ জানে না।

আমি বন্দিকে এক নজর দেখতে গেলাম। ঠোঁট কেটে বিশ্রী অবস্থায় চোখ রক্তবর্ণ। সে খালিগায়ে শুধুমাত্র একটা আন্ডারওয়ার পরে বসে আছে। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত গলায় বলল, আমি কিছুই করি নি। ফকির কিসিমের একটা লোক লাফ দিয়ে গাড়ির সামনে পড়ে গেছে। আমার অপরাধ কি বুঝলাম না। আর অপরাধ যদি হয়ে থাকে, বিচার হবে। আইন আছে। আদালত আছে।

এক জন ছাত্র এগিয়ে এসে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে কর্কশ গলায় বলল, মানুষ মেরে বড়-বড় কথা। আইন দেখায়।

মানুষ তো মরে নি ভাই।

চুপ থাক।

আপানারা কী করতে চান? মেরে ফেলতে চান?

চুপ থাক শালা। কুড়ি হাজার টাকা ফেল, তারপর কথা। সন্ধ্যার মধ্যে কুড়ি হাজার না পাওয়া গেলে পেট্রল দিয়ে গাড়ি পুড়িয়ে ফেলব। এই, পেট্রল নিয়ে আয়। মানুষ মেরে কথা বলে।

যান, গাড়ি পুড়িয়ে ফেলুন। একটা পয়সা দেব না।

তোর বাপ দেবে।

সাট আপ।

রোগামতো একটি ছেলে এসে আচমকা লোকটিকে একটা ধাক্কা দিল। সে গড়িয়ে পড়ে গেল। আমি সরে এলাম। সময় বদলে যাচ্ছে, এইসব এখন তুচ্ছ মনে হয়। কিছু দিন পর হয়তো দেখব পকেটমার ধরা পড়েছে—তার চোখ তুলে ফেলা হচ্ছে। ছেলেবুড়ো খুব আগ্রহ নিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে। ঘন-ঘন হাততালি পড়ছে। এর নাম সময়। সময়কে গাল দেওয়া যাবে না। তোমরা সময়কে গাল দিও না। আমিই সময়। স্বয়ং আল্লাহু এই কথা বলেছেন। সময়কে কোনো দোষ দেয়া যাবে না।

ভাত খেতে খেতেই বুঝতে পারলাম একটা মিটমাট হয়েছে। লোকটা চলে যাচ্ছে। তাকে একজন কে নিতে এসেছে। লোকা তাঁর কাঁধে ভর দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি ভাবলেশহীন। এক জন ছাত্র বেশ মাইডিয়ার ভঙিতে বলল, গাড়ি ঠিকমতো বুঝে নিন, গাড়িতে টাচ করা হয় নি। যেমন ছিল তেমন আছে। নিন চাবি। এরপর থেকে গাড়ি সাবধানে চালাবেন। পাবলিকের হাতে পড়লে জান শেষ করে দিত। আমরা ধরে নিয়ে এসেছি বলে বেঁচে গেলেন।

লোকটি একটি কথারও জবাব দিচ্ছে না।

রমিজ বলল, সর্ষে-বাটা কেমন লাগছে? ভালো।

পাঁচফোড়ন ছিল না। পাঁচফোড়নের একটু টাচ দিলে দেখতি কী হত।

আমি অবাক হয়ে জিমকে লক্ষ করলাম। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে মোটও স্পর্শ করে নি। সে ঐ প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলছে না।

বীরু।

কী

এশা তোক খুজছিল। খুব নাকি দরকার। আমার কাছে এসে তোর বাসার ঠিকানা চাইল।

বাসার ঠিকানা তো জানে। তোর কাছে আসার দরকার কি?

কীভাবে যেতে হয় জানে না। ডিরেকশন দিয়ে দিলাম। মসজিদের পাশে গলি। বাড়ির সামনে শিউলি গাছ। ঠিক আছে না?

আমাকে খুঁজছে কেন?

জানি না। বোধহয় এইবার প্রেম করতে চায়।

রমিজ গলা টেনে-টেনে হাসছে। এক সময় হাসি থামিয়ে বলল, অন্য কোনো ব্যাপারও হতে পারে। একটু চিন্তিত চিন্তিত মনে হল।

আমি বললাম, এশার কথা থাক। পরীক্ষার ডেট পড়েছে?

হুঁ।

হুঁ মানে? সত্যি পড়েছে?

ইয়েস। সামনের মাসের সাত, আট আর নয়। তোর রোল নম্বর আগের দিকে, তোর সাত তারিখে হয়ে যাবে।

এই খবর এতক্ষণে দিচ্ছিস!

ইম্পৰ্টেন্ট খবর না, কাজেই দিচ্ছি না। ডেট পিছাবে। আবার নতুন ডেট পড়বে। ইতিমধ্যে কোনট-একটা গণ্ডগোল হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তুই নিশ্চিন্ত মনে এশার সঙ্গে চালিয়ে যা। বন্ধু, তুমি এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে।

রমিজ শব্দ করে হাসতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, শুধু শুধু হাসছিস কেন?

হাসি আসছে, কাজেই হাসছি। তোর কাঁদতে ইচ্ছে হলে কাঁদতে পারিস। নো প্রবলেম।

হাত ধোবার সময় দেখলাম হলের প্রভোস্ট সাহেব আসছেন। হাসিহাসি মুখে ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলছেন। ছোটখাটো মানুষ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবিতে চমৎকার লাগছে। আটক করা গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এই আনন্দেই তিনি উল্লসিত। এক জন ছাত্র বলল, মানুষ মেরে পার পেয়ে যাবে, তা তো হয় না স্যার। কী বলেন?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

প্রভোস্ট সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসছেন। তিনি ঝামেলার হাত থেকে বেঁচে গেছেন। এরচেয়ে বড় সুসংবাদ কিছু হতে পারে না। এই সময়ে কেউ ঝামেলা সহ্য করতে পারে না। সবাই চায় ঝামেলাবিহীন দিন। প্রভোস্ট সাহেবের সঙ্গে দু জন চ্যাংড়ামত স্যার। তাঁদের চোখে-মুখে গভীর বিতৃষ্ণা, অথচ হাসিমুখে কথা বলতে চেষ্টা করছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *